Saturday, August 30, 2025

জীবিত বা মৃত কোনো কাফের-মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে দুআ করা কি বৈধ

 প্রশ্ন: ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জীবিত বা মৃত কোনো কাফের-মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে দুআ করা কি বৈধ?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি। অতঃপর কুরআন-সুন্নাহ এবং এই উম্মতের স্বলাফে সালেহীনের সর্বসম্মত মত (ইজমা)-এর আলোকে প্রমাণিত হয় যে, একজন কাফের-মুশরিকদের জন্য দো‘আ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। যার মধ্যে এক প্রকার পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ এবং অপরটি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে বৈধ।
.
▪️প্রথম প্রকার: কাফেরদের জন্য আখিরাতের সাথে সংশ্লিষ্ট দু’আ: যেমন কাফেরের জন্য জান্নাতে প্রবেশের দু’আ করা,তাদের জন্য ক্ষমা ও অনুগ্রহ পাওয়ার দোয়া করা,জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার দোয়া করা অথবা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত লাভ করার দোয়া করা এবং এ জাতীয় অন্য কোন দু’আ।এ ধরনের দু’আ করা কুরআন সুন্নাহ’র দলিল এবং এই উম্মতের ইজমা অনুযায়ী জায়েয নেই।কারন আল্লাহ তায়ালা এমন দু’আ করতে নিষেধ করে পবিত্র কুরআনে বলেন:مَا كَانَ لِلنَّبِیِّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ یَّسۡتَغۡفِرُوۡا لِلۡمُشۡرِكِیۡنَ وَ لَوۡ كَانُوۡۤا اُولِیۡ قُرۡبٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمۡ اَنَّهُمۡ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ“নবী ও মুমিনদের জন্য শোভনীয় নয় মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা; যদিও তারা আত্মীয়-স্বজন হয় যখন এটা তাদের কাছে সুস্পষ্ট যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।”(সূরা তাওবাহ, আয়াত: ১১৩)
.
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম আব্দুর রহমান আস-সা’দীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:يعني: ما يليق ولا يحسن بالنبي والمؤمنين به أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ أي: لمن كفر بهُ وعبد معه غيره وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ …”অর্থাৎ, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করবে, অর্থাৎ যারা আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করেছে এবং আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদত করেছে— যদিও তারা আত্মীয়-স্বজন হয়, যখন তাদের জন্য স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।”(তাফসিরে সাদী; খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ৫০৯)
.
ইমাম আবু ‘আব্দুল্লা-হ্ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল ক্বুরত্বুবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭১ হি.] বলেন:هذه الآية تضمنت قطع موالاة الكفار حيهم وميتهم فإن الله لم يجعل للمؤمنين أن يستغفروا للمشركين فطلب الغفران للمشرك مما لا يجوز “এই আয়াতে জীবিত বা মৃত,কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের কাফেরদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি দেননি। কাজেই কাফেরদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা বৈধ নয়।”(কুরতুবী;আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১৭৩)
.
ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন;وهذه الآية متضمنة لقطع الموالاة للكفار وتحريم الاستغفار لهم والدعاء بما لا يجوز لمن كان كافراً”এই আয়াতে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিন্ন করার নির্দেশ, এবং তাদের জন্য মাগফিরাত চাওয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”(শাওকানী; ফাতহুল কাদীর; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪১০)
.
সূরা তওবার উক্ত ১১৩ নং আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ বিন মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) মৃত:৯৪ হি:] থেকে বর্ণিত, ইবনুল মুসাইয়িব তার পিতা মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেন, যখন আবূ তালিবের মুমূর্ষ অবস্থা তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকট গেলেন। আবূ জাহলও তার নিকট উপবিষ্ট ছিল। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচাজান,কলেমাটি একবার পড়ুন, তাহলে আমি আপনার জন্য আল্লাহ্‌র নিকট কথা বলতে পারব। তখন আবূ জাহাল ও ‘আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌নু আবূ উমাইয়া বলল, হে আবূ তালিব! তুমি কি ‘আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে ফিরে যাবে? এরা দু’জন তার সাথে একথাটি বারবার বলতে থাকল। সর্বশেষ আবূ তালিব তাদের সাথে যে কথাটি বলল, তা হল, আমি ‘আবদুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপরেই আছি। এ কথার পর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকব যে পর্যন্ত আপনার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা না হয়। এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি নাযিল হল:
مَا كَانَ لِلنَّبِیِّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ یَّسۡتَغۡفِرُوۡا لِلۡمُشۡرِكِیۡنَ وَ لَوۡ كَانُوۡۤا اُولِیۡ قُرۡبٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمۡ اَنَّهُمۡ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ
“নবী ও মুমিনদের পক্ষে উচিত নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য যদি তারা নিকটাত্মীয়ও হয় যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামী – (আত-তাওবাহ: ১১৩)। আরো নাযিল হল: اِنَّكَ لَا تَهۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ “আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে হিদায়াত করতে পারবেন না।”(আল-কাসাস: ৫৬)।”(সহীহ বুখারী হা/৩৮৮৪ সহীহ মুসলিম হা/৩৯)
.
অনুরূপ সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:(اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَسْتَغْفِرَ لِأُمِّي فَلَمْ يَأْذَنْ لِي)”আমি আমার প্রভুর নিকট আমার মায়ের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করার অনুমতি চেয়েছিলাম আমার প্রভু আমাকে অনুমতি দান করেননি।”(সহীহ মুসলিম হা/২১৪৮;ই.ফা. ২১২৭, ই.সে. ২১৩০) হাদিসটির আলোকে শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:فهذا الحديث يبين أن الله عز وجل لم يأذن لنبيه وهو أشرف خلقه بالاستغفار لأمه بعد موتها وهذا هو الذي نهى الله عنه في الآية السابقة وهذا الحديث نص في هذه المسألة”এই হাদীস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সর্বপ্রিয় সৃষ্টি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও তাঁর (নবীর) মায়ের জন্য ইস্তিগফার করার অনুমতি দেননি। উপরোক্ত আয়াতে এই নিষেধের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে এটি একটি স্পষ্ট ও চূড়ান্ত প্রমাণ।”(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২০১০০)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:فإن الاستغفار للكفار لا يجوز بالكتاب والسنَّة والإجماع “নিঃসন্দেহে কাফেরদের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা (সম্মিলিত ঐক্যমত) অনুযায়ী বৈধ নয়”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৪৮৯)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,وأما الصلاة على الكافر ، والدعاء له بالمغفرة : فحرام بنص القرآن والإجماع ” ا“কাফেরের জন্য রহমত প্রার্থনা করা ও তার ক্ষমার জন্য দোয়া করা কুরআনের দ্ব্যর্থহীন দলিল ও ইজমার ভিত্তিতে হারাম।” (নববী আল মাজমূ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১২০)
.
উল্লেখ্য যে, কেউ যদি বলেন:নবী ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) তো তার কাফের পিতাকে বলেছিলেন,قَالَ سَلٰمٌ عَلَیۡكَ ۚ سَاَسۡتَغۡفِرُ لَكَ رَبِّیۡ ؕ اِنَّهٗ كَانَ بِیۡ حَفِیًّا “আপনার প্রতি সালাম।আমি আমার রব এর কাছে আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব, নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল”।(সূরা মারইয়াম,আয়াত;৪৭) তাহলে এর জবাব হচ্ছে, যা আল্লাহ তাআলা বলেছেন:وَ مَا كَانَ اسۡتِغۡفَارُ اِبۡرٰهِیۡمَ لِاَبِیۡهِ اِلَّا عَنۡ مَّوۡعِدَۃٍ وَّعَدَهَاۤ اِیَّاهُ ۚ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَهٗۤ اَنَّهٗ عَدُوٌّ لِّلّٰهِ تَبَرَّاَ مِنۡهُ ؕ اِنَّ اِبۡرٰهِیۡمَ لَاَوَّاهٌ حَلِیۡمٌ”অতএব, ইবরাহিম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। নিঃসন্দেহে ইবরাহিম ছিলেন অতি কোমল হৃদয়ের ও সহনশীল।”(সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১১৪)
ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: “যখন ইবরাহিমের পিতা মারা গেল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে সে আল্লাহর শত্রু ছিল, তখনই তিনি তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।”।(তাফসীর ইবনু কাসীর: পৃষ্ঠা: ২০৫; তাফসির মাআলিমুত তানজিল’ ওরফে ‘তাফসিরুল বাগাবি’ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১০২) এমনকি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) হাশরের মাঠে যখন তার পিতাকে কুৎসিত অবস্থায় দেখবেন তখন তার জন্য কোন দোআ বা সুপারিশ করবেন না। এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “হাশরের মাঠে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পিতাকে দেখে বলবেন, হে আল্লাহ্! আপনি আমাকে আজকের দিনে অপমান থেকে রক্ষা করার ওয়াদা করেছেন। আমার পিতার অপমানের চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে? আল্লাহ তা’আলা বলবেন: “আমি কাফেরদের জন্য জান্নাত হারাম করেছি।” তারপর আল্লাহ তা’আলা তখন তাকে তার পায়ের নীচে তাকাবার নির্দেশ দিবেন। তিনি তাকিয়ে একটি মৃত দুৰ্গন্ধযুক্ত পঁচা জানোয়ার দেখতে পাবেন, ফলে তিনি তার জন্য সুপারিশ না করেই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।”(সহীহ বুখারীঃ ৩১৭২, ৪৪৯০, ৪৪৯১) সুতরাং কাফেরের জন্য জান্নাতে প্রবেশের দু’আ করা কিংবা ক্ষমা ও অনুগ্রহ পাওয়ার দু’আ করা কিংবা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার দু’আ করা অথবা আমাদের নবী (ﷺ) শাফায়াত লাভের দু’আ করা জায়েজ নয়।
.
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের আলিম শাইখ সা’আদ বিন তুর্কি আল খাছলান (হাফিযাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,প্রশ্ন: একজন কাফিরের জন্য দুনিয়ার কোনো বিষয়ে দোয়া করার বিধান কী? যেমন: আমি তার জন্য দোয়া করি যেন আল্লাহ তাকে পরীক্ষায় সফলতা দেন, অথবা তার বিবাহে বরকত দেন, কিংবা অন্য কোনো বিষয়?
উত্তরে শাইখ বলেন:
:الدعاء للكافر على ثلاث حالات:الحالة الأولى: الدعاء له بالمغفرة، وهذا محرم بالإجماع، نهى الله تعالى عنه: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ ۝وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيم [التوبة:113-114]، هذا بنص الآية الكريمة: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى، هذه الصورة لا تجوز بالإجماع، الاستغفار لغير المسلمين عمومًا.
الحالة الثانية: الدعاء لهم بالهداية، وهذا لا بأس به؛ ولهذا لما كان اليهود يتعاطسون عند النبي  يرجون بذلك أن يدعو لهم بالرحمة: أن يرحمهم الله، فكان عليه الصلاة والسلام يقول: يهديكم الله [1]، فالدعاء للكافر بالهداية هذا أمر مشروع، ولعل الله أن يهديه، وأن يَمُنَّ عليه بالإسلام.
الحالة الثالثة: الدعاء له بالأمور الدنيوية، مثلما ذكر الأخ السائل: كالدعاء له بالرزق، أو بالتوفيق، أو نحو ذلك، وهذه الحال محل خلاف بين أهل العلم؛ والقول الراجح: أنه إذا كان في مصلحة -كتأليف قلبه على الإسلام ونحو ذلك- فهذا لا بأس به.
“কাফিরের জন্য দোয়া তিনটি অবস্থায় হয়ে থাকে:
প্রথম অবস্থা: তার জন্য মাগফিরাত বা ক্ষমা চাওয়া। এটি সর্বসম্মত নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা তা থেকে নিষেধ করেছেন। আল-কুরআনে এসেছে:“(নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে, যদিও তারা আত্মীয়-স্বজন হয়, এমনকি যখন এটা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী।“ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাটাও ছিল একটি প্রতিশ্রুতির কারণে। কিন্তু যখন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সে আল্লাহর শত্রু, তখন সে তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে নেয়।” (সূরা তাওবা: ১১৩-১১৪) এই কুরআনিক আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যে, মুশরিক বা অমুসলিমদের জন্য মাগফিরাত চাওয়া কখনো বৈধ নয় ।এমনকি যদি তারা আত্মীয়স্বজনও হয়। এ ব্যাপারে সম্মিলিত ঐক্যমত্য (ইজমা) রয়েছে যে অমুসলিমদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না।
দ্বিতীয় অবস্থা: তাদের জন্য হেদায়াত কামনা করে দোয়া করা এটি কোনো সমস্যা নয়। এজন্যই, যখন ইয়াহুদীরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে হাঁচি দিত, তখন তারা আশা করত তিনি তাদের জন্য দোয়া করবেন— যেন আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত করেন। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন: “আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত দিন”।(হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী “আদবুল মুফরাদ” গ্রন্থে হা/ ৯৪০; আবু দাউদ হা/৫০৩৮; তিরমিযি হা/২৭৩৯; ইমাম তিরমিযি হাদীসটি হাসান বলেছেন) সুতরাং কাফেরের জন্য হেদায়াত কামনা করে দোয়া করা এটি শরীয়তসম্মত। হতে পারে আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করবেন এবং ইসলামের প্রতি অনুগ্রহ করবেন।
.
তৃতীয় অবস্থা: দুনিয়াবী বিষয়ে তার জন্য দোয়া করা, যেমন প্রশ্নকারী ভাই যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন রিযিক (জীবিকা), তাওফিক (সফলতা) বা এর অনুরূপ কিছু কামনা করা। এই বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে। তবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো: যদি এতে কোনো কল্যাণ থাকে যেমন ইসলামের প্রতি তার হৃদয় আকৃষ্ট করা ইত্যাদি তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই।”(দেখুন: https://saadalkhathlan.com/fatwas/5322)
.
▪️দ্বিতীয় প্রকার: কাফেরদের জন্য দুনিয়াবী বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট দু’আ।অমুসলিম কাফের-মুশরিকদের জন্য দুনিয়াবি কল্যাণ বিষয়ে যেমন: অর্থ-সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি অথবা সুস্থতা কিংবা সৌভাগ্যের জন্য দু’আ করা। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মহান দু’আ হলো তার হেদায়াতের জন্য দু’আ করা জায়েজ আছে যদি সে ব্যক্তি মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয় বা ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র না করে। বিশেষ করে যদি তার উপকারে মুসলিমদের কোন কল্যাণ অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অথবা সে একান্ত নিকটাত্মীয় হয় যেমন: পিতা, সন্তান ইত্যাদি। কিন্তু যদি সে ব্যক্তি মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে বা দুশমনি করে বা তার সুস্থতায় মুসলিমদের ক্ষতি হবে বলে আশংকা থাকে তাহলে তার উদ্দেশ্যে দুনিয়াবি কল্যাণের জন্য দুআ করা বৈধ নয়।এ ক্ষেত্রে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেনلَّا يَنْهَاكُمُ اللَّـهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ কারীদেরকে ভালবাসেন।”(সূরা মুমতাহিনা: ৮) অমুসলিমদের জন্য ধন-সম্পদ, সন্তান, সুস্থতা কিংবা সৌভাগ্য কামনা করে দোয়া করা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ এবং এতে কোনো গোনাহ বা নিষেধ নেই। বিষয়টি একাধিক দিক থেকে প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য:
.
(১)- এমন দু’আর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়নি। আর নিষেধের পক্ষে কোনো দলীল না আসা পর্যন্ত জায়েয-ই মূল অবস্থা। এই মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহি কায়দা বা নীতি, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।
(২)- সুন্নাহতে বর্ণিত আছে, কোনো কাফের যদি কোনো মুসলিমকে স্পষ্ট শব্দে সালাম দেয়, তাহলে তার সালামের জবাব দেওয়া জায়েয। তার সালামের জবাব দেওয়া মূলত তার সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দু’আ করা। যেমন: প্রখ্যাত সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন:إِذَا سَلَّمَ عَلَيْكُمْ أَهْلُ الكتابِ فَقولُوا وَعَلَيْكُم “যখন তোমাদেরকে আহলে কিতাব (অর্থাৎ- ইয়াহূদী ও নাসারাগণ) সালাম দেয়, তখন তোমরাও (শুধু এতটুকু) বলবে ‘‘ওয়া আলায়কুম’’ (অর্থাৎ- তোমাদের ওপরও)।(সহীহ বুখারী হা/৬২৫৮, সহীহ মুসলিম হা/৫৫৪৫) অনুরূপভাবে সুন্নাহতে কাফেরের রুকইয়া করাও জায়েয বলা হয়েছে। আর রুকইয়া হল সুস্থতার জন্য দোয়া করা। যেমন সহীহ বুখারীতে প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস যেখানে কতিপয় সাহাবী এক অমুসলিম সরদারকে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়ফুঁক করেছিল।(সহিহ বুখারী হা/২১৫৬; ও সহিহ মুসলিম হা/২২০১)
.
(৩)- এতে করে কাফেরের মন জয় করার মত কল্যাণ অর্জিত হয়। শরীয়তের উদ্দেশ্যসমূহের মাঝে এটা হলো অন্যতম বিবেচ্য একটি মহৎ কল্যাণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক অসুস্থ ইহুদি গোলামকে দেখতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে ইসলাম গ্রহণ করে।যেমন:আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ইয়াহূদী যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করতেন। তাঁর মৃত্যুশয্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার মাথার পাশে বসে বললেন, হে অমুক! তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। যুবকটি তার পাশে থাকা পিতার দিকে তাকাল। পিতা তাকে বলল, আবুল ক্বাসিমের কথা মেনে নাও। যুবকটি ইসলাম গ্রহণ করল। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছ থেকে বের হয়ে এসে বললেন, আল্লাহর শুকরিয়া। তিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন।”(সহীহ বুখারীর হা/১৩৫৬) অপর বর্ননায় প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে উমর (রা.) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূল ﷺ) বলেছেন: ‘হে আল্লাহ্‌! এই দুই জন লোকের মধ্যে যে ব্যক্তি আপনার কাছে অধিক প্রিয় তার মাধ্যমে আপনি ইসলামকে শক্তিশালী করুন: আবু জেহেল কিংবা উমর বিন খাত্তাব।”(সুনানে তিরমিযি হা/৩৬৮১ ইমাম আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)।
.
(৪)- সালাফদের কারো কারো থেকে এমন দু’আ বর্ণিত হয়েছে। যেমন: উকবা ইবনে আমের আল-জুহানী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন যার বেশভূষা ছিল মুসলিমের মত। লোকটা তাকে সালাম দেয়। উকবা (রাঃ) সালামের উত্তর দিয়ে বলেন: “ওয়ালাইকা ওয়া-রাহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতুহু”। তখন উকবার গোলাম বলল: “সে খ্রিষ্টান।” তখন উকবা উঠে গিয়ে তার পিছু নেন এবং তাকে পাওয়ার পর বললেন: “আল্লাহর রহমত আর বরকত মুমিনদের উপর। তবে আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন এবং তোমার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিন।”(ইমাম বুখারী তার ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ বইয়ে; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৮০ হা/১১২২; হাদীসটি বর্ণনা করেন ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন ইরওয়া হা/১২৭৪)।অন্য বর্ণনায় এসেছে, জনৈক ইহূদী রাসূল (ﷺ)-এর নিকট দো‘আ চাইলে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার ধন-সম্পদ ও সন্তানাদিতে বরকত দিন এবং দেহে সুস্থতাও বয়সে প্রশস্ততা দান করুন।”(ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৫৮২৪; বর্ননাটিকে অনেকে দুর্বল বলেছেন) অপর বর্ননায় আবূ বুরদা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইয়াহুদীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে এই আশায় ইচ্ছাকৃতভাবেই হাঁচি দিতো যে, তিনি তাদের হাঁচির জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লা’ (আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন) বলবেন। কিন্তু তিনি বলতেনঃ ‘ইয়াহদিকুমুল্লাহু ওয়া ইউসলিহু বালাকুম।(আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত করুন এবং তোমাদের বিষয়গুলো সংশোধন করুন।)”।(আবু দাউদ হা/৫০৩৮; তিরমিজি হা/২৭৩৯)
.
প্রখ্যাত তাবি‘ঈ হাসান বিন ইয়াসার ওরফে হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:১১০ হি.] বলেন:إذا عزَّيتَ الذمي فقل : لا يصيبك إلا الخير “যিম্মীকে মৃত্যু শোকের সান্ত্বনা দিতে চাইলে বলবে, তোমার শুধু কল্যাণই হোক।” ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] তার ‘আহকামু আহলিয-যিম্মাহ’ বইয়ে উক্ত বর্ণনা আনার পর অনুরূপ আরো কিছু বর্ণনা উল্লেখ করেন।”(বিস্তারিত জানতে দেখুন; আহকামু আহলিয-যিম্মাহ; পৃষ্ঠা: ৪৩৮)
.
(৫)- ফকীহগন এ ধরনের দু’আ জায়েয বলেছেন। এর পক্ষে কিছু বক্তব্য নিম্নরূপ: হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম বুহূতী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘কাশ্‌শাফুল ক্বিনা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন:يجوز أن يقال له : أهلا وسهلا ، وكيف أصبحت ؟ ونحوه مثل : كيف حالك ؟ ويجوز أن يقول المسلم للذمي : أكرمك الله ، وهداك الله , يعني بالإسلام ، قال إبراهيم الحربي لأحمد : يقول له : ” أكرمك الله ” ؟ قال : نعم ، يعني بالإسلام “তাকে (কাফেরকে) বলা যাবে: আহলান ওয়া সাহলান (শুভেচ্ছা স্বাগতম), আপনার সকালটা কেমন?’ অনুরূপভাবে বলা যাবে: ‘কেমন আছেন?’ মুসলিমের জন্য যিম্মীকে ‘আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন, আপনাকে হেদায়াত দান করুন (অর্থাৎ ইসলামের মাধ্যমে) বলা বৈধ।’ ইব্রাহীম আল-হারবী ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করেন: ‘মুসলিম কি যিম্মীকে বলবে ‘আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন?’ ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ‘হ্যাঁ; অর্থাৎ ইসলামের মাধ্যমে’।”(সংক্ষেপে কাশ্শাফুল ক্বিনা’/,খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৩০)
.
শাফেয়ী মাযহাবের গ্রন্থ ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ টীকাতে এবং ‘তুহফাতুল মুহতাজ’ এর টীকায় এসেছে:
“কাফেরের শারীরিক সুস্থতা ও হেদায়াতের জন্য দু’আ করা জায়েয।”(নিহায়াতুল মুহতাজ’ খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৩৩; তুহফাতুল মুহতাজ’ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৮)
.
ইমাম মুনাওয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘ফাইযুল কাদীর’ বইয়ে বলেন:ويجوز الدعاء للكافر أيضا بنحو هداية ، وصحة ، وعافية ، لا بالمغفرة “কাফেরের জন্য হেদায়াত, সুস্থতা ও নিরাপত্তার দোয়া করা যাবে। তবে ক্ষমাপ্রাপ্তির দোয়া করা যাবে না।”(মুনাওয়ী; ফাইযুল কাদীর; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৫)
.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে: একজন মুসলিম কি খ্রিষ্টানকে বলতে পারবে: “আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন?” তিনি উত্তর দেন:نعم ، يقول : أكرمك الله ، يعني بالإسلام “হ্যাঁ। বলতে পারবে: আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন; অর্থাৎ ইসলামের মাধ্যমে।” ইবনু মুফলিহ আল-আদাব আশ-শরইয়্যাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৬৯)। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৪৯১৪)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী (হাফিজাহুল্লাহ)।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

মৃতকে মাটি দেওয়ার সময় কোন নির্দিষ্ট দো‘আ হাদীসে বর্ণিত হয়নি

 প্রশ্ন: মৃতকে মাটি দেওয়ার সময় “মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা” দু’আটি পড়ার বিধান কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর মৃতকে দাফন করার দায়িত্ব শরীয়তের দৃষ্টিতে পুরুষদের উপর ন্যস্ত। কবরের ভেতরে মাটি দেওয়ার সময় কোনো নির্দিষ্ট দো‘আ রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং সে সময় শুধু সাধারণ দো‘আ করা যাবে। আলেমদের একটি অংশের মতে, মৃতদেহ কবরস্থ করার পর সক্ষম ব্যাক্তিরা কবরের মাথার দিক থেকে দাঁড়িয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তিন মুঠো মাটি কবরের উপর ছড়িয়ে দেবেন।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু কুদামাহ; আল মুগনী; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৭২; বিন বায; মাজমূ‘ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১৯৯)।
.
আমাদের সমাজে মৃতকে কবরে শোয়ানোর সময় প্রথাগতভাবে সূরা ত্বাহা (২০: ৫৫)-এর আয়াত তিলাওয়াত করা হয়ে থাকে। এ আয়াত মৃতের কবরে মাটি দেওয়ার সময় পাঠ করা মুস্তাহাব বলে একদল আলেম মত প্রকাশ করেছেন।যেমন;শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,استحب بعض الفقهاء بعد الدفن أن يحثى على القبر ثلاث حثيات من تراب ، ويقال في الحثية الأولى :(منها خلقناكم) ، وفى الثانية (وفيها نعيدكم) ، وفى الثالثة (منها نخرجكم تارة أخرى)”কোনো কোনো ফকিহ বলেছেন, দাফনের পরে কবরে তিন মুঠ মাটি দেয়া মুস্তাহাব। প্রথম মুঠ দেয়ার সময় বলবে, مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ দ্বিতীয় মুঠ দেয়ার সময় বলবে, وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ আর তৃতীয় মুঠ দেয়ার সময় বলবে, وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى (ইমাম নববী আল মাজমু; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৯৩) এমনকি বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে দু’আটি পাঠ করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন:هذا سنة، ويقول معه: بسم الله والله أكبر এটি একটি সুন্নাত।পাশাপাশি “বিসমিল্লাহ” এবং “আল্লাহু আকবর”ও বলা যায়।(বিন বায; মাজমু‘ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ১৯৭)
.
তবে দলীল হিসেবে যে বর্ণনাটি পেশ করা হয়,সেটি সহীহ নয়।বর্ননাটি হলো—আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,لَمَّا وُضِعَتْ أُمُّ كُلْثُومٍ ابْنَةُ رَسُولِ اللهِ ﷺ فِي الْقَبْرِ ، قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ : ( مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ ، وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى )”রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা উম্মু কুলছূমকে যখন কবরে রাখা হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন, ‘মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা’। (মুসনাদে আহমাদ হা/২২১৮৭)
.
তাহক্বীক্ব: উক্ত বর্ণনা যঈফ কিংবা জাল। কারন এর সনদে আলী ইবনু যায়েদ ইবনু জুদ‘আন ও উবায়দুল্লাহ বিন যাহর নামে দুইজন পরিত্যক্ত রাবী আছে। বর্ননাটিকে; ইবনু হাজার আসকালানী; ইমাম নববী; ইবনু মুলক্বিন; বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী; ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ অনেকেই এটি অত্যন্ত দূর্বল বলেছেন।(তালখীস পৃষ্ঠা: ১০২; ইমাম আলবানী; আহকামুল জানায়েয; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৫৩; টীকা দ্র:; মাসআলা নং-১০৬; দ্রষ্টব্য)।
.
হাদীসটির সমস্যার বিষয়টি নিয়ে আলেমগণ আলোচনা করেছেন এবং তিনটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করেছেন।
প্রথমত: যে বিশদ বর্ণনা প্রশ্নে উল্লিখিত হাদীসে পাওয়া গেছে, তা সুন্নাহতে প্রতিপাদ্য হিসেবে বিদ্যমান নয়। ফলে এর মাধ্যমে কোনো শরীয়তসম্মত দলীল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়এমনকি যদি এর সনদ সহীহও হয়।”
.
দ্বিতীয়ত: এ ধরনের বিশদ বিবরণকে ফযায়েলে আমল হিসেবেও গ্রহণযোগ্য করা যায় না। কেননা দুর্বল হাদীস দ্বারা আমল করা মানে হলো কোনো একটি কাজকে শরীয়ত প্রমাণিত ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। অথচ শরীয়তের স্বীকৃতির সর্বনিম্ন স্তরও হলো “মুস্তাহাব” বা “সুন্নত” যা শরীয়তের পাঁচটি হুকুমের একটি এবং তা কেবল সহীহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস কোনো কাজে আসে না এ বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে সর্বসম্মতি রয়েছে।
.
তৃতীয়ত: আলোচ্য হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল, বরং ইবনু হিব্বান এটিকে “মাওদূ” (মনগড়া) আখ্যা দিয়েছেন। এর কারণ হলো, এটি এসেছে মুসনাদে আহমাদ (৫/২৫৪)-এ উবাইদুল্লাহ ইবনু যুহরের মাধ্যমে, আলী ইবনু ইয়াজিদের থেকে। আর এ আলী ইবনু ইয়াজিদ হচ্ছেন “ইলহানী”। ইমাম নববীর বর্ণনায় যাকে “আলী ইবনু যায়দ ইবনু জুদ‘আন” বলা হয়েছে, তা ভুল; কেননা মুসনাদে আহমাদ এর বর্ণনার সাথে তার মিল নেই। ইবনু হিব্বান বলেছেন: উবাইদুল্লাহ ইবনু যুহর, তিনি শক্তিশালী রাবিদের থেকেও মাওদূ হাদীস বর্ণনা করেন। আর যখন তিনি আলী ইবনু ইয়াজিদ থেকে বর্ণনা করেন তখন আজগুবি কথা নিয়ে আসেন। আর যখন কোনো সনদে উবাইদুল্লাহ, আলী ইবনু ইয়াজিদ এবং কাসিম আবু ‘আবদুর রহমান একসাথে হয়—তখন সেই হাদীস নিঃসন্দেহে তাদের বানানো জাল হাদীস হয়। ইবনু হাজার, তাবিয়ীনুল ‘আজব ফীমা ওয়ারাদা ফী ফাজলি রজব।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,وأما استحباب بعض المتأخرين من الفقهاء أن يقول في الحثية الأولى (منها خلقناكم) ، وفي الثانية (وفيها نعيدكم) ، وفي الثالثة (ومنها نخرجكم تارة أخرى) : فلا أصل له “কিছু পরবর্তী যুগের ফকীহগণ প্রস্তাব করেছেন যে প্রথম মুঠো মাটি নিক্ষেপের সময় বলা হবে: ‘منها خلقناكم’ (আমি তোমাদের এখান থেকেই সৃষ্টি করেছি),দ্বিতীয় মুঠো নিক্ষেপের সময় বলা হবে: ‘وفيها نعيدكم’ (আমি তোমাদের এর মধ্যেই ফিরিয়ে দেব),তৃতীয় মুঠো নিক্ষেপের সময় বলা হবে: ‘ومنها نخرجكم تارة أخرى’ (এবং আমি তোমাদের এখান থেকেই আবার একবার বের করব) তবে এ বিষয়ে শরীয়তে কোনো সঠিক দলিলভিত্তিক প্রমাণ নেই।”(ইমাম আলবানী; আহকামুল জানায়িয; পৃষ্ঠা: ১৫৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] প্রশ্ন করা হয়েছিল: “মৃতকে মাটিতে দাফনের সময় “মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা” পাঠ করা বৈধ?
তিনি জবাব দিলেন:ذكر بعض أهل العلم أنه يسن أن يحثي ثلاث حثيات .وأما قول “منها خلقناكم ، وفيها نعيدكم ، ومنها نخرجكم تارة أخرى ” : فليس فيه حديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتمد عليه “
কিছু আলেম বলেন, মৃতদেহের উপর তিনবার মাটি দেওয়া সুন্নাহ। কিন্তু “মিনহা খলাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা।” এই বাণীটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো স্বীকৃত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।”(ইবনে উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ১৮৫)।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটি স্পষ্ট হয় যে, কবরে মৃতকে দাফনের সময় কোন নির্দিষ্ট দো‘আ হাদীসে বর্ণিত হয়নি। তাই, মৃত ব্যক্তিকে কবরে শোয়ানোর সময় প্রার্থনা হিসাবে বলা যেতে পারে: “বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রসুলিল্লাহ।” অথবা “বিসমিল্লাহি ওয়া আলা সুন্নাতি রসুলিল্লাহ।” আর মৃতের কবরে মাটি দেওয়ার সময় সাধারণভাবে শুধুমাত্র “বিসমিল্লাহ” উচ্চারণ করাটাই যথেষ্ট।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

শহীদ কত প্রকার এবং যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি কি শহীদ

 প্রশ্ন: শহীদ কত প্রকার? যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি কি শহীদ? হাদীসে পেটের পীড়া দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর:
.
প্রথমত: মূলনীতি হচ্ছে, সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ’র দলিল অথবা উম্মাহ’র সর্ববাদিসম্মত মত ব্যতীত নির্দিষ্টভাবে কাউকে ‘শহিদ’ বলা বৈধ নয়। তবে যার বাহ্যিক অবস্থা ভালো, আমরা আল্লাহর কাছে তার ‘শহিদ’ হওয়ার আশা রাখব, এই আশা রাখাটাই তার মর্যাদা ও সম্মান হিসেবে যথেষ্ট। আর এ ব্যাপারে প্রকৃত জ্ঞান তার মহামহিমান্বিত স্রষ্টার নিকট রয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে সরাসরি ‘শহিদ’ বলব না, আবার তার ব্যাপারে কুধারণাও করব না। আশা রাখার ব্যাপারটি হলো উক্ত দুই অবস্থার মধ্যবর্তী পর্যায়। কিন্তু আমরা দুনিয়ায় তার ওপর শহিদের বিধিবিধান প্রয়োগ করব। সে যদি আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদ করতে গিয়ে নিহত হয়, তাহলে তাকে জানাযাহ’র নামাজ ছাড়াই তার রক্তমাখা কাপড়ে দাফন করতে হবে। আর সে যদি অন্যান্য শহিদদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তাকে গোসল করাতে হবে, কাফনের কাপড় পরাতে হবে এবং তার জনাযাহ’র নামাজ পড়তে হবে। কেননা আমরা যদি কাউকে নির্দিষ্টভাবে ‘শহিদ’ বলি, তাহলে এই সার্টিফিকেট দেওয়ার মাধ্যমে তাকে ‘বেহেশতবাসী’ বলে সার্টিফিকেট দেওয়া আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অথচ এটি আহলুস সুন্নাহ’র মানহাজ পরিপন্থি। কেননা নাবী ﷺ যে কাজের কাজিকে অথবা নির্দিষ্টভাবে যাদেরকে ‘বেহেশতবাসী’ বলেছেন, তাদেরকে ছাড়া আহলুস সুন্নাহ’র লোকেরা অন্য কাউকে জান্নাতের সার্টিফিকেট দেয় না।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু ‘উসাইমীন; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৫-১১৭)
.
দ্বিতীয়ত: ইসলামে শহীদ তিন প্রকার:
.
প্রথমত: যুদ্ধের কারণে কাফিরের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত ব্যক্তি। এই শ্রেণীর শহীদ আখিরাতের সাওয়াবে ও দুনিয়ার বিধানে তথা তাকে গোসল না দেয়া ও তার জন্য সালাতুল জানাযা আদায় না করা উভয় ক্ষেত্রে শহীদ হিসেবে গণ্য।
দ্বিতীয়ত: এই শ্রেণীর শহীদ আখিরাতে শাহাদাতের ফযীলত বা সাওয়াবপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু দুনিয়াতে শাহীদের বিধান প্রযোজ্য হবে না। যেমন : পেটের পীড়ায় নিহত ব্যক্তি, মহামারিতে নিহত, দেয়াল চাপা পড়ে নিহত; নিজের সম্পদ হিফাযাত করতে গিয়ে নিহত ব্যক্তি যাদেরকে সহীহ হাদীস শহীদ বলে অভিহিত করেছে। এই শ্রেণীর শহীদকে গোসল দিতে হবে ও জানাযা আদায় করাতে হবে। তবে এই শহীদগণ প্রথম শ্রেণীর শহীদদের সাওয়াব লাভ করবে না।
তৃতীয়ত: যে ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গানীমাতের জন্য কাফিরদের সাথে যুদ্ধে নিহত হয়। এই ধরনের ব্যক্তিকে হাদীসে শহীদ নামে অ্যাখ্যা দিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই শ্রেণীর শাহীদের ও পর দুনিয়াতে শাহাদাতের বিধান প্রযোজ্য। সুতরাং তাকে গোসল দেয়া হয় না এবং সালাতুল জানাযা আদায় করা হয় না। আর তার জন্য আখিরাতে পূর্ণ সাওয়াব হবে না। আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞাত। (শারহে মুসলিম ২য় খন্ড; হা: ২২৫; মিশকাত হা/৩৫১৩)
.
যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করে হাদিসে তাকে শহীহ বলা হয়েছে। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করবে সে শহিদ।”(সহিহ মুসলিম হা/১৯১৫) অপর বর্ননায় উবাদাহ ইবনু সামিত (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,مَا تَعُدُّوْنَ الشَّهِيْدَ فِيْكُمْ قَالُوا الَّذِىْ يُقَاتِلُ فَيُقْتَلُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ تَعَالَى فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ شُهَدَاءَ أُمَّتِىْ إِذًا لَقَلِيْلٌ الْقَتِيْلُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى شَهِيْدٌ وَالْمَطْعُوْنُ شَهِيْدٌ وَالْمَبْطُوْنُ شَهِيْدٌ وَالْمَرْأَةُ تَمُوْتُ بِجُمْعٍ شَهِيْدٌ”তোমরা তোমাদের মধ্যে কাদেরকে শহীদ হিসাবে গণ্য করবে? ছাহাবীগণ বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে নিহত হয় সেই শহীদ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে তো আমার উম্মতের মধ্যে শহীদের সংখ্যা কম হয়ে যাবে। (আরো শহীদ আছে, তারা হল) আল্লাহ ত্বাবারাকা ওয়া তা‘আলার রাস্তায় নিহত ব্যক্তি শহীদ, প্লেগ রোগে নিহত ব্যক্তি শহীদ, পেটের পিড়ায় নিহত ব্যক্তি শহীদ ও প্রসব বেদনায় নিহত মহিলা শহীদ’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৭৭২; ইবনু মাজাহ, হা/২৮০৪, সনদ সহীহ) আরেক হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরও বলেছেন;“পাঁচ ধরনের মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে গণ্য। প্লেগ রোগে মৃত্যু, পেটের পীড়ায় মৃত্যু, পানি ডুবে মৃত্যু, কোন কিছু ধ্বসে পড়ে মৃত্যু এবং আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়া।” (সহিহ বুখারি হা/২৮২৯; ও সহিহ মুসলিম হা/১৯১৫) তিনি আরো বলেন, সে ব্যক্তি কবরের ফিৎনা থেকে রক্ষা পাবে যার পেট তাকে হত্যা করেছে।(তিরমিযী হা/১০৬৪; মিশকাত হা/১৫৭৩;সহীহুত তারগীব হা/১৪১০)। উক্ত হাদীসগুলির ভিত্তিতে আলেমগন ইজতিহাদ করে বলেছেন যে, উপরোক্ত কঠিন রোগ সমূহে মারা যাওয়া ব্যক্তিরা আখেরাতে শহীদের মর্যাদা পাবে।(ফাৎহুল বারী; পৃষ্ঠা: ৬; পৃষ্ঠা: ৬৬; নববী; শারহু মুসলিম; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৬৩; শানক্বীতী; যাদুল মুস্তাকনি খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৩৪)।
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] উল্লেখ করেছেন: শাস্ত্রবিদদের মতে, আল্লাহর রহমতে এমন মৃত্যুকে শুধুমাত্র শাহাদাতের শ্রেণিতে ধরা হয়, কারণ এ ধরনের মৃত্যু অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও বেদনাদায়ক। তারা বলেন, যারা আল্লাহর পথে জিহাদের ময়দানে নিহত হয়েছেন তাদের ব্যতীত, বাকি সকলের ক্ষেত্রেই ‘শাহাদাত’ বলতে বোঝানো হয় যে আখেরাতে তাদের জন্য শহীদদের সমান প্রতিদান নির্ধারিত হয়েছে। তবে এদের জন্য পৃথিবীতে গোসল করানো এবং জানাজার নামাজ আদায় করা আবশ্যক।”(নববী শারহু সহীহ মুসলিম খণ্ড; ১৩: পৃষ্ঠা: ৬৩; ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-২৬৬৯৮৭)
.
হাদিসে পেটের পীড়া দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? এই মাসালায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
” وَأَمَّا ( الْمَبْطُون ) فَهُوَ صَاحِب دَاء الْبَطْن , وَهُوَ الإِسْهَال . قَالَ الْقَاضِي : وَقِيلَ : هُوَ الَّذِي بِهِ الاسْتِسْقَاء وَانْتِفَاخ الْبَطْن , وَقِيلَ : هُوَ الَّذِي تَشْتَكِي بَطْنه , وَقِيلَ : هُوَ الَّذِي يَمُوت بِدَاءِ بَطْنه مُطْلَقًا
আল-মাবতূন (المبطون) হলেন তিনি, যিনি পেটের রোগে আক্রান্ত। আর এর দ্বারা মূলত ডায়রিয়া (আলসার) বোঝানো হয়। কাদী ইয়া‌য বলেছেন: বলা হয়েছে—তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যার দেহে জলবসন্ত/অতিরিক্ত পানি জমে (Ascites) পেট ফুলে গেছে। আবার কেউ বলেছেন—তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি পেটব্যথায় ভোগেন।আরও বলা হয়েছে—যে কেউ পেটের যেকোনো রোগে মারা যান, তাকেই ‘আল-মাবতূন’ বলা হয়।”
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:“ হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি পেটের রোগে মারা যায় সে শহীদ। পেটের রোগে মারা যাওয়া বলতে কী বোঝায়? এটি কি লিভার সিরোসিসে মারা যাওয়া ব্যক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করে?
জবাবে তিনি বলেন:
“المبطون قال أهل العلم : من مات بداء البطن ،والظاهر أن من جنسه من مات بالزائدة لأنها من أدواء البطن التي تميت ، ولعل من ذلك أيضاً من مات بتليف الكبد لأنها داء في البطن مميت
আল-মাবতূন সম্পর্কে আলেমগণ বলেছেন—তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পেটের রোগে মারা যান। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, পেটের এমন রোগও এর অন্তর্ভুক্ত, যেমন এপেন্ডিসাইটিস (الزائدة – অ্যাপেন্ডিক্সের প্রদাহ); কারণ এগুলোও পেটের রোগ যা মৃত্যু ঘটাতে পারে। এর অন্তর্ভুক্ত হবেন সেই ব্যক্তিও, যিনি লিভার সিরোসিসে মারা গেছেন; কারণ সেটিও পেটের এমন একটি রোগ, যা মৃত্যুর কারণ হয়।”(ইবনু উসাইমীন, মাজাল্লাতুদ দাঈয়াহ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯২৮২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে মানব রচিত আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়ার বিধান

 প্রশ্ন: শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে মানব রচিত (তাগুতী) আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়ার বিধান কী?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি। অতঃপর  মূলনীতি হচ্ছে শরীয়াহর বিরোধী মানব প্রণীত আইন অনুযায়ী আদালতে বিচার চাওয়া জায়েজ নয়। একইভাবে, সেখানে কাজ করা কিংবা মানুষের মাঝে সে আইন কার্যকর করাও বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অতএব, (হে মুহাম্মদ ﷺ) আপনি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী বিচার নিষ্পত্তি করুন ও তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক হোন, যাতে আল্লাহ্ আপনার প্রতি যা নাযিল করেছেন তারা এর কোন কিছু হতে আপনাকে বিচ্যুত না করে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তাদেরকে কেবল তাদের কোন কোন পাপের জন্য শাস্তি দিতে চান। আর নিশ্চয় মানুষের মধ্যে অনেকেই তো ফাসেক।তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে?আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?”(সূরা মায়েদাহ: ৪৯-৫০) অপর আয়াতে আরও বলেন:”হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা ঈমান এনেছে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে আপনি আপনার কাছ থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবেন।”(সূরা নিসা: ৫৯-৬১) এমনকি আল্লাহ তাআলা শপথ করে বলেন কিন্তু না, আপনার রবের শপথ তারা মুমিন হবে না যতক্ষন পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।”(সূরা নিসা: ৬৫) আল-কুরআনে বহু আয়াত আছে, যেখানে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন যে মানুষ শুধুমাত্র তাঁর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার এবং ফয়সালা করবে। একই সঙ্গে তিনি স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন যে কেউ মানবসৃষ্ট আইনকে বিচার ও ফয়সালার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে।
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন,من أعظم ذلك وأظهرها معاندة للشرع ، ومكابرة لأحكامه ، ومشاقة لله ولرسوله : إيجاد المحاكم الوضعية التي مراجعها القانون الوضعي ، كالقانون الفرنسي ، أو الأمريكي ، أو البريطاني ، أو غيرها من مذاهب الكفار ، وأي كفر فوق هذا الكفر ؟! وأي مناقضة للشهادة بأن محمَّداً رسول الله بعد هذه المناقضة ؟! “সবচেয়ে বড় (গুনাহের) বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম এবং শরীয়তের সাথে সবচেয়ে প্রকাশ্য বিরোধিতা ও তার বিধানকে অস্বীকার করা, এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে সরাসরি বিরোধিতা করার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো: এই সব আদালত প্রতিষ্ঠা করা যেগুলো মানুষের বানানো আইনের দিকে রেফার করে, যেমন ফরাসি আইন, বা আমেরিকান আইন, বা ব্রিটিশ আইন, অথবা কাফিরদের অন্য কোনো মতবাদ। এর চাইতেও বড় কুফরি আর কী হতে পারে?! এবং এর চাইতে বড় ‘মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্যকে অস্বীকার করা আর কী হতে পারে?”।(তাহকীমুল কাওয়ানীন; পৃষ্ঠা: ৭)
.
প্রিয় পাঠক! ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে মানব রচিত (তাগুতি) আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়া জায়েজ নয়, তবে বাস্তব জীবনে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি উদ্ভূত হতে পারে, যখন একজন মুসলিমকে অন্যায়, জুলুম বা ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, অথবা তার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে মানব-নিয়ন্ত্রিত আইনের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হতে হয়।উদাহরণস্বরূপ একজন মুসলিম ব্যবসায়ী কোনো অমুসলিম ব্যবসায়ীর সাথে অমুসলিম লোকটির দেশে লেনদেন করেছে, কিন্তু পরবর্তীতে সেই অমুসলিম বণিক তার পাওনা অস্বীকার করে বসে, এখন সেই মুসলিম কাফির রাষ্ট্রের কোর্টে বিচারপ্রার্থী না হয়ে নিজের সম্পদ উদ্ধার করতে পারছেন না। তদ্রুপ কোনো মুসলিম নারী কাফিরদের দেশে আছেন, তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করেছে, তালাক না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে, এবং ভালো মানুষজন তাকে বুঝানোর পরেও সে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে অস্বীকার করছে তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। এমতাবস্থায় জরুরি প্রয়োজনে সেই নারী কি এমন কারও কাছে বিচার চাইতে পারবেন, যে আল্লাহর আইনপরিপন্থি মানবরচিত আইন দিয়ে বিচার-ফয়সালা করে দেবে? এ বিষয়ে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।তবে অধিকাংশ আলিমের মতে, কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে জরুরি প্রয়োজনে শরিয়াপরিপন্থি আদালতের দ্বারস্থ হওয়া বৈধ। শর্তগুলো হলো:
.
প্রথম শর্ত: উক্ত আদালতে বিচার না চাওয়ার কারণে যে ক্ষতি হবে, তা অবশ্যই সুনিশ্চিত ও বাস্তব বিষয় হতে হবে; কেবল অনুমাননির্ভর বা কল্পনাপ্রসূত (অর্থহীন ভীতি) হলে গ্রহণযোগ্য হবে না।
.
দ্বিতীয় শর্ত: যে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা অবশ্যই গুরুতর ও অসহনীয় মাত্রার হতে হবে। অর্থাৎ এমন ধরনের ক্ষতি নয়, যা সাধারণত মানুষ সহজেই সহ্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ কেবল কয়েক হাজার টাকা নিয়ে সামান্য বিরোধ বা ঝগড়া, যা একজন ব্যবসায়ীর জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় (এমন কারণে তাগুতের আদালতে বিচার প্রার্থনা করা যাবে না)। বরং ক্ষতি বা সমস্যা এতটাই গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় সহ্য করা সম্ভব নয়।
.
তৃতীয় শর্ত: ওই ক্ষতি বা সমস্যা দূর করার জন্য অন্য কোনো শরিয়তসম্মত উপায় অবলম্বন করা সম্ভব না হলে, তখন ওই আদালতে বিচার চাওয়া জায়েজ হবে।
.
চতুর্থ শর্ত: বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি কখনো নিজের শরয়ি হক বা অধিকার অতিক্রম করতে পারবে না। কারণ সেক্যুলার আদালত অনেক সময় অন্যায় রায় দেয়।যদি কেউ এমন রায়ের ভিত্তিতে তার প্রকৃত প্রাপ্যের চেয়ে বেশি কিছু গ্রহণ করে, তবে তা শারীরিকভাবে জায়েজ হবে না। উদাহরণস্বরূপ,একজন ব্যক্তি যদি প্রকৃতপক্ষে এক লাখ টাকার পাওনাদার হয়, আর আদালত তাকে দশ লাখ টাকার রায় দেয়; তাহলে তার জন্য এক লাখের চেয়ে বেশি টাকা নেওয়া জায়েজ হবে না।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: তালাক, ব্যবসা এবং অন্যান্য বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে আমেরিকান আইনের কাছে বিচারের জন্য আবেদন করার বিধান কী?
তারা উত্তর দিলেন:
لا يجوز للمسلم التحاكم إلى المحاكم الوضعية إلا عند الضرورة إذا لم توجد محاكم شرعية ، وإذا قضي له بغير حق له فلا يحل له أخذه “
“মুসলিমদের জন্য মানুষের বানানো আইন-আদালতে বিচার চাওয়া বৈধ নয়; তবে জরুরি অবস্থায় যদি শরিয়ত-ভিত্তিক আদালত না থাকে, তখন (কোনো বিকল্প না থাকলে) সেখানে যাওয়া যেতে পারে। তবে যদি তার পক্ষে এমন কোনো রায় আসে যা প্রকৃতপক্ষে তার (হক) অধিকার নয়, তবে তা তার জন্য নেওয়া হালাল নয়।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২৩; পৃষ্ঠা: ৫০২)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: একজন মুসলিম যদি মানবসৃষ্ট আইন অধ্যয়ন করে, তারপর কোনো আইনি অফিস পরিচালনা করেন এবং কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়ানি আদালতে মামলা পরিচালনা করেন, তাহলে তার কাজের শার‘ই হুকুম কী? এছাড়াও, তিনি যে অর্থ উপার্জন করেন, তার বিধান কী?
তিনি উত্তর দিলেন:
وضع القوانين المخالفة للشرع مكان الشرع كفر؛ لأنه رفع للشرع ووضع للطاغوت بدله، وهذا يدخل في قوله عز وجل: (وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) المائدة/44 . ….وأما تعلم الإنسان للقوانين الوضعية، إذا كان يتعلمها من أجل أن يدفع الباطل بالحق ؛ فهذا لا بأس به ، وإذا كان يتعلمها من أجل أن يتبع ما فيها من القوانين المخالفة للشرع ؛ فهذا حرام. وفي هذا نقول : حتى المحاماة في بلد تحكم الشريعة فيه نقول: إذا كان المحامي يريد إيصال الحق إلى أهله ؛ فلا بأس أن يمارس هذه المهنة ، وإن كان يريد أن يغلب الناس في قوله ومحاماته بالحق أو بالباطل ؛ فهذا حرام
“মানুষের প্রণীত আইনকে শরিয়তের জায়গায় স্থাপন করা কুফরি; কারণ এর মাধ্যমে শরিয়তকে বাতিল করা হয় এবং তার স্থলে তাগুত (অশরিয়তি শাসনব্যবস্থা ও ভ্রান্ত আইন) প্রতিষ্ঠিত করা হয়।আর এটি আল্লাহ তাআলার এই বাণীর অন্তর্ভুক্ত:“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই কাফির।” (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫: ৪৪) তবে মানুষের বানানো আইন অধ্যয়ন করা যদি হয় মিথ্যা ও অন্যায়কে সত্য ও ন্যায়ের মাধ্যমে খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে, তবে এতে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি উদ্দেশ্য হয় শরিয়তের বিরোধী আইনসমূহকে গ্রহণ বা অনুসরণ করা, তবে তা হারাম। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য আমরা বলি: এমনকি যদি কোনো দেশে শরিয়তের বিধান দ্বারা শাসন পরিচালিত হয়, তবুও আইনজীবী হওয়ার ব্যাপারে বিধান হলো যদি আইনজীবীর উদ্দেশ্য হয় অধিকার তার প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তবে এই পেশা অনুশীলনে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য হয় কেবল বিতর্কে জয়লাভ করা,বা নিজের যুক্তি ও আইনজীবিত্ব দিয়ে মানুষের হক নষ্ট করা, তা সে হক বা বাতিল যেভাবেই হোক না কেন তবে তা হারাম।”(ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৩৩/৬)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! আমরা আমাদের সন্মানিত শাইখ বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] এর সুন্দর একটি নসীহা দ্বারা আলোচনার সমাপ্তি টানছি। শাইখুল ইসলাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
لا تجد أعدل من دين الله – عز وجل – في كل زمان ومكان، وكل ما خالف دين الله – عز وجل – فهو جور وظلم، ولهذا أخبر النبي عليه الصلاة والسلام أن أظلم الظلم أن تجعل لله ندًّا وهو خلقك. ثم سئل: أي الظلم أعظم؟ قال: «أن تجعل لله ندًّا وهو خلقك» فلو مشى الناس على شريعة الله لقاموا بالقسط، لكن كل من لم يتمش على شريعة الله فهو جائر، قال الله تعالى: {وعلى الله قصد السبيل ومنها جآئر} يعني من السبيل ما هو جائر وهو سبيل الظالمين
“তুমি প্রত্যেক যুগে ও স্থানে আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল্লার দ্বীনের চেয়ে অধিক ন্যায়পরায়ণ আর কিছু পাবে না। আর যা কিছুই আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল্লার দ্বীনের পরিপন্থী, তা-ই অত্যাচার ও যুলুম। এ কারণেই নবীজি (ﷺ) জানিয়েছেন যে, সবচেয়ে বড় যুলুম হলো আল্লাহর জন্য শরীক নির্ধারণ করা, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন যুলুম সবচেয়ে বড়? তিনি বলেন,“তুমি আল্লাহর জন্য শরীক নির্ধারণ করবে, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।”[বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুত তাফসীর, বাব: আল্লাহ তা‘আলার বাণী হাদীস নং ৪৪৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল ঈমান, বাব: শির্ক সবচেয়ে নিকৃষ্ট গুনাহ এবং এর পরে সবচেয়ে বড় গুনাহসমূহের বিবরণ, হাদীস নং ৮৬] সুতরাং মানুষ যদি আল্লাহর শারী‘আতের ওপর চলত, তবে তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করত। কিন্তু যে-ই আল্লাহর শারী‘আতের ওপর চলে না, সে-ই অত্যাচারী। (কুর‘আনুল কারীম: সূরাহ্ (১৬) আন-নাহল, আয়াত নং ৯।) অর্থাৎ,পথের মধ্যে কিছু আছে যা বক্র, আর তা হলো যালিমদের পথ।”(তাফসীরুল কুরআনিল কারীম: সূরাহ আল-হাদীদ, পৃষ্ঠা নং ৪২৩।) মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক ভাবে কুরআন সুন্নাহের অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

যিহার সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: যিহারের পরিচয় কি? কোন ধরনের কথা বা কাজের মাধ্যমে যিহার সংঘটিত হয়? ইসলামে যিহারের শারঈ হুকুম এবং এর কাফফারা কীভাবে আদায় করতে হয়?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂◉❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর জাহেলি যুগে প্রচলিত বহু কুসংস্কার ও প্রথা পরবর্তীতে মুসলিম সমাজেও প্রবেশ করেছিল। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো যিহার। জাহেলী যুগে আরবদের কাছে “যিহার” তালাক বা তার চেয়ে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা বলে মনে করা হত। কারণ তাদের দৃষ্টিতে এর অর্থ ছিল এই যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্কই শুধু ছিন্ন করছে না বরং তাকে নিজের মায়ের মত হারাম করে নিচ্ছে। এ কারণে আরবদের মতে তালাক দেয়ার পর তা প্রত্যাহার করা যেত। কিন্তু যিহার প্রত্যাহার করার কোন সম্ভাবনাই অবশিষ্ট থাকত না।ইসলামি ফিকহে যিহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; কারণ এর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের হালাল-হারামের মতো গুরুতর বিধান জড়িয়ে রয়েছে। একই সঙ্গে জাহেলি যুগ থেকে প্রচলিত এর অপব্যবহার সম্পর্কে ইসলামের সঠিক নির্দেশনা জানা মুসলিমদের জন্য অপরিহার্য।তাই আমরা এই মাসালা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
.
যিহারের সাধারণ সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আহালুল আলেমগন বলেন, تشبيه الزوج زوجته في الحرمة بمحرمه“স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনও মাহরাম নারীর সাথে সাদৃশ্য দেওয়াকে যিহার বলা হয়।”অথবা تشبيه المنكوحة بمن تحرم عليه “বিবাহিত স্ত্রীকে এমন মহিলার সাথে সাদৃশ্য দেওয়া যে তার জন্য হারাম।”(ইমাম মুহাম্মদ মুখতার শানকিতি;শারহু যাদিল মুস্তাকনি। শাইখ উক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন মাজহাবের আলোকে যিহারের আরও একাধিক সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন] উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো পুরুষ হারাম করার নিয়তে তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন “তুমি আমার জন্য হারাম, যেমন আমার মা আমার জন্য হারাম” অথবা “যেমন আমার বোন আমার জন্য হারাম” এরকম কোনো বাক্য উচ্চারণ করলে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হয়। যিহারের বিভিন্ন রূপ রয়েছে, এবং এর সংজ্ঞা ও শর্তসমূহ ফিকহের গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যিহার প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ“তোমাদের মধ্যের যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ (মায়ের মত হারাম বলে ঘোষণা করে) করে- তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মা তো কেবল তারাই, যারা তাদেরকে জন্মদান করেছে। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয় আল্লাহ মার্জনা কারী, ক্ষমাশীল।”(সূরা মুজাদিলা: ২) সাধারণভাবে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য বা বিরোধের সময় স্বামী রাগের বশে যিহার প্রকাশ করেন। উদাহরণস্বরূপ,ভিবিন্ন তাফসির গন্থে বর্ণিত হয়েছে যে খাওলা বিনত সালাবা ও তার বৃদ্ধ স্বামী আউস ইবনুস সামিত (রা.) এর মধ্যে মনোমালিন্য হলে আউস রা. ক্রোধান্বিত হয়ে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: «أنتِ عليَّ كظهرِ أُمِّي “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত।” অর্থাৎ যেভাবে আমার মা আমার ওপর হারাম, তেমনি তুমি আমার জন্য হারাম। জাহেলি যুগে কেউ যদি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইতো, সে প্রায়শই এই ধরনের কথা বলত।যাহোক, এই ঘটনা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন তিনি তাদের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। এরপর সূরা মুযাদালা-তে যিহার সম্পর্কিত আয়াতসমূহ নাজিল হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আউস রা. কে যিহারের কাফফারা প্রদান করতে সহায়তা করেছিলেন। (সংক্ষেপিত: তাফসির ইবনে কাসির সূরা মুজাদিলা: ২ নং আয়াতের তাফসির]
.
▪️কোন ধরনের কথা বা কাজের মাধ্যমে যিহার সংঘটিত হয়?
.
যিহার সংঘটিত হওয়ার জন্য স্বামী প্রায়শই কিছু নির্দিষ্ট বাক্য ব্যবহার করেন। যেমন: “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের সমতুল্য।” যেমন আমার বোন আমার জন্য হারাম, তেমনি তুমি আমার জন্য হারাম।” তোমার এক চতুর্থাংশ আমার জন্য আমার ধাত্রীমায়ের মতো হারাম।” যদিও এই ধরনের উক্তি সাধারণত যিহারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তবে এগুলো সরাসরি যিহারের স্পষ্ট শব্দ নয়। বরং এগুলো বলার মাধ্যমে যিহারের সম্ভাবনা থাকতে পারে, আবার অন্য কোনো অর্থ বোঝানোর সম্ভাবনাও থাকে।কারন এই উক্তিগুলোর মাধ্যমে যিহার সংগঠিত হবে কিনা তার শারঈ বিধান নির্ভর করে স্বামীর উদ্দেশ্য, নিয়ত এবং যে পরিস্থিতিতে কথা বলা হয়েছে, সেই প্রসঙ্গ-প্রমাণের ওপর। যেমন:
.
নিয়তের দিক থেকে: যদি স্বামী এ কথার দ্বারা এটাই বোঝাতে চায় যে স্ত্রী তার কাছে মায়ের মতো হারাম হয়ে গেছে, তাহলে তা যিহার হবে। আর যদি তার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রীকে মায়ের মতো সম্মান করা, ভালোবাসা, বা মর্যাদা দেওয়া,তাহলে তা যিহার হবে না, এবং এর জন্য কিছুই প্রযোজ্য হবে না।
প্রসঙ্গ-প্রমাণের দিক থেকে: কথার পরিস্থিতি বা ঘটনাপ্রবাহ কখনো প্রমাণ করে যে স্বামী আসলে যিহার উদ্দেশ্যেই বলেছে। যেমন যদি স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার সময় তাকে বলে: “তুমি আমার কাছে মায়ের মতো।” তাহলে কথার এই প্রেক্ষাপটে পরিষ্কার বোঝা যায়, সে যিহারের অর্থেই বলেছে। ফলে এটি যিহার গণ্য হবে।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলল:তুমি আমার কাছে আমার মা ও বোনের মতো।
তিনি উত্তরে বলেন:إنْ كَانَ مَقْصُودُهُ أَنْتِ عَلَيَّ مِثْلُ أُمِّي وَأُخْتِي فِي الْكَرَامَةِ فَلا شَيْءَ عَلَيْهِ . وَإِنْ كَانَ مَقْصُودُهُ يُشَبِّهُهَا بِأُمِّهِ وَأُخْتِهِ فِي ” بَابِ النِّكَاحِ ” فَهَذَا ظِهَارٌ عَلَيْهِ مَا عَلَى الْمُظَاهِرِ فَإِذَا أَمْسَكَهَا فَلا يَقْرَبُهَا حَتَّى يُكَفِّرَ كَفَّارَةَ ظِهَارٍ”যদি তার উদ্দেশ্য হয় ‘তুমি আমার কাছে আমার মা ও বোনের মতো সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে,’ তাহলে এতে তার ওপর কিছুই (বাধ্যবাধকতা) আসবে না। কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রীর সাথে নিকাহ (বিবাহ ও যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে) মায়ের ও বোনের সাথে তুলনা করা, তবে এটি হবে যিহার। অতএব, তার ওপর যিহারকারীর জন্য যে বিধান প্রযোজ্য, সেটিই প্রযোজ্য হবে। সুতরাং, যদি সে স্ত্রীকে দাম্পত্য সম্পর্কে রাখে, তবে সে তাকে স্পর্শ করতে পারবে না যতক্ষণ না সে যিহারের কাফফারা আদায় করে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা: ৫)
ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন:وَإِنْ أَرَادَ بِهَا عِنْدِي مِثْلُ أُمِّي . أَيْ فِي الامْتِنَاعِ عَنْ وَطْئِهَا وَالاسْتِمْتَاعِ بِهَا وَنَحْوِ ذَلِكَ مِمَّا يَحْرُمُ مِنْ الأُمِّ فَهِيَ مِثْلُ أُمِّي الَّتِي لَيْسَتْ مَحَلا لِلاسْتِمْتَاعِ بِهَا : فَهَذَا مُظَاهِرٌ يَجِبُ عَلَيْهِ مَا يَجِبُ عَلَى الْمُظَاهِرِ ، فَلا يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَطَأَهَا حَتَّى يُكَفِّرَ كَفَّارَةَ الظِّهَارِ ، فَيَعْتِقَ رَقَبَةً ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا”যদি সে এর দ্বারা উদ্দেশ্য করে আমার কাছে তুমি আমার মায়ের মতো; অর্থাৎ তোমার সাথে সহবাস করা, উপভোগ করা এবং অন্যান্য সেইসব বিষয় থেকে বিরত থাকব যেগুলো মায়ের ক্ষেত্রে হারাম। তাহলে (স্ত্রীকে এভাবে বলা) তার মায়ের মতোই হবে,যিনি উপভোগের জন্য বৈধ নন। এ অবস্থায় সে ‘যিহারকারী’ হিসেবে গণ্য হবে, এবং তার ওপর যিহারকারীর হুকুম প্রযোজ্য হবে। সুতরাং, তার জন্য স্ত্রীকে সহবাস করা বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে যিহারের কাফফারা আদায় করে।
আর সেই কাফফারা হলো: (১).একটি দাস মুক্ত করা; (২).যদি তা না পায়, তবে ধারাবাহিক দুই মাস সাওম রাখা; (৩).আর যদি সেটিও না পারে, তবে ষাটজন মিসকীনকে আহার করানো।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা: ৭)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,وَإِنْ قَالَ : أَنْتِ عَلَيَّ كَأُمِّي . أَوْ : مِثْلُ أُمِّي . وَنَوَى بِهِ الظِّهَارَ , فَهُوَ ظِهَارٌ , فِي قَوْلِ عَامَّةِ الْعُلَمَاءِ ; مِنْهُمْ أَبُو حَنِيفَةَ , وَصَاحِبَاهُ , وَالشَّافِعِيُّ , وَإِسْحَاقُ . وَإِنْ نَوَى بِهِ الْكَرَامَةَ وَالتَّوْقِيرَ , أَوْ أَنَّهَا مِثْلُهَا فِي الْكِبَرِ , أَوْ الصِّفَةِ , فَلَيْسَ بِظِهَارٍ . وَالْقَوْلُ قَوْلُهُ فِي نِيَّتِهِ”যদি (স্বামী) তার স্ত্রীকে বলে: ‘তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতো’ অথবা ‘আমার মায়ের সমতুল্য’, আর এ কথার মাধ্যমে যদি সে যিহারকে উদ্দেশ্য করে, তবে তা যিহার হিসেবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে অধিকাংশ আলেম একমত; তাদের মধ্যে আছেন ইমাম আবু হানিফা, তাঁর দুই সঙ্গী, ইমাম শাফেঈ এবং ইসহাক।কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া, অথবা কেবল বয়সে তার মায়ের মতো, কিংবা কোনো বিশেষ গুণাবলীতে তার মতো তাহলে তা যিহার হবে না।এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে স্বামীর নিজস্ব নিয়তের উপর,অর্থাৎ: এখানে আসল রেফারেন্স হলো স্বামী নিজেই; অন্য কেউ নয়,তার নিয়তই নির্ধারণ করবে বিষয়টি।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৬০)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,”إذا قال الزوج لزوجته : أنا أخوك أو أنت أختي ، أو أنت أمي أو كأمي ، أو أنت مني كأمي أو كأختي، فإن أراد بذلك أنها مثل ما ذكر في الكرامة أو الصلة والبر أو الاحترام أو لم يكن له نية ولم يكن هناك قرائن تدل على إرادة الظهار ، فليس ما حصل منه ظهارا ، ولا يلزمه شيء ، وإن أراد بهذه الكلمات ونحوها الظهار أو قامت قرينة تدل على الظهار مثل صدور هذه الكلمات عن غضب عليها أو تهديد لها فهي ظهار ، وهو محرم وتلزمه التوبة وتجب عليه الكفارة قبل أن يمسها ، وهي : عتق رقبة ، فإن لم يجد فصيام شهرين متتابعين ، فإن لم يستطع فإطعام ستين مسكينا”যদি স্বামী তার স্ত্রীকে বলে: আমি তোমার ভাই, অথবা তুমি আমার বোন, কিংবা তুমি আমার মা, অথবা তুমি আমার মায়ের মতো, অথবা তুমি আমার কাছে আমার মা কিংবা আমার বোনের মতো তাহলে, যদি তার উদ্দেশ্য হয়  সম্মান, আত্মীয়তার সম্পর্ক, সৌহার্দ্য, স্নেহ, মর্যাদা বা শ্রদ্ধা প্রকাশ করা, অথবা একেবারেই কোনো নিয়ত না থাকে, এবং এমন কোনো প্রমাণ-পরিস্থিতিও না থাকে যা দ্বারা বোঝা যায় যে সে আসলে যিহারের উদ্দেশ্য করেছে তাহলে এরূপ কথা যিহার নয়। এ অবস্থায় তার ওপর কোনো কিছু ওয়াজিবও হবে না।কিন্তু যদি সে এসব শব্দ দ্বারা যিহারকেই উদ্দেশ্য করে থাকে, অথবা এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যা দ্বারা বোঝা যায় যে সে যিহার উদ্দেশ্যেই বলেছে (যেমন: স্ত্রীর ওপর রাগের সময় বা তাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এসব কথা বলা) তাহলে তা যিহার গণ্য হবে।যিহার হলো হারাম কাজ। এ জন্য স্বামীর তওবা করা আবশ্যক। আর স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করার আগে তার ওপর যিহারের কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব।সেই কাফফারা হলো: (১). একটি দাস মুক্ত করা। (২).যদি তা সম্ভব না হয়, তবে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস রোযা রাখা (৩).আর যদি সেটাও না পারে, তবে ষাট জন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো।”(ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ; খণ্ড ২; পৃষ্ঠা: ২৭৪)
.
এমনকি নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেও বা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি যিহারের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে, তবে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে।যেমন স্বামী বলে: “তুমি আমার বোনের মতো, যতক্ষণ না আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট হই’ এটি যিহারের একটি অস্থায়ী রূপ। অর্থাৎ, যেহেতু এটি স্বামী সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত প্রযোজ্য, তাই যদি স্বামী সন্তুষ্ট হওয়ার আগে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তবে কাফফারা প্রয়োজন হবে। আর যদি সন্তুষ্ট হওয়ার পরে সহবাস করে, তাহলে কোনো কাফফারা প্রযোজ্য হবে না।”
.
শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন: ” ويصح الظهار مؤقتا ، مثل أن يقول : أنت علي كظهر أمي شهرا ، أو حتى ينسلخ شهر رمضان . فإذا مضى الوقت زال الظهار ، وحلّت المرأة بلا كفارة ، ولا يكون عائدا إلا بالوطء في المدة . وهذا قول ابن عباس وعطاء وقتادة والثوري وإسحاق وأبي ثور ، وأحد قولي الشافعي . . . لحديث سلمة بن صخر ، وقوله : ظاهرت من امرأتي حتى ينسلخ شهر رمضان . وأخبر النبي صلى الله عليه وسلم أنه أصابها في الشهر ، فأمره بالكفارة . ولم [ينكر] عليه تقييده “
“যিহার (সময় নির্দিষ্ট করে) করা বৈধ। যেমন কেউ বলে: ‘তুমি আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো এক মাসের জন্য বা বলে: রমযান মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত। সুতরাং যখন সেই সময় চলে যাবে, তখন যিহার বাতিল হয়ে যাবে, এবং স্ত্রী বৈধ হয়ে যাবে, কোনো কাফফারা ছাড়াই। আর সে (স্বামী) ঐ সময়ের মধ্যে সহবাস করলে তবেই কাফফারা দিতে হবে। এটাই ইবনু আব্বাস, আত্বা, ক্বতাদা, সাওরী, ইসহাক, আবূ সাওর এবং ইমাম শাফেয়ীর একটি অভিমত।সালামা ইবনু সাখর (রা.) এর হাদীস আছে তিনি বলেছিলেন: আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যিহার করেছি যতক্ষণ না রমযান মাস শেষ হয়। কিন্তু তিনি রমযানের মধ্যে সহবাস করেছিলেন, তখন নবী সা. তাকে কাফফারা দিতে আদেশ করেছিলেন। আর নবী সা. তার ঐ শর্ত বেঁধে দেওয়াকে (অর্থাৎ সময় নির্দিষ্ট করে যিহার করাকে) অস্বীকার করেননি।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খন্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৬৮)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] যিহারের নির্দিষ্ট সময়ের উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন: وهذا ربما يجري ويحصل من الإنسان أن يغضب من زوجته لإساءة عشرتها فيقول : أنت علي كظهر أمي كل هذا الأسبوع ، أو كل هذا الشهر ، أو ما أشبه ذلك ، فهذا يصح ظهارا ، وليس معنى قولنا : ” إنه يصح ” أنه يحِل ، بل المعنى أنه ينعقد . فإذا مضت المدة التي وقّت بها الظهار وجامعها بعد مضي الوقت لا تجب الكفارة ؛ لأن المدة انتهت فزال حكم الظهار . فإن وطئ الزوج زوجته في الوقت الذي وقّت فيه الظهار وجبت عليه الكفارة ، وإن فرغ الوقت ووطئ بعد الفراغ زال الظهار”এমনটা হতে পারে যে মানুষ তার স্ত্রীর খারাপ আচরণ দেখে রেগে গিয়ে বলে: তুমি আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো এই পুরো সপ্তাহের জন্য বা এই পুরো মাসের জন্য, কিংবা এর অনুরূপ কিছু। এটা যিহার হিসেবে গণ্য হবে। আর আমরা যখন বলি এটা বৈধ এর মানে এই নয় যে এটা হালাল হয়ে গেল, বরং এর মানে হলো এটা কার্যকর হলো। তাহলে যখন নির্দিষ্ট করা সময় শেষ হয়ে যাবে, তারপর সে যদি স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তার উপর কোনো কাফফারা আসবে না; কারণ সময় শেষ হয়ে গেলে যিহার বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু যদি স্বামী সেই নির্দিষ্ট করা সময়ের মধ্যেই স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তবে তার উপর কাফফারা ফরজ হবে। আর সময় শেষ হয়ে গেলে এবং পরে সে সহবাস করলে যিহারও শেষ হয়ে যাবে।”(ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৫৯৩)।
.
❑ যদি কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে, অথবা কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে, নিজের মাহরামদের কারো সাথে বা নিজের শরীরের বিশেষ কোনো অঙ্গের সাথে তুলনা করে, তবে এর শারঈ বিধান কী?
.
কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর শারীরিক গঠন, সৌন্দর্য বা গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে বলে যে, তোমার চোখ দেখতে আমার মায়ের মতো, তোমার চেহারা আমার বোনের মত ইত্যাদি অথবা কোন মহিলা তার স্বামীকে বলে, তোমার দেহের গঠন আমার ভাই বা পিতার মত তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। অনুরূপভাবে সম্মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে বা বৈশিষ্টগত ভাবে তুমি আমার মা/বাবার অনুরূপ তাহলেও তা যিহারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ হারাম করার নিয়ত না থাকলে যিহার বলে গণ্য হবে না। যদিও কিছু আলেম মনে করেন যে স্বামী যদি যিহারের উদ্দেশ্য ছাড়া কেবল স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীকে “হে আমার মা” বা “হে আমার বোন” বলে সম্বোধন করেন, তবে সেটি মাকরূহ। এ মতকে তারা সমর্থন করেছেন আবু দাউদে বর্ণিত (হাদিস নং ২২১০) একটি রেওয়ায়েত দ্বারা। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বললো, হে আমার বোন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সে কি তোমার বোন? তিনি তার এরূপ সম্বোধনরকে অপছন্দ করলেন এবং এরূপ করতে নিষেধ করলেন।”(আবু দাউদ হা/২২১০) কিন্তু সঠিক মত হলো এটি মোটেও মাকরূহ নয়, কারণ উক্ত হাদিসটি সহীহ নয়। ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটিকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন।
.
এছাড়াও বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:কেবল ভালোবাসা ও স্নেহ প্রকাশের উদ্দেশ্যে কি স্বামী তার স্ত্রীকে ‘হে আমার বোন’ বা ‘হে আমার মা’ বলে সম্বোধন করতে পারে?
উত্তরে শাইখ বলেন:” نعم , يجوز له أن يقول لها يا أختي , أو يا أمي , وما أشبه ذلك من الكلمات التي توجب المودة والمحبة , وإن كان بعض أهل العلم كره أن يخاطب الرجل زوجته بمثل هذه العبارات , ولكن لا وجه للكراهة , وذلك لأن الأعمال بالنيات , وهذا الرجل لم ينو بهذه الكلمات أنها أخته بالتحريم والمحرمية , وإنما أراد أن يتودد إليها ويتحبب إليها , وكل شيء يكون سبباً للمودة بين الزوجين , سواء كان من الزوج أو الزوجة فإنه أمر مطلوب“হ্যাঁ, স্বামী তার স্ত্রীকে ‘হে আমার বোন’, ‘হে আমার মা’ কিংবা এ জাতীয় শব্দ দ্বারা সম্বোধন করতে পারে, যা পারস্পরিক স্নেহ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। যদিও কিছু আলেম স্বামীর জন্য স্ত্রীকে এভাবে সম্বোধন করা (মাকরূহ) অপছন্দ করেছেন,বাস্তবে এর মধ্যে অপছন্দের কোনো কারণ নেই। কারণ কর্মের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যক্তি যখন স্ত্রীকে এভাবে ডাকেন, তখন তিনি তাকে আসলেই বোন বা মা হিসেবে বোঝাতে চান না যাতে মহরামত্ব বা হারাম হওয়ার কোনো দিক যুক্ত হয়—বরং তিনি কেবল আন্তরিকতা, স্নেহ ও মমতা প্রকাশ করতে চান। আর যে কোনো বিষয়, তা স্বামী অথবা স্ত্রী যেই করুক না কেন, যদি তা তাদের মাঝে ভালোবাসা ও মমতা বৃদ্ধির মাধ্যম হয়, তবে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে কাঙ্ক্ষিত এবং প্রশংসনীয়।”(ইবনু উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৮৩৩৮৬)
.
❑ যিহারের শারঈ বিধান এবং এর কাফফারা কী?
.
ইসলামে যিহার একটি ঘৃণিত এবং হারাম কাজ। আল্লাহ তাআলা এটিকে “মুনকার ও মিথ্যা বক্তব্য” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এজন্য, যিহারের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহ তওবা করার পাশাপাশি কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যিনি তার স্ত্রীর সাথে যিহার করেন, তার জন্য কাফফারা আদায় করা আবশ্যক। কাফফারা আদায়ের আগ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিলন হারাম। জাহেলি যুগে যিহারকে স্বাভাবিকভাবে তালাকের সমতুল্য ধরা হতো, ফলে স্ত্রী চিরস্থায়ীভাবে স্বামীর কাছ থেকে হারাম হয়ে যেত। যেমন, তাফসিরে কুরতুবীতে উল্লেখ করা হয়েছে:
“ذلك كان طلاق الرجل امرأته في الجاهلية
“জাহেলি যুগে এটি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাকের সমতুল্য ছিল।
কিন্তু ইসলাম এই নিয়মটি পরিবর্তন করেছে। যিহার ইসলামিক দৃষ্টিতে চিরস্থায়ী হারাম নয়, বরং অস্থায়ী হারামের সীমার মধ্যে রাখা হয়েছে।অর্থাৎ কোনও স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যিহার করলে কাফফারা প্রদান করলে তা হালাল হয়ে যাবে।যিহারের কাফফারা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِن نِّسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِّن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۚ ذَٰلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ -‏ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۖ فَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ۚ ذَٰلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ۚ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ“যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে ফেলে, অতঃপর তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে, তাদের কাফফারা হল, একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাসকে মুক্তি দিবে। এটা তোমাদের জন্যে উপদেশ হবে। আল্লাহ খবর রাখেন তোমরা যা কর। যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা রাখবে। যে এতেও অক্ষম হয় সে ষাট জন মিসকিনকে আহার করাবে। এটা এজন্যে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(সূরা মুজাদিলা: ৩ ও ৪) অর্থাৎ যিহারের কাফফারা রমজান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসের কাফফারার অনুরূপ। তা হল: (১). একটি মুমিন দাস মুক্ত করা। কিন্তু বর্তমান যুগে দাস-দাসী প্রথা প্রচলিত না থাকার কারণে তা প্রযোজ্য নয়। (২).এটি সম্ভব না হলে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা থাকা। এ ক্ষেত্রে ঈদ উপলক্ষে রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলোতে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। অত:পর রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলো অতিবাহিত হলে যথারীতি রোজা রাখা শুরু করবে। (৩).তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন মিসকিন (দরিদ্র-অসহায় মানুষ) কে এক বেলা খাবার খাওয়ানো অথবা খাদ্য দ্রব্য দান করা। খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ, প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য (যেমন: আমাদের দেশে চাল) থেকে প্রায় সোয়া কেজি। এর সমপরিমাণ টাকা দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ কুরআনে খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এর ব্যতিক্রম করা বৈধ নয়।
.
❑ স্ত্রীর পক্ষ থেকে কি স্বামীর সাথে যিহার হয়?
পবিত্র কুরআনের সূরা মুজাদিলা, আয়াত ২-এর আলোকে অধিকাংশ উলামা বলেন যে, যিহার কেবল স্বামীর পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়; স্ত্রীর পক্ষ থেকে নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে শুধুমাত্র স্বামীদের কথার উল্লেখ করেছেন। অতএব, যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন,“তুমি আমার জন্য হারাম, যেমন আমার পিতা বা আমার ভাই আমার জন্য হারাম,” তাহলে অধিকাংশ বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী এটি ‘যিহার’ হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এই ধরনের উক্তি হারামকে হারাম ঘোষণা করার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং গুনাহের কাজ। এটি এক প্রকার শপথ বা কসম হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে তার কর্তব্য হলো কসম ভঙ্গের জন্য নির্ধারিত কাফফারা পূর্ণ করা।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আমার স্ত্রী আমাকে সবসময় বলে, তুমি আমার স্বামী, তুমি আমার ভাই, তুমি আমার বাবা, আর তুমি আমার সবকিছু দুনিয়াতে। এই কথাগুলো কি তাকে আমার জন্য হারাম করে দেয়, না কি না?
উত্তরে শাইখ বলেন:
:هذا الكلام منها لا يحرمها عليك ؛ لأن معنى قولها ” أنت أبي وأخي ” وما أشبه ذلك : معناها : أنت عندي في الكرامة والرعاية بمنزلة أبي وأخي ، وليست تريد أن تجعلك في التحريم بمنزلة أبيها وأخيها .على أنها لو فُرض أنها أرادت ذلك : فإنكَ لا تحرم عليها ؛ لأن الظهار لا يكون من النساء لأزواجهن ، وإنما يكون من الرجال لأزواجهم ، ولهذا إذا ظاهرت المرأة من زوجها بأن قالت له ” أنتَ عليَّ كظهر أبي ، أو كظهر أخي ” أو ما أشبه ذلك : فإن ذلك لا يكون ظهاراً ، ولكن حكمه حكم اليمين ، بمعنى أنها لا يحل لها أن تمكنه من نفسها إلا بكفارة اليمين ، فإن شاءت دفعت الكفارة قبل أن يستمتع بها ، وإن شاءت دفعتها بعد ذلك .وكفارة اليمين : إطعام عشرة مساكين ، أو كسوتهم ، أو عتق رقبة ، فإن لم يجد : فصيام ثلاثة أيام .”
“(স্ত্রীর পক্ষ থেকে) এই কথাগুলো তাকে আপনার জন্য হারাম করে না। কারণ, তার এ কথার অর্থ তুমি আমার কাছে সম্মান ও যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার বাবা ও ভাইয়ের মতো। সে এভাবে বোঝাতে চায় না যে, তোমাকে সে তার বাবা বা ভাইয়ের মতো করে হারামের মর্যাদা দিতে চায়। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, সে আসলেই এ উদ্দেশ্যে বলেছে, তবুও আপনি তার জন্য হারাম হবেন না। কারণ যিহার (ظهار) যিহার (কাউকে বাবা বা ভাইয়ের সমতুল্য বলে হারাম করা) নারীরা তাদের স্বামীর জন্য করতে পারে না; বরং যিহার শুধুমাত্র পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে করে থাকে। এ কারণে, যদি কোনো নারী তার স্বামীর প্রতি বলে তুমি আমার জন্য আমার বাবার মতো, অথবা আমার ভাইয়ের মতো। কিংবা এ ধরনের কথা বলে, তবে তা যিহার হবে না; বরং এর হুকুম হবে শপথের হুকুমের মতো।অর্থাৎ, সে স্বামীকে নিজের কাছে ভোগ করতে দেওয়া তার জন্য হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে শপথের কাফফারা আদায় করে। সে চাইলে স্বামীর সঙ্গে মিলনের আগে কাফফারা আদায় করবে, আর চাইলে পরে আদায় করবে।শপথ ভঙ্গের কাফফারা হলো: ক. দশজন মিসকীনকে খাওয়ানো, অথবা খ. তাদের পোশাক পরানো, অথবা গ. একজন দাস মুক্ত করা। কোনোটিই যদি সম্ভব না হয়, তবে তিন দিন রোযা রাখা।”(ইবনু উসাইমীন;ফাতাওয়াউল মারআতিল মুসলিমাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮০৩)
.
অত:এব কোনও স্ত্রী যদি তার স্বামীকে এভাবে বলে যে, “তুমি আমার জন্য হারাম যেমন আমার জন্য আমার পিতা হারাম অথবা যেমন আমার ভাই আমার জন্য হারাম” তাহলে অধিক বিশুদ্ধ মতে তা ‘যিহার’ বলে গণ্য হবে না। বরং তা হালালকে হারাম করার অন্তর্ভুক্ত। এটিও হারাম ও গুনাহের কাজ।এটি কসম হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তার করণীয় হল, কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা।
.
❑ কোনও স্বামী যদি সাধারণভাবে তার স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম ঘোষণা করে তাহলে তার বিধান কী?
.
যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে কোনো মাহরাম নারীর সঙ্গে তুলনা না করে সাধারণভাবে হারাম ঘোষণা করে, যেমন বলে: “তুমি আমার জন্য হারাম”, অথবা স্ত্রীকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বলে: “তুমি যদি এ কাজ করো তবে তুমি আমার জন্য হারাম” তাহলে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এ ধরনের কথা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ এটি আল্লাহ কর্তৃক হালাল করা বিষয়কে হারাম ঘোষণা করার শামিল। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি কসম (শপথ) হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যদি সে তার এ কথার মাধ্যমে শর্ত ভঙ্গ করে, তবে তার উপর কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব হবে।আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ
“হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যাহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক।” [সূরা তাহরিম: ১ ও ২] উপরোক্ত আয়াতের আলোকে ইবনে আব্বাস রা. বলেন,إِذَا حَرَّمَ الرَّجُلُ عَلَيْهِ امْرَأَتَهُ فَهِيَ يَمِينٌ يُكَفِّرُهَا“যদি কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে তার জন্য হারাম করে দেয় তাহলে তা হল, একটি কসম। যার জন্য কাফফারা আদায় করবে।”(সহীহ বুখারি হা/৪৯১১ ও মুসলিম, হা/১৪৭৩) উল্লেখ্য যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হালাল কৃত কোনও খাবার, পানীয়, পোশাক বা অন্য যে কোনও কিছুকে নিজের জন্য হারাম বলে ঘোষণা দেয় তাহলে তার উপর একই বিধান বর্তাবে। অর্থাৎ তার জন্য কসম ভঙ্গের কাফফারারা আদায় করা আবশ্যক। তবে কেউ যদি উক্ত বাক্য বলার মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নিয়ত করে তাহলে তালাক বলে গণ্য হবে। কারণ “নিয়তের উপর সকল কর্ম নির্ভরশীল।” [সহিহ বুখারি]
.
❑ রাগান্বিত ব্যক্তির যিহার কার্যকর হয়?
.
আহলুল আলেমগন রাগান্বিত ব্যক্তির উচ্চারিত বাক্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন,তারা বক্তব্য অনুযায়ী রাগের তিনটি অবস্থা হতে পারে:
প্রথম অবস্থা: এত তীব্র রাগ উঠা যে, ব্যক্তি তার অনুভুতি হারিয়ে ফেলা। পাগল বা উন্মাদের মত হয়ে যাওয়া। সকল আলেমের মতে, এ লোকের যিহার কিংবা তালাক কার্যকর হবে না। কেননা সে বিবেকহীন পাগল বা উন্মাদের পর্যায়ভুক্ত।
দ্বিতীয় অবস্থা: রাগ তীব্র আকার ধারণ করা। কিন্তু সে যা বলছে সেটা সে বুঝতেছে এবং বিবেক দিয়ে করতেছে। তবে তার তীব্র রাগ উঠেছে এবং দীর্ঘক্ষণ ঝগড়া, গালি-গালাজ বা মারামারির কারণে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। এগুলোর কারণেই তার রাগ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ লোকের যিহার বা তালাকের ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। অগ্রগণ্য মতানুযায়ী, এ লোকের তালাকও কার্যকর হবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ইগলাক এর অবস্থায় তালাক কিংবা দাস আযাদ নেই”।(সুনানে ইবনে মাজাহ (২০৪৬), শাইখ আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ কিতাবে হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন] ইগলাক শব্দের অর্থে আলেমগণ বলেছেন: জবরদস্থি কিংবা কঠিন রাগ।
তৃতীয় অবস্থা: হালকা রাগ। স্ত্রীর কোন কাজ অপছন্দ করা কিংবা মনোমালিন্য থেকে স্বামীর এই রাগের উদ্রেক হয়। কিন্তু এত তীব্র আকার ধারণ করে না যে, এতে বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে কিংবা নিজের ভাল-মন্দের বিবেচনা করতে পারে না। বরং এটি হালকা রাগ। আলেমগণের সর্বসম্মতিক্রমে এ রাগের অবস্থায় তালাক বা যিহার কার্যকর হবে।রাগাম্বিত ব্যক্তির তালাকের মাসয়ালায় বিস্তারিত ব্যাখ্যামূলক এটাই সঠিক অভিমত। ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়্যূম এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যার সারকথা হচ্ছে: কঠিন রাগ; যে রাগের কারণে মানুষ কী বলছে তা উপলব্ধি করতে পারে না; এমন রাগ তালাক কার্যকরে বাধা দেয়। অনুরূপভাবে এমন তীব্র রাগ যা মানুষকে তালাক দেয়ার প্রতি প্ররোচিত করে ও ধাবিত করে; সে যদি নিজে যা বলছে সেটা উপলব্ধি করেও তদুপরি তালাক পতিত হবে না। আর হালকা রাগ মানুষের তালাক দেয়ার ইচ্ছার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। হালকা রাগ থাকা সত্ত্বেও তালাক কার্যকর হবে।তালাক সম্পর্কে যা বলা হয়, তা যিহার সম্পর্কেও বলা যেতে পারে, কারণ উভয়ই একই প্রকৃতির। বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু কাইয়ুম ইগাসাতুল লাহফান; পৃষ্ঠা: ১৯; ইমাম বিন বায এর ‘ফাতাওয়াত তালাক’ পৃষ্ঠা: ১৫-২৭; ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৪৪৪)
.
❑ কসম/শপথ ভঙ্গের কাফ্‌ফারা কিভাবে আদায় করতে হবে?
.
আল্লাহ তাআলা তাঁর নিম্নোক্ত বাণীতে শপথ ভঙ্গের কাফ্‌ফারা বর্ণনা করেছেন:لا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ “তোমাদের অনর্থক শপথের জন্য আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। তারপর এর কাফ্‌ফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি। অতঃপর যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফ্‌ফারা। আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর”। (সূরা মায়িদা,আয়াত: ৮৯)
সুতরাং একজন মানুষ তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে কোন একটি বাছাই করে নিতে পারেন:
.
(১) দশজন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো। নিজের ফ্যামিলিকে যে ধরনের খাবার খাওয়ানো হয় সে ধরণের মধ্যম মানের খাবার। প্রত্যেক মিসকীনকে দেশীয় খাদ্যদ্রব্যের অর্ধ সা’ দিতে হবে। যেমন চাল বা এ জাতীয় অন্য কিছু। অর্ধ সা’এর পরিমাণ হচ্ছে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। যদি কোন দেশে ভাতের সাথে তরকারি খাওয়ার প্রচলন থাকে, অনেক দেশে এটাকে তাবিখ (রান্নাকৃত) বলা হয় সেক্ষেত্রে চালের সাথে তাদেরকে তরকারী বা গোশত দেয়া উচিত। আর যদি দশজন মিসকীনকে একত্রিত করে দুপুরে বা রাতের খাবার খাওয়ানো হয় তাহলে সেটাও যথেষ্ট।
(২) দশজন মিসকীনকে বস্ত্র দান করা। যে কাপড় দিয়ে নামায আদায় করা যায় প্রত্যেক মিসকীনকে এমন ড্রেস দিতে হবে। পুরুষদের জন্য জামা (জুব্বা) কিংবা লুঙ্গি ও চাদর। আর নারীদের জন্য গোটা দেহ আচ্ছাদনকারী পোশাক এবং ওড়না।
(৩) একজন ঈমানদার ক্রীতদাস আদায করা। যে ব্যক্তির এর কোনটি করার সামর্থ্য নেই সে ব্যক্তি লাগাতার তিনদিন রোযা রাখবে। জমহুর আলেমের অভিমত হচ্ছে নগদ অর্থ দিয়ে কাফ্‌ফারা দিলে আদায় হবে না।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:لا يُجْزِئُ في الكفارة إِخراج قيمة الطعام ولا الكسوة، لأن الله ذكر الطعام فلا يحصل التكفير بغيره، ولأن الله خَيَّرَ بين الثلاثة أشياء ولو جاز دفع القيمة لم يكن التَخْييرُ منحصراً في هذه الثلاث… “কাফ্‌ফারা আদায় করার ক্ষেত্রে খাদ্য কিংবা বস্ত্রের মূল্য দিয়ে দিলে কাফ্‌ফারা আদায় হবে না। কেননা আল্লাহ্‌ খাদ্যের কথা উল্লেখ করেছেন সুতরাং অন্য কিছু দিয়ে কাফ্‌ফারা আদায় হবে না। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলা তিনটি পদ্ধতি থেকে একটি চয়ন করার সুযোগ দিয়েছেন। যদি মূল্য দেয়া জায়েয হত তাহলে তিনটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন অর্থ থাকে না।”(ইবনে কুদামা এর আল-মুগনি; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৫৬)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:(على أن تكون الكفارة طعاما لا نقودا، لأن ذلك هو الذي جاء به القرآن الكريم والسنة المطهرة، والواجب في ذلك نصف صاع من قوت البلد، من تمر أو بر أو غيرهما، ومقداره كيلو ونصف تقريبا، وإن غديتهم أو عشيتهم أو كسوتهم كسوة تجزئهم في الصلاة كفى ذلك، وهي قميص أو إزار ورداء.) কাফফারা অবশ্যই খাদ্য হতে হবে; অর্থ নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাহ্‌তে খাদ্যের কথাই এসেছে। আবশ্যকীয় পরিমাণ হচ্ছে অর্ধ সা’ দেশীয় খাদ্যদ্রব্য; যেমন- খেজুর, গম ইত্যাদি। আধুনিক পরিমানের হিসাবে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। আর যদি আপনি তাদেরকে দুপুরের খাবার খাইয়ে দেন বা রাতের খাবার খাইয়ে দেন কিংবা পোশাক পরিয়ে দেয়, যে পোশাক দিয়ে নামায পড়া জায়েয হবে সেটাও যথেষ্ট। এমন পোশাক হচ্ছে– একটা জামা (জুব্বা) কিংবা একটা লুঙ্গি ও চাদর।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৮১)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:”فإن لم يجد الإنسان لا رقبة ولا كسوة ولا طعاماً فإنه يصوم ثلاثة أيام، وتكون متتابعة لا يفطر بينهما.”যদি কেউ ক্রীতদাস না পায়, পোশাক বা খাবার দিতে না পারে তাহলে সে তিনদিন রোযা রাখবে। এ রোযাগুলো লাগাতারভাবে রাখতে হবে। মাঝে কোনদিন রোযা ভাঙ্গা যাবে না।”(ফাতাওয়া মানারুল ইসলাম; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬৬৭) আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করে সে আলোকে জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

Translate