Saturday, February 5, 2022

জীবন পরিবর্তন করার মত ১৩০টি জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা

 জীবন পরিবর্তন করার মত ১৩০টি ‘জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা

▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
মানুষ জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এবং বহু আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভর্তি করে। পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে তার হৃদয় আলোকিত ও সমৃদ্ধ হয়। পরিপক্ব হয় তার বুদ্ধি ও বিবেক। এই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার ফলাফল হল, জ্ঞানীদের প্রজ্ঞা পূর্ণ বিভিন্ন উক্তি ও প্রবচন। এগুলো আমাদের জীবনের জন্য অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞজনদের জ্ঞান ও উপদেশ পূর্ণ কথা আমাদের জীবন চলার পথকে সহজ করে দেয় এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে।

নিম্নে এ জাতীয় ১৩০টি প্রজ্ঞা পূর্ণ উক্তি এবং জ্ঞানের কথা উপস্থাপন করা হল:

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-১

১. ভুল করা দোষের কথা নয় বরং ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা দূষণীয়।
২. জ্ঞানী মূর্খকে চিনতে পারে। কেননা সে জ্ঞানী। পক্ষান্তরে মূর্খ জ্ঞানীকে চিনতে পারে না। কেননা সে মূর্খ।
৩. বন্ধুত্ব একটি ছাতার ন্যায়। বৃষ্টি যতই প্রবল হয় ছাতার ততই প্রয়োজন পড়ে।
৪. পা পিছলে পড়ে যাওয়া লজ্জার কথা নয়। বরং যথা সময়ে উঠে না দাঁড়ানোই লজ্জার ব্যাপার।
৫. বুদ্ধির সীমা আছে কিন্তু বোকামির কোন সীমা নেই।
৬. মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ছিন্ন করে অর্থ উপার্জন করতে যেও না। কারণ, বন্ধুত্ব স্থাপনই অর্থ উপার্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
৭. মানুষের সাথে সে রূপ আচরণ কর যেমন তারা পছন্দ করে। নিজের পছন্দ মাফিক আচরণ কর না।
৮. তর্কে জেতা বুদ্ধিমানের কাজ নয় বরং বুদ্ধিমানের কাজ হল, তর্কে না জড়ানো।
৯. আহাম্মকের সাথে তর্ক কর না। কারণ, মানুষ হয়ত দুজনের মাঝে পার্থক্য করতে ভুল করবে।
১০. তোমার স্ত্রীর রুচি বোধকে অবমূল্যায়ন কর না। কারণ, সে তোমাকে প্রথম পছন্দ করেছে।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-২

১১. যারা ব্যর্থতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস রাখে তারাই কষ্টকে জয় করে এবং সফল হয়।
১২. তোমার পিঠে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত চড়তে পারবে না যতক্ষণ না তুমি পিঠ নিচু কর।
১৩. তুমি যতটা মূল্যবান ততটা সমালোচনার পাত্র হবে।
১৪. যে অধিকার আদায়ের পেছনে চেষ্টা চালানো হয় তা কখনই বৃথা যায় না।
১৫. ইমাম মুসলিম রাহ. বলেন, “শরীরকে আরামে রেখে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব নয়।”
১৬. বেলাল বিন সাদ রাহ. বলেন, “পাপ ছোট কি না তা দেখ না বরং দেখ যার অবাধ্যতা করছ তিনি কত বড়।
১৭. রাফেঈ বলেন, “যদি তুমি দুনিয়াকে নতুন কিছু উপহার দিতে না পার তবে তুমি দুনিয়ার একটি বোঝা।”
১৮. মিসরীয় সাহিত্যিক আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ বলেন, “তিনটি ভাল বই একবার করে পড়ার চেয়ে একটি ভাল বই তিনবার পড়া বেশি উপকারী।”
১৯. পৃথিবীটা লবণাক্ত পানির মত। যতই তা পান করবে পিপাসা ততই বাড়বে।
২০. তুমি পাহাড়ের চূড়ার মত হইয়ো না। কারণ, এতে তুমি মানুষকে ছোট দেখবে আর মানুষও তোমাকে ছোট দেখবে।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৩

২১. চিরকাল অন্ধকারকে গালমন্দ না করে ছোট্ট একটি বাতি জ্বালানো অনেক ভালো।
২২. সব কিছু জানা তোমার জন্য আবশ্যক নয়। কিন্তু যা কিছু বলছ তার সবটুকু সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
২৩. কুপে থুথু ফেল না। কারণ, হয়ত কখনো তোমার এ কুপ থেকে পানি পান করার প্রয়োজন হতে পারে।
২৪. গাছ থেকে যখন আপেল পড়ল তখন সবাই বলল, গাছ থেকে আপেল পড়েছে। কিন্তু সব মানুষের মধ্যে এক ব্যক্তিই শুধু জানতে চাইল কেন আপেলটি পড়েছে? (আর তার মাধ্যমেই আবিষ্কৃত হল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।)
২৫. জীবন চলার পথে পড়ে আছে অসংখ্য পাথর। এতে তোমার চলার পথ যেন থেমে না যায়। বরং পাথরগুলো কুড়িয়ে তৈরি কর সাফল্যের সিঁড়ি।
২৬. যে হিংসা করে সে সবার আগে নিজের ক্ষতি করে।
২৭. আত্মতৃপ্তিতে ভোগা সংকীর্ণ জ্ঞানের পরিচয়।
২৮. যে অল্পতে তুষ্ট থাকে তার কাছে এ পৃথিবীর সব কষ্ট সহজ হয়ে যায়।
২৯. যদি নিজে নিজের বিবেককে বড় মনে কর তবে শত্রু সৃষ্টি হবে আর যদি হৃদয়কে বড় কর তবে বন্ধু বৃদ্ধি হবে।
৩০. যার ভুল হয় সে মানুষ আর যে ভুলের উপর স্থির থাকে সে শয়তান।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৪

৩১. বাকপটু ও নির্বোধের সাথে তর্কে যেও না। কারণ, বাকপটু তোমাকে কথায় পরাজিত করবে আর নির্বোধ তোমাকে কষ্ট দিবে।
৩২. যদি তুমি তোমার বন্ধুর সব কাজের সমালোচনা কর তবে এমন একটা সময় আসবে যখন সমালোচনা করার মত আর কোন বন্ধু খুঁজে পাবে না।
৩৩. শুধু জ্ঞান তোমার কোন কাজ দেবে না যদি না তুমি চরিত্রের মুকুট মাথায় পরিধান কর।
৩৪. অস্ত্রের আঘাত শুকিয়ে যায় কিন্তু কথার আঘাত শুকায় না।
৩৫. হাতে একটা চড়ুই পাখি থাকা গাছে দশটি থাকার চেয়ে ভাল।
৩৬. যদি চাও যে তোমার আদেশ পালন করা হোক তবে এমন আদেশ দাও যা করা সম্ভব।
৩৭. বক্তব্যে যদি অল্প কথায় ভাব ফুটিয়ে তুলতে সম্ভব হয় তবে সেটাই শ্রেষ্ঠ বক্তব্য।
৩৮. মানুষের সাথে কথা বল তাদের বুঝার ক্ষমতা অনুযায়ী।
৩৯. জ্ঞান যতই গভীর হয় কথা ততই হ্রাস পায়।
৪০. খারাপ বন্ধুর চেয়ে একা থাকা অনেক ভাল।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৫

৪১. মিথ্যার দাপট ক্ষণস্থায়ী কিন্তু সত্যের দাপট চিরস্থায়ী।
৪২. সম্পদ আসে কচ্ছপের মত আর যায় হরিণের মত।
৪৩. নির্বোধের কথার উত্তর না দেয়াই তার উত্তর।
৪৪. চরিত্রের কারণেই অনেক সম্মানিত ব্যক্তি সম্মান হারিয়েছে আবার অনেক নগণ্য ব্যক্তি কুঁড়িয়েছে বিরাট সম্মান।
৪৫. কোন ঘুমন্ত লোকের নিকট বসে না থাকা আর কোন ঘুমন্ত লোকের পাশে না ঘুমানো ভদ্রতার ব্যাপার।
৪৬. যে কাউকে বিশ্বাস করে না তাকে কেউ বিশ্বাস করে না।
৪৭. কোন মানুষকে সম্মান করা তার হৃদয়ের মনি কোঠায় প্রবেশের চাবির সমতুল্য।
৪৮. কোন জিনিসই অতিরিক্ত হওয়া ভালো নয় দুটি জিনিস ছাড়া। এক: জ্ঞান, দুই: ভদ্রতা।
৪৯. বিপদে হা-হুতাশ করা আরেকটি বিপদ।
৫০. জ্ঞানীর সম্পদ হল তার জ্ঞান আর মূর্খের সম্পদ হল তার অর্থ।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৬

৫১. যদি বাঘের দাঁত বের হয়ে থাকতে দেখ তবে মনে কর না যে, সে হাসছে।
৫২. জ্ঞানী আগে চিন্তা করে পরে কথা বলে আর নির্বোধ আগে কথা বলে পরে চিন্তা করে।
৫৩. যে অন্যের বিপদাপদ দেখে তার নিকট নিজের বিপদ তুচ্ছ হয়ে যায়।
৫৪. যার গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায়।
৫৫. প্রকৃত বন্ধুরা তারকার মত। তারকা সব সময় দেখা যায় না কিন্তু সেগুলো আকাশেই থাকে।
৫৬. ঘোড়াকে জোর করে পানিতে টেনে নেয়া সম্ভব। কিন্তু তাকে জোর করে পানি পান করানো সম্ভব নয়।
৫৭. ঝাড়ুদারের পেশা হল, আবর্জনা পরিষ্কার করা। আর যারা তাদেরকে ঘৃণা করে তাদের পেশা হল: নোংরা ও আবর্জনা সৃষ্টি করা।
৫৮. ব্যর্থ মানুষেরা দু প্রকার। এক প্রকার হল, যারা কাজের চিন্তা করেছে কিন্তু কাজ করে নি। আরেক প্রকার হল, যারা কাজ করেছে কিন্তু চিন্তা করে তা করে নি।
৫৯. কথা বলার আগে বিষয় নির্বাচন কর। আর বিষয় নির্বাচনে পর্যাপ্ত সময় নাও, যাতে তা পরিপক্ব হয়। কারণ, মানুষের কথাগুলো ফলের মত। সেগুলো পরিপক্ব হতে পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন।
৬০. ছোট-খাট বিষয়ে বিতর্ক করলে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। কারণ, আমাদের মাঝে এমন অনেক লোক আছে যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চেয়ে ছোট-খাট বিষয়গুলো সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখে।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৭

৬১. মানুষ যখন কারো প্রশংসা করে তখন খুব কম লোকেই তা বিশ্বাস করে। কিন্তু যখন কিনা কারো বদনাম করা হয় তখন প্রায় সবাই তা বিশ্বাস করে।
৬২. যখন অনেক উঁচু স্তরে পৌঁছে যাও তখন নিচের দিকে তাকাও যেন দেখতে পাও কারা তোমাকে এ পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। আর আকাশের দিকে তাকাও যেন আল্লাহ তোমার পদযুগল স্থির রাখেন। অর্থাৎ যেন আল্লাহ তোমার এ মর্যাদা ধরে রাখেন।
৬৩. যখন হতাশা জীবনকে ঘিরে ফেলে তখন হতাশার সাগরে আশার সেতু রচনা কর, জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর।
৬৪. মানুষ (তোমার কথায় বিরক্ত হয়ে) তাদের কান বন্ধ করার আগে তুমি নিজের মুখ বন্ধ কর আর মানুষ (তোমার বিরুদ্ধে) মুখ খোলার আগে নিজের কান খোল। তবেই তুমি সফল মানুষ হবে।
৬৫. যে ব্যক্তি দ্বিমুখী নীতি নিয়ে জীবন যাপন করে সে ব্যক্তি যখন মারা যায় তার কোন নীতিই থাকে না।
৬৬. রাগ অবস্থায় যদি কথা বল তবে এমন কথা বলে ফেলতে পর যার জন্য তুমি সারা জীবন লজ্জিত থাকবে।
৬৭. সচ্চরিত্র মানুষের অনেক খারাপ দিককে ঢেকে দেয় যেমন অসৎ চরিত্র অনেক ভালো দিককে ঢেকে দেয়।
৬৮. তোমার শক্তিমত্তা যখন তোমাকে অন্যায়-অবিচারের দিকে আহবান করে তখন আল্লাহর শক্তিমত্তার কথা স্মরণ কর।
৬৯. নীতি হীন মানুষ কাঁটা হীন ঘড়ির মত।
৭০. মানুষের অস্থির ধমনীকে শান্ত করার জন্য উপযুক্ত সময়ে একটি সুন্দর কথা বলার চেয়ে কার্যকরী কোন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নি।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৮

৭১. সততা একটি ছোট গাছের মত। সেটি লাগানোর পর পরিচর্যা নেয়া প্রয়োজন, যেন তা শক্ত হয় ও বৃদ্ধি পায়।
৭২. নম্রতার মাধ্যমে যা অর্জন করা যায় কঠোরতা মাধ্যমে তা অর্জন করা যায় না।
৭৩. বেশি কৌতুক করলে ব্যক্তিত্ব চলে যায় আর বেশি হাসলে প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়।
৭৪. পৃথিবীতে যত পাত্র আছে তাতে কিছু রাখা হলে তার স্থান ছোট হয়ে আসে। তবে জ্ঞানের পাত্র এর ব্যতিক্রম। এতে যতই জ্ঞান ঢালা হয় ততই তা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৭৫. মূর্খতার মত দরিদ্রতা আর জ্ঞানের মত সম্পদ কিছু নেই।
৭৬. লোকমান হাকিম রাহ. বলেন, “মানুষ যখন গর্ব করে সুন্দরভাবে কথা বলার মাধ্যমে; তুমি তখন গর্ব কর নীরবতা সহকারে অন্যের কথা সুন্দরভাবে শোনার মাধ্যমে।”
৭৭. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুকাফ্ফা বলেন, তুমি যদি করো উপকার কর তবে সাবধান! কখনো তা তার কাছে উল্লেখ কর না। আর কেউ যদি তোমার উপকার করে তবে সাবধান! কখনো তা ভুলে যেও না।
৭৮. তিনি আরও বলেন, যা কিছু শোন সেগুলো থেকে সব চেয়ে ভালো কথাগুলো লিখে রাখ। আর যা কিছু লেখ সেগুলো থেকে সব চেয়ে ভালোকথাগুলো সংরক্ষণ কর আর যা কিছু শোন সেগুলো থেকে চেয়ে ভালো কথাগুলো মানুষকে বল।
৭৯. যে ব্যক্তি কাউকে গোপনে উপদেশ দিল সে তাকে খুশি ও সুশোভিত করল আর যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে কাউকে উপদেশ দিল সে যেন তাকে লাঞ্ছিত ও কলঙ্কিত করল।
৮০. জনৈক জ্ঞানী বলেন, সব কিছুই ছোট আকারে শুরু হয় পাপ ছাড়া। কারণ, কেউ বড় পাপ করতে শুরু করলে আস্তে আস্তে তা তার নিকট ছোট মনে হয়। আর কোন কিছু অতিরিক্ত হলে তার মূল্য কমে যায় আদব বা ভদ্রতা ছাড়া। কারণ, আদব যতই বৃদ্ধি পায় তার মূল্য ততই বেড়ে যায়।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-৯

৮১. জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কোথা থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন? তিনি বললেন, অন্ধের কাছ থেকে। কারণ, সে মাটিতে পা ফেলে না লাঠি দ্বারা তা ভালভাবে পরীক্ষা না করে।
৮২. জনৈক দার্শনিক বলেন, মানুষ তিন প্রকার। একশ্রেণীর মানুষ হল, খাদ্যের মত যাদের দরকার হয় সবসময়। আরেক শ্রেণীর মানুষ হল, ওষুধের মত যাদের দরকার হয় মাঝে মাঝে। আরেক শ্রেণীর মানুষ হল রোগের মত যা আপনার কখনোই দরকার হয় না।
৮৩. পানি গর্ত সৃষ্টি করে। কিন্তু তা শক্তি দিয়ে নয় বরং অব্যাহত পতনের মাধ্যমে।
৮৪. কথা যদি অন্তর থেকে বের হয় তবে তা অন্তরে প্রবেশ করে। কিন্তু তা যদি শুধু মুখ থেকে বের হয় তা কান অতিক্রম করে না।
৮৫. ফুল থেকে শিক্ষা নাও প্রফুল্লতা, ঘুঘু থেকে শিক্ষা নাও নম্রতা, মৌমাছি থেকে শিক্ষা নাও শৃঙ্খলা, পিপীলিকা থেকে শিক্ষা নাও কাজ আর মোরগ থেকে শিক্ষা নাও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা।
৮৬. পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে আপনার চেয়েও কষ্টে আছে। অত:এব, হাসি-খুশি থাকুন।
৮৭. মুচকি হাসি হল, শব্দ বিহীন কথা।
৮৮. তোমার স্ত্রীর রুচি বোধের ত্রুটি ধর না। কারণ, তুমি তার প্রথম পছন্দ।
৮৯. যে ব্যক্তি এক সাথে দুটি শিকার ধরার জন্য ছুটবে সে দুটিই হারাবে।
৯০. এক হাতে দুটি তরমুজ নেওয়া যায় না।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-১০

৯১. পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ হল, ব্যর্থ হওয়ার পরিকল্পনা করা।
৯২. মানুষের হৃদয় জয় করতে চাইলে তাদের উপকার কর।
৯৩. জ্ঞান যখন পরিপক্ব হয় কথা তখন হ্রাস পায়।
৯৪. যে অল্পে তুষ্ট থাকে সে সম্মান পায় আর যে অতি লোভ করে সে লাঞ্ছিত হয়।
৯৫. অন্ধকারকে সারা জীবন গালাগালি না করে ছোট্ট একটি মোমবাতি জ্বালানো অনেক ভালো।
৯৬. বড় বড় উপাধি নির্বোধদের প্রত্যাশার জিনিস পক্ষান্তরে মহান ব্যক্তিদের নাম ছাড়া অন্য কিছুই দরকার নাই।
৯৭. তোমার প্রকৃত বন্ধু সেই ব্যক্তি যে তোমার ভুলগুলোকে স্পষ্ট ভাষায় তোমাকে জানায়। সে ব্যক্তি নয় যে তোমাকে খুশি করতে তোমার ভুলগুলোকে সঠিক বলে তোমার সামনে তুলে ধরে।
৯৮. মৃদু হাসি ভাষাহীন বক্তব্য।
৯৯. সুন্দর কথা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছার পাসপোর্ট।
১০০. অহংকার যখন বেড়ে যায় জীবনের আনন্দ তখন লোপ পায়।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-১১

১০১. তোমার শত্রুও যদি পরামর্শ চায় তবে তাকে ভালো পরামর্শ দাও। কারণ, তোমার পরামর্শে হয়ত সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হবে।
১০২. ধৈর্য ধর, শক্ত হও আর মনে রেখ, সময় সর্বদা এক অবস্থায় থাকে না।
১০৩. শিশুকালে শিক্ষা দেওয়া পাথরে খোদাই করার মত।
১০৪. সবচেয়ে বড় মিথ্যুক সে ব্যক্তি যে নিজের সম্পর্কে বেশী বলে।

১০৫. ইমাম শাফেয়ী:
“প্রকৃত শিক্ষা সেটাই যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়। সেটা প্রকৃত শিক্ষা নয় যা শুধু মুখস্থ রাখা হয় কিন্তু কোন কাজে লাগানো যায় না।”
‘‘যে ব্যক্তি কাউকে গোপনে উপদেশ দিল সে সত্যিকার তার কল্যাণকামিতার পরিচয় দিল আর যে লোক সম্মুখে উপদেশ দিল সে তাকে অপমান করল।”

১০৬. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল:
“আল্লাহর ভয়কে পাথেয় আর আখিরাতকে গন্তব্য বানিয়ে পথ চলো।”

১০৭. আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক:
“অনেক বড় বড় কাজ নিয়তের কারণে ছোট হয়ে যায়। আর অনেক ছোট ছোট কাজ নিয়তের কারণ, বড় হয়ে যায়।”

১০৮. জনৈক মনিষী:
“আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বিবেক দিয়েছেন; কু প্রবৃত্তি দেন নি। পশুদেরকে কু প্রবৃত্তি দিয়েছেন; বিবেক দেন নি। আর মানুষকে কু প্রবৃত্তি ও বিবেক উভয়টি দিয়েছেন।সুতরাং মানুষের বিবেক যখন কু প্রবৃত্তির উপর প্রাধান্য পায় তখন সে ফেরেশতাদের সমপর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর যখন তার কু প্রবৃত্তি বিবেকের উপর প্রাধান্য পায় তখন সে পশুর স্তরে নেমে যায়।”

১০৯. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.:
“প্রবৃত্তি পূজারীদের সাথে উঠ-বসা করলে অন্তরের মৃত্যু ঘটে।”

১১০. ইমাম শাবী:
ইমাম শাবী কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কিভাবে এত জ্ঞানার্জন করেছেন?
তিনি বললেন,
“কখনো পরের উপর নির্ভর করে থাকি নি।
জ্ঞানার্জনের জন্য দেশ-দেশান্তরে ঘুরেছি।
জড় পদার্থের মত ধৈর্য ধারণ করেছি।
কাকপক্ষীদের মত খুব ভোরে বিছানা ত্যাগ করেছি।”

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-১২

১১১. রাগ হল এমন একটি বাতাস যা বিবেকের প্রদীপ নিভিয়ে দেয়।
১১২. গোপন বিষয় দু জনকে অতিক্রম করলে ছড়িয়ে পড়ে।
১১৩. স্ত্রীকে যদি আপনি কেবল তার গুনাগুণ দেখে ভালবাসেন তবে তা প্রকৃত ভালবাসা নয়। প্রকৃত ভালবাসা তখনই হবে যখন আপনি তার মধ্যে দোষ দেখেও তাকে ভালবাসবেন।

১১৪. আমাদের জীবনের অধিকাংশ সমস্যা হয় দুটি কারণে:
এক. আমরা অনেক সময় চিন্তা না করেই কাজ করি।
দুই. আবার অনেক সময় কাজ না করে শুধু চিন্তা করি।

১১৫. জনৈক মনিষী বলেন, “সাফল্যের মূল রহস্য কি তা জানি না। কিন্তু ব্যর্থতার মূল রহস্য হল, সবাইকে খুশি করা চেষ্টা করা।”

১১৬. চারটি জিনিস মর্যাদা বৃদ্ধি করে:
ক. ধৈর্য ও সহনশীলতা
খ. বিনয়
গ. উদারতা
ঘ. সুন্দর ব্যবহার।

১১৭. চারটি জিনিস মহত্ত্বের পরিচায়ক:
ক. মানুষের উপকার করা (অর্থ, শ্রম, বুদ্ধি ও পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে)।
খ. মানুষকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা।
গ. কারো ভালো কাজের পুরষ্কার যথাসম্ভব দ্রুত দেয়া।
ঘ. কাউকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন হলে তাড়াহুড়া না করা।

১১৯. চারটি কাজ নিচু স্বভাবের পরিচায়ক:
ক. গোপন কথা ফাঁস করে দেয়া।
খ. বিশ্বাসঘাতকতা করা।
গ. অসাক্ষাতে অন্যের দোষ সমালোচনা করা।
ঘ. প্রতিবেশী বা সঙ্গীর সাথে খারাপ আচরণ করা।

১২০. জ্ঞানীরা চারটি জিনিস থেকে দূরে থাকে:
ক. যে কোন কাজে তাড়াহুড়া করা।
খ. সিদ্ধান্ত হীনতায় ভোগা।
গ. আত্মম্ভরিতা দেখানো।
ঘ. গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবহেলা করা।

❑ জ্ঞানের কথা-জ্ঞানীর কথা-১৩

১২১. যে ঘরে বই নেই সে ঘর প্রাণহীন।
১২২. পেছনের ধোঁকাবাজ নেকড়ের চেয়ে সামনের হিংস্র বাঘ শ্রেয়।
১২৩. কষ্ট-ক্লেশ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কখনো কষ্টের মুখোমুখি হয় নি সে জীবনকে যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারে নি।
১২৪. যে ব্যক্তি আশার সাথে পরিচিত সে অসম্ভবকে চেনে না।
১২৫. ‘অসম্ভব’ জিনিসটি হল শক্ত পাথরের মত। কঠিন সিদ্ধান্তের কশাঘাতে তা ভাঙ্গতে বাধ্য।
১২৬. বিলম্বে পৌঁছা, না পৌঁছার চেয়ে উত্তম।
১২৭. গোপনীয়তা হল চাবির মত। মানুষের উচিৎ, এই চাবিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা।
১২৮. মানুষ কখনও সাফল্যের বাগানে পৌঁছুতে পারে না যতক্ষণ না সে ক্লান্তি, ব্যর্থতা ও হতাশার পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে আসে।
১২৯. বাতাস যেমন জাহাজের চাহিদা অনুযায়ী প্রবাহিত হয় না তেমনি মানুষ যত আশা করে তার সব আশাই পূরণ হয় না।
১৩০. সবচেয়ে উঁচু ভবন নির্মানের দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হল, চারপাশের সব ভবন ভেঙ্গে ফেলা। অপরটি হল, অন্য সব ভবন থেকে উঁচু ভবন নির্মাণ করা। তুমি সব সময় ২য় পদ্ধতিটি অবলম্বন কর।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
অনুবাদ ও গ্রন্থনায়:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।।

প্রশ্ন: কার কাছে বই বা কোনও কিছু হাদিয়া (উপহার) চাওয়া কি ভিক্ষা চাওয়ার অনুরূপ? হাদিসে বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তির শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এটাও কি সে হাদিসের অন্তর্ভুক্ত? কারণ অনেকেই বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত জনের কাছে বই অথবা বিভিন্ন কিছু হাদিয়া চায়। দয়া করে এ বিষয়টি কুরআন-হাদিসের আলোকে জানিয়ে বাধিত করবেন।

 প্রশ্ন: কার কাছে বই বা কোনও কিছু হাদিয়া (উপহার) চাওয়া কি ভিক্ষা চাওয়ার অনুরূপ? হাদিসে বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তির শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এটাও কি সে হাদিসের অন্তর্ভুক্ত? কারণ অনেকেই বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত জনের কাছে বই অথবা বিভিন্ন কিছু হাদিয়া চায়। দয়া করে এ বিষয়টি কুরআন-হাদিসের আলোকে জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর:
কেউ যদি তার সামর্থ্যবান বন্ধু-বান্ধব ও নিকটাত্মীয়-যেমন: ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি ব্যক্তির কাছে বই অথবা অন্য কিছু হাদিয়া (উপহার) চায় তাহলে তাতে দোষের কিছু নাই ইনশাআল্লাহ। এটা খুব সাধারণ বিষয়। কারণ মানুষ সাধারণত ভালবাসা বা স্নেহ-মমতার দাবী থেকে অথবা মজার ছলে এমনটি করে থাকে। তবে কারও কাছে তা না চাওয়াই উত্তম। কারণ ইসলাম জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কারও কাছে কোনও কিছু চাওয়াকে অনুৎসাহিত করেছে। (শেষে এ বিষয়ে হাদিস পেশ করা হয়েছে)।

তবে সামর্থ্যবান বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জন বা নিকটাত্মীয়দের নিকট সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার দিক থেকে কখনোও উপহার চাওয়া হলে তা হাদিসে নিষিদ্ধ ‘ভিক্ষা বৃত্তি’র অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না। কেননা ইসলামে ভিক্ষা বৃত্তি তথা জীবন-জীবিকার পেশা হিসেবে এবং অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে মানুষের কাছে হাত পাতা নিষিদ্ধ। হাদিসে কিয়ামতের দিন এর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তবে অপরিচিত কারও নিকট কোনও কিছু উপহার চাওয়া আত্মমর্যাদার পরিপন্থী। ব্যক্তিত্ববান মানুষের এমনটি করা উচিৎ নয়।

❑ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভিক্ষা করা নিষিদ্ধ:

◈ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ
“যে ব্যক্তি সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের নিকট অর্থ চায় সে মূলত: (জাহান্নামের) জ্বলন্ত অঙ্গার চায়। অতএব সে কম-বেশি যা ইচ্ছা চাক।” [মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: মানুষের কাছে ভিক্ষা চাওয়া নাজায়েজ।]

◈ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‏ لأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ حَبْلَهُ فَيَأْتِيَ بِحُزْمَةِ الْحَطَبِ عَلَى ظَهْرِهِ فَيَبِيعَهَا فَيَكُفَّ اللَّهُ بِهَا وَجْهَهُ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النَّاسَ أَعْطَوْهُ أَوْ مَنَعُوهُ
“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রশি নিয়ে (বন-জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে) পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করার ফলে আল্লাহ তাকে (ভিক্ষাবৃত্তির অপমান থেকে) রক্ষা করেন তাহলে তা মানুষের নিকট তার হাতপাতার চেয়ে উত্তম। তারা দিতেও পারে নাও পারে।” [সহিহ বুখারী, যাকাত অধ্যায়: হাদিস ৫৫০]

◈ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَسْأَلُ النَّاسَ حَتّى يَأْتِيَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَيْسَ فِي وَجْهِه مُزْعَةُ لَحْمٍ
“যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে থাকে কিয়ামতের দিন সে এমনভাবে উঠবে যে, তখন তার মুখমণ্ডলে গোশত থাকবে না।” [সহীহ বুখারী ১৪৭৪ ও মুসলিম ১০৪০]

❑ উপহারের প্রতিদান দেওয়া সুন্নত:

মনে রাখতে হবে, ইসলামে উপহার লেনদেন করা সুন্নত। এতে পারস্পারিক ভালবাসা
ও সুসম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। অনুরূপভাবে কেউ উপহার দিলে উপহার দাতাকে প্রতিদান দেওয়াও সুন্নত।

❂ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

عنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقْبَلُ الْهَدِيَّةَ وَيُثِيبُ عَلَيْهَا‏.‏ لَمْ يَذْكُرْ وَكِيعٌ وَمُحَاضِرٌ عَنْ هِشَامٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ عَائِشَةَ‏.‏
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া কবুল করতেন এবং তার প্রতিদানও দিতেন।” [সহীহ বুখারি, অধ্যায়: ৪৩/ হিবা (উপহার) প্রদান, পরিচ্ছেদ: ১৬১৫. হিবার প্রতিদান দেওয়া]

❂ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَمَنْ أَتَى إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ، فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فَادْعُوا لَهُ، حَتَّى يَعْلَمَ أَنْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ‏
“যে ব্যক্তি তোমাদের জন্য ভালো কিছু করে তাহলে তোমরা তার প্রতিদান দাও। প্রতিদান দেয়ার মত কিছু না থাকলে তার জন্য দোয়া করো, যাতে সে অনুভব করতে পারে যে, তোমরা তার ভালো কাজের প্রতিদান দিয়েছ।”
[আবু দাউদ, নাসাঈ, আহমাদ আল-আদাবুল মুফরাদ, অধ্যায়: ভদ্র আচার ব্যবহার, পরিচ্ছেদ: ১১০- যার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয় সে যেন তার উত্তম বিনিময় দেয়।-সহিহ]

❑ ইসলাম মানুষের কাছে কোনও কিছু চাওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করে:

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, ইসলাম মানুষকে উন্নত চরিত্র ও সম্মানজনক আত্মমর্যাদা শিক্ষা দেয়, অন্যের সম্পদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতে নিষেধ করে এবং একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে নিরুৎসাহিত করে। যেমন:

❂ হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: دَعَانِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَشْتَرِطُ عَلَيَّ: «أَنْ لَا تَسْأَلَ النَّاسَ شَيْئًا» قُلْتُ: نَعَمْ. قَالَ: «وَلَا سَوْطَكَ إِنْ سَقَطَ مِنْكَ حَتَّى تنزل إِلَيْهِ فتأخذه» . رَوَاهُ أَحْمَدُ
আবু যার রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (একদিন) ডেকে এনে আমার ওপর শর্তারোপ করে বললেন, “তুমি কারো কাছে কোন কিছুর জন্য হাত পাতবে না। আমি বললাম, আচ্ছা। তারপর তিনি বললেন, “এমনকি তোমার হাতের লাঠিটাও যদি পড়ে যায় কাউকে উঠিয়ে দিতে বলবে না। বরং তুমি নিজে নেমে তা উঠিয়ে নেবে।” [মুসনাদে আহমদ, হা/২১৫০৯, সহীহ আত তারগীব, হা/ ৮১০, সহীহুল জামে, হা/ ৭৩০৭]

❂ সাওবান রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
من يتقبَّلُ لي بواحدةٍ وأتقبَّلُ لَهُ بالجنَّةِ قلتُ أنا قالَ لا تسألِ النَّاسَ شيئًا قالَ فَكانَ ثَوبانُ يقعُ سوطُهُ وَهوَ راكبٌ فلا يقولُ لأحدٍ ناوِلنيهِ حتَّى ينزلَ فيأخذَهُ
“কে আছে যে, আমার একটি কথা কবুল করবে? আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হবো। আমি বললাম, আমি।
তিনি বললেন, “তুমি মানুষের কাছে কোনও কিছু চাইবে না।”

বর্ণনা কারী বলেন, সাওবান রা. সওয়ারিতে আরোহী থাকা অবস্থায় যদি তার হাতের ছড়িটা নিচে পড়ে যেতো তাহলে তিনি কাউকে বলতেন না যে, এটি আমাকে তুলে দাও। বরং তিনি বাহন থেকে নেমে তা তুলে নিতেন।” [নাসায়ী, হা/২৫৯০, আবু দাউদ, হা/ ১৬৪৩,-সহিহ ইবনে মাজা, হা/১৪৯৯]

সুবহানাল্লাহ! ইসলাম মানুষকে কতটা আত্ম মর্যাদাবান হতে শেখায়। প্রকৃতপক্ষে কারও কাছে কোনও কিছু চাওয়া হলে সে তার কাছে ছোট হয়ে যায়। যে ব্যক্তি দরকারে হোক বিনা দরকারে হোক মানুষের কাছে টাকা-পয়সা বা অর্থ-সম্পদ চায় মানুষ তাদেরকে অপছন্দ করতে শুরু করে। তাই তো হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
আবুল আব্বাস সাহল ইবনে সা‘দ রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে একটা বিষয় বলে দিন যা করলে আমাকে আল্লাহও ভালবাসেন এবং মানুষও ভালবাসবে।
তিনি বললেন,
«ازْهَدْ في الدُّنْيَا يُحِبّك اللهُ، وَازْهَدْ فِيمَا عِنْدَ النَّاسِ يُحِبّك النَّاسُ
‘‘দুনিয়া থেকে লালসামুক্ত হও তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন। আর মানুষের ধন-সম্পদ থেকে লালসামুক্ত হও তাহলে তারাও তোমাকে ভালবাসবে।’’ [ইবনে মাজাহ, হাসান-সিলসিলাহ সহীহাহ, হা/ ৯৪৪]

সুতরাং আমাদের কর্তব্য, মানুষের সম্পদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে না তাকানো এবং একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও নিকট সাহায্যের আবেদন না করা বা কারও কাছে হাত না পাতা। এটি উন্নত ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার বহিঃপ্রকাশ।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।

জান্নাতে স্বামী স্ত্রীর দিকে ৪০ বছর তাকিয়ে থাকবে এ বিষয়ে কোনও হাদিস আছে কি

 প্রশ্ন: “জান্নাতে স্বামী স্ত্রীর দিকে ৪০ বছর তাকিয়ে থাকবে”-এ বিষয়ে কোনও হাদিস আছে কি?

উত্তর:
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের শর্তাবলী পূরণ করার তথা শিরক মুক্ত ঈমান ও বিদআত মুক্ত আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।

নি:সন্দেহে জান্নাতে স্বামী-স্ত্রীর মিলনে তাদের আনন্দের সীমা থাকবে না। কিন্তু সেখানে তাদের প্রথমবার দেখা হওয়ার পর তারা একে অপরের দিকে ৪০ বছর তাকিয়ে থাকবে-এ মর্মে কোনও হাদিস আছে বলে জানা নাই।

হ্যাঁ, জান্নাতে প্রবেশের পর জান্নাতের হুরের দিকে ৪০ বছর তাকিয়ে থাকা সংক্রান্ত একটি হাদিস পাওয়া যায়। কিন্তু শাইখ আলাবানি সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তা জঈফ (দুর্বল) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। [দেখুন: যাঈফুত তারগিব, হা/ ২১৮৪]

روى عبد بن حميد في مسنده عن ابن عمر رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال ضمن حديث طويلفإذا من الحور العين قاعدة على سرير ملكها فيرى مخ ساقيها من صفاء اللحم والدم فيقول لها: ما أنت. فتقول: أنا من الحور العين من اللاتي خبئن لك، فينظر إليها أربعين سنة لا يرفع بصره عنها، ثم يرفع بصره إلى الغرف فوقه فيرى، فإذا أخرى أجمل منها فتقول: أما آن لنا أن يكون لنا منك نصيب فيرتقي إليها فينظر إليها أربعين سنة لا يصرف بصره عنها.. الحديث، وقد ذكره المنذري في كتابه الترغيب والترهيب، وضعفه الشيخ الألباني
আল্লাহু আলাম।
-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল-

মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা এক মাইল দূরে চলে যায় এই হাদীসটি রেফারেন্স অনুযায়ী কি সঠিক

 প্রশ্ন: নিম্নোক্ত হাদিসটি রেফারেন্স অনুযায়ী কি সঠিক?

“মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা এক মাইল দূরে চলে যায়।” [ বুখারী হাদিস নং ৫৫১০ ]। এ হাদিসটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারিত হতে দেখা যাচ্ছে।
উত্তর:
এ হাদিসটি বানোয়াট বা জাল। [ইবনে হিব্বান-কিতাবুল মাজরূহীন, ২/১২০] মতান্তরে অত্যন্ত দুর্বল বা মুনকার [যইফুত তিরমিযি ১৯৭২ ও সিলসিলা যাঈফা ১৮২৮- আলবানি]

সুতরাং এ বানোয়াট বা মারাত্মক দুর্বল হাদিসের সাথে সহিহ বুখারির রেফারেন্সে পেশ করা নি:সন্দেহে ভুল। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস প্রচারের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা কাম্য।
إن العبدَ إذا كذب تباعدَ عنه الملَكُ ميلًا من نتنِ ما جاء به
الراوي:عبدالله بن عمر المحدث:ابن حبان المصدر:المجروحين الجزء أو الصفحة:2/120 حكم المحدث:موضوع
المحدث:الألباني المصدر:ضعيف الترمذي الجزء أو الصفحة:1972 حكم المحدث:ضعيف جداً
المحدث:الألباني المصدر:السلسلة الضعيفة الجزء أو الصفحة:1828 حكم المحدث:منكر
আল্লাহু আলাম।
-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল-

নামাজে মহিলারা কীভাবে সেজদা দিবে

 প্রশ্ন: নামাজে মহিলারা কীভাবে সেজদা দিবে?

উত্তর:
মহিলারা ঠিক সেভাবে সেজদা দিবে যেভাবে পুরুষরা দেয়। এটাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শেখনো পদ্ধতি। এভাবেই মহিলা সাহাবিগণ আমল করতেন।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে সহিহ সুন্নাহর দলিল ব্যতিরেক ভিন্ন কোনও পদ্ধতি আমল যোগ্য নয়- যদিও সে বিষয়ে কোনও বড় ইমাম, আলেম, মুহাদ্দিস, মুজতাহিদ বা অন্য কোনও ব্যক্তি ফতোয়া প্রদান করেন। কারণ আমরা একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করতে নির্দেশিত। সুতরাং আমাদের করণীয়, ইবাদত-বন্দেগীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করা। আল্লাহ বলেন,

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

“নিশ্চয় তোমাদের জন্য জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (সূরা আহযাব: ২১)

তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي

“তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখ, সেভাবে সালাত আদায় কর” [বুখারী ও মুসলিম]

এই নির্দেশ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আম ভাবে সবার জন্য প্রযোজ্য যতক্ষণ না ভিন্ন সহিহ হাদিস দ্বারা নারী অথবা পুরুষের জন্য ভিন্ন কোনও বিধান প্রমাণিত হয়।

হ্যাঁ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস ছাড়া অন্য কারও কথা বা ফতোয়া কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তা হাদিসের বিপরীত বা তার সাথে সাংঘর্ষিক না হবে।

সুতরাং আমাদের সমাজে প্রচলিত পদ্ধতিতে অনেক মহিলা পেটের সাথে উরু বা দু রান লাগিয়ে এবং দু হাত মাটিতে বিছিয়ে খুব জড়সড় হয়ে সেজদা দেয়। এটি স্পষ্ট হাদিস বিরোধী এবং পরিত্যাজ্য। কারণ:

◈ ক. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু হাত মাটিতে বিছিয়ে দিতেন না বরং তা জমিন থেকে উপরে [বুখারী] এবং পেটের দু পাশ থেকে দুরে রাখতেন। [বুখারী ও মুসলিম]

◈ খ. হাঁটু, পেট, হাত, মাথা এই অঙ্গগুলোর মাঝখানে এমন ফাঁকা থাকতে হয় যেন এই ফাঁকা দিয়ে একটি বকরীর বাচ্চা চলে যেতে পারে। [সহিহ মুসলিম]

◈ গ. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

اعْتَدِلُوا في السُّجُودِ ولا يَبْسُطْ أحَدُكُمْ ذِراعَيْهِ انْبِساطَ الكَلْبِ

“তোমরা সেজদার মধ্যে স্থির হও, তোমাদের কেউ তার বাহুদ্বয় কুকুরের ন্যায় বিছিয়ে রাখবে না”। [বুখারি, হা/৮২২, মুসলিম, হা/৪৯৩]

এ বিধানগুলো নারী-পুরুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদেরকে আলাদা পদ্ধতিতে সেজদা দেওয়ার কোনও নিয়ম শিক্ষা দেন নি। অথচ নারী-পুরুষের সালাতে যে সব পার্থক্য আছে তা বিভিন্ন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যদিও মাজাহাবের দোহায় দিয়ে নারীদেরকে একদম জড়সড় হয়ে সেজদা দেওয়ার ফতোয়া প্রদান করা হয় কিছু যুক্তি, পরবর্তী যুগের কিছু ফতোয়া এবং সনদগতভাবে দুর্বল হাদিস দ্বারা-যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিসের বিপরীতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

❑ মহিলাদের সেজদার সময় পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখার হাদিস সহিহ নয়:

আমাদের সমাজে প্রচলিত জড়সড় হয়ে সেজদার দেওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা দলিল প্রদান করা হয়-কিন্তু মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে তা সহিহ নয়। নিম্নে হাদিস এবং সে প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসদের অভিমত তুলে ধরা হল:

إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا

“মহিলা যখন নামাজের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে; যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তাআলা তাকে দেখে (ফেরেশতাদের সম্বোধন করে) বলেন, ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।” [সুনানে কুবরা, বায়হাকি, ২/২২৩, হাদিস নং ৩৩২৪]

এ হাদিসটির মান: জইফ (দুর্বল)

– ইমাম বায়হাকি নিজেই এ হাদিস সম্পর্কে বলেন,
ضعيف لا يحتج بمثله
“এটি দুর্বল। এমন দুর্বল হাদিস দ্বারা দলিল দেওয়া যায় না।”
– তিনি আরও বলেন
[فيه] أبو مطيع ضعفه ابن معين وابن عدي، وكذلك عطاء بن عجلان ضعيف
“এ হাদিসের সনদে আবু মুতি আল হাকাম আল বালখি (الحكم بْن عَبد اللَّهِ أَبُو مطيع البلخي) নামক বর্ণনাকারীকে ইয়াহয়া ইবনে মাঈন এবং ইবনে আদী জইফ (দুর্বল) বলেছেন। অনুরূপভাবে আরেকজন বর্ণনাকারী আত্বা বিন আজলানও জইফ।” [বায়হাকি ২/২২৩]

– ইবনুল কায়সারানি বলেন, الحكم البلخي ضعيف “(এর সনদে আবু মুতি) হাকাম আল বালখি নামক বর্ণনাকারী দুর্বল।” [যাখিরাতুল হুফফায: ১/৩০৩]

-ইমাম যাহাবি বলেন, فيه الحكم ضعفه ابن معين وغيره وتركه جماعة وراويه عنه محمد بن القاسم الطايكاني متهم
“এ হাদিসে বর্ণনাকারী হাকামকে ইবনে মাঈন প্রমুখগণ জইফ (দুর্বল) বলেছেন। এবং অন্য একদল মুহাদ্দিস তাকে বর্জন করেছেন। তার থেকে ‘মুহাম্মদ ইবনুল কাসেম আত ত্বয়কানি’ নামক যে বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছে সে متهم বা মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত।” [আল মুহাযযাব ২/৬৬২]

এ ছাড়াও এ বিষয়ে মুনকাতিন (বিচ্ছিন্ন সনদ বর্ণিত) হাদিস এবং পরবর্তী যুগের আলেমদের কিছু ফতোয়া পাওয়া যায় যেগুলো হাদিসের বিপরীতে পেশ করা কোনোভাবেই শোভনীয় নয়।

আল্লাহ আমাদেরকে সুপথ দেখান এবং বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬✪✪✪▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার , সৌদি আরব।

মৃত্যুকালীন শয়তানের ইমান হরণের কঠিন চক্রান্ত এবং আত্মরক্ষার উপায়

 প্রশ্ন: মানুষের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শয়তান ওয়াস‌ওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিয়ে তার ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা করে। এ থেকে বাঁচার উপায় কি?

উত্তর:
প্রথমত: আমাদের জানা দরকার যে, শয়তান বনী আদমের দীন ও ইমান সহ সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে চ্যালেঞ্জ করে আসা এক প্রকাশ্য শত্রু। সে প্রতি মুহূর্তে বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। সে তার শয়তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মানুষের গাফলতি, অসচেতনতা, বিপদাপদ, দুর্যোগ ও দুর্বল মুহূর্তগুলোকে কাজে লাগায়। সুতরাং মৃত্যুর মত কঠিন ও বিভীষিকাময় মুহূর্তে সে তাকে পথভ্রষ্ট করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করবে-তা খুবই স্বাভাবিক।

◍ আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ – ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
“সে (ইবলিশ) বলল, আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সিরাতে মুস্তাকিম বা সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে এবং আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।” [সুরা আরাফ: ১৬ ও ১৭]
◍ আল্লাহ তাআলা শয়তান থেকে সতর্ক করে আরও বলেন,
وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ ‎
“আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা বাকারা: ১৬৮]

◍ তিনি অন্যত্র বলেন,
إِنَّهُ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِينٌ
“নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু ও পথভ্রষ্ট কারী।” [সূরা কাসাস: ১৫]

এভাবে কুরআনে আল্লাহ তাআলা বহু স্থানে তাকে ‘প্রকাশ্য শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করে মানবজাতিকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

(যদিও বিশেষ করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শয়তান ইমানদারের সামনে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে অধিক উত্তম বলে উপস্থাপন করার ব্যাপারে কিছু আলেম লিখেছেন। কিন্তু সেগুলোর পক্ষে কোন দলিল নেই।)

❑ মৃত্যুকালীন শয়তান কর্তৃক ঈমান হরণের কঠিন চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষার দুআ:

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ করে মৃত্যুর বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে শয়তান যেন ইমান ছিনিয়ে নিতে না পারে বা পথভ্রষ্ট করতে না পারে সে জন্য আল্লাহর কাছে নিজে দুআ করেছেন এবং তার উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন:

১. আবুল ইয়াসার রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
الَّلهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَدمِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ التَرَدِّي ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الغَرَقِ وَالحَرَقِ وَالهَرَمِ ، وَأَعُوذُ بِكَ أَن يَتَخَبَّطَنِي الشَّيطَانُ عِندَ المَوتِ ، وَأَعُوذُ بِكَ أَن أَمُوتَ فِي سَبِيلِكَ مُدبِرًا ، وَأَعُوذُ بِكَ أَن أَمُوتَ لَدِيغًا
“হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি পতন জনিত মৃত্যু থেকে। আশ্রয় প্রার্থনা করছি ভারী কোনও বস্তুর চাপা পড়ে বা গর্তে পড়ে মৃত্যু থেকে। আরও আশ্রয় প্রার্থনা করছি, সলিল সমাধি ও আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে মৃত্যু এবং বার্দ্ধক্য থেকে।
আর আমি মৃত্যুকালে শয়তানের ছোঁ মারা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আপনার রাস্তায় (জিহাদের সময়) পলায়নপর অবস্থায় মৃত্যু থেকে এবং আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি সাপ-বিচ্ছুর দংশন জনিত মৃত্যু থেকে।” [সহিহ আবু দাউদ, হা/ ১৩৮৮]

ইমাম খাত্তাবি ‘শয়তান কর্তৃক ছোঁ মারা’ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম মৃত্যুর সময় শয়তান কর্তৃক ছোঁ মারা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এর অর্থ হল, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় শয়তান যেন তার উপর কর্তৃত্ব আরোপ করে তাকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে, তার তওবার সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, তার আত্ম সংশোধন করা এবং তার সম্মুখের অন্ধকার থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়ে দাঁড়ায়। সে যেন তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না করে বা তার মনে মৃত্যুর ব্যাপারে ঘৃণা বোধ এবং দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে হা-হুতাশ সৃষ্টি না করে। কেননা এর ফলে এই নশ্বর জীবন ছেড়ে আখিরাতের পথে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তোষ প্রকাশিত হবে। ফলে তার জীবনের পরিসমাপ্তি হবে মন্দ পরিস্থিতির উপরে এবং সে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়ে তার সাথে সাক্ষাত লাভ করবে।” [মাআলিমুস সুনান, ২/১৯৪]

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক নামাযের শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে মৃত্যুর ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আর মৃত্যু কালীন ফিতনার অন্তর্ভুক্ত হল, জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণের সংকটময় মুহূর্তে শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ সালাতে তাশাহুদ পড়বে, তখন চারটি বিষয় থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। বলবে,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ

“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি জাহান্নামের আযাব থেকে, কবরের আযাব থেকে, জীবন-মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং মাসীহ দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে।”
[সহিহহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫/ মসজিদ ও সালাতের স্থান, পরিচ্ছেদ: ২৫. সালাতের মধ্যে এসব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা]

সুতরাং কেউ যদি মৃত্যুকালীন শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে চায় তাহলে তার কর্তব্য, ১ম দুআটি অধিক পরিমাণে পাঠ করা। আর ২য় দুআটি বিশেষ করে প্রত্যেক সালাতের শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে পাঠ করা।

সেই সাথে কর্তব্য, জীবনভর শয়তানের রাস্তা থেকে দূরে থাকা, আল্লাহর নাফরমানি পরিত্যাগ করা, কখনো পাপাচার সংঘটিত হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তৎক্ষণাৎ আল্লাহর পথে ফিরে আসা।
আর যখনই মনের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ও আল্লাহর নাফরমানির কথা উদ্রেক হবে তখনই ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শাত্বানারি রাজীম” (অর্থ: আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি) পাঠ করা।
মোটকথা, যে ব্যক্তি তার জীবনটাকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্ম দ্বারা সাজাতে সক্ষম হবে, শয়তানের পথ অনুসরণ থেকে দূরে থাকবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক শিখানো দুআগুলো আমল করবে সে মৃত্যুর বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবে ইনশাআল্লাহ।
——–উত্তর প্রদানে——–
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।।

ফরয নামাযের সালাম শেষে প্রথমে এক বার আল্লাহু আকবার, নাকি তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ

 ফরয নামাযের সালাম শেষে প্রথমে এক বার আল্লাহু আকবার, নাকি তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ? একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা

▬▬▬◍❂◍▬▬▬
লেখক: আব্দুর রাকীব মাদানি
দাঈ, দাওয়া’হ সেন্টার খাফজী, সউদি আরব
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি

১-বিষয়টি অবতারণার কারণ:

আমরা জানি, আমাদের সমাজে নামায শিক্ষার সময় সাধারণত: এই শিক্ষা নেওয়া হয় বা দেওয়া হয় যে, ফরয সালাতে সালাম ফিরানোর পর প্রথমে এক বার সশব্দে আল্লাহু আকবার বলতে হবে অতঃপর নীরবে তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ এবং আমাদের আহলুল হাদিস সমাজের বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিগণকে জোর শব্দে এই আমলটি করতেও দেখা যায়। এছাড়া সালাফী আলেমগণের প্রচলিত প্রসিদ্ধ বাংলা সালাত শিক্ষার বই-পুস্তকেও এই মাসআলা দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্য হলাম, যখন সউদী আরবের সমাজে মুসল্লিদের নামাযান্তে ১বার উচ্চ কন্ঠে আল্লাহু আকবার বলতে শুনলাম না; অথচ এখানে সালাম শেষে উচ্চ স্বরে কিছুক্ষণ যিকর ও দুআ পড়ার প্রচলন রয়েছে। আর না এখানকার বিজ্ঞ উলামাদের বই-পুস্তকে এবং ফতোয়ায় এই বিধানটি লক্ষ্য করলাম। আরো আশ্চর্য হলাম যখন প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফিকহের বই পুস্তকেও সালাম শেষে এক বার জোর শব্দে আল্লাহু আকবার বলতে হবে বলে কোনো বিধান অবলোকন করলাম না; বরং তারা সকলে প্রথমে ৩ বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলার কথা উল্লেখ করেছেন, যা লেখার শেষ পয়েন্টে দেখা যেতে পারে। তাই এই বিষয়টি নিয়ে বহু পূর্বে মনে কৌতূহল জেগেছিল। সম্প্রতি সাধ্যানুযায়ী এ সম্বন্ধে দলিল-প্রমাণগুলির সাধারণ অধ্যয়ন করার চেষ্টা করলাম। অবশেষে যা অবগত হলাম, তা আপনাদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা ভাল মনে করছি। ওয়াল্লাহু হুআল্ মুআফ্ফিক্ ওয়াল্ মুস্তাআন।

বক্ষমাণ লেখাটির মূল বিষয় হল, সালাম ফিরানোর পর সর্ব প্রথম কি বলতে হবে এবং কত বার বলতে হবে?

২-যারা সালাম শেষে ১ বার জোর শব্দে আল্লাহু আকবার বলতে হবে বলে মত দিয়েছেন, তাঁদের মন্তব্য ও দলিল:

উল্লেখ্য যে, মুতাকাদ্দেমীন (প্রাচীন) উলামাদের কেউ এমন বলেছেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বর্তমান যুগের বাংলা ও উর্দুভাষী আহলে হাদিস উলামা ও লেখকগণের নামায শিক্ষার বইতে উপরোক্ত মত পাওয়া যায়। আমরা প্রথমে তাদের লেখা বই থেকে কিছু বিবরণ তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।

ক-‘আইনী তুহ্ফা সালাতে মুস্তফা’র সম্মানিত লেখক বলেন, ‘আল্লাহর রসূল সল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরয নামাযের সালাম ফিরেই আল্লাহ আকবার জোরে বলতেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি ঐ তাকবীর শুনে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এর নামায শেষ হওয়া বুঝতে পারতাম (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৮ পৃঃ)’। [আইনী তুহ্ফা সালাতে মুস্তফা, অধ্যাপক হাফিয শাইখ আইনুলবারী, ১ম খন্ড পৃঃ ১৫০]

খ-‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ এর শ্রদ্ধেয় লেখক বলেন, ‘অতঃপর একবার সরবে ‘আল্লাহু আকবার’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৯৫৯; বুখারী ফতহ সহ হা/৮৪১-৮৪২) এবং তিনবার ‘আসতাগফিরুল্লা-হ’ ও একবার ‘আল্লা-হুম্মা আন্ তাস সালা-মু অ-মিন্কাস সালা-মু, তাবা-রাকতা ইয়া-যাল জালা-লি ওয়াল ইকরা-ম’ বলে (মুসলিম, মিশকাত হা/৯৬১) ডাইনে অথবা বামে কিংবা সরাসরি মুক্তাদীগণের দিকে ফিরে বসবে (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৯৪৪-৪৬)।’ [ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), ড. মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, পৃঃ ১৩২]

গ-‘নামাযের মাসায়েল’ এর মুহতারাম লেখক বলেন, ‘মাসআলা-২৬০: ফরজ নামাজ থেকে সালাম ফিরানোর পর উচ্চস্বরে একবার ‘আল্লাহু আকবর’ এবং নিম্নস্বরে তিনবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ অতঃপর ‘আল্লাহুম্মা আন্ তাসসালাম ওয়া মিনকাস্ সালাম তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল্ ইকরাম’ বলা সুন্নাত।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফরজ নামাজ শেষ হওয়ার আন্দাজ করতাম তাকবীরের আওয়াজ দ্বারা। (বুখারী, মুসলিম)। [নামাযের মাসায়েল (বাংলা অনুদিত), মুহাম্মদ ইকবাল ক্বীলানী, পৃঃ ৭০]

দেখা যাচ্ছে, উপরোক্ত লেখকগণ সালাম শেষে প্রথমে এক বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন এবং তা জোর শব্দে বলতে বলেছেন। তার পর ৩ বার আস্তাগফিরুল্লাহ। প্রথমে এক বার আল্লাহু আকবার বলার প্রমাণ স্বরূপ তারা সকলে যেই দলিলটি পেশ করেছেন বা হাওয়ালা দিয়েছেন, সেটি হল ইবনে আব্বাস রা. এর এই হাদিস:

عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: “كنتُ أعرفُ انقضاءَ صلاةِ النبي صلى الله عليه وسلم بالتكبير” رواه البخاري في كتاب الأذان رقم 842

“ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযের শেষ হওয়া জানতে পারতাম তাকবীরের মাধ্যমে।” [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং (৮৪২) মুসলিম, মসজিদ অধ্যায়, নং (১৩১৬)]

অন্য সূত্রে বর্ণনাটি বহু বচনে এই ভাবে উল্লেখ হয়েছে, “আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায শেষ হওয়া জানতে পারতাম না তাকবীর (এর আওয়াজ শোনা) ছাড়া”। [ফাতহুলবারী, ২/৪২১]

৩–ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস “আমি তাকবীরের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযের শেষ হওয়া জানতে পারতাম।” এর পর্যালোচনা:

◈ পর্যালোচনা নং (১): ইবনে আব্বাস রা. এর এই বর্ণনা একটি শারঈ মূল বিধানের বিপরীত:

এ কথা দলিল ও উম্মতের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত যে, নামায শেষ হয় বা সম্পন্ন হয় সালামের মাধ্যমে কিন্তু ইবনে আব্বাস রা. এর এই বর্ণনানুযায়ী তিনি নামায শেষ হওয়া জানতে পারতেন তাকবীরের মাধ্যমে, যা একাধিক দলিল, ইজমায়ে উম্মত ও সালাতে সালাম ফিরানোর মূল নিয়মের বিপরীত। এই কারণে সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহ. বলেন, “এটা ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন বলে মতভেদ রয়েছে। আয়ায বলেন, বাহ্যত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তিনি (ইবনে আব্বাস) জামাআতে উপস্থিত ছিলেন না। কারণ তিনি ছোট ছিলেন, যে কারণে হয়তো তিনি বরাবর জামাআতে উপস্থিত হতেন না। আর জামাআতে হাজির হওয়া তার উপর জরুরিও ছিল না। তাই তিনি নামাযের শেষ হওয়াটা উপরোক্ত তাকবীরের মাধ্যমে বুঝতে পারতেন।

(আয়ায) ব্যতীত অন্য বিদ্বান বলেন, “হতে পারে তিনি নামাযের কাতারগুলোর শেষ দিকে উপস্থিত ছিলেন। তাই তিনি সালামের মাধ্যমে নামায শেষ হওয়াটা বুঝতে পারেন নি; বরং তাকবীরের মাধ্যমে বুঝতে পারেন”। [ফাতহুল বারী, ২/৪২১]

তাঁদের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করার কারণ হচ্ছে, একাধিক হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকবীরের মাধ্যমে নামায শুরু করতেন এবং সালামের মাধ্যমে নামায শেষ করতেন। [দেখুন, তিরমিযী নং (২৩৮) ইবনে মাজাহ নং (২৭৬) বায়হাক্বী নং (৩৭৮৫) সহীহ সুনান আবু দাউদ নং (৬১৯) সহীহ সুনান ইবনে মাজাহ নং (২২২)]

যাই হোক হাদিসটির বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা সম্ভব নয়, কারণ নামায শেষ হয় সালামের মাধ্যমে আর তিনি বলেছেন, “আমি বুঝতে পারতাম তাকবীরের মাধ্যমে।” তাই ইসালামি বিদ্বানগণ তার কথার অন্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর এমন হলে, সালামের পর প্রথমে এক বার তাকবীর দেওয়া সাব্যস্ত হয় না।

◈ পর্যালোচনা নং (২): হাদিসটির বাহ্যিক অর্থ দ্বারাও ১বার আল্লাহু আকবার বলা বুঝায় না।

হাদিসটির বাহ্যিক অর্থ ও এ কথার পক্ষে নয় যে, সালামের পর সর্বপ্রথম ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে এবং তা একবার বলতে হবে। আমি আরও একবার হাদিসের হুবহু অর্থ তুলে ধরলাম। “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযের শেষ হওয়া জানতে পারতাম তাকবীরের মাধ্যমে।” [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং (৮৪২) মুসলিম, মসজিদ অধ্যায়, নং (১৩১৬)

হাদিসটির বাহ্যিক অর্থে কি এটা রয়েছে যে, সালামের পর প্রথমে একবার সশব্দে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে? তাই সালামের পর এক বার সশব্দে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার বিধান যারা এই হাদিসের আলোকে দিয়েছেন, তারা কোন্ শব্দ থেকে তা গ্রহণ করেছেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ। হ্যাঁ, তবে এটা অনুমান করা যায় যে, নামায শেষে তাকবীর রয়েছে। কিন্তু সেটা সালামের পর প্রথম শব্দ এবং তা একবার-এটা কখনও বুঝা যায় না।

◈ পর্যালোচনা নং (৩): উলামাগণ হাদিস টি থেকে যা ইস্তিদলাল করেছেন বা বুঝেছেন।

সিংহভাগ মুহাদ্দিস ও উলামা হাদিস টি দ্বারা যা দলিল দিয়েছেন বা যা ইস্তিদলাল করেছেন তা হল, সালামের পর উচ্চস্বরে যিকর করা বৈধ; সালামের পর প্রথমে একবার তাকবীর দিতে হবে তা নয়। ইমাম বুখারী রাহ. আলোচ্য ইবনে আব্বাস রা. এর হাদিসের ঠিক পূর্বে স্বয়ং ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় আর এক হাদিস উল্লেখ করেছেন, যাতে নামাযের পর উচ্চস্বরে যিকরের বর্ণনা এসেছে। যা দ্বারাও অনুমান করা যায় যে, হাদিসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সশব্দে যিকর করার প্রামাণিকতা। তিনি রা. বলেন, “যিকরের মাধ্যমে আওয়াজ উঁচু করা-যখন লোকেরা ফরয নামায শেষ করতেন- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিল।” ইবনে আব্বাস বলেন, আমি তাদের নামায শেষ হওয়া জানতে পারতাম, যখন তা শুনতে পেতাম”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৮৪১]

ইমাম নবভী বলেন, “এটা কতিপয় সালাফের মতের পক্ষে দলিল, যারা বলেছেন, ফরয নামায শেষে উচ্চস্বরে তাকবীর ও যিকর করা মুস্তাহাব। মুতাআখ্খেরীন (পরবর্তী যুগের আলেমগণ) এর মধ্যে ইবনে হাযম মুস্তাহাব বলেছেন। ইবনে বাত্তাল সহ অন্যরা নকল করেছেন যে, অনুসৃত আসহাবে মাযহাব এবং অন্যরা ঐক্যমতানুযায়ী উচ্চস্বরে তাকবীর ও যিকর মুস্তাহাব মনে করেন না”। [শারহু মুসলিম, ৩/৮৬]

শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রাহ. ইবনে আব্বাস রা. এর এই হাদিস টি সম্পর্কে বলেন, “এই সহীহ হাদিস টি এবং এই অর্থের ইবনুয যুবাইর এবং মুগীরাহ বিন শু’বা সহ অন্যান্য হাদিস প্রমাণ করে যে, ফরয নামায শেষে এমন ভাবে উচ্চস্বরে যিকর করা বৈধ, যেন মসজিদের দরজার নিকট এবং মসজিদের আশেপাশে অবস্থানরত লোকেরা নামায শেষ হওয়া জানতে পারে”। [মাজমূউ ফাতাওয়া, ইবনে বায, ১১/২০৬]

◈ পর্যালোচনা নং (৪): আলোচ্য হাদিসে তাকবীর অর্থ আল্লাহু আকবার নয়; বরং এর অর্থ যিকর। “আমি তাকবীরের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায শেষ হওয়া জানতে পারতাম।” অর্থাৎ যিকরের মাধ্যমে।

উপরোক্ত অনুচ্ছেদে ইমাম বুখারী ও মুসলিম স্বয়ং ইবনে আব্বাস রা. থেকে একটি অন্য আসার বর্ণনা করেছেন, যা সেই তাকবীর শোনার ব্যাখ্যা দেয়। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “আমি এ থেকে তাদের শেষ করা জানতে পারতাম, যখন তা শুনতাম”। [বুখারী, নং ৮৪১, মুসলিম নং ১২২]

উপরোক্ত বাক্যের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার বলেন, “অর্থ হচ্ছে, আমি যিকর শোনার মাধ্যমে তাদের (নামায) শেষ হওয়া জানতে পারতাম”। [ফাতহুল বারী, ২/৪২১]

কিরমানী বলেন, (তাকবীরের মাধ্যমে) অর্থাৎ আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে। এ বক্তব্য আয়নী উমদাতুল ক্বারীতে উল্লেখ করেছেন। [৬/১২৬]

তাই ইবনে আব্বাস রা. এর উপরোল্লিখিত হাদিসে তাঁর উক্তি “আমি তাকবীরের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায শেষ হওয়া জানতে পারতাম” অর্থ তাদের যিকর শুনে বুঝতে পারতাম যে, তাদের নামায সমাপ্ত হয়েছে। তবে তিনি এখানে যিকরকে যিকর না বলে তাকবীর বলেছেন। এমন বলাটা অসঙ্গত নয়; কারণ আরবি বালাগাত তথা অলংকার শাস্ত্রে এর নজীর রয়েছে। এমন করাকে বলা হয়, জুয বলে কুল মুরাদ নেওয়া। অর্থাৎ কোনো কিছুর অংশ উল্লেখ করে তার সম্পূর্ণটাই উদ্দেশ্য করা। আর এর পিছনে কারণ হচ্ছে, যেহেতু সেই সব যিকরেরর মধ্যে তাকবীরও রয়েছে তাই হয়তো তিনি তাকবীর বলে যিকরকেই বুঝাতে চেয়েছেন। যেমনটি ইবনে হাজার রাহ. ব্যাখ্যায় উল্লেখ হয়েছে।

হয়তো অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, এমন অর্থ নেওয়া হাদিসের অপব্যাখ্যা নয় কি? আমি বলবো না, এটা অপব্যাখ্যা নয়। কারণ অপব্যাখ্যা তখন হত, যখন হাদিসটির শব্দকে নিজ অর্থে নেওয়া সম্ভব হত। এখানে হাদিসটিকে আসল অর্থে নেয়া অসম্ভব। কারণ; নামায শেষ হয় ঐক্যমতানুসারে সালামের মাধ্যমে কিন্তু তিনি রা. বলছেন: আমি জানতে পারতাম তাকবীরের মাধ্যমে। তাই উপরোক্ত ব্যাখ্যা আসলে কোনো অপব্যাখ্যা নয়; বরং দলিলের আলোকে সঠিক ব্যাখ্যা। এমন হলে এটা প্রমাণিত হয় না যে, সালামের পর প্রথমে একবার তাকবীর দিতে হবে। কারণ এই তাকবীরের অর্থ আল্লাহু আকবার বলা নয় বরং সাধারণ যিকর।

◈ পর্যালোচনা নং (৫): ইবনে আব্বাস রা. এর এই বর্ণনা অস্পষ্ট, অন্যান্য স্পষ্ট বর্ণনায় সালামের পর তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলার কথা এসেছে:

আমাদের এটা স্বীকার করতে দ্বিধা হতে পারে না যে, ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনায় যেই তাকবীরের কথা এসেছে তা অস্পষ্ট তথা মুহতামিল শব্দ। অর্থাৎ সেটা কোন্ তাকবীর তা স্পষ্ট নয়। সুবহানাল্লাহ, আল্ হামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবারের তাকবীর, না সালামের পর একটি স্বতন্ত্র তাকবীর না নামাযের এক অংশ শেষ করে দ্বিতীয় অংশে যাওয়ার তাকবীর? তবে সালামের পর তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলার বর্ণনাটি স্পষ্ট। ফিকহী মূলনীতিতে সাব্যস্ত যে, “দুটি দলিলের মধ্যে যদি একটি অপরটির বিপরীত হয় আর একটি অস্পষ্ট হয় কিংবা তাতে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে আর অন্যটি স্পষ্ট হয় এবং তাতে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে স্পষ্ট দলিল (স্বরীহ নস্স) অগ্রাধিকার পায়।” এই মূলনীতির আধারে আমরা সহজে বুঝতে সক্ষম যে, সালামের পর আল্লাহু আকবার বলার বর্ণনাটি অস্পষ্ট তথা একাধিক অর্থে সম্ভাব্য কিন্তু সালামের পর তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলার দলিলটি স্পষ্ট। তাই আস্তাগফিরুল্লাহ বলাই নির্ধারিত হবে। সহজ ভাবে বলা যেতে পারে, সালাম ফিরানোর পর আল্লাহু আকবার বলা অপেক্ষা আস্তাগফিরুল্লাহ বলার বর্ণনাটি বেশী স্বরীহ বা স্পষ্ট। তাছাড়া ইবনে আব্বাস রা. এর আলোচ্য বর্ণনাটি ছাড়া অন্য বর্ণনায় আস্তাগফিরুল্লাহ বলার বিবরণ এসেছে। তাই আস্তাগফিরুল্লাহ পড়া প্রাধান্য পাবে। নিম্নে বর্ণনাটি প্রদত্ত হল:

عن ثوبان قال: كان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا انْصرفَ مِنْ صلاتِه استغْفَرَ ثلاثاً و قال: ” اللهمَّ أنْتَ السلامُ و منْكَ السلامُ، و تباركتَ ذا الجَلالِ والإكْرامِ”

সাওবান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁর নামায থেকে ফিরতেন, তখন তিন বার ইস্তিগফার করতেন এবং বলতেন: “আল্লাহুম্মা আন্তাস্ সালামু ওয়া মিনকাস সালামু, ওয়া তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওযাল্ ইকরাম”। [মুসলিম, অধ্যায়ঃ মসজিদ ও নামাযের স্থান, নং (৫৯১) আবু দাউদ, সালাত অধ্যায়, নং (১৫১৩), তিরমিযী, সালাত অধ্যায়, নং (৩০০), ইবনে মাজাহ, নং (৯২৮)]

ইমাম নবভী বলেন, “যখন তিনি তাঁর নামায থেকে ফিরতেন…।” কথাটির অর্থ যখন তিনি সালাম ফিরাতেন। [শারহু মুসলিম, ৩/৯২]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাম ফিরানোর পরেই যে এই ইস্তিগফার করতেন, তা বিভিন্ন মুহাদ্দেসীনদের অনুচ্ছেদ দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়।
-উক্ত বর্ণনাটির জন্য ইমাম আবু দাউদের অনুচ্ছেদ শিরোনাম হচ্ছে, সালাম ফিরানোর পর মানুষ কী বলবে?
-ইমাম তিরমিযীর অনুচ্ছেদ শিরোনাম হচ্ছে, নামাযে সালামের পর যা বলবে।
-ইমাম ইবনে মাজার অনুচ্ছেদটি হচ্ছে, সালামের পর যা বলতে হয়।
অতঃপর তাঁরা সকলে উপরোক্ত সাওবান রা. এর বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন, যা দ্বারা মুহাদ্দিসগণের ইস্তিদলাল বুঝা যায় যে, সালামের পর প্রথমে তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ বলতে হবে; একবার আল্লাহু আকবার নয়।

◈ পর্যালোচনা নং (৬): যদি হাদিসের বাহ্যিক শব্দ তাকবীর এর অর্থ আল্লাহু আকবার গ্রহণ করা হয়, তাহলে সেই তাকবীর কি একটি স্বতন্ত্র ভিন্ন তাকবীর না সালাম শেষে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার এর তাকবীর?

উপরে বর্ণিত প্রমাণ ও সালফে সালেহীনদের ব্যাখ্যার আলোকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, সালামের পর একবার আল্লাহু আকবার নয়; বরং তিন বার আসতাগফিরুল্লাহ পড়তে হবে। কিন্তু কেউ যদি ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনার বাহ্যিক শব্দের ভিত্তিতে তার উপর আমল করতে চায়, তাহলে সে সালাম ফিরানোর পর তাকবীরের মাধ্যমে যিকর শুরু করতে পারে কিন্তু তা হবে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবারের তাকবীর, যা ৩৩ বার কিংবা অন্য বর্ণনানুযায়ী ১০ বার। একটি মাত্র তাকবীর নয়। সালাম শেষে একটি স্বতন্ত্র তাকবীরের কথা ইবনে আব্বাস রা. এর হাদিসের শব্দ দ্বারা বুঝা যায় আর না আবার সেই হাদিসের ব্যাখ্যায় কোনো প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকারীও তা বলেন নি। এমনকি সালফে সালেহীনের কেউই একটি ভিন্ন তাকবীরের কথা বলেন নি। হ্যাঁ, তবে উক্ত হাদিস “তাকবীরের মাধ্যমে নামায শেষ হওয়া জানতে পারতাম” এর ব্যাখ্যায় এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা দ্বারা অনুমান করা যেতে পারে যে, সালাফদের কেউ কেউ তাকবীরের মাধ্যমে যিকর শুরু করতেন। আর তা হত, সুবহানাল্লাহ, আল্ হামদুলিল্লাহর তাকবীর; কোনো স্বতন্ত্র তাকবীর নয়।

“বিত্ তাকবীর” (তাকবীরের মাধ্যমে) এ কথার ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার রাহ. উল্লেখ করেছেন: “মনে হয়, তারা নামায শেষে সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ এর পূর্বে আল্লাহুআকবার দ্বারা শুরু করতেন”। [ফাতহুলবারী, ২/৪২১]

সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদকে জিজ্ঞাসা করা হয়, উক্ত তাকবীর বলতে কী বুঝায়? [ফতোয়া নম্বর ১৮১৪৭ এর চতুর্থ প্রশ্ন] তাঁরা উত্তরে বলেন:

সেই হাদিসে উল্লেখিত তাকবীরের অর্থ হচ্ছে, নামাযের পশ্চাতে ৩৩ বার (সুবহানাল্লাহ, আল্ হামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার) বলা। এটা এ সম্বন্ধীয় হাদিস সমূহের মধ্যে সমন্বয় স্বরূপ। [ফাতাওয়াল লাজনা আদ দায়িমাহ, ৫/৪২০, মাকতাবা শামেলার নাম্বার অনুযায়ী]

শাইখ ইবনে উসায়মীন রহ. আলোচ্য হাদিসে “বিত্ তাকবীর” (তাকবীরের মাধ্যমে) বলতে কী বুঝায়? এর ব্যাখ্যায় বলেন, অর্থাৎ সেই তাকবীরের মাধ্যমে যা যিকরের সাথে হয়; কারণ সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার যিকরের অন্তর্ভুক্ত। [ফাতাওয়া নুরুন আলাদ্ দারব, ৮/২, মাকতাবা শামেলার নাম্বার অনুযায়ী]

যেহেতু নামাযের পশ্চাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাসবীহ, তাহমীদ ও তাকবীরের আদেশ দিয়েছেন, তাই নামায শেষ হলেই তা করা বৈধ। অন্য দিকে কিছু এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়, যাতে তাসবীহ এর পূর্বে তাকবীরের উল্লেখ এসেছে। তাই তাকবীর দ্বারা যিকর শুরু করা বৈধ কিন্তু উত্তম নয়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তুসাব্বিহূনা ওয়া তাহমাদূনা ওয়া তুকাব্বিরূনা খালফা কুল্লি স্বালাতিন সালাসাঁও ও সালাসীনা”। অর্থ: “তোমরা প্রত্যেক নামায শেষে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার বলবে”। [বুখারী, নং ৮৪৩]

ইবনে হাজার রাহ. বলেন, “বেশীরভাগ হাদিসে আলহামদুলিল্লাহ এর পূর্বে সুবহানাল্লাহ এসেছে এবং আল্লাহু আকবার পরে এসেছে। তবে ইবনে আজলান এর বর্ণনায় বিশেষ করে আল হামদুলিল্লাহের পূর্বে আল্লাহু আকবার এসেছে এবং তাতে আবু সালিহ এর উক্তি রয়েছে, তুমি বলবে: “আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ এবং আল হামদুলিল্লাহ”। অনুরূপ উম্মুল হাকাম থেকে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে (২৯৮৭)। এবং তাতে আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত, “তোমরা তাকবীর, হামদ এবং তাসবীহ পাঠ করবে”। ইবনে উমরের হাদিসেও অনুরূপ এসেছে।

তিনি আরও বলেন, এই মতভেদ প্রমাণ করে যে, উক্ত যিকরে ধারাবাহিকতা জরুরি নয়। আর এই মতের সমর্থনে রয়েছে বাকিয়াতুস্ স্বালিহাতের হাদিস “যার দ্বারাই শুরু কর না কেন তাতে কোনো ক্ষতি নেই”। [ফাতহুল বারী, ২/৪২৪/কাশফুল্ লিসাম, সাফারীনী, ৩/১০০]

উক্ত ব্যাখ্যা দ্বারাও বুঝা যায়, সুবহানাল্লাহ এবং আল্ হামদুলিল্লাহ এর পূর্বে আল্লাহু আকবার দ্বারা যিকর শুরু করা বৈধ। তবে উত্তম হচ্ছে প্রথমে তাসবীহ, তার পর তাহমীদ, অতঃপর তাকবীর”। [ফাতহুলবারী, ২/৪২৪]

অতএব বুঝা গেল, ইবনে আব্বাস রা. এর হাদিসে উল্লেখিত তাকবীর কোনো স্বতন্ত্র তাকবীর নয়; বরং তা তাসবীহ ও তাহমীদের তাকবীর। তাই কেউ ফরয সলাতান্তে তাকবীরের মাধ্যমে যিকর করতে চাইলে তো করতে পারে কিন্তু তা একটি আলাদা একবার তাকবীর হবে না; বরং তা হবে ৩৩ বার কিংবা ১০ বার, যা যিকরের অন্তর্ভুক্ত।

বিগত ও বর্তমান যুগের ১০ জন বিশিষ্ট ইসালামি লেখক, গবেষক ও উলামার উক্তি, যারা নামাযান্তে ৩ বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলার পক্ষে মন্তব্য ও ফতোয়া দিয়েছেন:

✪ ১-ইমাম নওয়াভী রহ. (মৃত্যু: ৬৭৬ হি.) বলেন, “কাযী আবুত ত্বাইয়েব বলেছেন, “এই সকল যিকরের মধ্যে ইস্তেগফার দিয়ে শুরু করা মুস্তাহাব। অতঃপর তিনি সাওবান রা. এর হাদিস উল্লেখ করেন।” [কিতাবুল্ মাজমু, ৩/৪৬৮]

✪ ২-ইবনে তায়মিয়াহ রহ. ( মৃত্যু: ৭২৮ হি. ) বলেন, “সহীতে উল্লেখ হয়েছে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুখ ফিরে বসার পূর্বে তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তেন এবং বলতেন আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালামু ওয়া মিনকাস্ সালামু তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম।” [মাজমুউ ফাতাওয়া, ২২/৪৯২-৪৯৩]

✪ ৩-ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. (মৃত্যু: ৭৫১ হি.) বলেন, “তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সালাম ফিরাতেন, তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলতেন। অতঃপর বলতেন: আল্লাহুম্মা আন্তাস্ সালামু .. ..।” [যাদুল মাআদ, ১/২৯৫]

✪ ৪-ইবনুন নাজ্জার রহ. (মৃত্যু; ৯৭২হি.) বলেন, “অতঃপর সুন্নত হল, তিন বার ইস্তিগফার করা এবং বলা আল্লাহুম্মা আন্তাস সালামু ….।” [মুনতাহাল ইরাদাত, ১/২২]

✪ ৫-রামলী রহ. (মৃত্যৃ: ১০০৪ হি.) বলেন, “তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায শেষ করতেন, তিনবার ইস্তিগফার করতেন।” [নিহাইয়াতুল মুহতাজ, ১/৫২৯]

✪ ৬-বহূতী রহ. (মৃত্যু: ১০৫১হি.) বলেন, “অতঃপর তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলবে। (তারপর) আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ….।” [কাশ্শাফুল কান্না, ১/৪৩৪]

✪ ৭-শাইখ ইবনে বায রহ. বলেন, ‘অতঃপর আমি আমার ভাইসকলকে এই উপদেশ দিতে আনন্দ বোধ করছি যে, সুন্নত হল: মুসলিম ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতান্তে ইমাম হোক কিংবা মুক্তাদি হোক কিংবা একাকী নামায আদায়কারী হোক- সে যেন বলে, আস্তাগফিরুল্লাহ তিন বার। আল্লাহুম্মা আন্তাস সালামু ওয়া মিনকাস্ সালামু তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম। অতঃপর ইমাম হলে যেন লোকদের দিকে মুখ করে ফিরে বসে।’ [মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১১/১৮৮]

✪ ৮-শাইখ বকর আবু যাইদ রাহ. তাঁর তাসহীহুদ্ দুআ নামক গবেষণাধর্মী গ্রন্থে সালাত শেষে বৈধ যিকর সমূহ শিরোনামে যিকরগুলির ধারাবাহিকতা উল্লেখ করার সময় প্রথম নম্বরে বলেন, “ইস্তিগফার করা, আর এর প্রমাণিত নিয়ম হচ্ছে “আস্তাগফিরুল্লাহ” তিন বার।” [তাসহীহুদ দুয়া, ১/৪৩০]

✪ ৯-শাইখ সালেহ বিন ফাউযান (হাফেযাহুল্লাহ) বলেন, “যখন সালাম শেষ হবে বলবে, আস্তাগফিরুল্লাহ তিন বার। আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আন্তাস সালাম ওয়া মিনকাস সালামু তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওয়াল ইকরাম। অতঃপর প্রমাণিত যিকর করবে।” [আল মুলাখ্খাস আল ফিকহী, ১/৭০]

✪ ১১-সউদি স্থায়ী উলামা পরিষদ তাদের ফতোয়ায় বলেন, “ফরয সালাতের সালাম শেষে মুসল্লি তিন বার ইস্তিগফার করবে এবং বলবে আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ওয়া মিনকাস সালামু তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম। তারপর বলবে: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহূ লা শারীকা লাহূ লাহুল‌ মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর। লা হাওলা ওয়ালা কুও আতা ইল্লা বিল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়ালা না’বুদু ইল্লা ইয়্যাহু..শেষ পর্যন্ত। আল্লাহুম্মা লা মানিয়া লিমা আ’ত্বাইতা ওয়ালা মু’ত্বিয়া লিমা মানা’তা ওয়ালা ইয়ানফাউ যাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দ। অতঃপর সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহুআকবার ৩৩ বার। অতঃপর ১০০ পূরণে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু …”।[ফাতাওয়াল লাজনা আদ দাইমাহ, ৭১০২-১০৩]

আশা করি, সম্মানিত পাঠকদের নিকট বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যিনা তাসলীমান মাযীদা।।

ইসলামের দৃষ্টিতে হস্তমৈথুন

 প্রশ্ন: মাস্টারবেট বা হস্তমৈথুন করার বিধান কী?

উত্তর:
ইসলাম অত্যন্ত স্বভাবজাত ও বাস্তবসম্মত একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শের নাম। এখানে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সুন্দরতম সমাধান রয়েছে। আর মানুষের জৈবিক চাহিদা যেহেতু তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সেহেতু এক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে-এটাই স্বাভাবিক।

আর তাইতো এই মহাবিশ্বের মহাপরিচালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে তার জৈবিক বাসনা পূর্ণ করার পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন:
মহা-গ্রন্থ আল কুরআনে তিনি বলেন,
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ ‎‏ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ ‎
“এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। অতঃপর কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্ঘন কারী হবে।” [সূরা আল মুমিনূন: ৫, ৬ ও ৭]
অর্থাৎ মানুষের যৌন চাহিদা পূরণের বৈধ পন্থা হল, দুটি। যথা:
🔹১. বিয়ের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন গঠন। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা প্রয়োজনবোধে শর্তসাপেক্ষে একসাথে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثۡنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تَعۡدِلُواْ فَوَٰحِدَةً أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَلَّا تَعُولُواْ
“অতএব তোমরা বিয়ে করো নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার ; আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই গ্রহণ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশী।
[সূরা নিসা: ৩]

🔹 ২. কাফেরদের সাথে সংঘটিত জিহাদের মাধ্যমে গনিমত হিসেবে প্রাপ্ত নারী বন্দি বা ক্রীতদাসী। (বর্তমানে দাস-দাসী প্রথা প্রচলিত নেই। বিধায় এখানে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো না)

উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত দুটি উপায়ের বাইরে লজ্জাস্থানের ব্যবহারকে ‘সীমালঙ্ঘণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকেই ইমাম শাফেয়ী রহ. সহ অনেক সম্মানিত ফকিহ, হাত বা অন্য কোনও উপায়ে বীর্য স্খলন ঘটানোকে হারাম বলেছেন।

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য।

🔸 সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন,
العادة السرية لا تجوز وهي الاستمناء باليد أو بغيرها من الآلات لا يجوز؛
“হস্তমৈথুন তথা হাত অথবা অন্য যন্ত্র দ্বারা বীর্য স্খলন ঘটানো জায়েজ নয়।” এরপর তিনি হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত হওয়ার বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করেন। (শাইখের এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট)

🔸 শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানিও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। তবে তিনি বলেন, হস্ত মৈথুন ‘অভিশাপ যোগ্য কর্ম’ হওয়ার ব্যাপারে কিছু হাদিস পাওয়া যায়। সেগুলো ভিত্তিহীন এবং এমন দুর্বল যা দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন,
من نكح بيده ملعون أو ناكح كفه ملعون. فهذا الحديث لا أصل له، نعم هناك حديث بمعناه ( سبعة لعنهم الله ومنهم ناكح يده ) لكنه حديث ضعيف الإسناد لا تقوم فيه حجة، ولذلك هو مذكور في كتابي ( ضعيف الجامع الصغير )
“যে তাঁর হাতকে বিয়ে করবে সে অভিশপ্ত অথবা হাতের তালুকে বিয়ে কারী অভিশপ্ত।” এর কোনও ভিত্তি নেই। হ্যাঁ, এর সমার্থবোধক একটি হাদিস রয়েছে। তা হল, “আল্লাহ সাত শ্রেণীর মানুষের প্রতি অভিসম্পাত করেন। তাদের মধ্যে একজন হল, হাতকে বিবাহ কারী।” কিন্তু এর সনদ দুর্বল যা দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। [যাঈফ আল জামে আস সাগীর]

এছাড়াও হস্তমৈথুন বিয়ের মাধ্যমে হালাল পন্থায় সন্তান লাভের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক এবং আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম পরিপন্থী। কেননা কোন মানুষ এই হারাম কর্মে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে বিয়ের প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমনকি অতিরিক্ত অবিচারের ফলে তার বিয়ের শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় যেমনটি ডাক্তারগণ সতর্ক করেছেন।

◾এবার দেখা যাক, হস্তমৈথুনের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন কী বলেন:

pnsnews24 এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়:

হস্তমৈথুন এমন একটি অভ্যাস যা একবার কাউকে পেয়ে বসলে ত্যাগ করা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, অভ্যাসটি এক সময় অনেকের যৌন জীবন বিপর্যস্ত করে তুলে। হস্তমৈথুনের কারণে দুই ধরনের সমস্যা হয়- মানসিক সমস্যা ও শারীরিক সমস্যা।

অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের ফলে যে ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে:

১. অকাল বীর্যপাত(Premature Ejaculation)। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ে বীর্যপাত ঘটে। ফলে স্বামী তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে অক্ষম হয়। বৈবাহিক সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না।

২. বীর্য পাতলা হয়ে যায় (Temporary Oligospermia)- Oligospermia হলে বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায়। তখন বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা হয় ২০ মিলিয়নের কম। যার ফলে Male infertility দেখা দেয়। অর্থাৎ সন্তান জন্মদানে ব্যর্থতা দেখা দিতে পারে। একজন পুরুষ যখন স্ত্রীকে রমণ করেন তখন তার পুরুষাঙ্গ থেকে যে বীর্য বের হয় সেই বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা হয় ৪২ কোটির মত।

৩. বিজ্ঞান বলে, কোনও পুরুষের থেকে যদি ২০ কোটির কম শুক্রাণু বের হয় তাহলে সে পুরুষ কোনও সন্তানের জন্ম দিতে পারেন না। অতিরিক্ত হস্তমৈথুন পুরুষের যৌনাঙ্গকে দুর্বল করে দেয়।

৪. Nervous system, heart, digestive system, urinary system এবং আরও অন্যান্য system ক্ষতিগ্রস্ত হয় । পুরো শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং শরীর রোগ-বালাইয়ের যাদুঘর হয়ে যায়।
৫. চোখের ক্ষতি হয়।
৬. স্মরণ শক্তি কমে যায়।
৭. মাথা ব্যথা হয় ইত্যাদি আরও অনেক সমস্যা হয় হস্তমৈথুনের কারণে।
৮. আরেকটি সমস্যা হল Leakage of semen। অর্থাৎ সামান্য উত্তেজনায় যৌনাঙ্গ থেকে তরল পদার্থ বের হওয়া।
৯. শারীরিক ব্যথা এবং মাথা ঘোরা।
১০. যৌন ক্রিয়ার সাথে জড়িত স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হওয়া অথবা ঠিক মত কাজ না করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া।
১১. শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন: হজম প্রক্রিয়া এবং প্রস্রাব প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত বীর্য স্খলনের প্রধান কারণ অতিরিক্ত হস্তমৈথুন।
১২. হস্তমৈথুনের ফলে অনেকেই কানে কম শুনতে পারেন। [পিএনএস ডেস্ক]

সুতরাং সামর্থ্য বান যুবকদের অনতিবিলম্বে বিয়ে করা উচিত। পাপাচারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে বিয়ে করা ফরজ। হ্যাঁ, বিশেষ কোন কারণে বিয়েতে সাময়িক বিলম্ব হলে রোজা রাখার মাধ্যমে যৌন বাসনা কে দমন করবে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন,
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ؛ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ.
“হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে চোখকে নিচু রাখতে এবং লজ্জা স্থানকে সংযত করতে সব চেয়ে বেশি সহায়ক। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সওম (রোজা) পালন করে। কেননা তা প্রবৃত্তিকে দমন করে।” [বুখারী ১৯০৫, ৫০৬৫ ও মুসলিম ১৪০০]

কিন্তু ক্যারিয়ার গঠন, চাকরি পাওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, বয়স হয়নি, বউকে কী খাওয়াবো এসব দুর্বল ও কু যুক্তি পেশ করে হালাল বিয়ে থেকে দূরে থাকা এবং তথাকথিত বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড নামক ঘৃণ্য অপসংস্কৃতিতে হাবুডুবু খাওয়া অথবা পর্ণ, ও যৌন উত্তেজক ভিডিও দেখা, এই জাতীয় গান শোনা, অশ্লীল ও নোংরা গল্প-উপন্যাস পড়া কিংবা কারো সাথে অশ্লীল কথাবার্তা বলার মাধ্যমে যৌন উত্তেজনা অনুভব করা অবশেষে হস্তমৈথুনের মাধ্যমে যৌন চাহিদা নিবৃত করে নিজের উপর অত্যাচার করা এবং তাকে অভ্যাসে পরিণত করা নিঃসন্দেহে হারাম ও কবিরা গুনাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হালাল পন্থায় জৈবিক চাহিদা পূরণ করার এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম
▬▬▬✪✪✪▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate