প্রশ্ন: ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জীবিত বা মৃত কোনো কাফের-মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে দুআ করা কি বৈধ?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি। অতঃপর কুরআন-সুন্নাহ এবং এই উম্মতের স্বলাফে সালেহীনের সর্বসম্মত মত (ইজমা)-এর আলোকে প্রমাণিত হয় যে, একজন কাফের-মুশরিকদের জন্য দো‘আ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। যার মধ্যে এক প্রকার পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ এবং অপরটি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে বৈধ।
.

.
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম আব্দুর রহমান আস-সা’দীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:يعني: ما يليق ولا يحسن بالنبي والمؤمنين به أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ أي: لمن كفر بهُ وعبد معه غيره وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ …”অর্থাৎ, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করবে, অর্থাৎ যারা আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করেছে এবং আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদত করেছে— যদিও তারা আত্মীয়-স্বজন হয়, যখন তাদের জন্য স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।”(তাফসিরে সাদী; খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ৫০৯)
.
ইমাম আবু ‘আব্দুল্লা-হ্ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল ক্বুরত্বুবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭১ হি.] বলেন:هذه الآية تضمنت قطع موالاة الكفار حيهم وميتهم فإن الله لم يجعل للمؤمنين أن يستغفروا للمشركين فطلب الغفران للمشرك مما لا يجوز “এই আয়াতে জীবিত বা মৃত,কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের কাফেরদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি দেননি। কাজেই কাফেরদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা বৈধ নয়।”(কুরতুবী;আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১৭৩)
.
ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন;وهذه الآية متضمنة لقطع الموالاة للكفار وتحريم الاستغفار لهم والدعاء بما لا يجوز لمن كان كافراً”এই আয়াতে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিন্ন করার নির্দেশ, এবং তাদের জন্য মাগফিরাত চাওয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”(শাওকানী; ফাতহুল কাদীর; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪১০)
.
সূরা তওবার উক্ত ১১৩ নং আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ বিন মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) মৃত:৯৪ হি:] থেকে বর্ণিত, ইবনুল মুসাইয়িব তার পিতা মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেন, যখন আবূ তালিবের মুমূর্ষ অবস্থা তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকট গেলেন। আবূ জাহলও তার নিকট উপবিষ্ট ছিল। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচাজান,কলেমাটি একবার পড়ুন, তাহলে আমি আপনার জন্য আল্লাহ্র নিকট কথা বলতে পারব। তখন আবূ জাহাল ও ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু আবূ উমাইয়া বলল, হে আবূ তালিব! তুমি কি ‘আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে ফিরে যাবে? এরা দু’জন তার সাথে একথাটি বারবার বলতে থাকল। সর্বশেষ আবূ তালিব তাদের সাথে যে কথাটি বলল, তা হল, আমি ‘আবদুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপরেই আছি। এ কথার পর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকব যে পর্যন্ত আপনার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা না হয়। এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি নাযিল হল:
مَا كَانَ لِلنَّبِیِّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ یَّسۡتَغۡفِرُوۡا لِلۡمُشۡرِكِیۡنَ وَ لَوۡ كَانُوۡۤا اُولِیۡ قُرۡبٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمۡ اَنَّهُمۡ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ
“নবী ও মুমিনদের পক্ষে উচিত নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য যদি তারা নিকটাত্মীয়ও হয় যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামী – (আত-তাওবাহ: ১১৩)। আরো নাযিল হল: اِنَّكَ لَا تَهۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ “আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে হিদায়াত করতে পারবেন না।”(আল-কাসাস: ৫৬)।”(সহীহ বুখারী হা/৩৮৮৪ সহীহ মুসলিম হা/৩৯)
.
অনুরূপ সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:(اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَسْتَغْفِرَ لِأُمِّي فَلَمْ يَأْذَنْ لِي)”আমি আমার প্রভুর নিকট আমার মায়ের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করার অনুমতি চেয়েছিলাম আমার প্রভু আমাকে অনুমতি দান করেননি।”(সহীহ মুসলিম হা/২১৪৮;ই.ফা. ২১২৭, ই.সে. ২১৩০) হাদিসটির আলোকে শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:فهذا الحديث يبين أن الله عز وجل لم يأذن لنبيه وهو أشرف خلقه بالاستغفار لأمه بعد موتها وهذا هو الذي نهى الله عنه في الآية السابقة وهذا الحديث نص في هذه المسألة”এই হাদীস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বপ্রিয় সৃষ্টি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও তাঁর (নবীর) মায়ের জন্য ইস্তিগফার করার অনুমতি দেননি। উপরোক্ত আয়াতে এই নিষেধের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে এটি একটি স্পষ্ট ও চূড়ান্ত প্রমাণ।”(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২০১০০)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:فإن الاستغفار للكفار لا يجوز بالكتاب والسنَّة والإجماع “নিঃসন্দেহে কাফেরদের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা (সম্মিলিত ঐক্যমত) অনুযায়ী বৈধ নয়”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৪৮৯)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,وأما الصلاة على الكافر ، والدعاء له بالمغفرة : فحرام بنص القرآن والإجماع ” ا“কাফেরের জন্য রহমত প্রার্থনা করা ও তার ক্ষমার জন্য দোয়া করা কুরআনের দ্ব্যর্থহীন দলিল ও ইজমার ভিত্তিতে হারাম।” (নববী আল মাজমূ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১২০)
.
উল্লেখ্য যে, কেউ যদি বলেন:নবী ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) তো তার কাফের পিতাকে বলেছিলেন,قَالَ سَلٰمٌ عَلَیۡكَ ۚ سَاَسۡتَغۡفِرُ لَكَ رَبِّیۡ ؕ اِنَّهٗ كَانَ بِیۡ حَفِیًّا “আপনার প্রতি সালাম।আমি আমার রব এর কাছে আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব, নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল”।(সূরা মারইয়াম,আয়াত;৪৭) তাহলে এর জবাব হচ্ছে, যা আল্লাহ তাআলা বলেছেন:وَ مَا كَانَ اسۡتِغۡفَارُ اِبۡرٰهِیۡمَ لِاَبِیۡهِ اِلَّا عَنۡ مَّوۡعِدَۃٍ وَّعَدَهَاۤ اِیَّاهُ ۚ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَهٗۤ اَنَّهٗ عَدُوٌّ لِّلّٰهِ تَبَرَّاَ مِنۡهُ ؕ اِنَّ اِبۡرٰهِیۡمَ لَاَوَّاهٌ حَلِیۡمٌ”অতএব, ইবরাহিম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। নিঃসন্দেহে ইবরাহিম ছিলেন অতি কোমল হৃদয়ের ও সহনশীল।”(সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১১৪)
ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: “যখন ইবরাহিমের পিতা মারা গেল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে সে আল্লাহর শত্রু ছিল, তখনই তিনি তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।”।(তাফসীর ইবনু কাসীর: পৃষ্ঠা: ২০৫; তাফসির মাআলিমুত তানজিল’ ওরফে ‘তাফসিরুল বাগাবি’ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১০২) এমনকি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) হাশরের মাঠে যখন তার পিতাকে কুৎসিত অবস্থায় দেখবেন তখন তার জন্য কোন দোআ বা সুপারিশ করবেন না। এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “হাশরের মাঠে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পিতাকে দেখে বলবেন, হে আল্লাহ্! আপনি আমাকে আজকের দিনে অপমান থেকে রক্ষা করার ওয়াদা করেছেন। আমার পিতার অপমানের চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে? আল্লাহ তা’আলা বলবেন: “আমি কাফেরদের জন্য জান্নাত হারাম করেছি।” তারপর আল্লাহ তা’আলা তখন তাকে তার পায়ের নীচে তাকাবার নির্দেশ দিবেন। তিনি তাকিয়ে একটি মৃত দুৰ্গন্ধযুক্ত পঁচা জানোয়ার দেখতে পাবেন, ফলে তিনি তার জন্য সুপারিশ না করেই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।”(সহীহ বুখারীঃ ৩১৭২, ৪৪৯০, ৪৪৯১) সুতরাং কাফেরের জন্য জান্নাতে প্রবেশের দু’আ করা কিংবা ক্ষমা ও অনুগ্রহ পাওয়ার দু’আ করা কিংবা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার দু’আ করা অথবা আমাদের নবী (ﷺ) শাফায়াত লাভের দু’আ করা জায়েজ নয়।
.
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের আলিম শাইখ সা’আদ বিন তুর্কি আল খাছলান (হাফিযাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,প্রশ্ন: একজন কাফিরের জন্য দুনিয়ার কোনো বিষয়ে দোয়া করার বিধান কী? যেমন: আমি তার জন্য দোয়া করি যেন আল্লাহ তাকে পরীক্ষায় সফলতা দেন, অথবা তার বিবাহে বরকত দেন, কিংবা অন্য কোনো বিষয়?
উত্তরে শাইখ বলেন:
:الدعاء للكافر على ثلاث حالات:الحالة الأولى: الدعاء له بالمغفرة، وهذا محرم بالإجماع، نهى الله تعالى عنه: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيم [التوبة:113-114]، هذا بنص الآية الكريمة: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى، هذه الصورة لا تجوز بالإجماع، الاستغفار لغير المسلمين عمومًا.
الحالة الثانية: الدعاء لهم بالهداية، وهذا لا بأس به؛ ولهذا لما كان اليهود يتعاطسون عند النبي يرجون بذلك أن يدعو لهم بالرحمة: أن يرحمهم الله، فكان عليه الصلاة والسلام يقول: يهديكم الله [1]، فالدعاء للكافر بالهداية هذا أمر مشروع، ولعل الله أن يهديه، وأن يَمُنَّ عليه بالإسلام.
الحالة الثالثة: الدعاء له بالأمور الدنيوية، مثلما ذكر الأخ السائل: كالدعاء له بالرزق، أو بالتوفيق، أو نحو ذلك، وهذه الحال محل خلاف بين أهل العلم؛ والقول الراجح: أنه إذا كان في مصلحة -كتأليف قلبه على الإسلام ونحو ذلك- فهذا لا بأس به.
“কাফিরের জন্য দোয়া তিনটি অবস্থায় হয়ে থাকে:
প্রথম অবস্থা: তার জন্য মাগফিরাত বা ক্ষমা চাওয়া। এটি সর্বসম্মত নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা তা থেকে নিষেধ করেছেন। আল-কুরআনে এসেছে:“(নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে, যদিও তারা আত্মীয়-স্বজন হয়, এমনকি যখন এটা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী।“ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাটাও ছিল একটি প্রতিশ্রুতির কারণে। কিন্তু যখন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সে আল্লাহর শত্রু, তখন সে তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে নেয়।” (সূরা তাওবা: ১১৩-১১৪) এই কুরআনিক আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যে, মুশরিক বা অমুসলিমদের জন্য মাগফিরাত চাওয়া কখনো বৈধ নয় ।এমনকি যদি তারা আত্মীয়স্বজনও হয়। এ ব্যাপারে সম্মিলিত ঐক্যমত্য (ইজমা) রয়েছে যে অমুসলিমদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না।
দ্বিতীয় অবস্থা: তাদের জন্য হেদায়াত কামনা করে দোয়া করা এটি কোনো সমস্যা নয়। এজন্যই, যখন ইয়াহুদীরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে হাঁচি দিত, তখন তারা আশা করত তিনি তাদের জন্য দোয়া করবেন— যেন আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত করেন। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন: “আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত দিন”।(হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী “আদবুল মুফরাদ” গ্রন্থে হা/ ৯৪০; আবু দাউদ হা/৫০৩৮; তিরমিযি হা/২৭৩৯; ইমাম তিরমিযি হাদীসটি হাসান বলেছেন) সুতরাং কাফেরের জন্য হেদায়াত কামনা করে দোয়া করা এটি শরীয়তসম্মত। হতে পারে আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করবেন এবং ইসলামের প্রতি অনুগ্রহ করবেন।
.
তৃতীয় অবস্থা: দুনিয়াবী বিষয়ে তার জন্য দোয়া করা, যেমন প্রশ্নকারী ভাই যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন রিযিক (জীবিকা), তাওফিক (সফলতা) বা এর অনুরূপ কিছু কামনা করা। এই বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে। তবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো: যদি এতে কোনো কল্যাণ থাকে যেমন ইসলামের প্রতি তার হৃদয় আকৃষ্ট করা ইত্যাদি তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই।”(দেখুন: https://saadalkhathlan.com/fatwas/5322)
.

.
(১)- এমন দু’আর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়নি। আর নিষেধের পক্ষে কোনো দলীল না আসা পর্যন্ত জায়েয-ই মূল অবস্থা। এই মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহি কায়দা বা নীতি, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।
(২)- সুন্নাহতে বর্ণিত আছে, কোনো কাফের যদি কোনো মুসলিমকে স্পষ্ট শব্দে সালাম দেয়, তাহলে তার সালামের জবাব দেওয়া জায়েয। তার সালামের জবাব দেওয়া মূলত তার সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দু’আ করা। যেমন: প্রখ্যাত সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন:إِذَا سَلَّمَ عَلَيْكُمْ أَهْلُ الكتابِ فَقولُوا وَعَلَيْكُم “যখন তোমাদেরকে আহলে কিতাব (অর্থাৎ- ইয়াহূদী ও নাসারাগণ) সালাম দেয়, তখন তোমরাও (শুধু এতটুকু) বলবে ‘‘ওয়া আলায়কুম’’ (অর্থাৎ- তোমাদের ওপরও)।(সহীহ বুখারী হা/৬২৫৮, সহীহ মুসলিম হা/৫৫৪৫) অনুরূপভাবে সুন্নাহতে কাফেরের রুকইয়া করাও জায়েয বলা হয়েছে। আর রুকইয়া হল সুস্থতার জন্য দোয়া করা। যেমন সহীহ বুখারীতে প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস যেখানে কতিপয় সাহাবী এক অমুসলিম সরদারকে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়ফুঁক করেছিল।(সহিহ বুখারী হা/২১৫৬; ও সহিহ মুসলিম হা/২২০১)
.
(৩)- এতে করে কাফেরের মন জয় করার মত কল্যাণ অর্জিত হয়। শরীয়তের উদ্দেশ্যসমূহের মাঝে এটা হলো অন্যতম বিবেচ্য একটি মহৎ কল্যাণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক অসুস্থ ইহুদি গোলামকে দেখতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে ইসলাম গ্রহণ করে।যেমন:আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ইয়াহূদী যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করতেন। তাঁর মৃত্যুশয্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার মাথার পাশে বসে বললেন, হে অমুক! তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। যুবকটি তার পাশে থাকা পিতার দিকে তাকাল। পিতা তাকে বলল, আবুল ক্বাসিমের কথা মেনে নাও। যুবকটি ইসলাম গ্রহণ করল। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছ থেকে বের হয়ে এসে বললেন, আল্লাহর শুকরিয়া। তিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন।”(সহীহ বুখারীর হা/১৩৫৬) অপর বর্ননায় প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে উমর (রা.) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূল ﷺ) বলেছেন: ‘হে আল্লাহ্! এই দুই জন লোকের মধ্যে যে ব্যক্তি আপনার কাছে অধিক প্রিয় তার মাধ্যমে আপনি ইসলামকে শক্তিশালী করুন: আবু জেহেল কিংবা উমর বিন খাত্তাব।”(সুনানে তিরমিযি হা/৩৬৮১ ইমাম আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)।
.
(৪)- সালাফদের কারো কারো থেকে এমন দু’আ বর্ণিত হয়েছে। যেমন: উকবা ইবনে আমের আল-জুহানী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন যার বেশভূষা ছিল মুসলিমের মত। লোকটা তাকে সালাম দেয়। উকবা (রাঃ) সালামের উত্তর দিয়ে বলেন: “ওয়ালাইকা ওয়া-রাহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতুহু”। তখন উকবার গোলাম বলল: “সে খ্রিষ্টান।” তখন উকবা উঠে গিয়ে তার পিছু নেন এবং তাকে পাওয়ার পর বললেন: “আল্লাহর রহমত আর বরকত মুমিনদের উপর। তবে আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন এবং তোমার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিন।”(ইমাম বুখারী তার ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ বইয়ে; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৮০ হা/১১২২; হাদীসটি বর্ণনা করেন ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন ইরওয়া হা/১২৭৪)।অন্য বর্ণনায় এসেছে, জনৈক ইহূদী রাসূল (ﷺ)-এর নিকট দো‘আ চাইলে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার ধন-সম্পদ ও সন্তানাদিতে বরকত দিন এবং দেহে সুস্থতাও বয়সে প্রশস্ততা দান করুন।”(ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৫৮২৪; বর্ননাটিকে অনেকে দুর্বল বলেছেন) অপর বর্ননায় আবূ বুরদা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইয়াহুদীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে এই আশায় ইচ্ছাকৃতভাবেই হাঁচি দিতো যে, তিনি তাদের হাঁচির জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লা’ (আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন) বলবেন। কিন্তু তিনি বলতেনঃ ‘ইয়াহদিকুমুল্লাহু ওয়া ইউসলিহু বালাকুম।(আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত করুন এবং তোমাদের বিষয়গুলো সংশোধন করুন।)”।(আবু দাউদ হা/৫০৩৮; তিরমিজি হা/২৭৩৯)
.
প্রখ্যাত তাবি‘ঈ হাসান বিন ইয়াসার ওরফে হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:১১০ হি.] বলেন:إذا عزَّيتَ الذمي فقل : لا يصيبك إلا الخير “যিম্মীকে মৃত্যু শোকের সান্ত্বনা দিতে চাইলে বলবে, তোমার শুধু কল্যাণই হোক।” ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] তার ‘আহকামু আহলিয-যিম্মাহ’ বইয়ে উক্ত বর্ণনা আনার পর অনুরূপ আরো কিছু বর্ণনা উল্লেখ করেন।”(বিস্তারিত জানতে দেখুন; আহকামু আহলিয-যিম্মাহ; পৃষ্ঠা: ৪৩৮)
.
(৫)- ফকীহগন এ ধরনের দু’আ জায়েয বলেছেন। এর পক্ষে কিছু বক্তব্য নিম্নরূপ: হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম বুহূতী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘কাশ্শাফুল ক্বিনা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন:يجوز أن يقال له : أهلا وسهلا ، وكيف أصبحت ؟ ونحوه مثل : كيف حالك ؟ ويجوز أن يقول المسلم للذمي : أكرمك الله ، وهداك الله , يعني بالإسلام ، قال إبراهيم الحربي لأحمد : يقول له : ” أكرمك الله ” ؟ قال : نعم ، يعني بالإسلام “তাকে (কাফেরকে) বলা যাবে: আহলান ওয়া সাহলান (শুভেচ্ছা স্বাগতম), আপনার সকালটা কেমন?’ অনুরূপভাবে বলা যাবে: ‘কেমন আছেন?’ মুসলিমের জন্য যিম্মীকে ‘আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন, আপনাকে হেদায়াত দান করুন (অর্থাৎ ইসলামের মাধ্যমে) বলা বৈধ।’ ইব্রাহীম আল-হারবী ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করেন: ‘মুসলিম কি যিম্মীকে বলবে ‘আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন?’ ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ‘হ্যাঁ; অর্থাৎ ইসলামের মাধ্যমে’।”(সংক্ষেপে কাশ্শাফুল ক্বিনা’/,খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৩০)
.
শাফেয়ী মাযহাবের গ্রন্থ ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ টীকাতে এবং ‘তুহফাতুল মুহতাজ’ এর টীকায় এসেছে:
“কাফেরের শারীরিক সুস্থতা ও হেদায়াতের জন্য দু’আ করা জায়েয।”(নিহায়াতুল মুহতাজ’ খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৩৩; তুহফাতুল মুহতাজ’ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৮)
.
ইমাম মুনাওয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘ফাইযুল কাদীর’ বইয়ে বলেন:ويجوز الدعاء للكافر أيضا بنحو هداية ، وصحة ، وعافية ، لا بالمغفرة “কাফেরের জন্য হেদায়াত, সুস্থতা ও নিরাপত্তার দোয়া করা যাবে। তবে ক্ষমাপ্রাপ্তির দোয়া করা যাবে না।”(মুনাওয়ী; ফাইযুল কাদীর; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৫)
.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে: একজন মুসলিম কি খ্রিষ্টানকে বলতে পারবে: “আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন?” তিনি উত্তর দেন:نعم ، يقول : أكرمك الله ، يعني بالإسلام “হ্যাঁ। বলতে পারবে: আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন; অর্থাৎ ইসলামের মাধ্যমে।” ইবনু মুফলিহ আল-আদাব আশ-শরইয়্যাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৬৯)। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৪৯১৪)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী (হাফিজাহুল্লাহ)।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।