(১). খারেজি সম্প্রদায়: খারিজি’ শব্দটি আরবি ‘খুরুজ’ মূলধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ বাহির হওয়া বা সীমানা লঙ্ঘন করা। একবচনে বলা হয় ‘খারিজি’ এবং এর বহুবচন ‘খাওয়ারিজ’। আভিধানিক দৃষ্টিকোণে, ‘খারিজি’ বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যে তার সম্প্রদায়, গোত্র বা সমসাময়িকদের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় এবং বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। খারেজিদের আক্বীদা হচ্ছে,কবিরা গুনাহগার হলো কাফির, কবীরাগুনাহ বড় কুফরি। যা মিল্লাত (ইসলাম) থেকে বের করে দেয়। এরা বলে, যে কবীরাগুনাহ করবে, সে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেছেন, فَكانَ مِن أوَّلِ البِدَعِ والتَّفَرُّقِ الَّذِي وقَعَ فِي هَذِهِ الأُمَّةِ «بِدْعَةُ الخَوارِجِ» المُكَفِّرَةِ بِالذَّنْبِ “এই উম্মতের মধ্যে উদ্ভূত সর্বপ্রথম বিদআত ও বিভক্তি হলো খারেজিদের বিদআত; যারা (বড়ো কুফর নয় এমন) গুনাহের দরুন কাফির ফতোয়া দেয়।”(মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৪৭০)
Monday, May 12, 2025
কবিরা গুনাহগারদের বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তিনটি দল
.
(২). মুতাজিলা সম্প্রদায়: মু‘তাযিলা” (المعتزلة) শব্দটি এসেছে “ই‘তাযাল” (اعتزل) ক্রিয়াপদ থেকে, যার অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, আলাদা থাকা বা একাকীত্ব অবলম্বন করা। এই দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব হয় হিজরী প্রথম শতকের শেষভাগ এবং দ্বিতীয় শতকের শুরুতে, যখন কিছু চিন্তাবিদ প্রচলিত ধারার চিন্তা থেকে সরে এসে স্বতন্ত্র মত প্রকাশ করেন। এদের আক্বীদা হচ্ছে, কবীরাগুনাহগার ব্যক্তি কাফির এবং মুমিন এই দুইয়ের মাঝখানে রয়েছে,এরা বলে,কবিরা গুনাহগার মুমিনও নয়, আবার কাফিরও নয়, বরং সে দুটো স্তরের মধ্যবর্তী স্তরের আওতাভুক্ত। আর এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে,এমনকি শাফা‘আতের মাধ্যমেও তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা যাবে না। কারণ সে ঈমানহীনভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। মু‘তাযিলা মতবাদের জনক ওয়াছিল বিন আতা বললেন,أنا لا أقول إن صاحب الكبيرة مؤمن مطلقا ولا كافر مطلقا بل هو في منزلة بين المنزلتين لا مؤمن ولا كافر “আমি কবীরাগুনাহকারীকে পূর্ণাঙ্গ মুমিন বলব না এবং পূর্ণাঙ্গ কাফিরও বলব না। বরং তার অবস্থান উভয়ের মাঝামাঝি। না মুমিন না কাফির”(আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫)
.
(৩). মুরজিয়া সম্প্রদায়: মুরজিয়া” (المرجئة) শব্দটি আরবি “إرجاء” ইরজা মূলধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো বিলম্ব করা, স্থগিত রাখা, বা পেছনে ঠেলে দেওয়া।যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, ফির’আউন বলেছিল, ‘আরিজহ ওয়া আখাহু’ [সূরা আল-আ’রাফ: ১১১] অর্থাৎ “মূসা ও তার ভাইকে একটু বিলম্ব করাও”। আর সে হিসেবে এদেরকে মুরজিয়া বলার কারণ তারা আমলকে ঈমানের সংজ্ঞায় প্রবেশ করায় না। তারা বলে, ঈমান হচ্ছে শুধু অন্তরে বিশ্বাসের নাম।এরা কবীরাগুনাহকে মুলতবি রাখে। এদের আক্বীদা হচ্ছে,কবিরা গুনাহগার পরিপূর্ণ ইমানওয়ালা মুমিন।কবীরাগুনাহ ঈমানের কোন ক্ষতি করে না। তার কোনো শাস্তি হবে না, এমনকি সে শাস্তির হকদারও হবে না। তাদের নিকট আমল ঈমানের রুকন নয়। সীমালঙ্ঘন বা পাপ কাজও ঈমানের কোন ক্ষতি করে না। যেমনভাবে কুফরী আনুগত্যের কোন ক্ষতি করতে পারে না। এরাই হল মুরজিয়া।।
.
পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতে প্রতিদানপ্রাপ্তির দৃষ্টিকোণ থেকে কবিরা গুনাহগারের বিধান হচ্ছে কোনো ব্যক্তি যদি বড় গোনাহে লিপ্ত হয়, তবে সে তার গোনাহের কারণে সে আল্লাহর নির্ধারিত প্রতিদান তথা শাস্তির হকদার হবে। তবে এতে সে চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে না। বরং তার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল আল্লাহ চাইলে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে তাকে তার গোনাহ অনুযায়ী শাস্তি দেবেন,আবার তিনি চাইলে তাঁর অনুগ্রহে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দেবেন।”যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করা ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্য সব (গুনাহ) যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” [সুরা নিসা: ৪৮] এছাড়াও কুরআন সুন্নাহ’য় আরো বহু দলিল রয়েছে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সালাত আদায়ের সময় কোনো রুকন বা ওয়াজিব আদায় করেছেন কিনা এই বিষয়ে সন্দেহ হলে করণীয়
প্রশ্ন: যদি কোনো ব্যক্তি সালাত আদায়ের সময় কোনো রুকন (আবশ্যিক অঙ্গ) বা ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয় কাজ) আদায় করেছে কিনা এই বিষয়ে সন্দেহে পড়ে যায়, তাহলে সেই সন্দেহজনিত ভুল কীভাবে সংশোধন করবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর: সালাতে সন্দেহ হলো বৃদ্ধি ও কমতির মাঝে দ্বিধা। যেমন: কেউ যদি দ্বিধায় পড়ে যায় যে সে কি তিন রাকাআত সালাত পড়েছে; নাকি চার রাকাআত। এক্ষেত্রে তার দুই অবস্থা:
(১).হয়তো তার কাছে দুটির একটি প্রাধান্য পাবে: কমতি বা বৃদ্ধি; তাহলে তার কাছে যেটা প্রাধান্য পেয়েছে সেটার উপর ভিত্তি করে সে সালাত পূর্ণ করবে এবং সালাম ফেরানোর পর দুটি সাহু সিজদাহ দিবে।
.
(২).নতুবা তার কাছে দুটির কোনোটি প্রাধান্য পাবে না। তখন তার যতটুকুর উপর দৃঢ় বিশ্বাস আছে তথা কম সংখ্যা, ততটুকু ধরে নিয়ে সালাত পূর্ণ করবে এবং সালাম ফেরানোর আগে দুটি সাহু সিজদাহ দিবে।
উদাহরণস্বরূপ: এক ব্যক্তি যোহরের সালাত আদায় করছিল। সালাতের মাঝে তার সন্দেহ হল সে কি তৃতীয় রাকাআতে রয়েছে, নাকি চতুর্থ রাকাআতে? চিন্তা করে তার কাছে তৃতীয় রাকাআতের সম্ভাবনাই বেশি মনে হল। এক্ষেত্রে সে তৃতীয় রাকাআত ধরে নিয়ে আরও একটি রাকাআত আদায় করবে এবং সালামের পর দুটি সাহু সিজদাহ দিবে। অন্য একটি অবস্থা হচ্ছে যখন সন্দেহের দুটো দিকই সমান মনে হয়। যেমন কেউ যোহরের সালাতে রয়েছে এবং তার মনে হল সে কি তৃতীয় রাকাআতে আছে, না কি চতুর্থ? কিন্তু কোনটার দিকেই তার প্রবল ধারণা নেই; উভয়ের সম্ভাবনাই সমান মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে একীনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ যে রাকাআত কম সেটাকেই একীন হিসেবে গ্রহণ করবে। ফলে সে তৃতীয় রাকাআত ধরে নিয়ে আরেকটি রাকাআত আদায় করবে এবং সালাম ফিরানোর পূর্বে দুটি সাহু সিজদাহ করবে তারপর সালাম ফিরিয়ে সালাত সম্পন্ন করবে।
.
এখন মনে করুন আপনি সালাতের সিজদা সংখ্যা নিয়ে সন্দেহে পড়েছেন; অর্থাৎ আপনি কি একটি সিজদা দিয়েছেন; না দুটি সিজদা দিয়েছেন এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান তাহলে আপনি একীনের (নিশ্চিত জ্ঞানের) উপর নির্ভর করবেন। একীন হচ্ছে ছোট সংখ্যাটি হিসাব করা। তাই আপনি শুধু একটি সিজদা দিয়েছেন ধরে নিয়ে দ্বিতীয় সিজদাটি আদায় করবেন। এরপর সালাম ফেরানোর আগে সহু সিজদা দিয়ে নেয়া উত্তম। এটি শাইখ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অভিমত।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন:
” أما إذا كان الشك في الصلاة ، فإنه يأتي بالسجدة ويبني على اليقين ، إذا شك هل سجد سجدة أو سجدتين يأتي بالسجدة الثانية سواء في الركعة الأولى أو الثانية أو الثالثة أو الرابعة ، ويسجد للسهو قبل السلام ، وإن سجد بعد السلام فلا بأس ، ولكن الأفضل قبل السلام “
“আর যদি সন্দেহটি সালাতের মধ্যে হয় তাহলে সে ব্যক্তি একীনের উপর নির্ভর করবে এবং সিজদাটি আদায় করবে। যদি সন্দেহ হয় এক সিজদা দিয়েছে, নাকি দুই সিজদা দিয়েছে তাহলে সে ব্যক্তি দ্বিতীয় সিজদাটি আদায় করবে। এটি প্রথম, কিংবা দ্বিতীয়, কিংবা তৃতীয় কিংবা চতুর্থ যে রাকাতের ক্ষেত্রে হোক না কেন। এরপর সালাম ফিরানোর পূর্বে সহু সিজদা দিবে; যদি সালাম ফিরানোর পরেও দেয় তাতে কোন অসুবিধা নেই। তবে আগে দেয়াই উত্তম”।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৩০)
.
কোনো কোনো আলেমের মতে সালাতের কোনো রুকন আদায়ে সন্দেহ হলে, তা সালাতের রাকাআতের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহের মতোই গণ্য হবে। যদি সন্দেহকারী নিশ্চিতভাবে বুঝতে না পারেন কোনটি সঠিক অর্থাৎ তার কাছে কোনো দিক প্রবল না মনে হয় তাহলে তাকে একীনের উপর নির্ভর করবে। একীন অর্থাৎ নিশ্চিত দিকটি, যা সাধারণত কম সংখ্যাটি হয়ে থাকে। এই অবস্থায় সে ব্যক্তি সালাম ফিরানোর পূর্বে সাহু সিজদা আদায় করবে। আর যদি তার কাছে কোনো একটি সম্ভাবনা প্রবল মনে হয়, তাহলে সে সেই প্রবল ধারণার ভিত্তিতে সালাত সম্পন্ন করবে এবং সালাম ফিরানোর পূর্বেই সাহু সিজদা আদায় করবে। যেমন:
মুরদাওয়ি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:قَوْلُهُ ( وَمَنْ شَكَّ فِي تَرْكِ رُكْنٍ : فَهُوَ كَتَرْكِهِ ) هَذَا الْمَذْهَبُ , وَعَلَيْهِ أَكْثَرُ الْأَصْحَابِ وَقَطَعَ بِهِ كَثِيرٌ مِنْهُمْ , وَقِيلَ : هُوَ كَتَرْكِ رَكْعَةٍ قِيَاسًا , فَيَتَحَرَّى ، وَيَعْمَلُ بِغَلَبَةِ الظَّنِّ“গ্রন্থকারের বক্তব্য: কারো কোনো একটি রুকন ছুটে গেছে সন্দেহ হওয়া সে রুকন আদৌ পালন না করার মতো , এটাই মাযহাবের অভিমত। মাযহাবের অধিকাংশ আলেম এ মতটি গ্রহণ করেছেন। তাদের অনেকে এ মতটিকে অকাট্য বলেছেন। কারো কারো মতে, এ মাসয়ালাটি কোনো একটি রাকাত ছেড়ে দেয়ার মাসায়ালার সাথে কিয়াসযোগ্য। তাই সে ব্যক্তি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করবে এবং প্রবল ধারণার ভিত্তিতে আমল করবে।”
(আল-ইনসাফ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫০)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]বলেন:
وإن شكَّ في تَرْكِ رُكن فكتركه أي : لو شَكَّ هل فَعَلَ الرُّكن أو تَرَكَه ، كان حكمه حكم مَنْ تركه .مثاله : قام إلى الرَّكعة الثانية ؛ فَشَكَّ هل سَجَدَ مرَّتين أم مرَّة واحدة ؟ … .وكان الشَّكُّ في تَرْكِ الرُّكن كالتَّرك ؛ لأن الأصل عدمُ فِعْله ، فإذا شَكَّ هل فَعَلَه ، لكن إذا غلب على ظَنِّه أنه فَعَلَه ؛ فعلى القول الرَّاجح وهو العمل بغلبة الظَّنِّ يكون فاعلاً له حكماً ، ولا يرجع ؛ لأننا ذكرنا إذا شَكَّ في عدد الركعات يبني على غالب ظَنِّهِ ، ولكن عليه سجود السَّهو بعد السلام
“যদি কারো কোনো একটি রুকন ছুটে গেছে সন্দেহ হয় সেটা কোনো রুকন ছেড়ে দেয়ার মতই”। অর্থাৎ সে ব্যক্তি যদি সন্দেহ করে যে, সে কি রুকনটি আদায় করেছে নাকি আদায় করেনি তার হুকুম হবে, যে ব্যক্তিটি আদৌ রুকনটি আদায় করেনি সে ব্যক্তির হুকুমের মতো। এর উদাহরণ হচ্ছে- কোনো মুসল্লি দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়ানোর পর তার সন্দেহ হল সে কি সিজদা দুইটা দিয়েছে নাকি একটা দিয়েছে? কোনো কিছু আদায় না-করার সন্দেহ ঐ কাজটি আদৌ না-করার মতো। কারণ কোনো কিছু না-করা নিয়ে যখন সন্দেহ হয় তখন সে জিনিসের মূল অবস্থা হচ্ছে না-করা। কিন্তু তার যদি প্রবল ধারণা হয় যে, সে রুকনটি আদায় করেছে তাহলে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী সে প্রবল ধারণার ভিত্তিতে নীতিগতভাবে সে রুকনটি আদায় করেছে ধরা হবে এবং তাকে এ রুকনটি পুনরায় আদায় করতে হবে না। কারণ আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, যদি কেউ সালাতের সংখ্যা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে তাহলে সে ব্যক্তি তার প্রবল ধারণার উপর নির্ভর করবে। তবে সালাম ফিরানোর পর তাকে সহু সিজদা দিতে হবে।”((ইবনু উসামীন, আশ-শারহুল মুমতি‘,আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৮৪)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
কোন ভুলগুলোতে সাহু সিজদা দিতে হয় এবং কখন ও কোথায় দিতে হয়
প্রশ্ন: সাহু সিজদার উদ্দেশ্য ও হিকমত কী? কোন ভুলগুলোতে এটি করা ওয়াজিব হয়? সাহু সিজদা কখন ও কোথায় আদায় করতে হয় এবং তাতে কী পড়া উচিত? কেউ যদি সাহু সিজদা না করেই সালাত শেষ করে, তবে তার সালাতের হুকুম কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর এখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে আমরা প্রতিটি পয়েন্ট আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
.

.
আল্লাহ তাআলার বান্দাদের প্রতি অপার রহমত ও এই পরিপূর্ণ দ্বীনের সৌন্দর্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো তিনি বান্দাদের ইবাদতে অনিবার্যভাবে ঘটে যাওয়া ত্রুটিগুলো পূরণ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। কেননা মানুষ ভুল-ভ্রান্তিমুক্ত নয়, আর এই ঘাটতি থেকে সম্পূর্ণরূপে রেহাই পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই আল্লাহ যেমন নফল ইবাদত, ক্ষমা প্রার্থনা এবং অনুরূপ বিভিন্ন উপায়ে এসব ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন, তেমনই, সালাতে সামান্য ভুল বা কমতি হলে তা পূরণের জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য ‘সাহু সিজদা’র বিধান দিয়েছেন। তবে এই বিধান সকল ভুলের জন্য নয়; বরং নির্দিষ্ট কিছু ভুল বা ঘাটতির ক্ষেত্রে এটি আরোপিত হয়েছে। প্রতিটি ভুল সাহু সিজদার মাধ্যমে পূরণযোগ্য নয়, আবার সব পরিস্থিতিতে সাহু সিজদা করা ওয়াজিবও নয়।
.

.
সাহু সিজদার কারণসমূহের ব্যাপারে শাইখ ইবনে উসাইমীন রহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি উত্তর দেন: সাকুল্যে সালাতে সাহু সিজদার কারণ তিনটি:
.
(১). বৃদ্ধি:- অতিরিক্ত কিছু যোগ করা (বৃদ্ধি): এর উদাহরণ হলো কেউ যদি সালাতে একটি রুকু, একটি সিজদাহ, দাঁড়ানো বা বসার অতিরিক্ত কোনো অংশ করে ফেলে।
.
(২).কমতি:- কোনো কিছু বাদ দেওয়া (কমতি): এর উদাহরণ হলো সালাতের কোনো রুকন (অবশ্য করণীয় অংশ) বা ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয় কাজ) কেউ ভুলক্রমে ফেলে দেয়।
.
(৩). সন্দেহ:- সন্দেহের উদাহরণ হলো: কোন ব্যক্তি সালাতের সংখ্যা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যাওয়া; যেমন কেউ রাকাআতের সংখ্যা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়; বুঝতে পারে না যে সে তিন রাকাত পড়েছে, নাকি চার।
.

.
সাহু সিজদার স্থান নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিক গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে:
.
(ক).যদি সালাতে কোনো বৃদ্ধি (অর্থাৎ অতিরিক্ত কিছু করা) হয়ে যায়, তাহলে সালামের পর সাহু সিজদা দিতে হবে।
.
(খ).আর যদি কমতি হয় (অর্থাৎ কোনো ওয়াজিব বা সুন্নাত ছেড়ে যায়), তাহলে সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে।
.
(গ).আর যদি সন্দেহ সৃষ্টি হয়, তাহলে বিষয়টি কিছুটা বিশ্লেষণসাপেক্ষ। যদি দুটি সম্ভাবনার মধ্যে কোনোটিই স্পষ্টভাবে প্রাধান্য না পায়, তাহলে সালামের আগে সাহু সিজদা করবে। (দেখুন: ইবনু উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ১৪-১৬)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
التشهد الأول في الصلاة واجب من واجباتها في أصح قولي العلماء ، لأن النبي صلى الله عليه وسلم كان يفعله ويقول : ( صلوا كما رأيتموني أصلي ) ، ولما تركه سهوا سجد للسهو ، فمن تركه عمدا بطلت صلاته ، ومن تركه سهوا جبره بسجود السهو قبل السلام
“আলেমদের দুই মতের মাঝে বিশুদ্ধ মত অনুসারে সালাতের প্রথম বৈঠকের তাশাহ্হুদ একটি ওয়াজিব। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতেন এবং তিনি বলেছেন: “তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখছ সেভাবে সালাত আদায় করো।” এবং যেহেতু তিনি এটা ছেড়ে দেওয়ার প্রেক্ষিতে সাহু সিজদা দিয়েছিলেন। সুতরাং কেউ ইচ্ছাকৃত প্রথম বৈঠক ছাড়লে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। আর ভুল করে ছেড়ে দিলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সালামের আগে সাহু সিজদা দিবে।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৮)
.
আর সাহু সিজদায় কি পড়তে হয় এই বিষয়ে কথা হচ্ছে, সালাতের সিজদার মতোই সাহু সিজদা আদায় করতে হয়। মুসল্লী সালাতের মতো করেই সাতটা হাড়ের উপর সাহু সিজদা আদায় করবে। ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ‘লা’ এই পরিচিত যিকির পড়বে। দুই সিজদার মঝে ‘রাব্বিগফিরলি, রাব্বিগফিরলি’ পড়বে। সাহু সিজদার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো যিকির নেই। আলেমরা এটাই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যেমন শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন;سُجُودُ السَّهْوِ سَجْدَتَانِ بَيْنَهُمَا جَلْسَةٌ , وَيُسَنُّ فِي هَيْئَتِهَا الافْتِرَاشُ ، وَيَتَوَرَّكُ بَعْدَهُمَا إلَى أَنْ يُسَلِّمَ , وَصِفَةُ السَّجْدَتَيْنِ فِي الْهَيْئَةِ وَالذِّكْرِ صِفَةُ سَجَدَاتِ الصَّلاةِ . وَاَللَّهُ أَعْلَمُ “ভুলজনিত সিজদা দুইটি। এ দুই সিজদার মাঝখানে একটি বৈঠক আছে। এই বৈঠকে ইফতিরাশ (ডান পা খাড়া রেখে, বাম পা বিছিয়ে এর উপর বসা) পদ্ধতিতে বসা এবং সিজদাদ্বয়ের পর সালাম ফিরানো পর্যন্ত তাওয়াররুক (ভূমির উপর নিতম্ব রেখে উভয় পা ডান দিকে বের করে বসা) পদ্ধতিতে বসা সুন্নত। এ সিজদাদ্বয়ের পদ্ধতি ও যিকির নামাযের সিজদাগুলোর মতো। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।”(নববী “আল-মাজমু” খণ্ড; ৪; পৃষ্ঠা: ৭২)
.
মারদাওয়ী তার ‘আল-ইনসাফ’ বইয়ে বলেন:سجود السهو وما يقول فيه وبعد الرفع منه كسجود الصلاة“সাহু সিজদায় যা পড়া হবে এবং এর থেকে ওঠার পর যা পড়া হবে সবই সালাতের সিজদার মতো।”(আল-ইনসাফ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫৯) রামলী তার ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ বইয়ে বলেন:وكيفيتهما ( يعني سجدتي السهو ) كسجود الصلاة في واجباته ومندوباته كوضع الجبهة والطمأنينة والافتراش في الجلوس بينهما“দুই সাহু সিজদার ধরন নামাযের সিজদার মতই; এর ওয়াজিব ও মুস্তাহাবগুলোর ক্ষেত্রে। যেমন: মাটিতে কপাল রাখা, স্থির হওয়া, ইফতিরাশ করা (দুই সিজদার মাঝখানে পায়ের উপর নিতম্ব রেখে বসা।)”(নিহায়াতুল মুহতাজ’ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৮ থেকে সংক্ষেপে সমাপ্ত)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:يقول الساجد في سجود السهو والتلاوة مثل ما يقول في سجوده في صلاته : ” سبحان ربي الأعلى ” والواجب في ذلك مرة واحدة ، وأدنى الكمال ثلاث مرات ، ويستحب الدعاء في السجود بما يسر الله من الأدعية الشرعية المهمة“ভুলজনিত সিজদা ও তেলাওয়াতের সিজদা দানকারী সালাতের সিজদাতে যা যা বলেন তাই বলবেন: سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلى (আমার সুউচ্চ প্রভুর পবিত্রতা ঘোষণা করছি)। একবার বলা ওয়াজিব। পরিপূর্ণ মাত্রা হচ্ছে: ন্যূনতম তিনবার বলা। সিজদাতে সাধ্যমত শরয়ী দোয়াগুলো পড়া মুস্তাহাব।”(”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৪৩)
.
উল্লেখ যে কিছু ফকীহ মনে করেন সাহু সিজদাতে
سُبْحَانَ مَنْ لَا يَسْهُوْ وَلَا يَنَامُ
(সুবহানা মান লা ইয়াসহু ওয়া-লা ইয়ানামু) অর্থ: আমি সেই সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি ঘুমান না এবং ভুলে যান না) পড়া মুস্তাহাব। কিন্তু এর পক্ষে কোনো দলীল নেই। সুতরাং সালাতের সিজদায় যা পড়া হয় তাতে সীমিত থাকায় শরয়ি বিধান; এছাড়া অন্য কোন যিকিরে ব্যক্তি অভ্যস্ত হবে না। এই বিষয়ে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] তার আত-তালখীস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: আমি এর (পূর্বোক্ত দোয়ার) কোন ভিত্তি পাইনি।”(আত-তালখীস’;খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১২)
.

.
আলেমগণ উল্লেখ করেছেন, ভুলক্রমে যে ব্যক্তির সাহু সিজদা ছুটে গেছে যদি খুব বেশি বিলম্ব না হয় তাহলে সে তখনি সেটা কাযা করে নিবে। আর যদি দীর্ঘ সময় বিলম্ব হয় তাহলে মুসল্লির উপর থেকে সাহু সিজদা আদায় করার দায়িত্ব বাদ যাবে এবং তার সালাত সহিহ হবে।
ইমাম আল-বুহুতি ((রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
( وَإِنْ نَسِيَهُ ) أَيْ : السُّجُودَ وَقَدْ نُدِبَ ( قَبْلَهُ ) أَيْ : السَّلَامُ ( قَضَاهُ ) وُجُوبًا إنْ وَجَبَ ( وَلَوْ ) كَانَ ( شُرِعَ فِي ) صَلَاةٍ ( أُخْرَى فَ ) يَقْضِيهِ ( إذَا سَلَّمَ ) مِنْهَا إنْ قَرُبَ الْفَصْلُ , وَلَمْ يُحْدِثْ , وَلَمْ يَخْرُجْ مِنْ الْمَسْجِدِ لِبَقَاءِ مَحَلِّهِ ( وَإِنْ طَالَ فَصْلٌ عُرْفًا , أَوْ أَحْدَثَ , أَوْ خَرَجَ مِنْ الْمَسْجِدِ لَمْ يَقْضِهِ ) أَيْ : السُّجُودَ لِفَوَاتِ مَحَلِّهِ ( وَصَحَّتْ ) صَلَاتُهُ , كَسَائِرِ الْوَاجِبَاتِ إذَا تَرَكَهَا سَهْوًا “
“কেউ যদি সালামের আগে আদায় করা মুস্তাহাব এমন কোন সাহু সিজদা দিতে ভুলে যায়; সে সাহু সিজদাটি যদি ওয়াজিব হয় তাহলে সে ব্যক্তি ওয়াজিব হিসেবে এটাকে কাযা করে নিবে। আর যদি অন্য কোনো সালাত শুরু করে দেয় তাহলে ঐ সালাতের সালাম ফিরানোর পর সাহু সিজদা কাযা করবে; যদি এর মধ্যে বেশি বিলম্ব না হয়; ওজু না ভাঙ্গে এবং মসজিদ থেকে বের না হয়। যেহেতু সিজদাটি আদায় করার সময় এখনো আছে। আর যদি প্রথা অনুযায়ী খুব দেরী হয়ে যায়, কিংবা ওজু ছুটে যায় কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে সাহু সিজদা আর কাযা করা যাবে না। যেহেতু এটি আদায় করার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবে তার সালাত শুদ্ধ হবে। যেমন অন্য যে কোন ওয়াজিব ভুলক্রমে পরিত্যাগ করলেও সালাত শুদ্ধ হয়।”,(মুনতাহাল ইরাদাত; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৩৫)
.
যে ব্যক্তি এ মাসয়ালার বিধান জানে না এমন ব্যক্তি ও জেনে ভুলকারী উভয়ের জন্য হুকুম অভিন্ন। সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন: إذا كان تركه سجود السهو عمداً ، فصلاته باطلة وعليه إعادتها ، وإن كان تركه سهواً ، أو جهلاً ، فلا إعادة عليه وصلاته صحيحة “
যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সাহু সিজদা ছেড়ে দেয় তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে এবং তাকে পুনরায় সালাত পড়তে হবে। আর যদি ভুলক্রমে কিংবা অজ্ঞতাবশত ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে পুনরায় সালাত পড়তে হবে না। তার নামায সহিহ।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে,যদি কেউ নামাযের রাকাতে বেশি করে কিংবা কম করে এবং সাহু সিজদা না দেয় তাহলে তার সালাত কি বাতিল হয়ে যাবে?
তিনি জবাবে বলেন:
هذا فيه تفصيل : إذا كان عزم على ترك السجود وهو في الصلاة ، فهذا إذا تعمد ذلك ، وهو يعلم الحكم الشرعي : تبطل صلاته .أما إذا كان جاهلا أو ناسيا : ما تبطل ، وصلاته صحيحة …”
এক্ষেত্রে বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। যদি সে ব্যক্তি সাহু সিজদা দেয়ার হুকুম জানার পরও সালাতের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সাহু সিজদা না দেয় তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি অজ্ঞতাবশত কিংবা ভুলক্রমে সাহু সিজদা না দেয় তাহলে তার সালাত শুদ্ধ হবে।(বিন বায,ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত দেখুন শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১০৮৬৬)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
ঘড়ি কোন হাতে পরিধান করা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী
প্রশ্ন: ঘড়ি কোন হাতে পরিধান করা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী। ডান হাতে নাকি বাম হাতে? একটি ভারসাম্যপূর্ণ পর্যালোচনা।
▬▬▬▬▬▬❂✿❂▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর ঘড়ি কোন হাতে পরিধান করা উত্তম এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিংবা সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো স্পষ্ট দলিল প্রমাণিত হয়নি। কারণ, ঘড়ি একটি আধুনিক আবিষ্কার যা নবীজির যুগে ছিল না। ফলে এই বিষয়টি একটি ইজতিহাদী মাসআলা হিসেবে বিবেচিত। এই ইজতিহাদী মাসআলায় ইমামগণ সাধারণত আংটি পরিধান সংক্রান্ত হাদীসগুলোর উপর কিয়াস করে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ‘ঘড়ি কোন হাতে পরিধান করা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী এই বিষয়ে মোটামুটি তিনটি মত পাওয়া যায়।
.

.
(ক).ইসলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচারের পরিপূর্ণ নির্দেশনা দেয়। শরিয়তের অন্যতম মৌলিক নীতিমালা হলো সম্মানিত ও পবিত্র কাজসমূহ ডান হাত দিয়ে সম্পাদন করা এবং অশুচি বা হীন কাজসমূহ বাম হাত দিয়ে সম্পাদন করা, যাতে ডান দিকের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র ও উত্তম কাজগুলোয় ডান দিককে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন এবং সেদিকেই অগ্রাধিকার দিতেন। যেমন:আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ فِيْ تَنَعُّلِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَطُهُوْرِهِ وَفِيْ شَأْنِهِ كُلِّهِ ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুতা পরিধান, চুল আঁচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জন করা তথা প্রত্যেক কাজই ডান দিক হতে আরম্ভ করতে পছন্দ করতেন”।(সহীহ বুখারী, হা/১৬৮)।
.
(খ).তাঁরা আরও বলেন, ডান হাতে ঘড়ি পরা কুফরীদের থেকে মুসলিমদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার একটি মাধ্যম কারণ অধিকাংশ কাফের বাম হাতে ঘড়ি পরিধান করে। আর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ইয়াহূদী ও নাসারাদের বিরোধিতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের অনুকরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’(আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১; মিশকাত, হা/৪৩৪৭)
এটি প্রমাণ করে কা-ফের-মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা খুবই মারাত্মক বিষয়, সেটা কথার মাধ্যমে সাদৃশ্য হোক কিংবা কর্মের মাধ্যমে, পোশাকের মাধ্যমে হোক কিংবা অভ্যাস, অনুষ্ঠান বা উৎসবের মাধ্যমে।
.
(গ).তারা আংটির ক্ষেত্রে কিয়াস করে থাকেন যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত ডান হাতে আংটি পরতেন, তাই তাঁরা ডান হাতেই ঘরি পরিধানকে অগ্রাধিকার দেন; যদিও কিছু হাদিসে বাম হাতে পরার উল্লেখও পাওয়া যায়।” আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত; রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ডান হাতে রূপার একটি আংটি পরিধান করেছেন। তাতে হাবশী মোহর ছিল। তিনি এর মোহরটি হাতের তালুর দিকে রাখতেন। (সহীহ মুসলিম হা/৫৩৮০) আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ডান হাতে আংটি পরতেন। (আহমাদ আল-মুসনাদ; ৩/২৬৫)। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন,নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আংটি ছিল এ আঙ্গুলে- এ কথা বলে তিনি বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলের দিকে ইঙ্গিত করেন।”(সহীহ মুসলিম হা/৫৩৮২) তবে অধিকাংশ হাদিস ডান হাতের পক্ষে।
.
(ঘ).ঘড়ি কেবল সময়ের পরিমাপই নয়, এটি পরিধানকারীর মর্যাদা, রুচি ও সৌন্দর্যবোধেরও প্রতীক। তাই যখন ঘড়িটি ডান হাতে পরিধান করা হয়, তখন তা বাহ্যিক সৌন্দর্যকে আরও পরিপূর্ণ করে তোলে। রাসূল (ﷺ) নিজেও সম্মানজনক ও পরিচ্ছন্নতার কাজগুলিতে ডান দিককে অগ্রাধিকার দিতেন, যা পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।”
.
(ঙ).তারা আরও বলেন, বাম হাতে ঘড়ি পরার ফলে এটি অজুর সময় বা পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে নাপাকির সংস্পর্শে আসতে পারে, যা তহারাতের শুদ্ধতা ও সৌন্দর্যকে ব্যাহত করতে পারে। অথচ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান। যেমন আবূ মালেক আল-আশআরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,”পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক”(সহীহ মুসলিম, হা/২২৩; মিশকাত, হা/২৮১)
.

.

(১).আংটির উপর কিয়াস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান ও বাঁম উভয় হাতে আংটি পরেছেন, তাই ঘড়ি পরিধানের ক্ষেত্রে কোন একটি হাতকে নির্দিষ্ট করার কোন দলিল কিংবা নির্দিষ্ট কোন ফজিলত নেই।
.
(২).বাস্তবতা ও সুবিধার কথা বিবেচনা করলে, ডান হাতে ঘড়ি পরলে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা হতে পারে অথবা ঘড়ি ভাঙার আশঙ্কা থাকতে পারে। অধিকাংশ ঘড়ির নকশা বাঁ হাতে পরার উপযোগী, কারণ এর সুইচ বা রিল সাধারণত ডান পাশেই থাকে। এছাড়া, ডান হাতে খাওয়ার সময় সময় দেখার জন্য বাঁ হাতটি বেশি সুবিধাজনক।”
.
(৩).ডান দিককে অগ্রাধিকার দেওয়ার হাদীসের প্রাসঙ্গিকতা সব কাজে নয়; বরং তা মূলত শুরু ও সমাপ্তির মতো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।”
.
(৪).অনেক কাফেরও ডান হাতে ঘড়ি পরেন তাই এটিকে কাফেরদের বিরোধিতার মানদণ্ডে বিবেচনা করা সঙ্গত নয়।” এই মতের পক্ষে কয়েকটি ফাতওয়া হল।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল; পুরুষদের জন্য ডান বা বাম হাতে ঘড়ি পরিধান বৈধ কিনা?
জবাবে স্থায়ী কমিটির আলেমগন বলেছেন, الأمر في ذلك واسع،فيجوز لبسها في اليمنى أو اليسرى للرجال والنساء كالخاتم.”এ বিষয়ে প্রশস্ততা রয়েছে, সুতরাং আংটির ন্যায় ঘড়িও নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ডানহাতে কিংবা বামহাতে পরিধান করাতে কোন আপত্তি নেই”।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৮০: ফাতওয়া নং-৯৫৮৪)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,لا حرج في لبس الساعة في اليد اليمنى أو اليسرى،كالخاتم، وقد ثبت عن النبي ﷺ أنه لبس الخاتم في اليمنى واليسرى.» انتهى.”আংটির মত ঘড়ি ডানহাতে কিংবা বামহাতে পরতে কোন আপত্তি নেই। নবী ﷺ থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি ডানহাতে ও বামহাতে আংটি পরেছেন।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা, খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৫৫)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:وضع الساعة في اليد اليمنى ليس أفضل من وضعها في اليد اليسرى؛لأن الساعة أشبه ما تكون بالخاتم،فلا فرق بين أن تضع الساعة في اليمين أو اليسار،لكن لا شك أن وضعها في اليسار أيسر للإنسان،من ناحية التعبئة،ومن ناحية النظر إليها أيضاً،ثم هي أسلم في الغالب؛لأن اليمنى أكثر حركة فهي أخطر.والأمر في هذا واسع،فلا يقال:إن السنة أن تلبسها باليمين؛لأن السنة جاءت في اليمين واليسار في الخاتم، والساعة أشبه شيء به»انتهى.”ডানহাতে ঘড়ি পরা বামহাতে ঘড়ি পরার চেয়ে উত্তম নয়।কেননা ঘড়ির বিষয়টি আংটির কাছাকাছি। এ কারণে ঘড়ি ডানহাতে পরা কিংবা বামহাতে পরার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে বামহাতে পরা মানুষের জন্য সহজতর পরার দিক থেকে এবং ঘড়ি দেখার দিক থেকে। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বামহাতে ঘড়ি পরাটা অধিক নিরাপদ।কেননা ডানহাতে বেশি কাজ করা হয়। তাই সেটি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়টিতে প্রশস্ততা রয়েছে।তাই এ কথা বলা যাবে না যে,ডানহাতে পরা সুন্নত।কেননা হাদিসে ডানহাতে ও বামহাতে আংটি পরার বিষয়টি উদ্ধৃত হয়েছে।ঘড়ি আংটির সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ।”(ইমাম উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১১০)
.

.
জবাবে বলা যায় তিনটি মতের মধ্যে সুন্নাহ’র অধিক নিকটবর্তী হচ্ছে, ডান হাতে গড়ি পরিধান করা যেমনটি
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] ব্যাখ্যা করেছেন। ডান হাতে ঘড়ি পরিধান করা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী বলে গণ্য হয়, কারণ এটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত সকল ভালো কাজে ডান দিককে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। এতে রয়েছে অধিকাংশ কাফিরদের বিরোধিতা, আংটির মত ডান হাতে ব্যবহারের অনুরূপতা,এবং অপবিত্রতা থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত থাকার একটি মাধ্যম হিসেবেও ডান হাত ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যদিও ঘড়ি পরার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ নেই, তবে যখন সুযোগ থাকে, ডান হাতে পরা উত্তম। তবে, যদি এমন কোনো পরিস্থিতি থাকে যেখানে ডান হাতে ঘড়ি পরলে তা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে বাঁ হাতে পরা বৈধ এবং এমনকি অনেক সময় সেটাও উত্তম হতে পারে।
.
বর্তমান সৌদি আরবের আক্বীদার অন্যতম আলেম শাইখ ওয়ালিদ বিন রাশিদ আস-সাঈদান (হাফিজাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: ঘড়ি ও আংটি কোন হাতে পরা উত্তম ডান হাতে, না বাম হাতে?
উত্তরে শাইখ বলেন:
الأمر في ذلك واسع، فأما الخاتم فقد ثبت أن النبي ? لبسه في اليمين تارة وفي شماله تارة، فيجوز هذا وهذا، وأما الساعة فلا نص فيها؛ لأنها واقعة جديدة ولنا فيها تخريجان: الأول: أن تقاس على الخاتم فيجوز لبسها في اليمين أو في الشمال فالأمر واحد. والثاني: أن تلبس في اليمين، وذلك لثلاثة أمور: أحدها: أنها من باب الكرامة والتجمل والتزين، ذلك لأن الإنسان لا يقصد بشرائها مجرد مراعاة الوقت فقط، بل يقصد منها أيضًا النواحي الجمالية، وقد تقرر أن ما كان من باب التكريم والتزيين فتقدم فيه اليمين.
الثاني: أن لبسها في اليسار هي العادة السائدة عند الكفار على مختلف طوائفهم ومن المعلوم أن المسلمين أخذوا هذه العادة منهم تقليدًا لهم في ذلك (1)، ومخالفة الكفار فيما هو من عاداتهم وعبادتهم مقصد من مقاصد الشريعة حتى وإن كان في الأشياء اليسيرة كفرق الشعر؛ لأنهم يسدلون، وحف الشارب؛ لأنهم لا يحفون، والصلاة في النعل؛ لأنهم لا يصلون فيها، وكراهة اشتمال الصماء فقيل إنها لبسة اليهود، وتحريم شد الزنار، وغيرها كثيرة فمخالفة الكفار عمومًا واليهود والنصارى خصوصًا مقصد من مقاصد الشريعة فإذا كان من عادتهم لبس الساعة في اليسار فنحن نخالفهم ونلبسها في اليمين وينوي الإنسان بذلك مخالفتهم فيثاب عليه.
الثالث: أن اليد اليسار هي آلة إزالة النجاسات والأشياء المستقذرة فيخشى عند لبسها في اليسار أن يتسرب لها شيء من النجاسات وخصوصًا إذا كانت واسعة وهذا مما يغلب على الظن وغلبة الظن منزلة منزلة اليقين فدرءاً لذلك تلبس في اليمين التي لا تعلق لها بإزالة شيء من ذلك، والنفس تطمئن للتخريج الثاني لكن الأمر واسع ولا أظن العاقل ينكر على من لبسها في هذه أو لبسها في هذه؛ لأن مسائل الاجتهاد لا إنكار فيها وهذه منها
“আমি বলি, এই ব্যাপারে ইসলামে ব্যাপকতা রয়েছে, অর্থাৎ এতে কোনো সংকীর্ণতা বা কঠোরতা নেই। আংটির ক্ষেত্রে, প্রমাণ রয়েছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ডান হাতে আংটি পরেছেন, আবার কখনো বাম হাতে। ফলে, উভয়ভাবে পরা বৈধ। আর ঘড়ির বিষয়ে এটি নতুন আবিষ্কৃত একটি বিষয়, যার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট দলীল নেই। তবে আমরা এতে দুটি ব্যাখ্যার দিক নিতে পারি:
প্রথম ব্যাখ্যা হলো এটি আংটির উপর কিয়াস করে বলা যায়। যেহেতু আংটি দুই হাতে পরা যায়, ঘড়িও তেমনি ডান বা বাম যেকোনো হাতে পরা বৈধ। এতে কোনো সংকীর্ণতা নেই।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো ঘড়ি ডান হাতে পরা উচিত। এর তিনটি কারণ রয়েছে:
(১).এটি সৌন্দর্য, শোভা ও সম্মানের বস্তু হিসেবে গণ্য হয়। মানুষ কেবল সময় দেখার জন্যই ঘড়ি পরে না, বরং এটি অলঙ্কার হিসেবেও পরে। শরিয়তে যা কিছু সৌন্দর্য ও সম্মানের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, সেসব ক্ষেত্রে ডান হাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
(২).বাম হাতে ঘড়ি পরা হচ্ছে কা-ফিরদের সাধারণ অভ্যাস তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতেই এটি প্রচলিত। মুসলিমরা মূলত তাদের অনুসরণ করেই এটি গ্রহণ করেছে। অথচ শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো কা-ফিরদের অনুকরণ না করা, তা যত সামান্য বিষয়েই হোক না কেন। যেমন: চুল মাঝখান দিয়ে ভাগ করা কারণ তারা চুল ঝুলিয়ে রাখে; গোঁফ ছেঁটে রাখা কারণ তারা তা করে না; জুতা পায়ে নামায পড়া কারণ তারা তা করে না; ‘ইত্তিবা’ (চাদর একদিকে মোড়ানো) অপছন্দনীয়, কারণ এটি ইহুদিদের পোশাক বলা হয়; ‘যুননার’ (অবিশ্বাসীদের ধর্মীয় বেল্ট) পরা হারাম এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। সুতরাং, কা-ফিরদের বিশেষ করে ই-হুদি ও খ্রি-স্টানদের ভিন্নরূপ হওয়া শরিয়তের একটি উদ্দেশ্য। যদি তাদের রীতি হয় বাম হাতে ঘড়ি পরা, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করব, ডান হাতে পরব; আর এই নিয়তে পরলে এতে সাওয়াবও পাওয়া যাবে।
(৩). বাম হাত সাধারণত অপবিত্রতা ও অশুচি জিনিস দূর করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ফলে, যদি ঘড়ি বাম হাতে পরা হয়, বিশেষত যদি তা ঢিলা হয়, তবে অপবিত্রতা লাগার সম্ভাবনা থাকে। আর প্রবল ধারণাকে শরিয়তে নিশ্চিততার মর্যাদা দেওয়া হয়। তাই এই সম্ভাবনা থেকে বাঁচতে ডান হাতে ঘড়ি পরাই নিরাপদ ও উত্তম।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল দ্বিতীয় ব্যাখ্যাই অধিক প্রশান্তিদায়ক। তবে বিষয়টি উন্মুক্ত (ব্যাপকতা রয়েছে), এতে কোনো কঠোরতা নেই। আমি মনে করি না কোনো বিবেকবান ব্যক্তি কাউকে দোষারোপ করবে সে ডান হাতে পরুক বা বাম হাতে। কারণ এটি ইজতিহাদি (ব্যক্তিগত মতভেদযোগ্য) বিষয়, আর ইজতিহাদি বিষয়ে দোষারোপ করা যায় না।” (তালকীহুল আফহাম আল-উলিয়্যাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৭৬) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
রচনাকাল: ভোর ৪টা ৪৯ মিনিট।
রোজ বুধবার।
৯ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি।
২৪শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।
৭ই মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে
প্রশ্ন: জাতীয়তাবাদ (Nationalism) কী? জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার জন্য। দুরুদ বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। অতঃপর ইংরেজি Nationalism শব্দের বাংলা পরিভাষা হচ্ছে,জাতীয়তাবাদ।(Nationalism) হলো এমন একটি মতবাদ ও চিন্তাধারা, যার মাধ্যমে একটি জাতি তার স্বতন্ত্রতা, ঐক্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সচেতন হয় এবং তা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ হল এমন একটি আদর্শ যেখানে জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে জাতিগত আদর্শের পরে স্থান দেয়া হয়। জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে বলা হয়েছে: Nationalism is the desire by a group of people who share the same race, culture, language etc. to form an independent country.” অর্থাৎ ‘জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একই ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি, গোষ্ঠী ইত্যাদির অংশীদার একদল মানুষের একটি স্বাধীন দেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষা’।কার্ল্টন হেইস (Carleton Hayes) বলেন, জাতীয়তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি হল, একই ভাষা এবং একই ঐতিহ্য। যখন এগুলো কোন শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে আবেগ তাড়িত দেশত্ববোধে পরিণত হয়, তখনই জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ।এই মতবাদের মৌলিক উপাদান ৬টি। (১) বংশ (২) অঞ্চল, (৩) ভাষা, (৪) বর্ণ, (৫) অর্থনৈতিক ঐক্য এবং (৬) শাসনতান্ত্রিক ঐক্য।উক্ত ছয়টি উপাদানের মধ্যে ধর্মকে স্থান দেয়া হয়নি। জাতীয়তাবাদ ধর্মকে নস্যাৎ করার প্রথম কোন বিজাতীয় মতবাদ। একই স্বার্থ ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে একটি জাতি বলে। আর ‘জাতি’ ভিত্তিক মতবাদকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলে।(দেখুন: C. J. Hayes, Nationalism : A Religion (New York : Mcmillan, 1960 AD), p. 6.; ড.তাহির আমিন, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, জুলাই ২০০৮ খৃ.),পৃষ্ঠা: ৩২ আল ইখলাস)
.
❑ জাতীয়তাবাদের উত্থান ও পতনের সময়কাল:
জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক ধারণা। গবেষকদের দৃষ্টিতে ফরাসী বিপ্লবের কিছু পূর্বে অর্থাৎ ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। ১৭৮৯ থেকে ১৯১৪ খ্রি. পর্যন্ত এর দ্বিতীয় যুগ। মানবতা বিধ্বংসী এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন ইটালির ম্যাকিয়াভেলি (Machiavelli) এবং জার্মানির ফ্যাসিবাদের উদ্যোক্তা রক্ত পিপাসু হিটলার। এদেরকেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।তবে ইংরেজরা জাতীয়তাবাদ বা জাতি সত্তার পথিকৃৎ।(source: bcssolutionbd) ১৮ শতক হল,জাতীয়তাবাদের উত্থানের যুগ। কিন্তু মতবাদটি এর অন্তর্নিহিত অর্থের কারণে ১৯১৪ সালের পর থেকে নেতিবাচক রূপ লাভ করে। গ্লেন্ডা স্লুগা বলেন, ২০শ শতাব্দী হল জাতীয়তাবাদের মোহমুক্তি এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষের সময়।(দেখুন/Glenda Sluga, Internationalism in the Age of Nationalism (University of Pennsylvania Press, 2013) ch 1]
.
❑ জাতীয়তাবাদ এর প্রকারভেদ:
.
জাতীয়তাবাদ (Nationalism) একটি বহুস্তরবিশিষ্ট ধারণা, যা ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি রূপ হলো:
(১). ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ: যখন ভাষা একটি জাতির প্রধান পরিচায়ক হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ—বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।
.
(২). ভৌগোলিক বা রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ: যখন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হয়। যেমন—বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।
.
(৩). বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদ: জাতিগোষ্ঠী বা বর্ণের ওপর ভিত্তি করে গঠিত জাতীয়তাবাদ। যেমন কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদ, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ।
.
(৪). লিঙ্গভিত্তিক জাতীয়তাবাদ: যখন একটি লিঙ্গ বিশেষের অভিজ্ঞতা ও অধিকারকে জাতিসত্তার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন নারীবাদী বা পুরুষবাদী জাতীয়তাবাদ।
.
(৫).জাতিগোষ্ঠী বা নৃতাত্ত্বিক ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ: নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও অধিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ। যেমন কুর্দি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।
.
❑ ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদ:
.
জাতীয়তাবাদ ও এজাতীয় অন্যান্য মানবসৃষ্ট মতবাদ ইসলামের মৌলিক আক্বীদা বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক মানব-রচিত কুফরি মতবাদ,এগুলো ইসলামের মৌলিক আক্বীদা বিশ্বাস ও আদর্শের পরিপন্থী। এ দর্শন আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণের (‘আল-হুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল-বুগযু ফিল্লাহ’) মত গুরুত্বপূর্ণ আক্বীদার ভিত্তি ভেঙে দেয়। এতে করে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের বদলে জাতি, ভূখণ্ড ও ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ, একজন কাফির জাতীয়ভাবে আপন হলেও, ঈমানদার ভিনদেশি মুসলিমের চেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে যা ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এ দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি, বিভাজন ও আকীদাগত দুর্বলতার জন্ম দেয়। তাছাড়া মহান আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির পথনির্দেশক হিসেবে একমাত্র সত্য ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন। এটি কোনো মানুষের চিন্তা-নির্ভর নয়; বরং তা খোদ বিশ্বজগতের স্রষ্টার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ চূড়ান্ত জীবনবিধান।সুতরাং ইসলাম ব্যতীত যেসব মতবাদ ও দর্শনের প্রচলন ঘটেছে—যেমন জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র প্রভৃতি—সেগুলো আল্লাহর দেওয়া দ্বীনের বিকল্প হতে পারে না এবং মুসলিমদের জন্য তা গ্রহণযোগ্য নয়। এসব মতবাদ ইসলামি আকিদা ও তাওহিদের পরিপন্থী হওয়ায়, কোনো মুসলিমের জন্য এসব বিশ্বাস করা বা অনুসরণ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নয়।আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন:”ومن يبتغ غير الإسلام دينا فلن يقبل منه وهو في الآخرة من الخاسرين “যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করতে চায়, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা আলে ইমরান: ৮৫)এছাড়াও জাতীয়তাবাদ মূলত জাহেলী যুগে প্রচলিত গোত্র ও গোষ্ঠী ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার আধুনিক সংস্করণ। অথচ আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী সভ্যতার দিকে ফিরে যেতে নিষেধ করেছেন (সূরা আল-মায়িদাহ:৫০)। রাসূল (ﷺ) যাবতীয় জাহেলী কর্মকাণ্ডকে কবর দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসনের সূচনা করেছেন।(সহীহ মুসলিম, পৃষ্ঠা: ৩৫৫, হা/১২১৮)
.
জাতীয়তাবাদী কবি ফখরী আল-বারুদী বলেছিলেন:
بلادُ العرب أوطاني من الشام لبغـدانِ
ومن نجدٍ إلى يَمَـنٍ إلى مصرَ فتَطوان
فلا حدٌّ يُباعدنــا ولا دينٌ يُفرِّقنــا
لسانُ الضاد يجمعنا بغسّانٍ وعدنــانِ
আরবদের দেশ আমার স্বদেশ
শাম থেকে বাগদাদ পর্যন্ত,
নাজদ থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত,
মিশর থেকে তেতুয়ান পর্যন্ত।
কোনো সীমান্ত আমাদের আলাদা করতে পারে না,
আর কোনো ধর্ম আমাদের বিভক্ত করতে পারে না।”(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৭৭৩২)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:كل ما خرج عن دعوى الإسلام والقرآن من نسب أو بلد أو جنس أو مذهب أو طريقة: فهو من عزاء الجاهلية، بل لما اختصم مهاجري وأنصاري فقال المهاجري: يا للمهاجرين، وقال الأنصاري: يا للأنصار، قال النبي صلى الله عليه وسلم: «أبدعوى الجاهلية وأنا بين أظهركم وغضب لذلك غضبا شديدا» “ইসলাম এবং কুরআনের আহ্বানের বাইরে সকল বংশীয়, দেশ, জাতি, মাজহাব ও তরিকার আহ্বান জাহিলিয়াতের সাথে সম্পৃক্ত। একবার এক মুহাজির এবং এক আনসার সাহাবি বিবাদে লিপ্ত হলে মুহাজির ডাক দিয়ে বললেন, হে মুহাজিররা, তোমরা কে কোথায় আছো, জলদি ছুটে আসো-সাহায্য করো।” তখন আনসারি সাহাবীও ডেকে বললেন, হে আনসাররা, তোমাদের কে কোথায় আছো, জলদি ছুটে আসো-সাহায্য করো” তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,“জাহিলিয়াতের আহ্বান! অথচ আমি এখনো তোমাদের মাঝে বিদ্যমান আছি।” এতে তিনি প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ৩২৮; বিন বায; ইসলাম ও বাস্তবতার আলোকে আরব জাতীয়তাবাদের সমালোচনা; পৃষ্ঠা: ১৭)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে সে জাতীয়তাবাদী দাওয়াত সম্পর্কে কী মত, যারা মনে করে যে বংশগত বা ভাষাগত পরিচয় ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? অর্থাৎ যারা জাতীয়তাকে দ্বীনের ওপর অগ্রাধিকার দেয়?
তিনি উত্তর দিলেন:
هذه دعوة جاهلية ، لا يجوز الانتساب إليها ، ولا تشجيع القائمين بها , بل يجب القضاء عليها ؛ لأن الشريعة الإسلامية جاءت بمحاربتها والتنفير منها , وتفنيد شبههم ومزاعمهم والرد عليها بما يوضح الحقيقة لطالبها ؛ لأن الإسلام وحده هو الذي يخلد العروبة لغة ، وأدباً ، وخلقاً , وأن التنكر لهذا الدين معناه القضاء الحقيقي على العروبة في لغتها ، وأدبها ، وخلقها , ولذلك يجب على الدعاة أن يستميتوا في إبراز الدعوة إلى الإسلام بقدر ما يستميت الاستعمار في إخفائه .
ومن المعلوم من دين الإسلام بالضرورة أن الدعوة إلى القومية العربية أو غيرها من القوميات دعوة باطلة ، وخطأ عظيم ، ومنكر ظاهر ، وجاهلية نكراء ، وكيد للإسلام وأهله , وذلك لوجوه قد أوضحناها في كتاب مستقل سميته : ” نقد القومية العربية على ضوء الإسلام والواقع ” .
“এটি এক প্রকার জাহিলি (অজ্ঞতামূলক) দাওয়াত এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, সমর্থন জানানো কিংবা উৎসাহ দেওয়া কোনোভাবেই বৈধ নয়; বরং এটি মুছে ফেলা একান্ত জরুরি। কারণ ইসলামী শরিয়ত এসেছে এই ধরনের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষকে তা থেকে দূরে রাখার জন্য, তাদের সন্দেহ ও ভ্রান্ত যুক্তিগুলো খণ্ডন করে এবং সত্যকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করার জন্য যাতে সত্য অনুসরণকারীরা তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। ইসলামই একমাত্র শক্তি যা আরবত্বকে এর ভাষা, সাহিত্য ও নৈতিক মূল্যবোধসহ টিকিয়ে রেখেছে এবং অমর করেছে। ফলে যে কেউ ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে, সে প্রকৃতপক্ষে আরবত্বেরই বিরোধিতা করছে এর ভাষা, সাহিত্য ও চরিত্রের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে।এ কারণেই এক একজন দাঈ বা ইসলাম প্রচারকের উচিত, এমন নিষ্ঠা ও আত্মোৎসর্গের সঙ্গে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া, যেমনভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে তাদের সামর্থ্য ব্যয় করেছে ও এখনো করে যাচ্ছে। এই বিষয়টি ইসলামের অন্যতম মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত বিষয় যে,আরব জাতীয়তাবাদ কিংবা যেকোনো জাতীয়তাবাদে দাওয়াত দেওয়া একটি বাতিল পথে আহ্বান, ভয়াবহ গোমরাহি, স্পষ্ট গুনাহ ও জঘন্য জাহিলিয়াতের প্রতিফলন। এটি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।এই বিষয়ে আমি একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, যার নাম: ‘ইসলাম ও বাস্তবতার আলোকে আরব জাতীয়তাবাদের সমালোচনা’।(ফাতাওয়া ইবনে বায, খণ্ড ৪, পৃ. ১৭৩; বিস্তারিত আলোচনা: খণ্ড ১, পৃ. ২৮০-৩১৮ পর্যন্ত।
.
শাইখ (রহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন:
إن من أعظم الظلم ، وأسفه السفه , أن يقارن بين الإسلام وبين القومية العربية , وهل للقومية المجردة من الإسلام من المزايا ما تستحق به أن تجعل في صف الإسلام , وأن يقارن بينها وبينه ؟ لا شك أن هذا من أعظم الهضم للإسلام ، والتنكر لمبادئه ، وتعاليمه الرشيدة , وكيف يليق في عقل عاقل أن يقارن بين قومية لو كان أبو جهل , وعتبة بن ربيعة , وشيبة بن ربيعة وأضرابهم من أعداء الإسلام أحياء لكانوا هم صناديدها وأعظم دعاتها , وبين دين كريم صالح لكل زمان ومكان , دعاته وأنصاره هم : محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم ، وأبو بكر الصديق , وعمر ابن الخطاب , وعثمان بن عفان , وعلي بن أبي طالب , وغيرهم من الصحابة ، صناديد الإسلام ، وحماته الأبطال , ومن سلك سبيلهم من الأخيار؟ لا يستسيغ المقارنة بين قومية هذا شأنها , وهؤلاء رجالها ، وبين دين هذا شأنه ، وهؤلاء أنصاره ودعاته , إلا مصاب في عقله , أو مقلد أعمى , أو عدو لدود للإسلام ، ومن جاء به ، وما مثل هؤلاء في هذه المقارنة إلا مثل من قارن بين البعر والدر , أو بين الرسل والشياطين , ومن تأمل هذا المقام من ذوي البصائر , وسبر الحقائق والنتائج : ظهر له أن المقارنة بين القومية والإسلام : أخطر على الإسلام من المقارنة بين ما ذكر آنفا ، ثم كيف تصح المقارنة بين قومية غاية من مات عليها النار , وبين دين غاية من مات عليه الفوز بجوار الرب الكريم , في دار الكرامة والمقام الأمين ؟ .اللهم اهدنا وقومنا سواء السبيل , إنك على كل شيء قدير .
“নিঃসন্দেহে সর্বপ্রকার জুলুমের মধ্যে এটি অন্যতম বড় জুলুম এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের মূর্খতা হলো ইসলামকে আরব জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তুলনা করা। একবার ভাবুন, ইসলামবিহীন জাতীয়তাবাদের এমন কী গুণ আছে, যা তাকে ইসলামের সমকক্ষ করে তোলে? (ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ) এই দুইয়ের মধ্যে কি আদৌ কোনো তুলনার অবকাশ আছে? এটা নিঃসন্দেহে ইসলামের প্রতি চরম অবিচার এবং তার মহান নীতিমালা ও জ্ঞানপূর্ণ শিক্ষার প্রকাশ্য অস্বীকৃতি। কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষ কীভাবে জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের তুলনা করতে পারে? যখন আমরা দেখি, আবু জাহল, উতবা ও শায়বা ইবনু রাবি’আ এবং ইসলামবিরোধী এবং অন্যান্য কাফের ও ইসলামবিদ্বেষীরা যদি আজ বেঁচে থাকত, তবে তারাই হতো জাতীয়তাবাদের অগ্রগণ্য প্রচারক ও নেতৃত্বদানকারী। অপরদিকে, ইসলামের ধারক ও বাহক ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এবং তাঁর অনুগত সাহাবীগণ আবু বকর সিদ্দীক, উমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবনু আফফান, আলী ইবনু আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সকল সৎকর্মপরায়ণ মানুষ। তাহলে কীভাবে কোনো বিবেকবান ব্যক্তি এমন একটি মতাদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তুলনা করতে পারে এমন একটি দ্বীনের, যার অনুসারীরা হলেন আল্লাহর প্রদত্ত আলোয় পথ চলা নবী, সাহাবা ও মুত্তাকিগণ? যে ব্যক্তি এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা করে,সে হয় মস্তিষ্কবিকৃত,
অথবা অন্ধ অনুকরণকারী,অথবা ইসলামের দুশমন। এমন এক তুলনার উদাহরণ যা এমন, যেমন কেউ মুক্তার সঙ্গে কংকর তুলনা করে, অথবা নবীদের সঙ্গে শয়তানদের তুলনা করে।সুতরাং যে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, সে যদি চিন্তা করে ও সত্যের অনুসন্ধান করে, সে এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে পারবে—ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ কখনোই তুলনার উপযুক্ত নয়। এটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের মধ্যে তুলনা করা, পূর্বোক্ত তুলনার চেয়েও (মুক্তা ও কংকর, রাসূল ও শয়তান) ইসলামের জন্য আরও বিপজ্জনক।তারপর কিভাবে সঠিক হতে পারে এমন একটি তুলনা,যেখানে জাতীয়তাবাদের পরিণতি হলো: যে কেউ এই ধারণা নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, তার গন্তব্য জাহান্নাম।আর ইসলামের পরিণতি হলো: যে এতে মৃত্যু বরণ করে, সে পৌঁছে যায় মহান প্রতিপালকের সান্নিধ্যে, মর্যাদার ঘরে, নিরাপদ আবাসে বা স্থানে। হে আল্লাহ! আমাদের হিদায়াত দাও এবং আমাদেরকে সরল পথে প্রতিষ্ঠিত রাখো, নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশালী।”(ফাতাওয়ে শায়েখ বিন বার খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩২০-৩২১)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক প্রদত্ত ফাতওয়া দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী, যেখানে তিনি আরব জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামের মধ্যে তুলনা করার বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। দ্বিতীয় ফাতওয়া তিনি ঐ ব্যক্তির হুকুম বর্ণনা করেছেন,যে ব্যক্তি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের তুলনা করে। তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন এমন ব্যক্তি হয় বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী, অন্ধ অনুকরণকারী, অথবা ইসলামের কঠিন শত্রু। যে ব্যক্তি জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি জানে না, তার ক্ষেত্রে ওজরের সম্ভাবনা থাকতে পারে এবং সে হয়তো মাফযোগ্য ইনশাআল্লাহ। তবে যে ব্যক্তি ইসলামের প্রকৃতি জানে এবং তবুও বিশ্বাস করে যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম, ব্যবস্থা বা মতবাদ শ্রেষ্ঠতর তাহলে সে নিঃসন্দেহে কা-ফির, এতে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করছি তিনি যেন আমাদেরকে একমাত্র ইসলামী জীবন আদর্শকে আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বিচার, প্রশাসন, শিক্ষানীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন এবং বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করেন এবং সব ধরণের ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা, মানব রচিত মতবাদ ও মতাদর্শ থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহুম্মা আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◆◆▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি ।
Subscribe to:
Posts (Atom)