Wednesday, March 3, 2021

হযরত ইউসুফ আঃ এর জীবনী পার্ট -দুই

 



হযরত ইউসুফ (আ:) part 3কারাগারের জীবন :বালাখানা থেকে জেলখানায়নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর এক করুণ অভিজ্ঞতা শুরু হ’লইউসুফের জীবনে। মনোকষ্ট ও দৈহিক কষ্ট,সাথে সাথে স্নেহান্ধ ফুফু ও সন্তানহারা পাগলপরা বৃদ্ধপিতাকে কেন‘আনে ফেলে আসার মানসিক কষ্টসব মিলিয়ে ইউসুফেরজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।কেন‘আনে ভাইয়েরা শত্রু, মিসরে যুলায়খা শত্রু।নিরাপদ আশ্রয় কোথাও নেই। অতএবজেলখানাকেই আপাতত: জীবনসাথী করেনিলেন এবং নিজেকে আল্লাহর আশ্রয়ে সমর্পণকরে কয়েদী সাথীদের মধ্যে দ্বীনেরদাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। ইতিপূর্বেই বলাহয়েছে যে, ইউসুফকে আল্লাহ স্বপ্ন ব্যাখ্যাদানের বিশেষ জ্ঞান দানকরেছিলেন (ইউসুফ১২/৬)। দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে এবিষয়টিও তাঁর জন্য সহায়ক প্রমাণিত হয়।জেলখানারসাথীদের নিকটে ইউসুফের দাওয়াত :ইউসুফকারাগারে পৌঁছলে সাথে আরওদু’জন অভিযুক্ত যুবককারাগারে প্রবেশ করে। তাদের একজন বাদশাহকেমদ্য পান করাতো এবং অপরজন বাদশাহর বাবুর্চি ছিল।ইবনু কাছীর তাফসীরবিদগণের বরাত দিয়েলেখেন যে, তারা উভয়েই বাদশাহর খাদ্যে বিষমিশানোর দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে আসে।তখনও মামলার তদন্ত চলছিল এবং চূড়ান্ত রায় বাকীছিল। তারা জেলে এসে ইউসুফের সততা, বিশ্বস্ততা,ইবাদতগুযারী ও স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের ক্ষমতাসম্পর্কে জানতে পারে। তখন তারা তাঁর নৈকট্যলাভে সচেষ্ট হয় এবং তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণতহয়।বন্ধুত্বের এই সুযোগকে ইউসুফতাওহীদের দাওয়াতে কাজে লাগান। তাতেপ্রতীতি জন্মে যে, সম্ভবতঃ কারাগারেইই্উসুফকে ‘নবুঅত’ দান করা হয়। ইউসুফের কারাসঙ্গীদ্বয় এবং তাদের নিকটে প্রদত্ত দাওয়াতেরবিবরণ আল্লাহ দিয়েছেন নিম্নোক্তভাবে: ﻭَﺩَﺧَﻞَﻣَﻌَﻪُ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦَ ﻓَﺘَﻴَﺎﻥَ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺣَﺪُﻫُﻤَﺎﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﺍﻧِﻲ ﺃَﻋْﺼِﺮُ ﺧَﻤْﺮﺍًﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻵﺧَﺮُ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﺍﻧِﻲ ﺃَﺣْﻤِﻞُ ﻓَﻮْﻕَ ﺭَﺃْﺳِﻲْ ﺧُﺒْﺰﺍً ﺗَﺄْﻛُﻞُﺍﻟﻄَّﻴْﺮُ ﻣِﻨْﻪُ ﻧَﺒِّﺌْﻨَﺎ ﺑِﺘَﺄْﻭْﻳﻠِﻪِ ﺇِﻧَّﺎ ﻧَﺮَﺍﻛَﻤِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ- ﻗَﺎﻝَ ﻻَﻳَﺄْﺗِﻴﻜُﻤَﺎ ﻃَﻌَﺎﻡٌ ﺗُﺮْﺯَﻗَﺎﻧِﻪِ ﺇِﻻَّ ﻧَﺒَّﺄْﺗُﻜُﻤَﺎ ﺑِﺘَﺄْﻭِﻳﻠِﻪِ ﻗَﺒْﻞَ ﺃَﻥ ﻳَﺄْﺗِﻴﻜُﻤَﺎﺫَﻟِﻜُﻤَﺎ ﻣِﻤَّﺎ ﻋَﻠَّﻤَﻨِﻲ ﺭَﺑِّﻲ ﺇِﻧِّﻲ ﺗَﺮَﻛْﺖُ ﻣِﻠَّﺔَ ﻗَﻮْﻡٍ ﻻَّ ﻳُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻭَﻫُﻢ ﺑِﺎﻵﺧِﺮَﺓِ ﻫُﻢْ ﻛَﺎﻓِﺮُﻭﻥَ – ﻭَﺍﺗَّﺒَﻌْﺖُ ﻣِﻠَّﺔَ ﺁﺑَﺂﺋِـﻲﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﻭَﺇِﺳْﺤَﺎﻕَ ﻭَﻳَﻌْﻘُﻮﺏَ ﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻟَﻨَﺎ ﺃَﻥ ﻧُّﺸْﺮِﻙَ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻣِﻦﺷَﻲْﺀٍ ﺫَﻟِﻚَ ﻣِﻦ ﻓَﻀْﻞِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﺸْﻜُﺮُﻭﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩৬-৩৮)-‘ইউসুফের সাথেকারাগারে দু’জন যুবক প্রবেশ করল। তাদের একজনবলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি মদ নিঙড়াচ্ছি।অপরজন বলল, আমি দেখলাম যে, আমি মাথায় করেরুটি বহন করছি। আর তা থেকে পাখি খেয়েনিচ্ছে।আমাদেরকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিন।কেননা আমরা আপনাকে সৎকর্মশীলগণেরঅন্তর্ভুক্ত দেখতে পাচ্ছি’ (৩৬)।‘ইউসুফ বলল,তোমাদেরকে প্রত্যহ যে খাদ্য দান করা হয়, তাতোমাদের কাছে আসার আগেই আমি তার ব্যাখ্যাবলে দিতে পারি। এ জ্ঞান আমার পালনকর্তা আমাকেদানকরেছেন। আমি ঐসব লোকদের ধর্ম ত্যাগকরেছি, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে নাএবং আখেরাতকে অস্বীকার করে’(৩৭)। ‘আমিআমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূবের ধর্মঅনুসরণ করি। আমাদের জন্য শোভা পায় না যে,কোন বস্ত্তকে আল্লাহর অংশীদার করি। এটাআমাদের প্রতি এবং অন্য সব লোকদের প্রতিআল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কিন্তু অধিকাংশ লোককৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না’ (ইউসুফ১২/৩৬-৩৮)।অতঃপর তিনি সাথীদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াতদিয়ে বলেন, ﻳَﺎ ﺻَﺎﺣِﺒَﻲِ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺃَﺃَﺭْﺑَﺎﺏٌ ﻣُّﺘَﻔَﺮِّﻗُﻮْﻥَ ﺧَﻴْﺮٌﺃَﻡِ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟْﻮَﺍﺣِﺪُ ﺍﻟْﻘَﻬَّﺎﺭُ- ﻣَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ ﻣِﻦْ ﺩُﻭْﻧِﻪِ ﺇِﻻَّ ﺃَﺳْﻤَﺎﺀٌﺳَﻤَّﻴْﺘُﻤُﻮْﻫَﺎ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﻭَﺁﺑَﺂﺅُﻛُﻢْ ﻣَّﺎ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠﻪ ُﺑِﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺳُﻠْﻄَﺎﻥٍ، ﺇِﻥِﺍﻟْﺤُﻜْﻢُ ﺇِﻻَّ ِﻟﻠﻪِ ﺃَﻣَﺮَ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﺍْ ﺇِﻻَّ ﺇِﻳَّﺎﻩُ ﺫَﻟِﻚَ ﺍﻟﺪِّﻳْﻦُ ﺍﻟْﻘَﻴِّﻢُﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩৯-৪০)-‘হেকারাগারের সাথীদ্বয়! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্যভাল, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ’? ‘তোমরাআল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের পূজাকরে থাক। যেগুলো তোমরা এবং তোমাদেরবাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছ। এদের পক্ষেআল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহব্যতীত কারু বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশদিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত তোমরা অন্য কারুইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশলোক তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৩৯-৪০)। এভাবেতাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার পর তিনি স্বীয়কারাসাথীদ্বয়ের প্রশ্নের জওয়াব দিতে শুরুকরলেন।- ﻳَﺎ ﺻَﺎﺣِﺒَﻲِ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺃَﻣَّﺎ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻤَﺎ ﻓَﻴَﺴْﻘِﻲ ﺭَﺑَّﻪُﺧَﻤْﺮﺍً ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﺍﻵﺧَﺮُ ﻓَﻴُﺼْﻠَﺐُ ﻓَﺘَﺄْﻛُﻞُ ﺍﻟﻄَّﻴْﺮُ ﻣِﻦ ﺭَّﺃْﺳِﻪِ ﻗُﻀِﻲَﺍﻷَﻣْﺮُ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻓِﻴﻪِ ﺗَﺴْﺘَﻔْﺘِﻴَﺎﻥِ- ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻟِﻠَّﺬِﻱ ﻇَﻦَّ ﺃَﻧَّﻪُ ﻧَﺎﺝٍ ﻣِّﻨْﻬُﻤَﺎﺍﺫْﻛُﺮْﻧِﻲ ﻋِﻨﺪَ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺄَﻧﺴَﺎﻩُ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥُ ﺫِﻛْﺮَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻓَﻠَﺒِﺚَ ﻓِﻲﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺑِﻀْﻊَ ﺳِﻨِﻴﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৪১-৪২)-‘হে কারাগারেরসাথীদ্বয়! তোমাদের একজন তার মনিবকেমদ্যপান করাবে এবং দ্বিতীয়জন, তাকে শূলেচড়ানো হবে। অতঃপর তার মস্তক থেকে পাখি(ঘিলু) খেয়ে নিবে। তোমরা যে বিষয়ে জানতেআগ্রহী, তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে’। ‘অতঃপর যেব্যক্তি সম্পর্কে (স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী) ধারণাছিল যে, সে মুক্তি পাবে, তাকে ইউসুফ বলেদিলযে, তুমি তোমার মনিবের কাছে (অর্থাৎ বাদশাহরকাছে) আমার বিষয়ে আলোচনা করবে (যাতেআমাকে মুক্তি দেয়)। কিন্তু শয়তান তাকে তারমনিবের কাছে বলার বিষয়টি ভুলিয়ে দেয়। ফলেতাকেকয়েক বছর কারাগারে থাকতে হ’ল’ (ইউসুফ১২/৪১-৪২)।ইউসুফের দাওয়াতে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:(১) দাওয়াত দেওয়ার সময় নিজের পরিচয়স্পষ্টভাবে তুলে ধরা আবশ্যক। যাতে শ্রোতারমনে কোনরূপ দ্বৈত চিন্তা ঘর না করে। ইউসুফ তাঁরদাওয়াতের শুরুতেই বলে দিয়েছেন যে, আমিঐসব লোকের ধর্ম পরিত্যাগ করেছি, যারা আল্লাহরপ্রতি বিশ্বাস পোষণ করেনা এবং আখেরাতেজবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না’ (ইউসুফ ১২/৩৭)।(২)দাওয়াত দেওয়ার সময় নিজের অভিজাত বংশের পরিচয়তুলে ধরা মোটেই অসমীচীন নয়। এতেশ্রোতারমনে দাওয়াতের প্রভাব দ্রুত বিস্তার লাভকরে। ইউসুফ (আঃ) সেকারণ নিজের নবী বংশেরপরিচয় শুরুতেই তুলে ধরেছেন’ (ইউসুফ ১২/৩৮)।(৩) শ্রোতার সম্মুখে অনেক সময় নিজেরকোন বাস্তব কৃতিত্ব তুলে ধরাও আবশ্যক হয়।যেমন ইউসুফ (আঃ) স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ারআগে নিজের আরেকটি মু‘জেযার কথা বর্ণনাকরেন যে, কয়েদীদের খানা আসার আগেইআমি তার প্রকার, গুণাগুণ, পরিমাণ ও আসার সঠিক সময়বলে দিতে পারি (ইউসুফ ১২/৩৭)।(৪) নিজেকেকোনরূপ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী কিংবাভবিষ্যদ্বক্তা বলে পেশ করা যাবেনা। সেকারণইউসুফ সাথে সাথে বলে দিয়েছিলেন যে, ‘এজ্ঞান আমার পালনকর্তা আমাকে দানকরেছেন’ (ইউসুফ ১২/৩৭)।(৫) প্রশ্নের জওয়াবদানের পূর্বে প্রশ্নকারীর মন-মানসিকতাকেআল্লাহমুখী করে নেওয়া আবশ্যক। সেকারণইউসুফ তাঁর মুশরিক কারাসঙ্গীদের জওয়াব দানেরপূর্বে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন(১২/৩৯)।(৬) প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শ্রোতারমস্তিষ্ক যাচাই করে দাওয়াত দেওয়া একটি উত্তমপদ্ধতি। সেজন্য ইউসুফ (আঃ) তাঁর কারা সঙ্গীদেরজিজ্ঞেস করলেন, ‘পৃথক পৃথক অনেক উপাস্যভাল, না পরাক্রমশালী একক উপাস্য ভাল’? (ইউসুফ১২/৩৯)।(৭) শিরকের অসারতা হাতেনাতে ধরিয়েদিয়ে মুশরিককে প্রথমেই লা-জওয়াব করে দেওয়াআবশ্যক। সেকারণ ইউসুফ (আঃ) বললেন, তোমরাআল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কিছু নামের পূজা করমাত্র। এদের পূজা করার জন্য আল্লাহ কোনআদেশ প্রেরণ করেননি’ (ইউসুফ ১২/৪০)।(৮)তাওহীদের মূল কথা সংক্ষেপে বা এক কথায় পেশকরা আবশ্যক, যাতে শ্রোতার মগয সহজে সেটাধারণ করতে পারে। সেজন্য ইউসুফ (আঃ)সোজাসুজি এক কথায় বলে দিলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কারুকোন বিধান নেই… এবং এটাই সরল পথ’ (ইউসুফ১২/৪০)।(৯) বিপদ হ’তে মুক্তি কামনা করা ও সেজন্যচেষ্টা করা আল্লাহর উপরেতাওয়াক্কুলেরপরিপন্থী নয়। সেজন্য ইউসুফ (আঃ) কারাগারথেকে মুক্তি চেয়েছেন এবং নিরপরাধ হওয়াসত্ত্বেও তাঁকে যে কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে, সে বিষয়টি বাদশাহর কাছেতুলে ধরার জন্য মুক্তিকামীকারা সাথীকে বলেদিলেন (ইউসুফ ১২/৪২)।(১০) বান্দা চেষ্টা করারমালিক। কিন্তু অবশেষে তাক্বদীর জয়লাভ করে।সেকারণ ইউসুফের মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদী বন্ধুবাদশাহর কাছে তার কথা বলতে ভুলে গেল এবংকয়েক বছর তাকে কয়েদখানায় থাকতে হ’ল।কুরআনে ﺑﻀﻊ ﺳﻨﻴﻦ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে(ইউসুফ ১২/৪২)। যা দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্তসংখ্যা বুঝানো হয়। অধিকাংশ তাফসীরবিদগণ তাঁরকারাজীবনের মেয়াদ সাত বছর বলেছেন।এভাবে অবশেষে তাক্বদীর বিজয়ী হ’ল। কারণআল্লাহর মঙ্গল ইচ্ছা বান্দা বুঝতে পারেনা।বাদশাহরস্বপ্ন ও কারাগার থেকে ইউসুফের ব্যাখ্যাদান:মিসরের বাদশাহ একটি স্বপ্ন দেখলেন এবং এটিইছিল আল্লাহর পক্ষ হ’তে ইউসুফের কারামুক্তিরঅসীলা। অতঃপর বাদশাহ তার সভাসদগণকে ডেকেস্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কেউজবাব দিতে পারল না। অবশেষে তারা বাদশাহকেসান্ত্বনা দেবার জন্য বলল, এগুলি ‘কল্পনা প্রসূতস্বপ্ন’ ( ﺃﺿﻐﺎﺙ ﺃﺣﻼﻡ ) মাত্র। এগুলির কোন বাস্তবতানেই। কিন্তু বাদশাহ তাতে স্বস্তি পাননা। এমন সময়কারামুক্ত সেই খাদেম বাদশাহর কাছে তার কারাসঙ্গীও বন্ধু ইউসুফের কথা বলল। তখন বাদশাহ ইউসুফেরকাছে স্বপ্ন ব্যাখ্যা জানার জন্য উক্ত খাদেমকেকারাগারে পাঠালেন। সে স্বপ্নব্যাখ্যা শুনে এসেবাদশাহকে সব বৃত্তান্তবলল। উক্ত বিষয়ে কুরআনীবর্ণনানিম্নরূপ: ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚُ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﻯ ﺳَﺒْﻊَ ﺑَﻘَﺮَﺍﺕٍ ﺳِﻤَﺎﻥٍﻳَﺄْﻛُﻠُﻬُﻦَّ ﺳَﺒْﻊٌ ﻋِﺠَﺎﻑٌ ﻭَﺳَﺒْﻊَ ﺳُﻨْﺒُﻼَﺕٍ ﺧُﻀْﺮٍ ﻭَﺃُﺧَﺮَ ﻳَﺎﺑِﺴَﺎﺕٍ،ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎﺍﻟْﻤَﻸُ ﺃَﻓْﺘُﻮْﻧِﻲْ ﻓِﻲ ﺭُﺅْﻳَﺎﻱَ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻤْﻠِﻠﺮُّﺅْﻳَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺮُﻭﻥَ-ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺃَﺿْﻐَﺎﺙُ ﺃَﺣْﻼَﻡٍ ﻭَﻣَﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﺑِﺘَﺄْﻭِﻳﻞِ ﺍﻷَﺣْﻼَﻡِ ﺑِﻌَﺎﻟِﻤِﻴْﻦَ-‏( ﻳﻮﺳﻒ ৪৩-৪৪)-‘বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নেদেখলাম,সাতটি মোটা-তাজা গাভী, এদেরকে সাতটিশীর্ণ গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজশিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। হে সভাসদবর্গ! তোমরাআমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দাও, যদিতোমরা স্বপ্ন ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাক’।‘তারাবলল, এটি কল্পনা প্রসূত স্বপ্ন মাত্র। এরূপ স্বপ্নেরব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই’ (ইউসুফ ১২/৪৩-৪৪)।‘তখনদু’জন কারাবন্দীর মধ্যে যে ব্যক্তি মুক্তিপেয়েছিল, দীর্ঘকাল পরে তার (ইউসুফের কথা)স্মরণ হ’ল এবং বলল, আমি আপনাদেরকেএস্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব, আপনারা আমাকে(জেলখানায়) পাঠিয়ে দিন’। ‘অতঃপর সে জেলখানায়পৌঁছে বলল, ইউসুফ হে আমার সত্যবাদী বন্ধু!(বাদশাহ স্বপ্ন দেখেছেন যে,) সাতটি মোটাতাজাগাভী, তাদেরকে খেয়ে ফেলছে সাতটি শীর্ণগাভী এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলি শুষ্ক। আপনিআমাদেরকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিন, যাতেআমি তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তা জানাতেপারি’ (ইউসুফ ১২/৪৫-৪৬)। জবাবে ইউসুফ বলল,ﻗَﺎﻝَﺗَﺰْﺭَﻋُﻮﻥَ ﺳَﺒْﻊَ ﺳِﻨِﻴْﻦَ ﺩَﺃَﺑﺎً ﻓَﻤَﺎ ﺣَﺼَﺪﺗُّﻢْ ﻓَﺬَﺭُﻭﻩُ ﻓِﻲ ﺳُﻨْﺒُﻠِﻪِﺇِﻻَّ ﻗَﻠِﻴﻼً ﻣِّﻤَّﺎ ﺗَﺄْﻛُﻠُﻮﻥَ- ﺛُﻢَّ ﻳَﺄْﺗِﻲ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﺫَﻟِﻚَ ﺳَﺒْﻊٌ ﺷِﺪَﺍﺩٌﻳَﺄْﻛُﻠْﻦَ ﻣَﺎ ﻗَﺪَّﻣْﺘُﻢْ ﻟَﻬُﻦَّ ﺇِﻻَّ ﻗَﻠِﻴﻼً ﻣِّﻤَّﺎ ﺗُﺤْﺼِﻨُﻮﻥَ- ﺛُﻢَّ ﻳَﺄْﺗِﻲْﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﺫَﻟِﻚَ ﻋَﺎﻡٌ ﻓِﻴﻪِ ﻳُﻐَﺎﺙُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﻭَﻓِﻴﻪِ ﻳَﻌْﺼِﺮُﻭﻥَ-‏( ﻳﻮﺳﻒ ৪৭-৪৯)-‘তোমরা সাত বছর উত্তমরূপেচাষাবাদ করবে। অতঃপর যখন ফসল কাটবে, তখনখোরাকি বাদে বাকী ফসলশিষ সমেত রেখেদিবে’ (৪৭)। ‘এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর।তখন তোমরা খাবে ইতিপূর্বে যা রেখেদিয়েছিলে, তবে কিছু পরিমাণ ব্যতীত যা তোমরা(বীজ বা সঞ্চয় হিসাবে) তুলে রাখবে’ (৪৮)।‘এরপরে আসবে এক বছর, যাতে লোকদেরউপরে বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং তখন তারা (আঙ্গুরের)রস নিঙড়াবে (অর্থাৎ উদ্বৃত্ত ফসল হবে)’ (ইউসুফ১২/৪৭-৪৯)।ঐ খাদেমটি ফিরে এসে স্বপ্ন ব্যাখ্যাবর্ণনা করলে বাদশাহ তাকে বললেন, ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚُﺍﺋْﺘُﻮﻧِﻲْ ﺑِﻪِ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﺎﺀَﻩُ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺭْﺟِﻊْ ﺇِﻟَﻰ ﺭَﺑِّﻚَﻓَﺎﺳْﺄَﻟْﻪُ ﻣَﺎ ﺑَﺎﻝُ ﺍﻟﻨِّﺴْﻮَﺓِ ﺍﻟﻼَّﺗِﻲ ﻗَﻄَّﻌْﻦَ ﺃَﻳْﺪِﻳَﻬُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲﺑِﻜَﻴْﺪِﻫِﻦَّ ﻋَﻠِﻴﻢٌ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫০)-‘তুমি পুনরায় কারাগারে ফিরেযাও এবং তাকে (অর্থাৎ ইউসুফকে) আমার কাছেনিয়ে এস। অতঃপর যখন বাদশাহর দূত তার কাছেপৌঁছলো, তখন ইউসুফ তাকে বলল, তুমি তোমারমনিবের (অর্থাৎ বাদশাহর) কাছে ফিরে যাও এবংতাঁকে জিজ্ঞেস কর যে, নগরীর সেইমহিলাদের খবর কি? যারা নিজেদের হাত কেটেফেলেছিল।আমার পালনকর্তা তো তাদের ছলনাসবই জানেন’ (ইউসুফ ১২/৫০)।বাদশাহর দূতকেফেরৎ দানের শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ:(১) দীর্ঘকারাভোগের দুঃসহ যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে ইউসুফ(আঃ) নিশ্চয়ই মুক্তির জন্য উন্মুখ ছিলেন। কিন্তুবাদশাহর পক্ষ থেকে মুক্তির নির্দেশ পাওয়াসত্ত্বেও তিনি দূতকে ফেরত দিলেন। এর কারণএই যে, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ কারামুক্তিরচাইতে তার উপরে আপতিত অপবাদ মুক্তিকে অধিকগুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ইউসুফ (আঃ)সেকারণেই ঘটনারমূলে যারা ছিল, তাদের অবস্থা জানতেচেয়েছিলেন।(২) তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, জেলথেকে বের হওয়ার আগেই বাদশাহ বা গৃহস্বামী‘আযীযে মিছর’ তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ মুক্ত কি-নাসেটা জেনে নেওয়া এবং ঐ মহিলাদের মুখ দিয়েতার নির্দোষিতার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়া।(৩) ইউসুফ তারবক্তব্যে ‘মহিলাদের’ কথা বলেছেন। আযীয-পত্নী যুলায়খার কথা নির্দিষ্টভাবে বলেননি। অথচসেই-ই ছিল ঘটনার মূল। এটার কারণ ছিল এই যে, (ক)ঐ মহিলাগণ সবাই যুলায়খার কু-প্রস্তাবের সমর্থকহওয়ায় তারা সবাই একই পর্যায়ে চলে এসেছিল (খ)তাছাড়াআরেকটি কারণ ছিল- সৌজন্যবোধ। কেননানির্দিষ্টভাবে তার নাম নিলে আযীযের মর্যাদায়আঘাত আসত। এতদ্ব্যতীত আযীয ছিলেনইউসুফের আশ্রয়দাতা ও লালন-পালনকারী। তার প্রতিকৃতজ্ঞতাবোধের আধিক্য ইউসুফকে আযীয-পত্নীর নাম নিতে দ্বিধান্বিত করেছে। ইউসুফ(আঃ)-এর এবম্বিধ উন্নত আচরণের মধ্যেযেকোন মর্যাদাবান ব্যক্তির জন্য শিক্ষণীয় বিষয়লুকিয়ে রয়েছে।(৪) ইউসুফ চেয়েছিলেন এসত্য প্রমাণ করে দিতে যে, প্রত্যেক মানুষেরমধ্যে মন্দপ্রবণতা থাকলেও তা নেককার মানুষকেপথভ্রষ্ট করতে পারে না আল্লাহর বিশেষঅনুগ্রহের কারণে। যদি আমিসেই অনুগ্রহ নাপেতাম, তাহ’লে হয়ত আমিও পথভ্রষ্ট হয়েযেতাম।অতএব আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁরঅনুগ্রহ লাভে সদা সচেষ্ট থাকাই বান্দার সর্বাপেক্ষাবড় কর্তব্য। বস্ত্ততঃ এইরূপ পবিত্র হৃদয়কেকুরআনে ‘নফসে মুত্বমাইন্নাহ’ বা প্রশান্ত হৃদয় বলাহয়েছে (ফাজর ৮৯/২৭)। যা অর্জন করারজন্যসকলকেই সচেষ্ট হওয়া উচিত। নবীগণ সবাইছিলেন উক্ত প্রশান্তহৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহরবিশেষ অনুগ্রহে ইউসুফ (আঃ)ও অনুরূপ পবিত্রহৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেনবাদশাহও তাঁর পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হৌন।(৫)পবিত্রতার অহংকারঃ বাদশাহর দূতকে ফিরিয়ে দেবারমধ্যে ইউসুফের হৃদয়ে পবিত্রতার যে অহংকারজন্মেছিল, তা প্রত্যেক নির্দোষ মানুষেরমধ্যে থাকা উচিত। ইউসুফের এই সাহসী আচরণেঅভিভূত হয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন, ﺇﻥَّﺍﻟﻜﺮﻳﻢَ ﺍﺑﻦَ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺍﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ : ﻳﻮﺳﻒُ ﺑﻦُﻳﻌﻘﻮﺏَ ﺑﻨِﺎﺳﺤﺎﻕَ ﺑﻦِ ﺇﺑﺮﺍﻫﻴﻢَ، ﻭَﻟَﻮ ﻟﺒِﺜْﺖُ ﻓﻰ ﺍﻟﺴﺠﻦﻣﺎﻟﺒﺚَ ﺛﻢ ﺟﺎﺀﻧﻰ ﺍﻟﺮﺳﻮﻝُ ﻷَﺟَﺒْﺖُ ﺛﻢ ﻗﺮﺃ ‏(ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﺎﺀَﻩُﺍﻟﺮَّﺳُﻮْﻝُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺭْﺟِﻊْ ﺇِﻟَﻰ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺎﺳْﺄَﻟْﻪُ ﻣَﺎ ﺑَﺎﻝُ ﺍﻟﻨِّﺴْﻮَﺓِ ﺍﻟﻼَّﺗِﻲﻗَﻄَّﻌْﻦَ ﺃَﻳْﺪِﻳَﻬُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲ ﺑِﻜَﻴْﺪِﻫِﻦَّ ﻋَﻠِﻴﻢٌ ‏) ، ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯﺑﺴﻨﺪ ﺣﺴﻦ -‘নিশ্চয়ই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির পুত্র সম্ভ্রান্ত,তার পুত্র সম্ভ্রান্ত, তার পুত্র সম্ভ্রান্ত- (তাঁরা হ’লেন)ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক্ব, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁরপুত্র ইউসুফ। যদি আমি অতদিন কারাগারে থাকতাম, যতদিনতিনি ছিলেন, তাহ’লেবাদশাহর দূত প্রথমবার আসারসাথে সাথে আমি তার প্রস্তাব কবুল করতাম’। এ কথাবলার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা ইউসুফ ৫০আয়াতটি পাঠকরেন’।[22]বাদশাহর দরবারে ইউসুফ (আঃ):কারাগারথেকে পাঠানো ইউসুফের দাবী অনুযায়ীমহিলাদের কাছে বাদশাহ ঘটনার তদন্ত করলেন।আল্লাহ বলেন, বাদশাহ মহিলাদের ডেকে বলল, ﻗَﺎﻝَﻣَﺎ ﺧَﻄْﺒُﻜُﻦَّ ﺇِﺫْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻦَّ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ‘তোমাদেরখবর কি যখন তোমরা ইউসুফকে কুকর্মেফুসলিয়েছিলে? তারা বলল, ﺣَﺎﺵَ ِﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻋَﻠِﻤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻣِﻦْﺳُﻮْﺀٍ ‘আল্লাহ পবিত্র। আমরা তাঁর (ইউসুফ) সম্পর্কেমন্দ কিছুই জানি না’। আযীয-পত্নী বলল, ﺍﻵﻥَﺣَﺼْﺤَﺺَ ﺍﻟْﺤَﻖُّ ﺃَﻧَﺎ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦْ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻤِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ‘এখন সত্য প্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলামএবং সে ছিল সত্যবাদী’ (ইউসুফ ১২/৫১)। ইতিপূর্বেএকবার শহরের মহিলাদের সম্মুখে যুলায়খা উক্তস্বীকৃতি দিয়ে বলেছিল, ﻟَﻘَﺪْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِﻓَﺎﺳَﺘَﻌْﺼَﻢَ ‘আমি তাকে ফুসলিয়েছিলাম। কিন্তু সেনিজেকে সংযত রেখেছিল’ (ইউসুফ ১২/৩২)।অতঃপরআযীয-পত্নী বলল, ﺫَﻟِﻚَ ﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺃَﻧِّﻲ ﻟَﻢْ ﺃَﺧُﻨْﻪُ ﺑِﺎﻟْﻐَﻴْﺐِﻭَﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻻَ ﻳَﻬْﺪِﻱ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟْﺨَﺎﺋِﻨِﻴْﻦَ ‘এটা (অর্থাৎ এইস্বীকৃতিটা) এজন্যে যেন গৃহস্বামী জানতেপারেন যে, তার অগোচরে আমি তার প্রতিবিশ্বাসঘাতকতা করিনি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদেরষড়যন্ত্র সফল করেন না’ (৫২)। ‘আর আমিনিজেকে নির্দোষ মনে করি না। নিশ্চয়ই মানুষেরমন মন্দপ্রবণ। কেবল ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার প্রতি আমারপ্রভু দয়া করেন। নিশ্চয়ই আমারপ্রতিপালক ক্ষমাশীলও দয়াবান’ (৫৩)।এভাবে আযীয-পত্নী ও নগরীরমহিলারা যখন বাস্তব ঘটনা স্বীকার করল, তখন বাদশাহনির্দেশ দিলেন, ইউসুফকে আমার কাছে নিয়েএস। কুরআনের ভাষায়- ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚُ ﺍﺋْﺘُﻮْﻧِﻲْ ﺑِﻪِﺃَﺳْﺘَﺨْﻠِﺼْﻪُ ﻟِﻨَﻔْﺴِﻲْ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﻛَﻠَّﻤَﻪُ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧَّﻚَ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻟَﺪَﻳْﻨَﺎ ﻣِﻜِﻴْﻦٌﺃَﻣِﻴْﻦٌ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৪)-‘বাদশাহ বলল, তাকে তোমরা আমার কাছে নিয়েএসো। আমি তাকে আমার নিজের জন্য একান্তসহচর করে নেব। অতঃপর যখন বাদশাহ ইউসুফেরসাথে মতবিনিময় করলেন, তখন তিনি তাকে বললেন,নিশ্চয়ই আপনি আজ থেকে আমাদের নিকট বিশ্বস্তও মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অধিকারী’ (ইউসুফ ১২/৫৪)।ইউসুফের অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ এবং সাথে সাথেবাদশাহীর ক্ষমতা লাভ:কারাগার থেকে মুক্ত হয়েফিরে এসে বাদশাহর সাথে কথোপকথনের একপর্যায়ে বাদশাহ যখন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় দক্ষ ওবিশ্বস্ত লোককোথায় পাবেন বলে নিজেরঅসহায়ত্ব প্রকাশ করছিলেন, তখন ইউসুফ (আঃ)নিজেকে এজন্য পেশ করেন। যেমন আল্লাহরভাষায়- ﻗَﺎﻝَ ﺍﺟْﻌَﻠْﻨِﻲْ ﻋَﻠَﻰ ﺧَﺰَﺁﺋِﻦِ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺣَﻔِﻴْﻆٌ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ -‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৫)-‘ইউসুফ বলল, আপনি আমাকে দেশেরধন-ভান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। আমিবিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ বিষয়ে) বিজ্ঞ’ (ইউসুফ১২/৫৫)।তাঁর এই পদ প্রার্থনা ও নিজের যোগ্যতানিজ মুখে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিজেরশ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকার প্রকাশের জন্য ছিল না। বরংকুফরী হুকূমতের অবিশ্বস্ত ওঅনভিজ্ঞ মন্ত্রীও আমলাদের হাত থেকে আসন্ন দুর্ভিক্ষ পীড়িতসাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য ও তাদের প্রতিদয়ার্দ্র চিত্ততার কারণে ছিল। ইবনু কাছীরবলেন,এর মধ্যে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার দলীলরয়েছে ঐ ব্যক্তিরজন্য, যিনি কোন বিষয়েনিজেকে আমানতদার ও যোগ্য বলে নিশ্চিতভাবেমনে করেন’।[23] কুরতুবী বলেন, যখন কেউনিশ্চিতভাবে মনে করবেন যে, এ ব্যাপারে তিনিব্যতীত যোগ্য আর কেউ নেই, তখন তাকে ঐপদ বা দায়িত্ব চেয়ে নেওয়া ওয়াজিব হবে।পক্ষান্তরে যদি অন্য কেউ যোগ্য থাকে, তবেচেয়ে নেওয়া যাবে না। মিসরে ঐ সময় ইউসুফেরচাইতে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় যোগ্য ও আমানতদারকেউ ছিল না বিধায় ইউসুফ উক্ত দায়িত্ব চেয়ে নিয়েছিলেন’।[24] আত্মস্বার্থ হাছিল বা পাপকাজে সাহায্যকরা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।আহলে কিতাবগণের বর্ণনামতে এই সময় বাদশাহ তাঁকে কেবল খাদ্য মন্ত্রণালয়নয়, বরং পুরা মিসরের শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন এবংবলেন, আমি আপনার চাইতে বড় নই, কেবল সিংহাসনব্যতীত’। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে এ সময়বাদশাহ তাঁর হাতে মুসলমান হন। একথাও বলা হয়েছেযে, এই সময় ‘আযীযে মিছর’ ক্বিৎফীর মারা যান।ফলে ইউসুফকে উক্ত পদে বসানো হয় এবং তারবিধবা স্ত্রী যুলায়খাকে বাদশাহ ইউসুফের সাথে বিবাহদেন।[25] জ্ঞান ও যুক্তি একথা মেনে নিলেওকুরআন এ বিষয়ে কিছু বলেনি। যেমন রাণীবিলক্বীসের মুসলমান হওয়া সম্পর্কে কুরআনস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে (নমল ২৭/৪৪)।যেহেতু কুরআন ও হাদীছ এ বিষয়ে কিছু বলেনি,অতএব আমাদের চুপ থাকা উত্তম। আর আহলেকিতাবগণের বর্ণনা বিষয়ে রাসূলের দেওয়ামূলনীতি অনুসরণ করা উচিত যে, তাওরাত ও ইনজীলবিষয়ে আমরা তাদের কথা সত্যও বলব না, মিথ্যাওবলবনা বরং আমাদের নিকটে শেষনবীর মাধ্যমে যেবিধান এসেছে, কেবল তারই অনুসরণ করব।।[26]নবী হিসাবে সুলায়মান (আঃ)-এর যেমনউদ্দেশ্য ছিল বিলক্বীসের মুসলমান হওয়া ও তাররাজ্য থেকে শিরক উৎখাত হওয়া। অনুরূপভাবে নবীহিসাবে ইউসুফ (আঃ)-এরও উদ্দেশ্য থাকতে পারেবাদশাহর মুসলমান হওয়া এবং মিসর থেকে শিরক উৎখাতহওয়া ও সর্বত্র আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বাদশাহযখন তার ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন এবং নিজেরবাদশাহী তাকে সোপর্দ করেছিলেন, তখন ধরেনেওয়া যায় যে, তিনি শিরকী ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগকরেতাওহীদের অনুসারী হয়েছিলেন এবংইউসুফকে নবী হিসাবে স্বীকারকরে তাঁরশরী‘আতের অনুসারী হয়ে বাকী জীবনকাটিয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।এভাবেআল্লাহর ইচ্ছায় ইউসুফ (আঃ) মিসরের সর্বোচ্চপদে সসম্মানে বরিত হ’লেন এবং অন্ধকূপেহারিয়ে যাওয়া ইউসুফ পুনরায় দীপ্ত সূর্যের ন্যায়পৃথিবীতে বিকশিত হয়ে উঠলেন। আল্লাহবলেন, ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻣَﻜَّﻨَّﺎ ﻟِﻴُﻮﺳُﻒَ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻳَﺘَﺒَﻮَّﺃُ ﻣِﻨْﻬَﺎﺣَﻴْﺚُ ﻳَﺸَﺂﺀُ ﻧُﺼِﻴْﺐُ ﺑِﺮَﺣْﻤَﺘِﻨَﺎ ﻣَﻦْ ﻧَﺸَﺂﺀُ ﻭَﻻَ ﻧُﻀِﻴﻊُ ﺃَﺟْﺮَﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৬)-‘এমনিভাবে আমরা ইউসুফকেসেদেশে প্রতিষ্ঠা দান করি। সে তথায় যেখানেইচ্ছা স্থান করে নিতে পারত। আমরা আমাদের রহমতযাকে ইচ্ছা তাকে পৌঁছে দিয়ে থাকি এবং আমরাসৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করি না’ (ইউসুফ১২/৫৬)। উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট ইঙ্গিতরয়েছে ইউসুফের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীহওয়ার এবং মিসরের সর্বত্র বিধান জারি করার। ইবনুকাছীর বলেন, এই সময় তিনি দ্বীনী ও দুনিয়াবীউভয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন’।[27]ইউসুফেরদক্ষ শাসন ও দুর্ভিক্ষ মুকাবিলায় অপূর্বব্যবস্থাপনা:সুদ্দী, ইবনু ইসহাক্ব, ইবনু কাছীর প্রমুখবিদ্বানগণ ইসরাঈলী রেওয়ায়াত সমূহের ভিত্তিতেযে বিবরণ দিয়েছেন, তার সারকথা এই যে, ইউসুফ(আঃ)-এর হাতে মিসরের শাসনভার অর্পিত হওয়ার পরস্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রথম সাত বছর সমগ্রদেশে ব্যাপক ফসল উৎপন্ন হয়। ইউসুফ (আঃ)-এরনির্দেশক্রমে উদ্বৃত্ত ফসলের বৃহদাংশ সঞ্চিত রাখাহয়। এতে বুঝা যায় যে, আধুনিক কালের এলএসডি,সিএসডি খাদ্য গুদামের অভিযাত্রা বিগত দিনে ইউসুফ(আঃ)-এর মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল।এরপর স্বপ্নেরদ্বিতীয় অংশের বাস্তবতা শুরু হয় এবং দেশে ব্যাপকদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি জানতেন যে, এ দুর্ভিক্ষসাতবছর স্থায়ী হবে এবং আশপাশের রাজ্যসমূহেবিস্তৃত হবে। তাই সংরক্ষিত খাদ্যশস্য খুব সতর্কতারসাথে ব্যয় করা শুরু করলেন। তিনি ফ্রি বিতরণ না করেস্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণের সিদ্ধান্ত নেন। সেইসাথে মাথাপ্রতি খাদ্য বিতরণের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণনির্ধারণ করে দেন। তাঁর আগাম হুঁশিয়ারি মোতাবেকমিসরীয় জনগণের অধিকাংশের বাড়ীতে সঞ্চিতখাদ্যশস্য মওজূদ ছিল। ফলে পার্শ্ববর্তীদুর্ভিক্ষপীড়িতরাজ্যসমূহ থেকে দলে দলেলোকেরা মিসরে আসতে শুরু করে। ইউসুফ (আঃ)তাদের প্রত্যেককে বছরে এক উট বোঝাইখাদ্য-শস্য স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে প্রদানেরনির্দেশ দেন।[28] অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ারকারণে খাদ্য বিতরণের তদারকি ইউসুফ (আঃ) নিজেইকরতেন। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, খাদ্য-শস্যের সরকারী রেশনের প্রথা বিশ্বে প্রথমইউসুফ (আঃ)-এর হাতেই শুরু হয়।ভাইদের মিসরেআগমন:মিসরের দুর্ভিক্ষ সে দেশের সীমানাপেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দূর-দূরান্ত এলাকা সমূহেবিস্তৃত হয়। ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূবের আবাসভূমিকেন‘আনও দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে পতিত হয়।ফলে ইয়াকূবের পরিবারেও অনটন দেখা দেয়। এসময় ইয়াকূব (আঃ)-এর কানে এ খবর পৌঁছে যায় যে,মিসরের নতুন বাদশাহ অত্যন্ত সৎ ও দয়ালু। তিনিস্বল্পমূল্যে একউট পরিমাণ খাদ্যশস্য অভাবীব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করছেন। এ খবর শুনেতিনি পুত্রদের বললেন,তোমরাও মিসরে গিয়েখাদ্যশস্য নিয়ে এসো। সেমতে দশ ভাই দশটিউটনিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। বৃদ্ধ পিতার খিদমত ওবাড়ী দেখাশুনার জন্য ছোট ভাই বেনিয়ামীনএকাকী রয়ে গেল। কেন‘আন থেকে মিসরেররাজধানী প্রায় ২৫০ মাইলের ব্যবধান।যথাসময়েদশভাই কেন‘আন থেকে মিসরে উপস্থিত হ’ল।ইউসুফ (আঃ) তাদেরকে চিনে ফেললেন। কিন্তুতারা তাঁকে চিনতে পারেনি। যেমন আল্লাহবলেন, ﻭَﺟَﺎﺀ ﺇِﺧْﻮَﺓُ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻓَﺪَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻓَﻌَﺮَﻓَﻬُﻢْ ﻭَﻫُﻢْﻟَﻪُ ﻣُﻨْﻜِﺮُﻭْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৮)-‘ইউসুফের ভাইয়েরা আগমনকরল এবং তার কাছে উপস্থিত হ’ল। ইউসুফতাদেরকে চিনতে পারল। কিন্তু তারা তাকে চিনতেপারেনি’ (ইউসুফ ১২/৫৮)।ইউসুফের কৌশল অবলম্বনও বেনিয়ামীনের মিসর আগমন :সুদ্দী ওঅন্যান্যদের বরাতে কুরতুবী ও ইবনু কাছীরবর্ণনা করেন যে, দশ ভাই দরবারে পৌঁছলে ইউসুফ(আঃ) তাদেরকে দোভাষীর মাধ্যমে এমনভাবেজিজ্ঞাসাবাদ করেন, যেমন অচেনা লোকদেরকরা হয়। উদ্দেশ্য ছিল তাদের সম্পর্কে নিশ্চিতহওয়া এবং পিতা ইয়াকূব ও ছোটভাই বেনিয়ামীনেরবর্তমান অবস্থা জেনে নেওয়া। যেমন তিনিজিজ্ঞেসকরেন, তোমরা ভিন্নভাষী এবংভিনদেশী। আমরা কিভাবে বুঝব যে, তোমরাশত্রুর গুপ্তচর নও? তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরাগুপ্তচর নই। আমরা আল্লাহর নবী ইয়াকূব (আঃ)-এরসন্তান। তিনি কেন‘আনে বসবাস করেন। অভাবেরতাড়নায় তাঁর নির্দেশে সুদূর পথ অতিক্রমকরেআপনার কাছে এসেছি আপনার সুনাম-সুখ্যাতি শুনে।যদি আপনি আমাদের সন্দেহ বশে গ্রেফতারকরেন অথবা শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন, তাহ’লেআমাদের অতিবৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আমাদের দশ ভাইয়েরপরিবার না খেয়ে মারা পড়বে।[29]একথা শুনেইউসুফের হৃদয় উথলে উঠল। কিন্তু অতি কষ্টেবুকে পাষাণ চেপে রেখে বললেন, তোমাদেরপিতার আরও কোন সন্তান আছে কি?তারা বলল, আমরাবারো ভাই ছিলাম। তন্মধ্যে এক ভাই ইউসুফ ছোটবেলায় জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। আমাদের পিতাতাকেই সর্বাধিক স্নেহ করতেন। অতঃপর তারসহোদর সবার ছোট ভাই বেনিয়ামীন এখনবাড়ীতে আছে পিতাকে দেখাশুনার জন্য। সবকথাশুনে নিশ্চিত হবার পর ইউসুফ (আঃ) তাদেরকেরাজকীয় মেহমানের মর্যাদায় রাখার এবং যথারীতিখাদ্য-শস্য প্রদানের নির্দেশ দিলেন। অতঃপরবিদায়ের সময় তাদের বললেন, পুনরায় আসার সময়তোমরা তোমাদের ছোট ভাইটিকেসাথে নিয়েএসো। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ- ﻭَﻟَﻤَّﺎﺟَﻬَّﺰَﻫُﻢْ ﺑِﺠَﻬَﺎﺯِﻫِﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺋْﺘُﻮﻧِﻲْ ﺑِﺄَﺧٍﻠَّﻜُﻢ ﻣِّﻦْ ﺃَﺑِﻴْﻜُﻢْ ﺃَﻻَﺗَﺮَﻭْﻥَ ﺃَﻧِّﻲْ ﺃُﻭْﻓِﻲ ﺍﻟْﻜَﻴْﻞَ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟْﻤُﻨْﺰِﻟِﻴْﻦَ- ﻓَﺈِﻥ ﻟَّﻢْﺗَﺄْﺗُﻮﻧِﻲْ ﺑِﻪِ ﻓَﻼَ ﻛَﻴْﻞَ ﻟَﻜُﻢْ ﻋِﻨْﺪِﻱ ﻭَﻻَ ﺗَﻘْﺮَﺑُﻮﻥِ – ﻗَﺎﻟُﻮﺍْ ﺳَﻨُﺮَﺍﻭِﺩُﻋَﻨْﻪُ ﺃَﺑَﺎﻩُ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻔَﺎﻋِﻠُﻮﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৯-৬১)-‘অতঃপর ইউসুফযখন তাদের রসদ সমূহ প্রস্ত্তত করে দিল, তখনবলল, তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে আমার কাছেনিয়ে এসো। তোমরা কি দেখছ না যে, আমি মাপপূর্ণভাবে দিয়ে থাকি এবং মেহমানদের উত্তমসমাদরকরে থাকি’? (৫৯)। ‘কিন্তু যদি তোমরা তাকেআমার কাছে না আনো, তবে আমার কাছেতোমাদের কোন বরাদ্দ নেই এবং তোমরা আমারনিকটে পৌঁছতে পারবে না’ (৬০)। ‘ভাইয়েরা বলল,আমরা তার সম্পর্কে তার পিতাকে রাযী করার চেষ্টাকরব এবং আমরা একাজ অবশ্যই করব’ (ইউসুফ১২/৫৯-৬১)।এরপর ইউসুফ (আঃ) কৌশল অবলম্বনকরলেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে,দশটি উটের সমপরিমাণ খাদ্যমূল্য সংগ্রহ করতেভাইদের সামর্থ্য নাও হ’তে পারে। অথচ ছোটভাইকে আনা প্রয়োজন। সেকারণ তিনিকর্মচারীদের বলে দিলেন, খাদ্যমূল্য বাবদতাদের দেওয়া অর্থ তাদের কোন একটি বস্তারমধ্যে ভরে দিতে। যাতে বাড়ী গিয়ে উক্ত টাকানিয়ে আবার তারা চলে আসতে পারে। এ বিষয়েকুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ- ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻟِﻔِﺘْﻴَﺎﻧِﻪِ ﺍﺟْﻌَﻠُﻮْﺍﺑِﻀَﺎﻋَﺘَﻬُﻢْ ﻓِﻲ ﺭِﺣَﺎﻟِﻬِﻢْ ﻟَﻌَﻠَّﻬُﻢْ ﻳَﻌْﺮِﻓُﻮْﻧَﻬَﺎ ﺇِﺫَﺍ ﺍﻧْﻘَﻠَﺒُﻮْﺍ ﺇِﻟَﻰﺃَﻫْﻠِﻬِﻢْ ﻟَﻌَﻠَّﻬُﻢْ ﻳَﺮْﺟِﻌُﻮْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬২)-‘ইউসুফ তারকর্মচারীদের বলল, তাদের পণ্যমূল্য তাদেররসদ-পত্রের মধ্যে রেখে দাও, যাতেগৃহেপৌঁছে তারা তা বুঝতে পারে। সম্ভবতঃ তারা পুনরায়আসবে’ (ইউসুফ ১২/৬২)।ইউসুফের ভাইয়েরাযথাসময়ে বাড়ী ফিরে এল। বস্তা খুলে পণ্যমূল্যফেরত পেয়ে তারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েউঠলো। তারাএটাকে তাদের প্রতি আযীযেমিছরেরবিশেষ অনুগ্রহ বলে ধারণা করল। এক্ষণেতারা পিতাকে বলল, আববা! আমরা যখন পণ্যমূল্যপেয়ে গেছি, তখন আমরা সত্বর পুনরায় মিসরে যাব।তবে মিসররাজ আমাদেরকে একটিশর্ত দিয়েছেনযে, এবারে যাওয়ার সময় ছোট ভাইবেনিয়ামীনকে নিয়ে যেতে হবে। তাকেছেড়ে গেলে খাদ্যশস্য দিবেন না বলে তিনিস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। অতএব আপনি তাকেআমাদের সাথে যাবার অনুমতি দিন। জবাবে পিতা ইয়াকূব(আঃ) বললেন, তার সম্পর্কে তোমাদের কিভাবেবিশ্বাস করব? ইতিপূর্বে তোমরা তার ভাই ইউসুফসম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গ করেছ’। অতঃপর পরিবারেরঅভাব-অনটনের কথা ভেবে তাদের কাছ থেকেঅঙ্গীকার নিয়ে তিনি বেনিয়ামীনকে তাদেরসাথে যাবার অনুমতি দিলেন। ঘটনাটি কুরআনের ভাষায়নিম্নরূপ- ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺟَﻌُﻮْﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﺑِﻴْﻬِﻢْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻣُﻨِﻊَ ﻣِﻨَّﺎﺍﻟْﻜَﻴْﻞُ ﻓَﺄَﺭْﺳِﻞْ ﻣَﻌَﻨَﺎ ﺃَﺧَﺎﻧَﺎ ﻧَﻜْﺘَﻞْ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻪُ ﻟَﺤَﺎﻓِﻈُﻮْﻥَ- ﻗَﺎﻝَﻫَﻠْﺂﻣَﻨُﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺇِﻻَّ ﻛَﻤَﺎ ﺃَﻣِﻨﺘُﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﺧِﻴْﻪِ ﻣِﻦ ﻗَﺒْﻞُ ﻓَﺎﻟﻠﻪُﺧَﻴْﺮٌ ﺣَﺎﻓِﻈﺎً ﻭَﻫُﻮَﺃَﺭْﺣَﻢُ ﺍﻟﺮَّﺍﺣِﻤِﻴْﻦَ – ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﻓَﺘَﺤُﻮْﺍ ﻣَﺘَﺎﻋَﻬُﻢْﻭَﺟَﺪُﻭْﺍ ﺑِﻀَﺎﻋَﺘَﻬُﻢْ ﺭُﺩَّﺕْ ﺇِﻟَﻴْﻬِﻢْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻣَﺎ ﻧَﺒْﻐِﻲ ﻫَـﺬِﻩِﺑِﻀَﺎﻋَﺘُﻨَﺎ ﺭُﺩَّﺕْ ﺇِﻟَﻴْﻨَﺎ ﻭَﻧَﻤِﻴْﺮُ ﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ ﻭَﻧَﺤْﻔَﻆُ ﺃَﺧَﺎﻧَﺎ ﻭَﻧَﺰْﺩَﺍﺩُﻛَﻴْﻞَ ﺑَﻌِﻴْﺮٍ ﺫَﻟِﻚَ ﻛَﻴْﻞٌ ﻳَﺴِﻴْﺮٌ – ﻗَﺎﻝَ ﻟَﻦْ ﺃُﺭْﺳِﻠَﻪُ ﻣَﻌَﻜُﻢْ ﺣَﺘَّﻰﺗُﺆْﺗُﻮْﻥِ ﻣَﻮْﺛِﻘﺎً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻟَﺘَﺄْﺗُﻨَّﻨِﻲْ ﺑِﻪِ ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳُّﺤَﺎﻁَ ﺑِﻜُﻢْ ﻓَﻠَﻤَّﺎﺁﺗَﻮْﻩُ ﻣَﻮْﺛِﻘَﻬُﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﻧَﻘُﻮْﻝُ ﻭَﻛِﻴْﻞٌ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ৬৩-৬৬)-‘অতঃপর তারা যখন তাদের পিতার কাছে ফিরেএল, তখন বলল, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্যখাদ্যশস্যের বরাদ্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতএবআপনি আমাদের সাথে আমাদের ভাইকে প্রেরণকরুন, যাতে আমরা খাদ্যশস্যের বরাদ্দ আনতে পারি।আমরা অবশ্যই তার পুরোপুরি হেফাযত করব’ (৬৩)।‘পিতা বললেন, আমি কি তার সম্পর্কে তোমাদেরসেইরূপ বিশ্বাস করব, যেরূপ বিশ্বাস ইতিপূর্বে তারভাই সম্পর্কে করেছিলাম? অতএব আল্লাহ উত্তমহেফাযতকারী এবং তিনিই সর্বাধিক দয়ালু’ (৬৪)। ‘অতঃপরযখন তারা পণ্য সম্ভার খুলল, তখন দেখতে পেলযে, তাদেরকে তাদের পণ্যমূল্য ফেরত দেওয়াহয়েছে। তারা (আনন্দে) বলে উঠলো, হেআমাদের পিতা! আমরা আর কি চাইতে পারি? এইতোআমাদের দেওয়া পণ্যমূল্য আমাদেরকে ফিরিয়েদেওয়া হয়েছে। এখন আমরা আবার আমাদেরপরিবারের জন্য খাদ্যশস্য আনব। আমরা আমাদেরভাইয়ের হেফাযত করব এবং এক উট খাদ্যশস্যবেশী আনতে পারব এবং ঐ বরাদ্দটা খুবইসহজ’ (৬৫)। ‘পিতা বললেন, তাকে তোমাদেরসাথে পাঠাব না, যতক্ষণ না তোমরা আমার নিকটেআল্লাহর নামে অঙ্গীকার কর যে, তাকে অবশ্যইআমার কাছে পৌঁছে দেবে। অবশ্য যদি তোমরাএকান্তভাবেই অসহায় হয়ে পড় (তবে সেকথাস্বতন্ত্র)। অতঃপর যখন সবাই তাঁকে অঙ্গীকার দিল,তখন তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে যেকথা হ’ল,সে ব্যাপারে আল্লাহ মধ্যস্থ রইলেন’ (ইউসুফ১২/৬৩-৬৬)।উপরের আলোচনায় মনে হচ্ছে যে,দশভাই বাড়ী এসেই প্রথমে তাদের পিতার কাছেবেনিয়ামীনকে নিয়ে যাবার ব্যাপারে দরবারকরেছে। অথচ তারা ভাল করেই জানত যে, এপ্রস্তাবে পিতা কখনোই রাযী হবেননা। দীর্ঘদিনপরে বাড়ী ফিরে অভাবের সংসারে প্রথমেখাদ্যশস্যের বস্তা না খুলে বৃদ্ধ পিতার অসন্তুষ্টিউদ্রেককারী বিষয় নিয়ে কথা বলবে, এটা ভাবা যায়না। পণ্যমূল্য ফেরত পাওয়ায় খুশীর মুহূর্তেই বরংএরূপ প্রস্তাব দেওয়াটা যুক্তিসম্মত।উল্লেখ্য যে,কুরআনী বর্ণনায় আগপিছ হওয়াতে ঘটনার আগপিছহওয়া যরূরী নয়। যেমন মূসা (আঃ)-এর কওমেরগাভী কুরবানীর ঘটনা বর্ণনা (বাক্বারাহ ৬৭-৭১)শেষে ঘটনার কারণ ও সূত্র বর্ণনা করা হয়েছে(বাক্বারাহ ৭২-৭৩)। এমন বিবরণ কুরআনের বিভিন্নস্থানে পাওয়া যায়। এখানেও সেটা হয়েছে বলেঅনুমিত হয়।ছেলেদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনিয়ে বেনিয়ামীনকে তাদের সাথে পাঠাবারব্যাপারে সম্মত হওয়ার পর পিতা ইয়াকূব (আঃ)পরিষ্কারভাবে বলেন, ﻓَﺎﻟﻠﻪُ ﺧَﻴْﺮٌ ﺣَﺎﻓِﻈﺎً ‘আল্লাহ্ইউত্তম হেফাযতকারী’ (ইউসুফ ১২/৬৪)। অর্থাৎ তিনিবেনিয়ামীনকে আল্লাহর হাতেই সোপর্দকরলেন। আল্লাহ তার বান্দার এই আকুতি শুনলেন।অতঃপর ইয়াকূব (আঃ) ছেলেদেরকে কিছু উপদেশদেন, যার মধ্যে তাঁর বাস্তববুদ্ধি ও দূরদর্শিতারপ্রতিফলন ঘটেছে। তিনি তাদেরকে একসাথেএকই প্রবেশদ্বার দিয়ে মিসরের রাজধানীতেপ্রবেশ করতে নিষেধ করেন। বরং তাদেরকেপৃথক পৃথক ভাবে বিভিন্ন দরজা দিয়ে শহরেপ্রবেশ করতে বলেন। কেননা তিনিভেবেছিলেন যে, একই পিতার সন্তান সুন্দর ওসুঠামদেহী ১১ জন ভিনদেশীকে একত্রে একদরজা দিয়েপ্রবেশ করতে দেখলে অনেকেমন্দ কিছু সন্দেহ করবে। দ্বিতীয়তঃ প্রথমবারসফরে মিসররাজ তাদের প্রতি যে রাজকীয়মেহমানদারী প্রদর্শন করেছেন, তাতেঅনেকের মনে হিংসা জেগে থাকতে পারে এবংতারা তাদের ক্ষতি করতে পারে। তৃতীয়তঃ তাদেরপ্রতি অন্যদের কুদৃষ্টি লাগতে পারে। বিষয়টি আল্লাহবর্ণনা করেন এভাবে, ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑَﻨِﻲَّ ﻻَ ﺗَﺪْﺧُﻠُﻮﺍْ ﻣِﻦْ ﺑَﺎﺏٍﻭَﺍﺣِﺪٍﻭَﺍﺩْﺧُﻠُﻮﺍْ ﻣِﻦْ ﺃَﺑْﻮَﺍﺏٍ ﻣُّﺘَﻔَﺮِّﻗَﺔٍ ﻭَﻣَﺎ ﺃُﻏْﻨِﻲْ ﻋَﻨﻜُﻢ ﻣِّﻦَﺍﻟﻠﻪِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﻥِ ﺍﻟْﺤُﻜْﻢُ ﺇِﻻَِّﻟﻠﻪِ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺗَﻮَﻛَّﻠْﺖُ ﻭَﻋَﻠَﻴْﻪِﻓَﻠْﻴَﺘَﻮَﻛَّﻞِ ﺍﻟْﻤُﺘَﻮَﻛِّﻠُﻮْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬৭)-‘ইয়াকূব বললেন,হে আমার সন্তানেরা! তোমরা সবাই একই দরজাদিয়ে প্রবেশ করো না। বরং পৃথক পৃথক দরজাদিয়ে প্রবেশ কর। তবে আল্লাহ থেকে আমিতোমাদের রক্ষা করতে পারি না। আল্লাহ ব্যতীতকারু হুকুম চলে না। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি এবংতাঁর উপরেই ভরসা করা উচিত সকলভরসাকারীর’ (ইউসুফ ১২/৬৭)।অতঃপর পিতার নিকটথেকে বিদায় নিয়ে বেনিয়ামীন সহ ১১ ভাই ১১টি উটনিয়ে মিসরের পথে যাত্রা করল। পথিমধ্যে তাদেরকোনরূপ বাধা-বিঘ্ন ঘটেনি। মিসরেপৌঁছে তারা পিতারউপদেশ মতে বিভিন্ন দরজা দিয়ে পৃথক পৃথকভাবেশহরে প্রবেশ করল। ইয়াকূবের এ পরামর্শ ছিলপিতৃসূলভ স্নেহ-মমতা হ’তে উৎসারিত। যার ফলসন্তানেরা পেয়েছে। তারা কারু হিংসার শিকার হয়নি কিংবাকারু বদনযরে পড়েনি। কিন্তু এর পরেওআল্লাহরপূর্ব নির্ধারিত তাক্বদীর কার্যকর হয়েছে।বেনিয়ামীন চুরির মিথ্যা অপবাদে গ্রেফতার হয়েযায়। যা ছিল ইয়াকূবের জন্য দ্বিতীয়বার সবচেয়েবড় আঘাত। কিন্তু এটা ইয়াকূবের দো‘আর পরিপন্থীছিল না। কেননা তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ থেকেআমি তোমাদের রক্ষা করতে পারি না। আল্লাহব্যতীত কারু হুকুম চলে না’ (ইউসুফ ১২/৬৭)। অতএবপিতার নির্দেশ পালনকরলেও তারা আল্লাহরপূর্বনির্ধারণ বা তাক্বদীরকে এড়াতে পারেনি। আরসেই তাক্বদীরের ফলেই ইয়াকূব (আঃ) তারহারানো দু’সন্তানকে একত্রে ফিরে পান।ইয়াকূবের গভীর জ্ঞানের প্রশংসা করে আল্লাহবলেন, ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﺬُﻭْ ﻋِﻠْﻢٍ ﻟِّﻤَﺎ ﻋَﻠَّﻤْﻨَﺎﻩُ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ، ‘ইয়াকূব বিশেষ জ্ঞানেরঅধিকারী ছিলেন।যা আমরা তাকে দান করেছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ লোকতা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৬৮)।বলা বাহুল্য, ইয়াকূবেরসেই ইল্ম ছিল আল্লাহর সত্তা ও তাঁর গুণাবলীর ইল্ম,আল্লাহর অতুলনীয় ক্ষমতার ইল্ম। আর এটাইহ’লমা‘রেফাত বা দিব্যজ্ঞান, যা সূক্ষ্মদর্শী মুত্তাক্বীআলেমগণ লাভ করে থাকেন। সেজন্যেইতিনিনিজের দেওয়া কৌশলের উপরে নির্ভর না করেআল্লাহর উপরে ভরসা করেন ও তাঁর উপরেইছেলেদের ন্যস্ত করেন। সেকারণেই আল্লাহতাঁর নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করে ছেলেদেরকেসসম্মানে পিতার কোলে ফিরিয়ে দেন। ফালিল্লাহিলহাম্দ।উক্ত বিষয়গুলি কুরআনে বর্ণিত হয়েছেনিম্নরূপে: ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻣِﻦْ ﺣَﻴْﺚُ ﺃَﻣَﺮَﻫُﻢْ ﺃَﺑُﻮْﻫُﻢْ ﻣَّﺎ ﻛَﺎﻥَﻳُﻐْﻨِﻲْ ﻋَﻨْﻬُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﻻَّ ﺣَﺎﺟَﺔً ﻓِﻲْ ﻧَﻔْﺲِﻳَﻌْﻘُﻮْﺏَ ﻗَﻀَﺎﻫَﺎ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﺬُﻭْ ﻋِﻠْﻢٍ ﻟِّﻤَﺎ ﻋَﻠَّﻤْﻨَﺎﻩُ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَﺍﻟﻨَّﺎﺱِﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ – ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮﺍْ ﻋَﻠَﻰ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﺁﻭَﻯ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﺃَﺧَﺎﻩُ ﻗَﺎﻝَﺇِﻧِّﻲ ﺃَﻧَﺎْ ﺃَﺧُﻮْﻙَ ﻓَﻼَ ﺗَﺒْﺘَﺌِﺲْ ﺑِﻤَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮْﺍ ﻳَﻌْﻤَﻠُﻮْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ৬৮-৬৯)-‘তারা যখন তাদের পিতার নির্দেশনা মতেশহরে প্রবেশ করল, তখন আল্লাহর বিধানেরবিরুদ্ধে তা তাদের বাঁচাতে পারল না (অর্থাৎ তাদেরসে কৌশল কাজে আসল না এবং বেনিয়ামীনগ্রেফতার হ’ল)। কেবল ইয়াকূবের একটিপ্রয়োজন (অর্থাৎ ছেলেদের দেওয়াপরামর্শে) যা তার মনের মধ্যে (অর্থাৎ, স্নেহমিশ্রিত তাকীদ) ছিল, যা তিনি পূর্ণ করেছিলেনবস্ত্ততঃ তিনি তো ছিলেন একজন জ্ঞানী, যেজ্ঞান আমরা তাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম (অর্থাৎআল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে প্রকৃতজ্ঞান)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’। ‘অতঃপর যখনতারা ইউসুফের নিকটে উপস্থিত হ’ল, তখন সে তারভাই (বেনিয়ামীন)-কে নিজের কাছে রেখে দিলএবং (গোপনে তাকে) বলল, নিশ্চয়ই আমি তোমারসহোদর ভাই (ইউসুফ)। অতএব তাদের (অর্থাৎ সৎভাইদের) কৃতকর্মের জন্য দুঃখ করো না’ (ইউসুফ১২/৬৮-৬৯)।বেনিয়ামীনকে আটকে রাখাহ’ল:সহোদর ছোট ভাই বেনিয়ামীনকে রেখেদেবার জন্য ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর হুকুমে একটিবিশেষ কৌশলঅবলম্বন করলেন। যখন সকল ভাইকেনিয়ম মাফিক খাদ্য-শস্য প্রদান করা হ’ল এবং পৃথক পৃথকবস্তায় পৃথক নামে পৃথক উটের পিঠে চাপানো হ’ল,তখন গোপনে বেনিয়ামীনের বস্তার মধ্যেবাদশাহর নিজস্ব ব্যবহৃত স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত ওযনপাত্র, যা ছিল অতীব মূল্যবান, সেটিকে ভরেদেওয়া হ’ল। অতঃপর কাফেলা বের হয়ে কিছু দূরগেলে পিছন থেকে জনৈক রাজকর্মচারী ছুটেগিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করল, হে কাফেলারলোকেরা! তোমরা চোর। দাঁড়াও তোমাদেরতল্লাশি করা হবে। ঘটনাটির বর্ণনা কুরআনের ভাষায়নিম্নরূপ: ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﻬَّﺰَﻫُﻢْ ﺑِﺠَﻬَﺎﺯِﻫِﻢْ ﺟَﻌَﻞَ ﺍﻟﺴِّﻘَﺎﻳَﺔَ ﻓِﻲْ ﺭَﺣْﻞِﺃَﺧِﻴْﻪِ ﺛُﻢَّ ﺃَﺫَّﻥَ ﻣُﺆَﺫِّﻥٌ ﺃَﻳَّﺘُﻬَﺎ ﺍﻟْﻌِﻴْﺮُ ﺇِﻧَّﻜُﻢْ ﻟَﺴَﺎﺭِﻗُﻮْﻥَ- ﻗَﺎﻟُﻮْﺍﻭَﺃَﻗْﺒَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣَﺎﺫَﺍ ﺗَﻔْﻘِﺪُﻭْﻥَ- ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻧَﻔْﻘِﺪُ ﺻُﻮَﺍﻉَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚِﻭَﻟِﻤَﻦْ ﺟَﺎﺀ ﺑِﻪِ ﺣِﻤْﻞُ ﺑَﻌِﻴْﺮٍ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺑِﻪِ ﺯَﻋِﻴْﻢٌ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﻟَﻘَﺪْﻋَﻠِﻤْﺘُﻢْ ﻣَﺎ ﺟِﺌْﻨَﺎ ﻟِﻨُﻔْﺴِﺪَ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﺳَﺎﺭِﻗِﻴْﻦَ- ﻗَﺎﻟُﻮْﺍﻓَﻤَﺎ ﺟَﺰَﺁﺅُﻩُ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﻛَﺎﺫِﺑِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺟَﺰَﺁﺅُﻩُ ﻣَﻦْ ﻭُﺟِﺪَ ﻓِﻲْﺭَﺣْﻠِﻪِ ﻓَﻬُﻮَ ﺟَﺰَﺍﺅُﻩُ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ৮০-৮৫)-‘অতঃপর যখন ইউসুফ তাদের জন্য খাদ্যশস্যপ্রস্ত্তত করে দিচ্ছিল, তখন একটি পাত্র তার(সহোদর) ভাইয়ের বরাদ্দ খাদ্যশস্যের মধ্যেরেখে দিল। অতঃপর একজন ঘোষক ডেকেবলল, হে কাফেলার লোকজন! তোমরা অবশ্যইচোর’ (৭০)। ‘একথা শুনে তারা ওদের দিকে মুখফিরিয়ে বলল, তোমাদের কি হারিয়েছে’? (৭১)।‘তারা বলল, আমরা বাদশাহর ওযনপাত্র হারিয়েছি। যেকেউ এটা এনে দেবে,সে এক উটের বোঝাপরিমাণ মাল পাবেএবং আমি এটার যামিন রইলাম’ (৭২)। ‘তারাবলল, আল্লাহর কসম! তোমরা তো জানো যে,আমরা এদেশে কোনরূপ অনর্থ ঘটাতে আসিনি এবংআমরা কখনোই চোর নই’ (৭৩)। বাদশাহরলোকেরা বলল, ‘যদি তোমরা মিথ্যাবাদী হও তবেযে চুরি করেছে, তার শাস্তি কি হবে’? (৭৪)। ‘তারাবলল, (আমাদের নবী ইয়াকূবের শরী‘আতঅনুযায়ী) এর শাস্তি এই যে, যার খাদ্যশস্যের বস্তাথেকে এটা পাওয়া যাবে, তারশাস্তি স্বরূপ সে(মালিকের) গোলাম হবে। আমরা যালেমদেরকেএভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি’ (ইউসুফ ১২/৭০-৭৫)।এভাবে ইউসুফ তার ভাইদের মুখ দিয়েই তাদেরশরী‘আতের বিধান জেনে নিলেন এবং সভাসদগণসবাই তা জানলো। যদিও ইউসুফ তার পিতারশরী‘আতের বিধান জানতেন এবং নিজেও নবীছিলেন। আল্লাহ বলেন, ﻓَﺐَﺃَﺩَ ﺑِﺄَﻭْﻋِﻴَﺘِﻬِﻢْ ﻗَﺒْﻞَ ﻭِﻋَﺎﺀِﺃَﺧِﻴْﻪِ ﺛُﻢَّ ﺍﺳْﺘَﺨْﺮَﺟَﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﻭِﻋَﺎﺀِ ﺃَﺧِﻴْﻪِ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻛِﺪْﻧَﺎ ﻟِﻴُﻮْﺳُﻒَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻟِﻴَﺄْﺧُﺬَ ﺃَﺧَﺎﻩُ ﻓِﻲْ ﺩِﻳْﻦِ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚِ ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳَّﺸَﺂﺀَ ﺍﻟﻠﻪُﻧَﺮْﻓَﻊُ ﺩَﺭَﺟَﺎﺕٍ ﻣَّﻦْ ﻧَﺸَﺂﺀُ ﻭَﻓَﻮْﻕَ ﻛُﻞِّ ﺫِﻱ ﻋِﻠْﻢٍ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ৭৬)-‘অতঃপর (ইউসুফের নির্দেশ মোতাবেক) তারভাইয়ের বস্তার পূর্বে (ঘোষক) অন্য ভাইদেরবস্তাতল্লাশি শুরু করল। অবশেষে সেই পাত্রটি তার(সহোদর) ভাইয়ের বস্তা থেকে বের করল।এমনিভাবে আমরা ইউসুফকে কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম।সে বাদশাহর (প্রচলিত) আইনে আপন ভাইকেকখনো নিজ অধিকারে নিতে পারত না আল্লাহর ইচ্ছাব্যতীত। আমরা যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করিএবং (সত্য কথা এই যে,) প্রত্যেক জ্ঞানীরউপরে জ্ঞানী আছেন (ইউসুফ ১২/৭৬)।শিক্ষণীয় বিষয় :(১) আল্লাহর উপরোক্তবক্তব্যের মাধ্যমে একথা বুঝানো হয়েছে যে,ভাইদের মর্যাদার চেয়ে ইউসুফের মর্যাদা আল্লাহঅধিক উন্নীত করেছেন (২) এতদ্ব্যতীত এবিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইয়াকূব (আঃ) নিজ জ্ঞানমোতাবেক বেনিয়ামীনকে তাঁর কাছে ফিরিয়েআনার জন্য ছেলেদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনেওয়ার মাধ্যমে যে কৌশল অবলম্বনকরেছিলেন, তার চাইতে ইউসুফের মাধ্যমেআল্লাহ যে জ্ঞানের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা ছিলঅনেক ঊর্ধ্বের এবং অনেক সুদূর প্রসারী।কেননা এর ফলেই পরবর্তীতে ইয়াকূব (আঃ) সবছেলেদের নিয়ে সপরিবারে মিসরে উচ্চ সম্মাননিয়ে আগমনের সুযোগপান।প্রশ্ন হ’তে পারেযে, ইউসুফ (আঃ) বেনিয়ামীনকে চোর বানিয়েনিজের কাছে রেখে দেবার মত নিষ্ঠুর পন্থাবেছে নিলেন কেন? তাছাড়া এর দ্বারা তার বৃদ্ধ পিতাইয়াকূব (আঃ) যে আরও বেশী মনোকষ্ট পাবেন,তাতো তিনি জানতেন। তিনি এটাও জানতেন যে,তাকে হারিয়ে শোকে-দুঃখে তার পিতা কাতর হয়েআছেন। এ প্রশ্নের জবাব আল্লাহ নিজেইদিয়েছেন যে, ‘আমরাই ইউসুফকে এ কৌশল শিক্ষাদিয়েছিলাম। নইলে বাদশাহর (প্রচলিত) আইনে আপনভাইকে সে কখনো নিজ অধিকারে নিতে পারতনা’ (ইউসুফ ১২/৭৬)। অতএব আল্লাহর হুকুমে ইউসুফএ কাজ করেছিলেন। এখানে তার নিজের কিছুইকরার ছিল না।(৩) একটি সাধারণ নীতি এখানে জানিয়েদেওয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক জ্ঞানীরউপরে জ্ঞানী আছেন। অতএব মানুষ যেন তারজ্ঞানের বড়াই না করে। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,এখানে আল্লাহকেই সর্বোচ্চ জ্ঞানেরঅধিকারী বলে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)।বেনিয়ামীনকে ফিরিয়ে নেবার জন্য ভাইদেরপ্রচেষ্টা :চোর হিসাবে বিদেশে গ্রেফতার হওয়াও গোলামীর শৃংখলে আবদ্ধ হওয়ার মতলজ্জাষ্কর ঘটনায় প্রত্যেক ভাই-ই বিস্ময়েবিমূঢ়হয়ে পড়েছিল। স্বয়ং বেনিয়ামীনও এজন্যপ্রস্ত্তত ছিল না। তবে তার মনে এতটুকু সান্ত্বনা ছিলযে, সে তার ভাইয়ের কাছে থাকবে। কিন্তু চুরিরমত অপবাদ সহ্য করা নিঃসন্দেহে কষ্টদায়ক ছিল।কিন্তু বিদেশ-বিভূঁইয়ে ভিন রাজ্যে তাদের কিছুকরারও ছিল না। অবশেষে সকলে মিলে বাদশাহরকাছে গিয়ে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা গিয়েবাদশাহ্কে বলল, আমাদের যিনি বৃদ্ধ পিতা আছেন,ছোট ছেলেটি তাঁর অতীব প্রিয়। এরবিচ্ছেদেরবেদনা তিনি সইতে পারবেন না। তাইআমাদের অনুরোধ, আপনি তার বদলে আমাদেরএকজনকে রেখে দিন’। কিন্তু বাদশাহ (ইউসুফ)তাতে রাযীহলেন না। তিনি বললেন, যার কাছে মালপাওয়া গেছে, তাকে বাদ দিয়েঅন্যকে গ্রেফতারকরা আইনসিদ্ধ নয়।শত অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হওয়ায়অবশেষে মনের ক্ষেদ প্রকাশ করে তাদেরকেউ বলে ফেলল, সে যদি চুরি করে থাকে,তবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে। ওর ভাইওইতিপূর্বে চুরি করেছিল। এর দ্বারা তারা বুঝাতেচেয়েছিল যে, আমরা দশভাই ঠিক আছি, ওরা দুইসহোদর ভাই-ই চোর (নাঊযুবিল্লাহ)।ইউসুফকেকাছে রাখার জন্য শৈশবে তার স্নেহপরায়ণ ফুফু যেচুরির ঘটনা সাজিয়েছিল, সে ঘটনার দিকেই তারা ইঙ্গিতকরেছিল, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। যদিও তারাভালভাবে জানত যে, সেটা ছিল একেবারেই মিথ্যাএবং সাজানো বিষয়। কিন্তু সেটাকেই সত্যিকার চুরিবলে আখ্যায়িত করল বেনিয়ামীনের প্রতিআক্রোশ বশতঃ। ইউসুফ শুনে ধৈর্য ধারণ করলেনও মনের দুঃখ মনে চেপে রাখলেন।এভাবেবাদশাহর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে বেনিয়ামীনকেছেড়ে যখন তারা বেরিয়ে এল, তখন তাদের বড়ভাই ইয়াহূদা অন্য ভাইদের বলল, তোমরা পিতার কাছেফেরত যাও এবং তাঁকে সব খুলে বল। আমি এখানথেকেফেরত যাব না, যতক্ষণ না পিতা আমাকেআদেশ দেন কিংবা আল্লাহ আমার জন্য কোনফায়ছালা করেন। উল্লেখ্য, এই বড় ভাইয়ের হাতেইতার পিতা বেনিয়ামীনকে সোপর্দ করেছিলেনএবং ইতিপূর্বে এই বড় ভাই-ই ইউসুফকে হত্যা না করারজন্য অন্য ভাইদের পরামর্শ দিয়েছিল এবং সেই-ইগোপনে জঙ্গলের সেই অন্ধকূপে ইউসুফেরজন্য খাদ্য সরবরাহ করেছিল ও সারাক্ষণ তার তদারকিকরত, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।উপরোক্তঘটনাটি কুরআনে আগপিছ করে বর্ণিত হয়েছে।যেমন সেখানেইউসুফের সামনে আগেইইউসুফের চুরির ঘটনা বলা হয়েছে। অথচ শুরুতেইএটা বলা অযৌক্তিক এবং অসমীচীন। কেননা তাতেবেনিয়ামীন যে আসলেই চোর, সেকথাপরোক্ষভাবে স্বীকার করা হয়। অথচ তারাপ্রথমে সেটা অস্বীকার করেছিল এবং সেটাইস্বাভাবিক। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺇِﻥﻳَّﺴْﺮِﻕْ ﻓَﻘَﺪْ ﺳَﺮَﻕَ ﺃَﺥٌ ﻟَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﻓَﺄَﺳَﺮَّﻫَﺎ ﻳُﻮْﺳُﻒُ ﻓِﻲْﻧَﻔْﺴِﻪِ ﻭَﻟَﻢْ ﻳُﺒْﺪِﻫَﺎ ﻟَﻬُﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﺷَﺮٌّ ﻣَّﻜَﺎﻧﺎً ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﺑِﻤَﺎﺗَﺼِﻔُﻮْﻥَ- ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟْﻌَﺰِﻳْﺰُ ﺇِﻥَّ ﻟَﻪُ ﺃَﺑﺎً ﺷَﻴْﺨﺎً ﻛَﺒِﻴْﺮﺍً ﻓَﺨُﺬْﺃَﺣَﺪَﻧَﺎ ﻣَﻜَﺎﻧَﻪُ ﺇِﻧَّﺎ ﻧَﺮَﺍﻙَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ- ﻗَﺎﻝَ ﻣَﻌَﺎﺫَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺃَﻥْﻧَﺄْﺧُﺬَ ﺇِﻻَّ ﻣَﻦْ ﻭَﺟَﺪْﻧَﺎ ﻣَﺘَﺎﻋَﻨَﺎ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﺇِﻧَّـﺎ ﺇِﺫﺍً ﻟَّﻈَﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ-‏( ﻳﻮﺳﻒ ৭৭-৭৯)-‘তারা বলতে লাগল, যদি সে চুরি করেথাকে, তবে তার এক ভাইও ইতিপূর্বেচুরি করেছিল।তখন ইউসুফ প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনের মধ্যেরাখল, তাদেরকে প্রকাশ করল না। (মনে মনে)বললেন, তোমরা লোক হিসাবে খুবই মন্দ এবংআল্লাহ সে বিষয়ে ভালভাবে জ্ঞাত, যা তোমরাবলছ’ (৭৭)। ‘তারা বলতে লাগল, হে আযীয (অর্থাৎইউসুফ)! তার পিতা আছেন অতিশয় বৃদ্ধ। অতএব আপনিআমাদেরএকজনকে তার বদলে রেখে দিন। আমরাআপনাকে অনুগ্রহশীলদের মধ্যকার একজন বলেদেখতে পাচ্ছি’ (৭৮)। ‘সে বলল, যার কাছে আমরাআমাদের মাল পেয়েছি, তাকে ছেড়ে অন্যকেগ্রেফতার করা থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষাকরুন। এমনটি করলে তো আমরা নিশ্চিতভাবেযুলুমকারী হয়ে যাব’ (ইউসুফ ১২/৭৭-৭৯)।বেনিয়ামীনকে রেখেই মিসর থেকে ফিরলভাইয়েরা :অতঃপর তারা যখন বাদশাহর কাছ থেকে নিরাশহয়ে গেল, তখন পরামর্শের জন্য সকলেএকান্তে বসল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ﻓَﻠَﻤَّﺎﺍﺳْﺘَﻴْﺄَﺳُﻮﺍْ ﻣِﻨْﻪُ ﺧَﻠَﺼُﻮﺍْ ﻧَﺠِﻴّﺎً ﻗَﺎﻝَ ﻛَﺒِﻴْﺮُﻫُﻢْ ﺃَﻟَﻢْ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮﺍْ ﺃَﻥَّﺃَﺑَﺎﻛُﻢْ ﻗَﺪْ ﺃَﺧَﺬَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢ ﻣَّﻮْﺛِﻘﺎً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠّﻪِ ﻭَﻣِﻦ ﻗَﺒْﻞُ ﻣَﺎ ﻓَﺮَّﻃﺘُﻢْﻓِﻲ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﻓَﻠَﻦْ ﺃَﺑْﺮَﺡَ ﺍﻷَﺭْﺽَ ﺣَﺘَّﻰَ ﻳَﺄْﺫَﻥَ ﻟِﻲ ﺃَﺑِﻲ ﺃَﻭْﻳَﺤْﻜُﻢَ ﺍﻟﻠﻪ ُﻟِﻲ ﻭَﻫُﻮَ ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟْﺤَﺎﻛِﻤِﻴﻦَ، ﺍﺭْﺟِﻌُﻮﺍْ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﺑِﻴﻜُﻢْﻓَﻘُﻮﻟُﻮﺍْ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﺇِﻥَّ ﺍﺑْﻨَﻚَ ﺳَﺮَﻕَ ﻭَﻣَﺎ ﺷَﻬِﺪْﻧَﺎ ﺇِﻻَّ ﺑِﻤَﺎ ﻋَﻠِﻤْﻨَﺎﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﻟِﻠْﻐَﻴْﺐِ ﺣَﺎﻓِﻈِﻴْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৮০ -৮১)-‘অতঃপরযখন তারা তার (বাদশাহর) কাছ থেকে নিরাশ হয়েগেল, তখন তারা একান্তে পরামর্শে বসল।তখনতাদের বড় ভাই বলল, তোমরা কি জানো না যে,পিতা তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামেঅঙ্গীকার নিয়েছেন এবং ইতিপূর্বে ইউসুফেরব্যাপারেও তোমরা অন্যায় করেছ? অতএব আমিকিছুতেই এদেশ ত্যাগ করব না, যে পর্যন্ত না পিতাআমাকে আদেশ দেনঅথবা আল্লাহ আমার কোনফায়ছালা করেন।তিনিই সর্বোত্তম ফায়ছালাকারী’।‘তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও এবংবল, হে পিতা! আপনার ছেলে চুরি করেছে। আমরাযা জানি, কেবল তারই সাক্ষ্যদিলাম এবং কোন অদৃশ্যবিষয়ে আমরা হেফাযতকারী ছিলাম না’ (ইউসুফ১২/৮০-৮১)।অর্থাৎ বেনিয়ামীনকে হেফাযতেরঅঙ্গীকার বাহ্যিক অবস্থা পর্যন্ত সম্ভবপর ছিল।কিন্তু আমাদের দৃষ্টির আড়ালে সে কিছু করেথাকলে তাতে আমাদের কিছুই করার ছিল না। অতঃপরতারা কেন‘আনে ফিরে এল এবং পিতাকে সব কথাখুলে বলল।পিতার নিকটে ছেলেদের কৈফিয়ত:কেন‘আনে ফিরে এসে পিতার নিকটে তারাবেনিয়ামীনকে রেখে আসার কারণ ব্যাখ্যা করেএবং সেই সাথে তারা নিজেদের কথার সত্যতাপ্রমাণের জন্য মিসর প্রত্যাগত অন্যান্যকেন‘আনী কাফেলাকে সাক্ষী মানল এবং পিতাকেবলল, ﻭَﺍﺳْﺄَﻝِ ﺍﻟْﻘَﺮْﻳَﺔَ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻛُﻨَّﺎ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻭَﺍﻟْﻌِﻴﺮَ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﺃَﻗْﺒَﻠْﻨَﺎﻓِﻴﻬَﺎ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﺼَﺎﺩِﻗُﻮﻥَ ‘(হে পিতা!) আপনি জিজ্ঞেস করুনঐ জনপদের লোকদের, যেখানে আমরা ছিলামএবং (জিজ্ঞেস করুন) ঐসব কাফেলাকে যাদেরসাথে আমরা এসেছি। আমরা নিশ্চিতভাবেই(আপনাকে) সত্য ঘটনা বলছি’ ( ইউসুফ ৮২)। (কিন্তুক্ষুব্ধ ও ব্যথিত পিতা তাদের কথায় কর্ণপাত না করেবললেন), ﺑَﻞْ ﺳَﻮَّﻟَﺖْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﻧﻔُﺴُﻜُﻢْ ﺃَﻣْﺮﺍً ﻓَﺼَﺒْﺮٌ ﺟَﻤِﻴْﻞٌﻋَﺴَﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﺃَﻥ ﻳَّﺄْﺗِﻴَﻨِﻲْ ﺑِﻬِﻢْ ﺟَﻤِﻴْﻌﺎً ﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴْﻢُ‘বরং তোমরা মনগড়া একটা কথা নিয়েই এসেছ। এখনধৈর্যধারণই উত্তম। সম্ভবতঃ আল্লাহ তাদের সবাইকে(ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে) একসঙ্গে আমারকাছে নিয়ে আসবেন। তিনি বিজ্ঞ ওপ্রজ্ঞাময়’ (৮৩)। ‘অতঃপর তিনি তাদের দিক থেকেমুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, হায় আফসোসইউসুফের জন্য! (আল্লাহ বলেন,) এভাবে দুঃখেতাঁর চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গেল এবং অসহনীয়মনস্তাপে তিনি ছিলেন ক্লিষ্ট’ (৮৪)। ছেলেরা তখনতাঁকে বলতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! আপনি তোইউসুফের স্মরণ থেকে নিবৃত্ত হবেন না, যেপর্যন্ত না মরণাপন্নহন কিংবা মৃত্যুবরণ করেন’(৮৫)।ইয়াকূব বললেন, ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺃَﺷْﻜُﻮْ ﺑَﺜِّﻲ ﻭَﺣُﺰْﻧِﻲ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺃَﻋْﻠَﻢُﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻻَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ، ﻳَﺎ ﺑَﻨِﻲَّ ﺍﺫْﻫَﺒُﻮْﺍ ﻓَﺘَﺤَﺴَّﺴُﻮْﺍ ﻣِﻦْﻳُﻮﺳُﻒَ ﻭَﺃَﺧِﻴْﻪِ ﻭَﻻَ ﺗَﻴْﺄَﺳُﻮْﺍ ﻣِﻦْ ﺭَّﻭْﺡِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻪُ ﻻَ ﻳَﻴْﺄَﺱُ ﻣِﻦْﺭَّﻭْﺡِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻻَّ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡُ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮُﻭْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৮৬-৮৭ )-‘আমিতো আমার অস্থিরতা ও দুঃখ আল্লাহর কাছেই পেশকরছি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি,তোমরা তা জানো না’ (৮৬)। ‘হে বৎসগণ!যাও ইউসুফও তার ভাইকে তালাশ কর এবং আল্লাহর রহমত থেকেনিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকেকাফের সম্প্রদায় ব্যতীত কেউ নিরাশ হয়না’ (ইউসুফ ১২/৮২-৮৭)।উপরোক্ত ৮৬ ও ৮৭আয়াতে বর্ণিত ইয়াকূব (আঃ)-এর বক্তব্যে ইউসুফ ওবেনিয়ামীনকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদব্যক্ত করা হয়েছে। হ’তে পারে ইউসুফকেহারানোর দীর্ঘ বিরহ-বেদনা এবং নতুনভাবে পাওয়াবেনিয়ামীন হারানোর কঠিন মানসিক ধাক্কা সামালদেওয়ার জন্য আল্লাহ পাক তাঁকে অহী মারফতইঙ্গিত দিয়ে থাকবেন অথবা আল্লাহ তাকে উক্তমর্মে ওয়াদা দিয়ে থাকবেন। ইয়াকূব (আঃ)-এরবক্তব্য ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺃَﺷْﻜُﻮ ﺑَﺜِّﻲ ﻭَﺣُﺰْﻧِﻲ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ ‘আমি আমারঅস্থিরতা ও দুঃখ আল্লাহর কাছে পেশ করছি’ (ইউসুফ১২/৮৬), একথার মধ্যে তাঁর কঠিন ধৈর্যগুণের প্রকাশঘটেছে।পিতার নির্দেশে ছেলেদের পুনরায়মিসরে গমন :ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে খুঁজেবেরকরার জন্য ইয়াকূব (আঃ) ছেলেদেরকে এরূপকঠোর নির্দেশ ইতিপূর্বে কখনো দেননি। তাঁরদৃঢ়তায় ছেলেদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হ’ল।বেনিয়ামীন মিসরে থাকা নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তুইউসুফের ব্যাপারে কোন আশা ছিল না।বলা হয়েথাকে যে, ﺇﺫﺍ ﺃﺭﺍﺩ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻣﺮًﺍ ﻫﻴﺄ ﻟﻪ ﺍﻷﺳﺒﺎﺏ ‘আল্লাহযখন কোন কাজের ইচ্ছা করেন, তখন তারকার্যকারণ সমূহ প্রস্ত্তত করে দেন’।বেনিয়ামীনের উদ্দেশ্যে মিসর যাত্রার মধ্যেইইউসুফ উদ্ধারের বিষয়টি লুকিয়েছিল, যেটা কারু জানাছিল না। তাই আল্লাহর ইচ্ছায় ভাইয়েরা সবাই মিসরেরউদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল।ইউসুফের সৎ ভাইয়েরাপিতার নির্দেশক্রমে মিসর পৌঁছল এবং ‘আযীযেমিছর’-এর সাথে সাক্ষাৎ করল। তারা তাঁর কাছেনিজেদের সাংসারিক অভাব-অনটনের কথা পেশকরল। এমনকি পণ্যমূল্য আনার মত সঙ্গতিও তাদেরনেই বলে জানাল। তদুপরি পরপর দুই পুত্রকেহারিয়ে অতিবৃদ্ধ পিতার করুণ অবস্থার কথাও জানালো।যেমন আল্লাহ বলেন, ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎﺍﻟْﻌَﺰِﻳْﺰُ ﻣَﺴَّﻨَﺎ ﻭَﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ ﺍﻟﻀُّﺮُّ ﻭَﺟِﺌْﻨَﺎ ﺑِﺒِﻀَﺎﻋَﺔٍ ﻣُّﺰْﺟَﺎﺓٍ ﻓَﺄَﻭْﻑِ ﻟَﻨَﺎﺍﻟْﻜَﻴْﻞَ ﻭَﺗَﺼَﺪَّﻕْ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻳَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟْﻤُﺘَﺼَﺪِّﻗِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ৮৮)-‘অতঃপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছল, তখনবলল, হে আযীয! আমরা ও আমাদের পরিবার বর্গকষ্টের সম্মুখীন হয়েছি এবং আমরা অপর্যাপ্ত পুঁজিনিয়ে এসেছি। আপনি আমাদেরকে পুরোপুরি বরাদ্দদিন এবং আমাদেরকে অনুদান দিন। আল্লাহদানকারীদের প্রতিদান দিয়ে থাকেন’ (ইউসুফ১২/৮৮)। উল্লেখ্য যে, এখানে ছাদাক্বার অর্থঅনুদান এবং স্বল্প মূল্যেরবিনিময়ে পুরোপুরি দানকরা।ইউসুফের আত্মপ্রকাশ এবং ভাইদের ক্ষমাপ্রার্থনা :পরিবারের অনটনের কথা শুনে এবং পিতারঅন্ধত্ব ও অসহায় অবস্থারকথা শুনে ইউসুফ আরনিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজেকে প্রকাশকরে দিলেন এবং বললেন, ﻗَﺎﻝَ ﻫَﻞْ ﻋَﻠِﻤْﺘُﻢْ ﻣَﺎ ﻓَﻌَﻠْﺘُﻢﺑِﻴُﻮﺳُﻒَ ﻭَﺃَﺧِﻴﻪِ ﺇِﺫْ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﺟَﺎﻫِﻠُﻮﻥَ – ‘তোমাদের কি জানাআছে যা তোমরা করেছিলে ইউসুফ ও তারভাইয়ের সাথে? যখন তোমরা (পরিণাম সম্পর্কে)অজ্ঞ ছিলে’ (৮৯)। ‘তারা বলল, ﺇِﻧَّﻚَ ﻟَﺄَﻧﺖَ ﻳُﻮﺳُﻒُ؟তবে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেন, ﺃَﻧَﺎ ﻳُﻮﺳُﻒُ ﻭَﻫَـﺬَﺍﺃَﺧِﻲْ ﻗَﺪْ ﻣَﻦَّ ﺍﻟﻠﻪ ُﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ، আমিই ইউসুফ, আর এ হ’লআমার (সহোদর) ভাই। আল্লাহ আমাদের প্রতিঅনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তাক্বওয়াঅবলম্বন করে ও ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ এহেনসৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না’ (৯০)।‘তারা বলল, ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﻟَﻘَﺪْ ﺁﺛَﺮَﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻭَﺇِﻥْ ﻛُﻨَّﺎ ﻟَﺨَﺎﻃِﺌِﻴْﻦَ -‘আল্লাহরকসম! আমাদের উপরে আল্লাহতোমাকে পসন্দ করেছেন এবং আমরা অবশ্যইঅপরাধী ছিলাম’ (৯১)। ‘ইউসুফ বললেন, ﻻَ ﺗَﺜْﺮَﻳﺐَﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻳَﻐْﻔِﺮُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﻜُﻢْ ﻭَﻫُﻮَ ﺃَﺭْﺣَﻢُ ﺍﻟﺮَّﺍﺣِﻤِﻴْﻦَ – ‘আজতোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালুরচাইতে অধিক দয়ালু’ (ইউসুফ ১২/৮৯-৯২)।ইউসুফেরব্যবহৃত জামা প্রেরণ :ভাইদেরকে মাফ করেদেওয়ার পর ইউসুফ তাঁর ব্যবহৃত জামাটি বড় ভাইদেরহাতে দিয়ে বললেন, এই জামাটি নিয়ে পিতার চেহারারউপরে রেখো। তাতেই তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরেপাবেন। অতঃপর তাঁকে সহ তোমাদের সকলেরপরিবারবর্গকে নিয়ে এখানে চলে এসো। একটিবর্ণনায় এসেছে যে, এইসময় ইয়াহূদা বলেছিল, বড়ভাই হিসাবে পিতা সেদিন আমার হাতেই তোমাকেসোপর্দ করেছিলেন। কিন্তু আমি ভাইদের চাপেরমুখে তোমার জামায় মিথ্যা রক্ত মাখিয়ে পিতাকেদেখিয়েছিলাম। আজ আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করতেচাই। তোমার এ জামাটি আমিই স্বহস্তে পিতার মুখেরউপরে রাখব। এর বিনিময়ে তিনি যদি আমাকে ক্ষমাকরে দেন। ইতিপূর্বেবলা হয়েছে যে, এই বড়ভাই-ই সে সময় তিনদিন ধরে গোপনে ইউসুফকেকূয়ায় দেখাশুনা করতেন। এরই পরামর্শে ভাইয়েরাতাকে হত্যা করেনি। বেনিয়ামীনকে হারিয়েমনের দুঃখে এই বড় ভাই-ই মিসর থেকে আরকেন‘আনে ফিরে যায়নি। তাই আজকে ইউসুফকেফিরে পাওয়ার সুসংবাদ এবং তার জামা নিয়ে পিতার চেহারারউপরে রাখার এ মহান দায়িত্ব পালনের অধিকার স্বভাবতঃতার উপরেই বর্তায়। অতঃপর ইউসুফের জামা নিয়েভাইদের কাফেলা মিসর ত্যাগ করে কেন‘আনেরপথে রওয়ানা হ’ল। ওদিকে আল্লাহর বিশেষব্যবস্থাপনায় প্রায় ২৫০ মাইল দূরে ইয়াকূবেরনিকটেউক্ত জামার গন্ধ পৌঁছে গেল। তিনি আনন্দেরআতিশয্যে সবাইকে বলে ফেললেন যে, ﺇِﻧِّﻲﻟَﺄَﺟِﺪُ ﺭِﻳﺢَ ﻳُﻮﺳُﻒَ ওগো তোমরা শুনো! আমিইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’ (১২/৯৪)। নিঃসন্দেহে এটি ছিলমু‘জেযা, যা আল্লাহ যথাসময়ে ইয়াকূবকে প্রদর্শনকরেছেন। কেননা মু‘জেযানবীগণেরইচ্ছাধীন নয়। এটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি সময় ওপ্রয়োজন মাফিক নবীগণের মাধ্যমে তা প্রদর্শনকরে থাকেন।যদি এটা নবীগণের ইচ্ছাধীন হ’ত,তাহ’লে বাড়ীর অদূরে জঙ্গলের এক পরিত্যক্তকূয়ায় ইউসুফ তিনদিন পড়ে রইলেন, তার রক্তমাখা জামাপিতার কাছে দেওয়া হ’ল তখন তো তিনি ইউসুফেরখবর জানতে পারেননি। তাই নবীদের মু‘জেযা হৌকবা দ্বীনদার মুমিনদের কারামত হৌক, কোনটাইব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহরইচ্ছাধীন।ভাইদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের তাৎপর্য:ইউসুফ ভাইদের উপরে কোনরূপ প্রতিশোধনিতে চাননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন তাদের তওবা ওঅনুতাপ। সেটা তিনি যথাযথভাবেই পেয়েছিলেন।কেননা এই দশ ভাইও নবীপুত্র এবং তাদেরই একজন‘লাভী’ ( ﻻﻭﻯ ) -এর বংশের অধঃস্তন চতুর্থ পুরুষহয়ে জন্ম নেন অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলহযরত মূসা (আঃ)।বস্ত্ততঃ ইয়াকূব (আঃ)-এর উক্তবারোজন পুত্রের বংশধারা হিসাবে বনু ইস্রাঈলেরবারোটি গোত্র সৃষ্টি হয় এবং তাদের থেকেইযুগে যুগে জন্ম গ্রহণ করেন লক্ষাধিক নবী ওরাসূল। যাঁদের মধ্যে ছিলেন দাঊদ ও সুলায়মানেরমতশক্তিধর রাষ্ট্রনায়ক, রাসূলও নবী এবং বনু ইস্রাঈলেরসর্বশেষ রাসূল হযরত ঈসা (আঃ)। অতএব বৈমাত্রেয়হিংসায় পদস্খলিত হ’লেও নবী রক্তের অন্যান্যগুণাবলী তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। ইউসুফ (আঃ)তাই তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে নিঃসন্দেহে বিরাটমহত্ত্ব ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।পরবর্তীকালে অর্থাৎ এই ঘটনার প্রায় আড়াই হাযারবছর পরে বনু ইসমাঈলের একমাত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠএবং সর্বশেষ নবী বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ৮ম হিজরীতে মক্কাবিজয়ের দিন তাঁর জানী দুশমন মক্কার কাফেরদেরপ্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনিও সেদিনইউসুফের ন্যায় একই ভাষায় বলেছিলেন, ﻻﺗﺜﺮﻳﺐَﻋﻠﻴﻜﻢُ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﻓﺎﺫﻫﺒﻮﺍ ﻭﺃَﻧﺘﻢُ ﺍﻟﻄُّﻠَﻘﺎﺀُ ‘তোমাদের প্রতিআজ কোন অভিযোগ নেই। যাও! তোমরা মুক্ত’।শুধু তাইনয়, কাফের নেতা আবু সুফিয়ানের গৃহে যেব্যক্তি আশ্রয় নিবে, তাকেও তিনি ক্ষমা ঘোষণাকরে বলেন, ﻣَﻦْ ﺩَﺧَﻞَ ﺩَﺍﺭَ ﺃَﺑﻰ ﺳُﻔﻴﺎﻥَ ﻓﻬﻮ ﺁﻣِﻦٌ ‘যেব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নিবে, সেনিরাপদ থাকবে’।[30] তাতে ফল হয়েছিল এই যে, যারাছিল এতদিন তাঁর রক্ত পিয়াসী, তারাই হ’ল এখন তাঁরদেহরক্ষী। মক্কা বিজয়ের মাত্র ১৯ দিন পরেহুনায়েন যুদ্ধে নওমুসলিম কুরায়েশদেরবীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং দু’বছর পরে আবুবকরেরখেলাফতকালে ইয়ারমূকের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানেরও তার পুত্র ইয়াযীদের এবং আবু জাহ্ল-পুত্র ইকরিমারকালজয়ী ভূমিকা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাইবিদ্বেষী সৎ ভাইদের ক্ষমা করে দিয়ে ইউসুফ(আঃ) নবীসুলভ মহানুভবতা এবং রাষ্ট্রনায়কোচিতদূরদর্শিতারপরিচয় দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।ঘটনাটির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ﺍﺫْﻫَﺒُﻮﺍ ﺑِﻘَﻤِﻴﺼِﻲ ﻫَـﺬَﺍﻓَﺄَﻟْﻘُﻮﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻪِ ﺃَﺑِﻲ ﻳَﺄْﺕِ ﺑَﺼِﻴﺮﺍً ﻭَﺃْﺗُﻮﻧِﻲ ﺑِﺄَﻫْﻠِﻜُﻢْﺃَﺟْﻤَﻌِﻴﻦَ – ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﻓَﺼَﻠَﺖِ ﺍﻟْﻌِﻴﺮُ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺑُﻮﻫُﻢْ ﺇِﻧِّﻲ ﻟَﺄَﺟِﺪُ ﺭِﻳﺢَﻳُﻮﺳُﻒَ ﻟَﻮْﻻَ ﺃَﻥ ﺗُﻔَﻨِّﺪُﻭﻥِ – ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻚَ ﻟَﻔِﻲ ﺿَﻼَﻟِﻚَﺍﻟْﻘَﺪِﻳﻢِ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৩-৯৫)-ইউসুফ তার ভাইদের বললেন,‘তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও। এটি আমার পিতারচেহারার উপরে রেখো। এতে তাঁর দৃষ্টিশক্তিফিরে আসবে। আর তোমাদের পরিবারবর্গেরসবাইকে আমার কাছে নিয়ে আস’। ‘অতঃপর কাফেলাযখন রওয়ানা হ’ল, তখন (কেন‘আনে) তাদের পিতাবললেন, যদি তোমরা আমাকে অপ্রকৃতিস্থনাভাবো, তবে বলি যে, আমি নিশ্চিতভাবেইইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’। ‘লোকেরা বলল, আল্লাহরকসম! আপনি তো আপনার সেই পুরানোভ্রান্তিতেই পড়ে আছেন’ (ইউসুফ ১২/৯৩-৯৫)।ইয়াকূব (আঃ) দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন :যথাসময়েকাফেলা দীর্ঘ সফর শেষেবাড়ীতে পৌঁছল এবংবড়ভাই ইয়াহূদা ছুটে গিয়ে পিতাকে ইউসুফের সুসংবাদদিলেন। অতঃপর ইউসুফের প্রদত্ত জামা পিতার মুখেরউপরে রাখলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় সাথে সাথে তাঁরদৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। খুশীতে উদ্বেলিত ওআনন্দে উৎফুল্ল বৃদ্ধ পিতা বলে উঠলেন, ‘আমি কিবলিনি যে, আল্লাহর নিকট থেকে আমিযা জানি,তোমরা তা জানো না’। অর্থাৎ ইউসুফ জীবিতআছে এবং তার সাথে আমার সাক্ষাত হবে, এ খবরআল্লাহ আমাকে আগেই দিয়েছিলেন। বিষয়টিরকুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﻥْ ﺟَﺎﺀَ ﺍﻟْﺒَﺸِﻴْﺮُ ﺃَﻟْﻘَﺎﻩُﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻬِﻪِ ﻓَﺎﺭْﺗَﺪَّ ﺑَﺼِﻴْﺮﺍً ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻟَﻢْ ﺃَﻗُﻞ ﻟَّﻜُﻢْ ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﻣِﻦَﺍﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻻَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৬)-‘অতঃপর যখন সুসংবাদ দাতা(ইয়াহূদা) পৌঁছল, সে জামাটি তার (ইয়াকূবের) চেহারারউপরে রাখল। অমনি সে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলএবং বলল, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমিআল্লাহর পক্ষ থেকেযা জানি, তোমরা তা জানোনা’? (ইউসুফ ১২/৯৬)।ঘামের গন্ধে দৃষ্টিশক্তি ফেরাসম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য :ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যবহৃতজামা প্রেরণ ও তা মুখের উপরে রাখার মাধ্যমেদৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার এ বিষয়টির উপর বর্তমানেগবেষণা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে,মানবদেহের ঘামের মধ্যে এমন উপাদান আছে যারপ্রতিক্রিয়ায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসা সম্ভব। উক্তগবেষণার মূল সূত্র ছিল ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যবহৃত জামামুখের উপরে রাখার মাধ্যমে ইয়াকূব (আঃ)-এরদৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার কুরআনী বর্ণনা।[31]পিতারনিকটে ছেলেদের ক্ষমা প্রার্থনা :প্রকৃত ঘটনাসবার নিকটে পরিষ্কার হয়ে গেলে লজ্জিত ওঅনুতপ্ত বিমাতা ভাইয়েরা সবাই এসে পিতার কাছেকরজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং আল্লাহরনিকটে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুরোধকরল। যেমন আল্লাহ বলেন, ﻗَﺎﻟُﻮﺍْ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﺍﺳْﺘَﻐْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎﺫُﻧُﻮْﺑَﻨَﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﺧَﺎﻃِﺌِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻝَ ﺳَﻮْﻑَ ﺃَﺳْﺘَﻐْﻔِﺮُﻟَﻜُﻢْ ﺭَﺑِّﻲ ﺇِﻧَّﻪُﻫُﻮَ ﺍﻟْﻐَﻔُﻮﺭُ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴﻢُ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৭-৯৮)-‘তারা বলল, হেআমাদের পিতা! আমাদের অপরাধ মার্জনার জন্যআল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আমরাগোনাহগার ছিলাম’। ‘পিতা বললেন, সত্বর আমি আমারপালনকর্তার নিকটে তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইব।নিশ্চয়ই তিনিক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইউসুফ ১২/৯৭-৯৮)।ইয়াকূব-পরিবারের মিসর উপস্থিতি ও স্বপ্নেরবাস্তবায়ন :৯৩ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইউসুফ তারভাইদেরকে তাদের পরিবারবর্গসহ মিসরে আসতেবলেছিলেন। মিসরে তাদের এই যাওয়াটাই ছিলকেন‘আন থেকে স্থায়ীভাবে তাদের মিসরেহিজরত। আরবের ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্নকরেছিল, ইয়াকূব পরিবারের মিসরেহিজরতের কারণকি? তার জবাব এটাই যে, ইউসুফের আহবানে ইয়াকূবপরিবার স্থায়ীভাবে মিসরে হিজরত করেছিল এবংপ্রায় চারশ’ বছর পরে সেখানে মূসা (আঃ)-এরআবির্ভাবকালে তাদের সংখ্যা ছিল মিসরের মোটজনসংখ্যার ১০ হ’তে ২০ শতাংশের মত।[32]মিসরথেকে ভাইদের কেন‘আনে ফেরৎ পাঠানোরসময় কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক ইউসুফ (আঃ)দু’শো উট বোঝাই খাদ্য-শস্য ও মালামাল উপঢৌকনস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন, যাতে তারা যাবতীয় দায়-দেনাচুকিয়ে ভালভাবে প্রস্ত্ততি নিয়ে মিসরেস্থায়ীভাবে ফিরে আসতে পারে। ইয়াকূব পরিবারসেভাবেই প্রস্ত্ততি নিলেন। অতঃপর গোটা পরিবারবিরাট কাফেলানিয়ে কেন‘আন ছেড়ে মিসরঅভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। এই সময় তাদের সংখ্যানারী-পুরুষ সব মিলে ৭০ জন অথবা তার অধিক ছিলবলে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে।[33]অপর দিকে মিসর পৌঁছার সময় নিকটবর্তী হ’লেইউসুফ (আঃ) ও নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদেরঅভ্যর্থনার জন্য বিশাল আয়োজন করেন। অতঃপরপিতা-মাতা ও ভাইদের নিয়ে তিনি শাহী মহলে প্রবেশকরেন। ইউসুফের শৈশবকালেতার মা মৃত্যুবরণ করারকারণে তার আপন খালাকে পিতা বিবাহ করেন,ফলেতিনিই মা হিসাবে পিতার সাথে আগমন করেন। তবেকেউ বলেছেন, তাঁরনিজের মা এসেছিলেন।[34]অতঃপর তিনি পিতা-মাতাকে তাঁর সিংহাসনেবসালেন। এরপরবর্তী ঘটনা হ’ল শৈশবে দেখা স্বপ্নবাস্তবায়নের অনন্য দৃশ্য। এ বিষয়ে বর্ণিতকুরআনী ভাষ্য নিম্নরূপ: ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﺁﻭَﻯﺇِﻟَﻴْﻪِ ﺃَﺑَﻮَﻳْﻪِ ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﺩْﺧُﻠُﻮْﺍ ﻣِﺼْﺮَ ﺇِﻥْ ﺷَﺂﺀ ﺍﻟﻠﻪُ ﺁﻣِﻨِﻴْﻦَ- ﻭَﺭَﻓَﻊَﺃَﺑَﻮَﻳْﻪِ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺮْﺵِ ﻭَﺧَﺮُّﻭْﺍ ﻟَﻪُ ﺳُﺠَّﺪﺍً ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﻫَـﺬَﺍﺗَﺄْﻭِﻳْﻞُ ﺭُﺅْﻳَﺎﻱَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﻗَﺪْ ﺟَﻌَﻠَﻬَﺎ ﺭَﺑِّﻲْ ﺣَﻘّﺎً ﻭَﻗَﺪْ ﺃَﺣْﺴَﻦَﺑِﻲْ ﺇِﺫْ ﺃَﺧْﺮَﺟَﻨِﻲْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﻭَﺟَﺎﺀَ ﺑِﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﺒَﺪْﻭِ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﺃَﻥ ﻧَّﺰَﻍَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥُ ﺑَﻴْﻨِﻲْ ﻭَﺑَﻴْﻨَﺈِﺧْﻮَﺗِﻲْ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲْ ﻟَﻄِﻴﻒٌ ﻟِّﻤَﺎﻳَﺸَﺂﺀُ، ﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴْﻢُ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৯-১০০)-‘অতঃপরযখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছল, তখন ইউসুফ পিতা-মাতাকে নিজের কাছে নিল এবং বলল, আল্লাহ চাহেনতো নিঃশংকচিত্তে মিসরে প্রবেশ করুন’। ‘অতঃপরসে তাঁর পিতা-মাতাকে সিংহাসনে বসালো এবংতারা সবাইতার সম্মুখে সিজদাবনতহ’ল। সে বলল, হে পিতা!এটিই হচ্ছে আমার ইতিপূর্বে দেখা স্বপ্নেরব্যাখ্যা। আমার পালনকর্তা একে বাস্তবে রূপায়িতকরেছেন। তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবংআপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন,শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টিকরে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা চান, সুক্ষ্মকৌশলে তা সম্পন্ন করেন। নিশ্চয়ই তিনি বিজ্ঞ ওপ্রজ্ঞাময়’ (ইউসুফ ১২/৯৯-১০০)।দীর্ঘবিচ্ছেদের পর পিতা-পুত্রের মিলনের সময়ইউসুফের কথাগুলি লক্ষণীয়। তিনি এখানে ভাইদেরদ্বারা অন্ধকূপে নিক্ষেপের কথা এবংপরবর্তীতে যোলায়খার চক্রান্তে কারাগারেনিক্ষেপের কথা চেপে গিয়ে কেবলকারামুক্তিথেকে বক্তব্য শুরু করেছেন। তারপরপিতাকে গ্রাম থেকে শহরে এনে মিলনের কথাও উন্নত জীবনে পদার্পণের কথা বলেছেন।অতঃপর ভাইদের হিংসা ও চক্রান্তের দোষটিশয়তানের উপরে চাপিয়ে দিয়ে ভাইদেরকেবাঁচিয়ে নিয়েছেন। সবকিছুতে আল্লাহর অনুগ্রহেরস্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশকরেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটিউচ্চাঙ্গের বর্ণনা এবং এতে মহানুভব ব্যক্তিদেরজন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।উল্লেখ্য যে,ইয়াকূবী শরী‘আতে সম্মানের সিজদা বা সিজদায়েতা‘যীমী জায়েয ছিল। কিন্তু মুহাম্মাদীশরী‘আতে এটা হারাম করা হয়েছে। এমনকি সালামকরার সময় মাথা নত করা বা মাথা ঝুঁকানোও হারাম। এরমাধ্যমে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের প্রতি সিজদা করারদূরতম সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।ইউসুফের দো‘আ :এভাবে ইউসুফের শৈশবকালীনস্বপ্ন যখন স্বার্থক হ’ল, তখন তিনি কৃতজ্ঞ চিত্তেআল্লাহর নিকটে প্রাণভরে দো‘আ করেননিম্নোক্ত ভাষায়- ﺭَﺏِّ ﻗَﺪْ ﺁﺗَﻴْﺘَﻨِﻲْ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﻠْﻚِ ﻭَﻋَﻠَّﻤْﺘَﻨِﻲْﻣِﻦْ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞِ ﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳْﺚِ ﻓَﺎﻃِﺮَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽِ ﺃَﻧْﺖَ ﻭَﻟِﻴِّﻲْﻓِﻲ ﺍﻟﺪُّﻧُﻴَﺎ ﻭَﺍﻵﺧِﺮَﺓِ ﺗَﻮَﻓَّﻨِﻲْ ﻣُﺴْﻠِﻤﺎًﻭَّﺃَﻟْﺤِﻘْﻨِﻲْ ﺑِﺎﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴْﻦَ-‏( ﻳﻮﺳﻒ ১০১)-‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকেরাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন এবং আমাকে(স্বপ্নব্যাখ্যা সহ) বাণীসমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যাদানের শিক্ষা প্রদান করেছেন। নভোমন্ডল ওভূমন্ডলের হে সৃষ্টিকর্তা! আপনিই আমারকার্যনির্বাহী দুনিয়া ও আখেরাতে। আপনি আমাকে‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান করুন এবং আমাকেসৎকর্মশীলদের সাথে মিলিত করুন’ (ইউসুফ১২/১০১)।ইউসুফের উক্ত দো‘আর মধ্যে যুগেযুগে সকল আল্লাহভীরু মযলূমের হৃদয় উৎসারিতপ্রার্থনা ফুটে বেরিয়েছে। সকল অবস্থায়আল্লাহর উপরে ভরসাকারী ও সমর্পিত চিত্তব্যক্তির জন্য ইউসুফ (আঃ)-এর জীবনীনিঃসন্দেহে একটি অনন্য সাধারণ প্রেরণাদায়কদৃষ্টান্ত।ইউসুফের প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা :সূরা আল-আন‘আমের ৮৩ হ’তে ৮৬ আয়াতে আল্লাহ পাকএকই স্থানে পরপর ১৮ জন নবীর নাম উল্লেখপূর্বক তাঁদের প্রশংসা করে বলেন, আমি তাদেরপ্রত্যেককে সুপথ প্রদর্শন করেছি,সৎকর্মশীলহিসাবে তাদের প্রতিদান দিয়েছি এবংতাদের প্রত্যেককে আমরা সারাবিশ্বের উপরেশ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি ( ﻭَﻛُﻼًّ ﻓﻀَّﻠْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ ) -(৮৬)। তারা প্রত্যেকে ছিল পুণ্যবানদেরঅন্তর্ভুক্ত ( ﻛُﻞٌّ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ ) -(৮৫)। বস্ত্ততঃ ঐ ১৮জন প্রশংসিত নবীর মধ্যে হযরত ইউসুফওরয়েছেন (আন‘আম ৬/৮৪)।ইউসুফকে আল্লাহসম্ভবতঃ ছহীফা সমূহ প্রদান করেছিলেন, যেমনইতিপূর্বে ইবরাহীম (আঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল(আ‘লা ৮৭/১৯)।আল্লাহ তাঁকে নবুঅত ও হুকূমত উভয়মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। মানুষ তাঁর প্রশংসায়পঞ্চমুখ থাকলেও মিসরবাসী সকলে তাঁর দ্বীনকবুল করেনি। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ ইউসুফেরপ্রশংসা করেন এবং মানুষের সন্দেহবাদের নিন্দাকরে বলেন, ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺟَﺎﺀَﻛُﻢْ ﻳُﻮْﺳُﻒُ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﺑِﺎﻟْﺒَﻴِّﻨَﺎﺕِﻓَﻤَﺎ ﺯِﻟْﺘُﻢْ ﻓِﻲْ ﺷَﻚٍّ ﻣِّﻤَّﺎ ﺟَﺎﺀَﻛُﻢْ ﺑِﻪِ ﺣَﺘَّﻰ ﺇِﺫَﺍ ﻫَﻠَﻚَ ﻗُﻠْﺘُﻢْ ﻟَﻦْﻳَّﺒْﻌَﺚَ ﺍﻟﻠﻪ ُﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﻩِ ﺭَﺳُﻮْﻻً ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻳُﻀِﻞُّ ﺍﻟﻠﻪ ُﻣَﻦْ ﻫُﻮَﻣُﺴْﺮِﻑٌ ﻣُّﺮْﺗَﺎﺏٌ -‘ইতিপূর্বে তোমাদের কাছে ইউসুফসুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ আগমন করেছিল। অতঃপরতোমরা তার আনীত বিষয়ে সর্বদা সন্দেহপোষণ করতেথাক। অবশেষে যখন সে মারাগেল, তখন তোমরা বললে, আল্লাহ ইউসুফেরপরে কখনো আর কাউকে রাসূল রূপে পাঠাবেননা… (অথচ রিসালাতের ধারা অব্যাহত ছিল)। আল্লাহএমনিভাবে সীমালংঘনকারী ও সন্দেহবাদীদেরপথভ্রষ্ট করে থাকেন’ (মুমিন ৪০/৩৪)।শেষনবীরপ্রতি আল্লাহর সম্বোধন ও সান্ত্বনা প্রদান :৩থেকে ১০১ পর্যন্ত ৯৯টি আয়াতে ইউসুফেরকাহিনী বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করার পর আল্লাহ পাকশেষনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন, ﺫَﻟِﻚَ ﻣِﻦْ ﺃَﻧﺒَﺎﺀِﺍﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻧُﻮْﺣِﻴْﻪِ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨْﺖَ ﻟَﺪَﻳْﻬِﻢْ ﺇِﺫْ ﺃَﺟْﻤَﻌُﻮﺍ ﺃَﻣْﺮَﻫُﻢْﻭَﻫُﻢْ ﻳَﻤْﻜُﺮُﻭْﻥَ – ‘এগুলি হ’ল গায়েবী খবর, যা আমরাতোমার কাছে প্রত্যাদেশ করলাম। তুমি তাদেরনিকটে (অর্থাৎ ইউসুফ ভ্রাতাদের নিকটে) ছিলে না,যখন তারা তাদের পরিকল্পনা অাঁটছিল এবং ষড়যন্ত্রকরছিল’ (ইউসুফ ১২/১০২)।এর দ্বারা আল্লাহ একথাবুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রায় আড়াই হাযার বছরপূর্বে ঘটে যাওয়া ইউসুফ ও ইয়াকূব পরিবারের এইঅলৌকিক ঘটনা ও অশ্রুতপূর্ব কাহিনী সবিস্তারে ওসঠিকভাবে বর্ণনা করা নবুঅতে মুহাম্মাদীর একঅকাট্য দলীল। কুরআন অবতরণের পূর্বে এ ঘটনামক্কাবাসী মোটেই জানত না। যেমন আল্লাহঅন্যত্র বলেন, ﺗِﻠْﻚَ ﻣِﻦْ ﺃَﻧﺒَﺎﺀِ ﺍﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻧُﻮْﺣِﻴْﻬَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﻣَﺎﻛُﻨْﺖَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻬَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﻭَﻻَ ﻗَﻮْﻣُﻚَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞِ ﻫَـﺬَﺍ ، ‘ইতিপূর্বে(নবীদের) এ সকল ঘটনা না তুমি জানতে, না তোমারস্বজাতি জানত’ (হূদ ১১/৪৯)।ইমাম বাগাভী (রহঃ) বলেন,(মদীনা থেকে প্রেরিত) ইহুদী প্রতিনিধি এবংকুরায়েশ নেতারা একত্রিতভাবে রাসূলকে ইউসুফ ওইয়াকূব-পরিবারের ঘটনাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞেসকরেছিল। তাদের প্রশ্নের জবাবে অহীরমাধ্যমে প্রাপ্ত উপরোক্ত ঘটনাবলী সুন্দরভাবেবলে দেওয়া সত্ত্বেও এবং তা তাওরাতেরঅনুকূলে হওয়া সত্ত্বেও যখন তারা অবিশ্বাস ওকুফরীতে অটল রইল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)অন্তরে দারুন আঘাত পেলেন। এ সময় আল্লাহতাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে পরবর্তী আয়াত নাযিল করেবলেন, ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻛْﺜَﺮُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻟَﻮْ ﺣَﺮَﺻْﺖَ ﺑِﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ – ‘তুমিযতই আকাংখা কর, অধিকাংশ লোক বিশ্বাস স্থাপনকারীনয়’ (ইউসুফ ১২/১০৩; তাফসীরে বাগাভী)। অর্থাৎনবী হিসাবে একমাত্র কাজ হ’ল প্রচার করা ও সাধ্যমতসংশোধনের চেষ্টা করা। চেষ্টাকে সফল করারদায়িত্ব বা ক্ষমতা কোনটাই নবীরএখতিয়ারাধীন নয়।কাজেই লোকদের অবিশ্বাস বা অস্বীকারে দুঃখকরার কিছুই নেই। যেমন আল্লাহ অন্যত্রবলেন, ﻧَﺤْﻦُ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﺑِﻤَﺎ ﻳَﻘُﻮْﻟُﻮْﻥَ ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺑِﺠَﺒَّﺎﺭٍﻓَﺬَﻛِّﺮْ ﺑِﺎﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻣَﻦ ﻳَّﺨَﺎﻑُ ﻭَﻋِﻴْﺪِ -‘তারা যা বলে আমরা তাসম্যক অবগত আছি। তুমি তাদের উপরেযবরদস্তিকারী নও। অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয়করে, তাকে কুরআনের মাধ্যমে উপদেশদাও’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)।ইউসুফের কাহিনী এক নযরে :(১) জন্মের বৎসরাধিক কাল পরেই মায়ের মৃত্যু (২)অতঃপর ফুফুর কাছে লালন-পালন (৩) ফুফু ও পিতারস্নেহের দ্বন্দ্বে ফুফু কর্তৃক চুরির অপবাদপ্রদান। অতঃপর চুরির শাস্তি স্বরূপ ফুফুর দাসত্ব বরণ (৪)শৈশবে স্বপ্ন দর্শন ও পিতার নিকটে বর্ণনা (৫)পিতৃস্নেহের আধিক্যের কারণে ভ্রাতৃ হিংসায় পতিতহন এবং তাকে হত্যার চক্রান্ত হয় (৬) পরেজঙ্গলে নিয়ে হত্যার বদলে অন্ধকূপে নিক্ষেপকরা হয় (৭) সেখান থেকে প্রসিদ্ধ মতে তিন দিনপরে একটি পথহারা ব্যবসায়ী কাফেলার নিক্ষিপ্তবালতিতে করে উপরে উঠে আসেন (৮) অতঃপরভাইদের মাধ্যমে ব্যবসায়ী কাফেলার নিকটেক্রীতদাস হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়ে যান (৯)অতঃপর ‘আযীযে মিছর’ ক্বিৎফীরের গৃহেক্রীতদাস হিসাবে পদার্পণ করেন ও পুত্রস্নেহেলালিত-পালিত হন (১০)যৌবনে গৃহস্বামীর স্ত্রীযোলায়খার কু-নযরে পড়েন (১১) অতঃপর সেখানথেকে ব্যভিচার চেষ্টার মিথ্যা অপবাদে কারাগারেনিক্ষিপ্ত হন (১২) প্রসিদ্ধ মতে সাত বছর কারাগারেথাকার পর বাদশাহর স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের অসীলায়বেকসূর খালাস পান এবং তার পূর্বে সম্ভবতঃজেলখানাতেই তাঁর নবুঅত লাভ হয় (১৩) অতঃপরবাদশাহর নৈকট্যশীল হিসাবে বরিত হন (১৪) এ সময়ক্বিৎফীরের মৃত্যু এবং বাদশাহর উদ্যোগেযুলায়খার সাথে ইউসুফের বিবাহ হয় বলে ইস্রাঈলীবর্ণনায় প্রতিভাত হয়। তবে এতে মতভেদরয়েছে। (১৫) বাদশাহ ইসলাম কবুল করেন বলেবর্ণিত হয়েছে এবং ইউসুফকে অর্থমন্ত্রণালয় সহদেশের পুরা শাসনভার অর্পণ করে তিনি নির্জনবাসীহন (১৬) দুর্ভিক্ষের সাত বছরের শুরুতেকেন‘আন থেকে ইউসুফের সৎ ভাইয়েরাখাদ্যের সন্ধানে মিসরে আসেন এবং তিনি তাদেরচিনতে পারেন। দ্বিতীয়বার আসার সময় তিনিবেনিয়ামীনকে সাথে আনতে বলেন (১৭)বেনিয়ামীনকে আনার পর বিদায়ের সময় তার খাদ্য-শস্যেরবস্তার মধ্যে ওযনপাত্র রেখে দিয়েকৌশলে ‘চোর’(?) বানিয়ে তাকে নিজের কাছেআটকে রাখেন (১৮) বেনিয়ামীনকে হারানোরমনোকষ্টে বেদনাহত পিতা ইয়াকূব স্বীয় পুত্রইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে একত্রে পাওয়ারব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে বিশেষ জ্ঞানঅথবা গোপন অহী লাভ করেন (১৯) ইউসুফ ওবেনিয়ামীনকে খুঁজে আনার জন্য ছেলেদেরপ্রতি তিনি কড়া নির্দেশ দেন এবং সেমতে তারাপুনরায় মিসর গমন করেন (২০) এই সময় আযীযেমিছরের সঙ্গে সাক্ষাৎ কালে ভাইদের মুখেবৃদ্ধপিতার ও দুস্থ পরিবারের দুরবস্থার কথা শুনে ব্যথিতইউসুফ নিজেকে প্রকাশ করে দেন। (২১) তখনভাইয়েরা তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবংনিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন (২২)ইউসুফেরনির্দেশে ভাইয়েরা কেন‘আনে ফিরে যান এবংইউসুফের দেওয়া তার ব্যবহৃত জামা তার পরামর্শমতেঅন্ধ পিতার চেহারার উপরে রাখার সাথে সাথে তিনিদৃষ্টিশক্তি ফিরে পান (২৩) অতঃপরইউসুফেরআবেদনক্রমে গোটা ইয়াকূব-পরিবার মিসরেস্থায়ীভাবে হিজরত করে (২৪) মিসরে তাদেরকেরাজকীয় সন্বর্ধনা প্রদান করা হয় এবং প্রসিদ্ধ মতেচল্লিশ বছর পর পিতা ও পুত্রের মিলন হয়। (২৫)অতঃপর পিতা-মাতা ও ১১ ভাই ইউসুফকে সম্মানের সিজদাকরেন। (২৬) এভাবে শৈশবে দেখা ইউসুফেরস্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় এবং একটি করুণ কাহিনীরআনন্দময় সমাপ্তি ঘটে।ইয়াকূব (আঃ)-এর মৃত্যু :ইয়াকূব(আঃ) মিসরে ১৭ বছর বসবাস করার পর ১৪৭ বছরবয়সে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন এবং অছিয়তঅনুযায়ী তাঁকে কেন‘আনে পিতা ইসহাক ও দাদাইবরাহীম (আঃ)-এর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।[35]ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যু:ইউসুফ (আঃ) ১২০ বছরবয়সে মিসরে ইন্তেকাল করেন। তিনিওকেন‘আনে সমাধিস্থ হওয়ার জন্য অছিয়ত করে যান।তাঁর দুই ছেলে ছিল ইফরাঈম ও মানশা।[36]কেন‘আনের উক্ত স্থানটি এখন ফিলিস্তীনেরহেবরন এলাকায় ‘আল-খলীল’ নামে পরিচিত। আল্লাহবলেন, ﻟَﻘَﺪْ ﻛَﺎﻥَ ﻓِﻲ ﻗَﺼَﺼِﻬِﻢْ ﻋِﺒْﺮَﺓٌ ﻟِّﺄُﻭْﻟِﻲ ﺍﻷَﻟْﺒَﺎﺏِ ،‘নিশ্চয়ই নবীগণের কাহিনীতে জ্ঞানীদেরজন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে’ (ইউসুফ১২/১১১)।ঐতিহাসিক মানছূরপুরী (মৃ: ১৩৪৯/১৯৩০ খৃ:)বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এর অবস্থার সাথে আমাদেরনবী (ছাঃ)-এর অবস্থার পুরোপুরি মিল ছিল। দু’জনেইসৌন্দর্য ও পূর্ণতার অধিকারী ছিলেন। দু’জনকেইনানাবিধ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হয়েছে।দু’জনের মধ্যে ক্ষমা ও দয়াগুণের প্রাচুর্য ছিল।দু’জনেই স্ব স্ব অত্যাচারী ভাইদের উদ্দেশ্যেসাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেছিলেন, ﻻَﺗَﺜْﺮِﻳْﺐَﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনঅভিযোগ নেই’। দু’জনেই আদেশ দানের ও শাসনক্ষমতার মালিক ছিলেন এবং পূর্ণ কামিয়াবী ওপ্রতিপত্তি থাকা অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায়হয়েছেন’।[37]পূর্বে বর্ণিত ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সাথে মানছূরপুরীর বর্ণনার মধ্যে কিছুগরমিল রয়েছে। ঐতিহাসিকগণের মধ্যে এরূপমতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আমাদেরবক্তব্য এই যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছেরবাইরে সকল বক্তব্যের উৎস হ’ল ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহ। সেখানে বক্তব্যের ভিন্নতার কারণেই মুসলিমঐতিহাসিকদের বক্তব্যে ভিন্নতা এসেছে। এইসঙ্গে এটাও জানা আবশ্যক যে, ইহুদীরা ছিলআল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকারকারী,অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যাকারী, আল্লাহরকিতাবসমূহকে বিকৃতকারী ও তার মাধ্যমে দুনিয়াউপার্জনকারী এবং নবীগণের চরিত্র হননকারী।বিশেষ করে ইউসুফ, দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা ও তাঁরমায়ের উপরে যে ধরনের জঘন্য অপবাদ সমূহ তারারটনা করেছে, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। অতএবইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে তাদের বর্ণিত অভব্য ওআপত্তিকর বিষয়াবলী থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।সংশয় নিরসন :সূরা ইউসুফের মোট ৯ (নয়)টিআয়াতের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদরয়েছে। আয়াতগুলি হ’ল যথাক্রমে৪, ৬, ৮, ১৫, ২৪,২৬, ২৮, ৪২ ও ৫২ আমরা এখানে সেগুলি সংক্ষেপেতুলে ধরবএবং গৃহীত ব্যাখ্যাটি পেশ করব।-১. আয়াতসংখ্যা ৪ : ( ﺃَﺣَﺪَ ﻋَﺸَﺮَ ﻛَﻮْﻛَﺒﺎً ) ‘এগারোটি নক্ষত্র’। জনৈকইহুদীরপ্রশ্নের উত্তরে রাসূলের বরাত দিয়েউক্ত ১১টি নক্ষত্রের নাম সহ হাদীছ বর্ণনা করাহয়েছে।[38]যাদেরকে ইউসুফ আকাশে তাকেসিজদাকরতে দেখেন। অথচ হাদীছটি ভিত্তিহীন।এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল, ইউসুফের বাকী ১১ ভাইহ’লেন ১১টি নক্ষত্র এবং তাঁর পিতা-মাতা হ’লেন সূর্য ওচন্দ্র, যারা একত্রে ইউসুফকে সম্মানের সিজদাকরেন। যা বর্ণিত হয়েছে সূরা ইউসুফ ১০০ নম্বরআয়াতে।২. আয়াত সংখ্যা ৬ : ( ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻚَ ﻣِﻦ ﺗَﺄْﻭِﻳﻞِﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳﺚِ ) ‘এবং তোমাকে বাণী সমূহের নিগুঢ়তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন’। এখানে একদল বিদ্বানবলেছেন, ‘বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব’ অর্থআল্লাহর কিতাব ও নবীগণের সুন্নাত সমূহেরঅর্থউপলব্ধি করা। এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল : স্বপ্নব্যাখ্যা দানের ক্ষমতা, যা বিশেষভাবে হযরত ইউসুফ(আঃ)-কে দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর বাণী সমূহ, যাতাঁর কিতাব সমূহে এবং নবীগণের সুন্নাত সমূহেবিধৃত হয়েছে, সেসবের ব্যাখ্যাও এর মধ্যে শামিলরয়েছে।৩. আয়াত সংখ্যা ৮ : ( ﺇِﻥَّ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻟَﻔِﻲ ﺿَﻼَﻝٍﻣُّﺒِﻴﻦٍ ) ‘নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যেরয়েছেন’। ইউসুফের বিমাতা দশ ভাই তাদের পিতাহযরত ইয়াকূব (আঃ)-কে একথা বলেছিল শিশুপুত্রইউসুফ ও তার ছোট ভাই বেনিয়ামীনের প্রতি তাঁরস্নেহাধিক্যের অভিযোগ এনে। একই কথা তাঁকেপরিবারের অন্যেরা কিংবা প্রতিবেশীরাও বলেছিল,যখনইউসুফের সাথে সাক্ষাতের পর তার ব্যবহৃত জামানিয়ে ভাইদের কাফেলা কেন‘আনের উদ্দেশ্যেমিসরত্যাগ করছিল। পিতা ইয়াকূব তখন বলেছিলেন, ﺇِﻧِّﻲﻟَﺄَﺟِﺪُ ﺭِﻳْﺢَ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ‘আমি ইউসুফের গন্ধপাচ্ছি’ (ইউসুফ৯৪)। জবাবে লোকেরা বলেছিল,ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻚَ ﻟَﻔِﻲْ ﺿَﻼَﻟِﻚَ ﺍﻟْﻘَﺪِﻳْﻢِ ‘আল্লাহর কসম! আপনিতো সেই পুরানোভ্রান্তিতেই পড়েআছেন’ (ইউসুফ ৯৫)।এখানে ‘ভ্রান্তি’ ( ﺿﻠﻞ ) অর্থ‘প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে না জানা’। যেমন শেষনবী(ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ﻭَﻭَﺟَﺪَﻙَ ﺿَﺎﻻًّﻓَﻬَﺪَﻯ ‘তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথহারা।অতঃপর তিনি পথ দেখিয়েছেন’ (আয-যোহা ৭)।অতএবগৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল এই যে, এখানে ﺿﻼﻝ বাভ্রান্তি কথাটি আভিধানিক অর্থে এসেছে পারিভাষিকঅর্থে নয়। কেননা পারিভাষিক অর্থে ﺿﻼﻝ বাভ্রষ্টতার অর্থ ﺿﻼﻝ ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻳﻦ ‘ধর্মচ্যুত হওয়া’।নবীপুত্র হিসাবে ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পিতানবী ইয়াকূবকে নিশ্চয়ই ধর্মচ্যুত কাফের বলেনি।৪. আয়াত সংখ্যা ১৫ : ( ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺫَﻫَﺒُﻮﺍ ﺑِﻪِ ﻭَﺃَﺟْﻤَﻌُﻮﺍْ ﺃَﻥﻳَّﺠْﻌَﻠُﻮْﻩُ ﻓِﻲ ﻏَﻴَﺎﺑَﺔِ ﺍﻟْﺠُﺐِّ ﻭَﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻟَﺘُﻨَﺒِّﺌَﻨَّﻬُﻢْ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻫِﻢْﻫَـﺬَﺍ ﻭَﻫُﻢْ ﻻَ ﻳَﺸْﻌُﺮُﻭْﻥَ ) ‘অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়েযাত্রা করল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতেএকমতহ’ল, তখন আমরা তাকে অহী (ইলহাম) করলামযে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যই তুমিতাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিতকরবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবে না’।এখানে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন ‘যখন তারাতাকে নিয়ে যাত্রা করল’-এর ﻟَﻤَّﺎ অর্থাৎ ‘যখন’-এরজওয়াব নিয়ে। অর্থাৎ কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেনা পরেএই ইলহাম হয়েছিল। কোন কোন বিদ্বানবলেছেন, কূপে নিক্ষিপ্তহওয়ার পর ভাইয়েরা যখনরক্ত মাখা জামা নিয়ে পিতার নিকটে এসে কৈফিয়তপেশ করে (ইউসুফ ১৭), তখন ইউসুফকে সান্ত্বনাদিয়ে এ ইলহাম করা হয়।এক্ষেত্রে গৃহীত ব্যাখ্যাহ’ল: ( ﻭَﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ )-এর ﻭﺍﻭ এসেছে ( ﻟَﻤَّﺎ )-এরজওয়াব হিসাবে এবং তা বাক্যে ﺻﻠﺔ হয়েছে। ফলেব্যাখ্যা দাঁড়াবে এই যে, কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়ারপূর্বেই এ ইলহাম করা হয়েছিল। আর এটি বাস্তবায়িতহয়েছিল বহু বৎসর পরে যখন ইউসুফের সঙ্গেতার ভাইদের সাক্ষাৎ হয়। অথচ তারা তাঁকে চিনতেপারেনি (ইউসুফ ৫৮)। ইউসুফ তার ভাইদের সেদিনবলেছিলেন, ‘তোমাদের কি জানা আছে যাতোমরা করেছিলে ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে?যখন তোমরা (পরিণাম সম্পর্কে) অজ্ঞ ছিলে’?‘তারা বলল, তবে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেন, আমিইইউসুফ, আর এ হ’ল আমার (সহোদর) ভাই। আল্লাহআমাদেরপ্রতি অনুগ্রহ করেছেন… (ইউসুফ৮৯-৯০)।৫. আয়াত সংখ্যা ২৪ : ( ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻫَﻤَّﺖْ ﺑِﻬِﻮَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ﻟَﻮْﻻَﺃَﻥ ﺭَّﺁ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ) ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তাকরেছিল। আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি নাসে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত..’।এখানে প্রথম প্রশ্ন হ’লঃ ইউসুফ উক্ত মহিলার প্রতিকোনরূপ অন্যায় কল্পনা করেছিলেন কি-না।দ্বিতীয় প্রশ্ন হ’ল, তিনি যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে‘প্রমাণ’ ( ﺑﺮﻫﺎﻥ) অবলোকন করেছিলেন সেটা কি?প্রথম প্রশ্নের জওয়াব হ’ল দ্বিবিধ: (১)অনিচ্ছাকৃতভাবে কল্পনা এসে থাকতে পারে। যাবেগানা নারী-পুরুষের মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তুবুদ্বুদের ন্যায় উবে যাওয়া চকিতের এই কল্পনাকোন পাপের কারণ নয়। কেননা তিনি নিজেকেসংযত রেখেছিলেন এবং ছুটেঘর থেকেবেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ নবী হিসাবে যেটাতাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহ বলেন, ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﻣَﻦْ ﺧَﺎﻑَﻣَﻘَﺎﻡَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻭَﻧَﻬَﻰ ﺍﻟﻨَّﻔْﺲَ ﻋَﻦِ ﺍﻟْﻬَﻮَﻯ، ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔَ ﻫِﻲَﺍﻟْﻤَﺄْﻭَﻯ – ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সত্তাকে ভয় করেএবং নিজেকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখে’,‘নিশ্চয়ই জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৪০-৪১)।মুনাফিকদের কুপরামর্শে ওহোদের যুদ্ধ থেকেবনু হারেছাহ ও বনু সালামাহ পালিয়ে আসতেচেয়েছিল। কিন্তু পালায়নি। যে বিষয়ে আল্লাহবলেন, ﺇِﺫْ ﻫَﻤَّﺖْ ﻃَّﺂﺋِﻔَﺘَﺎﻥِ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺃَﻥ ﺗَﻔْﺸَﻼَ ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُﻭَﻟِﻴُّﻬُﻤَﺎﻭَﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﻠْﻴَﺘَﻮَﻛَّﻞِ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨُﻮْﻥَ ‘যখন তোমাদের দু’টিদল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহতাদের অভিভাবক ছিলেন, আর আল্লাহর উপরেইবিশ্বাসীদের ভরসা করা উচিত’ (আলেইমরান ১২২)।এখানে একই ﻫَﻤَّﺖْ (কল্পনা করছিল) ক্রিয়া ব্যবহার করাহয়েছে। অথচ আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন এবংনিজেকে তাদের অভিভাবক বলে বরং তাদের প্রশংসাকরেছেন। উল্লেখ্য যে, ﻫَﻢٌّ বা কল্পনাদু’ধরনের হয়ে থাকে। এক- ﻫﻢ ﺛﺎﺑﺖ বা দৃঢ় কল্পনা,যা আযীয-পত্নী করেছিল ইউসুফের প্রতি। দুই-ﻫﻢ ﻋﺎﺭﺽ অনিচ্ছাকৃত কল্পনা, যাতে কোন দৃঢ়সংকল্প থাকে না। ইউসুফের মধ্যে যদি এটা এসেথাকে বলে মনে করা হয়, তবে তাতে তিনিদোষী হবেন না। কেননা তিনি ঐ কল্পনার কথামুখে বলেননি বা কাজে করেননি। বরং তার বিরুদ্ধেবলেছেন ও করেছেন।দ্বিতীয় জওয়াব হ’ল এইযে, ইউসুফের মনে আদৌ কোন অন্যায় কল্পনাআসেনি। প্রমাণ মওজুদ থাকার কারণে এটা তাঁরচরিত্রে নিষিদ্ধ ছিল। মুফাসসির আবু হাইয়ান স্বীয়তাফসীর ‘বাহরুল মুহীত্বে’ একথা বলেন। তিনিবলেন, এমতাবস্থায় আয়াতটির বর্ণনা হবে, ﻟﻮﻻ ﺃﻥ ﺭَّﺁﺑﺮﻫﺎﻥ ﺭﺑﻪ ﻟﻬﻢَّ ﺑﻬﺎ ‘যদি তিনি তার পালনকর্তার প্রমাণ নাদেখতেন, তাহ’লে তার (অর্থাৎ উক্ত মহিলার)ব্যাপারে কল্পনা করতেন’। আলোচ্য আয়াতে ﻟﻮﻻ(যদি) শর্তের জওয়াব আগেই উল্লেখিতহয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ﻟَﻮْﻻ ﺃَﻥ ﺭَّﺁﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ‘আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি নাসে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত’।আর সেই ‘বুরহান’ বা প্রমাণ ছিল আল্লাহ নির্ধারিত‘নফসে লাউয়ামাহ’ অর্থাৎ শাণিত বিবেক, যা তাকেকঠোরভাবে বাধা দিয়েছিল।আরবী সাহিত্যে ওকুরআনে এ ধরনের বাক্যের বহু দৃষ্টান্তরয়েছে। যেমন জান্নাতীগণ বলবেন, ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎﻟِﻨَﻬْﺘَﺪِﻱَ ﻟَﻮْﻻَ ﺃَﻥْ ﻫَﺪَﺍﻧَﺎ ﺍﻟﻠﻪُ ‘আমরা কখনো সুপথপেতাম না, যদি না আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শনকরতেন’ (আ‘রাফ ৪৩)। অর্থাৎ ﻟﻮﻻ ﺃﻥ ﻫﺪﺍﻧﺎ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣﺎﻛﻨﺎ ﻟِﻨﻬﺘﺪﻱَ ‘যদি আল্লাহ আমাদের হেদায়াত নাকরতেন, তাহ’লে আমরা হেদায়াত পেতাম না’।ইউসুফের নিষ্পাপত্ব :ইউসুফ যে এ ব্যাপারে শতভাগনিষ্পাপ ছিলেন, সে বিষয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলিদ্রষ্টব্য:(১) ইউসুফ দৃঢ়ভাবে নিজের নির্দোষিতাঘোষণা করেন। যেমন গৃহস্বামীর কাছে তিনিবলেন, ﻫِﻲَ ﺭَﺍﻭَﺩَﺗْﻨِﻲْ ﻋَﻦْ ﻧَﻔْﺴِﻲْ ‘উক্ত মহিলাইআমাকে প্ররোচিত করেছিল’ (ইউসুফ ২৬)। তারআগে তিনি মহিলার কুপ্রস্তাবের জওয়াবেবলেছিলেন, ﻣَﻌَﺎﺫَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻪُ ﺭَﺑِّﻲْ ﺃَﺣْﺴَﻦَ ﻣَﺜْﻮَﺍﻱَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻻَﻳُﻔْﻠِﺢُ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ ‘আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন! তিনি(অর্থাৎ গৃহস্বামী) আমার মনিব। তিনি আমার উত্তমবসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারীগণ সফলকাম হয় না’ (ইউসুফ ২৩)। নগরীরমহিলাদের সমাবেশে গৃহকত্রী যখন ইউসুফকেতার কুপ্রস্তাবে রাযী না হ’লে জেলে পাঠানোরহুমকি দেন, তখন ইউসুফ তার জওয়াবে বলেছিলেন,ﺭَﺏِّ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦُ ﺃَﺣَﺐُّ ﺇِﻟَﻲَّ ﻣِﻤَّﺎ ﻳَﺪْﻋُﻮﻧَﻨِﻲْ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ‘হে আমারপালনকর্তা! এরা আমাকে যে কাজের দিকে আহবানজানাচ্ছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকটে অধিকপসন্দনীয়’ (ইউসুফ ৩৩)। এখানে তিনি তাদেরচক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় ভিক্ষাকরেন।(২) উক্ত মহিলা নিজেই ইউসুফেরনির্দোষিতার সাক্ষ্য দেন। যেমন নগরীরমহিলাদের সমাবেশে তিনি বলেন, ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦْﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻓَﺎﺳَﺘَﻌْﺼَﻢَ ‘আমি তাকে প্ররোচিত করেছিলাম,কিন্তু সে নিজেকে সংযত রেখেছিল’ (ইউসুফ৩২)। পরবর্তীতে যখন ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়,তখনও উক্ত মহিলা বলেন, ﺍﻵﻥَ ﺣَﺼْﺤَﺺَ ﺍﻟْﺤَﻖُّ ﺃَﻧَﺎﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦْ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻤِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ ‘এখন সত্যপ্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলাম এবং সেছিল সত্যবাদী’ (ইউসুফ ৫১)।(৩) তদন্তকালেনগরীর সকল মহিলা ইউসুফ সম্পর্কে সত্য সাক্ষ্যদেন। তারা বলেন, ﺣَﺎﺵَ ِﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻋَﻠِﻤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻣِﻦْ ﺳُﻮْﺀٍ‘আল্লাহ পবিত্র। আমরা ইউসুফ সম্পর্কে মন্দকিছুইজানি না’ (ইউসুফ ৫১)।(৪) গৃহকর্তা আযীযেমিছর তার নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْﻛَﻴْﺪِﻛُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَﻛُﻦَّ ﻋَﻈِﻴْﻢٌ ‘(হে স্ত্রী!) এটাতোমাদের ছলনা মাত্র। নিঃসন্দেহে তোমাদেরছলনা খুবই মারাত্মক’ (ইউসুফ ২৮)। ‘ইউসুফ! এ প্রসঙ্গছাড়। আর হে মহিলা! এ পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকর। নিশ্চিতভাবে তুমিই পাপাচারিনী’ (ঐ, ২৯)।(৫)গৃহকর্তার উপদেষ্টা ও সাক্ষীএকইভাবে সাক্ষ্যদেন ও বলেন, ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻤِﻴْﺼُﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦْ ﺩُﺑُﺮٍ ﻓَﻜَﺬَﺑَﺖْﻭَﻫُﻮَﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ ‘যদি ইউসুফের জামা পিছন দিকেছেঁড়া হয়, তবে মহিলামিথ্যা বলেছে এবং ইউসুফসত্যবাদী’ (ঐ, ২৭)।(৬) আল্লাহ স্বয়ং ইউসুফেরনির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻟِﻨَﺼْﺮِﻑَ ﻋَﻨْﻪُ ﺍﻟﺴُّﻮْﺀَ ﻭَﺍﻟْﻔَﺤْﺸَﺎﺀَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻋِﺒَﺎﺩِﻧَﺎﺍﻟْﻤُﺨْﻠَﺼِﻴْﻦَ ‘এভাবেই এটা এজন্য হয়েছে, যাতেআমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয়সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে আমাদের মনোনীতবান্দাগণের অন্যতম’ (ঐ, ২৪)।(৭) এমনকি অভিশপ্তইবলীসও প্রকারান্তরে ইউসুফের নির্দোষিতারসাক্ষ্য দিয়েছে। যেমন সে অভিশপ্ত হওয়ার পরআল্লাহ্কে বলেছিল, ﻟَﺄُﻏْﻮِﻳَﻨَّﻬُﻢْ ﺃَﺟْﻤَﻌِﻴْﻦَ، ﺇِﻻَّ ﻋِﺒَﺎﺩَﻙَﻣِﻨْﻬُﻢُ ﺍﻟْﻤُﺨْﻠَﺼِﻴْﻦَ – ‘আমি অবশ্যই তাদের (বনুআদমের) সবাইকে পথভ্রষ্ট করব’। ‘তবে তাদেরমধ্য হ’তে তোমার মনোনীত বান্দাগণ ব্যতীত(হিজর ৩৯-৪০; ছোয়াদ ৮২)। এখানে একই শব্দব্যবহার করে আল্লাহ ইউসুফকে তাঁর ‘মনোনীতবান্দাগণের অন্যতম’ (ইউসুফ ২৪) বলে ঘোষণাকরেছেন।অত্র ২৪ আয়াতে বর্ণিত ( ﺍﻟﺴُّﻮﺀَﻭَﺍﻟْﻔَﺤْﺸَﺎﺀ ) ‘মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয়সমূহ’ অর্থ কি? এবিষয়ে বিদ্বানগণ বলেন, মুখের বা হাতের দ্বারাস্পর্শ করার পাপ এবং প্রকৃত যেনার পাপ। অর্থাৎ উভয়প্রকার পাপ থেকে আল্লাহ ইউসুফকেফিরিয়েনেন।নিকৃষ্ট মনের অধিকারী ইহুদীরা ওতাদেরঅনুসারীরা, যারা ইউসুফের চরিত্রে কালিমা লেপনকরে নানাবিধ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে শত শত পৃষ্ঠামসীলিপ্ত করেছে, তাদের উদ্দেশ্যে ইমামরাযী (রহঃ)বলেন, ‘যেসব মূর্খরা ইউসুফেরচরিত্রে কলংক লেপনের চেষ্টা করে, তারা যদিআল্লাহর দ্বীনের অনুসারী হবার দাবীদার হয়,তাহ’লে তারা এ ব্যাপারে আল্লাহর সাক্ষ্য কবুল করুক।অথবা যদি তারা শয়তানের তাবেদার হয়, তবেইবলীসের সাক্ষ্য কবুল করুক’। আসল কথা এইযে, ইবলীস এখন এদের শিষ্যে পরিণতহয়েছে।এক্ষণে আয়াতের গৃহীত ব্যাখ্যা দু’টিরসারমর্ম হ’ল (১) আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রমাণ মওজুদথাকার কারণে ইউসুফের অন্তরে আদৌ বাজেকল্পনার উদয় হয়নি (২) প্রমাণ দেখার কারণেকল্পনার বুদ্বুদ সাথে সাথে মিলে যায় এবং তিনিআল্লাহর আশ্রয় কামনা করেন ও দৌড়ে ঘর থেকেবেরিয়ে যান।এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল: ঐ ‘বুরহান’ বাপ্রমাণটি কি ছিল, যা তিনি দেখেছিলেন? এ বিষয়েইবনু আববাস,আলী, ইকরিমা, মুজাহিদ, সুদ্দী, সাঈদইবনু জুবায়ের, ইবনু সীরীন,ক্বাতাদাহ, হাসান বাছরী,যুহরী, আওযাঈ, কা‘ব আল-আহবার, ওহাব বিন মুনাবিবহএবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ বিদ্বান মন্ডলীর নামে এমন সবউদ্ভট ও নোংরা কাল্পনিক চিত্রসমূহ তাফসীরেরকেতাব সমূহে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা পড়তেওঘৃণাবোধ হয় ও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। শুরুথেকে এ যাবত কালের কোন তাফসীরেরকেতাবই সম্ভবতঃ এইসব ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক গল্পথেকে মুক্ত নয়। উক্ত মুফাসসিরগণের তাক্বওয়া ওবিদ্যাবত্তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতেবাধ্যহব যে, ইউসুফের প্রতি সুধারণা রাখা সত্ত্বেও তাঁরাপ্রাচীন কালের ইহুদী যিন্দীক্বদের বানোয়াটকাহিনী সমূহের কিছু কিছু স্ব স্ব কিতাবে স্থান দিয়েদুধের মধ্যেবিষ মিশ্রিত করেছেন। যা এ যুগেরনাস্তিক ও যিন্দীক্বদের জন্য নবীগণেরনিষ্পাপত্বের বিরুদ্ধে প্রচারের মোক্ষম হাতিয়ারেপরিণত হয়েছে। অন্যদিকে তা ধর্মভীরু মানুষেরধর্মচ্যুতির কারণ হয়েছে। সাথে সাথে এগুলি কিছুপেট পূজারী কাহিনীকারের রসালো গল্পেরখোরাক হয়েছে। তাফসীরের নামে যাশুনেমানুষ ক্রমেই ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।অতএব ঈমানদারগণ সাবধান!!‘বুরহান’ কি? ﻟَﻮْﻻ ﺃَﻥ ﺭَّﺁﻯ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَﺭَﺑِّﻪِ ‘যদি সে তার পালনকর্তার প্রমাণ না দেখত’ একথার মধ্যে কোন্ প্রমাণ ইউসুফকেদেখানোহয়েছিল, সেটা বলা হয়নি। তবে কুরআনে মানুষেরতিনটি নফসের কথা বলা হয়েছে। (১) নফসেআম্মারাহ। যা মানুষকে অন্যায় কাজে প্ররোচিতকরে (২) নফসে লাউয়ামাহ। যা মানুষকে ন্যায় কাজেউদ্বুদ্ধ করে ও অন্যায় কাজে বাধা দেয় এবং (৩)নফসে মুত্বমাইন্নাহ, যা মানুষকেন্যায়ের উপর দৃঢ়রাখে, আর তাতেদেহমনে প্রশান্তি আসে।নবীগণের মধ্যে শেষের দু’টি নফস সর্বাধিকজোরালোভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। আর নফসেলাউয়ামাহ বা বিবেকের তীব্র কষাঘাতকেই এখানে‘বুরহান’ বা ‘আল্লাহর প্রমাণ’ হিসাবে বলা হয়ে থাকতেপারে। যেমন হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছিরাতেমুস্তাক্বীমের উদাহরণ বর্ণনা করে তার মাথায়একজন আহবানকারীরকথা বলেছেন, যিনি সর্বদামানুষকে ধমক দেন যখনই সে অন্যায়ের কল্পনাকরে। তিনি বলেন, খবরদার! নিষিদ্ধ পর্দা উত্তোলনকরো না। করলেই তুমি তাতে প্রবেশ করবে।এই ধমকদানকারীকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ﻭﺍﻋﻆُ ﺍﻟﻠﻪِﻓﻲ ﻗﻠﺐِ ﻛﻞِّ ﻣﺆﻣﻦٍ ‘প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়েআল্লাহর উপদেশদাতা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[39] ইউসুফের হৃদয়ে নিশ্চয়ই ঐ ধমকদাতা উপদেশদানকারী মওজুদ ছিলেন যাকে( ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ) বা‘আল্লাহর প্রমাণ’ বলা হয়েছে।অতএব এখানে‘বুরহান’ বা প্রমাণ বলতে যেনার মত জঘন্যঅপকর্মের বিরুদ্ধে বিবেকের তীব্রকষাঘাতকেই বুঝানো হয়েছে। যা নবীগণেরহৃদয়ে আল্লাহ প্রোথিত রাখেন। ইমাম জা‘ফরছাদিক্ব বলেন, ‘বুরহান’ অর্থ নবুঅত, যাকেআল্লাহনবীগণের হৃদয়ে গ্রথিত রাখেন। যা তারমধ্যে এবং আল্লাহর ক্রোধপূর্ণ কাজের মধ্যেপ্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। অতএব ‘বুরহান’ অর্থনবুঅতের নিষ্পাপত্ব, যা ইউসুফকে উক্ত পাপথেকে বিরত রাখে।৬. আয়াত সংখ্যা ২৬ : ( ﻭَﺷَﻬِﺪَﺷَﺎﻫِﺪٌ ﻣِّﻦْ ﺃَﻫْﻠِﻬَﺎ ) ‘আর মহিলার পরিবারের জনৈক ব্যক্তিসাক্ষ্য দিল’। কিন্তু কে সেই সাক্ষী? এ নিয়েমুফাসসিরগণের মধ্যে প্রচুর মতভেদ রয়েছে।যেমন কেউ বলেছেন এটি ছিল দোলনার শিশু,কেউ বলেছেন, মহিলার এক দূরদর্শী চাচাতোভাই, কেউ বলেছেন, তিনি মানুষ বা জিন ছিলেন না,বরং আল্লাহর অন্য এক সৃষ্টি ছিলেন। ছাহাবী ওতাবেঈগণের নামেই উক্ত মতভেদগুলি বর্ণিতহয়েছে। অথচ কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলেদিয়েছে যে, ‘ঐ ব্যক্তি ছিলেন মহিলার পরিবারেরসদস্য’ (ইউসুফ ২৬)। এটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয়না যে, লোকটি ছিলেন নিরপেক্ষ ও অত্যন্তজ্ঞানী ব্যক্তি এবং তিনি ছিলেন আযীযে মিছরেরনিকটতমলোক। নইলে তিনি তার সঙ্গেঅন্দরমহলে আসতে পারতেন না।দুর্ভাগ্য যে, এপ্রসঙ্গে একটি হাদীছও বলা হয়ে থাকে।সেখানে বলা হয়েছে যে, চার জন শিশু দোলনায়থাকতে কথা বলেছে, তার মধ্যে ইউসুফেরসাক্ষী একজন। চারজনের মধ্যে তিন জনেরবিষয়টিসঠিক। কিন্তু ইউসুফের সাক্ষী কথাটি মিথ্যা। যারকারণে হাদীছটি যঈফ।[40] ঐ তিন জন হ’লেন, ঈসা(আঃ), ২- জুরায়েজ নামক বনু ইস্রাঈলের জনৈক সৎব্যক্তি, যাকে এক দুষ্টু মহিলা যেনার অপবাদ দেয়।পরে তার বাচ্চা স্বয়ং জুরায়েজ-এর নির্দোষিতারসাক্ষ্য দেয় ও প্রকৃত যেনাকারীর নাম বলে দেয়(মুত্তাফাক্ব আলাইহ)। ৩- শেষনবীরজন্মগ্রহণেরপ্রায় ৪০ বছর পূর্বে সংঘটিত আছহাবুল উখদূদেরঘটনা, যেখানে এক যালেম শাসক বহু গর্ত খুঁড়েসেখানে আগুন জ্বালিয়ে একদিনে প্রায় বিশ হাযারমতান্তরে সত্তুর হাযার ঈমানদার নর-নারীকেজীবন্ত পুড়িয়ে মারে। সে সময় একজন মহিলা তারকোলে থাকা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপদিতেইতস্তত করায় শিশু পুত্রটি বলে উঠেছিল ﺇﺻﺒِﺮﻯﻳﺎﺍُﻣَّﻪْ ﻓﺈﻧﻚِ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺤﻖ ‘ছবর কর মা! কেননা তুমিসত্যের উপরে আছ’।[41] এইসব ছহীহহাদীছের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছেইউসুফের সাক্ষীর নাম। অথচ কুরআন স্পষ্টভাবেইবলে দিয়েছে যে, সাক্ষী ছিলেন মহিলাটিরপরিবারের একজন ব্যক্তি। তাছাড়া আরও বলেদিয়েছে উক্ত ব্যক্তির দূরদর্শিতাপূর্ণ পরামর্শ যে,যদি ইউসুফের জামা পিছন দিকে ছেঁড়া হয়, তাহ’লেসে সত্যবাদী’ (ইউসুফ ২৭)। এক্ষণে কীভাবেএকথা বলা যায় যে, ঐ সাক্ষী ছিল দোলনার শিশু বাআল্লাহর অন্য এক সৃষ্টি? যদি তাই হবে, তাহ’লেসেটাই তো যথেষ্ট ছিল। অন্য কোন তদন্তেরদরকার ছিল না বা ইউসুফকে হয়ত জেলও খাটতে হ’তনা।৭. আয়াত সংখ্যা ২৮ : ( ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَﻛُﻦَّ ﻋَﻈِﻴﻢٌ ) ‘নিশ্চয়ইতোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক’। এই আয়াতেরসঙ্গে যদি অন্য একটি আয়াত মিলানো হয়, যেখানেবলা হয়েছে যে, ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﻛَﺎﻥَ ﺿَﻌِﻴْﻔﺎً‘নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল সর্বদাদুর্বল’ (নিসা ৭৬)।তাহ’লে ফলাফল দাঁড়াবে এই যে, মহিলারা শয়তানেরচাইতে মারাত্মক। ইমাম কুরতুবী এর পক্ষে একটিমরফূ হাদীছ এনেছেন, যেখানে বলা হয়েছেযে, ﺇﻥَّ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ ﺃَﻋْﻈَﻢُ ﻣِﻨْﻜَﻴْﺪِ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ‘নিশ্চয়ইনারীদের ছলনা শয়তানের ছলনার চাইতে বড়’। অথচহাদীছটি যঈফ ও জাল।[42] অথচ শয়তানকে আল্লাহক্ষমতা দিয়েছেন মানুষকে পথভ্রষ্ট করার। আর এটাকরেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য, কেশয়তানের ধোঁকায় পড়ে আর কে না পড়ে। পুরুষও নারী উভয়ের মধ্যে ভাল ও মন্দ রয়েছে।উভয়ে শয়তানের খপ্পরে পড়তে পারে। কিন্তুকেউই শয়তানের চাইতে বড়নয়। আলোচ্যআয়াতে দুষ্টু নারীদের ছলনার ভয়ংকরতা বুঝানোহয়েছে। যেকথা একটি ছহীহ হাদীছেআল্লাহররাসূলও বলেছেন যে, ‘জ্ঞানী পুরুষকে হতবুদ্ধিকরার মোক্ষম হাতিয়ার হ’ল নারী’।[43] কেননা সাধারণনীতি এই যে, নারীর প্রতি পুরুষ সহজে দুর্বলহয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে এর অর্থ এটা নয় যে,নারীদের ছলনা শয়তানের চাইতে বড়। এ ধরনেরব্যাখ্যা নারী জাতিকে অপমান করার শামিল।৮. আয়াতসংখ্যা ৪২ : ( ﺍﺫْﻛُﺮْﻧِﻲْ ﻋِﻨْﺪَ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺄَﻧﺴَﺎﻩُ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥُ ﺫِﻛْﺮَ ﺭَﺑِّﻪِﻓَﻠَﺒِﺚَ ﻓِﻲ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺑِﻀْﻊَ ﺳِﻨِﻴْﻦَ ) ‘যে কারাবন্দীসম্পর্কে ইউসুফেরধারণা ছিল যে, সে মুক্তিপাবে, তাকে সে বলে দিল যে, তুমি তোমারমনিবের কাছে আমার কথা আলোচনা করো। কিন্তুশয়তান তাকে তা ভুলিয়ে দেয় ফলে তাঁকে কয়েকবছর কারাগারে থাকতে হয়’।মালেক ইবনে দীনার,হাসান বাছরী, কা‘ব আল-আহবার, ওহাব বিন মুনাবিবহ ওঅন্যান্য বিদ্বানগণের নামে এখানে বিষ্ময়কর সবতাফসীর বর্ণনা করাহয়েছে। যেমন আইয়ূবরোগভোগ করেন সাত বছর, ইউসুফ কারাভোগকরেন সাত বছর, বুখতানছর আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তিভোগ করেন সাতবছর’ (কুরতুবী)। আমরা বুঝতেপারি না আল্লাহর নবীগণের সাথে ফিলিস্তীনেইহুদী নির্যাতনকারী নিষ্ঠুর রাজা বুখতানছরের তুলনাকরার মধ্যে কিসামঞ্জস্য রয়েছে?অন্য একবর্ণনায় এসেছে যে, ইউসুফ যখন কারাবন্দীসাক্ষীকে উক্ত কথা বলেন, তখন তাকে বলা হয়,হে ইউসুফ! তুমি আমাকে ছেড়ে অন্যকেঅভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করলে? অতএব শাস্তি স্বরূপআমি তোমার কারাভোগের মেয়াদ বাড়িয়ে দিলাম।তখন ইউসুফ কেঁদে উঠে বললেন, হে আমারপালনকর্তা! বিপদ সমূহের বোঝা আমার অন্তরকেভুলিয়ে দিয়েছে। সেজন্য আমি একটি কথা বলেফেলেছি। আর কখনো এরূপ বলব না’।অন্য বর্ণনায়এসেছে, জিবরীল কারাগারে প্রবেশ করলেনএবং ইউসুফকে বললেন, বিশ্বপালক তোমাকে সালামদিয়েছেন এবং তোমাকে বলেছেন যে, ইউসুফ!তোমার কি লজ্জা হয়নি যে, তুমি আমাকে ছেড়েমানুষের কাছে সুফারিশ করলে? অতএব আমার সম্মানও উচ্চ মর্যাদার কসম! অবশ্যই আমি তোমাকেকয়েক বছর জেলে রাখব। ইউসুফ বললেন, এরপরেও কি তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট আছেন?জিব্রীল বললেন, হ্যাঁ আছেন। তখন ইউসুফবললেন, তাহ’লে আমি কিছুরই পরোয়া করি না’।অন্যএকজন মুফাসসির বলেছেন, পাঁচ বছর জেল খাটারপরে এই ঘটনা ঘটে। ফলে শাস্তি স্বরূপ তাঁকেআরো সাত বছর জেল খাটতে হয়। এরপরতাঁরমুক্তির অনুমতি হয় এবং বাদশাহ স্বপ্ন দেখেন ওসেই অসীলায় তাঁর মুক্তি হয়’। এভাবে কেউবলেছেন ১২ বছর, কেউ বলেছেন ১৪ বছরজেল খেটেছেন (ইবনুকাছীর)। তবেঅধিকাংশের মতে ৭ বছর। আর কুরআনে রয়েছেকেবল ﺑﻀﻊ ﺳﻨﻴﻦ যার অর্থ হ’ল কয়েক বছর, যা ৩থেকে ৯ অথবা ১০ বছরের মধ্যে (কুরতুবী)।মূলতঃ ইহুদী লেখকরা ইউসুফ (আঃ)-এরকারাভোগকে তাঁর অপরাধের শাস্তি হিসাবে প্রমাণকরার জন্যএরূপ গল্প বানিয়েছে। অথচ এটা আদৌকোন অপরাধ নয়। কেননা ছহীহ হাদীছেএসেছে, ‘আল্লাহ মানুষের সাহায্যে অতক্ষণথাকেন, যতক্ষণ মানুষ মানুষের সাহায্যে থাকে’।[44]অতএব একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কাছেসাহায্য চাইবে এবং পরস্পরকে সাহায্য করবে, এটাইস্বাভাবিক এবং এতে অশেষ নেকী রয়েছে।কিন্তু অপরাধহ’ল সেটাই যখন জীবিত ব্যক্তি কোনমৃত ব্যক্তি বা কোন বস্ত্তর কাছে সাহায্য চায়, অথচতার কোন ক্ষমতা নেই। মুসলিম তাফসীরকারগণওএক্ষেত্রে ধোঁকায় পড়েছেন। এমনকি উক্তমর্মে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে রাসূলের নামে একটিহাদীছও বর্ণিত হয়েছে যে, ﺭﺣﻢ ﺍﻟﻠﻪ ﻳﻮﺳﻒ ﻟﻮﻟﻢﻳﻘﻞ ﺍﻟﻜﻠﻤﺔ ﺍﻟﺘﻲ ﻗﺎﻟﻬﺎ ﻣﺎ ﻟﺒﺚ ﻓﻲ ﺍﻟﺴﺠﻦ ﻃﻮﻝ ﻣﺎ ﻟﺒﺚ،ﺣﻴﺚ ﻳﺒﺘﻐﻲ ﺍﻟﻔﺮﺝ ﻣﻦ ﻋﻨﺪ ﻏﻴﺮ ﺍﻟﻠﻪ – ‘ইউসুফের উপরআল্লাহ রহম করুন! যদি তিনি ঐ কথা না বলতেন যা তিনিকারা সাথীকে বলেছিলেন, তাহ’লে এত দীর্ঘসময় তাঁকে কারাগারে থাকতে হতো না। কেননা তিনিকারামুক্তির জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাহায্যকামনা করেছিলেন’।[45] অথচ হাদীছটি মুনকার ওযঈফ এবং অত্যন্ত দুর্বল। যা থেকে কোনদলীল গ্রহণ করা যায় না (হাশিয়াকুরতুবী; ইবনুকাছীর)। এর বিপরীতছহীহ হাদীছে আবু হুরায়রা(রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) বলেন,ﻟﻮﻟَﺒِﺜْﺖَ ﻓﻰ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﻣﺎ ﻟَﺒِﺚَ ﻳﻮﺳﻒُ ﻷَﺟَﺒْﺖُ ﺍﻟﺪﺍﻋِﻲَ‘ইউসুফ যতদিন জেল খেটেছেন, অতদিন যদি আমিজেল খাটতাম, তাহ’লে আমি বাদশাহর দূতের ডাকেসাড়া দিতাম’।[46] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ﻟﻮ ﻛﻨﺖ ﺃﻧﺎﻷﺳﺮﻋﺖُ ﺍﻹﺟﺎﺑﺔَ ﻭﻣﺎ ﺍﺑﺘﻐﻴﺖُ ﺍﻟﻌﺬﺭَ ‘যদি আমি হ’তাম,তাহ’লে দ্রুত সাড়া দিতাম এবং কোনরূপ ওযর করতামনা’।[47]বস্ত্ততঃ এটি ছিল নবী হিসাবে ইউসুফ (আঃ)-এর পরীক্ষা। আর নবীগণই দুনিয়াতে বেশীপরীক্ষিত হন, যা বহু ছহীহ হাদীছেবর্ণিতহয়েছে।[48]৯. আয়াত সংখ্যা ৫২ : ( ﺫَﻟِﻚَ ﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺃَﻧِّﻲ ﻟَﻢْﺃَﺧُﻨْﻪُ ﺑِﺎﻟْﻐَﻴْﺐِ ) ‘এটা এজন্য যাতে গৃহস্বামী জানতেপারেন যে, আমি তার অগোচরে তার সাথেকোন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি’।এখানে ‘আমি’ কে?গৃহকত্রী না ইউসুফ? বড় বড় মুফাসসিরগণলিখেছেন, ইউসুফ। এজন্য ইবনু আববাস (রাঃ)-এরনামে একটি হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানেবলা হয়েছে যে, বাদশাহ নগরীর মহিলাদের জমাকরে তাদের কাছে ইউসুফ সম্পর্কে জিজ্ঞেসকরলে সবাই বলে যে, আমরা তার ব্যাপারে মন্দকিছু জানি না। তখন আযীয-পত্নী বলেন, এখনসত্য প্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে প্ররোচিতকরেছিলাম এবং সে ছিল সত্যবাদীদেরঅন্তর্ভুক্ত। তখন ইউসুফ বলল, এটা এজন্য যাতেগৃহকর্তা জানতে পারেন যে, আমি তার অসাক্ষাতেতার সাথে কোন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি’। তখনজিবরীল ইউসুফকে গুঁতা মেরে বলেন, যখন ঐনারীর প্রতি তুমি কুচিন্তা করেছিলে তখনও কি নয়?অর্থাৎ তখন কি তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করো নি? জবাবেইউসুফ বলেন, আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না।নিশ্চয়ই মানুষের অন্তর মন্দ প্রবণ’। অন্য বর্ণনায়এসেছে, জিবরীল ইউসুফকেবলেন, যখন তুমিপায়জামা খুলেছিলে, তখনও কি বিশ্বাসঘাতকতাকরোনি? ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলি যে স্রেফ বাজেকথা, তা যেকোন পাঠকই বুঝতে পারেন। অথচএগুলি এমন এমন তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,যা সব সময় আমরা মাথায় রাখি।[49]বস্ত্ততঃ ৫০, ৫১, ৫২ ও৫৩ চারটি আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক বিচার করলেপরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, ৫২ ও ৫৩ আয়াতেরবক্তব্য হ’ল আযীযে মিছরের স্ত্রীর। কেননাঐ সময় ইউসুফ ছিলেন জেলখানায়। তিনি কিভাবেমহিলাদের ঐ মজলিসে হাযির থাকলেনএবং উক্তমন্তব্য করলেন? নগরীর মহিলাদের ও আযীয-পত্নীর স্পষ্ট স্বীকৃতির মাধ্যমে সত্যউদঘাটনের পরেই তো ইউসুফের মুক্তির পথখুলে গেল এবং বাদশাহ বললেন, তাকে আমারকাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার একান্তসহচর করে নেব (ইউসুফ ৫৪)। কুরআনের প্রকাশ্যঅর্থকে পাস কাটিয়ে দূরতম অর্থ গ্রহণের পিছনেনবী বিদ্বেষী ইহুদী লেখকদেরঅপপ্রচারের ফাঁদে পা দেওয়া ছাড়া এগুলি আরকীইবা হ’তে পারে?প্রাচীনতম মুফাসসির হিসাবেইবনু জারীর ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) তাঁর বিখ্যাততাফসীরে এমন অনেক দুর্বল বর্ণনা জমাকরেছেন, যা নবীগণের মর্যাদার খেলাফ। রাসূল(ছাঃ), ছাহাবী, তাবেঈ ও অন্যান্য বিদ্বানগণের নামেসেখানে অসংখ্য যঈফ ও ভিত্তিহীন বর্ণনা জমা করাহয়েছে।যেমন ২৪ আয়াতাংশ ( ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻫَﻤَّﺖْ ﺑﻪ ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ )-এর তাফসীরে ইবনু আববাসের ৮টি সহ ছয়জনবিদ্বানেরমোট ১৪টি উক্তি উদ্ধৃত করার পর তিনিবলেছেন, ﻫﺬﺍ ﻗﻮﻝ ﺟﻤﻴﻊ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺑﺘﺄﻭﻳﻞ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥﺍﻟﺬﻳﻦ ﻋﻨﻬﻢ ﻳﺆﺧﺬ ﺗﺄﻭﻳﻠﻪ ‘এগুলি হ’ল কুরআন ব্যাখ্যায়অভিজ্ঞ সেই সকল বিদ্বানের ব্যাখ্যা সমূহ, যাঁদেরথেকে কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়ে থাকে’।[50] অথচ এসব বিদ্বানগণের নামে উদ্ধৃতবক্তব্যগুলি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত বলে পরবর্তীবিদ্বানগণ স্বীকার করেননি।এভাবে প্রধানতঃ ইবনুজারীরের তাফসীরের উপরে ভিত্তি করেইপরবর্তী বহু খ্যাতনামা মুফাসসির ঐসব ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনাঅথবা এ সবের মর্ম সমূহ স্ব স্ব তাফসীরে স্থানদিয়েছেন। যেমন ওয়াহেদী, বাগাভী, কুরতুবী,ইবনু কাছীর, জালালায়েন, বায়যাভী, কাশশাফ,আলূসী, আবুস সঊদ, শাওকানী প্রমুখবিদ্বানগণ।যদিও তাঁদের অনেকেই এসবের সমর্থক ছিলেননা। তবুও তাঁদের তাফসীরে এসব বর্ণনা স্থান পাওয়ায়লোকেরা তাঁদের নামে সেগুলি অন্যদের নিকটবর্ণনা করে এবং জনগণ বিভ্রান্ত হয়। অবস্থাদাঁড়িয়েছে এই যে, নবীগণের শত্রু হিব্রুভাষীইহুদী যিন্দীক্বদের কপট লেখনীগুলোআরবী ভাষী মুসলিম বিদ্বানগণের মাধ্যমেবিশ্বের সর্বত্র প্রচারিত হয়েছে। বিদ্বানগণেরসরলতা এভাবেই অনেক সময় অন্যদেরপথভ্রষ্টতার কারণ হয়।শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ(রহঃ) বলেন, ﻭﺃﻣﺎ ﻣﺎ ﻳﻨﻘﻞ ﺃﻧﻪ ﺣﻞ ﺳﺮﺍﻭﻳﻠﻪ ﻭﺟﻠﺲﻣﺠﻠﺲ ﺍﻟﺮﺟﻞ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺮﺃﺓ ﻭﺃﻧﻪ ﺭﺃﻯ ﺻﻮﺭﺓ ﻳﻌﻘﻮﺏ ﻋﺎﺿﺎًﻋﻠﻰ ﻳﺪﻩ ﻭﺃﻣﺜﺎﻝ ﺫﻟﻚ ﻓﻜﻠﻪ ﻣﻤﺎ ﻟﻢ ﻳﺨﺒﺮ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻪ ﻭﻻﺭﺳﻮﻟﻪ ﻭ ﻣﺎﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻛﺬﻟﻚ ﻓﻬﻮ ﻣﺄﺧﻮﺫ ﻋﻦ ﺍﻟﻴﻬﻮﺩ ﺍﻟﺬﻳﻦﻫﻢ ﺃﻋﻈﻢ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻛﺬﺑًﺎ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﻧﺒﻴﺎﺀ ﻭﻗﺪﺣﺎً ﻓﻴﻬﻢ، ﻭﻛﻞﻣﻦ ﻧﻘﻠﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺴﻠﻤﻴﻦ ﻓﻌﻨﻬﻢ ﻧﻘﻠﻪ، ﻟﻢ ﻳﻨﻘﻞ ﻣﻦ ﺫﻟﻚﺃﺣﺪ ﻋﻦ ﻧﺒﻴﻨﺎ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺣﺮﻓﺎًﻭﺍﺣﺪﺍً-‘অতঃপর যেসব কথা বর্ণিত হয়েছে যে,ইউসুফ তার পাজামা খুলে ফেলেছিলেন ও উক্তনারীর উপর উদ্যত হয়েছিলেন এবং এ সময় তিনি তারপিতাকে দাঁতে নিজ আঙ্গুল কামড়ে ধরা অবস্থায়দেখেছিলেন- এধরনের কাহিনী সমূহের সবটাইঐসমস্ত কথার অন্তর্ভুক্ত, যে বিষয়ে আল্লাহ এবংতাঁর রাসূল কোন খবর দেননি। আর তা আদৌ ঐরূপ নয়।বরং এগুলি ইহুদীদের কাছ থেকে গৃহীত, যারানবীগণের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও অপবাদ দেওয়ারব্যাপারে মানবজাতির মধ্যে সেরা। মুসলমানদেরমধ্যে যারা এসব বিষয়ে বলে, তারা তাদের থেকেনকলকরে বলে। অথচ তাদের কেউ এবিষয়েআমাদের নবী (ছাঃ) থেকে একটি হরফওবর্ণনা করেনি’।[51] তিনি আরও বলেন, ﻭﻗﺪ ﺍﺗﻔﻖﺍﻟﻨﺎﺱ ﻋﻠﻰ ﺃﻧﻪ ﻟﻢ ﺗﻘﻊ ﻣﻨﻪ ﺍﻟﻔﺎﺣﺸﺔ ﻭﻟﻜﻦ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱﻳﺬﻛﺮ ﺃﻧﻪ ﻭﻗﻊ ﻣﻨﻪ ﺑﻌﺾ ﻣﻘﺪﻣﺎﺗﻬﺎ – ‘বিদ্বানগণ এ বিষয়েএকমত যে, ইউসুফ থেকে কোন ফাহেশা কাজহয়নি। তবে কিছু লোক বর্ণনা করে যে, তাঁরথেকে উক্ত কাজের প্রারম্ভিক কিছু নমুনা পাওয়াগিয়েছিল। যেমন তারা এ বিষয়ে কিছু বর্ণনা করেথাকে। যার কোনটাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে নয়। বরংকিছু ইহুদী থেকে তারা এগুলি বর্ণনা করে থাকেমাত্র’।[52]উল্লেখ্য যে, সূরা ইউসুফ-এর ৪২আয়াতটিকে লুফে নিয়ে একদল কাহিনীকার কল্পনারঘোড়া দৌড়িয়ে এমনকি মহাকাব্য পর্যন্ত রচনাকরেছেন। এ ব্যাপারে ফারসী ভাষায় কবিফেরদৌসীর (মৃঃ ৪১৬ হিঃ/১০২৫ খৃঃ) ‘মাছনাবী ইউসুফ-যোলেখা’ ( ﻣﺜﻨﻮﻯ ﻳﻮﺳﻒ ﺯﻟﻴﺨﺎ ) কাব্য প্রসিদ্ধ।যদিও এটি তাঁর সময়কার অজ্ঞাত কোন কবিরলেখনী বলে অনেকে ধারণা করেন। তারপর তাতুর্কী ভাষায় অনুদিত হয়। অতঃপর ফারসী ও তুর্কীভাষা হ’তে তা এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিতও রূপান্তরিত হয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।দিল্লীর সুলতান গিয়াছুদ্দীন আযম শাহের সময়(১৩৮৯-১৪১০ খৃঃ) পনের শতকের প্রথম মুসলিম কবিশাহ মুহাম্মাদ ছগীর সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম বাংলায় ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। বর্তমানে নামধারী কিছুমুফাসসিরে কুরআন গ্রামে ও শহরে তাফসীরমাহফিলের নামে কয়েকদিন ব্যাপী ইউসুফ-যুলায়খাররসালো কাহিনী শুনিয়ে থাকেন। অথচ ‘যুলায়খা’নামটিরও কোন সঠিক ভিত্তি নেই। কুরআনে কেবলﺍﻣﺮﺃﺓ ﺍﻟﻌﺰﻳﺰ বা ‘আযীয-পত্নী’ বলা হয়েছে।নবী বিদ্বেষী ইহুদী গল্পকারদের খপপরেপড়ে মুসলমান গল্পকারগণ আজকাল রীতিমতমুফাসসিরে কুরআন বনে গেছেন।অতএব জান্নাতপিয়াসী পাঠক, গবেষক, লেখক, আলেম, মুফতীও বক্তাগণকে অবশ্যই সাবধান হ’তে হবে এবংমন্দটা বাদ দিয়ে ভালটা বাছাই করে নিতে হবে।নইলে ক্বিয়ামতের মাঠে জওয়াবদিহিতার সম্মুখীনহ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন-আমীন![আলোচনা দ্রষ্টব্যঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মজমূ‘ফাতাওয়া ‘তাফসীর’ অধ্যায়; মুহাম্মাদ আল-আমীনশানক্বীত্বী, তাফসীর আযওয়াউল বায়ান (বৈরুত:‘আলামুলকুতুব, তাবি); ডঃ মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ, আল-ইস্রাঈলিয়াত (কায়রোঃ মাকতাবাতুস সুন্নাহ ৪র্থ সংস্করণ১৪০৮); ডঃ তাহের মাহমূদ, আসবাবুল খাত্বা ফিততাফসীর (দাম্মাম, সঊদী আরব, দার ইবনুল জাওযী১ম সংস্করণ ১৪২৫ হিঃ) প্রভৃতি]ইউসুফের কাহিনীতেশিক্ষণীয় বিষয় সমূহ:(১) ইউসুফের কাহিনীতেএকথা পূর্ণভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, আল্লাহ পাকতাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেই পরিণামে বিজয়ী করেন।এই বিজয় তো আখেরাতে অবশ্যই। তবেদুনিয়াতেও হ’তে পারে।(২) আল্লাহর কৌশল বান্দাবুঝতে পারে না। যদিও অবশেষে আল্লাহর কৌশলইবিজয়ী হয়। যেমন অন্ধকূপে নিক্ষেপ করেঅতঃপর বিদেশী কাফেলার কাছে ক্রীতদাসহিসাবে বিক্রি করে দিয়ে ইউসুফের ভাইয়েরানিশ্চিন্ত হয়ে ভেবেছিল যে, আপদ গেল। কিন্তুআল্লাহ তাঁর নিজস্ব কৌশলে ইউসুফকে দেশেরসর্বোচ্চ পদে আসীন করলেন এবংভাইদেরকে ইউসুফের কাছে আনিয়ে অপরাধস্বীকারে বাধ্য করলেন’ (ইউসুফ ৯১)। যেটাইউসুফ নিজে কখনোই পারতেন না।(৩) সর্বাবস্থায়আল্লাহর উপরে ভরসা করা ও সুন্দরভাবে ধৈর্য ধারণকরাই হ’ল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।সেজন্যেই দেখা গেছে যে, ইউসুফ (আঃ)জেলে গিয়েও সর্বদা আল্লাহরউপরে ভরসাকরেছেন ও সুন্দরভাবে ধৈর্য ধারণ করেছেন।অন্যদিকে পিতা ইয়াকূব (আঃ) সন্তান হারিয়ে পাগলপরাহ’লেও তাঁর যাবতীয় দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহরনিকটে পেশ করে ধৈর্য ধারণ করেছেন’ (ইউসুফ৮৬)।(৪) নবীগণ মানুষ ছিলেন। তাই মনুষ্যসূলভপ্রবণতা ইয়াকূব ও ইউসুফের মধ্যেও ছিল।ইউসুফের শোকে ইয়াকূবের বিরহ-বেদনা এবংআযীযের গৃহে চরিত্র বাঁচানো কঠিন হবেবিবেচনায় ইউসুফের কারাগারকে বেছে নেওয়ারআগ্রহ প্রকাশের মধ্যে উপরোক্ত দুর্বলতারপ্রমাণ ফুটে ওঠে। কিন্তু তাঁরা সর্বাবস্থায় আল্লাহরপ্রতি নিবিষ্টচিত্ত থাকার কারণে আল্লাহর অনুগ্রহেনিষ্পাপ থাকেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাঁর প্রত্যেকতাক্বওয়াশীল বান্দার প্রতি একইরূপ অনুগ্রহ করেথাকেন।(৫) ইউসুফের কাহিনী কেবল তিক্তবাস্তবতার এক অনন্য জীবন কাহিনীনয়। বরং বিপদেও সম্পদে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ও তাঁরউপরে একান্ত নির্ভরতার এক বাস্তব দলীল।(৬)ইউসুফের কাহিনীর সার-নির্যাসহ’ল ‘তাওহীদ’ অর্থাৎ‘তাওহীদে ইবাদত’। কারণ এখানে বাস্তব ঘটনাবলীদিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে যে, কেবলআল্লাহর স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, বরং জীবনেরসকল ক্ষেত্রে তাঁর দাসত্ব করা ও তাঁর বিধান মেনেচলার মধ্যেই বান্দার প্রকৃত মঙ্গল ও সার্বিক কল্যাণনির্ভর করে। যেমন ইউসুফের সৎ ভাইয়েরাআল্লাহকে মানতো। কিন্তু তাঁর বিধান মানেনি বলেইতারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও লজ্জিত হয়েছিল। অথচইউসুফ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আল্লাহরদাসত্বে ও তাঁর বিধান মানায় অটল থাকায় আল্লাহ তাঁকেঅনন্য পুরস্কারে ভূষিত করেন ও মহা সম্মানেসম্মানিত করেন।[1]. বুখারী, মিশকাত হা/৪৮৯৪‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ১৩।[2]. কুরতুবী, ইউসুফ৭; ইবনু জারীর হা/১৮৭৮৬ ইবনু আববাস হ’তে।[3].উল্লেখ্য যে, ইউসুফ (আঃ)-এর চরিত্র বাইবেলেঅত্যন্ত বিকৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে (দ্রঃ সুলায়মানমানছূরপুরী, রহমাতুললিল আলামীন ২/২৪৪-২৪৬।[4].ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়াল নিহায়াহ ১/১৯০।[5].আল-বিদায়াহ ১/১৯৬-১৯৭। তবে মানছূরপুরী বলেন,তাঁর বিবাহ ‘আসনাথ’ নাম্নী এক মহিলার সাথে হয়েছিল।-রাহমাতুললিল আলামীন ৩/১০৭। হ’তে পারেদু’জনেই তাঁর স্ত্রী ছিলেন।[6]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৪ পৃঃ।[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৩ ‘মি‘রাজ’অধ্যায়।[8]. বুখারী হা/৩৩৮০ ‘নবীর গুণাবলী’অনুচ্ছেদ।[9]. ইবনু কাছীর, ইউসুফ ৫৬-৫৭।[10].ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৬-১৯৭ পৃঃ।[11]. তারীখুল আম্বিয়া পৃঃ ১/১২৪পৃঃ।[12]. আল-বিদায়াহ১/১৮৪ পৃঃ।[13]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ইউসুফ৭৭।[14]. কুরতুবী, ইউসুফ ৪, ১০০ আয়াত।[15].কুরতুবী, ইউসুফ ১৯; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ১/১৮৯।[16]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ইউসুফ ১৯।[17]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ১/১৮৮।[18]. ইবনুকাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৮৯; হাকেম২/৩৭৬ হা/৩৩২০, হাকেম একে ‘ছহীহ’ বলেছেনএবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।[19]. বুখারীহা/৬১২৬ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ৩১ অনুচ্ছেদ; মুসলিমহা/১৩১ ‘ঈমান’ অধ্যায় ৬১ অনুচ্ছেদ; মুসলিম, মিশকাতহা/৫৮৬৩ ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।[20]. যঈফুল জামে‘হা/৪৭৬২, ৪৭৭৫।[21]. তাফসীর কুরতুবী, ইউসুফ২৬-২৮।[22]. তিরমিযী হা/৩৩৩২ ‘তাফসীর’ অধ্যায় ১৩অনুচ্ছেদ ‘সূরা ইউসুফ’; ছহীহ তিরমিযী হা/২৪৯০সনদ হাসান; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৫‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়, ‘সৃষ্টির সূচনা ওনবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।[23]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৬।[24]. তাফসীরেকুরতুবী, ইউসুফ ৫৫।[25]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৬-১৯৭।[26]. বুখারী, মিশকাত হা/১৫৫‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ; মির‘আত১/২৫২।[27]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৭।[28].তাফসীর ইবনু কাছীর, ইউসুফ ৫৮-৬২।[29].তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর,ইউসুফ ৫৮-৫৯।[30].আর-রাহীকুল মাখতূম (কুয়েতঃ১৪১৪/১৯৯৪), পৃঃ ৪০৫,৪০১।[31]. সূরা ইউসুফ ৮৪ এবং ৯৩-৯৬ আয়াতগুলিগবেষণা করে মিসরের সরকারী ‘ন্যাশনাল সেন্টারঅফ রিসার্চেস ইন ইজিপ্ট’-এর মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. আবদুল বাসিত মুহাম্মাদ মানুষেরদেহের ঘাম থেকে একটি ‘আইড্রপ’ আবিষ্কারকরেন, যা দিয়ে ২৫০ জন রোগীর উপরপরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, কোনরূপপার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই ৯০%-এর বেশী চোখেরছানি রোগ সেরে যায় ও তারা দৃষ্টি ফিরে পায়।ইতিমধ্যে এই ঔষধটি ‘ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনালপ্যাটেন্ট ১৯৯১’ এবং ‘আমেরিকান প্যাটেন্ট ১৯৯৩’লাভ করেছে। এছাড়া একটি সুইস ঔষধকোম্পানীরসাথে তাঁর চুক্তি হয়েছে এই মর্মেযে, তারা তাদের ঔষধের প্যাকেটের উপর‘মেডিসিন অফ কুরআন’ লিখে তা বাজারে ছাড়বে।-সূত্র: ইন্টারনেট।[32]. মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ওমাসায়েল (ঢাকাঃ ১৯৯৬), ৫/২৫০ পৃঃ।[33]. ইবনু কাছীর,আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৪।[34]. ইবনু কাছীর,আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, ১/১৮৪, ২০৪।[35]. ইবনুকাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৫।[36] . ঐ, পৃঃ১/২০৬, ১৯৬।[37]. সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী,রহমাতুল লিল আলামীন(সুইওয়ালাঁ দিল্লী-২ : ই‘তিক্বাদপাবলিশিং হাউস, ১ম সংস্করণ ১৯৮০ খৃঃ), ৩/১৩৩ পৃঃ।[38].আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/১৮৬।[39] . রাযীন, আহমাদ,মিশকাত হা/১৯১সনদ ছহীহ, ‘কিতাব ও সুন্নাহকেঅাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।[40]. আলবানী, যঈফুলজামে‘ হা/৪৭৬২,৪৭৭৫।[41]. আহমাদ, সনদ ছহীহ,রাবী ছোহায়েব (রাঃ), সিলসিলা যঈফাহ হা/৮৮০।[42].মারাসীলু ইবনে আবী হাতেম হা/৪২৯; কুরতুবী,ঐ, ২৮ আয়াত, ৯/১৫০ পৃঃ।[43]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ,মিশকাত হা/১৯ ‘ঈমান’ অধ্যায়।[44]. মুসলিম, মিশকাতহা/২০৪ ‘ইল্ম’অধ্যায়।[45]. কুরতুবী হা/৩৬৭০-৭১; ইবনুজারীর, ইবনু কাছীর, ত্বাবারাণী, ইবনু হিববান প্রভৃতি।[46]. বুখারী হা/৩৩৭২, ৩৩৮৭, ৪৬৯৪, ৬৯৯২; মুসলিম,নাসাঈ, আহমাদ; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৫‘কিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ওনবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।[47]. আহমাদহা/৯২৯৮ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ), হাদীছ হাসান।[48].সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৬৭; ছহীহুল জামে‘হা/৯৯৪-৯৬।[49]. যেমন ১-সঊদী সরকার প্রকাশিত ওমাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত করাচীর মুফতীমুহাম্মাদ শফী কৃত তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআনেবক্তব্যটি ইউসুফের বলে লেখা হয়েছে (পৃঃ৬৬৯)। ২-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বঙ্গানুবাদে ১৩১নং টীকাতে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশতাফসীরকারেরমতে ৫২ ও ৫৩ নম্বর আয়াতেবর্ণিতকথাগুলি হযরত য়ূসুফের উক্তি (ঐ,পৃঃ ৩৬৭)। ৩-তাফসীর ইবনে কাছীরের অনুবাদে ডঃ মুজীবুররহমান ব্রাকেটে লিখেছেন, ‘ইউসুফ বললেন’ (ঐ,দারুস সালাম, রিয়াদ পৃঃ ৪৫৫)। ৪- মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ীঅনূদিত ঐ উর্দূ তাফসীরে একই অনুবাদ করাহয়েছে, যা সঊদী সরকার কর্তৃক পাকিস্তানেরছালাহুদ্দীন ইউসুফের তাফসীর সহ প্রকাশিতহয়েছে (ঐ, পৃঃ ৬৫৬)। ৫- সঊদী সরকার প্রকাশিতইংরেজী অনুবাদেও (পৃঃ ৩১০) একই কথা লেখাহয়েছে। ৬- অথচ আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী তাঁরইংরেজী তাফসীরে সঠিক অর্থ করেছেন (ঐ,পৃঃ ৫৭০)। ৭- অন্যদিকে মাওলানা মওদূদী কেবল এটিইউসুফের উক্তি বলে সমর্থনই করেননি, উল্টা এরবিরোধিতা করার কারণে ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনু কাছীরপ্রমুখ জগদ্বিখ্যাত বিদ্বানগণকে কটাক্ষ করেতাফসীর লিখেছেন (ঐ, বঙ্গানুবাদ ৬/১০৪ পৃঃ)।আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।[50]. দ্রঃ তাফসীর ত্বাবারী(বৈরুতঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ১২/১০৮-১১০ পৃঃ।[51].দাক্বায়েকুত তাফসীর ৩/২৭৩ পৃঃ।[52]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া‘তাফসীর’ অধ্যায় (কায়রোঃ ১৪০৪ হিঃ) ১৫/১৪৮-৪৯ পৃঃ।

হযরত ইউসুফ আঃ এর জীবনী পার্ট -এক

 



  1. হযরত ইউসুফ (আ:) part 1. হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)সূচীপত্র সূরা নাযিলের কারণ সুন্দরতম কাহিনীআরবী ভাষায় কেন?কাহিনীর সার-সংক্ষেপসূরাটিমক্কায় নাযিল হওয়ার কারণইউসুফ (আঃ)-এরকাহিনীমিসরে ইউসুফের সময়কালশৈশবে ইউসুফেরলালন-পালন ও চুরির ঘটনাইউসুফ-এর স্বপ্নভাইদের হিংসারশিকার হলেনইউসুফ অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হ’লেনপিতারনিকটে ভাইদের কৈফিয়তকাফেলার হাতে ইউসুফইউসুফমিসরের অর্থমন্ত্রীর গৃহেইউসুফ যৌবনে পদার্পণকরলেনযৌবনের মহা পরীক্ষায় ইউসুফমহিলাদেরসমাবেশে ইউসুফনবীগণ নিষ্পাপ মানুষছিলেনইউসুফের সাক্ষী কে ছিলেন?ইউসুফজেলে গেলেনকারাগারের জীবনজেলখানারসাথীদের নিকটে ইউসুফের দাওয়াতইউসুফেরদাওয়াতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহবাদশাহর স্বপ্ন ওকারাগার থেকে ইউসুফের ব্যাখ্যা দানবাদশাহর দূতকেফেরৎ দানে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহবাদশাহর দরবারেইউসুফ (আঃ)ইউসুফের অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ এবংসাথে সাথে বাদশাহীর ক্ষমতা লাভইউসুফের দক্ষশাসন ও দুর্ভিক্ষ মুকাবিলায় অপূর্ব ব্যবস্থাপনাভাইদেরমিসরে আগমনইউসুফের কৌশল অবলম্বন ওবেনিয়ামীনের মিসর আগমনবেনিয়ামীনকেআটকে রাখা হ’লশিক্ষণীয় বিষয়বেনিয়ামীনকেফিরিয়ে নেবার জন্য ভাইদেরপ্রচেষ্টাবেনিয়ামীনকে রেখেই মিসর থেকেফিরল ভাইয়েরাপিতার নিকটে ছেলেদেরকৈফিয়তপিতার নির্দেশে ছেলেদের পুনরায় মিসরেগমনইউসুফের আত্মপ্রকাশ এবং ভাইদের ক্ষমাপ্রার্থনাইউসুফের ব্যবহৃত জামা প্রেরণভাইদের প্রতিক্ষমা প্রদর্শনের তাৎপর্যইয়াকূব (আঃ) দৃষ্টিশক্তিফিরে পেলেনঘামের গন্ধে দৃষ্টিশক্তি ফেরাসম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্যপিতার নিকটেছেলেদের ক্ষমা প্রার্থনাইয়াকূব-পরিবারের মিসরউপস্থিতি ও স্বপ্নের বাস্তবায়নইউসুফেরদো‘আইউসুফের প্রশংসায় আল্লাহতা‘আলাশেষনবীর প্রতি আল্লাহর সম্বোধন ওসান্ত্বনা প্রদানইউসুফের কাহিনী এক নযরেইয়াকূব(আঃ)-এর মৃত্যুইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুসংশয়নিরসনইউসুফের নিষ্পাপত্ব‘বুরহান’ কি?ইউসুফেরকাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ।আব্দুল্লাহ ইবনুওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইউসুফ (আঃ)সম্পর্কে বলেন, ﺍﻟﻜﺮﻳﻢُ ﺑﻦُ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺑﻦِﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﻳﻮﺳﻒُ ﺑﻦُ ﻳﻌﻘﻮﺏَ ﺑﻦِ ﺍﺳﺤﺎﻕَ ﺑﻦِ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢَ ﻋﻠﻴﻬﻢُﺍﻟﺴﻼﻡُ- ‘নিশ্চয়ই মর্যাদাবানের পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্রমর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান। তাঁরা হলেনইবরাহীমের পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁরপুত্র ইউসুফ ‘আলাইহিমুস সালাম’ (তাঁদের উপর শান্তিবর্ষিত হৌক!)।[1]নবীগণের মধ্যে হযরত ইউসুফ(আঃ) হ’লেন একমাত্র নবী, যাঁর পুরা কাহিনী একটিমাত্র সূরায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউসুফ-এর ১১১টি আয়াতের মধ্যে ৩ থেকে ১০১ আয়াতপর্যন্ত ৯৯টি আয়াতে ইউসুফের কাহিনী বিবৃতহয়েছে। এ ছাড়া অন্যত্র কেবল সূরা আন‘আম ৮৪এবং সূরা মুমিন ৩৪ আয়াতে তাঁর নাম এসেছে।সূরানাযিলের কারণ : সত্যনবী এবং শেষনবীজেনেও কপট ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রতিপদে পদে কষ্ট দিত এবং পরীক্ষা করার চেষ্টাকরত। তাদেরসমাজনেতা ও ধর্মনেতাদের কাজইছিল সর্বদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এরবিরুদ্ধে চক্রান্ত করা ওতাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা। এ সময় মক্কায় কোনআহলে কিতাব বসবাস করত না এবং মক্কার লোকেরাইউসুফ বা অন্য নবীদের সম্পর্কে কিছু জানতও না।ফলে মদীনার কুচক্রী ইহুদীদের একটি দলমক্কায় এসে একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করলযে, বলুন দেখি, কোন নবী শামে (সিরিয়ায়)ছিলেন। অতঃপর তার ছেলেকে সেখান থেকেমিসরে বহিষ্কার করা হয়। তাতে ঐ ব্যক্তি কেঁদেঅন্ধ হয়ে যান? (এটি বানোয়াট কথা। কেননাকেবলমাত্র কেঁদে কারু চোখ অন্ধ হয় না এবং এটিনবীগণের মর্যাদার খেলাফ)। একথারজওয়াবেঅতঃপর সূরা ইউসুফ পুরাটা একত্রেনাযিল হয়।[2] তাদের পন্ডিতেরা তওরাত-ইঞ্জীলে বর্ণিতউক্ত ঘটনাআগে থেকেই জানতো। তাওরাত-যবূর-ইনজীল সবই ছিল হিব্রু ভাষায় রচিত। আমাদের রাসূলনিজের ভাষাতেই লেখাপড়া জানতেন না, অন্যেরভাষা জানা তো দূরের কথা। ইহুদী নেতাদেরসূক্ষ্ম পলিসি ছিল এই যে, উক্ত বিষয়ে উম্মীনবী মুহাম্মাদ-এর পক্ষে জবাব দেওয়া আদৌ সম্ভবহবে না। ফলে লোকদের মধ্যে তার নবুঅতেরব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হবে এবংতার বিরুদ্ধেপ্রোপাগান্ডা যোরদার করা যাবে।বস্ত্ততঃ তাদেরপ্রশ্নের উত্তরে ইউসুফ (আঃ) ও ইয়াকূব পরিবারেরপ্রকৃত ঘটনা ‘অহি’ মারফত ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ তাঁররাসূলকে বর্ণনা করে দেন। যা ছিল রাসূলের জন্যনিঃসন্দেহেএকটি গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা।[3] শুধুইউসুফের ঘটনাই নয়, আদম থেকে ঈসা পর্যন্তকুরআনে বর্ণিতবাকী ২৪ জন নবী ও তাঁদেরকওমের ঘটনাবলী বর্ণনা ছিল শেষনবী মুহাম্মাদ(ছাঃ)-এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য মু‘জেযা। কেননাতাঁদের কারু সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তাদেরসম্পর্কে লিখিত কোন বই-পত্র সে যুগে ছিল না।আর তিনি নিজে কারু কাছে কখনো লেখাপড়াশিখেননি। অথচ বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়েবিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিগত যুগের শিক্ষণীয়ঘটনাবলী তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উম্মতকেশুনিয়ে গেছেন কুরআনের মাধ্যমে। এগুলিই তাঁরনবুঅতের অন্যতম প্রধান দলীল ছিল।এরপরেওখাছ করে ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর পিতা ইয়াকূব(আঃ)-এর পরিবারের ঘটনাবলী ছিল বিগত ইতিহাসেরএক অনন্য সাধারণ ঘটনা। যার প্রয়োজনীয় অংশগুলিগুছিয়ে একত্রিতভাবে উপস্থাপন করাই হ’ল সূরাইউসুফের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য।সুন্দরতম কাহিনী:অন্যান্য নবীদের কাহিনী কুরআনের বিভিন্নস্থানে প্রয়োজন অনুসারে বিক্ষিপ্তভাবে বর্ণিতহয়েছে। কিন্তু ইউসুফ নবীর ঘটনাবলী একত্রেসাজিয়ে একটি সূরাতে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে।সম্ভবতঃ সেকারণে এটিকে ﺃَﺣْﺴَﻦُ ﺍﻟْﻘَﺼَﺺِ‘সুন্দরতম কাহিনী’ বলা হয়েছে (ইউসুফ ১২/৩)।দ্বিতীয়তঃ এর মধ্যে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে,তা যেমনি অলৌকিক,তেমনি চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়।তৃতীয়তঃ অন্যান্য নবীদের কাহিনীতে প্রধানতঃউম্মতের অবাধ্যতা ও পরিণামে তাদের উপরেআপতিত গযবের কাহিনী এবং অন্যান্য উপদেশ ওহিকমত সমূহ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনীতে রয়েছে দুনিয়ার তিক্ত বাস্তবতা এবংআল্লাহর উপরে অকুণ্ঠ নির্ভরতার সমন্বয়ে সৃষ্টএক অতুলনীয় ও অভাবনীয় এক ট্রাজিক জীবননাট্য। যা পাঠ করলে যেকোন বোদ্ধা পাঠকেরজীবনে সৃষ্টি হবেসর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরেভরসা ও তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণেরএক অনুপমউদ্দীপনা।আরবী ভাষায় কেন?আল্লাহ বলেন,‘আমরা একে আরবী কুরআন হিসাবে নাযিল করেছি,যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (ইউসুফ ১২/২)। এরঅন্যতম কারণ ছিল এই যে, ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনীযারা জানতে চেয়েছিল, তারা ছিল আরবীয় ইহুদীএবং মক্কার কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ। তাই তাদেরবোধগম্য হিসাবে আরবী ভাষায় উক্ত কাহিনীবর্ণনাকরা হয়েছে এবং আরবীতেই সমগ্র কুরআন নাযিলকরা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন ভাষাগর্বীআরবরা কুরআনের অপূর্ব ভাষাশৈলীর কাছে হারমেনেছে, অন্যদিকে তেমনি কিতাবধারী ইহুদী-নাছারা পন্ডিতেরা কুরআনের বিষয়বস্ত্ত ও বক্তব্যসমূহের সত্যতা ও সারবত্তা উপলব্ধি করে নিশ্চুপহয়েছে।কাহিনীর সার-সংক্ষেপ :কাহিনীটি শৈশবেদেখা ইউসুফের একটি স্বপ্ন দিয়ে শুরু হয়েছেএবং তার সমাপ্তি ঘটেছে উক্ত স্বপ্নের সফলবাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাঝখানের ২২/২৩ বছরমতান্তরে চল্লিশ বছর অনেকগুলি বিয়োগান্ত ওচমকপ্রদ ঘটনায় পূর্ণ। কাহিনী অনুযায়ী ইউসুফশৈশবকালে স্বপ্ন দেখেন যে, ১১টি নক্ষত্র এবংসূর্য ও চন্দ্র তাকে সিজদা করছে। তিনি এই স্বপ্নপিতা হযরত ইয়াকূবকে বললে তিনি তাকে সেটাগোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তা ফাঁস হয়ে যায়।ফলে এটা তার সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি ভেবে সৎভাইয়েরা হিংসায় জ্বলে ওঠে এবংতারা তাকে দুনিয়াথেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে। অতঃপরতারা তাকে জঙ্গলের একটি পরিত্যক্ত অন্ধকূপেনিক্ষেপ করে। তিনদিন পরে পথহারা ব্যবসায়ীকাফেলার নিক্ষিপ্ত বালতিতে করে তিনি উপরেউঠে আসেন। পরে ঐ ব্যবসায়ীরা তাকেমিসরের রাজধানীতে বিক্রি করে দেয়।ভাগ্যক্রমে মিসরের অর্থ ওরাজস্ব মন্ত্রীক্বিৎফীর ( ﻗﻄﻔﻴﺮ ) তাকে খরিদ করে বাড়ীতেনিয়ে যান ক্রীতদাস হিসাবে। কয়েক বছরেরমধ্যে যৌবনে পদার্পণকারী অনিন্দ্য সুন্দরইউসুফের প্রতি মন্ত্রীর নিঃসন্তান স্ত্রী যুলায়খারআসক্তি জন্মে। ফলে শুরু হয় ইউসুফেরজীবনে আরেক পরীক্ষা। একদিন যুলায়খাইউসুফকে তার ঘরেডেকে নিয়ে কুপ্রস্তাবদেয়। তাতে ইউসুফ সম্মত না হয়ে বেরিয়েআসতে চাইলে পিছন থেকে যুলায়খা তার জামাটেনে ধরলে তা ছিঁড়ে যায়। দরজা খুলেবেরিয়েআসতেই দু’জনে ধরা পড়ে যায় বাড়ীরমালিক ক্বিৎফীরের কাছে। পরে যুলায়খার সাজানোকথামতে নির্দোষ ইউসুফের জেল হয়। যুলায়খাছিলেন মিসররাজ রাইয়ান ইবনু অলীদেরভাগিনেয়ী।[4]অন্যূন সাত বছর জেল খাটার পরবাদশাহর এক স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানের পুরস্কার স্বরূপতাঁর মুক্তি হয়। পরে তিনি বাদশাহর অর্থ ও রাজস্বমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং বাদশাহর আনুকূল্যে তিনিইহনসমগ্র মিসরের একচ্ছত্র শাসক।ইতিমধ্যেক্বিৎফীরের মৃত্যু হ’লে বাদশাহর উদ্যোগেবিধবা যুলায়খার সাথে তাঁর বিবাহ হয়।[5] বাদশাহর দেখাস্বপ্ন মোতাবেক মিসরে প্রথম সাত বছর ভাল ফসলহয় এবং পরের সাত বছর ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখাদেয়। দুর্ভিক্ষের সময় সুদূর কেন‘আন থেকেতাঁর বিমাতা দশ ভাই তাঁর নিকটে খাদ্য সাহায্য নিতে এলেতিনি তাদের চিনতে পারেন। কিন্তুনিজ পরিচয় গোপনরাখেন। পরে তাঁর সহোদর একমাত্র ছোট ভাইবেনিয়ামীনকে আনা হ’লে তিনি তাদের সামনেনিজের পরিচয় দেন এবং নিজের ব্যবহৃত জামাটিভাইদের মাধ্যমে পিতার নিকটে পাঠিয়ে দেন।বার্ধক্য তাড়িত অন্ধ পিতা ইয়াকূবের মুখেরউপরেউক্ত জামা রেখে দেওয়ার সাথে সাথে তাঁরদু’চোখ খুলে যায়। অতঃপর ইউসুফের আবেদনক্রমে তিনিসপরিবারে মিসর চলে আসেন। ইউসুফতার ভাইদের ক্ষমা করে দেন। অতঃপর ১১ ভাই ওবাপ-মা তাঁর প্রতি সম্মানের সিজদা করেন। এভাবেইশৈশবে দেখা ইউসুফের স্বপ্ন সার্থক রূপ পায়(অবশ্য ইসলামী শরী‘আতে কারু প্রতি সম্মানেরসিজদা নিষিদ্ধ)। সংক্ষেপে এটাই হ’ল ইউসুফ (আঃ) ওইয়াকূব পরিবারের ফিলিস্তীন হ’তে মিসরেহিজরতের কারণ ও প্রেক্ষাপট, যে বিষয়েইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করেছিল মূলতঃতাঁকে ঠকাবার জন্য।সূরাটি মক্কায় নাযিল হওয়ার কারণ:মক্কায় কোন ইহুদী-নাছারা বাস করত না। ইউসুফ ওইয়াকূব পরিবারের ঘটনা মক্কায় প্রসিদ্ধ ছিল না এবংমক্কার কেউ এ বিষয়ে অবগতও ছিল না। তাহ’লে সূরাইউসুফ কেন মক্কায় নাযিল হ’ল?এর জবাব এই যে,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের সংবাদ মদীনায় পৌঁছেগেলে সেখানকার ইহুদী-নাছারা নেতৃবর্গ তাওরাত-ইনজীলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তাঁকে ঠিকইচিনে ফেলে (বাক্বারাহ ২/১৪৬; আন‘আম ৬/২০)।কিন্তু অহংকার বশে মানতে অস্বীকার করে এবংতাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বুনতেশুরু করে।সে মোতাবেক শেষনবী (ছাঃ) যাতেমদীনায় হিজরত করতে না পারেন এবং মক্কাতেইতাঁকে শেষ করে ফেলা যায়, সেই কপটউদ্দেশ্য নিয়ে তাদের একদল ধুরন্ধর লোকমক্কায় প্রেরিত হয়। তারা এসে অস্পষ্ট ভঙ্গিতেপ্রশ্ন করতে লাগল যে, বলুন কোন্ নবীর একপুত্রকে শাম হ’তে মিসরে স্থানান্তরিত করা হয়।কোন্ নবীসন্তানের বিরহ-বেদনায় কেঁদেকেঁদে অন্ধ হয়ে যান ইত্যাদি।জিজ্ঞাসার জন্য এঘটনাটি বাছাই করার অন্যতম কারণ ছিল এই যে, এ ঘটনাটিমক্কায় ছিল অপরিচিত এবংএকটি সম্পূর্ণ নতুন বিষয়।অতএবমক্কার লোকেরাই যে বিষয়ে জানে না,সে বিষয়ে উম্মী নবী মুহাম্মাদ-এর জানার প্রশ্নইওঠেনা। ফলে নিশ্চয়ই তিনি বলতে পারবেন না এবংঅবশ্যই তিনি অপদস্থ হবেন। তখন মক্কারকাফেরদের কাছে একথা রটিয়ে দেওয়া সম্ভবহবে যে, মুহাম্মাদ কোন নবী নন, তিনি একজনভন্ড ও মতলববাজ লোক। বাপ-দাদার ধর্মেরবিরোধিতা করার কারণে তখন লোকেরাতাকে হয়তপিটিয়ে মেরে ফেলবে।যাইহোক ইহুদীদেরএ কুটচাল ও কপট উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তাদেরপ্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ইউসুফ নাযিল হয় এবংতাতে ইউসুফ ও ইয়াকূব-পরিবারের ঘটনাবলীএমননিখুঁতভাবে পরিবেশিত হয়, যা তওরাত ওইনজীলেও ছিল না। বস্ত্ততঃ এটি ছিল শেষনবী(ছাঃ)-এর একটি প্রকাশ্য মু‘জেযা।ইউসুফ (আঃ)-এরকাহিনী :ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা ছিলেন ইয়াকূব ইবনেইসহাক্ব ইবনে ইবরাহীম (আঃ)। তাঁরা সবাইকেন‘আনবা ফিলিস্তীনের হেবরন এলাকার বাসিন্দাছিলেন। ইয়াকূব (আঃ)-এরদ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভেজন্মগ্রহণ করেন ইউসুফ ও বেনিয়ামীন।শেষোক্ত সন্তান জন্মের পরপরই তার মামৃত্যুবরণ করেন। পরে ইয়াকূব (আঃ) তাঁর স্ত্রীরঅপর এক বোন লায়লা-কে বিবাহ করেন। ইউসুফ-এরসাথে মিসরে পুনর্মিলনের সময় ইনিই মাহিসাবেসেখানে পিতার সাথে উপস্থিত ছিলেন।[6]হযরতইয়াকূব (আঃ) মিসরে পুত্র ইউসুফের সাথে ১৭ বছরমতান্তরে ২০ বছরের অধিককাল অতিবাহিত করেন।অতঃপর ১৪৭ বছর বয়সে সেখানেই ইন্তেকালকরেন। মৃত্যুকালে অছিয়ত করে যান যেন তাঁকেবায়তুল মুক্বাদ্দাসের নিকটবর্তী হেবরন মহল্লায়পিতা ইসহাক ও দাদা ইবরাহীম (আঃ)-এর পাশে সমাহিতকরা হয় এবং তিনি সেখানেই সমাধিস্থ হন। যা এখন‘খলীল’ মহল্লা বলে খ্যাত। হযরত ইউসুফ (আঃ) ১১০বছর বয়সে মিসরে ইন্তেকাল করেন এবং তিনিওহেবরনের একই স্থানে সমাধিস্থ হওয়ার জন্যসন্তানদের নিকটে অছিয়ত করে যান। এর দ্বারাবায়তুল মুক্বাদ্দাস অঞ্চলের বরকত ও উচ্চ মর্যাদাপ্রমাণিত হয়। হযরত ইয়াকূব-এর বংশধরগণ সকলে ‘বনুইসরাঈল’ নামে খ্যাত হয়। তাঁর বারো পুত্রের মধ্যেমাত্র ইউসুফ নবী হয়েছিলেন। তাঁর রূপ-লাবণ্য ছিলঅতুলনীয়।রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি মি‘রাজরজনীতে ইউসুফ (আঃ)-এর সাথেসাক্ষাৎ হলেদেখলাম যে, আল্লাহ তাকে সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক দান করেছেন’।[7] উল্লেখ্যযে, ছাহাবী বারা ইবনে আযেব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারাকে ‘পূর্ণ চনেদ্রর’ সাথে তুলনাকরেছেন’।[8] যেদিকে ইঙ্গিত করেই ফারসীকবি গেয়েছেন- ﺣﺴﻦ ﻳﻮﺳﻒ ﺩﻡ ﻋﻴﺴﻰ ﻳﺪ ﺑﻴﻀﺎﺩﺍﺭﻯﺂﻧﭽﻪ ﺧﻮﺑﻪ ﻫﻤﻪ ﺩﺍﺭﻧﺪ ﺗﻮ ﺗﻨﻬﺎ ﺩﺍﺭﻯ ‘ইউসুফেরসৌন্দর্য, ঈসার ফুঁক ও মূসার দীপ্ত হস্ততালু- সবকিছুইযে হে নবী, তোমার মাঝেই একীভূত’।যুলায়খা-র গর্ভে ইউসুফ (আঃ)-এর দু’টি পুত্র সন্তান হয়।তাদের নাম ছিল ইফরাঈম ও মানশা। ইফরাঈমের একটিপুত্র ও একটি কন্যা সন্তান হয়। পুত্র ছিলেন ‘নূন’ যারপুত্র ‘ইউশা’ নবী হন এবং কন্যা ছিলেন ‘লাইয়া’ অথবা‘রাহ্মাহ’, যিনি আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রী ছিলেন’।[9]উল্লেখ্য যে, বিগত নবীদের বংশ তালিকার অধিকাংশনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।মিসরে ইউসুফের সময়কাল :মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব(৮০-১৫০ হিঃ) বলেন, ঐ সময় মিসরের সম্রাট ছিলেন‘আমালেক্বা’ জাতির জনৈক রাইয়ান ইবনে ওয়ালীদ।তিনি পরবর্তীকালে ইউসুফের কাছে মুসলমান হনএবং ইউসুফকে মিসরের সর্বময় ক্ষমতায় বসিয়েবলেন, ﻟﺴﺖُ ﺃﻋﻈﻢَ ﻣﻨﻚ ﺇﻻ ﺑﺎﻟﻜﺮﺳﻰ ‘আমি আপনারচাইতে বড় নই, সিংহাসন ব্যতীত’। এ সময় ইউসুফেরবয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর।[10] পক্ষান্তরে তারীখুলআম্বিয়ার লেখক বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এরকাহিনীতে মিসরে যুগ যুগ ধরে রাজত্বকারীফেরাঊন রাজাদের কোন উল্লেখ না থাকায়অনেকে প্রমাণ করেন যে, ঐ সময় ‘হাকসূস’ রাজারা( ﻣﻠﻮﻙ ﺍﻟﻬﻜﺴﻮﺱ ) ফেরাঊনদের হটিয়ে মিসর দখলকরেন এবং দু’শো বছর যাবত তারা সেখানে রাজত্বকরেন। যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় দু’হাযারবছরপূর্বের ঘটনা’।[11]উল্লেখ্য যে, ইউসুফ (আঃ)-এর সময়কাল ছিল ঈসা (আঃ)-এর অন্যূন আঠারশ’ বছরপূর্বেকার। তবে সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন,আনুমানিক ১৬৮৬ বছর পূর্বের। হ’তে পারে কেউইউসুফের সময়কালের শুরু থেকে এবং কেউ তাঁরমৃত্যু থেকে হিসাব করেছেন।তবে তাঁর সময়থেকেই বনু ইস্রাঈলগণ মিসরে বসবাস শুরু করে।শৈশবে ইউসুফের লালন-পালন ও চুরির ঘটনা :হাফেযইবনু কাছীর বর্ণনা করেন যে, ইউসুফ-এরজন্মের কিছুকাল পরেই বেনিয়ামীন জন্মগ্রহণকরেন। বেনিয়ামীন জন্মের পরপরই তাদেরমায়ের মৃত্যু ঘটে।[12] তখন মাতৃহীন দুই শিশুর লালন-পালনের ভার তাদের ফুফুর উপরে অর্পিত হয়।আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফকে এত বেশী রূপ-লাবণ্যএবং মায়াশীল ব্যবহার দান করেছিলেন যে, যেই-ইতাকে দেখত, সেই-ই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েপড়ত। ফুফু তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।একদন্ড চোখের আড়াল হ’তে দিতেন না।এদিকে বিপত্নীক ইয়াকূব (আঃ)মাতৃহীনা দুই শিশুপুত্রের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই অধিকতর দুর্বল এবংসর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। ইতিমধ্যে ইউসুফ একটু বড়হ’লে এবং হাঁটাচলা করার মত বয়স হ’লে পিতা ইয়াকূব(আঃ) তাকে ফুফুর নিকট থেকে আনতে চাইলেন।কিন্তু ফুফু তাকে ছাড়তে নারায।ওদিকে পিতাও তাকেনিয়ে আসতে সংকল্পবদ্ধ। শুরু হ’ল পিতা ও ফুফুরমধ্যে মহববতের টানাপড়েন। ফলে ঘটে গেলএক অঘটন।অধিক পীড়াপীড়ির কারণে ইউসুফকেযখন তার পিতার হাতে তুলে দিতেই হ’ল, তখনস্নেহান্ধ ফুফু গোপনে এক ফন্দি করলেন। তিনিস্বীয় পিতা হযরত ইসহাক্ব (আঃ)-এর নিকট থেকেযে একটা হাঁসুলি পেয়েছিলেন এবং যেটাকেঅত্যন্ত মূল্যবান ও বরকতময় মনেকরা হ’ত, ফুফুসেই হাঁসুলিটিকে ইউসুফ-এর কাপড়ের নীচেগোপনে বেঁধে দিলেন।অতঃপর ইউসুফ তার পিতারসাথে চলে যাওয়ার পর ফুফু জোরেশোরেপ্রচার শুরু করলেন যে, তার মূল্যবান হাঁসুলিটি চুরি হয়েগেছে। পরে তল্লাশী করে তা ইউসুফেরকাছে পাওয়া গেল। ইয়াকূবী শরী‘আতের বিধানঅনুযায়ী ফুফু ইউসুফকে তার গোলাম হিসাবে রাখারঅধিকার পেলেন। ইয়াকূব (আঃ)ও দ্বিরুক্তি না করেসন্তানকে তারফুফুর হাতে পুনরায় সমর্পণ করলেন।এরপর যতদিন ফুফু জীবিত ছিলেন, ততদিন ইউসুফ তারকাছেই রইলেন।[13]এই ছিল ঘটনা, যাতে ইউসুফনিজের অজান্তে চুরির অপরাধে অভিযুক্তহয়েছিলেন। এরপর বিষয়টি সবার কাছেদিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল যে,তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে একেবারেই নির্দোষ।ফুফুর অপত্য স্নেহই তাকে ঘিরে এ চক্রান্ত জালবিস্তার করেছিল। এসত্য কথাটি তার সৎভাইদেরও জানাছিল। কিন্তু এটাকেই তারা ইউসুফের মুখের উপরেবলে দেয় যখন আরেক বানোয়াট চুরিরঅভিযোগে বেনিয়ামীনকে মিসরে গ্রেফতারকরা হয়। ইউসুফ তাতে দারুণ মনোকষ্ট পেলেও তাচেপে রাখেন।বলা বাহুল্য, শৈশবে যেমন ইউসুফস্বীয় ফুফুর স্নেহের ফাঁদে পড়ে চোর (?)সাব্যস্ত হয়ে ফুফুরগোলামী করেন, যৌবনেতেমনি যুলায়খার চক্রান্তে পড়ে মিথ্যা অপবাদেঅন্যূন সাত বছর জেল খাটেন- যে ঘটনা পরেবর্ণিত হবে।ইউসুফ-এর স্বপ্ন :বালক ইউসুফ একদিনতার পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর কাছে এসে বলল, ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَﻳُﻮْﺳُﻒُ ﻟِﺄَﺑِﻴْﻪِ ﻳَﺎ ﺃَﺑﺖِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺭَﺃَﻳْﺖُ ﺃَﺣَﺪَ ﻋَﺸَﺮَ ﻛَﻮْﻛَﺒﺎًﻭَّﺍﻟﺸَّﻤْﺲَ ﻭَﺍﻟْﻘَﻤَﺮَ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻬُﻢْ ﻟِﻲْ ﺳَﺎﺟِﺪِﻳْﻦَ -‘আমি স্বপ্নদেখেছি যে, ১১টি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্রআমাকে সিজদা করছে’। একথা শুনে পিতা বললেন,ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑُﻨَﻲَّ ﻻَ ﺗَﻘْﺼُﺺْ ﺭُﺅْﻳَﺎﻙَ ﻋَﻠَﻰ ﺇِﺧْﻮَﺗِﻚَ ﻓَﻴَﻜِﻴْﺪُﻭﺍْ ﻟَﻚَﻛَﻴْﺪﺍً ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ﻟِﻠْﺈِﻧﺴَﺎﻥِ ﻋَﺪُﻭٌّ ﻣُّﺒِﻴْﻦٌ – ‘বৎস, তোমারভাইদের সামনে এ স্বপ্ন বর্ণনা করো না। তাহ’লেওরা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। নিশ্চয় শয়তানমানুষের প্রকাশ্য শত্রু (ইউসুফ ১২/৪-৫)। ইবনু আববাস(রাঃ) ও ক্বাতাদাহ বলেন, এগারোটি নক্ষত্রের অর্থহচ্ছে ইউসুফ (আঃ)-এর এগারো ভাই এবং সূর্য ওচন্দ্রের অর্থ পিতা ও মাতা বা খালা’।[14] বস্ত্ততঃ এস্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রকাশ পায় যখন মিসরে পিতা-পুত্রের মিলন হয়।উল্লেখ্য যে, স্বপ্ন ব্যাখ্যা করাজ্ঞানের একটি পৃথক শাখা। হযরত ইবরাহীম, ইসহাক্বও ইয়াকূব সকলে এ বিষয়ে পারদর্শীছিলেন।সম্ভবতঃ একারণেই ইয়াকূব (আঃ) নিশ্চিত ধারণাকরেছিলেন যে, বালক ইউসুফ একদিন নবী হবে।হযরত ইউসুফকেও আল্লাহ এ ক্ষমতা দানকরেছিলেন। যেমন আল্লাহ এদিকে ইঙ্গিত দিয়েবলেন, ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻳَﺠْﺘَﺒِﻴْﻚَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻚَ ﻣِﻦ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞِﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳْﺚِ ﻭَﻳُﺘِﻢُّ ﻧِﻌْﻤَﺘَﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺁﻝِ ﻳَﻌْﻘُﻮْﺏَ ﻛَﻤَﺎ ﺃَﺗَﻤَّﻬَﺎﻋَﻠَﻰ ﺃَﺑَﻮَﻳْﻚَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻭَﺇِﺳْﺤَﺎﻕَ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑَّﻚَ ﻋَﻠِﻴْﻢٌﺣَﻜِﻴْﻢٌ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬)-‘এমনিভাবে তোমার পালনকর্তাতোমাকে মনোনীত করবেন (নবী হিসাবে)এবং তোমাকে শিক্ষা দিবেন বাণী সমূহের (অর্থাৎস্বপ্নাদিষ্ট বাণী সমূহের) নিগুঢ় তত্ত্ব এবং পূর্ণকরবেন স্বীয় অনুগ্রহ সমূহ (যেমন মিসরেররাজত্ব, সর্বোচ্চ সম্মানও ধন-সম্পদ লাভ এবং পিতারসাথে মিলন প্রভৃতি) তোমার প্রতি ও ইয়াকূব-পরিবারের প্রতি, যেমন তিনি পূর্ণ করেছিলেনইতিপূর্বে তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাক্বেরপ্রতি। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা সর্বজ্ঞ ওপ্রজ্ঞাময়’ (ইউসুফ ১২/৬)।উপরোক্ত ৫ ও ৬আয়াতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি ফুটে ওঠে। যেমন,(১) ইয়াকূব (আঃ) ইউসুফের দেখা স্বপ্নকে একটিসত্য স্বপ্ন হিসাবে গণ্য করেছিলেন এবং এটাওউপলব্ধি করেছিলেন যে, ইউসুফ-এর জীবনেএকটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। সেজন্য তারজীবনেআসতে পারে কঠিন পরীক্ষা সমূহ। (২)ভাল স্বপ্নের কথা এমন লোকের কাছে বলা উচিতনয়, যারা তার হিতাকাংখী নয়। সেজন্যেই ইযাকূব (আঃ)বালক ইউসুফকে তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত তার সৎভাইদেরকাছে বলতে নিষেধ করেছিলেন। (৩)ইউসুফকে আল্লাহ তিনটি নে‘মত দানের সুসংবাদদেন। (ক) আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছেননবী হিসাবে (খ) তাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করারযোগ্যতা দান করবেন (গ) তার প্রতি স্বীয় নে‘মতসমূহ পূর্ণ করবেন। বলা বাহুল্য, এগুলির প্রতিটিইপরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়েছে অত্যন্তসুন্দরভাবে, যা আমরা পরবর্তী কাহিনীতেঅবলোকন করব।এক্ষণে ইউসুফকে উপরোক্ত৬ আয়াতে বর্ণিত অহী আল্লাহ কখন নাযিলকরেছিলেন, সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়না। তবে ১৫ আয়াতের মর্মে বুঝা যায় যে, তাঁকেকূপে নিক্ষেপ করার আগেই উপরোক্ত অহীরমাধ্যমে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়। এটি নবুঅতের‘অহিয়ে কালাম’ ছিল না। বরং এটি ছিল মূসার মায়ের কাছেঅহী করার ন্যায় ‘অহিয়ে ইলহাম’। কেননা নবুঅতের‘অহি’ সাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়সে হয়েথাকে।ভাইদের হিংসার শিকার হলেন :এটা একটা স্বভাবগতরীতি যে, বিমাতা ভাইয়েরা সাধারণতঃ পরস্পরেরবিদ্বেষী হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ এই বিদ্বেষযাতে মাথাচাড়া না দেয়, সেকারণ ইয়াকূব (আঃ) একইশ্বশুরের পরপর তিন মেয়েকে বিয়েকরেছিলেন। এরপরেও শ্বশুর ছিলেন আপন মামু।পরস্পরে রক্ত সম্পর্কীয় এবং ঘনিষ্ঠ নিকটাত্মীয়হওয়া সত্ত্বেও এবং নবী পরিবারের সার্বক্ষণিকদ্বীনী পরিবেশ ও নৈতিক প্রশিক্ষণ থাকাসত্ত্বেও বৈমাত্রেয় হিংসার কবল থেকে ইয়াকূব(আঃ)-এর দ্বিতীয় পক্ষেরসন্তানেরা রক্ষা পায়নি।তাই বলা চলে যে, ইউসুফের প্রতি তার সৎভাইদেরহিংসার প্রথম কারণ ছিলবৈমাত্রেয় বিদ্বেষ। দ্বিতীয়কারণ ছিল- সদ্য মাতৃহীন শিশু হওয়ার কারণে তাদেরদু’ভাইয়ের প্রতি পিতার স্বভাবগত স্নেহের আধিক্য।তৃতীয় কারণ ছিল, ইউসুফের অতুলনীয় রূপ-লাবণ্য,অনিন্দ্যসুন্দর দেহসৌষ্ঠব, আকর্ষণীয় ব্যবহার-মাধুর্য এবং অনন্য সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। চতুর্থইউসুফের স্বপ্নবৃত্তান্তের কথা যেকোন ভাবেইহৌক তাদের কানে পৌঁছে যাওয়া। বলা চলে যে,শেষোক্ত কারণটিই তাদের হিংসার আগুনে ঘৃতাহুতিদেয় এবং তাকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়েদেওয়ার শয়তানী চক্রান্তে তারা প্ররোচিত হয়।কিন্তু শয়তান যতই চক্রান্ত করুক, আল্লাহ বলেন, ﺇِﻥَّﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﻛَﺎﻥَ ﺿَﻌِﻴْﻔًﺎ – ‘শয়তানের চক্রান্ত সর্বদাইদুর্বল হয়ে থাকে’ (নিসা৪/৭৬)। ইউসুফের মধ্যেভবিষ্যৎ নবুঅত লুকিয়ে আছে বুঝতে পেরেইইয়াকূব (আঃ) তার প্রতি অধিক স্নেহশীল ছিলেন।আর সেকারণে সৎ ভাইয়েরাও ছিল অধিক হিংসাপরায়ণ।বস্ত্ততঃ এই হিংসাত্মক আচরণের মধ্যেই লুকিয়েছিল ইউসুফের ভবিষ্যৎ উন্নতির সোপান।ইউসুফঅন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হ’লেন:দশ জন বিমাতা ভাই মিলেইউসুফকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যতাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতারণারআশ্রয় নিল। তারা একদিন পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর কাছেএসে ইউসুফকে সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তীজঙ্গলে আনন্দ ভ্রমণে যাবার প্রস্তাব করল। তারাপিতাকে বলল যে, ‘আপনি তাকে আগামীকালআমাদের সাথে প্রেরণ করুন। সে আমাদেরসঙ্গে যাবে, তৃপ্তিসহ খাবে আর খেলাধূলাকরবেএবং আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব’।জবাবে পিতা বললেন, আমার ভয় হয় যে, তোমরাতাকে নিয়ে যাবে, আর কোন এক অসতর্কমুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে’। ‘তারাবলল, আমরা এতগুলো ভাই থাকতে তাকে বাঘেখেয়ে ফেলবে, তাহ’লে তো আমাদের সবইশেষ হয়ে যাবে’ (ইউসুফ ১২/১২-১৪)। উল্লেখ্যযে, কেন‘আন অঞ্চলে সে সময়ে বাঘেরপ্রাদুর্ভাব ছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস(রাঃ)প্রমুখাত বর্ণিত হয়েছে যে, ইয়াকূব (আঃ)পূর্বরাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়েরউপরে আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশেইউসুফ খেলা করছে। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাকেঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যতহয়। কিন্তু তাদের মধ্যকার একটি বাঘ এসে তাকেমুক্ত করে দেয়। অতঃপর ইউসুফ মাটির ভিতরেলুকিয়ে যায়’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন যে, উক্তস্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইয়াকূব (আঃ) তার দশপুত্রকেই দশ ব্যাঘ্র গণ্য করেছিলেন। কিন্তুতাদের কাছে রূপকভাবে সেটা পেশ করেন।যাতে তারা বুঝতে না পারে (কুরতুবী)।যাইহোকছেলেদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনিরাযী হলেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকেঅঙ্গীকার নিলেন যাতে তারা ইউসুফকে কোনরূপকষ্ট না দেয় এবং তার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখে।অতঃপর তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র ইয়াহুদা বা রুবীল-এর হাতেইউসুফকে সোপর্দ করলেন এবং বললেন, তুমিইএর খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য সকল ব্যাপারে দেখাশুনাকরবে। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছেই শয়তানী চক্রান্তবাস্তবায়নের জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠলো। তারাইউসুফকে হত্যা করার জন্য প্রস্ত্তত হ’ল। তখন বড়ভাই ইয়াহুদা তাদের বাধা দিল এবং পিতার নিকটে তাদেরঅঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কিন্তু শয়তানতাদেরকে আরও বেশী যেদী করে তুলল।অবশেষে বড় ভাই একা পেরে না উঠে প্রস্তাবকরল, বেশ তবে ওকে হত্যা না করে বরং ঐদূরের একটা পরিত্যক্ত কূয়ায় ফেলে দাও। যাতেকোন পথিক এসে ওকেউঠিয়ে নিয়ে যায়। তাতেতোমাদের দু’টো লাভ হবে। এক- সে পিতার কাছথেকে দূরে চলে যাবে ও তোমরা তখন পিতারনিকটবর্তী হবে।দুই- নিরপরাধ বালককে হত্যা করারপাপ থেকে তোমরা বেঁচে যাবে।ভাইদের এইচক্রান্তের কথা আল্লাহ ব্যক্ত করেছেননিম্নোক্তভাবে- ﻟَﻘَﺪْ ﻛَﺎﻥَ ﻓِﻲْ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﻭَﺇِﺧْﻮَﺗِﻪِ ﺁﻳَﺎﺕٌﻟِّﻠﺴَّﺎﺋِﻠِﻴْﻦَ، ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻟُﻮﺍْ ﻟَﻴُﻮْﺳُﻒُ ﻭَﺃَﺧُﻮْﻩُ ﺃَﺣَﺐُّ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﺑِﻴْﻨَﺎ ﻣِﻨَّﺎﻭَﻧَﺤْﻦُ ﻋُﺼْﺒَﺔٌ ﺇِﻥَّ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻟَﻔِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ، ﺍﻗْﺘُﻠُﻮﺍْ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﺃَﻭِﺍﻃْﺮَﺣُﻮْﻩُ ﺃَﺭْﺿﺎً ﻳَﺨْﻞُ ﻟَﻜُﻢْ ﻭَﺟْﻪُ ﺃَﺑِﻴﻜُﻢْ ﻭَﺗَﻜُﻮْﻧُﻮﺍْ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِﻩِﻗَﻮْﻣﺎً ﺻَﺎﻟِﺤِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺂﺋِﻞٌ ﻣَّﻨْﻬُﻢْ ﻻَ ﺗَﻘْﺘُﻠُﻮﺍْ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻭَﺃَﻟْﻘُﻮْﻩُﻓِﻲ ﻏَﻴَﺎﺑَﺔِ ﺍﻟْﺠُﺐِّ ﻳَﻠْﺘَﻘِﻄْﻪُ ﺑَﻌْﺾُ ﺍﻟﺴَّﻴَّﺎﺭَﺓِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻢْﻓَﺎﻋِﻠِﻴْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৭-১০)-‘নিশ্চয়ই ইউসুফ ও তার ভাইদেরকাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্য রয়েছেনিদর্শনাবলী’ (৭)। ‘যখন তারা বলল, অবশ্যই ইউসুফ ওতার ভাই আমাদের পিতার কাছে আমাদের চাইতেঅধিক প্রিয়। অথচ আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ শক্তিবিশেষ। নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তিতেরয়েছেন’ (৮)। ‘তোমরা ইউসুফকে হত্যা করঅথবা তাকে কোথাও ফেলে আস। এতে শুধুতোমাদের প্রতিই তোমাদের পিতার মনোযোগনিবিষ্ট হবে এবং এরপর তোমরাই (পিতার নিকটে)যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকবে’ (৯)। ‘তখন তাদেরমধ্যেকার একজন (বড় ভাই) বলে উঠল, তোমরাইউসুফকে হত্যা করো না, বরং ফেলে দাও তাকেঅন্ধকূপে, যাতে কোন পথিক তাকে উঠিয়েনিয়ে যায়, যদি একান্তই তোমাদের কিছু করতেহয়’ (ইউসুফ ১২/৭-১০)।বড় ভাইয়ের কথায় সবাই একমতহয়ে ইউসুফকে কূয়ার ধারে নিয়েগেল। এ সময়তারা তার গায়ের জামা খুলে নিল। নিঃসন্দেহে ধরেনেওয়া যায় যে, এ সময় ৬/৭ বছরেরকচি বালকইউসুফ তার ভাইদের কাছে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করেপ্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু শয়তান তাদেরকে হিংসায়উন্মত্ত করে দিয়েছিল। এই কঠিন মুহূর্তেইউসুফকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তারনিকটে অহী নাযিল করেন। নিঃসন্দেহেএটিনবুঅতের অহী ছিল না। কেননা সাধারণতঃ চল্লিশবছর বয়স হওয়ার পূর্বে আল্লাহ কাউকেনবীকরেন না। এ অহী ছিল সেইরূপ, যেরূপঅহী বা ইলহাম এসেছিল শিশু মূসার মায়ের কাছেমূসাকে বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়েদেবারজন্য (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯)।এসময়কার মর্মন্তুদ অবস্থা আল্লাহ বর্ণনা করেনএভাবে, ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺫَﻫَﺒُﻮْﺍ ﺑِﻪِ ﻭَﺃَﺟْﻤَﻌُﻮْﺍ ﺃَﻥ ﻳَﺠْﻌَﻠُﻮْﻩُ ﻓِﻲْ ﻏَﻴَﺎﺑَﺔِﺍﻟْﺠُﺐِّ ﻭَﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻟَﺘُﻨَﺒِّﺌَﻨَّﻬُﻢ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻫِﻢْ ﻫَـﺬَﺍ ﻭَﻫُﻢْ ﻻَﻳَﺸْﻌُﺮُﻭْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ১৫)-‘যখন তারা তাকে নিয়ে চললএবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হ’ল,এমতাবস্থায় আমি তাকে (ইউসুফকে) অহী (ইলহাম)করলাম যে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যইতুমি তাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিতকরবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবেনা’ (ইউসুফ ১২/১৫)।ইমাম কুরতুবী বলেন যে,কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই অথবা পরেইউসুফকে সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দিয়ে এ অহীনাযিল হয়েছিল। ইউসুফকে তার ভাইয়েরা কূপেনিক্ষেপ করল। সেখানেও আল্লাহ তাকে সাহায্যকরলেন। তিনি কূয়ার নীচে একখন্ডপাথরেরউপরে স্বচ্ছন্দে বসে পড়লেন। বড় ভাই ইয়াহুদাগোপনেতার জন্য দৈনিক একটা পাত্রের মাধ্যমেউপর থেকে খাদ্য ও পানীয় নামিয়ে দিত এবং দূরথেকে সর্বক্ষণ তদারকি করত।পিতার নিকটেভাইদের কৈফিয়ত :ইউসুফকে অন্ধকূপে ফেলেদিয়ে একটা ছাগলছানা যবেহ করে তার রক্তইউসুফের পরিত্যক্ত জামায় মাখিয়ে তারা সন্ধ্যায়বাড়ী ফিরল এবং কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে হাযিরহয়ে ইউসুফকে বাঘে নিয়ে গেছে বলেকৈফিয়ত পেশ করল। প্রমাণ স্বরূপ তারা ইউসুফেররক্ত মাখা জামা পেশ করল। হতভাগারা এটা বুঝেনি যে,বাঘে নিয়ে গেলে জামাটা খুলে রেখে যায় না।আর খুললেও বাঘের নখের অাঁচড়ে জামা ছিন্নভিন্নহয়ে যাবার কথা। তাছাড়া যে পিতার কাছে তারা মিথ্যাকৈফিয়তপেশ করছে, তিনি একজন নবী। অহীরমাধ্যমে তিনি সবই জানতে পারবেন।কিন্তু হিংসায় অন্ধহয়ে গেলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়।ইউসুফেরভাইদের দেওয়া কৈফিয়ত ও পিতার প্রতিক্রিয়া আল্লাহবর্ণনা করেন নিম্নোক্ত রূপে, ﻭَﺟَﺎﺅُﻭْﺍ ﺃَﺑَﺎﻫُﻢْ ﻋِﺸَﺎﺀًﻳَّﺒْﻜُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﺫَﻫَﺒْﻨَﺎ ﻧَﺴْﺘَﺒِﻖُ ﻭَﺗَﺮَﻛْﻨَﺎ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻋِﻨْﺪَﻣَﺘَﺎﻋِﻨَﺎ ﻓَﺄَﻛَﻠَﻪُ ﺍﻟﺬِّﺋْﺐُ ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﺑِﻤُﺆْﻣِﻦٍ ﻟَّﻨَﺎ ﻭَﻟَﻮْ ﻛُﻨَّﺎﺻَﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ، ﻭَﺟَﺂﺅُﻭْﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻗَﻤِﻴْﺼِﻪِ ﺑِﺪَﻡٍ ﻛَﺬِﺏٍ ﻗَﺎﻝَ ﺑَﻞْ ﺳَﻮَّﻟَﺖْﻟَﻜُﻢْ ﺃَﻧﻔُﺴُﻜُﻢْ ﺃَﻣْﺮﺍً ﻓَﺼَﺒْﺮٌ ﺟَﻤِﻴﻞٌ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻌَﺎﻥُ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎﺗَﺼِﻔُﻮْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ১৬-১৮)-‘তারা (ভাইয়েরা) রাতেরবেলায় কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এল’। ‘এবং বলল,হে পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবংইউসুফকে আসবাবপত্রের কাছে বসিয়েরেখেছিলাম। এমতাবস্থায় তাকে বাঘে খেয়েফেলেছে। আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাসকরবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী’। ‘এ সময় তারা তারমিথ্যা রক্ত মাখানো জামা হাযির করল। (এটা দেখেঅবিশ্বাস করে ইয়াকূব বললেন, কখনোই নয়) বরংতোমাদের মন তোমাদের জন্য একটা কথা তৈরীকরে দিয়েছে। (এখন আর করার কিছুই নেই),অতএব ‘ছবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা কিছু বললেতাতে আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল’ (ইউসুফ১২/১৬-১৮)।কাফেলার হাতে ইউসুফ :সিরিয়া থেকেমিসরে যাওয়ার পথেএকটি ব্যবসায়ী কাফেলা পথভুলে জঙ্গলের মধ্যে উক্ত পরিত্যক্ত কূয়ারনিকটে এসে তাঁবু ফেলে।[15] তারা পানির সন্ধানেতাতে বালতি নিক্ষেপ করল। কিন্তুবালতিতে উঠেএল তরতাযা সুন্দর একটি বালক ‘ইউসুফ’। সাধারণদৃষ্টিতে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হ’লেওসবকিছুই ছিল আল্লাহর পূর্ব পরিকল্পিত এবং পরস্পরসংযুক্ত অটুট ব্যবস্থাপনারই অংশ। ইউসুফকে উদ্ধারকরার জন্যই আল্লাহ উক্ত কাফেলাকে পথ ভুলিয়েএখানে এনেছেন। তাঁর গোপন রহস্য বুঝবারসাধ্যবান্দার নেই। আবুবকর ইবনুআইয়াশ বলেন, ইউসুফকূয়াতে তিনদিন ছিলেন।[16] কিন্তু আহলে কিতাবগণবলেন, সকালে নিক্ষেপের পর সন্ধ্যার আগেইব্যবসায়ী কাফেলা তাকে তুলে নেয়।[17] আল্লাহসর্বাধিক অবগত।কাফেলার মধ্যকার জনৈক ব্যক্তিরনিক্ষিপ্ত বালতিতে ইউসুফ উপরে উঠে আসেন।অনিন্দ্য সুন্দর বালকদেখে সে আনন্দে আত্মহারাহয়ে বলে উঠলো ‘কি আনন্দের কথা। এ যেএকটি বালক!’ এরপর তারা তাকে মালিকবিহীনপণ্যদ্রব্য মনে করে লুকিয়ে ফেলল। কেননাসেযুগে মানুষ কেনাবেচা হ’ত। কিন্তু তারা গোপনকরতে পারল না। কারণ ইতিমধ্যে ইউসুফের বড় ভাইএসে কূয়ায় তাকে না পেয়ে অনতিদূরেকাফেলারখোঁজ পেয়ে গেল। তখন সে কাফেলার কাছেগিয়ে বলল, ছেলেটি আমাদের পলাতক গোলাম।তোমরা ওকে আমাদের কাছ থেকে খরিদ করেনিতে পার’। কাফেলা ভাবল খরিদ করে না নিলেচোর সাব্যস্ত হয়ে যেতে পারি। অতএব তারা দশভাইকে হাতে গণা কয়েকটি দিরহাম দিয়ে নিতান্ত সস্তামূল্যে ইউসুফকে খরিদ করে নিল। এর দ্বারাইউসুফের ভাইদের দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। এক- যাতেইউসুফ তার বাপ-ভাইদের নাম করে পুনরায় বাড়ীফিরে আসার সুযোগ না পায়। দুই- যাতে ইউসুফদেশান্তরী হয়ে যায় ও অন্যের ক্রীতদাস হয়েজীবন অতিবাহিত করে এবং কখনোই দেশেফিরতে না পারে। এই সময়কার দৃশ্য কল্পনা করতেওগা শিউরে ওঠে। নিজের ভাইয়েরা ইউসুফকেপরদেশী কাফেলার হাতে তাদের পলাতক গোলামহিসাবে বিক্রি করে দিচ্ছে। নবীপুত্র ইউসুফেরমনের অবস্থা ঐ সময় কেমন হচ্ছিল। কল্পনা করা যায়কি? বালক ইউসুফ ঐ সময় বাড়ী যাওয়ার জন্য কান্নাকাটিকরাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তেমন কোনকথাকুরআনে বর্ণিত হয়নি। তাতে মনে হয়,বিক্রয়ের ঘটনাটি তার অগোচরে ঘটেছিল।ভাইদের সাথে পুনরায় দেখা হয়নি (আল্লাহ সর্বাধিকঅবগত)। ইউসুফকে কূয়া থেকে উদ্ধার ও পরেপলাতক গোলাম হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করেদেবার ঘটনা আল্লাহর ভাষায় নিম্নরূপ- ﻭَﺟَﺂﺀَﺕْ ﺳَﻴَّﺎﺭَﺓٌﻓَﺄَﺭْﺳَﻠُﻮﺍْ ﻭَﺍﺭِﺩَﻫُﻢْ ﻓَﺄَﺩْﻟَﻯﺪَﻟْﻮَﻩُ ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑُﺸْﺮَﻯ ﻫَـﺬَﺍ ﻏُﻼَﻡٌﻭَﺃَﺳَﺮُّﻭْﻩُ ﺑِﻀَﺎﻋَﺔً ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ ﺑِﻤَﺎ ﻳَﻌْﻤَﻠُﻮْﻥَ- ﻭَﺷَﺮَﻭْﻩُ ﺑِﺜَﻤَﻦٍﺑَﺨْﺲٍ ﺩَﺭَﺍﻫِﻢَ ﻣَﻌْﺪُﻭْﺩَﺓٍ ﻭَﻛَﺎﻧُﻮﺍْ ﻓِﻴْﻪِ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺰَّﺍﻫِﺪِﻳْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ১৯-২০)-‘অতঃপর একটা কাফেলা এল এবং তারা তাদেরপানি সংগ্রহকারীকে পাঠালো। সে বালতি নিক্ষেপকরল। (বালতিতে ইউসুফের উঠে আসা দেখেসে খুশীতে বলে উঠল) কি আনন্দের কথা!এযে একটি বালক! অতঃপর তারা তাকে পণ্যদ্রব্য গণ্যকরে গোপন করে ফেলল। আল্লাহ ভালইজানেন, যাকিছু তারা করেছিল’। ‘অতঃপর ওরা(ইউসুফের ভাইয়েরা) তাকে কম মূল্যে বিক্রয়করে দিল হাতে গণা কয়েকটি দিরহামের (রৌপ্যমুদ্রার)বিনিময়ে এবং তারা তার (অর্থাৎ ইউসুফের) ব্যাপারেনিরাসক্ত ছিল’ (ইউসুফ ১২/১৯-২০)। মূলতঃ ইউসুফকেদূরে সরিয়ে দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।ইউসুফমিসরের অর্থমন্ত্রীর গৃহে :অন্ধকূপ থেকেউদ্ধার পাওয়ার পরব্যবসায়ী কাফেলা তাকে বিক্রিরজন্য মিসরের বাজারে উপস্থিত করল। মানুষ কেনা-বেচার সেই হাটে এই অনিন্দ্য সুন্দর বালককেদেখেবড় বড় ধনশালী খরিদ্দাররা রীতিমতপ্রতিযোগিতা শুরু করল। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকেমর্যাদার স্থানে সমুন্নত করতে চেয়েছিলেন। তাইসব খরিদ্দারকে ডিঙিয়ে মিসরের তৎকালীন অর্থ ওরাজস্বমন্ত্রী ক্বিৎফীর ( ﻗﻄﻔﻴﺮ) তাকে বহুমূল্যদিয়ে খরিদ করে নিলেন। ক্বিৎফীর ছিলেননিঃসন্তান।মিসরের অর্থমন্ত্রীর উপাধি ছিল ‘আযীয’বা ‘আযীয মিছর’। ইউসুফকে ক্রয় করে এনে তিনিতাকে স্বীয় স্ত্রীর হাতে সমর্পণ করলেন এবংবললেন, একে সন্তানের ন্যায় উত্তম রূপে লালন-পালন কর। এর থাকার জন্য উত্তম ব্যবস্থা কর।ভবিষ্যতে সে আমাদের কল্যাণে আসবে’।বস্ত্ততঃ ইউসুফের কমনীয়চেহারা ও নম্র-ভদ্রব্যবহারে তাদের মধ্যে সন্তানের মমতাজেগেওঠে। ক্বিৎফীর তার দূরদর্শিতার মাধ্যমেইউসুফের মধ্যে ভবিষ্যতের অশেষ কল্যাণদেখতে পেয়েছিলেন। আর সেজন্য তাকেসর্বোত্তম যত্ন সহকারে রাখার ব্যবস্থাকরেছিলেন। মূলতঃ এসবই ছিল আল্লাহর পূর্ব-নির্ধারিত। এবিষয়ে কুরআনী বক্তব্য নিম্নরূপঃ ﻭَﻗَﺎﻝَﺍﻟَّﺬِﻱ ﺍﺷْﺘَﺮَﺍﻩُ ﻣِﻦ ﻣِّﺼْﺮَ ﻻِﻣْﺮَﺃَﺗِﻪِ ﺃَﻛْﺮِﻣِﻲْ ﻣَﺜْﻮَﺍﻩُ ﻋَﺴَﻰ ﺃَﻥﻳَّﻨْﻔَﻌَﻨَﺎ ﺃَﻭْ ﻧَﺘَّﺨِﺬَﻩُ ﻭَﻟَﺪﺍً ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻣَﻜَّﻨِّﺎ ﻟِﻴُﻮْﺳُﻒَ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِﻭَﻟِﻨُﻌَﻠِّﻤَﻪُ ﻣِﻦْ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞِ ﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳْﺚِ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻏَﺎﻟِﺐٌ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻣْﺮِﻩِﻭَﻟَـﻜِﻨَّﺄَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ২১)-‘মিসরে যেব্যক্তি তাকে ক্রয় করল, সে তার স্ত্রীকে বলল,একে সম্মানজনকভাবে থাকার ব্যবস্থা কর। সম্ভবতঃসে আমাদের কল্যাণে আসবে অথবা আমরা তাকেপুত্ররূপে গ্রহণ করে নেব। এভাবে আমরাইউসুফকে সেদেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম এবংএজন্যে যে তাকে আমরা বাক্যাদির পূর্ণ মর্মঅনুধাবনের পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষা দেই। আল্লাহস্বীয় কর্মে সর্বদা বিজয়ী। কিন্তু অধিকাংশ লোকতা জানে না’ (ইউসুফ ১২/২১)।আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ(রাঃ) বলেন, দুনিয়াতে তিন ব্যক্তি ছিলেন সর্বাধিকসূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন ( ﺃﻓﺮﺱ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺛﻼﺛﺔ )। একজনহ’লেন ‘আযীযে মিছর’ (যিনি ইউসুফের চেহারাদেখেই তাঁকে চিনেছিলেন)। দ্বিতীয়শো‘আয়েব (আঃ)-এর ঐ কন্যা, যে মূসা (আঃ)সম্পর্কে স্বীয় পিতাকে বলেছিল,হে পিতা! আপনিএঁকে আপনার কর্মসহযোগী হিসাবে রেখেদিন। কেননা উত্তম সহযোগী সেই-ই, যেশক্তিশালী ও বিশ্বস্ত হয়’ (ক্বাছাছ ২৮/২৬)। তৃতীয়হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব, যিনি ওমর ফারূককেপরবর্তী খলীফা নিয়োগ করেছিলেন’।[18]ইউসুফ যৌবনে পদার্পণ করলেনআযীযেমিছরের গৃহে কয়েক বছর পুত্র স্নেহে লালিতপালিত হয়ে ইউসুফ অতঃপর যৌবনে পদার্পণ করলেন।আল্লাহ বলেন, ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺑَﻠَﻎَ ﺃَﺷُﺪَّﻩُ ﺁﺗَﻴْﻨَﺎﻩُ ﺣُﻜْﻤﺎً ﻭَّﻋِﻠْﻤﺎًﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ২২)-‘অতঃপর যখনসে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল, তখন আমরা তাকেপ্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম। আমরা এভাবেইসৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (ইউসুফ১২/২২)।উক্ত আয়াতে দু’টি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।পূর্ণ যৌবন প্রাপ্তি এবং প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি লাভ করা।সকলে এ বিষয়ে একমত যে, প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তিলাভের অর্থ হ’ল নবুঅত লাভ করা। আর সেটাসাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়সে হয়েথাকে। অন্যদিকেপূর্ণ যৌবন লাভ তার পূর্বেই হয়। যা বিশ বছর থেকেত্রিশ বা তেত্রিশের মধ্যে হয়ে থাকে। হযরতইবনু আববাস, মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ প্রমুখ বিদ্বান তেত্রিশবছর বলেছেন এবংযাহহাক বিশ বছর বলেছেন।যাহহাক সম্ভবতঃ প্রথম যৌবন এবং ইবনু আববাস পূর্ণযৌবনের কথা বলেছেন।এক্ষণে ইউসুফের প্রতিযুলায়খার আসক্তির ঘটনা নবুঅত লাভের পূর্বের নাপরের, এ বিষয়েবিদ্বানগণ একমত নন। আমাদেরপ্রবল ধারণা এই যে, যদিও যৌবন ও নবুঅতের কথাএকই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তথাপি ঘটনা একইসময়ের নয়। নবুঅত তিনি চল্লিশ বছর বয়সেইপেয়েছেন ধরে নিলে যুলায়খার ঘটনা অবশ্যই তারপূর্বে তার পূর্ণ যৌবনেই ঘটেছে।কারণ ঐ সময়ইউসুফের রূপ-লাবণ্য নিশ্চয়ই শৈশবের ও প্রৌঢ়বয়সের চাইতে বেশী ছিল, যা যুলায়খার ধৈর্যচ্যুতিঘটায়। অথচ ইউসুফের চরিত্রের কোন পরিবর্তনঘটেনি। কেননা নবীগণ ছোটবেলা থেকেইপাপ হ’তে পবিত্র থাকেন।যৌবনের মহা পরীক্ষায়ইউসুফ :রূপ-লাবণ্যে ভরা ইউসুফের প্রতিমন্ত্রীপত্নী যুলায়খার অন্যায় আকর্ষণ জেগেউঠলো। সে ইউসুফকে খারাব ইঙ্গিত দিতে লাগল।এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ﻭَﺭَﺍﻭَﺩَﺗْﻪُ ﺍﻟَّﺘِﻲْ ﻫُﻮَ ﻓِﻲْ ﺑَﻴْﺘِﻬَﺎﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻭَﻏَﻠَّﻘَﺖِ ﺍﻷَﺑْﻮَﺍﺏَ ﻭَﻗَﺎﻟَﺖْ ﻫَﻴْﺖَ ﻟَﻚَ ﻗَﺎﻝَ ﻣَﻌَﺎﺫَﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻪُ ﺭَﺑِّﻲ ﺃَﺣْﺴَﻦَ ﻣَﺜْﻮَﺍﻱَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻻَ ﻳُﻔْﻠِﺢُ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ- ﻭَﻟَﻘَﺪْﻫَﻤَّﺖْ ﺑِﻪِ ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ﻟَﻮْﻻ ﺃَﻥ ﺭَّﺃَﻯ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻟِﻨَﺼْﺮِﻑَﻋَﻨْﻪُ ﺍﻟﺴُّﻮﺀَ ﻭَﺍﻟْﻔَﺤْﺸَﺎﺀَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻋِﺒَﺎﺩِﻧَﺎ ﺍﻟْﻤُﺨْﻠَﺼِﻴْﻦَ – ﻭَﺍﺳْﺘَﺒَﻘَﺎﺍﻟْﺒَﺎﺏَ ﻭَﻗَﺪَّﺕْ ﻗَﻤِﻴﺼَﻪُ ﻣِﻦ ﺩُﺑُﺮٍ ﻭَﺃَﻟْﻔَﻴَﺎ ﺳَﻴِّﺪَﻫَﺎ ﻟَﺪَﻯ ﺍﻟْﺒَﺎﺏِﻗَﺎﻟَﺖْ ﻣَﺎ ﺟَﺰَﺍﺀُ ﻣَﻦْ ﺃَﺭَﺍﺩَ ﺑِﺄَﻫْﻠِﻜَﺴُﻮْﺀﺍً ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳُّﺴْﺠَﻦَ ﺃَﻭْﻋَﺬَﺍﺏٌ ﺃَﻟِﻴﻢٌ – ﻗَﺎﻝَ ﻫِﻲَ ﺭَﺍﻭَﺩَﺗْﻨِﻲ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻲ ﻭَﺷَﻬِﺪَ ﺷَﺎﻫِﺪٌﻣِّﻦْ ﺃَﻫْﻠِﻬَﺎ ﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻤِﻴْﺼُﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦ ﻗُﺒُﻞٍ ﻓَﺼَﺪَﻗَﺖْ ﻭَﻫُﻮَ ﻣِﻦَﺍﻟﻜَﺎﺫِﺑِﻴْﻦَ – ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻤِﻴْﺼُﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦ ﺩُﺑُﺮٍ ﻓَﻜَﺬَﺑَﺖْ ﻭَﻫُﻮَ ﻣِﻦَﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ – ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻯ ﻗَﻤِﻴْﺼَﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦ ﺩُﺑُﺮٍ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْﻛَﻴْﺪِﻛُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَﻛُﻦَّ ﻋَﻈِﻴْﻢٌ- ﻳُﻮﺳُﻒُ ﺃَﻋْﺮِﺽْ ﻋَﻦْ ﻫَـﺬَﺍﻭَﺍﺳْﺘَﻐْﻔِﺮِﻱْ ﻟِﺬَﻧْﺒِﻚِ ﺇِﻧَّﻚِ ﻛُﻨْﺖِ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺨَﺎﻃِﺌِﻴْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ২৩-২৯)-‘আর সে যে মহিলার বাড়ীতে থাকত, ঐমহিলা তাকে ফুসলাতে লাগল এবং (একদিন) দরজা সমূহবন্ধ করে দিয়ে বলল, কাছে এসো! ইউসুফ বলল,আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন! তিনি (অর্থাৎ আপনারস্বামী) আমার মনিব। তিনি আমার উত্তম বসবাসেরব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীগণসফলকাম হয় না’ (২৩)। ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তাকরেছিল এবং ইউসুফ তার প্রতি (অনিচ্ছাকৃত) কল্পনাকরেছিল। যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণঅবলোকন করত’ (অর্থাৎ আল্লাহ নির্ধারিতউপদেশদাতা ‘নফসে লাউয়ামাহ’ তথা শাণিত বিবেক যদিতাকে কঠোরভাবে বাধা না দিত)। এভাবেই এটাএজন্য হয়েছে যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয়মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সেআমাদেরমনোনীত বান্দাগণের একজন’ (২৪)।‘তারা উভয়ে ছুটে দরজার দিকে গেল এবং মহিলাটিইউসুফের জামা পিছন দিক থেকে ছিঁড়ে ফেলল।উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার মুখে পেল।তখন মহিলাটি তাকে বলল, যে ব্যক্তি তোমারস্ত্রীর সাথে অন্যায় বাসনা করে, তাকে কারাগারেনিক্ষেপ করা অথবা (অন্য কোন) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিদেওয়া ব্যতীত আর কি সাজা হ’তে পারে’? (২৫)।‘ইউসুফ বলল, সেই-ই আমাকে (তার কুমতলব সিদ্ধকরার জন্য) ফুসলিয়েছে। তখন মহিলার পরিবারেরজনৈক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল যে, যদি ইউসুফের জামাসামনের দিকে ছেঁড়া হয়, তাহ’লে মহিলা সত্য কথাবলেছে এবং ইউসুফ মিথ্যাবাদী’ (২৬)। ‘আর যদি তারজামা পিছন দিক থেকে ছেঁড়া হয়, তবে মহিলা মিথ্যাবলেছে এবংইউসুফ সত্যবাদী’ (২৭)। ‘অতঃপরগৃহস্বামী যখন দেখল যে, ইউসুফের জামা পিছনদিক থেকে ছেঁড়া, তখন সে (স্বীয় স্ত্রীকেউদ্দেশ্য করে) বলল, এটা তোমাদের ছলনা।নিঃসন্দেহে তোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক’ (২৮)।(অতঃপর তিনি ইউসুফকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,)‘ইউসুফ! এ প্রসঙ্গ ছাড়। আর হে মহিলা! এ পাপেরজন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চিতভাবে তুমিইপাপাচারিনী’ (ইউসুফ ১২/২৩-২৯)।মহিলাদেরসমাবেশে ইউসুফ :গৃহস্বামী দু’জনকে নিরস্তকরে ঘটনা চেপে যেতে বললেও ঘটনা চেপেথাকেনি। বরং নানা ডাল-পালা গজিয়ে শহরময় বাষ্ট্র হয়েগেলযে, আযীযের স্ত্রী স্বীয় পুত্রসমগোলামের সাথে অন্যায় কর্মে উদ্যোগীহয়েছিলেন। তখন বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য যুলায়খাশহরের উচ্চশ্রেণীর মহিলাদের নিজ বাড়ীতেভোজসভায় দাওয়াত দেবার মনস্থ করল। এ বিষয়েকুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপঃ ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻧِﺴْﻮَﺓٌ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻤَﺪِﻳْﻨَﺔِ ﺍﻣْﺮَﺃَﺓُﺍﻟْﻌَﺰِﻳْﺰِ ﺗُﺮَﺍﻭِﺩُ ﻓَﺘَﺎﻫَﺎ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻗَﺪْ ﺷَﻐَﻔَﻬَﺎ ﺣُﺒًّﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻨَﺮَﺍﻫَﺎﻓِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ – ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺳَﻤِﻌَﺖْ ﺑِﻤَﻜْﺮِﻫِﻦَّ ﺃَﺭْﺳَﻠَﺘْﺈِﻟَﻴْﻬِﻦَّﻭَﺃَﻋْﺘَﺪَﺕْ ﻟَﻬُﻦَّ ﻣُﺘَّﻜَﺄً ﻭَﺁﺗَﺖْ ﻛُﻞَّ ﻭَﺍﺣِﺪَﺓٍ ﻣِّﻨْﻬُﻦَّ ﺳِﻜِّﻴْﻨﺎً ﻭَﻗَﺎﻟَﺖِﺍﺧْﺮُﺝْ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻦَّ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻳْﻨَﻪُ ﺃَﻛْﺒَﺮْﻧَﻪُ ﻭَﻗَﻄَّﻌْﻦَ ﺃَﻳْﺪِﻳَﻬُﻦَّ ﻭَﻗُﻠْﻦَﺣَﺎﺵَ ِﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻫَـﺬَﺍ ﺑَﺸَﺮﺍًﺇِﻥْ ﻫَـﺬَﺍ ﺇِﻻَّ ﻣَﻠَﻚٌ ﻛَﺮِﻳْﻢٌ- ﻗَﺎﻟَﺖْﻓَﺬَﻟِﻜُﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻟُﻤْﺘُﻨَّﻨِﻲْ ﻓِﻴْﻪِ ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِﻓَﺎﺳَﺘَﻌْﺼَﻢَ ﻭَﻟَﺌِﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﻔْﻌَﻞْ ﻣَﺎ ﺁﻣُﺮُﻩُ ﻟَﻴُﺴْﺠَﻨَﻦَّ ﻭَﻟَﻴَﻜُﻮﻧﺎً ﻣِّﻦَﺍﻟﺼَّﺎﻏِﺮِﻳْﻦَ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩০-৩২)-‘নগরে মহিলারা বলাবলিকরতে লাগল যে, আযীযের স্ত্রী স্বীয়গোলামকে অন্যায় কাজে ফুসলিয়েছে। সে তারপ্রতি আসক্তহয়ে গেছে। আমরা তো তাকেপ্রকাশ্য ভ্রষ্টতার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি’ (৩০)।‘যখন সে (অর্থাৎ যুলায়খা) তাদের চক্রান্তের কথাশুনল, তখন তাদের জন্য একটা ভোজসভারআয়োজন করল এবং (ফল কাটার জন্য) তাদেরপ্রত্যেককে একটা করে চাকু দিল। অতঃপরইউসুফকে বলল, এদের সামনে চলে এস।(সেমতে ইউসুফ সেখানে এল) অতঃপর যখন তারাতাকে স্বচক্ষে দেখল, তখন সবাই হতভম্ব হয়েগেল এবং (ফল কাটতে গিয়ে নিজেদেরঅজান্তে) স্ব স্ব হাত কেটে ফেলল।(ইউসুফেরসৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তারা) বলেউঠল, হায় আল্লাহ! এ তো মানুষ নয়। এ যে মর্যাদাবানফেরেশতা!’ (৩১)। ‘(মহিলাদের এই অবস্থা দেখেউৎসাহিত হয়ে) যুলায়খা বলে উঠল,এই হ’ল সেইযুবক, যার জন্য তোমরা আমাকে ভৎর্সনা করেছ।আমি তাকে প্ররোচিত করেছিলাম। কিন্তু সেনিজেকে সংযত রেখেছে। এক্ষণে আমিতাকেযা আদেশ দেই, তা যদি সে পালন না করে, তাহ’লেসে অবশ্যই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সেঅবশ্যই লাঞ্ছিত হবে’ (ইউসুফ ১২/৩০-৩২)।উপরোক্ত আয়াতে যুলায়খার প্রকাশ্য দম্ভোক্তিথেকে বুঝা যায় যে, উপস্থিত মহিলারাও ইউসুফেরপ্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েএবং যুলায়খার কুপ্রস্তাবেরসাথে তারাও ঐক্যমত পোষণ করে। যা ইউসুফেরপ্রার্থনায় বহুবচন ব্যবহার করায় বুঝা যায়। যেমন এইকঠিন পরীক্ষার সময়ে ইউসুফ আল্লাহর আশ্রয়প্রার্থনা করে বলেন, ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺏِّ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦُ ﺃَﺣَﺐُّ ﺇِﻟَﻲَّ ﻣِﻤَّﺎﻳَﺪْﻋُﻮْﻧَﻨِﻲْ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻭَﺇِﻻَّ ﺗَﺼْﺮِﻑْ ﻋَﻨِّﻲْ ﻛَﻴْﺪَﻫُﻦَّ ﺃَﺻْﺐُ ﺇِﻟَﻴْﻬِﻦَّﻭَﺃَﻛُﻦ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﺠَﺎﻫِﻠِﻴْﻦَ – ﻓَﺎﺳْﺘَﺠَﺎﺏَ ﻟَﻪُ ﺭَﺑُّﻪُ ﻓَﺼَﺮَﻓَﻌَﻨْﻪُ ﻛَﻴْﺪَﻫُﻦَّﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟﺴَّﻤِﻴْﻊُ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ- ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩৩-৩৪)-‘হে আমারপালনকর্তা! এরা আমাকে যেকাজের দিকে আহবানজানাচ্ছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকটেঅধিকপসন্দনীয়। (হে আল্লাহ!) যদি তুমি এদেরচক্রান্তকে আমার থেকেফিরিয়ে না নাও, তবেআমি (হয়ত) তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবংআমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’। ‘অতঃপর তারপালনকর্তা তার প্রার্থনা কবুল করলেন ও তাদেরচক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতাও সর্বজ্ঞ’ (ইউসুফ ১২/৩৩-৩৪)।শহরের সম্ভ্রান্তমহিলাদের নিজ বাড়ীতে জমা করে তাদের সামনেযুলায়খার নিজের লাম্পট্যকে প্রকাশ্যে বর্ণনারমাধ্যমে একথাও অনুমিত হয় যে, সেসময়কারমিসরীয় সমাজে বেহায়াপনা ও ব্যভিচারব্যাপকতর ছিল।নবীগণ নিষ্পাপ মানুষ ছিলেন:ইউসুফের প্রার্থনায় ‘আমি তাদেরপ্রতি আকৃষ্ট হয়েপড়ব’ কথার মধ্যে এ সত্য ফুটে উঠেছে যে,নবীগণ মানুষ ছিলেন এবং মনুষ্যসুলভ স্বাভাবিকপ্রবণতা তাদের মধ্যেও ছিল। তবে আল্লাহরবিশেষ অনুগ্রহ ও ব্যবস্থাধীনে তাঁরা যাবতীয়কবীরা গোনাহ হ’তে মুক্ত থাকেন এবং নিষ্পাপথাকেন।বেগানা নারী ও পুরুষের মাঝে চৌম্বিকআকর্ষণ এটা আল্লাহ সৃষ্ট প্রবণতা, যা অপরিহার্য।ফেরেশতাদের মধ্যে আল্লাহ এই প্রবণতা ওক্ষমতা সৃষ্টি করেননি। তাই তারা এসব থেকেস্বাভাবিকভাবেই মুক্ত।রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাদীছেকুদসীতে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয়ফেরেশতামন্ডলীকে বলেন, আমার বান্দা যখনকোন সৎকর্মের আকাংখা করে, তখন তার ইচ্ছারকারণে তার আমলনামায় একটা নেকী লিখে দাও। যদিসে সৎকাজটি সম্পন্ন করে, তবে দশটি নেকীলিপিবদ্ধ কর। পক্ষান্তরে যদি কোন পাপকাজেরইচ্ছা করে, অতঃপর আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করে,তখন পাপের পরিবর্তে তার আমলনামায় একটিনেকী লিখে দাও। আর যদি পাপকাজটি সে করেইফেলে, তবে একটির বদলে একটি গোনাহলিপিবদ্ধ কর’।[19]অতএব ইউসুফ-এর অন্তরেঅনিচ্ছাকৃত অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টির আশংকাটি কেবলধারণার পর্যায়ে ছিল। সেটা ছগীরা বা কবীরাকোনরূপ গোনাহের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।নিঃসন্দেহে ইউসুফ ছিলেন নির্দোষ ও নিষ্পাপ এবংপূত চরিত্রের যুবক।ইউসুফের সাক্ষী কেছিলেন?উপরের আলোচনায় ২৬নং আয়াতে আল্লাহবলেছেন, ﻭَﺷَﻬِﺪَ ﺷَﺎﻫِﺪٌ ﻣِّﻦْ ﺃَﻫْﻠِﻬَﺎ ‘ঐ মহিলারপরিবারের জনৈক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল’- কিন্তু কেসেইব্যক্তি, সে বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয়নি। তবেইবনু জারীর,আহমাদ, ত্বাবারাণী, হাকেম প্রমুখহযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে একটিহাদীছ বর্ণনা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছেযে, চারটি শিশু দোলনায় থাকতে কথা বলেছিল।তন্মধ্যে ‘ইউসুফের সাক্ষী’ ( ﺷﺎﻫﺪ ﻳﻮﺳﻒ )হিসাবে একটি শিশুর কথা এসেছে। শায়খ আলবানীবলেন, হাদীছটি যঈফ।[20] কুরতুবী বলেন, উক্তব্যক্তি ছিলেন, গৃহস্বামী ‘আযীযে মিছরের’সাথী তাঁর একান্ত পরামর্শদাতা দূরদর্শী জ্ঞানীব্যক্তি। যিনি যুলায়খার চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনিইউসুফেরজামা সম্মুখ থেকে বা পিছন থেকেছেঁড়া কি-না প্রমাণ হিসাবে পেশ করার কথা বলেন(ইউসুফ ১২/২৬-২৮)। যদি দোলনার শিশু সাক্ষ্য দিত,তাহ’লে সেটা অলৌকিক ঘটনা হ’ত এবং সেটাই যথেষ্টহ’ত। অন্য কোন প্রমাণের দরকার হতো না’।[21]ইউসুফ জেলে গেলেন :শহরের বিশিষ্টমহিলাদের সমাবেশে যুলায়খা নির্লজ্জভাবেবলেছিল, ইউসুফ হয়আমার ইচ্ছা পূরণ করবে, নয়জেলে যাবে’। অন্য মহিলারাও যুলায়খাকে সমর্থনকরেছিল। এতে বুঝা যায় যে, সে যুগে নারীস্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা চরমে উঠেছিল। তাদেরচক্রান্তের কাছে পুরুষেরা অসহায় ছিল।নইলেস্ত্রীর দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরেওমন্ত্রী তার স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়ার সাহস নাকরে নির্দোষ ইউসুফকে জেলে পাঠালেনকেন? অবশ্য লোকজনের মুখ বন্ধ করার জন্য ওনিজের ঘর রক্ষার জন্যও এটা হ’তে পারে।ইউসুফযখন বুঝলেন যে, এই মহিলাদের চক্রান্ত থেকেউদ্ধার পাওয়ার কোন উপায় নেই, তখন তিনিআল্লাহরআশ্রয় প্রার্থনা করে বললেন, আল্লাহ এরা আমাকেযে কাজেআহবান করছে, তার চেয়ে কারাগারইআমার জন্য শ্রেয়:। আল্লাহ তার দো‘আ কবুলকরলেন এবং তাদের চক্রান্তকে হটিয়ে দিলেন(ইউসুফ১২/২৩-২৪)। এতে বুঝা যায় যে, চক্রান্তটাএকপক্ষীয় ছিল এবং তাতে ইউসুফের লেশমাত্রসম্পৃক্ততা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ ইউসুফ যদিজেলখানাকে ‘অধিকতর পসন্দনীয়’ না বলতেন এবংশুধুমাত্র আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, তাহ’লেহয়তবা আল্লাহ তার জন্য নিরাপত্তার অন্য কোনব্যবস্থা করতেন।যাইহোক আযীযে মিছরেরগৃহে বাস করে চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করা অসম্ভববিবেচনা করে ইউসুফ যুলায়খার হুমকি মতেজেলখানাকেই অধিকতর শ্রেয়: বলেন। ফলেকারাগারই তার জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়।আল্লাহ তা‘আলামহিলাদের চক্রান্তজাল থেকে ইউসুফকেবাঁচানোর জন্য কৌশল করলেন। ‘আযীযে মিছর’ ওতার সভাসদগণের মধ্যে ইউসুফের সততা ওসচ্চরিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা জন্মেছিল। তথাপিলোকজনের কানা-ঘুষা বন্ধ করার জন্য এবংসর্বোপরি নিজের ঘর রক্ষা করার জন্য ইউসুফকেকিছুদিনের জন্য কারাগারে আবদ্ধ রাখাকেই তারাসমীচীন মনে করলেন এবং সেমতে ইউসুফজেলে প্রেরিত হলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,ﺛُﻢَّ ﺑَﺪَﺍ ﻟَﻬُﻢ ﻣِّﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﻣَﺎﺭَﺃَﻭُﺍ ﺍﻵﻳَﺎﺕِ ﻟَﻴَﺴْﺠُﻨُﻨَّﻪُ ﺣَﺘَّﻰ ﺣِﻴْﻦٍ -‘অতঃপর এসব (সততার) নিদর্শন দেখার পর তারা(আযীয়ে মিছর ও তার সাথীরা) তাকে(ইউসুফকে) কিছুদিন কারাগারে রাখা সমীচীন মনেকরল’ (ইউসুফ ১২/৩৫)।

Translate