ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর:
প্রথমত: মুশরিক, কাফির অথবা এমন মুনাফিক, যে গুরুতর আকীদাগত নিফাকের মাধ্যমে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় তার জানাযার নামাজ আদায় করা বৈধ নয়। কারন যদি কারো কুফর বা নিফাক সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ থাকে, তবে তার জানাযা পড়া, মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া করা কিংবা ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ সে আত্মীয় হোক বা অপরিচিত যে-ই হোক না কেন।
আবু ইসহাক আশ-শিরাযী (রহিমাহুল্লাহ) আল-মুহাযযাব-এ বলেন:
” وإن مات كافر لم يصل عليه ، لقوله عز وجل: (وَلا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَداً وَلا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ) التوبة/84، ولأن الصلاة لطلب المغفرة ، والكافر لا يغفر له، فلا معنى للصلاة عليه “
“যদি কোনো কাফের মারা যায়, তবে তার উপর জানাজার নামাজ পড়া যাবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর (হে মুহাম্মাদ ﷺ) তাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তুমি কখনও তার উপর জানাজার নামাজ পড়ো না এবং তার কবরের সামনে দাঁড়াবে না।”(সূরা আত-তাওবা: ৮৪) কেননা জানাজার নামাজের উদ্দেশ্য হলো মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা; আর কাফেরের জন্য আল্লাহ তাআলা ক্ষমা ঘোষণা করেননি। সুতরাং তার জন্য জানাজার নামাজের কোনো প্রয়োজন বা তাৎপর্য নেই।”(আল-মুহায্যাব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৫০)
.
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,فإن الاستغفار للكفار لا يجوز بالكتاب والسنَّة والإجماع “নিশ্চয় কাফিরদের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত অনুযায়ী নাজায়েয।”(মাজমুঊল ফাতাওয়া; খন্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৪৮৯)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:وَأَجْمَعُوا عَلَى تَحْرِيمِ الصَّلَاةِ عَلَى الْكَافِرِ “তাঁরা সর্বসম্মতভাবে একমত যে, কাফের ব্যক্তির জন্য জানাজার সালাত পড়া হারাম।”(নববী আল-মাজমু’ খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৫৮)
.
মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ,কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ-এ বলা হয়েছে:
” كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي عَلَى الْمُنَافِقِينَ وَيَسْتَغْفِرُ لَهُمْ، حَتَّى نَزَل قَوْل اللَّهِ تَعَالَى: (اسْتَغْفِرْ لَهُمْ أَوْ لاَ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ إِنْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ سَبْعِينَ مَرَّةً فَلَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ) . فَلَمْ يَكُنْ يُصَلِّي عَلَيْهِمْ بَعْدَ ذَلِكَ ، وَلاَ يَسْتَغْفِرُ لَهُمْ. وَكَانَ مَنْ مَاتَ مِنْهُمْ صَلَّى عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ الَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ أَنَّهُ مُنَافِقٌ ، وَمَنْ عُلِمَ أَنَّهُ مُنَافِقٌ لَمْ يُصَل عَلَيْهِ.وَكَانَ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إِذَا مَاتَ مَيِّتٌ لَمْ يُصَل عَلَيْهِ ، حَتَّى يُصَلِّيَ عَلَيْهِ حُذَيْفَةُ ؛ لأِنَّ حُذَيْفَةَ كَانَ قَدْ عَلِمَ أَعْيَانَ الْمُنَافِقِينَ “
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাফিকদের জানাযার সালাত আদায় করেছিলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন যতক্ষণ না নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়,আল্লাহ বলেন,”(হে মুহাম্মাদ) আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করুন একই কথা; আপনি সত্তর বার তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না”।(সূরা তওবা: ৮০) এরপর থেকে আর তাদের জানাযার সালাত আদায় করেননি এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। আর যে সকল মুনাফিকদের ওপর মুসলিমরা জানাযার সালাত আদায় করেছেন মূলত তারা জানতেন না যে সে মুনাফিক। আর যার ব্যাপারে তারা জানতেন যে, সে মুনাফিক, তার জানাযার সালাত আদায় করেননি। কেউ মারা গেলে প্রখ্যাত সাহাবী ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তার জানাযা পড়াতেন না যতক্ষণ না হুজাইফা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তার জানাযা পড়তেন, কারণ হুজাইফা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) জানতেন কারা মুনাফিক।”(মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ; খণ্ড: ৪১; পৃষ্ঠা: ২১)
.
আবূ ত্বালিব মৃত্যুবরণ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। তখন আল্লাহ তাঁকে তা করতে নিষেধ করলেন এবং এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন:“নবী এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের পক্ষে এটা মোটেই সমীচীন নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে যদিও তারা আত্মীয়স্বজন হয় যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী (অর্থাৎ তারা কুফরের ওপর মৃত্যুবরণ করেছে)। আর ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম)-এর পক্ষ থেকে তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কেবল সেই অঙ্গীকারের কারণে ছিল, যা তিনি তাঁর সাথে করেছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। নিশ্চয়ই ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম) ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের, আল্লাহর দরবারে বিনয়াভরে কান্নাকাটি করতেন এবং ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল। (সূরা তাওবা ৯: ১১৩-১১৪] এ একই বিধান প্রযোজ্য সেই জাদুকরের ক্ষেত্রেও, যে জাদু করার জন্য জিনদের সাহায্য গ্রহণ করে। সে কাফির, এবং তার জানাযার নামাজ পড়া বৈধ নয়।
.
সৌদি আরবের বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতি আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৬২ হি./১৯৪৩ খ্রি.] বলেছেন, “এটা সুবিদিত যে, কাফিরের জন্য দোয়া করা যাবে না,ক্ষমাপ্রার্থনাও করা যাবে না। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘নাবী ও মুমিনদের জন্য শোভনীয় নয়, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে; যদিও মুশরিকরা তাদের জ্ঞাতিবর্গ হয়ে থাকে।’ (সূরা তাওবা: ১১৩) সুতরাং যে গাইরুল্লাহর ইবাদত করে, আল্লাহর সাথে অন্যের শরিক স্থাপন করে, তার প্রতি আমি রহমতের দোয়া করব না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির বিদ‘আত ‘কাফির সাব্যস্তকারী বিদআত’ নয়, আর তার বিদ‘আত তাকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়নি, সে একজন পাপী মুসলিম। আমি আল্লাহর কাছে তার জন্য মুক্তি চাইব।” [গৃহীত: আল-আথারি (alathary) ডট নেট]
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে একজন যাদুকরের জানাজার সালাত পড়া এবং তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর মুসলিম কবরস্থানে দাফনের বিধান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি উত্তর দেন:
إذا قتل لا يصلى عليه ، ولا يدفن في مقابر المسلمين ، يدفن في مقابر الكفرة ، ولا يدفن في مقابر المسلمين ، ولا يصلى عليه ، ولا يغسل ولا يكفن
“যদি কোনো ব্যক্তি (যেমন যাদুকর) মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হয়, তবে তার জন্য জানাজার নামাজ পড়া হারাম, এবং তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। বরং তাকে কাফেরদের কবরস্থানে দাফন করতে হবে, তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না, তার জানাজার নামাজ পড়া অনুমোদিত নয়, এবং তাকে গোসল দেওয়া বা কাফন দেওয়াও বৈধ নয়।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১১)
.
দ্বিতীয়ত: একটি বিষয় সবার জানা উচিত যে তাকফিরের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা যাবে না।কারন আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামা‘আহ-এর উলামাগণ সর্বসম্মত যে—যে ব্যক্তি এ দু’টি সাক্ষ্য উচ্চারণ করে—“আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই” এবং “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল” তার মূল বা প্রাথমিক হুকুম হলো: সে মুসলিম। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।অতএব, যার ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে সে মুসলিম, স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ছাড়া তার কাছ থেকে মুসলিম পরিচয় ছিনিয়ে নেওয়া বৈধ নয়। যদি কারও ব্যাপারে সংশয় দেখা দেয়, তবে তার মৌলিক অবস্থা (অর্থাৎ মুসলিম হওয়া)-কেই ভিত্তি ধরা হবে, সন্দেহকে দূর করা হবে, তাকফীর (কাফির বলে রায় দেওয়া) থেকে বিরত থাকতে হবে, এবং বাহ্যিকভাবে মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তির সাথে মুসলিমদের মতো করেই আচরণ করতে হবে।এ কারণেই উলামাগণ সর্বসম্মত হয়েছেন যে, মুসলিমদের দেশে যদি কোনো মৃতদেহ জানাজার নামাজের জন্য পেশ করা হয়, তবে তার জানাজার নামাজ পড়া আবশ্যক। অথচ কিছু লোকের অবস্থান হলো—মুসলিমদের মসজিদে কাউকে জানাজার জন্য আনা হলে তারা তার জানাজা পড়ে না; কেবলমাত্র যাকে ব্যক্তিগতভাবে মুসলিম বলে জানে, তারই জানাজা পড়ে। তাদের এ ধরনের কাজ বিদআত হিসেবে গণ্য।একইভাবে, এ যুগের কিছু বিদআতীরা আরেকটি ভ্রান্ত মত প্রচার করেছে—তাদের মতে, মুসলিমদের জবাই বৈধ নয়, যতক্ষণ না নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে যে, জবাইকারী মুসলিম। এমনকি, “মুহাম্মাদ” নামের কেউ পশু জবাই করলেও তারা সেই মাংস খায় না, যতক্ষণ না যাচাই করে নিতে পারে যে, সে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম।কারণ, তাদের নিকট মৌলিক অবস্থা হলো—সন্দেহ। বিধানগত বিচারে তাদের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তির ইসলাম নিয়ে সন্দেহ করা মানে তাকে কাফির গণ্য করে ফেলা! আর এটি হলো বিদআত ও বিভ্রান্তি। এ ধরনের চিন্তাধারা মানুষকে শুধু অকল্যাণ ও ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেয়।”(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইমাম নববী, শরহু মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৪৮-১৪৯; রাওদাতুত ত্বালিবীন, খণ্ড: ১০, পৃষ্ঠা: ৮২; ইবনু তাইমিয়্যাহ, আল-ঈমান, পৃষ্ঠা: ২৮৩, ৩২৪; জামিউল-মাসায়িল, পৃষ্ঠা: ২০১)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মানহাজ বর্ণনা করে বলেছেন:
وَلَيْسَ لِأَحَدِ أَنْ يُكَفِّرَ أَحَدًا مِنْ الْمُسْلِمِينَ وَإِنْ أَخْطَأَ وَغَلِطَ حَتَّى تُقَامَ عَلَيْهِ الْحُجَّةُ وَتُبَيَّنَ لَهُ الْمَحَجَّةُ وَمَنْ ثَبَتَ إِسْلَامُهُ بِيَقِينِ لَمْ يُزَلْ ذَلِكَ عَنْهُ بِالشَّكْ؛ بَلْ لَا يَزُولُ إِلَّا بَعْدَ إِقَامَةِ الْحُجَّةِ وَإِزَالَةِ الشَّبْهَةِ».
“মুসলিমদের কেউ ভুল ও ত্রুটি করলেও তাকে কাফির আখ্যা দেওয়া কারও জন্য বৈধ নয়, যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে হুজ্জাহ (দলিল) প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এবং দলিল স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। যে ব্যক্তি সুনিশ্চিতভাবে মুসলিম সাব্যস্ত হয়েছে, সন্দেহ-সংশয়ের ভিত্তিতে তার থেকে এই পরিচয় অপসারণ করা যাবে না। বরং দলিলপ্রতিষ্ঠা ও সংশয়-দূরীকরণ না করা হলে উক্ত পরিচয় তার থেকে অপসৃত হবে না।”(মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ১২, পৃষ্ঠা: ৪৬৬) তিনি আরও বলেছেন,
وَمَنْ ثَبَتَ إِيمَانُهُ بِيَقِينِ لَمْ يُزَلْ ذَلِكَ عَنْهُ بِالشَّكُ».
“যে ব্যক্তি সুনিশ্চিতভাবে মুমিন সাব্যস্ত হয়েছে, সন্দেহ-সংশয়ের ভিত্তিতে তার থেকে এই পরিচয় অপসারণ করা যাবে না।”(মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ১২,পৃষ্ঠা: ৫০১)
ইমাম ইবনু আব্দিল বার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন:وَهَذَا أَصْلٌ مُسْتَعْمَلْ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنْ لَا تَزُولَ عَنْ أَصْلٍ أَنْتَ عَلَيْهِ إِلَّا بِيَقِينِ مِثْلِهِ وَأَنْ لَا يترك اليقين بِالشَّكْ”উলামাগণের নিকটে এটি একটি সুব্যবহৃত মূলনীতি যে, আপনি যেই মৌলিক অবস্থার ওপরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, অনুরূপ সুনিশ্চিত বিষয় ব্যতিরেকে আপনি উক্ত মৌলিক অবস্থা থেকে অপসৃত হয়ে যাবেন না; আর সন্দেহ-সংশয়ের দরুন সুনিশ্চিত বিষয়কে পরিত্যাগ করা যাবে না।”(আত-তামহিদ খন্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ৩৩৯-৩৪০) তিনি রাহিমাহুল্লাহ আরও বলেছেন:وَمِنْ جِهَةِ النَّظَرِ الصَّحِيحِ الَّذِي لَا مِدْفَعَ لَهُ أَنْ كُلَّ مَنْ ثَبَتَ لَهُ عَقْدُ الْإِسْلَامَ فِي وَقْتِ بِإِجْمَاعِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ثُمَّ أَذْنَبَ ذَنْبًا أَوْ تَأَوَّلَ تَأْوِيلًا فَاخْتَلَفُوا بَعْدُ فِي خُرُوجِهِ مِنَ الْإِسْلَامِ لَمْ يَكُنْ لِاخْتِلَافِهِمْ بَعْدَ إِجْمَاعِهِمْ مَعْنَى يُوجِبُ حُجَّةً وَلَا يُخْرِجُ مِنَ الْإِسْلَامِ الْمُتَّفَقِ عَلَيْهِ إِلَّا بِاتِّفَاقِ آخَرَ أَوْ سُنَّةٍ ثَابِتَةٍ لَا مُعَارِضَ لَهَا “প্রতিহত করা যায় না এমন বিশুদ্ধ গবেষণা বা অভিমত অনুযায়ী মুসলিমদের সর্বসম্মতিক্রমে যে ব্যক্তির মুসলিম পরিচয় সাব্যস্ত হয়ে যায়, এরপর সে কোনো পাপকাজ করে কিংবা কোনো তাবিল তথা ভিন্ন ব্যাখ্যা করে, ফলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে কিনা তা নিয়ে তারা মতভেদ করে, তাহলে তাদের নিজেদের ইজমা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পরে তাদের দ্বারা সংঘটিত এই মতভেদের এমন কোনো অর্থ নেই, যা কিনা দলিল হওয়াকে আবশ্যক করে (অর্থাৎ উক্ত মতভেদের এমন কোনো অর্থ নেই, যা বিষয়টিকে দলিল হওয়ার যোগ্য করে তোলে)। সর্ববাদিসম্মতিক্রমে সাব্যস্ত মুসলিমকে অনুরূপ সর্ববাদিসম্মত মত কিংবা অপ্রতিরোধ্য প্রমাণিত সুন্নাহ ছাড়া ইসলাম থেকে বের করা যাবে না।”(আত-তামহিদ, খণ্ড: ১৭, পৃষ্ঠা: ২১) কিংবা প্রমাণিত সুন্নাহ মানে: বিশুদ্ধ সুস্পষ্ট দলিল। তিনি (ইবনু আব্দিল বার) উলামাগণের আদর্শকে স্পষ্ট করে আরও বলেছেন,
فَالْوَاجِبُ فِي النَّظَرِ أَنْ لَا يُكَفِّرَ إلَّا مَن اتفق الجميع على تكفيره أوقام عَلَى تَكْفِيرِهِ دَلِيلٌ لَا مِدْفَعَ لَهُ مِنْ كِتَابٍ أَوَسُنَّةٍ”
গবেষণা অনুযায়ী এটি একটি অত্যাবশ্যক বিষয় যে, কাউকে কাফির বলার ব্যাপারে সবাই একমত না হলে, অথবা কাউকে কাফির বলার ব্যাপারে কিতাব বা সুন্নাহ থেকে অপ্রতিরোধ্য দলিল প্রতিষ্ঠিত না হলে, তাকে কাফির বলা যাবে না।”(আত-তামহিদ খণ্ড;১৭,পৃষ্ঠা:২২)
ইবনু নুজাইম আল-হানাফি তাঁর ‘আল-বাহরুর রায়িক’ গ্রন্থে বলেছেন,وَمَا يَشُكُ أَنَّهُ رِدَّةٌ لَا يَحْكُمُ بِهَا إِذْ الْإِسْلَامُ الثَّابِتُ لَا يَزُولُ بِشَكٍّ”কোনো বিষয় ‘রিদ্দাহ (মুরতাদ কাফির হয়ে যাওয়ার মতো বিষয়)’ কিনা এমন সন্দেহ হলে, সেটাকে রিদ্দাহ বলে হুকুম দেওয়া যাবে না। কেননা সন্দেহ-সংশয়ের দরুন কারও সাব্যস্ত মুসলিম পরিচয় বিলীন হয়ে যায় না।”(আল-বাহরুর রায়িক খষ্ঠা: ৫, পৃষ্ঠা: ১৩৪)
এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো এই হাদিস- উসামাহ ইবনু যায়িদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে হুরকা গোত্রের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমরা প্রত্যুষে গোত্রটির উপর আক্রমণ করি এবং তাদেরকে পরাজিত করি। এ সময়ে আনসারদের এক ব্যক্তি ও আমি তাদের (হুরকাদের) একজনের পিছু ধাওয়া করলাম। আমরা যখন তাকে ঘিরে ফেললাম তখন সে বলে উঠল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এ বাক্য শুনে আনসারী তার অস্ত্র সামনে নিলেন। কিন্তু আমি তাকে আমার বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে ফেললাম। আমরা মদিনায় ফিরার পর এ সংবাদ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৌঁছালে তিনি বললেন, হে উসামাহ! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরেও তুমি তাকে হত্যা করেছ? আমি বললাম, সে তো জান বাঁচানোর জন্য কালিমা পড়েছিল। এর পরেও তিনি এ কথাটি ‘হে উসামাহ! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরেও তুমি তাকে হত্যা করেছ’ বারবার বলতে থাকলেন। এতে আমার মন চাছিল যে, হায়, যদি সেই দিনটির পূর্বে আমি ইসলামই গ্রহণ না করতাম!(সহীহ বুখারী হা/৬৮৭২; মুসলিম ১/৪১, হাঃ ৯৬, আহমাদ ২১৮০৪] (আ.প্র. ৩৯৩৬, ই.ফা. ৩৯৪০) এই হাদীসে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠকারী ব্যক্তিকেও হত্যা করার ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত ব্যথিত হন। তাই উসামা (রাঃ) চরম অনুতপ্ত হয়ে এ কথা বলেছিলেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, ঐদিনের পর ইসলাম গ্রহণ করলে এত বড় কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না আর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও এত কষ্ট পেতেন না।
.
পাশাপাশি কোনো মুসলিমের মধ্যে যদি মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, তবুও তাকে কাফের বলা যাবে না; কারণ মুনাফিকির দুই প্রকার আছে— বড় (ই‘তিকাদী) মুনাফিকি ও ছোট (আমলী) মুনাফিকি।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
” النفاق نوعان: نفاق اعتقادي، ونفاق عملي، فالنفاق الاعتقادي محله القلب ، ولا يعلم به إلا الله، ولهذا بعض الصحابة الذين حصل منهم المخالفة، فقال عمر: إنه نافق، فعارضه الرسول صلى الله عليه وسلم.فالنفاق الاعتقادي محله القلب، ولا يجوز أن يرمي الإنسان به أحداً من المسلمين، وأهل الولاء لله ورسوله إلا ببينة واضحة.والنفاق العملي: أن يأتي الإنسان خصلة من خصال المنافقين، فلا بأس أن تقول: هذا منافق لهذا الفعل، فإذا رأينا الرجل يحدث ويكذب؛ قلنا: هذا منافق نفاقاً عملياً في هذه المسألة، وإذا رأيناه قام إلى الصلاة وهو كسلان؛ نقول: هذا فيه خصلة من خصال المنافقين؛ لأنه أشبه بالمنافقين في قيامه إلى الصلاة على وجه الكسل، فالنفاق العملي واسع؛ فكل من وافق المنافقين في خصلة من خصالهم ، فإنه منافق في هذا العمل خاصة، وكما قال الرسول صلى الله عليه وسلم: (آية المنافق ثلاث: إذا حدث كذب، وإذا وعد أخلف، وإذا اؤتمن خان) .هذه علامة المنافق، لكن هذه العلامات قد يقوم بها أناس من المسلمين؛ فنقول: هو منافق في هذه المسألة
মুনাফিকি দুই প্রকার:
১. আকীদাগত (বিশ্বাসের) মুনাফিকি,
২. আমলগত (কর্মের) মুনাফিকি,
প্রথমত: আকীদাগত মুনাফিকি: এটি অন্তরের সাথে সম্পর্কিত, এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তা জানে না। এজন্যই যখন এক সাহাবী কোনো ভুল করেছিলেন এবং উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন: “সে একজন মুনাফিক”, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর এই কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন।অতএব, কোনো মুসলিম যে প্রকাশ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রদর্শন করে—তার উপর স্পষ্ট প্রমাণ ব্যতীত আক্বীদাগত মুনাফিকির অভিযোগ আনা কখনো বৈধ নয়।
দ্বিতীয়ত: আমলগত মুনাফিকি কোনো ব্যক্তি যদি মুনাফিকদের কোনো বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটায়, তবে সে কর্মের দিক থেকে মুনাফিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেমন, আমরা যদি কাউকে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলতে দেখি, তাহলে বলা যায়: “সে কাজে মুনাফিকি করছে”।আবার,আমরা যদি কাউকে অলসভাবে সালাতে দাঁড়াতে দেখি, তাহলে বলা যায়: “তার মধ্যে মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে; কারণ সে মুনাফিকদের মতো অলসভাবে নামাজে দাঁড়িয়েছে। আমলগত মুনাফিকির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। তাই যে ব্যক্তি মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যের কোনো একটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তাকে সুনির্দিষ্টভাবে ওই কাজের কারণে মুনাফিক বলা যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ রয়েছে: (১) যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে ।(২) যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তখন তা ভঙ্গ করে। (৩) আর যখন তার উপর আমানত রাখা হয় তখন সে খিয়ানত করে।”এগুলো মুনাফিকদের লক্ষণ। তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেকোনো মুসলিমের মধ্যেও দেখা যেতে পারে। সুতরাং আমরা বলব, যে ব্যক্তি এ বৈশিষ্ট্যের কোনো একটি প্রদর্শন করেছে—সে শুধু ওই দিকেই মুনাফিক,পূর্ণাঙ্গ অর্থে নয়।”(ইবনু উসাইমীন; লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৩২/২১)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment