Tuesday, March 14, 2023

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমণ কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত

 প্রশ্ন: আমি কোন এক ওয়াজে শুনেছিলাম যে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগমন’ কিয়ামতের একটি আলামত। এটা কি সঠিক?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: হ্যাঁ, এটি হাদিস সম্মত সঠিক কথা। নিঃসন্দেহে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তারপরে কিয়ামতের পূর্বে আর কোন নবির আগমন ঘটবে না‌। অর্থাৎ এর পরেই কেয়ামত সংঘটিত হবে।
সুতরাং তাঁর আগমন নিশ্চিতভাবেই কিয়ামতের একটি আলামত। এটি সর্বপ্রথম আলামত যার মাধ্যমে কিয়ামত ঘনিয়ে আসার আলামতের সূচনা হয়েছে এবং হাদিসে বর্ণিত অন্যান্য আলামতগুলো একের পর এক ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

◆ প্রখ্যাত সাহাবি সাহল রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ هَكَذَا وَيُشِيرُ بِإِصْبَعَيْهِ فَيَمُدُّ بِهِمَا

“আমাকে পাঠানো হয়েছে কিয়ামতের সঙ্গে এভাবে। এ কথা বলে তিনি তাঁর দু আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে সে দুটোকে প্রসারিত করলেন।” [সহীহুল বুখারী, অধ্যায়: ৮১/ কোমল হওয়া, পরিচ্ছেদ: ২৭২১. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “আমাকে পাঠানো হয়েছে কিয়ামতের সাথে এ দুটি আঙ্গুলের ন্যায়।” (আল্লাহ তাআলার বাণী:)
وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلاَّ كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“আর কিয়ামতের ব্যাপার তো চোখের পলকের ন্যায় বরং তা অপেক্ষাও সত্ত্বর। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” [সূরা নাহল: ৭৭]

◆ জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

إِذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ وَعَلاَ صَوْتُهُ وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ حَتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ يَقُولُ ‏”‏صَبَّحَكُمْ وَمَسَّاكُمْ”: وَيَقُولُ ‏”‏ بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَاتَيْنِ ‏”‏‏ وَيَقْرُنُ بَيْنَ إِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى

“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুতবা দিতেন তখন তার চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ হতো, স্বর উঁচু হতো এবং কঠোর রাগ প্রকাশ পেত। মনে হতো, তিনি যেন আক্রমণকারী বাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করেছেন আর বলছেন, তারা তোমাদের উপর সকালে আক্রমণ করবে এবং বিকেলে আক্রমণ করবে।
আর তিনি বলতেন, আমি প্রেরিত হয়েছি এমন অবস্থায় যে, আমি ও কিয়ামত এ দুটির ন্যায়: অতঃপর তিনি মধ্যমা ও তর্জনী (শাহাদত) অংগুলী মিলিয়ে দেখাতেন।” [সহিহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৮/ জুমা, অনুচ্ছেদ: ৮. সালাত ও খুতবা সংক্ষিপ্তকরণ]
এই মমার্থবোধক আরও একাধিক হাদিস রয়েছে।

◍ ইমাম কুরতুবি বলেন,

أولها النبي ﷺ لأنه نبي آخر الزمان، وقد بُعِثَ ليس بينه وبين القيامة نبي

“কিয়ামতের প্রথম আলামত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কেননা, তিনি শেষ জমানার নবি। তিনি এমন সময় প্রেরীত হয়েছেন যে, তাঁর মাঝে এবং কিয়ামতের মাঝে আর কোনও নবি নেই।” [আত তাযকিরাহ ফী আলামাতিস সাআহ, (কিয়ামতের আলামত বার্তা) পৃষ্ঠা নম্বর: ১২১৯]

◍ সহিহ বুখারির ভাষ্যকার হাফেজুল হাদিস ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,

قال الضحاك: أول أشراطها بعثة محمد صلى الله عليه وسلم. والحكمة في تقدم الأشراط إيقاظ الغافلين وحثهم على التوبة والاستعداد

“যাহহাক (বিশিষ্ট মুফাসসির এবং তাবেঈ-মৃত্যু:১০২, মতান্তরে ১০৫ বা ১০৬] বলেছেন, “কিয়ামতের প্রথম আলামত হল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন। আর কিয়ামতের পূর্বে তার আলামত সমূহ প্রকাশিত হওয়ার উদ্দেশ্য হল, অসচেতনদেরকে সচেতন করা এবং তাদেরকে তওবা ও কিয়ামতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে উৎসাহ প্রদান।” [ফাতহুল বারী]
➤ আলেমগণ এটি কেয়ামতের ছোট আলামতসমূহের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, কিয়ামতের সব আলামত খারাপ বা অকল্যাণকর নয়। বরং কিছু কিছু আলামত ভালো ও কল্যাণকর। হে আল্লাহ, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে তুমি আমাদেরকে তওবা করে কিয়ামতের প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দান করো। আমিন।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ এর মাধ্যমে ভিক্ষা চাওয়ার বিধান

 প্রশ্ন: আমাদের দেশে ফকির-মিসকিনরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বলে ভিক্ষা চায়। এটা কতটুকু শরিয়ত সম্মত?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ অর্থ: “আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই; মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত দূত।”
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এমন এমন একটি বাণী যার মধ্যে বিবৃত হয়েছে, মানুষ আর জিন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। এটি ইসলামের মূল কথা। এটি কালিমাতুত তাওহিদ বা একত্ববাদের বাণী।
ভিক্ষার জন্য ইসলামে এই কালিমার আবির্ভাব ঘটেনি। বরং এটি এসেছে, ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র পৃথিবীর পরিবর্তনের জন্য। এর মর্মবাণী বাস্তবায়িত হওয়া ও না হওয়ার উপরই নির্ভর করছে মানব জাতির সাফল্য ও ব্যর্থতা, জান্নাত ও জাহান্নাম।

অথচ অজ্ঞতা বশত: এক শ্রেণীর মূর্খ মানুষ এটিকে ভিক্ষার মাধ্যম বানিয়ে ছেড়েছে! এরা এই মহান কালিমার মাধ্যমে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ায়, মানুষের কাছে হাতপাতে!! যা খুবই দুর্ভাগ্য ও লজ্জা জনক।

এভাবে তাওহিদের এই মহান বাণী দ্বারা ভিক্ষাবৃত্তি করা নাজায়েজ। কারণ এতে কালিমার মানহানি হয়, মানুষের নিকট এটিকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করা হয় এবং নষ্ট হয় এর ভাবগাম্ভীর্যতা। অবশ্য কাউকে যদি সত্যিই নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়ে অনন্যোপায় হয়ে ভিক্ষার আশ্রয় নিতে হয় তাহলে সে বলতে পারে, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে দান করুন’ ‘দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন’ বা এ জাতীয় ভাষা। কিন্তু উক্ত কালিমাতুত তাওহিদকে ভিক্ষার মাধ্যম বানানো কোনভাবেই উচিৎ নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

কুরআন শুধু মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েত না কি সমগ্র মানবজাতির জন্য হেদায়েত

 প্রশ্ন: সুরা বাকারার ২য় আয়াতে বলা হচ্ছে “এই কিতাব মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েত বা পথপ্রদর্শক।” কিন্তু আমরা জানি, কুরআন তো পুরো মানব জাতির জন্য এসেছে। তাহলে এই আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা কী হবে?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: আল্লাহ তাআলা বলেন,
ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ
“এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী মুত্তাকি বা পরহেজগারদের জন্য।” [সূরা বাকারা: ২]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ
“রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানবজাতির জন্য পথপদর্শক।” [সূরা বাকারা: ১৮৫]
উক্ত দুই আয়াতে দু রকম বলার ব্যাখ্যা কী?
উত্তর হল, হিদায়েত বা পথপ্রদর্শন দু প্রকার। যথা:
– ক. সমগ্র মানবজাতির জন্য উন্মুক্ত (আম)।
– খ. আল্লাহর বিশেষ বান্দা, পরহেজগার ও মুত্তাকিদের জন্য -(খাস)।
প্রথম প্রকার হেদায়েত (যা সমগ্র মানব জাতির জন্য উন্মুক্ত) মানে হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনের মাধ্যমে শুধু সঠিক পথের সন্ধার দেওয়া। যে কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করবে সে তাতে সত্য ও সুন্দরের পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু সে তা গ্রহণ নাও করতে পারে। হয়তো সে কুরআন থেকে সঠিক পথের সন্ধান পেল বা সঠিক জিনিসটি জানতে পারল ঠিকই কিন্তু তা গ্রহণ করার সুযোগ হল না।
পক্ষান্তরে ২য় প্রকার হেদায়েত মানে হল, শুধু সঠিক পথ দেখানোই নয় বরং তাকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেওয়া বা তাকে সত্যের সন্ধান দেওয়ার পর তাকে সে পথে চলার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এবং তাকে এ পথে টিকে থাকার তওফিক দান করা। এই প্রকার হেদায়েত কেবল আল্লাহভীরু-মুত্তাকিদের জন্য খাস। যারা আল্লাহকে ভয় করে কুরআন অধ্যয়ন করবে আল্লাহ তাদেরকে কুরআনের মাধ্যমে সঠিক পথ দেখাবেন তারপর সে পথের উপর অবিচল থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে দিবেন। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য বিশেষ নিয়ামত। যা থেকে অন্য মানুষরা বঞ্চিত হবে।
সুতরাং দু আয়াত সাংঘর্ষিক নয়। আল হামদুলিল্লাহ। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

কুরআন তিলাওয়াতের সময় আজান হলে

 প্রশ্ন: আমি জানতে চাই, যখন আজান দেয় তখন আমরা যদি কুরআন তিলাওয়াতে রত থাকি তখন কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করে আজানের উত্তর দিব নাকি কুরআন পড়া শেষ হলে আজানের উত্তর দিব?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: কুরআন তিলাওয়াতের সময় আজান শুনলে করণীয় হল, কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ রেখে আজানের জবাব দেওয়া। কারণ, আজানের সময় তার জবাব দেওয়া অধিক উত্তম অন্যান্য নফল ইবাদতের চেয়ে। কেননা আজানের সময় সংক্ষিপ্ত আর কুরআন তিলাওয়াতের সময় প্রশস্ত। আজানের জবাব দেওয়ার পর পূণরায় কুরআন তিলাওয়াত করার সুযোগ রয়েছে। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

এক কালেমায় রুটি-রুজি আর এক কালেমায় ফাঁসি শীর্ষক কথাটির বাস্তবতা কতটুকু

 মিসরের ব্রাদারহুড নেতা সাইয়েদ কুতুব-এর নামে প্রচলিত “এক কালেমায় রুটি-রুজি আর এক কালেমায় ফাঁসি” শীর্ষক কথাটির বাস্তবতা কতটুকু?

▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
বর্তমানে “এক কালেমায় রুটি রুজি আর এক কালেমায় ফাঁসি” শীর্ষক একটি কথা বা গানের কলি নিয়ে ফেসবুকে চলছে তুমুল আলোচনা-পর্যালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক।

জামায়াতে ইসলামী পন্থীদের মধ্যে এটি খুবই প্রসিদ্ধ কথা। দাবি করা হয় যে, মিসরের ব্রাদারহুড নেতা সাইয়েদ কুতুবের ফাঁসির ১ ঘণ্টা আগে জেলখানার ইমাম এসে যখন তাকে কালিমা পড়তে বলেন, তখন তিনি নাকি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আমাকে কালিমা পড়ানো লাগবে না। আমি তা জানি। যে কালিমা পড়ানোর কারণে সরকার তোমাকে বেতন দেয় সেই কালিমার কারণে আজ আমাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।” জামায়াতে ইসলামীর বিখ্যাত বক্তা মিজানুর রহমান আজহারি এভাবেই তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। এ কথাটি মোহাম্মদ রহমত উল্লাহর কথামালা এবং শিল্পী মশিউর রহমান-এর কণ্ঠের গানে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। যা আমার দেখা মতে, দেলোয়ার হোসেন সাইদির ছেলে মাসউদ সাঈদি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বাশার সহ অনেকেই শেয়ার করেছেন। শুধু তাই নয়, জামায়াত পন্থী বহু বক্তাও এ কথাটা উল্লেখ করার মাধ্যমে যে সব আলেমগণ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকে সমর্থন করেন না তাদের কালিমাকে কটাক্ষ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকে।

◍ এবার দেখা যাক, এ বিষয়টির বাস্তবতা কতটুকু?

প্রকৃত পক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও শিবির নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের পক্ষ থেকে উক্ত কথাটি সাইয়েদ কুতুবের নামে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলেও এর সপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং বলা হয়ে থাকে, যে, ইতালীয় দখলদার কর্তৃক লিবিয়ার কিংবদন্তী নেতা ও মুজাহিদ ওমর আল-মুখতার রহ. এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে তিনি প্রায় এমন একটি কথা বলেছিলেন।

গবেষকগণ বলেন, সাইয়েদ কুতুবের ফাঁসি কার্যকর করার তারিখ ও সময় সম্পর্কে কয়েকজন দায়িত্ব রত সরকারী কর্মকতা, আর্মি ও পুলিশ অফিসার ছাড়া কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। সাইয়েদ কুতুব নিজেও জানতেন না কখন তার ফাঁসি হবে। কারণ খুবই গোপনীয়তার সাথে তা বাস্তবায়ন করা হয়। যার কারণে কোনও মসজিদের ইমাম বা আজহার থেকে কোনও আলেমকেও কালিমা পড়ানোর জন্য ডাকা হয়নি। কোনও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বা ডকুমেন্টে এমন তথ্য পাওয়া যায় না।

– বিখ্যাত লেখিকা জয়নাব গাল গজালির লেখা «أيام من حياتى» (আমার জীবনের দিনগুলো) শীর্ষক বইয়ে (যা বাংলা ভাষায় ‘কারাগারে রাত দিন” নামে মগবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে) সাইয়েদ কুতুবের কালিমা পড়ানোর বিষয়ে কোনও কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। অথচ তিনি সে সময় সাইয়েদ কুতুবের বোন হামিদা কুতুবের সাথে একই জেলখানায় বন্দি ছিলেন এবং তিনি তার বইয়ে তখনকার বিভিন্ন ঘটনাবলি ও জুলুম-নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন। হ্যাঁ, ধরে নিলাম হয়ত, ফাঁসির সময় ব্রাদারহুডের কোনও নেতা-বা কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিল না। যার কারণে তিনি হয়ত তা জানতে পারেননি। কিন্তু সাইয়েদ কুতুবের ফাঁসির শেষ মুহূর্তের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ সহ বই লিখেছেন, একমাত্র ব্যক্তি মেজর জেনারেল ফুয়াদ আল্লাম। (তিনি বাস্তবেও এসব ঘটনাবলীর চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন)। বইটির নাম: “ব্রাদারহুড এবং আমি…মানশিয়া থেকে মানাসসা পর্যন্ত”
«الإخوان وأنا.. من المنشية إلى المنصة
এই বইয়ের মধ্যে তিনি ফাঁসির শেষ মুহূর্তের প্রতিটি ঘটনাবলী সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। সেখানেও কালেমা পড়ানোর বিষয়টি লিখেননি। বরং মিসরের দৈনিক ‘আল ইয়াউমুস সাবি”-এর এক সাক্ষাৎকারে উক্ত মেজর জেনারেল বলেন,

«سيد قطب لم يفتح فمه بكلمة واحدة منذ أن تسلمته من السجن الحربى وحتى تنفيذ حكم الإعدام فيه داخل سجن الاستئناف، وكنت أجلس بجواره طوال الطريق» وتابع: «عندما سأله وكيل النيابة انت عايز حاجة ؟ لم يرد عليه، وتمتم بكلمات غير مفهومة»

“সাইয়েদ কুতুবকে সামরিক কারাগার থেকে গ্রহণ করার সময় থেকে আপিল কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি শব্দও মুখ খোলেননি এবং আমি সারা পথ তার পাশে বসে ছিলাম।” তিনি আরও বলেন, “যখন প্রসিকিউটর জিজ্ঞাসা করলেন সে, তোমার কি কিছু লাগবে? তিনি তাকে উত্তর দেননি, এবং অ বোধগম্য শব্দগুলি বিড়বিড় করছিলেন।”
[সূত্র: আল ইয়াওমুস সাবি পত্রিকার অনলাইন ভার্সন, প্রবন্ধ: সাইয়েদ কুতুব-এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পূর্বে শাহাদাহ বাণী পাঠের বাস্তবতা-অনুদিত, সংক্ষেপায়িত ও পরিমার্জিত]
অত:এব যারা এই কথা নিয়ে মাতামাতি করছেন, তারা তাদের কথার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা কর্তব্য, অন্যথায় মিথ্যা রটনা থেকে বিরত থাকা।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬

লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শানে ইশক, মোহাব্বত এবং প্রেম শব্দের ব্যবহার

 প্রশ্ন: বলা হয়, “দুনিয়ার বেশি গভীরে প্রবেশ করো না; বের হতে পারবে না। দুনিয়ার মোহে পড়ে গেলে আল্লাহ প্রেমের স্বাদ পাবে না।” প্রশ্ন হল, প্রেম শব্দটি কি আল্লাহর সাথে ব্যবহার করা জায়েজ আছে? তৎসঙ্গে এই ক্ষেত্রে ইশক এবং মহাব্বত শব্দের ব্যবহারের বিধান জানতে চাই।

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর:
❑ ১. ইশক/এশক শব্দের ব্যবহার:

আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের শানে ‌ইশক/এশক (عشق) শব্দ ব্যবহার করা জায়েজ নেই। কারণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের প্রবল আকর্ষণ ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা যুক্ত ভালোবাসাকে ‘ইশক’ বলা হয়।
ইবনুল মনজুর রহ. ‘লিসানুল আরব’ শীর্ষক আরবি অভিধানে বলেন,
العِشْقُ فرط الحب وقيل هو عُجْب المحب بالمحبوب يكون في عَفافٍ الحُبّ ودَعارته
“বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ভালবাসাকে ইশক বলা হয়।” আরও বলা হয়েছে, ইশক হলো, প্রেয়সীর প্রতি প্রেমিকের অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হওয়া-চাই প্রেম-ভালবাসা পবিত্র হোক অথবা অপবিত্র।’
আরও বলা হয়েছে,
عشِق الشَّيءَ :هوِيه وتعلّق قلبُه به وأحبَّه حبًّا شديدًا
“ইশক হলো, কোনও কিছুর প্রতি আবেগ সহকারে অন্তর লেগে থাকা এবং তাকে তীব্রভাবে ভালবাসা।” [kalimmat]

এ স্তরের ভালবাসা আল্লাহ তাআলার
‌ও‌ তাঁর রসূলের জন্য সাব্যস্ত করা বৈধ নয়। তাই বান্দার অন্তরে আল্লাহর প্রতি যে ভালোবাসা থাকে, তাকেও ইশক নাম দেওয়াও যাবে না।

এ শব্দটি কুরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের মুখে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশার্থে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি।

মূলত: ভ্রান্ত সুফি পন্থী ও বিদআতিরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শানে এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।‌ যেমন: তারা বলে থাকে, আশেকে রসুল, চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক রচিত ‘আশেক-মাশুক বা এস্কে এলাহী’ নামে একটি বই রয়েছে। আমাদের সমাজে অনেক মানুষের নাম দেখা যায় ‘আশেকে এলাহি/আশেকে খোদা’। (এমন নাম রাখা নাজায়েজ।)

ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কায়েম প্রমুখ মুহাক্বিক আলিমগণ এ ক্ষেত্রে উক্ত শব্দটি ব্যবহারের বিরোধিতা করেছেন। [মাদারিজুদ সালিকিন]

ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন,

ولما كانت المحبة جنسا تحته أنواع متفاوتة في القدر والوصف، كان أغلب ما يذكر فيها في حق الله تعالى ما يختص به ويليق به، كالعبادة والإنابة والإخبات، ولهذا لا يذكر فيها العشق والغرام والصبابة والشغف والهوى.. وقد يذكر لفظ المحبة كقوله تعالى: يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَه [المائدة: 54]

“মোহাব্বত (ভালোবাসা) শব্দটি হল, একটি জাতিবাচক বিশেষ্য। এর অধীনে পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে নানা ধরণের ভিন্নতা রয়েছে। এই জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লাহর শানে তার জন্য যা নির্ধারিত এবং উপযুক্ত তাই ব্যবহৃত হয়। যেমন: দাসত্ব করা, অভিমুখী হওয়া, নত হওয়া। এ জন্য আল্লাহর শানে ইশক (চরম পর্যায়ের ভালবাসা), আসক্তি, তীব্র আকাঙ্ক্ষা, মোহ, কামনা-বাসনা…উল্লেখ করা হয় না। তবে (আল্লাহ শানে) কখনো মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দটিও উল্লেখ করা হয়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন, يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ “তাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে।” (সূরা মায়িদা: ৫৪) [ইমাম ইবনুল কাইয়েম-ইগাসাতুল লাহফান]

❑ ২. মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দের ব্যবহার:

কুরআন-সুন্নায় মোহব্বত (ভালোবাসা) শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রতি, কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি, আবার কখনো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

➧ কয়েকটি উদাহরণ:

◈ মহান আল্লাহ বলেন,

مِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّه
“আর কোন লোক এমনও রয়েছে, যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ইমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশি।” [সূরা বাকারা: ১৬৫]

◈ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ

“হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে তা দিন থেকে ফিরে যাবে, অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে।” [সূরা মায়িদা: ৫৪]

◈ তিনি আরও বলেছেন,

قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ

“(হে নবি) আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” [সূরা আলে ইমরান: ৩১]

◈ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

“তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা, পুত্র ও অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই।” [সহীহ বুখারি]

◈ তিনি আরও বলেন,

ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ

“তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে, সে ঈমানের স্বাদ পায়। আল্লাহ ও তাঁর রসুল তার কাছে অন্য সব কিছুর থেকে প্রিয় হওয়া, কাউকে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালবাসা এবং কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত ঘৃণা করা।” [বুখারি ও মুসলিম]

এভাবে এই মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দটি কুরআন ও হাদিসে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কোথাও ‘ইশক/এশক শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। অথচ শরিয়ী শব্দাবলীর ব্যবহার কুরআন-সুন্নাহর মধ্যেই সীমিত থাকা জরুরি।

উল্লেখ্য যে, মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দটি স্বামী, স্ত্রী, পিতা, মাতা, সন্তান, আলেম, কুরআন, হাদিস ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহারযোগ্য। যদিও পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মোহাব্বত বা ভালবাসার বিভিন্ন প্রকারভেদ হয়ে থাকে। (যেমনটি ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহ. উল্লেখ করেছেন।)

❑ ৩. আল্লাহর ও তাঁর রসুলের শানে ‘প্রেম’ শব্দের ব্যবহার:

কতিপয় আলেম বলেন যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ‘প্রেম’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ তা নাকি যৌন চাহিদা বা যৌনাকাঙ্ক্ষা যুক্ত ভালবাসাকে বুঝায়। কিন্তু এ মতটি আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি। কারণ বাংলা অভিধানে ‌এই শব্দটি প্রণয় এবং সাধারণ ভালোবাসা, স্নেহ, ভক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এই ভালবাসায় যৌনাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। যেভাবে শুধু ‘ভালোবাসা’ শব্দটিও উভয় ধরনের অর্থই প্রকাশ করে। ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে প্রেম শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে: ১ প্রণয়, ভালোবাসা, ২. প্রীতি (বন্ধুত্ব). ৩. স্নেহ [বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-পরিমার্জিত সংস্করণ]

❑ যৌনাকাঙ্ক্ষা মুক্ত সাধারণ ভালোবাসা, অনুরাগ এবং স্নেহ অর্থে প্রেম শব্দ ব্যবহারের কিছু উদাহরণ:

◆ দেশপ্রেম: স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ।
◆ দেশপ্রেমী: স্বদেশকে যে ভালোবাসে।
◆ প্রকৃতি প্রেমিক: প্রকৃতিকে ভালোবাসে এমন।
◆ বৃক্ষ প্রেমী: গাছ ভালোবাসে এমন।
◆ ভাতৃপ্রেম/: ভাইয়ের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা।
◆ মাতৃ প্রেম: মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বোধক ভালোবাসা।
◆ আত্ম প্রেম: নিজের প্রতি ভালোবাসা।
◆ ভাষা প্রেমিক: ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ আছে এমন।
◆ গ্রন্থ প্রেমী: বই পড়তে ভালোবাসে এমন।
◆ সাহিত্য প্রেমিক: সাহিত্যকে ভালোবাসে এমন।
◆ ঈশ্বর প্রেম: বিধর্মীরা তাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা প্রকাশে এই শব্দটি ব্যবহার করে। [বানান আন্দোলন ও অন্যান্য]

একইভাবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি সম্মানসুলভ অগাধ ভালোবাসা বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহারে কোন দোষ নেই ইনশাআল্লাহ। তবে বলা যায়, বিতর্ক এড়াতে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ক্ষেত্রে এ শব্দটি পরিহার করাই ভালো।

হ্যাঁ, কেউ যদি যৌনাকাঙ্ক্ষা সুলভ ভালোবাসা ও প্রেমাসক্তি অর্থে মহান আল্লাহ ও‌ তাঁর রসুলের শানে এই শব্দটি ব্যবহার করে তাহলে তা অবশ্যই হারাম হবে। আল্লাহু আলম (আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন)।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

আইন বিষয়ে পড়াশোনা করা এবং আইনজীবী ও বিচারক হিসেবে কাজ করার বিধান

 বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করা এবং আইনজীবী ও বিচারক হিসেবে কাজ করার বিধান

নিম্নে এ বিষয়ে ৪টি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল: وبالله التوفيق

❑ ১. আইন বিষয়ে পড়াশোনা এবং বিচার কিংবা ওকালতি পেশায় চাকরি করার বিধান

প্রশ্ন: আমরা জানি, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় ইসলামি শরিয়ত পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয় না বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব রচিত আইন-কানুন প্রচলিত রয়েছে। এমতবস্থায় ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করা, অত:পর এডভোকেট, উকিল এবং বিচারক-এর পেশায় যাওয়া কি জায়েজ হবে?
উত্তর: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। স্বভাবতই ইসলামে সমাজে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ, জুলুম-নির্যাতন, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, মতবিরোধ, অধিকার হরণ, দাবি-দাওয়া ইত্যাদি নিষ্পত্তির ব্যাপারে সুস্পষ্ট আইন-কানুন রয়েছে।
সুতরাং মুসলিম সরকারের জন্য ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও বিচারকার্য পরিচালনা করা ফরজ এবং ইসলামি আইনের বিপরীতে মানব রচিত আইন দ্বারা বিচার পরিচালনা করা হারাম। আল্লাহ তাআলা কুরআনে একাধিক স্থানে আল্লাহর আইন ব্যতিরেকে মানব রচিত আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা কারীদেরকে কাফের, ফাসেক এবং জালিম হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর আইন ও বিধান ব্যতিরেকে বিচার-ফয়সালা করা কখনও কুফরি পর্যায়ের অপরাধ, আবার কখনো কবিরা গুনাহ (ফাসেকি ও জুলুম)। দেখুন: সূরা মায়িদা-এর ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা।

সঙ্গত কারণেই ইসলামি আইন-কানুন সম্পর্কে পড়াশোনা করা অপরিহার্য (ফরজে কেফায়া)। কেননা কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জন ছাড়া তা বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও মুসলিম যদি ইসলামি আইনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এবং তথাকথিত ইসলাম বিরোধী মানব রচিত আইনের অসারতা ও ক্ষতিকারক বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে পড়াশোনা করে তাহলে এতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের এ সকল মানব রচিত আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করা, প্র্যাকটিস করা,‌ আইনি সহায়তা দেওয়া বা ওকালতি করা হারাম।

◈ আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,

وأما تعلم الإنسان للقوانين الوضعية، إذا كان يتعلمها من أجل أن يدفع الباطل بالحق ؛ فهذا لا بأس به ، وإذا كان يتعلمها من أجل أن يتبع ما فيها من القوانين المخالفة للشرع ؛ فهذا حرام. وفي هذا نقول : حتى المحاماة في بلد تحكم الشريعة فيه نقول: إذا كان المحامي يريد إيصال الحق إلى أهله ؛ فلا بأس أن يمارس هذه المهنة ، وإن كان يريد أن يغلب الناس في قوله ومحاماته بالحق أو بالباطل ؛ فهذا حرام ” انتهى باختصار من “لقاء الباب المفتوح” (33/6).

“আর কেউ যদি মানব রচিত আইন বিষয়ে শিক্ষার্জন করে সত্যে দ্বারা মিথ্যাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তাহলে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি জ্ঞানার্জন করে ততে যে সব শরিয়ত পরিপন্থী আইন-কানুন রয়েছে সেগুলোর অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে তাহলে তা হারাম। এই বিষয়ে আমরা আরও বলি: শরিয়তের বিধান বাস্তবায়িত আছে এমন দেশেও যদি আইনজীবীর উদ্দেশ্য থাকে পাওনাদারের নিকট তার পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া তাহলে এই পেশায় প্র্যাকটিস করায় কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি সে তার কথা ও ওকালতির মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা যে কোনও প্রকারে বিজয়ী হওয়ার মনোভাব রাখে তাহলে তা হারাম।”

❑ ২. মেয়েদের জন্য আইন নিয়ে পড়াশোনা করার বিধান:

প্রশ্ন: মেয়েরা কি আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে? আমার ছোট বোন পড়তে চাচ্ছে। কিন্তু আমি এতে ইচ্ছুক নই। কারণ যতটুকু জানি, এখানে পরিপূর্ণ পর্দা মানা যায় না। কিন্তু সবাইকে বুঝানোর মতন রেফারেন্স/দলিল না থাকায় আমার নিষেধ টা জোরালো হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে সাহায্য করবেন।
উত্তর: বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামি আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয় না তারপরও কেউ যদি দুর্বল, অসহায়, মজলুম-নিপীড়িত মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়া, সত্যের পক্ষে কথা বলা, ইসলামবিরোধী কার্যক্রমকে রুখে দেওয়া অথবা সাধারণ মানুষকে বৈধ ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা করার উদ্দেশ্যে এই পেশায় সৎ ভাবে কাজ করা হয় তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। তবে কোন ভাবে জেনে-বুঝে মিথ্যা-জালিয়াতি, শরিয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড অথবা জালিম বা অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া বৈধ নয়। আর এ পেশায় নারীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কথা হল, ইসলামে নারীর জন্য পর্দা রক্ষা করা ফরজ। সুতরাং তার জন্য এমন পেশায় যুক্ত হওয়া বৈধ নয় যেখানে পর্দা লঙ্ঘিত হয় বা নারী-পুরুষ সহ অবস্থান করতে হয়। চাই তা আইন পেশা হোক অথবা অন্য কোনও পেশা।

❑ ৩. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইন পেশায় কাজ করা কি বৈধ?

প্রশ্ন: বাংলাদেশ তো মানব রচিত আইন বা কুফরি শাসন ব্যবস্থা দিয়ে চলে যা আপনার অজানা নয়। এমতাবস্থায় পেশা হিসেবে যদি কেউ যদি Lawyer/Advocate হিসেবে কাজ করে তাহলে কি তা বৈধ হবে? উল্লেখ্য যে, সে তার কাজে অসৎ, অন্যয়, মিথ্যা বা খারাপ কিছুর আশ্রয় না নিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করার চেষ্টা করবে-এমনটাই তার নিয়ত।
উত্তর: মানুষ অনেক সময় জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়, অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অন্যের দ্বারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তারা বিভিন্ন কারণে ন্যায় বিচার পায় না। এক্ষেত্রে উকিল যদি তার পক্ষে কাজ করে তাকে জুলুম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে বা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তার অধিকার ফিরিয়ে দেয় তাহলে নিঃসন্দেহে তা ভালো কাজ। বরং অসহায় মানুষকে সাহায্য করার নিয়ত থাকলে এতে সে সওয়াবের অধিকারী হবে। এটি পারস্পারিক সৎকর্মে সহায়তার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ
“সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর।” [সূরা মায়িদা: ২]

তবে এই পেশায় যারা কাজ করে তাদের জন্য মিথ্যা কথা বলা, অনৈতিক কাজ করা, ভুয়া ও জাল ডকুমেন্ট হাজির করা অথবা জেনেশুনে সত্য গোপন করা এবং জালিম ও অপরাধীর পক্ষে কাজ করা জায়েজ নেই- যা অনেক উকিল কেবল মামলায় জেতার উদ্দেশ্যে করে থাকে (নাউযুবিল্লাহ)। যে আইনজীবী এসব কাজ করবে সে গুনাহগার হবে এবং এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তার জন্য হারাম বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে কোন উকিলের জন্য অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা, জালিম ও অপরাধীকে সাহায্য করা, আইনের মার-প্যাঁচে ফেলে কারো অধিকার হরণ করা অথবা শরিয়ত বহির্ভূত কোনও কাজে কাউকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ওকালতি করা কোনোভাবেই বৈধ নয়। কেননা তা পাপকর্মে সহায়তার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

“তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।” [সূরা মায়িদা: ২]

◈ আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. কে আইন পেশা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন,

فإذا كان المحامي يتقي الله، ولا يساعد صاحبه بالمنكر والكذب؛ فلا حرج عليه، الواجب عليه أن يتقي الله في محاماته، وأن يطالب بالحق، وألا يكذب، وألا يعين صاحبه على معصية الله، فإذا كان يطالب بالحق الذي يعلمه، أو يطلب من القاضي الحكم بالشرع الذي يعلمه القاضي، ولا يعلمه المحامي؛ فلا حرج عليه في ذلك.
أما أن يتعمد كذبًا، أو إعانة على كذب، أو على غش؛ فلا يجوز له، وهو آثم في ذلك وظالم،

“অতএব উকিল যদি আল্লাহকে ভয় করে এবং বিচার প্রার্থীকে অন্যায় ও মিথ্যা-জালিয়াতির মাধ্যমে সাহায্য না করে তাহলে ‌এতে কোন দোষ নেই। তার জন্য আবশ্যক হল, আইন পেশার ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা। সে (আদালতে বিচারকের নিকট) পাওনা দাবি করবে। এ ক্ষেত্রে কোনও ধরণের জালিয়াতির আশ্রয় নিবে না এবং বিচার প্রার্থীকে ‌আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে না।
অত:এব সে যদি এমন পাওনা দাবি করে যা সে জানে অথবা সে বিচারকের নিকট আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা চায় যে বিষয়ে বিচারক জ্ঞান রাখে; আইনজীবী হয়ত সে বিষয়ে জ্ঞান রাখে না তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সে যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা কথা বলে অথবা অসত্য ও প্রতারণার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তাহলে তা জায়েজ নাই। এতে সে জুলুমকারী ও গুনাহগার হবে।”

❑ ৪. প্রশ্ন: কোন মুসলিম কি কোন হিন্দু বা অন্য ধর্মের আইনজীবী দ্বারা মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করা জায়েজ?
উত্তর: ন্যায় বিচার পাওয়ার স্বার্থে যদি কোন অমুসলিম আইনজীবীকে আইন ও মামলা পরিচালনায় অধিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও পারঙ্গম মনে হয় তাহলে তার মাধ্যমে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করা দূষণীয় নয় যদি সে এ ক্ষেত্রে শরিয়ত বিরোধী কোন কাজ না করে। যেমন: মিথ্যা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য হাজির করা, ডকুমেন্ট জাল করা, উৎকোচ প্রদান ইত্যাদি। এ সকল অন্যায় ও অসৎ উপায় অবলম্বন করা সর্বাবস্থায় সকলের জন্য গর্হিত কাজ ও নিষিদ্ধ-চাই সে মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম হোক।

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রয়োজনবোধে দুনিয়াবি প্রয়োজনীয় কাজে অর্থের বিনিময়ে বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ অমুসলিমকে নিয়োগ দেওয়া জায়েজ। যেমন: আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের প্রাক্কালে মক্কা থেকে মদিনার রাস্তা দেখানোর উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহ বিন উরাইকিতকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন যদিও সে সময় সে মুশরিক ছিল। [সিরাত গ্রন্থ সমূহ] আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

বরাত অর্থ এবং প্রকৃত ভাগ্য রজনী বা মুক্তি রজনী

 প্রশ্ন: বরাত অর্থ কী? এবং প্রকৃত ভাগ্য রজনী বা মুক্তি রজনী কোনটি?

উত্তর: বরাত শব্দটি শব্দের অর্থ: কপাল, ভাগ্য বা অদৃষ্ট। যেমন: বলা হয়, বরাত মন্দ (কপাল খারাপ), বদ-নসিবের বরাত খারাব।” [জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবিতা: কামাল পাশা] এর আরেকটি অর্থ, প্রতিনিধিত্ব বা দায়িত্বও কার্যভর। এখান থেকেই বলা হয়, বিয়ের বরাত অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বলার দায়িত্ব। আরেকটি অর্থ: বরযাত্রীদল। [বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান]

যাহোক, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে আমাদের সমাজে “শবে বরাত” বা ভাগ্য রজনী বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ মানুষ মনে করে, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়। কিন্তু এ কথা ভুল। কেননা, মূলত ‘ভাগ্য রজনী’ হল, রমজান মাসের শেষ দশকের ‘শবে কদর’। কেননা, এ রাতেই মানুষের বাৎসরিক ভাগ্য বণ্টিত হয়। আর আমাদের অজানা নয় যে, তা রয়েছে রমজান মাসের শেষ দশকের কোন এক বেজোড় রাতে। মহাগ্রন্থ কুরআনে এই রাতকে ১০০০ মাসের থেকেও উত্তম বলা হয়েছে। [সূরাতুল কদরের ব্যাখ্যা পড়ুন]
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
“আমি ইহা (কুরআনুল কারিম) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। কেননা, আমি মানুষকে সতর্ক কারী। এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞা পূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়।”
◯ এ ‘বরতকময় রাত’ দ্বারা কোন রাত উদ্দেশ্য?
● অধিকাংশ তাফসির বিশারদগণ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, শবে কদর/লাইলাতুল কদর-যা রমজান মাসে রয়েছে।
ইমাম ইবনে কাসির রহ. উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন,
أي : في ليلة القدر يفصل من اللوح المحفوظ إلى الكتبة أمر السنة ، وما يكون فيها من الآجال والأرزاق ، وما يكون فيها إلى آخرها . وهكذا روي عن ابن عمر ، وأبي مالك ، ومجاهد ، والضحاك ، وغير واحد من السلف
“শবে কদর (কদরের রাতে) লাওহে মাহফুজ থেকে লেখক ফেরেশতাদের নিকট বছর ব্যাপী জীবন-মৃত্যু, রিজিক ইত্যাদি যা কিছু ঘটবে সেগুলো বণ্টন করা হয়। এমনটি বর্ণিত হয়েছে, ইবনে উমর, আবি মালিক, মুজাহিদ, যাহহাক প্রমূখ একাধিক সালাফ থেকে।” [তাফসিরে ইবনে কাসির] যারা বলেন, এর রাত দ্বারা উদ্দেশ্য, ’লাইলাতুন নিসফে শাবান’ বা অর্ধ শাবানের রাত তাদের কথা সঠিক নয়। নিম্নে এ ব্যাপারে পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হল:
● ইবনে কাসির রহ. বলেন, “উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ মর্মে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি এ কুরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছেন। আর সেটি হল কদরের রাত। যেমন: আল্লাহ বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْر
“আমি তো ইহা (কুরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা কাদর: ১] আর এ রাতটি ছিল রমজান মাসে। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ
“রমজান মাস হল, সে মা যাতে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি।” [ সূরা বাকারা: ১৮৫] এ প্রসঙ্গে হাদিসগুলো সূরা বাকারায় উল্লেখ করেছি যা পুণরোল্লেখ করার নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। আর যারা বলে যে, উক্ত রাতটি হল, অর্ধ শাবানের রাত-যেমন ইকরিমা বর্ণনা করেছেন-তাদের এ মত অনেক দূরবর্তী। কারণ, তা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী। [তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪র্থ খণ্ড ৫৭০ পৃষ্ঠা]

এ রাতটিকে ‘অর্ধ শাবানের রাত’ বলা কুরআন বিরোধী:

যারা বলে, উক্ত আয়াতে রবতমময় রাত দ্বারা অর্ধ শাবানের রাত বলে থাকে তারা উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইকরিমা থেকে বর্ণিত বক্তব্যটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি (ইকরামা) বলেন, “এ রাত হল, অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতেই সারা বছরের সকল ফয়সালা চূড়ান্ত করা হয়…।” [আল জামিউল কুরতুবী ১৬/১২৬।] কিন্তু এ দাবী মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা সরাসরি কুরআন বিরোধী। আর এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সহিহ তো নই বরং সেগুলো ভিত্তিহীন। যেমনটি ইবনুল আরবি প্রমুখ গবেষক আলেমগণ দৃঢ়তার সাথে করেছেন। সেই সাথে সেগুলো কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক (যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে)।
সুতরাং অবাক হতে হয় সে সকল মুসলমানদের অবস্থা দেখে যারা কুরআন ও সহীহ হাদিসের দলিল ছাড়া কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধিতা করে!। [তাফসিরে আযওয়াউল বায়ান, ৭/৩১৯] সুতরাং শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতকে শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী (অথবা মুক্তি রজনী) বলা নিতান্তই ভুল।
আর এই রাতে বিশেষ ফজিলতের আশায় বিশেষ কোন ধরনের ইবাদত-বন্দেগি করা বা হালুয়া-রুটি খাওয়া, দল বেঁধে কবর জিয়ারত করা, ঘরবাড়ি আলোক সজ্জা করা, এ রাতে গোসল করা, আতর সুগন্ধি মাখা, চোখে কাজল লাগানো ইত্যাদি সব বিদআত। অনুরূপভাবে এ রাতে ভালো খাবার খেলে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে এমন বিশ্বাস করা কুসংস্কার।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

শবে বরাত উপলক্ষে স্বামী যদি স্ত্রীকে হালুয়া-রুটি ইত্যাদি তৈরি করতে বাধ্য করে

 প্রশ্ন: স্বামী যদি স্ত্রীকে শবে বরাতের জন্য হালুয়া-রুটি তৈরি করতে বাধ্য করে এবং বিরোধিতা করায় স্বামী সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে তাহলে এ ক্ষেত্রে ওই স্ত্রীর করণীয় কী?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: কথিত ‘শবে বরাত’ উপলক্ষে হালুয়া-রুটি, গোস্ত-পোলাও অথবা অন্য কোন ধরনের বিশেষ খাবার-দাবারের আয়োজন করা শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ শবে বরাত পালন করা এবং এই উপলক্ষে বিশেষ খাবার অথবা কোন ধরনের আয়োজন-অনুষ্ঠান করা বিদআত তথা দিনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বিষয়।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কোন নতুন বিষয় সংযুক্ত করবে যা তার অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে (অর্থাৎ তা গ্রহণযোগ্য হবে না)। [বুখারী, হা/২৬৯৭, মুসলিম,হা/ ১৭১৮]

মুসলিমের বর্ণনার ভাষা হলো এই যে,
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ”
“যে ব্যক্তি এমন কাজ করবে যা আমাদের দ্বীনে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”
সুতরাং কথিত শবে বরাত পালন করা এবং এই উপলক্ষে স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে হালুয়া-রুটি অথবা বিশেষ কোনো খাবার প্রস্তুত করার নির্দেশ প্রদান করা হারাম। এমন নির্দেশ দিলেও স্ত্রী তা পালন করতে বাধ্য নয়।‌ কেননা ইসলামের একটি মৌলিক নীতি হলো, আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে সৃষ্টি জীবের কারও নির্দেশ মান্য করা জায়েজ নেই। আলী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا طاعة لبشر في معصية الله، إنما الطاعة في المعروف
“আল্লাহর নাফরমানিতে কোন মানুষের আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধু ভাল কাজে।” [বুখারী ও মুসলিম] তাই স্ত্রী যথাসম্ভব তার স্বামীকে আগে থেকেই এ বিষয়ে সতর্ক করবে বা বুঝাবে। কিন্তু স্বামী একরোখা স্বভাবের হওয়ায় বা বিদআতে নিমজ্জিত থাকার কারণে যদি সত্য গ্রহণে নারাজ থাকে এবং তার স্ত্রীকে এই কাজে বাধ্য করতে চায় তাহলে স্ত্রী এক্ষেত্রে অপারগ।

সুতরাং এই পরিস্থিতিতে মনের মধ্যে এহেন বিদআতের প্রতি ঘৃণাবোধ বজায় রেখে হালুয়া-রুটি বা অন্যান্য খাবার তৈরি করতে পারে। বিদআতের প্রতি এই ঘৃণাবোধের কারণে সে ইনশাআল্লাহ গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে কিন্তু এ নির্দেশ দেওয়ার কারণে স্বামী গুনাগার হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে হক জানার, বুঝার তৌফিক দান করুন এবং সব ধরনের বাতিল, ভ্রান্ত ও বিদআতি কার্যক্রম থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

পরিবারের পক্ষ থেকে পর্দা করতে বাধা দিলে করণীয়

 প্রশ্ন: আমি কয়েক মাস আগেও পর্দা করতাম না। কিন্তু দু মাস ধরে আমি পুরোপুরি পর্দা করি। যেখানেই যাই বোরখা পরিধান করি। কিন্তু আমার পরিবারের কেউ কেউ সব জায়গায় বোরখা পরে না। কিন্তু আমি পরতে চাই। তবে আমার বড়রা বলে যে, সব জায়গায় সব কিছু মানায় না। সমাজের সাথেও চলতে হয়। একা যেখানে যাও পর্দা করো। তবে পরিবারের সাথে কোথাও বেড়াতে গেলে বা দাওয়াতে গেলে বোরখা পড়া মানানসই না। হিজাব পড়লেই যথেষ্ট। এখন আমি পরিবারের জন্য পুরোপুরি পর্দা করে যেতে পারি না। তাদের সাথে যাব নাও বলতে পারি না। এখন আমার কী করণীয়?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: আপনি পর্দা করতে শুরু করেছেন এ জন্য আপনাকে অভিনন্দন। দুয়া করি, আল্লাহ যেন আপনাকে আমরণ ইসলামের এই মহান বিধানের উপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করেন আর আপনার জন্য এ পথে চলা সহজ করে দেন। আমিন।

আপনার পরিবার যেহেতু সঠিক নিয়মে পর্দা করে না তাই স্বাভাবিকভাবে তারা আপনার পর্দাকে স্বাগত জানাবে না বরং নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু পর্দা যেহেতু মুসলিম নারীর প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অলঙ্ঘনীয় ফরজ ইবাদত সেহেতু কোনভাবেই মানুষের সমালোচনার সামনে হার মানা যাবে না। কে কী বলল বা ভাবল তার চেয়ে বড় কথা হল, এটি রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নির্দেশ। তার নির্দেশ উপেক্ষা করলে তিনি হয়ত জাহান্নামের কঠিন আজাবে নিক্ষেপ করবেন। পক্ষান্তরে সকল সমালোচনা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দৃঢ়তার পরিচয় দিলে তিনি জান্নাতে অভাবনীয় পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন।

তাই মানুষের কটুকথা, ভ্রুকুঞ্চন আর তথাকথিত সামাজিকতার ওজুহাত ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে আল্লাহ বিধানের উপর অবিচল থাকুন। সেই সাথে তাদের হেদায়েতের জন্য দুআ করার পাশাপাশি যথাসম্ভব তাদেরকে আল্লাহর ভয় দেখান, জাহান্নামের শাস্তির কথা শুনান এবং তাদের কাছে পর্দার গুরুত্ব তুলে ধরুন।

আল্লাহ যদি তাদের কপালে হেদায়েত লিখে রাখেন ইনশাআল্লাহ তারাও বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। অন্যথায় তাদের সাথে ঝগড়া-ঝাড়ি ও খারাপ ব্যবহার থেকে দূরে থেকে নিজে পূর্ণ পর্দা করতে থাকুন। নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে আখিরাতে সীমাহীন পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate