Tuesday, October 25, 2022

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন-সংক্রান্ত প্রচলিত গল্পটি বানোয়াট ও হাদিসের নামে মিথ্যাচার

 প্রশ্ন: নিম্নোক্ত ঘটনাটি কি সহিহ? নবীজীর কাছে তাঁর সকল বিবি বসা ছিলেন। এমন সময়, এক বিবি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আপনার বিবিদের মাঝে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন? কেমন কঠিন প্রশ্ন! কারণ সকল বিবি এখানে উপস্থিত। নবীজী কাকে হাসাবেন আর কাকে কাঁদাবেন? তাই কৌশলে বললেন, আগামী কালকে তার জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।

অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কুমারী স্ত্রী আয়েশা রা. এর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে ২টি খেজুর দিয়ে বললেন, আয়েশা, এই খেজুরের কথা কাউকে বলবে না।

এভাবে সকল বিবির ঘরে প্রবেশ করে সকলকেই ২টি করে খেজুর দিয়ে বললেন, এই খেজুরের কথা কাউকে বলবে না। অতপর পরের দিন সকল বিবি একত্রিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ রাসুল, জবাব দিন, আপনি কোন স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন?

নবীজী উত্তরে বলেন, গত রাতে যাকে আমি ২টি খেজুর দিয়ে ছিলাম। তাকেই সবচাইতে বেশি ভালবাসি। তখন সকল বিবি মনে মনে আনন্দিত হয়ে গেলেন।

নবিজী মুচকি হাসলেন। কারণ নবিজী তো সকলকেই খেজুর দিয়ে ছিলেন। কিন্তু একজনের টা অন্যজন জানে না।

অতএব নবীজীর ভালবাসা সকলের উপর সমান ভাবে চলে গেল। কেউ নারাজ হয়নি। এটাকেই বলে ইনসাফ ও ইসলামি বিনোদন এবং সুন্দর কৌশল! এটার নামই দীন-ইসলাম। কত যে শান্তি ইসলামে আমরা তা বুঝি না। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:
এটি কোনও হাদিস নয় বরং হাদিসের নামে মিথ্যাচার। এ বিষয়টি islamweb, dorar ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত ওয়েব সাইটগুলো এবং বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ স্পষ্ট করেছেন-আল হামদুলিল্লাহ।

এর কয়েকটি কারণ। যথা:

◈ ১. সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু মূর্খ গল্পবাজ বক্তা ছাড়া কোনও হাদিস গ্রন্থে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

◈ ২. তাছাড়া এই মুখরোচক গল্পে ভাষা শৈলির দুর্বলতা স্পষ্ট-যা হাদিসে নব্বীর ভাষার সাথে বেমানান।
◈ ৩. শুধু তাই নয়, সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর রাসুল এবং এমন অতুলনীয় মহাজ্ঞানী মহামানবের পক্ষ থেকে তাঁর স্ত্রীদের সাথে এমন দুর্বল কৌশল অকল্পনীয়। কারণ একাধিক স্ত্রীর মাঝে এ জাতীয় গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। জীবনের কোনও না কোনও সময় তা প্রকাশিত হবে বলেই ধারণা করা যায়। তখন তিনি তাদের সামনে মিথ্যাবাদী ও অবিশ্বস্ত (নাউযুবিল্লাহ) বলে প্রতীয়মান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তা যে বানোয়াট গল্প তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

◈ ৪. আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সকল স্ত্রীর মধ্যে মা জননী আয়েশা রা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন তা স্পষ্ট করেই বলেছেন। যেমন:
عَمْرُو بْنُ الْعَاصِ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَهُ عَلَى جَيْشِ ذَاتِ السَّلاَسِلِ، فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ أَىُّ النَّاسِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ ‏”‏ عَائِشَةُ ‏”‏‏.‏ فَقُلْتُ مِنَ الرِّجَالِ فَقَالَ ‏”‏ أَبُوهَا ‏”‏‏.‏ قُلْتُ ثُمَّ مَنْ قَالَ ‏”‏ ثُمَّ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ ‏”‏‏.‏ فَعَدَّ رِجَالاً‏.‏

আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যাতুস সালাসিল যুদ্ধের সেনানায়ক করে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষের মধ্যে কে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয়?
তিনি বললেন, আয়েশা।
আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে কে?
তিনি বললেন, আয়েশার পিতা (আবু বকর রা.)।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কে?
তিনি বললেন, উমর ইবনুল খাত্তাব। তারপর আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৫. তাছাড়া আয়েশা রা. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন-এ বিষয়টি সাহাবিদের নিকটও সুবিদিত ছিল। তাই তো তিনি যেদিন আয়েশা.-এর ঘরে থাকতেন সেদিন সাহাবিগণ সে দিন তাঁর নিকট উপহার-সামগ্রী পাঠাতেন। হাদিসে এসেছে,
وَكَانَ الْمُسْلِمُوْنَ قَدْ عَلِمُوْا حُبَّ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَائِشَةَ فَإِذَا كَانَتْ عِنْدَ أَحَدِهِمْ هَدِيَّةٌ يُرِيْدُ أَنْ يُهْدِيَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَخَّرَهَا حَتَّى إِذَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ بَعَثَ صَاحِبُ الْهَدِيَّةِ بِهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ

উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামা রা. সাহাবিদের এই উপহার পাঠানোর বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কথা তুললে তিনি কয়েকবার চুপ থাকার পর অবশেষে বললেন,
لَا تُؤْذِيْنِيْ فِيْ عَائِشَةَ فَإِنَّ الْوَحْيَ لَمْ يَأْتِنِيْ وَأَنَا فِيْ ثَوْبِ امْرَأَةٍ إِلَّا عَائِشَةَ

“আয়েশা রা.-এর ব্যাপার নিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। মনে রেখ, আয়েশারা. ব্যতীত আর কোন স্ত্রীর বস্ত্র তুলে থাকা অবস্থায় আমার উপর ওহি নাজিল হয়নি।”

(আয়েশা রা.) বলেন, এ কথা শুনে তিনি (উম্মে সালামা রা.) বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, “আপনাকে কষ্ট দেয়া হতে আমি আল্লাহর নিকট তওবা করছি।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫১/ হেবা ও এর ফজিলত, পরিচ্ছেদ: ৫১/৮. সঙ্গীকে কোন হাদিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অন্য স্ত্রী ছেড়ে কোন স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত দিনের অপেক্ষা করা।]

এসব হাদিস থেকেও প্রমাণিত হয়, আল্লাহর রাসূলের কাছে তাঁর কোনও স্ত্রী সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র তা তাঁদের সকলের জানা ছিল। সুতরাং তাঁদের একসাথে জোট বেঁধে তাঁকে এমন প্রশ্ন করে বিব্রত করার আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না।
অতএব, এটি গল্পবাজ বক্তা ও দীন বিষয়ে মূর্খ লোকদের তৈরি করা হাদিস তা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়।

সুতরাং মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য ছাড়া এ জাতীয় হাদিস প্রচার করা ও বর্ণনা করা হারাম।

● রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানোয়াট হাদিস বর্ণনার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেন,
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর মিথ্যা রোপ করল (মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করল), সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা করে নিলো।” (সহিহ বুখারি, অনুচ্ছেদ: আম্বিয়াদের হাদিস, হাদিস নং ৩২৭৪)

● তিনি আরও বলেন,
كفى بالمرء كذباً أن يحدث بكل ما سمع
“মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সহিহ মুসলিম এর ভূমিকা, আবু দাউদ ৪/২৯৮, ইবনে হিব্বান, ১/২১৩ )

● অন্য বর্ণনায় এসেছে
كفى بالمرء إثما أن يحدث بكل ما سمع
“গুনাহ হওয়ার জন্য এতটুকুই এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সিলসিলা সহিহা হা/২০২৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বানোয়াট হাদিস, ও দলিল বহির্ভূত কিচ্ছা-কাহিনী থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

কাফির রাষ্ট্রে পড়াশোনা ও অবস্থানের বিধান

 আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার অগণিত প্রশংসা দিয়ে শুরু করছি। একইসাথে আশরাফুল আম্বিয়া, সায়্যিদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন, আবুল ক্বাসিম মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দিল্লাহ বিন ‘আব্দিল মুত্তালিব আল-হাশিমী আল-কুরাইশী এর উপর অসংখ্য সালাত ও সালাম কামনা করছি; আল্লাহুম্মা সাল্লি আলাইহি, আল্লাহুম্মা বারিক আলাইহি। সাম্প্রতিক সময়ে আমার পরিচিতদের মাঝে অনেকেরই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে অমুসলিম দেশে ভ্রমণের প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। এবং তাদের সাথে আলাপ করে বুঝলাম তারা অনেকেই এর শরী’ঈ বিধান সম্পর্কে অবগত নয়। তাই এই প্রবন্ধটি সংকলন করতে সচেষ্ট হলাম। আল্লাহর পূর্ণ তাওফীক কাম্য।

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে অমুসলিম দেশে ভ্রমণের হুকুম সম্পর্কে যুগশ্রেষ্ঠ তিন কিংবদন্তী আলিমের ফাতওয়া উল্লেখ করা হয়েছে। আশা করি প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পড়লে পাঠকের খোরাক মিটবে এবং এ বিষয়ে সংশয় নিরসন হবে, ইন শা আল্লাহ।

১. সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি, সামাহাতুশ শাইখ, আল-‘আল্লামাহ্, ইমাম আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দিল্লাহ বিন বায (رحمه الله)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

❝ অমুসলিম দেশগুলিতে ভ্রমণ করা একটি ঝুঁকি যা একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত মুসলিমদের এড়িয়ে চলতে হবে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

“আমি ঐ সমস্ত মুসলিমদের দায়ভার বহন করবো না যারা মুশরিকদের মাঝে থাকে।” [আবু দাউদ: ২৬৪৫, তিরমিযী: ১৬০৪; সনদ: সহিহ (তাহকিক: আলবানি)]

মুসলিম কর্তৃপক্ষসমূহের (ওয়াফফাক্বাহুমুল্লাহ) উচিত নয় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অমুসলিম দেশে লোক পাঠানো। তবে অমুসলিম দেশের প্রতিনিধিদের হতে হবে পরহেজগার, দ্বীন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানী এবং ওসব দেশে ভ্রমনের ফলে নেতিবাচক প্রভাবের আশংকামুক্ত। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়কগণের উচিত অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করা এবং তাদের সার্বক্ষণিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। অমুসলিম দেশে দাওয়াতের উদ্দেশ্য প্রতিনিধি পাঠানো জায়েজ, এমনকি উত্তমও বটে, যাতে করে সেখানে ইসলামের প্রচার হয়। উপরিউক্ত দুটি অবস্থা বাদে অন্য কোনো অবস্থাতে যুবকদের অমুসলিম দেশে পাঠানো কদর্যকাজ (মুনকার) হিসেবে বিবেচিত, যাতে চরম ঝুঁকি রয়েছে। একই হুকুম বর্তাবে অমুসলিম দেশে ব্যাবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এর কারণ হলো সেখানে ফিতনাহ এবং পাপাচারের প্রচার প্রসার, যেখানে ব্যাক্তির সর্বদা শয়তান, তার কুপ্রবৃত্তি এবং অসৎসঙ্গী হতে সতর্ক থাকা উচিত। ❞[১]

২. যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল-‘আল্লামাহ, ইমামুস সালাফিয়্যাহ, শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (رحمه الله) কে উক্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেন,

❝ আমাদের এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে কোনো কাফির দেশে মুসলিমদের বসবাস করা জায়েয নয়। কাউকে যদি কোনো মুসলিম দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়, তাহলে সে অন্য কোনো মুসলিম দেশে চলে যাবে। ❞ [২]

৩. সামাহাতুল ফাক্বীহ, আল-‘আল্লামাহ্, আশ-শাইখুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল-উসাইমীন (رحمه الله) এ বিষয়ে বলেন,

❝ ব্যাক্তিগত এবং বিশেষ কোনো বৈধ প্রয়োজনে সেখানে অবস্থান করা জায়েয, যেমন ব্যাবসা বা চিকিৎসা। তবে তা হতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেখানে অবস্থান করা যাবে না। উলামায়ে কিরাম ব্যাবসার জন্য কাফির রাষ্ট্রে অনুপ্রবেশকে জায়েয বলেছেন এবং এ বিষয়ে দালীল হিসেবে তারা কিছু সংখ্যক সাহাবীর উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।

আর পড়াশুনার জন্য কাফির রাষ্ট্রে অবস্থান করা; এ ধরনের অবস্থান যদিও পূর্বোল্লিখিত প্রয়োজনে কাফির রাষ্ট্রে অবস্থানের অন্তর্ভুক্ত, তথাপি অন্যান্য প্রয়োজনে সেখানে অবস্থানের তুলনায় পড়াশোনার জন্য অবস্থানের বিষয়টি তার দ্বীন ও চরিত্রের জন্য অধিকতর ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। কেননা যে কোন শিক্ষার্থী মর্যাদার দিক দিয়ে নিজেকে ছোট মনে করে এবং তার শিক্ষককে বড় মনে করে থাকে। এক্ষেত্রে তাই এমন হবে যে, সে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, তাদের চিন্তা-চেতনা, মতাদর্শ এবং চাল-চলনকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিবে এবং এভাবে এক সময় সে তাদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে শুরু করবে। তবে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী যাদেরকে আল্লাহ্ হিফাযত করে থাকেন, কেবল তারাই এরূপ পরিস্থিতি থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

তাছাড়া একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রয়োজনে তার শিক্ষকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। এতে করে শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে ভালবাসতে শুরু করে এবং শিক্ষকের গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতাকে সে তোষামোদ করতে থাকে। তাছাড়া ঐসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীর অনেক কাফির সহপাঠী থাকে এবং তাদের মধ্য থেকে সে অনেককে বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। সে তাদেরকে ভালবাসে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ প্রকারের বিপদের কারণে পূর্বোল্লেখিত প্রকারের চেয়ে নিজেকে অধিক হেফাযত প্রয়োজন। আর তাই মৌলিক ২টি শর্তের পাশাপাশি আরো কয়েকটি শর্তারোপ করা হয়েছে। সেগুলো হলো:

i. শিক্ষার্থীকে বিবেক-বুদ্ধির দিক দিয়ে যথেষ্ট পরিপক্ক হতে হবে, যা দ্বারা সে কল্যাণকর এবং ক্ষতিকর বিষয় সমূহের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারবে এবং সুদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তা দেখতে পাবে। আর কম বয়সী এবং অপরিপক্ক বুদ্ধ-জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য কাফিরদের দেশে পাঠানোর কাজটি হবে তাদের দ্বীন, চরিত্র এবং চাল-চলনের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া এটি তাদের জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্যও মারাত্মক বিপজ্জনক। তার এ বিষপান তার ফিরে যাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সংক্রমিত হবে। বাস্তবতা ও পর্যবেক্ষণও তাই সাক্ষ্য দেয়। কেননা পড়াশোনার জন্য পাঠানো বহু শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের পরিবর্তে অন্য কিছু নিয়েই ফিরে এসেছে। তারা দ্বীন, চরিত্র এবং চাল-চলনে বিপথগামী হয়ে ফিরেছে। আর এসব বিষয়ে তাদের নিজেদের এই সমাজের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা তো জানা কথা এবং সাক্ষ্যও তাই বলে। কাজেই অপরিপক্ক জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন এসব কম বয়সী শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার জন্য কাফির রাষ্ট্রে পাঠানো যেন কোন ভেড়ীকে হিংস্র কুকুরের মুখে তুলে দেওয়ার মতই কাজ।

ii. শিক্ষার্থীর নিকট ইসলামী শারীআতের এই পরিমাণ জ্ঞান থাকতে হবে যা দ্বারা সে হক ও বাতিলের মাঝে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে এবং সত্য দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিহত করতে পারে। যাতে করে কাফিরদের বাতিল বিষয়াদি দ্বারা সে প্রতারিত না হয় এবং বাতিলকে যেন সত্য বলে মনে না করে বা বিভ্রান্তিতে যেন না পড়ে কিংবা বাতিলকে প্রতিহত করতে অক্ষম হয়ে দিশেহারা অথবা বাতিলের অনুসারী না হয়ে যায়। হাদীসে বর্ণিত দুআ’য় রয়েছে

اللهم أرني الحق حقا وارزقني اتباعه وأرني الباطل باطلا وارزقني اجتنابه ولا تجعله ملتبسا علي فأضل

“হে আল্লাহ্! সত্যকে সত্য হিসেবে আমাকে দেখাও এবং তা অনুসরণ করার তাওফীক আমাকে দান করো। আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে আমাকে দেখাও এবং তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক আমাকে দান করো এবং সত্য-মিথ্যার বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট রেখো না, তাহলে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবো।”

iii. শিক্ষার্থীর মাঝে এ পরিমাণ ধার্মিকতা থাকতে হবে যা তাকে কুফর এবং পাপাচার থেকে রক্ষা করবে। ধার্মিকতার দিক দিয়ে দুর্বল কোন ব্যক্তি কাফির রাষ্ট্রে অবস্থান করে নিরাপদে থাকতে পারে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে যদি কাউকে নিরাপদে রাখেন তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কেননা সেখানে তাকে আক্রমণকারী বিষয়সমূহ বেশ শক্তিশালী এবং তার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ দুর্বল। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কুফর ও পাপাচারের অসংখ্য শক্তিশালী উপকরণ। এগুলো যদি এমন কোন স্থানে সংঘটিত হয় যেখানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশ দুর্বল, তাহলে যা হবার তাই হবে।

iv. মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণকর যে জ্ঞানার্জন প্রয়োজনীয়তার দাবী, তা অর্জনের মত প্রতিষ্ঠান তার নিজ দেশে নেই। কিন্তু সে বিষয়ে যদি মুসলিম জাতির কোন ফায়দা না থাকে অথবা সে বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা যদি কোন ইসলামী দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকে, তাহলে সে জ্ঞানার্জনের জন্য অমুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থান করা জায়েয নয়। কারণ অমুসলিম দেশে অবস্থান একদিকে যেমন দ্বীন ও আখলাকের জন্য বিপজ্জনক, অন্যদিকে তা প্রচুর অর্থ-সম্পদ অনর্থক অপচয় করার কারণও বটে। ❞ [৩]

পাদটীকা:
[১] https://tinyurl(.)com/binbazstudyabroad
[২] সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, ক্যাসেট নং ৬১৭; বঙ্গানুবাদ: ফাতওয়ায়ে আলবানী, পৃ: ৩৬৬
[৩] শারহু সালাসাতিল উসুল, বঙ্গানুবাদ, আলোকধারা হতে প্রকাশিত, পৃ: ২৮৯

অনুবাদ ও সংকলন: মুহাম্মাদ আখলাকুজ্জামান।
সম্পাদনা: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা।

ঝড়-বৃষ্টিতে যে দুআ পাঠ করতে হয়

 ❒ ঝড় ও বায়ু প্রবাহের সময় দুআ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا تَسُبُّوا الرِّيحَ فَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْهَا مَا تَكْرَهُونَ فَقُولُوا: اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ الرِّيحِ، وَخَيْرَ مَا فِيهَا وَخَيْرَ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ، وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِهِ الرِّيحِ، وَشَرِّ مَا فِيهَا وَشَرِّ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ
“তোমরা বাতাসকে গালি দিও না। যখন এমন বাতাস দেখবে যা তোমরা অপছন্দ করো তখন বলবে:
উচ্চারণ:
“আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকা খায়রাহা ওয়া খায়রা মা ফীহা ওয়া খায়রা মা উরসিলাত বিহী; ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা ফীহা ওয়া মিন শাররি মা উরসিলাত বিহী।”
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট এই বায়ুর কল্যাণ, এর মধ্যে যে কল্যাণ নিহীত আছে এবং যা নিয়ে তা প্রেরিত হয়েছে তার কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এই বায়ুর অনিষ্ট, এর মধ্যে যে অনিষ্ট নিহীত রয়েছে এবং যা নিয়ে তা প্রেরিত হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে।”
[সুনান তিরমিযী, অনুচ্ছেদ: বাতাসকে গালি দেয়া নিষেধ, হা/২১৭৮, সহীহ-আলবানী রহ.]

❒ বৃষ্টির সময় দুআ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বৃষ্টি দেখতেন তখন বলতেন,
اللّهُمَّ صَيِّـباً نافِـعاً
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাইয়িবান নাফিয়ান।
অর্থ: “আল্লাহ, (এই মেঘকে) তুমি কল্যাণময় বৃষ্টি বৃষ্টিতে পরিণত করো।”
[সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: বৃষ্টির সময় যা পাঠ করতে হয়]
হে আল্লাহ, তুমি ধেয়ে আসা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, টর্নেডো ইত্যাদির ভয়াবহ কবল থেকে আমাদেরকে হেফাজত করো। রক্ষা করো তোমার আজাব ও গজব থেকে। আমরা তোমার নিকট আমাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার নিকটই প্রত্যাবর্তন করছি।
আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

বন্ধ হোক এসব উড়াধুড়া কিচ্ছা-কাহিনীর প্রচার ও প্রসার

 খলিফা উমর রা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিতে সাহাবির জিম্মায় ছেড়ে দিলেন এবং সে তিন দিন পর ফিরে এলো!

▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
প্রশ্ন: তাবলিগ জামাতের ‘হায়াতুস সাহাবা’ কিতাবে উল্লেখিত নিম্নোক্ত ঘটনাটা কি সত্য?
❝এই যুবক আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।❞

দোষী যুবককে টেনে-হিঁচড়ে খলিফার দরবারে নিয়ে এসেছেন দুই ব্যক্তি। তারা তাদের পিতার হত্যার বিচার চান।

খলিফা হযরত উমর রা. সেই যুবককে জিজ্ঞেস করলেন যে তার বিপক্ষে করা অভিযোগ সত্য কিনা। অভিযোগ স্বীকার করল যুবক। দোষী যুবক সেই ঘটনার বর্ণনা দিল:
“অনেক পরিশ্রমের কাজ করে আমি বিশ্রামের জন্য একটি খেজুর গাছের ছায়ায় বসলাম। ক্লান্ত শরীরে অল্প সময়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার একমাত্র বাহন উটটি পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে কিছু দূর গিয়ে পেলাম, তবে তা ছিল মৃত। অভিযোগকারী এই দুই ব্যক্তির বাবাকে আমার মৃত উটের পাশে পেলাম। সে আমার উটকে তার বাগানে প্রবেশের অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করেছে। এই কারণে আমি হঠাৎ করে রাগান্বিত হয়ে পড়ি এবং তার সাথে তর্কাতর্কি করতে করতে এক পর্যায়ে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে ফেলি। ফলে সে সেইখানেই মারা যায়। যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে গেছে। এর জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।”

বাদীরা জানালেন- “আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই।” সব শুনে হযরত উমর রা. অপরাধী যুবককে বললেন, “উট হত্যার বদলে তুমি একটা উট দাবি করতে পারতে, কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছ। হত্যার বদলে হত্যা। এখন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তোমার কোন শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো।” নওজোয়ান বলল, “আমার কাছে কিছু ঋণ ও অন্যের রাখা কিছু আমানত আছে। আমাকে যদি কিছু দিন সময় দিতেন, আমি বাড়ি গিয়ে আমানত ও ঋণগুলি পরিশোধ করে আসতাম।”

খলিফা হযরত উমর রা. বললেন, “তোমাকে এভাবে একা ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমার পক্ষ থেকে কাউকে জিম্মাদার রেখে যেতে পারো তবে তোমায় সাময়িক সময়ের জন্য যেতে দিতে পারি।“ নওজোয়ান বলল, “এখানে আমার কেউ নেই যে আমার জিম্মাদার হবে।” যুবকটি তখন নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এই সময় হঠাৎ মজলিসে উপস্থিত একজন সাহাবি হযরত আবু যর গিফারি রা. দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি হবো ঐ ব্যক্তির জামিনদার। তাকে যেতে দিন।”
আবু যর গিফারি রা.-এর এই উত্তরে সভায় উপস্থিত সবাই হতবাক। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি, তার উপর হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী! তার জামিনদার কেন হচ্ছেন আবু যর!
খলিফা বললেন, “আগামী শুক্রবার জুমা পর্যন্ত নওজোয়ানকে মুক্তি দেয়া হল। জুমার আগে নওজোয়ান মদিনায় ফেরত না আসলে নওজোয়ানের বদলে আবু যরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।” মুক্তি পেয়ে নওজোয়ান ছুটল মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির দিকে। আবু যর গিফারি রা. চলে গেলেন নিজ বাড়িতে।

দেখতে দেখতে জুমাবার এসে গেল। নওজোয়ানের আসার কোনও খবর নেই। হযরত উমর রা. রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন আবু যর গিফারির রা. কাছে। পত্রে লিখা, আজ শুক্রবার বাদ জুমা সেই যুবক যদি না আসে, আইন মোতাবেক আবু যর গিফারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আবু যর যেন সময় মত জুম্মার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববিতে হাজির হন। খবর শুনে সারা মদিনায় থমথমে অবস্থা। একজন নিষ্পাপ সাহাবি আবু যর গিফারি আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জুমার পর মদিনার সবাই মসজিদে নববির সামনে হাজির। সবার চোখে পানি। কারণ দণ্ডপ্রাপ্ত যুবক এখনো ফিরে আসেনি। জল্লাদ প্রস্তুত।

জীবনে কত জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছে না জল্লাদ। আবু যরের মত একজন সাহাবি সম্পূর্ণ বিনা দোষে আজ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, এটা মদিনার কেউ মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা উমর রা. নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। হৃদয় তাঁর ভারাক্রান্ত। তবু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারো পরিবর্তনের হাত নেই। আবু যর রা. তখনও নিশ্চিন্ত মনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর পায়ে আবু যর রা. এর দিকে এগুচ্ছেন আর কাঁদছেন। আজ যেন জল্লাদের পা চলে না। পায়ে যেন কেউ পাথর বেঁধে রেখেছে।

এমন সময় এক সাহাবি উচ্চ স্বরে জল্লাদকে বলে উঠলেন, “হে জল্লাদ একটু থামো। মরুভূমির ধুলার ঝড় উঠিয়ে ঐ দেখ কে যেন আসছে। হতে পারে ঐটা নওজোয়ানের ঘোড়ার পদধূলি। একটু দেখে নাও।” ঘোড়াটি কাছে আসলে দেখা যায় সত্যিই এ সেই নওজোয়ান।

নওজোয়ান দ্রুত খলিফার সামনে এসে বলল, “আমিরুল মুমিনিন, মাফ করবেন। রাস্তায় যদি আমার ঘোড়া পায়ে ব্যথা না পেত, তবে যথা সময়েই আসতে পারতাম। বাড়িতে গিয়ে আমি একটুও দেরি করিনি। বাড়ি পৌঁছে গচ্ছিত আমানত ও ঋণ পরিশোধ করি। তারপর বাবা, মা এবং নববধূর কাছে সব খুলে বলে চিরবিদায় নিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এখন আমার জামিনদার ভাইকে ছেড়ে দিন আর আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পবিত্র করুন। কেননা কেয়ামতের দিন আমি খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না।”

আশেপাশের সবাই একেবারেই নীরব। চারিদিকে একদম থমথমে অবস্থা। সবাই হতবাক, কী হতে চলেছে! যুবকের পুনরায় ফিরে আসাটা অবাক করে দিলো সবাইকে।
খলিফা হযরত উমর রা. যুবককে বললেন, “তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, তারপরেও কেন ফিরে এলে?” উত্তরে সেই যুবক বলল- “আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলমান সাহায্য করতে এগিয়ে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গেছিলো।”

এবার হযরত উমর রা. হযরত আবু যর গিফারি রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন না চেনা সত্যেও এর জামিনদার হলেন?” উত্তরে হযরত আবু যর গিফারি রা. বললেন, “পরবর্তীতে কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান বিপদে পড়েছিলো, অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।”

এমন কথা শুনে, হঠাৎ বৃদ্ধের দুই সন্তানের মাঝে একজন বলে উঠল, “হে খলিফা, আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার উপর করা অভিযোগ তুলে নিলাম।”
হযরত উমর রা. বললেন, “কেন তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছ?” তাদের এক ভাই বলে উঠলো, “কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করে নিজেই স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরেও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি।”
[হায়াতুস সাহাবা-৮৪৪]

উত্তর:

এটি নির্ভরযোগ্য কোনও ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় না বরং পাওয়া যায়, কিছু গল্পের বইয়ে-যার কোনও ভিত্তি নাই। সুতরাং এটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কাহিনী তাতে কোন সন্দেহ নেই।

◈ কাতার ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত islamweb ওয়েব সাইটে উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে গবেষকগণ বলেছেন, ”এই গল্পটি পড়লেই তার শুদ্ধতা অনুসন্ধান করার দরকার পড়ে না। কারণ এর মধ্যে এমন সব অদ্ভুত কথাবার্তা আছে যেগুলো সাহাবিদের জ্ঞান-গরিমার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যাহোক, আমরা এর সনদ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেও কোথাও তা পাইনি। তবে পাওয়া গেছে, বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী এবং দুর্বল উপাখ্যান জাতীয় বইয়ে। আমরা যা পেয়েছি তা হল, আল ইতলিদি (বিশিষ্ট গল্প লেখক মুহম্মদ দাইয়াব আল ইতলিদি-মিসর, মৃত্যু: হিজরি ১২ শতকের প্রথম দিকে) তার নাওয়াদেরুল খোলাফা [খলিফাদের দুর্লভ উপাখ্যান-যা ‘ইলামুন নাস বিমা ওয়াকায়া লিল বারামিকা’ إعلام الناس بما وقع للبرامكة নামে প্রসিদ্ধ] কিতাবের সূচনায় [পৃষ্ঠা: ১১] এ গল্পটি উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে আল মাশরিক ম্যাগজিন [Al-Machriq Magazine]-এর প্রতিষ্ঠাতা লুইস চিকো Louis Cheikho [তুরস্কের খৃষ্টান ক্যাথলিক-ক্যালডীয় ধর্মের অনুসারী, জন্ম ১৮৫৯ ও মৃত্যু ১৯২৮ খৃষ্টাব্দ] তার ‘মাজানিল আদব ফী হাদায়েকিল আরব’ مجاني الأدب في حدائق العرب (৪/২৩০) কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

◈ এ ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত dorar ওয়েব সাইট বলা হয়েছে, لم نجدها في كتب الأثار “আমরা পুরাকীর্তি বা পূর্বযুগের ঘটনাবলী সংক্রান্ত কোনও বইয়ে আমরা তা পাইনি।”
সত্যি আবু যর রা.-এর মত একজন প্রবীণ ও বিচক্ষণ সাহাবি এক অজানা-অচেনা মৃত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর জামিন গ্রহণ করে, নিজে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে তাকে ছেড়ে দিবেন-এটা কোনও প্রজ্ঞা পূর্ণ সিদ্ধান্ত ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক হতে পারে না।

সুতরাং যে সব স্টেজ মাতানো ও সুরেলা বক্তারা এ জাতীয় উড়াধুড়া ও মুখরোচক গল্প দ্বারা জনগণকে বোকা বানাচ্ছেন আর যেসব আবেগী মূর্খরা ফেসবুকে এগুলো প্রচার করে মহামূল্যবান (!) লাইক ও কমেন্ট পেয়ে খুশিতে গদগদ করছেন তাদের উচিৎ, আল্লাহকে ভয় করা এবং সাহাবিদের নামে মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা। অনুরূপভাবে তাবলিগ জামাতের প্রখ্যাত আমির মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভি কর্তৃক রচিত হায়তুস সাহাবা নামক বইটিও পড়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। কারণ বইটি সাহাবিদের নামে নানা দুর্বল ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী দ্বারা সাজানো হয়েছে।
আল্লাহ আমাদেরকে আরও সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Wednesday, October 12, 2022

ঐতিহাসিক আরাফার খুতবার বাংলা অনুবাদ

 খতীব: সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য মান্যবর শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন সুলাইমান আল মানী (হাফিজাহুল্লাহ)।

بسم الله الرحمن الرحيم
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার যিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও মার্জনাকারী, মহাপরাক্রমশালী শক্তিধর ও মহা প্রতাপশালী। যিনি যাবতীয় নিয়তির নির্ধারক এবং মন্দ থেকে ভালো কে প্রভেদ করেন। যিনি অবারিত কল্যাণ ও নেয়ামতে বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং বান্দাদেরকে কখনো কখনো বিপদে আপতিত করেন যাতে নিহিত রয়েছে অনেক তাৎপর্য ও সমূহ কল্যাণ।

আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি একক এবং যাবতীয় গোপন রহস্য সম্পর্কে অবগত। আর তিনি রাত ও দিনে সংঘটিত সকল বিষয়ের নিয়ন্ত্রনকারী।

আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও নির্বাচিত রাসূল। বিশ্ব প্রতিপালক তাঁর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন-
لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ.
অর্থঃ তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। (সূরা আত-তাওবাহ্‌, আয়াত: ১২৮)

তাঁর উপর আল্লাহ তাআলার সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক, এবং তার সাথী ও উত্তম অনুসারীদের উপর যারা কল্যাণ ও সত্য প্রচারে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, আর তারাই ছিলেন সবচেয়ে পুণ্যবান মানুষ।

অতঃপর, হে মুসলিম সকল!
আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ভীতির উপদেশ দিচ্ছি, যার উপদেশ দিয়েছেন সকল পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গণ। যেমনি ভাবে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَلَقَدْ وَصَّيْنَا ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَٰبَ مِن قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَإِن تَكْفُرُوا۟ فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ وَكَانَ ٱللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدًا
অর্থঃ আর আমি নির্দেশ দিয়েছি তোমাদের পূর্ববর্তী গ্রন্থের অধিকারীদেরকে এবং তোমাদেরকে যে, তোমরা সবাই ভয় করতে থাক আল্লাহকে। যদি তোমরা তা না মান, তবে জেনো, সে সব কিছুই আল্লাহ তা’আলার যা কিছু রয়েছে আসমান সমূহে ও যমীনে। আর আল্লাহ হচ্ছেন অভাবহীন, প্রশংসিত। (সূরা আন নিসা, আয়াত: ১৩১)

আর আল্লাহ ভীতির কারণেই সকল কল্যাণ অবতীর্ণ হয় এবং সকল অকল্যাণ ও বিপদ-মুসিবত দূরীভূত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجْعَل لَّهُۥ مِنْ أَمْرِهِۦ يُسْرًا
অর্থঃ যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন। (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৪)

আর আল্লাহ ভীতি হচ্ছে আনুগত্যের পথে অগ্রগামী হওয়া এবং মন্দ ও পাপাচার হতে বিমুখ থাকা।

আল্লাহ ভীতির সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ এবং সকল ইবাদত শুধুমাত্র তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট করা। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সালাত না পড়া, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দোয়া না করা, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করা এবং তিনি ছাড়া অন্য কারো জন্য যবেহ, মান্নত ইত্যাদি না করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعْبُدُوا۟ رَبَّكُمُ ٱلَّذِى خَلَقَكُمْ وَٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
অর্থঃ হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে। (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ২১)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
وَٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا۟ بِهِۦ شَيْـًٔا
অর্থঃ আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। (সূরা আন নিসা, আয়াত: ৩৬)

তিনি আরো বলেন-
ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمْ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ خَٰلِقُ كُلِّ شَىْءٍ فَٱعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ وَكِيلٌ
অর্থঃ তিনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা। অতএব, তোমরা তাঁরই এবাদত কর। তিনি প্রত্যেক বস্তুর কার্যনির্বাহী। (সূরা আল আনআম, আয়াত: ১০২)

তিনি আরো বলেন-

قُلْ أَفَغَيْرَ ٱللَّهِ تَأْمُرُوٓنِّىٓ أَعْبُدُ أَيُّهَا ٱلْجَٰهِلُونَ.
وَلَقَدْ أُوحِىَ إِلَيْكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلْخَٰسِرِينَ.
بَلِ ٱللَّهَ فَٱعْبُدْ وَكُن مِّنَ ٱلشَّٰكِرِينَ.
অর্থঃ বলুন, হে মুর্খরা, তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করতে আদেশ করছ?
আর আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের পতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন।
বরং আল্লাহরই এবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন। (সূরা আয্‌-যুমার, আয়াত: ৬৪-৬৬)

আর এটাই হচ্ছে কালিমায়ে তাওহীদ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর প্রকৃত দাবি। আর এ স্বাক্ষী দেওয়াও তাওহীদের দাবি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। যেমন আল্লাহ তালা বলেন-
مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّۦنَ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمًا
অর্থঃ মুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা আল আহ্‌যাব, আয়াত: ৪০)

যাতে করে তাঁর আদেশের আনুগত্য করা হয় এবং তাঁর বাণীকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং তাঁর পন্থায় ব্যতীত অন্য কোনো পন্থায় আল্লাহর ইবাদত না করা হয়।

আর আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, অতএব তাতে নতুন কোন কিছু সংযোজনের প্রয়োজন নেই। আল্লাহতালা এ জায়গায় এবং এ আরাফার দিনেই তাঁর নবীর উপর আয়াত অবতীর্ণ করে বলেন-
ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلْإِسْلَٰمَ دِينًا
অর্থঃ আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত: ৩)

আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করেছেন যে ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিতঃ এ সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা, নির্ধারিত প্রাপকের জন্য নিজের মাল থেকে যাকাত বের করা, রমযানের সওম পালন এবং সামর্থ্যবানদের জন্য বাইতুল্লাহর হাজ্জ পালন।
তেমনি ভাবে ঈমানের রুকনসমূহ উল্লেখ করে বলেন- ঈমান হচ্ছে বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাব সমূহের প্রতি, তাঁর রসূলগণের প্রতি, আখেরাত দিবসের প্রতি এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি।

আল্লাহ তা’আলা বলেন-
كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْكُمْ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا۟ تَعْلَمُونَ.
فَٱذْكُرُونِىٓ أَذْكُرْكُمْ وَٱشْكُرُوا۟ لِى وَلَا تَكْفُرُونِ.
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱسْتَعِينُوا۟ بِٱلصَّبْرِ وَٱلصَّلَوٰةِ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ.
অর্থঃ যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রসূল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমুহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।

সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।

হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।
(সূরা আল বাকারা, আয়াত: ১৫১-১৫৩)

আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে নবুয়তের অনুগ্রহ দান করে তাকে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধৈর্যের অসিয়ত করেছেন।

আর আল্লাহ ভীরুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেদনাদায়ক নিয়তির উপর ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَٱلصَّٰبِرِينَ فِى ٱلْبَأْسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَحِينَ ٱلْبَأْسِ أُو۟لَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُوا۟ وَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُتَّقُونَ
অর্থাৎ, আর অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।
সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ১৭৭

ও হে মানব সকল! নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্ত নয় আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ধৈর্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍ مِّنَ ٱلْخَوْفِ وَٱلْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ.
ٱلَّذِينَ إِذَآ أَصَٰبَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوٓا۟ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيْهِ رَٰجِعُونَ.
أُو۟لَٰٓئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَٰتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُهْتَدُونَ

অর্থঃ আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।
যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।
তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।
(সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ১৫৫-১৫৭)

আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন-
وَلَنَجْزِيَنَّ ٱلَّذِينَ صَبَرُوٓا۟ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ
অর্থঃ আর যারা সবর করে, আমি তাদেরকে প্রাপ্য প্রতিদান দেব তাদের উত্তম কর্মের প্রতিদান স্বরূপ যা তারা করত।
(সূরা আন নাহল (النّحل), আয়াত: ৯৬)

আর বান্দা কেনইবা ধৈর্য ধারণ করবে না; অথচ সে তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাসী, সে নিশ্চিত বিশ্বাস করে- যা কিছু ঘটেছে তা কিছুতেই অঘটিত থাকতো না; কেননা দুনিয়ার সকলে একত্রিত হলেও আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্ত থেকে তাকে ফেরাতে পারবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فِىٓ أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِى كِتَٰبٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٌ

অর্থঃ পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সূরা আল-হাদীদ (الحديد), আয়াত: ২২)

আর এসব বিপদ মুসিবত বান্দাকে আল্লাহর নেয়ামত ও অবারিত কল্যাণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা আল্লাহতালা মানুষকে দান করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَإِن تَعُدُّوا۟ نِعْمَةَ ٱللَّهِ لَا تُحْصُوهَآ إِنَّ ٱللَّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ

অর্থঃ যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
সূরা আন নাহল (النّحل), আয়াত: ১৮

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
সূরা লোক্‌মান (لقمان), আয়াত: ২০

أَلَمْ تَرَوْا۟ أَنَّ ٱللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُۥ ظَٰهِرَةً وَبَاطِنَةً.
অর্থঃ তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যাকিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন?

আর এ সকল মুসিবত বান্দাকে তার রবের অপরিসীম ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; ফলশ্রুতিতে সে আল্লাহর দিকে বিনম্র, বিনয়ী ও প্রত্যাশী হয়ে ফিরে আসে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَبَلَوْنَٰهُم بِٱلْحَسَنَٰتِ وَٱلسَّيِّـَٔاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থঃ আর আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি ভাল ও মন্দের মাধ্যমে, যাতে তারা ফিরে আসে।
(সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ১৬৮)

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন-
وَلَنُذِيقَنَّهُم مِّنَ ٱلْعَذَابِ ٱلْأَدْنَىٰ دُونَ ٱلْعَذَابِ ٱلْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থঃ গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।
(সূরা আস সেজদাহ্ (السّجدة), আয়াত: ২১)

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন-
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَآ إِلَىٰٓ أُمَمٍ مِّن قَبْلِكَ فَأَخَذْنَٰهُم بِٱلْبَأْسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ
অর্থঃ আর আমি আপনার পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতিও পয়গম্বর প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে অভাব-অনটন ও রোগ-ব্যধি দ্বারা পাকড়াও করেছিলাম যাতে তারা কাকুতি মিনতি করে। (সূরা আল আনআম (الانعام), আয়াত: ৪২)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ أَنتُمُ ٱلْفُقَرَآءُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلْغَنِىُّ ٱلْحَمِيدُ
অর্থঃ হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।
(সূরা ফাতির (فاطر), আয়াত: ১৫)

আর এ সকল বিপদ মুসিবত মানুষকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাদেরকে জান্নাতের প্রস্তুতির জন্য উদ্বুদ্ধ করে, যেখানে কোন প্রকারের দুঃখ-দুর্দশা ও চিন্তা-ভাবনা নেই। আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّآ أُخْفِىَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَآءًۢ بِمَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ
অর্থঃ কেউ জানে না তার জন্যে কৃতকর্মের কী কী নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুকায়িত আছে।
(সূরা আস সেজদাহ্ (السّجدة), আয়াত: ১৭)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ ٱلْأَنفُسُ وَتَلَذُّ ٱلْأَعْيُنُ وَأَنتُمْ فِيهَا خَٰلِدُونَ
অর্থঃ আর তথায় রয়েছে মনে যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা তথায় চিরকাল অবস্থান করবে।
(সূরা আয্‌-যুখরুফ (الزّخرف), আয়াত: ৭১)

আর এ সকল বিপদ আপদের মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষা করা হয় এবং ধৈর্যশীল ও অধৈর্যশীলদের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

সূরা আল আম্বিয়া (الأنبياء), আয়াত: ৩৫

وَنَبْلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
অর্থঃ আর আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।

বিপদ আপদ যতই কঠিন হোক না কেন, তা কখনো চিরস্থায়ী হয় না। আল্লাহর রহমত অধিকতর প্রশস্ত এবং তার পক্ষ থেকে মুক্তি নিকটবর্তী। আর আল্লাহ তাআলা কষ্ট লাঘব ও সহজকরণের অঙ্গীকার করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
فَإِنَّ مَعَ ٱلْعُسْرِ يُسْرًا
إِنَّ مَعَ ٱلْعُسْرِ يُسْرًا
অর্থঃ নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।
অতঃপর নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।
(সূরা আল ইনশিরাহ (الشرح), আয়াত: ৫-৬)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
سَيَجْعَلُ ٱللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا
অর্থঃ আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।
(সূরা আত-তালাক (الطّلاق), আয়াত: ৭)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ
অর্থঃ আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না।
(সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ১৮৫)

আর এ সকল বিপদ আপদ আল্লাহ আনুগত্যের দ্বার সমূহ উম্মুক্ত করে, যা বিপদে পতিত হওয়ার পূর্বে তা থেকে রক্ষা পেতে এবং পতিত হওয়ার পর তা থেকে মুক্তির উপায় উপকরণ গ্রহণ করে আল্লাহ সমীপে দ্বারস্থ হওয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর শাশ্বত ইসলামী জীবন বিধান এজাতীয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। উদাহরণ স্বরূপঃ বিপাদাপদে করণীয়, এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় করণীয় সম্পর্কে ইলাহী দিকনির্দেশনা। যেমন ইসলামী শরীয়ত উপার্জন, উৎপাদন ও কর্মে আত্মনিয়োগ ও ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করছে। আর ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হচ্ছে হালাল ও জায়েজ এবং সুদ ও প্রতারণা হচ্ছে নিষিদ্ধ ও হারাম।
ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় মালের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ করেছে এবং পারস্পরিক অঙ্গীকার ও শর্ত পালনের আদেশ করেছে। তেমনি ভাবে ব্যবসায়িক লেনদেন ও পারস্পরিক সহযোগিতার বিধিমালা নির্ধারণ করেছে। পারস্পরিক ঋণ পরিশোধ ও অধিকার সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে এবং অপচয় করার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আর অসহায় ও গরিবকে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আর বিপদ-আপদ ও সংকটময় দিনে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَوْفُوا۟ بِٱلْعُقُودِ
অর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ন কর।

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وَٱلَّذِينَ إِذَآ أَنفَقُوا۟ لَمْ يُسْرِفُوا۟ وَلَمْ يَقْتُرُوا۟ وَكَانَ بَيْنَ ذَٰلِكَ قَوَامًا
অর্থঃ এবং তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।
(সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ৬৭)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلْبَيْعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰا۟
অর্থঃ আর আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।
(সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ২৭৫)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَأْكُلُوٓا۟ أَمْوَٰلَكُم بَيْنَكُم بِٱلْبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।
(সূরা আন নিসা (النّساء), আয়াত: ২৯)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وأشهدوا إذا تبايعتم
আর তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সাক্ষী রাখো।

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وأوفوا الكيل والميزان
আর তোমরা ওজন ও মাপ পূর্ণ করো।

আকাশ আল্লাহ তায়ালা জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে বলেন-
“এটি (জান্নাত) তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে।”

ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে ইসলামের শরিয়া গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাবলী দিয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, সন্তানদের লালন-পালন, সামাজিক সুসম্পর্ক, পারস্পরিক সহানুভূতি ও সাহায্যের প্রতি উৎসাহিত করেছে। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার, সাধারণ মানুষের অধিকার, নারী ও পুরুষের অধিকার সুস্থ এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকার এমনকি অন্যের মনস্তাত্ত্বিক অধিকারের ব্যাপারে ইসলামী শরিয়া নির্দেশনা দিয়েছে। বিপদাপদে পরস্পরেরর পাশে দাঁড়ানো, পারস্পরিক সদাচরণ, সদালাপ, সৌহার্দ্য সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوٓا۟ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلْوَٰلِدَيْنِ إِحْسَٰنًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ ٱلْكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا.
وَٱخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِى صَغِيرًا.
অর্থঃ তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।

আর তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।
(সূরা বনী-ইসরাঈল (الإسرا), আয়াত: ২৩-২৪)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وَقُل لِّعِبَادِى يَقُولُوا۟ ٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ إِنَّ ٱلشَّيْطَٰنَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ ٱلشَّيْطَٰنَ كَانَ لِلْإِنسَٰنِ عَدُوًّا مُّبِينًا
অর্থঃ আর আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে।
সূরা বনী-ইসরাঈল (الإسرا), আয়াত: ৫৩

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكْرَهُوا۟ شَيْـًٔا وَيَجْعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

অর্থঃ আর নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।
(সূরা আন নিসা (النّساء), আয়াত: ১৯)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
إِنَّ ٱللَّهَ يَأْمُرُ بِٱلْعَدْلِ وَٱلْإِحْسَٰنِ وَإِيتَآئِ ذِى ٱلْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ ٱلْفَحْشَآءِ وَٱلْمُنكَرِ وَٱلْبَغْىِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
অর্থঃ আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্নীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
وَءَاتِ ذَا ٱلْقُرْبَىٰ حَقَّهُۥ وَٱلْمِسْكِينَ وَٱبْنَ ٱلسَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
অর্থঃ আত্নীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না।
(সূরা বনী-ইসরাঈল (الإسرا), আয়াত: ২৬)

উসামা বিন শারিক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বিদায় হজ্বে উপস্থিত ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিলেন এবং বললেনঃ সর্বপ্রথম তোমার মা, অতঃপর তোমার পিতা, অতঃপর তোমার বোন, অতঃপর তোমার ভাই, অতঃপর নিকটজন, অতঃপর তোমার নিকটজন।

আর রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যাপারে ইসলামী শরিয়া এমনসব ব্যবস্থাপনা রেখেছে যার দ্বারা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। ইসলামী শরিয়া মানুষের অধিকার এবং সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দিয়েছে। আর অপরের প্রতি সীমালংঘন ও কষ্টদান কে নিষিদ্ধ ও হারাম করেছে। তেমনি ভাবে পারস্পরিক সংঘাতে ইন্দন দান, সন্ত্রাস লালন এবং জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি নিষেধ করেছে। ফেতনা সৃষ্টির যাবতীয় কারণসমূহ থেকে বিরত থাকতে এবং শত্রুর প্ররোচনায় পতিত না হতে নির্দেশনা দিয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং দায়িত্বশীলদের ন্যায় সঙ্গত অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে। সর্বোপরি সমাজে ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা এবং অনিষ্টতা ও অকল্যাণ বিদূরিত করতে নির্দেশ দিয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا۟
অর্থঃ আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।
(সূরা আল ইমরান (آل عمران), আয়াত: ১০৩)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَلَمْ يَلْبِسُوٓا۟ إِيمَٰنَهُم بِظُلْمٍ أُو۟لَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ
অর্থঃ যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় বিশ্বাসকে শেরেকীর সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তারাই সুপথগামী।
(সূরা আল আনআম (الانعام), আয়াত: ৮২)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
إِنَّ ٱللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا۟ ٱلْأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحْكُمُوا۟ بِٱلْعَدْلِ إِنَّ ٱللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِۦٓ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ سَمِيعًۢا بَصِيرًا.
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُوا۟ ٱلرَّسُولَ وَأُو۟لِى ٱلْأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَٰزَعْتُمْ فِى شَىْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا.
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায় ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদিগকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।
(সূরা আন নিসা (النّساء), আয়াত: ৫৮-৫৯

আল্লাহতালা আরো বলেন-
وَلَا تَبْخَسُوا۟ ٱلنَّاسَ أَشْيَآءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَٰحِهَا ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
অর্থঃ আর তোমরা মানুষকে তাদের দ্রব্যদি কম দিয়ো না এবং ভুপৃষ্টের সংস্কার সাধন করার পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না। এটাই হলো তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।
(সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ৮৫)

আল্লাহ তাআলার আরো বলেন-
وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱقْتَتَلُوا۟ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَهُمَا
অর্থঃ যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে।
(সূরা আল হুজুরাত (الحجرات), আয়াত: ৯)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
সূরা আল হুজুরাত (الحجرات), আয়াত: ১০
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থঃ মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।

আর বিদায় হজ্বের ভাষণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমাদের রক্ত ও তোমাদের সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম যেমন তা হারাম তোমাদের এ দিনে, তোমাদের এ মাসে এবং তোমাদের এ শহরে। তোমরা আমার পরে কুফরীতে ফিরে যাবে না যাতে একে অপরকে হত্যা করবে। অতঃপর তিনি তাদেরকে শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিলেন। এবং বললেন- হে মানব মণ্ডলী! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক হকদারকে তার হক প্রদান করছেন, অতঃপর বললেন তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করো, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করো, রমজানের রোজা রাখো, দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করো এবং জান্নাত তোমার প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ করো।

আর চিকিৎসাসংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী শরিয়া স্বাস্থ্য ও শারীরিক সুরক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি নির্দেশ প্রদান এবং স্বচ্ছ ও নির্মল পরিবেশ সংরক্ষণে নির্দেশ প্রদান। ইসলাম পবিত্র খাদ্যসমূহ বৈধ করেছে এবং ক্ষতিকর ও অনিষ্ট খাদ্য নিষেধ করেছে। মহামারী ও অন্যান্য রোগ ব্যাধি থেকে সমাজকে সুরক্ষা রাখতে দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغْسِلُوا۟ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى ٱلْمَرَافِقِ وَٱمْسَحُوا۟ بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى ٱلْكَعْبَيْنِ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَٱطَّهَّرُوا۟

অর্থঃ হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর, মাথা মুছেহ কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও।
(সূরা আল মায়িদাহ (المآئدة), আয়াত: ৬)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
আর তুমি তোমার পোশাককে পবিত্র করো।

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
আর যখন তুমি অসুস্থ হও তখন তিনি তোমাকে সুস্থ করে তোলেন।

আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আল্লাহর বান্দাগণ তোমরা রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করো। কেননা প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা রয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন- কুষ্ঠরোগী হতে পলায়ন করো, যেমন তুমি বাঘ হতে পালিয়ে থাকো।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন- কেউ যেন কখনও রোগাক্রান্ত উট সুস্থ উটের সাথে না রাখে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম আরও বলেন- যখন তোমরা কোন অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোন, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করো সেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না।

এ হাদীসে নববীর আলোকে মহামারি ও দ্রুত বিস্তারকারী ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় রাজকীয় সৌদি সরকার এ বছর দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণে সীমিত সংখ্যক হাজী নিয়ে হজ্ব সম্পাদনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যাতে করে স্বাস্থ্যবিধির পূর্ণ অনুসরণ ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা উপকরণ গ্রহণের মাধ্যমে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হজ্বের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করা যায়। আর এর মাধ্যমে জনসাধারণের নিরাপত্তা, মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া এবং সর্বোপরি ইসলামী শরিয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ।
বিশ্বের মুসলমানদের কল্যাণের নিমিত্তে গৃহীত এ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত মহামারী বিস্তার রোধে ও পবিত্র দুই শহর মক্কা ও মদিনার সুরক্ষায় থাকবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে ইনশাআল্লাহ।
অতএব আল্লাহতালা খাদেমুল হারামাইন শারিফাইন বাদশাহ সালমান বিন আব্দুলাজিজ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর্ণধার ব্যক্তিবর্গকে হারামাইন শরীফাইনের খেদমত ও তার সুরক্ষায় অবদানের জন্য উত্তম বিনিময় দান করুন, তাদের নেক কাজের সাওয়াবগুলো বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিন এবং তাদেরকে অনিষ্ট কারীদের কবল থেকে রক্ষা করুন।
আর মুমিন ব্যক্তি অন্যদের জন্য দোয়া করার উসিলায় নিজের জন্য, তাঁর পরিবার-পরিজন, দেশবাসী ও সমগ্র মুসলমানের জন্য দোয়া করার সুযোগ লাভ করে। যে ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করে আল্লাহ তা’আলা একজন ফেরেশতা নিয়োগ করেন যে তার সাথে আমিন বলেন এবং বলেন তোমার জন্যও অনুরূপ নির্ধারিত হোক।
আর বিশেষ করে এই পবিত্র জায়গা এবং আজকের এই পবিত্র আরাফার দিন দোয়া কবুলের অন্যতম সুযোগ। আর এ কারণেই এদিনে হাজী সাহেবদের জন্য রোযা না রাখা উত্তম বা মুস্তাহাব, যাতে করে তারা বেশি বেশি দোয়া ও জিকির করার সুযোগ লাভ করেন; যেমনটি রাসুল (সাঃ) করেছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফায় খুতবা প্রদান করেন এবং বিলাল (রা:) কে আযানের নির্দেশ দেন অতঃপর বিলাল আযান দেন এবং ইকামত দেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই রাকাত যোহরের নামায কসর করেন, অতঃপর পুনরায় ইকামতের মাধ্যমে দুই রাকাত আসরের কসর করেন, এরপর তিনি সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করেন এবং আল্লাহর যিকির ও তার নিকট দোয়া অব্যাহত রাখেন, অতঃপর মোযদালিফার উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং সেখানে মাগরিবের তিন রাকাত এবং এশার দুই রাকাত একত্রিত ও কসর করেন। অতঃপর মোযদালিফায় রাত্রি যাপন এবং সেখানে ফজর পড়েন, চারদিকে আলো উদ্ভাসিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। তারপর মিনার দিকে গমন করেন এবং বড় জামারায় সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন এবং তার হাদী (দমে শোকর) যবেহ করেন এবং মাথা মুন্ডন করেন, এরপর বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেন। অতঃপর আইয়ামে তাশরীকে মিনায় অবস্থান করেন এবং সেখানে তিন দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন, প্রত্যেহ আল্লাহ জিকির ও জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করেন। অতঃপর যখন হজ্জের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করেন এবং সফরের ইচ্ছে পোষণ করেন তখন বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেন।

এবছর আমরা সকল হাজী ও সহযোগী ব্যাক্তিদের প্রতিরক্ষা মূলক ব্যাবস্থা গ্রহনে নিশ্চিত হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। হে মুসলিমগন! নিশ্চই কল্যাণ ও নেয়ামত প্রাপ্তি এবং বিপদাপদ ও শাস্তির হতে রক্ষা পাওয়ার সর্বোত্তম সম্বল হল আল্লাহর নিকট দোয়া করা, আর আল্লাহ্ তায়ালা তার নিকট প্রার্থনা কারীদের প্রার্থনা কবুল করার অঙ্গীকার করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-
“তোমরা আমাকে তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো।”
আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-
“আর আমার বান্দা যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার নিকট এই থাকি আমি আহবানকারীর আহবানে সাড়া দেই যখন সে আমাকে আহ্বান করে।”

অতঃপর হে মুসলমান! তোমরা বিনয় ও একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, আর দোয়া কবুলের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যাশী হও এবং অন্যের দোয়ার সাথে বলো- আমিন!
হে আল্লাহ আপনি আমাদের থাকে এ মহামারী দূর করে দিন, অসুস্থদের সুস্থ করে দিন এবং অসুস্থদের চিকিৎসার সাথে জড়িতদের সক্ষমতা দান করুন এবং সঠিক রোগের নির্ণয় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উদ্ভাবনের তাওফীক দান করুন।

হে আল্লাহ্ তোমার নেয়ামত দিয়ে তাদের ভরপুর করে দাও এবং তোমার অনুগ্রহে তাদেরকে ধন্য করো, হে আল্লাহ্! তাদের অন্তরের মধ্যে ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দাও, এবং তাদেরকে আল্লাহভীতি ও সৎকাজে সহযোগী বানাও; পাপাচার এবং সীমালঙ্ঘনের কাজে নয়। আল্লাহ্ তুমি তোমার অনুগ্রহ ও করুণায় আমাদেরকে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা দান করো।
سبحان ربك رب العزة عما يصفون، وسلام على المرسلين، والحمد لله رب العلمين، وصلى الله وسلم على رسوله الآمين.
(নেট থেকে সংগৃহিত)

Translate