Sunday, April 21, 2024

ইতিকাফ অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার

 প্রশ্ন: ইতিকাফ-এর সময় মোবাইল ফোনে কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ ইত্যাদি কি শোনা যাবে?

উত্তর: হ্যাঁ, যাবে। তবে এ সময় যথাসম্ভব নেট মোবাইল ব্যবহার থেকে দূরে থাকাই ভালো।‌ কারণ এটা খুবই আকর্ষণীয় জিনিস। এতে বিভিন্ন নোটিফিকেশন আসে। তখন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে সময় অপচয় হওয়ার ও বিভিন্ন অনর্থক কাজে সময় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি হারাম জিনিস দেখা বা‌ শোনার দিকেও মন ধাবিত হতে পারে। ইউটিউবে ওয়াজ বা কুরআন তিলাওয়াতের সময় অপ্রত্যাশিত হারাম অ্যাড প্রদর্শিত হতে পারে-যা ইতিকাফ-এর ভাব গাম্ভীর্যতা নষ্ট করবে এবং মসজিদের আদব ক্ষুণ্ণ করবে।
তবে এ বিকল্প হিসেবে নেট বিহীন মোবাইল ফোন থেকে ম্যামরিতে সংরক্ষিত কুরআনের অডিও-ভিজ্যুয়াল তিলাওয়াত বা বিজ্ঞ আলেমদের ওয়াজ বা ইসলামি আলোচনা শ্রবণ করা যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে যে, ইতিকাফ-এর উদ্দেশ্য হল, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষের সাথে যোগাযোগ (একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া), দুনিয়াবি কর্মব্যস্ততা, পাপাচার, অনর্থক কথা ও কাজ ইত্যাদি থেকে নিজেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর আনুগত্যে নিবিষ্ট চিত্তে কিছু সময় অতিবাহিত করা‌। এটি মহান স্রষ্টার সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করা এবং নিজেকে পরিবর্তন করা অপূর্ব সুযোগ। এটি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত।
তাই এ সময় জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, সিয়াম পালন ইত্যাদি ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি যথাসাধ্য নফল সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত, দুআ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, ইসতিগফার, দরুদ পাঠ, হাদিস পাঠ, ইসলামি বই-পুস্তক থেকে জ্ঞানার্জন ইত্যাদির মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করতে হবে।

ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদে মোবাইল-ফোন সঙ্গে রাখা এবং এর মাধ্যমে পরিবার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর রাখা জায়েজ আছে। কিন্তু মোবাইলের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা, গেমস খেলা, ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ ইত্যাদি দেখা কিংবা নাটক, সিনেমা বা মিউজিক ভিডিও ইত্যাদি দেখা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম।
মোটকথা, আমাদের ইতিকাফ যেন হয় সব অনর্থ কাজ ও পাপ-পঙ্কিলতা মুক্ত সেদিকে অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ অবস্থায় এমন কিছু করা উচিৎ নয় যা এই মহৎ উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

জুমাতুল বিদা কী এবং ইসলামের দৃষ্টিতে এটি পালনের কি কোন ভিত্তি আছে

 জুমাতুল বিদা বলতে বুঝায়, রমজানের শেষ জুমা সালাতের মাধ্যমে রমজানকে বিদায় জানানো।

আমাদের দেশে দেখা যায়, রমজানের শেষ শুক্রবারকে খুব গুরুত্বের সাথে ‘জুমাতুল বিদা’ হিসেবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষে জুমার নামাজে পরিলক্ষিত হয় প্রচুর ভিড়। এ দিনে কেউ কেউ মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে, কেউ কেউ এ দিন উপলক্ষে বিশেষ কিছু নামাজ পড়ে, মসজিদে মসজিদে আয়োজন করা হয় বিশেষ দুআ-মুনাজত, ইফতার পার্টি ইত্যাদি। পরে পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে নিউজ আসে “যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে সারা দেশে ‘জুমাতুল বিদা’ পালিত হয়েছে”!

অথচ রমজানের শেষ জুমার আলাদা কোনো ফজিলত আছে বা এ দিনটি বিশেষভাবে উদযাপন করতে হবে কুরআন-সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন ধারণা পাওয়া যায় না।
আমাদের কর্তব্য, প্রত্যেক জুমার দিনকে গুরুত্ব দেওয়া। সকল জুমার দিন ফজিলতপূর্ণ। রমজানের প্রতিটি দিন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রমজানের শেষ জুমার বিশেষ কোন ফজিলত আছে বলে কুরআন-সুন্নায় কোন প্রমাণ নাই।

সুতরাং এ দিনটিকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মনে করে ‘জুমাতুল বিদা’ পালন করা বিদআত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল প্রকার বিদআত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬ উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

তারাবিহ এর সালাত একাকী আদায় করার চেয়ে জামাতের সাথে আদায় করা অধিক উত্তম

 তারাবিহ-এর সালাত একাকী আদায় করা যেমন শরিয়ত সম্মত তেমনি জামাতে আদায় করাও শরিয়ত সম্মত। তবে একাকী আদায় করার চেয়ে জামাতের সাথে আদায় করা অধিক উত্তম। কারণ:

◈ ১- একাকী বা বিচ্ছিন্নভাবে তারাবিহ এর সালাত পড়ার চেয়ে মসজিদে জামাতে পড়া উত্তম না হলে উমর ইবনুল খাত্তাব রা. মানুষকে মসজিদে এক ইমামের পেছনে জামাত পূণপ্রতিষ্ঠিত করতেন না এবং এরপর এটিকে “চমৎকার আবিষ্কার نعمة البدعة هذا” বলে অবিহিত করতেন না।

◈ ২- সালাত আদায় শেষ হওয়া পর্যন্ত ইমামের সাথে থাকা সারারাত নফল সালাত আদায়ের সমপরিমাণ মর্যাদার কথা বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন: হাদিসে এসেছে,

مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ

“যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে সালাতে দাঁড়ায় এবং ইমামের শেষ করা পর্যন্ত তাঁর সাথে অবস্থান করে তাহলে তার জন্য সারারাত (নফল) সালাত আদায়ের সওয়াব লেখা হয়।” [সুনান আত তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৮/ সওম (রোজা) পরিচ্ছেদ: রমজান মাসের কিয়াম]
কিন্তু একাকী আদায় কারী জন্য এই মর্যাদা নেই।

◈ ৩- জামাতে তারাবিহর সালাত আদায় করা মূলত: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি সুন্নতকে পূর্ণজীবিত করার নামান্তর। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন দিন তা পড়েছিলেন। কিন্তু ফরজ হওয়ার আশঙ্কায় তা পরিত্যাগ করেছিলেন।

সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদেরকে নিয়ে কয়েক রাতে নামাজ পড়েছেন। তৃতীয় রাতে কিংবা চতুর্থ রাতে তিনি আর বের হননি। ভোরবেলায় তিনি বলেন,
لم يمنَعْني من الخروجِ إليكم إلَّا أنِّي خَشِيتُ أن تُفرَضَ عليكم، وذلك في رَمَضانَ
“অন্য কোন কারণ আমাকে বের হতে বাধা দেয়নি; তবে আমি তোমাদের উপর ফরজ করে দেওয়ার আশংকা করছি।”[সহিহ বুখারী, হা/১১২৯]

সহিহ মুসলিমের (৭৬১) ভাষ্যে এসেছে “কিন্তু আমি আশংকা করেছি তোমাদের উপর কিয়ামুল লাইল ফরজ করে দেওয়ার। এমনটি হলে পরে তোমরা তা আদায় করতে পারবে না।”

◈ ৪- উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর পর থেকে বাকি তিন খলিফা সবাই নিয়মিত জামাতের সাথেই তারাবহির সালাত আদায় করেছেন। [ফিকহ বিশ্বকোষ ২৭/১৩৮]

وجاء في الموسوعة الفقهية (27/138) “:
” وَقَدْ وَاظَبَ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ وَالْمُسْلِمُونَ مِنْ زَمَنِ عُمَرَ رضي الله تعالى عنه عَلَى صَلاةِ التَّرَاوِيحِ جَمَاعَةً , وَكَانَ عُمَرُ رضي الله تعالى عنه هُوَ الَّذِي جَمَعَ النَّاسَ فِيهَا عَلَى إمَامٍ وَاحِدٍ

-শাইখ আলবানি বলেন,

” وتشرع الجماعة في قيام رمضان ، بل هي أفضل من الانفراد ، لإقامة النبي صلى الله عليه وسلم لها بنفسه ، وبيانه لفضلها بقوله

“রমজান মাসে জামাতের সাথে কেয়াম করা শরিয়ত সম্মত। বরং তা একাকী পড়ার থেকে উত্তম। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তা করেছেন এবং তার মর্যাদা বর্ণনা করেছেন…। এ ছাড়াও বহু আলেম এই মত ব্যক্ত করেছেন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

টাকা বনাম খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে ৮ টি পয়েন্টে একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

 এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত এই আটটি পয়েন্ট হয়তো আপনাকে নতুন করে ভাবতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ।

নিম্নে সংক্ষেপে সেগুলো উপস্থাপন করা হলো:

✅ ১. প্রতিবছর রমজানের শেষে বহু মানুষ আলেম-উলামা ও মসজিদের ইমামদেরকে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে, “হুজুর, এবারের ফিতরা কত টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে? শাইখ, এবারের ফিতরা কত টাকা? মাওলানা সাহেব, এখনো কি ঠিক হয়েছে এ বছর কত টাকা ফিতরা দিতে হবে? ইত্যাদি। মানুষ এ বিষয়ে অনেক পেরেশান থাকে। তারা বিভিন্নভাবে তা জানার চেষ্টা করে। মনে হচ্ছে, আসলেই ইসলাম আগে থেকে এর কোন সমাধান দেয়নি। তাই সাধারণ মানুষ প্রতিবছর ইসলামি ফাউন্ডেশন, অমুক সংগঠন কিংবা অমুক মাদরাসার ফতোয়া বোর্ড কী সিদ্ধান্ত দেয় সেটা জানার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে! অথচ ইসলাম মানুষকে এই অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিয়েছে ১৪০০ বছর পূর্বেই। অর্থাৎ ফিতরার পরিমাণ আগে থেকেই নির্ধারিত। তা হলো, এক সা পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য। (যা বর্তমানে আড়াই বা তিন কেজি দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য। (যেমন: আমাদের দেশে, চাল)। যা কখনো পরিবর্তনযোগ্য নয়।
সাধারণ মানুষকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে এই অস্থিরতার মধ্যে ফেলে রাখার পেছনে দায়ী কারা? মূলত আমাদের সমাজের এক শ্রেণির আলেম-ওলামা এবং মসজিদের ইমামগণই এ জন্য দায়ী। কারণ তারা সর্বসাধারণের মাঝে এই খাদ্যদ্রব্য দানের বিষয়টি প্রচার করলে মানুষ এমন অস্থিরতা, দ্বিধা-সংশয়‌ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খেত না।

✅ দুই. বর্তমানে একদল মানুষকে এই যুক্তি দিতে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহর রাসুলের যুগে খাদ্যদ্রব্যকে কারেন্সি বা নগদ অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যার দলিল হিসেবে তারা, হিজামা কারীকে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা পারিশ্রমিক দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে থাকেন। হ্যাঁ, এ বিষয়টি আমরা অস্বীকার করি না। তৎকালীন সময়ে দিনার-দিরহাম, দানেক, কিরাত নামক বিভিন্ন ক্যাটাগরির মুদ্রার প্রচলন থাকলেও কখনো কখনো খাদ্যদ্রব্য দ্বারাও পারিশ্রমিক দেওয়া হতো।‌ কিন্তু ফিতরার আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত এক সা পরিমাণ যেসব খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো কোনভাবেই নগদ মূল্যের বিকল্প নয়। কেননা লক্ষ্য করুন, হাদিসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্য গুলোর মূল্যমান এক সমান নয়। এক সা যব অথবা গম কি কখনো এক সা কিসমিস অথবা পনিরের সমান হতে পারে? খেজুর আর গম বা জবের বাজার মূল্য কি সমান? কখনোই নয়। আগেও ছিল না। এখনও নেই। এখান থেকে প্রতিমান হয় যে, খেজুর যব, গম, পনির, কিসমিস ইত্যাদি সমমূল্যের না হওয়ার পরেও সবকিছুই ‘এক সা’ পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি নিছক একটি ইবাদত‌। অতএব ভুয়া যুক্তি খাটিয়ে এগুলোকে কারেন্সি বানানোর পাঁয়তারা একদমই অগ্রহণযোগ্য।

✅ তিন. বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক এবারের (২০২৩) ঘোষিত ফিতরার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৪০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা নির্ধারণ নিতান্তই অযৌক্তিক এবং ইসলামি শরিয়তের একটি বিধানকে নিজেদের মতো অপব্যাখ্যা করার শামিল। একই বিধানের ক্ষেত্রে কেউ দিবে মাত্র ১১৫ টাকা আর কেউ দিবে ২৬৪০ টাকা-এমন অদ্ভুত নীতি ইসলাম সম্মত হতে পারে না। বরং সঠিক হল, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফিতরার পরিমাণ এক ও অভিন্ন হওয়া। যেমনটি মানত ভঙ্গের কাফফারা, কসম ভঙ্গের কাফফারা, দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসের কাফফারা, রোজা রাখতে অক্ষম ব্যক্তির ফিদিয়া, হজের ক্ষেত্রে ফিদিয়া ও দম, রক্তপন
ইত্যাদি ক্ষেত্রে সকলের জন্য ইসলামের বিধান এক ও অভিন্ন। এক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মাঝে কোনো তারতম্য নেই। সুতরাং রোজার ফিতরার ক্ষেত্রেও সর্ব শ্রেণির মুসলিমের বিধান এক হবে-এটাই যৌক্তিক‌। আর বাস্তবে ইসলামে তাই বলা হয়েছে।

✅ চার. সুন্নাহ অনুসরণের মধ্যে দেশ ও দেশের মানুষের জন্যই কল্যাণকর।কীভাবে? আমাদের বাংলাদেশে প্রায় ১৫ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জনপ্রতি আড়াই বা তিন কেজি পরিমাণ চাল দেওয়ার বিধান বাস্তবায়িত হলে বাজারে এত বিশাল পরিমাণ চালের যোগান দেওয়ার জন্য দেশে কী পরিমাণ চাষাবাদ করার প্রয়োজন হতো? কী পরিমাণ আবাদি জমির ব্যবহার হতো? কী পরিমাণ শ্রমিক কাজ পেতো? কত মানুষকে এর পেছনে শ্রম ব্যয় করতে‌ হতো? একটু হিসাব করে দেখুন। এর মাধ্যমে মূলত আমাদের কৃষক, শ্রমিক এবং চাষাবাদ, উৎপাদন, পরিবহন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সর্বশ্রেণির ব্যবসায়ী উপকৃত হতো। সমৃদ্ধ হতো দেশের অর্থনীতি এবং আরো বেশি সচল হতো অর্থনীতির চাকা। পক্ষান্তরে টাকা দ্বারা ফিতরা দেওয়ার ফলে কেবলমাত্র জন থেকে জনে অর্থ হাত বদল হয়। ফলে দেশের সাধারণ মানুষ এবং দেশের অর্থনীতি উৎপাদনমুখী বিরাট সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।

✅ পাঁচ. টাকা দ্বারা ফিতরা আদায়ের ফলে ফিতরা গ্রহণকারী ব্যক্তি টাকা হাতে পেয়ে বিড়ি, সিগারেট,‌ মদ-গাজা বা হারাম বস্তু ক্রয়ের সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি নিজে গুনাহগার হওয়ার পাশাপাশি তার পরিবারের অন্য সদস্যগণ এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পক্ষান্তরে খাদ্যদ্রব্যে এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সাধারণত খাদ্যদ্রব্য দ্বারা পরিবারের সকলেই উপকৃত হয়। অবশ্যই আল্লাহর প্রত্যেকটি বিধানের মধ্যেই হেকমত রয়েছে এবং সেগুলোতে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে যদি তারা তা বুঝতো।

✅ ছয়. ফিতরার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, গরিব-অসহায় মানুষের খাদ্য সংস্থান-যেমনটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ গরিব-অসহায় মানুষ যেন ঈদের দিন অভ্যুক্ত না থেকে যায়। মুসলিমদের জাতীয় উৎসবের দিনে তার বাড়িতে যেন কমপক্ষে কিছু খাবার মজুদ থাকে। সেই খাবার খেয়ে হলেও যেন ঈদের মাঠে যেতে পারে। ‌আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন খেজুর খেয়ে তারপরে ঈদের মাঠে গেছেন। অতএব ওই গরিব মানুষটিও যেন ফিতরার মাধ্যমে প্রাপ্ত খাবার খেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম-এর এই সুন্নাহটি পালনের সুযোগ পায়। এটি খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরার অন্যতম একটি উপকারিতা।

✅ সাত. ইসলামের বিধি-বিধানগুলো বৈচিত্র্যময়। এই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময়তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন উপকারিতা এবং স্বাদ রয়েছে। তাই‌ দেখা যায়, ইসলাম সম্পদের জাকাতের জন্য অর্থ দেওয়াকে আবশ্যক করেছে। অর্থ ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া জায়েজ নেই। যেন মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী তা খরচ করতে পারে। পক্ষান্তরে রমজান শেষে মানুষের গুনাহ মোচন এবং গরিব-অসহায় মানুষের খাবার হিসেবে খাদ্যদ্রব্য নির্ধারণ করেছে। এটি ইবাদত গত বৈচিত্রের একটি উদাহরণ। সুতরাং জাকাতের ক্ষেত্রে যেমন খাদ্যদ্রব্য বা অন্য কিছু ক্রয় করে দেওয়া জায়েজ নেই তেমনি ফিতরার ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া জায়েজ নেই (বিশেষ প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা)।

✅ আট. এক দুঃখজনক নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-ওলামাগণ টাকা দ্বারা ফিতরা দেওয়ার ফতোয়া প্রচারের ফলে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা যে ফিতরা দেওয়া সুন্নত (যে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই) সাধারণ মানুষ সেটাই ভুলতে বসেছে। যার কারণে বহু মানুষ আদৌ জানে না যে, খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা দেওয়া যায়। এবং যারা ফিতরা গ্রহণ করে তারাও অধিকাংশই টাকা ছাড়া অন্য কিছু নিতে নারাজ। এভাবেই আমাদের সমাজে জায়েজের ফতোয়া দিয়ে সুন্নতকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এইসব বিবেক প্রসূত ফতোয়ার মাধ্যমে-যা খুবই দুঃখজনক। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।

পরিশেষে বলবো, নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রত্যেকটি বিধানে‌ রয়েছে গভীর হেকমত ও প্রজ্ঞা যে সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জ্ঞান রাখে।
অতএব মানুষের তৈরি করা নানা যুক্তি মতবাদের পিছনে না ছুটে আমরা আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করি। এতেই ইনশাআল্লাহ আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে অবারিত কল্যাণের অধিকারী হবো।
আল্লাহ সকলকে তৌফিক দান করুন। আমিন।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব।

সুন্নত পালনার্থে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা দিন টাকা দিয়ে নয়

 প্রশ্ন: যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে টাকা দেওয়া সুন্নত না কি খাদ্যদ্রব্য?

উত্তর: হাদিসে ফিতরা হিসেবে খাদ্যদ্রব্য প্রদানের কথাই বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল কিন্তু তারা কখনো খাদ্যদ্রব্য ছাড়া দিনার-দিরহাম বা অন্য কিছু দ্বারা ফিতরা প্রদান করেছেন বলে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

কী কী জিনিস দ্বারা এবং কত পরিমাণ ফিতরা দেওয়া সুন্নত?

এর উত্তর সহীহ হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে যার, ফল কথা হল: খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর কিংবা প্রধান খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা দেওয়া সুন্নত, মূল্য দ্বারা নয়। আর এক জন ব্যক্তিকে এক সা’ ফিতরা দিতে হবে, যার পরিমাণ সাধারণ মানুষের চার পূর্ণ অঞ্জলি সমান। [ফাতাওয়া মাসায়েল, মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৩] কেজির ওজনে তা আড়াই কিলোর কম নয়।

▪ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
فَرَضَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِن تَمْرٍ، أوْ صَاعًا مِن شَعِيرٍ علَى العَبْدِ والحُرِّ، والذَّكَرِ والأُنْثَى، والصَّغِيرِ والكَبِيرِ مِنَ المُسْلِمِينَ، وأَمَرَ بهَا أنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إلى الصَّلَاةِ

‘‘আল্লাহর রাসুল যাকাতুল ফিতর স্বরূপ এক সা কিংবা এক সা যব ফরজ করেছেন মুসলিম দাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড় সবার উপর। আর তা লোকদের নামাজে বের হওয়ার পূর্বে আদায় করে দিতে আদেশ করেছেন”। [বুখারী, অধ্যায়: যাকাত হাদিস নম্বর ১৫০৩/ মুসলিম নম্বর ২২৭৫]

উক্ত হাদিসে দুটি খাদ্য দ্রব্যের নাম পাওয়া গেল যেগুলো দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ফিতরা দেওয়া হত। একটি হচ্ছে খেজুর অপরটি যব।
এবার নিম্নে আর একটি হাদিস পাঠ করুন:
আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন,

كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِن طَعَامٍ، أوْ صَاعًا مِن شَعِيرٍ، أوْ صَاعًا مِن تَمْرٍ، أوْ صَاعًا مِن أقِطٍ، أوْ صَاعًا مِن زَبِيبٍ

‘‘আমরা-নবীজীর যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ।’’ [বুখারী- ১৫০৬ মুসলিম-২২৮১]

এই হাদিসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল, কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য।

উল্লেখ থাকে যে, নবীজীর মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া রা.এর খেলাফত কালে অনেকে গম দ্বারা ফিতরা দিতেন। [বুখারী হাদিস নম্বর ১৫০৮ মুসলিম ২২৮১] তাই আমরা যদি সুন্নত অনুসরণ করতে চাই তাহলে আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রধান খাদ্য দ্রব্য তথা চাল দ্বারা ফিতরা দেওয়া কর্তব্য। ফিতরার মুল্য দ্বারা অথবা সে টাকা দিয়ে পোশাক, গোশত, চিনি, তেল, ডাল, মসলা, শেমাই ইত্যাদি কিনে দেওয়া সুন্নত পরিপন্থী।

তবে একান্ত জরুরি অবস্থায় টাকা দ্বারা ফিতরা দেওয়া যেতে পারে বলে, অনেক আলেম মন্তব্য করেছেন। যেমন: রোগীর চিকিৎসার জন্য জন্য এই মুর্হতে টাকা প্রয়োজন। চাল দিলে সেটা বিক্রয় করে টাকা সংগ্রহ করতে গেলে রোগীর সমস্যা বেড়ে যেতে পারে…বা এ জাতীয় পরিস্থিতে ফিতরার মূল্য দিলেও আদায় হয়ে যাবে। কারণ এখানে বিশেষ পরিস্থিতে মুল্য দ্বারা ফিতরা প্রদান করা হয়েছে। এটা ব্যতিক্রমি পরিস্থিতি।

সুতরাং আমাদের কতর্ব্য, খাদ্যদ্রব্য দেওয়া। কেউ যদি তা নিতে না চায় তাহলে এমন ব্যক্তিকে দেওয়া উচিৎ যে তা গ্রহণ করবে।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের হানাফি সামাজ থেকে খাদ্যদ্রব্য দেওয়ার সুন্নতটি প্রায় উঠে যাওয়ার কারণে তারা প্রতি বছর টাকা নির্ধারণ করে থাকেন আর গরিবরাও টাকা ছাড়া অন্য কিছু নিতে চায় না। তবে আল হামদুলিল্লাহ অধিকাংশ আহলে হাদিস সমাজে খাদ্যদ্রব্য দেওয়ার সুন্নতটি এখনো প্রচলিত রয়েছে।

সৌদি আবরেও এখনো ফিতরা হিসেবে চাল দেওয়ার সুন্নতটি চালু আছে। এখানে চ্যারিটেবল সোসাইটিগুলোতে চাল ও টাকা উভয়টি নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে টাকা দ্বারা চাল কিনে গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হয়। আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাহ পালনের তৌফিক দান করুন‌ আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◆◈◆ ▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সউদী আরব।

Translate