Friday, June 20, 2025

যারা অনবরত পেশাব ঝরার সমস্যায় ভুগেন এবং যেসব নারীর ইস্তেহাযার রক্তপাত চলতে থাকে তাদের অযুর পদ্ধতি

 প্রশ্ন: যারা অনবরত পেশাব ঝরার সমস্যায় ভুগেন এবং যেসব নারীর ইস্তেহাযার রক্তপাত চলতে থাকে তাদের অযুর পদ্ধতি কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর যে ব্যক্তি (নারী বা পুরুষ) এমন অপবিত্রতা বা শারীরিক সমস্যায় ভুগে থাকেন যা ক্রমাগত চলতে থাকে যেমন: প্রস্রাব ঝরা রোগ তাকে অনেক ফকীহ (ইসলামী আলেমগণ) ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারীর হুকুমে গণ্য করেন। এ ধরনের ব্যক্তি যতটুকু সম্ভব অপবিত্রতা ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবেন, অসুস্থ ব্যক্তি যদি অনবরত পেশাবের রোগী হয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এর থেকে সুস্থ না হয় তাহলে তার উপর ওয়াজিব প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর শৌচ করা এবং প্রত্যেক নামাযের জন্য অযু করা। তার শরীর ও কাপড়ে যা লেগেছে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। অথবা কষ্ট না হলে নামাযের জন্য একটা পবিত্র কাপড় রেখে দিবে। আর কষ্ট হয়ে গেলে সেটা ক্ষমার্হ। নিজের জন্য সে সতর্কতা অবলম্বন করবে যাতে কাপড়ে, শরীরে অথবা নামাযের স্থানে পেশাব ছড়িয়ে না যায়। সে জন্য সে গোপনাঙ্গের অগ্রভাগে কোন নিরোধক ব্যবহার করবে। সুতরাং এমন ব্যক্তি (নারী পুরুষ) যখন প্রতিটি নামাযের ওয়াক্তে নতুন ভাবে অযু করবেন। সেই অযু দিয়ে তিনি ইচ্ছামতো ফরজ ও নফল নামায আদায় করতে পারবেন। তবে যদি দেখা যায় যে, একটি নামায আদায়ের পর পরবর্তী ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে, অথচ এ সময়ের মধ্যে তার প্রস্রাবের জায়গা থেকে কিছু বের হয়নি, (অর্থাৎ অযু ভঙ্গ হয়নি) তাহলে পুনরায় অযু করার প্রয়োজন নেই পূর্ববর্তী অযুই যথেষ্ট হবে।
.
মূলনীতি হচ্ছে যেহেতু ইসলামি শরীআত আমাদেরকে পেশাব ও যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। তাই এই নির্দেশ ব্যাক্তির ‘সাধ্য অনুযায়ী পালন’-এর নীতির অন্তর্ভুক্ত হয়।এই মূলনীতির দলিল হচ্ছে আল্লাহ তাআলা বলেন:﴿فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ﴾“তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যতটুকু সম্ভব।”(সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬) আর আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بشيء فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কিছু করতে নিষেধ করি, তখন তা পরিহার করো; আর যখন কোনো কিছু করতে আদেশ করি, তখন তা যতটুকু সাধ্য হয়, করো।” (সহিহ বুখারি হা/৭২৮৮,সহিহ মুসলিম হা/১৩৩৭) অতএব উক্ত মূলনীতির আলোকে যে ব্যক্তির অপবিত্রতা স্থায়ী ও চলমান, যেমন: পেশাব-ঝরা রোগী কিংবা অনবরত বায়ু ত্যাগের রোগী, তিনি প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাযের জন্য অযু করবেন। এই অযু দিয়ে তিনি যত রাকাত ইচ্ছা ফরয ও নফল নামায পড়বেন; যতক্ষণ না আরেক নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। দলিল হলো: সহিহ বুখারী ও মুসলিমে আছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আমি ইস্তেহাযাগ্রস্ত হই। তারপর আর পবিত্র হই না। আমি কি নামায ছেড়ে দিব?” তিনি বললেন: সেটি শিরা (থেকে রক্তক্ষরণ); হায়েযের স্রাব নয়। যখন তোমার হায়েযের স্রাব শুরু হবে তখন নামায পড়বে না। যখন হায়েযের স্রাব থেমে যাবে তখন তুমি রক্ত ধৌত করবে এবং নামায পড়বে। এরপর প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্ত এলে সেটির জন্য অযু করবে।”(সহীহ বুখারী হা/২২৬; সহীহ মুসলিম হা/৩৩৩) কিন্তু যদি জানা যায় যে তার পেশাব একটা সময়ে থেমে থাকে যে সময়টুকু পবিত্রতা অর্জন করা ও নামায আদায় করার জন্য যথেষ্ট তাহলে ঐ সময় পর্যন্ত দেরী করা তার উপর আবশ্যক।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
“المصاب بسلس البول له حالان:
الأولى: إذا كان مستمرّاً عنده بحيث لا يتوقف، فكلما تجمَّع شيء بالمثانة نزل: فهذا يتوضأ إذا دخل الوقت ويتحفظ بشيء على فرجه، ويصلِّي ولا يضرُّه ما خرج.
الثانية: إذا كان يتوقف بعد بوله ولو بعد عشر دقائق أو ربع ساعة: فهذا ينتظر حتى يتوقف ثم يتوضأ ويصلِّي، ولو فاتته صلاة الجماعة”
“পেশাব-ঝরা রোগীর দুই অবস্থা:
ক. যদি তার পেশাব এমনভাবে চলমান থাকে যে থামে না, মূত্রাশয়ে কিছু জমলেই নেমে যায়: এমন ব্যক্তি ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর অযু করবে, কিছু একটা দিয়ে (যেমন ডায়াপার, ন্যাকড়া) তার লজ্জাস্থানকে আবদ্ধ করে রাখবে, তারপর সে নামায পড়বে। এর মধ্যে যা বের হবে এতে তার নামাযের কোনো ক্ষতি হবে না।
খ. যদি পেশাব করার পর পেশাব-ঝরা থেকে যায়; এমন কি সেটা দশ মিনিট অথবা পনের মিনিট পরে হলেও: এমন ব্যক্তি পেশাব থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর অযু করে নামায পড়বে, এমনকি এতে করে তার জামাতের সাথে নামায আদায় ছুটে গেলেও।”(ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, প্রশ্ন-১৭, পর্ব: ৬৭)
.
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
فمن لم يمكنه حفظ الطهارة مقدار الصلاة ، فإنه يتوضأ ويصلي ، ولا يضره ما خرج منه في الصلاة، ولا ينتقض وضوؤه بذلك باتفاق الأئمة، وأكثر ما عليه أن يتوضأ لكل صلاة ” ا
“যে ব্যক্তি নামাযের সময়কাল পর্যন্ত পবিত্রতা ধরে রাখতে সক্ষম নয়, সে (প্রত্যেক নামাযের সময়) ওজু করবে এবং নামায আদায় করবে। নামাযের মাঝে তার শরীর থেকে কিছু নিঃসরণ হলেও তাতে তার কোনো ক্ষতি নেই এবং এর মাধ্যমে তার ওজু ভঙ্গ হবে না এ বিষয়ে ইমামগণের ঐক্যমত রয়েছে। তার জন্য সর্বোচ্চ করণীয় হলো প্রত্যেক নামাযের সময় নতুন করে ওজু করা।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ২২১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:
(المريض المصاب بسلس البول ولم يبرأ بمعالجته عليه أن يتوضأ لكل صلاة بعد دخول وقتها، ويغسل ما يصيب بدنه، ويجعل للصلاة ثوبا طاهرا إن لم يشق عليه ذلك، وإلا عفي عنه لقول الله تعالى: (وما جعل عليكم في الدين من حرج) وقوله: (يريد الله بكم اليسر ولا يريد بكم العسر)، وقوله صلى الله عليه وسلم: (إذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم) ويحتاط لنفسه احتياطا يمنع انتشار البول في ثوبه أو جسمه أو مكان صلاته)
‘পেশাব-ঝরা রোগে আক্রান্ত যে রোগী চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেননি, তিনি প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশের পর অযু করবেন। তার শরীরে যা লেগেছে তা ধুয়ে ফেলবেন। যদি তার জন্য কষ্টকর না হয় তাহলে নামাযের জন্য পবিত্র কাপড় রাখবেন। আর যদি কষ্টকর হয় তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ তোমাদের জন্য দ্বীনে কোনো রূপ সংকীর্ণতা রাখেননি।” তিনি আরো বলেন: “আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, তোমাদের জন্য কঠিন চান না।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমি যখন তোমাদেরকে কোনো নির্দেশ প্রদান করবো তখন তোমরা সাধ্যমত তা করার চেষ্টা করবে।” তারপর সে নিজের জন্য এমন কোন সতর্ক উপায় অবলম্বন করবেন যা তার কাপড়ে, পোশাকে অথবা নামায পড়ার স্থানে পেশাব ছড়াতে বাধা দিবে।’(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৯২)
.
▪️ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারীর পবিত্রতা:
.
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ফিকহবিদদের দৃষ্টিতে পেশাব-ঝরা রোগী ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারীর হুকুমে গণ্য হন। তবে ইস্তিহাযা কিংবা অনুরূপ ধরণের স্থায়ী অপবিত্রতা-সংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির পবিত্রতা সংক্রান্ত বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাঁরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন যে, এমন রোগীর পবিত্রতা কি ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বাতিল হয়ে যায়,নাকি পরবর্তী নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর তা বাতিল হয়? এই মতভেদের বাস্তব প্রভাব দেখা যায়, যেমন: কেউ যদি ফজরের নামাযের জন্য অযু করে, তবে সে কি ঐ একই অযু দিয়ে চাশত বা দুই ঈদের নামায আদায় করতে পারবে, নাকি চাশত বা দুই ঈদের সালাত আদায়ের জন্য নতুন করে অযু করতে হবে? যারা বলেন: ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেলে ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারীর পবিত্রতা বাতিল হয়ে যায়, তারা এভাবে করা থেকে বারণ করবেন। যেহেতু সূর্যোদয়ের মাধ্যমে তার পবিত্রতা শেষ হয়ে গিয়েছে। আবার যারা বলেন: আরেক নামাযের ওয়াক্ত শুরু হলে তার পবিত্রতা বাতিল হয়, তারা তার জন্য ফজরের অযু দিয়ে চাশত ও দুই ঈদের নামায পড়াকে জায়েয বলেন। কারণ যোহরের ওয়াক্ত প্রবেশ করা পর্যন্ত তার পবিত্রতা বলবৎ থাকে। উভয় মত ইমাম আহমদের মাযহাবে রয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য মাযহাবেও রয়েছে।(আল ইনসাফ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৭৮; আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২১২) তবে নিরাপদ হলো চাশত ও দুই ঈদের নামাযের জন্য নতুন করে অযু করা। শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ এই ফাতওয়া দিয়েছেন।
.
ইমাম বুহূতী (রাহিমাহুল্লাহ) আর-রাওদুর মুরবি গ্রন্থে বলেন: (والمستحاضة ونحوها) ممن به سلس بول أو مذي أو ريح … (تتوضأ لـ) دخول (وقت كل صلاة) إن خرج شيء (وتصلي) ما دام الوقت (فروضا ونوافل)، فإن لم يخرج شيء لم يجب الوضوء“ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারী এবং তার অনুরূপ যাদের অনবরত পেশাব ঝরে, অনবরত কামরস বের হয় কিংবা বায়ু নির্গত হয় … তারা প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করলে অযু করবে, যদি কোনো কিছু বের হয়। আর যতক্ষণ ওয়াক্ত আছে ততক্ষণ ফরয ও নফল নামায পড়বে। আর যদি কোনো কিছু বের না হয় তাহলে অযু করা ওয়াজিব হবে না।”(আর-রাওদুর মুরবি; পৃষ্ঠা: ৫৭)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:يجب على المستحاضة أن تتوضأ لوقت كل صلاة إن خرج شيء، فإن لم يخرج منها شيء بقيت على وضوئها الأول”ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারীকে প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্তে অযু করতে হবে, যদি কোনো কিছু বের হয়। যদি কোনো কিছু বের না হয়, তাহলে প্রথম অযুর উপরই সে বলবৎ আছে।(ইবনু উসাইমীন; আশ-শারহুল মুমতি; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৩৮)
.
অতএব, ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারী প্রত্যেক সালাতের সময় যোনিপথ পরিষ্কার করবে, অর্থাৎ যোনিপথ থেকে নিঃসৃত অপবিত্রতা দূর করবে। এরপর বাহিরে যেন রক্ত প্রবাহিত না হয় বা গড়িয়ে না পড়ে এ জন্য যোনিপথের মুখে তুলা বা অনুরূপ কোনো উপযোগী বস্তু স্থাপন করবে এবং সেটিকে ভালোভাবে বেঁধে রাখবে যাতে তা সরে না যায়। এরপর সালাতের সময় উপস্থিত হলে সে ওযু করবে এবং নামাজ আদায় করবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুস্তাহাযা নারীর ক্ষেত্রে বলেন:تدع الصلاة أيام أقرائها، ثم تغتسل وتتوضأ عند كل صلاة“মুস্তাহাযাহ নারী তার হায়েযের দিনগুলোয় সালাত ত্যাগ করবে, অতঃপর গোসল করবে ও প্রত্যেক সালাতের জন্য ওযু করবে”।(তিরমিযি হা/১২৬; আবু দাউদ হা/২৯৭) অপর বর্ননায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:أنعت لك الكرسف تحشين به المكان“তুমি নিজের জন্য কুরসুফ (সুতি কাপড়) বানিয়ে নাও এবং তার দ্বারা স্থানটি ঢেকে নাও”(তিরমিযি হা/১২৮; আবু দাউদ হা/২৮৭) ডাক্তারি গবেষণায় তৈরি ন্যাপকিন ব্যবহার করাও বৈধ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

অসুস্থ ব্যক্তি কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে

 প্রশ্ন: অসুস্থ ব্যক্তি (নারী-পুরুষ) কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর রোগীর জন্য শরীআতে কিছু বিশেষ বিধান রয়েছে,রোগীর কতক বিধান রয়েছে যা তার সাথেই খাস। কারণ সে যে অবস্থা অতিক্রম করে শরী‘আত সে মোতাবেক তাকে বিধান দিয়েছে। বস্তুত মহান আল্লাহ তার রাসূল (ﷺ)-কে সহজ, সরল ও একনিষ্ঠ দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন: “তিনি তোমাদের ওপর দ্বীনের ব্যাপারে কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি।”(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৭৮) আরেক স্থানে বলেন:“আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠিনতা চান না।”(সূরা আল বাক্বারাহ: ১৮৫) আরও বলেন:“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যতটুকু সম্ভব হয়, শ্রবণ কর এবং আনুগত্য কর।”(সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬) ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“নিশ্চয় দ্বীন সহজ।”(সহীহ বুখারী হা/৩৯) ইমাম ইবনু হিব্বান (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“যখন আমি তোমাদের কোনো আদেশ প্রদান করি, তখন তোমরা তা পালন কর যতটুকু তোমাদের সামর্থ্য হয়।”(ইবনু হিব্বান হা/৩৭০৪) এই মৌলিক নীতিমালাগুলোর ভিত্তিতে আল্লাহ তা‘আলা রোগীর জন্য তার ইবাদতের ক্ষেত্রে সহজতা প্রদান করেছেন, যাতে সে কষ্ট বা অসুবিধা ছাড়া ইবাদত সম্পাদন করতে পারে অতএব সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক রাব্বুল আলামীনের জন্য।
.
এক নজরে অসুস্থ ব্যক্তির পবিত্রতা অর্জনের মৌলিক নীতিমালা:
(১)- অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সুস্থ ব্যক্তির মতো করেই বড় অপবিত্রতা ও ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করা আবশ্যক। সে ছোট অপবিত্রতা থেকে অযু করবেন এবং বড় অপবিত্রতা থেকে গোসল করবেন।
.
(২)- অসুস্থ ব্যক্তি যদি পেশাব বা পায়খানা করে থাকেন তাহলে অযু করার আগে অবশ্যই পানি ব্যবহার করে কিংবা পাথর বা পাথরের স্থলাভিষিক্ত কিছু দিয়ে ঢিলা-কুলুখ করবেন। পাথর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই তিনটি পবিত্র পাথর দিয়ে ঢিলা করবেন। গোবর, হাড়, খাবার বা সম্মানিত কোনো বস্তু ঢিলা হিসেবে ব্যবহার করা জায়েয নেই। পাথর বা অনুরূপ বস্তু দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম; যেমন: টিস্যু পেপার ও এ জাতীয় অন্য কিছু। এরপর পানি ব্যবহার করবে। কারণ পাথর নাপাকির কাঠামোকে দূর করে। আর পানি স্থানকে পরিষ্কার করে। এতে করে ভালোভাবে পাক হবে। ব্যক্তির জন্য পানি, পাথর বা অনুরূপ যে কোনো বস্তু দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের স্বাধীনতা রয়েছে। যদি কেউ পানি বা পাথরের মধ্যে কোন একটায় সীমিত থাকতে চায়, তাহলে পানিই উত্তম। কারণ পানি স্থানকে পবিত্র করে, নাপাকির কাঠামো ও চিহ্নকে দূর করে দেয়। তাই এটি পরিষ্কারকরণে অধিক কার্যকরী। আর যদি পাথর ব্যবহারে সীমিত থাকে, তাহলে তিনটি পাথরের ব্যবহারে স্থানটি নির্মল হলে তিনটিই যথেষ্ট হবে। আর যদি নির্মল না হয়, তাহলে চতুর্থ ও পঞ্চমটি বৃদ্ধি করবে, যতক্ষণ না স্থানটি নির্মল হয়। উত্তম হলো বেজোড় সংখ্যায় শেষ করা। ডানহাতে পাথর ব্যবহার করে ঢিলা করা জায়েয নেই। যদি বামহাত কাটা থাকে অথবা ভেঙে যায় অথবা রোগ বা অনুরূপ কিছু থাকে, তাহলে প্রয়োজনের খাতিরে ডান হাত দিয়ে ঢিলা করবে; এতে গুনাহ হবে না।
.
(৩)- অসুস্থ ব্যক্তি অক্ষমতা বা রোগ বৃদ্ধির ভয় বা সুস্থ হতে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কায় পানি দিয়ে অযু করতে না পারেন তাহলে তায়াম্মুম করবেন। তায়াম্মুমের বিশুদ্ধ পদ্ধতি হলো: প্রথমে তায়াম্মুমের নিয়ত করে বিসমিল্লাহ্‌ পড়া। এরপর ভূপৃষ্ঠের উপর দুই হাতের তালু একবার নিক্ষেপ করা। এরপর বাম হাতের তালু দিয়ে ডানহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করা এবং ডান হাতের তালু দিয়ে বামহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করা। এরপর দুই হাত দিয়ে চেহারা মাসেহ করা। ওজুর পর যে যে যিকিরগুলো পড়া হয় তায়াম্মুমের শেষেও সে দোয়াগুলো পড়া।”(সহীহ বুখারী খণ্ড-১,পৃষ্ঠা: ৪৫৫ হা/৩৪৭; ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ৪২৫; ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৫৭) জেনে রাখুন এমন প্রত্যেক বস্তু দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েয যাতে ধুলা রয়েছে, এমনকি যদি সেটা ভূপৃষ্ঠ নয় এমন কিছুর উপরেও থাকে। যেমন যদি দেয়াল বা অনুরূপ কিছু থেকে ধুলা উড়ে তাহলে এটি দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েয হবে। আর যদি প্রথম তায়াম্মুমের পবিত্রতা বজায় থাকে তাহলে এই পবিত্রতা দিয়ে ওযুর মত সে কয়েক ওয়াক্তের নামায পড়তে পারবে। তাকে তায়াম্মুম নবায়ন করতে হবে না। যেহেতু এটি পানির বদলি। বিকল্প বস্তুর হুকুম মূল বস্তুর অনুরূপ। অযু বিনষ্ট করে এমন সকল কিছু তায়াম্মুম বিনষ্ট করে। আর পানি না থাকার পর উপস্থিত হলে কিংবা পানি ব্যবহারে অক্ষমতা থাকার পরে সক্ষমতা অর্জিত হলে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে।
.
(৪)- অসুস্থতা যদি কম হয় যার কারণে পানি ব্যবহার করলে শারীরিক ক্ষতি, ভয়াবহ রোগ, সুস্থতায় বিলম্ব, ব্যথা বৃদ্ধি বা বড় কিছু ঘটার আশঙ্কা না থাকে, যেমন: মাথাব্যথা, দাঁত ব্যথা প্রভৃতি অথবা যদি গরম পানি ব্যবহার করলে কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয হবে না। কারণ তায়াম্মুমের বৈধতা ক্ষতি দূর করার জন্য। এ অবস্থায় তার কোনো ক্ষতি নেই এবং তার কাছে পানি আছে। তাই তার উপর পানি ব্যবহার করা ওয়াজিব।
.
(৫)- অসুস্থ ব্যক্তির জন্য যদি অযু করতে অথবা নিজে নিজে তায়াম্মুম করতে কষ্ট হয়, তাহলে অন্য কেউ তাকে অযু অথবা তায়াম্মুম করাবেন এবং সেটি তার জন্য যথেষ্ট।
.
(৬)- যার কোনো ধরনের ক্ষত, আঘাত, ভাঙন বা এমন কোন রোগ আছে যে পানি ব্যবহার করলে তার ক্ষতি হয়, সে যদি জুনুবী হয় (বড় অপবিত্র হয়), তখন তার জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয। যদি তার জন্য শরীরের সুস্থ কোনো অংশ ধৌত করা সম্ভবপর হয়, তাহলে সে অংশ ধৌত করবে, আর বাকি অংশের জন্য তায়াম্মুম করবে।
.
(৭)- যার পবিত্রতা অর্জনের কোনো অঙ্গে জখম আছে সে পানি দিয়ে সেটি ধৌত করবে। যদি ধোয়া তার জন্য কষ্টকর হয় কিংবা ক্ষতিকর হয় তাহলে জখমযুক্ত অঙ্গটি ধোয়ার পালা যখন আসবে তখন পানি দিয়ে সেটি মাসেহ করবে। যদি পানি দিয়ে মাসেহ করা কষ্টকর হয় অথবা করলে ক্ষতি হয় তাহলে তায়াম্মুম করবে এবং তার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে।
.
(৮)- প্লাস্টার করা ব্যক্তি: তিনি এমন ব্যক্তি যার কোন অঙ্গে ভাঙ্গনের কারণে অঙ্গটি কাপড় বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে মোড়ানো, এমন ব্যক্তি পানি দিয়ে মাসেহ করবেন। এটাই তার জন্য যথেষ্ট। এমনকি যদি পবিত্র অবস্থায় প্লাস্টার করা না হয় তদুপরি।
.
(৯)- অসুস্থ ব্যক্তি নামায পড়তে চাইলে তার উচিত শরীর, জামা-কাপড় ও নামাযের স্থানকে নাপাকি থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হওয়া। সে যদি না পারে তাহলে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই নামায পড়বে। এতে কোনো গুনাহ হবে না।
.
(১০)- অসুস্থ ব্যক্তি যদি অনবরত পেশাবের রোগী হয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এর থেকে সুস্থ না হয় তাহলে তার উপর ওয়াজিব প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর শৌচ করা এবং প্রত্যেক নামাযের জন্য অযু করা। তার শরীর ও কাপড়ে যা লেগেছে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। অথবা কষ্ট না হলে নামাযের জন্য একটা পবিত্র কাপড় রেখে দিবে। আর কষ্ট হয়ে গেলে সেটা ক্ষমার্হ। নিজের জন্য সে সতর্কতা অবলম্বন করবে যাতে কাপড়ে, শরীরে অথবা নামাযের স্থানে পেশাব ছড়িয়ে না যায়। সে জন্য সে গোপনাঙ্গের অগ্রভাগে কোন নিরোধক ব্যবহার করবে। আল্লাহই তৌফিকদাতা। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবীদের উপর।(পুরো ১০ টি পয়েন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন; ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ লিল-বুহূসিল ইলমিয়্যা ওয়াল-ইফতা; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৪০৫; শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, শাইখ আব্দুল আযীয আলুশ শাইখ, শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে গুদাইয়্যান, শাইখ সালেহ আল-ফাউযান এবং শাইখ বকর আবু যাইদ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৫৩৫৬)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

গোসল সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: গোসলের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, শর্তাবলী, কোন কোন কারণে গোসল করা ওয়াজিব হয়, গোসলের সঠিক নিয়ম কী, এবং গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ কী কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর গোসলের আভিধানিক অর্থ ধৌত করা বা ধোয়া। পারিভাষিক অর্থ ইবাদতের নিয়তে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পবিত্র পানি দ্বারা সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করাকে গোসল বলা হয়। গোসল দুই ধরণের হতে পারে: ন্যূনতম বা জায়েয পদ্ধতি এবং পরিপূর্ণ পদ্ধতি।
.
জায়েয পদ্ধতিতে মানুষ শুধু ফরযগুলো আদায় করে ক্ষান্ত হয়; সুন্নত ও মুস্তাহাব আদায় করে না। সে পদ্ধতিটি হচ্ছে: পবিত্রতার নিয়ত করবে। এরপর গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেওয়ার সাথে গোটা দেহে পানি ঢালবে; সেটা যেভাবে হোক না কেন; শাওয়ারের নীচে, সমুদ্রে নেমে, বাথটাবে নেমে ইত্যাদি। অপরদিকে গোসলের পরিপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে গোসল করেছেন সেভাবে গোসলের সকল সুন্নত আদায় করে গোসল করা।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে গোসলের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন: গোসল করার পদ্ধতি দুইটি:
প্রথম পদ্ধতি: ফরয পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে গোটা দেহে পানি ঢালা। এর মধ্যে গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেয়াও রয়েছে। সুতরাং কেউ যদি যে কোনভাবে তার গোটা দেহে পানি পৌঁছাতে পারে তাহলে সে বড় অপবিত্রতা মুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে যাবে। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেছেন: “যদি তোমরা জুনুবি হও তাহলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬]।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: পরিপূর্ণ পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে গোসল করতেন সেভাবে গোসল করা। যে ব্যক্তি জানাবাত (অপবিত্রতা) থেকে গোসল করতে চায় তিনি তার হাতের কব্জিদ্বয় ধৌত করবেন। এরপর লজ্জাস্থান ও লজ্জাস্থানে যা লেগে আছে সেসব ধৌত করবেন। এরপর পরিপূর্ণ ওযু করবেন। এরপর মাথার উপর তিনবার পানি ঢালবেন। এরপর শরীরের অবশিষ্টাংশ ধৌত করবেন। এটাই হচ্ছে পরিপূর্ণ গোসলের পদ্ধতি।(ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম থেকে সমাপ্ত, পৃষ্ঠা-২৪৮)
.
❑.যে সকল কারণে গোসল করা ওয়াজিব:
______________________________________
সর্বমোট তিনটি কারনে গোসল ওয়াজিব হয়:
(১) যৌন উত্তেজনার সাথে বীর্য নির্গত হওয়া: এমনকি সেটা যদি যৌনাঙ্গদ্বয় একত্রিত হওয়া ব্যতিরেকে হাত দিয়ে সম্ভোগ করার কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও গোসল ফরজ হবে।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا ‘আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও।'(সূরা মায়েদা: ৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “পানির কারণে পানি অপরিহার্য।”(সহিহ মুসলিম হা/১৫১)। অপর বর্ননায় আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন-অর্থাৎ আমার প্রায়ই মযী নির্গত হ’ত এবং আমি গোসল করতাম। এমনকি এ কারণে আমার পৃষ্ঠদেশে ব্যথা অনুভব করতাম। অতঃপর আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পেশ করি অথবা অন্য কারো দ্বারা পেশ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তুমি এরূপ করবে না। বরং যখনই তুমি মযী দেখবে তখন তোমার পুরুষাঙ্গ ধৌত করবে এবং সালাত আদায়ের জন্য ওযু করবে। অবশ্য যদি কোন সময় উত্তেজনা বশতঃ বীর্য নির্গত হয় তবে গোসল করবে’।(আবু দাউদ হা/২০৬) অতএব জাগ্রত অবস্থায় অসুস্থতার কারণে যৌন উত্তেজনা ছাড়াই বীর্যপাত হলে তার উপর গোসল ওয়াজিব নয়।(ইবনু উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, ১/৩৩৪)।অর্থাৎ সে ব্যক্তি শুধুমাত্র লজ্জস্থান ধৌত করবে এবং যে পোষাকে বীর্য লেগেছে তা পরিবর্তন করে নতুনভাবে ওযু করে সালাত আদায় করবে।পক্ষান্তরে ঘুমন্ত অবস্থায় বীর্যপাত হলেই গোসল ওয়াজিব হবে।এক্ষেত্রে গোসল ওয়াজিব হওয়ার জন্য যৌন উত্তেজনা শর্ত নয়।(দেখুন সহীহ বুখারী: ১৩০; সহীহ মুসলিম: ৩১৩; আর লুলু ওয়াল মারজান: ১৮০)। অতএব স্বপ্নের কিছু বুঝতে পারুক বা না পারুক, ঘুম থেকে জেগে বীর্য দেখলেই তার উপর গোসল ওয়াজিব।
.
(২).খতনার স্থানদ্বয় তথা যৌনাঙ্গদ্বয় একত্রিত হওয়া। অর্থাৎ পুরুষাঙ্গের খাতনার স্থান পর্যন্ত স্ত্রীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ-করানো সংঘটিত হওয়া। বীর্য নির্গত হোক বা না হোক গোসল ওয়াজিব হবে এটাই সঙ্গম বা সহবাস। বীর্যপাত হওয়া শর্ত নয়। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যদি খতনার স্থানদ্বয় মিলিত হয় এবং পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ ভিতরে ডুবে যায় তাহলে বীর্যপাত হোক বা না-হোক গোসল ফরজ হবে।”(সুনানে আবু দাউদ, সহিহ আবু দাউদ হা/২০৯) অপর বর্ননায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যখন তোমাদের কেউ স্ত্রীলোকের চার শাখার (দুই হাত দুই পা) মাঝখানে বসে সঙ্গমে রত হয় তখন তার উপর গোসল করা ফরজ হয়ে যায়,যদিও বীর্যপাত না হয়।(সহীহ মুসলিম: ৩৪৮; বুখারী: ৩৪৮; মিশকাত: ৪৩০)
.
(৩) মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার উপর গোসল ওয়াজিব। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত;এক ব্যক্তি আরাফাতে অবস্থানরত অবস্থায় আকস্মাৎ তার উটনী হ’তে পড়ে যায় এতে তার ঘাড় মটকে গেল অথবা রাবী বলেছেন, ঘাড় মটকে দিল (যাতে সে মারা গেল)। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে কুলপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করাও,তার পরিধেয় বস্ত্র দু‘টি দিয়ে তার কাফন দাও,কিন্তু তার মুখমণ্ডল ও মাথা অনাবৃত রাখ। কারণ তাকে কিয়ামাতের দিন তালবিয়াহ্ পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।সহিহ মুসলিম হা/২৭৮৬)।উল্লিখিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার উপর গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে যুদ্ধে শহীদ হওয়া ব্যক্তির উপর গোসল ওয়াজিব নয়।(দেখুন সহীহ বুখারী ১৩৪৩; ইবনু মাজাহ্ ১৫১৪; ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৬৭৫৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৬৯২৫; মিশকাত হা/১৬৬৫)
.
❑ পবিত্রতা অর্জনের গোসলের সঠিক নিয়ম:
_______________________________________
গোসলের পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি হচ্ছে:
(১)। বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার নিয়ত করবে। সেটা জানাবাত হোক, হায়েয হোক কিংবা নিফাস।
(২)। এরপর বিসমিল্লাহ বলবে। দুই হাত তিনবার ধৌত করবে। লজ্জাস্থানের ময়লা ধৌত করবে।
(৩)। তারপর নামাযের ওযু করার ন্যায় পরিপূর্ণ ওযু করবে।
(৪)। এরপর মাথার উপর তিনবার পানি ঢালবে। চুল ঘষা দিবে যাতে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছে।
(৫)। অতঃপর সারা শরীরে পানি ঢালবে ও ধৌত করবে। ডানপার্শ্ব দিয়ে শুরু করবে। এরপর বামপার্শ্ব ধৌত করবে। সারা শরীরে যেন পানি পৌঁছে সেজন্য হাত দিয়ে ঘষামাজা করবে।
.
মহিলাদের গোসলও পুরুষদের অনুরুপ। অবশ্য মহিলার মাথার চুলে বেণী বাঁধা (চুটি গাঁথা) থাকলে তা খোলা জরুরী নয়। তবে ৩ বার পানি নিয়ে চুলের গোড়া অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে।(দেখুন সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/৪৩৮)।নখ নখপালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত গোসল হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় গোসল হয়ে যাবে। কপালে টিপ থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ গোসল হবে না। বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও মাসিকের গোসল, অথবা মাসিক ও ঈদ, অথবা বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও জুমআ বা ঈদের গোসল নিয়ত হলে একবারই যথেষ্ট। পৃথক পৃথক গোসলের দরকার নেই।(ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু পৃষ্ঠা: ৬০)। গোসলের পর নামাযের জন্য আর পৃথক ওযুর প্রয়োজন নেই। গোসলের পর ওযু ভাঙ্গার কোন কাজ না করলে গোসলের ওযুতেই নামায হয়ে যাবে।(আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/৪৪৫) রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় নামায মাফ নয়। (আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/ ৫৬০-৫৬১)। সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। নচেৎ অনেকের মতে কুল্লি না করলে এবং নাকে পানি না নিলে গোসলই শুদ্ধ হবে না।(ইবনু উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতি খন্ড:১; পৃষ্ঠা: ৩০৪)। গোসলের উপরোক্ত মুস্তাহাব পদ্ধতির দলিল হচ্ছে-আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবাতের (অপবিত্রতার) গোসল করতেন তখন তিনি তাঁর হাত দুইটি ধৌত করতেন, নামাযের ওযুর ন্যায় ওযু করতেন। এরপর গোসল করতেন। হাত দিয়ে চুল খিলাল করতেন; যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি মনে করতেন যে, চামড়া ভিজেছে। তিনি মাথার উপর তিনবার পানি ঢালতেন। এরপর সারা শরীর ধৌত করতেন।”(সহিহ বুখারী হা/২৪৮;ও সহিহ মুসলিম (৩১৬) অপর বর্ননায় আয়েশা (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবাতের গোসল করতে চাইতেন তখন তিনি একটি পাত্র আনতে বলতেন; যেমন- হিলাব (উটের দুধ দোহনের পাত্র।) তিনি হাত দিয়ে পানি নিতেন। ডান পার্শ্ব থেকে গোসল শুরু করতেন। এরপর বামপার্শ্ব। এরপর দুই হাতে পানি নিয়ে মাথার উপর পানি ঢালতেন।”(সহিহ বুখারী হা/২৫৮; সহিহ মুসলিম হা/৩১৮)
.
❑ যে সকল কারণে গোসল করা সুন্নাত:
___________________________________
▪️(ক) সহবাসের পরে পুনরায় সহবাসে লিপ্ত হ’তে চাইলে ওযু গোসল করা সুন্নাহ করা।।(মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৩৫০; আবূ দাঊদ হা/২১৯; মিশকাত হা/৪৭০)
▪️(খ) জুম‘আর সালাতের জন্য গোসল করা সুন্নতনা (সহীহ বুখারী হা/৮৭৭; সহীহ মুসলিম হা/৮৪৪)
▪️(গ) দুই ঈদের দিনে গোসল করা সুন্নত।(সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, হা/৬৩৪৩; ইরওয়া হা/১৪৬)
▪️(ঘ) হজ্জ ও ওমরার ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করা সুন্নত।(সুনানে তিরমিয়ী হা/৮৩০; বুলুগুল মারাম হা/৭৩০)
▪️(ঙ) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার পরে নিজেও গোসল করা সুন্নত।(মুসনাদে আহমাদ হা/ ৯৮৬২; আবূ দাঊদ হা/৩১৬১; তিরমিযী হা/৯৯৩; ইবনু মাজা হা/১৪৬৩)
▪️(চ) কোন অমুসলিম ইসলাম গ্রহন করলে গোসল করা সুন্নত।(আবু দাউদ হা/৩৫৫; মিশকাত হা/৫৪৩)
.
❑ গোসল সহীহ হওয়ার শর্তগুলো কি কি?
_____________________________
গোসল সহিহ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে। যদি এ শর্তগুলো পূরণ না হয় তাহলে গোসল বাতিল হয়ে যাবে। শর্তগুলো হচ্ছে:
.
প্রথম শর্ত হচ্ছে নিয়ত: রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক আমল নিয়ত অনুযায়ী (ধর্তব্য) হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সেটাই তার প্রাপ্য।”(সহিহ বুখারী হা/১; ও সহিহ মুসলিম হা/১৯০৭)। তাই তার গোসলের শুরুতে এ গোসলের মাধ্যমে জানাবাত (অপবিত্রতা) উত্তোলন করার নিয়ত করতে হবে। সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আমি পবিত্র অব্স্থায় গোসল করেছি বিধায় বড় অপবিত্রতা দূর করার নিয়ত করিনি। গোসল করার শেষে আমার মনে পড়ল যে, গোসল করার আগে আমি জুনুব (অপবিত্র) ছিলাম। তাই আমার উপর কি পুনরায় গোসল করা আবশ্যকীয়; নাকি আমি ঐ গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা লাভ করেছি? জবাবে তারা বলেন: যদি আপনি পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও ঠাণ্ডা লাভের নিয়তে গোসল করে থাকেন তাহলে আপনার উপর আবশ্যক পুনরায় বড় পবিত্রতা উত্তোলন করার নিয়তে গোসল করা। কেননা আপনি প্রথম গোসলের মাধ্যমে নিয়ত করেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমলগুলো নিয়ত দ্বারা হয়ে থাকে”।(ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৩৩)
.
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে গোসলের পানি পবিত্র হওয়া: ইবনে আব্দুল বার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: পানি হয়তো নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হবে কিংবা অন্য কিছু দ্বারা পরিবর্তিত হবে। যদি নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হয় তাহলে আলেমগণ ইজমা করেছেন যে, সেই পানি অপবিত্র ও অ-পবিত্রকারী (আত-তামহীদ; খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা; ১৬) তাই কেউ যদি গোসল শুরু করে, এরপর খেয়াল করে যে, পানি নাপাক তাহলে তার কর্তব্য হল: পবিত্র পানি দিয়ে পুনরায় গোসল করা।পক্ষান্তরে যে পানির ছিটা এসে পড়ে ও গোসলকারীর শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ে সেই পানি পবিত্র। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: আলেমগণ এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, যে অপবিত্র ব্যক্তির শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নাপাকি নাই সে যদি তার মুখে ও হাতে পানি ঢালে এবং সে পানি তার উপর দিয়ে, তার কাপড়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সে পানি পবিত্র। কারণ সেটা পবিত্র পানি পবিত্র শরীরে লেগেছে…।আলেমদের ইজমার মধ্যে রয়েছে যে, ওযুকারী ও গোসলকারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেগে থাকা পানি ও ফোঁটা ফোঁটা করে কাপড়ের উপর পড়া পানি পবিত্র: এটি ব্যবহৃত পানি পবিত্র হওয়ার দলিল।” (আল-আওসাত; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৮)
.
তৃতীয় শর্ত হচ্ছে: গোটা দেহে পানি পৌঁছা। যাতে করে শরীরে এমন কিছু না থাকে যা পানি চামড়ায় পৌঁছা বা চুলে পৌঁছাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ জানাবাত বা অপবিত্রতা গোটা দেহের সাথে সম্পৃক্ত। ইমাম নববী বলেন: “তারা এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, জানাবাত গোটা দেহে আপতিত হয়।”(আল-মাজমু; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৬৭) তাই চামড়ার উপরে যদি কোন ডাক্তারি প্লাস্টার থাকে কিংবা চুলের উপর এমন কোন পদার্থ থাকে বা চমড়ার উপর থাকে যা পানি পৌঁছতে বাধা দেয় তাহলে এমতাবস্থায় গোসল শুদ্ধ হবে না। অবশ্যই এ জিনিসগুলো দূর করতে হবে যাতে করে গোসল শুদ্ধ হয়।লম্বা নখের নীচে ময়লা থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির তারল্যের কারণে সেটি নখের নীচে পানি পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করে না। যদি বাধা সৃষ্টি করে তাহলে সেটি যৎসামান্য বিধায় ক্ষমার্হ। তাছাড়া যেহেতু এটি মানুষের মাঝে ঘটাটা প্রসিদ্ধ; কিন্তু শরিয়ত ওযু বা গোসলকালে নখের নীচে পানি পৌঁছানো নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়নি।(দেখুন: নববী আল-মাজমু; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৭; ইবনু তাইমিয়া; আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩০৩)
.
চতুর্থ শর্ত হচ্ছে: এটি আলেমদের মাঝে মতভেদপূর্ণ বিষয়। সেটি হচ্ছে গোসলের অঙ্গগুলোর মাঝে পরম্পরা রক্ষা করা এবং দীর্ঘ সময়ের বিরতি না ঘটা। ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন: “অধিকাংশ আলেম গোসলের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে গোসল বাতিলকারী হিসেবে মনে করেন না। তবে রবিআ বলেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা করবে আমি মনে করি তার উপর পুনরায় গোসল করা আবশ্যক। লাইছও এ কথা বলেছেন। মালেক থেকে একাধিক অভিমত এসেছে। ইমাম শাফেয়ির ছাত্রদেরও এক অভিমত হচ্ছে এটি। তবে জমহুর আলেম যে মতের উপর আছেন সেটাই উত্তম। গোসলে তারতীব বা ক্রমবিন্যাসই ওয়াজিব নয় সুতরাং পরম্পরাও ওয়াজিব নয়।”(ইবনু কুদামাহ আল-মুগনী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৯১-২৯২) তাই একজন মুসলিমের কর্তব্য নিজের গোসলের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা। গোসলের অংশগুলোর মাঝে লম্বা সময়ের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি না করা; যাতে করে মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন এবং নামাযের শুদ্ধতার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন।
.
❑ যদি কোন মুসলিম অভ্যাসগত গোসল করে, ওযু না করে; সে কি নামায পড়তে পারবে?
__________________________________________
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসরণে একজন মুসলিমের জন্য মুস্তাহাব হলো গোসলের পূর্বে ওযু করা।যদি গোসলটি বড় অপবিত্রতাজনিত হয়; (যেমন জানাবাতের গোসল ও হায়েযের গোসল) এবং গোসলকারী কুলি করা ও নাকে পানি দেয়াসহ সমস্ত দেহে পানি পৌঁছায়; তাহলে এ গোসল ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোসলের পর আর ওযু করতেন না। আর যদি গোসলটি শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য হয় কিংবা পরিচ্ছন্নতার জন্য হয়; তাহলে সেটি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: জানাবতের গোসল কি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে? তিনি জবাব দেন: “যদি কোন ব্যক্তি জানাবত (সহবাস, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত)-এর গোসল করে তাহলে তা ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “যদি তোমরা জুনুবী হও তাহলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন কর”। গোসলের পর তাকে ওযু করতে হবে না; যদি ওযু ভঙ্গের কোন কারণ না ঘটে। আর যদি গোসলের পর ওযু ভঙ্গের কোন কারণ ঘটে তাহলে ওযু করা তার উপর ওয়াজিব। আর যদি ওযু ভঙ্গের কোন কারণ না ঘটে তাহলে জানাবতের গোসলই তার ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে; চাই সে গোসলের পূর্বে ওযু করুক; কিংবা না করুক। কিন্তু কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। ওযু ও গোসলে এ দুটো অবশ্যই পালনীয়।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; ১১/প্রশ্ন নং-১৮০) ইমাম (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: শরিয়তে আদিষ্ট নয় এমন গোসল কি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে? তিনি জবাব দেন: “শরিয়তে আদিষ্ট নয় এমন গোসল ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না। কেননা সেই গোসল কোন ইবাদত নয়।”(ইবনু উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল: ১১/প্রশ্ন নং-১৮১)
.
অনুরূপভাবে ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: গোসল কি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে?
তিনি জবাব দেন: “যদি সেটা জানাবত (সহবাস, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত)-এর গোসল হয়; তাহলে সেটি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। যেহেতু আল্লাহ্‌র বাণী হচ্ছে: “যদি তোমরা জুনুবী হও তাহলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন কর”। কোন ব্যক্তি যদি জানাবতের শিকার হন; এরপর কোন পুকুরে বা নদীতে বা এ জাতীয় অন্য কিছুর ভেতরে ডুব দেন এবং এর মাধ্যমে জানাবত দূর করার নিয়ত করেন, কুলি করেন ও নাকি পানি দেন; তাহলে এর মাধ্যমে ছোট অপবিত্রতা ও বড় পবিত্রতা উভয়টি দূরীভুত হবে। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা জানাবতের কারণে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন করা ছাড়া অন্য কিছু করা ওয়াজিব করেননি। প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন হচ্ছে সারা দেহকে পানি দিয়ে ধৌত করা। যদিও জানাবতের গোসলকারীর জন্য উত্তম হচ্ছে- প্রথমে ওযু করে নেয়া। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতের কব্জিদ্বয় ধোয়ার পরে লজ্জাস্থান ধৌত করতেন। এরপর নামাযের ওযুর মত ওযু করতেন। এরপর মাথার ওপর পানি ঢালতেন। যখন ধারণা হত যে, তিনি চামড়া ভিজিয়েছেন তখন মাথার ওপর তিনবার পানি ঢালতেন। এরপর অবশিষ্ট শরীর ধৌত করতেন। পক্ষান্তরে পরিচ্ছন্নতা বা শরীর ঠাণ্ডা রাখার কারণে গোসল করলে সেই গোসল ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না। কেননা সেটি ইবাদত নয়। বরং সেটি অভ্যাসগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত; যদিও শরিয়ত পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এভাবে নয়; বরং পরিচ্ছন্নতার সাধারণ নির্দেশ; সেটা যে কোন কিছুতে যেভাবেই পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হোক না কেন।
মোটকথা: যদি গোসলটা শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য কিংবা পরিচ্ছন্নতার জন্য হয় তাহলে সেটি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল: ১১/প্রশ্ন নং-১৮২)
.
❑ গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহ:
________________________________________
(ক) মসজিদে অবস্থান করা। তবে মসজিদে অবস্থান না করে জরুরী প্রয়োজনে তা অতিক্রম করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِيْ سَبِيْلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوْا ‘আর অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর,তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।”(সূরা নিসা: ৪৩)
.
(খ) কুরআনের আরবি মুসহাফ স্পর্শ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘কেউ তা (কুরআন) স্পর্শ করে না পবিত্রগণ ব্যতীত”।(সূরা ওয়াকিয়া;৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلا طَاهِرٌ. “কুরআন স্পর্শ করে না পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত’।(তিরমিযী ১/১৪৬; মুসনাদে আহমাদ হা/৬৩৯, মিশকাত হা/৪৫১)।
.
(গ) সালাত আদায় করা। সালাত সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো,ছোট ও বড় উভয় প্রকার নাপাকী হ’তে পবিত্রতা অর্জন করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ”পবিত্রতা ব্যতীত সালাত এবং হারাম মালের দ্বারা দান কবুল হয় না’।(সহীহ মুসলিম হা/২২৪; সহীহ বুখারী হা/৩৩১)।
.
(ঘ) পবিত্র কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করা। বিনা ওযুতে কাবাঘর তওয়াফ করা নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কাবাঘরে তাওয়াফ করা নামাযতুল্য।”(সূনানে নাসাঈ হা/২৯২০)।অপর এক হাদীসে আয়েশা (রা)-কে সম্বােধন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,“পবিত্র না হয়ে আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করো না।”(সহীহ বুখারী হা/২৯৪ ও ৩০৫; সহীহ মুসলিম হা/ ২৯৭৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

তায়াম্মুম সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: তায়াম্মুম কাকে বলে? শরীয়তের দৃষ্টিতে তায়াম্মুমের হুকুম কি? তায়াম্মুম সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত কি কি? তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণ সমূহ কি কি? শুদ্ধতম হাদীস অনুসারে তায়াম্মুম করার পদ্ধতি কি?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর তায়াম্মুমের সংজ্ঞা: তায়াম্মুম (التيمم) অর্থ ‘সংকল্প করা’। পারিভাষিক অর্থে:আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে পানি না পাওয়া গেলে ওযু বা গোসলের পরিবর্তে নির্দিষ্ট নিয়মে পবিত্র মাটি দ্বারা মুখমন্ডল ও উভয় হাত মাসাহ করাকে তায়াম্মুম বলে।(ফিকহুল মুয়াস্সার,পৃষ্ঠা; ৩২)।এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর অন্যতম বিশেষ অনুগ্রহ। যা ইতিপূর্বে কোন উম্মতকে দেওয়া হয়নি।[ফিক্বহুস সুন্নাহ: খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৯]। এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য আবুবকর-পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কেননা সম্ভবত:৫ম হিজরী সনে বনুল মুছত্বালিক্ব যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে মদীনার উপকণ্ঠে ‘বায়দা’ (البَيْدَاء) নামক স্থানে পৌঁছে আয়েশা (রাঃ)-এর গলার হার হারিয়ে যায়।তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেটি খোঁজার জন্য কাফেলা থামিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে কোন পানি ছিল না। ফলে এভাবেই পানি ছাড়া সকাল হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন।(সূরা মায়েদাহ: ৬; সহীহ বুখারী, ফৎহুল বারী হা/৩৩৪ ‘তায়াম্মুম’ অধ্যায়-৭ হা/৪৬০৮ মুসলিম হা/৮৪২ ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ-২৮)
.
❑ শরীয়তের দৃষ্টিতে তায়াম্মুমের হুকুম:
____________________________________
তায়াম্মুম ইসলামী শরী‘আতে জায়েয,যা আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য বিশেষ ছাড়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,আর যদি তোমরা পীড়িত হও কিংবা সফরে থাক অথবা পায়খানা থেকে আস কিংবা স্ত্রী স্পর্শ করে থাক, অতঃপর পানি না পাও,তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা ‘তায়াম্মুম’ কর ও তা দ্বারা তোমাদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় মাসাহ কর’..।(সূরা মায়েদাহ ৫/৬, নিসা ৪/৪৩)আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ পাক-পবিত্র মাটি মুসলমানকে পবিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে,যদি দশ বছরও সে পানি না পায়। পানি যখন পাবে তখন সে যেন তাঁর গায়ে পানি লাগায়। এটাই তার জন্য উত্তম। নাসায়ীতে ”যদি দশ বছরও যদি পানি না পায়” পর্যন্ত অনুরুপ বর্ণনা করেছেন।(সহীহ আবূ দাঊদ হা/৩৩২, তিরমিযী হা/১২৪,নাসাঈ হা/৩২৪ মিশকাত হা/৫৩০) অপর বর্ননায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সকল মানুষের উপর তিনটি বিষয়ে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। (১) আমাদের (সলাতের) কাতারকে মালায়িকার সারির মত মর্যাদা দেয়া হয়েছে। (২) সমস্ত পৃথিবীকে বানানো হয়েছে আমাদের সলাতের স্থান এবং (৩) মাটিকে করা হয়েছে আমাদের জন্য পবিত্রকারী,যখন আমরা পানি পাবো না।(সহীহ মুসলিম ৫২২, সহীহ আল জামি‘ ৪২২৩, ইরওয়া ২৮৫, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ্ ২৬৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৬৯৭, মিশকাতুল মাসাবিহ, ৫২৬)
.
❑ তায়াম্মুম সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত সমূহ:
_____________________________________
▪️(ক) النية অর্থাৎ পানি না পেলে ওযুর পরিবর্তে সালাতের জন্য তায়াম্মুম এর নিয়ত করা। কেননা তায়াম্মুম একটি ইবাদত, যা নিয়ত সহীহ হওয়ার উপর নির্ভরশীল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয়ই প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পায়‌।’(বুখারী, হা/১ ,মিশকাত, ১)।তবে ফরয সালাতের নিয়তে তায়াম্মুম করতে হবে, তাহ’লে তাতে নফল এবং কাযা সালাত আদায় করা বৈধ হবে। পক্ষান্তরে যদি নফল সালাতের নিয়তে তায়াম্মুম করা হয় তাহ’লে তাতে ফরয সালাত সহীহ হবে না।(শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, ১/৪০১)। যেমন কেউ যদি তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য তায়াম্মুম করে, তাহলে ঐ তায়াম্মুম দ্বারা ফজরের ফরয সালাত আদায় করা সহীহ হবে না।
.
▪️(খ) الإسلام অর্থাৎ ব্যক্তিকে মুসলিম হ’তে হবে। কেননা তায়াম্মুম হল ইবাদত,যা কোন কাফিরের নিকট হতে আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করবেন না।(সূরা আলে ইমরান, ৮৫ সহীহ মুসলিম, হা/২৮০৮; সিলসিলা সহীহা, হা/২৭৭০)।
.
▪️(গ) العقل অর্থাৎ জ্ঞান সম্পন্ন হ’তে হবে। কেননা পাগল এবং অজ্ঞান ব্যক্তির উপর ইবাদত ওয়াজিব নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,তিন শ্রেণীর ব্যক্তির উপর থেকে আল্লাহ তা‘আলা কলম উঠিয়ে নিয়েছেন। ঘুমন্ত ব্যক্তি,যতক্ষণ পর্যন্ত সে জাগ্রত না হয়। শিশু যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বপ্ন দোষ না হয় এবং পাগল, যতক্ষণ তার জ্ঞান ফিরে না আসে’।(নাসাঈ ৩৪৩২, আবু দাউদ ৪৩৯৮, ইবনে মাজাহ ২০৪১, মিশকাত, ৩২৮৭-৮৮)
.
▪️(ঘ) পানি ব্যবহারে অক্ষমতার শারঈ ওযর থাকা। অর্থাৎ শারঈ ওযরের কারণে পানি ব্যবহারে অক্ষম হ’লে তার উপর তায়াম্মুম করা ওয়াজিব। আর এই অক্ষমতা কয়েকভাবে হ’তে পারে। যেমন:
.
(১) যদি পাক পানি না পাওয়া যায়।
(২) পানি পেতে গেলে যদি সালাত ক্বাযা হওয়ার ভয় থাকে।
(৩) পানি ব্যবহারে যদি রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকে।
(৪) যদি কোন বিপদ বা জীবনের ঝুঁকি থাকে ইত্যাদি। উপরোক্ত কারণ সমূহের প্রেক্ষিতে ওযু বা ফরয গোসলের পরিবর্তে প্রয়োজনে দীর্ঘদিন যাবৎ একটানা ‘তায়াম্মুম’ করা যাবে।(সূরা মায়েদাহ ৫/৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৭ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ-১০; বুখারী হা/৩৪৪; তিরমিযী হা/১২৪, ইরওয়া ১৫৩ মিশকাত হা/৫৩০)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “আমি বিছানায় শয্যাশায়ী। নড়াচড়া করার মত শক্তি রাখি না। এমতাবস্থায় আমি নামাযের জন্য কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে পারি ও নামায পড়তে পারি?
জবাবে তাঁরা বলেন:أولا : بالنسبة للطهارة يجب على المسلم أن يتطهر بالماء ، فإن عجز عن استعماله لمرض أو غيره تيمم بتراب طاهر ، فإن عجز عن ذلك سقطت الطهارة وصلى حسب حاله ، قال تعالى: ( فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ) ، وقال جل ذكره : ( وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ ) ، أما ما يتعلق بالخارج من البول والغائط فيكفي فيه الاستجمار بحجر أو مناديل طاهرة ، يمسح بها محل الخارج ثلاث مرات أو أكثر حتى ينقي المحل ” এক: মুসলিমের উপর পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা ওয়াজিব। যদি কোন রোগের কারণে কিংবা অন্য কোন কারণে পানি ব্যবহার করতে অক্ষম হয় তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে। যদি তায়াম্মুমও করতে না পারে তাহালে তার উপর থেকে পবিত্রতার বিধান মওকুফ হয়ে যাবে এবং সে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় নামায পড়বে। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তোমরা সাধ্যমত আল্লাহ্‌কে ভয় কর”। আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন: “তবে দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোন কষ্ট চাপিয়ে দেননি।”(সূরা আল-হাজ্জ আয়াত:৭৮) পক্ষান্তরে, পেশাব ও পায়খানার যা কিছু বের হয় সেটা পাথর দিয়ে কিংবা পবিত্র টিস্যুপেপার দিয়ে পরিষ্কার করাই যথেষ্ট। এগুলো দিয়ে ময়লা বের হওয়ার স্থানটি তিন বা ততোধিকবার পরিষ্কার করবে; যাতে করে স্থানটি নির্মল হয়ে যায়।”(ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৪৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন; “তার বক্তব্য: “কিংবা এটি (পানি) ব্যবহার করলে বা অন্বেষণ করতে গেলে শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা করে” অর্থাৎ যদি পানি ব্যবহার করলে তার শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সে অসুস্থ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে সে আল্লাহর এই বাণীর সার্বিকতার অন্তর্ভুক্ত হবে: “যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাকো”(সূরা মায়েদা: ৬) অনুরূপভাবে কারো ওযুর অঙ্গসমূহে যদি ক্ষত থাকে কিংবা গোসলের ক্ষেত্রে পুরো শরীরে ক্ষত থাকে এবং (পানির স্পর্শে) শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তাহলে সে তায়াম্মুম করতে পারবে।”(ইবনু উসাইমীন আশ-শারহুল মুমতি: খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৭৮, ৩৭৯; ইবনুল জাওযী প্রকাশনীর ছাপা)
.
(ঙ) পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা। অর্থাৎ যে মাটির সাথে পেশাব-পায়খানা মিশ্রিত হয়েছে,সেই মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েয নয়।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসাহ কর।’(মায়েদাহ: ৬)।ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, صَعِيْدًا বলতে সেই মাটিকে বুঝানো হয়েছে যেই মাটিতে শষ্য উৎপাদন করা হয়। আর طَيِّبًا বলতে পবিত্র মাটিকে বুঝানো হয়েছে।(ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃঃ ৩৩)।তবে ধুলা-মাটিহীন স্বচ্ছ পাথর, কাঠ, কয়লা, লোহা, মোজাইক, প্লাষ্টার, টাইলস, চুন ইত্যাদি দ্বারা ‘তায়াম্মুম’ জায়েয নয়।(আলোচনা দ্রষ্টব্য: সাদেক শিয়ালকোটি,সালাতুর রসূল; টীকা, পৃঃ ১৪৮-৪৯) অতএব পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করতে হবে। কিন্তু যদি মাটি পাওয়া না যায়। তাহলে বালি অথবা পাথর দ্বারাও তায়াম্মুম করা বৈধ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاتَّقُوْا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর।”(সূরা তাগাবুন: ১৬)। আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বালি মাটির অন্তর্ভুক্ত।(ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃষ্ঠা: ৩৪)
.
❑ প্রচণ্ড শীতের দিনে ফরজ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করা জায়েজ?
_____________________________________
যে ব্যক্তির উপর গোসল ফরয হয়েছে সে ব্যক্তি নামায পড়তে চাইলে তার উপর ফরয হচ্ছে– পানি দিয়ে গোসল করে নেয়া। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বানী: “আর তোমরা জুনুবী (অপবিত্র) হলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬) তাই কেউ যদি পানি ব্যবহারে অক্ষম হয়– পানি না থাকার কারণে কিংবা পানি থাকলেও এর ব্যবহারে রোগের ক্ষতি হতে পারে কিংবা তীব্র ঠাণ্ডার কারণে (তার কাছে পানি গরম করার মত কিছু না থাকলে); তাহলে সে ব্যক্তি পানি দিয়ে গোসল করার পরিবর্তে মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করতে পারেন। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ মলত্যাগ করে আসে বা তোমরা স্ত্রী সহবাস কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬) এ আয়াতে দলিল রয়েছে যে, অসুস্থ ব্যক্তি পানি ব্যবহার করার ফলে যদি তার মৃত্যু ঘটা, কিংবা রোগ বেড়ে যাওয়া কিংবা আরোগ্য লাভ বিলম্ব হওয়ার আশংকা থাকে সেক্ষেত্রে তিনি তায়াম্মুম করবেন। আল্লাহ্‌ তাআলা তায়াম্মুমের পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: “তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬) আল্লাহ্‌ তাআলা এ বিধান প্রদান করার গূঢ় রহস্যও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর কোন কাঠিন্য রাখতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬)
.
আমর বিন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘যাতুস সালাসিল’ এর অভিযানে এক ঠাণ্ডার রাতে আমার স্বপ্নদোষ হয়ে গেল। আমি আশংকা করলাম, আমি যদি গোসল করি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করলাম। এরপর আমার সাথীদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করলাম। আমার সাথীরা বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেন: হে আমর! তুমি কি জুনুবী (গোসল ফরজ হওয়া) অবস্থায় তোমার সাথীদের নিয়ে নামায পড়েছ? তখন আমি তাঁকে জানালাম কি কারণে আমি গোসল করিনি এবং আমি আরও বললাম: আমি শুনেছি আল্লাহ্‌ বলেন: ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি দয়ালু”(সূরা নিসা, আয়াত: ২৯) তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে দিলেন, কোন কিছু বললেন না।”(সুনানে আবু দাউদ হা/৩৩৪), আলবানী ‘সহিহ সুনানে আবু দাউদ’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)
.
হাফেয ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেন: وفي هذا الحديث جواز التيمم لمن يتوقع من استعمال الماء الهلاك سواء كان لأجل برد أو غيره ، وجواز صلاة المتيمم بالمتوضئين “এ হাদিসে দলিল রয়েছে যে, পানি ব্যবহার করলে যে ব্যক্তি মারা যাওয়ার আশংকা রয়েছে; সেটা ঠাণ্ডার কারণে হোক কিংবা অন্য কোন কারণে হোক তার জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয। তায়াম্মুমকারীর জন্য ওজুকারীদের ইমাম হওয়াও জায়েয।”(ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৫৪)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:إن كنت تستطيع أن تجد ماء دافئا أو تستطيع تسخين البارد ، أو الشراء من جيرانك أو غير جيرانك : فالواجب عليك أن تعمل ذلك ؛ لأن الله يقول : ( فاتَّقوا الله ما استَطَعْتُم ) ، فعليك أن تعمل ما تستطيع من الشراء أو التسخين أو غيرهما من الطرق التي تمكنك من الوضوء الشرعي بالماء ، فإن عجزت وكان البرد شديداً ، وفيه خطر عليك ، ولا حيلة لك بتسخينه ولا شراء شيء من الماء الساخن ممن حولك : فأنت معذور ، ويكفيك التيمم ؛ لقول الله تعالى : ( فاتَّقوا الله ما استَطَعْتُم ) وقوله سبحانه : ( فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ مِنْهُ ) .والعاجز عن استعمال الماء حكمه حكم من لم يجد الماء “যদি আপনার পক্ষে গরম পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় কিংবা আপনি গরম করতে পারেন কিংবা প্রতিবেশি বা অন্য কারো থেকে কিনে নিতে পারেন তাহলে সেটা করা আপনার উপর আবশ্যকীয়। কেননা আল্লাহ্‌ বলেন: “তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ্‌কে ভয় কর।”[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬] তাই আপনার কর্তব্য হচ্ছে পানি কেনা বা গরম করা কিংবা অন্য যেভাবে শরিয়তের বিধান মোতাবেক ওজু করা যায় সেটা করা। যদি আপনি অপারগ হন এবং ঠাণ্ডা অতি তীব্র হয়, পানি ব্যবহারে বিপদ ঘটার আশংকা থাকে, পানি গরম করা বা আশপাশে কারো থেকে গরম পানি কেনার কোন উপায় না থাকে সেক্ষেত্রে আপনার ওজর গ্রহণযোগ্য এবং তায়াম্মুম করাই আপনার জন্য যথেষ্ট। যেহেতু আল্লাহ্‌ বলেছেন: “তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ্‌কে ভয় কর” এবং তিনি আরও বলেছেন: “পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে: তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬] যে ব্যক্তি পানি ব্যবহারে অক্ষম সে ব্যক্তির হুকুম যে ব্যক্তি পানি পায়নি তার হুকুমের অনুরূপ।”(বিন বায; মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ১৯৯-২০০)আপনি আপনার শরীরের যতটুকু ধৌত করতে পারেন ততটুকু ধৌত করা আপনার উপর আবশ্যকীয়। যেমন- হাতদ্বয়, পাদ্বয় ইত্যাদি ধৌত করা; যদি এতে আপনার কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে। এরপর আপনি তায়াম্মুম করবেন।
.
❑ তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণ সমূহ:
_______________________________
(ক).ওযূ ভঙ্গের কারণ সংঘটিত হওয়া। অর্থাৎ তায়াম্মুম করার পরে পেশাব, পায়খানা ও বায়ু নিঃসরণ হ’লে, স্ত্রী সহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হ’লে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে।
.
(খ).পানি উপস্থিত হওয়া। অর্থাৎ তায়াম্মুম করার পরে পানি পাওয়া গেলে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার উপর উক্ত পানি দ্বারা ওযূ করা ওয়াজিব হবে। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ পাক-পবিত্র মাটি মুসলমানকে পবিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে, যদি দশ বছরও সে পানি না পায়। পানি যখন পাবে তখন সে যেন তাঁর গায়ে পানি লাগায়। এটাই তার জন্য উত্তম।নাসায়ীতে ” যদি দশ বছরও যদি পানি না পায় ” পর্যন্ত উনুরুপ বর্ণনা করেছেন।(আবূ দাঊদ ৩৩২, তিরমিযী ১২৪, ইরওয়া ১৫৩, মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৫৩০)
.
❑.সালাত আরম্ভ হওয়ার পরে পানি পাওয়া গেলে করণীয় :পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করে সালাত আরম্ভ করলে এবং সালাত রত অবস্থায় পানি উপস্থিত হ’লে উক্ত সালাত ছেড়ে পুনরায় ওযূ করে সালাত আদায় করতে হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে এক্ষেত্রে ছহীহ মত হ’ল, তাকে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর (মায়েদাহ ৬)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,”যখন পানি পাবে তখন তোমার চর্মে পানি লাগাবে, এটাই উত্তম’।(আবু দাউদ: ৩৩২ মিশকাত: ৫৩০) অতএব পানি পাওয়ার সাথে সাথে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে। পানি দ্বারা ওযূ করে সালাত আদায় করতে হবে।
.
❑ তায়াম্মুমের বিশুদ্ধ পদ্ধতি:
_______________________________
মুসল্লী পবিত্র হওয়ার নিয়ত করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মাটিতে দুই হাত একবার মারবে।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ; সহীহ বুখারী হা/১; মিশকাত হা/১; সহীহ তিরমিযী হা/২৫ সহীহ ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭, পৃঃ ৩২ সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪০২)।অতঃপর ফুঁক দিয়ে ঝেড়ে ফেলে প্রথমে বাম হাতের তালু দিয়ে ডানহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করা এবং ডান হাতের তালু দিয়ে বামহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করবে এরপর দুই হাত দিয়ে চেহারা মাসেহ করবে।যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন,তোমার জন্য এইরূপ করাই যথেষ্ট ছিল।এই বলে তিনি তাঁর দুই হাত মাটির উপর মারলেন এবং ফুঁক দিলেন। অতঃপর দুই হাত দ্বারা মুখমন্ডল ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন।(সহীহ বুখারী হা/৩৩৮, তায়াম্মুম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪; মুসলিম হা/৮৪৬ মিশকাত হা/৫২৮) ওজুর পর যে যে যিকিরগুলো পড়া হয় তায়াম্মুমের শেষেও সে দোয়াগুলো পড়া।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২১০৭৪)উল্লেখ যে, দুইবার হাত মারা ও কনুই পর্যন্ত মাসাহ করার হাদীস যঈফ।(আবু দাঊদ হা/৩৩০মিশকাত হা/৪৬৬ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-৬) শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আল-ফাতাওয়া’ গ্রন্থে বলেন: “সহিহ বুখারীর বর্ণনাটি সুস্পষ্ট যে, চেহারার পূর্বে হাতের তালুর পিঠ মাসেহ করেছেন”। অপর বর্ণনায় উদ্ধৃত: “তালুদ্বয়ের পিঠদ্বয়” প্রমাণ করে যে, তিনি প্রত্যেক হাতের কব্জির পিঠ অপর হাতের তালু দিয়ে মাসেহ করেছেন।” তিনি আরও বলেন: “কিন্তু বুখারীর একক বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, তিনি কব্জিদ্বয়ের পিঠ চেহারার পূর্বে মাসেহ করেছেন।(ইবনু তাইমিয়া মাজমুউ ফাতাওয়া,খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ৪২২-৪২৭)
.
পাশাপাশি জেনে রাখা ভাল যে,আবু দাঊদে দুইবার হাত মারা ও পুরো হাত বগল পর্যন্ত মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তার সনদ বিশুদ্ধ হলেও সেগুলো মূলতঃ কতিপয় সাহাবীর ঘটনা মাত্র, যা রাসূল (ﷺ) তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার আগে ঘটেছিল।(আবু দাঊদ হা/৩১৮; মিশকাত হা/৫৩৬) অতঃপর রাসূল (ﷺ) তায়াম্মুমের উক্ত পদ্ধতি অর্থাৎ দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ পদ্ধতি শিক্ষা দেন। যেমন ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বলেন,এটা সাহাবীদের কাজের ঘটনা,যা আমরা রাসূল (ﷺ) থেকে নকল করতে পারিনি। যেমনটি আম্মার (রাঃ) জুনবী অবস্থায় মাটিতে গড়াগড়ি করার ঘটনা নিজের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর যখন তিনি রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,তখন তিনি শুধু মুখমন্ডল ও দুই কব্জি মাসাহর নির্দেশ দান করেন। এ পর্যন্তই শেষ করেছেন। আর আম্মার (রাঃ) তার কাজ থেকে ফিরে আসেন।(তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫৩৬-এর টীকা দ্রঃ)।ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,কিন্তু আমল এর উপর (দুই হাত মারা) ছিল না। কারণ তখন সাহাবীগণ রাসূল (ﷺ)-এর শিক্ষা অনুযায়ী করেননি। বরং আমল ছিল শেষ হাদীসের প্রতি, যা পরেই আসছে।(সহীহ আবু দাঊদ হা/৩৪৩) অতএব রাসূল (ﷺ)-এরনআমল ও বক্তব্যই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়
.
❑ তায়াম্মুমের আনুষঙ্গিক মাসায়েলগুলো জেনে রাখা ভাল। যেমন:
____________________________________
অযু করার জন্য পানি খোঁজার পর না পাওয়া গেলে আওয়াল ওয়াক্তেই তায়াম্মুম করে নামায পড়া উচিৎ। শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পানির অপেক্ষা করা বা পানি খোঁজা জরুরী নয়। আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়ে শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পানির অপেক্ষা করা বা পানি খোঁজা জরুরী নয়। আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়ে শেষ ওয়াক্তে পানি পাওয়া গেলেও নামায পুনরায় পড়তে হবে না।(সিলসিলা সহীহ; ৬/২৬৫-২৬৮)
.
(১).তায়াম্মুম’ করে সালাত আদায়ের পরে ওয়াক্তের মধ্যে পানি পাওয়া গেলে পুনরায় ঐ সালাত আদায় করতে হবে না।(মিশকাত হা/৫৩৩; আবু দাঊদ হা/৩৩৮)
.
(২).পানি খোঁজাখুঁজি না করেই তায়াম্মুম করে নামায পড়লে এবং পানি তার আশে-পাশে মজুদ থাকলে নামায বাতিল গণ্য হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২২০)। এবং যে ব্যক্তি নামায পড়া অবস্থায় পানি পেয়ে যায়,তাকে নামায ছেড়ে দিয়ে ওযু করে পুনরায় নামায পড়তে হবে।(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৩)
.
(৩).ওযুর মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায়,তায়াম্মুমের দ্বারা সেসব কাজ করা যায়। অমনিভাবে যেসব কারণে ওযূ ভঙ্গ হয়, সেসব কারণে ‘তায়াম্মুম’ ভঙ্গ হয়।
.
(৪).ওযর দূরীভূত হওয়া। অর্থাৎ যে ওযরের কারণে তায়াম্মুম করা হয়েছে সে ওযর দূরীভূত হ’লে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে। যেমন অসুস্থতা বৃদ্ধির আশংকায় তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করা বৈধ। কিন্তু তায়াম্মুম অবস্থায় সুস্থতা ফিরে পেলে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে এবং তার উপর ওযু করে সালাত আদায় করা ওয়াজিব হবে।(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৩)
.
(৫).একই তায়াম্মুমে কয়েক ওয়াক্তের নামায পড়া সিদ্ধ।(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪০) সিদ্ধ না হওয়ার ব্যাপারে আসার গুলো শুদ্ধ নয়।
.
(৬).যদি মাটি বা পানি কিছুই না পাওয়া যায়,তাহলে বিনা ওযুতেই সালাত আদায় করবে।(সহীহ বুখারী হা/৩৩৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ও অন্যান্য; নায়লুল আওত্বার ১/৪০০, পানি ও মাটি ব্যতীত সালাত’ অনুচ্ছেদ)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

কুরআন সুন্নাহর আলোকে ওজু করার বিশুদ্ধ পদ্ধতি

 পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর ওজু শব্দটি আরবি ‘আল-ওয়াদাআ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ: পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য। কেননা ওজু ব্যক্তিকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করে। শরিয়তের পরিভাষায়:الْوُضُوءُ : اسْتِعْمَالُ مَاءٍ طَهُورٍ مُبَاحٍ فِي الأَعْضَاءِ الأَرْبَعَةِ، عَلَى صِفَةٍ مَخْصُوصَةٍ.”নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে (শরীরের) চারটি অঙ্গে পবিত্র ও বৈধ পানি ব্যবহার করাকে ওজু বলে। শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে ওজু করার দুটো পদ্ধতি রয়েছে।

❑ (ক). ফরয পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে:
(১)। সমস্ত মুখমণ্ডল একবার ধৌত করা। এর মধ্যে গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেয়াও অন্তর্ভুক্ত হবে। মুখমণ্ডলের পরিসীমা দৈর্ঘ্যে মাথার চুলের উৎস থেকে থুতনি পর্যন্ত এবং প্রন্থে দু কানের শাখা পর্যন্ত বিস্তৃত।
(২)। কনুই পর্যন্ত হাত একবার ধৌত করা।
(৩)। সমস্ত মাথা একবার মাসেহ করা। এর মধ্যে কানদ্বয় মাসেহ করাও অন্তর্ভুক্ত হবে।
(৪)। দুই পায়ের টাকনু পর্যন্ত একবার ধৌত করা।
পূর্বোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘একবার’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের কোন অংশ যেন ধোয়া থেকে বাদ না পড়ে।
(৫)। এই ক্রমধারা বজায় রাখা। অর্থাৎ প্রথমে মুখমণ্ডল ধৌত করবে, এরপর হাতদ্বয় ধৌত করবে, এরপর মাথা মাসেহ করবে, এরপর পা দুইটি ধৌত করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ক্রমধারা বজায় রেখে ওযু করেছেন।
(৬)। পরম্পরা রক্ষা করা। অর্থাৎ উল্লেখিত অঙ্গগুলো ধৌত করার ক্ষেত্রে পরম্পরা রক্ষা করা; যাতে করে একটি অঙ্গ ধোয়ার পর অপরটি ধোয়ার মাঝখানে স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের বিরতি না পড়ে। বরং এক অঙ্গের পরপর অপর অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ধৌত করা। এগুলো হচ্ছে- ওজুর ফরয কাজ; ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যে কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে।
.
উপরোক্ত কাজগুলো ওজুর ফরয হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও; এবং যদি তোমরা জুনুবী অবস্থায় থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে, বা তোমরা স্ত্রী সহবাস কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে: তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬] উপরোক্ত কাজগুলো পর্যায়ক্রম বজায় রাখার দলিল-এই হাদিস, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,ابْدَؤُوا بِمَا بَدَأَ اللَّهُ بِهِ “(কুরআনে) আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন, তোমরাও তা দিয়ে শুরু করো।(নাসায়ি, হা. ২৯৬২) উপরোক্ত কাজগুলো বিরামহীনতা অটুট রাখার দলিল-ওজুর পরেও পা শুকনো থেকে যাওয়া ব্যক্তির হাদিস। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দেখলেন, এক ব্যক্তির পায়ে এক দিরহাম পরিমাণ স্থান জ্বলজ্বল করছে, (ওজুর সময়) তাতে পানি পৌঁছেনি; তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পুনরায় ওজু করে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিলেন।(আবু দাউদ হা/১৭৫সনদ সহীহ; আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনে কাসিম এর হাশিয়াসহ ‘আল-রওযুল মুরবি’ খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৮১-১৮৮)
.
❑ (খ). অযুর মুস্তাহাব পদ্ধতি: যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে; ওযুর বিস্তারিত পদ্ধতি নিম্নরূপ:
(১)। ব্যক্তি নিজে পবিত্রতা অর্জন ও হাদাস (ওজু না থাকার অবস্থা) দূর করার নিয়ত করবে। তবে নিয়ত উচ্চারণ করবে না। কেননা নিয়তের স্থান হচ্ছে অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই নিয়তের স্থান অন্তর।
(২)। বিসমিল্লাহ বলবে।(স্মরণ থাকলে ওজুর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করা ওয়াজিব।
(৩)। হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধৌত করবে।
(৪)। এরপর তিনবার গড়গড়া কুলি করবে (গড়গড়া কুলি: মুখের ভেতরে পানি ঘুরানো)। বাম হাত দিয়ে তিনবার নাকে পানি দিবে ও তিনবার নাক থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে দিবে। ‘ইস্তিনশাক’ শব্দের অর্থ নাকের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করানো। আর ‘ইস্তিনসার’ শব্দের অর্থ নাক থেকে পানি বের করে ফেলা।
(৫)। মুখমণ্ডল তিনবার ধৌত করবে। মুখমণ্ডলের সীমানা হচ্ছে দৈর্ঘ্যে মাথার স্বাভাবিক চুল গজাবার স্থান থেকে দুই চোয়ালের মিলনস্থল ও থুতনি পর্যন্ত। প্রস্থে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত। ব্যক্তি তার দাঁড়ি ধৌত করবে। যদি দাঁড়ি পাতলা হয় তাহলে দাঁড়ির ওপর ও অভ্যন্তর উভয়টা ধৌত করবে। আর যদি দাঁড়ি এত ঘন হয় যে চামড়া দেখা যায় না তাহলে দাঁড়ির ওপরের অংশ ধৌত করবে, আর দাঁড়ি খিলাল করবে।
(৬)। এরপর দুই হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। হাতের সীমানা হচ্ছে- হাতের নখসহ আঙ্গুলের ডগা থেকে বাহুর প্রথমাংশ পর্যন্ত। ওজু করার আগে হাতের মধ্যে আঠা, মাটি, রঙ বা এ জাতীয় এমন কিছু লেগে থাকলে যেগুলো চামড়াতে পানি পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেগুলো দূর করতে হবে।
(৭)। অতঃপর নতুন পানি দিয়ে মাথা ও কানদ্বয় একবার মাসেহ করবে; হাত ধোয়ার পর হাতের তালুতে লেগে থাকা অবশিষ্ট পানি দিয়ে নয়। মাসেহ করার পদ্ধতি হচ্ছে- পানিতে ভেজা হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনের দিকে নিবে; এরপর পুনরায় যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। এরপর দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানের ছিদ্রতে প্রবেশ করাবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠদ্বয় মাসেহ করবে। আর মহিলার মাথার চুল ছেড়ে দেয়া থাকুক কিংবা বাঁধা থাকুক; মাথার সামনের অংশ থেকে ঘাড়ের ওপর যেখানে চুল গজায় সেখান পর্যন্ত মাসেহ করবে। মাথার লম্বা চুল যদি পিঠের ওপর পড়ে থাকে সে চুল মাসেহ করতে হবে না।
(৮)। এরপর দুই পায়ের কা’ব বা টাকনু পর্যন্ত ধৌত করবে। কা’ব বলা হয় পায়ের গোছার নিম্নাংশের উঁচু হয়ে থাকা হাড্ডিদ্বয়কে। আরো সহজে বললে টাখনু বলতে উদ্দেশ্য পায়ের গোড়ালি থেকে একটু ওপরে অবস্থিত উঁচু হাড়। আর এক পায়ে দুটো টাখনু থাকে।
.
দলিল হচ্ছে ইতিপূর্বে উল্লেখিত উসমান (রাঃ) এর ক্রীতদাস হুমরান এর বর্ণনা যে, একবার উসমান বিন আফফান (রাঃ) ওযুর পানি চাইলেন। এরপর তিনি ওযু করতে আরম্ভ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন), উসমান (রাঃ) হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধুইলেন, এরপর কুলি করলেন এবং নাক ঝাড়লেন। এরপর তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন এবং ডান হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর বাম হাত অনুরূপভাবে ধুইলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাসেহ করলেন। এরপর তার ডান পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর অনুরূপভাবে বাম পা ধুইলেন। তারপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার এ ওযুর করার ন্যায় ওযু করতে দেখেছি এবং ওযু শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ ওযুর ন্যায় ওযু করবে এবং একান্ত মনোযোগের সাথে দু’ রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির পিছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৩১]
ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে- ইসলাম গ্রহণ করা, আকলবান হওয়া, বুঝদার হওয়া ও নিয়ত করা। এসব শর্তের কারণে কোন কাফের ওযু করলে ওযু হবে না। পাগলের ওযু হবে না। বুঝদার হয়নি এমন শিশুর ওযু হবে না। নিয়ত করেনি এমন ব্যক্তির ওযু হবে না; উদাহরণতঃ কেউ যদি ঠাণ্ডা উপভোগ করার নিয়তে এ অঙ্গগুলো ধৌত করে। ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য পানি পবিত্রকারী হতে হবে। নাপাক পানি দিয়ে ওযু শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব বস্তু চামড়াতে ও নখে পানি পৌঁছতে বাধা দেয় সেসব জিনিস দূর করতে হবে; যেমন- মহিলাদের নখের মধ্যে ব্যবহৃত নেইল পলিশ।জমহুর আলেমের মতে, ওযুতে বিসমিল্লাহ পড়ার বিধান রয়েছে। তবে আলেমেরা মতানৈক্য করেছেন বিসমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব নাকি মুস্তাহাব? ওযুর শুরুতে কিংবা মাঝখানে যে ব্যক্তির স্মরণে থাকে তার উচিত বিসমিল্লাহ পড়া। পুরুষ ও মহিলার ওযু করার পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য নেই। ওযু সমাপ্ত করার পর এই দোয়া বলা মুস্তাহাব: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন ওযু করে এবং পরিপূর্ণভাবে পানি পৌঁছায় কিংবা (বলেছেন) পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এরপর বলে: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’ (অর্থ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল) তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজায় খুলে দেয়া হয়। সে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৪৫; সুনানে তিরমিযিতে আরেকটু অতিরিক্ত এসেছে যে, ‘আল্লাহুম্মাজ আলনি মিনাত্তাওয়্যাবীন ওয়াজ আলনি মিনাল মুত্বাতাহ্হিরীন’ (অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে আপনি তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন)[সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে হা/৪৮) আলবানী হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন]দেখুন শাইখ আল-ফাওযান লিখিত ‘আল-মুলাখ্খাস আল-ফিকহী’ ১/৩৬; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১৪৯৭)
.
❑ পরিশেষে সংক্ষেপে ওজুর বিশুদ্ধ সুন্নাতি পদ্ধতি:
.
সর্বাগ্রে ওজুর নিয়ত করবেন। ওজুর আগে মিসওয়াক করতে পারেন; যা একটি সুন্নাতি আমল। এরপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলবেন। তারপর দু হাতের কব্জি ধৌত করবেন তিনবার। কব্জিদ্বয় তিনবার ধৌত করা, প্রথমে ডান হাতের কব্জি ধৌত করা এবং দু হাতের আঙুলসমূহ খিলাল করা সুন্নাত। এরপর ডান হাতে পানি নিয়ে তিনবার কুলি করবেন এবং ডান হাতে পানি নিয়ে তিনবার নাকে পানি দেবেন। এক অঞ্জলি পানি দিয়েই একসাথে কুলি করতে ও নাকে পানি দিতে পারবেন; আবার কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার জন্য আলাদাভাবেও পানি নিতে পারবেন। আর নাকে পানি দেওয়ার পর নাক ঝাড়বেন বাম হাত দিয়ে। এরপর তিনবার মুখমণ্ডল ধৌত করবেন। ঘন দাড়ি থাকলে দাড়ি খিলাল করবেন; এক অঞ্জলি পানি নিয়ে দাড়ি ঘষার মাধ্যমে খিলাল করবেন। এরপর তিনবার কনুই সহকারে দুই হাত যৌত করবেন, কনুই পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ডান হাত আগে ধৌত করা সুন্নাত। এরপর দুই হাতে পানি নেওয়ার পর পানি ফেলে দিয়ে ভেজা দুই হাত দ্বারা সমগ্র মাথা একবার মাসেহ করবেন; মাথার সামনের দিকের চুল যেখানে শুরু হয়েছে সেখান থেকে নিয়ে মাথার পেছনে ঘাড়ের শেষভাগ পর্যন্ত মাসেহ করবেন। দুই কানের ওপরে থাকা চুলবিহীন সাদা অংশও মাসেহ করবেন। এরপর নতুন করে পানি নিয়ে পানিভেজ। হাত দিয়ে একবার দুই কান মাসেহ করবেন। একসাথে দুই কান মাসেহ না করে প্রথমে ডান কান এরপরে বাম কান মাসেহ করা সুন্নাত। কান মাসেহের সময় তর্জনী আঙুল দিয়ে কানের ছিদ্রের অংশ মাসেহ করবেন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পৃষ্ঠদেশ মাসেহ করবেন। এরপর তিনবার টাখনু সহকারে দুই পা ধৌত করবেন, টাখনু পর্যন্ত। প্রথমে ডান পা ধৌত করা সুন্নাত। পা ধোয়ার সময় পায়ের আঙুলগুলো খিলাল করা সুন্নাত। সুতরাং বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে ডান পায়ের আঙুলগুলো খিলাল করবেন; ডান পায়ের কনিষ্ঠ আঙুল থেকে শুরু করে ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি পর্যন্ত, এরপর বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে শুরু করে বাম পায়ের কনিষ্ঠ আঙুল পর্যন্ত খিলাল করবেন। তারপর বলবেন, “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসুলুহ।” দ্রষ্টব্য: মারয়ি বিন ইউসুফ আল-কারামি, দালিলুত তালিব লি নাইলিল মাতালিব, তাহকিক: আবু কুতাইবা আল-ফারিয়াবি (রিয়াদ: দারু তাইবা, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫ হি,/২০০৪ খ্রি.), পৃ. ১১-১২; মানসুর বিন ইউনুস আল-বুহুতি, আর-রওদুল মুরবি বি শারহি জাদিল মুস্তাকনি, তাহকিক খালিদ আল-মুশাইকিহ, আব্দুল আজিজ আল-ইদান ও আনাস আল-ইয়াতামা (কুয়েত দারু রাকায়িজ, ১ম প্রকাশ, ১৪৩৮ হি.), খণ্ড; ১,পৃষ্ঠা: ১১২-১১৪ ও ১২৪-১২৭; আল-কুআইমি, ফাইদুল জালিল, খণ্ড: ১,পৃষ্ঠা: ৬৬-৭৬)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Translate