প্রশ্ন: গোসলের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, শর্তাবলী, কোন কোন কারণে গোসল করা ওয়াজিব হয়, গোসলের সঠিক নিয়ম কী, এবং গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ কী কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর গোসলের আভিধানিক অর্থ ধৌত করা বা ধোয়া। পারিভাষিক অর্থ ইবাদতের নিয়তে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পবিত্র পানি দ্বারা সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করাকে গোসল বলা হয়। গোসল দুই ধরণের হতে পারে: ন্যূনতম বা জায়েয পদ্ধতি এবং পরিপূর্ণ পদ্ধতি।
.
জায়েয পদ্ধতিতে মানুষ শুধু ফরযগুলো আদায় করে ক্ষান্ত হয়; সুন্নত ও মুস্তাহাব আদায় করে না। সে পদ্ধতিটি হচ্ছে: পবিত্রতার নিয়ত করবে। এরপর গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেওয়ার সাথে গোটা দেহে পানি ঢালবে; সেটা যেভাবে হোক না কেন; শাওয়ারের নীচে, সমুদ্রে নেমে, বাথটাবে নেমে ইত্যাদি। অপরদিকে গোসলের পরিপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে গোসল করেছেন সেভাবে গোসলের সকল সুন্নত আদায় করে গোসল করা।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে গোসলের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন: গোসল করার পদ্ধতি দুইটি:
প্রথম পদ্ধতি: ফরয পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে গোটা দেহে পানি ঢালা। এর মধ্যে গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেয়াও রয়েছে। সুতরাং কেউ যদি যে কোনভাবে তার গোটা দেহে পানি পৌঁছাতে পারে তাহলে সে বড় অপবিত্রতা মুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে যাবে। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: “যদি তোমরা জুনুবি হও তাহলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬]।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: পরিপূর্ণ পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে গোসল করতেন সেভাবে গোসল করা। যে ব্যক্তি জানাবাত (অপবিত্রতা) থেকে গোসল করতে চায় তিনি তার হাতের কব্জিদ্বয় ধৌত করবেন। এরপর লজ্জাস্থান ও লজ্জাস্থানে যা লেগে আছে সেসব ধৌত করবেন। এরপর পরিপূর্ণ ওযু করবেন। এরপর মাথার উপর তিনবার পানি ঢালবেন। এরপর শরীরের অবশিষ্টাংশ ধৌত করবেন। এটাই হচ্ছে পরিপূর্ণ গোসলের পদ্ধতি।(ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম থেকে সমাপ্ত, পৃষ্ঠা-২৪৮)
.
❑.যে সকল কারণে গোসল করা ওয়াজিব:
______________________________________
সর্বমোট তিনটি কারনে গোসল ওয়াজিব হয়:
(১) যৌন উত্তেজনার সাথে বীর্য নির্গত হওয়া: এমনকি সেটা যদি যৌনাঙ্গদ্বয় একত্রিত হওয়া ব্যতিরেকে হাত দিয়ে সম্ভোগ করার কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও গোসল ফরজ হবে।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا ‘আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও।'(সূরা মায়েদা: ৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “পানির কারণে পানি অপরিহার্য।”(সহিহ মুসলিম হা/১৫১)। অপর বর্ননায় আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন-অর্থাৎ আমার প্রায়ই মযী নির্গত হ’ত এবং আমি গোসল করতাম। এমনকি এ কারণে আমার পৃষ্ঠদেশে ব্যথা অনুভব করতাম। অতঃপর আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পেশ করি অথবা অন্য কারো দ্বারা পেশ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তুমি এরূপ করবে না। বরং যখনই তুমি মযী দেখবে তখন তোমার পুরুষাঙ্গ ধৌত করবে এবং সালাত আদায়ের জন্য ওযু করবে। অবশ্য যদি কোন সময় উত্তেজনা বশতঃ বীর্য নির্গত হয় তবে গোসল করবে’।(আবু দাউদ হা/২০৬) অতএব জাগ্রত অবস্থায় অসুস্থতার কারণে যৌন উত্তেজনা ছাড়াই বীর্যপাত হলে তার উপর গোসল ওয়াজিব নয়।(ইবনু উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, ১/৩৩৪)।অর্থাৎ সে ব্যক্তি শুধুমাত্র লজ্জস্থান ধৌত করবে এবং যে পোষাকে বীর্য লেগেছে তা পরিবর্তন করে নতুনভাবে ওযু করে সালাত আদায় করবে।পক্ষান্তরে ঘুমন্ত অবস্থায় বীর্যপাত হলেই গোসল ওয়াজিব হবে।এক্ষেত্রে গোসল ওয়াজিব হওয়ার জন্য যৌন উত্তেজনা শর্ত নয়।(দেখুন সহীহ বুখারী: ১৩০; সহীহ মুসলিম: ৩১৩; আর লুলু ওয়াল মারজান: ১৮০)। অতএব স্বপ্নের কিছু বুঝতে পারুক বা না পারুক, ঘুম থেকে জেগে বীর্য দেখলেই তার উপর গোসল ওয়াজিব।
.
(২).খতনার স্থানদ্বয় তথা যৌনাঙ্গদ্বয় একত্রিত হওয়া। অর্থাৎ পুরুষাঙ্গের খাতনার স্থান পর্যন্ত স্ত্রীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ-করানো সংঘটিত হওয়া। বীর্য নির্গত হোক বা না হোক গোসল ওয়াজিব হবে এটাই সঙ্গম বা সহবাস। বীর্যপাত হওয়া শর্ত নয়। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যদি খতনার স্থানদ্বয় মিলিত হয় এবং পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ ভিতরে ডুবে যায় তাহলে বীর্যপাত হোক বা না-হোক গোসল ফরজ হবে।”(সুনানে আবু দাউদ, সহিহ আবু দাউদ হা/২০৯) অপর বর্ননায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যখন তোমাদের কেউ স্ত্রীলোকের চার শাখার (দুই হাত দুই পা) মাঝখানে বসে সঙ্গমে রত হয় তখন তার উপর গোসল করা ফরজ হয়ে যায়,যদিও বীর্যপাত না হয়।(সহীহ মুসলিম: ৩৪৮; বুখারী: ৩৪৮; মিশকাত: ৪৩০)
.
(৩) মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার উপর গোসল ওয়াজিব। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত;এক ব্যক্তি আরাফাতে অবস্থানরত অবস্থায় আকস্মাৎ তার উটনী হ’তে পড়ে যায় এতে তার ঘাড় মটকে গেল অথবা রাবী বলেছেন, ঘাড় মটকে দিল (যাতে সে মারা গেল)। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে কুলপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করাও,তার পরিধেয় বস্ত্র দু‘টি দিয়ে তার কাফন দাও,কিন্তু তার মুখমণ্ডল ও মাথা অনাবৃত রাখ। কারণ তাকে কিয়ামাতের দিন তালবিয়াহ্ পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।সহিহ মুসলিম হা/২৭৮৬)।উল্লিখিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার উপর গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে যুদ্ধে শহীদ হওয়া ব্যক্তির উপর গোসল ওয়াজিব নয়।(দেখুন সহীহ বুখারী ১৩৪৩; ইবনু মাজাহ্ ১৫১৪; ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৬৭৫৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৬৯২৫; মিশকাত হা/১৬৬৫)
.
❑ পবিত্রতা অর্জনের গোসলের সঠিক নিয়ম:
_______________________________________
গোসলের পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি হচ্ছে:
(১)। বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার নিয়ত করবে। সেটা জানাবাত হোক, হায়েয হোক কিংবা নিফাস।
(২)। এরপর বিসমিল্লাহ বলবে। দুই হাত তিনবার ধৌত করবে। লজ্জাস্থানের ময়লা ধৌত করবে।
(৩)। তারপর নামাযের ওযু করার ন্যায় পরিপূর্ণ ওযু করবে।
(৪)। এরপর মাথার উপর তিনবার পানি ঢালবে। চুল ঘষা দিবে যাতে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছে।
(৫)। অতঃপর সারা শরীরে পানি ঢালবে ও ধৌত করবে। ডানপার্শ্ব দিয়ে শুরু করবে। এরপর বামপার্শ্ব ধৌত করবে। সারা শরীরে যেন পানি পৌঁছে সেজন্য হাত দিয়ে ঘষামাজা করবে।
.
মহিলাদের গোসলও পুরুষদের অনুরুপ। অবশ্য মহিলার মাথার চুলে বেণী বাঁধা (চুটি গাঁথা) থাকলে তা খোলা জরুরী নয়। তবে ৩ বার পানি নিয়ে চুলের গোড়া অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে।(দেখুন সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/৪৩৮)।নখ নখপালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত গোসল হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় গোসল হয়ে যাবে। কপালে টিপ থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ গোসল হবে না। বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও মাসিকের গোসল, অথবা মাসিক ও ঈদ, অথবা বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও জুমআ বা ঈদের গোসল নিয়ত হলে একবারই যথেষ্ট। পৃথক পৃথক গোসলের দরকার নেই।(ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু পৃষ্ঠা: ৬০)। গোসলের পর নামাযের জন্য আর পৃথক ওযুর প্রয়োজন নেই। গোসলের পর ওযু ভাঙ্গার কোন কাজ না করলে গোসলের ওযুতেই নামায হয়ে যাবে।(আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/৪৪৫) রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় নামায মাফ নয়। (আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/ ৫৬০-৫৬১)। সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। নচেৎ অনেকের মতে কুল্লি না করলে এবং নাকে পানি না নিলে গোসলই শুদ্ধ হবে না।(ইবনু উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতি খন্ড:১; পৃষ্ঠা: ৩০৪)। গোসলের উপরোক্ত মুস্তাহাব পদ্ধতির দলিল হচ্ছে-আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবাতের (অপবিত্রতার) গোসল করতেন তখন তিনি তাঁর হাত দুইটি ধৌত করতেন, নামাযের ওযুর ন্যায় ওযু করতেন। এরপর গোসল করতেন। হাত দিয়ে চুল খিলাল করতেন; যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি মনে করতেন যে, চামড়া ভিজেছে। তিনি মাথার উপর তিনবার পানি ঢালতেন। এরপর সারা শরীর ধৌত করতেন।”(সহিহ বুখারী হা/২৪৮;ও সহিহ মুসলিম (৩১৬) অপর বর্ননায় আয়েশা (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবাতের গোসল করতে চাইতেন তখন তিনি একটি পাত্র আনতে বলতেন; যেমন- হিলাব (উটের দুধ দোহনের পাত্র।) তিনি হাত দিয়ে পানি নিতেন। ডান পার্শ্ব থেকে গোসল শুরু করতেন। এরপর বামপার্শ্ব। এরপর দুই হাতে পানি নিয়ে মাথার উপর পানি ঢালতেন।”(সহিহ বুখারী হা/২৫৮; সহিহ মুসলিম হা/৩১৮)
.
❑ যে সকল কারণে গোসল করা সুন্নাত:
___________________________________






.
❑ গোসল সহীহ হওয়ার শর্তগুলো কি কি?
_____________________________
গোসল সহিহ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে। যদি এ শর্তগুলো পূরণ না হয় তাহলে গোসল বাতিল হয়ে যাবে। শর্তগুলো হচ্ছে:
.
প্রথম শর্ত হচ্ছে নিয়ত: রাসূলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক আমল নিয়ত অনুযায়ী (ধর্তব্য) হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সেটাই তার প্রাপ্য।”(সহিহ বুখারী হা/১; ও সহিহ মুসলিম হা/১৯০৭)। তাই তার গোসলের শুরুতে এ গোসলের মাধ্যমে জানাবাত (অপবিত্রতা) উত্তোলন করার নিয়ত করতে হবে। সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আমি পবিত্র অব্স্থায় গোসল করেছি বিধায় বড় অপবিত্রতা দূর করার নিয়ত করিনি। গোসল করার শেষে আমার মনে পড়ল যে, গোসল করার আগে আমি জুনুব (অপবিত্র) ছিলাম। তাই আমার উপর কি পুনরায় গোসল করা আবশ্যকীয়; নাকি আমি ঐ গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা লাভ করেছি? জবাবে তারা বলেন: যদি আপনি পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও ঠাণ্ডা লাভের নিয়তে গোসল করে থাকেন তাহলে আপনার উপর আবশ্যক পুনরায় বড় পবিত্রতা উত্তোলন করার নিয়তে গোসল করা। কেননা আপনি প্রথম গোসলের মাধ্যমে নিয়ত করেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমলগুলো নিয়ত দ্বারা হয়ে থাকে”।(ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৩৩)
.
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে গোসলের পানি পবিত্র হওয়া: ইবনে আব্দুল বার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: পানি হয়তো নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হবে কিংবা অন্য কিছু দ্বারা পরিবর্তিত হবে। যদি নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হয় তাহলে আলেমগণ ইজমা করেছেন যে, সেই পানি অপবিত্র ও অ-পবিত্রকারী (আত-তামহীদ; খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা; ১৬) তাই কেউ যদি গোসল শুরু করে, এরপর খেয়াল করে যে, পানি নাপাক তাহলে তার কর্তব্য হল: পবিত্র পানি দিয়ে পুনরায় গোসল করা।পক্ষান্তরে যে পানির ছিটা এসে পড়ে ও গোসলকারীর শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ে সেই পানি পবিত্র। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: আলেমগণ এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, যে অপবিত্র ব্যক্তির শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নাপাকি নাই সে যদি তার মুখে ও হাতে পানি ঢালে এবং সে পানি তার উপর দিয়ে, তার কাপড়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সে পানি পবিত্র। কারণ সেটা পবিত্র পানি পবিত্র শরীরে লেগেছে…।আলেমদের ইজমার মধ্যে রয়েছে যে, ওযুকারী ও গোসলকারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেগে থাকা পানি ও ফোঁটা ফোঁটা করে কাপড়ের উপর পড়া পানি পবিত্র: এটি ব্যবহৃত পানি পবিত্র হওয়ার দলিল।” (আল-আওসাত; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৮)
.
তৃতীয় শর্ত হচ্ছে: গোটা দেহে পানি পৌঁছা। যাতে করে শরীরে এমন কিছু না থাকে যা পানি চামড়ায় পৌঁছা বা চুলে পৌঁছাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ জানাবাত বা অপবিত্রতা গোটা দেহের সাথে সম্পৃক্ত। ইমাম নববী বলেন: “তারা এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, জানাবাত গোটা দেহে আপতিত হয়।”(আল-মাজমু; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৬৭) তাই চামড়ার উপরে যদি কোন ডাক্তারি প্লাস্টার থাকে কিংবা চুলের উপর এমন কোন পদার্থ থাকে বা চমড়ার উপর থাকে যা পানি পৌঁছতে বাধা দেয় তাহলে এমতাবস্থায় গোসল শুদ্ধ হবে না। অবশ্যই এ জিনিসগুলো দূর করতে হবে যাতে করে গোসল শুদ্ধ হয়।লম্বা নখের নীচে ময়লা থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির তারল্যের কারণে সেটি নখের নীচে পানি পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করে না। যদি বাধা সৃষ্টি করে তাহলে সেটি যৎসামান্য বিধায় ক্ষমার্হ। তাছাড়া যেহেতু এটি মানুষের মাঝে ঘটাটা প্রসিদ্ধ; কিন্তু শরিয়ত ওযু বা গোসলকালে নখের নীচে পানি পৌঁছানো নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়নি।(দেখুন: নববী আল-মাজমু; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৭; ইবনু তাইমিয়া; আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩০৩)
.
চতুর্থ শর্ত হচ্ছে: এটি আলেমদের মাঝে মতভেদপূর্ণ বিষয়। সেটি হচ্ছে গোসলের অঙ্গগুলোর মাঝে পরম্পরা রক্ষা করা এবং দীর্ঘ সময়ের বিরতি না ঘটা। ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন: “অধিকাংশ আলেম গোসলের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে গোসল বাতিলকারী হিসেবে মনে করেন না। তবে রবিআ বলেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা করবে আমি মনে করি তার উপর পুনরায় গোসল করা আবশ্যক। লাইছও এ কথা বলেছেন। মালেক থেকে একাধিক অভিমত এসেছে। ইমাম শাফেয়ির ছাত্রদেরও এক অভিমত হচ্ছে এটি। তবে জমহুর আলেম যে মতের উপর আছেন সেটাই উত্তম। গোসলে তারতীব বা ক্রমবিন্যাসই ওয়াজিব নয় সুতরাং পরম্পরাও ওয়াজিব নয়।”(ইবনু কুদামাহ আল-মুগনী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৯১-২৯২) তাই একজন মুসলিমের কর্তব্য নিজের গোসলের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা। গোসলের অংশগুলোর মাঝে লম্বা সময়ের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি না করা; যাতে করে মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন এবং নামাযের শুদ্ধতার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন।
.
❑ যদি কোন মুসলিম অভ্যাসগত গোসল করে, ওযু না করে; সে কি নামায পড়তে পারবে?
__________________________________________
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসরণে একজন মুসলিমের জন্য মুস্তাহাব হলো গোসলের পূর্বে ওযু করা।যদি গোসলটি বড় অপবিত্রতাজনিত হয়; (যেমন জানাবাতের গোসল ও হায়েযের গোসল) এবং গোসলকারী কুলি করা ও নাকে পানি দেয়াসহ সমস্ত দেহে পানি পৌঁছায়; তাহলে এ গোসল ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোসলের পর আর ওযু করতেন না। আর যদি গোসলটি শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য হয় কিংবা পরিচ্ছন্নতার জন্য হয়; তাহলে সেটি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: জানাবতের গোসল কি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে? তিনি জবাব দেন: “যদি কোন ব্যক্তি জানাবত (সহবাস, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত)-এর গোসল করে তাহলে তা ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যদি তোমরা জুনুবী হও তাহলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন কর”। গোসলের পর তাকে ওযু করতে হবে না; যদি ওযু ভঙ্গের কোন কারণ না ঘটে। আর যদি গোসলের পর ওযু ভঙ্গের কোন কারণ ঘটে তাহলে ওযু করা তার উপর ওয়াজিব। আর যদি ওযু ভঙ্গের কোন কারণ না ঘটে তাহলে জানাবতের গোসলই তার ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে; চাই সে গোসলের পূর্বে ওযু করুক; কিংবা না করুক। কিন্তু কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। ওযু ও গোসলে এ দুটো অবশ্যই পালনীয়।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; ১১/প্রশ্ন নং-১৮০) ইমাম (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: শরিয়তে আদিষ্ট নয় এমন গোসল কি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে? তিনি জবাব দেন: “শরিয়তে আদিষ্ট নয় এমন গোসল ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না। কেননা সেই গোসল কোন ইবাদত নয়।”(ইবনু উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল: ১১/প্রশ্ন নং-১৮১)
.
অনুরূপভাবে ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: গোসল কি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে?
তিনি জবাব দেন: “যদি সেটা জানাবত (সহবাস, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত)-এর গোসল হয়; তাহলে সেটি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। যেহেতু আল্লাহ্র বাণী হচ্ছে: “যদি তোমরা জুনুবী হও তাহলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন কর”। কোন ব্যক্তি যদি জানাবতের শিকার হন; এরপর কোন পুকুরে বা নদীতে বা এ জাতীয় অন্য কিছুর ভেতরে ডুব দেন এবং এর মাধ্যমে জানাবত দূর করার নিয়ত করেন, কুলি করেন ও নাকি পানি দেন; তাহলে এর মাধ্যমে ছোট অপবিত্রতা ও বড় পবিত্রতা উভয়টি দূরীভুত হবে। কেননা আল্লাহ্ তাআলা জানাবতের কারণে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন করা ছাড়া অন্য কিছু করা ওয়াজিব করেননি। প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন হচ্ছে সারা দেহকে পানি দিয়ে ধৌত করা। যদিও জানাবতের গোসলকারীর জন্য উত্তম হচ্ছে- প্রথমে ওযু করে নেয়া। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতের কব্জিদ্বয় ধোয়ার পরে লজ্জাস্থান ধৌত করতেন। এরপর নামাযের ওযুর মত ওযু করতেন। এরপর মাথার ওপর পানি ঢালতেন। যখন ধারণা হত যে, তিনি চামড়া ভিজিয়েছেন তখন মাথার ওপর তিনবার পানি ঢালতেন। এরপর অবশিষ্ট শরীর ধৌত করতেন। পক্ষান্তরে পরিচ্ছন্নতা বা শরীর ঠাণ্ডা রাখার কারণে গোসল করলে সেই গোসল ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না। কেননা সেটি ইবাদত নয়। বরং সেটি অভ্যাসগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত; যদিও শরিয়ত পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এভাবে নয়; বরং পরিচ্ছন্নতার সাধারণ নির্দেশ; সেটা যে কোন কিছুতে যেভাবেই পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হোক না কেন।
মোটকথা: যদি গোসলটা শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য কিংবা পরিচ্ছন্নতার জন্য হয় তাহলে সেটি ওযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে না।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল: ১১/প্রশ্ন নং-১৮২)
.
❑ গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহ:
________________________________________
(ক) মসজিদে অবস্থান করা। তবে মসজিদে অবস্থান না করে জরুরী প্রয়োজনে তা অতিক্রম করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِيْ سَبِيْلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوْا ‘আর অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর,তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।”(সূরা নিসা: ৪৩)
.
(খ) কুরআনের আরবি মুসহাফ স্পর্শ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘কেউ তা (কুরআন) স্পর্শ করে না পবিত্রগণ ব্যতীত”।(সূরা ওয়াকিয়া;৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلا طَاهِرٌ. “কুরআন স্পর্শ করে না পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত’।(তিরমিযী ১/১৪৬; মুসনাদে আহমাদ হা/৬৩৯, মিশকাত হা/৪৫১)।
.
(গ) সালাত আদায় করা। সালাত সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো,ছোট ও বড় উভয় প্রকার নাপাকী হ’তে পবিত্রতা অর্জন করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ”পবিত্রতা ব্যতীত সালাত এবং হারাম মালের দ্বারা দান কবুল হয় না’।(সহীহ মুসলিম হা/২২৪; সহীহ বুখারী হা/৩৩১)।
.
(ঘ) পবিত্র কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করা। বিনা ওযুতে কাবাঘর তওয়াফ করা নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কাবাঘরে তাওয়াফ করা নামাযতুল্য।”(সূনানে নাসাঈ হা/২৯২০)।অপর এক হাদীসে আয়েশা (রা)-কে সম্বােধন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,“পবিত্র না হয়ে আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করো না।”(সহীহ বুখারী হা/২৯৪ ও ৩০৫; সহীহ মুসলিম হা/ ২৯৭৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment