Monday, March 1, 2021

নামাযে প্রচলিত ৩৭টি ভুল-ত্রুটি (ওযুর ভুল-ত্রুটি সহ)

 সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত ছালাত আদায় করার ক্ষেত্রে মুমিন সর্বাধিক সতর্ক হবে। যথাসম্ভব নির্ভূলভাবে ছালাত সম্পাদন করতে সচেষ্ট হবে। ছালাতের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত এবং ছালাতের পূর্বাপর বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিশুদ্ধভাবে পালন করবে। তার ছালাত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছালাতের সাথে মিলছে কি না তা নিশ্চিত হয়ে নিবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কি? বর্তমানে মুসলমানদের ছালাতের অবস্থা দেখলে মনে হয়না যে তারা ছালাতের মত শ্রেষ্ঠ ইবাদতটি আদায় করছেন না কি করছেন? দেখা যায় অধিকাংশ লোকের ছালাত বিভিন্ন ধরণের ভুলে ভরা।আমরা নিম্নে এমন কিছু ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করছি যেগুলো মুছল্লীদের মধ্যে দেখা যায়; অথচ তা থেকে সতর্ক থাকা সকলের জন্য জরুরী

১) তাড়াহুড়া করে ওযু করাঃ নামায ধরার জন্য তাড়াহুড়া করে ওযু করার কারণে অনেক সময় কোন কোন স্থানে পানি পৌঁছে না। শুকনা রয়ে যায় বিভিন্ন অঙ্গের কোন কোন স্থান। অথচ কোন স্থান শুকনা থেকে গেলে সেই ওযু দিয়ে ছালাত বিশুদ্ধ হবে না।
২) পেশাব ও পায়খানার চাপ রেখে ছালাত আদায় করাঃ রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لَا صَلَاةَ بِحَضْرَةِ الطَّعَامِ وَلَا هُوَ يُدَافِعُهُ الْأَخْبَثَانِ
“খাদ্য উপস্থিত হলে এবং দুটি নাপাক বস্তুর (পেশাব-পায়খানা) চাপ থাকলে ছালাত হবে না। (মুসলিম)
৩) দ্রুততার সাথে দৌড়িয়ে নামাযে শরীক হওয়াঃ অনেকে ইমামের সাথে তাকবীরে তাহরীমা পাওয়ার জন্য বা রুকু পাওয়ার জন্য দৌড়িয়ে বা দ্রুত হেঁটে ছালাতে শামীল হয়। অথচ এটা নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ فَلَا تَأْتُوهَا تَسْعَوْنَ وَأْتُوهَا تَمْشُونَ عَلَيْكُمُ السَّكِينَةُ فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوا وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا
“যখন নামাযের ইকামত প্রদান করা হয় তখন তাড়াহুড়া করে নামাযের দিকে আসবে না। বরং ধীর-স্থীর এবং প্রশান্তির সাথে হেঁটে হেঁটে আগমণ করবে। অতঃপর নামাযের যতটুকু অংশ পাবে তা আদায় করবে। আর যা ছুটে যাবে তা (ইমামের সালামের পর) পূর্ণ করে নিবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
৪) জায়নামায পাক করার জন্য দুয়া পাঠ করাঃ ইন্নী ওয়াজ্জাহ্‌তু … বলে জায়নামায পাক করার জন্য দুয়া পাঠ করা হয়। এটি একটি বিদআত। কেননা জায়নামায পবিত্র থাকলে দুয়া না পড়লেও ছালাত হবে। আর জায়নামায নাপাক থাকলে হাজার দুয়া পড়লেও তা পাক হবে না। তাছাড়া এঅবস্থায় দুয়া পাঠ করা নবীজীর ছালাতের পদ্ধতীতে প্রমাণিত নয়।
৫) ছালাত শুরুর সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করাঃ নাওয়াইতু আন… বলে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা আরেকটি বিদআত। কেননা এর পক্ষে কোন ছহীহ হাদীছ তো দূরের কথা কোন যঈফ হাদীছও পাওয়া যায় না। এ ভাবে নিয়ত না রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না ছাহাবায়ে কেরাম না তাবেঈন না তাবে-তাবেঈন না চার ইমামের কেহ করেছেন। এটা কোন বুযুর্গ ব্যক্তির তৈরী করা প্রথা। তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং তা বর্জন করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরয। নিয়ত শব্দের অর্থ-ইচ্ছা বা সঙ্কল্প করা। আর তা অন্তরে হয় মুখে নয়। সুতরাং কোন কিছু করার জন্য অন্তরে ইচ্ছা বা সঙ্কল্প করলেই সে কাজের নিয়ত হয়ে গেল। তা মুখে বলতে হবে না।
৬) নাভীর নীচে হাত বাঁধাঃ এক্ষেত্রে আহমাদ ও আবু দাঊদ বর্ণিত হাদীছটি দলীল হিসেবে পেশ করা হয়। আলী (রাঃ) বলেন, সুন্নাত হচ্ছে ছালাতে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নীচে রাখা। কিন্তু হাদীছটির সনদ দুর্বল, তাই উহা আমলযোগ্য নয়। তার বিপরীতে ছহীহ হাদীছ হচ্ছে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখা। (হাদীছটি ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) এর বরাতে আবু দাঊদে বর্ণিত হয়েছে।)
৭) সিজদার স্থানে দৃষ্টিপাত না করাঃ আকাশের দিকে বা অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করার ফলে ছালাতে ভুল হয়ে যায় এবং মনের মাঝে নানান কথার সৃষ্টি হয়। অথচ দৃষ্টি নত রাখা এবং সার্বক্ষণিক দৃষ্টি সিজদার স্থানে রাখার জন্য নির্দেশ রয়েছে। তবে তাশাহুদ অবস্থায় ডান হাতের তর্জনী খাড়া রেখে তা নাড়াতে হবে এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কি হয়েছে কিছু লোকের, তারা ছালাতরত অবস্থায় আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে? তারপর তিনি কঠোর শব্দ ব্যবহার করে বলেন, “তারা এথেকে বিরত হবে; অন্যথা তাদের দৃষ্টি শক্তি ছিনিয়ে নেয়া হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
ছালাত অবস্থায় ডানে-বামে দৃষ্টিপাতের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “এটা হচ্ছে বান্দার ছালাত থেকে কিছু অংশ শয়তানের ছিনিয়ে নেয়া।” (বুখারী)
৮) তাকবীর, কুরআন তেলাওয়াত ও ছালাতের অন্যান্য দুয়ার সময় ঠোঁট না নড়িয়ে শুধু মনে মনে বলাঃ এটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল। ইমাম নববী বলেন, ইমাম ছাড়া অন্য সবার জন্য সুন্নাত হচ্ছে সবকিছু চুপে চুপে পাঠ করা। চুপে চুপে বলার সর্বনিম্ন সীমা হচ্ছে নিজেকে শোনানো- যদি তার শ্রবণ শক্তি ঠিক থাকে এবং কথায় কোন জড়তা না থাকে। এ বিধান সকল ক্ষেত্রে ক্বিরাত পাঠ, তাকবীর, রুকু সিজদার তাসবীহ্‌ প্রভৃতি। তাছাড়া ঠোঁট না নাড়ালে তো তাকে পড়া বলা চলেনা। কারণ আরবীতে এমন অনেক অক্ষর আছে ঠোঁট না নাড়ালে যার উচ্চারণই হবে না।
৯) ছানা এবং আঊযুবিল্লাহ্‌ পাঠ না করে সরাসরি বিসমিল্লাহ্‌ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করা। ছানা ও আঊযুবিল্লাহ্‌ পাঠ করা মুস্তাহাব।
১০) সূরা ফাতিহা পাঠ না করাঃ বিশেষ করে ইমামের পিছনে ছালাত আদায় করার সময় সূরা ফাতিহা অনেকে পড়ে না। অথচ সুরা ফতিহা ছাড়া ছালাত হয় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি এমন ছালাত পড়ল যাতে সূরা ফাতিহা পড়ে নাই সে ছালাত ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ তথা অসম্পূর্ণ। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাঃ) একদা ফজরের ছালাত শেষে মুছল্লীদের বললেন, তোমরা কি ইমামের পিছে পিছে কিছু পাঠ কর? আমরা বললাম, হাঁ, দ্রুত করে পড়ে নেই। তিনি বললেন, এরূপ করো না। তবে সূরা ফাতিহা পড়ে নিও। কেননা যে ব্যক্তি এ সূরা পড়বে না তার ছালাত হবে না। (আবু দাঊদ, তিরমিযী)
১১) ইমামের ওয়ালয্‌যওয়াল্লীন বলার পর কোন কোন মুছল্লী আমীন বলার পর আরো বাড়িয়ে বলে ওয়ালে ওয়ালি দাইয়্যা ওয়া লিল মুসলিমীন। এটা সুন্নাত বহির্ভূত কাজ।
১২) দন্ডায়মান এবং বসাবস্থায় পিঠ সোজা না রাখাঃ যেমন পিঠ কুঁজো করে রাখা বা ডানে-বামে হেলে থাকা। অনুরূপভাবে রুকু ও সিজদায় পিঠ সোজা না রাখা।
রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রুকু-সিজদায় পিঠ সোজা করে না, আল্লাহ্‌ তার ছালাতের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। (ত্ববরানী ছহীহ সনদে) তিনি আরো বলেন,
أَتِمُّوا الرُّكُوعَ وَالسُّجُودَ
“তোমরা রুকু ও সিজদা পরিপূর্ণরূপে আদায় কর। (বুখারী ও মুসলিম)
১৩) রুকু অবস্থায় প্রশান্তি ও ধীরস্থীরতা অবলম্বন না করাঃ দেখা যায় অনেক মানুষ তাড়াহুড়া করে ছালাত আদায় করতে গিয়ে ভালভাবে রুকু-সিজদা করে না। রুকুর সময় পিঠ সেজা না করে মাথাটা একটু নীচু করে। মোরগের ঠোকর দেয়ার মত করে সিজদা করে। অথচ এভাবে ছালাত আদায়কারীকে হাদীছে নিকৃষ্ট ছালাত চোর বলা হয়েছে। আর তার ছালাতও বিশুদ্ধ হবে না। যায়দ বিন ওয়াহাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযায়ফা (রাঃ) দেখলেন জনৈক ব্যক্তি অপূর্ণরূপে রুকু-সিজদা করছে। তিনি তাকে বললেন, তুমি তো ছালাত আদায় করো নি। তুমি যদি এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ কর, তবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্‌ যে ফিতরাত (বা বৈশিষ্ট বা ইসলাম) দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তুমি তা ভিন্ন অন্য ফিতরাতের উপর মৃত্যু বরণ করবে। (বুখারী ও মুসলিম)
আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে (দ্রুত) ছালাত আদায় করল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “তুমি ফিরে গিয়ে ছালাত আদায় কর। কেননা তুমি ছালাতই আদায় করো নি।” (বুখারী)
১৪) রুকু থেকে উঠার পর কোন শব্দ বাড়িয়ে বলাঃ যেমন কেউ কেউ রাব্বানা লাকাল হামদু বলার পর ওয়াশ্‌ শুকরু শব্দ বাড়িয়ে বলে। এটা সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়।
১৫) রফউল ইয়াদায়ন না করাঃ অধিকাংশ মুছল্লী শুধুমাত্র তাকবীর তাহরীমা (ছালাত শুরুর সময় তাকবীর) বলার সময় রফউল ইয়াদায়ন বা হাত উত্তোলন করে থাকে; কিন্তু পরবর্তীতে রুকুর আগে ও পরে তা করে না। আবার অনেকে তাকবীর তাহরীমার সময়ও করে না। এটা সুন্নাত বিরোধী। কেননা ছহীহ্‌ বুখারী ও মুসলিমসহ বিভিন্ন গ্রন্থের একাধিক ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, উক্ত ক্ষেত্র সমূহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত উত্তোলন করেছেন। আবদুল্লাহ্‌ বিন ওমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখেছি রাসূলুল্লাহ্‌ ছালাত পড়তে দাঁড়িয়ে দুহাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। রুকুর তাকবীর বলার সময় এমনটি করতেন এবং রুকু থেকে মাথা উঠাবার সময় এরূপ করতেন এবং বলতেন সামিআল্লাহু লিমান হামীদাহ্‌। (বুখারী হা নং/ ৬৯২) সুতরাং মাযহাবের দোহাই দিয়ে এই সুন্নাতের প্রতি আমল না করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করারই নামান্তর।
১৬) ছালাতে সিজদা করার সময় সাতটি অঙ্গ পরিপূর্ণরূপে মাটিতে না রাখাঃ আবদুল্লাহ্‌ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। মুখমণ্ডল (নাক ও কপাল) দুহাত, দুহাঁটু, দুপা। (বুখারী) কিছু লোক সিজদা করার সময় দুটি পা সামান্য একটু উঠিয়ে রাখে বা এক পা অন্যটির উপর রাখে। অনুরূপভাবে কেউ কেউ শুধু কপাল মাটিতে রাখে নাক রাখে না। এরূপ করা সুন্নাতের পরিপন্থী।
উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ বলে থাকে সিজদা করার সময় আগে নাক রাখতে হবে তারপর কপাল রাখবে। আর সিজদা থেকে উঠার সময় আগে কপাল উঠাবে তারপর নাক। এরূপ খুঁটিনাটি পার্থক্য ইসলামে কোথাও নেই। এগুলো নিছক বাড়াবাড়ি।
১৭) দুসিজদার মধ্যে তর্জনী আঙ্গুল নাড়ানোঃ একাজ সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়; বরং প্রমাণিত হচ্ছে, তাশাহ্‌হুদে বসে তাশাহ্‌হুদ পড়াবস্থায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তর্জনী আঙ্গুল নড়াতে হবে। আর এটাই হচ্ছে সুন্নাত।
১৮) তাশাহুদের সময় আঙ্গুল না নড়ানোঃ অধিকাংশ মানুষ শুধুমাত্র আশহাদু আন লাইলাহা বলার সময় তর্জনী বা শাহাদত আঙ্গুল উঠায় এবং ইল্লাল্লাহু… বলার সময় আঙ্গুল নামিয়ে দেয়। এ ধরণের নিয়ম হাদীছে কোথাও বর্ণিত হয়নি। বরং ছহীহ্ হাদীছ অনুযায়ী নিয়ম হচ্ছে তাশাহ্হুদে বসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উক্ত আঙ্গুল উঠিয়ে রাখতে হবে এবং নাড়াতে হবে। “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাম হাতের তালু বাম হাঁটুর উপর বিছিয়ে দিতেন, আর ডান হাতের সবগুলো অঙ্গুলী মুষ্টিবদ্ধ করে তর্জনী দ্বারা কিবলার দিকে ইঙ্গিত করতেন এবং সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন।” (ছহীহ্ মুসলিম)
১৯) তাশাহ্হুদে বসে দরূদ পাঠ করার সময় [সাইয়্যেদেনা] শব্দ বৃদ্ধি করে পাঠ করাঃ হাফেয ইবনু হাজার (রঃ) বলেন, দুয়া যিকিরের ক্ষেত্রে হাদীছে প্রমাণিত শব্দাবলী উচ্চারণ করাই সুন্নাত সম্মত।
তাছাড়া কোন হাদীছ, ছাহাবী বা তাবেঈদের আমল থেকে এর কোন প্রমাণ নেই।
২০) তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট ছালাতের শেষ তাশাহ্হুদে তাওর্য়ারুক না করাঃ অধিকাংশ মুছল্লী সব ধরণের তাশাহ্হুদে বসে ইফতেরাশ করে। (ইফতেরাশ হচ্ছে, ডান পা খাড়া রেখে বাম পায়ের উপর বসা। আর তাওর্য়ারুক হচ্ছে, ডান পা খাড়া রেখে বাম পাকে ডান পায়ের নীচ দিয়ে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিতম্বের উপর বসা।) আবু হুমাইদ সায়েদী (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দুরাকাতে বসতেন তখন বাম পায়ের উপর বসতেন, ডান পা খাড়া রাখতেন। আর যখন শেষ রাকাতে বসতেন তখন বাম পাকে (ডান পার নীচ দিয়ে) সামনের দিকে বাড়িয়ে দিতেন এবং ডান পা খাড়া করতেন তারপর নিতম্বের উপর বসতেন। (ছহীহ্ বুখারী)
২১) দুদিকে সালাম ফেরানোর সময় মাথা ঝাঁকানোঃ লক্ষ্য করা যায় কতিপয় মুছল্লী সালাম ফেরানোর সময় মাথাটা একটু উপর দিকে উঠয়ে আবার নীচে নামায়। উভয় দিকে এরূপ করে। অথচ এটা সুন্নাতে রাসূলের বিপরীত কাজ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান দিকে সালাম ফেরানোর সময় বলতেন, আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। সে সময় তাঁর ডান গালের শুভ্র অংশ পিছন থেকে দেখা যেত। আর বাম দিকে সালাম ফেরানোর সময় বলতেন, আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। সে সময় তাঁর বাম গালের শুভ্র অংশ দেখা যেত। (তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ)
২২) সালাম ফেরানোর পর দু পাশের মুছল্লীকে সালাম দিয়ে মুসাফাহা করাঃ এব্যাপারে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহ:)কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ছালাত শেষ করে পাশের মুছল্লীর সাথে মুছাফাহা করা সুন্নাত নয়; বরং এটি একটি একটি বিদআত। (মাজমু ফাতাওয়া ২৩/২৩৯)
২৩) ছালাত শেষে জামাতবদ্ধভাবে দুআ (মুনাজাত) করাঃ ফরয ছালাত শেষ হলেই ইমাম মুক্তাদি মিলে দলবদ্ধ হয়ে মুনাজাত একটি বহুল প্রচলিত কাজ। মুসলমানগণ ব্যাপকভাবে এভাবে দুআ করে আসছে। অথচ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এব্যাপারে কোন হাদীছ পাওয়া যায় না। ছাহাবী তাবেঈদের যুগেও এর ছহীহ্ সনদ ভিত্তিক কোন প্রমাণ মিলেনা। এমনকি নবীজি থেকে ছহীহ্ তো দূরের কথা যঈফ বা মওযু বর্ণনাও পাওয়া যায় না। তাই একাজ সম্পূর্ণ সুন্নাত বিরোধী বা বিদআত। যা পরিত্যাগ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে মুসলামানগণ এই বিদআতটিকে একটি সুন্নাত তো বটেই বরং ফরযের মতই মনে করে। যার কারণে আপনি দেখবেন, যদি আপনি ফরয ছালাত শেষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পঠিতব্য ছহীহ্ হাদীছে প্রমাণিত দুআ যিকিরে মাশগুল হন, ওদের সাথে বিদআতী মুনাজাতে শরীক না হন- তবে অন্যান্য মুছল্লীরা আপনার প্রতি বাঁকা নজরে দেখবে, যেন আপনি মস্তবড় একটি অপরাধ করছেন।! আর ইমাম সাহেব যদি কখনো এই মুনাজাত ছেড়ে দেয় তবে অনেক ক্ষেত্রে তার চাকুরী নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।
২৪) পূর্বের কাতার পূর্ণ না করেই নতুন কাতার শুরু করাঃ মসজিদের প্রশস্থতা দীর্ঘ হয়ার কারণে বা তাড়াহুড়া করে রাকাআত ধরার জন্য অনেক মানুষ অলসতা করে আগের কাতার পূর্ণ না করেই নতুন একটি কাতার শুরু করে দেয়। ফলে পরবর্তীরা তাদের সাথে এসে শরীক হয় এবং অনেক সময় আগের কাতারের ডান দিক বা বাম দিক অপূর্ণই রয়ে যায়। অথচ এরূপ করা কোন ক্রমেই বৈধ নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
(مَنْ وَصَلَ صَفاًّ وَصَلَهُ اللهُ وَمَنْ قَطَعَ صَفاًّ قَطَعَهُ اللهُ)
“যে ব্যক্তি কাতার মিলিত করে আল্লাহ্ তার সথে সম্পর্ক জুড়ে দেন, আর যে ব্যক্তি কাতার বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহ্ তার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন।” (নাসাঈ, ইবনু খুযায়মা ও হাকেম।)
২৫) সরাসরি ইমামের সাথে ছালাতে শরীক না হয়ে অপেক্ষা করাঃ অর্থাৎ- ইমাম সিজদায় থাকলে বাসার অপেক্ষা করা বা বসা অবস্থায় থাকলে দাঁড়ানোর অপেক্ষা করবে। তিনি যখন দাঁড়াবেন বা রুকুতে যাবেন তখন তার সাথে ছালাতে শামিল হবে। এটা সুন্নাত বহির্ভূত কাজ; বরং ইমাম যে অবস্থাতেই থাকুন তার সাথে ছালাতে শরীক হতে হবে।
মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا أَتَى أَحَدُكُمُ الصَّلاةَ وَالْإِمَامُ عَلَى حَالٍ فَلْيَصْنَعْ كَمَا يَصْنَعُ الْإِمَامُ
“তোমাদের কেউ যদি ছালাতে উপস্থিত হয়ে ইমামকে কোন অবস্থায় পায় তবে সেভাবেই তার সাথে ছালাতে শরীক হবে ইমাম যেভাবে থাকেন।” (তিরমিযী)
২৬) ইমামের সালাম শেষ হওয়ার আগেই বা সালাম ফেরানো শুরু করলেই মাসবূকের দাঁড়িয়ে পড়াঃ (মাসবুক বলা হয় সেই মুছল্লীকে যে পরে এসে ইমামের সাথে জামাতে শরীক হয়।) শায়খ আবদুর রহমান সাদী (রহঃ) বলেন, এরূপ করা জায়েয নয়। ইমামের দ্বিতীয় সালাম শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা জরুরী। কেউ যদি ইমামের সালাম পূর্ণ হওয়ার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে তবে তার ছলাত নফল হয়ে যাবে। ফরয ছালাত তাকে পূণরায় পড়তে হবে। অবশ্য যদি আবার বসে পড়ে তারপর দাঁড়ায় তবে কোন অসুবিধা নেই।
২৭) ইমামের আগ বেড়ে কোন কাজ করাঃ যেমন ইমামের আগেই রুকূ, সিজদা করা বা দাঁড়িয়ে পড়া ইত্যাদি। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেকে এরূপ করে ফেলে। অথচ উচিত ছিল ধীরস্থিরভাবে ইমামের পরে পরে এসমস্ত কাজ করা। কেননা এক্ষেত্রে হাদীছে কঠিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,  তোমাদের কোন ব্যক্তি কি এ ভয় করে না যে, যখন ইমামের আগে সে মাথা উঠাবে, তখন হতে পারে আল্লাহ্ তার মাথাটা গাধার মাথায় পরিবর্তন করে দিবেন অথবা তার আকৃতিকে গাধার আকৃতিতে পরিবর্তন করে দিবেন? (বুখারী ও মুসলিম)
২৮) দুস্তম্ভের মধ্যবর্তী স্থানে ছালাত আদায় করাঃ কেননা এর মাধ্যমে কাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। র্ক্বরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে দুস্তম্ভের মধ্যখানে কাতার বন্দী হতে আমাদেরকে নিষেধ করা হত এবং সে স্থান থেকে আমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হত। (ইবনু মাজাহ্)
২৯) দেয়াল, স্তম্ভ প্রভৃতিতে হেলান দিয়ে ছালাত আদায় করাঃ মান্যবর শায়খ আবদুল আযীয বিন বায (রহঃ)কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেন, ফরয ছালাত আদায় করার সময় দেয়াল, স্তম্ভ প্রভৃতিতে হেলান দিয়ে ছালাত আদায় করা জায়েয নয়। কেননা ফরয ছালাতে ওয়াজিব হচ্ছে সামর্থবান ব্যক্তি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে। নফল ছালাতের ক্ষেত্রে এরূপ করতে অসুবিধা নেই। কেননা নফল ছালাত বসে আদায় করা বৈধ। সুতরাং বসে আদায় করার চাইতে দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে আদায় করা উত্তম।
৩০) কোন সুতরা ছাড়াই ছালাত আদায় করাঃ অধিকাংশ মানুষ কোন পরওয়া না করে যেখানে সেখানে ছালাত আদায় করার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। সুন্নাত হচ্ছে, কোন সুতরা সামনে রাখা। অর্থাৎ- কমপক্ষে অর্ধহাত বরাবর কোন উঁচু বস্তু সামনে রেখে ছালাতে দাঁড়ানো উচিত। আলেমদের মধ্যে অনেকে সুতরা গ্রহণ করা ওয়াজিব বলেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সুতরাং ব্যতীত ছালাত পড়বে না, আর তোমার সম্মুখ দিয়ে কাউকে অতিক্রম করতে দিবে না, যদি সে অগ্রাহ্য করে তবে তার সাথে লড়াই করবে, কেননা তার সাথে ক্বারীণ (শয়তান) রয়েছে।” (ইবনু খুযায়মা, হাকেম, বায়হাক্বী)
৩১) নামাযীর সামনে দিয়ে চলে যাওয়াঃ এবিষয়ে অনেক মানুষ ভীষণ শিথীলতা প্রদর্শন করে থাকে। অথচ এক্ষেত্রে কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আবুল জুহাইম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَوْ يَعْلَمُ الْمَارُّ بَيْنَ يَدَيِ الْمُصَلِّي مَاذَا عَلَيْهِ لَكَانَ أَنْ يَقِفَ أَرْبَعِينَ خَيْرًا لَهُ مِنْ أَنْ يَمُرَّ بَيْنَ يَدَيْهِ قَالَ أَبُو النَّضْرِ لَا أَدْرِي أَقَالَ أَرْبَعِينَ يَوْمًا أَوْ شَهْرًا أَوْ سَنَةً
“ছালাতের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রমকারী যদি জানত এতে কি পরিমাণ পাপ রয়েছে। তবে তার সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করার চাইতে চল্লিশ (বছর) দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম হত।” হাদীছের বর্ণনাকারী আবু নযর বলেন, আমার মনে পড়ে না- চল্লিশ দিন না চল্লিশ মাস না চল্লিশ বছর বলেছেন।” (বুখারী)
৩২) অনর্থক বেশী নড়াচড়া করাঃ সুন্নাত হচ্ছে মুমিন ব্যক্তি শরীর হৃদয়-মন সবকিছু উপস্থিত রেখে বিনয়-নম্র সহকারে ছালাত আদায় করবে। উক্ত ছালাত ফরয হোক বা নফল। কেননা আল্লাহ্ তাআলা বলেন, নিশ্চয় মুমিনগণ সফলকাম হবে। যারা ছালাতে বিনয়ী একাগ্র থাকে। (সূরা মুমিনূন- ১/২) সুতরাং আবশ্যক হচ্ছে অনর্থক নড়াচড়া না করে প্রশান্তি ও ধীরস্থিরভাবে ছালাত আদায় করা।
তাই ছালাত অবস্থায় বেশী হাঁটা হাঁটি করা, বেশী নাড়া-চাড়া করা, ঘড়ি দেখা, বোতাম লাগানো, আঙ্গুল ফুটানো, নাক, দাড়ী, কাপড় প্রভৃতি নাড়াচাড়া করা মাকরূহ। এগুলো নিয়ে খেলা করা যদি অধিকহারে লাগাতার হতে থাকে তবে ছালাত বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তা যদি সাধারণভাবে অল্প হয় এবং লাগাতার না হয় তবে ছালাত বাতিল হবে না। (শায়খ বিন বায (রহ:) অবশ্য কাতার বরাবর করার জন্য এবং ফাঁকা জায়গা পূরণ করার জন্য নাড়াচড়া করা ওয়াজিব।
৩৩) বিনা কারণে চোখ বন্ধ করে ছালাত আদায় করাঃ ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ:) বলেন, “ছালাত অবস্থায় দুচোখ বন্ধ রাখা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হেদায়াত বহির্ভূত কাজ। তিনি তাশাহ্হুদে বসে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের দিকে দৃষ্টি রাখতেন এবং দুআ পাঠ করতেন। অবশ্য মুছল্লীর সামনে যদি এমন কিছু থাকে যার দিকে দৃষ্টি পড়ার কারণে তার বিনয় ও একাগ্রতা বিনষ্ট হবে, তবে এক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করতে কোন অসুবিধা নেই।
৩৪) ফরয ছালাতের একামত হওয়ার পরও নফল বা সুন্নাত আদায় করতে থাকাঃ অনেক মানুষ সুন্নাত বিরোধী একাজটি করে থাকে। বিশেষ করে ফজরের সময় এটি ব্যাপক আকারে দেখা যায়। ইক্বামত হয়ে যাওয়ার পর বা ছালাত শুরু হয়ে গেলেও তাড়াহুড়া করে অনেকে দুরাকাআত ছালাত আদায় করে। আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (إذاَ أُقِيْمَتِ الصَّلاَةُ فَلاَ صَلاَةَ إلاَّ الْمَكْتُوْبَةَ)  “যখন কোন ছালাতের ইক্বামত দিয়ে দেয়া হয়, তখন সেই ছালাত ব্যতীত আর কোন ছালাত নেই।” (মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ্) ইবনু হযম (রহঃ) বলেন, ফরয নামাযের একামত হয়ে যাওয়ার পর যদি কেহ সুন্নাত নামায শুরু করে, আর এ কারণে তার তাকবীর বা এক রাকাত ছুটে যায় তবে উক্ত সুন্নাত শুরু করা তার জন্য জায়েয নয় এবং এ অবস্থায় সে আল্লাহর নাফারমান বলে গণ্য হবে।
৩৫) কাঁচা পিঁয়াজ-রসুন খেয়ে মসজিদে আসাঃ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন
مَنْ أَكَلَ مِنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ يَعْنِي الثُّومَ فَلَا يَقْرَبَنَّ مَسْجِدَنَا
“যে ব্যক্তি এ বৃক্ষ (পিয়াজ-রসুন) থেকে কোন কিছু খাবে সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটবর্তী না হয়।” (বুখারী) অবশ্য রান্নার মাধ্যমে পিঁয়াজ-রসুনের দুর্গন্ধ দূর হয়ে গেলে কোন অসুবিধা নেই। অনুরূপভাবে ধুমপান করে (মুখে দুর্গন্ধ নিয়ে) মসজিদে আসাও নাজায়েয।
৩৬) ইক্বামত দেয়ার সময় আক্বামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা বলাঃ এ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ। তাই তার উপর আমল পরিত্যাগ করাই উত্তম।
৩৭) ছালাতরত অবস্থায় হাই প্রতিরোধ না করাঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
(إذاَ تَثاَءَبَ أحَدُكُمْ فِيْ الصَّلاَةِ فَلْيَكْظِمْ ماَ اسْتَطاَعَ، فَإنَّ الشَّيْطاَنَ يَدْخُلُ)
”তোমাদের কোন ব্যক্তির ছালাত অবস্থায় যদি হাই আসে তবে সাধ্যানুযায়ী তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। কেননা ঐ অবস্থায় শয়তান ভিতরে প্রবেশ করে। (মুসলিম) প্রতিরোধ করার পদ্ধতি হচ্ছে, ঐ অবস্থায় মুখে হাত দেয়া। যেমনটি অন্যান্য বর্ণনায় পাওয়া যায়।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে পূর্বোল্লিখিত সুন্নাত বিরোধী বিষয়গুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং সুন্নাত অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছালাতের অনুরূপ ছালাত আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥
সংযুক্তি: ওযুর ক্ষেত্রে কয়েকটি ভূল-ত্রুট ১) ঘাড় মাসেহ করা। এরূপ করা রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণীত নয়। (অবশ্য এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস রয়েছে, তবে তার সবগুলোই দূর্বল হাদীস বিধায় তা আমল যোগ্য নয়।)
২) পরিপূর্ণরূপে ওযু না করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিটি অংশে পানি পোঁছানোর ব্যাপারে গুরুত্ব না দেয়া।
৩) বিস্‌মিল্লাহ্‌ না বলা, কুলি এবং নাক ঝাড়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রকাশ করা।
৪) বিভিন্ন অঙ্গ ধোয়ার সময় নির্দিষ্ট কোন দু’আ পড়া। কারণ, এরূপ দু’আ পড়া রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) থেকে সাব্যস্ত নেই।
৫) পানি ব্যবহারে অপচয় করা। রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এক মুদ (প্রায় ৩৫০ গ্রাম) পানিতে ওযু এবং এক সা‘ ( প্রায় তিন কে.জি.) পানিতে গোসল করতেন।
৬) প্রত্যেক ওযুর পূর্বে পেশাব-পায়খানার রাস্তা ধৌত করা। এমনকি বায়ু নির্গত হলেও।

জীবনে সুখী হবার ১০ টি উপায়

 ১) অন্যের কাজে নাক গলাবেন না: আমরা জীবনের বেশিরভাগ সমস্যাই সৃষ্টি করি অন্যের কাজে অহেতুক হস্তক্ষেপ করে। অন্যের চলার পথকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন না। কেননা, আল্লাহ প্রত্যেকটি মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ।

২) ক্ষমা করে মনে রাখবেন না: ক্ষমা মহৎ লক্ষণ কিন্তু সেটা মহৎ থাকে না যদি আপনি সেটা সবার মাঝে বলে বেড়ান। এমন কাজে নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় জীবনে নেই। ক্ষমা করে, ভুলে গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে জান। মনে রাখবেন, ভালোবাসাটা দেওয়ার পড় ভুলে যেতে পারলেন কিনা তার মধ্যেই প্রস্ফুটিত হয়।

৩) স্বীকৃতি পাওয়ার কামনা করবেন না: এই পৃথিবী স্বার্থপর মানুষের পরিপূর্ণ। আজ আপনার প্রশংসা করে আপনার ক্ষমতা আছে বলে, কাল যখন ক্ষমতা থাকবে না তখন ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবে না। আপনার সকল অর্জন-ত্যাগ ভুলে যাবে। কিন্তু শুধু স্বীকৃতির জন্য আপনার ভিতরের মানুষটাকে ধ্বংস করবেন কেন? আপনার কাজ আপনি যথাযথ ভাবেই করে যান।

৪) হিংসা কে মাটি চাপা দিন: কারো অর্জনে কখনো হিংসা করবেন না। হিংসা মানুষের অর্জনগুলো মাটি চাপা দিয়ে দেয়। এটা আমাদের মানসিক প্রশান্তির নষ্টেরও বড় ধরণের একটা কারণ।

৫) নিজেকে বদলান: আপনি যদি আপনার চারপাশ পরিবর্তন করে দিতে চান, তাহলে সেটা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাড়াতে পারে এবং বেশিরভাগ সময় ই আপনি এতে বিফল হবেন। তাই চারপাশের পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিন। তারপর সবাইকে নিয়েই পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যান।

৬) যা থেকে পরিত্রাণ পাবেন না, তা সহ্য করে নিনঃ প্রতিদিন আমরা এমন সব সমস্যার সম্মুখীন হই যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। এ সমস্যাগুলো নিইয়ে অহেতুক ভেবে আমরা কোন সমাধানে পৌঁছতে পারি না, কিন্তু মাঝে দিয়ে অনেক গুলো সময় নষ্ট হয়। আমাদের এ ছোট ছোট সমস্যাগুলোকে নিজেদের মানসিক প্রশান্তির জন্যই সহ্য করে নিতে হবে।

৭) সাধ্যাতীত কাজ এড়িয়ে চলুনঃ আমরা অনেকেই আমাদের সাধ্যের বাহিরেও কাজের দায়িত্ব নিয়ে থাকি। অনেক সময় আত্মমর্যাদা থেকে অহেতুক কাজের ভার বাড়িয়ে নেই।

৮) মহান আল্লাহকে স্মরণ করুনঃ সব সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখুন । তার অনুগ্রহ চান। এটা আপনার কাজের গতি বাড়িয়ে দিবে এবং কম সময়ে বেশি কাজ করতে সহায়তা করবে।”মহান আল্লাহর সহায়তা পাচ্ছেন” – এমন ভেবে কাজ করলে মনের সতেজতা অনেক গুন বৃদ্ধি পায়।

৯) মনকে শূন্য রাখবেন না: কথায় আছে- “অলস মস্তিষ্ক শতানের কারখানা”। তাই মন কে কখনো ফাকা রাখবেন না। যখনি সুযোগ পাবেন নিজেকে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত রাখবেন।

১০) অতীত নিয়ে ভাববেন না: অতীত ভুলে সামনে আগান। পিছনে জয়-পরাজয় যাই থাকুক না কেন, তা থেকে হয়তো শিক্ষা নিয়ে নয়তো অনুপ্রেরণা নিয়ে সামনে আগাতে পারেন। কিন্তু অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে কখনোই সামনে এগুবার পথ টুকু ও খুঁজে পাবেন

কেয়ামতের ভয়াবহতা ও তারপর ২য় পর্ব

 চতুর্থ অধ্যায়

জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের বিবরণ
কাফের ও মুশরিকদের যখন জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে তখন তারা জাহান্নামে বসে তাদের এ দুর্গতির জন্য একে অপরকে দোষারোপ করবে। একদল তাদের পূর্বসূরীদের দুষবে। আরেক দল তাদের নেতাদের দোষ দেবে। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনেক কথা বলেছেন তার কিছু এখানে তুলে ধরলাম।
তিনি বলবেন, আগুনে প্রবেশ কর জিন ও মানুষের দলগুলোর সাথে, যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে। যখনই একটি দল প্রবেশ করবে, তখন পূর্বের দলকে তারা লানত করবে। অবশেষে যখন তারা সবাই তাতে একত্রিত হবে তখন তাদের পরবর্তী দলটি পূর্বের দল সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের রব, এরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। তাই আপনি তাদেরকে আগুনের দ্বিগুণ আযাব দিন। তিনি বলবেন, সবার জন্য দ্বিগুণ, কিন্তু তোমরা জান না। আর তাদের পূর্ববর্তী দল পরবর্তী দলকে বলবে, তাহলে আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অতএব তোমরা যা অর্জন করেছিলে, তার কারণে তোমরা আযাব আস্বাদন কর। (সূরা আল আরাফ, আয়াত ৩৮-৩৯)
আর জাহান্নামে তারা যখন বানানুবাদে লিপ্ত হবে তখন দুর্বলরা, যারা অহঙ্কার করেছিল, তাদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম, অতএব তোমরা কি আমাদের থেকে আগুনের কিয়দংশ বহন করবে? অহঙ্কারীরা বলবে, আমরা সবাই এতে আছি; নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করে ফেলেছেন। আর যারা আগুনে থাকবে তারা আগুনের দারোয়ানদেরকে বলবে, তোমাদের রবকে একটু ডাকো না! তিনি যেন একটি দিন আমাদের আযাব লাঘব করে দেন। তারা বলবে, তোমাদের কাছে কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের রাসূলগণ আসেনি? জাহান্নামীরা বলবে, হ্যাঁ অবশ্যই। দারোয়ানরা বলবে, তবে তোমরাই দুআ কর। আর কাফিরদের দুআ কেবল নিষ্ফলই হয়।’(সূরা আল মুমিন ৪৭-৫০)
আর তারা সবাই আল্লাহর সামনে হাজির হবে, অতঃপর যারা অহঙ্কার করেছে দুর্বলরা তাদেরকে বলবে, নিশ্চয় আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম। সুতরাং তোমরা কি আল্লাহর আযাবের মোকাবেলায় আমাদের কোন উপকারে আসবে? তারা বলবে, যদি আল্লাহ আমাদের হেদায়েত করতেন, তাহলে আমরাও তোমাদের হেদায়েত করতাম। এখন আমরা অস্থির হই কিংবা ধৈর্য ধারন করি, উভয় অবস্থাই আমাদের জন্য সমান। আমাদের পালানোর কোন জায়গা নেই। (সূরা ইবরাহীম, আয়াত ২১)
নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে লানত করেছেন এবং তাদের জন্য জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রেখেছেন। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। তারা না পাবে কোন অভিভাবক এবং না কোন সাহায্যকারী। যেদিন তাদের চেহারাগুলো আগুনে উপুড় করে দেয়া হবে, তারা বলবে, হায়, আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের আনুগত্য করতাম, তারা আরো বলবে, হে আমাদের রব, আমরা আমাদের নেতৃবর্গ ও বিশিষ্ট লোকদের আনুগত্য করেছিলাম, তখন তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব, আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দিন এবং তাদেরকে বেশী করে লানত করুন। (সূরা আল আহযাব, ৬৪-৬৮)
এবং পথভ্রষ্টকারীদের জন্য জাহান্নাম উন্মোচিত করা হবে। আর তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায় যাদের তোমরা ইবাদাত করতে আল্লাহ ছাড়া? তারা কি তোমাদেরকে সাহায্য করছে, না নিজেদের সাহায্য করতে পারছে; অতঃপর তাদেরকে এবং পথভ্রষ্টকারীদেরকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে,  আর ইবলিসের সকল সৈন্যবাহিনীকেও। সেখানে পরস্পর ঝগড়া করতে গিয়ে তারা বলবে, আল্লাহর কসম! আমরা তো সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতায়  নিমজ্জিত ছিলাম। যখন আমরা তোমাদেরকে সকল সৃষ্টির রবের সমকক্ষ বানাতাম। আর অপরাধীরাই শুধু আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। অতএব, আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই এবং কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুও নেই। হায়, আমাদের যদি আরেকটি সুযোগ হত, তবে আমরা মুমিনদের অর্ন্তভুক্ত হতাম। (সূরা আশ শুআরা, আয়াত ৯১-১০২)
অনুসারীদের থেকে শয়তানের দায়মুক্তির চেষ্টা
যখন শয়তানের অনুগত কাফের মুশরিকদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তখন শয়তানকে ডাকা হবে। শয়তান বলবে এদের কূফরী ও শিরকে আমিও মোটেও যুক্ত ছিলাম না। সে আরো বলবে আমি যে এদের কুফরী ও শিরক করতে উদ্বুদ্ধ করেছি এমন কোন প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
আর যখন যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিলেন সত্য ওয়াদা। আর তোমাদের উপর আমার কোন আধিপত্য ছিল না, তবে আমিও তোমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিলাম, এখন আমি তা ভঙ্গ করলাম। তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, আর তোমরা আমার দাওয়াতে সাড়া দিয়েছ। সুতরাং তোমরা আমাকে তিরস্কার করো না, বরং নিজদেরকেই তিরস্কার কর। আমি তোমাদের উদ্ধারকারী নই, আর তোমরাও আমার উদ্ধারকারী নও। ইতঃপূর্বে তোমরা আমাকে যার সাথে শরীক করেছ, নিশ্চয় আমি তা অস্বীকার করছি। নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।  (সূরা ইবরাহীম, আয়াত ২২)
জাহান্নামবাসীদের আফসোস ও অনুতাপ
জাহান্নাবাসীরা জাহান্নামে গিয়ে যে আফসোস ও অনুতাপ করবে তার কিছু আলোচনা আল – কুরআনে এভাবে এসেছে
وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَجَعَلْنَا الْأَغْلَالَ فِي أَعْنَاقِ الَّذِينَ كَفَرُوا هَلْ يُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ. (سورة سبأ : 33)
আর তারা যখন আযাব দেখবে তখন তারা অনুতাপ গোপন করবে। আর আমি কাফিরদের গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে দেব। তারা যা করত কেবল তারই প্রতিফল তাদেরকে দেয়া হবে। (সূরা সাবা আয়াত ৩৩)
وَلَوْ أَنَّ لِكُلِّ نَفْسٍ ظَلَمَتْ مَا فِي الْأَرْضِ لَافْتَدَتْ بِهِ وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ. (سورة يونس : 54)
আর যমীনে যা রয়েছে, তা যদি যুলম করেছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির হয়ে যায়, তবে তা সে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে দেবে এবং তারা লজ্জা গোপন করবে, যখন তারা আযাব দেখবে। আর তাদের মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করা হবে এবং তাদেরকে যুলম করা হবে না। (সূরা ইউনূস, আয়াত ৫৪)
আর সেদিন যালিম (অনুতাপে) নিজের হাত দুটো কামড়িয়ে বলবে, হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে কোন পথ অবলম্বন করতাম। হায় আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশবাণী থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক। (সূরা আল ফোরকান, আয়াত ২৭-২৯)
হাদীসে এসেছে-
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: প্রত্যেক জান্নাতীকে, যদি তার কর্ম খারাপ হতো তাহলে জাহান্নামে তার অবস্থান কোথায় হত তা দেখানো হবে। তখন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। আর প্রত্যেক জাহান্নামীকে, যদি তার কর্ম ভালো হতো তাহলে জান্নাতে তার অবস্থান কোথায় হতো তা দেখানো হবে। তখন সে অনুতাপ করবে। (বর্ণনায়: বুখারী)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন জান্নাতীরা জান্নাতে যাবে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে তখন মুত্যুকে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থানে জবেহ করে দেয়া হবে। অত:পর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেবে, হে জান্নাতবাসীরা! আর কোন মৃত্যু নেই। হে জাহান্নামবাসীরা! আর কোন মৃত্যু নেই। এ ঘোষণা শুনে জান্নাতীদের আনন্দ-ফুর্তি আরো বেড়ে যাবে। আর জাহান্নামীদের দু:খ- অনুতাপ আরো বেড়ে যাবে। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম) আবু সায়ীদ আল খুদরী বর্ণিত মুসলিমের বর্ণনায় একটি বাক্য বেশী আছে। তা হল: একথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করেছেন যে,
وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْحَسْرَةِ إِذْ قُضِيَ الْأَمْرُ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ وَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ. سورة مريم: 39
আর তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপ দিবস সম্পর্কে যখন সব বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে, অথচ তারা রয়েছে উদাসীনতায় বিভোর এবং তারা ঈমান আনছে না। (সূরা মারইয়াম, আয়াত ৩৯) উদাসীনতায় বিভোর কথাটি বলার সময় তিনি দুনিয়ার দিকে হাত দ্বারা ইশারা করেছেন। (বর্ণনায় : মুসলিম)
জাহান্নামের শাস্তি হবে চিরস্থায়ী
আল্লাহ তাআলা বলেন:নিশ্চয় অপরাধীরা জাহান্নামের আযাবে স্থায়ী হবে; তাদের থেকে আযাব কমানো হবে না এবং তাতে তারা হতাশ হয়ে পড়বে।  আর আমি তাদের উপর যুলম করিনি; কিন্তু তারাই ছিল যালিম। তারা চিৎকার করে বলবে, হে মালিক, তোমার রব যেন আমাদেরকে শেষ করে দেন। সে বলবে, নিশ্চয় তোমরা অবস্থানকারী। অবশ্যই তোমাদের কাছে আমি সত্য নিয়ে এসেছিলাম; কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই ছিলে সত্য অপছন্দকারী। (সূরা যুখরুফ, আয়াত ৭৪-৭৮)
তিনি আরো বলেন:
আর যারা কুফরী করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদের প্রতি এমন কোন ফয়সালা দেয়া হবে না যে, তারা মারা যাবে, এবং তাদের থেকে জাহান্নামের আযাবও লাঘব করা হবে না। এভাবেই আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। আর সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করে দিন, আমরা পূর্বে যে আমল করতাম, তার পরিবর্তে আমরা নেক আমল করব। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি যে, তখন কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত? আর তোমাদের কাছে তো সতর্ককারী এসেছিল। কাজেই তোমরা আযাব আস্বাদন কর, আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা আল ফাতির, আয়াত ৩৬-৩৭)
জাহান্নামের শিকল ও আলকাতরা
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ ﴿49﴾ سَرَابِيلُهُمْ مِنْ قَطِرَانٍ وَتَغْشَى وُجُوهَهُمُ النَّارُ ﴿50﴾ (سورة إبراهيم)
আর সে দিন তুমি অপরাধীদের দেখবে তারা শিকলে বাঁধা। তাদের পোশাক হবে আলকাতরার এবং আগুন তাদের চেহারাসমূহকে ঢেকে ফেলবে। (সূরা ইবরাহীম, আয়াত ৪৯-৫০)
আর যদি তুমি আশ্চর্য বোধ কর, তাহলে আশ্চর্যজনক হল তাদের  বক্তব্য, আমরা যখন মাটি হয়ে যাব, তখন কি আমরা নতুন সৃষ্টিতে পরিণত হব? এরাই তারা, যারা তাদের রবের সাথে কুফরী করেছে,আর ওদের গলায় থাকবে শিকল এবং ওরা অগ্নিবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে। (সূরা আর রাদ, আয়াত ৫)
জাহান্নামের যাক্কুম বৃক্ষ
আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেন:
নিশ্চয় যাক্কুম বৃক্ষ পাপীর খাদ্য ; গলিত তামার মত, উদরসমূহে ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত পানির মত (বলা হবে) ওকে ধর, অতঃপর তাকে জাহান্নামের মধ্যস্থলে টেনে নিয়ে যাও। তারপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও। (বলা হবে) তুমি আস্বাদন কর, নিশ্চয় তুমিই সম্মানিত, অভিজাত। নিশ্চয় এটা তা-ই যে বিষয়ে তোমরা সন্দেহ করতে। (সূরা আদ দুখান, আয়াত ৪৩-৫০)
আপ্যায়নের জন্য এগুলো উত্তম না যাক্কুম বৃক্ষ, নিশ্চয় আমি তাকে যালিমদের জন্য করে দিয়েছি পরীক্ষা। নিশ্চয় এ গাছটি জাহান্নামের তলদেশ থেকে বের হয়। এর ফল যেন শয়তানের মাথা, নিশ্চয় তারা তা থেকে খাবে এবং তা দিয়ে পেট ভর্তি করবে। তদুপরি তাদের জন্য থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ। তারপর তাদের প্রত্যাবর্তন হবে জাহান্নামের আগুনে। নিশ্চয় এরা নিজদের পিতৃপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ট পেয়েছিল, ফলে তারাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে দ্রুত ছুটেছে। (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ৬২-৭০)
এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন: তোমরা আল্লাহ-কে যথাযথ ভয় করো আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। এরপর তিনি বললেন: যদি যাক্কুম বৃক্ষ থেকে একটি ফোটা পৃথিবীতে পতিত হয়, তাহলে তা পৃথিবীবাসীর সব জীবনোপকরণ নষ্ট করে দেবে। অতএব যে তা খাবে তার অবস্থা কী হবে? (বর্ণনায়: তিরমিজী। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
গলিত পুঁজ হবে জাহান্নামীদের খাদ্য
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:
আর তারা বিজয় কামনা করল, আর ব্যর্থ হল সকল স্বৈরাচারী হঠকারী। এর সামনে রয়েছে জাহান্নাম, আর তাদের পান করানো হবে গলিত পুঁজ থেকে। সে তা গিলতে চাইবে এবং প্রায় সহজে সে তা গিলতে পারবে না। আর তার কাছে সকল স্থান থেকে  মৃত্যু ধেঁয়ে আসবে, অথচ সে মরবে না। আর  এর পরেও রয়েছে কঠিন আযাব । (সূরা ইবরাহীম, আয়াত ১৫-১৭)
এরা দুটি বিবাদমান পক্ষ, যারা তাদের রব সম্পর্কে বিতর্ক করে। তবে যারা কুফরী করে তাদের জন্য আগুনের পোশাক প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের মাথার উপর থেকে ঢেলে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি। যার দ্বারা তাদের পেটের অভ্যন্তরে যা কিছু রয়েছে তা ও তাদের চামড়াসমূহ বিগলিত করা হবে। আর তাদের জন্য থাকবে লোহার হাতুড়ী। যখনই তারা যন্ত্রণাকাতর হয়ে তা থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে, তখনই তাদেরকে তাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বলা হবে, দহন-যন্ত্রণা আস্বাদন কর। (সূরা আল হজ, আয়াত ১৯-২২)
সৎকাজে আদেশ করে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করে অথচ নিজে তা থেকে দূরে থাকে না এমন ব্যক্তির শাস্তি
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা অন্যকে ভাল কাজের আদেশ দেয় কিন্তু নিজে করে না। আবার অন্যকে অন্যায় ও পাপাচার থেকে ফিরে থাকতে বলে অথচ সে নিজে তাতে লিপ্ত হয়। এমন ব্যক্তি জাহান্নামে এক বিশেষ ধরনের শাস্তি ভোগ করবে।
হাদীসে এসেছে
উসামা ইবনে যায়েদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, তার পেটের নাড়িভুরিগুলো ঘুরপাক খেতে থাকবে। ফলে সে গাধার মত ঘুরতে থাকবে। গাধা যেমন চরকার পাশে ঘুরে থাকে। জাহান্নামের অধিবাসীরা তাকে দেখার জন্য জড়ো হবে। তারা তাকে বলবে, এই! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি কি সৎ কাজের আদেশ করতে না আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করতে না? সে বলবে: হ্যা, আমি সৎ কাজের আদেশ করতাম কিন্তু তা নিজে করতাম না। আর অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলতাম কিন্তু নিজে তাতে লিপ্ত হতাম। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
জাহান্নামে সবচেয়ে নিম্নমানের শাস্তির ধরন
হাদীসে এসেছে
সাহাবী নুমান ইবনে বশীর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জাহান্নামীদের মধ্যে যার সবচেয়ে হাল্কা শাস্তি হবে তার শাস্তির ধরনটা এমন হবে যে, তার পায়ে আগুনের দুটো জুতা থাকবে ও আগুনের দুটো ফিতা থাকবে। এর আগুনের তাপে তার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে যেমন ডেগের মধ্যে পানি ফুটতে থাকে। লোকেরা তার অবস্থা দেখে মনে করবে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু নেই। অথচ এ শাস্তিটা হল সবচেয়ে হাল্কা শাস্তি। (বর্ণনায় : মুসলিম)
জাহান্নামে শাস্তির বিভিন্ন স্তর
হাদীসে এসেছে-
সামুরা ইবনে জুনদাব রা. থেকে বর্ণিত যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জাহান্নামীদের কারো পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত আগুনে স্পর্ষ করবে। করো হাটু পর্যন্ত আগুনে স্পর্ষ করবে। কারো কোমর পর্যন্ত আবার কারো কণ্ঠ পর্যন্ত আগুন স্পর্ষ করবে। (বর্ণনায় : মুসলিম)
নারীরা অধিকহারে জাহান্নামে যাবে
হাদীসে এসেছে-
উসামা ইবনে যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমি জান্নাতের গেটে দাড়ালাম, দেখলাম যারা তাতে প্রবেশ করেছে তারা অধিকাংশ ছিল দুনিয়াতে দরিদ্র অসহায়। আর ধনী ও প্রভাবশালীদের আটকে দেয়া হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে যাদের জাহান্নামে যাওয়ার ফয়সালা হয়ে গেছে তাদের কথা আলাদা। আর আমি জাহান্নামের প্রবেশ পথে দাড়ালাম। দেখলাম, যারা প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশ নারী। (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
কেন নারীরা পুরুষদের তুলনায় অধিকহারে জাহান্নামে যাবে?
অন্য একটি হাদীসে এ সম্পর্কে এসেছে.
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হে নারীগণ! তোমরা দান-সদাক করো। বেশী বেশী করে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। কেননা আমি জাহান্নামে তোমাদের অধিকহারে দেখেছি। এ কথা শোনার পর উপস্থিত মহিলাদের মধ্য থেকে একজন -যার নাম ছিল জাযলা-  প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কেন এ অবস্থা? কেন জাহান্নামে আমরা বেশী সংখ্যায় যাবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমরা স্বামীর প্রতি বেশী অকৃতজ্ঞ ও অভিশাপ দাও বেশী। (বর্ণনায় : মুসলিম)
বলতে খারাপ শুনালেও আসলে আমাদের সমাজের নারীদের বাস্তব চিত্র এ রকমই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। আমি দাম্পত্য জীবনে অনেক সুখী নারীকে দেখেছি তারা স্বামীর প্রতি অনেক সময় চরম অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। অনেক সময় সামান্য বিরক্ত হলে নিজ সন্তানদেরও অভিশাপ দেয়। নারীদের জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য এ দুটো স্বভাব পরিহার করতে হবে অবশ্যই। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বলার উদ্দেশ্য এটাই। তিনি নারীদের স্বভাব সংশোধন করার জন্যই এ কথা বলেছেন। নারীদের খাটো করা বা তাদের ভূমিকা অবমুল্যায়নের জন্য বলেননি।
 
পঞ্চম অধ্যায়
জান্নাত ও তার অধিবাসীদের বিবরণ
যারা জান্নাতে যাবেন তারা হলেন, নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও ঈমানদার সৎকর্মশীল মানুষ।
জান্নাত এমন একটি স্থান যার পাশ দিয়ে বয়ে যায় নদী। যার প্রাসাদসমূহ তৈরী হয়েছে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইট দিয়ে। এ প্রাসাদের অন্যান্য উপকরণসমূহের মধ্যে আছে মনি-মুক্তা, মৃগনাভী, হিরা-মানিক্য ইত্যাদি। সেখানে আছে নারী-পুরুষ সকলের জন্য পবিত্র সঙ্গী-সাথী। আছে সব ধরনের ফল-মুল। সেখানের অধিবাসীরা খাওয়া-দাওয়া আর আমোদ-ফুর্তিতে মত্ত থাকবে। থাকবে না কোন ধরনের দু:চিন্তা ও ভয়-ভীতি। সেখানে থাকে হাসি ও আনন্দ। থাকবে না কোন কান্না। মৃত্যু থাকবে না। থাকবে না মৃত্যুর দু:চিন্তা। সবচেয়ে বড় নেআমাত হল আমাদের মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাক্ষাত লাভ ও তার সন্তুষ্টি।
মোট কথা হল, সেখানের সুখ শান্তি, আনন্দ-ফুর্তির কোন দৃষ্টান্ত কোন চোখ এখনো দেখেনি। কোন কান কখনো শুনেনি। তার সত্যিকার ধরণ সম্পর্কে কোন হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি।
সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
হাদীসে এসেছে-
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: آتي باب الجنة يوم القيامة . فأستفتح . فيقول الخازن : من أنت ؟ فأقول : محمد . فيقول : بك أمرت لا أفتح لأحد قبلك. رواه مسلم.
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমি কেয়ামতের দিন জান্নাতের গেটে এসে জান্নাত খুলে দিতে বলবো। তখন দারোয়ান প্রশ্ন করবে, আপনি কে? আমি বলবো, আমি মুহাম্মদ। তখন সে বলবে, আমাকে নির্দেশ দেয়া আছে যে, আপনার পূর্বে আমি যেন কারো জন্য জান্নাতের দরজা খুলে না দেই।
(বর্ণনায়: মুসলিম)
প্রথম যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে
হাদীসে এসেছে.
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম সা বলেছেন: কেয়ামতের দিন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষদের কিভাবে হাজির করা হবে তার একটি চিত্র আমাকে দেখানো হয়েছে। আমি দেখলাম একজন নবী আসলেন তার সাথে দশ জনের কম সংখ্যক অনুসারী। আরেকজন নবী আসেলন, তার সাথে একজন বা দুজন অনুসারী। আবার আরেকজন নবী আসলেন তার সাথে কোন অনুসারী নেই। এরপর দেখলাম বড় একদল মানুষকে আনা হল। আমি ধারনা করলাম এরা আমার অনুসারী হবে। কিন্তু আমাকে বলা হল, এরা মূছা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারী। আমাকে বলা হল, আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। আমি তাকালাম। দেখলাম বিশাল একদল মানুষ। আমাকে বলা হল, এবার অন্য প্রান্তে তাকান। আমি তাকালাম। দেখলাম, সেখানেও বিশাল একদল মানুষ। আমাকে বলা হল, এরা সকলে আপনার অনুসারী। এবং তাদের মধ্যে সত্তর হাজার মানুষ এমন আছে, যারা কোন হিসাব-নিকাশ ও শাস্তি ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ কথাগুলো বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে তাঁর ঘরে গেলেন। উপস্থিত লোকজন এ সকল লোক কারা হবে এ নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিল। কেহ কেহ বললো, তারা হবে ঐ সকল মানুষ যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহচর্য লাভ করেছে। কেহ বললো, তারা হবে ঐ সকল মানুষ যারা ইসলাম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে আর কখনো শিরক করেনি। আবার অনেকে অন্য অনেক কথা বললো। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে আসলেন। বললেন, তোমরা কি নিয়ে বিতর্ক করছিলে? তখন তারা বলল, ঐ সকল লোক হবে কারা এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ঐ সকল লোক হলো তারা. যারা ঝাড়-ফূঁক করে না। ঝাড়-ফূঁক করতে যায় না। যারা কুলক্ষণ সুভ লক্ষণে বিশ্বাস করে না। আর শুধু তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর (তাওয়াক্কুল) করে।
এ কথা শুনে উকাশা ইবনে মিহসান দাড়িয়ে গেলেন আর বললেন, হে রাসূল! আপনি আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন, তিনি যেন আমাকে এ সকল লোকদের অন্তর্ভূক্ত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলে। এরপর আরেকজন দাড়িয়ে বললেন, হে রাসূল! আপনি আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন, তিনি যেন আমাকেও এ সকল লোকদের অন্তর্ভূক্ত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,  উকাশা তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসটি থেকে আমরা যা জানতে পারি:
এক. অন্যান্য নবীদের অনুসারীদের তুলনায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসারীদের সংখ্যা হবে অনেক বেশী।
দুই. মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসারীদের মধ্যে সত্তর হাজার মানুষ বিনা হিসাব ও কোন শাস্তি ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তিন. শরীয়ত অনুমোদিত ঝাড়-ফুঁক বৈধ। আর যে সকল ঝাড়-ফুঁক শরীয়ত অনুমোদন করে না তা নিষিদ্ধ। বৈধ ঝাড়-ফুঁক করা বা করানো তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। তবে এগুলো পরিহার করে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভর করা হলো তাওয়াক্কুলের একটি শীর্ষ স্থান। যারা এ শীর্ষ স্থানের অধিকারী হতে পারবে তারা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবে।
চার. কোন কিছু দেখে বা কোন কিছু করে তার মাধ্যমে শুভ অশুভ নির্ণয় করা জায়েয নয়।
পাঁচ. কুরআন বা হাদীসের কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক বা আলোচনা করা দোষের কিছু নয়। সাহাবীগন যখন এ ভাগ্যবান মানুষগুলো কারা হবেন এ বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিষেধ করেননি। বা বিতর্ক করা ঠিক নয় বলে কোন মন্তব্য করেননি।
ছয়. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব ব্যাপারে মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রবর্তন করেছেন। তার সমকালে কোন রাজা-বাদশা বা ধর্মীয় নেতারা তাদের লোকদের এভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেননি। কারো মতামত ভুল হলেও তিনি তা প্রকাশ করার জন্য উৎসাহ দিতেন। কাউকে মতামত প্রকাশে বাধা প্রদান করেননি।
সাত. কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুআ করতে বলা শরীয়ত অনুমোদিত কাজ বলে স্বীকৃত ছিল যতদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত ছিলেন। যেমন; আমরা এ হাদীসে দেখলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে উক্কাশা রা. দুআ চেয়েছেন। এমনিভাবে জীবিত কোন আলেম বা বুযুর্গ ব্যক্তির কাছে যে কোন ব্যাপারে দুআ চাওয়া যায়। কিন্তু কোন মৃত নবী বা অলীর কাছে কোন ব্যাপারে দুআ চাওয়া যায় না।
আট. এ হাদীসটি আমাদের সকলকে যথাযথভাবে আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল করা ও তাওয়াক্কুলের শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে।
জান্নাতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মর্যাদা
হাদীসে এসেছে-
মুগীরা ইবনে শোবা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: মুসা আলাইহিস সালাম তার প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করলেন, জান্নাতবাসীদের মধ্যে  সর্বনিম্ন মর্যাদার লোকটি মর্যাদা কি রকম হবে? আল্লাহ তাআলা বললেন: সে হল এমন এক ব্যক্তি, জান্নাতের অধিবাসীদের জান্নাতে প্রবেশ করানোর পর আমি তাকে বলবো, তুমি জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলবে, হে প্রভূ! কিভাবে আমি জান্নাতে প্রবেশ করবো যখন সকলকে নিজ নিজ মর্যাদা অনুযায়ী স্থান নিয়ে গেছে এবং তাদের পাওনাগুলো গ্রহণ করেছে?
তখন তাকে বলা হবে, দুনিয়ার সম্রাটদের মত একজন সম্রাটের যা থাকে তোমাকে সে পরিমাণ দেয়া হলে তুমি কি সন্তুষ্ট হবে? সে উত্তরে বলবে হে প্রভূ, আমি সন্তুষ্ট হবো। আল্লাহ তাআলা বলবেন: তোমাকে সে পরিমাণ দেয়া হবে, তারপরও সে পরিমাণ আবার দেয়া হবে, তারপরও সে পরিমাণ আবার দেয়া হবে তারপর আবার সে পরিমাণ দেয়া হবে। পঞ্চমবার সে বলবে, হে প্রভু আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তাহলে এ পরিমাণ তোমার সাথে এর আরো দশগুণ তোমাকে দেয়া হলো। আর তোমার জন্য রয়েছে যা তোমার মন কামনা করে আর যা তোমার চোখ দেখতে চায়। সে বলবে, হে প্রভু আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম।
তারপর মুসা আলাইহিস সালাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ! আর সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাবান ব্যক্তির স্থান কেমন হবে? আল্লাহ তাআলা বললেন: তারা হলো. যাদের মর্যাদার বীজ আমি নিজ হাতে বপন করেছি এবং তার উপর সীলমোহর এঁটে দিয়েছি। কাজেই সেখানের মর্যাদা ও সুখ-শান্তি এমন যা কোনদিন কোন চোখ দেখেনি। কোন কান শোনেনি। কোন মানুষের অন্তর তার কল্পনা করেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এর সত্যতা তোমরা আল্লাহ তাআলার এ বাণীতে পেতে পারো যেখানে তিনি বলেছেন :
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ
অতএব কোন ব্যক্তি জানে না চোখ জুড়ানো কি জিনিষ তাদের জন্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে। (বর্ণনায় : মুসলিম)
হাদীসে আরো এসেছে
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন বস্তু প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোন চোখ দেখেনি। আর যা কোন কান শোনেনি। এবং কোন মানুষের অন্তর তা কল্পনা করতে সক্ষম হয়নি। আবু হুরাইরা রা. বলেন: তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পারো :
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ
অতএব কোন ব্যক্তি জানে না চোখ জুড়ানো কি জিনিষ তাদের জন্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
জান্নাতের গেটের আলোচনা
জান্নাতের আটটি গেট রয়েছে। গেটগুলো এত বিশাল যে, একটি গেটের দুপাটের মধ্যে দুরত্ব হল মক্কা থেকে হিজর পর্যন্ত (প্রায় ১১৬০ কিলোমিটার) অথবা মক্কা থেকে বসরা পর্যন্ত (প্রায় ১২৫০ কি.মি)
প্রত্যেক সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের তাদের আমল অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ গেট থেকে আহবান করা হবে। যে ছদকাহ করেছে তাকে ছদকার গেট থেকে আহবান করা হবে। যে রোযা রেখেছে তাকে রাইয়ান নামক গেট থেকে আহবান করা হবে।
জান্নাতের গেট সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ. سورة الزمر : 73)
আর যারা তাদের রবকে ভয় করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন সেখানে এসে পৌঁছবে এবং এর গেটসমূহ খুলে দেয়া হবে তখন জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা ভাল ছিলে। অতএব স্থায়ীভাবে থাকার জন্য এখানে প্রবেশ কর।’(সূরা যুমার, আয়াত ৭৩)
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, জান্নাতে অনেকগুলো গেট আছে।
জান্নাতের গেট সম্পর্কে হাদীসে আরো এসেছ
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে দুটো বিষয় (প্রাণ ও সম্পদ) আল্লাহর পথে খরচ করেছে তাকে জান্নাতের গেট থেকে ডাক দিয়ে বলা হবে, হে আল্লাহর বান্দা! তোমার জন্য এটা কল্যাণকর। যে নামাজী হবে তাকে নামাজের দরজা থেকে ডাকা হবে। আর যে জিহাদকারী তাকে জিহাদের গেট থেকে ডাকা হবে। সিয়াম পালনকারীকে রাইয়ান নামক গেট থেকে ডাকা হবে।  যে ছদকা করেছে তাকে ছদকার গেট থেকে ডাকা হবে। এ কথা শুনে আবু বকর রা. প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ -আপনার প্রতি আমার পিতা মাতা উৎসর্গ হোক- যাকে এ সকল গেট থেকে ডাকা হবে সে কি কোন অনুবিধার সম্মুখীন হবে? আর এমন কোন লোক পাওয়া যাবে যাকে জান্নাতের সকল গেট থেকে ডাকা হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হ্যাঁ, পাওয়া যাবে। আমি আশা করি তুমি তাদের একজন। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম, এমন কিছু নেককার মানুষ থাকবেন যাদেরকে জান্নাতে সকল গেট ও দরজা দিয়ে ডাকা হবে। জান্নাতের সকল কপাট তাদের জন্য খোলা থাকবে। আর এ সকল ভাগ্যবানদের একজন হলেন, খলীফাতুল মুসলিমীন আবু বকর সিদ্দীক রা.। কারণ তিনি সকল নেক আমলই সম্পাদন করতেন। কোন নেক আমলই ত্যাগ করতন না। এ সম্পর্কে একটি হাদীসে এসেছে
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের মধ্যে আজ কে রোযা রেখেছে? আবু বকর রা. বললেন, আমি রোযা রেখেছি। এরপর তিনি প্রশ্ন করলেন, কে তোমাদের মধ্যে আজ কোন মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন ও জানাযায় অংশ নিয়েছে? আবু বকর রা. বললেন, আমি অংশ নিয়েছি। তারপর তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ কোন অভাবী ব্যক্তিকে খাবার খাইয়েছে? আবু বকর রা. বললেন, আমি খাবার দিয়েছি। তারপর তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে আজ কে অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করেছে? আবু বকর রা. বললেন, আমি করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: যার মধ্যে এ ভাল কাজগুলোর সমাবেশ ঘটবে জান্নাতে সে প্রবেশ করবেই। (বর্ণনায় : মুসলিম)
আর এ জন্যই আবু বকর রা. কে জান্নাতের সকল গেট থেকে আহবান করা হবে। কারণ তিনি সকল প্রকার ভাল কাজ করেছেন।
এ হাদীসের শিক্ষা অনুযায়ী আমাদের কর্তব্য হল, সকল প্রকার ভাল ও সৎকর্ম যা করা সম্ভব তা সম্পাদন করা। তাহলে আল্লাহ তাআলার রহমত-অনুগ্রহে আমরা এ মর্যাদা অর্জন করতে পারি।
হাদীসে আরো এসেছে
সাহাল বিন সাআদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জান্নাতে একটি গেট রয়েছে। যার নাম রাইয়ান। কেয়ামতের দিন সিয়াম পালনকারীরাই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। যখন তারা প্রবেশ করবে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস দিয়েও আমরা বুঝলাম জান্নাতে রোযাদারদের জন্য একটি বিশেষ গেট থাকবে।
জান্নাতের বিভিন্ন স্তর
জান্নাতীদের মান মর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর দান করা হবে। এমনিভাবে মুজাহিদদের জন্য একশত স্তর থাকবে। অন্যান্য ঈমানদার ও আলেম উলামাদের জন্য থাকবে বিভিন্ন স্তর।
এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَا. (سورة طه : 75)
আর যারা তাঁর নিকট আসবে মুমিন অবস্থায়, সৎকর্ম করে তাদের জন্যই রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা। (সূরা তা-হা, আয়াত ৭৫)
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ، (سورة المجادلة : 11)
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত। (সূরা আল মুজাদালাহ, আয়াত ১১)
فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا ﴿95﴾ دَرَجَاتٍ مِنْهُ وَمَغْفِرَةً وَرَحْمَةً وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا ﴿96﴾، (سورة النساء)
নিজদের জান ও মাল দ্বারা জিহাদকারীদের মর্যাদা আল্লাহ বসে থাকাদের উপর অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ প্রত্যেককেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং আল্লাহ জিহাদকারীদেরকে বসে থাকাদের উপর মহা পুরস্কার দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তাঁর পক্ষ থেকে রয়েছে অনেক মর্যাদা, ক্ষমা ও রহমত। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আন নিসা, আয়াত ৯৫-৯৬)
এ সকল আয়াতের সবগুলোতে আমরা দেখতে পেলাম, আল্লাহ তাআলা জান্নাতে মর্যাদার বিভিন্ন স্তর রেখেছেন। তিনি নবী ও রাসূলদের পর সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে আলেম উলামা ও আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করেছেন তাদের বিশেষ ও সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন।
জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে আর নামাজ কায়েম করবে ও রোযা পালন করবে আল্লাহর উপর দায়িত্ব হলো, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। সে ব্যক্তি তার জন্ম ভূমিতে বসে থাকুক বা আল্লাহর পথে জিহাদ করুক (উভয় অবস্থাতে সে জান্নাতের অধিকারী হবে) সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি এ সুসংবাদটি মানুষকে দেব না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: অবশ্যই জান্নাতে একশ স্তর রয়েছে বিভিন্ন মর্যাদার। যা আল্লাহ সে সকল লোকদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে। এক একটি মর্যাদার ব্যপ্তি হবে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার দুরত্বের সম পরিমাণ। যখন তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করবে তখন তোমরা জান্নাতুল ফেরদাউস চাবে। কারণ এটা জান্নাতের মধ্যবর্তী ও সুউচ্চ মর্যাদার স্থান। এর উপর রয়েছে দয়াময় আল্লাহর আরশ। (বর্ণনায় : বুখারী)
এ হাদীস থেকে আমরা যা শিখতে পারি
এক. যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান স্থাপন করবে ও নামাজ রোযা পালন করবে তারা জান্নাতে যাবেভ
দুই. যারা আল্লাহর পথে তাঁর দীন সুউচ্চ করার লক্ষ্যে যুদ্ধ ও জিহাদ করবে তাদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী।
তিন. আল্লাহ তাআলার কাছে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তথা ফেরদাউস লাভ করার জন্য প্রার্থনা করতে রাসূলের নির্দেশ।
চার. এ হাদীসটি মুসলিমদের জন্য একটি বিরাট সুসংবাদ। সাহাবায়ে কেরাম হাদীসটি শোনার পর বলেছেন, এ সংবাদটি কি আমরা সকলের কাছে প্রচার করবো না? তাদের এ প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু বলেননি। অন্য বর্ণনায় আছে তিনি বলেছেন, তাহলে লোকদের অলসতায় পেয়ে বসবে। মোট কথা হল, যেখানে ও যখন হাদীসটি বললে লোকদের অলসতায় পেয়ে বসবে না, বরং ঈমান ও ইসলামের ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন, তখন হাদীসটি বলা উচিত। আর যখন দেখা যাবে হাদীসটি বললে এ সমাজের লোকদের মধ্যে অলসতা এসে যাবে তখন না বলা উত্তম হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল কুরআনের ধারক-বাহককে বলা হবে, পাঠ করতে থাকো আর উপরে উঠতে থাকো এবং সামনে অগ্রসর হও। যেমন তুমি দুনিয়াতে কুরআন পাঠে সামনে অগ্রসর হয়েছিলে। তোমার মর্যাদা সেখানে, যেখানে তুমি তোমার সর্বশেষ আয়াতটি পাঠ করবে। (বর্ণনায়, তিরমিজী, আহমদ। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সহীহ আল জামে নং ৩৪৯/৬)
এভাবে আল কুরআনের ধারক-বাহক ; হাফেজ, কারী, আলেম, কুরআনের বাণী প্রচারক ও মুফাসসিরদের জান্নাতে সুউচ্চ মর্যাদা দান করা হবে।
জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষসমূহ
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ غُرَفٌ مِنْ فَوْقِهَا غُرَفٌ مَبْنِيَّةٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَعْدَ اللَّهِ لَا يُخْلِفُ اللَّهُ الْمِيعَادَ، (سورة الزمر : 20)
কিন্তু যারা নিজদের রবকে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে কক্ষসমূহ যার উপর নির্মিত আছে আরো কক্ষ। তার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত। এটি আল্লাহর ওয়াদা; আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করেন না। (সূরা যুমার, আয়াত ২০)
এ আয়াত দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে, জান্নাতবাসীদের জন্য জান্নাতে প্রাসাদ ও কক্ষসমূহ প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
হাদীসে এসেছে
আবু সায়ীদ আল খুদরী রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জান্নাতের কক্ষে অবস্থানরত জান্নাতবাসীরা অন্যান্য জান্নাতবাসীদের দেখবে। যেমন তোমরা পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অস্তগামী নক্ষত্রসমূহকে দেখতে পাও। তাদের পরস্পরের মর্যাদার ভিন্নতা সত্বেও তোমরা দেখতে পাবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়ার রাসূলাল্লাহ! রাসূলদের এই যে মর্যাদা রয়েছে তাতে অন্য কেহ কি অভিষিক্ত হতে পারবে? তিনি বললেন: যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্বার শপথ ঐ সকল মানুষেরা সেই মর্যাদা পাবে যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও রাসূলদের সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
আমরা যেমন ভুপৃষ্ঠে অবস্থান করে আকাশের সব তারকাগুলো দেখতে পাই। কোনটা আছে পূর্ব প্রান্তে, কোনটা পশ্চিম প্রান্তে আবার কোনটি মধ্য আকাশে থাকে। কোনটা দেখতে আমাদের বেগ পেতে হয় না। এমনিভাবে জান্নাতের কক্ষ ও অধিবাসীদের দেখা যাবে।
জান্নাতবাসীদের খাবার -দাবার
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
يَا عِبَادِ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ ﴿68﴾ الَّذِينَ آَمَنُوا بِآَيَاتِنَا وَكَانُوا مُسْلِمِينَ ﴿69﴾ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنْتُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ تُحْبَرُونَ ﴿70﴾ يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِصِحَافٍ مِنْ ذَهَبٍ وَأَكْوَابٍ وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنْفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿71﴾ وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿72﴾ لَكُمْ فِيهَا فَاكِهَةٌ كَثِيرَةٌ مِنْهَا تَأْكُلُونَ ﴿73﴾، (سورة الزخرف)
হে আমার বান্দাগণ, আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না। যারা আমার আয়াতে ঈমান এনেছিল এবং যারা ছিল মুসলিম। তোমরা সস্ত্রীক সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। ¯^Y©LwPZ থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করা হবে, সেখানে মন যা চায় আর যাতে চোখ তৃপ্ত হয় তা-ই থাকবে এবং সেখানে তোমরা হবে স্থায়ী। আর এটিই জান্নাত, নিজদের আমলের dj¯^iƒc তোমাদেরকে এর অধিকারী করা হয়েছে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে অনেক ফলমূল, যা থেকে তোমরা খাবে। (সূরা যুখরুফ, আয়াত ৬৮-৭৩)
এ আয়াতগুলো থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:
এক. জান্নাতবাসীদের কোন ভয় থাকবে না আর থাকবে না কোন দু:শ্চিন্তা। দুনিয়ার জীবনে মানুষ যত সম্পদের অধিকারী হোক না কেন আর সে যতই সুখী হোক,  তার ভয় থাকে, থাকে দু:শ্চিন্তা। কিন্তু জান্নাতে এক অনন্য বৈশিষ্ট হলো, সেখানে কোন পেরেশানী, দু:খ-কষ্ট, উদ্বেগ, দু:শ্চিন্তা ভয় কিছুই থাকবে না।
দুই. ঈমান ও ইসলাম দুটো দুই বিষয়। যেমন এ আয়াতে দুটোকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন. যারা জান্নাতের অধিকারী হবে তাদের স্ত্রী, স্বামী ও সন্তান-সন্তদি যদি ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হয় তাহলে তারা জান্নাতে একত্রেই থাকবে। যেমন এ আয়াতে স্বামী ও স্ত্রীসহ জান্নাতে প্রবেশ করতে বলা হবে বলে বাণী এসেছে।
অন্য আয়াত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ ﴿21﴾ وَأَمْدَدْنَاهُمْ بِفَاكِهَةٍ وَلَحْمٍ مِمَّا يَشْتَهُونَ ﴿22﴾ يَتَنَازَعُونَ فِيهَا كَأْسًا لَا لَغْوٌ فِيهَا وَلَا تَأْثِيمٌ ﴿23﴾ وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ غِلْمَانٌ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَكْنُونٌ ﴿24﴾ وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ ﴿25﴾ قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ ﴿26﴾، (سورة الطور : 21-27)
আর যারা ঈমান আনে এবং তাদের সন্তান-সন্তুতি ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করে, আমরা তাদের সাথে তাদের সন্তানদের মিলন ঘটাব এবং তাদের কর্মের কোন অংশই কমাব না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার কামাইয়ের ব্যাপারে দায়ী থাকবে। আর আমি তাদেরকে অতিরিক্ত দেব ফলমূল ও গোশ্‌ত যা তারা কামনা করবে। তারা পরস্পরের মধ্যে পানপাত্র বিনিময় করবে; সেখানে থাকবে না কোন বেহুদা কথাবার্তা এবং কোন পাপকাজ। আর তাদের সেবায় চারপাশে ঘুরবে বালকদল; তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তা। আর তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তারা বলবে, পূর্বে আমরা আমাদের পরিবারের মধ্যে শঙ্কিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। (সূরা আত তুর, আয়াত ২১-২৭)
চার. জান্নাতে মনে যা চায় ও চোখ যা দেখতে চায় তার সবকিছুই থাকবে। এমন নয় যে শুধু আল-কুরআন ও হাদীসে যা উল্লেখ করা হয়েছে শুধু সেগুলোই থাকবে। শুধু বাগান, নদী, গাছ, ফল-মুলই নয়। যা চায় মনে তার সবকিছু পাওয়া যাবে সেখানে। দুনিয়াতে একজন মানুষ যত প্রভাবশালী, ক্ষমতার অধিকারী ও ধন-সম্পদের মালিক হোক না কেন,  মনে যা চায় সে তা পায় না। সে তা করতে পারে না। কিন্তু জান্নাত এ রকম নয়। সেখানে নেই কোন সীমাবদ্ধতা।
জান্নাতে খাবার দাবার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:
আর অগ্রগামীরাই অগ্রগামী। তারাই সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। তারা থাকবে নিআমতপূর্ণ জান্নাতসমূহে । বহুসংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে, আর অল্পসংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য থেকে। ¯^Y© ও দামী পাথরখচিত আসনে! তারা সেখানে হেলান দিয়ে আসীন থাকবে মুখোমুখি অবস্থায়। তাদের আশ-পাশে ঘোরাফেরা  করবে চির কিশোররা, পানপাত্র, জগ ও প্রবাহিত ঝর্ণার শরাবপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে। তা পানে না তাদের মাথা ব্যথা করবে, আর না তারা মাতাল হবে। আর (ঘোরাফেরা করবে) তাদের পছন্দমত ফল নিয়ে। আর পাখির গোশ‌ত নিয়ে, যা তারা কামনা করবে। আর থাকবে ডাগরচোখা হূর। যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা। এগুলো তারা যে আমল করত তার cÖwZ`vb¯^iƒc| তারা সেখানে শুনতে পাবে না কোন বেহুদা কথা, এবং না পাপের কথা; শুধু এই বাণী ছাড়া, সালাম, সালাম। আর ডান দিকের দল; কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল! তারা থাকবে কাঁটাবিহীন কুলগাছের নিচে, আর কাঁদিপূর্ণ কলাগাছের নিচে, আর বিস্তৃত ছায়ায়, আর সদা প্রবাহিত পানির পাশে, আর প্রচুর ফলমূলে, যা শেষ হবে না এবং নিষিদ্ধও হবে না। (তারা থাকবে) সুউচ্চ শয্যাসমূহে; নিশ্চয় আমি হূরদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করব। অতঃপর তাদেরকে বানাব কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়সী। ডানদিকের লোকদের জন্য। তাদের অনেকে হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে। আর অনেকে হবে পরবর্তীদের মধ্য থেকে। (সূরা আল ওয়াকিয়া, আয়াত ১০-৪০)
হাদীসে এসেছে-
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: জান্নাতবাসীরা জান্নাতে খাবে, পান করবে কিন্তু তারা থুথু ফেলাবে না, প্রসাব করবে না, পায়খানা করবে না, বমি করবে না। এ কথা শুনে সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, তাহলে খাবার দাবার কোথায় যাবে? তিনি বললেন: ঢেকুর হয়ে মৃগনাভীর সুগন্ধ নিয়ে বের হয়ে যাবে। যেভাবে শাস-প্রশ্বাস নেয়া হয়, এভাবেই জান্নাতবাসীরা আল্লাহ তাআলার তাসবীহ ও তাহমীদ করতে থাকবে।  (বর্ণনায় : মুসলিম)
এ হাদীসটি থেকে আমরা জানতে পারলাম:
এক. জান্নাতবাসীরা খাওয়া-দাওয়া করবে কিন্তু এ জন্য তাদের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে না।
দুই. তাদের পানাহারকৃত বস্তুগুলো ঢেকুরের সাথে বের হয়ে যাবে। আর এ ঢেকুর কোন বিরক্তির কারণ হবে না। বরং সুগন্ধ ছড়াবে।
তিন. জান্নাতবাসীরা আল্লাহ তাআলার প্রশংসা বা তাহমীদ ও পবিত্রতা বর্ণনা বা তাসবীহ আদায় করবে। কিন্তু এ জন্য তাদের আলাদা কোন পরিশ্রম করতে হবে না। যেমন আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কোন পরিশ্রম বা ইচ্ছা করতে হয় না।
জান্নাতের তাবু
হাদীসে এসেছে-
عن أبي موسى الأشعري رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: إن للمؤمن في الجنة لخيمة من لؤلؤة واحدة مجوفة . طولها ستون ميلا . للمؤمن فيها أهلون . يطوف عليهم المؤمن . رواه البخاري ومسلم.
আবু মূছা আল আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জান্নাতে মুমিনদের জন্য মুক্তা খচিত তাবু থাকবে। যার প্রশস্ততা হবে ষাট মাইল। সেখানে মুমিনদের পরিবার পরিজন একত্র হবে ও পরস্পরে দেখা সাক্ষাত করবে। (বর্ণনায়: বুখারী ও মুসলিম)
জান্নাতে যেমন বিশাল বিশাল অট্টালিকা থাকবে তেমনি থাকবে বিশাল বিশাল তাবু। যখন যেমন মনে চাবে জান্নাতীরা তা ব্যবহার করবে।

জান্নাতের বাজার

হাদীসে এসেছে-আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জান্নাতে একটি বাজার থাকবে আর তাতে শুক্রবার দিন লোকজনের সমাগম হবে। সেখানে উত্তর দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হবে। এ বায়ুর প্রভাবে জান্নাতীদের রূপ ও সৌন্দর্য বেড়ে যাবে। এরপর যখন তারা তাদের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে আসবে আর তারা তাদের রূপ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বলবে, সুস্বাগতম তোমাদের। আল্লাহ তাআলার কসম! আমাদের চেয়ে তোমার রূপ-সৌন্দর্য তো অনেক বেড়ে গেছে। এর জবাবে তারা বলবে, আল্লাহর শপথ! আমাদের চেয়ে তোমাদের রূপ-সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। (বর্ণনায় : মুসলিম)
এ হাদীসটি থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:
এক. জান্নাতে একটি বাজার থাকবে। তা বসবে সপ্তাহের শুক্রবারে। যাদের মনে চায় তারা সেখানে যাবে। পরস্পরে দেখা সাক্ষাত হবে।
দুই. এ বাজারের একটি বৈশিষ্ট হল, যে এখানে আসবে তার রূপ-সৌন্দর্য আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাবে।
তিন. বাজার থেকে ফিরে আসার পর সঙ্গী সাথিরা তাদের রূপ সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে। আবার সেও তাদের রূপ-সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে। এটা তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, প্রেম-ভালোবাসার একটি প্রকাশ। যা তাদের দাম্পত্য সূখ-শান্তি আরো বাড়িয়ে দেবে।
জান্নাতের নদ-নদী
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا ﴿30﴾ أُولَئِكَ لَهُمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا ﴿31﴾، (سورة الكهف)
যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, নিশ্চয় আমি এমন কারো প্রতিদান নষ্ট করব না, যে সুকর্ম করেছে। এরাই তারা, যাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী জান্নাতসমূহ, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ। সেখানে তাদেরকে অলংকৃত করা হবে ¯^‡Y©i চুড়ি দিয়ে এবং তারা পরিধান করবে মিহি ও পুরু সিল্কের সবুজ পোশাক। তারা সেখানে (থাকবে) আসনে হেলান দিয়ে। কী উত্তম প্রতিদান এবং কী সুন্দর বিশ্রামস্থল ! (সূরা আল কাহফ, আয়াত ৩০-৩১)
مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ فِيهَا أَنْهَارٌ مِنْ مَاءٍ غَيْرِ آَسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِنْ لَبَنٍ لَمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِنْ خَمْرٍ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِنْ عَسَلٍ مُصَفًّى وَلَهُمْ فِيهَا مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ كَمَنْ هُوَ خَالِدٌ فِي النَّارِ وَسُقُوا مَاءً حَمِيمًا فَقَطَّعَ أَمْعَاءَهُمْ، (سورة محمد: 15)
মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হল, তাতে রয়েছে নির্মল পানির নহরসমূহ, দুধের ঝর্নাধারা, যার ¯^v` পরিবর্তিত হয়নি। পানকারীদের জন্য my¯^v`y সুরার নহরসমূহ এবং আছে পরিশোধিত মধুর ঝর্নাধারা। তথায় তাদের জন্য থাকবে সব ধরনের ফলমূল আর তাদের রবের পক্ষ  থেকে ক্ষমা। তারা কি তাদের ন্যায়, যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং তাদেরকে ফুটন্ত পানি পান করানো হবে ফলে তা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে?  (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ১৫
জান্নাতের হুর সঙ্গী
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ عِينٌ ﴿48﴾ كَأَنَّهُنَّ بَيْضٌ مَكْنُونٌ ﴿49﴾، سورة الصافات)
তাদের কাছে থাকবে আনতনয়না, ডাগরচোখা। তারা যেন আচ্ছাদিত ডিম। (সূরা সাফফাত, আয়াত ৪৮-৪৯)
هَذَا ذِكْرٌ وَإِنَّ لِلْمُتَّقِينَ لَحُسْنَ مَآَبٍ ﴿49﴾ جَنَّاتِ عَدْنٍ مُفَتَّحَةً لَهُمُ الْأَبْوَابُ ﴿50﴾ مُتَّكِئِينَ فِيهَا يَدْعُونَ فِيهَا بِفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ وَشَرَابٍ ﴿51﴾ وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ أَتْرَابٌ ﴿52﴾ هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِيَوْمِ الْحِسَابِ ﴿53﴾ إِنَّ هَذَا لَرِزْقُنَا مَا لَهُ مِنْ نَفَادٍ ﴿54﴾، (سورة ص)
এটি এক স্মরণ, আর মুত্তাকীদের জন্য অবশ্যই রয়েছে উত্তম নিবাস- চিরস্থায়ী জান্নাত, যার দরজাসমূহ থাকবে তাদের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে তারা হেলান দিয়ে আসীন থাকবে, সেখানে তারা বহু ফলমূল ও পানীয় চাইবে। আর তাদের নিকটে থাকবে আনতনয়না সমবয়সীরা। হিসাব দিবস সম্পর্কে তোমাদেরকে এ ওয়াদাই দেয়া হয়েছিল। নিশ্চয় এটি আমার দেয়া রিয্‌ক, যা নিঃশেষ হবার নয়। (সূরা সাদ: ৪৯-৫৪)
জান্নাতের সূখ-শান্তি হবে স্থায়ী
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيلًا، سورة النساء: 57)
আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা হবে স্থায়ী। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র সঙ্গীগণ এবং তাদেরকে আমি প্রবেশ করাব বিস্তৃত ঘন ছায়ায়। (সূরা নিসা, আয়াত ৫৭)
হাদীসে এসেছে-
আবু সায়ীদ আল খুদরী রা. থেকে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের বলবেন: হে জান্নাতবাসীগণ! তারা বলবে, উপস্থিত হে প্রভূ, সৌভাগ্য ও কল্যাণতো আপনারই হাতে। তারা বলবে, তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছো? তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা কেন সন্তুষ্ট হবো না? আপনি আমাদের এমন নেয়ামত ও সূখ-শান্তি দিয়েছেন যা কখনো অন্য কাউকে দেননি। আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমি কি তোমাদের এরচেয়ে উত্তম কোন কিছু দেব? তখন তারা বলবে, হে প্রতিপালক! যা দিয়েছেন তার চেয়ে আবার উত্তম কোন জিনিষ আছে কী? আল্লাহ তাআলা বলবেন, আজ থেকে আমার সন্তুষ্টি তোমাদের উপর স্থায়ী হয়ে গেল। আর কোন দিন তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবো না। (বর্ণনায়: বুখারী ও মুসলিম)
হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্টি লাভ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামাত। ব্যাপারটা আমরা এভাবে বুঝতে পারি, আপনি যদি কোন এক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে চাকুরী করেন। আর সকল দায়ীত্ব কর্তব্য পালন করে যান, তাহলে সে আপনার প্রাপ্য পুরোপুরিভাবে আদায় করবে। আপনাকে নিয়মের মধ্যে থেকে পদোন্নতি দেবে। এরচেয়ে বেশী কি? কিন্তু তিনি যদি আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আপনাকে তার প্রিয় করে নেন, তাহলে ব্যাপারটা কত বড় হয়ে গেল। তখন শুধু নির্ধারিত বেতন আর পদোন্নতি নয়। পাবেন সব সুখ শান্তি, সম্মান, এমনকি কর্তৃত্বও।
এভাবেই আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জান্নাতের সুখ শান্তি দিবেন। কিন্তু যখন তিনি ঘোষণা করবেন আমি স্থায়ীভাবে তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম, তখন এটার মর্যাদা ও আনন্দ যে কত বিশাল হবে সেটা শুধু তখনই অনুভব করা যাবে।
আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে আমাদের জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভূক্ত করুন।
হাদীসে এসেছে
আবু সায়ীদ ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত. তারা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জান্নাতে একজন ঘোষক ঘোষণা দেবে: তোমরা সর্বদা সুস্থ থাকবে কখনো রোগাক্রান্ত হবে না। তোমরা চিরদিন জীবিত থাকবে, কখনো মৃত্যু আসবে না। তোমরা চিরদিন যুব থাকবে। বার্ধক্যে তখনো তোমাদের স্পর্ষ করবে না। তোমরা সর্বদা পরিতৃপ্ত থাকবে। কখনো ক্ষুধার্ত হবে না। আর এটা আল্লাহ তাআলার সেই কথার বাস্তবায়ন : তাদেরকে ডেকে বলা হবে, ঐ হল জন্নাত। তোমরা যা কাজ করেছো, তার বিনিময়ে এর উত্তরাধিকারী করা হলো। (বর্ণনায় :মুসলিম)
জান্নাতীদের সবচেয়ে বড় আনন্দ
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ﴿22﴾ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ﴿23﴾، سورة القيامة : 22-23)
সেদিন কতক মুখমন্ডল হবে হাস্যোজ্জল। তাদের প্রতিপালকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপকারী। (সূরা আল কিয়ামা, আয়াত ২২-২৩)
হাদীসে এসেছে
সুহাইব বিন সিনান আর রুমী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন: তোমাদের আরো কিছু বাড়িয়ে দেই এমন কিছুকি তোমরা চাও? তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারা হাস্যোজ্জল করেননি? আপনি কি আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাননি? আপনি কি আমাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? এরপর আল্লাহ তাআলা তার চেহারা থেকে পর্দা উঠিয়ে তাদের জন্য নিজ চেহারাকে উম্মুক্ত করবেন। তখন তাদের অনুভুতি হবে আমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তার চেয়ে আল্লাহ তাআলার এ দর্শনই সর্বাধিক প্রিয়। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর এ বাণীটি তেলাওয়াত করেন: যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম (জান্নাত) এবং আরো বেশী ( তা হলো আল্লাহকে সরাসরি দেখা)। (বর্ণনায়: মুসলিম)
জান্নাতবাসীরা পৃথিবীর অবিশ্বাসী সাথিদের অবস্থা দেখতে পাবে
যারা জান্নাতে যাবে পৃথিবীতে তাদের এমন কিছু সহকর্মী, সাথি বন্ধু থাকবে যারা জাহান্নামে যাবে। কারণ, তারা পরকালে বিশ্বাস করতো না। জান্নাতে বসে পৃথিবীর সেই অবিশ্বাসী সঙ্গি-সাথিদের কথা মনে পড়ে যাবে। বলবে, আমার তো অমুক বন্ধু ছিল, কিন্তু সে পরকাল, জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাস করতো না। তার অবস্থা এখন কী?  সে কোথায় আছে? তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অবিশ্বাসী বন্ধুদের অবস্থা দর্শন করাবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ ﴿50﴾ قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ إِنِّي كَانَ لِي قَرِينٌ ﴿51﴾ يَقُولُ أَئِنَّكَ لَمِنَ الْمُصَدِّقِينَ ﴿52﴾ أَئِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَئِنَّا لَمَدِينُونَ ﴿53﴾ قَالَ هَلْ أَنْتُمْ مُطَّلِعُونَ ﴿54﴾ فَاطَّلَعَ فَرَآَهُ فِي سَوَاءِ الْجَحِيمِ ﴿55﴾ قَالَ تَاللَّهِ إِنْ كِدْتَ لَتُرْدِينِ ﴿56﴾ وَلَوْلَا نِعْمَةُ رَبِّي لَكُنْتُ مِنَ الْمُحْضَرِينَ ﴿57﴾ (سورة الصافات)
অতঃপর তারা মুখোমুখি হয়ে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করবে । তাদের একজন বলবে, (পৃথিবীতে) আমার এক সঙ্গী ছিল, সে বলত, তুমি কি সে লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা বিশ্বাস করে আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হয়ে যাবো তখনও কি আমাদেরকে প্রতিফল দেয়া হবে? আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি উঁকি দিয়ে দেখবে? অতঃপর সে উঁকি দিয়ে দেখবে এবং তাকে (পৃথিবীর সঙ্গীকে) দেখবে জাহান্নামের মধ্যস্থলে। সে বলবে, আল্লাহর কসম! তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলে! আমার রবের অনুগ্রহ না থাকলে আমিও তো (জাহান্নামে) হাযিরকৃতদের একজন হতাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত ৫০- ৫৭)
এ আয়াতসমূহ থেকে আমরা শিখতে পারলাম, পৃথিবীর কর্মস্থল, পড়াশুনা, যাত্রাপথ ইত্যাদি সুত্রে যে সকল সঙ্গী-সাথি আছে তাদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। যেমন এ আয়াতে আমরা দেখি জান্নাতী লোকটি বলবে, তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলে। হ্যা কুরআনের কথা সত্যি। এ সকল অবিশ্বাসী মানুষের সাথে চলাফেরা উঠা-বসা করলে তারা বিশ্বাসীদের আকীদা-বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলে।
অন্য আয়াতে এসেছে-
كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ ﴿38﴾ إِلَّا أَصْحَابَ الْيَمِينِ ﴿39﴾ فِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ ﴿40﴾ عَنِ الْمُجْرِمِينَ ﴿41﴾ مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ ﴿42﴾ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ ﴿43﴾ وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ ﴿44﴾ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ ﴿45﴾ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ ﴿46﴾ حَتَّى أَتَانَا الْيَقِينُ ﴿47﴾ فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ ﴿48﴾ فَمَا لَهُمْ عَنِ التَّذْكِرَةِ مُعْرِضِينَ ﴿49﴾ (سورة المدّثر)
প্রতিটি প্রাণ নিজ অর্জনের কারণে দায়বদ্ধ। কিন্তু ডান দিকের লোকেরা নয়, জান্নাতসমূহের মধ্যে তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করবে অপরাধীদের সম্পর্কে : কিসে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করালো? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়কারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আর আমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করতাম না। আর আমরা অনর্থক গল্প-গুজবকারীদের সাথে (বেহুদা আলাপে) মগ্ন থাকতাম। আর আমরা প্রতিদান দিবসকে A¯^xKvi করতাম। অবশেষে আমাদের কাছে মৃত্যু আগমন করে। অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকার করবে না। আর তাদের কী হয়েছে যে, তারা উপদেশ বাণী হতে বিমুখ? (সূরা আল মুদ্দাসসির, আয়াত ৩৮-৪৯)
সমাপ্ত
 
 
সংকলন : আব্দুল মালেক আলী আল-কুলাইব 
অনুবাদক : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

Translate