Wednesday, September 27, 2023

শরয়ী ইলম সংক্রান্ত কিছু জরুরী জ্ঞাতব্য বিষয়- আল্লাহ্‌র দিকে দাওয়াত

 

শরয়ী ইলম সংক্রান্ত কিছু জরুরী জ্ঞাতব্য বিষয়


আল্লাহ্‌র দিকে দাওয়াত
আল্লাহ্‌র দিকে দাওয়াত দেওয়া সর্বাধিক মহান, নৈকট্য অর্জনকারী বিষয়। এজন্যই এই কাজটি সম্পাদন করেছেন সৃষ্টির সেরা ব্যক্তিত্ব-তথা নবী-রাসূলগণ। আর ইহাই এই দাওয়াতের ফযীলতের প্রমাণ হিসাবে যথেষ্ট। কারণ আমরা সমগ্র মানুষকে জীবনের প্রকৃত দায়িত্বের দিকে আহ্বান করছি। আর তাহল যথাযথভাবে আল্লাহ তা’আলার দাসত্ব করা। মহান আল্লাহ এরশাদ করছেনঃ

(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْأِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ)[الذاريات:৫৬]
আমি জিন ও মানবজাতীকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমারই ইবাদত করার জন্যে। (আয্‌ যারিয়াতঃ৫৬)।
এজন্যই আল্লাহ এর বিনিময় স্বরূপ সুনির্দিষ্ট করেছেন মহান বিনিময়, অফুরন্ত প্রতিদান। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(لَأَنْ يَهْدِىَ اللهُ بِِكَ رَجُلاً وَاحِداً خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ) [رواه البخاري -كتاب المغازي৪২১০، ومسلم ুفضائل الصحابة ২৪০৬]
আল্লাহ যদি তোমার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকেও হেদায়াত দান করেন, তবে ইহাই তোমার জন্য লাল উট অপেক্ষা উত্তম (বুখারী,মাগাযী অধ্যায়,হা/৪২১০,মুসলিম,ফাযায়েলুছ্‌ ছাহাবাহ্‌ অধ্যায়,হা/২৪০৬)।
এই মহান পুরষ্কার এজন্যই যে, এই কাজটি অতীব গুরূত্বপূর্ণ। এজন্যই প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উচিত হল আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার মৌলিক নীতি জেনে নেওয়া এবং এবং এই উম্মতের পূর্বসূরীদের তরীক্বার অনুসরণ করা যাদের প্রধান হলেন ইসলামের প্রথম দাঈ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِداً وَمُبَشِّراً وَنَذِيراً (৪৫) وَدَاعِياً إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُنِيراً (৪৬))[الأحزاب]
হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসাবে, এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও প্রদীপ্ত প্রদীপ হিসাবে প্রেরণ করেছি। (আল্‌ আহ্‌যাব : ৪৫-৪৬)।
কারণ নবী ও তাঁর অনুসারীদের আল্লাহর পথে দাওয়াত ছিল জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ (১০৮)[ يوسف]
‘(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন ইহাই আমার পথ আমি ও আমার অনুসারীগণ আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে দাওয়াত দান করি। আমি আল্লাহ্‌র পবিত্রতা বর্ণনা করছি। এবং আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই। (ইউসুফঃ১০৮)।
আমরা আল্লাহ্‌র দিকে দাওয়াত দিব নিম্ন বর্ণিত কারণে:
১-আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসার এবং যমীনের বুকে তাঁর দাসত্ব বাস্তবায়ন করা
আর ইহা সম্পন্ন হবে উহার বিপরীত বিষয়গুলির অবসানের মাধ্যমে যেমন বিভিন্ন রকম কুফরী, সীমালংঘন, পাপাচার ও অবাধ্যতা প্রভৃতি।
২-উত্তম নমুনা তথা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করা
কারণ তিনি রাত ও দিনের বিভিন্ন অংশে দাওয়াত দিতেন। তিনি আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছেন যেমন করে ছিলেন তাঁর পূর্বেকার নবী ও রাসূলগণ। মহান আল্লাহ্‌ নূহ আলাইহিস্‌ সালাম এর বক্তব্য উল্লেখ করে বলেনঃ
قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلاً وَنَهَاراً (৫) فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائي إِلَّا فِرَاراً (৬) وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَاراً (৭) ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَاراً (৮) ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَاراً (৯)[نوح]
‘সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার জাতিকে রাতে এবং দিনে আহ্বান করেছি। কিন্তু আমার আহ্বান তাদের পলায়নই বৃদ্ধি করেছে মাত্র। আমি যতবারই তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, যাতে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, ততবারই তারা কানে আঙ্গুলি দিয়েছে, মুখমন্ডল বস্ত্রাবৃত করেছে, জেদ করেছে এবং খুব ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছে। অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি। অতঃপর আমি ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি এবং গোপনে চুপিসারে বলেছি। ( সূরা নূহ : ৫-৯)
নবী নূহ আলাইহিস্‌ সালাম অন্যান্য নবীগণের ন্যায় একজন নবী। তিনি তাঁর কওমকে সর্বসময়, সর্ব উপকরণ, পথ ও পদ্ধতি অবলম্বনে দাওয়াত দিয়েছেন। বরং তিনি বিনা বিরক্তি বিনা অবসাদে সুদীর্ঘ সাড়ে নয়শ’ বছর দাওয়াত দিয়েছেন। এজন্যই আমাদের বন্ধু নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নিম্নোক্ত ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে-
(ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ)[ النحل:১২৫].
‘আপানি আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বন করুন।’ ( সূরা আন নাহল:১২৫)।
(وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ إِنَّكَ لَعَلَى هُدىً مُسْتَقِيمٍ) [الحج:৬৭]
‘আর আপনি আপনার রবের দিকে আহ্বান করুন। নিশ্চয় আমি সঠিক হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।’ (সূরা আল হজ : ৬৭)
(وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ) [القصص:৮৭]
‘আর আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান করুন। আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকুন।’ (সূরা আল্‌ ক্বাছাছ : ৮৭)
তাইতো নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যুদম পর্যন্ত আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী হিসাবে কাটিয়েছেন। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেনঃ
(بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيةً)[ البخاري، كتاب الأنبياء، باب ما ذكر عن بني إسرائيل، حديث ৩৪৬১]
‘তোমরা আমার নিকট থেকে পৌঁছিয়ে দাও-তথা প্রচার কর, যদিও তা একটি আয়াতও হয়।’ (বুখারী, হা/৩৪৬১)।
৩-যদি আল্লাহর পথে দাওয়াত অব্যাহত না থাকে তবে কুফর ও শিরকের উপস্থিতি দ্রুত হোক বা বিলম্বে, এক সময় তা ইসলামের স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলবে এবং তার অনুসারীদেরকে হ্রাস করবে।
৪-মুসলিমদের থেকে ধ্বংস ও শাস্তি প্রতিহত করা:
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَاتَّقُوا فِتْنَةً لا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ) [الأنفال:২৫]
আর তোমরা এমন ফিৎনাহকে ভয় কর যা তোমাদের মধ্যেকার অত্যাচারীদেরকেই শুধু আপতিত করবে না। (বরং সকলকে তা গ্রাস করবে)। আর জেনে রেখ নিশ্চয় আল্লাহ্‌ হলেন কঠিন শাস্তিদানকারী। (সূরা আল্‌ আনফাল: ২৫)।
যায়নাব বিনতে জাহ্‌শ থেকে বর্ণিত,তিনি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ আমরা কি আমাদের মাঝে সৎকর্মশীলদের উপস্থিতি সত্ত্বেও ধ্বংস প্রাপ্ত হব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ অবশ্যই। যখন পাপাচার বৃদ্ধি পাবে। (মুসলিম,ফিৎনা-ফাসাদ অধ্যায়, হা/২৮৮০)।
৫-ইসলামের প্রতি মানুষের অতীব প্রয়োজনীয়তা
কারণ তাদেরকে গায়রুল্লাহর গোলামী ও দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রয়োজন। এবং তাঁর জটীল সমস্যা গুলির সমাধান ও তার অবস্থার সংশোধন প্রয়োজন। আর এসব সমস্যার সমাধান একমাত্র বিশুদ্ধ ইসলাম দ্বারাই সম্ভব। আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكاً)[طـه:১২৪]
‘যে আমার যিক্‌র-উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য অবশ্যই রয়েছে সংকীর্ণময় জীবন।’ (সূরা ত্বা-হা : ১২৪)।
৬-খৃষ্টানী ও ভ্রষ্টতার দাওয়াতের অপতৎপরাতার মুখে দাঁড়ানো যা সমগ্র পৃথিবীকে ধ্বংস করেছে এবং কতিপয় দুর্বলদের মনে নিজ ইসলাম ধর্ম বিষয়ে সংশয়ের ধুম্রজালে আবদ্ধ করে দিয়েছে।
৭-ধ্বংসকারী কতিপয় দর্শন যেমন ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, ধর্মহীনতা, জাতীয়তাবাদ, ধর্মহীন আধুনিকতা প্রভৃতির প্রসারতা রোধ করা।
৮-নিশ্চয় আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বান করা সর্বাধিক সম্মানিত দায়িত্ব। কারণ এরই মাঝে দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মান নিহিত রয়েছে।
আল্লাহ্‌র পথে দাওয়াত দেওয়ার বিধান কি? কার উপর এই দায়িত্ব বর্তায়?
আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী ওয়াজিব। কারণ মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ)[آل عمران:১০৪]
‘তোমাদের মাঝে এমন একটি দল হওয়া উচিত। যারা কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, আর ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে।’ (সূরা আলে ইমরানঃ১০৪)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেন:
(كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ)[آل عمران:১১০]
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের কল্যণের জন্য। তোমরা ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে।’ (আলে ইমরানঃ ১১০)।
তা ছাড়াও নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ)[مسلم].
তোমাদের কেউ কোন গর্হিত কাজ দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তাও না পারে তবে অন্তর দিয়ে প্রতিহত করবে। আর ইহা হল দুর্বলতম ঈমান। (মুসলিম,ঈমান অধ্যায়। হা/৪৯)।
উল্লেখ্য(ولتكن منكم) এর মধ্যেকার (من)টি তাবঈয তথা অংশ বিশেষ বুঝানোর জন্য এসেছে[১]। অথবা (الاستغراق) তথা ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য এসেছে। আল্লাহর বাণীঃ
(فاجتنبوا الرجس من الأوثان واجتنبوا قول الزور) এর মধ্যে (من) এর মতই এর ব্যবহার যা ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য এসেছে। এজন্যই অত্র আয়াত দ্বারা নির্দিষ্ট কোন জামা’আতের সাথে দাওয়াতের বিষয়টি খাছ করা যাবে না। বরং তা সকলের উপরই ওয়াজিব। বিষয়টির প্রমাণ স্বরূপ পূর্বের দলীলগুলো এবং প্রাগুক্ত আয়ত (ولتكن منكم) এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যথেষ্ট।
কতিপয় বিষয় যা দাওয়াত দাতার উপর লক্ষ্য রাখা ওয়াজিবঃ
১-ইলমঃ দাঈর উপর ওয়াজিব হল তিনি যার দিকে মানুষকে আহ্বান করবেন, সে বিষয়টি ও সম্পর্কে জ্ঞান সম্পন্ন হবেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ)
‘আপনি বলে দিন,ইহাই আমার পথ আমি আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে দাওয়াত দিয়ে থাকি।’ (সূরা ইউসুফঃ১০৮)।
আর ইলম মূলতঃ একটি মাত্র বস্তু নয় যা বিভাজন, বিভক্তি কবুল করে না। বরং এর অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন মাসআলাহ্‌ জানলো সে উক্ত মাসআলার আলেম। এজন্য তার উপর ওয়াজিব হল সেদিকে মানুষকে আহ্বান করা। অবশ্য তাকে যে বিষয়ের ইলম নেই সেই বিষয়ের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্বভার দেওয়া হয়নি।
প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ওয়াজিব হল সে তার জ্ঞান অনুযায়ী দাওয়াত দেবে। আর যে বিষয়ে তার জানা নেই সে বিষয়ে অযথা দায়িত্বভার নিতে যাবে না। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ) (৮৬) [سورة ص ].
‘বল, আমি তোমাদের নিকট এই দাওয়াতের উপর কোন বিনিময় চাইনা, এবং আমি লৌকিকতা প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সূরা ছাদ : ৮৬)
আর যদি আমরা দাওয়াতকে শুধু মাত্র বিজ্ঞ আলেমদের মাঝেই সীমিত করে দেই, আর অন্যদের জন্য এ দাওয়াত নাজায়েয বলি, তাহলে আমাদের নিকট অতি অল্প সংখ্যক দাঈ টিকবে যা উল্লেখযোগ্য নয়। তখন বতিল ও গর্হিত কাজ প্রচার ও প্রসারতা লাভ করবে।
অনুরূপভাবে দাঈদের কর্তব্য হল উলামায়ে দ্বীন থেকে উপকৃত হওয়া। তাদের মতামত, বই-পুস্তক প্রভৃতি থেকে আলো গ্রহণ করা।
২-দাঈর উপর ওয়াজিব হল সর্ব সময় সর্বাবস্থায় দাওয়াত করা:
আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া, ছালাত, ছিয়াম ও হজ প্রভৃতির মত নিদির্ষ্ট সময়-কালের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। যা থেকে আগে-পিছে করা যাবে না, এমন নয়[২]।
নূহ্‌ আলাইহিস্‌ সালাম তাঁর জাতীকে রাতে, দিনে, প্রকাশ্যে, অপ্রকাশে সর্বাবস্থায় দাওয়াত দিয়েছেন। অনুরূপভাবে ইউসুফ আলাইহিস্‌ সালাম জেল খানাকে দাওয়াতের ক্ষেত্র ভূমিতে পরিবর্তিত করে দিয়ে ছিলেন। জেলে থাকার বিষয়টিকে তিনি দাওয়াতী কর্ম থেকে বিরত থাকার ওযর হিসাবে পেশ করেননি।
অতএব, একজন মুসলিম সে নিজ ঘরে, কর্মস্থলে, বাজারে, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে, নিজ আচার আচরণে, মানুষের সাথে লেন-দেন করার ক্ষেত্রে, সফরে, মুকীম অবস্থায় তথা প্রত্যেকটি অবস্থায় ও প্রতিটি মুহূর্তে দাওয়াতদানকারী হিসাবে ভূমিকা পালন করবে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ)[الأنعام:১৬২]
‘নিশ্চয় আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মরণ সবই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত।’ (সূরা আল্‌ আন’আম : ১৬২)।
নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘তুমি যেখানেই থাকনা কেন, আল্লাহ্‌-কে ভয় করবে। (তিরমিযী, কিতাবুল বির ওয়াছ্‌ ছিলাহ্‌,হা/১৯৮৭)।
৩-এটা শর্ত নয় যে দাঈর কথা মানুষ মেনে নেবে
মহান আল্লাহ্‌ বলেন:
(وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلاغُ الْمُبِينُ)[النور:৫৪،العنكبوت:১৮]
‘রাসূলের উপর স্পষ্টভাবে পৌঁছানো ছাড়া আর কোন দায়িত্ব নেই।’ (সূরা আল্‌ আনকাবূতঃ১৮)
একজন দাওয়াত-কর্মীর কর্তব্য হল, সে নিজ দাওয়াতী কর্মে নিয়োজিত থাকবে। যদিও তার কথা কেউ না মানে, না শুনে। কারণ, মূল উদ্দেশ্য হল প্রকাশ্যভাবে পৌঁছিয়ে দেওয়া। দাওয়াতকৃত ব্যক্তিদের সাড়া দেওয়া দাঈর জন্য আবশ্যক নয়। অতএব তার উচিত নিজ ওয়াজিব দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে বিরক্তি বোধ, ক্লান্তি, অবসাদ কিছুই যেন তাকে না পায়। নিজ দাওয়াতী কাজ নিয়মিত আদায় করা অন্যান্য ইবাদতগুলি নিয়মিত আদায় করার মত। ইহাই আল্লাহ্‌র নবী ও রাসূলগনের আদর্শ।
যেমন নূহ আলাইহিস্‌ সালাম নিজ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নিকট সাড়ে নয়শ’ বছর পর্যন্ত দাওয়াত দিতে থেকেছেন অথচ তাঁর আহবানে অল্প কিছু লোকই ঈমান এনেছিল। বরং কোন কোন নবী যুগের পর যুগ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে দাওয়াত দিতে থেকেছেন এরপরও তাঁদের দাওয়াতে একজনও ঈমান আনেনি। ইমাম নববী (রহ.) ছহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় বলেনঃ শরীয়ত বলবৎ হয়েছে এরূপ ব্যক্তি থেকে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার দায়িত্ব রহিত হবে না। এই ধারনা করা যাবে না যে তার এই আদেশ নিষেধ কোন উপকারে আসবে না। বরং এরপরও আদেশ নিষেধ করা তার জন্য ওয়াজিব। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ)[الذاريات:৫৫]
‘আপনি উপদেশ দিন, কারণ ওয়ায-উপদেশ মুমিনদের উপকার দেয়। ‘ ( সূরা আয্‌ যারিয়াত: ৫৫)। কারণ তার উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে তাহল এই যে, সে তার দাওয়াতী কাজ বিরতিহীনভাবে চালিয়ে যাবে। আদেশ ও নিষেধ কবুল করানো তার দায়িত্ব নয়। (ছহীহ মুসলিম ইমাম নববীর ব্যাখ্যাসহ)।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
(وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْماً اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَاباً شَدِيداً قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ)[الأعراف:১৬৪]
তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক বলল, কেন তোমরা এমন লোকদেরকে উপদেশ দিচ্ছ, যাদেরকে আল্লাহ্‌ ধ্বংস করবেন বা কঠিন শাস্তি দেবেন? তারা জবাবে বলল, এটা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দায়মুক্তি স্বরূপ। আর হতে পারে তারা আল্লাহকে ভয় করবে। (সূরা আল্‌ আরাফঃ১৬৪)।
দাওয়াতী কর্ম চালিয়ে যাওয়ার পিছনে ইহাই হল মূল কারণ, যদিও কোন প্রতিফল দেখা না যায়। কারণ অন্তরসমূহ তো রহমান-দয়াময় আল্লাহর দুটি আঙ্গুলের মধ্যে রয়েছে। তিনি যেভাবে চান তা পরিবর্তন করেন। সুতরাং আজ যে দাওয়াতে প্রভাবিত হয়নি, হতে পারে আগামীকাল সে দাওয়াতে প্রভাবিত হবে। এই তো সেই খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ, আবু সুফয়ান ইবনু হারব এবং হিন্দাহ বিনতে ওতবাহ যাঁরা রাসূল(ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো, কিন্তু পরবর্তীতে তারাই তাঁর ধর্মের পথে দাওয়াতদানকারী বনে গিয়ে ছিলো। যদি দাওয়াতী কাজ তাদের থেকে মওকূফ রাখা হত আর তাদের কে পূর্ব পৌঁছনো দাওয়াতের কারণে আর দাওয়াত না দেওয়া হত তাহলে তাদের শেষ পরিণতি বড্ড খারাপ হত।
৪-দাওয়াত দানকৃত ব্যক্তির উপর দয়া-মায়া প্রদর্শনঃ
নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণের বিষয়ে ন্যায়ের আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ, আল্লাহর পথে জিহাদ, তাঁর পথে দাওয়াত দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে অত্যন্ত লালায়িত ছিলেন। ইহা সত্ত্বেও তিনি তাঁর উম্মতের উপর সর্বাধিক দয়া-মায়া প্রদর্শন কারী ছিলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَؤُوفٌ رَحِيمٌ)[التوبة:১২৮]
নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদেরই মধ্য থেকেই এসেছেন একজন রাসূল। তোমাদের কষ্টদানকারীবস্তু তাকেও কষ্ট দেয়। তিনি তোমাদের (কল্যাণ দান করার) জন্য লালায়িত, মুমিনদের জন্য করূণাকারী ও দয়ালু। (সূরা আত্‌ তাওবাহ:১২৮)
বরং তিনি তাঁর উম্মতের ক্ষেত্রে কিরূপ কল্যাণ পৌঁছানোর জন্য লালায়িত তা তিনি নিজেই চিত্রায়িত করে বলেনঃ
(إِنَّمَا مَثَلِى وَمَثَلُ أُمَّتِى كَمَثَلِ رَجُلٍ اسْتَوْقَدَ نَارًا فَجَعَلَتِ الدَّوَابُّ وَالْفَرَاشُ يَقَعْنَ فِيهِ فَأَنَا آخِذٌ بِحُجَزِكُمْ وَأَنْتُمْ تَقَحَّمُونَ فِيهِ)[رواه مسلم كتاب الفضائل، باب شفقته صلى الله عليه وسلم على أمته…رقم الحديث ১৭].
আমার উদাহরণ ও আমার উম্মতের উদাহরণ হল ঐব্যক্তির ন্যায় যে আগুন প্রজ্জলিত করল, তা দেখে কীট-পতঙ্গ তাতে পড়তে শুরূ করে দিল। সুতরাং আমি তোমাদের কোমর ধারণকারী (যাতে আগুনে না পতিত হও) অথচ তোমরা তাতেই পতিত হচ্ছ। (সহীহ মুসলিম,ফাযায়েল অধ্যায়,হা/১৭)।
অতএব একজন দাঈর উচিত দাওয়াতের পিছনে প্রকৃত উদ্বুদ্ধকারী বিষয় যেন হয় পাপাচারীদের উপর মন্দ পরিণতির ভয় করা। এজন্যই তো নূহ্‌ আলাইহিস্‌ সালাম তাঁর দাওয়াতের অন্যতম কারণ হিসাবে প্রকাশ করেছেন নিজ কওমের উপর তার ভয়-ভীতি। মহান আল্লাহ্‌ তাঁর কথা উদ্ধৃত করে বলেনঃ
(إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ)[الأعراف:৫৯]
‘নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর এক মহান দিনের আযাবের ভয় করছি।’ (সূরা আল্‌ আরাফ : ৫৯)
আর এই তো সেই ফিরআউন বংশের মুমিন ব্যক্তিটি যিনি তার কওমকে লক্ষ্য করে বলেনঃ
(يَا قَوْمِ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ مِثْلَ يَوْمِ الْأَحْزَابِ)[غافر:৩০].
‘হে আমার জাতি! নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর পূর্ববতী সম্প্রদায়সমূহের মতই বিপদ সঙ্কুল দিনের আশংকা করছি।’ (সূরা আল গাফির-মুমিন : ৩০)।
তিনি আরও বলেনঃ
(وَيَا قَوْمِ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ يَوْمَ التَّنَادِ)[غافر:৩২]
‘হে আমার জাতি! আমি তোমাদের জন্যে প্রচন্ড হাঁক-ডাকের দিনের তথা মহাপ্রলয় দিবসের আশংকা করছি।’ (সূরা আল গাফের-মুমিন : ৩২)।
দাঈর কর্তব্য হল তিনি মনে করবেন যে, তিনি রোগীদের সাথে লেন-দেন করছেন। আর রোগীরা এমন হৃদয়ের মুখাপেক্ষী যা হয় দয়ালু ও রহমকারী। সুতরাং তারা রূহানী রোগীদের সাথে ঐরূপ আচরণ করবেন যেরূপ আচরণ করে থাকেন ডাক্তারগণ বাহ্যিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের সাথে। অধিকাংশ পাপাচারীই উপলদ্ধি করতে পারে না ঐসব পাপের ভয়াবহতা যাতে তারা লিপ্ত। কাজেই দাওয়াত-কর্মীদের কর্তব্য হল ঐসব পাপাচারীদের ভুল সংশোধনকালীন নরমতা, হিকমত, ধির-স্থিরতা অবলম্বন করা। ইহাই হল মূলতঃ আল্লাহভীরু ওলামায়ে দ্বীনের আদর্শ পদ্ধতি। এজন্যই মহান আল্লাহ্‌ তাঁর নবী মূসা ও হারূনকে নির্দেশ করে ছিলেন সহজ ও নরম কথা ব্যবহার করার, তাও আবার এমন ব্যক্তির সাথে যে হল এই যমীনের উপর সর্বাধিক বড় ত্বাগুত। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(فَقُولا لَهُ قَوْلاً لَيِّناً)[طـه:৪৪]
‘তোমরা তাকে নরম কথা বল।’ ( সূরা ত্বা-হা : ৪৪)।
অতএব যদি ফিরাউন তার সীমালংঘন ঔদ্ধত্য, প্রভূ হওয়ার দাবী করা, এবং মানুষকে নিজের ইবাদত করার দিকে আহ্বান করা সত্ত্বেও যদি তার সাথে নরম ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়, তাহলে তো সে ব্যতীত অন্যান্য ফাসেক ও পাপাচারী এ বিষয়ে আরোও বেশী হকদার। অবশ্য এসব কথা থেকে যেন কোন ব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাড়াহুড়া প্রিয় ব্যক্তি একথা বুঝে না নেয় যে, এরূপ আচরণ পাপাচারী-অপরাধকারীদের সাথে শিথিলতা করা বুঝায়। বরং ইহাই প্রকৃত হিকমত।
আর দ্বীনের ব্যাপারে শিথিলতা হল, পাপাচারী ব্যক্তিদের ভুল-ভ্রান্তি থেকে চোখ বন্ধ করে রাখা, তাদেরকে ওয়ায-উপদেশ, সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দেওয়া থেকে বিরত থাকা, আর এর উদ্দেশ্য হবে ঐসব পাপাচারী ব্যক্তির থেকে দুনিয়াবী কোন সুবিধা অর্জন করা।
দাঈর উচিত হল যে সে রূঢ়তা, কঠোরতা থেকে দূরে থাকবে এবং তাদের ভুল সংশোধন করার সময় রেগে যাওয়া থেকে দূরে থাকবে। এই বিশ্বাসে তাদের উপর রেগে যাবে না যে আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যেই তার এই ক্রোধ। বস্তুত যারই এসব চিন্তা-ধারা হবে সেই সঠিক পথ থেকে বহু দূরে অবস্থান করবে। তাড়াতাড়ি ফল পেতে চেয়ে সে সুফল থেকে সে বঞ্চিত হবে। মহান আল্লাহ্‌ -তাঁর নবী মুহাম্মাদ-ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে এরশাদ করেনঃ
(وَلَوْ كُنْتَ فَظّاً غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ)[آل عمران:১৫৯]
‘যদি আপনি কঠোর ও রূঢ় হৃদয়ের হতেন, তবে তারা আপনার চতুর্পাশ থেকে ভেগে যেত।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)।
তবে আল্লাহর দিনের জন্য রাগ করা ও বদলা গ্রহণ করা অবশ্যই বৈধ। তবে এটি হবে দাওয়াত কৃত ব্যক্তির স্তরের উপর নির্ভরশীল। কাজেই একজন কাফের ও ফাসেকের সাথে যেরূপ আচরণ করা হয় তদ্রূপ আচরণ একজন মুসলিমের সাথে হবে না যে মুসলিম ব্যক্তিটি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত যার ক্ষেত্রে আমরা ভেগে যাওয়ার আশংকা করি না। এবং আমরা যার অন্তরে ঈমান কিরূপ প্রবেশ করেছে মর্মে জানি। এক কথায় প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তার অবস্থাভেদে আচরণ করতে হবে।
অনুরূপভাবে দাঈর উচিত পাপাচারীদের ভুল সংশোধন করতে গিয়ে ইশারাহ্‌ ইঙ্গিত ব্যবহার করা। অতএব তিনি তাদের বিষয়টি প্রকাশ করে দেবেন না, তাদেরকে জনসমুদ্রে অপমান করবেন না। বরং তাঁর উচিত এইভাবে বলাঃ ‘লোকদের কি হয়েছে তারা এরূপ এরূপ করছে? এই পদ্ধতির মাধ্যমেই তিনি উদ্দেশ্যকৃত খাছ ব্যক্তিদেরকে সতর্ক করে দিলেন, জাহেলদেরকে শিক্ষা দিলেন। এভাবে তার উদ্দেশ্য হাছিল হয়ে গেল অথচ ভুলকারীর কোন অসুবিধা হল না। এটা মূলতঃ আল্লাহর নবী-রাসূল আলাইহিমুস্‌ সালামদের কর্ম- পদ্ধতি। অতএব (হে দাঈ!) আপনি এই পদ্ধতি থেকে আঙ্গুলের পৌর বরাবরও দূরে সরবেন না। আপনাকে যেন এমন ব্যক্তি ধোঁকায় না ফেলে দেয় যে এই নববী তরীকার বিরোধিতা করে বা তা থেকে পথচ্যূত হয়েছে।
৫-দাওয়াতদাতা মানুষদের নিকট দাওয়াতের কোন বিনিময় তালাশ করবেন না, তাদের প্রশংসা, তাদের তরফ থেকে মর্যাদা আশা করবেন না।
বস্তুত দাওয়াত হল অন্যান্য ইবাদতের মত একটি মহান ইবাদত যা থেকে একমাত্র খাঁটি ইবাদতটিই গ্রহণ করা হবে। আর এই ইবাদতের উপর একমাত্র মুখলিছ ব্যক্তিকেই নেকী দান করা হবে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لا يُبْخَسُونَ)[هود:১৫]
‘যে ব্যক্তি এই পার্থিব্য জীবন ও তার চাক-চিক্যতা চাইবে আমি তাদেরকে এই দুনিয়াতেই তাদের আমলের বিনিময় পুরাপুরিভাবে প্রদান করব। এখানে তাদেরকে তা কম করে দেওয়া হবে না। (সূরা হূদঃ১৫)।
এজন্যই তো শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌ হাব রহ. তার মহান কিতাব-আত তাওহীদে একটি অধ্যায় এভাবে রচনা করেছেন।
‘অধ্যায়ঃ ব্যক্তির আমল দ্বারা দুনিয়া লাভের ইচ্ছা করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত’
এই অধ্যায়ে তিনি মহান আল্লাহর এই আয়াতটি দলীল স্বরূপ উল্লেখ করেছেন।
(مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لا يُبْخَسُونَ (১৫) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (১৬))[هود:১৫-১৬]
‘যে ব্যক্তি এই পার্থিব্য জীবন ও তার চাক-চিক্যতা চাইবে আমি তাদেরকে এই দুনিয়াতেই তাদের আমলের বিনিময় পুরাপুরিভাবে প্রদান করব। এখানে তাদেরকে তা কম করে দেওয়া হবে না। এরাই হল তারা যাদের জন্য আখেরাতে জাহান্নামের আগুন বৈ আর কিছুই নেই। তারা যা কিছু কর্ম করে ছিল দুনিয়াতে তা সবই বরবাদ হয়ে গেছে। তারা যা কিছু আমল করত তার সবই বাতিল বলে গণ্য। (সূরা হূদ : ১৫-১৬)।
এজন্যই দাঈর কর্তব্য হল, সে মানুষের নিকট তার দাওয়াতের কোন বিনিময় আশা করবে না। আর তার উদ্দেশ্যও দৃঢ় ইচ্ছা যেন না হয় মানুষদের প্রশংসা, তাদের পক্ষ থেকে সম্মান গ্রহণ, তাদের থেকে নিজকে আলাদা ভাবা এবং সম্মানের প্রাচীরদ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়া। যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এমন হবে সে তার দাওয়াতের বিনিময় থেকে বঞ্চিত হবে, আল্লাহর আযাবের হকদার হবে। কারণ সে এর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে শিরক করে বসেছে।
নবী ও রাসূল আলাইহিমুস্‌ সালাম গণ এই তরীকা স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন। তারা মানুষদের থেকে দাওয়াতের পারিশ্রমিক হিসাবে কোন বিনিময় বা শুকরিয়া কামনা করতেন না। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُمْ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ)[يونس:৭২]
‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে মনে রেখ। আমি কিন্তু তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চাইনি, আমার বিনিময় তো আল্লাহর কাছেই রয়েছে।’ (সূরা ইউনুস : ৭২)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(قُلْ لا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْراً إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى وَمَنْ يَقْتَرِفْ حَسَنَةً نَزِدْ لَهُ فِيهَا حُسْناً إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ شَكُورٌ)[الشورى:২৩]
‘আপনি বলে দিন আমি আমার দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে কেবল আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ চাই। যে কেউ উত্তম কাজ করে আমি তার জন্য তাতে পুণ্য বাড়িয়ে দেই। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ক্ষমাকারী, গুণগ্রাহী। (সূরা আশ্‌ শুরা : ২৩)।
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(وَجَاءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَا قَوْمِ اتَّبِعُوا الْمُرْسَلِينَ . اتَّبِعُوا مَنْ لا يَسْأَلُكُمْ أَجْراً وَهُمْ مُهْتَدُونَ)[يس:২০-২১]
‘আর শহরের দূরতম প্রান্ত থেকে জনৈক ব্যক্তি দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল : হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা এই রাসূলদের আনুগত্য কর। এমন ব্যক্তিদের আনুগত্য কর, যারা তোমাদের নিকট কোন কোন প্রকার বিনিময় চান না। উপরোন্তু তাঁরা হেদায়াত প্রাপ্ত। (সূরা ইয়া-সীন : ২০-২১)।
নিশ্চয় দাওয়াতের বিনিময়ে মানুষদের নিকট প্রশংসা, তাদের ধন-সম্পদ প্রভৃতি তলব করা মারাত্মক পদস্খলন। কাজেই দাওয়াত দানকারীকে এরূপ পদস্খলনে পতিত হওয়ার পূর্বে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। আর সে বিষয়ে হাজারো বার হিসাব করতে হবে। অতএব তিনি একমাত্র আল্লাহর নিকটেই দাওয়াতের বিনিময় আশা করবেন। অবশ্য দাঈদের জন্য বেতন ও সম্মানী হিসাবে যা ধার্য করা হয় তা তাদেরকে দাওয়াতী কাজের লক্ষ্যে অন্য কাজ থেকে অবসর দেওয়ার জন্যই দেওয়া হয়। এটা বদলা বা পারিশ্রমিক নয়।
৬-দাঈ, দাওয়াতকৃত ব্যক্তিকে তুচ্ছ মনে করবেন না, যদিও সে দুর্বল বা দরিদ্র হয়ে থাকে :
নিশ্চয় দাওয়াতদানকারীর দায়িত্ব হল মানুষদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা এবং মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে মানুষের প্রতিপালকের দাসত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং যেরূপ আমরা ধনী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের উপর জাহান্নামের আগুন ও তার ভয়াবহতার ভয় করি তদ্রূপ আমরা দরিদ্র ও দুর্বলদের ক্ষেত্রেও ভয় করি। কারণ তারাও অনুরূপ এমন ব্যক্তির মুখাপেক্ষী যে তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাবে এবং মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ইবাদতের প্রতি তাদেরকে দিক নির্দেশনা করবে। দাঈর কর্তব্য হল ইহাই যে, তিনি আরবী ও আজমীর মধ্যে, কালো, সাদা, সম্মানিত ও নীচু ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য করবেন না। অতএব যেভাবে তিনি ক্ষমতাসীন ও সমাজের গণ্যমানদের সাথে নম্রতা ও হিকমতের সাথে কথা বলবেন ঠিক তদ্রূপ আচরণ করবেন অন্যান্য সকল প্রকার মানুষের সাথে। কারণ তারা সকলে আল্লাহর নিকট বরাবর তাদের কেউ কারও থেকে বেশী ফযীলত মন্ডিত হবে না বংশ মর্যাদার কারণে। বরং মর্যাদা নির্ণিত হবে কেবল তাক্বওয়া-পরহেযগারির ভিত্তিতে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ)[الحجرات:১৩]
‘নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে যে বেশী আল্লাহ্‌ভীরু সেই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত।’ (সূরা আল্‌ হুজুরাত : ১৩)।
নিশ্চয় দাঈ কোন কোন সময় ক্ষমতাসীন মহল ও সমাজের মান্যগণ্য থেকে নয় বরং দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীর মাধ্যমে দুঃখ- কষ্টের স্বীকার হতে পারে। বস্তুত এটা তার উপর এক প্রকার কষ্ট বটে। এ ক্ষেত্রে তার উচিত তা সহ্য করে নেওয়া। কারণ স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নেতৃস্থানীয় লোকদের পক্ষ থেকে কষ্ট-ক্লেশের শিকার হয়েছেন যেমন আবুজাহল্‌ প্রমুখ। আবার নিম্নমানের লোকদের মাধ্যমেও কষ্টের শিকার হয়েছেন। যেমনটি তাঁর তায়েফে যাওয়ার প্রাক্কালে ঘটেছিল। বরং ইসলামের পতাকা উর্ধ্বমুখী ও তার অনুসারীদের শক্তিশালী ও নিজ রাষ্ট্রীয় শক্তি পুষ্ট হওয়ার পরও তিনি এমন এমন আরব্য বেদুঈন দ্বারা কষ্ট পেয়েছেন যারা দুনিয়ার কোন কিছুরই মালিক ছিল না। বস্তুত এগুলো সবই পরীক্ষার বিভিন্ন চিত্র যদিও এগুলোর উৎস বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন প্রকৃতির। অতএব দাঈর কর্তব্য হল সমস্ত প্রকার দু:খ্য-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা। তার উচিত দাওয়াতকৃত ব্যক্তিদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, বিরক্তি প্রভৃতির উপর ধৈর্য ধারণ করা। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ)[لقمان:১৭]
‘আর তুমি ন্যায়ের আদেশ কর, অন্যায় থেকে নিষেধ কর, আর তোমার নিকট (দু:খ-কষ্ট হতে) যা পৌছে থাকে তাতে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয় ইহা সুদৃঢ় বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত। ‘(সূরা লোক্বমান : ১৭)
৭-দাঈর উচিত তিনি যেন সর্বদা বিনয় নম্রতা অবলম্বন করেনঃ
আর আল্লাহর পথে দাওয়াতদানকারীর ক্ষেত্রে বিনয় গুণটি একান্তই কাম্য। তার উচিত মানুষের সাথে লেনদেন করতে যেয়ে নিজেকে সুউচ্চ মনে না করা এবং তাদের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা ও চরম মূর্খতার জন্য তাদেরকে অবহেলা না করা। বস্তুত অহংকার, আর মহানত্ব -বড়ত্ব প্রকাশ করা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও জন্যে বৈধ নয়। অতএব এই খাছ বস্তুদ্বয়ে যে তাঁর প্রতিপালকের সাথে শরীক হতে চাইবে সে অবশ্যই আযাব ও শাস্তির অধিকারী বলে বিবেচিত হবে। আর দাঈ যতই বিনয়ীতা অবলম্বন করবেন তাঁর দাওয়াত ততই বেশী গ্রহণীয় হবে এবং তাঁর তরীকা ও আচরণের প্রভাব মানুষের উপর তত বেশী পড়বে। বস্তুত যে বিনয়ীতা অবলম্বন করে আল্লাহ্‌ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।
৮-দাঈর উচিত যে তিনি নিজ আত্মার কোন প্রকার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন না :
দাঈর ইহাই উচিত যে নিজেকে ব্যস্ত করবেন না ঐ ব্যক্তির প্রতিবাদ করতে যেয়ে যে তার সমালোচনা করেছে বা তার কর্মের ভুল ধরেছে। তাঁর উচিত এই আস্থা রাখা যে নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিহত করবেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا) [الحج:৩৮]
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঈমানদারদের পক্ষ হতে প্রতিহত করে থাকেন।’ (সূরা আল হজ : ৩৮)
নিশ্চয় একজন দাঈ মানুষের পক্ষ থেকে দুঃখ্য-কষ্টের, তাদের পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধের শিকার হতে পারে। এবং এরূপ হবেই হবে। সুতরাং যদি কোন দাঈ নিজের পক্ষ থেকে প্রতিহত করতে থাকে, নিজ প্রতিপক্ষদের ঝগড়া-বিবাদের ঢেউ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা চালায় তাহলে তার সময় নষ্ট হবে। এতে তার মান-মর্যাদা কমে যাবে।
সুতরাং তার এই অগাধ বিশ্বাস থাকা দরকার যে আল্লাহই তার প্রতিপক্ষদেরকে অপমানিত করবেন এবং তার দুশমনদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।
মহান বলেনঃ
(إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُومُ الْأَشْهَادُ)[غافر:৫১]
‘নিশ্চয় আমি আমার রাসূল ও ঈমানদারদেরকে এই দুনিয়ায় সাহায্য করব, এবং সে দিবসেও করব যে দিন সকল সাক্ষ্যদাতাগণ দন্ডায়মান হবে।’ (সূরা আল গাফির-মুমিন : ৫১)
ইবনু কাছীর রহ. বলেনঃ অত্র আয়াতে সাহায্য বলতে তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা বুঝানো হয়েছে যারা তাদেরকে কষ্ট দিয়ে থাকে। হতে পারে এই প্রতিশোধ তাদের উপস্থিতিতে হবে অথবা তাদের অবর্তমানে তাদের মরণোত্তর হবে। যেমনটি আল্লাহ্‌ ইয়াহয়া ও যাকারিয়্যা আলাইহিমাস্‌ সালামদের হত্যাকারীদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
দাওয়াত-কর্মীর উচিত আল্লাহর উপর গভীরভাবে আস্থা রাখা। কারণ যাকে আল্লাহর পথে কষ্ট দেওয়া হয় আল্লাহ্‌ এমন ব্যক্তিকে কখনই সাহায্যহীন অবস্থায় ছেড়ে দেবেন না। অবশ্য প্রাগুক্ত বিষয় থেকে দাঈর এরূপ প্রতিবাদ অবশ্যই স্বতন্ত্র হবে যে প্রতিবাদ শরীয়াতের মৌলিক বিষয়ের, দ্বীনী বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হবে। এক্ষেত্রে দাঈর প্রতিপক্ষরা তার সমালোচনা করলেও তার কথা ভিন্ন অন্য কথার ইখতেলাফ যাহের করলে তার উপর ওয়াজিব হয়ে যাবে বিষয়টি খুলে ব্যাখ্যা করা। অবশ্যই এটা অপরিহার্য কর্তব্য। তবে এর পরও দাঈ নিজের ব্যক্তিস্বার্থে কোন প্রতিশোধ নেবে না। সে নিজের স্বার্থে জন্য ক্রোধ প্রকাশ করবে না। এবং যে সব কথায় কোন ফায়েদা-উপকার নেই সেসব কথা থেকে বিরত থাকবে।
৯-দাঈর উচিত ধৈর্য ধারণ করা :
অতএব নিজ দাওয়াতের ফল বিলম্বিত হওয়ার জন্য কোন প্রকার পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার জন্য তার সুদৃঢ় ইচ্ছা-পরিকল্পনা যেন ভেঙ্গে না যায়। কারণ তিনিই তো অন্যদের চেয়েও বেশী বেশী পরীক্ষা, কষ্ট-ক্লেশের শিকার হবেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَأِ الْمُرْسَلِينَ)[الأنعام:৩৪]
‘আর নিশ্চয়ই তোমার পূর্বেও রাসূলদেরকে মিথ্যা পতিপন্ন করা হয়েছে। তারা এতে ধৈর্য ধারণ করেছেন। তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছা পর্যন্ত তাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন। আল্লাহর বাণী কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। আর নিশ্চয়ই আপনার কাছে বিগত রাসূলদের খবর পৌঁছেছে। (সূরা আল্‌ আন’আম : ৩৪)
দাঈর উচিত হল ইহাই যে, তিনি কষ্ট-তকলীফ প্রভৃতির কারণ দু:চিন্তাগ্রস্ত হবেন না। মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ (৯৭) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ (৯৮) وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ (৯৯) [الحجر]
‘(হে নবী!) নিশ্চয় আমি জানি যে তাদের কথায় আপনার বক্ষ-হৃদয় সংকীর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং আপনি নিজ প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ করুন, এবং সাজদাহ্‌কারীদের মধ্যে শামিল হয়ে যান। আর আপনার নিকট মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত নিজ প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকুন। (সূরা আল্‌ হিজর : ৯৭-৯৯)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ)[لقمان:১৭]
‘আর তোমার নিকট (দুঃখ-কষ্ট হতে) যা পৌঁছে থাকে তাতে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয় ইহা সুদৃঢ় বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত। (সূরা লোক্বমান : ১৭)।
অবশ্য এসব কথার অর্থ এমনটি নয় যে, দাওয়াত-কর্মী শুধু মাত্র ফিৎনা-ফাসাদের জায়গায় পতিত হবেন, আর পরীক্ষার স্থানগুলি তালাশ করে বেড়াবেন। আর নিজেকে পরীক্ষার সম্মুখীন করবেন এই ধারণায় যে, তার দাওয়াত এরূপ করণ ছাড়া বিশুদ্ধ হবে না। বরং তাঁর উচিত হবে, তিনি দুশমনদের সাক্ষাৎ কামনা করবেন না। বরং আল্লাহ্‌র কাছে নিরাপত্তা চাইবেন। এজন্যই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে তিনি বলেছেনঃ
لا يَنْبَغِي لِمُسلِمٍ أَنْ يَذِلَّ نَفْسَهُ. قَالُوْا: وَكَيْفَ يَذِلُّ نَفْسَهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ:يَتَحَمَّلُ مِنَ الْبَلاءِ مَا لا يُطِيقُهُ) [أخرجه ابن ماجة وحسنه الألباني رحمه الله في صحيح ابن ماجة ৩২৫৯].
‘কোন মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় নিজেকে লাঞ্ছিত করা। তাঁরা (ছাহাবায়ে কিরাম) প্রশ্ন করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে সে নিজেকে লাঞ্ছিত করতে পারে? তিনি বললেন: এমন বিপদাপদ গ্রহণ করবে যা বরদাশত করার ক্ষমতা সে রাখে না।’ (তিরমিযী,ইবনু মাজাহ্‌,আলবানী রহ.হাদীছটিকে তাঁর ছহীহ ইবনু মাজায় ৩২৫৯ হাসান বলেছেন)।
নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ
(لَا تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ وَسَلُوا اللَّهَ الْعَافِيَةَ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا)[أخرجه البخاري في كتاب الجهاد، باب رقم لا تتمنوا لقاء العدو৩০২৫]
তোমরা দুশমনের সাথে সাক্ষাতের আকাংখা করবে না। আর আল্লাহ্‌র কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করবে। তবে যখন তাদের সাথে (অনিচ্ছা সত্ত্বেও) সাক্ষাৎ হয়ে যাবে তখন ধৈর্য ধারণ করবে। (সহীহ বুখারী, জিহাদ অধ্যায়,হা/৩০২৫)।
১০-দাঈর উচিত দাওয়াতকৃত ও শ্রোতা ব্যক্তিদের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা:
আল্লাহ্‌ নবীদেরকে তাদের স্বজাতি থেকে বরং তাদের বংশ থেকে নির্বাচন করেছেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(كَذَّبَتْ قَوْمُ نُوحٍ الْمُرْسَلِينَ . إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ نُوحٌ أَلا تَتَّقُونَ) [الشعراء১০৫- ১০৬]
‘নূহের সম্প্রদায় রাসূলদেরকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছে। যখন তাদেরকে তাদেরই ভাই নূহ্‌ বললেন: তোমরা কি ভয় করবে না? (সূরা আশ্‌ শু’আরা : ১০৫-১০৬)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ هُودٌ أَلا تَتَّقُونَ) [الشعراء: ১২৪]
‘যখন তাদেরকে তাদের ভাই হূদ বললেনঃ তোমরা কি ভয় করবে না? (সূরা আশ্‌ শু’আরা :১২৪)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ صَالِحٌ أَلا تَتَّقُونَ) [الشعراء: ১৪২]
‘যখন তাদেরকে তাদের ভাই ছালেহ বললেন: তোমরা কি ভয় করবে না?’ (সূরা আশ্‌ শু’আরাঃ১৪২)
অনুরূপভাবে আল্লাহ্‌ নবীদেরকে এমন এমন মুজিযাহ্‌ -অলৌকিক বিষয়- দান করে শক্তিশালী করেছেন যা তাদের কওমের নিকট পরিচিত বিষয় এবং যা দ্বারা তারা অন্যদের উপর বিশেষত্ব অর্জন করেছেন। আল্লাহ্‌ নবীদেরকে মুজিযাহ্‌-অলৌকিক বিষয় ও নবুওতের দলীল দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। সে কারণে তারা জানতে পেরেছে যে, এগুলো মানবরচিত নয়।
ঈসা আলাইহিস্‌ সালাম এর কওম ডাক্তারী বিদ্যায় প্রসিদ্ধি লাভ করে ছিল বলে ঈসা আলাইহিস্‌ সালাম এর মুজিযা ছিল ডাক্তারী সংক্রান্ত তথা মৃতদেরকে জীবিত করণ। কুরাইশরা বক্তৃতা, বাগ্মিতা ও সাহিত্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, তাই তো নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বাধিক মহান ও স্থায়ী মুজিযা হল আল্‌ কুরআনুল কারীম। এজন্যই আল্লাহ্‌ শ্রোতাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং দাওয়াতের পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন :
(ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ) [النحل:১২৫]
‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও উত্তম নছীহতের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে উত্তমভাবে বিতর্ক কর।’ (সূরা আন্‌ নাহ্‌ল : ১২৫)
ইহাই মূলত: যাকে দাওয়াত দেয়া হবে তার অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখার দলীল। এজন্যই ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. তাঁর তাফসীরে বলেনঃ
আল্লাহ্‌ দাওয়াতের স্তরসমূহ সৃষ্টিকুলের স্তর অনুযায়ী নির্ধারণ করেছেন
(ক) দাওয়াত কবুলকরার যোগ্য ও চালাক-চতুর ব্যক্তি যে হকের বিরোধিতা করে না, তা অস্বীকারও করে না। এরূপ ব্যক্তিকে হিকমতের সাথে দাওয়াত দিতে হবে।
(খ)দাওয়াত কবুল করার যোগ্য তবে তার নিকট কিছু অলসতা ও পশ্চাদমুখিতা রয়েছে -এরূপ ব্যক্তিকে উত্তম ওয়ায-নছীহতের মাধ্যমে দাওয়াত দিতে হবে। তথা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করতে হবে তারগীব বা উদ্দীপন ও তারহীব বা ভীতি প্রদর্শন সূচক আয়াত ও হাদীছ পাঠের মাধ্যমে তাদেরকে বুঝাতে হবে।
গ) হটকারিতাকারী কিন্তু মূখ নয়র্ : এর সাথে উত্তম আচরণের মাধ্যমে বিতর্ক করতে হবে।
নিশ্চয় দাঈ হবেন একজন দয়ালু মানুষ। তাঁর উচিত হল শ্রোতাদের অবস্থা, তাদের মানসিক, সামাজিক, অবস্থা ও সময়ের প্রতি খেয়াল রাখা। কারণ, কোন মানুষ নির্দিষ্ট এক সময় দাওয়াত গ্রহণ করতে পারে আবার অন্য সময়ে তা প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। তার উদ্দেশ্য শুধু মাত্র দাওয়াত পৌঁছানো ও হুজ্জত কায়েম করাই হবে না, বরং মানুষের দাওয়াত গ্রহণ করার উপর লালায়িত হবেন। অতএব যদি হুজ্জত কায়েম করার সাথে সাথে দাওয়াত গৃহীত হয় তবে তো মূল উদ্দেশ্যই হাসিল হয়ে গেল। আর যদি দাওয়াত গৃহীত না হয় কিন্তু হুজ্জত কায়েম হয়ে যায় তবে এদ্বারা দায়ভার মুক্ত হওয়া যাবে।
১১-দাঈ মানুষদের নিকট তাদের মজলিসে ও থাকার স্থানে আসবেনঃ
দাঈ এই মর্মে আদিষ্ট যে তিনি মানুষদেরকে হেদায়াত করবেন। আর এর অর্থই হল, তিনি তাদের জমায়েত হওয়ার স্থানে, আবাস স্থলে, কর্ম স্থলে, তাঁবু-খীমাতে আরাম ও বিনোদনের স্থান প্রভৃতিতে গিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। যেমনটি স্বয়ং নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করতেন। যখনই তিনি লোকদের জামা’আত দেখতেন তখনই তাদেরকে দাওয়াত দিতেন এবং যাতে তাদের সংষ্কার -কল্যাণ রয়েছে সেদিকে তাদেরকে দিক নির্দেশনা দিতেন। নিশ্চয় কৃত্রিম সংকট, ভয়-ভীতি, অহেতুক লজ্জা-শরম এমনই একটি পোশাক যা কোন দাঈর জন্য পরিধান করা উচিত নয়।
নিশ্চয় মানুষ একক, সামগ্রিক কোনভাবেই কখনো দাঈর অনুসন্ধান করবে না, যদি দাঈ নিজেই তাদের অনুসন্ধান না করেন। এজন্যই মানুষদেরকে তাদের স্বস্থানে যিয়ারত করা সর্বাধিক দাওয়াতী সাফল্য কৌশল যা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী এবং নবুওতী তরীকার অধিক নিকটবর্তী কর্ম কৌশল। পক্ষান্তরে শুধু মাত্র দাওয়াতী তৎপরতা মসজিদসমূহে সীমাবদ্ধ করার অর্থই হল কল্যাণ ও সংষ্কারমুখী ব্যক্তিদের উপরই তা সীমাবদ্ধ রাখা যা মোটেও উচিত নয়। এমন আচরণ নবীর তরীকা থেকে দূরে সরে যাওয়ার নামান্তর। কারণ নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে, বাড়ী-ঘরে, বাজারে তথা সকল স্থানে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করেছেন। দাঈর কর্তব্য হল দাওয়াতের সহজসাধ্য সমস্ত মাধ্যম দিয়ে মানুষকে উপকার পৌঁছানো। যেমন:
খুত্ববাহ্‌, ওয়ায-নছীহত, ক্যাসেট, টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, ওয়েব সাইট, ইন্টারনেট-ব্লগসহ আধুনিক যাবতীয় মাধ্যম। পাঠ যোগ্য, শ্রবণ যোগ্য ও দর্শন যোগ্য মাধ্যম তথা পত্রিকা, রেডিও, টিভি, ভিডিও প্রভৃতির মাধ্যমও স্ববিশেষ উল্লেখ যোগ্য। তবে প্রচার মাধ্যমের ক্ষেত্রে আপত্তিকর বিষয়গুলি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ক্ষতিকর বিষয় প্রতিহত করা উপকারী বস্তু আহরণ করার চেয়ে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়।
১২-দাঈর উচিত তিনি নির্দিষ্ট কোন চিন্তা-ধারা, মাযহাব বা নির্দিষ্ট কোন জামা’আতের অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করবেন না:
হক বিসর্জন দিয়ে সেগুলোর সহযোগিতা করবেন না। বরং তাঁর একান্ত ইচ্ছা-অভিলাস যেন হয় মহান আল্লাহ্‌কে রাযী-খুশী করা। আর এমনটি তখনই সম্ভব যখন তিনি মতভেদ পরিলক্ষিত হলে কুরআন ও (ছহীহ) সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবেন। কারণ অন্ধপক্ষপাতিত্ব সর্বাবস্থায় ঘৃণিত। ইহা মুসলিমদের পরস্পরের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস রাখার বিষয়টি দুর্বল করে তোলে এবং ইসলামী উম্মাহকে দুর্বল করে দেয়।…
১৩-দাঈর উচিত বিভিন্ন স্পর্শকাতর অবস্থানগুলোকে কাজে লাগানো:
আসলে দাঈ একজন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি জানেন কিভাবে বিভিন্ন স্পর্শকাতর অবস্থান গুলিকে নিজ দাওয়াতের খিদমতে ব্যবহার করবেন। বিশেষ করে যে সমস্ত অবস্থান একেবারেই নাজুক ও স্পর্শকাতর, যে কারণে অন্তরসমূহ কোমল হয় এবং আত্মাসমূহ বিনয়ী হয়ে উঠে সে সব কারণগুলোকে দাওয়াতের কাজে লাগাতে হবে। যেমন মৃত্যু ও রোগ। এজন্যই তো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় অবস্থানকে কাজে লাগানোর বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তাই তো তিনি তার জনৈক ইহুদী কিশোরকে তার মৃত্যু রোগ শয্যায় দেখতে গিয়ে ছিলেন এবং তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করে ছিলেন। এতে ছেলেটির হৃদয় নরম হয়ে উঠেছিল, নিজ পিতাও প্রভাবিত হয়েছিল। অতঃপর ছেলেটি ইসলাম কবুল করলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখান থেকে প্রস্থান করে ছিলেন আর বলে ছিলেনঃ
‘ঐ আল্লাহর প্রশংসা যিনি আমার দ্বারা ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান দান করলেন।’ (বুখারী,জানাযা অধ্যায়,হা/১৩৫৬)।
নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরস্থানেও মানুষকে ওয়ায-নছীহত করতেন। কারণ সেখানে মৃত্যুর দাফন ও কবর দেখে অন্তর বিনয়ী ও নরম হয়। এজন্যই ইমাম বুখারী রহ. জামে’ছহীহ তথা ছহীহ বুখারীতে এভাবে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন।
‘বাবুল মাওঈযাতি ইন্‌দাল ক্বাবরি’ মানে কবরের নিকট ওয়ায- নছীহত করা সম্পর্কে পরিচ্ছেদ।
১৪-উত্তম আদর্শ ও উত্তম ব্যবহার প্রদর্শন :
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً)[الأحزاب:২১]
‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ এর মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে; তাদের জন্য যারা আল্লাহ্‌ এবং শেষ দিবসের আশা করে ও আল্লাহ্‌কে বেশী বেশী করে স্মরণ করে।’ (সূরা আল্‌ আহযাবঃ২১)।
১৪-দাঈর উপর ওয়াজিব হল, তিনি তাঁর লেন-দেন আদব আচরণে উত্তম আদর্শ হবেন:
এর মাধ্যমে তাঁর দাওয়াত বেশী কবুল হওয়ার আশা করা যায়। কত পথহারা মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে দাঈর সদাচরণের মাধ্যমে? যারা মুসলিমদের সুন্দর আচরণে ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের জীবন ও কাহিনী বই-কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এপর্যায়ে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের লোকদের কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য-যাদের সাথে মুসলিম ব্যবসায়ীগণ ভাল আচরণ করেছিলেন (ফলে তারা দলে দলে ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়ে ছিলেন)। অতএব দাঈরও কর্তব্য হল যে, তিনি তাঁর পূর্বসূরী পুন্যবানদের অনুসরণ করবেন যাতে করে -আল্লাহর ইচ্ছায়-তাঁর দাওয়াত ফল দান করে এবং এর কল্যাণ অর্জিত হয়।
اقرأ التاريخ إذ فيه العبر ضل قوم ليس يدرون الخبر
‘তুমি ইতিহাস অধ্যায়ন কর, কারণ তাতে রয়েছে উপদেশাবলী। ঐজাতি বিপথগামী হবে যারা ইতিহাস বিষয়ে কোন খবরই রাখে না’
১৫- দাঈ মতবিরোধীয় জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হবেন:
দাঈর উচিত এই বিষয়টি জেনে নেওয়া যে আহ্‌লে সুন্নাতের নিকট আক্বীদায় মতবিরোধ পরিচিত কোন বিষয় নয়;অল্প সামান্য বিষয়ে ইখতিলাফ পাওয়া যায় যা সঠিক আক্বীদায় কোন প্রকার প্রভাব ফেলবে না। যেমন একটি মাসআলাহ্‌ঃ ‘উর্ধ্বাকাশে মেরাজকালীন কি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতিপালককে দেখেছিলেন?
অবশ্য শাখাগত মাসায়েল বিষয়ে মতভেদ শক্তিশালী, অনেক এবং ফুক্বাহাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ। এর পরও যারা (ইজতিহাদ করতে যেয়ে) সঠিক বিষয়ের বিরোধিতা করেছেন তাঁরা পুরস্কার পাবেন। দাঈর কর্তব্য হল তিনি বিষয়টি ভালভাবে লক্ষ্য রাখবেন এবং পর্যালোচনা, তর্ক, পারষ্পরিক কথোপকথনকালীন মতবিরোধ সংক্রান্ত আদব-কায়দা অনুসরণ করবেন। এবং তাঁর নীতি হবে ইমাম শাফেঈ রহ. এর নীতির মতঃ
(قولي صواب يحتمل الخطأ وقول غيري خطأ يحتمل الصواب)
‘আমার কথা সঠিক, তবে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পক্ষান্তরে আমি ভিন্ন অন্যের মতামত ভুল। তবে তা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'[৩]
এমন ব্যক্তি খুব কমই রয়েছে যে ইমাম শাফেয়ীর এ কথায় প্রভাবিত হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হল আদল, ইনসাফ ন্যায় নিষ্ঠা থেকে দূরে অবস্থান করা।
দাঈর ইহাই উচিত, তিনি প্রতিপক্ষদের সাথে কঠোরতা, কর্কশ ভাষা প্রয়োগ করা থেকে দূরে থাকবেন যাতে করে তার দাওয়াত বেশী গ্রহণযোগ্য হয়। [৪]
১৬-কোন কথা ও কাজটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ের জ্ঞান রাখা :
দাঈর উচিত হল, যা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাই দিয়ে সূচনা করবেন। এরপর তা দিয়ে সূচনা করবেন যা মোটামোটি গুরুত্বপূর্ণ। এটা রাসূল সা. ও ছাহাবায়ে কিরামের পদ্ধতি। তাই তো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মু’আয রা. কে ইয়ামানে প্রেরণকালীন এই মর্মে নির্দেশ ছিলেন যেন তিনি তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করবেন, অতঃপর ছালাতের দিকে, অতঃপর যাকাত প্রভৃতির দিকে…। (বুখারী, যাকাত অধ্যায়, হা/১৩৯৫)।
দাঈ থেকে যা প্রথম তলব করা হবে তা হল ইহাই যে তিনি সর্ব প্রথম লোকদের আক্বীদাহ্‌ পরিশুদ্ধ করবেন। সুতরাং যার নিকট শিরক ও পাপ রয়েছে চাই তা ছোট হোক বা বড়, তার সংস্কার করবেন। দাঈর উচিত, তিনি সর্ব প্রথম ঐ ব্যক্তির আক্বীদাহ বিশুদ্ধ করা শুরূ করবেন। এমন না হয় যে সে কাউকে ধুমপান থেকে নিষেধ করবে অথচ সে ব্যক্তি কবর পূজায়, কবরের চতুর্পাশ তওয়াফ করা, তার জন্য নযর-মান্নত পেশ করায় যথেষ্ট আসক্ত। তদ্রূপ ঐ ব্যক্তিও যে কোন ব্যক্তিকে দাড়ি মুন্ডন করার জন্য ওয়ায করে অথচ সে জুমুআহ্‌ ও জামা’আত পরিত্যাগকারী; ছালাতই সে আদায় করে না।
অতএব দাঈ,মানুষের আক্বীদাহ বিশুদ্ধ করার পর ভয়াবহতা হিসাবে বিভিন্ন ধরনের পাপ থেকে সতর্র্কীকরণ শুরূ করবে। যেমন সূদ ভক্ষণ অবশ্যই ধুম পান অপেক্ষা মারাত্মক। অবশ্য এর অর্থ এমন নয় যে, অন্যান্য সকল পাপকে ছোট চোখে দেখা হচ্ছে। বরং উদ্দেশ্য হল নবী কারীম সা. এর অনুসৃত পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়া। আর এটাকেই ‘ফিকহুল আওলাবিয়্যাত’ বলা হয় যার অর্থ হল ‘কোন্‌ কোন্‌ বিষয়গুলি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ের জ্ঞান’।[৫]
ইলমে দ্বীনের ফযীলত
পটভূমিঃ
প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির একথা জেনে রাখা ওয়াজিব যে ইলম শব্দটি যখন সাধারণভাবে আসবে এবং শরী’আতের দলীলাদি তার ফযীলতে বিধৃত হবে তখন মনে করতে হবে যে ইহা দ্বারা শরঈ ইলম উদ্দেশ্য, কাজেই তা থেকে অন্যান্য সকল ইলম বহির্ভূত বলে গণ্য হবে।[৬]
(হাফেয) ইবনু হাজার (রহ.) ফাতহুলবারীতে বলেনঃ
وَالْمُرَاد بِالْعِلْمِ الْعِلْم الشَّرْعِيّ الَّذِي يُفِيد مَعْرِفَة مَا يَجِب عَلَى الْمُكَلَّف مِنْ أَمْر عِبَادَاته وَمُعَامَلَاته ، وَالْعِلْم بِاَللَّهِ وَصِفَاته ، وَمَا يَجِب لَهُ مِنْ الْقِيَام بِأَمْرِهِ ، وَتَنْزِيهه عَنْ النَّقَائِض ، وَمَدَار ذَلِكَ عَلَى التَّفْسِير وَالْحَدِيث وَالْفِقْه (فتح الباري ১/১৪১).
ইলমে শরঈ দ্বারা উদ্দেশ্য হল এমন ইলম যা ঐসব ধর্মীয় বিষয় জানার ফায়েদা দিয়ে থাকে যা একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। যেমন ইবাদত, লেনদেন, আল্লাহ্‌ ও আল্লাহর গুণাবলী সংক্রান্ত ইলম, অনুরূপভাবে তার জন্য যা যা করা ওয়াজিব যেমন তাঁর আদেশ পালন, তাঁকে যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যূতি থেকে পবিত্র করণ মর্মের ইলম। আর এই ইলমের ভিত্তি হল তাফসীর, হাদীছ ও ফিক্বহ্‌ প্রভৃতি (ফাতহুলবারী ১/১৪১)।
ইলমের ফযীলত মর্মে কিছু দলীল
আল্লাহর কিতাব- আল্‌ কুরআন থেকে:
১-মহান আল্লাহর বাণী –
(أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِداً وَقَائِماً يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ)[الزمر:৯]
‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সাজদাহ্‌র মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালের ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের রহমতের আশা করে সে কি তার সমান যে এরূপ করে না? আপনি বলুন: যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? উপদেশ তো কেবল তারাই গ্রহণ করে যারা বুদ্ধিমান। ‘(সূরা আয্‌ যুমার : ৯)।
২-মহান আল্লাহর বাণীঃ
(يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ)[المجادلة:১১]
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞান প্রাপ্ত, আল্লাহ্‌ তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দিবেন।’ ( সূরা আল্‌ মুজাদিলাহ্‌ : ১১)
৩-মহান আল্লাহর বাণীঃ
(شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِماً بِالْقِسْطِ)[آل عمران:১৮]
‘আল্লাহ্‌ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোনই উপাস্য নেই। (একই বিষয়ে) ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮)
ইলমের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ থেকে দলীলঃ
১-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ
(إِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ لَتَحُفُّهُ الْمَلَائِكَةُ وَتُظِلُّهُ بِأَجْنِحَتِهَا ثُمَّ يَرْكَبُ بَعْضُهُمْ بِعْضًا حَتَّى يَبْلُغُوْا السَّمَاءَ الدُّنْيَا مِنْ حُبِّهِمْ لِمَا يَطْلُبُ)[قال المنذري: رواه أحمد والطبراني بإسناد جيد واللفظ له، وابن حبان في صحيحه والحاكم، وقال: صحيح الإسناد، وروى ابن ماجة نحوه باختصار، مختصر الترغيب والترهيب، فضل الرحلة في العلم، رقم الحديث (৪০) ورواه الطبراني في الكبير ورجاله رجال الصحيح/ قلتُ:-وأنا أختر- وأخرجه أيضاً الضياء المقدسي في الأحاديث المختارة برقم ৩৪، ৩৫].
‘নিশ্চয় ইলম অর্জনকারীকে ফেরেশতাগণ চতুর্পাশ থেকে বেষ্টন করেন ও নিজ পাখা দিয়ে ছায়া দান করেন। এবং তারা একে অপরের উপর আরোহণ করতঃ আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যান। তার ইলম অর্জনের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনস্বরূপ তারা এমনটি করেন। [ইমাম মুনযিরী বলেনঃ হাদীছটি আহমাদ, ত্বাবারানী বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন। হাদীছটির শব্দ তাবারানীর। আরও বর্ণনা করেছেন ইবনু হিব্বান নিজ ছহীহতে এবং হাকেম এটিকে-মুস্তাদরাকে -বর্ণনা করার পর বলেন: এটির সনদ ছহীহ। ইবনু মাজাহ প্রায় অনুরূপ হাদীছ সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। মুখতাছারুত্‌ তারগীবি ওয়াত্‌ তারহীব, ইলমের জন্য সফর করা অধ্যায়, হা/৪০, এটিকে তাবারানী তার আল্‌ মুজামুল কাবীর গ্রন্থে বর্ণনা করেন,তার এই বর্ণনার সকল সুত্র ছহীহ (বুখারী ও মুসলিম) এর বর্ণনাকারী। হাদীছটি যিয়া মাক্বদিসী তাঁর ‘আল্‌ আহাদীছুল মুখতারাহ্‌’ নামক বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। দ্রঃ আল্‌ আহাদীছ্‌ আল্‌ মুখতারাহ্‌,হা/৩৪,৩৫]।
২-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ
(مَا مِنْ رَجُلٍ يَسْلُكُ طَرِيْقاً يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا إِلاَّسَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ ، وَمَنْ أَبْطَأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ حسَبُهُ) [رواه مسلم بزيادة في أوله وآخره، كتاب الذكر والدعاء، باب فضل الاجتماع على تلاوة القرآن وعلى الذكر، رقم الحديث ৩৮، وأخرجه أبو داود بهذا اللفظ- كتاب العلم-باب الحث على طلب العلم، رقم الحديث ৩৬৪৩].
‘যদি কোন ব্যক্তি ইলম অন্বেষণ কল্পে কোন পথে পরিচালিত হয় তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের একটি পথ সুগম-সহজ করে দেন। আর যার আমল নিজেকে ধীর গতি সম্পন্ন করেছে তাকে তার বংশীয় মর্যাদা এগিয়ে দিতে পারবে না। তথা আমলে পিছিয়ে থাকলে বংশীয় মর্যাদার গুণে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না। (মুসলিম,প্রথমে ও পরে বর্ধিত অংশ সহ, যির্ক‌ ও দু’আ অধ্যায়,হা/৩৮, আবুদাউদ এই শব্দে সংকলন করেছেন। দেখুনঃ আবুদাঊদ ইলম অধ্যায়,হা/৩৬৪৩)।
৩-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ
( إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَة أَشْيَاءَ: مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ ) [رواه مسلم ، كتاب الوصية، باب ما يلحق الإنسان من الثواب بعد وفاته، حديث رقم ১৬৩১]
‘মানুষ যখন মৃত্যু বরণ করে তখন তার আমল তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে তিনটি বস্তুর কথা ভিন্ন (সেগুলির নেকী কর্তিত হয় না)। প্রবাহ মান-স্থায়ী সদকা, এমন ইলম যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়, এমন সৎ সন্তান যে তার জন্য দু’আ করে।’ (মুসলিম, ওছিয়্যত অধ্যায়, হা/১৬৩১)।
৪-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ
(فَضْلُ الْعِلْمِ خَيْرٌ مِنْ فَضْلِ الْعِبَادَةِ وَخَيْرُ دِيْنِكُمُ الْوَرْعُ).
‘ইলমের অতিরিক্ততা, ইবাদতের অতিরিক্ততা অপেক্ষা উত্তম- আর দ্বীনের মূল ও মৌলিক বিষয় হল তাক্বওয়া-আল্লাহভীতি (বায্‌যার এটিকে হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন,ত্বাবারানী আল্‌ আওসাত গ্রন্থে সংকলন করেছেন। হাকেম এটিকে এই শব্দে ‘আর তোমাদের ধর্মের উত্তম বিষয় হল তাক্বওয়া-আল্লাহভীতি, হাকেম,ইলম অধ্যায়,হা/৩১৪। এটিকে হাকেম ছহীহ বলেছেন, যাহাবী তাঁর সমর্থন করেছেন। এবং আলবানী রহ. এটিকে ছহীহুল জামে’ গ্রন্থে হা/৪২১৪ ছহীহ বলেছেন)।
৫-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
(مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ لَا يُرِيْدُ إِلَّا لِيَتَعَلَّمَ خَيْراً أَوْيُعَلِّمَهُ كَانَ لَهُ كَأَجْرِ مُعْتَمِرٍ تّامِّ الْعُمْرَةِ، فَمَنْ رَاحَ إِلَى الْمَسْجِدِ لَا يُرِيْدُ إِلَّا لِيَتَعَلَّمَ خَيْراً أَوْ يُعَلِّمَهُ فَلَهُ أَجْرِ حَاجٍّ تَامِّ الحْـَجَّةِ)[أخرجه الحاكم، كتاب العلم رقمه ৩১১، وصححه على شرط البخاري ووافقه الذهبي. ورواه الطبراني بلفظ: من غدا إلى المسجد لا يريد إلا أن يتعلم خيراً أو يعلمه كان له كأجر حاج تاماً حجته. وهو في صحيح الترغيب رقم ৮৬، وقال حسن صحيح].
যে ব্যক্তি সকালে মসজিদের দিকে রওয়ানা হবে কোন কল্যাণ শিক্ষা করার জন্য বা শিক্ষা দেওয়ার জন্য, তাহলে সে একজন পূর্ণাঙ্গ উমরাহ্‌কারীর মত নেকী অর্জন করবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধাকালীন মসজিদ অভিমুখে বের হবে শুধু মাত্র কল্যাণ শিক্ষা করার জন্য বা শিক্ষা দেওয়ার জন্য সে পূর্ণাঙ্গ হজকারীর ন্যায় নেকী পাবে। (হাকেম,ইলম অধ্যায়,হা/৩১১,হাকেম এটিকে বুখারীর শর্তানুযায়ী ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাঁর সমর্থন করেছেন। তাবারানী হাদীছটি এই শব্দে বর্ণনা করেছেন: ‘যে ব্যক্তি সকালে একমাত্র কল্যাণ শিক্ষা করা বা কল্যাণ শিক্ষা দেওয়ার জন্য মসজিদ অভিমুখে বের হবে সে একজন পূর্ণাঙ্গ হজকারীর ন্যায় নেকী পাবে।’ হাদীছটি ছহীহ তারগীবে ৮৬ নম্বরে বিধৃত হয়েছে। সংকলক বলেন: হাদীছটি হাসান ও ছহীহ)।
ইলমের ফযীলত সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের কিছু উক্তি :
মু’আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেনঃ এই ইলম দ্বারাই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা হয়, হারাম থেকে হালাল চেনা যায়। ইলম হল ইমাম স্বরূপ এবং তার উপর আমল করা হল তার মুক্তাদী বা অনুসারী। এটি সৌভাগ্যশীলদেরকে ইলহাম করা হয় এবং হতভাগ্যদেরকে ইহা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রহ. বলেনঃ মানুষ পানাহারের চেয়েও এই ইলমের দিকে বেশী মুখাপেক্ষী। কারণ এক ব্যক্তি দৈনিক এক বার বা দুই বার পানাহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। অথচ তার ইলমের প্রয়োজন হয়ে থাকে তার শাস-নিঃশ্বাসের সংখ্যা পরিমাণ।
ইবনু আবী হাতেম রহ. বলেনঃ আমি মুযানীকে বলতে শুনেছি তিনি শাফেঈকে লক্ষ্য করে বলেছেন: আপনার ইলমের প্রতি চাহিদা কিরূপ? তিনি বললেন: নতুন কোন কোন অক্ষর বা বাক্য শুনলে আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ এই আশা করে যে তাদের যদি শ্রবণ শক্তি হত তাহলে তারাও আনন্দবোধ করত যেভাবে দুই কান আনন্দ উপভোগ করে থাকে। তাঁকে বলা হলঃ ইলমের প্রতি আপনার আকর্ষণ কেমন? তিনি বললেনঃ যেমন ভাবে একজন ধন সঞ্চয়কারী কৃপণ ব্যক্তি ধন সংগ্রহে লালায়িত থাকে ঠিক তদ্রূপ আমি ইলমের ক্ষেত্রে লালায়িত। তাঁকে প্রশ্ন করা হল: আপনি এই ইলম কিভাবে অর্জন করেন? তিনি বললেন: যেরূপ কোন মহিলা তার একমাত্র সন্তানটিকে হারিয়ে তালাশ করতে থাকে সেরূপ আমি ইলম অন্বেষণ করি।
ইলম অন্বেষনকারীর কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখা ওয়াজিব
১-আল্‌ ইখলাছ: তথা শুধু আল্লাহকে খুশী করার জন্য কাজ করা।
ইলম অর্জনকারীর জন্য আবশ্যক যে সে ইলম অর্জনের বিষয়টি -অন্যান্য বিষয়ের মত আল্লাহ তাআলার জন্য খালেছ করবে। কারণ নবী কারীম সা. ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত আছে তিনি বলেনঃ
(مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ- عَزَّ وَجَلَّ- لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ )[أخرجه أبوداود، كتاب العلم،باب في طلب العلم لغير الله تعالى، حديث:৩৬৬৪، وابن ماجة في المقدمة باب ২৩، حديث ২৫২، وصححه الألباني في صحيح ابن ماجة، وذكره الحاكم وصححه و وافقه الذهبي، كتاب العلم حديث (২৮৮/২).
যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয় এরূপ ইলম যে শিক্ষা করবে দুনিয়ার কোন স্বার্থ লাভের আশায় তাহলে সে (জান্নাতে যাওয়া দূরের কথা) জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। (আবুদাউদ,ইলম অধ্যায়,হা/৩৬৬৪,ইবনু মাজাহ,ভূমিকা,হা/২৫২,হাদীছটিকে আলবানী ছহীহ ইবনু মাজায় ছহীহ বলেছেন। হাকিম এটিকে উল্লেখ পূর্বক ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাঁর সমর্থন করেছেন। দ্রঃ হাকিম,ইলম অধ্যায়,হাদীছ নং ২৮৮/১)।
নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
‘কিয়ামতে যাদের দ্বারা জাহান্নামকে প্রজ্জলিত করা হবে তারা হল তিন ব্যক্তি। এদের মধ্যে নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ আলেমের কথা উল্লেখ করেছেন যে নিজ ইলম দ্বারা মানুষের প্রশংসা ও তাদের গুণর্কীতর্ন আশা করে ছিল (আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা করেনি)…
(হাদীছটি বিস্তারিতভাবে জানার জন্য দেখুন ছহীহ মুসলিম, ইমারত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি লোক দেখানো বা শুনানোর জন্য জিহাদ করে। হা/১৯০৫,তিরমিযী.ইলম অধ্যায়,হা/২৬৫৪,আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
( من طلب العلم ليماري به السفهاء أو ليباهي به العلماء أو ليصرف وجوه الناس إليه فهو في النار )[أخرجه ابن ماجة وقال عنه الألباني في صحيح ابن ماجة في المقدمة باب (২৩) رقم الحديث ২০৭) حديث حسن]
‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করবে নির্বোধদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করা জন্য বা আলেমদের সামনে অহংকার প্রদর্শনের জন্য অথবা মানুষের আকর্ষণ নিজের দিকে নিবদ্ধ রাখার জন,্য তাহলে সে জাহান্নামে যাবে।’ (ইবনু মাজাহ,হা/২৫৩, ইমাম আলবানী এটিকে হাসান হাদীছ বলেছেন। ছহীহ ইবনু মাজাহ্‌, ভূমিকা,অনুচ্ছেদ নং ২৩,হাদীছ নং২০৭)।
২- ইলম অনুযায়ী আমল করাঃ
আলেমের উচিত নিজ ইলম অনুযায়ী আমল করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لا تَفْعَلُونَ (২) كَبُرَ مَقْتاً عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لا تَفْعَلُونَ (৩)[الصف]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা কর না তা বল কেন? নিশ্চয় আল্লাহর নিকট বড়ই ক্রোধের বিষয় এটা যে, তোমরা যা করবে না তা বলে বেড়াবে। (সূরা আছ্‌ ছাফ : ২-৩)
মহা পবিত্র আল্লাহ্‌ শুআইব-আলাইহিস্‌ সালাম-এর বক্তব্য উল্লেখ করেনঃ
(وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ) [هود:৮৮]
‘আর আমি তো চাই না যে, যা থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করি তোমাদের বিরোধিতা করে আমি তাই করে বসব।’ (সূরা হূদ : ৮৮)
আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
(هتف العلم بالعمل فإن أجابه وإلا ارتحل) [ اقتضاء العلم العمل للخطيب البغدادي بتحقيق الألباني-رحمه الله].
‘ইলম আমলকে আহ্বান করে থাকে, যদি সে তার ডাকে সাড়া দেয় তো ভাল কথা নতুবা সে প্রস্থান করে-তথা বিদায় নিয়ে যায়। (খত্বীব বাগদাদী প্রণীত আলবানী (রহ.) এর তাহক্বীক্ব ‘ইকতিযাউল ইলমিল আমাল’)।
৩- ইলম অর্জনকারীর উচিত ফতওয়া দেওয়ার বিষয়ে তাড়াহুড়া না করাঃ
আলেম ও ইলম অন্বেষনকারীদের উচিত যে, তারা যা জানবেন কেবল সে অনুযায়ীই জবাব দেবেন। আর তাদের কর্তব্য হল (অজানা বিষয়ে) ‘আমরা জানি না’ বলতে সঙ্কোচ বোধ না করা। এটা সালাফে ছালেহীনের অভ্যাস ও পদ্ধতি। ইবনু মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ হে জনগণ! আপনাদের মধ্য হতে কাউকে যদি এমন ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যা তার জানা আছে তবে সে যেন তা বলে। আর যার নিকটে সে বিষয়ে ইলম নেই সে যেন বলেঃ ‘আল্লাহই বেশী অবগত’। নিশ্চয় বরকতময় মহান আল্লাহ্‌ তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ
قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ (৮৬) [ص]
আপনি বলুন! আমি তো দাওয়াতের উপর তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চাই না। এবং আমি লৌকিকতা প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সূরা ছোওয়াদঃ৮৬)
অপর বর্ণনায় ইবনু মাসঊদ-রাযিয়াল্লাহু আনহু-বলেনঃ ইহাই একজন ব্যক্তির জ্ঞানের পরিচায়ক যে, যে বিষয়ে তার ইলম নেই সে সম্পর্কে বলবেঃ ‘আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত। ‘(জামেঊ বায়ানিল ইলম ২/৫২)।
দারেমীর বর্ণনায় ইবনু মাসঊদ -রাযিয়াল্লাহু আনহু-বলেনঃ নিশ্চয় যে ব্যক্তি মানুষদের প্রত্যেক জিজ্ঞাসকৃত বিষয়ে ফতওয়া দেয় সে অবশ্যই একজন পাগল। ইবনু আব্দিল বার বর্ধিত করে বলেনঃ আমাশ বলেছেন, আমি এ কথাটি হাকাম বিন উতায়বাহ্‌ এর নিকট উল্লেখ করলে তিনি বলেনঃ যদি আমি এটা আপনার নিকট ইতো পূর্বে শুনতাম তাহলে আমি জিজ্ঞাসাকৃত প্রত্যেকটি বিষয়ে ফতওয়া দিতাম না (জামেঊ বায়ানিল ইলম ৫৫/২)।
ইমাম দারেমী আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেনঃ
যদি তোমাদেরকে এমন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে সম্পর্কে তোমাদের জানা নেই তাহলে পলায়ন কর। তাঁরা বললেনঃ কিভাবে পলায়ন করব হে আমীরুল মুমিনীন? তিনি বললেনঃ তোমরা বলবেঃ ‘আল্লাহ্‌ সর্বাধিক অবগত।'(জামেঊ বায়ানিল ইলম ৫৫/২)।
ইবনু আব্দিল বার মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ ইবনু উমার রাঃ কে ফারায়েয এর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ্‌ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেনঃ আমি জানি না। এরই প্রেক্ষিতে তাকে বলা হল, আপনাকে প্রশ্নের জবাব দিতে কিসে বাধা দিচ্ছে? তখন তিনি বললেনঃ ইবনু উমারকে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যা তার জানা নেই, তাই বলেছেন, ‘আমি জানি না।’ (জামেঊ বায়ানিল ইলম ৫৩/২)।
অনুরূপভাবে ইবনু আব্দিল বার উক্ববাহ বিন মুসলিম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন. আমি ৩৪ টি মাস ইবনু উমার (রাঃ) এর সাথে থেকেছি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে অধিকাংশ সময় তিনি বলতেন. আমি জানি না। এরপর আমার দিকে মুখ করে বলতেনঃ তুমি জান এরা কী বলতে চায়? এরা চায় আমাদের পৃষ্ঠদেশকে জাহান্নামের উপরের ব্রীজ বানাতে। (যার উপর দিয়ে তারা জাহান্নাম অতিক্রম করে যাবে) (জামেঊ বায়ানিল ইলম,৫৪/২)।
ইবনু আব্দিল বার হাম্মাদ বিন যায়দ এর সূত্রে আইয়ূব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন. মিনায় আব্দুল্লাহ ইবনুল ক্বাসিম এর নিকট ব্যাপক আকারে লোক সমবেত হয়ে তাকে প্রশ্ন করতে শুরূ করে। আর তিনিও উত্তর দিতে থাকেন: আমি জানি না। অতঃপর বলেন, আল্লাহর কসম! আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। আমাদের জানা থাকলে কখনই আপনাদের থেকে তা গোপন রাখতাম না। আর আমাদের জন্য আপনাদের নিকট জানা বিষয় গোপন রাখাও বৈধ নয়। (জামেঊ বায়ানিল ইলম ৫৪/২)।
৪-ভুল ফাৎওয়া থেকে ফিরে আসা :
ইলম অন্বেষনকারীর কর্তব্য হল এই বিষয়টি জেনে রাখা যে, সে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তাঁর ফতওয়ায় স্বাক্ষর করছে। এজন্যই ইবনুল ক্বায়্যিম রহিমাহুল্লাহ্‌ একটি কিতাব রচনা করেছেন। তার নাম দিয়েছেনঃ ‘আলামুল মুওয়াক্বক্বিঈন আন্‌ রাব্বিল আলামীন’ যার অর্থ হল, ‘রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে যারা দস্তখতকারী তাদের জ্ঞাতব্য।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
(قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْأِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَاناً وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ) [الأعراف:৩৩]
আপনি বলুন, আমার প্রতিপালক প্রকাশ্য ও গোপনীয় অশ্লীল বিষয়কে হারাম করেছেন। আর তিনি হারাম করেছেন, তোমাদের আল্লাহর শরীক করাকে – যার কোন সনদ তিনি অবতীর্ণ করেননি। তোমাদের জ্ঞান ব্যতিরেকে আল্লাহর ব্যাপারে কথা বলাও তিনি হারাম করেছেন। ( সূরা আল আরাফঃ ৩৩)।
অতএব আলেম, তালেবে ইলম প্রত্যেকেরই উচিত নিজ ঐ ফতওয়া থেকে ফিরে আসা যখনই তার ভ্রান্তিা প্রকাশ পাবে এবং তার কথার বিপরীতে হক উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
সালাফে ছালেহীন থেকে তাদের পূর্ব ভুল ফতওয়া থেকে ফিরে আসার বর্ণনা পাওয়া যায়। ইবনু আব্দিল বার সুফইয়ান থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস ও যায়েদ বিন ছাবিত ঋতুবতী মহিলা সম্পর্কে মতবিরোধ করেন যে মহিলা মক্কা ত্যাগ করতে চায় (বিদায়ী তওয়াফ ছাড়া)। যায়েদ বলেন. সে বিদায় হতে পারবে না যে পর্যন্ত না তার শেষ মুহূর্তটি বায়তুল্লাহ দিয়ে (তাওয়াফ) অতিক্রান্তহবে। এটা শুনে ইবনু আব্বাস যায়েদকে বললেনঃ আপনি আপনার মহিলাদেরকে তথা উম্মু সুলাইমান ও তার সঙ্গিনীদেরকে জিজ্ঞাসা করুন। একথা শুনে যায়েদ গিয়ে তাঁর মহিলাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন অতঃপর হাসতে হাসতে ফিরে আসলেন এবং বললেনঃ তোমার কথাটিই সঠিক।…[৭]
৫-সুন্নাতের অনুসরণ ও তাকলীদ প্রত্যাখ্যান করণঃ
ইলম অন্বেষনকারীর উচিত যেন তার মুখ্য উদ্দেশ্য হয় নবীর সুন্নাহর অনুসরণ এবং কোন আলেম বা গ্রন্থকার বা মাযহাবের অন্ধভাবে অনুসরণ না করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلاً مَا تَذَكَّرُونَ) [الأعراف:৩]
‘তোমরা তারই অনুসরণ কর যা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। তা বাদ দিয়ে ওলী-আওলিয়াদের অনুসরণ কর না। তোমরা তো খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।’ (সূরা আল্‌ আরাফঃ৩)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ)[القصص:৬৫]
‘(আল্লাহ)যখন তাদেরকে ডাক দিয়ে বলবেনঃ তোমরা রাসূলদের কী জবাব দিয়েছিলে? (সূরা আল কাসাস: ৬৫)
আল্লাহ্‌ একথা বলেননি যে, তোমরা ওমুক তমুককে কী জবাব দিয়েছিলে? যখন তাদের কথা আল্লাহ্‌ ও তদীয় রাসূলের কথার বিপরীত হয়? তাই ইলম অন্বেষনকারীর উচিত যেন তার স্বভাব জাহেলী স্বভাব তুল্য না হয়। যে জাহেলী স্বভাবের শ্লোগান হলঃ
وما أنا إلا من غزية إن غوتْ غويتُ وإن ترشد غزية أرشد
আমি তো ‘গাযিয়া’ প্রেমিকার অংশ বিশেষ। অতএব যদি সে পথভ্রষ্ট হয় আমিও পথভ্রষ্ট হব, আর যদি সে সুপথে পরিচালিত হয় আমিও সুপথে পরিচালিত হব।
• মাযহাবী গোঁড়ামী
মাযহাবী গোঁড়ামী কঠিনভাবে বৃদ্ধি লাভ করেছে, অথচ দেখা যায় যে, কোন কোন মাসআলায় বিরোধীতাকারীর মাযহাবের বিপরীত কথাটাকে সত্য হিসাবে পাওয়া যায়। কারণ সেমর্মের দলীল একেবারেই স্পষ্ট। এজন্যই সকল ইমাম তাদের অন্ধ অনুসারীদের থেকে নিজেদের সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন। এবং স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন যে, হক বিষয়টিই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং হাদীছ হল তাদের মাযহাব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আপনার নিকট ঐমর্মে তাদের থেকে বর্ণিত কিছু উক্তি পেশ করা হলঃ
১-ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ্‌ঃ
ইমাম আবু হানীফা রহ. তার সহচরবৃন্দ তাঁর থেকে বিভিন্ন বাণী উদ্ধৃত করেছেন যেগুলোর সবটুকুই হাদীছ গ্রহণ ও তাক্বলীদ বর্জনের প্রতি আহ্বান করে। তিনি বলেনঃ
(إِذَا صَحَّ الحْـَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ)[ ذكره ابن عابدين في الحاشية ১০/৬৩].
‘হাদীছ ছহীহ প্রমাণিত হলে সেটাই আমার মাযহাব। (হাশিয়া ইবনু আবেদীন ১০/৬৩)।
ইমাম আবু হানীফা রহ. আরও বলেনঃ
(لَا يَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يَأْخُذَ بِقَوْلِنَا مَالمَ ْيَعْلَمْ مِنْ أَيْنَ أَخَذْنَاهُ)[ذكره ابن عبد البر في الانتقاء ص ১৪৫، وابن القيم في إعلام الموقعين ২/৩০৯]
‘কোন ব্যক্তির জন্য হালাল নয় আমাদের কথা গ্রহণ করবে, যতক্ষণ না সে জেনে নেবে আমরা তা কোত্থেকে গ্রহণ করেছি। (ইবনু আব্দুল বার প্রণীত ‘আল্‌ ইন্তিক্বা,পৃঃ১৪৫,ইবনুল ক্বায়্যিম প্রণীত ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন ২/৩০৯)।
অপর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেনঃ
(حَرَامٌ عَلَى مَنْ لَمْ يَعْرِفْ دَلِيْلِيْ أَنْ يُفْتِيَ بِكَلَامِيْ) [ذكره ابن عبد البر في الانتقاء ص ১৪৫، وابن القيم في الإعلام২/৩০৯]
যে আমার দলীল-প্রমাণ জানে না তার জন্য আমার কথার অনুসরণে মতে ফতওয়া দেওয়া হারাম।’ (ইবনু আব্দুল বার প্রণীত ‘আল্‌ ইন্তিক্বা,পৃঃ১৪৫,ইবনুল ক্বায়্যিম প্রণীত ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন ২/৩০৯)।
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন :
(ويحك يا أبا يعقوب-وهو أبو يوسف صاحبه-لا تكتب كل ما تسمع مني، فإني قد أرى الرأي اليوم وأتركه غداً، وأرى الرأي غداً وأتركه بعد غدٍ)[ذكره ابن عبد البر في الانتقاء ص ১৪৫، وابن القيم في الإعلام২/৩০৯].
হে আবু ইয়াকূব! (তাঁরই শিষ্য আবু ইউসুফ) আমার থেকে যা শুন তার সবটুকুই লিখে নিও না, কারণ হতে পারে আজকে আমি যে মত ব্যক্ত করলাম, আগামীকাল তা পরিত্যাগ করব। আবার আগামী কাল যে মত ব্যক্ত করব, তা আগামী পরশু পরিত্যাগ করব। (এটি ইবনু আব্দিল বার তাঁর সুবিখ্যাত কিতাব ‘আল্‌ ইন্তিক্বা’এর ১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, এবং ইবনুল ক্বায়্যিম তাঁর ইলামুল মুওয়াক্কিঈন কিতাবে ২/৩০৯ উল্লেখ করেছেন)।
আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ্‌ আরও বলেনঃ
(إذا قلت قولا يخالف كتاب الله وخبر الرسول ুصلى الله عليه وسلم-فاتركوا قولي) [النافع الكبير لأبي الحسنات ص ১৩৫].
‘আমি যদি এমন কথা বলে থাকি যা আল্লাহর কিতাব ও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের পরিপন্থী তাহলে আমার কথা অবশ্যই তোমরা পরিত্যাগ করবে।’ (আবুল হাসানাত-আব্দুল হাই লাক্ষ্নৌভি প্রণীত ‘আন্‌ নাফিঊল কাবীর,পৃঃ১৩৫)।
২-ইমাম মালিক ইবনু আনাস রহিমাহুল্লাহ্‌ঃ
তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ
(إنما أنا بشر أخطئ وأصيب فانظروا في رأيي فكل ما وافق الكتاب والسنة فخذوه وكل ما لم يوافق الكتاب والسنة فاتركوه)[ ذكره ابن حزم في أصول الأحكام ৬/১৪৯]
‘আমি তো একমজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি, শুদ্ধও করি। অতএব আমার মতামত ভাল করে লক্ষ্য করবে। যে সকল মতামত কুরআন ও সুন্নাহর অনুকুল হবে তা তোমরা গ্রহণ করবে আর যেসব মতামত কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিকূল হবে তা প্রত্যাখ্যান করবে। (ইবনু হাযম প্রণীত’উছূলুল আহকাম ৬/১৪৯)।
তিনি আরও বলেনঃ
(ليس بعد النبي-صلى الله عليه وسلم-إلا ويؤخذ من قوله ويترك)[ذكره ابن عبد الهادي في إرشاد السالك-২/২৭৭]
‘নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পর এমন কেউই নেই যার সবকিছু গ্রাহ্য হবে আর তার কোন কথা প্রত্যাখ্যাত হবে না।’ (ইবনু আব্দিল হাদী প্রণীত ‘ইরশাদুস্‌ সালিক, ২/২৭৭)।
৩-ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ্‌ঃ
তিনি বলেনঃ
(ما من أحد إلا وتذهب عليه سنة للرسول-صلى الله عليه وسلم-وتعزب عنه، فمهما قلتُ من قول أو أصلت من أصلٍ فيه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم خلاف ما قلتُ، فالقول ما قاله رسول الله-صلى الله عليه وسلم-وهو قولي ودعوا ما قلتُ. وفي رواية: (فاتبعوها ولا تلتفتوا إلى قول أحد )[ الهروي في ذم الكلام ৩/৪৭، النووي في المجموع ১/৬৩، الإيقاظ ص ১০০]
‘প্রত্যেক ব্যক্তিই এমন, যার উপর রাসূল এর কিছু সুন্নাত চলে যাবে এবং গায়েব থাকবে, অতএব আমি যে কথাই বলি না কেন, বা যে কায়দা-নীতিই প্রণয়ন করিনা কেন; যদি সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমার কথার বিপরীত কথা বর্ণিত হয় তবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কথা বলেছেন সেটাই সঠিক। ইহা আমারও কথা। আর আমার পূর্বের কথাটি তোমরা প্রত্যাখ্যান করবে। অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘সে সময় তোমরা তারই অনুসরণ করবে, এবং অন্য কারও কথার দিকে দৃষ্টি দেবে না। (হেরাভী প্রণীত যাম্মুল কালাম ৩/৪৭,নাওয়াভী প্রণীত’আল্‌ মাজমূ’১/৬৩,ফুল্লানী প্রণীত’আল্‌ ঈক্বায,পৃঃ১০০)।
তিনি আরো বলেন :
(كل ما قلتُ فكان عن النبي-صلى الله عليه وسلم-خلاف قولي بما يصح فحديث رسول الله أولى فلا تقلدوني)[ رواه ابن أبي حاتم في الأدب ص ৯৩، وابن عساكر ১০/১৫২]
‘আমার বলা যে সব কথার বিপরীতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ বাণী পাওয়া যাবে, তখন মনে করবে রাসূলুল্লাহর হাদীছই বেশী উত্তম-অগ্রগণ্য, অতএব তোমরা আমার অনুসরণ করবে না। (ইবনু আবী হাতেম প্রণীত ‘আল্‌ আদাব’,ইবনু আসাকির প্রণীত ‘১০/১৫২)।
৪-ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ্‌ঃ
তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেনঃ
(لا تقلدني ولا تقلد مالكا ولا الشافعي ولا الأوزاعي ولا الثوري وخذ من حيث أخذوا)[ ذكره ابن القيم في الإعلام ২/৩০২، والفلاني ুفي الإيقاظ- ১১৩]
‘তুমি আমার অনুসরণ কর না। মালেক, শাফেঈ, আওযাঈ, ছাওরী প্রমুখেরও অনুসরণ কর না। বরং তাঁরা যেখান থেকে (শরী’আতের বিধি-বিধান) গ্রহণ করেছেন তুমিও ঠিক সেখান থেকেই গ্রহণ কর। (ইবনুল ক্বায়্যিম প্রণীত’আল্‌ ইলাম,২/৩০২,ফুল্লানী প্রণীত ‘আল্‌ ঈক্বায’ ১১৩)।
অপর বর্ণনায় তিনি বলেনঃ
(لا تقلد دينك أحداً من هؤلاء، ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم- وأصحابه فخذ به، ثم التابعين بعد فالرجل فيه مخير)[ذكره أبو داود في مسائل الإمام أحمد ص ২৭৬، ২৭৭].
তাদের তথা ইমামদের মধ্য হতে কারই তাক্বলীদ-অন্ধ অনুসরণ-করবে না। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর ছাহাবীদের থেকে যা এসেছে তা গ্রহণ কর, অতঃপর তাবেঈদের বিষয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে (ইচ্ছা করলে তাদের কথা সে গ্রহণ করতে পারে আবার বর্জনও করতে পারে)
(আবুদাউদ এটিকে মাসায়েলুল ইমাম আহমাদ’ পৃঃ২৭৬-২৭৭ এ উল্লেখ করেছেন)।
ইমাম আহমাদ রহ. আরো বলেনঃ
(رأي الأوزاعي و رأي مالك ورأي أبي حنيفة كله رأي، وهو عندي سواء، وإنما الحجة في الآثار)[ ذكره ابن عبد البر في الجامع ২/১৪৯]
‘আওযাঈর রঅভিমত, মালেক এর অভিমত, আবু হানীফার অভিমত এগুলোই সবই অভিমত যা আমার নিকট সমান। প্রকৃত প্রমাণ হল আছার তথা রাসূল ছাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ।
(ইবনু আব্দিল বার প্রণীত ‘জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি’২/১৪৯)।
তিনি আরো বলেনঃ
(من رد حديثاً لرسول الله صلى الله عليه وسلم فهو على شفا هلكة)[ذكره ابن الجوزي في مناقب الإمام أحمد-رحمه الله-১৮২]
‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের এর কোন হাদীছ প্রত্যাখ্যান করবে সে অবশ্যই ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত। (ইবনুল জাওযী প্রণীত ‘মানাক্বিবুল ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ-১৮২)
এই যদি হয় মাযহাবসমূহের ইমামগণের তরীকা তবে তো আপনার তাদের বিরোধী হওয়া উচিত নয়। তবে ইহার অর্থ এই নয় যে, তাদের কথা গ্রহণ করা যাবে না, তাদের সমধিক দলীল সম্মত কথাটিও অনুসরণ করা যাবে না। বিষয়টিতে কখনো বাড়াবাড়ি ও ত্রুটি, কোনটিই করা যাবে না।
• কিছু আদব-শিষ্টাচার যা ইলম অন্বেষণকারীর মাঝে বিদ্যমান থাকা যরূরী
১-বিনয়-নম্রতা
২-নিজের ইলম জনগণের খেদমতে কাজে লাগান ও তা পরিশুদ্ধ করা।
৩-নীরবতাবলম্বন ও ধৈর্যধারণ
৪-নেতৃত্ব ও কতৃত্ব থেকে দূরে থাকা
এই বিষয়ে আরও অনেক কিছু রয়েছে যা ছেড়ে দিয়েছি কেবল বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায়।
এবিষয়ে আরও অধিক জানার জন্য পড়ুনঃ
১-আজুররী প্রণীত ‘ইখতিলাফুল উলামা’।
২-ইবনু আব্দিল বার প্রণীত ‘জামেঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহী’।
৩-ইবনুল ক্বায়্যিম প্রণীত ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন’।
৪-আলবানীর তাহক্বীক্বে খত্বীব বাগদাদী প্রণীত ‘ইক্বতিযাউল ইলমিল আমালা।
৫-ইবনু মুফলিহ প্রণীত ‘আল্‌ আদাবুশ্‌ শারঈয়্যাহ।
৬-হামূদ তুওয়াইজিরী প্রণীত ‘তাগলীযুল মালাম।
৭-বাকর আবু যায়দ প্রণীত ‘হিলয়াতু ত্বালিবিল ইলম’।
ইলমে তাফসীর তথা তাফসীর বিষয়ের ভূমিকা
ইলমে তাফসীর বিষয়ে কথা বলার পূর্বে কুরআনুল কারীমের ফযীলত এবং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থাবলী প্রভৃতি বিষয়ে ইশরাহ্‌-ইঙ্গিত দেওয়া যরূরী।
প্রথমতঃ আল্‌ কুরআন ও তার সংজ্ঞাঃ
মহাগ্রন্থ আল্‌ কুরআন হল আল্লাহর বাণী যা তাঁর রাসূল সা. এর প্রতি জিবরীলে আমীনের মাধ্যমে নাযিল করা হয়েছে। যার তিলাওয়াত-পঠনের মাধ্যমে ইবাদত করা হয় এবং যা আমাদের নিকট ধারাবাহিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যার শব্দ ও আয়াত অলৌকিক বিষয়। এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন-আল্লাহর প্রশংসা ও করুণায়-সমগ্র মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে স্থানান্তরকারী। ইহা আল্লাহর বাণী, এটি সৃষ্ট বস্তু নয়। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لا يَعْلَمُونَ (৬)[التوبة]
‘যদি কোন মুশরিক আপনার কাছে নিরাপত্তা তলব করে তাহলে তাকে নিরাপত্তা দিন যাতে সে আল্লাহর কালাম-বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দিন। ইহা এজন্যই যে তারা অজ্ঞজাতী। (সূরা আত্‌ তাওবাহ্‌ঃ৬)
মুসলিম উম্মত এই মহান গ্রন্থের উপর গভীরভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। এই সেই কিতাব যা কাফেরদের গলাভ্যন্তরের কন্টকস্বরূপ এবং মুনাফিক ও অপরাধীদেরকে লাঞ্ছিতকারী। এই কুরআনের প্রতি মুসলিম উম্মত যথেষ্ট লক্ষ্য রেখেছে তিলাওয়াত, মুখস্ত করণ, আমল প্রভৃতির মাধ্যমে। আল্লাহ্‌ এই গ্রন্থের সংরক্ষণের দায়িত্বভার নিজেই নিয়েছেন। তাই তো মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ (৯)[الحجر]
‘নিশ্চয়ই আমিই এই যিকর (কুরআন) কে নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী। (সূরা আল্‌ হিজর :৯)
এজন্যই মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হল, এই মহান গ্রন্থকে নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। গভীরভাবে অর্থ জেনে বুঝে পাঠ করা। এজন্যই সে একটি আয়াত ততক্ষণ অতিক্রম করবে না যেযাবৎ তার অর্থ না বুঝবে এবং তদানুযায়ী আমল না করবে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا (২৪)[محمد]
‘তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না কেন, নাকি তাদের অন্তর সমূহে তালা ঝুলানো রয়েছে?’ (সূরা মুহাম্মাদঃ২৪)
মহান আল্লাহ্‌ আরও বলেনঃ
أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلافاً كَثِيراً (৮২)[النساء]
‘তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না কেন? যদি তা আল্লাহ্‌ ভিন্ন অন্য কারও পক্ষ থেকে হত, তাহলে এর মাঝে অনেক মতভেদ দেখতে পেত।’ (সূরা আন্‌ নিসা : ৮২)
সালাফে ছালেহীন কুরআনের মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তারা তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণায় মত্ব হয়ে ছিলেন। নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণ দশটি আয়াত অতিক্রম করতেন না যে যাবৎ তারা তা মুখস্ত করে না নিতেন এবং তার উপর আমল না করতেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَاناً وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ (২)[الأنفال]
‘মুমিন তো তারাই যাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের অন্তরসমূহ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যায়। আর তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হলে তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে দেয় আর তারা নিজ প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। (সূরা আল্‌ আনফালঃ২)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
لَوْ أَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعاً مُتَصَدِّعاً مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ (২১)[الحشر]
‘আমি এই কুরআনকে যদি পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তাহলে অবশ্যই তাকে দেখতে পেতে এই অবস্থায় যে, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে।’ (সূরা আল্‌ হাশরঃ২১)।
তারীখে বাগদাদ প্রণেতা (খত্বীব বাগদাদী) উল্লেখ করেছেন, আবু হানীফা পুরা একটি রাত কিয়াম করেছেন মহান আল্লাহর এই বাণীটি তেলাওয়াত করতে করতে-
بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ (৪৬)[القمر]
‘বরং কিয়ামত হল তাদের প্রতিশ্রূত সময়। আর এই কিয়ামত হল ঘোরতর বিপদ ও তিক্ততর।’ (সূরা আল্‌ ক্বামারঃ৪৬)।
এসব কারণেই এই উম্মতের উপর এই মহান ভিত্তি দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং তার ফযীলত জানা, তার তেলাওয়াত করা এবং তা পরিত্যাগকৃত অবস্থায় ফেলে না রাখা কর্তব্য। উল্লেখ্য এই কিতাব দৃঢ়ভাবে ধারণ করার দাবী হিসাবে কিছু মহান বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা একান্তই যরূরী। এ বিষয়গুলোর অন্যতম হল এই আল কুরআন-কে মুখস্ত করা।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ… (৪৯)[العنكبوت]
‘বরং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে ইহা (কুরআন) তো স্পষ্ট আয়াত-নিদর্শন।’ (সূরা আল্‌ আনকাবূতঃ৪৯)।
হাদীছে কুদসীতে এসেছে, যা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-তাঁর প্রতিপালক থেকে বর্ণনা করেনঃ
(إِنَّمَا بَعَثْتُكَ لأَبْتَلِيَكَ وَأَبْتَلِىَ بِكَ وَأَنْزَلْتُ عَلَيْكَ كِتَابًا لاَ يَغْسِلُهُ الْمَاءُ تَقْرَؤُهُ نَائِمًا وَيَقْظَانَ)[رواه مسلم مطولاً، كتاب الجنة، باب الصفات التي يعرف بها في الدنيا أهل الجنة وأهل النار(৭১৩৬)]
আমি তো আপনাকে প্রেরণ করেছি একমাত্র এজন্যই যে আপনাকে আমি পরীক্ষা করব এবং আপনার দ্বারা অন্যদেরকে পরীক্ষায় ফেলব। আপনার উপর এমন একটি গ্রন্থ নাযিল করেছি যা সাগরের পানি ধৌত করতে পারবে না। তা আপনি ঘুমিয়ে, জাগ্রত সর্বাবস্থায় পড়তে পারবেন।’ (মুসলিম এর দীর্ঘ হাদীছের অংশ বিশেষ,জান্নাত অধ্যায়,হা/৭১৩৬)।
(ইমাম) নববী (রহ.) বলেনঃ ‘অর্থাৎ এই কুরআন বক্ষে সংরক্ষিত, ইহা বিলুপ্ত হবার নয়। বরং যুগ পরম্পরায় (অপরিবর্তিত অবস্থায়) অবশিষ্ট থাকবে। (শারহু মুসলিম ১৯৫/১৭,জান্নাত অধ্যায়,৭১৭৬ নং হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
এই কুরআন সমস্ত মানুষের উপর মুখস্ত করা সহজঃ
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (১৭)[القمر]
‘আর আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি, সুতরাং আছে কি কেউ উপদেশ গ্রহণকারী? (সূরা আল্‌ ক্বামারঃ১৭)
কুরতুবী আয়াতটির তাফসীরে বলেনঃ
অর্থাৎঃ আমি এই কুরআনকে মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি, এবং যে তা মুখস্থ করতে চায় তাকে সহযোগিতা করেছি। সুতরাং আছে কি কেহ, যে এটা মুখস্থ করতে চায়? তাকে সে বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে? (তাফসীরুল কুরতুবী ৮৭/১৭)।
কুরআন কারীম মুখস্থ করার ফযীলত
১-কুরআন মুখস্থ করার মাধ্যমে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা হয়ঃ
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
لقدكَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً (২১)[الأحزاب]
‘তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, তাদের জন্য যারা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করে।’ (সূরা আল্‌ আহযাবঃ২১)
কুরআন মুখস্থ করার মাধ্যমে নবীর অনুসরণ করা হয় এজন্যই যে রাসূল কুরআন মুখস্থ করতেন এবং জিবরীলের নিকট তা শুনাতেন। এবং তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম ও রাসূলুল্লাহর কাছে কুরআন শুনাতেন। (বুখারী,হা/৬,মুসলিম,হা/৮০৩২)
২-কুরআনের ধারক-বাহকগণ আল্লাহর আপন জনঃ
ইবনু মাজাহ্‌ আনাস এর সূত্রে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সংকলন করেন, তিনি বলেনঃ
( إن لله أهلين من الناس قالوا يا رسول الله من هم ؟ قال هم أهل القرآن أهل الله وخاصته )[رواه ابن ماجة، المقدمة، باب فضل من تعلم القرآن وعلمه(১৬) حديث رقم (২১৫) وصححه الألباني في صحيح ابن ماجة]
‘নিশ্চয় মানুষের মধ্য থেকে আল্লাহর কিছু আপনজন রয়েছে। তাঁরা (ছাহাবায়ে কেরাম) বললেনঃ তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেনঃ তারা হল কুরআনপন্থীরা। এরাই হল আল্লাহর আপন ও খাছ ব্যক্তিবর্গ। (ইবনু মাজাহ,ভূমিকা,হা/২১৫,হাদীছটিকে শাইখ আলবানী ছহীহ ইবনু মাজায় ছহীহ বলেছেন)
আবুদাউদ আবু মূসা আশ’আরীর সূত্রে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ
্র إِنَّ مِنْ إِجْلاَلِ اللَّهِ إِكْرَامَ ذِى الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ وَحَامِلِ الْقُرْآنِ غَيْرِ الْغَالِى فِيهِ وَالْجَافِى عَنْهُ وَإِكْرَامَ ذِى السُّلْطَانِ الْمُقْسِطِ গ্ধ.[أخرجه أبو داود، كتاب الأدب، باب في تنزيل الناس منازلهم (২৩) حديث رقم (৪৮৪৩)، وقد حسنه الألباني-رحمه الله-في صحيح الجامع ২১৯৫].
‘নিশ্চয় আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনেরই অন্তর্ভুক্ত হল বয়োবৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কুরআনের এমন বাহককে সম্মান করা যে তাতে বাড়াবাড়ি কিংবা ত্রুটি-বিচ্যুতি করেনি। আর ন্যায়পরায়ণ শাসককে সম্মান করা।’ (আবুদাউদ,আদব অধ্যায়, হা/৪৮৪৩, হাদীছটিকে শাইখ আলবানী হাসান বলেছেন। দ্রঃ ছহীহুল জামে’ হা/২১৯৫)
৩-কুরআনের হাফেয এর সাথে ঈর্ষা পোষণ করা অধিক উপযুক্ত ও যুক্তি সঙ্গতঃ
কুরআন ইলম ও মর্যাদার উৎস। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
انْظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلاً (২১) [الإسراء]
‘আপনি দেখুন কিভাবে আমি তাদের একজনকে অপর জনের উপর মর্যাদা দান করেছি। আর অবশ্যই আখেরাত হবে মর্যাদা ও ফযীলতের দিক থেকে আরও বড় ও আরও মহান। (সূরা আল্‌ ইসরাঃ২১)
কুরআন এর বাহককে আল্লাহ মর্যাদা দান করেছেন। এজন্যই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে ইমরান রাঃ এর সূত্রে।
তিনি এরশাদ করেনঃ
( إِنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ)[رواه مسلم، كتاب صلاة المسافرين وقصرها، باب فضل من يقوم بالقرآن ويعلمه…، حديث رقم (২৬৯)]
নিশ্চয় আল্লাহ্‌ এই কিতাব-কুরআন দ্বারা কিছু লোককে মর্যাদা মন্ডিত করেন আবার কিছু লোককে এই কিতাব-কুরআন দিয়েই নীচু করে দেন। (মুসলিম, ছালাত অধ্যায়, হা/২৬৯)
এজন্যই কুরআনের বাহকের সাথে ঈর্ষা করা অধিক উপযুক্ত কারণ, আল্লাহ্‌ তাকে এই কুরআন এর মাধ্যমেই মর্যাদা মন্ডিত করেছেন। ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ الْقُرْآنَ وَقَامَ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ (وَآنَاءَ النَّهَارِ) وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَهُوَ يَتَصَدَّقُ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ .
‘একমাত্র দুইটি বিষয়ে তথা দুই ব্যক্তির সাথে ঈর্ষা পোষণ করা যায়। এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্‌ কুরআন দান করেছেন এবং সে তদানুযায়ী আমল করে রাতের এবং দিনের অংশে।
অপর বর্ণনায় এসেছে : সে উহার তেলাওয়াত করে রাতে এবং দিনের অংশে। আরেক জন ব্যক্তি হল, যাকে আল্লাহ্‌ সম্পদ দান করেছেন আর সে উক্ত সম্পদ রাত ও দিনে দান করে থাকে।
(বুখারী, ইলম অধ্যায়, হা/৭৩, মুসলিম, মুসাফিরদের ছালাত অধ্যায়। হা/২৬৬)
৪-এই কুরআন মুখস্থ করা ও তেলাওয়াতে রয়েছে মহা পুরস্কার
মানুষ দেরহাম ও দীনার লাভে আনন্দিত হয়। আর কুরআনের হাফেজগণ ও উহার ধারক-বাহকগণ তার চেয়েও অধিক উত্তম ও অধিক স্থায়ী বস্তু হাছিল করে থাকেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
(أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ إِذَا رَجَعَ إِلَى أَهْلِهِ أَنْ يَجِدَ فِيهِ ثَلاَثَ خَلِفَاتٍ عِظَامٍ سِمَانٍ গ্ধ. قُلْنَا نَعَمْ. قَالَ ্র فَثَلاَثُ آيَاتٍ يَقْرَأُ بِهِنَّ أَحَدُكُمْ فِى صَلاَتِهِ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلاَثِ خَلِفَاتٍ عِظَامٍ سِمَانٍ)[رواه مسلم، كتاب صلاة المسافرين، باب فضل قراءة القرآن في الصلاة و تعلمه، حديث رقم (৮০২)]
‘তোমাদের কেউ কি চায় যে সে নিজ পরিবারে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে তিনটি বড় বড় ও মোটা-তাজা উট পেয়ে যাবে? আমরা বললামঃ হ্যাঁ, আমরা তা চাই। তিনি বললেনঃ তোমাদের কারও নিজ ছালাতে তিনটি আয়াত পাঠ করা এর চেয়ে উত্তম। (মুসলিম, মুাফিরদের ছালাত অধ্যায়, হা/৮০২)
উক্ববাহ বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (মসজিদে নববীর) ছুফ্‌ফায়[৮] ছিলাম এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্‌ আমাদের নিকট বের হয়ে আসলেন এবং বললেনঃ
(أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِىَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِى غَيْرِ إِثْمٍ وَلاَ قَطْعِ رَحِمٍ، فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ نُحِبُّ ذَلِكَ. قَالَ: أَفَلاَ يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمَ أَوْ يَقْرَأَ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلاَثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلاَثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ [رواه مسلم، باب فضل قراءة القرآن…حديث رقم (৮০৩)]
তোমাদের কেউ এটা পছন্দ করে যে, সে প্রতি দিন সকালে বুতহান বা আক্বীক গিয়ে সেখান থেকে কোন প্রকার পাপ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক কর্তন ছাড়াই দুটি মোটা তাজা উষ্ট্রী নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তা পছন্দ করি। তিনি বললেন,
তোমাদের মধ্য থেকে কেউ সকাল বেলা যেয়ে মহান আল্লাহর কিতাব -আল্‌ কুরআন থেকে দুটি আয়াত শিক্ষা করে বা করায় অথবা পাঠ করে না কেন? এটা তো তার জন্য দুটি উষ্ট্রী অপেক্ষা উত্তম, তিনটি আয়াত তিনটি উষ্ট্রী অপেক্ষা উত্তম। চারটি আয়াত চারটি উষ্ট্রী অপেক্ষা উত্তম। এভাবে কুরআনের আয়াত সংখ্যা উষ্ট্রী সংখ্যা অপেক্ষা উত্তম। (মুসলিম, অনুচ্ছেদ: কুরআন তেলাওয়াত করার ফযীলত, হা/৮০৩)
জাবির (রাঃ) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ
(الْقُرْآَنُ شَافِعٌ مُشَفَّعٌ، وَمَا حَلَّ مُصَدَّقٌ، فَمَنْ جَعَلَهُ إِمَامَهُ قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَهُ سَاقَهُ إِلَى النَّارِ”)[رواه ابن حبان، وصححه الألباني-رحمه الله-في صحيح الجامع ৪৪৪৩]
‘নিশ্চয় কুরআন হল এমন সুপারিশকারী, যার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। আর তা তার বিরোধীদের বিপক্ষে মত্যায়নকারী। সুতরাং যে তাকে নিজের সামনে রাখবে সে তাকে জান্নাতের দিকে পরিচালনা করবে। পক্ষান্তরে যে তাকে পিছে ফেলে রাখবে সে তাকে জাহান্নামের আগুনের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে।
(ইবনু হিব্বান, আলবানী রহিমাহুল্লাহ্‌ হাদীছটিকে ছহীহুল জামে’ গ্রন্থে হা/ ৪৪৪৩-ছহীহ বলেছেন)।
আবু হুরাইরা রা. নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ
يَجِيءُ الْقُرْآنُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَلِّهِ، فَيُلْبَسُ تَاجَ الْكَرَامَةِ ثُمَّ يَقُولُ يَا رَبِّ زِدْهُ فَيُلْبَسُ حُلَّةَ الْكَرَامَةِ ثُمَّ يَقُولُ يَا رَبِّ ارْضَ عَنْهُ [فَيَرْضَى عَنْهُ] فَيُقَالُ لَهُ اقْرَأْ وَارْقَ وَتُزَادُ بِكُلِّ آيَةٍ حَسَنَةً)
[رواه الترمذي في كتاب فضل القرآن رقم (২৯১৫)، والدارمي، فضائل القرآن، رقم(৩৩১১)، وحسنه الألباني رحمه الله-في صحيح الجامع ৮০৩০]
‘কিয়ামত দিবসে কুরআন উপস্থিত হয়ে বলবেঃ হে প্রতিপালক! তাকে (কুরআনের বাহককে) সুসজ্জিত করুন। তখন তাকে সম্মানের তাজ-মুকুট পরানো হবে। অতঃপর কুরআন বলবেঃ তাকে আরো বাড়িয়ে দিন তখন তাকে সম্মানের এক জোড়া কাপড় পরানো হবে। এরপর কুরআন বলবে, হে প্রতিপালক! আপনি তার উপর রাযী-খুশী হয়ে যান। তখন তিনি তার উপর রাযী-খুশী হয়ে যাবেন। পরে তাকে বলা হবে, তুমি পড় এবং উপর দিকে উঠে যাও এবং তোমাকে প্রত্যেকটি আয়াতের বিনিময় একটি করে নেকী বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে।
(তিরমিযী,কুরআনের ফযীলত অধ্যায়,হা/২৯১৫,দারেমী,ফাযায়েলুল কুরআন অধ্যায়,হা/৩৩১১,হাদীছটিকে শাইখ আলবানী ছহীহুল জামে’ গ্রন্থে,হা/৮০৩০-হাসান বলেছেন)।
ইবনু হাজার হায়তামী বলেনঃ
উক্ত হাদীছটি ঐ ব্যক্তির সাথে খাছ যে কুরআন মুখস্থ করে। তার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, যে কুরআন দেখে দেখে পড়ে। কারণ কুরআন দেখে পড়া পড়ার বিষয়টিতে মানুষ এক অপর থেকে ভিন্ন নয় এবং কম ও বেশীর দিক থেকে তাদেও মধ্যে কোন তফাত নেই। আর যে বিষয়ে তাদের মধ্যে তফাৎ রয়েছে তা হল অন্তর দিয়ে কুরআন মুখস্ত করার বিষয়টি। এর পর হায়তামী রহিমাহুল্লাহ্‌ বলেন, আর ফেরেশতাদের কথা, ‘তুমি পড় এবং উপর দিকে উঠে যাও’-তাঁদের এই কথাটিই এই মর্মে সম্পূর্ণ স্পষ্ট যে ইহা দ্বারা অন্তর দিয়ে কুরআন মুখস্ত করাই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। [৯]।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ: الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ)[رواه الترمذي، كتاب الفضائل برقم ২৯১০، وصححه الألباني-رحمه الله في صحيح الجامع ৬৪৬৯]
যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব হতে একটি অক্ষর পড়বে সে একটি নেকী পাবে, আর একটি নেকী তার দশগুণ হবে। আমি বলছি না যে (আলিফ লাম মিম) মিলে একটি হরফ হয়। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ। (তিরমিযী,ফাযায়েল অধ্যায়,হা/২৯১০,হাদীছটিকে শাইখ আলবানী ছহীহুল জামে’ গ্রন্থে,হা/৬৪৬৯-ছহীহ বলেছেন।[১০]
সাবেক আসমানী কিতাব সমূহের প্রতি ঈমান -বিশ্বাস স্থাপনঃ[১১]
১-এসব কিতাবাদির সংজ্ঞাঃ
এগুলি হল ঐসব কিতাব যা আল্লাহ্‌ তদীয় রাসূলদের উপর নাযিল করেছেন এই সৃষ্টিকূলের প্রতি দয়া স্বরূপ এবং তাদের হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে। এই সমস্ত কিতাবেরই অন্তভুর্ক্ত হল যা আল্লাহর রাসূল মূসা, ঈসা, দাঊদ, ইবরাহীম-আলাইহিমুস্‌ সালাম-প্রমুখের উপর নাযিল করা হয়েছে। কিতাব গুলি হলঃ ১-তাওরাত (যা মূসা নবীর উপর নাযিল হয়েছে) ২-ইঞ্জিল (যা ঈসা নবীর উপর নাযিল হয়েছে, ৩-যাবূর (যা দাঊদ নবীর উপর নাযিল হয়েছে) এবং ‘ছুহুফ্‌’-ছহীফা (যা ইবরাহীম আলাইহিমুস্‌ সালাম এর উপর নাযিল হয়েছে)
২-এসব আসমানী কিতাবাদির উপর ঈমান আনার বিধানঃ
এগুলি কিতাবের উপর ঈমান-বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অন্যতম রুকন। ইহা ব্যতীত কোন মানুষের ঈমান বিশুদ্ধ হবে না।
অতএব,অবশ্যই এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেই হবে যে মহান আল্লাহ্‌ কিছু কিতাব নাযিল করেছেন তাঁর রাসূলদের নিকটে সুস্পষ্ট হক সহকারে এবং সুউজ্জল আদর্শের সাথে। এবং আরও বিশ্বাস রাখতে হবে যে, উহা মহান আল্লাহর বাণী সেটাই যা তিনি বাস্তবেই বলেছেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى…)[البقرة:১৩৬]
তোমরা বল,আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা নাযিল হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব এবং তদীয় বংশধরদের প্রতি এবং মূসা ও ঈসাকে যা দান করা হয়েছে… তৎসমূদয়ের উপর (আল্‌ বাক্বারাহঃ১৩৬)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
(وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلائِكَةِ)[البقرة:১৭৭]
বরং বড় সৎ কাজ হল, যে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, শেষ দিবসের উপর এবং ফেরেশতাদের উপর। (সূরা আল্‌ বাক্বারাহঃ ১৭৭)
৩-মুসলিম ব্যক্তি উপর ওয়াজিব হল এই বিশ্বাস করা যে এই কিতাবগুলো মানসূখ তথা রহিত হয়ে গেছে।
কারণ, মহান বলেনঃ
(وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقاً لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِناً عَلَيْهِ)[المائدة:৪৮].
আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয় বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সূরা আল্‌ মায়িদাহ্‌ঃ ৪৮)
অথর্ঃ এই কিতাব পূর্বের সকল আসমানী কিতাবসমূহের উপর ফায়ছালাদানকরী। তার উচিত এই বিশ্বাস করা যে, বিদ্যমান পূর্বের আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত, পরিবর্তিত হয়েছে। এবং এসব কিতাবের অনুসারীগণ তথা ইহুদী ও খৃষ্টানগণ এই কিতাবগুলির বিনিময়ে অল্প-তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে এগুলোর মৌলিকত্ব নষ্ট করে ফেলেছে। সুতরাং তারা কতই না মন্দ বিষয় খরিদ করেছে! এসব কিতাবের মাঝে বিকৃতি ঘটার নিদর্শন ও প্রমাণ অসংখ্য। তার থেকে নিম্নে কিছু পরিবেশিত হলঃ
১-এই সমস্ত কিতাবাদিতে এমন এমন বিষয় সন্নিবেশিত আছে যা দ্বারা না আল্লাহ্‌ না তাঁর নবী, না তাঁর অলীগণকে গুনাম্বিত করা জায়েয।
২-এসব কিতাবাদিও সনদ বিচ্ছিন্ন-কর্তিত বরং এগুলোর সনদই নেই।
৩-এগুলো কিতাব অনুবাদক, ঐতিহাসিক ও তাফসীরকারকদের কথার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে গেছে।
৪-এসব কিতাবাদির সংবাদ ও বিধি-বিধান প্রভৃতি প্রকাশ্যভাবে স্ববিরোধী যা দ্বারা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এগুলো কিতাব বর্তমান অবস্থায়-আল্লাহর পক্ষ থেকে (নাযিলকৃত) নয়। আর তাদের কিতাবে যা সত্যের অনুকূল এবং বিকৃতি ঘটানো থেকে নিরাপদ রয়েছে সেটিও মহান কুরআন দ্বারা মানসূখ-রহিত হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়তঃ তাফসীর
তাফসীর এর আভিধানিক অর্থঃ হল খুলে দেওয়া, উজ্জল করে তোলা।
পরিভাষায়ঃ
(علم يفهم به كتاب الله ুعز وجلَّ-المنزل على نبيه-صلى الله عليه وسلم-، وبيان معانيه، واستخراج أحكامه وحكمه).
তাফসীর এমন এক ইলমকে বলে, যা দ্বারা মহান আল্লাহর কিতাবকে বুঝা যায় -যা তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। এবং তার অর্থ বর্ণনা করা, তার বিধি-বিধান ও রহস্য উদঘাটন করা হয়।
ইলমে তাফসীরের গুরুত্বঃ
নিশ্চয় আল্লাহ্‌ এই সৃষ্টিকূলকে কুরআন দ্বারা তাঁর ইবাদত করতে বলেছে। কুরআনে শামিল রয়েছে এমন এমন আক্বীদাহ্‌-বিশ্বাস, বিধি-বিধান এবং আদব-আখলাক যার অধিকাংশই ইলমে তাফসীর ভিন্ন অন্য কোন পথে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয় আর তার কারণ নিম্নরূপঃ
১-কুরআন ভাষা অলংকারের সর্বশীর্ষে উন্নীত। তা বহুবিধ অর্থকে অল্প শব্দে একত্রিত করে। আর এবিষয়টি আল্‌ কুরআনের সংক্ষিপ্তকে বিস্তারিত এবং দুর্বোধ্যকে খুলে বলার প্রয়োজন।
২-কুরআন অনেক সময় প্রকাশ্য অর্থ ছাড়াও আরো বিভিন্ন বিষয় উদ্দেশ্য সম্বলিত হয়, যা খুলে বলে দেয় এমন বিদ্যার মুখাপেক্ষী।
৩-কিছু কিছু আয়াত নির্দিষ্ট কারণে নাযিল হয়েছে। তাই (এজাতীয়) আয়াতের অর্থ বুঝা সম্ভব নয় যে যাবৎ তার নাযিল হওয়ার কারণ (প্রেক্ষাপট) না জানা যাবে। ইবনু দাক্বীক্বিলঈদ রহ. বলেনঃ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বর্ণনা দেওয়া কুরআন বুঝার শক্তিশালী মাধ্যম।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্‌ -রহিমাহুল্লাহ্‌- বলেনঃ
(معرفة سبب النزول يعين في فهم الآية فإن العلم بالسبب يورث العلم بالمسبب)
‘আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ (প্রেক্ষাপট) জানা আয়াত বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। কারণ কোন বিষয়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত হওয়ার মাধ্যমে যে কারণে তা ঘটেছে সে বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়।
৪-ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
(الذي يقرأ القرآن ولا يفسر كالأعرابي الذي يهذي بالشعر)
যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে অথচ তার তাফসীর করে না, সে ঐ গ্রাম্য ব্যক্তির ন্যায় যে তাড়াহুড়ার সাথে কবিতা আবৃত্তি করে।
মুজাহিদ বিন জাবর (রহিমাহুল্লাহ্‌) আরো বলেনঃ
(أحب الخلق إلى الله أعلمهم بما أنزل)
আল্লাহর নিকট সৃষ্টিকূলের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় সে ব্যক্তি যে তাঁর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিষয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত।
ইলমে তাফসীরের ব্যুৎপত্তির ইতিহাসঃ
১-নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যামানায় লোক জন ছিল খাঁটি আরবী। তাঁরা কুরআন বুঝতে পারতেন নিজ ভাষাগত যোগ্যতা বলে। তবে কুরআন তাঁর শব্দ, ভাষাগত ও অলংকারগত দিক থেকে অন্যান্ন সকল আরবী ভাষার উর্ধ্বে, আর অর্থগত দিক থেকে তো উর্ধ্বে আছেই। এজন্যই এই কুরআন বুঝার ও আয়ত্ব করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে (যথেষ্ট) তফাৎ ছিল।
এজন্যই তাদের একজন অপরজনের নিকট আল্‌ কুরআন থেকে যা দুর্বোধ্য হত তা তাকে ব্যাখ্যা করে বলে দিতেন। তাদের নিকট এর কোন শব্দ বা অর্থ বুঝতে জটিলতা দেখা দিলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তিনিও তাদেরকে তা ব্যাখ্যা করে বলতেন। কতিপয় আলেম বলেন-যাঁদের অন্যতম হলেন শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্‌[১২]-ঃ ইহা জানা আবশ্যক যে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ছাহাবীদের জন্য কুরআনের অর্থ যেমন খুলে বলেছেন তদ্রূপ তার শব্দগুলিও তিনি খুলে বলেছেন। দলীল মহান আল্লাহর বাণীঃ
(لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ)[النحل:৪৪]
(আপনার নিকটে আমি কুরআন নাযিল করেছি)। যাতে করে তাদের নিকট যা নাযিল হয়েছে তা আপনি তাদেরকে ব্যাখ্যা করে শুনিয়ে দেন। (সূরা আন্‌ নাহল :৪৪)
২-ছাহাবায়ে কেরামের যুগে তাফসীরঃ
আল্লাহর নবীর যামানার চেয়ে ব্যক্তিক্রম ছিল না কারণ, তারা নবুওয়াতের নিকটবর্তী যুগে ছিলেন। এবং বড় বড় ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদের আলেম গোষ্ঠি উপস্থিত ছিলেন। এজন্যই তাদের তাফসীর এ বিষয়ে অনন্য যে, তাতে ইসরাঈলী বর্ণনা খুবই কম গৃহীত হয়েছে। কারণ তারা তাফসীর বিষয়ে অযথা পরিশ্রম করতেন না। এক্ষেত্রে তাঁরা নিন্দনীয় গভীরতায় যেতেন না। বরং সাধারণ অর্থ দ্বারাই যথেষ্ট মনে করতেন। যার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বড় কোন উপকারিতা নেই সেক্ষেত্র তারা বিস্তারিত ব্যাখ্যাকে অবধারিত করতেন না। এতদসত্ত্বেও তাঁরাই ছিলেন কুরআনের তাফসীর ও তার অর্থ অনুধাবনের বিষয় সর্বাধিক জ্ঞানী মানুষ। আর এ বিষয়ে এত টুকুই যথেষ্ট যে তাঁরা কুরআন নাযিলকরণ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং একই যুগে বাস করেছেন।
৩-তাবেঈনদের যুগে তাফসীরঃ
তাবেঈগণ তাঁদের তাফসীর ছাহাবায়ে কেরাম থেকে গ্রহণ করেছেন। এতদসত্ত্বেও তাঁরা তাফসীর করতে অসুবিধা বোধ করতেন যেভাবে ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) অসুবিধা বোধ করতেন। যেমনঃ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহিমাহুল্লাহ্‌) তাঁকে কোন আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে চুপ করে থাকতেন যেন তিনি কিছুই শুনেননি। এজন্যই তাদের তাফসীর শুধুমাত্র উদ্ধৃত তাফসীরেই সীমিত থেকেছে।
৪-লিপিবদ্ধ করণ যুগে তাফসীরঃ
এই যুগে তাফসীর বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করেছে। যদিও অধিকাংশ ওলামায়েদ্বীন হাদীছের অধ্যায়ে এই তাফসীর সন্নিবেশিত করতেন। ঐসময় পরিবর্তন ও এলমেলো ভাব প্রকাশ পায় যখন কিছু মুফাস্‌সির কিছু সনদকে সংক্ষিপ্ত করে এবং সালাফদের থেকে বর্ণিত আছারগুলিকে তাদের মতের দিকে সম্পর্কিত না করেই উদ্ধৃত করার দিকে ধাবিত হন যার ফলে তাঁরা বিশুদ্ধ বর্ণনাকে যঈফ-অশুদ্ধ বর্ণনার সাথে সংমিশ্রিত করে ফেলে। এই ছিদ্র দিয়ে ধর্মের দুশমন, বেদ্বীন ও সঠিক ধর্মচ্যুত ব্যক্তিরা প্রবেশ করে যাতে করে এমন সব কথা তৈরী করে দেয় যা ছহীহ নয়। অবশ্য আল্লাহ্‌ এমন সকল ওলামা প্রস্তুত করে দেন যারা হক উম্মোচন করে দেন ও তা প্রকাশ করে দেন এবং যা বাতিল তা মানুষকে জানিয়ে দেন এবং তার খন্ডন করেন। এই স্তরের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রশংসিত ও অপ্রশংসিত উভয় প্রকার মত দ্বারা তাফসীর প্রকাশ লাভ করে। অনুরূপভাবে কুরআনে আল্লাহর উপর বিনা ইলমে কথা বলার দুঃসাহসিকতা প্রকাশ করে এবং একই আয়াতের তাফসীরে বিভিন্ন রকম উক্তি প্রকাশ পায়। ইসরাঈলী বর্ণনা ব্যাপক আকারে প্রকাশ পায়। তবে আল্লাহর প্রশংসা যে, ইসলামের ইমামদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক ইলমে তাফসীরের গবেষক ব্যক্তি পাওয়া যায়, যাঁরা এই সমস্ত বর্ণনা ও কথাগুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নিধারণ করেন কোন্‌টি কথা বা বর্ণনা গ্রহণীয় এবং কোন্‌টি বর্জনীয়।
তাফসীরের প্রকারভেদঃ
মহা গ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর দুইভাগে বিভক্তঃ
১-বর্ণনা ভিত্তিক তাফসীরঃ
এতে শামেল রয়েছে কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর যা কোন আয়াতের ক্ষেত্রে অন্যত্র বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণের সাথে এসেছে। অনুরূপভাবে যা নবী ছাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তাঁর ছাহাবীদের থেকে উদ্ধৃত হয়েছে যা কুরআন কারীমে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে।
২-নিজস্ব মত দ্বারা তাফসীরঃ এরূপ তাফসীর দুই ভাগে বিভক্তঃ
ক-প্রশংসিত মত
খ) নিন্দিত মত
আরো জানা দরকার যে কুরআনের বিভিন ্নরকম তাফসীর রয়েছে। যার অন্যতম হলঃ
ফিক্বহী তাফসীর, লুগাবী তথা ভাষাগত তাফসীর, বিজ্ঞান ভিত্তিক তাফসীর, ইঙ্গিত সূচক তাফসীর প্রভৃতি। যার কিছু কিছু প্রকারকে কতিপয় ইমাম নিন্দনীয় বলেছেন। কারণ সেগুলিতে অযথা শ্রম ব্যয় করা হয়েছে। আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং এমন এমন বিষয়ের সন্নিবেশ করা হয়েছে যার সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই। এবং এমন এমন স্থানে আয়াতকে অবতীর্ণ করা হয়েছে যা তার শানে মোটেও প্রযোজ্য নয় এবং যার উদ্দেশ্যে যা তাফসীর করা হয়েছে তার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
কুরআন কারীম তাফসীর করার পদ্ধতিঃ
(ক)কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর করাঃ
এই প্রকারটি হল তাফসীর করার সর্বোত্তম ও সর্বাধিক নিরাপদ পদ্ধতি। কারণ সংক্ষিপ্ত আয়াত অন্যান্য স্থানে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহকারে আসে। যেমন নবী কাহিনী প্রভৃতি। আবার কোন কোন সময় আয়াতের তাফসীর একই সূরাহতে এসে থাকে যেমন মহান আল্লাহর বাণীঃ
وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ (১) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ (২) النَّجْمُ الثَّاقِبُ (৩)[الطارق]
‘আসমান ও ত্বারেক এর কসম! আপনি কি জানেন ত্বারেক কি? সেটি হল’অধিক উজ্জল তারকা।’
এখানে আল্লাহ্‌ স্পষ্টভাবে বলেই দিয়েছেন যে ত্বারেক দ্বারা উদ্দেশ্য হল ‘আন্‌ নাজমুছ্‌ ছাক্বিব’-অধিক উজ্জল তারকা।
খ-তাফসীরুল কুরআন বিস্‌ সুন্নাহ্‌ তথা আল্লাহ্‌র রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ দ্বারা তাফসীর করাঃ
অতএব একজন মুসলিমের উচিত আয়াতের তাফসীরে সর্ব প্রথম আল্লাহর কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করা, মানে অন্য আয়াতে খোজ করা। যদি না পায় তাহলে তার তাফসীর তালাশ করবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীছে। এরই অন্যতম উদাহরণ হল, ‘ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবার’ তথা হজের বড় দিনের তাফসীর করা ‘ইয়াওমুন্‌ নাহ্‌র-কুরবানীর দিন’ দ্বারা। (বুখারী,হা/৪৪০৬,মুসলিম,হা/১৬৭৯)।
এবং কুরআনের সূরা আনফালের ৬০ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘শক্তির’ তাফসীর করা তীর নিক্ষেপ দ্বারা। (মুসলিম,হা/১৯১৭)।
গ) যদি সে তাফসীর আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতে না পায় তবে অবশ্যই সে উক্ত আয়াতের তাফসীর ছাহাবীদের বাণীতে অবশ্যই পাবে।
কারণ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছেন যার জন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের তাফসীর বিষয়ে (জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য) দু’আ করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্‌ (রহ.) তাঁর ভূমিকাতে বলেনঃ
‘যদি আপনি (কোন আয়াতের) তাফসীর কুরআন ও সুন্নাহ্‌তে না পান তবে সেক্ষেত্রে ছাহাবীদের বাণীর দিকে প্রত্যাবর্তন করবেন। কারণ এই তাফসীর বিষয়ে তাঁরাই সর্বাধিক অবগত। কারণ তাঁরাই বিভিন্ন আলামত ও অবস্থা যা তাদের সাথেই নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। অনুরূপভাবে তাঁদের রয়েছে পুর্ণাঙ্গ বুঝ এবং ছহীহ ইলম বিশেষ করে তাঁদের আলেম ও বড়দের মধ্যে তো এসব আছেই। (‘মুক্বাদ্দিমাতুত্‌ তাফসীর’ শাইখ ইবনু উছায়মীন রহ. এর ব্যাখ্যাসহ, পৃঃ১২৯-১৩০)
যারকাশী রহিমাহুল্লাহ্‌ বলেনঃ
‘ছাহাবীদের তাফসীর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মারফূ হাদীছের মর্যাদায় উন্নীত। অতএব যদি তাঁরা ভাষাগত দিক থেকে তাফসীর করেন সেক্ষেত্রে সন্দেহাতীত ভাবে তাঁদের প্রতি নির্ভর করতে হবে। আর যদি তাঁরা তাফসীর করেন প্রেক্ষাপট ও আলামত প্রভৃতি দ্বারা যা তাঁরা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন তাতেও কোন সন্দেহ করা যাবে না।’
খ্যাতনামা তাফসীরকারক ওলামায়ে দ্বীনঃ
ছাহাবীদের মধ্য হতেঃ তাঁরা হলেনঃ আলী ইবনু আবী ত্বালিব, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আব্দুল্লাহ্‌ ইবনু আব্বাস, উবায় ইবনু কা’ব (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)
এবং তাবেঈদের মধ্য হতেঃ
মুজাহিদ বিন জাব্‌র, সাঈদ ইবনু জুবাইর, আত্বা, ক্বাতাদাহ, আবুল আলিয়াহ্‌, আমের আশ্‌ শা’বী। ইনাদের পরেই আসবেন শুবাহ্‌ ইবনুল হাজ্জাজ, আব্দুব্‌নু হুমায়দ প্রমুখ (রহিমাহুমুল্লাহ্‌)।
বর্ণনা ভিত্তিক তাফসীরের গুরুত্বপূর্ণ কিতাব সমূহঃ
১-মুহাম্মাদ বিন জারীর আত-তাবারী (মৃত্যুঃ ৩১০ হি.) প্রণীত ‘জামেঊল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন।’
২-আবু মুহাম্মাদ বিন হুসাইন আল বাগাভী (মুত্যুঃ৭৭৪ হিঃ) প্রণীত ‘মা’আলিমুত্‌ তানযীল’।
৩-ইবনু কাছীর (মৃত্যুঃ ৭৭৪ হি.) প্রণীত ‘তাফসীরুল কুরআনিল আযীম’।
তাফসীর সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ঃ
১-ইলম অন্বেষণকারীর কর্তব্য হল সালাফে ছালেহীন ও তাদের (ন্যায় নিষ্ঠভাবে) অনুসরণকারীদের তাফসীরেরর প্রতি বেশী আগ্রহ থাকেত হবে।
২-ঐসমস্ত তাফসীর থেকে দূরে সরে থাকবে যেগুলি বক্র ও বিকৃত আক্বীদায় লেখক হিসাবে সুপ্রসিদ্ধ ও সুপরিচত। যেমন, যামাখ্‌শারী প্রণীত ‘তাফসীরুল কাশ্‌শাফ’ যাতে তিনি নিজ ইতিযালী মাযহাব ( বিদ’আতী মুতাযিলা মাযহাব) এবং উলট-পালট তাফসীর প্রকাশ করেছেন যা প্রাথমিক পর্যায়ের তালেবে ইলমকে কঠিন পেরেশানিতে লিপ্ত করতে সক্ষম। এরই অনুরূপ হল ছূফী রাফেযী ও ইবাযী (প্রমুখ বিদআতী সম্প্রদায়ের) তাফসীরসমূহ। এরই অনুরূপ হল ঐসমস্ত তাফসীরের কিতাব যেগুলি- আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাবীল, বিকৃত ব্যাখ্যা এবং ইলহাদ তথা বিকৃত উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অপব্যাখ্যা পরিবেশনকারী হিসাবে সুপরিচতি। এজাতীয় বিষয় অধিকহারে সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরেও পাওয়া যায়। এসব তাফসীরের কোন কোন তাফসীরকারক অগাধ ইলম ও সৎ নিয়্যতেরও অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর নিজ পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে আল্লাহর কিছু কিছু গুণাবলীর ক্ষেত্রে তার উপর আশ’আরী মাযহাব প্রাধান্য লাভ করেছে। এমন আচরণ তাঁর সমগ্র তাফসীরকে বতিল করবে না। তবে তা থেকে উপকারী বিষয়টি নিতে হবে আর যা ছহীহ আক্বীদাহ বিরোধী হবে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেমন তাফসীরুল কুরতুবী প্রভৃতি। অবশ্য এই অবকাশ একমাত্র তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যিনি হক-বাতিল পার্থক্য করার শক্তি-যোগ্যতা রাখে। পক্ষান্তরে যে ইহার ক্ষমতা রাখে না যেমন প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র এবং যে তাফসীর বিশেষজ্ঞ নয়, সে এর থেকে দুরে থাকবে। এসব লোকদের ক্ষেত্রে সালাফদের তাফসীরেই যথেষ্ট ও তাকে অভাবমুক্ত করতে পারে। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা নিবেদিত।
ইলমুল আক্বীদাহ্‌ তথা বিশ্বাসগত ইলমের ভূমিকা
আক্বীদাহ্‌ এর সংজ্ঞাঃ
‘আক্বীদাহ্‌’এর আভিধানিক অর্থঃ আকদুল হাবল অর্থ্যাৎ রশীতে গিরাহ লাগানো থেকে গৃহীত। যার অর্থ হল রশির এক অংশকে আরেক অংশের সাথে বেঁধে ফেলা।
শরী’আতের দৃষ্টিতে আক্বীদাহ্‌ হলঃ এই মর্মে সুদৃঢ়ভাবে ঈমান-বিশ্বাস স্থাপন করা যে আল্লাহ্‌ হলেন সমস্ত কিছুর প্রতিপালক, মালিক, সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি এককভাবে এই বিষয়ের অধিকারী যে শুধু তাঁর সমীপে ইবাদত নিবেদন করতে হবে। এবং একমাত্র তিনিই হলেন সকল পূর্ণাঙ্গ গুনাহবলী দ্বারা গুণাম্বিত। এবং সকল প্রকার দোষত্রুটি থেকে চিরমুক্ত। এই বিশ্বাস আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং অবাধ্যতার মাধ্যমে হ্রাস পায়। এই বিশ্বাস কে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে এবং তদানুযায়ী আমল করতে হবে।
আক্বীদাহ্‌ এর গুরুত্বঃ
১-আকীদা বিশুদ্ধ ইসলামী সমাজের নিখুঁত ভিত্তি।
অতএব যে সমাজ তাদের যাবতীয় বিষয়ে ছহীহ আক্বীদাহ্‌র উপর নির্ভর করে আপনি এরূপ সমাজকে দেখতে পাবেন মজবূত এবং সোজা-সরল। পক্ষান্তরে যে সমাজ এর বিপরীত হবে তথা বক্র ও বিকৃত আক্বীদার উপর ভিত্তিশীল হবে আপনি এরূপ সমাজকে দেখতে পাবেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
২-এই আক্বীদাহ্‌-ই হল ধর্মের ভিত্তি ও মূল এবং আমল কবুল ও বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْأِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (৫)[المائدة]
আর যে ঈমানের সাথে কুফুরী করবে তার আমল বাতিল হয়ে যাবে, এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হবে। (সূরা আল্‌ মায়িদাহ্‌ঃ৫)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ (৬৫)[الزمر]
আমি তোমার ও তোমার পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতি এই মর্মে অহি করেছি যে, যদি তুমি শিরক কর তবে তোমার আমল বাতিল হয়ে যাবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভুক্ত হবে। (সূরা আয্‌ যুমারঃ৬৫)
অতএব একজন মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য সে সামর্থ অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাবে এবং নিজ আক্বীদাহ-বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যথা সাধ্য চেষ্টা সাধনা করবে। কারণ এরই মাধ্যমে নাজাত রয়েছে।
৩-এই আক্বীদাহ্‌ই হল রাসূলদের দাওয়াতের ভিত্তিঃ
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ[النحل:৩৬]
আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই বার্তা দিয়ে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, এবং ত্বাগুত-তথা গায়রুল্লাহ্‌র ইবাদত -থেকে বিরত থাক। (সূরা আন্‌ নাহলঃ৩৬)
এজন্যই নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় ১৩ টি বছর অবস্থান করে তাওহীদের দিকে ও শিরক বর্জনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করেছেন। এবং এরই উপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপ্রতিষ্ঠিত থেকেছেন হিজরতের পরেও। বরং তাঁর শেষ জীবনের দিকেও তিনি কবরসমূহকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। এই বিষয়ে বহু দলীলাদি রয়েছে।
সালাফে ছালেহীনের নিকট আকীদা গ্রহণের উৎস সমূহঃ
এই উৎস গুলি হল কিতাবুল্লাহ বা আল্‌ কুরআন এবং বিশুদ্ধ সুন্নাত বা আল্‌ হাদীছ। এজন্যই সালাফ-পূর্বসূরী পুন্যবান বিদ্বানদের থেকে আক্বীদাহ সংক্রান্ত মাসআলাহ্‌ মাসায়েলে তাদের মতবিরোধ ঐরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেনি যতটুকু করেছে ফিক্বহ্‌ সংক্রান্ত মাসআলাহ্‌ মাসায়েলের ক্ষেত্রে।[১৩]
কিছু বিষয় যা মুসলিম ব্যক্তির উপর জানা ওয়াজিব
প্রথমতঃ আল্‌ ইসলামঃ আর তাহল আল্লাহর জন্য নিজেকে সমর্পণ করা, তার তাওহীদ, আনুগত্যের মাধ্যমে তার অনুগত হওয়া,এবং নিজেকে খাঁটি ও মুক্ত করে রাখা শিরক ও শিরক পন্থীদের থেকে।
ইসলামের দুটি অর্থ রয়েছেঃ
আম বা ব্যাপক অর্থঃ এই অর্থে ইসলাম সমস্ত রাসূলদের ধর্মকে শামিল করে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (১৩২)[البقرة].
‘এই মর্মে ইবরাহীম নিজ সন্তানদেরকে ওছিয়ত করেছেন এবং ইয়াকূবও করেছেনঃ হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য এই ধর্মকে মনোনীত করেছেন। অতএব মুসলিম না হয়ে তোমরা মৃত্যু বরণ কর না।’ (সূরা আল্‌ বাক্বারাহঃ১২২)
অবশ্য ইহা নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবিভার্বের পূর্বের ধর্মের সাথে খাছ। নবীর নবী হিসাবে আত্ম প্রকাশের পর এই ব্যাপক অর্থের ইসলাম রহিত হয়ে গেছে এখন অবশিষ্ট রয়েছে শুধু খাছ ইসলাম।
খাছ ইসলামঃ আর ইহা হল সেই ইসলাম যা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন এবং যা ব্যতীত -নবীর আবির্ভাবের পর- কারো থেকে অন্য কিছু গ্রহণ করা হবে না। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْأِسْلامِ دِيناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (৮৫)[آل عمران]
‘আর যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন কিছুকে ধর্ম হিসাবে তালাশ করবে, তা তার থেকে কখনো গৃহীত হবে না। আর সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হবে।’ (সূরা আলে ইমরানঃ ৮৫)
এই আয়াত তাদের প্রতিবাদ করে যারা আসমানী সমস্ত ধর্মকে এক গণ্য করার এবং ইবরাহীমী দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেওয়ার পক্ষপাতি।[১৪]। কারণ আয়াতটি এই মর্মে সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট যে, আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রাহ্য ধর্ম হল ইসলাম যা নিয়ে এসেছেন মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইহা ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম প্রত্যাখ্যাত।
ইসলামের রুকন সমূহ
(দুই শাহাদাত [এর কলেমা], ছালাত, যাকাত, ছিয়াম এবং হজ্জ)
সমস্ত উলামায়েদ্বীন এই মর্মে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, যে ব্যক্তি এই রোকনগুলোর সবকটি, অথবা (কালেমায়ে)শাহাদাতাইন পরিত্যাগ করবে সে কাফির। শাহাদাতাইন ভিন্ন অন্যান্য রুকনের ক্ষেত্রে মতভেদ থাকলেও ছালাতের ক্ষেত্রে প্রাধান্যযোগ্য অভিমত হল যে এর পরিত্যাগকারী কাফির। কারণ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ
(بّيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاةِ)[أخرجه مسلم، كتاب الإيمان، باب بيان إطلاق اسم الكفر على من ترك الصلاة، حديث رقم (৮২)]
‘একজন (মুসলিম) ব্যক্তি ও কুফর ও শিরকের মধ্যে তথা কাফের ও মুশরিকের মধ্যে পার্থক্যই হল ছালাত পরিত্যাগ করা।’ (মুসলিম,ঈমান অধ্যায়,হা/৮২)।
দুই শাহাদাত (কলেমা) এর ফযীলতঃ
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ النَّارَ)[رواه مسلم، كتاب الإيمان، باب الدليل على أن من مات على التوحيد دخل الجنة قطعاً، حديث رقم(২৯)]
‘যে ব্যক্তি এই মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ্‌ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল-আল্লাহ্‌ তার উপর জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।'(মুসলিম,ঈমান অধ্যায়,হা/২৯)।
এই দুই কলেমায়ে শাহাদত শুধু মুখে উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং এর উপর পূর্ণ বিশ্বাস এবং তার দাবী অনুযায়ী আমল করতে হবে।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’ এর অর্থ হল-লা মা’বূদা বেহাক্কিন ইল্লাল্লাহ্‌-অর্থাৎঃ আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই।
এই কালেমার রুকন হলঃ দুটি
১-লা ইলাহা (প্রকৃত কোন উপাস্য নেই)ঃ নাকচ করণ বাক্য।
২-ইল্লাল্লাহ্‌ (আল্লাহ্‌ ছাড়া)ঃ আল্লাহর জন্য উলূহিয়্যত উপাসনা সাব্যস্ত করণ, যিনি একক এবং যাঁর কোনই শরীক নেই।
এই কালেমার সর্বমোট শর্ত হল সাতটি যা কবির নিম্ন বর্ণিত কবিতায় একত্রিত করা হয়েছেঃ
عِلْمٌ وَيَقِيْنٌ وَإِخْلَاصٌ وَصِدْقُكَ مَعَ مَحَبَّةٍ وانْقِيَادٍ وَالْقَبُوْلِ لَهَا
‘ইলম, ইয়াক্বীন-দৃঢ় বিশ্বাস, ইখলাছ, সত্যবাদিতা, ভালবাসা, আনুগত্য ও কবূল করা।’
(শর্ত গুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ)ঃ
১-আল্‌ ইলমঃ অর্থাৎ কালেমাটির অর্থ এবং উদ্দেশ্য জানা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ (১৯)[محمد].
‘আপনি জেনে নিন যে আল্লাহ্‌ ছাড়া প্রকৃত কোনই উপাস্য নেই।’ (সূরা মুহাম্মাদঃ১৯)
২-আল ইয়াক্বীন (দৃঢ় বিশ্বাস)ঃ অতএব আল্লাহর রুবূবিয়্যত (রব) ও উলূহিয়্যত (উপাস্য) মর্মে যে তিনি এক ও অদ্বিতীয় এ বিষয়ে যেন আপনার নিকট কোন সংশয় সৃষ্টি না হয়। অনুরূপভাবে তার দাবী তথা মহা পবিত্র আল্লাহর সাথে শরীক ও সমকক্ষ না হওয়ার বিষয়েও যেন কোন সন্দেহের অনুপ্রবেশ না ঘটে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا (১৫)[الحجرات]
মুমিন তো তারাই যারা যারা আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের উপর ঈমান আনয়ন করার পর কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করে না। (সূরা আল্‌ হুজুরাতঃ১৫)
৩-‘আল ক্বাবূলু’ তথা কবূল করে নেওয়া।
অতএব, এই কালেমা যা চায় তা অন্তর ও মুখ দ্বারা গ্রহণ করে নেবে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ (৩৫)[الصافات].
‘তাদেরকে-তথা মুশরিকদেরকে যখন বলা হত ‘লা-ইলাহা,ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনই উপাস্য নেই-ইহা বল) তখন তারা অহংকার প্রদর্শ করে। (সূরা আছ্‌ ছাফ্‌ফাতঃ৩৫)
৪-অনুগত হওয়া (মান্য করা)ঃ
অর্থাৎ এই কালেমা যা প্রমাণ করে তার অনুগত হওয়া। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَأَنِيبُوا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ (৫৪)[ الزمر]
‘তোমরা তোমাদের প্রতি পালকের নিকট প্রত্যাবর্তন কর, এবং তার নিকট আত্মসমর্পন কর। (সূরা আয্‌ যুমারঃ৫৪)।
৫-সত্যবাদিতা, সত্যভাষণ যা মিথ্যার পরিপন্থীঃ
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ إِلَّا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ[(رواه البخاري ১/১৩৪ برقم ১২৮ و) رواه مسلم، كتاب الإيمان، باب الدليل على أن من مات على التوحيد دخل الجنة قطعا حديث رقم ৩২]
যে ব্যক্তি এই মর্মে আন্তরিকভাবে সত্যবাদী হয়ে সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ্‌ ছাড়া প্রকৃত কোনই উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্‌র রাসূল- অবশ্যই আল্লাহ্‌ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন। (বুখারী ১/১৩৪,হা/১২৮,মুসলিম,ঈমান অধ্যায়,হা/৩২)।
৬-আল্‌ ইখলাছঃ
আর তা হলঃ আমলকে নিয়্যতের সচ্ছতা দিয়ে সকল প্রকার শিরক ও লোক দেখানোর অবিমিশ্রণ থেকে মুক্ত রাখা। সকল কথা ও কাজ শুধু মাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
أَلا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ (৩)[الزمر]
খাঁটি ধর্ম -ইবাদত-একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। (সূরা আয্‌ যুমারঃ ৩)
৭-আল্‌ মাহাব্বাহ বা ভালবাসাঃ
অতএব আপনি এই কালেমা এবং কালেমা দ্বারা যা প্রমাণিত হয় তা ভালোবাসবেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبّاً لِلَّهِ (১৬৫)[البقرة]
আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসে। (সূরা আল্‌ বাক্বারাহঃ১৬৫)[১৫]
ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ
১-শিরক।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(إنَّ اللهَ لاَيَغْفِرُ أنْ يُشْرَكَ بِهِ)[النساء:৪৮]
‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না।’ (সূরা আন্‌ নিসাঃ৪৮)
২-যে ব্যক্তি নিজের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থ স্থির করে তাদেরকে আহ্বান করে, তাদের নিকট সুপারিশ তলব করে, তাদের উপর ভরসা করে (এই ধরনের ব্যক্তি সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ (وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ)[يونس:১৮]
‘তারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত এমন কিছু উপাসনা করে যা তাদের অপকার ও উপকার কিছুই করতে পারে না (আর তারা বলে যে এরা-তথা তাদের বাতিল উপাস্যগুলি-আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশকারী) (সূরা ইউনুসঃ১৮)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى[الزمر:৩]
‘(তারা বলেঃ) আমরা তো তাদের ইবাদত এজন্যই করি যাতে করে তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।’ (সূরা আয্‌ যুমারঃ৩)
৩-যে ব্যক্তি মুশরিকদেরকে কাফের বলবে না বা তাদের কুফরীতে সন্দেহ পোষণ করবে কিংবা তাদের ধর্মকে সঠিক ভাববে সে কাফের বলে গণ্য হবে।
কারণ এর অর্থই হল আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন তাতে সন্দেহ সৃষ্টি করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَقَالُوا إِنَّا كَفَرْنَا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ وَإِنَّا لَفِي شَكٍّ مِمَّا تَدْعُونَنَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ (৯)[إبراهيم]
আর তারা বললঃ নিশ্চয় আপনারা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন আমরা তার সাথে কুফরী করলাম। আর নিশ্চয়ই আপনারা আমাদেরকে যার প্রতি আহ্বান করতেছেন সে বিষয়ে আমরা সন্দেহে আছি, ইহা আমাদেরকে উৎকন্ঠায় ফেলে রেখেছে। (সূরা ইবরাহীমঃ ৯)
কারণ যে ব্যক্তি তাদের ধর্মকে সঠিক মনে করবে এবং তারা যার উপর প্রতিষ্ঠিত তা উত্তম জানবে অর্থাৎ তাদে কুফরী ও সীমালংঘণকে উত্তম গণ্য করবে সে মুসলিমদের ঐকমত্যে কাফের। (শাইখ সুলাইমান আল্‌ উলওয়ান প্রণীত ‘আত্‌ তিবয়ানু বিশারহি নাওয়াক্বিযিল ইসলাম’ পৃঃ২৬)
৪-যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস করে যে অন্যের আদর্শ বা তার ফায়ছালা নবীর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের ও ফায়ছালার চাইতে বেশী উত্তম, অথবা তার মত।
তাহলে সে তাদের মত হয়ে গেল যারা ত্বাগুতদের বিধানকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً (৬৫)[النساء].
‘আপনার প্রতিপালকের কসম! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না আপনাকে তাদের বিতর্কিত বিষয়ে ফায়ছালাকারী হিসাবে গ্রহণ করবে, অতঃপর আপনার ফায়ছালা মর্মে তাদের অন্তরে সামান্য সংকীর্ণতাবোধ তারা পাবে না, এবং পরিপূর্ণরূপে তা মেনে নেবে।’ (সূরা আন্‌ নিসাঃ৬৫)
৫-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম আনিত কোন বস্তুকে যদি কেউ ঘৃণার চোখে দেখে তবে যদিও সে ঐ বস্তুর উপর বাহ্যিকভাবে আমল করে তবুও সমস্ত ওলামায়ে দ্বীনের ঐকমত্যে সে কাফের বলে গণ্য হবে। যেমন আল ইক্বনা’ কিতাবের গ্রন্থকার সংকলন করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
( ذلكَ بِأنَّهُمْ كَرِهُوا ماَ أنْزَل اللهُ فَأحْبَطَ أعْماَلَهُمْ)[محمد:৯]
এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহর নাযীলকৃত বিষয়কে ঘৃণা করেছে সুতরাং আল্লাহ তাদের আমলগুলোকে বাতিল করে দিয়েছেন। (সূরা মুহাম্মাদ : ৯)
৬-যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের কোন কিছুকে নিয়ে বা তার পুরস্কার কিংবা শাস্তি-কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
( قُلْ أ بِاللهِ وآياَتِهِ وَرَسُوْلِهِ كُنْتُمْ تستهزئون . لاَ تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إيْماَنِكُمْ )[التوبة:৬৫-৬৬].
(হে রাসূল!) বল, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তদীয় আয়াতসমূহের সাথে এবং তাঁর রাসূেেলর সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছিলে? কোন প্রকার ওযর আপত্তির অবতারনা করোনা। তোমরা ঈমানের পর আবার কুফরী করেছ। (সূরা আত্‌ তাওবাহ্‌ : ৬৫-৬৬)
এ ক্ষেত্রে কথা, কাজ, নির্দেশ, নিষেধাজ্ঞায় কোন পার্থক্য নেই।
৭- যাদু টোনা করা, বা তাতে পরিতুষ্ট থাকা (কাউকে কারো থেকে ফিরানো, কাউকে কারো সাথে সংযুক্ত করার কৌশল অবলম্বন -ইহা যাদু টোনারই অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি যাদু করবে বা তাতে রাযী হবে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেন:
وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلاقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (১০২)[البقرة]
আর তারা (হারূত ও মারূত ফেরেশ্‌তা) কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না।’ এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা নিশ্চয় জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা বুঝত।
(সূরাবাক্বারাহ্‌: ১০২)
৮-মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরূদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإنَّهُ مِنْهُمْ)
তোমাদের মধ্য হতে যে ওদের (অর্থাৎ বিধর্মীদের) সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদেরই দলভূক্ত বলে গণ্য হবে। (সূরা আল্‌ মায়েদাহ্‌ : ৫১)
৯-যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, কারো জন্য ইসলামের শরী’আতের বাইরে থাকার অবকাশ রয়েছে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।
এরই অন্তর্ভুক্ত হবে ঐ ব্যক্তি যে খৃষ্টান বা ইহুদীদের ইসলামের শরী’আতের বাইরে থাকা বৈধ মনে করবে, এই অযুহাতে যে, তাদের ধর্মও আসমানী ধর্ম। অথবা তাসাউফপন্তী পীরদের ব্যাপারে এ ধারনা করা যে, তারা শরীয়তের আওতার বাহিরে অবস্থান করছে।
মহান আল্লাহ বলেন:
( وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوِ فِيْ الآخِرَةِ مِنَ الْخاَسِرِيْنَ )
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছু অন্বেষণ করবে তার থেকে তা কক্ষণই গ্রহণ করা হবে না। এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভূক্ত হবে।’ (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)
অতএব, ইসলাম হল ব্যাপক ও সর্ববিষয় অন্তর্ভূক্তকারী। এই ইসলাম দ্বারা আল্লাহ্‌ পূর্বেও সকল শরী’আতকে মিটিয়ে দিয়েছেন। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পর আল্লাহ্‌ কারো থেকে এই ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনই ধর্ম গ্রহণ করবেন না।
অত্যন্ত আফসুসের বিষয় যে, ইহুদী ও খৃষ্টানদের জন্য এই ইসলাম এর বাইরে থাকার মাসয়ালাটি এমনই একটি দর্শন যা দ্বারা অজ্ঞতা বা গাফলাতির কারণ ধোকাগ্রস্ত হয়েছেন এমন কিছু কিছু ব্যক্তি যারা ইসলামী চিন্তাধারার লোক বলে মানুষ জানে।[১৬] অথচ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মর্মে সংবাদ দিয়েছেন যে, তার (আনিত) ধর্ম অন্য সকল ধর্মকে মানসূখ-রহিত করে দিয়েছে।
তিনি বলেন-যেমনটি নাসায়ীর নিকট এসেছেঃ
(لَوْ كَانَ أَخِيْ مُوْسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا اتِّبَاعِيْ)[أخرجه أحمد ৩/৩৭৩، وقد حسنه الألباني في الإرواء ৬/৩৪]
যদি আমার ভাই মুসা আজ জীবিত থাকতেন তাহলে তার আমার আনুগত্য ছাড়া কোন উপায় থাকত না। (আহমাদ,৩/৩৭৩, আলবানী হাদীছটিকে ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে ৬/৩৪ হাসান বলেছেন)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া বলেন:
‘যে বিষয় দ্বারা তাদের মূসা ও খিযির এর ঘটনা দ্বারা শরী’আতের বিরোধিতা করার দলীল গ্রহণ করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ভুল প্রমাণিত হয়ে যায় তাহল ইহাই যে, মূসা আলাইহিস্‌ সালাম ‘খাযের’ আলাইহিস্‌ সালামের নিকট নবী হিসাবে প্রেরিত হননি। অনুরূপভাবে আল্লাহ্‌ খাযিরের উপর মূসার অনুসরণ ও আনুগত্য করা ওয়াজিবও করেননি। বরং বুখারী ও মুসলিমে এই মর্মে হাদীছ সুসাব্যস্ত হয়েছে যে, তাঁকে তথা মূসা কে লক্ষ্য করে খাযির আলাইহিস্‌ সালাম বলেছিলেনঃ হে মূসা! আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন এক ইলমের উপর আছি যা আল্লাহ্‌ আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন; আপনি সে ইলম সম্পর্কে জানেন না। অনুরূপভাবে আল্লাহর শিখানো এমন এক ইলমের উপর আপনি সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছেন যা আমি জানি না। আর এর কারণই হল যে, মূসা আলাইহিস্‌ সালামের দাওয়াত খাছ ছিল। আর আমাদের-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাওয়াত হল ব্যাপক এবং সমস্ত মানুষকে শামিল করে। তাঁর আনুগত্য থেকে বাইরে অবস্থান করা ও তা থেকে অমুখাপেক্ষী থাকার কারও অধিকার নেই।’
১০-সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর দ্বীন হতে বিমুখ থাকা। সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন না করা, তদানুযায়ী কাজ করার প্রয়োজন অনুভব না করা (এই ধরনের মন মানসিকতার ব্যক্তিও কাফের বলে গন্য)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেন:
( وَمَنْ أظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآياَتِ رَبِّهِ ثُمَّ أعْرَضَ عَنْهاَ ، إناَّ مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ مُنْتَقِمُوْنَ) [السجدة:২২]
‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কে বেশী যালিম (অত্যাচারী) হতে পারে, যাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা অত:পর সে উহা হতে বিমুখ হয়েছে? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’ (সূরা আস সাজদাহ্‌ : ২২)
এতে আমাদের যামানার ও তার পূর্বের যামানার বহু কবর পূজারীর বিধান শামিল রয়েছে। যাদের নিকট তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছেছে, তাদেরকে তা খুলে বলার পরও তারা তা মানে না। বস্তুত এরাই হল রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আনিত শরী’আত থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ব্যক্তি যারা নিজের কান ও অন্তর উভয় দিক দিয়েই সম্পূর্ণরূপে (শরী’আত থেকে) বিমুখ হয়ে রয়েছে।
এরা কোন নছীহতকারীর নছীহতে এবং কোন পথপ্রদর্শকের দিক নির্দেশনার প্রতি মোটেও কান দেয় না। এরূপ ধর্ম বিমুখতার কারণে এজাতীয় লোক কাফের। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ (৩)[الأحقاف]
‘আর যারা কাফির তাদেরকে যে বিষয়ে ভীতি প্রদর্শন করানো হয়েছে তা থেকে তারা বিমুখ।’ (সূরা আল্‌ আহক্বাফঃ৩)
সাধারণতঃ জাহেল-অজ্ঞ ব্যক্তিকে কোনটি হক খুলে বলা হলে সে তার অনুসরণ ও আনুগত্য করে। অথচ এই কবর পূজারীগণ তারা তাদের বাতিল উপাস্যগুলির ইবাদতে অটল থাকছে। তারা আল্লাহ্‌ ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথায় কর্ণপাত করে না। এবং উপদেশদাতাদের দিক নির্দেশনা থেকে সর্বদা বিমুখ থাকে। বরং কখনও কখনও তারা-তাদের বাতিল ও ফাসেক্বী (মুশরেকী) কাজের যারা প্রতিবাদ করে তাদেরকে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে থাকে। এই প্রকৃতির লোকদের উপর হুজ্জত কায়িম হয়ে গেছে। হটকারিতা ছাড়া এদের আর কোনই ওযর-আপত্তি বাকী নেই।
(দেখুন, শাইখ সুলাইমান আল্‌ উলওয়ান প্রণীত ‘আত্‌ তিবয়ান,পৃঃ৬৯)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেন:
( وَمَنْ أظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآياَتِ رَبِّهِ ثُمَّ أعْرَضَ عَنْهاَ ، إناَّ مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ مُنْتَقِمُوْنَ)[السجدة:২২]
‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কে বেশী যালিম (অত্যাচারী) হতে পারে, যাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা অত:পর সে উহা হতে বিমুখ হয়েছে? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’ (সূরা আস সাজদাহ্‌ : ২২)
১১-মহান আল্লাহ্‌ যা কিছু নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন অথবা রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু স্থির করেছেন-এ গুলির কোন কিছুকে অস্বীকার করা।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কোন মাখলূকের জন্য আল্লাহর জন্য খাছ গুণাবলী হতে কিছু গুণ কোন মাখলুকের জন্য নির্ধারণ করবে যেমন আল্লাহর ইলম, অথবা তার পক্ষ থেকে এমন বস্তু সাব্যস্ত করা যা মহান আল্লাহ্‌ নিজেই নিজের পক্ষ থেকে নাকচ করেছেন অথবা তাঁর পক্ষ থেকে তদীয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাকচ করেছেন। যেমন ঐ ব্যক্তির বিষয়টি যে আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করে থাকে। (এরূপ আচরণকারী সকলেই কাফের)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (১) اللَّهُ الصَّمَدُ (২) لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ (৩) وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُواً أَحَدٌ (৪)[ سورة الإخلاص]
বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই। (সূরা আল ইখলাছ)
বাণীঃ
وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (১৮০)[الأعراف]
‘আর আপনি তাদেরকে ছেড়ে দিন যারা আল্লাহর নামসমূহে ‘ইলহাদ’ করে তথা বিকৃত ও মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়। অচিরেই তাদেরকে তাদের কৃত কর্মের (উচিত) বিনিময় প্রদান করা হবে। (সূরা আল্‌ আরাফঃ১৮০)
১২-রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ঐসব বিষয়ের কোন একটি বিষয়ে যা তিনি নিয়ে এসেছেন। হোক তা গায়েবী-অদৃশ্য অতীত বা ভবিষ্যত সংক্রান্ত বিষয়। অথবা শরী’আতের বাধ্যতামূলক বিষয়।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَإِنْ يُكَذِّبُوكَ فَقَدْ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ وَبِالزُّبُرِ وَبِالْكِتَابِ الْمُنِيرِ (২৫) ثُمَّ أَخَذْتُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ (২৬)[فاطر].
তারা যদি আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তবে তাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ ষ্পষ্ট নিদর্শন, ছহীফা এবং উজ্জ্বল কিতাবসহ এসেছিলেন। অতঃপর আমি কাফিরদেরকে ধৃত করেছিলাম। কেমন ছিল আমার আযাব? (সূরা ফাত্বিরঃ২৫-২৬)
এ গুলো হল সুপ্রসিদ্ধ ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ। আরও অনেক ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যা সামষ্টি গতভাবে প্রাগুক্ত বিষয়গুলোর যে কোন একটির অন্তর্ভূক্ত যাবে। এরই অন্যতম হল কুরআন অস্বীকার করা বা কুরআনের কোন অংশ অস্বীকার করা, অথবা তা ই’জায-তথা চিরন্তন মুজিযা হওয়া বিষয়ে সন্দেহ করা। অথবা এই কুরআনকে বেহুরমত-অসম্মান করা, অথবা এমন বিষয়কে হালাল করে নেওয়া যার হারাম হওয়ার ব্যাপারে সকলে ঐকমত্য যেমন যেনা-ব্যভিচার প্রভৃতি…।
যে এ সমস্ত ইসলাম বিধ্বংসী বিষয়ে লিপ্ত হয় ঠাট্টা বিদ্রুপকরার ছলে বা ইচ্ছা করে অথবা কাউকে ভয় করে[১৭] এদের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। তবে এগুলো করতে যাকে জোর করে বাধ্য করা হয়েছে তার কথা ভিন্ন।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْأِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْراً فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (১০৬)[النحل]
যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছে, তাদের উপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত। (সূরা আন নাহল, আয়াত ১০৬)
شهادة أن محمدا رسول الله-صلى الله عليه وسلم
‘এই মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া যে মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল-ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’
এর অর্থ হলঃ এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ্‌ এবং রাসূল।এবং সর্বশেষ নবী, তাঁর রেসালাত সকল জিন ও ইনসানের জন্য প্রজোয্য।
এই শাহাদতের দাবীঃ
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করা তার নির্দেশকৃত বিষয়ে। তিনি যা সংবাদ দিয়েছেন তা সত্য বলে মেনে নেয়া। তিনি যা থেকে নিষেধ ও সতর্ক করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এবং আল্লাহর ইবাদত একমাত্র তার নবী প্রদর্শিত পদ্ধতিতে করা।
অতএব, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিষয়ে দুটি বিষয় অবশ্যই একত্রিত করতে হবেঃ
১-আল্লাহর উবূদিয়্যত-(অর্থাৎ এই বিশ্বাস করতে হবে যে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আল্লাহ তাআলার দাস)। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى (১০)[النجم]
‘অতঃপর তিনি তাঁর দাসের নিকট যা অহি করার ছিল তা অহি করলেন।’ (সূরা আন্‌ নাজমঃ১০)
২ রেসালাতঃ অর্থাৎ তাঁর রেসালতের সাক্ষ্য দিতে হবে, আল্লাহ্‌ বলেনঃ
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ
মুহাম্মাদ হলেন আল্লাহর রাসূল। (সূরা আল ফাতহ :২৯)। অতএব তিনি হলেনঃ আল্লাহর দাস ও তাঁর রাসূল।
ঈমান
এই ঈমানের ছয়টি রোকন বা ভিত্তি রয়েছে যা মহান আল্লাহর নিম্ন বর্ণিত পৃথক দুই বাণীতে উল্লেখিত হয়েছে (বাণী দুটি হল)ঃ
إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ (৪৯)[القمر]
‘নিশ্চয়ই আমি প্রতিটি বস্তুকে তাক্বদীরের সাথে সৃষ্টি করেছি। (আল্‌ ক্বামারঃ১৭৭)
এ আয়াতে তাকদীরের প্রতি ঈমানের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ[البقرة:১৭৭]
ভালো কাজ হল (তারা কাজ) যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি। (সূরা আল্‌ বাক্বারাহঃ১৭৭)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা, আখেরাত, ফেরেশতা, কিতাবসমূহ ও নবীদের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
ঈমানের সংজ্ঞাঃ
তা হল আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর নবী ও রাসূলগনের প্রতি শেষ দিবসের প্রতি ও ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
কেউ কেউ ঈমানের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেনঃ
(تصديق بالقلب، وإقرار باللسان، وعمل بالأركان، يزيد بالطاعة وينقص بالمعصية).
‘ঈমান হলঃ অন্তর দিয়ে সত্যয়ন করা, মুখ দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া, অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে কর্ম করা। আর এটা আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি লাভ করে এবং অবাধ্যতার মাধ্যমে হ্রাস পায়।’
এজন্যই উলামায়ে দ্বীন আমল সমূহকে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ[البقرة:১৪৩]
‘আর আল্লাহ্‌ এমন নন যে তিনি তোমাদের ঈমান তথা ছালাতকে নষ্ট করে দেবেন। (যা বায়তুল্‌ মুক্বাদ্দাস অভিমুখী হয়ে পড়েছ) (আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ১৪৩)
এ আয়াতে সালাত যা একটি আমল তাকে ঈমান বলা হয়েছে।
হাদীছে এসেছেঃ
(الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً)[صحيح مسلم، كتاب الإيمان، باب بيان عدد شعب الإيمان ১/৫৭،৫৮]
নিশ্চয় ঈমানের সত্তরটির অধিক শাখা রয়েছে। (মুসলিম,ঈমান অধ্যায়,হা/৫৭,৫৮)[১৮]
ইমাম শাফেঈ উক্ত বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের ইজমা-ঐকমত্য উদ্ধৃত করেছেন। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ তাওহীদের সেই তিনটি প্রকারই এই ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হবে। সুপ্রসিদ্ধ হাদীছে জিবরীলে দ্বীনের মৌলিক বিষয় তথা ইসলাম, ঈমান ও ইহ্‌সানের বর্ণনা এসেছে।
معنى التوحيد و ذكر أحكامه
তাওহীদের অর্থ ও তার বিধি-বিধান আলোচনা
তাওহীদঃ হল এই মর্মে ঈমান আনায়ন করা যে, আল্লাহ্‌ এক, তাঁর কোনই শরীক নেই, তিনি ব্যতীত আর কোন রব-প্রতিপালক নেই।
এই তাওহীদ তিন ভাগে বিভক্তঃ
১-তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহঃ
আর তা হল, সৃষ্টিকূল সংক্রান্ত কর্মে, রাজত্বে, নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতিতে তাঁকে একক বলে বিশ্বাস করা (অর্থাৎ আল্লাহর যাবতীয় কর্মে আল্লাহকে এক ও একক জানাই হল তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ’)।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
أَلا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ[الأعراف:৫৪]
‘মনে রাখবে, তারই জন্য সুনির্ধারিত হল সৃষ্টি করা ও নির্দেশ প্রদান করা।’ (সূরা আল্‌ আরাফঃ৫৪)। মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
يُدَبِّرُ الْأَمْرَ[السجدة:৫]
‘তিনি-আল্লাহ্‌ সমস্ত কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন।'(আস্‌ সাজদাহ্‌ঃ৫)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ[آل عمران:১৮৯]
‘আর আল্লাহরই জন্য সুনির্ধারিত আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব।’ (আলে ইমরানঃ১৮৯)
আর এ প্রকার তাওহীদ মানবিক প্রকৃতিতে প্রথিত রয়েছে। এটাকে একমাত্র তারাই অস্বীকার করে যাদের মানব-স্বভাব বিকৃত হয়ে গেছে অথবা যারা অহংকার করে যেমন নাস্তিকগণ।
অবশ্য কোন ব্যক্তির ইসলামে প্রবেশ করার জন্য এই প্রকার তাওহীদ যথেষ্ট নয়। কারণ মুশরিকগণ পর্যন্ত এই প্রকার তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল অথচ এই তাওহীদ তাদেরকে ইসলামে প্রবে করায়নি। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ (৮৭)[الزخرف]
(হে রাসূল!) তুমি যদি তাদের তথা মুশরিকদেরকে জিজ্ঞাসা কর, তাদেরকে কে সৃষ্টি করেছেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ্‌ (তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন)। (আয্‌ যুখরুফঃ৮৭)
২-তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ্‌ঃ
‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ হল মহান আল্লাহকে ইবাদতে একক করা ও এক জানা। যেমন ভালবাসা, ভয়,আশা,ভরসা, দু’আ, আনুগত্য, পশু যবেহ, নযর-মান্নত, বিনয় ও আত্মসমর্পন প্রভৃতি (ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌কে এক ও একক জানা ও মানা)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (১৬২)[الأنعام]
(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, নিশ্চয় আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মরণ সবই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত। (আল্‌ আনমঃ১৬২)
এই হল সেই তাওহীদ যার জন্য রাসূলগণ ও তাঁদের স্বজাতির মধ্যে বিতর্ক ঘটেছিল। কারণ এই তাওহীদ শুধু মাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই ইবাদত খাঁটিভাবে সম্পাদন করা ও ত্বাগূত এর সাথে কুফরী করার উপর ভিত্তিশীল। এজন্য কাফেরগণ এই প্রকার তাওহীদকে অস্বীকার করে বলেছিলঃ
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ (৫)[ص]
‘তিনি তথা মুহাম্মাদ কি সমস্ত উপাস্যকে একটি মাত্র উপাস্য বানিয়ে দিচ্ছে? নিশ্চয় এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ব্যাপার। (ছোয়াদঃ৫)
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একারণেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
৩-তাওহীদুল আস্‌মা ওয়াছ্‌ ছিফাতঃ
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর তাওহীদ। আর তা হল কুরআন ও হাদীছে যেভাবে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী এসেছে ঠিক সেভাবেই এগুলিকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা। শুধু তাঁর জন্যই স্থির করা।
আর এর দাবী এটাই, এই মর্মে ঈমান আনতে হবে যে আল্লাহ সমস্ত পূর্ণাঙ্গ গুণ দ্বারা গুনাম্বিত এবং সমস্ত প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
এই তাওহীদের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছেঃ
(الإيمان بما وصف الله به نفسه أو وصفه به رسوله-صلى الله عليه وسلم-من غير تمثيل ولا تشبيه ولا تحريف ولا تعطيل ولا تكييف).
(তাওহীদুল আসমা ওয়াছ্‌ ছিফাত হল)ঃ আল্লাহ নিজেকে যা দ্বারা গুনাম্বিত করেছেন এবং তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা দ্বারা তাকে গুণাম্বিত করেছেন তার প্রতি ঈমান-বিশ্বাস স্থাপন করা কোন;প্রকার উদাহরণ পেশ, তুলনাকরণ, বিকৃতি সাধন, অকেজো করণ ও পদ্ধতি-অবকাঠামো বর্ণনা করণ করা যাবে না। কারণ এই বিষয়গুলো আল্লাহ্‌র কিতাব ও তদীয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বিরোধী। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (১৮০)[الأعراف]
আর আপনি তাদেরকে ছেড়ে দিন (আল্লাহ্‌র হাতে) যারা তাঁর নাম (ও গুণাবলীর) ক্ষেত্রে ‘ইলহাদ’ করে তথা বিকৃত ব্যাখা-বিশ্লেষণ করে থাকে। অচিরেই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের (উচিত) বিনিময় দেওয়া হবে। (আল্‌ আরাফঃ১৮০)
ক-আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে ‘ইলহাদ’ হল এসব নামসমূহের উপযুক্ত অর্থ (যা মহান আল্লাহর শানে প্রযোজ্য) পরিত্যাগ করে অন্য দিকে যাওয়া তথা ঐগুলি নামের বিকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা।
খ-আত-তামছীল বা আল্লাহর গুণের সাথে কোন কিছুকে তুলনা করাঃ এর অর্থ হল আল্লাহর সদৃশ নির্ধারণ করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ (১১)[الشورى]
‘তাঁর-তথা আল্লাহর স্বদৃশ কোন কিছুই নয়, আর তিনি হলে সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (আশ্‌ শুরাঃ১১)
গ- আত্‌ তাহরীফ তথা বিকৃতি করণঃ আর তা হল ইহাই যে আপনি আল্লাহর গুণকে বিকৃত করবেন। যেমন উদাহরণ স্বরূপ এভাবে বললেন যে (يد) এর অর্থ হল কুদরত তথা শক্তি। অর্থাৎ তাহরীফ হল আল্লাহর গুণসূচক কোন শব্দকে তার প্রকাশ্য অর্থ থেকে ফিরিয়ে অন্য অর্থ করা। এই তাহ্‌রীফ তথা বিকৃতি সাধন শব্দেও হতে পাওে আবার অর্থেও হতে পারে।
ঘ-আত্‌ তা’ত্বীল তথা অকেজো-বাতিল করণঃ আর তা হল আল্লাহ্‌ যে গুণ দিয়ে নিজেকে গুণাম্বিত করেছেন তা অস্বীকার করা। এভাবে আল্লাহকে তাঁর পূর্ণঙ্গ গুণাবলী থেকে শুন্য করা। যেমন উদাহরণ স্বরূপঃ আল্লাহর যাত পাক থেকে ‘শ্রবণ’ গুণকে অস্বীকার করা, অথবা তাঁর থেকে হাত বা চেহারা (প্রভৃতি সুপ্রমাণিত গুণাবলীকে) অস্বীকার করতঃ এই কথা বলা যে, আল্লাহর কোন হাত নেই, চেহারা নেই…ইত্যাদি।
ঙ-আত্‌ তাকয়ীফ তথা পদ্ধতি-প্রকৃতি বর্ণনা করাঃ এর অর্থ হল আপনি আল্লাহ্‌র ‘গুণ’ এর নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবকাঠামো বলতে গিয়ে বলবেন আল্লাহর হাত এর পদ্ধতি-অবকাঠামো হল এরকম এরকম। আল্লাহর চেহারার পদ্ধতি-অবকাঠামো হল এরূপ এরূপ। এমনটি করা জায়েয নেই। কারণ আল্লাহ্‌র গুণাবলীর ধরন অনুমান বা আয়ত্ব করা অসম্ভব ব্যাপার। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَلا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْماً (১১০)[طـه]
‘তারা তাঁকে (আল্লাহকে) জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ত করতে পারে না।’ (ত্বোয়া-হাঃ১১০)
তা ছাড়াও ‘গুণ’ এর পদ্ধতি-অবকাঠামো জানা তিনটি বস্তুর যে কোন একটি দ্বারা হয়ে থাকেঃ
১-সেটিকে তার স্বসত্তায় চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ করা। আর এটি দুনিয়াবী জীবনে (কক্ষণই সম্ভব) হবে না।
২-তদসদৃশ কিছু দেখা। এ বিষয়টিও মহা পবিত্র আল্লাহ্‌র শানে অসম্ভব। কারণ মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ[الشورى:১১]
‘তাঁর স্বদৃশ কোন কিছুই নেই।'(আশ্‌ শুরাঃ১১)
৩-সত্য সংবাদঃ আর আমাদের নিকট কিতাব ও সুন্নাত থেকে এমন কোন খবর পৌঁছেনি যাতে আল্লাহর ছিফাত-গুণাবলী হতে কোন একটি ‘ছিফাত’-গুণ এর কাইফিয়ত-পদ্ধতি বা ধরন বর্ণনা এসেছে।
مسألة التفويض
(আসমা ও ছিফাত বিষয়ে) তাফভীয (সোপর্দ করণ) এর মাসআলা
আমরা অনেক সময় শুনে থাকি যে কোন কোন সালাফে ছালেহীন (এই আস্‌মা ও ছিফাতঃ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে) বলেন যে, এগুলিকে তোমরা রেখে দাও যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই; অথচ তাদের কথার প্রতিবাদ করা হয় না। পক্ষান্তরে আমরা খালাফ তথা পরবর্তীদের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিকেও একথা বলতে শুনি যে, এগুলিকে যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই রেখে দাও’ তখন তাদের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা হয়। তাহলে সালাফদের ও খালাফদের ‘তাফভীয’ এর ক্ষেত্রে পার্থ্যক্যটা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর হল এই যে,’তাফ্‌ভীয’ মুলতঃ দুই প্রকারঃ
১-অর্থগতভাবে তাফভীযঃ
যেমনঃ আপনার এই কথা বলা যে, ‘আল্লাহর আগমন’ এর উদ্দেশ্য আমি জানি না। আমি জানি না, (يد) ‘ইয়াদ’ দ্বারা কি উদ্দেশ্য? তা দ্বারা কি শক্তি বা নেআমত উদ্দেশ্য নাকি সত্যিকার হাত উদ্দেশ্য। অতএব আমি বিষয়গুলি আল্লাহর দিকেই সোপর্দ করলাম। এটাই হল খালাফদের প্রকৃত তাফভীয। এটাই হল কোন কোন পথভ্রষ্ট, বিকৃত দলের মাযহাব। এই প্রকার তাফভীযকেই সালাফে ছালেহীন হারাম বলেছেন এবং তা থেকে সতর্ক করেছেন। কারণ আল্লাহর ছিফাত-গুণাবলী এবং তার অন্তর্নিহিত আল্লাহ্‌র শানে প্রযোজ্য অর্থগুলো স্বীকার করে নেয়া হল ‘হক’। এ ক্ষেত্রে সেগুলিকে তার প্রকাশ্য অর্থ থেকে ফিরানো যাবে না, তার বিকৃত ব্যাখ্যাও দেওয়া যাবে না। তাশবীহ ও তামছীল থেকে দূরে থাকতে হবে। যেমন আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল্‌ জামাআত এর পক্ষ থেকে আল্লাহর জন্য হাত সাব্যস্ত করণ যার অর্থ সর্বজন বিদিত। তবে আল্লাহর শানে তা যেভাবে প্রযোজ্য তার ধরন সেভাবেই। কোন প্রকার তুলনা করা যাবে না, উদাহরণ পেশ করা যাবে না। কারণ মহান আল্লাহ, ‘তাঁর মত কোন কিছুই নেই, আর তিনি হলেন সর্ব শ্রোতা ও সর্ব দ্রোষ্টা।’ (আশ্‌ শুরাঃ১১)।
২-‘তাফভীযুল কায়ফ’ তথা আল্লাহর ছিফাত গুণের কায়ফিয়ত-ধরন বিষয়টি আল্লাহ্‌র দিকে সোপর্দ করা। এর তাৎপর্য হল ইহা যে, আল্লাহর যে ছিফাত যে অর্থ দাবী করে তা-ই আপনি স্বীকার করবেন; তবে তার ধরন-পদ্ধতির বিষয়টি আল্লাহ্‌র দিকে সোপর্দ করে দেবেন। বলবেনঃ আল্লাহর হাত রয়েছে। এবং এহাত আসলেই ‘হাত’ তবে যেভাবে মহান আল্লাহর শানে প্রযোজ্য তা ঠিক সেভাবেই। অবশ্য এই হাতের কায়ফিয়ত বা ধরন কিরূপ তা আপনি জানেন না। এটাই হল প্রকৃত অর্থে ‘তাফভীয’ যা সালাফদের থেকে পরিচিত। যা তারা তাদের এই কথা দ্বারা বুঝিয়ে থাকেনঃ
‘এই সব গুণাবলী যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই এগুলিকে রেখে দাও।’ অতএব কেউ যেন এই পরিভাষা শ্রবণ করার সময় ধোঁকাগ্রস্ত ও প্রতারিত না হয়। এবং এরূপ ধারণা করে না বসে যে, সালাফে সালেহীন তাফভীয বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে ওয়াজিব করে থাকেন। অথচ তাঁরা কেবল কায়ফিয়ত-ধরন বিষয়টিই ‘তাফভীয’ করে থাকেন। তারা অর্থগত তাফভীয হারাম গণ্য করে থাকেন।
কুফরীর প্রকারভেদ
কুফরী দুই প্রকারঃ
প্রথমতঃ ইতিক্বাদী তথা বিশ্বাসগত কুফরীঃ
এটা এমনই কুফরী যা তার সম্পাদনকারীকে স্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে ছাড়ে-আল্লাহর কাছে এ থেকে পানাহ্‌ চাই-এ প্রকার কুফরী ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্ম থেকে বহিষ্কার করে দেয়।
এরূপ আবার কুফরী পাঁচ প্রকারঃ
(ক) আত্‌ তাকযীবু ওয়াল জুহূদঃ মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা ও অস্বীকার করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوىً لِلْكَافِرِينَ (৬৮)[العنكبوت].
অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে অস্বীকার করে। জাহান্নামই কাফেরদের আশ্রয় স্থল নয়কি? (আল্‌ আনকাবূতঃ৬৮)
(খ) ‘আল্‌ইবা ওয়াল্‌ ইস্তিকবার’ঃ অস্বীকার করা ও অহংকার প্রদর্শন করাঃ মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا) إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ (৩৪)[البقرة].
‘আমি যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সাজদাহ্‌ কর। তখন তারা সকলেই সাজদাহ্‌ করল একমাত্র ইবলীস করল না। সে সাজদাহ্‌ করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের দলভুক্ত হয়ে গেল। (আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ৩৪)
(গ) ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলি বা তার কতিপয় বিষয়ের ক্ষেত্রে দৃঢ় বিশ্বাস না রেখে সেক্ষেত্রে সন্দেহ ও ধারণা পোষণ করা। (ইহাও এক প্রকার কুফরী)। মহান আল্লাহ্‌ (অন্যের বক্তব্যে) বলেনঃ
وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْراً مِنْهَا مُنْقَلَباً (৩৬) قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلاً (৩৭) [الكهف]
‘আর আমি ধারণা করি না যে ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে, যদি আমাকে আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করতেই হয় তবে অবশ্যই আমি সেখানেও ইহার চেয়েও উত্তম প্রত্যাবর্তন স্থল পাব। এতদশ্রবণে তার সাথী তাকে কথা প্রসঙ্গে বললঃ তুমি কি তার সাথে কুফরী করলে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর বীর্য থেকে, অতঃপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানব আকৃতিতে? (আল্‌ কাহ্‌ফঃ ৩৬-৩৭)
(ঘ) কর্ণ ও অন্তর দিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিমুখ থাকাঃ
যার ফলে সে রাসূলকে না সত্যায়ন করবে, না মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, না তাঁকে ভালবাসবে, না থাকে ঘৃণা করবে। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ (৩)[الأحقاف]
‘আর যারা কাফের, তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা থেকে তারা বিমুখ রয়েছে।’ (আল্‌ আহক্বাফঃ৩)।
(ঙ) আন্‌ নিফাক্ব-তথা কপটতা বা মুনাফেক্বীঃ আর তা হল উপরে উপরে ঈমান প্রকাশ করা এবং ভিতরে ভিতরে কুফরী গোপন করে রাখা।
দ্বিতীয়তঃ আমল বা কর্মগত কুফরীঃ
এই প্রকার কুফরীও দুই ভাগে বিভক্ত।
(ক) বড় কুফরীঃ এটি ধর্ম থেকে বহিষ্কারকারী কুফরী। যেমনঃ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে সাজদাহ্‌ করা, কুরআনকে অপমানিত করা এবং নবীআলাইহিমুছ্‌ ছালাতু ওয়াস্‌সালামদের মধ্য হতে যে কোন নবীকে হত্যা করা।
(খ) ছোট কুফরীঃ ইহা ধর্ম থেকে বহিষ্কারকারী নয় বটে তবে তা তাওহীদের পূর্ণতার বিরোধী। যেমন নে’আমতের কুফরী করা, কোন মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, বংশে আঘাত হানা, মৃতের উপর বিলাপ করা তথা উচ্চস্বরে ক্রন্দন করা প্রভৃতি।
শিরক দুই প্রকারঃ
১-শিরকে আকবার তথা বড় শিরকঃ আর তাহল এই মর্মে আক্বীদাহ্‌ -বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ্‌র কোন শরীক রয়েছে। অথবা গায়রুল্লাহ্‌র জন্য ইবাদতের কোন কিছু ব্যয় করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ)[النساء:৪৮]
‘নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শিরক করা ক্ষমা করেন না।’ (আন্‌ নিসাঃ৪৮)।
এই প্রকার শিরকের উদাহরণের অন্তর্ভুক্ত হল কবরের চতুরপার্শ ত্বাওয়াফ করা তথা চক্কর লাগানো, গায়রুল্লাহ্‌র নামে নযর-মান্যত করা, গায়রুল্লাহর জন্য পশু যবেহ করা, গায়রুল্লাহর জন্য সাজদাহ্‌ ও রুকূ’ করা। এক কথায় ইবাদতের কোন কিছু আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য নিবেদন করা। এই জাতীয় আচরণ ইসলাম ধর্ম থেকে বহিষ্কারকারী।
২-শিরকে আছগার তথা ছোট শিরকঃ এই শিরক বলতে প্রত্যেক ঐ পাপকে বুঝানো হয় যেগুলিকে শরী’আতের দলীলাদি শিরক বলে আখ্যায়িত করেছে, তবে সেগুলি ‘শিরকে আকবার’ তথা বড় শিরকের সীমানায় পৌঁছেনি। যেমনঃ গায়রুল্লাহর নামে কসম খাওয়া, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর শপথ করা। এবং এরূপ বলাঃ
‘আল্লাহ যা চেয়েছেন এবং আপনি যা চেয়েছেন’ ‘এটা আল্লাহ্‌ ও আপনার পক্ষ থেকে’ ‘আমি আল্লাহর মাধ্যমে ও আপনার মাধ্যমে..’ ‘আমি আল্লাহ্‌র উপর এবং আপনার উপর ভরসাকারী’ ‘উপরে আল্লাহ নীচে আপনি’ ‘আপনি যদি না থাকতেন তবে এরূপ হত না…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে অল্প-সল্প রিয়া বা লোক দেখানো কাজ। যেমন ইবাদতেরা কোন কিছু মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে বা শোনানোর উদ্দেশ্যে করা। সৃষ্টিকুলের খোশামোদ করা, তাদেরকে দেখানোর জন্য কাজ করা। তাবীয-কবচ লটকানো, পাখী উড়িয়ে অলক্ষি-কুলক্ষি নির্ধারণ করা, অনুরূপভাবে বিভিন্ন মাস দ্বারা অলক্ষি-কুলক্ষি নির্ধারণ করা। এজাতীয় আচরণ কবীরাহ্‌ গুনাহের অন্তর্ভূক্ত হলেও ধর্ম থেকে বহিষ্কার করে না।
ইসলাম এগুলিকে হারাম করার বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর। যাতে করে এগুলি শিরকে আকবার তথা বড় শিরকের দিয়ে না নিয়ে যায়। অনুরূপভাবে ইসলাম কবরের উপর বিল্ডিং নির্মাণ ও তাকে মসজিদ হিসাবে গ্রহণ করা হারাম করে দিয়েছে। এবং সৎকর্মশীলদের শ্রদ্ধায় অতিরঞ্জণ, বাড়াবাড়ি ও তাদের অতিশয় প্রশংসা করতে নিষেধ করেছে। এগুলো সবই মূলতঃতাওহীদের হেফাযত ও তার রক্ষণা কল্পে করেছে এবং যাতে শিরকের ছিদ্র পথসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। (সে জন্যই এরূপ করেছে)
تعريف التوسل
অসীলা গ্রহণ এর সংজ্ঞা
আত্‌ তাওয়াস্‌ সুল তথা অসীলা গ্রহণ মূলতঃ ঐ বস্তুকে বলে যা মাধ্যমে কোন কিছু লাভ করা ও তার নিকটবর্তী হওয়া যায়। এই ‘অসীলাহ্‌’ এর বহু বচন হল ‘অসায়েল’। বলা হয়ঃ
وسل إليه وسيلة، وتوسل
সে তার নিকটে পৌঁছার মাধ্যম অবলম্বন করেছে বা অসীলা অবলম্বন করেছে।
(শরী’আতের) পরিভাষায় অসীলাহ্‌ দ্বারা উদ্দেশ্য হল এমন কিছু যা দ্বারা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়[১৯] যেমন কথা কর্ম প্রভৃতি যা দ্বারা আল্লাহর কাছে চাওয়া হয় এবং দু’আ করা হয়।
أقســـــــــــام التوســـــــــل
‘তাওয়াস্‌সুল’ তথা অসীলাহ অবলম্বনের প্রকারসমূহ
এই অসীলাহ্‌ অবলম্বন দুই ভাগে বিভক্তঃ
ক-শরী’আত সম্মত অসীলাহ্‌ঃ
এই শরী’আত সম্মত অসীলাহ্‌ তিন ভাগে বিভক্তঃ
১-আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা তাঁর নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا[الأعراف:১৮০]
‘আর আল্লাহর রয়েছে অতীব সুন্দর নামসমূহ, সুতরাং তোমরা তাঁর নিকট দু’আ নিবেদন কর সেগুলির অসীলায়। (আল্‌ আরাফঃ১৮০)
এই প্রকারটি শরী’আত সম্মত অসীলাহ গ্রহণের সর্বাধিক মহান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকার।
২-এমন সৎ কর্ম দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যা দুআকারী নিজে সম্পাদন করেছে।
যেমনঃ (মুমিনদের ভাষায়) মহান আল্লাহর বাণীঃ
رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (১৬)[ آل عمران]
‘হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা ঈমান আনয়ন করেছি। সুতরাং আপনি আমাদের গুণাহ্‌গুলি মার্জনা করে দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন। (আলে ইমরান :১৬)
(লক্ষ্যণীয় বিষয় যে) এখানে তারা সৎ কর্ম-কে অসীলাহ্‌ হিসাবে গ্রহণ করেছে যা নিজেরাই সম্পাদন করেছে। অনুরূপভাবে পাহাড়ের গুহা ওয়ালাদের ঘটনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য (যেখানে তারা পাহাড়ের উপর থেকে বিরাট একটি পাথর পড়ে গিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবরুদ্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু তারা নিজ নিজ সৎ কর্মের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল। ফলে পাহাড়ের গর্ত মুখ থেকে উক্ত বিশাল পাথর আল্লাহ সরিয়ে দিয়ে তাদেরকে মুক্তি দান করেছিলেন)[২০]
৩-সৎকর্মশীল জীবিত ও উপস্থিত ব্যক্তির দু’আ দ্বারা অসীলাহ্‌ গ্রহণঃ
এভাবেই ছাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বারা তাঁর জীবদ্দশায় (অনা বৃষ্টির সময়) বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতেন। তাঁরা তাঁর নিকট এসে তাদের জন্য দু’আ করতে বলতেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিরোধানের পর ছাহাবায়ে কেরাম আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এর দ্বারা (আল্লাহ্‌র কাছে) বৃষ্টি প্রার্থনা করেছিলেন[২১] কারণ তাঁরা জানতেন যে, মৃত ব্যক্তি দ্বারা অসীলাহ্‌ গ্রহণ জায়েয নয়।
অনুরূপভাবে ছাহাবী মুআবিয়া (রাঃ) কর্মও এই পর্যায়ের অসীলায় পড়ে। যখন তিনি ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদকে দিয়ে আল্লাহর নিকট বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। ঐসময় তিনি বলে ছিলেনঃ উঠে দাঁড়াও হে অধিক ক্রন্দনকারী! এতদশ্রবণে তিনি মিম্বারে উঠে যান এবং মু’আবিয়া (রাঃ) বলেনঃ হে আল্লাহ্‌ আমরা আপনার নিকট আমাদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক উত্তম ও ফযীলতমন্ডিত তাকে দিয়ে আমরা আপনার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। এর পর ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ দু’আ করলে আল্লাহর অনুগ্রহে বৃষ্টি নাযিল হয়েছিল। (আছারটিকে হাফেয ইবনু আসাকির ছহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। দ্রঃ ইবনু আসাকির প্রণীত ‘তারীখে দেমাশক ১৮/১৫১/১)।
খ)-হারাম অসীলাহ্‌ঃ
যেমন মৃত ব্যক্তিকে ‘অসীলাহ্‌’ হিসাবে গ্রহণ করা। অনুরূপভাবে মানুষের এভাবে বলাঃ
হে আল্লাহ্‌! আপনার নবীর হকের অসীলায়, অথবা ‘আপনার নিকট’ তার যে মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে তার অসীলায় আমাকে সুস্থতা-নিরাপত্তা দান করুন, আমাকে ক্ষমা করুন। অথবা তাদের এইভাবে কথা বলা যে, হে আল্লাহ্‌! ওমুক অলী, ওমুক সৎব্যক্তির মর্যাদায়…। অথবা তাদের এরূপ কথা বলাঃ
‘অমুক ব্যক্তির যে সম্মান আপনার নিকট রয়েছে তার অসীলায় বা আমরা যার নিকট উপস্থিত তার মর্যাদার অসীলায় আমাদের থেকে বিপদ সরিয়ে দিন অথবা আমাদেরকে (রুযী প্রভৃতিতে) প্রশস্ততা দান করুন। ইত্যাদি ইত্যাদি যা জায়েয নয়। এগুলো সবই ‘হারাম অসীলাহ’ এর অন্তর্ভূক্ত। বিভ্রান্ত সূফীগণ এই প্রকার অসীলাহ্‌কে বৈধ করতে যেয়ে যা কিছু পেশ করে থাকে তার সিংহভাগই দুর্বল অথবা বানোয়াট দলীল। যা প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা জায়েয নয়। আর ঐ সকল দলীলের মধ্যে যেটি বিশুদ্ধ তাতে মূলতঃ তাদের দাবীর পক্ষে কোনই কথা নেই[২২]।
ومن الأمور التي يجب الاهتمام بها معرفة أصحابه صلى الله عليه وسلم
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর অন্যতম বিষয় হল নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে জানা
ছাহাবী হলেন প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যিনি নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ঈমানের অবস্থায় সাক্ষাৎ করেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যু বরণ করেছেন। ছাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম ছাহাবী হলেনঃ আবু বকর রা.,অতঃপর উমার রা., অতঃপর উছমান রা. অতঃপর আলী রা.। অতঃপর,আশারায়ে মুবাশ্‌শারাহ্‌ (তথা জান্নাতের শুভ সংবাদ প্রাপ্ত) ১০ জন। অতঃপর বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ব্যক্তিগণ। এবং তাদের সকলেই যোগ্য উলামায়ে দ্বীনের নিকট ন্যায় পরায়ণ। তাদের মন্দ কর্মগুলি তাঁদের নেকীর সাগরে ডুবে গিয়েছে। আল্লাহ্‌ তাঁদের উপর রাযী হয়ে গেছেন এবং তারাও আল্লাহ তাআলার প্রতি সন্তুষ্ট। মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হল, ছাহাবায়ে কেরামের মাঝে পরষ্পরে যা ঘটে সেসব বিষয়ে নিজেকে জড়াবে না। কারণ এতে করে তাদের কারো কারো প্রতি অন্তর বিদ্বেষী হয়ে উঠতে পারে। (যা মোটেও উচিত নয়)। ক্বাহত্বানী (রহ.) বলেনঃ
دع ما جرى بين الصحابة في الوغى بسيوفهم يوم التقى الجمعان
فقتيلهم منهـــم وقاتلهم لهم وجميعهم في الحشر مرحومان
অর্থঃ ছাহাবীদের মাঝে উভয় দলে যুদ্ধে তরবারীসহ যা সংঘটিত হয়েছে আপনি তা ছেড়ে দিন। কারণ তাঁদের নিহত ব্যক্তি, তাঁদের হত্যাকারী ব্যক্তি এবং তাঁদের সকলেই হাশরের দিনে (আল্লাহর) রহমত প্রাপ্ত।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান স্থাপনকারী প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হল, সে এই মর্মে একান্তভাবে জেনে রাখবে যে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীগণই এই দ্বীনের তাবলীগ করেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই আমাদের নিকট মহাগ্রন্থ আল্‌ কুরআন ও নবী করীম মুস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত এসেছে। অতএব, একমাত্র যে জাহেল সে ব্যতীত অন্য কেউ তাঁদের ফযীলত অস্বীকার করবে না। একমাত্র পথভ্রষ্ট বা হিংসুক ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউই তাদেরকে গাল-মন্দ করবে না। এই ছাহাবায়ে কেরাম হলেন একটি নির্বাচিত গোষ্ঠি, তারাই হলেন সৃষ্টির সেরা। তাঁরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবী হওয়ার সম্মান-গৌরব অর্জন করেছেন। তাঁদেরকে যে গালি দেবে সে মূলতঃ দ্বীনে ইসলামকেই গালি দেয়। কারণ, এই ছাহাবায়ে কেরামই হলেন এই দ্বীনে ইসলামের ধারক ও বাহক। তাঁদের ফযীলত ও মহত্ব বর্ণনায় কুরআন ও সুন্নাহর দলীলসমূহ এবং পূর্বসুরী ও উত্তরসুরি ওলামায়ে দ্বীনের বাণীসমূহ মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ইবনু কাছীর রহ. মহান আল্লাহর নিম্মোক্ত বাণীর তাফসীরে বলেনঃ
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَاناً وَإِثْماً مُبِيناً (৫৮)[الأحزاب]
অর্থঃ মুমিন নর ও মুমিন নারী কোন অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা তাদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও পাপের বোঝা বহন করে। (আল্‌ আহযাবঃ৫৮)
‘এটাই হল প্রকাশ্য অপবাদ যে মুমিনদের বিষয়ে দোষারোপ ও মানহানি করার জন্য এমন কিছু উদ্ধৃত করা হবে যা তারা মোটেও করেনি। এই শাস্তির বিধানে যারা অধিকহারে প্রবেশ করবে তারা হল আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলের সাথে কুফরীকারী। অতঃপর যারা রাফেযা তথা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে চরম ভক্তিকারী যারা ছাহাবীদেরকে সমালোচনা করে এবং তাদেরকে এমন এমন বিষয়ের অভিযোগ টেনে দোষারোপ করে যা থেকে আল্লাহ্‌ তাদেরকে পাক ও মুক্ত রেখেছেন। এবং আল্লাহ্‌ তাদের সম্পর্কে যা খবর দিয়েছেন, তারা তার বিপরীত গুণে তাঁদেরকে গুণাম্বিত করে। কারণ মহান আল্লাহ্‌ এই মর্মে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুহাজির ও আনছারী ছাহাবীদের উপর রাযী-খুশী হয়ে গেছেন। তিনি তাদের প্রশংসা করেছেন। অথচ এই বিবেকহীন জাহেল সম্প্রদায় তাদেরকে গাল-মন্দ করে তাদেরকে দোষারোপ করে এবং তাদের সম্পর্কে এমন এমন বিষয় উল্লেখ করে যা কোন দিনই ঘটেনি এবং তারা কখনই করেননি। এরা প্রকৃত অর্থে বিকৃত অন্তরের অধিকারী এরা প্রশংসিতদের এভাবেই বদনাম করে থাকে। (তাফসীর ইবনু কাছীর ৬/৪৮০,সূরায়ে আহযাবের ৫৮ নং আয়াতের তাফসীরের আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
ছাহাবায়ে কেরামের ফযীলত সংক্রান্ত দলীলগুলি এবার শুনুন
১-মহান আল্লাহ বলেনঃ
لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحاً قَرِيباً (১৮)[الفتح]
‘আল্লাহ রাযী হয়ে গেছেন মুনিদের উপর যখন তারা আপনার হাতে বায়’আত করছিল বৃক্ষের নীচে। তাদের অন্তরের বিষয়াবলী তাঁর আগেই জানা ছিল। এরই প্রেক্ষিতে তিনি তাদের উপর শান্তি নাযিল করলেন এবং বিনিময় হিসাবে তাদেরকে প্রদান করলেন আসন্য বিজয়। (ফাতহঃ১৮)
২-মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعاً سُجَّداً يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَاناً[الفتح:২৯]
মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা রয়েছে -এরা কাফেরদের উপর কঠোর তবে তারা পরস্পরে দয়ালু। আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন রুকূ’ এবং সাজদাহ্‌ রত অবস্থায় এদ্বারা তারা কামনা করে আল্লাহর নিকট তাঁর অনুগ্রহ এবং সন্তুষ্টি। (আল্‌ ফাতহঃ২৯)
৩-মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ
لا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلّاً وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (১০)[الحديد]
‘তোমাদের মধ্য হতে যারা বিজয়ের পূর্বে (আল্লাহর পথে) খরচ করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা (অন্যদের) সমান নয়। বরং তাদের মর্যাদা ওদের চেয়েও মহান যারা বিজয়ের পর খরচ করেছে এবং যুদ্ধ করেছে। অবশ্য প্রত্যেককেই আল্লাহ্‌ হুসনা তথা জান্নাত প্রদানের ওয়াদা দিয়েছেন। আর আল্লাহ্‌ তোমাদের কৃত কর্ম সম্পর্কে সম্যক খবর রাখেন। (আল্‌ হাদীদঃ১০)
৪-মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (১০০)[التوبة]
আর মুহাজির ও আনছারদের মধ্য হতে যারা অগ্রণী ও প্রথম এবং যারা তাদের উত্তমভাবে অনুসরণকারী-আল্লাহ এদের সকলের উপর রাযী হয়েছেন, এরাও আল্লাহর উপর রাযী হয়েছে। এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত সেথায় তাঁরা চিরকাল অবস্থান করবে। এটা হল মহা সফলতা। (আত্‌ তাওবাহ্‌ঃ১০০)
উপরোক্ত আয়াত গুলোতে বেশ কিছু বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে আমরা তা থেকে কিছু এখানে উল্লেখ করবঃ
১- মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান, ফযীলত, অগ্রগামীতা প্রভৃতি মর্মে মহান আল্লাহর সাক্ষ্য প্রদান। আর আল্লাহই সাক্ষ্যদাতা হিসাবে যথেষ্ট। এজন্যই খত্বীব বাগদাদী[২৩] বলেন : এই অর্থে পর্যাপ্ত পরিমাণে হাদীছ এসেছে। এগুলোই সবই কুরআনিক দলীলে যা এসেছে তারই অনুকুল। আর এগুলির সবকটি দলীলের এটাই চাহিদা যে ছাহাবায়ে কেরাম পবিত্র এবং তাঁরা সুনিশ্চিতভাবেই ন্যায়পরায়ন। অতএব এদের কেউই তাদের গোপন বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত নন। মহান আল্লাহর তাদীল তথা ন্যায়নিষ্ঠতার ঘোষণার পর অন্য কারো সাফাইয়ের তারা মুখাপেক্ষী নন।”
২-তদ্রূপ উপরোক্ত দলীলাদি এই মর্মের প্রমাণ বহন করে যে, মহান আল্লাহ্‌ হলেন মহান দাতা, মহা সম্মানিত, মহা ক্ষমাশীল এবং অতীব দয়ালু। তিনি ছাহাবীদের সকলকেই জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন, আর তাঁর ওয়াদাহ্‌ হল সত্য। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ وَعْدَهُ)[الحج:৪৭]
‘আর আল্লাহ্‌ কখনই ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না। (আল্‌ হাজ্জঃ৪৭)
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
(وَكُلّاً وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى)[ النساء:৯৫]
আর তিনি (ছাহাবীদের) সকলকেই জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। (আন্‌ নিসাঃ৯৫)
তিনি আরো বলেনঃ
وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (১০০)[التوبة]
আর তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন তাদের (ছাহাবীদের) জন্য জান্নাত যার তলদেশে সমূহ নদীসমূহ প্রবাহিত, সেথায় তারা চিরকাল থাকবে। বস্তুত ইহা মহান সফলতা। (আত্‌ তাওবাহ্‌ঃ১০০)
দ্বিতীয়তঃ ছাহাবীদের ফযীল সম্পর্কে হাদীছ থেকে দলীলঃ
১-আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فوالذي نفسي بيده لو أَنْفَقَ أَحَدَكُمْ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ (متفق عليه).
‘তোমরা আমার ছাহাবীদেরকে গালমন্দ কর না। ঐ সত্তার কসম দিয়ে বলছি, তোমাদের কেউ যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তবুও তার এই ব্যয় মর্যাদায় তাদের খরচকৃত এক অঞ্জলী পরিমাণ বা তার অর্ধেকের সমান হবে না। (মুত্তাফাকুন আলাইহঃ বুখারী, ছাহাবীদের ফযীলত অধ্যায়, হা/হা/৩৬৭৩, মুসলিম, ছাহাবীদের ফযীলত অধ্যায়, হা/২৫৪০)
২-নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا بَعْدِي فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ وَمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِي وَمَنْ آذَانِي فَقَدْ آذَى اللَّهَ وَمَنْ آذَى اللَّهَ أَوْشَكَ أَنْ يَأْخُذَهُ (رواه الترمذي في المناقب، باب (৫৯) حديث رقم (৩৮৬২)، والبغوي في شرح السنة ( ১৪/৭১ ). وابن حبان في صحيحه ( ২২৮৪- موارد ) ، أحمد في مسنده (৫/৫৪،৫৫-৫৭).[২৪]
আমার ছাহাবীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তাদের-কে (গাল-মন্দের) লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত কর না। যে তাদেরকে ভালবাসল সে আমার প্রতি ভালবাসার কারণে ভালবাসল। পক্ষান্তরে যে তাদেরকে ঘৃণা করল সে মূলতঃ আমাকে ঘৃণা করেই তাদেরকে ঘৃণা করল। যে তাদেরকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে মূলতঃ আল্লাহ্‌কেই কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দেবে অচিরেই আল্লাহ্‌ তাকে পাকড়াও করবেন। (তিরমিযী, মানাক্বিব অধ্যায়, হা/২৫৩১, আহমাদ ৪/৩৯৯, হাদীছ যঈফ। দ্রঃ যঈফুল জামে’ হা/১১৬০ )
অবশ্য এটি একটি দুর্বল সনদের হাদীস।
৩-ওয়াছিলাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
طُوبَى لِمَنْ رَآنِي ، وَلِمَنْ رَأَى مَنْ رَآنِي[رواه أحمد وجمع من أهل العلم.قال عنه الهيثمي في المجمع: رواه الطبراني وفيه بقية قد صرح بالسماع فزالت الدلسة وبقية رجاله ثقات].
‘আমাকে যে দেখেছে তার জন্য সুসংবাদ। আমাকে দেখা ব্যক্তিকে যে দেখেছে তার জন্যও সৃসংবাদ। (আহমাদ, এবং বিদ্বানগণের একটি জামা’আত। হায়ছামী তাঁর মাজমা’ গ্রন্থে বলেনঃ এটিকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদে ‘বাক্বিয়্যাহ’ রয়েছে। সে শ্রবণ করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলেছে কাজেই তাদলীস তথা সনদের দোষ গোপন অপরাধ দূরীভূত হয়েগেছে। বাকী অন্যান্য রেজাল-রাবীগণ নির্ভরযোগ্য)
৪-আহমাদ, মুসলিম প্রমুখ আবু মূসা সূত্রে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেনঃ তিনি বলেনঃ
النُّجُومُ أَمَنَةٌ لِلسَّمَاءِ فَإِذَا ذَهَبَتِ النُّجُومُ أَتَى السَّمَاءَ مَا تُوعَدُ وَأَنَا أَمَنَةٌ لأَصْحَابِى فَإِذَا ذَهَبْتُ أَتَى أَصْحَابِى مَا يُوعَدُونَ وَأَصْحَابِى أَمَنَةٌ لأُمَّتِى فَإِذَا ذَهَبَ أَصْحَابِى أَتَى أُمَّتِى مَا يُوعَدُونَ [رواه مسلم، كتاب فضائل الصحابة، باب بيان أن بقاء النبي صلى الله عليه وسلم أمان لأصحابه…، رقم الحديث (২৫৩৯)، والإمام أحمد ৪/৩৯৯]
তারকারাজী আসমানের জন্য নিরাপত্তা স্বরূপ। অতএব যখন তারকারাজী বিদায় নেবে তখন আসমানের নিকট তা এসে যাবে যার প্রতিশ্রুতি তাকে দেওয়া হয়েছে (অর্থাৎ ধ্বংস প্রাপ্ত হবে)। আমি আমার ছাহাবীদের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। অতএব আমি যখন বিদায় নেব তখন আমার ছাহাবীদের ভাগ্যে তাই ঘটবে যার ওয়াদা তাদেরকে করা হয়েছে। তদ্রূপ আমার ছাহাবীগণ আমার উম্মতের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। অতএব, আমার ছাহাবীগণ যখন চলে যাবে তখন আমার উম্মতের নিকট তা এসে উপস্থিত হবে যার ওয়াদা তাদেরকে করা হয়েছে। (অর্থাৎ তারা বিপদগ্রস্ত হবে) (মুসলিম, ছাহাবীদের ফযীলত অধ্যায়, হা/২৫৩১, আহমাদ,৪/৩৯৯)
তৃতীয়তঃ ছাহাবীদের ফযীলত সম্পর্কে উলামায়ে দ্বীনের উক্তি :
আবু যুরআহ্‌ রাযী বলেনঃ
(إذا رأيت الرجل ينتقص أحداً من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فاعلم أنه زنديق، وذلك أن رسول الله صلى الله عليه وسلم (عندنا) حق، والقرآن حق، وإنما أدى إلينا هذا القرآن والسنن أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، وإنما يريدون أن يجرحوا شهودنا ليبطلوا الكتاب والسنة، والجرح بهم أولى وهم زنادقة) . [الكفاية للخطيب ص ৯৭] والإصابة للحافظ ১/১০: عدالة الصحابة رضى الله عنهم ودفع الشبهات – (১ / ১১৯)
অর্থঃ যখন তুমি দেখবে কোন ব্যক্তিকে যে সে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদের সমালোচনা করছে, তখন মনে করবে যে লোকটি যিন্দীক্ব তথা বেদ্বীন। তার কারণ, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট সত্য, কুরআন সত্য, আর আমাদের নিকট কুরআন ও সুন্নাতসমূহ একমাত্র রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীগণই পৌঁছিয়েছেন। তারা তো কেবল মাত্র চায় আমাদের সাক্ষীদেরকে দোষযুক্ত করতে যাতে করে তারা কিতাব ও সুন্নাহ্‌-কে বাতিল করতে পারে। অথচ তারাই দোষারোপকৃত হওয়ার অধিকযোগ্য, এবং তারা মূলতঃ যানাদিকা তথা বেদ্বীন (নিকৃষ্ট শ্রেণীর কাফের) (খত্বীব বাগদাদী প্রণীত ‘আল্‌ কিফায়াহ্‌,পৃঃ৯৭)[২৫]।
২-ইমাম আহ্‌মাদ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ
إذا رأيت رجلًا يذكر أحدًا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم بسوء فاتهمه على الإسلام [الصارم، ص ৫৬৮]
‘যদি তুমি দেখতে পাও যে, কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক ছাহাবীকে মন্দের সাথে স্মরণ করছে তথা সমালোচনা করছে তাহলে তাকে ইসলামের বিষয়ে অভিযুক্ত বলে মনে করবে অর্থাৎ তার ইসলামে সন্দেহ পোষণ করবে। (আছ্‌ ছারেম,পৃঃ৫৬৮, আরও দেখুনঃ উছূলুল ঈমান ফী যওয়িল কিতাবি ওয়াস্‌ সুন্নাহ ১/২৪২)।
৩-ইমাম মালেক (রহিমাহুল্লাহ্‌)বলেনঃ
“إنما هؤلاء أقوام أرادوا القدح في النبي عليه الصلاة والسلام، فلم يمكنهم ذلك فقدحوا في أصحابه حتى يقال: رجل سوء ولو كان رجلاً صالحاً لكان أصحابه صالحين (الصارم ص ৫৮০).
অর্থঃ তারা তো এমন ব্যক্তি যারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমালোচনা করার ইচ্ছা করলেও তা তাদের জন্য সম্ভব হয়নি বিধায় তাঁরা তাঁর ছাহাবীদের সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছে ; যাতে করে এ কথা বলা হয় যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন অসৎ ব্যক্তি। যদি তিনি সৎ হতেন তাহলে তাঁর ছাহাবীগণও সৎ হতেন। (আছ্‌ ছারিম,পৃঃ৫৮০,[আক্বীদাতু আহ্‌লিস্‌ সুন্নাহ্‌ ওয়াল জামা’আহ্‌ ফিছ্‌ ছহাবাতিল কিরাম,২/৮৬১])।
৪-এই সকল ইমামদের পূর্বে যে সমস্ত ছাহাবায়ে কেরাম বয়স পেয়ে শেষের দিকে ইন্তেকাল করে ছিলেন। তাঁরা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদের গালমন্দকারীদেরকে নিন্দা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেনঃ
لا تسبوا أصحاب محمد فإن الله قد أمر بالاستغفار لهم وقد علم أنهم سيقتتلون(الصارم ص ৫৭৪).
তোমরা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদেরকে গাল-মন্দ কর না। কারণ আল্লাহ্‌ তাদের জন্য ইস্তিগফার তথা মাগফিরাত কামনা করতে বলেছেন। অথচ তিনি আগে থেকেই একথা অবগত যে, তাঁরা পরষ্পরে মারামারি করবেন। (আছ্‌ ছারিম,পৃঃ৫৭৪,আল্‌ হুজ্জাহ্‌ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ্‌ ২/৩৯৫)।
৫-আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেনঃ
“لا تسبوا أصحاب محمد، فإن مقام أحدهم خير من عملكم كله (رواه اللالكائي).
তোমরা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদেরকে গালমন্দ কর না। কারণ তাঁদের একজনের (নবীর সাথে কিছুক্ষণের জন্য) দাড়ানো তোমাদের সমূদয় আমল অপেক্ষা উত্তম। (লালাকায়ী, [আক্বীদাতু আহ্‌লিস্‌ সুন্নাহ্‌ ওয়াল জামা’আহ্‌ ফিছ্‌ ছহাবাতিল কিরাম, ২/৮৬১])
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
(اللهَ اللهَ في أصحاب نبيه صلى الله عليه وسلم، فإنه أوصى بهم خيراً) [رواه الطبراني]
‘তোমরা নবীর ছাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহ-কে ভয় কর, আল্লাহ্‌কে ভয় কর, কারণ তিনি (তোমাদেরকে) তাদের ব্যাপারে মঙ্গলের ওছিয়ত করেছেন। (তাবারানী)
চতুর্থতঃ বিবেক-জ্ঞানঃ
নিশ্চয় কোন প্রকার আল্লাহর ভয়-ভীতি ও বান্দাগণের শরম-লজ্জা ছাড়াই যারা ছাহাবীদেরকে গালমন্দ করে,প্রিয়দেরকে মন্দ কথা বলে এবং সকলের সম্মুখে তাদেরকে কাফের বলে -এই প্রকৃতির লোকদের কর্মকান্ডে সচেতন বিবেকবান আশ্চর্যবোধ করেন। বিবেকবান-জ্ঞানী-গুণীদের নিকট এদের এসব কথা বাতিল এবং গর্হিত এবং প্রত্যাখ্যাত। কারণ তাদের এসব কথা এমন কিছু বিষয় দাবী করে যা একেবারেই বাতিল। সেগুলি হল নিম্নরূপঃ
১-ছাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম ন্যায়পরায়ণ নন। অতএব তাদের খবর-হাদীস গ্রহণ করা যাবে না। বরং তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করতে হবে, তাদের বর্ণনার উপর আস্থা রাখা যাবে না। কারণ তারা কাফির, ফাসিক। আর কাফির ও ফাসিকের হাদীস গ্রহণ করা হয় না।
২-আল কুরআনের মত সুন্নাতও আমাদের নিকট সংকলিত হয়েছে ছাহাবীদের সূত্রে। আর তাদের কথা মেনে নিলে দুটিও ছহীহ নয়। কারণ কুরআন ও সুন্নাহ্‌ তাঁদের সূত্রেই আমাদের নিকট পৌঁছেছে। অথচ -তাদের দৃষ্টিতে- তাঁরা ন্যায়পরায়ণ নন।
৩-তাদের কথার দাবী অনুযায়ী শরী’আতটাই বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত। কারণ, শরীয়ত এমন কিছু মানুষদের থেকে সংকলিত হয়েছে যাদের সংবাদ গ্রহণযোগ্য নয়, যাদের কথা সত্য মনে করা যায় না।
আমরা এই মাসআলায় আমাদের বিরোধিতাকারী তথা রাফেযী ও তাদের দোসরদের বলবঃ
(ক) নিশ্চয় এই ইসলাম আমরা কুরআন ও সুন্নাহের মাধ্যমেই চিনেছি যা আমাদের নিকট ছাহাবীদের মাধ্যমেই উদ্ধৃত হয়েছে। আর এ দুটি ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার অর্থই হল ইসলামকেই ধ্বংস করা। এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়া। অতএব যে ব্যক্তি এ দুটি কে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে তার উচিত হল ইসলাম বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্ম অনুসন্ধান করা। কারণ, সে তো ইসলামের প্রতি আস্থাশীল নয়।
(খ) আমরা ইসলাম ধর্ম নিয়েই পরিতুষ্ট যা আমাদের নিকট উদ্ধৃত হয়েছে ছাহাবায়ে কেরামের সূত্রে। কারণ আমরা তাদের উপর পরিতুষ্ট। আর তাঁরা যা আমাদের জন্য সংকলন করেছেন তাতে তোমরা পরিতুষ্ট নও। তাহলে কিভাবে তোমরা কিভাবে ভাবতে পার তোমাদের ও আমাদের ধর্ম একটাই? আর কেনইবা তোমরা আমাদের উপর রাগ কর যখন আমরা তোমাদের বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান করি? কারণ, আমাদের এই মর্মে সুনিশ্চিত ইলম আছে যে, আমাদের পথ তোমাদের পথ থেকে ভিন্ন, আমাদের শরী’আত উৎস তোমাদের উৎস থেকে ভিন্ন। আমাদের মৌলনীতিসমূহ ও তোমাদের মৌলনীতি থেকে ভিন্ন।
(গ) আমরা -আলহাদুলিল্লাহ- এই মর্মে সন্তুষ্ট যে, যে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এবং মানুষের নিকট সুপরিচিত, যার উৎস হল কুরআন ও সুন্নাহ-এটিই আমাদের ধর্ম, এর বিকল্প আমরা চাইনা। এ থেকে আঙ্গুলের কর পরিমাণও আমরা সরে যেতে চাই না। অতএব, যারা আমাদের শরী’আতের উৎসের বিরোধিতা করে তাদের কর্তব্য হল, তারা তাদের জন্য এই ইসলাম ধর্ম বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্ম সন্ধান করবে। অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম থেকে একটি বেছে নিতে পারে। ইসলাম একমাত্র বিশুদ্ধ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের জন্য প্রযোজ্য।
(ঘ)কেন তোমরা আমাদের নিকটবর্তী হওয়ার আপ্রান প্রচেষ্টা চালাচ্ছ অথচ তোমাদের ভালভাবেই জানা আছে যে, তোমাদের সাথে আমাদের মৌলিক ও শাখাগত সকল মাসআলায় পার্থক্য আছে। অল্প-সামান্য কিছু বিষয় ছাড়া তোমাদের সাথে আমাদের কোন মিল নেই। তা হলে আমাদের নিকবর্তী হওয়ার কেন এই অদ্ভুত আকাংখা? কেনইবা এতো আগ্রহ আহলে সুন্নাতের নিকটবর্তী হওয়ার? তোমরা কি তোমাদের ধর্মের ব্যাপারে আস্থাশীল নও? তোমরা কি নিজ আক্বীদাহ্‌ বিশ্বাস নিয়ে পৃথক ও স্বতন্ত্র হয়ে যেতে পার না? যেমনটি ইহুদী, খৃষ্টান, অগ্নি উপাসকগণ নিজ নিজ আক্বীদাহ্‌ নিয়ে স্বতন্ত্র ও পৃথক হয়ে রয়েছে? বল কেন তোমরা ইসলাম ধর্মের নামে আমাদের সাথে ভীড় করছো?
(ঙ) নিশ্চয় তোমাদের পক্ষ থেকে ছাহাবীদের সমালোচনা করা-ইহা প্রকৃত অর্থে নবীরই সমালোচনার নামান্তর। অথচ তোমরা তার সাথে ঈমান এনেছ যেমনটি তোমরা দাবী কর ও প্রকাশ করে থাক। কারণ তিনিই তো তাদেরকে তার সান্নিধ্যের জন্য চয়ন করেছেন এবং নিজ হাতে তাদেরকে লালন-পালন করেছেন এবং নিজ ঝর্ণা হতে তাদেরকে পান করিয়েছেন। তাঁদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন তাদের প্রতিপালকের কিতাব এবং তাঁদের নবীর সুন্নাত। বিশেষ করে তাঁদের মধ্য হতে উমার ও আবু বকর রা. এর ব্যাপারে তোমরা আমাদের সাথে দ্বিমত নও যে, তিনি নবীর হিজরতকালীন সঙ্গী ছিলেন। তিনি তাঁদের উভয়কে তাঁর অন্যান্য ছাহাবীদের উপর বিশেষভাবে মর্যাদা দান করেছেন। এতদসত্ত্বেও এরা দুজনেই হলেন কুফর ও গুমরাহীর ইমাম বরং তোমাদের নিকট তারা ইহুদী ও খৃষ্টানদের চেয়েও বড় কাফের। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে যে আক্বল-জ্ঞান সম্পন্ন -যদি তোমাদের মধ্যে আক্বল-জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি থেকে থাকে-তার উচিত নিজেকে প্রশ্ন করা যে, এটা কি বিবেক সম্মত কথা যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাঁর নিকট আসমান থেকে অহি করা হয় তিনি দুই জন ব্যক্তিকে মর্যাদা দিচ্ছেন। তাদের প্রশংসা করছেন। আর তোমরা বলছ তাঁরা কুফরী গোপন করে ঈমান প্রকাশ করেছেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পবিত্র সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের শত্রুতা প্রকাশ করেছেন। এরপরও নবী সা. এর কোন খবর হয়নি। কি আশ্চর্য তোমাদের বিবেক-বুদ্ধি! কত ভয়াবহ তোমাদের চিন্তা-ভাবনা!
মহান আল্লাহ বলেনঃ
كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ إِنْ يَقُولُونَ إِلَّا كَذِباً (৫)[الكهف]
‘কত কঠিন তাদের মুখের কথা, তারা যা বলে তা তো সবই মিথ্যা। (আল্‌ কাহ্‌ফঃ৫)
(চ) আর কিভাবেই বা নবীর শানে প্রযোজ্য হবে যে তিনি দুজন কাফের মহিলাকে বিয়ে করবেন অথচ কুরআন এমনটি না করারই তাকে নির্দেশ দিচ্ছে যেমনটি তোমরাও তা পাঠ করে থাক? মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَلا تُمْسِكُوا بِعِصَمِ الْكَوَافِرِ[الممتحنة:১০]
তোমরা কাফের নারীদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখোনা। (আল্‌ মুমতাহিনাহ্‌ঃ১০)
তোমরা নবীর দুজন সম্মানিতা স্ত্রী আয়েশা ও হাফছা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে কাফের বলেছ। এ ক্ষেত্রে না তোমরা আল্লাহ্‌র ভয় করেছ, আর না মানুষ থেকে লজ্জা করেছ?
যদি তোমরা বল,’নূহ্‌ ও লূত্ব আলাইহিমাস্‌ সালাম- ও তো দুজন কাফের মহিলা বিয়ে করে ছিলেন’ তদুত্তরে আমরা বলব :নিশ্চয় তোমরা আমাদের সাথে ঐকমত্য যে নূহ্‌ ও লূত্ব আলাইহিমাস্‌ সালাম তাঁদের স্ত্রীদের কুফরী সম্পর্কে জানতেন। আর মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের নিকট এতো বড় গাফেল-নির্বোধ যে তিনি তাঁর নিজ দুই স্ত্রীর কুফরী সম্পর্কে জানতেন না, আমরণ তাদের সাথে ঘর-সংসার কেরেছেন? তিনি তাদের কুফরী সম্পর্কে টের না পেয়েই তাদের প্রশংসা করেছেন। আর যদি তিনি তাদের কুফরীর কথা জানতেন, তাহলে তো তিনি কুরআন ও রহমানের বিরুদ্ধাচারণকারী বলে গণ্য হবেন। কারণ, তিনি কাফের মহিলাদেরকে বিয়ে করেছেন। তাই বলি, তোমরা যে কত বড় বাতিল মতবাদ পোষন করছ, কত নিকৃষ্ট আদর্শে প্রতিষ্ঠিত আর কেমন স্ববিরোধিতায় লিপ্ত- এই একটি বিষয়ই তার বর্ণনা দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
(ছ) তোমরা ইহুদীদেরকে কাফের বলছ। কারণ তাদের মৌলিক বিষয়গুলি তোমাদের মৌলিক বিষয়গুলি থেকে ভিন্ন, তাদের শরী’আত গ্রহণ উৎস তোমাদের উৎস থেকে ভিন্ন। খৃষ্টানদেরকেও একই কারণে কাফের বলেছ। তাহলে আমাদেরকের-কে তাদের মত কেন কাফের বলছ না? অথচ এটা জানা কথা যে তোমরা আমাদের আলেমদেরকে কাফের বলেছ, আমাদের আইম্মায়ে কেরাম তথা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদেরকে কাফের বলেছ?! আর সাধারণ ব্যক্তিরা ঐ বিধানে আলেমদেরই অনুগামী হবেন। যদি তোমরা বল যে, তোমরা হলে জাহেল শ্রেণী, তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলা হয়েছে’-তাহলে তো তোমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, ইহুদ ও খৃষ্টানদের সাধারণ ব্যক্তিদেরকে তোমরা কাফের বলবে না। কারণ তারাও আমাদের মতই জাহেল ও প্রতারিত। তাহলে বল, তাদের সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত তোমরা নিয়েছ সে রকম সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যাপারে কেন গ্রহণ কর না? আর কেনইবা তোমরা আদাজল খেয়ে লেগেছ আমাদেরকে তোমাদের ধর্মীয় ভাই বানানোর জন্য? যেহেতু তোমরা খৃষ্টানদেরকে ও মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদেরকে কাফের বলেছ, কাজেই আমাদের ব্যাপারেও ইনছাফ কর এবং আমাদেরকেও কাফের বল যেমন করে আমাদের ইমামদের কাফের বলেছ। ন্যায় ও ইনসাফের দাবী তো এটাই হওয়া উচিত। আমি আশচর্য বোধ করি এই মর্মে যে, সদা সর্বদা অবিরতভাবে তোমরা তোমাদের সমূদয় মাহফিলে আমাদের জন্য তোমাদের ভাতৃত্ব প্রকাশ করে থাক এবং আমাদের বিভিন্ন সমস্যায় আমাদের সাহায্য এবং আমাদের সাথে থাকা প্রকাশই করে থাক। অথচ তোমরা ভাল করেই জান যে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যেকার পার্থক্য ঐরূপ যেমনটি আমাদের ও অন্যান্য কাফের দল যেমন ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে রয়েছে। [২৬]
حكم سب الصحابة
ছাহাবীদের গাল-মন্দ করার বিধান
ছাহাবীদেরকে গাল-মন্দ করা তিন ভাগে বিভক্তঃ
১-এমনভাবে তাদের গালমন্দ করা, যার অর্থই হল তাদের অধিকাংশ বা সকলেই কাফের। তাহলে এই পর্যায়ের গাল-মন্দ করা কুফরী; কারণ এটা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার নামান্তর। কারণ আল্লাহর কিতাবে ও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতে তাদের প্রশংসা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উপর রাযী থাকার কথা এসেছে। (এই প্রকৃতির লোক তো কাফেরই) বরং যারা তার মত লোকের কুফরীতে সন্দেহ করবে তার কুফরীও সুনিশ্চিত। কারণ এরূপ কথার ফলাফল হল, কিতাব ও সুন্নাতের বর্ণনাকারী ছাহাবী গণ সকলেই কাফের এবং পাপাচারী।
২-তাদেরকে গালমন্দ করা লা’নত করার মাধ্যমে, তাদের শানে কটুবাক্য ব্যবহার করা। এরূপ আচরণকারী ব্যক্তির কুফরী মর্মে উলামায়ে দ্বীনের দুটি অভিমত রয়েছে। এবং কাফের হবে না-এই মর্মের অভিমতের ভিত্তিতে ঐরূপ আচরণকারীকে দোররা মারতে হবে এবং আমৃত্যু জেলখানায় রাখতে হবে। পূর্বের কথা থেকে সে ফিরে আসলে ভাল কথা।[২৭]
৩-তাদেরকে এমন ভাবে গালমন্দ করা যাদ্বারা তাদের দ্বীন-ধার্মিকতায় কোন সমালেচনা লেপন হয় না। যেমন কাপুরুষতা, কৃপণতা প্রভৃতি অভিযোগে তাদেরকে অভিযুক্ত করা। এরূপ আচরণকারী কাফের হবে না। তবে তাকে সেকারণ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ইমাম আহমাদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে তিনি বলেনঃ
(ولا يجوز أن يذكر شيء من مساوئهم، ولا يطعن على أحد منهم بعيب أو نقص فمن فعل ذلك أُدِّبَ، فإن تاب وإلا جلد في الحبس حتى يموت أو يرجع)
আর ছাহাবীদের কোন মন্দ বিষয় উল্লেখ করা জায়েয নয়, অনুরূপভাবে তাদের কারো ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটির সাথে সমালোচনা করাও বৈধ নয়। এরূপ যে করবে তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে হবে। যদি সে তাওবাহ্‌ করে তো ভাল, নতুবা তাকে জেলখানায় বন্দী রেখে প্রহার করতে হবে। যতক্ষণ না পূর্বের মতবাদ থেকে ফিরে আসবে। (দেখুনঃ শাইখ মুহাম্মাদ বিন উছায়মীন প্রণীত ‘শারহু লুম’আতিল ই’তিক্বাদ,পৃঃ১৫২, এবং শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্‌ প্রণীত কিতাব ‘আছ্‌ ছারেমুল মাসলূল, পৃঃ৫৭৩)
পরিশেষেঃ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীদের গৌরবের জন্য এতো টুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাদের ক্ষেত্রে এই মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তাঁরাই হলেন সর্বাধিক উত্তম মানুষ। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ[آل عمران:১১০]
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি যাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্যই বের করা হয়েছে।’ (আলে ইমরাঃ১১০)
আর এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীগণই সর্বাগ্রে মহান আল্লাহর উক্ত সম্বোধনের আওতাভুক্ত।
ছাহাবী বিদ্বেষী রাফেযী সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখিত কিতাবঃ
১-হাফেয আবু নু’আইম প্রণীত ‘কিতাবুল ইমামাহ্‌ ওর্য়া‌ রাদ্দু আর্লা‌ রাফেযাহ্‌।
২-শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্‌ প্রণীত ‘মিন্‌হাজুস্‌ সুন্নাহ্‌’।
৩-ইবনু হাজার হায়তামী প্রণীত ‘আছ্‌ ছওয়াঈকুল মুহ্‌রিক্বাহ্‌ আলা আহলির রাফযি ওয়ায্‌ যলালে ওয়ায্‌ যান্দাক্বাহ।
৪-আলূসী প্রণীত ‘মুখতাছারুত্‌ তুহফাহ আল ইছ্‌নায় আশারিয়্যাহ্‌।
৫-মুহিব্বুদ্দীন আল খত্বীব প্রণীত’ আল খুতুতুল আরীযাহ্‌’।
৬-আবুল মা’আলী আলূসী প্রণীত ‘ছব্বুল আযাব আলা মান্‌ সাব্বাল আছহাব।
৭-শাইখ ড.নাছির আল্‌ ক্বাফারীর কিতাবসমূহঃ উছূলু মাযহাবিশ্‌ শী’আহ্‌, মাসআলাতুত্‌ তাক্বরীবে বায়না আহলিস্‌ সুন্নাহ্‌ ওয়াশ্‌ শী’আহ্‌
৮-মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ্‌ আল্‌ গারীব প্রণীত ‘ওয়া জা-আ দাওরুল মাজূস’
৯-শাইখ উছমান আল্‌ খামীস এর তীজানীর উপর প্রতিবাদ (কাশফুল্‌ জানী মুহাম্মাদ তীজানী ফী কুতুবিহিল্‌ আরবা’আহ্‌)।
১০-শাইখ যুহায়লী প্রণীত ‘আল্‌ ইন্তিছার লিছ্‌ ছহবি ওয়াল্‌ আলি মিন ইফতী রা-আতিত্‌ তীজানী আয্‌ য-ল।
১১-শাইখ ইহসান ইলাহী যহীর (রহ.)প্রণীত কিতাবাদি।
১২-তুন্‌সী প্রণীত ‘বুত্বলানু আক্বাঈদিশ্‌ শী’আহ্‌’।
مقدمة في السنة
সুন্নাত সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান
আভিধানিক অর্থে সুন্নাত হলঃ যে কোন তরীক্বাহ্‌ বা পদ্ধতি, তা প্রশংসিত হোক বা নিন্দিত হোক। এই অর্থেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বাণীটি-
مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ[أخرجه مسلم ৩/৮৬ برقم ২৩৯৮]
যে ব্যক্তি ইসলামের মাঝে ‘সুন্নাতে হাসানাহ্‌ -ভাল সুন্নাত’ জারী করবে সে উক্ত সুন্নাতের নেকী পাবে এবং যারা তার পরে তদানুযায়ী আমল করবে তাদেরও নেকী পাবে। তবে তাদের নেকী থেকে কোন কিছুই হ্রাস করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ইসলামের মধ্যে ‘মন্দ সুন্নাত’ জারী করবে তার উপর উক্ত মন্দ সুন্নাতের পাপ বর্তাবে, অনুরূপভাবে তাদেরর পাপ বর্তাবে যারা তার পরে তদানুযায়ী আমল করবে। অবশ্য এজন্য ঐ লোকদের পাপ থেকে কিছুই কমানো হবে না। (মুসলিম, ৩/৮৬, হা/২৩৯৮)
শরী’আতের পরিভাষায় সুন্নাত হলঃ
(مَا أُثِرَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ أَوْ صِفَةٍ خَلْقِيَّةٍ أَوْ خُلُقِيَّةٍ أَوْ سِيْرَةٍ سَوَاءٌ كَانَ قَبْلَ الْبِعْثَةِ أَوْ بَعْدَهَا).
যা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যা উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা কথা হোক বা কাজ হোক, বা সমর্থন হোক, কিংবা তাঁর সৃষ্টিগত বা চারিত্রিক গুণ হোক, অথবা নবী হিসাবে প্রেরিত হওয়ার পূর্বের[২৮] বা পরের তাঁর জীবনীই হোক না কেন।
১-নবীর ক্বওলী সুন্নাত যেমন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ
(إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ)[رواه البخاري و مسلم]
‘আমল মাত্রই নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল।’ (বুখারী,হা/১ ও মুসলিম)।
২-ফে’লী তথা কর্মগত সুন্নাতঃ
ছাহাবায়ে কেরাম-নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম হিসাবে ইবাদত প্রভৃতি বিষয় যেমন ছালাত, হজ, সিয়াম মর্মে যা কিছু উদ্ধৃত করেছেন এই প্রকার সুন্নাতের মধ্যে শামিল রয়েছে।
৩-সমর্থনগত সুন্নাতঃ
এর মধ্যে শামিল রয়েছে ঐ সমস্ত কাজ-কর্ম যা কোন কোন ছাহাবী থেকে সংঘটিত হয়েছে এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা সমর্থন করেছেন। যেমন তাঁর পক্ষ থেকে কতিপয় ছাহাবীর বনু কোরায়যা গৌত্রে আছর ছালাত আদায় করার বিষয়ে ইজতিহাদকে সমর্থন করা। যখন তিনি তাঁদেরকে বলে ছিলেনঃ
لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْعَصْرَ إِلاَّ فِى بَنِى قُرَيْظَةَ[رواه البخاري ومسلم برقم৪৭০১]
‘তোমাদের কেউই যেন বনু ক্বোরায়যা ছাড়া অন্য কোথাও আছর সালাত আদায় না করে। (বুখারী, হা/৪১১৯, মুসলিম, হা/৪৭০১)
কেউ কেউ এই নিষেধাজ্ঞাকে প্রকৃত অর্থেই মনে করে মাগরিবের পরবর্তী পর্যন্ত আছর ছালাত বিলম্বিত করেন। পক্ষান্তরে তাদের কেউ কেউ বুঝলেন যে, এ দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হল ছাহাবীদেরকে দ্রুত পথ চলার বিষয়ে উৎসাহ যোগানো। তাই তারা আছর ছালাত সঠিক সময়ে আদায় করে নেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উভয় দলের কৃত কর্মের কথা পৌঁছলে তিনি তাদের সমর্থন করেন এবং তাদের কোন প্রতিবাদ করেননি।
مكانة السنة في التشريع الإسلامي
ইসলামী শরী’আত প্রবর্তনে সুন্নাতের অবস্থান
নবীর সুন্নাত ইসলামী শরী’আতের দ্বিতীয় উৎস হিসাবে পরিগণিত।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ[الأحزاب:৩৪]
আর আল্লাহর আয়াত ও হিকমত (সুন্নাত) হিসাবে যা তোমাদের উপর তেলাওয়াত করা হয় তা তোমরা স্বরণ কর। (আল্‌ আহযাবঃ৩৪)
মহান আল্লাহ্‌ আরও বলেনঃ
وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ[البقرة:১২৯]
‘আর তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিবেন কিতাব এবং হিকমত (সুন্নাত)। (আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ১২৯)
ওলামায়ে দ্বীন এবং মুহাক্কিকীনদের অধিকাংশ এই দিকে গিয়েছেন যে কুরআনে উল্লেখিত হিকমত কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু উদ্দেশ্য হবে। এটিকে ওলামায়ে কেরাম সুন্নাত হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ইমাম শাফেঈ রহ. বলেনঃ হিকমত হল রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত। এই কথাটিই ইয়াহয়া ইবনু আবী কাছীর ও ক্বাতাদাহ্‌ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আর এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আল্লাহ্‌ এই সুন্নাতকে কিতাবের উপর ‘আতফ’ সংযুক্ত করেছেন। আর এ সংযুক্তির দাবী হল, উভয়টি পৃথক হওয়া। অথচ এই পৃথক ও স্বতন্ত্র হিকমতটি সুন্নাত ব্যতীত অন্য কিছু হওয়াও বিশুদ্ধ নয়। এজন্যই মহান মহিয়ান আল্লাহ্‌ আমাদেরকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ) [الحشر:৭]
আল্লাহ্‌ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রাসূলের, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্য। যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভুত না হয়। রাসূল তোমাদেরকে যা দান করে তা গ্রহণ কর, এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। (আল্‌ হাশরঃ৭)
মহান আল্লাহ নবীর প্রশংসা করে বলেনঃ
يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ[الأعراف:১৫৭]
‘তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎ কর্মের, বারণ করেন অসৎ কর্ম থেকে, তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন এবং হারাম ঘোষণা করেন অপবিত্র বস্তুসমূহ এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল।’ (আল্‌ আরাফঃ১৫৭)
মহান মহিয়ান আল্লাহ্‌ নবীর আনুগত্য করার নির্দেশ করে বলেনঃ
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (১৩২)[آل عمران]
‘আর তোমরা আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য কর তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।’ (আলে ইমরানঃ১৩২)
এজন্যই ছাহাবায়ে কেরাম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রত্যাবর্তন করতেন যাতে তিনি তাদেরকে কুরআনের বিধি-বিধান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে শুনান। তিনি তাঁদের বিতর্কিত বিষয়ে ফায়ছালা, তাদের ঝগড়া মিামাংসা করতেন। আর তাঁরাও তাঁর আদেশ নিষেধের সীমা রেখা মেনে নেওয়া অবধারিত করে নিতেন, এবং তাঁর আমল, ইবাদত, মু’আমালাত প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর অনুগত্য করতেন। একমাত্র কোন আমল নবীর সাথেই বিশেষায়িত হওয়া জানতে পারলে সে ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁর আনুগত্য করতেন না। তাদের নবীর প্রতি আনুগত্য নিবেদন এমন পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে ছিল যে, তিনি যা করতেন ঠিক তাই তারা করতেন। আর তিনি যা পরিত্যাগ করতেন তাই তারা পরিত্যাগ করতেন। তারা তাঁর উক্ত কর্ম করার পিছনে কোন কারণ, অযুহাত বা হিকমত না জানা সত্ত্বেও এমনটি করতেন। ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
(اتَّخَذَ رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَاتَمًا مِنْ ذَهَبٍ فَاتَّخَذَ النَّاسُ خَوَاتِيمَ مِنْ ذَهَبٍ ثم نبذه النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ: إِنِّي لَنْ أَلْبَسَهُ أَبَدًا فَنَبَذَ النَّاسُ خَوَاتِيمَهُمْ) [رواه البخاري].
রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি স্বণের্র আংটি গ্রহণ করলে লোকেরাও স্বর্ণের আংটি গ্রহণ করল। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আংটিটি ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেনঃ আমি আর কখনো এটি পরিধান করব না। এদেখে তারাও তাদের আংটি গুলি ছুঁড়ে ফেললেন। (বুখারী, হা/৭২৯৮)
তাঁরা নবীর আনুগত্য তাঁর তিরোধানের পরও আঁকড়ে ধরে থেকেছেন। কারণ যে সমস্ত দলীলাদি নবীর আনুগত্য ওয়াজিব প্রমাণ করেছে এগুলোর সবটুকই সাধারণ ও ব্যাপক। এগুলি নবীজির জীবদ্দশার সাথে মোটেও খাছ নয়। অনুরূপভাবে এই আনুগত্য অন্যান্যদের বাদ দিয়ে শুধু ছাহাবীদের জন্যই খাছ নয় বরং সকলের উপর এই আনুগত্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয (রাঃ) এর প্রশংসা করেছেন। তাকে ইয়েমেনে প্রেরণকালে তাকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ তোমার নিকট বিচার আসলে কিভাবে ফায়ছালা করবে? তিনি বলেছিলেনঃ আমি আল্লাহর কিতাব দ্বারা ফায়ছালা করব। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ যদি তুমি আল্লাহ্‌র কিতাবে সে বিষয়টি না পাও।(তখন কি করবে)? তদুত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ তাহলে আমি আল্লাহ্‌র রাসূলের সুন্নাত দিয়ে ফায়ছালা করব। (আবুদাউদ, তিরমিযী) [২৯]
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّتِيْ)
[رواه الحاكم১/১৭২ برقم ৩১৯ والبيهقي ১০/১১৪ برقم২০৮৩৪ (ومالك برقم১৫৯৪)]
‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এই দুটিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে কক্ষণই পথভ্রষ্ট হবে না। বস্তু দুটি হলঃ আল্লাহর কিতাব-তথা আল্‌ কুরআন এবং আমার সুন্নাত তথা আল্‌ হাদীছ। (হাকেম, ১/১৭২, হা/৩১৯, বায়হাক্বী ১০/১১৪,হা/২০৮৩, মালেক,হা/১৫৯৪,হাদীছ বিশুদ্ধ। দ্রঃ আলবানীর ‘ছহীহুল জামে’হা/২৯৩৭,৩২৩২,)।
উমার (রাঃ) বিচারক শুরায়্‌হ্‌ কে দিক নির্দেশনাস্বরূপ বলেছিলেনঃ
যখন তোমার নিকট কোন কিছু উপস্থিত হবে তখন আল্লাহ্‌র কিতাব অনুযায়ী তার ফায়ছালা দেবে। আর যদি তোমার নিকট এমন বস্তু উপস্থিত হয় যা আল্লাহর কিতাবে নেই, তাহলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে বিষয়ে যা সংবিধিবদ্ধ করেছেন তা দ্বারা ফায়ছালা করবে…।’
التحذير من نبذ السنة
নবীর সুন্নাত প্রত্যাখ্যান করা থেকে সতর্কীকরণ
১-মহা মহিয়ান আল্লাহ্‌ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশের বিরোধিতা করা থেকে সতর্ক করে বলেনঃ
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (৬৩)[النور]
অতএব, যারা তার তথা নবীর আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে। (সূরাহ আন্‌ নূরঃ ৬৩)
নবীর ফায়ছালার সামনে আল্লাহ্‌ আমাদের কোন প্রকার ইখতিয়ার রাখেননি (বরং তা মেনে নেওয়া ফরয করে দিয়েছেন)
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْراً أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ)[الأحزاب:৩৬]
অর্থঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষন করার অধিকার নেই। (আল্‌ আহ্‌যাবঃ ৩৬)
শুধু তাই নয়, আল্লাহ্‌ রাসূলকে ফায়ছালাকারীরূপে গ্রহণ করাকে উছূলুল ঈমান তথা ঈমানের মৌলিক বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেনঃ
فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً (৬৫)[النساء]
‘আপনার রবের ক্বসম! তারা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আপনাকে তারা তাদের বিতর্কিত বিষয়ে ফায়ছালাকারী হিসাবে গ্রহণ করবে, এবং আপনার ফায়ছালাকৃত বিষয়ে নিজ মনে সামান্যতম সংর্কীণতা বোধ করবে না এবং পরিপূর্ণভাবে সে ফায়ছালাকে মেনে নেবে। (আন্‌ নিসাঃ ৬৫)
এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئاً عَلَى أَرِيْكَتِهِ، يَأْتِيْهِ الْأَمْرُ مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ، فَيَقُوْلُ: بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ الْقُرْآنُ فَمَا وَجَدْنَا فِيْهِ مِنْ حَلَالٍ أَحْلَلْنَاهُ، وَمَا وَجَدْنَا فِيْهِ مِنْ حَرَامٍ حَرَّمْنَاهُ، أَلَا إِنِّيْ أُوْتِيْتُ الْقُرْآن وَمِثْلَهُ مَعَهُ (أخرجه أبو داود والترمذي وقال: هذا حديث حسن).
আমি তোমাদের কাউকে তার শোফায় উপবিষ্ট অবস্থায় যেন এরূপ না দেখতে পাই যে, তার নিকট আমার আদেশ-নিষেধ হতে কোন কিছু আসলে এই কথা বলে, আমাদের ও তোমাদের সামনে রয়েছে আল্‌ কুরআন। কাজেই তাতে যা আমরা হালাল পাব তাই হালাল গণ্য করব। পক্ষান্তরে তাতে যা হারাম পাবে কেবল তাই হারাম গণ্য করব। সাবধান! নিশ্চয় আমাকে কুরআন ও তার সাথে অনুরূপ আরেকটি বস্তু (হাদীছ) দান করা হয়েছে। (আবু দাউদ,তিরমিযী প্রভৃতি। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীছটি হাসান)।
…السنة بالقرآن
কুরআনের মাধ্যমে সুন্নাত…
কুরআনের সাথে সুন্নাতের নুছূছ তথা বাণীসমূহ তিন ভাগে বিভক্তঃ
১-এমন নছ্‌ বা হাদীছ যা কুরআনের বিধি-বিধানকে হুবহু সমর্থনকারী এবং তার অনুকুল সংক্ষিপ্ত, বিস্তারিত উভয় দিক থেকেই।
এর উদাহরণ হল যেমনঃ ঐ সকল হাদীছ ছালাত, যাকাত, হজ্জ, ছওম প্রভৃতি ওয়াজিব হওয়ার কথা বুঝায় কোন প্রকার শর্ত বা রুকন প্রভৃতির আলোচনা ছাড়া। এ সকল হাদীছ মূলত ঐসকল আয়াতের আনুকুল্যতা প্রদর্শনকারী যেগুলি উক্ত ইবাদত ওয়াজিব হওয়া মর্মে এসেছে।
যেমন মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ[البقرة:৪৩]
আর তোমরা ছালাত ক্বায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। (আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ৪৩)
নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ..[البخاري-৫২৩]
ইসলাম পঁচটি বিষয়ের উপর ভিত্তিশীলঃ এ মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ্‌ ছাড়া প্রকৃত কোনই উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। ছালাত ক্বায়েম করা, যাকাত প্রদান করা… (বুখারী, হা/৫২৩, মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, হা/১৬)।
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ [النساء:২৯]
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের মধ্যে পরষ্পরে বাতিলভাবে সম্পদ ভক্ষণ কর না। (আন্‌ নিসাঃ২৯) নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لاَ يَحِلُّ مَالُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلَّا بِطِيْبِ نَفْسٍ مِنْهُ [صححه الألباني-رحمه الله-في صحيح الجامع ২৭৮০، والإرواء ১৪৫৯]
কোন মুসলিম ব্যক্তির মাল অপরের জন্য হালাল নয় যে যাবৎ সে সন্তুষ্ট চিত্তে না দেয়। (সুনানুল বায়হাক্বী ৬/১০০, হা/১১৩২৫, মুসনাদে আবু ইয়ালা ৩/১৪০, হা/১৫৭০, বায়হাক্বীর ‘মারিফাতুস্‌ সুনানি ওয়াল্‌ আছার, ১৩/৩৮০, হা/৫২৫৫)
২-এমন সুন্নাত বা হাদীছ যা কুরআনের বিধি-বিধান ব্যাখ্যাকারীঃ
যেমন-
(ক)সাধারণ বিষয়কে শর্তযুক্ত করণঃ যেমন-মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا[المائدة:৩৮]
আর পুরুষ চোর ও মেয়ে চোর উভয়েরই হাতকে তোমরা কেটে দাও তাদের কৃত উপার্জনের বিনিময় স্বরূপ। (আল্‌ মায়েদাহ্‌ঃ৩৮)
সুন্নাত এসে এই হাত কর্তনকে (ডান হাতের) কব্জি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।[৩০]
(খ) অথবা সংক্ষিপ্ত বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা স্বরূপ হবেঃ যেমন আল্লাহ ছালাতের নির্দেশ করেছেন এবং সুন্নাত তা আদায় করার পদ্ধতির বিশদ ব্যাখ্যা নিয়ে এসেছে।
(গ) অথবা কোন সাধারণ ও ব্যাপক বিষয়কে নির্দিষ্ট করণঃ যেমন মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ[النساء:১১]
আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানাদির ব্যাপারে নির্দেশ করছেন এই মর্মে যে ছেলে সন্তানের জন্য মেয়ে সন্তানের দ্বিগুণ অংশ হবে। (আন্‌ নিসাঃ১১)
কুরআনের এই শব্দ সাধারণ ও ব্যাপক যা সকল সন্তান-সন্ততিকে শামিল করে। কিন্তু সুন্নাত এসে এই বিধানকে হত্যাকারী নয় এমন সন্তানের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
কারণ নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لاَ يَرِثُ الْقَاتِلُ [صححه الألباني في صحيح ابن ماجة ২৬৯৫، وفي إرواء الغليل ১৬৭১]
‘হত্যাকারী ওয়ারিছ-উত্তারাধিকারী হবে না।’ অর্থাৎ যে হত্যা করে সে যদি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হয় তাহলে সে উত্তরাধিকার পাবে না। (হাদীছটিকে আলবানী ছহীহ ইবনু মাজায়, হা/২৬৯৫ এবং ইরওয়াল গালীল কিতাবে, হা/ ১৬৭১ ছহীহ্‌ বলেছেন)
৩-এমন সুন্নাহ যা অতিরিক্ত বিধি-বিধান নিয়ে এসেছে যার সম্পর্কে কুরআন নীরবতা পালন করেছে।
যেমন ‘কোন মহিলাকে তার ফুফু বা খালার সাথে বিয়ে করা (অর্থাৎ ফুফু-ভাতিজি বা খালা-ভাগ্নিকে এক সাথে বিবাহ বন্ধনে রাখা) মর্মে নবী কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ কুরআন এ সম্পর্কে নীরব থেকেছে। (দ্রঃবুখারী, হা/৪৮২০, মুসলিম, হা/১৪০৮)
অনুরূপভাবে স্বর্ণ ও রেশম পুরুষের হারাম করণের বিষয়টি সুন্নাত-হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত। যা কুরআনে বর্ণিত হারামের উপর বর্ধিত বিধান বলে গণ্য)
এগুলি হল কুরআন কারীমের সাথে সুন্নাহর সম্পর্ক। যে সমস্ত বিধি-বিধান এই সুন্নাত দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে প্রমাণিত -এসব ক্ষেত্রেও এই সুন্নাহ পরিত্যাগ করা যাবে না বা শিথিলতা প্রদর্শন করা যাবে না। কারণ তার অর্থই হল, এই দ্বীনে ইসলামকে ধ্বংস করা, এবং শরী’আত প্রবর্তনের এমন দ্বিতীয় উৎসকে অকার্যকর করা যে উৎস দলীলাদি দ্বারা সুপ্রমাণিত এবং যার উপর রয়েছে ইজমায়ে উম্মত তথা এই মুসলিম উম্মতের ঐকমত্য। প্রয়োজনও এটাকে স্বীকার করেছে।
ইমারান বিন হুছাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি জনৈক ব্যক্তিকে বলেনঃ
‘নিশ্চয় তুমি একজন বেকুফ-নির্বোধ ব্যক্তি। তুমি কি আল্লাহ্‌র কিতাবে চার রাক’আত যোহর পেয়েছ যাতে ক্বিরাআত জোরে করা হবে না? এরপর এজাতীয় সমস্ত বিষয়গুলি একটা একটা করে গণনা করতঃ তার সামনে তুলে ধরেন আর বলেনঃ এগুলো কি তুমি আল্লাহর কিতাবে ব্যাখ্যা সহকারে পেয়েছ? নিশ্চয় আল্লাহ্‌র কিতাব এগুলি অস্পষ্ট রেখেছে আর সুন্নাত তার বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। (শাত্বেবী প্রণীত ‘আল্‌ মুওয়াফাক্বাত’ এবং ইবনু আব্দিল বার প্রণীত ‘জামেঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী’ প্রভৃতি)।
علـم الحديث
হাদীস শাস্ত্র
হাদীস শাস্ত্র দুটি প্রধান বিষয়কে শামিল করে। বিষয় দুটি হলঃ
১- علم الحديث رواية:’বর্ণনা ভিত্তিক হাদীস শাস্ত্রঃ
কথা, কাজ, সমর্থন ও গুণাবলী প্রভৃতি হতে যা কিছু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে তা উদ্ধৃত করার উপর যে ইলম সুপ্রতিষ্ঠিত তাকেই علم الحديث روايةً’বর্ণনা ভিত্তিক হাদীস শাস্ত্র’ বলে।
২- علم الحديث دراية:’জানা তথা জ্ঞান আহরণের দিক থেকে হাদীস শাস্ত্রঃ
কেউ কেউ বলেনঃ
(هو معرفة القواعد المعرفة بحال الراوي والمروي)
তা হল এমন কিছু নীতিমালার নাম যা রাবী ও মারবীর অবস্থার পরিচয়দানকারী।
‘রাবী’ হল হাদীসের বর্ণনাকারী। আর ‘মারবী’ হল, যা কিছু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে (কথা, কাজ, সমর্থন ও গুণাবলী প্রভৃতি হিসাবে) সম্পর্কিত করা হয়েছে।
অতএব জ্ঞান ভিত্তিক ইলমে হাদীছের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে-
(ক) সনদঃ এটা হল রেজাল বা রাবীদের ধারাবাহিকতা রাসূলুল্লাহ সা. পর্যন্ত হাদীসটির ধারাবাহিক সুত্র।
খ) মতনঃ আর তা হল ঐ কথা-হাদীছ যা সুত্র-সনদ বর্ণনার পর উক্ত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন কথার শর্ত লাগানো ছহীহ নয়। কারণ সংকলিত বস্তু কোন কোন সময় (নবীর) কর্মও হতে পারে। আর (এবিষয়ে) আল্লাহই অধিক অবগত।
উদাহরণঃ ইমাম বুখারী (রহ.) বলেনঃ
حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ قَالَ حَدَّثَنِي مَالِكٌ عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنْ الْأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ قَالَ اللَّهُ أَنْفِقْ يَا ابْنَ آدَمَ أُنْفِقْ عَلَيْكَ[أخرجه البخاري مطولاً في عدة مواضع ৪৬৮৪]
‘আমাকে হাদীছ বর্ণনা করে শুনিয়েছেন ইসমাঈল। তিনি বলেনঃ আমাকে মালেক-আবুয্‌ যিনাদ থেকে হাদীছ বর্ণনা করে শুনিয়েছেন, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হোরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মহান আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ
হে আদম সন্তান! আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তাহলে আমিও তোমার জন্য খরচ করব।(বুখারী তাঁর ছহীহ বুখারীর বিভিন্ন স্থানে এটিকে সংকলন করেছেন। যেমন হা/৪৬৮৪)
অত্র হাদীছে সনদ হল হাদীছের রেজাল তথা বর্ণনাকারীগণ। যেমন ‘আমাকে হাদীছ বর্ণনা করে শুনিয়েছেন ইসমাঈল। তিনি বলেনঃ আমাকে মালেক-আবুয্‌ যিনাদ থেকে হাদীছ বর্ণনা করে শুনিয়েছেন, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হোরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন। এ পর্যন্ত হল সনদ। এবং মতন হলঃ ‘হে আদম সন্তান…’।
জ্ঞান নির্ভর হাদীস শাস্ত্রের উপকারিতা হলঃ ‘কোন্‌টি গ্রহণযোগ্য হাদীছ এবং কোন্‌টি প্রত্যাখ্যানযোগ্য হাদীছ’ তার পরিচয় লাভ করা।
হাদীছ, খবর, আছার প্রভৃতির মাঝে পার্থক্য নিরূপণঃ
১-হাদীছ (এর সংজ্ঞা)ঃ
(ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم سواء كان قولاً أو فعلاً أو تقريراً)
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যা কিছু এসেছে তাই হাদীছ। তা তাঁর কথা হোক, বা কর্ম হোক, মৌন সমর্থন হোক।
২-খবর (এর সংজ্ঞা)ঃ
(ما جاء عن النبي-صلى الله عليه وسلم-أو أصحابه أو التابعين، أو من دونهم).
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা ছাহাবীগণ বা তাবেঈগণ বা তাদের নীচের ব্যক্তিদের থেকে যা এসেছে তাকেই খবর বলে।
৩-‘আছার’ (এর সংজ্ঞা)ঃ
(ما جاء عن غير النبي-صلى الله عليه وسلم-من الصحابة أو التابعين، أو من دونهم).
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত ছাহাবা, তাবেঈন বা তাদের নীচের ব্যক্তিদের থেকে যা কিছু এসেছে তাকেই আছার বলে (অবশ্য অনেক সময় আছার দ্বারা নবীর হাদীছকেও উদ্দেশ্য করা হয়)
مصطلحات في علم المصطلح
হাদীস শাস্ত্রের কিছু পরিভাষা
১-মুতাওয়াতির হাদীছঃ
وهو ما نقله إلينا جماعة كثيرون تحيل العادة تواطؤهم على الكذب و توافقهم عليه، عن جماعة كذلك، ويكون إخبارهم عن شيء محسوس من مشاهد أو مسموع، كأن يقول: رأيت رسول الله صلى الله عليه يفعل كذا، أو سمعت رسول الله-صلى الله عليه وسلم-يقول كذا…الخ.
‘মুতাওয়াতির’ ঐ হাদীছকে বলে যা আমাদের নিকট উদ্ধৃত করেছে এমন একটি জামাআতের মাধ্যমে যাদের মিথ্যা বলার উপর ঐক্যমত অসম্ভব। এ রকম জামা’আত অনুরূপ আরেকটি জামা’আত থেকে হাদীছটিকে বর্ণনা করেছে। এবং তাদের পরিবেশিত তথ্যটি অনুভব করা যায় এ রকম বিষয় হতে হবে যেমন প্রত্যক্ষ করা বা শোনা বিষয়। উদাহরণ, বর্ণনাকারী বলবে, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এরূপ করতে দেখেছি..। অথবা আমি রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এরূপ বলতে শুনেছি..।
মুতাওয়াতির হাদীছ দুই ভাগে বিভক্তঃ
(ক) মুতাওয়াতির লাফযী তথা শাব্দিকভাবে মুতাওয়াতিরঃ
আর তা হল এমন হাদীছ যার শব্দ ও অর্থ উভয়টি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুতাওয়াতিরভাবে (সন্দেহাতীত সূত্রে) বর্ণিত। যেমন এই হাদীছটি-
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا (فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّار) [البخاري، وهو من الأحاديث المتواترة].
যে ব্যক্তি আমার উপর এমন কথা আরোপ করবে যা আমি বলিনি তাহলে সে যেন জাহান্নামে তার বসার স্থান নির্ধারণ করে নেয়। (মুত্তাফাকুন আলাইহিঃ বুখারী, জানাযা অধ্যায়, হা/১২০৯, আদব অধ্যায়, হা/৫৭২৯, নবীদের হাদীছ অধ্যায়, হা/৩২০২, ও মুসলিম-ভূমিকা, হা/৪,৫ হাদীছটি মুতাওয়াতের সূত্রে বর্ণিত। দ্রঃ ছহীহুল জামে’হা/৬৫১৯)।
(খ) মুতাওয়াতির মানাবী তথা অর্থগতভাবে মুতাওয়াতিরঃ
এই প্রকার হল, এমন হাদীস, যার শব্দ নয় বরং অর্থটা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুতাওয়াতিরভাবে (সন্দেহাতীত সূত্রে) প্রমাণিত। যেমনঃ ‘হাওয’ ‘শাফাআত’ সংক্রান্ত হাদীছসমূহ। (এগুলি হাদীছ অর্থগতভাবে মুতাওয়াতির, শব্দগতভাবে মুতাওয়াতির নয়)
এই প্রকার হাদীছ সন্দেহাতীতভাবে সুসাব্যস্ত, এটা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার মতই। এর উপর আমল করা ওয়াজিব[৩১]
২-ছহীহ হাদীছঃ
(وهو: ما اتصل سنده نقل العدل الضابط عن مثله إلى منتهاه ولا يكون شاذاً ولا معللاً بعلة قادحة)
ছহীহ হাদীছ ঐ হাদীছকে বলে, যার সনদ শুরূ থেকে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ, স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা বর্ণিত। এবং সেটি অন্য ছহীহ হাদীছের বিরোধী হবে না এবং কোন দোষযুক্তও হবে না।
৩-ছহীহ লেগায়রিহীঃ তথা অপরের সহযোগিতায় ছহীহঃ
এটি হল মূলত ‘হাসান লেযাতিহী’ হাদীছ; যখন তার সূত্র একাধিক হবে।
কেউ কেউ বলেছেনঃ ছহীহ লিগায়রিহী ঐ হাদীছকে বলে যার শর্তাবলী ছহীহ লেযাতিহী’ এর শর্তাবলী থেকে হালকা হয়, কিন্তু সুত্রসমূহের আধিক্যের কারণে এই ঘাটতিটুকু পূর্ণ হয়ে যায়।
৪-জায়্যেদ হাদীছঃ
ঐ হাদীছকে বলে যে হাদীছ হাসান লেযাতিহী’ হাদীছ এর উপর উন্নীত হয়েছে তবে তার ছহীহ হাদীছের মর্যাদায় পৌঁছার বিষয়টি নিশ্চিত নয়, সন্দেহযুক্ত। কারণ তার গুণটি ‘ছহীহ’র গুণ থেকে তুলনামূলক নিম্ন মানের।
৫-হাসান লেযাতিহী হাদীছঃ
(هو الحديث الذي اتصل سنده بنقل عدل خف ضبطه غير شاذ ولا معلل)
‘হাসান লেযাতিহী তথা নিজ গুণে হাসান ঐ হাদীছকে বলে যার সনদ অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ,,হালকা স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির দ্বারা বর্ণিত। এবং সেটি অন্য ছহীহ হাদীছের বিরোধী হবে না এবং কোন দোষযুক্তও হবে না।’
জমহূর ওলামায়ে দ্বীনের নিকট এই প্রকার হাদীছও ছহীহ হাদীছের মত দলীল হিসাবে গ্রহণ যোগ্য।
৬-হাসান লেগায়রিহীঃ অন্য কিছুর সহযোগিতায় হাসান হাদীছঃ
(هو: الخبر المتوقف عن قبوله، إذا قامت قرينة ترجح جانب قبول ما يتوقف فيه)
অর্থঃ ‘হাসান লেগায়রিহী’ হল এমন খবর যা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা হয়েছে, যদি কোন আলামত পাওয়া যায় যা তবে তা গ্রহণ করা হয়।
উক্ত হাদীছের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছেঃ
(هو الضعيف: إذا تعددت طرقه وليس في رواته من يتهم بكذب ولا فسق)
সেটি মূলতঃ যঈফ হাদীছই, যখন তার সূত্রগুলি একাধিক হয় এবং তার রাবীদের মাঝে এমন কোন ব্যক্তি থাকবে না যে মিথ্যা বলার অভিযোগে বা ফাসেক্বী কর্ম করার অভিযোগে অভিযুক্ত।
৭-যঈফ হাদীছঃ
(هو: ما لم تجتمع فيه صفات الصحيح، ولا صفات الحسن).
যঈফ হাদীছ ঐ হাদীছকে বলে যার মাঝে না ছহীহ হাদীছের গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে, না হাসান হাদীছের গুণাবলী পাওয়া যায়।
৮-শায হাদীছঃ
(هو: ما روى الثقة مخالفاً لرواية الناس،
‘শায’ হাদীছ হল সেই হাদীছ যে হাদীছকে বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী- অন্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিপরীত বর্ণনা করেছেন।
৯-নির্ভরযোগ্য রাবীর ‘বর্ধিত হাদীছ’ঃ
(هو: ما زاد فيه بعض الثقات ألفاظاً بالحديث، عما رواه الثقات الآخرون لذلك الحديث، وهي مقبولة على القول الراجح).
হাদীছের মধ্যে কোন কোন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী শব্দ বৃদ্ধি করে বর্ণনা করেছেন। যা উক্ত হাদীছের অন্যান্য বিশ্বস্ত রাবীগণ করেননি। এরূপ অতিরিক্ত অংশ অধিকাংশের অভিমত অনুসারে গ্রহণযোগ্য।
১০-মাওকূফ হাদীছঃ
(هو ما روى عن الصحابة قولا لهم أو فعلاً أو تقريراً، متصلاً كان أو منقطعاً).
‘মাওকূফ হাদীছ’ ঐ হাদীছকে বলে যা ছাহাবীদের থেকে বর্ণিত, তা তাদের ব্যক্তিগত বাণী হোক বা কর্ম হোক বা মৌন সমর্থন হোক। অনুরূপভাবে তা অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত হোক বা বিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত হোক।[৩২]
১১-মাক্বতূ’ঃ
(وهو: ما نسب إلى التابعي أو من دونه من قول أو فعل وهو غير المنقطع).
‘মাকতূ’ বলা হয় এমন হাদীছকে যা কোন তাবেঈ বা তারও নীচের লোকদের দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে, তা কথা হোক বা কাজ হোক। এটাকে কিন্তু ‘মুনক্বাতি’ বলা হবে না।
১২-হাদীছে কুদুসী :
(هو: ما نقل إلينا عن النبي -صلى الله عليه وسلم-مع إضافته إلى ربه-عز وجل-).
উহা সেই হাদীছ যা আমাদের নিকট উদ্ধৃত করা হয়েছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এবং সেটি তাঁর মহান আল্লাহর কথা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। (অর্থাৎঃ নবীর সূত্রে বর্ণিত আল্লাহর বাণীকে হাদীছে কুদুসী )
১৩-‘মাওযূ’ তথা জাল হাদীছঃ
(هو: المختلق المصنوع على رسول الله -صلى الله عليه وسلم-).
‘মাওযূ তথা জাল হাদীছ’ ঐ হাদীছকে বলা হয় যা রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে তৈরী করা হয়েছে এবং মিথ্যা জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এর সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছেঃ
(هو ما كان راويه كاذبا، أو متنه مخالفا للقواعد)
অর্থাৎঃ ‘মাওযূ’ তথা জাল হাদীছ ঐ হাদীছকে বলে যার বর্ণনাকারী-রাবী মিথ্যাবাদী হয় বা হাদীছটির বক্তব্য ইসলামী মৌলিক নীতিমালার বিরোধী হয়।
এরূপ হাদীছ জেনে বুঝে বর্ণনা করা হারাম তা যে অর্থেরই হাদীছটি হোকনা কেন। একমাত্র ঐ অবস্থায় এরূপ ‘মাওযূ’-জাল হাদীছ বর্ণনা করা বৈধ, যখন সঙ্গে সঙ্গে তার বানাওয়াট-জাল হওয়ার বিষয়টি বলে দেওয়া হবে।
১৪-হাদীছের কিতাবে লিখিতঃ
(ثا-ثنا-دثنا)
‘ছা-ছানা-দাছানা) এগুলি মূলতঃ (حَدَّثَنَا)’হাদ্দাছানা’ এর সংক্ষিপ্তরূপ যার অর্থ হল-আমাদেরকে হাদীছ বর্ণনা করে শুনিয়েছেন..।
১৫-অনুরূপভাবে (ثني)(দাছানী) এটি মূলতঃ (حّدَّثَنِيْ)’হাদ্দাছানী’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ যার অর্থ হলঃ আমাকে হাদীছ বর্ণনা করে শুনিয়েছেন..।
১৬-দৃঢ়তার শব্দাবলীঃ
(قال، روى فلان، جاء، عن) ‘ক্বালা’ (সে বলেছে) রওয়া ফুলানুন, (ওমুক বর্ণনা করেছে), জা-আ (এসেছে), আন্‌ (হতে)ঃ
১৭-রুগ্নকারী শব্দ তথা এমন পরিভাষা যা দ্বারা বর্ণনা যঈফ প্রমাণ করার প্রতি ইঙ্গিত বহন করেঃ
(قيل،يروى، روي عن فلان) ‘ক্বীলা’ তথা বলা হয়েছে, কথিত আছে। ‘য়ুরওয়া’ তথা বর্ণনা করা হয়। ‘য়ুযকারু’ তথা উল্লেখ করা হয়। ‘রুভিয়া আন্‌ ফুলানিন’ তথা ওমুক থেকে বর্ণনা করা হয়েছে।
১৮-‘যাবত’ তথা দৃঢ়তা, নিশ্চয়তা প্রভৃতি। যার অর্থ হল সংরক্ষণে দৃঢ়তা-চরম সতর্কতা অবলম্বন।
এটি দুই প্রকারঃ
ক) ‘যবতু ছদ্‌র’ তথা স্মৃতিশক্তিতে সংরক্ষণ। খ) ‘যবতু কিতাব’ তথা লিখিত আকারে সংরক্ষণ।
১৯- (أخرجه الستة:البخاري، مسلم، أبوداود، الترمذي، النسائي، ابن ماجة)এর অর্থ হল, ‘হাদীছটি ছয়জন বর্ণনা বা সংকলন করেছেন। ছয় বলতে ‘বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ্‌ প্রমুখ-কে বুঝায়।
২০-(أخرجه الخمسة: أصحاب السنن مع الإمام أحمد) এর অর্থ হল, ‘হাদীছটি পাঁচ জন বর্ণনা (সংকলন) করেছেন। তাঁরা হলেনঃ সুনান চতুষ্টয়ের প্রণেতাগণ তথা আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ্‌ -ইমাম আহমাদ সহ।
২১-(أخرجه الأربعة: أي أصحاب السنن) কথাটির অর্থ হল, ‘হাদীছটি চার জন বর্ণনা (সংকলন) করেছেন। তথা সুনান চতুষ্টয়ের প্রণেতগণ বর্ণনা (সংকলন) করেছে। এই পরিভাষায় বুখারী ও মুসলিম গণনায় বাদ থাকবেন।
২২-(أخرجه الثلاثة: أصحاب السنن ما عدا ابن ماجة) কথাটির অর্থ হল, হাদীছটি তিন জন বর্ণনা (সংকলন) করেছেনঃ অর্থাৎ ইবনু মাজাহ ব্যতীত সুনান চতুষ্টয়ের বাকী গ্রন্থকারগণ বর্ণনা করেছেন।
২৩-(متفق عليه: اتفاق البخاري ومسلم على روايته من حديث صحابي واحد) কথাটির অর্থ, একই ছাহাবী থেকে হাদীছ বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্য হওয়া।
২৪-‘আল্‌ জামে’ এটি হল প্রত্যেক ঐ কিতাব যাতে গ্রন্থকার সমস্ত বিষয়ের হাদীস সংকলন করেন। যেমন আক্বাঈদ, ইবাদাত, বৈষয়িক লেনদেন, জীবনি প্রভৃতি। যেমন ইমাম বুখারী (রহিমাহুল্লাহ্‌) প্রণীত ‘আল্‌ জামেউছ্‌ ছহীহ’ তথা ছহীহ্‌ বুখারী।
২৫-‘আস্‌ সুনান’ঃ
‘সুনান’ ঐ সমস্ত কিতাবকে বলে যা ফিক্বহী অধ্যায়ের উপর সুবিন্যস্ত। এবং তাতে আক্বীদাহ্‌ ও জীবনী সংক্রান্ত কিছুই পাওয়া যাবে না। যেমন সুনান আবুদাউদ।
২৬-আল্‌ মুস্তাদরাক’ঃ ‘আল্‌ মুস্তাদরাক’ প্রত্যেক ঐ কিতাবকে বলে যার মধ্যে গ্রন্থকার ঐসমস্ত হাদীছ সংকলন করেছেন, যে গুলি অন্য কিতাবের শর্ত অনুযায়ী ছিল কিন্তু এর পরও সেগুলি উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়নি। যেমন ইমাম হাকেম প্রণীত ‘আল্‌ মুস্তাদরাকু আলাছ্‌ ছহীহায়ন’।
২৭-‘আল্‌ মুছান্নাফাতঃ আল্‌ মুছান্নাফাত ঐ গ্রন্থকে বলে যা ফিক্বহী অধ্যায়ের উপর সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। তবে এই গ্রন্থ মারফূ হাদীছের সাথে ‘মাওকূফ’ ও ‘মাকতূ’ হাদীছকেও শামিল করে থাকে। এই পর্যায়ের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের অন্যতম হল ‘মুছান্নাফ আব্দুর রায্‌যাক’ ও ‘মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্‌’।
২৮-আল্‌ মুস্তাখরাজাতঃ এর তাৎপর্য হল এই যে, কোন এক গ্রন্থকার হাদীছের যে কোন একটি কিতাবের দিকে এসে সে উক্ত কিতাবের হাদীছ গুলিকে নিজ সনদে উক্ত গ্রন্থের গ্রন্থকারের সূত্র ভিন্ন অন্য সূত্রে বর্ণনা করবেন। এভাবে তিনি উক্ত গ্রন্থকারের সাথে মিলিত হবেন তার ওস্তাদে অথবা তার উপরের ব্যক্তির ক্ষেত্রে। এই পর্যায়ে অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ কিতাব হল ইসমাঈলী প্রণীত ‘আল্‌ মুস্তারাজু আলাল্‌ বুখারী’।
২৯-আল্‌ মুসনাদঃ
মুসনাদ হল হাদীসের ঐ কিতাবে যাতে তার গ্রন্থকার প্রত্যেক ছাহাবীর যাবতীয় বর্ণনা পৃথক পৃথকভাবে সংকলন করেছেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাদীছটি কি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত তা লক্ষ্য করা হয় না। যেমন ইমাম আহমাদ এর মুসনাদ এবং আবু ইয়ালা এর মুসনাদ।
৩০-আল্‌ আত্বরাফঃ
‘আল্‌ আত্বরাফ’ ঐসমস্ত কিতাবকে বলে যার গ্রন্থাকারগণ হাদীছের এমন অংশ বিশেষ উল্লেখ করেন যা পুরো হাদীছের প্রতি ইঙ্গিত করে। এরপর তার সনদসমূহ উল্লেখ করেন যা হাদীছের মূল গ্রন্থাবলীতে সংকলিত হয়েছে। এই প্রকৃতির গ্রন্থাকারদের কেউ কেউ পূর্ণাঙ্গরূপে হাদীছের সনদ উল্লেখ করেন, আবার কেউ কেউ সনদের অংশ বিশেষ উল্লেখ করেন। এই পর্যায়ের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ইমাম মায্‌যী প্রণীত ‘তুহফাতুল্‌ আশরাফি বিমা’রিফাতিল আতরাফ’।
৩১-আল্‌ মা’আজিম’ঃ
‘আল্‌ মা’আজিম’ ঐ সকল গ্রন্থকে বলে যার মধ্যে হাদীছ সংকলন করা হয়েছে ওস্তাদদের সিরিয়াল অনুযায়ী এবং এই সিরিয়াল অধিকাংশ সময় আরবী অক্ষর অনুযায়ী করা হয়। যেমনঃ ত্বাবারানীর মা’আজিম সমূহ যথাঃ
১-আল্‌ মু’জামুল কাবীর। এটি ছাহাবীরে মুসনাদ অনুযায়ী আরবী অক্ষরের সিরিয়াল অনুসারে সাজানো হয়েছে।
২-আল্‌ মু’জামুল আওসাত্ব ও আল্‌ মু’জামুছ্‌ ছগীর। যা ইমাম তাবারানীর ওস্তাদদের (আরবী অক্ষর ভিত্তিক) সিরিয়াল অনুযায়ী সাজানো হয়েছে।
৩২-আল্‌ আজযাঃ
‘আল্‌ আজযা’ হাদীসের ঐ কিতাবকে বলে যাতে হাদীছের রাবীদের মধ্যে যে কোন একজন রাবীর বর্ণনাকৃত সকল হাদীছ সংকলন করা হয়েছে। চাই সে রাবী ছাহাবীদের স্তরের হোক যেমনঃ আবু বকর এর হাদীছের ‘যুয্‌’ বা তাদের পরের স্তরের হোক যেমনঃ মালেক এর হাদীছের অংশ।
‘আজযা’এর সংজ্ঞায় ইহাও বলা হয়েছেঃ ‘আজযা’ ঐ সমস্ত গ্রন্থ যার গ্রন্থকার একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের যত কিছু বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলি খুঁজে খুঁজে সংকলন করেছেন। যেমন: ইমাম বুখারী রহ. প্রণীত ‘জুযউ রাফঈল ইয়াদাইন ফিছ্‌ ছালাত্‌’।
مقدمة في علم الفقه
ইলমে ফিক্বহ্‌ বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞান
আভিধানিক অর্থে ফিক্বহ্‌ হলঃ বুঝা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
فَمَالِ هَؤُلاءِ الْقَوْمِ لا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثاً (৭৮)[النساء]
‘এই লোকদের কি হয়েছে যে তারা কথা বুঝাতে চায় না। (সূরা নিসা : ৭৮)
পরিভাষায়ঃ ফিক্বহ হল কর্মগত শরঈ বিধান জানার নাম যা তার বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ থেকে অর্জিত হয়ে থাকে।
ফিক্বহ ইসলামী স্তর সমূহ
১-নবুওতের যামানায় ফিক্বহ্‌ঃ
মুসলিম উম্মাহ এ যুগে শরঈ বিধি-বিধানের বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত ছিল না। কারণ তাঁদের নিকট এমন ব্যক্তির উপস্থিতি ঘটেছিল যিনি শরী’আত বিষয়ে নিজ প্রবৃত্তি থেকে কিছুই বলেন না। তিনি জাহেলকে শিক্ষা দিতেন, উদাসীনকে সতর্ক করতেন, হালাল-হারাম বাতলিয়ে দিতেন। সে সময় মতবিরোধকালীন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাটিই হত চূড়ান্ত ফায়ছালা।
আল্লাহ্‌র নবীর যামানায় ফিক্বহী জ্ঞান বেশ কয়েকটি বিষয় দ্বারা বিদিতঃ
১-কোন ঘটনার বিধান রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া, যেমন তাঁর বাণীঃ
(مَنْ بَدَّلَ دِيْنَهُ فَاقْتُلُوْهُ)[رواه البخاري، كتاب الجهاد والسير، باب لا يعذب بعذاب الله (১৪৯)، حديث رقم (৩০১৭)].
‘যে তার ধর্ম পরিবর্তন করবে তাকে তোমরা হত্যা কর।’ (বুখারী জিহাদ.. অধ্যায়,হা/৩০১৭)
এটা মূলতঃ উল্লেখিত মাসআলায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম।
অনুরূপভাবে মহান আল্লাহর বাণীঃ
(وَلا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ)[النساء:২২১]
আর তোমরা মুশরিক মহিলাদেরকে বিয়ে করবে যতক্ষণ না তারা ঈমান না আনবে।’ (আন্‌ নিসাঃ২২১)
২-রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে তাঁর ছাহাবীদের কিছু আমল সমর্থন করা এবং তাদের অপর কিছু আমলের ভুল ধরা। যেমনঃ
(ক) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে ঐ ব্যক্তির সমর্থন জানানো যে পানি না পাওয়ায় তাইয়াম্মুম করে ছালাত আদায় করে ছিল, অতঃপর উক্ত ছালাতের সময় বের হওয়ার পূর্বেই পানি পেয়ে গেছিল (কিন্তু সে ছালাত আর পুনরায় আদায় করেনি)। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সমর্থন করে বলেছিলেনঃ ‘তুমি সুন্নাত অনুযায়ী কাজ করেছ। (আবু দাউদ, পবিত্রতা অধ্যায়, হা/৩৩৮, নাসায়ী, গোসল এবং তায়াম্মুম অধ্যায়,হা/হা/৪৩৩)
(খ) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে উসামাহ বিন যায়দকে নিন্দা জ্ঞাপন করা যখন তিনি এমন একজন মুশরিককে হত্যা করে ছিলেন যে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’ পাঠ করে ছিল। উসামা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বলেছিলেনঃ সে তো উক্ত কালেমা পাঠ করে ছিল তরবারীর ভয়ে! এরই প্রেক্ষিতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে ছিলেনঃ
(هَلْ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ؟)[رواه مسلم، كتاب الإيمان في باب تحريم قتل الكافر بعد أن قال: لا إله إلا الله (৪১) حديث رقم (১৫৮)]
‘তুমি কি তার অন্তর ফেড়ে দেখেছ?’ (মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, হা/১৫৮)[৩৩]
৩-নির্দিষ্ট কোন কর্মের প্রচার ও প্রসার হওয়ার পরও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা থেকে নিষেধ করেননি এবং কুরআনও নাযিল হয়নি উক্ত বিষয় হারাম করার ক্ষেত্রে। এরূপ অবস্থায় উক্ত কর্ম বৈধ হওয়া প্রমাণ করে। যেমন স্ত্রীদের সাথে সহবাসকালীন বীর্য বাইরে ফেলার বিষয়টি বৈধ। কারণ জাবের (রাঃ) বলেনঃ
(كُنَّا نَعْزِلُ وَ الْقُرْآنُ يَنْزِلُ)[رواه البخاري، كتاب النكاح، حديث (৫২০৮، ৫২০৯)، ومسلم، باب حكم العزل، رقم الحديث (১০৬৫)]
‘আমরা স্ত্রীদের সাথে আযল করতাম অথচ কুরআন সে সময় নাযিল হচ্ছিল।’ (বুখারী, বিবাহ অধ্যায়, হা/৫০২৮,৫০২৯)
৪-এমন কিছু অবস্থার সৃষ্টি হওয়া যে ক্ষেত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত কোন কিছু বলা থেকে বিরত থাকতেন যতক্ষণ না সে বিষয়ের বর্ণনায় কুরআন নাযিল হত। যেমনঃ যেহারের বিধান…প্রভৃতি।
২-খলীফাদের যামানায় ফিক্বহ্‌ঃ
বহু মাসাআলাহ্‌-মাসায়েলের ক্ষেত্রে ছাহাবীদের মাঝে বড় ধরনের কোনই মতবিরোধ ছিল না। কারণ তাঁরা নবুওতের যামানার নিকটবর্তী ছিলেন। এবং ছাহাবীদের মধ্যে প্রবীণ প্রবীণ ছাহাবী ছিলেন। যাদের কথা বহু মাসা’আলাহ্‌-মাসায়েলের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ফায়ছালা বলে গণ্য হত। এটি আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) এর যামানায় স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এর পরই যামানা যত পিছাতে শুরূ করে তত মতবিরোধও বৃদ্ধি লাভ করে। এজন্যই দেখা যায় যে, উমার (রাঃ) এর যামানার তুলনায় উছমান (রাঃ) এর যামানা মতবিরোধ বেশী। এবং আলী (রাঃ) এর যামানায় উছমানের যামানার চেয়ে মতবিরোধ বেশী। এর একমাত্র কারণ হল ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং নবুওতের যামানা হতে তাদের দূরে অবস্থান করা।
৩-তাবেঈদের যামানায় ফিক্বহ্‌ঃ
তাবেঈদের যামানায়, বিশেষ করে প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে রায় পন্থীদের মাদরাসা প্রকাশের পর ইসলামী ফিক্বহে মতবিরোধের পরিধি বেড়ে যায়। এসময় মূলতঃ আমাদের নিকট দুটি মাদরাসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
*মাদরাসাতুল হাদীছ- হাদীছের প্রতিষ্ঠানঃ
এই প্রতিষ্ঠান ছিল হাদীছ নির্ভরশীল।
*মাদরাসাতুর রায়-তথা রায় ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানঃ
এই প্রতিষ্ঠান হাদীছ প্রত্যাখ্যান করত না, এই প্রতিষ্ঠান বহু হাদীছ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকত। এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় ইরাক দেশে যার সম্পর্কে কোন কোন পূর্বসূরী বিদ্বান বলেনঃ
(كان الحديث يخرج من المدينة شبراً ويعود من العراق ذراعاً )
‘মদীনা থেকে হাদীছ এ বিঘত হয়ে বের হত এবং ইরাক থেকে তা এক হাত হয়ে ফিরে আসত।’
مصادر الفقه الإسلامي
ইসলামী ফিক্বহের উৎসসমূহ
১-আল্‌ কুরআনুল কারীমঃ মুসলিম ব্যক্তি মহান আল্লাহ্‌র এই কিতাব থেকেই বিভিন্ন মাসআলাহ্‌-মাসায়েলের বিধি-বিধান গ্রহণ করবে। উদাহরণ স্বরূপ, যে ব্যক্তি অবিবাহিত অবস্থায় যেনা-ব্যভিচার করবে তাকে (চার জন ন্যায় পরায়ণ সাক্ষ্যদাতার সাক্ষর ভিত্তিতে, বা তার নিজ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে) একশতটি চাবুক মারা হবে (যা রাষ্ট্রীয় ইসলামী শাষকের আদেশক্রমে বাস্তবায়িত হবে)।
কারণ মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ[النور]
‘ব্যভিচারীনী নারী এবং ব্যভিচারী পুরুষ-এদের উভয়কে তোমরা একশতটি করে চাবুক মার। (আন্‌ নূরঃ২)
২-আস্‌ সুন্নাহঃ তথা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছঃ
মুসলিম ব্যক্তি এই সুন্নাতের মাঝে বহু মাসআলাহ্‌-মাসায়েলের বিধান পাবে। তদ্রূপ মাসআলাহ্‌-মাসায়েলের মৌলিক বিষয়গুলিও পাবে। যেমন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ
خُذُوا عَنِّى خُذُوا عَنِّى قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلاً الْبِكْرُ بِالْبِكْرِ جَلْدُ مِائَةٍ وَنَفْىُ سَنَةٍ[رواه مسلم، كتاب الحدود، باب حد الزنا(৩)، حديث رقم (১৬৯০)]
‘তোমরা আমার থেকে গ্রহণ করে নাও, তোমরা আমার থেকে গ্রহণ করে নাও। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ঐসব মহিলাদের জন্য পথ করে দিয়েছেন। কুমারী নারীর সাথে কুমার পুরুষ যেনা-ব্যভিচার করলে তাদের শাস্তি হলঃ একশতটি কোড়া (চাবুক) লাগানো এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর করা তথা দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া। (মুসলিম, হুদূদ-শাস্তি বিধান অধ্যায়, হা/১৬৯০)
এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ
(مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ)[رواه البخاري، كتاب الجهاد والسير، باب لا يعذب بعذاب الله (১৪৯)، حديث رقم (৩০১৭)]
যে তার নিজ ধর্ম (ইসলাম) পরিবর্তন করবে তাকে তোমরা হত্যা করে ফেল। (বুখারী, জিহাদ.. অধ্যায়, হা/৩০১৭)।
৩-আল্‌ ইজমাঃ মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তঃ এ দ্বারা উদ্দেশ্য হল নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর যে কোন যামানায় উম্মতে মুহাম্মাদীর ওলামায়ে দ্বীনের এই মর্মে ঐকমত্য পোষণ করা যে, এই মাসআলার বিধান এরূপ এরূপ হবে। তবে এই ইজমা অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল হতে হবে।
এই ইজমার অর্থ হল ইহাই যে, উম্মতের ওলামায়ে দ্বীন দলীল থেকে শরঈ বিধান বুঝতে যেয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন (অর্থাৎঃ সকলেই সংশ্লিষ্ট দলীলের নির্দিষ্ট একটি অর্থই বুঝেছেন। সে বিষয়ে তাদের কেউই দ্বিমত পোষণ করেননি)।
৪-আল্‌ ক্বিয়াসঃ ইহা হল কোন ঘটনাকে এমন কোন ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেওয়া যার শরঈ বিধান আল্লাহ্‌র কিতাব বা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছের দলীলের ভিত্তিতে সুসাব্যস্ত হয়েছে। এবং তা করা হয় এমন একটি কারণের জন্য যা উভয় ঘটনাতেই বিদ্যমান। এর সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছেঃ
ক্বিয়াস হল কোন শাখাগত বিধানকে মূলের সাথে মিলিয়ে দেওয়া এমন একটি কারণ থাকার জন্য যা উভয়ের মাঝেই বিদ্যমান। যেমনঃ ‘মুখাদ্দারাত’ তথা হিরোইনকে হারাম করা মদ্যপান হারাম করার উপর কিয়াস করা হয়েছে, আর এর কারণ হল বেহুঁশ হয়ে যাওয়া-চেতনা হারিয়ে ফেলা (যা উভয়ের মাঝেই সমানভাবে বিদ্যমান, বরং হিরোইনে আরও বেশী রয়েছে।
৫-এছাড়াও ইসলামী ফিক্বহের আরো কিছু উৎস রয়েছে। যেমনঃ ইস্তিহ্‌সান (দলীল নীরব এরকম কোন বিষয়কে ভাল মনে করে করা), মাছালীহ মুরসালাহ (উপকারী বস্তু অথচ শরী’আতে তার পক্ষে-বিপক্ষে কোনই আলোচনা আসেনি)্‌, সাদ্দুয্‌ যারায়ে’ (পাপের বা গর্হিত কাজের দিকে নিয়ে যায় বা তা করার অসীলায় পরিণত হয় এরকম বৈধ কোন বস্তু না করা উক্ত গর্হিত কাজের পথ বন্ধ করার নিয়্যতে)’, ছাহাবীর উক্তি, উরফ (শরী’আত বিরোধী নয় এমন দেশাচর) এবং মদীনাবাসীদের আমল।
القواعد الفقهية
কতিপয় ফিক্বহী নীতিমালা
প্রথমতঃ الأمور بمقاصدها
‘আল উমূরু বিমাক্বাছিদিহা’ তথা ‘সকল বস্তু তার নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল।’
এই ক্বায়দার দলীল হল-নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ)[أخرجه الستة..]
‘সমস্ত আমলই নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল’
প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদীছ গ্রন্থের গ্রন্থকারগণ এটিকে সংকলন করেছেন। দ্রঃ বুখারী, অহির সূচনা অধ্যায়, হা/১, মুসলিম, ইমারত-নেতৃত্ব অধ্যায়, হা/১৯০৭, আবুদাউদ, ত্বালাক অধ্যায়, হা/২২০১, তিরমিযী, জিহাদের ফযীলত অধ্যায়, হা/১৬৪৭, নাসায়ী, পবিত্রতা অধ্যায়, হা/৭৫, ইবনু মাজাহ্‌, যুহ্‌দ-দুনিয়া বিমূখতা অধ্যায়, হা/৪২২৭)।
উদাহরণঃ
১- যে ব্যক্তি সাধারণভাবে হালাল এমন কোন কাজ করল এই উদ্দেশ্যে যে, সে ইহা দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতা নেবে-তাহলে এমন ব্যক্তি সৎ নিয়্যতের কারণে নেকী পাবে।
২- যে ব্যক্তি অন্য কাউকে অন্যায়ভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে তার বিধান একটা আর ভুলবশতঃতা যদি করে থাকে অর্থাৎ ভুলক্রমে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার দ্বারা মানুষ মারা যায় তার বিধান আরেকটা হবে। কারণ মূল ভিত্তিই হল নিয়্যত।
৩-
দ্বিতীয়তঃ’আল ইয়াক্বীনু লা ইয়াযূলু বিশ্‌ শাক্কি’-দৃঢ়তা সন্দেহ দ্বারা দূরীভুত হয় না।
এই ক্বায়েদার দলীলাদিঃ
(وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنّاً إِنَّ الظَّنَّ لا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئاً)[يونس:৩৬]
‘তাদের অধিকাংশই ধারণার অনুসরণ করছে, আর ধারণা হক বিষয়ে মোটেই ফলপ্রসূ নয়। (ইউনুসঃ৩৬)
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ্‌ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(إِذَا شَكَّ أَحَدُكُمْ فِى صَلاَتِهِ فَلَمْ يَدْرِ كَمْ صَلَّى ثَلاَثًا أَمْ أَرْبَعًا فَلْيَطْرَحِ الشَّكَّ وَلْيَبْنِ عَلَى مَا اسْتَيْقَنَ)[رواه مسلم، كتاب المساجد، باب السهو في الصلاة، والسجود له، حديث رقم(৭২১)].
‘যদি তোমাদের কেউ নিজ ছালাতে এমনভাবে সন্দেহে পতিত হয় যে সে জানে না কত রাক’আত ছালাত আদায় করেছে, তিন না চার? তাহলে সে যেন সন্দেহ ফেলে দিয়ে যাতে তার দৃঢ় বিশ্বাস আছে তারই উপর (নিজ ছালাতের) ভিত্তি করে। (মুসলিম,মসজিদ সমূহ অধ্যায়, হা/৫৭১)
উদাহরণঃ
১-যদি কোন ব্যক্তির যিম্মায় ঋণ থাকে অতঃপর সে সন্দেহ করে যে সে ঋণ পরিশোধ করেছে কি না, তাহলে সে ইয়াক্বীন তথা দৃঢ় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করবে। আর তাহল ঋণ তার যিম্মায় অবশিষ্ট থাকা এবং তা আদায় না করা। অতএব, তাকে এমতাবস্থায় ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। তবে ঋণ দাতা যদি প্রাপ্তি স্বীকার করে তাহলে আর পরিশোধ করা লাগবে না।
২-যদি কোন ব্যক্তি এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাসী হয় যে সে উযূ করেছে, এর পর সন্দেহে পড়ে তার উযূ ভেঙ্গে গেছে কি যায়নি? তাহলে যে বিষয়ে তার দৃঢ়তা রয়েছে তারই উপর ভিত্তি করবে; আর তাহল পবিত্রতার অবশিষ্টতা। অতএব সন্দেহ তথা উযূ ভঙ্গের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করবে। অনুরূভাবে এর বিপরীত বিষয়টিও (তথা কারও উযূ না করার কথা নিশ্চিতভাবে মনে থাকার পর যদি তার সন্দেহ হয় সে উযূ করেছে কি না? তাহলে অবশ্যই সে সন্দেহ ফেলে দিয়ে নিঃসন্দেহ বিষয়ের উপর ভিত্তি করবে; আর তা হল নিজেকে উযূহীন মনে করা। অতএব, অবশ্যই সে উযূ করে ছালাত আদায় করবে।
এই ক্বায়দার আলোকে শাখাগত ক্বায়দা এসে যায়, তাহলঃ
(الأصل بقاء ما كان على ما كان)
অর্থঃ ‘আসল হল, যেটা যে অবস্থায় ছিল সেটা সে অবস্থাতেই থাকবে’ এই ক্বায়েদা মূলত আরেকটি ক্বায়দার প্রতিধ্বনি, তাহলঃ
‘যে বিষয়টি অতীত যামানা থেকে সাব্যস্ত সেটা অবশিষ্ট আছে বলেই ফায়ছালা দিতে হবে যেযাবৎ এর বিপরীত দলীল না পাওয়া যায়। এই ক্বায়দার অর্থ হলঃ যে বিষয়টি নির্দিষ্ট কোন অবস্থায় অতীত যামানায় সাব্যস্ত হয়েছে, তা ইতিবাচক বিষয় হোক বা নেতিবাচক হোক- তাহলে সেটি তার পূর্বের অবস্থাতেই বাকী থাকবে, পরিবর্তিত হবে না যেযাবৎ পরিবর্তনকারী দলীল না পাওয়া যাবে।
মূল ক্বায়দা তথা ‘আল ইয়াক্বীনু লা ইয়াযূলু বিশ্‌ শাক্‌কি’-দৃঢ়তা সন্দেহ দ্বারা দূরীভুত হয় না-এর দলীল গুলিই হল এই আলোচ্য ক্বায়দার দলীল।
উদাহরণঃ
যে ব্যক্তি নিখোঁজ, যার সম্পর্কে কোন খবর পাওয়া যায় না, সে মরেছে কি জীবিত রয়েছে তাও জানা যায় না। এমতাবস্থায় সে জীবিত আছে বলেই ফায়ছালা দিতে হবে। কারণ এ ক্ষেত্রে মূল হলঃ জীবিত অবস্থায় থাকা।
তৃতীয়তঃ’আল্‌ মাশাক্কাতু তাজলিবুত্‌ তায়সীর’-কঠিনতা সহজতা টেনে আনে।’
এই ক্বায়দার দলীলাদিঃ
মহান আল্লাহর বাণীঃ
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ[البقرة:১৮৫]
‘আল্লাহ্‌ তোমাদের সহজ চান, কঠিনতা চান না। (আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ ১৮৫)
মহান আল্লাহ্‌র আরেকটি বাণীঃ
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ[الحج:৭৮]
‘আর তিনি (আল্লাহ্‌) তোমাদের জন্য ধর্মে কোন প্রকার সংকীর্ণতা রাখেননি।’ (আল্‌ হজ্জঃ৭৮)
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেনঃ
(مَا خُيِّرَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- بَيْنَ أَمْرَيْنِ إِلاَّ اخْتَارَ أَيْسَرَهُمَا مَا لَمْ يَكُنْ إِثْمًا)[متفق عليه:البخاري، كتاب المناقب، باب صفة النبي صلى الله عليه وسلم، (২৩)، حديث رقم (৩৫৬০)، ومسلم، كتاب الفضائل، باب مباعدته-صلى الله عليه وسلم-للآثام…(২০) حديث رقم (২৩২৭)].
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যে কোন দুটি বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হলে তিনি তুলনামূলক যেটি সহজ সেটিই নির্বাচরণ করতেন যদি তা কোন পাপের কাজ না হত। (মুত্তাফাকুন আলাইহিঃ বুখারী, জীবনী অধ্যায়, হা/৩৫৬০, মুসলিম, ছাহাবীদের ফযীলত অধ্যায়, হা/২৩২৭)
উদাহরণ সমূহঃ
১-মুসাফিরের প্রত্যেক ছালাতের জন্য পথচলা বিরতী দেওয়া এবং পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যেক ছালাত যথা সময়ে আদায় করা কষ্টকর হলে তার জন্য শরী’আতে দুই ছালাত একত্রে পড়ার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সহজ করা হয়েছে। যেমন যোহরের সাথে আছর, অনুরূপভাবে মাগরিবের সাথে এশা, চাই তা তরাম্বিত জমা হোক বা বিলম্বিত জমা হোক -এরূপ জমা করার মাধ্যমে মুসাফিরের উপর সহজতা করা হয়েছে।
২- কোন ব্যক্তির দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা কষ্টকর হলে, সে ক্ষেত্রে তার প্রতি সহজ করা হয়েছে। অতএব সে বসে বসে ছালাত আদায় করবে।…
চতুর্থতঃ
(الضرورات تبيح المحظرات)
‘আয্‌ যরূরা-তু তুবীহুল মাহযূরা-ত’ অর্থাৎঃ ‘একান্ত নিরূপায় অবস্থা হারামকে হালাল করে দেয়।’
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلا عَادٍ فَلا إِثْمَ عَلَيْهِ[البقرة:১৭৩]
‘অবশ্য যে ব্যক্তি (এসব অবৈধ খাদ্যের প্রতি) অনোন্যপায় হয়ে পড়ে এবং নাফারমানকারী ও সীমালংঘণকারী না হয় তাহলে তার উপর কোন পাপ বর্তাবে না।’
উদাহরণঃ
যদি কোন ব্যক্তি মৃত্যুর আশংকায় বাধ্য হয়ে কোন হারাম বস্তু ভক্ষণ করে, তাহলে এরূপ ভক্ষণ তার জন্য শুধু জায়েযই নয় বরং মৃত্যুর আশংকায় তার উপর এরূপ খাদ্য গ্রহণ করা অধিকাংশ ওলামায়ে দ্বীনের নিকট ওয়াজেব।
পঞ্চমতঃ
(لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ…أو قاعدة: الضَّرَرُ يُزَالُ)
‘লা যরারা ওয়ালা যিরা-রা। আও ক্বায়িদাতুঃ আয্‌যরারু য়ূযা-লু’
অর্থাৎঃ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না আর কোন ক্ষতি করা যাবে না।’
অথবা আরেকটি মূলনীতিঃ ‘ক্ষতি অপসারণ করতে হবে।’
(প্রথমটি নবীর হাদীছঃ এটি মুস্তাদ্‌রাকুল হাকিম, মুওয়াত্ত্বা মালিক মুরসালভাবে- ফায়ছালা অধ্যায়, হা/৩১, মুসনাদ আহমাদ প্রভৃতি গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। হাদীছটি হাসান)
এই ক্বায়িদাহ্‌ এর উদাহরণঃ
যদি কারও ঘরের জানালা নিজ প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় তাহলে অবশ্যই উক্ত জানালা বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে এই ক্ষতি অপসারণ করতে হবে।
অথবা তার বাড়ীর গাছ-পালা নিজ প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, অথবা তার যমীন বা বাড়ী মানুষের মানুষের চলার রাস্তা-ঘাট নষ্ট করে তাহলে এসব কিছু অবশ্যই দূরীভূত করতে হবে।
ষষ্ঠতঃ
(درء المفاسد مقدم على جلب المصالح)
‘দারউল মাফাসিদি মুক্বাদ্দামুন আলা জাল্‌বিল মাছালিহি’
অর্থাৎঃ ফাসাদ-অপকার প্রতিহত করা উপকার আনয়নের উপর প্রাধান্য প্রাপ্ত।’
মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(وَلا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْواً بِغَيْرِ عِلْمٍ)[الأنعام:১০৮]
আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত।
(আল্‌ আনআমঃ১০৮)
উদাহরণঃ
১-হারাম যন্ত্র-পাতি প্রবেশ করানো নিষিদ্ধ করতে হবে অপকারের ক্ষতির আশংকায়; যদিও তাতে কিছু উপকার নিহিত থাকে।
২-যদি কোন মহিলার উপর গোসল ওয়াজিব হয়ে থাকে। অথচ পুরুষ থেকে পরদা করার মত কিছু না পায়, তাহলে সে অবশ্যই গোসল বিলম্বিত করবে। কারণ মহিলার নগ্ন হওয়া একটি বিপর্যয়, আর গোসল করা হল উপকারী বস্তু। অতএব অপকার-বিপর্যয় প্রতিহত করাই ওয়াজিব।
সপ্তমতঃ
(الْأَصْلُ فِيْ الْأَشْيَاءِ الحْـِلُّ وَالْإِبَاحَةُ )
‘আল্‌ আছলু ফিল্‌ আশইয়ায়ি আল্‌ হিল্লু ওয়াল্‌ ইবাহাতু’।
অর্থাঃ ‘বৈষয়িক সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে আসল হল ইহাই যে তা হালাল এবং বৈধ।’
এই আসল তথা মূল নীতির প্রমাণ হল:
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعاً[البقرة:২৯]
তিনি সেই সত্তা যিনি যমীনের বুকে যা কিছু আছে তার সব টুকুই তোমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। (আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ২৯)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ [الأعراف:৩২]
আপনি বলুন, আল্লাহর সাজ-সজ্জা-যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্য বস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে? (আল্‌ আরাফঃ৩২)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
قُلْ لا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّماً عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَماً مَسْفُوحاً أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقاً أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ [الأنعام:১৪৫].
‘আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান অহির মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তম্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাইনা কোন ভক্ষণকারীর জন্যে যা সে ভক্ষণ করে। কিন্তু মৃত, অথবা প্রবাহিত রক্ত, অথবা শুকরের গোস্ত-এটা অপবিত্র অথবা অবৈধ যবেহ করা জন্,্তু যা আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়।’ (আল্‌ আন’আমঃ১৪৫)
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
مَا أَحَلَّ اللَّهُ[ فِى كِتَابِهِ] فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ اللهُ فَهُو حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَفُوٌّ، فَاقْبَلُوا مِنَ اللَّهِ عَافِيَتَهُ فَإِنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُنْ لِيَنْسَى شَيْئًا[أخرجه الطبراني والبزار وسنده حسن، وقال عنه الحاكم صحيح الإسناد]
আল্লাহ যা (তাঁর কিতাবে) হালাল করেছেন তাই হালাল আর যা আল্লাহ্‌ হারাম করেছেন তাই হারাম। আর যা থেকে তিনি নীরবতা পালন করেছেন তা মাফ। অতএব তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নিরাপত্তা গ্রহণ কর। কারণ আল্লাহ্‌ কোন কিছুই ভুলতে পারেন না। (তাবারানী, বাযযার প্রভৃতি, সনদ হাসান। ইমাম হাকিম বলেনঃ হাদীছটির সনদ ছহীহ। দ্রঃ ২/৩৭৫, হাফেয যাহাবী তাঁর সমর্থন করেছেন, তবে মুহাদ্দিছ আলবানী এটিকে শুধু হাসান বলে আখ্যা দিয়েছেন। দ্রঃ আলবানীর ‘সিলসিলাতুল আহাদীছ্‌ আছ ছহীহাহ্‌, ৫/৩২৫, হা/২২৫৬, গায়াতুল মারাম,হা/২)।
অতএব এ সমস্ত আয়াত এবং হাদীছ এমর্মে প্রমাণ বহন করে যে (বৈষয়িক বিষয়ে) আসল হল হালাল হওয়া। হারাম করণের বিষয়টি বিশেষ স্বতন্ত্রতা যা দলীল – প্রমাণ ছাড়া সাব্যস্ত করা যাবে না।
উদাহরণঃ
এই যামানায় যত কিছু আত্ম প্রকাশ করেছে যেমন যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ। এক্ষেত্রে সেগুলি হারাম হালালকারী কোন খাছ দলীল শরী’আতে আসেনি যেমন ফোন করার যন্ত্র-পাতি (মোবাইল, টেলিফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি)। এ ক্ষেত্রে আসল ইহাই যে এগুলি হালাল ও বৈধ।
(أسس التشريع الإسلامي)
‘ইসলামী শরী’আতের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
১-কষ্টকর ও দুঃসাধ্য বিধান এতে নেই। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ [الحج:৭৮]
‘আর আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর ধর্মে কোনরূপ সংকীর্ণতা- কষ্ট আরোপ করেননি। (হজ্জঃ ৭৮)
২-শরী’আত প্রবর্তনে ধীর-স্থিরতা অবলম্বনঃ
যেমন মদ্য পান হারাম করণের বিষয়টি (এটি একবারে হারাম না করে কয়েকটি ধাপে হারাম করা হয়েছে)।
৩-এই শরী’আতের বিধি-বিধানে কষ্ট কম রয়েছে। মহান আল্লাহ্‌ আমাদেরকে যে দু’আ করতে শিখিয়েছেন তার অংশ বিশেষে :
وَلا تُحَمِّلْنَا مَا لا طَاقَةَ لَنَا بِهِ[ البقرة:২৮৬]
‘আর (হে আমাদের প্রতিপালক!) আমাদের উপর এমন বোঝ চাপিয়ে দিয়েন না যা বহনে আমাদের ক্ষমতা নেই।'(আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ২৮৬)
ফিক্বহের সুপ্রসিদ্ধ আলেমগণ
ফিক্বহের জ্ঞান সম্পন্ন এমন অনেক বড় বড় ওলামা রয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা গণনা করা সম্ভব নয়। ছাহাবায়ে কেরাম ও বিজ্ঞ তাবেঈগণের পর পরই চারটি মাযহাবের ইমামগণ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হয়ে চিরকাল থাকবেন। তাঁরা হলেনঃ
১-আবু হানীফা (রহ.) : নু’মান বিন ছাবিত বিন যূত্বা। তিনি ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৫০ হিজরীতে।
২-মালিক বিন আনাস বিন মালিক আল্‌ আছবাহী (রহ.) ইনি ৯৩ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু বরণ করেন ১৭৯ হিজরীতে।
৩-মুহাম্মাদ বিন ইদরীস্‌ আশ্‌শাফেঈ (রহ.)। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৫০ হিজরীতে এবং মৃত্যু বরণ করেন ২০৪ হিজরীতে।
৪-আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হান্বাল আশ্‌ শায়বানী (রহ.)। তিনি ১৬৪ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু বরণ করেন ২৪১ হিজরীতে।
الخاتمة
উপ সংহার
পরিশেষে আমি ঐসমস্ত দ্বীনী ভাইদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যাঁরা আমার সাথে অংশ গ্রহণ করেছেন -বিভিন্ন বিষয় ও শরঈ ইলম সম্বলিত এই নোট বুক টি’র সম্পাদনার ক্ষেত্রে। বিশেষভাবে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি আমার শাইখ আব্দুর রহমান আল মাহমূদ এর প্রতি এবং আমার ভাই মুহাম্মাদ খুযায়র, আমার ভাই ডঃ খালিদ আল্‌ ক্বাসিম, আমার ভাই ডঃ আব্দুল্লাহ্‌ আল্‌ বাররাক, আমার ভাই মুফলিহ্‌ বিন আলী আশ্‌শাম্মারী, আমার ভাই শাইখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আন্‌ নামলাহ্‌, আমার ভাই ঈমাদ বাকরী, আমার ভাই মুহাম্মাদ আল হাবদান, আমার ভাই উসতাদ আব্দুল আযীয আল্‌ খারাশী, আমার ভাই শাইখ মুহাম্মাদ আল্‌ আক্বীদ। আমার ভাই শাইখ ছালেহ্‌ আব্দুল্লাহ্‌ আল্‌ উছায়মী, আমার ভাই শাইখ আব্দুল আযীয আত্‌ তুওয়ায়জিরী -প্রমুখের প্রতি। এবং অন্যান্য সকল ব্যক্তির শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যাঁরা আমার সাথে অংশ নিয়েছেন সুচিন্তিত মতামত দিয়ে।
এই বইয়ে যা সঠিক হয়েছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর যা ভুল হয়েছে তা নিজের এবং শয়তানের পক্ষ থেকে। আমি আল্লাহর কাছে ইহাই চাচ্ছি যেন তিনি আমার গুনাহ মাফ করেন, এবং আমাকে ও আমার মুসলিম ভাইদেরকে শয়তান থেকে আশ্রয় দান করেন। আমি আরোও কামনা করছি আমার সম্মানিত ভাই তথা এই নোট বইয়ের পাঠকের নিকট যে, তিনি আমার জন্য মতামত, উপদেশ, দু’আ প্রভৃতির বিষয়ে কার্পণ্যতা করবেন না।
إن تجد عيباً فسد الخللا فجل من لا عيب فيه ولا خللا
‘কোন দোষ-ত্রুটি পেলে যেখানে ত্রুটি তা ঠিক করে দিন।
সেই সত্তাই তো মহান যার মাঝে কোন দোষ নেই, ত্রুটি নেই।
সুতরাং যে ব্যক্তি কোন প্রকার ভুল, ত্রুটি, কমতি, বর্ধিত দেখবেন তিনি যেন তাঁর ভাইকে সে বিষয়ে সতর্ক করতে কার্পণ্যতা প্রদর্শন না করেন। তা টেলিফোন যোগাযোগের ভিত্তিতে হোক বা পোষ্টকৃত পত্রের মাধ্যমে হোক অথবা যেভাবে সম্ভব।
(والسلام عليكم ورحمة الله و بركاته)
আপনাদের সকলের প্রতি সালাম, আল্লাহর রহমত এবং তাঁর বরকত নাযিল হোক।
ছালেহ্‌ বিন মুক্ববিল আল্‌ উছায়মী, আত্‌ তামীমী
পোঃবক্স নংঃ ১২০৯৬৯,আর রিয়াদঃ১১৬৮৯
মোবাইলঃ০০৫৫৪২৮৯৬০
সমাপ্ত
_________________________________________________________________________________
[১] সম্ভবত সর্বাধিক বিশুদ্ধ কথা হল,এখানে (من) টি (التبيين) তথা বর্ণনা দেওয়ার জন্য এসেছে যা ব্যাপকতার ফায়েদা দিয়ে থাকে (আল্‌ মাহমূদ)।
[২] মুসাফিরের কিছু কিছু অবস্থায় ছালাত আগে পিছে করা বৈধ রয়েছে। অনুরূপভাবে ছিয়াম বিলম্বিত করা বৈধ। তদ্রূপ যাকাত নির্দিষ্ট কিছু অবস্থায়-যা এখানে ব্যখ্যা করার অবকাশ নেই-বৈধ রয়েছে।
[৩] এ কথাটি ইমাম শাফেঈ থেকে বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ এ কথাটির মাঝেও নিজের আত্ম প্রশংসা ফুটে উঠে যা সাধারণত ইমাম শাফেঈর মত পন্ডিতের জন্য শোভা পায় না -অনুবাদক।
[৪]ইহা সত্ত্বেও যে তিনি ইখতেলাফী মাসায়েলে তাঁর নিকট যা বেশী প্রধান্যযোগ্য তাই বলবেন। কারণ দলীল যা প্রমাণ করে তারই অনুসরণ করা ওয়াজিব। আর ইখতিলাফ বিদ্যমান থাকার অর্থ এই নয় যে, একজন ব্যক্তি বিভিন্ন মাযহাব-মতামত হতে যা ইচ্ছা বা যা মনে ভাল লাগে তাই বেছে নেওয়ার তাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে (আল্‌ মাহমূদ)।
[৫] অবশ্য একথাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে,ইহার অর্থ এমন নয় যা কেউ কেউ ধারণা করে বসেছে-যে সর্ব প্রথম আক্বীদাহ্‌ দিয়ে শুরূ করতে হবে এবং বাকী সব কিছু পরিত্যাগ করে দিতে হবে। এর পর শরঈ আহকাম তথা ছালাত,ছিয়াম,যাকাত,ছওম,হারামকৃত বস্তু গুলির হারাম করণ যেমন যেনা-ব্যভিচার,মদ্যপান প্রভৃতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। এমন ধারণা করা নিতান্তই ভুল। কারণ এই ইসলাম ধর্ম পরিপূর্ণ। যারা ছালাত ও যাকাতে পার্থক্য করতে চেয়ে ছিল তাদের বিরুদ্ধে আবু বাকর (রাঃ)যুদ্ধ করেছিলেন। কাফের ইসলাম কবুল করলে আমরা তাকে ছালাতের তা’লীম দিব এবং ছালাত আদায় করার নির্দেশ করব। তাকে হালাল হারাম বাতলিয়ে দিব। এজন্যই আমি বলছি,দাড়ি মুন্ডনকারী ছালাত ত্যাগকারীকে আগে ছালাতের বিষয়ে তাকীদ দেওয়া ভাল তবে এর অর্থ এমন নয় যে তাকে দাড়ি বিষয়ে সতর্ক করা যাবে না,দাড়ি বাড়ানোর (ছেড়ে রাখার) দাওয়াত দেওয়া যাবে না। এভাবে বাকী সমস্ত বিষয়… (আল্‌ মাহমূদ)।
[৬] অবশ্য এর অর্থ এমন নয় যে,অন্যান্য সকল উপকারী ইলমের প্রয়োজন নেই। বরং উম্মতের প্রয়োজন হেতু তাও কাম্য। এই ইলমের অধিকারীগণ এর ছওয়াবেরও অধিকারী হবেন যদি তাদের উক্ত ইলম ও আমলে সৎ নিয়্যত,তার মুসলিম উম্মতের খিদমত এবং তাদের কাফের শত্রু থেকে তাদেরকে বেনিয়ায করণ উদ্দেশ্য জড়িত হয়ে থাকে (আল্‌ মাহমূদ)।
[৭] এর পর লেখক উমার ইবনুল খাত্তাবের একটি যঈফ আছার উল্লেখ করেছিলেন,তা যঈফ হওয়ার জন্যই অনুবাদ করিনি।
[৮] মসজিদে নববীর একটি বিশেষ উঁচু জাগাকে ‘ছুফ্‌ফা’ বলা হয় যেখানে পরিবারহীন মিসকীন মুহাজির ছাহাবীগণ থাকতেন, তাঁরা আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শিক্ষা লাভ করতেন এবং অন্যান্য ছাহাবীদের দান-ছাদকার উপর তাদের জীবিকা নির্ভর করত। জায়গাটি এখনও তুলনামূলক উঁচু করে রাখা হয়েছে-অনুবাদক।
[৯] আল ফাতাওয়াল হাদীছিয়্যাহ। আমি বলছিঃ এই মাসআলায় আলেমদের মতবিরোধ রয়েছে। যে এ বিষয়ে আরো অধিক অবগত হতে চায় সে যারকাশী প্রণীত ‘আল্‌ বুরহান ফী ঊলূমিল কুরআন ১/৪৬১, ইমাম নববীর ‘আল্‌ আযকার’ প্রভৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন করুক।
[১০]যে এ বিষয়ে আরো অধিক অবগত হতে চায় সে যেন নববী রহিমাহুল্লাহ্‌ প্রণীত ‘আত্‌তিবয়ান ফী-আদাবি হামালাতিল কুরআন’এবং শাইখ মুহাম্মাদ দাবেশ হাফিযাহুল্লাহ্‌ প্রণীত ‘হিফযুল কুরআনিল কারীম’ নামক বই দু’খানা অধ্যায়ন করতে পারেন।
[১১] তাদের কিতাব গুলি দুই ভাগে বিভক্তঃ
১-আল আহদুল ক্বাদীম-তথা পুরাতন যুগঃ
তারা-ইহুদীরা-দাবী করে থাকে যে এসব কিতাব ঈসার পূর্বে যারা নবী ছিলেন তাঁদের মাধ্যমে তাদের নিকট পৌঁছেছে। আর এই আহদে ক্বাদীম-তথা পুরাতন যুগ বলতে মূসা (আলাইহিস্‌ সালাম) এর পাঁচটি আসফার তথা ছহীফা গণ্য (সেগুলি হলঃ সিফরুত্‌ তাকভীন, সিফরুল খুরূজ, সিফরুল আদাদ, সিফরুল্‌ লাদিইয়ীন, সিফরুত্‌ তাছনিয়াহ্‌) এই পাঁচটি কিতাবের সমিিষ্টর নাম হল ‘তাওরাত’।
২-আল্‌ আহদুল জাদীদ-তথা নতুন যুগঃ
খৃষ্টানরা -দাবী করে থাকে এই কিতাব গুলি ইলহাম দ্বারা ‘মাসীহ ঈসা’ এর আকাশে উত্তোলনের পর তার রাসূল-তথা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে লেখা হয়। আর এটা চারটি ইঞ্জিলকে শামিল করে থাকে (ইঞ্জিল গুলি হলঃ ইঞ্জিলে মাত্‌তা, ইঞ্জিলে লোক্বা, ইঞ্জিলে ইউহান্না, ইঞ্জিলে মরকোস)। ইঞ্জিলের অর্থ হলঃ সুসংবাদ দেওয়া, শিক্ষা দেওয়া।
এই চারটি ইঞ্জিল গীর্জা -তথা গীর্জার নেতৃস্থানীয়গণ সেকালীন উপস্থিত ৭০ টি ইঞ্জিলের মধ্য থেকে চয়ন করেছে। ইহা ছিল ঈসা আলাইহিস্‌ সালামকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়ার অনেক অনেক দিন পরের ঘটনা। এই দুই আহদের কোন একটি সিফর-তথা কিতাবের অবিচ্ছিন্ন সূত্র পাওয়া যায় না।
এসব কিতাবাদির বিধানঃ
১-কুরআন কারীম ইহুদ ও খৃষ্টানদের কিতাব বিকৃতির দিকে ইঙ্গিত করেছে। এবং এই মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছে যে তাদের কিতাবে উল্লেখিত হওয়া অনেক বিষয়কে তারা গোপন করে দিয়েছে। তদ্রূপ এ দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছে যে তাদের মধ্য হতে কিছু লোক নিজে কিতাব লিখে মহান আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করত (বলতঃ ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে)। অনুরূপভাবে তাদের মধ্য থেকে আরও কিছু লোক এমন রয়েছে, যাদেরকে যা দ্বারা ওয়ায-উপদেশ দেওয়া হয়েছে তার বিশেষ একটি অংশ (দুনিয়ার মোহে পড়ে) ভুলে গেছে।
এসব কিতাবাদির বাস্তব অবস্থা এই মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, এই কিতাবগুলো বিকৃত করা হয়েছে। আমরা তাদের ‘আহদে ক্বাদীম’ ও ‘আহদে জাদীদ’ তথা পুরাতন ও নতুন যুগের কিতাবাদির বিকৃতির কিছু উদাহরণ পেশ করবঃ
ক) তাদের কিতাব সমূহে মতবিরোধ ও ভুল-ভ্রান্তি বিদ্যমান থাকাঃ যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে সিফরুত্‌ তাকবীনের এ স্থানে এসেছে যে আল্লাহ্‌ নূহ (আলাইহিস্‌ সালাম) কে তাঁর নৌকায় প্রত্যেক জোড়া থেকে দুটি করে নিতে বলেছেন। অথচ আরেক স্থানে এসেছেঃ ‘তুমি তোমার সাথে সাতজন সাত জন করে নেবে’!
খ) ঐসব কিতাবাদির মধ্যে এমন এমন গুণ দ্বারা আল্লাহকে গুনাম্বিত করা যার তাঁর শানে মোটেও প্রযোজ্য নয়ঃ
যেমনঃ (তাদের এসব কিতাবে পাওয়া যায়) ‘আল্লাহ্‌ আসমান-কে ছয় দিনে সৃষ্টি করার পর ষষ্ঠ দিনের দিন আরাম (বিরতি) করে ছিলেন’
যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘আদম কে ভালমন্দ পরিচয় এর বৃক্ষ থেকে খেতে নিষেধ করা হয়েছিল যাতে তিনি মৃত্যু বরণ না করেন। এবং তিনি তা ভক্ষণ করার পর লুকিয়ে গিয়ে ছিলেন ফলে আল্লাহ্‌ তাকে ডাকতে শুরূ করে ছিলেনঃ কোথায় তুমি?
গ- তাদের পক্ষ থেকে নবীদের প্রতি দোষারোপ তথা -কালিমা লেপন করাঃ
যেমন (এসব বাজে কথা বলা যে) লূত (আলাইহিস্‌ সালাম) এর দুই মেয়ে তাদের পিতার সাথে শয়ন করার সুযোগ গ্রহণ উপলক্ষে তাকে মদ্য পান করিয়ে ছিলেন।’
-হারূন (আলাইহিস্‌ সালাম) ই নাকি ঐবাছুরটি তৈরী করে ছিলেন।
-সুলাইমান (আলাইহিস্‌ সালাম) নাকি তাঁর জীবনের সমাপ্তি করে ছিলেন মূর্তি পূজার মাধ্যমে।
তাদের আহদে জাদীদ তথা নতুন যুগের কিতাবাদির বিকৃতিঃ
-চারটি ইঞ্জিলের উপস্থিতি অথচ ঈসা (আলাইহিস্‌ সালাম) এর উপর নাযিল কৃত ইঞ্জিল হল মাত্র একটি।
-৭০টি ইঞ্জিলের মধ্য হতে চারটি ইঞ্জিল চয়ন করা। অথচ এসব ইঞ্জিল মাসীহ (আলাইহিস্‌ সালাম) লিখে যাননি। এবং এমর্মে তাকে অহিও করা হয়নি। বরং এসবকটি ইঞ্জিলই ঈসা (আলাইহিস্‌ সালাম) এর পরবর্তীতে লিখিত হয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু কথা পাওয়া যায় যার মিথ্যা ও বিকৃত হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কারণ তা কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন মাসীহ (আঃ) কে শূলে চড়ানো ও তাঁর মৃত্যু বরণ করার বিষয়টি (এটি সম্পূর্ণরূপে কুরআন বিরোধী। আল কুরআনে ঈসা এর শূলে চড়ানো এবং মৃত্যু বরণ করার বিষয়টি কঠিনভাবে নাকচ করা হয়েছে )।
-তাদের কিতাবাদি ইতিহাস বিকৃতি,সংযোজন,বিয়োজন প্রভৃতি দ্বারা ভরপুর। এগুলো সবই তাদের হাতের কারসাজি। এভাবেই মাসীহ (আলাইহিস্‌ সালাম) এর রেখে যাওয়া ধর্ম আজ দার্শনিক ও মূির্ত পূজারীদের ধর্মের সমষ্টিতে পরিণত হয়েছে। তারা জাতিকে মূর্তি পূজা থেকে ফটো পূজার দিকে স্থানান্তরিত করেছে। এরপর হালাল করে নিয়েছে শুকর ভক্ষণ করা, শনিবারকেও তারা হালাল করে নিয়েছে। আর খৃষ্টীয় বড় বড় প্রতিষ্ঠান খৃষ্টানদের ধর্ম নিয়ে খেল-তামাশায় মত্ত হয়েছে। যেমনঃ তাদের পক্ষ থেকে ঈসা (আলাইহিস্‌ সালাম) কে ইলাহ-উপাস্য সাব্যস্ত করণ, এবং তাদের মতের বিরোধী অন্যান্য কিতাবাদি পুড়িয়ে ফেলা স্ববিশেষ উল্লেখ যোগ্য।
-তাদের কিতবাদিতে নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আবির্ভাবের সুসংবাদের উপস্থিতি। যেমনঃ
(أقيم لهم نبياً من وسط إخوتهم مثلك)
‘আমি তােদর জন্য নবী দাঁড় করব তাদের ভাইদের মধ্য হতেই তোমার ন্যায়’
-প্রতিপালক সায়না পর্বত থেকে এসেছেন, সাঈর থেকে আমাদের জন্য দৃষ্ট হয়েছেন, আর ফারান এর পর্বত থেকে উপরে উঠেছেন।’ ফারানঃ অর্থ মক্কা।
এ বিষয়ে আরো অধিক জানার জন্য দেখুনঃ ইবনু তায়মিয়াহ্‌ প্রণীত ‘মাজমূল ফাতাওয়া’১৩/১০৪,(হাফেয ইবনু হাজার প্রণীত) ‘ফাতহুলবারী’ ১৩/৫২২, ইবনু হাযাম প্রণীত ‘আল্‌ ফিছাল’ ১/২০১,২/২৭, এবং ইবনু তায়মিয়া প্রণীত ‘আল্‌ জাওয়াবুছ্‌ ছহীহ লিমান্‌ বাদ্দালা দ্বীনাল মাসীহ্‌২/৩৯৭,৪২০,৩/৯)।
[১২] মুক্বাদ্দিমা ফী উছূলিত্‌ তাফসীর,পৃঃ২১, আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ আল্‌ উছায়মীন উক্ত মুক্বদ্দিমার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে যেয়ে এই অভিমতটিকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই মর্মে তিনি মহান আল্লাহর এই বাণী দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন-
(ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ) [القيامة:১৯]
অতঃপর আমার দায়িত্ব হল ইহা বর্ণনা করে দেওয়া-তথা তাফসীর করে দেওয়া (আল্‌ ক্বিয়ামাহঃ ১৯ ) -শারহুল মুক্বাদ্দিমাহ্‌,পৃঃ২১)। অবশ্য এ মাসআলায় আলেমদের মাঝে মতবিরোধ আছে যার এখানে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দেওয়ার অবকাশ নেই। আর আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞানী।
[১৩] আরো অধিক জানার জন্য অধ্যায়ন করুনঃ ফযীলাতুশ্‌ শাইখ আব্দুর রহমান বিন ছালিহ্‌ আল্‌ মাহমূদ -হাফিযাহুল্লাহ-প্রণীত গ্রন্থ ‘মাছদারুত্‌ তালাক্কী ইন্‌দাস্‌ সালাফ’
[১৪]এই দর্শনের ঐতিহাসিক তথ্যঃ
মহান আল্লাহ্‌ তাঁর অকাট্য গ্রন্থ -আল কুরআনে স্পষ্টভাবে এই মর্মে বলে দিয়েছেন যে, ইহুদী এবং খৃষ্টানগণ মুসলিমদেরকে তাদের ইসলাম থেকে পথভ্রষ্ট করে কুফরীর দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাদেরকে ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্মের দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সাধ্য-সাধনায় লিপ্ত।
وَقَالُوا لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ كَانَ هُوداً أَوْ نَصَارَى تِلْكَ أَمَانِيُّهُمْ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (১১১)[ البقرة]
‘তারা বলে, ইহুদী ও খৃষ্টান ব্যতীত অন্য কেউ কখনও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আপনি বলুন! তোমরা তোমাদের-একথার-দলীল দাও, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।’ (সূরা আল্‌ বাক্বারাহ্‌ঃ১১১)
মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ
وَقَالُوا كُونُوا هُوداً أَوْ نَصَارَى تَهْتَدُوا قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفاً وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (১৩৫)[البقرة]
আর তারা বলেঃ তোমরা ইহুদী অথবা খৃষ্টান হও তাহলেই সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে। আপনি বলুনঃ (কখনো নয়) বরং আমরা ইবরাহীমের ধর্মে আছি, যাতে বক্রতা নেই, আর তিনি মুশরিকদের দলভুক্ত ছিলেন না। (সূরা আল্‌ বাক্বারাহঃ১৩৫)
-চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে এই মতবাদের পথে দাওয়াত দেওয়ার স্তরঃ
এই দর্শনের দাওয়াত সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে, এবং কেবল তা এসব মতবাদ বহনকারীদের অন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। এভাবে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এটিকে ‘মাসুনিয়াহ্‌’ নামক ইহুদী সংগঠন গ্রহণ করে। এই সংগঠন এই পথে আহ্বান করে থাকে বিশ্বে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য। এবং তারা চায় সারা বিশ্বে নাস্তিক্যতা ও যেনা-ব্যভিচারের প্রসার।
এরপরও তাদের পাতানো ফাঁদে পড়ে যায় মুসলিমদের কিছু আলেম এবং বুদ্ধিজীবি এবং একটি সংগঠন কায়েম করে নাম দেন ‘জমঈয়াতুত্‌ তালীফি ওয়াত্‌ তাক্বরীব’ অর্থাৎঃ তিনটি ধর্মকে পরষ্পর জমায়েত ও নিকটবর্তী করণ।’
*আধুনিক যুগে এদিকে আহ্বান করার স্তরঃ
এই স্তরে আন্তর্জাতিক আধুনিক বিধানের ছত্র ছায়ায় ইহুদী ও নাছারাগণ তাদের ও মুসলিমদের মাঝে বিভিন্ন নামে ধর্মীয় ঐক্যের পথে প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দিতে শুরূ করেছে। যেমনঃ
‘দ্বীন সমুহকে পরষ্পর নিকটবর্তী করণের দাওয়াত’ ‘বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নৈকটত্ব,’ধর্মীয় গোঁড়ামী বর্জন,’সমগ্র ধমর্কে একক ও অভিন্ন করণ’ ইবরাহীমী ধমর্’,’ধর্ম সমূহের একত্রিত হওয়ার স্থান’ ‘দ্বীন সমূহকে কেন্দ্র করে আধুনিক বিতর্ক অনুষ্ঠান’ ইত্যাদি।
ইসলাম ও মুসলিমদের উপর ইহার কুপ্রভাবঃ
-বাধা অতিক্রম করা এবং একদিক থেকে মুসলিম সম্পর্কে তাদের ভয়ের অন্তরায়কে ভেঙ্গে ফেলা। এবং অপর দিক থেকে কাফিরদের ক্ষেত্রে মুসলিমদের ঘৃণাবোধ ভেঙ্গে ফেলা।
-খৃষ্টীয় পোপ বিশ্বের বুকে নিজেকে এইভাবে পেশ করেছেন যে, তিনিই হলেন সমস্ত ধর্মের আধ্যাত্নিক পরিচালক।
-এই মতবাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মতবাদটি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। এই মতবাদকে কেন্দ্র করে বড় বড় ইসলামী কন্‌ফারেন্স হয়েছে এবং সমিতি গঠিত হয়েছে।
-কিছু কিছু (অপরিণাম দর্শী) আলেম এসব বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে প্রভাবিত হয়েছে। এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই মিশরে ১৪১৬ হিজরীতে শারামুশ্‌ শাইখ মুতামার’ নামক কন্‌ফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয় এমন এমন গুণাবলীর উপর যা তাদের কথিত ইবরাহীমী কন্‌ফারেনস এ যোগদানকারীদের যৌথ গুণ। কোন কোন ফিৎনা গ্রস্ত ব্যক্তি এই মর্মে বিজ্ঞপ্তিও দেয় যে তারা একটি কিতাব ছেপে বের করবে যার মধ্যে সন্নিবেশিত থাকবে কুরআন কারীম, তাওরাত ও ইঞ্জীল। এদ্বারা তারা ইহুদী ও খৃষ্টানী মতবাদকে মুসলিমদের মাঝে ছড়াতে চেয়েছেন। এবং তাদের সাথে তাদের আনন্দ-ঈদ-উৎসবে শরীক হওয়ার জন্য, তাদের পদাংক অনুসরণ ও তাদের সাথে সম্পর্ক মজবূত করার জন্যই তারা অমনটি করেছেন।
এই মতবাদের শরঈ বিধানঃ
ঈমানের রুকন ও আক্বীদাহর মৌলিক বিষয়ের অন্যতম বিষয় হলঃ ঐসমস্ত কিতাবাদির উপর ঈমান স্থাপন করা যা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তাঁর নবী ও রাসূলগণের উপর নাযিল করা হয়েছে। এবং আরো বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর কিতাব’আল্‌ কুরআনুল কারীম’ সর্বশেষ নাযিলকৃত আল্লাহর কিতাব, এবং এটিই সর্বশেষে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের নিকট থেকে প্রেরিত মহাগ্রন্থ। আরও বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ইহুদীরা হল আল্লাহর অভিশপ্ত জাতি, এবং খৃষ্টানগণ হল পথভ্রস্ট জাতি। এরা সকলেই আল্লাহ্‌র সাথে কুফরী করেছে। কারণ তারা কুরআনের উপর এবং কুরআন তার পূর্বে যা রহিত করেছে তার উপর ঈমান আনেনি। এতদ্‌সত্ত্বেও তারা তাদের নিকট তাওরাত ও ইঞ্জীলের যা অবশিষ্ট রয়েছে তাদের হাতে এগুলিকে তারা আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করে থাকে অথচ সেগুলির সাথে যুক্ত করা হয়েছে অর্থ ও শব্দের বিকৃতি, পরিবর্তন, বানোয়াট ব্যাখ্যা, বরং তাতে রয়েছে আল্লাহর নবীদের উপর এমন এমন মিথ্যারোপকৃত কথা যা কারো নিকট গোপন নেই।
ফলাফল হলঃ
১-মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হল এই দর্শনের সাথে কুফরী করা। অর্থাৎ’প্রত্যেক বিকৃত ও রহিত দ্বীনকে দ্বীনে ইসলামের সাথে একাকার করা যে দ্বীন ইসলাম চির সত্য, অকাট্য এবং বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে চির সংরক্ষিত এবং যা পূর্বের সকল আসমানী কিতাবকে রহিতকারী'(এই সর্বনাশা মতবাদের সাথে কুফরী করা)। এটি তো সকলেরই জানাশুনা আক্বীদাহ্‌ – বিশ্বাস এবং ইসলামের সর্ব স্বীকৃত বিষয়।
২-এই দর্শনের দিকে দাওয়াত-আহ্বান করা হল মুনাফেক্বী, শরী’আতের বিরোধিতা এবং ফাটল সৃষ্টি করা। এবং মুসলিমদেরকে ইসলাম থেকে বহিষ্কারকারী আমল। অতএব যে এই তথা কথিত ইবরাহীমী ধর্মে পরিচালিত হল, সে ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্ম তালাশ করল (বলে গণ্য যা তার থেকে কখনই গৃহীত হবে না)
৩-দুটি সত্বা (জিন ও ইনসান) এর উপর ওয়াজিব হল এই মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করা যে, সমস্ত ও নবী ও রাসূলদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে মিল্লাত ও ধর্ম এক ও অভিন্ন ছিল তাওহীদ, নবুওত, পুনরুত্থান প্রভৃতি বিষয়ে। তবে এই আক্বীদাহ্‌গত মৌলিক বিষয়টি পরবর্তীতে একমাত্র মুসলিমগণ ব্যতীত অন্য কারো মধ্যে নিখুঁতভাবে পাওয়া যায়নি।
৪- জিন ও ইনসান এর উপর ওয়াজিব হল এই মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করা যে,শরী’আত বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন প্রকৃতির। এবং ইসলামের শরী’আত সর্বশেষ শরী’আত যা পূর্বের সকল শরী’আতকে রহিতকারী। অতএব সৃষ্টিকূলের কোন ব্যক্তির জন্যই ইসলামের শরী’আত ভিন্ন অন্য কোন শরী’আত দ্বারা আল্লাহর ইবাদত করা জায়েয নয়।
৫-মানব ও জিন এর কিতাবধারী, কিতাববিহীন সকল প্রকার ব্যক্তির উপর দুটি শাহাদতবাণী উচ্চারণ করার মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ করা ওয়াজিব। এবং ইসলাম ধর্মে যা কিছু এসেছে তার উপর সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে ঈমান স্থাপন করা ও তদানুযায়ী আমল করা, তার অনুসরণ করা, তা ব্যতীত সকল বিকৃত শরী’আত বর্জন করা ওয়াজিব।
৬-প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে ইহুদ,খৃষ্টান ও অন্যান্য সকল ব্যক্তি থেকে যে ব্যক্তিই এই ইসলামে প্রবেশ করবে না সে কাফের। তাকে কাফের বলা ওয়াজিব, আরও বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে এরূপ ব্যক্তি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হবে যদি সে তার এই (বাতিল) আক্বীদাহর উপর মৃত্যু বরণ করে। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা চির সত্য ইসলামের অন্যান্য বিকৃত, রহিত ধর্মের সাথে সংমিশ্রণ ঘটানোর দর্শন-মতবাদ বাতিল প্রমাণিত হল। আরো ইহা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কিছু বাকী নেই, একমাত্র কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু বাকী নেই, এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। এবং তাঁর আনিত শরী’আত পূর্বের সমস্ত শরী’আতকে রহিত-বাতিলকারী। তিনি ব্যতীত অন্য কারও (নিঃশর্ত) আনুগত্যও জায়েয নেই।
[১৫]কোন কোন আলেম অষ্টম নং শর্ত যোগ করেছেন, তা হলঃ ত্বাগুতের সাথে কুফরী করা। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
(أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ)[النحل:৩৬].
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগুত থেকে বিরত থাক।’ (সূরা আন্‌ নাহলঃ৩৬)
কবী বলেনঃ
وَزِيْدَ ثَامِنُهَا الْكُفْرَانُ مِنْك بِمَا سِوَى الْإِلَهِ مِنَ الْأَوْثَانِ قَدْ اُلهِاَ
‘আর এই কালেমার অষ্টম শর্ত হিসাবে ইহাও বর্ধিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত যত কিছু বাতিল উপাস্যের উপাসনা করা হয়- তুমি তার সাথে কুফরী করবে।’
[১৬] ‘ইসলামী চিন্তা ধারা’-তথা ইসলামী চিন্তাবিদ’এই পরিভাষাটি আমাদের শাইখ আল্লামাহ্‌ বাকর বিন আব্দুল্লাহ্‌ আবু যায়দ তাঁর ‘মু’জামুল মানাহী আল্‌ লাফযিয়্যাহ’ নামক গ্রন্থে অস্বীকার-প্রতিবাদ করেছেন। এর পরও আমি তা বলেছি কারণ ঐজাতীয় লোকদের পরিচয়ে এজাতীয় শব্দ ব্যবহার করার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
[১৭] অর্থাৎঃ যে নিজের মাল বা মর্যাদা বিলুপ্ত হওয়ার ভয় করে। শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব (রহিমাহুল্লাহ্‌) কাশফুশ্‌ শুবুহাত’-সংশয় নিরসন নামক কিতাবে এই মাসআলাহ্‌টির বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ নিশ্চয় যে ব্যক্তি কুফরী বাক্য উচ্চারণ করবে বা কুফরীর উপর আমল করবে সম্পদ বা মর্যাদা হ্রাসের ভয়ে অথবা কারো সাথে শিথিলতাস্বরূপ-এরূপ ব্যক্তি ঐব্যক্তির চেয়েও বড় অপরাধী যে ঠাট্টা করে কোন (কুফরী) কথা বলে। এর পর তিনি বিষয়টির বর্ণনা দেন..অথবা এই কুফরী কাজটি করে ভয়ে বা লোভে পড়ে অথবা কারও সাথে শিথিলতা প্রদর্শন করতে যেয়ে অথবা নিজ দেশ, পরিবার,বংশ বা ধন-সম্পদ এর ক্ষতির ভয়ে (এসকল অবস্থায় সে কাফির বলেই গণ্য হবে)।
[১৮] অন্য বর্ণনায় এসেছেঃ
(الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ).[صحيح مسلم،كتاب الإيمان ، الحديث رقم ১৬২]
ঈমানের ত্তরটির বা ষাটটির অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এগুলির মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হলঃ এই কথা বলা যে,আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনই উপাস্য নেই। আর সর্ব নিম্ন শাখাটি হলঃ রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। আর লজ্জাশীলতা হল ঈমানের অন্যতম শাখা। (মুসলিম,ঈমান অধ্যায়,হা/১৬২)।
অত্র হাদীছ এই মর্মে বলিষ্ঠ প্রমাণ যে ঈমান তিন প্রকারঃ ১-মুখে স্বীকৃতি দেওয়া। ২-অঙ্গ-প্রতঙ্গ দ্বারা কর্ম সম্পাদন করা ৩-এবং অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা। আলোচ্য হাদীছে ঈমানের তিনটি প্রকার উল্লেখিত হয়েছে। মুখ দিয়ে কালেমা ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এর স্বীকৃতি দেওয়া-এটি হল মৌখিক ঈমান। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তুর অপসারণ করা এটি হলঃ কর্মগত ঈমান। আর লজ্জাশীলতা হল আন্তরিক ঈমান।
[১৯] দেখুনঃ ইবনুল আছীর প্রণীত ‘আন্‌ নিহায়া’ ৫/১৬১
[২০] দ্রষ্টব্যঃ বুখারী, ইজারা-ভাড়া দেওয়া অধ্যায়। অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি কোন শ্রমিককে শ্রমে লাগালো অথচ সে শ্রমিক তার পারিশ্রমিক ছেড়ে দিল। হা/২২৭২।
[২১] বুখারী ২/৩৯৮, তাবাক্বাতে ইবনু সাদ ৪/২৮-২৯।
[২২] এই মর্মে যে আরো অধিক জানতে চায় সে যেন শাইখ আলবানীর বই ‘আত্‌ তাওয়াস্‌ সুলু আনওয়াউহূ ওয়া আহক্বামুহু। এটি মুহাম্মাদ ঈদ আল্‌ আব্বাসী সংকলন করেছেন। এটি ‘আল্‌ মাকতাবুল ইসলামীর অন্যতম প্রকাশনা।
[২৩] দ্রঃ আল্‌ কিফায়াহ্‌ পৃঃ৯৩
[২৪]إسناده ضعيف: مسند أحمد بتحقيق الشيخ شعيب الأرنؤوط ৫/৫৭، الحديث رقم২০৫৯৭، سلسلة الأحاديث الضعيفة والموضوعة للمحدث الألباني برقم ২৯০১).
[২৫] আরো দেখুনঃ হাফেয ইবনু হাজার প্রণীত ‘আল্‌ ইছাবাহ’ এবং ‘আদালাতুছ্‌ ছাহাবাহ’ ১/১১৯)।-অনুবাদক
[২৬] এটা সাধারণত প্রতিপক্ষকে লা-জওয়াব করার জন্য বলা; অন্যথায় তারা (শী’আহ সম্প্রদায়) আহ্‌লে সুন্নাতকে কাফের বলে এবং মনে করে যে তারা গুমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে। আর যারা শাইখাইন তথা আবু বাকর ও উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)কে কাফের বলে তারা কখনই তাদের চেয়ে নিম্নমানের আহলে সুন্নাতের লোককে কাফের বলতে শিথিলতা করবে না এরূপ ধারা এযাবৎ অব্যাহত রয়েছে (মাহমূদ)।
[২৭] দেখুনঃ শাইখ ইবনু উছায়মীন প্রণীত’ শারহু লুম’আতিল ই’তিক্বাদ,পৃঃ১৫২, এবং শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্‌ প্রণীত কিতাব’আছ্‌ ছারেমুল মাসলূল, পৃঃ৫৭৩
[২৮] যেমন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গারে হেরায় ইবাদত বন্দেগী করার বিষয়টি। যদিও কেউ কেউ মনে করেন যে ‘নবী হিসাবে প্রেরিত হওয়ার পূবের’ মর্মের কথাটি (সুন্নাতের সংজ্ঞায়) যুক্ত করা ছহীহ নয়। ওয়াল্লাহু আলাম।
[২৯] হাদীছটিকে মুহাদ্দিছদের বড় একটি জামা’আত যঈফ প্রমাণ করেছেন। তাদের অন্যতম হলেনঃআহমাদ, বুখারী, ইবনু হাযম, যাহাবী, ইবনু হাজার আসক্বালানী, ইবনুত্‌ তাহির এবং এযুগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুহাদ্দিছ আল্লামাহ্‌ নাছিরুদ্দীন আলবানী রহ.। হাফেয ইবনু কাছীর এটিকে পূর্বে হাসান বলেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তার এই রায় পরিবর্তন করে তিনিও এটিকে যঈফ প্রমাণ করেছেন। অতএব,এরূপ যঈফ হাদীছ কোনক্রমেই দলীলযোগ্য হতে পার না। এখানে এরূপ যঈফ হাদীছ লেখকের উল্লেখ করা ঠিক হয়নি (গাফারাল্লাহু লানা ওয়া লাহু)-অনুবাদ।
[৩০] অনুরূপভাবে চুরির মালকে এক চতুর্থ দীনারের সাথে খাছ করে দিয়েছে। দ্রঃ মুত্তাফাকুন আলাইহ্‌ঃ বুখারী,হা/৬৭৮৯, মুসলিম, হা/৪৪৯২, অর্থাৎ চুরিকৃত সম্পদ এই পরিমাণ হলে হাত কাটা হবে, নতুবা নয় (অনুবাদক)।
[৩১] তাওয়াতুর ত্ববক্বী অর্থাৎ প্রত্যেক শতাব্দীর একটি বড় জামা’আত থেকে আরেকটি বড় জামা’আত বর্ণনা করবে। যেমন ছালাতের রাক’আত সমূহ প্রভৃতি (আল্‌ খোযায়র)।
[৩২] ছাহাবীদের নীচের লোকদের ক্ষেত্রেও ‘মাওকূফ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করা জায়েয আছে,তবে ঐসময় তা কার মাওকূফ হাদীছ তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে (আল্‌ খোযায়র)
(অর্থাৎঃ উদাহরণ স্বরূপ এভাবে বলে দিতে হবে যে এটি হাসান বাছরীর মওকূফ বর্ণনা,এটি সাঈদ বিন জুবাইর এর মাওকূফ বর্ণনা…ইত্যাদি ইত্যাদি/অনুবাদক)।
[৩৩] এই হাদীছ প্রমাণ করে যে ছাহাবায়ে কেরাম নিষ্পাপ নন, তবে ইহা তাদের আদালত-ন্যায় পরায়ণতা ও ফযীলতে মোটেও ক্ষতি করবে না।
_________________________________________________________________________________
সংকলন: আবু আব্দিল ইলাহ্‌ ছালেহ্‌ বিন মুক্ববিল আল্‌ উছায়মী আত্‌ তামীমী
অনুবাদ: আখতারুল আমান বিন আব্দুস্‌ সালাম (মাদানী)
সম্পাদনা: ইকবাল হোছাইন মাছুম
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

Translate