Friday, April 1, 2022

ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি শিয়াদের আসল চেহারা

 ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি শিয়াদের আসল চেহারা

মূল: প্রফেসর ডক্টর সুলাইমান বিন সালিহ আল গুসন
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

الْحَمْدُ لِلّهِ والصَّلاَةُ السَّلامُ عَلي رَسُوْلِ اللهِ وعَلى آلِه وصَحْبِه ومَنْ وَالَاه وبَعْدُ

ভূমিকা:

হুতি নামটি বর্তমানে অনেকের কাছে পরিচিত। ইয়েমেনে যাদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ‘আসিফাতুল হাযম’ নামে একটি যুদ্ধ পরিচালিত করেছে। কিন্তু বাংলাভাষী অনেকেই এই হুতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। ফলে বিভিন্ন শিয়া প্রভাবিত এবং ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়ার কারণে অনেকে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। অথচ মুসলিম বিশ্বের উপর এই ঘটনা-প্রবাহের সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে-তাতে কোন সন্দেহ নাই। তাই এ সম্পর্কে মুসলিম যুবকদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী।

এই প্রেক্ষাপটে সউদী আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত কিং সউদ ইউনিভার্সিটি’র ‘আকিদা ও সমকালীন মতবাদ’ এর অধ্যাপক প্রফেসর ডক্টর সুলাইমান বিন সালিহ আল গুসন রচিত বক্ষ্যমাণ পুস্তিকাটি অনুবাদ করা হল যেন, বাংলাভাষী মুসলিমগণ এই ফিতনার ব্যাপারে সচেতন হতে পারে।

অত্র পুস্তিকাটিতে শিয়া হুতি সম্প্রদায়ের উৎস, পরিচিতি, ক্রমবিকাশ, কার্যক্রম, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক ভাবে রাফেযীয়া-ইমামিয়া-ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা তার জমিনে সত্যের পতাকা উড্ডীন করুন। বাতিল ও মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

অনুবাদক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
তারিখ: ১৯-০৪-২০১৫ইং
——————————

❑ হুতিদের উৎস ও পরিচয়:

হুতিরা হল, উত্তর ইয়েমেনের সা’দাহ[1] এলাকার একটি সম্প্রদায়ের নাম। এদের উৎপত্তি জারুদিয়া সম্প্রদায় থেকে। জারুদিয়ারা হল, শিয়া-যায়দিয়াদের একটি গোঁড়া ও উগ্রপন্থী ফিরকা।

হুতিরা রাফেযীয়া-ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের মত উগ্রপন্থী আকিদা-বিশ্বাস প্রচার শুরু করে এবং ইরানের সাহায্য-সহযোগিতা ও আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে শিয়া বিপ্লবের নায়ক খোমেনির আদর্শ ও পদ্ধতির আলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতে থাকে।

হুতি সম্প্রদায়ের পরিচয়ের আগে জারুদিয়াদের সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। যাতে স্পষ্ট হয়, জারুদিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এই হুতি এবং রাফেযী ইসনা আশারিয়াদের মাঝে কতটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে আর কিভাবে তারা ইমামিয়া-ইসনা আশারিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

❑ জারুদিয়া সম্প্রদায়ের পরিচয়:

প্রতিষ্ঠাতা: জারুদিয়ার সম্প্রদায়টির নাম করণ হয় আবুল জারুদ নামক এক ব্যক্তির নামানুসারে। তার পুরো নাম, যিয়াদ বিন মুনযির আল হামাদানী আল কূফী।

আহলে সুন্নাহ’র পূর্বসূরি ইমামগণ এ ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[2] শুধু তাই নয়, শিয়াদের কিছু বই-পুস্তকেও তার বদনাম করা হয়েছে।[3]

❑ জারুদিয়াদের কিছু মৌলিক আকিদা:

১) তারা বিশ্বাস করে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরে খলীফা হিসেবে আলী (রা.) কে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি আলী (রা.) এর নাম না নিলেও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার মাধ্যমে তাঁকেই বুঝিয়েছিলেন।
২) তাদের মতে, আলী (রা.) এর মর্যাদা অন্য সকল সাহাবীর চেয়ে বেশী।
৩) আলী (রা.) এর পরে ইমাম হবে কেবল হাসান-হুসাইন ও তাদের বংশধরের মধ্য থেকে।
৪) তারা সাহাবীদেরকে কাফের মনে করে। কারণ, সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরে আবু বকর (রা.) কে খলীফা হিসেবে মনোনীত করেছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বলে যাওয়া গুণ-বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সে বৈশিষ্ট্যের আলোকে তারা আলী (রা.) কে খলীফা নিয়োগ করে নি। [4]
৫) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরে যারা আলী এবং তাঁর বংশধর থেকে ইমাম হওয়াকে আবশ্যক মনে করে না তারা কাফের।
৬) আবু বকর (রা.)ও উমরা (রা.)থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তাদেরকে গালাগালি করা। অনুরূপভাবে আয়েশা (রা.), মুয়াবিয়া (রা.)এবং আমর ইবনুল আস (রা.)কে গালাগালি করা।
৭) জারুদিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মনে করে যে, তাদের যে সব ইমাম মারা গেছে তারা পুনরায় ফিরে আসবেন।
৮) তাদের মধ্যে অনেকে মুতা বিবাহ (চুক্তি ভিত্তিক সাময়িক বিয়ে)কে বৈধ মনে করে।[5]
জারুদিয়াদের এসব আকিদা দেখলে বুঝা যাবে, তারা রাফেযীয়া- জাফরিয়া- ইমামিয়া- ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে।

❑ হুতিদের ইতিহাস এবং প্রেরণার উৎস:

হুতিদের চরমপন্থি নেতা নাম হুসাইন বিন বদরুদ্দীন হুতি। তার পিতা বদরুদ্দীন বিন আমীরউদ্দিন আল হুতি হল তাদের ধর্মগুরু এবং রূহানী নেতা।

এই ধর্মগুরু ১৩৪৫ হিজরিতে উত্তর ইয়েমেনের সা’দাহর উপকণ্ঠে জন্ম গ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। তাকে জারুদিয়াদের বড় আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হয়।

যায়দিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় আলেমদের সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ইরান চলে যান এবং তেহরানে কয়েক বছর বসবাস করেন। পরবর্তীতে সমঝোতার মাধ্যমে তাকে নিজ এলাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি ১৪৩১ হিজরির যিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে মৃত্যু বরণ করেন।

হুসাইন বিন বদরুদ্দীন হুতি হল বদরুদ্দীনের বড় ছেলে। তিনি সা’দায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তারপর সুদান থেকে শরীয়া বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করার পর ডক্টরেট শুরু করেন। কিন্তু পড়ালেখা বাদ দিয়ে দেন এবং মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন এই যুক্তিতে যে, একাডেমিক সার্টিফিকেট জ্ঞান-বুদ্ধিকে জমাটবদ্ধ করে দেয়।

১৯৯০ সালে ইয়েমেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর যখন রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়ত তখন হুসাইন হুতি শিয়া ‘হিযবুল হক’ নামক একটি দল প্রতিষ্ঠায় অংশ গ্রহণ করেন এবং দলের পক্ষ থেকে তিনি ১৯৯৩-১৯৯৭ইং সেশনের জন্য পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।

এদিকে দক্ষিণ ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কম্যুনিস্টরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে হুসাইন হুতি তাদের পক্ষাবলম্বন করেন। যার কারণে সরকার তার বসত বাড়িতে সশস্ত্র অভিযান চালায়। ফলে তিনি সুদান পালিয়ে যান এবং সুদান থেকে ইরানে আত্মগোপন করে। অত:পর ইরানের কুম শহরে তার পিতার সাথে কয়েক মাস অবস্থান করেন।

সেখান থেকে লেবানন যান হিযবুল্লাহ গ্রুপের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য।

এ দিকে সরকার তার প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করলে তিনি পুনরায় ইয়েমেনে ফিরে আসেন।

ইয়েমেনে ফিরে আসার পর তিনি তার ভক্ত ও অনুসারীদের মাঝে বক্তৃতা ও দরস দেয়া শুরু করেন এবং বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যেগুলোতে শতশত ছাত্র ভর্তি হয়।

❑ আশ শাবাবুল মুমিন (মুমিন যুবক) নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা:

বদরুদ্দীন হুতি হিযবুল হক দলের সহ সভাপতি হিসেব কাজ করতেন। কিন্তু সংগঠনের সভাপতি মাজদুদ্দীন আল মুয়াইদীর সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। মতবিরোধের কারণ ছিল দুটি:

১) ইমামিয়া মাসয়ালায় হুতি এবং তার অনুসারীদের গোঁড়ামিপূর্ণ ধ্যান-ধারণা পোষণ করা।

২) ইরানের খোমেনি বিপ্লবের আদর্শের দিকে প্রচণ্ড ভাবে ঝুঁকে পড়া।

এই মতবিরোধের জের ধরে হুতি এবং তার অনুসারীরা হিযবুল হক থেকে বের হয়ে আশ শাবাবুল মুমিন (মুমিন যুবক) সংগঠনে যোগ দেয়। যে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তারা ইতোপূর্বে ১৯৯৭ সালে অংশ গ্রহণ করেছিল।

ইরান এবং তৎকালীন ইয়েমেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আশ শাবাব সংগঠনটি তাদের কর্মপরিধি বৃদ্ধি করে উত্তর ইয়েমেনের সাদাহ অঞ্চল সহ কয়েকটি জেলার অনেক যুবক,অল্প বয়সী তরুণ এবং বিভিন্ন গোত্রের সাধারণ জনগণকে তাদের দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়।

১৯৯৭ সালে বদরুদ্দীন হুতি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তার সংগঠনের কাজে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে।

এরপর শিয়া রাফেযী, ইমামিয়া, ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় সাধন করে তাদের সাথে একীভূত হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে এবং ইরান বিপ্লবের স্তুতি গাইতে থাকে-যাতে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তারা ইয়েমেনের মাটিতে বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হয়।

তারপর তিনি তার অনুসারীদেরকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করেন এবং তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যেন তারা অন্ধভাবে তার নির্দেশ পালন করে।

তারপর ইয়েমেন সরকারের জুলুম-শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেয় এবং বাস্তবেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়ে। ২০০৪ সালে সরকারী বাহিনীর সাথে হুতি বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু এ বছরই তিনি সরকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। তার নিহত হওয়ার মাধ্যমে এসব আক্রমণ ও যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

✪ আব্দুল মালিক হুতি:

হুসাইন হুতি নিহত হওয়ার পর তার ভাই আব্দুল মালিক হুতি আশ শাবাব সংগঠনের নেতৃত্বে আসে। তিনি ছিলেন প্রভাব সৃষ্টিকারী সুবক্তা। তিনি তার ভায়ের পদাঙ্ক অনুসরণে ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধ বিদ্রোহী আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

✪ হুতিদের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আকিদা ও মতবাদ:

কতিপয় গবেষক নিশ্চিতভাবে বলেছেন যে, হুসাইন হুতি শিয়াদের ইমামি ইসনা আশারিয়া মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার লিখিত বই-পুস্তক এবং বক্তৃতার বিভিন্ন ক্যাসেট দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়।

হুতিদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, বক্তৃতা এবং কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে তাদের বেশ কিছু আকিদা ও মতবাদ স্পষ্ট হয়। সেগুলোর সারাংশ নিম্নরূপ:

১) তাদের দাওয়াতের মূল কথা হল,

● ক) ইমামিয়া আকিদাকে মজবুত করা।

● খ) এই আকিদা পোষণ করা যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরে আলী (রা.) কে খলীফা হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন।

● গ) আলী (রা.) এর পরে ইমাম হবেন হাসান (রা.) এবং হুসাইন (রা.)।

● ঘ) ইমাম হওয়ার পরম্পরা হাসান-হুসাইন (রা.) এর বংশধর থেকে কখনো বাইরে যাবে না।

● ঙ) কোন ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম আকিদা পোষণ করলে সে কাফের।

২) খুলাফায়ে রাশেদীন-বিশেষ করে তিন খলীফা (আবু বকর (রা),উমর (রা.),এবং উসমান (রা.) থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং অন্যান্য সাহাবীদেরকে কাফের মনে করা। কারণ, তাদের আকিদা হল, মুসলিম বিশ্বে আজ পর্যন্ত যত ফেতনা-ফ্যাসাদ আর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণ হল, এই তিন খলীফা সহ অন্য সাহাবীগণ।

বদরুদ্দীন হুতি বলেন,“আমি বিশ্বাস করি,তারা (অর্থাৎ সাহাবীরা) কাফের। কারণ,তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে।”

হুসাইন হুতি নিশ্চিত করে বলেন,

“আবু বকর এর বাইয়াত গ্রহণের অনিষ্ট এবং কুপ্রভাব এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণেই মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং শত্রুরা মুসলিম জাতির উপর চড়াও হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন যে, আবু বকর, উসমান এবং মুয়াবিয়া সকলেই উমরের অন্যায় কার্যক্রমের ফসল।

৩) এ মর্মে দাওয়াত দেয়া যে,কেবল কুরআন অনুসরণ করতে হবে এবং কুরআন ছাড়া ইসলামী শরিয়ার অন্য সকল বিষয় বর্জন করতে হবে। কারণ তাদের মতে, হাদিস সাহাবী ও তাবেঈনদের মাধ্যমে বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণিত হয় নি। ফলে যে হাদিস মুসলিম বিশ্বের কাছে যুগ পরিক্রমায় পরম নির্ভরতার সাথে গ্রহণীয় হয়ে আসছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য শরঈ উৎস নয়। এ কারণে, তারা সহীহ বুখারি ও মুসলিমকে সরাসরি কটাক্ষ করে থাকে।

৪) তাদের দাবী হল,তাফসীর এবং উসুলে ফিকহের ক্ষেত্রে হাদিসকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। এর মূল উদ্দেশ্য হল,এই মতবাদে বিশ্বাসীরা যেন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থেকে অন্ধভাবে তাদেরকে অনুসরণ করে। এভাবে অনুসারীদেরকে মূল রহস্য সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করা যাবে এবং অন্যান্য রাফেযী আকিদা গ্রহণ করানো সহজ হবে।

৫) জনগণকে উত্তেজিত করে সেই জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার আহবান জানানো যাদের মধ্যে ইমাম হওয়ার শর্তাবলী বিদ্যমান নয়। তাদের মতে ইমাম হওয়ার অন্যতম শর্ত হল,হাসান ও হুসাইন (রা.) এর বংশোদ্ভূত হওয়া।

এ ধরণের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

সংগঠনের সদস্য ও সহযোগী লোকজনকে নিশ্চিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করে ব্যাপক অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তোলার আহবান জানানো।

৬) আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের লোকদেরকে এই যুক্তিতে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা যে, তারা তাদের সন্তানদেরকে বাতিল আকিদা শিক্ষা দিচ্ছে। যে কারণে ইতিহাস পরিক্রমায় মুসলিম জাতিকে খেসারত দিতে হচ্ছে।

আহলে সুন্নাহর লোকদেরকে বয়কট করা। কারণ, তারা আবু বকর (রা.), উমর (রা.) ও উসমান (রা.)কে ভালবাসে এবং তাদেরকে আলী এর উপর অগ্রাধিকার দেয়।

৭) ইরানের খোমেনী বিপ্লব এবং লেবাননের হিযবুল্লাহকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা। কারণ, তারা মনে করে সম্মান, মর্যাদা এবং মুক্তির জন্য এগুলোকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা কর্তব্য।

৮) মানুষের অনুভূতি ও চেতনায় উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য ইরান থেকে আমদানি করা কিছু অন্তঃসারশূন্য শ্লোগান দেয়া। যেমন: আমেরিকা ধ্বংস হোক, ইসরাইল ধ্বংস হোক, ইহুদিদের উপর লানত, ইসলামের বিজয়…ইত্যাদি।

৯) তাদের শিয়া যায়দিয়া সম্প্রদায়ের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য সমালোচনা ও কান্নাকাটি করা এবং সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে তাদেরকে বিপ্লবের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।

১০) তাদের অনুসারীদেরকে আহলে সুন্নতের তথাকথিত ‘ওয়াহাবী’দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং হারামাইনের দেশকে তাদের কবল থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানানো।

আহলে সুন্নাহর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিন্তাকে বোকামি প্রসূত চিন্তা বলে আখ্যায়িত করা।

১১) গাদ্দারি, বিশ্বাস ঘাতকতা এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ ইত্যাদি অপকর্মে হুতিদের খ্যাতি রয়েছে।

✪✪ ইরান এবং শিয়া-ইসনা আশারিয়া মতবাদের সাথে হুতিদের সম্পর্ক:

যায়দিয়া সম্প্রদায়ের কিতাবাদি রাফেজী-ইমামিয়া-ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সমালোচনায় ভরপুর..বরং তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট ও কাফির হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ইমামিয়াদের কিতাবাদী যায়দিয়াদের সমালোচনা ও কুফরির ফতোয়ায় পরিপূর্ণ।[6]

এমন পরস্পর বিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার পরও ইরানী বিপ্লব ‘তাকিয়া’ (তথা চরম গোপনীয়তা রক্ষা) নীতির অন্তরালে যায়দিয়াদের কাতারে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী হুতি জারুদীদের চিন্তা-চেতনার মাঝে তাদের হারানো মানিকের সন্ধান পায়।

তারা দেখল ইয়েমেনের মাটিতে তাদের বিপ্লব ও আকিদা-বিশ্বাস রপ্তানির জন্য হুতিরা সবচেয়ে ভালো প্রতিনিধি, অনুগত ছাত্র বা সৈনিক হওয়ার উপযুক্ত। এদের মাধ্যমেই ইয়েমেনে তাদের আদর্শ,চিন্তা-চেতনা ও মতবাদ প্রচার করার পাশাপাশি তাদের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

উল্লেখ্য যে,বদরুদ্দীন হুতি এবং তার ছেলে হুসাইন হুতি ইতোপূর্বে ইরানে বসবাস করে রাফেযী আকিদা এবং ব্যাপক-বিস্তর বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা গলধঃকরণ করে এসেছে।

এটাও অজানা নয় যে,এই হুতি ইরানের খোমেনী বিপ্লবের প্রতি মুগ্ধ। তিনি এই বিপ্লবকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে থাকে। তিনি এটিকে আল্লাহর রহমত ও নিয়ামত মনে করেন। তিনি বলেন, “ইমাম খোমেনী ছিলেন একজন ন্যায়-নিষ্ঠ ইমাম। আল্লাহ ভীরু ইমাম। তিনি এমন ন্যায় পরায়ণ ইমাম ছিলেন যার দুয়া বিফলে যায় না।”

ইয়েমেনের যায়দিয়া সম্প্রদায়ের আলেমগণ এ মর্মে সতর্ক করেছিলেন যে, হুতিরা গোঁড়া ও বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসনা আশারিয়া মতবাদ ও কর্মপদ্ধতি বহন করছে। এ ব্যাপারে তারা একটা বিবৃতিও প্রকাশ করেছিল।

বাস্তবেই হুতিদের হাত ধরেই ইসনা আশারিয়া এবং ইরান বিপ্লবের সাথে যায়দিয়াদের ঐকমত্য সৃষ্টি ও কাছাকাছি আসার প্রবণতা বিস্তার লাভ করে।

◍◍ ইরান এবং শিয়া-ইসনা আশারিয়া মতবাদের সাথে হুতিদের সম্পর্কের প্রমাণ:

ধারাবাহিক ভাবে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে গভীর সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:

১) ‘গাদির খুম’ দিবস পালন করা। এটি ইয়েমেনের মাটিতে একটি নতুন বিষয়। এ দিন তারা বড় বড় মিছিল বের করে। এতে থাকে চমকপ্রদ নানা শ্লোগান আর বক্তৃতা।

হুসাইন হুতি তার এক বক্তৃতায় বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী বিন আবি তালিব (রা.)কে উম্মতের জন্য পরবর্তী খলীফা ঘোষণা করার আগে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন নি।

২) হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত দিবস পালন এবং এ উপলক্ষে হুসাইনী মাহফিলের আয়োজন করা।

৩) আবু বকর (রা.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণকারী সকল সাহাবী এবং তাদের পথের অনুসারী সকল মানুষকে কাফের মনে করা।

এ প্রসঙ্গে হুসাইন হুতি এক দরসে বলেন, আলী’র ইমামত ও খেলাফত বিষয়ে যাদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ পৌঁছার পরও তা অমান্য করে তারা কাফের।

৪) হুতি ও ইরানীদের মাঝে একাধিক দ্বিপাক্ষিক সফর এবং গোপন বৈঠকের আয়োজন করা।

ইরাকে অবস্থিত ইরান দূতাবাসের পক্ষ থেকে ইসনা আশারিয়া আকিদার প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে নাজাফে ইয়েমেনি হুতিদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৫) হুতিদের পক্ষ থেকে ইরানী বিপ্লব ও পদ্ধতির প্রশংসা করা এবং তাদের শ্লোগান ব্যবহার করা। অনুরূপভাবে লেবাননের হিযবুল্লাহর শ্লোগান ব্যবহার করা এবং তাদের কোন কোন সেন্টারে হিযবুল্লাহর পতাকা উত্তোলন করা।

৬) ইরানের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, বক্তৃতা-বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে হুতিদের এবং ইয়েমেনে তাদের বিপ্লবী কার্যক্রমকে মিডিয়া গত সাপোর্ট দেয়।

৭) ইরান এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের রাফেযীদের পক্ষ থেকে ইয়েমেনে হুতিদের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার সুযোগে তাদের অনুসারী ও অনুরাগীদের মাঝে বিতরণের উদ্দেশ্যে প্রচুর আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করা হয়।

৮)ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহর পক্ষ থেকে হুতিদেরকে সামরিক সহায়তা প্রদান করা হয়। ইরানী অস্ত্র-শস্ত্র হুতিদের কাছে পৌঁছানো হয় বিভিন্ন পথে। তন্মধ্যে ইয়েমেনের বিভিন্ন দ্বীপ-উপদ্বীপ ও সমুদ্র বন্দর। এগুলো দিয়ে তেহরান থেকে পাঠানো অস্ত্রের চালান চোরাই পথে হুতিদের হাতে এসে পৌঁছে।

তাছাড়া ইরান ও লেবাননের অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা হুতি এবং তাদের সাথে যে সব রাফেযী এসে যুক্ত হয় তাদেরকে বিভিন্ন ধরণের উন্নতমানের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। যেন ইয়েমেনে হুতিদের একটি ক্ষমতা সম্পন্ন ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা সেখানে তাদের আলাদা মজবুত অবস্থান তৈরি হয়। যাদের মাধ্যমে ইয়েমেন ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ইরানী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা যায়-যেভাবে করা হয় লেবাননের হিযবুল্লাহর মাধ্যমে।

সম্প্রতি দেখা গেছে, সা’দাহ জেলা প্রশাসনের মদদে হুতিদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে এবং ইয়েমেনের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি,সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার দুর্বলতা, সেনাবাহিনীর অদক্ষতা, উন্নত ও আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের স্বল্পতা ও সর্বোপরি দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ইত্যাদির সুযোগে অন্যান্য এলাকা দখলের চেষ্টা করা হয়েছে।

হুতিরা আহলুস সুন্নাহর লোকদেরকে সা’দাহ জেলা থেকে বিতাড়নের চেষ্টা করত। এ জন্য তারা তাদেরকে নানা চাপের মুখে রাখত, চেক পয়েন্টে তাদেরকে তল্লাশি করত বরং পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছিল যে, তাদেরকে ঘেরাও করে তাদের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিত। যেমনটি ঘটেছে ইয়েমেনের দাম্মাজ এলাকায়। সেখানে উপর্যুপরি বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে তারা হত্যা করেছে।

৯) প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদির আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা। তারা দাবী করত যে, হুসাইন হুতি হল ইমাম মাহদি। তিনি নিহত হওয়া পর্যন্ত তাদের মাঝে এই বিশ্বাসই জীবিত ছিল। পরবর্তীতে ঘোষণা করা হল, তিনি উধাও হয়ে গেছেন। অবশেষে প্রায় দশ বছর পরে তার নিহত হওয়ার কথা তারা স্বীকার করেছে।

১০) ইসনা আশারিয়া আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি আহবান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ।

১১) ইরানের পক্ষ থেকে হুতি ও হুতি সমর্থক ছাত্রদেরকে পড়ালেখার জন্য ইরান নিয়ে আসা হয়। তারপর তাদের মাঝে ইমামিয়া রাফেযী আকিদা এবং খোমেনী বিপ্লবের চিন্তাধারার বীজ বপন করা হত যাতে এরা ইরানী শিয়া মতাদর্শের ধারক-বাহক, প্রচারক ও সৈনিক হিসেবে ফিরে আসে এবং এদের মাধ্যমে ইরানের পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

◍◍ রাফেযী সম্প্রদায়ের কতিপয় মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাস:

ইরান বিপ্লব যে মতাদর্শে বিশ্বাসী তা হল ‘ইমামিয়া ইসনা আশারিয়া’ মতবাদ। এটি একটি গোঁড়া শিয়া-রাফেযী ফিরকা।

এদের মৌলিক কিছু আকিদা নিম্নরূপ:

১) আল্লাহর সাথে শিরক: অর্থাৎ এ মতবাদে বিশ্বাসীরা তাদের ইমামদের নিকট দুয়া করে, তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে, তাদের কবরে যায় হজ্জ করার উদ্দেশ্যে, তাদের কবরে তওয়াফ করে, কবর জাপটে ধরে বরকত নেয়। এরা এই সব করবকে কাবা এবং বায়তুল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে।

২) তারা এ দাবী করে যে, ইমামত হল দীনের একটি রোকন বা স্তম্ভ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে গেছেন। তিনি ইমাম হওয়ার বিষয়টি বারো জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন।

৩) তারা বলে, ইমামগণ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। তারা নিষ্পাপ। তারা অদৃশ্যের সব খবর রাখেন এবং এ বিশ্বজগত পরিচালনায় তাদেরও ক্ষমতা রয়েছে।

৪) তারা মনে করে প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী বর্তমানে ইরাকের সিরডাপ সামুররায় আত্মগোপন করে আছে।

৫) তারা মনে করে কুরআনকে বিকৃত করা হয়েছে এবং তা অপূর্ণ।

৬) চারজন সাহাবী (আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা.) ছাড়া সব সাহাবীকে কাফের মনে করা এবং গালাগালি করা। বিশেষ করে আবু বকর (রা.), উমর (রা.), এবং আয়েশা (রা.),কে।

৭) ‘তাকিয়া’ (চরম গোপনীয়তা রক্ষা) নীতি অবলম্বন করা। এরা আহলে সুন্নাহর প্রতি ভয়ানক শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে কিন্তু বাহ্যিক আচরণে সেটা প্রকাশ করে না।

৮) তারা বাদাআত মতবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নিকট এমন কিছু প্রকাশিত হয় যা তিনি আগে জানতেন না। যার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।

৯) যে সব আহলে সুন্নতের লোকেরা তাদের বিরোধিতা করে তাদেরকে তারা শুধু কাফিরই মনে করে না বরং মনে করে তাদেরকে হত্যা করা এবং সম্পদ লুণ্ঠন করা তাদের জন্য বৈধ।

১০) মুতা বিবাহ তথা (শরীয়ত সম্মত বিবাহ ছাড়া) নারী সম্ভোগ করা বৈধ।

এই হল হুতি সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং তাদের কার্যক্রম, উৎস, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

আল্লাহর নিকট দুয়া করি, তিনি যেন তাদেরকে হেদায়েত দান করেন এবং মুসলমানদেরকে তাদের অনিষ্ট ও ষড়যন্ত্রের কবল থেকে হেফাজত করেন। নিশ্চয় তিনি এ সব ব্যাপারে ক্ষমতাশীল।

صَلَّى اللهُ عَلى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَ عَلَى آلِه وَصِحْبِه وَسَلَّمَ

———-টিকা———
[1] ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ২৪২ কি:মি: দূরে অবস্থিত একটি জেলা।

[2] দ্রষ্টব্য: মীযানুল ইতিদাল ২/৯৩, আল কামিল ৩/১০৪৬-১০৪৮

[3] দ্রষ্টব্য: রিজালুল কিশশী, পৃষ্ঠা নং ১৯৯, আল ফিহরিস্ত, ইবনে নাদীম, পৃষ্ঠা নং ২৫৩

[4] দ্রষ্টব্য: আল ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃষ্ঠা নং ৩০-৩২

[5] দ্রষ্টব্য: যিয়াদ ইবনে মুনযেরের জীবনী, মীযানুল ইতিদাল-ইমাম যাহাবী। রাফিযাতুল ইয়ামান, পৃষ্ঠা নং ১২৬-১২৮, মুহাম্মদ ইমাম, যায়দিয়া: পরিচয় ও আকিদা-বিশ্বাস, কাযী ইসমাইল আল আকওয়া, পৃষ্ঠা নং ২৪-২৫

[6] দ্রষ্টব্য:আল ইমামাতুল ইসনা আশারিয়া লিয যায়দিয়া বাইনা আদায়িল আমস ওয়া তকিয়াতুল ইয়াওম-মুহাম্মদ আল খুযার।

———————————–

حَقِيْقَةُ الحُوْثِيِّيْنَ
تأليف: سليمان بن صالح الغصن

ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি শিয়াদের আসল চেহারা
মূল: প্রফেসর ডক্টর সুলাইমান বিন সালিহ আল গুসন
অধ্যাপক, কিং সউদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব
প্রকাশনায়: ধর্ম মন্ত্রণালয়, সউদী আরব।।

মানুষকে গাধা, কুকুর ইত্যাদি বলে সম্বোধনের ব্যাপারে সাবধান বাণী

 ◈ ১. আলা ইবনুল মুসাইয়েব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা (মুসাইয়েব) বলেছেন,

لاتقل لصاحبك يا حمار يا كلب يا خنزير فيقول لك يوم القيامة : أتراني خلقت كلبا أو حمارا أو خنزيرا
“তোমার সঙ্গী-সাথীকে হে গাধা, হে কুকুর, ওহে শুয়োর বলে সম্বোধন করবে না। অন্যথায় কিয়ামতের দিন সে তোমাকে বলবে, “তুমি কি মনে করতে যে, আমাকে কুকুর, গাধা বা শুয়োর রূপে সৃষ্টি করা হয়েছিল?” [মুসান্নিফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫/২৮২]

◈ ২. অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে, ইবরাহিম নাখঈ রাহ. থেকেও। [মুসান্নিফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫/২৮৩]

◈ ৩. ইমাম নওবী রাহ. বলেন,
“ومن الألفاظ المذمومة المستعملة في العادة قوله لمن يخاصمه: يا حمار، يا تيس، ياكلب، ونحو ذلك، فهذا قبيح لوجهين: أحدهما: أنه كذب. والآخر: أنه إيذاء
“নিন্দনীয় যে সব শব্দ সচরাচর ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, ঝগড়াঝাঁটিতে প্রতিপক্ষকে বলা: হে গাধা, হে পাঠা/ছাগল, কুকুর ইত্যাদি। তা দুটি কারণে কুৎসিত:
এক: তা মিথ্যা, অন্যটি হল, কষ্টদায়ক।” [আল আযকার, পৃষ্ঠা নং ৩৬৫]

◈ ৪. আল্লামা শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায বলেন, কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য কাউকে গাধা, কুকুর, শুয়োর, খচ্চর, গরু-ছাগল ইত্যাদি বলে ডাকা শোভনীয় নয়। বরং সবচেয়ে সুন্দর নামে সম্বোধন করা উচিত।

এ সব উপাধি দিয়ে মানুষকে সম্বোধন করা হলে পারস্পারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, মন-কষাকষি, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি হতে পারে।” [শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট]

◈ ৫. আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন বলেন, “মানুষকে জীবজন্তু বা পশুর উপাধি দিয়ে ডাকা হারাম।”

বিন বায, উসাইমিন রাহ. উভয়েই নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করেন:

আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا نِسَآءٞ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهُنَّۖ وَلَا تَلۡمِزُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَلَا تَنَابَزُواْ بِٱلۡأَلۡقَٰبِۖ بِئۡسَ ٱلِٱسۡمُ ٱلۡفُسُوقُ بَعۡدَ ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن لَّمۡ يَتُبۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ

“হে ইমানদারগণ! কোনও মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোনও মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরাও যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে। কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারিনীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ইমানের পর মন্দ উপাধি অতি নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না তারাই তো যালিম।” [সূরা হুজুরাত: ১১]

ইমাম ইবনে কাসির রাহ. উক্ত আয়াতে ولا تنابزوا بالألقاب “আর তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধিতে ডাকিও না” এর ব্যাখ্যায় বলেন,
أي : لا تتداعوا بالألقاب ، وهي التي يسوء الشخص سماعها
“অর্থাৎ তোমারা একে অপরকে এমন সব উপাধি দ্বারা ডাকাডাকি করো না যা সে শুনতে অপছন্দ করে।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]
আল্লাহ আমাদেরকে জন্তু-জানোয়ারের নামে মানুষকে সম্বোধনের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬ ❂◯❂▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।

সহিহ, হাসান ও জইফ হাদিসের পরিচয়

 ❑ ক. প্রশ্ন: সহিহ হাদিস কাকে বলে?

সহিহ শব্দের অর্থ: শুদ্ধ, নির্ভুল, সুস্থ, সঠিক, সত্য, প্রকৃত ইত্যাদি।
আর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,
هو ما نقله العدل تام الضبط متصل السند غيرمعلل ولا شاذ
“যে হাদিস মুত্তাসিল (অবিচ্ছিন্ন) সনদ পরম্পরায় বর্ণিত হয়, রাবী (বর্ণনাকারী) আদিল (সততা ও ন্যায়-নীতিমান) ও পূর্ণ আয়ত্ত শক্তির অধিকারী হয় এবং সনদটি শায (অধিক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের বিপরীত নয়) কিংবা মুআল্লাল (হাদিসের মূল মতন গোপন ত্রুটি যুক্ত) নয়-এমন হাদিস কে সহিহ বলে।

মোটকথা, হাদিস সহিহ হওয়ার জন্য ৫টি শর্ত থাকা আবশ্যক। যথা:

◍ ১. অবিচ্ছিন্ন সনদ পরম্পরায় বর্ণিত হওয়া। অর্থাৎ এমন অবিচ্ছিন্ন বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হওয়া যে বর্ণনা সূত্রের কোথাও একজন বর্ণনাকারীও বাদ পড়ে নি।
◍ ২. বর্ণনা সূত্রের প্রত্যেক বর্ণনাকারী সততা, আদর্শ ও ন্যায়-নীতিতে প্রশ্নাতীত থাকা।
◍ ৩. বর্ণনাকারী পূর্ণ আয়ত্ত শক্তির অধিকারী হওয়া অর্থাৎ হাদিস আয়ত্ত বা সংরক্ষণের কোনও ত্রুটি না থাকা- চাই তা মুখস্থ রাখার ক্ষেত্রে হোক বা লিখে রাখার ক্ষেত্রে হোক।
◍ ৪. শায না হওয়া অর্থাৎ হাদিস বর্ণনাকারীর বর্ণনা তার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর বিপরীত না হওয়া।
◍ ৫. হাদিস বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে হাদিসের মতনে কোন ধরণের সূক্ষ্ম ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা না পড়া।

❑ খ. প্রশ্ন: হাসান হাদিস কাকে বলে?
উত্তর:
হাসান শব্দের অর্থ: সুন্দর, ভালো, চমৎকার, উত্তম ইত্যাদি।
এর পারিভাষিক অর্থ হল, যে হাদিসের মধ্যে সহিহ হাদিসের সকল শর্ত যথাযথভাবে পাওয়া যাবে একটি শর্ত ছাড়া। তা হল, হাদিস সংরক্ষণ। অর্থাৎ বর্ণনাকারীর হাদিস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সহিহ হাদিসের তুলনায় কিছুটা ঘাটতি থাকবে।
الحديث الحسَن لذاته هو: “ما اتَّصل إسنادُه، بنَقل عدلٍ، قَلَّ ضبطه، غير شاذٍّ، ولا معلولٍ
ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,
هو والصحيح سواء، إلَّا في تفاوت الضَّبط؛ فراوي الصَّحيح يشترط أن يكون مَوصوفًا بالضَّبط الكامِل، وراوي الحسن لا يُشترط أن يَبلغ تلك الدَّرجة
“হাসান এবং সহিহ হাদিস সমপর্যায়ের স্মৃতিশক্তি বা হাদিস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পার্থক্য ছাড়া। সহিহ হাদিসের বর্ণনাকারী পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিশক্তি বা হাদিস সংরক্ষণের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত হওয়া শর্ত কিন্তু হাসান হাদিসের বর্ণনাকারী সে স্তরে পৌঁছা‌ শর্ত নয়।” [আল আসইলাতুল ফাইকা, হা/৬৪-alukah]
মর্যাদার দিক দিয়ে হাসান হাদিস সহিহ হাদিস থেকে একটু কম মর্যাদা সম্পন্ন তবে গ্রহণযোগ্য। অন্য ভাষায়, হাসান হাদিস সহিহ ও জইফের মাঝামাঝি পর্যায়ের হাদিস।

❑ গ. প্রশ্ন: জঈফ হাদিস কাকে বলে?
উত্তর:
জইফ শব্দের অর্থ: দুর্বল, ক্ষীণ, অপারগ, অক্ষম ইত্যাদি।
الحَدِيثُ الضَّعِيفُ: مَا فَقَدَ أَحَدَ شُرُوطِ الحَدِيثِ الصَّحِيحِ: أي: كل حديث لم تجتمع فيه شروط الحديث الصحيح، وكذا لم تجتمع فيه شروط الحديث الحسن، فهو ضعيف
“যে হাদিসে সহিহ হাদিসের কোনও একটি শর্ত অনুপস্থিত।” অর্থাৎ যে হাদিসে সহিহ হাদিসের শর্তাবলী একসাথে পাওয়া যায় না, অনুরূপভাবে যাতে হাসান হাদিসের শর্তাবলী একসাথে পাওয়া যায় না তাকেই জইফ (দুর্বল) হাদিস বলে।” [মুকাদ্দামায়ে ইবনুস সালাহ, ৪১ পৃষ্ঠা]
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate