প্রশ্ন: একজন তালিবুল ইলম (জ্ঞান অন্বেষণকারী) কী কী শিষ্টাচার ও নৈতিক গুণাবলি অবলম্বন করলে তাঁর ইলম অর্জন বিশুদ্ধ, ফলপ্রসূ ও বরকতময় হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: যাবতীয় প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করে ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে কলমের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। মানুষকে এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে, যেন তাকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। অতঃপর….. কর্ম সম্পাদনের পূর্বে একজন ব্যক্তির প্রথম কর্তব্য জ্ঞান অন্বেষণ করা। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فاعلم انه لا اله الا الله واستغفر لذنبك وللمؤمنين والمؤمنات “আপনি জেনে রাখুন, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। আর ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আপনার ত্রুটির জন্য এবং মুমিন নর-নারীর জন্য’ (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থে এ মর্মে অধ্যায় রচনা করে শিরোনাম দিয়েছেন باب العِلمِ قبْلَ القوْلِ والعملِ.”কথা এবং কাজের পূর্বে জ্ঞান অন্বেষণ করা’।অতঃপর উক্ত আয়াত পেশ করেছেন।নিশ্চয় ইলম অর্জনের বেশ কিছু আদব রয়েছে; একজন তালিবুল ইলমের সে আদবগুলোতে সুশোভিত হওয়া উচিত। আমরা আপনার সমীপে সে আদব ও উপদেশগুলো পেশ করছি; আশা করি আল্লাহ্ সেগুলোর মাধ্যমে আপনাকে উপকৃত করবেন:
.
(১).নিয়ত বিশুদ্ধ করা: প্রিয় পাঠক! ইলমে দ্বীন অর্জনের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম কর্তব্য নিয়তকে বিশুদ্ধ করা। যাবতীয় লৌকিকতা পরিহার করা বা সুনাম সুখ্যাতি অর্জন অথবা লোকমুখে তাকে আলেম বলে সম্বোধন করা হবে এই উদ্দেশ্যকে লালন করা এবং দুনিয়া লাভের আশায় কিংবা ইহলৌকিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে জ্ঞানার্জনে বিরত থাকা। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তেই ইলমে দ্বীন হাছিল করা। কেননা জ্ঞান অন্বেষণ একটি মহৎ কাজ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى”যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক মানুষের জন্য তাই-ই রয়েছে, যার জন্য সে সংকল্প করেছে”।(সহীহ বুখারী, হা/১) সুতরাং দ্বীনের ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে নিয়তকে পরিশুদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।গাযালী ‘ইহয়াউ উলূমিদ্দীন-এ বলেন: “ইবাদতগুলো নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত মৌলিক শুদ্ধতা ও মর্যাদা বহুগুণ হওয়ার দিক থেকে (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৭০)।
.
(২).ধৈর্য: নিঃসন্দেহে ইলম অর্জন উচ্চ মর্যাদার বিষয়।পরিশ্রমের সিঁড়ি না পেরিয়ে উচ্চ শিখরে পৌঁছা যায় না। কবি আবু তাম্মাম নিজেকে সম্বোধন করে বলেন:”ছেড়ে দে আমায়, আমি মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছতে চাই্, সাধারণতঃ যেথায় পৌঁছা যায় না। কঠিন শিখরে পৌঁছতে হয় কাঠিন্য পার হয়ে, সহজ স্তরে পৌঁছা যায় সহজে। তুমি সস্তা পথে উচ্চ শিখরের নাগাল পেতে চাও? মধু খেতে হলে মধুকরের হুলে বিদ্ধ হতে হয়। অন্য এক কবি বলেন:”তুমি বৃদ্ধের গতিতে মর্যাদার পানে আগাচ্ছ। অথচ অন্যেরা কষ্টের চূড়ান্তে পৌঁছে লুঙ্গি ফেলে রেখে ছুটে চলছে। মর্যাদার লক্ষ্যপানে কঠিন পরিশ্রম করে তাদের অধিকাংশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মর্যাদার নাগাল তারাই পায় যারা অধ্যাবসায় চালিয়ে যায় ও ধৈর্য রাখে। তুমি মর্যাদায় পৌঁছাকে খেজুর খাওয়ার মত সহজ মনে করো না। বরং তুমি তিতা ঔষুধ চেটে খাওয়া ব্যতীত মর্যাদার সীমানায় পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং ধৈর্য ধর, অধ্যবসায়ী হও। কারণ জিহাদের সবর হয় সামান্য কিছু সময়ের জন্য; কিন্তু তালিবুল ইল্মকে জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা কর এবং সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক, আর আল্লাহ্ ভীতি অবলম্বন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)।
.
(৩).কর্মনিষ্ঠা: কুরআন সুন্নাহ’র বিশুদ্ধ ইলম অর্জনের দ্বিতীয় শিষ্টাচার হচ্ছে নিষ্ঠার সাথে কর্ম করা। তালেবুল ইলমদের উদ্দেশ্য যেন হয় আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও পরকাল; লৌকিকতা ও সঙ্গি-সাথীদের উপরে উঠার লিপ্সা থেকে বেঁচে থাকা। কারণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করে আলিমদের ওপর গৌরব করার জন্য অথবা জাহিল-মূর্খদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য; আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।”(সুনানে নাসাঈ হা/২৬৫৪; ইমাম আলবানী সহিহুন নাসাঈ গ্রন্থে হাদিসটিকে হাসান বলেছেন) মোটকথা তাহলে বললে ইলমের ভেতর ও বাহির বড়-ছোট সব ধরণের গুনাহ থেকে পবিত্র হতে হবে।
.
(৪): ইলম অনুযায়ী আমল করা: জেনে রাখুন আমল হচ্ছে ইলমের ফলাফল। যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করল কিন্তু আমল করল না সে ব্যক্তি ইহুদীদের মত; আল্লাহ্ কুরআনে যাদের ক্ষেত্রে সর্বনিকৃষ্ট উদাহরণ টেনে এনেছেন। তিনি বলেন: “যাদেরকে তওরাত দেয়া হয়েছিল, অতঃপর তারা এর অনুসরণ করেনি, তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধা; যে পুস্তক বহন করে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে, তাদের দৃষ্টান্ত কত নিকৃষ্ট। আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।”(সূরা জুমুআ, আয়াত: ৫) আর যে ব্যক্তি ইল্ম ছাড়া আমল করে সে খ্রিস্টানদের মত। যাদেরকে সূরা ফাতিহাতে পথভ্রষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ইলম অর্জনকারীর অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী আমল করা আবশ্যক। আমলহীন সঞ্চিত জ্ঞানে কোন বরকত থাকে না। আর এই জ্ঞানই ক্বিয়ামতের দিন তোমার বিপক্ষে সাক্ষী দিবে। কেননা আমলহীন জ্ঞান ফলহীন গাছের ন্যায়। কবি বলেন, وعالم بعلمه لم يعلمن معذب من قبل عباد الوثن “যে আলেম তার জ্ঞান মাফিক আমল করে না,ক্বিয়ামতের দিন মূর্তিপূজকের পূর্বে সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে’। কেননা ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তারা হল এমন আলেম যারা তাদের জ্ঞান মাফিক কর্মসম্পাদন করত না। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে, যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন মাজীদ অধ্যয়ন করেছে। তখন তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রদত্ত নে‘মতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তা চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, এত বড় নে‘মত পেয়ে বিনিময়ে তুমি কী করলে? জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যয়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি তো জ্ঞান অর্জন করেছিলে এজন্যে যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন তেলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে যাতে লোকে বলে, তুমি একজন ক্বারী। তা বলা হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেয়া হবে, সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”(সহীহ মুসলিম, হা/১৯০৫; নাসাঈ, হা/৩১৩৭)।
.
(৫).আল্লাহ আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন এ অনুভুতি লালন করা: একজন মুমিনের অন্তরে সদা জাগ্রত থাকা উচিত আল্লাহ আমাদের প্রতিনিয়ত দেখছেন, প্রকাশ্যেও, গোপনেও। তিনি আমাদের সমস্ত অবস্থা অবগত। এ অনুভূতি আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে জাগ্রত থাকা উচিত। ভয় ও আশার মধ্যে ভারসাম্য রেখে আমরা যেন আমাদের রবের দিকে এগিয়ে যাই। মুমিনের জন্য ভয় ও আশা এই দুইটি গুণ পাখির দুইটি ডানার মতো। একটির অভাবেও উড্ডয়ন সম্ভব নয়। আল্লাহর দিকে সম্পূর্ণভাবে মনোযোগী হতে হবে, যেন আমাদের হৃদয় পূর্ণ হয় আল্লাহর ভালোবাসায়, আমাদের জিহ্বা ভরে উঠে রবের যিকিরে।আল্লাহর বিধান ও তাঁর গূঢ় রহস্যগুলো জানার সৌভাগ্যে যেন আমরা আনন্দে উদ্ভাসিত হই, খুশিতে উদ্বেল হই। প্রতিটি সিজদায় যেন আমরা কাঁদতে কাঁদতে দোয়া করি হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য বিশুদ্ধ ইলমের দরজা খুলে দিন, আমাদের উপকারী ইলম দান করুন। যদি আমরা আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বস্ত হই, তবে তিনি আমাদের তাওফিক দান করবেন, আমাদেরকে রাব্বানী আলেমদের মর্যাদায় উন্নীত করবেন।
.
(৬).সময়ের সদ্ব্যবহার করা: ওহে বুদ্ধিমান ভাই বোন,আপনার যৌবনকে, জীবনকালকে ইলম অর্জনে দ্রুত কাজে লাগান। এই তো করব, আগামীতে করব এ ধরণের ধোকা যেন আপনাকে প্রবঞ্চিত না করে। আপনার জীবন থেকে যে ঘণ্টাটি চলে যাচ্ছে সেটার কোন প্রতিস্থাপন নেই, সেটার কোন বদলি নেই। আপনার পারিপার্শ্বিক ব্যস্ততা, লক্ষ্যপানের পথে প্রতিবন্ধকতা, সর্বোচ্চ পরিশ্রম ও উদ্দীপনা বিনিয়োগের রাস্তায় বাধা-বিপত্তি যতটুকু সম্ভব সরিয়ে ফেলুন। কেননা এ বাধাগুলো হচ্ছে যাত্রাপথের দস্যুর মত। এ কারণে সলফে সালেহীন (নেককার পূর্বসূরিরা) পরিবার থেকে দূরে ও স্বদেশ ত্যাগ করে ইলম হাছিল করাকে মুস্তাহাব মনে করতেন। কেননা চিন্তা-ভাবনা যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় সেটা গূঢ় রহস্য ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝার ক্ষেত্রে অযোগ্য হয়ে পড়ে। আল্লাহ্ তাআলা একজন লোকের অন্তরে দুটো অন্তর রাখেননি। জেনে রাখুন: আপনি যদি ইলমের প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ ও আন্তরিকতা না দেন, তাহলে ইলমও আপনাকে তার সামান্যটুকুও দিবে না।
.
(৭) সতর্কতা অবলম্বন: ইলম অর্জনের সূচনালগ্নে আমরা আলেমদের মতভেদ কিংবা সাধারণ মানুষের মতভেদের পেছনে পড়ব না। কারণ এটি স্মৃতিকে হয়রান করে ফেলে, বিবেক-বুদ্ধিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। নানাবিধ কিতাবপুস্তক থেকেও আমরা সতর্ক থাকব। কেননা এতে আমাদের সময় নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমাদের চিন্তা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। বরং আপনি আমি যে কিতাব পড়ছি বা যে বিষয়টি পড়ছেন সেটাকে আত্মস্থ করার জন্য আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করুন। কোন কারণ ছাড়া এক কিতাব থেকে আরেক কিতাবে স্থানান্তরিত হওয়া থেকে সতর্ক থাকুন। কারণ এটি অস্বস্তি ও বিফলতার আলামত। আমাদের উচিত সর্বপ্রথম, প্রতিটি শাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়সমূহ বিশেষ করে আক্বীদা সংক্রান্ত জ্ঞান আয়ত্তে আনা। এরপর ধাপে ধাপে অন্যান্য অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিংবা এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি অগ্রসর হওয়া।
.
(৮).পাকাপোক্তভাবে মুখস্ত করা: আপনি যা মুখস্ত করতে চান সেটা কোন যোগ্য সালাফি শাইখের তত্ত্বাবধানে কিংবা অন্য কারো সহযোগিতা নিয়ে সুনিপুনভাবে শুদ্ধ করে নিতে সচেষ্ট হোন; এরপর পোক্তভাবে মুখস্ত করুন। এরপর দিনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে বারবার আওড়াতে থাকুন যাতে করে আপনি যা মুখস্ত করেছেন তা ভুলে না যান এবং স্মৃতি আরও দৃঢ় হয়।কোন কোন আলেম এমন কিছু খাবারের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো মুখস্তশক্তি বৃদ্ধি করে। যেমন মধু ও কিসমিস খাওয়া এবং বিশেষ কিছু সুইংগাম চিবানো।ইমাম যুহরী বলেন: তুমি মধু খাবে; কারণ এটি স্মৃতিশক্তির জন্য ভাল। তিনি আরও বলেন: যে হাদিস মুখস্ত করতে চায় সে যেন কিসমিস খায়।(খতীব আল-বাগদাদীর ‘আল-জামে খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৯৪)। ইব্রাহিম বলেন: তোমরা সুইংগাম খাবে। এটি অন্তরকে উদ্বুদ্ধ করে, ভুলে যাওয়াকে বিদূরিত করে।(খতীব আল-বাগদাদীর আল-জামে খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৯৭) আলেমগণ আরও বলেন: অম্লজাতীয় খাবার স্মৃতিশক্তির জড়তা ও মুখস্তশক্তির দুর্বলতা বাড়ায়। পাশাপাশি পাপ কাজ পরিহার করাও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।খতীব আল-জামে নামক গ্রন্থে ইয়াইয়া বিন ইয়াহইয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, এক লোক মালেক বিন আনাসকে বললেন: হে আবু আব্দুল্লাহ! মুখস্তশক্তি বাড়ানোর কোন কিছু আছে কি? তিনি বলেন: যদি কোন কিছু থাকে তাহলে সেটা হল: গুনাহ পরিত্যাগ করা। যখন কোন মানুষ গুনাহ করে তখন এ গুনাহটি তাকে ঘিরে রাখে এবং গুনাহর ফলে তাকে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা পেয়ে বসে। সে গুনাহর কারণে তার চিন্তাধারা মশগুল হয়ে থাকে। এভাবে এ দুশ্চিন্তা তার অনুভূতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে এবং তাকে অনেক কল্যাণকর কাজ থেকে দূরে রাখে। এর মধ্যে মুখস্তশক্তি অন্যতম।(খতীব আল-বাগদাদীর আল-জামে/খণ্ড:২; পৃষ্ঠা: ৩৮৭)।
.
(৯): কিতাব অধ্যয়ন: অধ্যয়নের শুরুতে সংক্ষিপ্ত ও সহজপাঠ্য পুস্তিকাগুলো মুখস্থ করা, সেগুলোর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ গভীরভাবে আত্মস্থ করা, এবং এগুলোর মধ্যে নিহিত গুরুত্বপূর্ণ জটিলতা ও মূল্যবান ফায়দাগুলো রপ্ত করা উচিত। এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের পর ধাপে ধাপে বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থপাঠে মনোনিবেশ করতে হবে। প্রতিনিয়ত অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অধ্যয়নের সময় যখনই কোনো মূল্যবান ফায়দা, সূক্ষ্ম মাসআলা, বিরল বা গভীর শাখাগত মাসআলা, জটিল বিষয়ের সমাধান কিংবা সমজাতীয় বিধানসমূহের মাঝে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য চোখে পড়বে, তখনই তা সংরক্ষণযোগ্য মনে করে সঙ্গে সঙ্গে নোট করে রাখতে হবে।এই নিয়মটি সকল শাস্ত্র ও বিদ্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনো একটি ফায়দা শুনলে কিংবা কোনো একটি কায়েদা জানলে সেটিকে তুচ্ছ বা সামান্য মনে করা যাবে না; বরং তা গুরুত্বের সাথে লিখে রাখা এবং সম্ভব হলে মুখস্থ করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা চাই। তাই আপনার বেশি ইলম অর্জন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অল্পেতে তুষ্ট হবেন না। নবীদের মীরাছ সামান্যটুকু পেয়ে আপনি তৃপ্ত হবেন না। কোন একটি ফায়েদা অর্জন করার সুযোগ থাকলে সেটা হাত ছাড়া করবেন না। আগামীতে শিখব এ ধোকা যেন আপনাকে প্রবঞ্চিত না করে। কারণ রেখে দেয়ার অনেক সংকট আছে। আর আপনি বর্তমান সময়ে যদি এই ফায়েদাটা শিখে ফেলতে পারেন দ্বিতীয় সময়ে আপনি অন্য কিছু শিখতে পারবেন। বেকারত্ব কিংবা দায়িত্বের প্রতিবন্ধকতা আসার পূর্বে আপনি আপনার অবসর ও কর্মোদ্দীপনাময় সময়কে কাজে লাগান। সুস্থতা ও যৌবনকালকে গনীমত মনে করুন। আপনার স্মৃতির নির্মলতা ও ব্যস্ততার স্বল্পতাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন।আপনার যে কিতাবগুলো প্রয়োজন সেগুলো পাওয়ার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করুন। কেননা কিতাব হচ্ছে ইল্ম অর্জনের মাধ্যম। কোন উপকার ছাড়া বেশি বেশি কিতাব সংগ্রহ করা যেন আপনার ইল্মী অর্জন না হয়, আপনার বোধশক্তির অংশ না হয়। বরং আপনার কর্তব্য হচ্ছে সাধ্যানুযায়ী কিতাবগুলো থেকে ফায়েদা নেয়ার চেষ্টা করা।
.
(১০).ইলম অর্জনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়া: ইলম অর্জনের পথে আপনার অন্তরে গভীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক। আপনি যদি অধিক জ্ঞান লাভের সক্ষমতা রাখেন, তবে অল্পতে সন্তুষ্ট হয়ে থেমে যাবেন না। নবীগণের উত্তরাধিকার এই মহামূল্যবান মীরাছ এর ক্ষুদ্রাংশে তুষ্ট হওয়া একান্ত অনুচিত। জ্ঞানের কোনো দ্বার যদি আপনার জন্য উন্মুক্ত থাকে, তাহলে তা হাতছাড়া করা উচিত নয়।”পরে শিখব” এই ধোঁকায় যেন আপনি প্রতারিত না হন। ভবিষ্যতের উপর নির্ভরতা এক ধরনের অদূরদর্শিতা। মনে রাখবেন, পরবর্তী সময়ে নানা ব্যস্ততা, দায়িত্ব কিংবা শারীরিক অক্ষমতা আপনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই বর্তমানকেই সর্বোত্তম সময় হিসেবে বিবেচনা করুন। আজ আপনি একটি ফায়েদা অর্জন করলে আগামীকাল আরেকটি অর্জনের সুযোগ পাবেন। আপনার অবসর সময় ও কর্মস্পৃহাকে কাজে লাগান। বেকারত্ব বা দায়িত্বের ভার আসার আগেই জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে নিন। সুস্থতা ও যৌবনকালকে গনীমত মনে করুন এ সময়টাই আপনার মূল পুঁজি। স্মৃতিশক্তির প্রখরতা ও ব্যস্ততার স্বল্পতা এই দুটিকে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করুন।যেসব কিতাব আপনার ইলম অর্জনের জন্য অপরিহার্য, তা সংগ্রহে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। কারণ কিতাবই হলো ইলমের মূল উৎস। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে কেবলমাত্র সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বই সংগ্রহ করা যেন আপনার ইলমী জীবনের উদ্দেশ্য না হয়ে ওঠে। বরং প্রতিটি কিতাব থেকে যথাযথ উপকার গ্রহণ করাই হওয়া উচিত আপনার মূল লক্ষ্য। কিতাবগুলো আপনার চিন্তাশক্তির অংশ হোক, আপনার অন্তরের আলো হোক।
.
(১১):সঙ্গি নির্বাচন করা: আপনি এমন একজন বন্ধুকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণে সচেষ্ট হোন, যিনি নেককার, ইলম অর্জনে ব্যস্ত, সদাচরণে অভ্যস্ত এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী। যিনি আপনাকে আল্লাহর দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন, যখন আপনি পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় থাকবেন তখন আপনাকে দৃঢ় রাখবেন। যদি কোনো কল্যাণ হাতছাড়া হয়, তিনি তা পূরণে আপনাকে সহযোগিতা করবেন। বেশি ইলম ও হিকমত অর্জনের জন্য আপনাকে উৎসাহিত করবেন। আপনার ক্লান্তি ও অস্থিরতা দূর করতে চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গী যেন দ্বীনদার হয়, চরিত্রে বিশ্বস্ত হয় এবং আল্লাহর জন্য পরামর্শদাতা হয় নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক।অন্যদিকে, অসৎ সঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। কারণ, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি সহজেই প্রভাবিত হয় সঙ্গীর দ্বারা, কখনো তা অজান্তেই ঘটে। মানুষ মূলত পাখির ঝাঁকের মতো একজন আরেকজনকে অনুসরণ করে। তাই এমন কারও সান্নিধ্যে যাবেন না, যার আচরণ ও চরিত্র আপনাকে ভুল পথে টেনে নিতে পারে। কারণ, মন্দ সঙ্গ একটি সংক্রামক রোগের মতো আক্রান্ত হওয়ার আগে সতর্ক হওয়া সহজ, কিন্তু একবার আক্রান্ত হলে মুক্তি পাওয়া কঠিন। আবূ মূসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সৎসঙ্গী ও অসৎসঙ্গীর উদাহরণ আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের ন্যায়। আতর বিক্রেতাদের থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসবে না৷ হয় তুমি আতর খরীদ করবে, না হয় তার সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের হাপর হয় তোমার ঘর অথবা তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, না হয় তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে”।(সহীহ বুখারী, হা/২১০১) অপর বর্ননা আরও এসেছে “ঈমানের সবচাইতে মজবুত হাতল হল, আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, আল্লাহর ওয়াস্তে শত্রুতা স্থাপন করা, আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসা রাখা এবং আল্লাহরই ওয়াস্তে ঘৃণা পোষণ করা।” (ত্বাবারানী,সিলসিলাহ সহীহা হা/ ১৭২৮)।
.
(১২).উস্তাদের সাথে আদব রক্ষা করা : প্রাথমিক স্তরের ইলম কিতাবের বুক থেকে গ্রহণ করা যায় না। বরঞ্চ অবশ্যই একজন যোগ্য শাইখ থেকে নিতে হয়; মৌলিক জ্ঞানগুলো যার রপ্ত আছে; যাতে করে স্খলন থেকে নিরাপদ থাকা যায়। আপনার কর্তব্য হচ্ছে শাইখের সাথে আদব রক্ষা করে চলা। কেননা এটাই হচ্ছে আপনার কল্যাণ, সফলতা এবং ইলম হাছিলের চাবিকাঠি। আপনার শাইখ যেন আপনার সম্মান, মর্যাদা ও কোমল আচরণের পাত্র হন। আপনি আপনার শাইখের সাথে যাবতীয় আদব রক্ষা করে চলবেন: তাঁর সাথে বসার ক্ষেত্রে, কথা বলার ক্ষেত্রে, প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে, শ্রবণ করার ক্ষেত্রে, তার সামনে কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টানোর ক্ষেত্রে, তার সামনে উচ্চবাচ্য পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে, কোন কথা বা হাঁটার মাধ্যমে তাঁর অগ্রবর্তী না হওয়া, তার সামনে অধিক কথা না বলা, নিজের কথা দিয়ে তার দরসের মধ্যে সংযোজনী না দেয়া, কোন জবাব দেয়ার জন্য চাপাচাপি না করা, অধিক প্রশ্ন না করা বিশেষত অনেক মানুষের উপস্থিতিতে। কেননা এটি আপনাকে প্রবঞ্চিত করবে, আপনার বিরক্তির উদ্রেক করবে। আপনি শাইখকে তার নাম ধরে বা কুনিয়ত ধরে ডাকবেন না। বরং এভাবে বলবেন: ইয়া শাইখি (হে আমার শাইখ) কিংবা বলবেন: ইয়া শাইখানা (হে আমাদের শাইখ)।যদি আপনার কাছে শাইখের কোন ভুল চোখে পড়ে কিংবা কোন বিস্মৃতি ধরা পড়ে তাহলে এটার কারণে আপনার চোখে যেন শাইখের মর্যাদা খাটো হয়ে না যায়। কেননা এটি আপনার ইল্ম থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। ভুল থেকে বাঁচতে পারেন এমন কেউ কি আছে?।[যানার জন্য দেখুন: শাইখ বাকর আবু যায়েদ এর ‘হিলাতু তালিবুল ইলম] আমরা আল্লাহ্র কাছে আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য তাওফিক ও অবিচলতা প্রার্থনা করছি। তিনি যেন আমাদেরকে সেই দিনটি দেখান যেই দিন আপনি আলেম হবেন, আল্লাহ্র দ্বীনের জন্য সকলের রেফারেন্স হবেন, মুত্তাকীদের ইমাম হবেন। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৩২৪)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment