Monday, October 22, 2018

Images













মেয়েদের জান্নাত হাসিলের উপায়


         ***মেয়েদের জান্নাত হাসিলের উপায়***

**একজন নেককার নারী ৭০ জন ওলীর চেয়ে উত্তম।
**একজন বদকার নারী এক হাজার বদকার পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট।
**একজন গর্ভবতী মেয়েলোকের ২ রাকাত নামায একজন গর্ভহীন মেয়েলোকের ৮০ রাকাত নামাযের চেয়ে উত্তম।
**যে মেয়েলোক আল্লাহর ওয়াস্তে আপন সন্তানকে দুধ পান করান, তাহার প্রত্যেক ফোঁটা দুধের বিনিময়ে একটি নেকী তাহার আমল নামায় লেখা হয়।
**যখন স্বামী পেরেশান হইয়া বাড়ী ফেরে তখন যদি স্ত্রী স্বামীকে মারহাবা বলিয়া সান্তনা দেয়, ঐ মেয়েলোককে জেহাদের অর্ধেক নেকী দান করা হয়।
**যে মেয়েলোক আপন সন্তানের কারণে রাত্রে শুইতে পারে না, তাহাকে ২০ টি গোলাম আজাদ করার নেকী দান করা হয়।
**যে ব্যক্তি তাহার স্ত্রীকে রহমতের নজরে দেখে এবং স্ত্রীও স্বামীকে রহমতের নজরে দেখে, আল্লাহতালা ঐ দম্পতীকে রহমতের নজরে দেখে।
**যে মেয়েলোক স্বামীকে আল্লাহর রাস্তায় পাঠাইয়া দেন এবং নিজেও স্বামীর অনুপস্থিতির কষ্ট সাদরে বরদাস্ত করেন ঐ মেয়েলোক পুরুষ অপেক্ষা ৫০০ বৎসর পূর্বে জান্নাতে যাইবেন এবং ৭০ হাজার ফেরেস্তা তাহাকে ইস্তেকবাল করিবেন, তিনি হুরদের সর্দার হইবেন, জাফরান দ্বারা তাকে গোসল দেওয়া হইবে। ইয়াকুতের নির্মিত ঘোড়ার উপর ছাওয়ার করা হইবে এবং তিনি স্বামীর অপেক্ষায় থাকিবেন।
**যে মেয়েলোক সন্তানের কারণে ঘুমাইতে পারে না, সন্তানের সেবা করে,আল্লাহতাআলা ঐ মেয়েলোকের পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন এবং ১২ বৎসরের নেকী দান করেন।
**যে মেয়েলোক গরু-ছাগলের দুধ দোহন করার পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলিয়া শুরু করে, ঐ জানোয়ার তাহার জন্য দোয়া করে।
**যে মেয়েলোক বিসমিল্লাহ্ বলিয়া খাবার প্র¯‘ত করে আল্লাহতাআলা ঐ খাবারে বরকত দান করেন।
**যে মেয়েলোক বেগানা (পর) পুরুষকে উঁকি মারিয়া দেখে আল্লাহতালা ঐ মেয়ে লোককে লানত (অভিসাম্পাত) করেন। পুরুষের জন্য বেগানা মেয়েলোককে দেখা যেমন হারাম, তেমনি মেয়েলোকের জন্যও পর (বেগানা) পুরুষকে দেখা হারাম।
**যে মেয়েলোক জিকিরের সাথে ঘর ঝাড়– দেয়, আল্লাহ পাক তাহাকে খানায়ে কাবা ঝাড়– দেওয়ার সওয়াব দান করেন।
**যে মেয়েলোক নামায় রোজার পাবন্দি করে, পবিত্রতা রক্ষা করিয়া চলে, স্বামীর তাবেদারী করিয়া চলে, তাহাকে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হইবে।
**দুই ব্যক্তির নামায মাথার উপর উঠে না, প্রথম যে গোলাম তাহার মনিব থেকে পলায়ন করে, দ্বিতীয় ঐ নারী যে তাহার স্বামীর নাফরমানী করে।
**যে মেয়েলোক গর্ভবতী অবস্তায় থাকে সন্তানাদি প্রসব না হওয়া পর্যন্ত ঐ মেয়েলোক দিনে রোজা এবং রাতে নামায়ে রত থাকার নেকী পাইতে থাকিবে।
**যে মেয়েলোকের সন্তান প্রসব হয়, তাহাকে ৭০ বৎসরের নফল নামায ও রোজার নেকী দেওয়া হয়।প্রসবের সময় যে কষ্ট হয়, প্রতিবারের ব্যাথার করণে হজ্বের নেকী দান করা হয়।
**সন্তান প্রসবের ৪০ দিনের মধ্যে মারা গেলে, তাঁহাকে শাহাদতের সওয়াব ও মর্তবা দান করা হয়।
**যে মা সন্তানের (রাত্রিতে) কান্নাকটির ফলে বদ দোয়া করে দেয় না, বরং সবর করে, ঐ মেয়েলোককে এক বৎসর নফল ইবাদতের সওয়াব দেওয়া হয়।
**যকন সন্তানের দুধ পান করানো পুরা হইয়া যায়, তখন আসমান থেকে একজন ফেরেস্তা সুসংবাদ দেয় যে, তোমার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
**যখন স্বামী বিদেশ হইতে ফিরিয়া আসে স্ত্রী খুশী হইয়া, খানা খাওয়ায় এবং সফর কালীন সময়ে স্বামীর হকের কোন খেয়ানত করে না, তিনি ১২ বৎসর নফল নামাযের সওয়াব পাইবে।
**যে মেয়েলোক হুকুমের পূর্বে তাহার স্বামীর খেদমত করে, আল্লাহতাআলা তাঁহাকে ৭ তোলা স্বর্ণ ছাদকা করার সওয়াব দেন।
**যে স্ত্রী তাঁহার স্বামীর (সš‘ষ্ট) অবস্থায় মারা যায় তাহার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।
**যে স্বামী স্ত্রীকে ১টি মাছআলা শিক্ষা দিবেন তিনি ৭০ বৎসর নফল ইবাদতের সওয়াব পাইবেন।
**সকল জান্নাতীগণ আল্লাহ্ পাকের সাক্ষাতের জন্য যাইবে কিš‘ যে মেয়েলোক তাহাদের হায়া ও পর্দা রক্ষা করিয়া চলিয়াছে স্বয়ং আল্লাহ তাহাদের সাক্ষাতে যাইবেন।
** যে সকল মেয়েলোক পর্দা রক্ষা করে চলে না লজ্জাহীন, পাতলা কাপড় পরিধান করে এবং অন্যকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, ঐ সমস্ত মেয়েলোক জান্নাতে যাইবে না, এমন কি জান্নাতের খুশবুও পাইবে না।
** যে নারী স্বামীকে দ্বীনের উপর চলার জন্য তাকিদ করেন, তিনি মা আছিয়ার সাথে জান্নাতে যাইবেন।

** নারীদের দায়েমী ফরজ ৫টিঃ-
১)   ঈমানের সহিত থাকা
২) পর্দায় থাকা
৩) সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া রাখা
 ৪) স্বামীর কথা মানিয়া চলা ও
৫) ছোট আওয়াজে কথা বলা।
** নারীর দায়েমী সূন্নাত ৭টিঃ-
               ১) মাতার চুল লম্বা রাখা
               ২) চুল সুন্দর রাখা
               ৩) হাত পায়ের নখ কাটা
                ৪) নাভীর ও দগলের নিচের লোম পরিষ্কার করা
               ৫) ঢিলা ব্যবহার করা
                ৬) হায়েজ নেফাছে পট্টি ব্যবহার করা
               ৭) মিছওয়াক করা

ইমাম আবু হানিফা (র:) জিবনী

ইমাম আবু হানিফা (র:) জিবনী

ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ ইংরেজী মোতাবেক ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন।এবং ১৪ জুন ৭৬৭ ইংরেজী ১৫০ হিজরী ইন্তেকাল করেন। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা) এর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ।ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন।
এঁরা হচ্ছেন-
১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী)
২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী)
৩) সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী)
৪) আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী)
৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী)
৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী)
৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)
ইমাম সাহেবের শিক্ষা জীবনঃ
সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্হিতি ইমাম আবু হানীফা রহ. যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন আলমে আসলামের খেলাফতের মনসদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান। ইরাকের শাসন কর্তৃত্ব ছিল হাজ্জান ইবনে ইউসুফের হাতে। সাহাবী এবং যুগশ্রষ্ঠ জ্ঞানীগুনিগণের শহর কুফা ছিল তার রাজধানী। হাজ্জাজকে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে জালেম প্রশাসকরূপে আখ্যায়িত করা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীসহ অগণিত সংখ্যক জ্ঞানী গুনীকে তার জুলুম অত্যাচরের কবলে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলতেন, পূর্ববর্তী উম্মতগণের সকল জালেমকে এক পাল্লায় এবং আমাদের হাজ্জাজকে যদি আর এক পাল্লায় তোলা হয় তবে নিঃসন্দেহে হাজ্জাজের জুলুমের পাল্লা অনেক ভারি হবে।
ইবরাহীম নখয়ীর রহ. ন্যায় সাধক ব্যক্তি হাজ্জাজের মৃত্যুসংবাদ শুনে সেজদায় পড়ে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে আল্লাহর শুকুর আদায় করেছিলেন। জুলুম-অত্যাচরের বিভীষিকাময় পরিস্হিতিতে আলেম-সাধক এবং দীনদার শ্রেণীর লোকেরা অনেকটা নিষ্ক্রীয়তা এবং নির্জনবাস বেছে নিয়েছিলেন। যারাই একটু সাহসের সাথে অগ্রসর হয়েছেন, তাদের কেউ এই জালেমের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাননি।
খলীফা আবদুল মালেকের ইন্তেকাল হয় হিজরী ৮৬ সনে। দুর্দন্তপ্রতাপ এই খলিফার শাসনামলে ইসলামী খেলাফতের সীমান্ত পূর্বে কাবুল-কান্দাহার এবং সিন্ধু-পান্জাব পর্যন্ত এবং পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু এলমে-দীনের বড় বড় কেন্দ্রগুলি ছিল স্তব্ধ। আলেমগণ নিজেদের নির্জন হুজরায় বরে দীনি এলেমের চর্চা নামেমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সত্য, কিন্তু বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এলেমের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
হিজরী ৯৫ সনে হাজ্জাজ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। পরবর্তী বছর আব্দুল মালেকের পুত্র ওলীদেরও মৃত্যু হয়। ওলীদের মৃত্যুর পর সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। ইতিহাসবিদগণের বিবেচনায় সুলায়মান ছিলেন উমাইয়া বংশীয় খলীফাদণের মধ্যে অন্যতম সেরা সৎ শাসক। হিজরী প্রথম শতাব্দির মুজাদ্দেদ রূপে পরিচিত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. নিযুক্ত হন তার প্রধান উপদেস্টারূপে। মত্র পৌনে তিন বৎসর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার পর যখন তার ইন্তেকাল হয়, তখন খলিফার অসিয়্যত অনুযায়ী ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হন। (হিজরী ৯৯ সন)
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. স্বয়ং একজন সাধক প্রকৃতির আলেম ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও যত্নে সে যুগের বিশিষ্ট আলেমগণ হাদিস, তফসীর ও ফেকাহশাস্ত্রের চর্চায় ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম বুখারী লিখেছেন, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. আবু বকর ইবনে হাদম এর বরাবরে লিখিত এক পত্রে এ মর্মে আদেশ প্রদান করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস সুমূহ যত্নের সাথে সংগ্রহ ও তা লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্হা কর। আমার আশঙ্কা হয় (বিরাজমান অবস্হায়) এলেম চর্চা এবং আলেমগণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে না যায়! (সহীহ আল বুখারী)
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী বহ. বলেন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উপরোক্ত মর্মের আদেশনামাটি সে যুগের সব বিশিষ্ট আলেমের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হিজরী ১০০ সন থেকে হাদিস সংকলনের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়। তা না হলে আজ আমাদের নিকট হাদিসের যে বিরাট ভান্ডার মজুদ আছে, তা হয়ত থাকতো না। (ওমদাতুল-ক্বারী, ১ম খন্ড)
ওলীদের যখন মৃত্যু হয় (হিজরী ৯৬) তখন আবু হানীফা রহ. ষোল বছরের তরুণ। এ পর্যন্ত তাঁর লেখাপড়া পারিবারিক পরিবেশেই সীমিত ছিল। সে বছরই পিতার সাথে হজ্বে গমন করে মসজিদুল-হারামের দরছের হালকায় বসে আল্লাহর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীর জবানী হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমে এলমে-হাদিসের সাথে তাঁর সরাসরি পরিচিতি ঘটে। প্রথম যৌবনের সীমিত কিছুদিন ছাড়া ইমাম আবু হানীফার জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্তটি ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে কন্টকিত। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতেই উমাইয়া শাসনের পতন এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের উত্থান ঘটে। আব্বাসীয়দের দাবী ছিল খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন ব্যবস্হা পূনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শাসন ক্ষমতায় আহলে-বাইতের প্রাধান্য স্হাপন। যে কারণে সমসাময়িক বিশিষ্ট আলেম ওলামাগণের পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফাও রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটানোর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শরীক হয়েছিলেন।
সেই বিস্ফোরণমূথী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই ইমাম আবু হনীফা কুরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবীগণের জীবনপদ্ধতি মন্হন করে এলমে-ফেকাহ বা বিধান শাস্ত্র রচনা করে গেছেন। সর্বকালের মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞান সম্মত বিধিবিধান সম্বলিত এগরো লক্ষাধীক মাসআলা সংকলিত করে গেছেন তিনি। তাঁর সংকলিত মৌলিক মাসআলা-মাসায়েলের সুত্রগুলির মধ্যে এমন একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সমর্থনে কুরআন, হাদিস বা সাহাবীগণের আছার এর সমর্থন নাই। এর দ্বারাই অনুমিত হয় যে, তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটুকু বিস্তৃত ছিল।
ইমাম আবু হানীফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় প্রষ্ঠপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। তাঁর অন্যতম বিশিষ্ট সাগরেদ ইমাম মুহম্মদকে তিনি বাল্যকাল থেকেই লালন-পালন করে প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত শিখরে পৌছে দিয়েছিলেন। তাঁর অর্থ সাহায্যে লালিত এবং জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন শাখায় সুপ্রতিষ্ঠিত মনীষীবর্গের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ওবাং বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শা’বীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শা’বী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি! তুমি কোথায় যাওয়া-আসা কর?
ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শা’বী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে?
আবু হানীফা রহ. সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়।
কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শা’বী আবু হানীফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম সাহেব বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু জোহরা)
এ সময় আবু হানীফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর কাল ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন। ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতিঃ
যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করা। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)
ইমাম ইবনে হাযম রঃ বলেন, আবু হানীফার রঃ সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হবে। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার রঃ মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রঃ বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রঃ হারামাইন শরীফে কাশফ যুগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আমাকে অবগত করেছেনযে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার রঃ সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামন্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)
সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা রঃ বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্হান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ
সে জামানার দরসের হালকা বা শিক্ষাঙ্গনের চিত্র ছিল, উস্তাদ কোন একটি উচ্চ আসনে বসে তকরীর করতেন। ছাত্রগণ চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে নিতান্ত নিবিষ্টতার সাথে তকরীর শ্রবণ করতেন। অনেকেই তকরীর শুনে তা আয়ত্ব করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এসব তকরীর উস্তাদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে যিনি তকরীর করতেন তাঁর নামেই সেগুলো গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হতো। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দির সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফার রঃ শিক্ষাদান কার্যক্রমেও সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। কোন কোন মাসআলায় তর্ক শুরু হয়ে যেত। সে তর্ক কয়েকদিন পর্যন্তও চলতো। শেষ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যা সাব্যস্ত হতো সেটাই লিপিবদ্ধ হতো। কোন কোন মাসআলায় উস্তাদ ও সাগরেতের মধ্যকার মতভেদ অমীমাংসিতই থেকে যেত। সেই মত পার্থক্যগুলিও স্ব স্ব যুক্তি সহকারেই কিতাব লিপিবদ্ধ করা হতো। এভাবেই হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্হগুলি সংকলিত হয়েছে।
ইমাম সাহেবের দরছগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্হানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনেরা সমবেত হতেন। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন।
কর্মদিবস গুলিতে তিনি এশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। জোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। ফতোয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিল। তবে অবস্হা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো।
দরসের মজলিসে শিক্ষার্থীগণের সাথে অনেক সাধারণ লোকও শরীক হতেন। তর্কচ্ছলে অনেকে আপত্তিকর মন্তব্যও করত। কিন্তু কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে পরম ধৈর্যের সাথে জবাব দিতেন। চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের মোকাবেলাতেও তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না। প্রায সময়ই তিনি একটা কবিতাংশ আবৃত্তি করতেন। যা অর্থ ছিলো- ইয়া আল্লাহ ! যাদের অন্তর আমাদের দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আছে, আমাদের অন্তর তাদের প্রতি প্রশস্ত করে দাও। (আবু যোহরা)
প্রতিটি তকরীরের শেষে তিনি বলতেন, এটি আমার অভিমত। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, তা আমি বললাম। কেউ যদি আমার চাইতেও মজবুত দলীল ও যুক্তির অবতারনা করতে পারেন, তবে তাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। (আবু যোহরা)
কোন একটি বিষয় আলোচনার সময় একবার একজন ছাত্র বলেছিলেন, আপনার এই অভিমতটি খুবই চমৎকার। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে, এক পর্যায়ে এটি ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)
ইমাম আবু ইউসুফ রঃ তাঁর সব আলোচনারই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতেন। ইমাম সাহেব বলতেন, আমার তকরীর শুনে তা অনুধাবন করতে বেশি যত্নবান হও। এমনও হতে পারে যে, আজকের এই কথাগুলি পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)
যারা বিরূপ মন্তব্য করতো, তাদের সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মন্তব্য ছিল- যদি কেউ আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমার মধ্যে নাই, তবে সে ভুল বলছে। আর আলেমদের কিছু না কিছু দোষ চর্চা তো তাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।
ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফ রঃ এর দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফা রঃ এর নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।
মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রঃ ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।
খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। তিনি উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে খলীফাকে সম্বোধন করে বলেন, ’’ আল্লাহর শপথ , কোন ব্যাপারে আমার ফয়সালা যদি আপনার বিরুদ্ধে যায় এবং আপনি আমাকে হুকুম দেন যে হয়ত সিদ্বান্ত পাল্টাও না হলে তোমাকে ফোরাত নদীদে ডুবিয়ে মারা হবে। তখন আমি ডুবে মরতে প্রস্তুত থাকব তবু নিজের সিদ্বান্ত পাল্টাতে পারবনা। তা ছাড়া আপনার দরবারে এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের মনতুষ্টি করার মত কাজীর প্রয়োজন।’’
ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয় । যারফলে তাঁর সারা শরীর রক্কাক্ত হয়ে পড়ে। তখন খলীফা মানসুরের চাচা আব্দুস সামাদ ইবন আলী তাকে এজন্য খুবই তিরিষ্ড়্গার করে বলেন , ’’ ইনি শুধু ইরাকের ফকীহ নন। সমগ্র প্রাচ্যবাসীর ফকীহ।’’ এতে মনসুর লজ্জিত হয়ে প্রত্যেক চাবুঘাতের বদলে এক হাজার দিরহাম ইমাম আবু হানিফার কাছে পাঠান। কিন্তু ইমাম উক্ত দিরহাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানান। তখন তাকে বলা হয় তিনি এ অর্থ গ্রহন করে নিজের জন্য না রাখলেও দুঃখী-গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এর জবাবে ইমাম বলেণ ’’ তার কাছে কি কোন হালাল অর্থও রয়েছে’’?। মানসুর এরপর আরও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। ইমামকে আরও চাবুকাঘাত করা হয়। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফার মৃত্যূ হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মানুসর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন এন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়।

Friday, October 19, 2018


অামরা থাকবো ইসলামের পক্ষে। ইসলামই দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা, ইসলাম শিখিয়েছে ব্যবহার।
  একমাত্র ইসলামই মানবতার মুক্তির পথ দেখাতে পারে।

Thursday, October 18, 2018

মৃতের বাড়ীতে কুরআন খানী অনুষ্ঠান করার বিধান কি?

মৃতের বাড়ীতে কুরআন খানী অনুষ্ঠান করার বিধান কি?



মৃতের বাড়ীতে কুরআন খানী অনুষ্ঠান করার বিধান কি?

নিঃসন্দেহে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কোরানখানী মাহফিল করা একটি বিদআত। কেননা ইহা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা তাঁর ছাহাবায়ে কেরামের যুগে প্রচলিত ছিল না। কুরআন দ্বারা দুঃখণ্ডচিন্তা হালকা হয়- যদি কোন ব্যক্তি উহা নীচু স্বরে তেলাওয়াত করে থাকে। জোরে চিৎকার করে বা মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পাঠ করলে এরূপ হয় না। কেননা উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করলে সমস্ত মানুষ তা শুনে থাকে এমনকি খেলা-ধুলায় লিপ্ত লোকদের কানেও তা পৌঁছে কিন্তু তারা তার প্রতি গুরুত্বারোপ করে না। এমনকি আপনি দেখবেন যারা গান্তবাদ্য শুনে তাদের কাছেও ঐ কুরআনের আওয়াজ পৌঁছে। তারা গানও শুনছে কুরআনও শুনছে। ফলে তারা যেন এই কুরআনকে ঠাট্টা ও তাচ্ছিল্যের বিষয়ে পরিণত করেছে। কুরআনের অবমাননা করছে।
আর শোক-সমবেদনা জানাতে ও আগত লোকদের স্বাগত জানানোর জন্য মৃতের পরিবারের নিকট সমবেত হওয়া একটি বিদআত। অনুরূপভাবে মৃতের বাড়ীতে ভোজের আয়োজন করাও একটি বিদআত। কেননা বিষয়টি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যুগে পরিচিত ছিল না। তবে চলতে ফিরতে, মসজিদে বাজারে মৃতের পরিবারকে শোক জানানোতে কোন অসুবিধা নেই। মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে তার বাড়িতে সমবেত লোকদের জন্য খাদ্য প্রস্তত করাকে ছাহাবায়ে কেরাম নিষিদ্ধ নিয়াহা বা ‘মৃতের জন্য বিলাপ’ এর অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। আর মৃতের জন্য বিলাপ করা কাবীরা গুনাহ। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিলাপকারীনী ও বিলাপ শ্রবণকারীনীকে লা‘নত করেছেন। তিনি বলেন,
النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ
“উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করে ক্রন্দনকারীনী যদি মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করে, তবে ক্বিয়ামত দিবসে এমনভাবে উত্থিত করা হবে যে, তার গায়ে আলকাতরার একটি পায়জামা পরানো হবে এবং পরানো হবে খুঁজলী যুক্ত চাদর।” (আমরা আল্লাহ্‌র কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি)
মুসলিম ভাইদের প্রতি আমার নসীহত, তারা যেন এরকম সবধরণের বিদআত থেকে সাবধান হয়। কেননা বিদআত পরিত্যাগে তাদের যেমন কল্যাণ আছে, তেমনি উপকার আছে মৃত ব্যক্তির। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ “নিশ্চয় মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে তার পরিবারের লোকদের ক্রন্দন ও বিলাপের কারণে।”  এখানে ‘শাস্তি দেয়া হবে’ একথার অর্থ হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি এই ক্রন্দন ও বিলাপের কারণে ব্যথিত হয় কষ্ট পায়। যদিও বিলাপকারীর শাস্তি তাকে দেয়া হবে না। কেননা আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন, وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى “একজন অন্যজনের পাপের বোঝা বহণ করবে না।” (সূরা আনআমঃ ১৬৪) আর শাস্তি মানেই দন্ডিত হওয়া নয়। কেননা হাদীছে বলা হয়েছেঃ “সফর  শাস্তির একটি অংশ।” অথচ এখানে কোন দন্ড নেই; বরং এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুঃখ, চিন্তা, মনোকষ্ট প্রভৃতি।
সারকথা মুসলিম ভাইদেরকে আমি নসীহত করি, তারা যেন শরীয়ত বহির্ভূত এই কুসংস্কার পরিত্যাগ করে যা তাদেরকে আল্লাহ্‌ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে এবং মৃতদের শাস্তি বৃদ্ধি করবে।

সালাতে একাগ্রতা ও খুশুর জন্য ৩৩ টি উপায়

সালাতে একাগ্রতা ও খুশুর জন্য ৩৩ টি উপায়



সালাত ইসলামের একটি শরীরিক ইবাদত, বড় রুকন। একাগ্রতা ও বিনয়াবনতা এর প্রাণ, শরিয়তের অমোঘ নির্দেশও। এদিকে অভিশপ্ত ইবলিশ মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত করার শপত নিয়ে অঙ্গীকার করেছে,
‘তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’। (আল-আরাফ : ১৭)
কাজেই তার মূল উদ্দেশ্য মানবজাতিকে সালাত হতে বিভিন্ন ছলে-বলে অন্য মনস্ক করা। ইবাদতের স্বাদ, সওয়াবের বিরাট অংশ থেকে বঞ্চিত করার নিমিত্তে সালাতে বিভিন্ন ধরনের ওয়াসওয়াসা ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটানো। তবে বাস্তবতা হল, শয়তানের আহবানে মানুষের বিপুল সাড়া, দ্বিতীয়ত, সর্বপ্রথম সালাতের একাগ্রতা পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়া, তৃতীয়ত, শেষ জমানা। এ হিসেবে আমাদের উপর হুজায়ফা রা. এর বাণী প্রকটভাবে সত্যতার রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন,
‘সর্বপ্রথম তোমরা নামাজের একাগ্রতা হারা হবে, সর্ব শেষ হারাবে সালাত। অনেক নামাজির ভেতর-ই কোনো কল্যাণ বিদ্যমান থাকবে না। হয়তো মসজিদে প্রবেশ করে একজন মাত্র নামাজিকেও সালাতে বিনয়ী-একাগ্রতা সম্পন্ন দেখবে না।’ (মাদারিজুস সালিকিন, ইবনুল কায়্যিম ১/৫২১)
তা সত্বেও কতক মানুষের আত্মপ্রশ্ন, অনেকের সালাতে ওয়াসওয়াসা ও একাগ্রতাহীনতার অভিযোগ।
বিষয়টির আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক অপরিসীম। সে জন্যেই নিম্নে বিষয়টির উপর সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে।আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘মুমিনগণ সফলকাম, যারা সালাতে মনোযোগী’। (সূরা আল-মুমিনূন: ১-২) অর্থাৎ আল্লাহ ভীরু এবং সালাতে স্থির।
‘খুশু হল-আল্লাহর ভয় এবং ধ্যান হতে সৃষ্ট স্থিরতা, গাম্ভীর্যতা ও নম্রতা।(‘দার-আশশুআব প্রকাশিত ইবনে কাসির : ৬/৪১৪)
‘বিনয়াবনত এবং আপাত-মস্তক দীনতাসহ আল্লাহর সমীপে দন্ডায়মান হওয়া’। (আল-মাদারেজ : ১/৫২০)
মুজাহিদ বলেন, ‘কুনুতের অর্থ : আল্লাহর ভয় হতে উদ্‌গত স্থিরতা, একাগ্রতা, অবনত দৃষ্টি, সর্বাঙ্গীন আনুগত্য। (তাজিমু কাদরিস সালাত ১/১৮৮)
খুশু তথা একাগ্রতার স্থান অন্তর তবে এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রতঙ্গে। ওয়াসওয়াসা কিংবা অন্যমনস্কের দরুন খুশুতে বিঘ্নতার ফলে অঙ্গ-প্রতঙ্গের ইবাদতেও বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়। কারণ, অন্তকরণ বাদশাহ আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ আজ্ঞাবহ-অনুগত সৈনিকের ন্যায়। বাদশার পদস্খলনে সৈনিকদের পদস্খলন অনস্বীকার্য। তবে কপট ও বাহ্যিকভাবে খুশু তথা একাগ্রতার ভঙ্গিমা নিন্দনীয়। বরং ইখলাসের নিদর্শন হল একাগ্রতা প্রকাশ না করা।
হুজায়ফা রা. বলতেন, ‘নেফাক সর্বস্ব খুশু হতে বিরত থাক। জিজ্ঞাসা করা হল, নেফাক সর্বস্ব খুশু আবার কি? উত্তরে বললেন, শরীর দেখতে একাগ্রতাসম্পন্ন অথচ অন্তর একাগ্রতা শূন্য।’
ফুজায়েল বলেন, ‘আগে অন্তরের চেয়ে বেশী খুশু প্রদর্শন করা ঘৃণার চোখে দেখা হত।’
জনৈক বুজুর্গ এক ব্যক্তির শরীর ও কাঁধে খুশুর আলামত দেখে বললেন, এই ছেলে ! খুশু এখানে, বুকের দিকে ইশারা করে। এখানে নয়, কাঁধের দিকে ইশারা করে। (মাদারিজ: ১/.৫২১)
সালাতের ভেতর খুশু একমাত্র তারই অর্জিত হবে, যে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে সালাতের জন্য ফারেগ করে নিবে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে সালাতকে স্থান দিবে। তখনই সালাতের দ্বারা চোখ জুড়াবে, অন্তর ঠান্ডা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
সালাতেই আমার চোখের শান্তি রাখা হয়েছে। (মুসনাদু আহমাদ: ৩/১২৮)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় খুশুর সহিত সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য ধার্যকৃত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা প্রদান করেছেন। ( সূরা আল-আহজাব : ৩৫) খুশু বান্দার উপর সালাতের দায়িত্বটি স্বাভাবিক ও হালকা করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ. ﴿البقرة:৪৫﴾
আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা খুশুওয়ালা-বিনয়ী ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন। ( সূরা আল-বাকারা : ৪৫)
অর্থাৎ সালাতের কষ্ট বড় কঠিন, তবে খুশু ওলাদের জন্য কোন কষ্টই নয়।” (তাফসিরে ইবনে কাসির : (১/১২৫) খুশু যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন কঠিন ও দূর্লভ, বিষেশ করে আমাদের এ শেষ জামানায়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘এই উম্মত হতে সর্ব প্রথম সালাতের খুশু উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তালাশ করেও তুমি কোনো খুশু ওয়ালা লোক খুঁজে পাবে না।’ (তাবরানি)
 খুশু তথা একাগ্রতার হুকুম
 নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে খুশু ওয়াজিব। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলার বাণী,وَ
”তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, তবে সালাতে একাগ্রতা বঞ্চিতদের জন্য তা খুব কঠিন।” (সূরা আল-বাকারা : ৪৫)- এর মাধ্যমে খুশুহীনদের দুর্নাম ও নিন্দা করা হয়েছে। অর্থাৎ খুশু ওয়াজিব। কারণ, ওয়াজিব তরক করা ছাড়া কারো দুর্নাম করা হয় না।
 অন্যত্র বলেন,
”মুমিনগণ সফল, যারা সালাতে একাগ্রতা সম্পন্ন…তারাই জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে।” ( সূরা আল-মোমেনুন : ১-১১) এ ছাড়া অন্যরা তার অধিকারী হবে না। এর দ্বারাও প্রমাণিত হয়, খুশু ওয়াজিব। খুশু হল বিনয় ও একাগ্রতার ভাব ও ভঙ্গি। সুতরাং যে ব্যক্তি কাকের মত মাথা ঠোকরায়, রুকু হতে ঠিক মত মাথা উঁচু করে না, সোজা না হয়ে সেজদাতে চলে যায়, তার খুশু গ্রহণ যোগ্য নয়। সে গুনাহগার-অপরাধি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৫৫৩-৫৫৮)
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন। যে ভাল করে ওজু করবে, সময় মত সালাত আদায় করবে এবং রুকু-সেজদা ঠিক ঠিক আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোনো দায়িত্ব নেই। শাস্তিও দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন। (আবু দাউদ : ৪২৫, সহিহ আল-জামে : ৩২৪২)
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
”যে সুন্দরভাবে ওজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে দু’রাকাত সালাত পড়ে, (অন্য বর্ণনায়-যে সালাতে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (অন্য বর্ণনায়- তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।) (বোখারি : ১৫৮, নাসায়ি : ১/৯৫)
 খুশু ও একাগ্রতা সৃষ্টি করার কয়েকটি উপায়
 খুশু তৈরীর উপায় ও বিষয় নিয়ে গবেষণা করার পর স্পষ্ট হয় যে, এগুলো দু’ভাগে ভিবক্ত।
এক. খুশু তৈরী ও শক্তিশালী করণের উপায় গ্রহণ করা।
দুই. খুশুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো পরিহার ও দুর্বল করা।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, খুশুর সহায়ক দুটি জিনিস। প্রথমটি হল- নামাজি ব্যক্তির প্রতিটি কথা, কাজ, তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়া গভীর মনোযোগ সহকারে আদায় করা। আল্লাহকে দেখে এসব আদায় করছি এরূপ নিয়ত ও ধ্যান করা। কারণ, নামাজি ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। হাদিসে জিবরীলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে,
”আল্লাহর ইবাদত কর, তাকে দেখার মত করে। যদি তুমি তাকে না দেখ, সে তো অবশ্যই তোমাকে দেখে।” ( বোখারি মুসলিম )
এভাবে যতই সালাতের স্বাদ উপভোগ করবে, ততই সালাতের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। আর এটা সাধারণত ঈমানের দৃঢ়তার অনুপাতে হয়ে থাকে। ঈমান দৃঢ় করারও অনেক উপায় রয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ”তোমাদের দুনিয়ার তিনটি জিনিস আমার নিকট প্রিয়। নারী ও সুগন্ধি, আর সালাত তো আমার চোখের প্রশান্তি।”
আরেকটি হাদিসে এসেছে, ”ও বেলাল, সালাতের মাধ্যমে (প্রশান্তি) মুক্তি দাও।”
দ্বিতীয়টি হল- প্রতিবন্ধকতা দূর করা। অন্তরের একাগ্রতা বিনষ্টকারী জিনিস ও চিন্তা-ফিকির পরিত্যাগ করা। যা ব্যক্তি অনুসারে সকলের ভেতর হয়ে থাকে। যার ভেতর প্রবৃত্তি ও দ্বীনের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা কোনো জিনিসের প্রতি আসক্তি রয়েছে, তার ভেতর ওয়াসওয়াসাও অধিক হবে। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৬০৬-৬০৭ )
 খুশু সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ
 এক. সালাতের জন্য প্রস্ততি গ্রহণ ও তৈরী হওয়া।
যেমন, মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে আজানের শব্দগুলো উচ্চারণ করা এবং আজান শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়া।
আজান-ইকামতের মাঝখানে দোয়া করা, বিসমিল্লাহ বলে পরিশুদ্ধভাবে ওজু করা, ওজুর পরে দোয়া পড়া। যেমন,
মুখ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মেসওয়াকের প্রতি যত্নশীল থাকা, যেহেতু কিছক্ষণ পরেই সালাতে তেলাওয়াত করা হবে পবিত্র কালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমরা কোরআন পড়ার জন্য মুখ ধৌত কর।” ( বর্ণনায় বায্‌যার)
সুন্দর পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে পরিপাটি হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا
”ও বনি আদাম, তোমরা প্রতি সালাতের সময় সাজ-সজ্জা গ্রহণ কর।” (সূরা আল আরাফ: ৩১)
আল্লাহর জন্য পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা অধিক শ্রেয়। কারণ, পরিস্কার পরিচ্ছদ ও সুগন্ধির ব্যাবহার নামাজির অন্তরে প্রফুল্লতার সৃষ্টি করে। যা শয়নের কাপড় কিংবা নিম্নমানের কাপড় দ্বারা সম্ভব নয়। তদ্রুপ সালাতের প্রস্তুতি স্বরূপ, শরীরের জরুরি অংশ ঢেকে নেয়া, জায়গা পবিত্র করা, জলদি সালাতের জন্য তৈরী হওয়া ও ধীর স্থিরভাবে মসজিদ পানে চলা। আঙ্গুলের ভেতর আঙ্গুল দিয়ে অলসতার অবস্থা পরিহার করা। সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। মিলে মিলে এবং কাতার সোজা করে দাড়ানো। কারণ, শয়তান কাতারের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাতে আশ্রয় নেয়।
দুই : স্থিরতা অবলম্বন করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি অঙ্গ স্বীয় স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন
সালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ”এভাবে না পড়লে তোমাদের কারো সালাত শুদ্ধ হবে না।”[১]
আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”সালাতে যে চুরি করে, সেই সবচে নিকৃষ্ট চোর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল সালাতে কীভাবে চুরি করে ? তিনি বললেন, রুকু-সেজাদ ঠিক ঠিক আদায় করে না।” ( আহমাদ ও হাকেম) [২]
আবু আব্দুল্লাহ আশআরি রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
”যে ব্যক্তি রুকু অসর্ম্পর্ণ রাখে আর সেজাদাতে শুধু ঠোকর মারে, সে ঐ খাদকের মত যে দুই-তিনটি খেজুর খেল অথচ কোনো কাজে আসল না।”[৩] ( তাবরানি)
ধীরস্থিরতা ছাড়া খুশু সম্ভব নয়। কারণ, দ্রুত সালাতের কারণে খুশু নষ্ট হয়। কাকের মত ঠোকর মারার কারণে, সাওয়াব নষ্ট হয়।
তিন : সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তুমি সালাতে মৃত্যুর স্মরণ কর। কারণ, যে সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করবে, তার সালাত অবশ্যই সুন্দর হবে। এবং সে ব্যক্তির ন্যায় সালাত পড়, যাকে দেখেই মনে হয়, সে সালাতে আছে।”[৪] (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ)
আবু আইউব রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশ দিয়ে বলেন,
”যখন সালাতে দাড়াবে, মৃত্যুমুখী ব্যক্তির ন্যায় দাড়াবে।”[৫] (আহমদ)
মৃত্যু প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নিশ্চিত। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই শেষ সালাত চিন্তা করলে এ সালাতই এক বিশেষ ধরনের সালাতে পরিণত হবে। হতে পারে এটাই জীবনের শেষ সালাত।
 চার : পঠিত আয়াত ও দোয়া-দরূদে ফিকির করা, ও গভীর মনোযোগ দিয়ে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা এবং সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়া।
কারণ, কোরআন নাজিল হয়েছে মূলত: চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করার জন্যই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آَيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿২৯﴾ ( ص:২৯)
”জ্ঞানীদের উপদেশ গ্রহণ ও গবেষণার জন্য আমি একটি মোবারক কিতাব আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা সাদ: ২৯)
আর এর জন্য প্রয়োজন পঠিত আয়াতের অর্থানুধাবন, উপদেশ গ্রহণ করণ ও জ্ঞানার্জন। তবেই সম্ভব- গবেষণা, অশ্রু ঝরানো ও প্রভাবিত হওয়া। আল্লাহ তাআলা রহমানের বান্দাদের প্রসংশা করে বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآَيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا ﴿৭৩﴾ ( الفرقان : ৭৩)
আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে অন্ধ ও বধিরদের মত পড়ে থাকে না। (সূরা আল ফোরকান: ৭৩)
এর দ্বারাই বুঝে আসে তাফসিরের গুরুত্ব। ইবনে জারির রহ. বলেন, ”আমি আশ্চর্য বোধ করি, যে কোরআন পড়ে অথচ তাফসির জানে না, সে কিভাবে এর স্বাদ গ্রহণ করে।” (মাহমূদ শাকের কর্তৃক তাফসিরে তাবারির ভূমিকা: ১/১০)
গবেষণার আরো সহায়ক, বার বার একটি আয়াত পড়া এবং পুনঃপুনঃ তার অর্থের ভেতর চিন্তা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল এরূপই ছিল। বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-
إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿المائدة : ১১৮﴾
আয়াতটি পড়তে পড়তে রাত শেষ করে দিয়েছিলেন। ( ইবন খুযাইমা ও আহমাদ) [৬]
আয়াতের তেলাওয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়াও চিন্তার সহায়ক। হুজায়ফা রা. হতে বর্ণিত,
”আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোনো এক রাতে সালাত পড়েছি। লক্ষ্য করেছি, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোনো আয়াত আসতো, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসতো, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসতো, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন।” (সহিহ মুসলিম : ৭৭২)
আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”আমি এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত পড়েছি। তার নিয়ম ছিল, রহমতের কোনো আয়াত আসলে, আল্লাহর কাছে রহমত চাইতেন। শাস্তির আয়াত আসলে আল্লাহর নিকট শাস্তি হতে পানাহ চাইতেন। আল্লাহর পবিত্রতার আয়াত আসলে, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করতেন।” (তাজিমু কাদরিস সালাত: ১/৩২৭)
এ ঘটনাগুলো তাহাজ্জুতের সালাতের ব্যাপারে।
সাহাবি কাতাদা ইবনে নুমান এর ঘটনা, ”তিনি এক রাতে সালাতে দাড়িয়ে, বার বার শুধু সূরায়ে এখলাস পড়েছেন। অন্য কোন সূরা পড়েননি।” (বোখারি – ফতহুল বারি : ৯/৫৯, আহমাদ : ৩/৪৩)
সালাতে তেলাওয়াত ও চিন্তা-ফিকির করার জন্য কোরআন হিফজ করা এবং সালাতে পড়ার দোয়া-দরূদ মুখস্থ করাও একাগ্রতা অর্জনে সহায়ক।
তবে নিশ্চিত, কোরআনের আয়াতে চিন্তা-গবেষণা করা এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া একাগ্রতা অর্জনের জন্য বড় হাতিয়ার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا ﴿১০৯﴾ (الإسراء :১০৯)
‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। (সূরা ইসরা : ১০৯)
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি, যার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতে চিন্তা, একাগ্রতা এবং কোরআনের আয়াতে গবেষণার চিত্র ফুটে উঠবে, আরো ফুঠে উঠবে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা। তাবিয়ী রহ. বলেন, আমি এবং উবাইদ ইবনে ওমায়ের আয়েশা রা.-এর নিকটি গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা শুনান। আয়েশা রা. এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন, অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি আমার প্রভুর ইবাদত করি। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য পছন্দ করি এবং আপনার পছন্দের জিনিসও পছন্দ করি। আয়েশা রা. বলেন, তিনি উঠে ওজু করলেন এবং সালাতে দাড়ালেন। আর কাঁদতে আরাম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বক্ষ ভিজে গেল। আরো কাঁদলেন, কাঁদতে কাঁদতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) সালাতের সংবাদ দিতে এসে দেখেন, তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন! অথচ আল্লাহ আপনার আগে-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ? রাসূল বললেন, আমার কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে মনে চায় না? আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত অবর্তীণ হয়েছে, যে এগুলো পড়বে আর এতে চিন্তা ফিকির করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ নিম্নোক্ত আসুরায়ে ফাতেহার পর আমিন বলাও আয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়ার একটি নমুনা। এর সাওয়াবও অনেক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যখন ইমাম আমিন বলে, তোমরাও আমিন বল। কারণ, যার আমিন ফেরেস্তাদের আমিনের সাথে মিলবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” ( সহিহ েিবাখারি : ৭৪৭)
তদ্রুপ ইমামের سمع الله لمن حمده এর জায়গায় মুক্তাদির ربنا ولك الحمد، বলা। এতেও রয়েছে অনেক সাওয়াব। রেফাআ জারকি রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে সালাত পড়ছিলাম। যখন তিনি রুকু হতে سمع الله لمن حمده বলে মাথা উঠালেন, পিছন থেকে একজন বলল, ربنا ولك الحمد حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه، রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করে বললেন, কে বলেছে? সে বলল আমি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ত্রিশজনেরও বেশি ফেরেশতাদের লক্ষ্য করেছি, এর সাওয়াব লেখার জন্য দৌড়ে ছুটে আসছে। কে কার আগে লিখবে। ( বোখারি, ফাতহুল বারি ২/২৮৪)
 পাঁচ : প্রতিটি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করে করে পড়া।
এ পদ্ধতি চিন্তা ও বোঝার জন্য সহায়ক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতও বটে। উম্মে সালামা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল, প্রথমে بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ পড়তেন। এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, الحمد لله رب العالمين এরপর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, الرحمن الرحيم এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, مالك يوم الدين، এভাবে এক একটি আয়াত ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তেন।
رواه أبوداود رقم (৪০০১) وصححه الألباني في الإرواء وذكر طرقه (২/৬০).
প্রতি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করা সুন্নত। যদিও পরবর্তী আয়াতের সাথে অর্থের মিল থাকে।
 ছয় : সুন্দর আওয়াজে তারতিল তথা ধীর গতিতে পড়া।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন আবৃত্তি কর। (আল-মুজ্জাম্মেল : ৪)
রাসূলুল্লাগ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তেলাওয়াতও ছিল, একটি একটি অক্ষর করে সুবিন্যস্ত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারতিল সহকারে সূরাগুলো তেলাওয়াত করতেন। একটি লম্বা সূরার তুলনায় পরবর্তী সুরাটি আরো লম্ব হত। ( সহিহ মুসলিম : ৭৩৩)
তারতিলের সাথে ধীরগতির পড়া খুশু ও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুত গতির পড়া একাগ্রতার প্রতিবন্ধক। সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করাও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপদেশ
”তোমরা সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত কর। কারণ, সুন্দর আওয়াজ কোরআনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।” (আল-হাকেম : ১/৫৭৫, সহিহ আল-জামে : ৩৫৮১)
তবে সাবধান! সুন্দর আওয়াজে পড়ার অর্থ অহংকার কিংবা গান-বাজনার ন্যায় ফাসেক-ফুজ্জারদের মত আওয়াজে নয়। এখানে সৌন্দর্যের অর্থ চিন্তার গভীরতাসহ সুন্দর আওয়াজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”সবচে’ সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি যার তেলাওয়াত শুনে মনে হয় সে আল্লাহকে ভয় করছে।” (ইবনে মাজাহ : ১/১৩৩৯, সহিহ আল-জামে : ২২০২)
সাত : মনে করা আল্লাহ তাআলা সালাতের ভেতর তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সালাতকে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আমার বান্দা যা চাবে তা পাবে। যখন আমার বান্দা বলে,
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল জগতের রব) আল্লাহ তাআলা বলেন, عبدي حمدني ( আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল) যখন বলে, الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ( পরম দয়ালু অতীব মেহেরবান) আল্লাহ বলেন, أثنى علي عبدي ( আমার বান্দা আমার গুণগান করল) যখন বলে, مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ ( বিচার-প্রতিদান দিবসের মালিক)আল্লাহ তাআলা বলেন, مجدني عبدي ( আমার বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল) যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ( আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি, কেবল আপনার কাছেই সাহায্য চাই) আল্লাহ তাআলা বলেন, هذا بيني وبين عبدي ولعبدي ما سأل، (এটি আমি ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে, পাবে) যখন বলে ( আমাদের সরল পথ দেখান, তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ নিপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি) আল্লাহ তাআলা বলেন, هذا لعبدي ولعبدي ما سأل. ( এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে পাবে) (সহিহ মুসলিম : ৩৯৫)
হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো নামাজি এর অর্থ ধ্যানে রাখলে সালাতে চমৎকার একাগ্রতা হাসিল হবে। সূরা ফাতেহার গুরুত্বও প্রনিধান করবে যতেষ্টভাবে। যেহেতু সে মনে করছে, আমি আল্লাহকে সম্বোধন করছি, আর তিনি আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন। সুতারাং এ কথপোকথনের যথাযথ মূল্যায়ন করা একান্ত কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমাদের কেউ সালাতে দাড়ালে সে, মূলত: তার রব-আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। তাই খেয়াল করা উচিত কিভাবে কথপোকথন করছে।”
مستدرك الحاكم (১/২৩৬) وهو في صحيح الجامع رقم (১৫৩৮).
 আট : সামনে সুতরা রেখে সালাত আদায় করা এবং সুতরার কাছাকাছি দাড়ানো।
এর দ্বারাও সালাতে একাগ্রতা অর্জন হয়। দৃষ্টি প্রসারিত হয় না, শয়তান থেকে হেফাজত এবং মানুষের চলাচল থেকেও নিরাপদ থাকা যায়। অথচ এ সকল জিনিস দ্বারাই সালাতে অন্যমস্কতার সৃষ্টি হয়, সাওয়াব কমে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমাদের কেউ যখন সালাত পড়বে, সামনে সুতরা নিয়ে নেবে এবং তার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে।” (আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়ানোতে অনেক উপকার নিহিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”যখন তোমাদের কেউ সুতরার সামনে সালাত পড়বে, সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়াবে।”(আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
যাতে শয়তান তার সালাত নষ্ট না করতে পারে। সুতরার নিকটবর্তী হওয়ার সুন্নত তরিকা হলো, সুতরা এবং তার মাঝখানে তিন হাত ব্যবধান রাখা। সুতরা এবং সেজদার জায়গার মাঝখানে একটি বকরি যাওয়ার মত ফাক রাখা। (বোখারি -ফতহুল বারি : ১/৫৭৪, ৫৭৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যেন সুতরার সামনে দিয়ে যেতে কাউকে সুযোগ না দেয়। তিনি বলেন, ”যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করে, সালাতের সম্মুখ দিয়ে কাউকে যাওয়ার সুযোগ দিবে না। যথাসাধ্য তাকে প্রতিরোধ করবে। যদি সে অস্বীকার করে তবে তাকে হত্যা করবে। কারণ, তার সাথে শয়তান। ( সহিহ মুসলিম : ১/২৬০, সহিহ আল-জামে : ৭৫৫)
ইমাম নববি রহ. বলেন, ”সুতরার রহস্য হলো, এর ভেতর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখা, যাতায়াত বাধাগ্রস্থ করা, শয়তানের চলাচল রুদ্ধ করা। যাতে তার গমনাগমন বন্ধ হয়, সালাত নষ্ট করার সুযোগ না পায়। (সহিহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ : ৪/২১৬)
নয় : ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে দাড়াতেন, ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন। তিনি বলেন, ”আমরা হলাম নবীদের জমাত। আমাদেরকে সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।”
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ”সালাতের ভেতর এক হাতের উপর আরেক হাত রাখার মানে কি? তিনি বলেন, এটি মহান আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত অবস্থা।”
ইবনে হাজার রহ. বলেন, আলেমগণ বলেছেন, ”এটি অভাবী-মুহতাজ লোকদের যাঞ্চনা করার পদ্ধতি। দ্বিতীয়ত: এর কারণে অহেতুক নড়া-চড়ার পথ বন্ধ হয়, একাগ্রতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। (ফতহল বারি : ২/২২৪)
দশ : সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখা।
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের সময় মাথা অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি দিতেন মাটির দিকে।”
”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশ করে, বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেজদার জায়গাতেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছেন।”
যখন তাশাহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, ”তিনি যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সে দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতেন।”
رواه ابن خزيمة (১/৩৫৫ رقم ৭১৯) وقال المحقق : إسناده صحيح، وانظر صفة الصلاة ص: ১৩৯.
অন্য আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”তিনি শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে ইশারা করেছেন। আর দৃষ্টি এ ইশারা অতিক্রম করেনি।”رواه أحمد (৪/৩)، وأبو داود رقم (৯৯০).
একটি মাসআলা : অনেক নামাজির অন্তরে ঘোরপাক খায়, সালাতে চোখ বন্ধ রাখার বিধান কি? বিষেশত: এর দ্বারা অনেকে অধিক একাগ্রতাও উপলব্ধি করেন।
উত্তর : চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত সুন্নত এর খেলাফ। যা পূর্বের বর্ণনাতে স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এর দ্বারা সেজদার জায়গা ও শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সুন্নত ছুটে যায়। আরো অনেক হাদিস বর্ণিত আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে চোখ খোলা রাখতেন। যেমন, সালাতে কুছুফে জান্নাত দেখে ফলের থোকা ধরার জন্য হাত প্রসারিত করা, জাহান্নাম দেখা, বিড়ালের কারণে শাস্তি ভোগকারী নারীকে দেখা, লাঠির আঘাতে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে দেখা, সালাতের সামনে দিয়ে অগ্রসরমান জানোয়ার ফিরানো, তদ্রুপ শয়তানের গলা চিপে ধরা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ্য করা এসব ঘটনা ছাড়াও আরো ঘটনা আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় সালাতে চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ নয়।
তবে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ কি-না এ ব্যাপারে আলেমদের মতদ্বৈততা আছে। ইমাম আহমদসহ অনেকে বলেছেন, এটি ইহুদিদের আমল, সুতরাং মাকরূহ। অপর পক্ষ বলেছেন, এটি বৈধ, মাকরূহ নয়।… সঠিক উত্তর হলো, যদি চোখ খোলা রাখার কারণে, একাগ্রতায় কোনো বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়, তবে খোলা রাখাই উত্তম। আর যদি মসজিদের অঙ্গ-সজ্জা কিংবা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে একাগ্রতাতে বেঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ হবে না। বরং এ ক্ষেত্রে শরয়ি নিয়ম-কানুনের দৃষ্টিকোণ থেকে চোখ বন্ধ রাখা মোস্তাহাব হিসেবেই বিবেচিত। সংক্ষিপ্ত : زاد المعاد (১/২৯৩) ط. دار الرسالة.
 মুদ্দা কথা, সালাতে চোখ খোলা রাখাই সুন্নত। তবে একাগ্রতায় বিঘ্নতা সৃষ্টিকারী বস্তু হতে হেফাজতের জন্য চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ নয়।
 এগারো : শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করা।
অধিকাংশ নামাজি এর ফজিলত ও একাগ্রতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা কত বেশি তা তো জানেই না, উল্টো একে ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”লোহার তুলনায় এর আঘাত শয়তানের উপর অধিক কষ্টদায়ক।”
رواه الإمام أحمد (২/১১৯) بسند حسن كما في صفة الصلاة ص : ১৫৯.
কারণ, এর দ্বারা বান্দার মনে আল্লাহর একত্ব ও ইখলাসের কথা স্মরণ হয়। যা শয়তানের উপর বড়ই পিড়াদায়ক। الفتح الرباني للساعاتي (৪/১৫).
এজন্যই আমরা লক্ষ্য করি, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর জন্য একে অপরকে উপদেশ দিতেন, নিজেরাও এ ব্যাপারে যত্নবান থাকতেন। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আজ আমাদের কাছে অবহেলা ও অমনোযোগের শিকার। হাদিসে এসেছে, ”সাহাবায়ে কেরাম এ জন্য একে অপরকে নাড়া দিতেন, সতর্ক করতেন। অর্থাৎ আঙ্গুলের ইশারার জন্য।”
رواه ابن أبي شيبة بسند حسن كما في صفة الصلاة ص: ১৪১، المصنف ( ১০/৩৮১ رقم ৯৭৩২) ط. الدار السلفية، الهند.
আঙ্গুলের ইশারায় সুন্নত হলো, তাশাহুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আঙ্গুল কেবলার দিকে উঠিয়ে রাখা।
 বার : সালাতের ভেতর সব সময় একই সূরা ও একই দোয়া না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া-দরূদ পড়া।
এর দ্বারা নতুন নতুন অর্থ ও ভাবের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এ আমল সে ব্যক্তিই করতে পারে, যার বিভিন্ন সূরা ও অনেক দোয়া মুখস্থ আছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এমননি করতেন। তিনি কোনো একটি সূরা বা কোনো একটি দোয়া বার বার এক জায়গায় পড়েননি। যেমন তাকবিরে তাহরিমার পরে নিম্নোক্ত দোয়াগুলো থেকে একেক সময় একেকটা পড়তেন।
১. আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শুরু করে কিছু সময় চুপ থাকতেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল- আপনার উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ- তাকবির এবং কেরাতের মাঝখানে চুপ থাকেন কেন? তিনি বললেন, আমি এ সময় বলি,
২. আবু সাইদ, আয়েশা রা. ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শুরু করে এ দোয়াটি পড়তেন
৩. ইবনে ওমর রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত আদায় করছিলাম, এক লোক বলল,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ কালিমাগুলো কে বলল ? আমাদের ভেতর থেকে একজন বলল, আমি বলেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আশ্চর্য হলাম এর জন্য আসমানের সমস্ত দরজাই খুলে দেয়া হয়েছে। ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এ কথা শুনার পর আর কোন দিন এগুলো পড়া ছাড়িনি। ( সহিহ মুসলিম: ১/৪২০)
৪. আলী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দাড়িয়ে বলতেন,
وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين، إن صلاتي، ونسكي، ومحياي، ومماتي لله رب العالمين، لاشريك له وبذلك أمرت وأنا من المسلمين. اللهم أنت الملك لا إله إلا أنت. أنت ربي وأنا عبدك، ظلمت نفسي واعترفت بذنبي فاغفرلي ذنوبي جميعا إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت واهدني لأحسن الأخلاق لا يهدي لأحسنها إلا أنت، واصرف عني سيئها، لا يصرف عني سيئها إلا أنت، لبيك وسعديك، والخير كله بيديك، والشر ليس إليك، أنا بك وإليك، تباركت وتعاليت، أستغفرك وأتوب إليك. ( أخرجه مسلم ১/৫৩৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাত এ দোয়ার মাধ্যমে আরম্ভ করতেন।
اللهم رب جبرائيل، وميكائيل، وإسرافيل فاطر السموات والأرض، عالم الغيب والشهادة، أنت تحكم بين عبادك فيما كانوا فيه يختلفون. اهدني لما اختلف فيه من الحق بإذنك إنك تهدي من تشاء إلى صراط مستقيم.) أخرجه مسلم ১/৫৩৪(
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাতে দাড়িয়ে কখনো নিম্নেক্ত দোয়া পাঠ করতেন :
ت) .)ا ৩/৩ و১১/১১৬و ১৩/৩৭১، ৪২৩،৪৬৫ ومسلم مختصرا بنحوه ১/৫৩২(
এ সমস্ত দোয়া হতে কোনো একটি সর্বদার জন্য নির্দিষ্ট করে পড়েননি।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ সকল দোয়া অনুসন্ধান করে বলেন,
১. সবচে’ উত্তম জিকির হলো যেগুলোতে শুধু আল্লাহর প্রসংশা ও গুণ-র্কীতন রয়েছে।
২. এর পর যেগুলোতে বান্দার ইবাদত-আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
৩. এর পর যেগুলোতে দোয়া-প্রার্থনা রয়েছে।
সবচে’ উত্তম জিকির যেমন,
سبحانك اللهم وبحمدك، وتبارت اسمك، وتعالى جدك، ولاإله غيرك.
এবং দোয়া,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
এ দুটি দোয়ার মাঝে প্রথমটির ফজিলত বেশী। কারণ, এতে আছে, কোরআনের পর সবচে’ মর্যদাশীল কলিমা, سبحانك اللهم وبحمدك এবং কোরআনের শব্দ وتبارت اسمك، وتعالى جدك এ জন্যই অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম এর মাধ্যমে সালাত আরাম্ভ করতেন। ওমর রা. এ দোয়া জোরে জোরে পড়তেন এবং মানুষদের শিক্ষা দিতেন। এর পর দ্বিতীয় প্রকার দোয়া যেমন, وجهت وجهي للذي فطر السموات…. এতে আনুগত্যের বর্হিপ্রকাশও রয়েছে, দোয়াও রয়েছে। প্রথম প্রকার দোয়া শেষে এ দোয়াটি পড়লে মূলত দোয়ার তিন প্রকারই পড়া হবে। তৃতীয় প্রকার দোয়া যেমন, اللهم باعد بيني وبين خطاباي… ইত্যাদি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৩৯৪-৩৯৫)
সালাতের ভেতর সূরা তেলাওয়াত করার সময়ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূরা পড়তেন। ফজর সালাতে সাধারণত পড়তেন, তেওয়ালে মুফাস্‌সল : ওয়াকিয়া, তুর, ক্বাফ। কেসারে মুফাস্‌সল : তাকওয়ীর, জিলজাল, সূরা নাস ও ফালাক। সূরা রোম, ইয়াসিন, এবং সাফ্‌ফাতও পড়েছেন। জুমার দিন ফজর সালাতে পড়তেন, সূরা সেজদাহ ও সূরা দাহর।
জোহর সালাতে এক এক রাকাতে ত্রিশ আয়াত পরিমাণ পড়তেন। সূরায়ে তারেক, বুরূজ এবং লাইলও পড়েছেন।
আছর সালাতে এক এক রাকাতে পনের আয়াত পরিমাণ পর্যন্ত পড়তেন। সূরা তারেক, বুরূজ এবং সূরা লাইলও পড়েছেন।
মাগরিব সালাতে কেসারে মুফাস্‌সল : সূরা ত্বীন পড়তেন। আবার সূরা মুহাম্মদ, তুর ও মুরসালাত ইত্যাদিও পড়েছেন।
এশার সালাতে আওসাতে মুফাস্‌সল : সূরা শামস, ইনশেকাক পড়তেন। মুয়াজ রা.-কে এশার সালাতে সূরায়ে আ’লা, কালাম এবং সূরায়ে লাইল পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাতের সালাতে লম্বা লম্বা সূরা পড়তেন। দুই’শ একশ পঞ্চাশ আয়াত পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনো এরচে’ কমও পড়েছেন।
রুকুর বিভিন্ন তাসবিহ, যেমন :
১- سبحان ربي العظيم.
২- سبحان ربي العظيم وبحمده.
৩- سبوح قدوس رب الملائكة والروح. ৪
– اللهم لك ركعت، وبك آمنت، ولك أسلمت، وعليك توكلت، أنت ربي، خشع لك سمعي وبصري ودمي ولحمي وعظمي وعصبي لله رب العالمين.
রুকু হতে উঠার পর তাসবিহ। যেমন,
১- سمع الله لمن حمده.
২- ربنا ولك الحمد.
৩- ربنا لك الحمد.
৪ – اللهم ربنا لك ولك الحمد.
৫ – ملء السموات ومل الأرض وملء ما شئت من شيئ بعد. أهل الثناء والمجد، اللهم لا مانع لما أعطيت، ولا معطي لما منعت، ولا ينفع ذا الجد منك الجد.
সেজদার তাসবিহ সমূহ। যেমন,
১- سبحان ربي الأعلى.
২ – سبحان ربي الأعلى وبحمده.
৩- سبوح قدوس رب الملائكة والروح.
৪- سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي.
৫- اللهم لك سجدت، وبك آمنت، ولك أسلمت، سجد وجهي للذي خلقه وصوره وشق سمعه وبصره، تبارك الله أحسن الخالقين.
দুই সেজাদার ম

Saturday, October 13, 2018

১০টি ইসলাম ধ্বংসকারী বিষয়

১০টি ইসলাম ধ্বংসকারী বিষয়

 
 
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক সেই মহান নবীর উপর যার পরে আর কোন নবী নেই। আরো নাযিল হোক তাঁর পরিবার বর্গ, সহচর বৃন্দ এবং তাঁর হেদায়াতের অনুসারীদের উপর।
অত:পর হে মুসলিম ভাই! এ কথা জেনে নিন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল বান্দার উপর ইসলামে প্রবেশ করা, উহা আঁকড়ে ধরা এবং উহার পরিপন্থী বিষয় থেকে সতর্ক থাকা ফরজ করেছেন। আর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে দিকে আহবান করার জন্যই প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্‌ এই মর্মে ঘোষণা দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে পক্ষান্তরে যে তাঁর থেকে বিমুখ হবে সে পথভ্রষ্ট হবে। তিনি বহু আয়াতে মুরতাদ হওয়ার মাধ্যম, শির্ক ও কুফরীর সকল প্রকার হতে সতর্ক করেছেন।
বিদ্যানগণ মুরতাদের বিধি-বিধান অধ্যায়ে এই মর্মে উল্লেখ করেছেন যে, একজন মুসলমান ব্যক্তির রক্ত ও ধন-সম্পদ হালাল কারী বিভিন্ন ইসলাম বিধ্বংসী কার্য কলাপ সম্পদনের মাধ্যমে মুরতাদ ও ইসলাম হতে বহিস্কার হয়ে যায়।
ইসলাম বিধ্বংসী কাজ হল সর্ব মোট ১০টি যা শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহিমাহু্মুল্লাহ) ও অন্যান্য বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন। আমরা ঐ সকল ইসলাম বিধ্বংসী কাজ গুলো নিন্মে সংক্ষিপ্ত ভাবে কিঞ্চিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ আপনার জন্য উল্লেখ করছি। যাতে আপনি উক্ত বিষয়গুলো থেকে সতর্ক থেকে অপরকে সতর্ক করতে পারেন।
ইসলাম বিধ্বংসী কাজ গুলো নিন্মরূপঃ
প্রথমঃ আল্লাহর ইবাদতে শির্ক করা। আল্লাহ বলেনঃ

إنَّ اللهَ لاَيَغْفِرُ أنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ ماَ دُوْنَ ذلكَ لِمَنْ يَشاَءُ

“নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। উহা ব্যতিরেকে উহার নিন্ম পর্যায়ের পাপ সবই তিনি যাকে ইচছা ক্ষমা করেন”। [নিসা : ১১৬]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ

إنَّهُ مَنْ يُشْرِكُ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظاَّلِمِيْنَ مِنْ أنْصَارِ

“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি শির্ক করবে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর এই সমস্ত যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না”। [সূরা মায়েদাহ্‌ : ৭২]
জ্ঞাতব্যঃ এই শির্কের অন্তর্ভূক্ত হল: মৃতকে আহবান করা, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা, তাদের জন্য নযর-নেয়াজ মানা ও পশু যবেহ করা। যেমন কোন ব্যক্তি জ্বিনের জন্য বা কোন কবেরর জন্য যবেহ করল ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ঃ নিজের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতা সাব্যস্ত করে তাদের উপরেই ভরসা রাখা। এই ধরণের ব্যক্তি সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য।
তৃতীয়ঃ  মুশরিককে মুশরিক বা কাফেরকে কাফের না বলা বা তাদের কুফরীতে সন্দেহ পোষণ করা কিংবা তাদের ধর্মকে সঠিক ভাবা।
চতুর্থঃ এই বিশ্বাস করা যে অন্যের আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের চাইতে অধিক পূর্ণাঙ্গ। কিংবা এই বিশ্বাস করা যে, অন্যের বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধান অপেক্ষা অধিক উত্তম। (যেমন কেউ কেউ তাগুতের বিধানকে নবীর বিধানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিযে থাকে) সে ব্যক্তি কাফের বলে গণ্য হবে।
পঞ্চমঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনিত কোন বস্তুকে ঘৃণার চোখে দেখা। এমতাবস্থায় সে কাফের বলে গণ্য হবে যদিও সে ঐ বস্তুর উপর বাহ্যিক ভাবে আমল করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

ذلكَ بِأنَّهُمْ كَرِهُوا ماَ أنْزَل اللهُ فَأحْبَطَ أعْماَلَهُمْ

“ইহা এজন্যই যে, তারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিষয়কে ঘৃণা করেছে সুতরাং আল্লাহ তাদের আমল গুলোকে পণ্ড করে দিয়েছেন”। [সূরা মুহাম্মাদ : ৯]
ষষ্ঠঃ দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে বা তার পুরস্কার কিংবা শাস্তিকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ

قُلْ أبِاللهِ وآياَتِهِ وَرَسُوْلِهِ كُنْتُمْ تستهزئون . لاَ تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إيْماَنِكُمْ

“আপনি বলুন (হে রাসূল) তোমরা কি আল্লাহর সাথে, স্বীয় আয়াত সমূহের সাথে এবং রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? কোন প্রকার ওজর-আপত্তির অবতারণা কর না। তোমরা ঈমান আনায়নের পর আবার কুফরী করেছ”। [সূরা তাওবাহ্‌ : ৬৫-৬৬]
সপ্তমঃ যাদু-টোনা করা: যাদুর অন্যতম প্রকার হল তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে দুজন মানুষের বন্ধন তৈরী করা বা তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি যাদু করবে বা তাতে রাজি হবে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলার বলেনঃ

(وماَ يُعَلِّماَنِ مِنْ أحَدٍ حَتىَّ يَقُوْلاَ إنَّماَ نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ )

“ঐ দুজন (হারূত- মারুত ফেরেস্তা) কাউকে যাদু শিক্ষা দিতেন না যতক্ষণ পর্যন্ত এই ক্থা না বলতেন-নিশ্চয় আমরা (তোমাদের জন্য) পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং (আমাদের নিকট যাদু শিখে) কাফের হয়ো না”। [সূরা বাকারা : ১০২]
অষ্টমঃ মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরূদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করা। আল্লাহ তাআলার বাণী:

وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإنَّهُ مِنْهُمْ ، إنَّ اللهَ لاَ يَهْدِيْ الْقَوْمَ الظاَّلِمِيْنَ

“তোমাদের মধ্য হতে যে ওদের (অর্থাৎ বিধর্মীদের) সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদেরই দলভূক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালেমদেরকে হেদায়াত দান করেন না”। [সূরা মায়েদা : ৫১]
নবমঃ এ বিশ্বাস করা যে, কারও জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরীয়তের বাইরে থাকার অবকাশ রয়েছে। যেমন (এক শ্রেণীর ভণ্ড সূফীর ধারণা অনুপাতে) অবকাশ ছিল খিযির (আ:)এর জন্য মূসার (আ:) শরীয়ত হতে বাইরে থাকার। এ বিশ্বাসেও সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوِ فِيْ الآخِرَةِ مِنَ الْخاَسِرِيْنَ

“যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে তার থেকে তা গ্রহন করা হবে না। এবং সে পরকালে ক্ষতি গ্রস্থদের দলভূক্ত হবে”। [সূরা আলে ইমরান: ৮৫]
দশমঃ সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর দ্বীন হতে বিমুখ থাকা। সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন না করা, তদানুযায়ী আমল না করা, এই ধরণের মন-মানষিকতার ব্যক্তিও কাফের বলে পরিগণিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَنْ أظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآياَتِ رَبِّهِ ثُمَّ أعْرَضَ عَنْهاَ ، إناَّ مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ مُنْتَقِمُوْنَ

“ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কে বেশী যালিম (অত্যাচারী) হতে পারে, যাকে উপদেশ দেওযা হয়েছে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা অত:পর সে উহা হতে বিমুখ হয়েছে? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ কারী”। [সূরা সাজদাহ্‌ : ২২]
কোন লোক এ সকল বিষয়ে লিপ্ত হলে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে চাই সে মজা করার জন্য এ সকল কাজ করুক বা গুরুত্ব সহকারে করুক, সেচ্ছায় করুক বা ভয়ে করুক। অবশ্য কাউকে যদি  বাধ্য করা হয় তবে তার ব্যাপার আলাদ।  এ সমস্ত ইসলাম বিধ্বংশ বিষয় অত্যন্ত মারাত্মক। তার পরও তা ব্যাপকভাবে এসব সংগঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির উপর অপরিহার্য কর্তব্য হল এ সকল বিষয় থেকে সতর্ক থাকা। আমরা আল্লাহর নিকট তার ক্রোধ অবধারিত কারী বিষয় হতে এবং তাঁর যন্ত্রনা দায়ক শাস্তি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। সৃষ্টির সেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর পরিবারের উপর, সাহাবীগণের উপর আল্লাহ রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ হোক।
[এখান থেকেই শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহ:) এর বক্তব্য শেষ]।
উল্লেখিত চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত হবে ঐ ব্যক্তি যে বিশ্বাস করে যে, মানুষ যে সমস্ত সংবিধান রচনা করেছে উহা ইসলামী সংবিধানের চেয়েও উত্তম, অথবা উহার সম পর্যায়ের অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ঐ সমস্ত মানব রচিত বিধানের নিকট ফায়সালা তলব করা জায়েয, যদিও শরীয়তের বিধানকেই সে উত্তম মনে করে- এধরণের সকল বিশ্বাসই চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত।
অনুরূপভাবে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে ইসলামের বিধি-বিধান এই বিংশ শতাব্দীতে বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ইহাই মূলত: মুসলিমদের পশ্চাদ মুখী হওয়ার কারণ। অথবা উহাকে সে স্বীয় প্রতি পালকের সাথে সর্ম্পর্কত করার মধ্যেই সীমিত রাখে, জীবনের অন্যান্য বিষয়ের কোন কর্তৃত্ব নেই বলে ধারণা করে।অর্থাৎ বলে যে শরীয়ত ব্যক্তিগত জিনিস, সমাজ, রাষ্ট বা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রয়োজন নাই তাহলে সেও চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশকারী আমল সম্দপনকারী কাফেরদের দলভূক্ত হবে।
অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারে শামিল হবে ঐ ব্যক্তির কথা যে এমনটি ধারণা করে যে, চোরের হাত কাটা, বিবাহিত ব্যাভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদী আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা আধুনিক যুগের জন্য উপযোগী নয়।
অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারের অন্তর্ভূক্ত ঐ ব্যক্তির কথা, যে বিশ্বাস করে যে বৈষয়িক বিষয় সমূহ এবং দণ্ডবিধি ইত্যাদির ব্যাপারে শরিয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করা জায়েয। যদিও সে এই বিশ্বাস না রাখে যে উহা শরীয়তের বিধান অপেক্ষা উত্তম। (তবুও সে কাফের বলেই গণ্য হবে) কারণ সে এর মাধ্যমে এমন বিষয়কে হালাল করেছে যা আল্লাহ হারাম করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম কৃত বিধানকে হালাল করবে যার হারাম হওয়া দ্বীন ইসলামে সর্বজন বিদিত। যেমন: ব্যাভিচার করা, মদ্যপান করা, সূদী কারবার করা, আল্লাহর শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দ্বারা ফায়সালা করা ইত্যাদী বিষয়কে যে হালাল মনে করবে সে মুসলমানদের সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য হবে।
আমরা আল্লাহর সমীপে এই কামনা করি, তিনি যেন সকলকে তাঁর সন্তুষ্টি মূলক কাজের তাওফীক দেন এবং আমাদেরকে এবং সমস্ত মুসলিমদেরকে সঠিক পথের হেদায়াত দান করেন। নিশ্চয় তিনি সর্ব শ্রোতা ও নিকটবর্তী। আল্লাহ্‌ তাআলা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবার বর্গ ও সাহাবীদের উপর রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ করূন। আমীন॥
 
মূলঃ আল্লামা শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ্‌ বিন বায (রহঃ) 
অনুবাদঃ শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম

অধ্যয়ন ও জ্ঞানসাধনা (২য় পর্ব)

অধ্যয়ন ও জ্ঞানসাধনা (২য় পর্ব)


অধ্যয়ন ও জ্ঞানসাধনা (২য় পর্ব)
২য় পরিচ্ছেদ:
ইলম অন্বেষণের বিভিন্ন ঘটনা
রাখালের ইলম: পৃথিবীর যাবতীয় ইলম ছয়টি বস্তুর মধ্যে!
মাঠে এক রাখালের সঙ্গে ঈসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। তিনি রাখালকে বললেন, হে যুবক! তুমি গোটা জীবন এই পশুচারণের মধ্যে কাটিয়ে দিলে! যদি জীবনকে ইলম অন্বেষণের কাজে ব্যয় করতে হবে কতই না উত্তম হতো! জবাবে রাখাল বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমি ইলম ভাণ্ডার থেকে ছয়টি বস্তু গ্রহণ করেছি এবং সে অনুযায়ী আমল করি। যথা-
এক. ما دام الحلال موجوداً لا آكل حراماً ‘যতক্ষণ হালাল বস্তুর অস্তিত্ব আছে ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম ভক্ষণ করি না।’
দুই. ما دام الصدق موجوداً لا أكذب ‘যতক্ষণ সত্য বলার সুযোগ আছে ততক্ষণ মিথ্যার আশ্রয় নিই না।’
তিন. ما دمت أرى عيبي لا أنشغل بعيوب الآخرين ‘যতক্ষণ আমার নিজের মধ্যে দোষ আছে ততক্ষণ অন্যের দোষ তালাশ করি না।’
চার. حيث لم أجد إبليس قد مات لا أئتمن وساوسه ‘যতক্ষণ ইবলিশকে মৃত না দেখব ততক্ষণ পর্যন্ত তার চক্রান্ত ও কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে নিরাপদ ভাবব না।’
পাঁচ. ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর খাজানা খালি না হতে দেখব ততক্ষণ পর্যন্ত মাখলুকের খাজানার প্রতি লালায়িত হবো না। আর এখন পর্যন্ত আল্লাহর খাজানা শূন্য হয়নি। অতএব আমাকে মাখলুকের প্রতিও ধাবিত হতে হয় না।’
ছয়. حيث لم أر رجلي تطئان الجنة لا أؤمن عذاب الله تعالى ‘যতক্ষণ দুই পা জান্নাতে বিচরণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার আজাবের ব্যাপারে উদাসীন হবো না।’
ঈসা (আ.) এই ব্যক্তির কথা শুনে বললেন-
هذا هو علم الأولين والآخرين الذي قرأته أنت وأخذته
‘এটা হলো পূর্ববতী-পরবর্তী সকলের ইলম, যা তুমি পাঠ করেছ এবং নিজের মধ্যে সঞ্চিত করেছ।’
ইলম অন্বেষণে অবিচলতা
‘মিরাজুস সাআদা’ গ্রন্থের সংকলক মির্জা মাহদী নিরাকী (রহ.) খুব অর্থকষ্টে জীবন যাপন করতেন। এত অর্থকষ্ট ছিল যে, অধ্যয়নের উপকরণাদিই সংগ্রহ করতে পারতেন না। বিভিন্ন সময় মাদরাসার চেরাগের আলোতে মুতালাআ করতেন। কিন্তু কাউকে অর্থকষ্টের কথা বুঝতে দিতেন না। এত অর্থকষ্ট ও দারিদ্রের মাঝেও ইলমের সঙ্গে লেগে থাকতেন। এমনকি বাড়ি থেকে যে চিঠিপত্র আসত তাও কখনও খুলতেন না এই আশঙ্কায় যে, এতে হয়ত এমন কোনো সংবাদ থাকবে যা অধ্যয়ন ভাবনাকে এলোমেলো এবং দরস থেকে বঞ্চিত করবে। ফলে চিঠিগুলো না খুলেই বিছানার নিচে রেখে দিতেন।
এক চিঠিতে পিতা আবূ যর (রহ.)-এর শাহাদাতের সংবাদ এল। কিন্তু চিঠিটি অভ্যাস মোতাবেক আগের মতোই বিছানার নিচে রেখে দিলেন। ফলে বাড়ির লোকজন নিরাশ হয়ে তার উস্তাদের কাছে চিঠি লিখলেন এবং পুরো পরিস্থিতি অবহিত করে তাকে তা জানানোর অনুরোধ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিরাকে (বাড়িতে) পাঠিয়ে দেয়ারও অনুরোধ করলেন, যাতে তিনি বাড়ি এসে পরিত্যক্ত সম্পদের ভাগ-বণ্টন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করেন।
পরের দিন নিরাকী (রহ.) দরসে হাজির হলে উস্তাদ তার হাত ধরলেন। সে সময় তিনি ভীষণ চিন্তিত ও গম্ভীর ছিলেন। উস্তাদের এই অস্বাভাবিক অবয়ব দেখে নিরাকী (রহ.) বললেন, হযরত! আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
জবাবে উস্তাদ বললেন, তোমাকে নিরাক যাওয়া দরকার। তিনি বললেন, কেন? উস্তাদ বললেন, তোমার বাবা অসুস্থ ছিলেন। সেজন্য যাওয়া দরকার। নিরাকী (রহ.) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তাকে সুস্থ করবেন এবং হেফাজত করবেন। অতএব আপনি দরস শুরু করুন!
শাগরেদ ইশারা বুঝতে পারছে না দেখে উস্তাদ আসল ঘটনা খুলে বললেন এবং তৎক্ষণাত তাকে নিরাক যেতে বললেন। উস্তাদের আদেশে তিনি বাড়ি গেলেন বটে কিন্তু মাত্র তিনদিনের মধ্যে যাবতীয় দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আবার দরসে হাজির হলেন। সুবহানাল্লাহ, আমরা এই পূর্বসূরীদের অনুসারীর দাবিদার!
যে বাসনা মৃত্যুযন্ত্রণাকেও হার মানায়!
কারো কারো বাসনা ও চাওয়ার বস্তু থাকে একেবারেই ভিন্ন। তাদের সেই বাসনা কোনো কিছুতেই দমে না। মৃত্যুর মতো অকাট্য ফয়সালাও যেন ওই বাসনার কাছে হার মানে। এ ধরনেরই এক বাসনা হলো ইলম অন্বেষণের বাসনা। ইতিহাসে এমন সব ব্যক্তি অতিবাহিত হয়েছেন যাদের এই বাসনার কাছে মৃত্যু যন্ত্রণাও হার মানত।
জনৈক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে আগমন করলেন এবং বললেন, আমি বুঝতে পারছি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার মৃত্যু হবে। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন-
الموت ليس مشكلة كلنا نموت
‘মৃত্যু তো মুশকিল কিছু নয়। আমরা সবাই মৃত্যু বরণ করব।’
লোকটি বললেন, এই সময় আমার করণীয় কী? আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, اطلب العلم ‘ইলম অন্বেষণ কর। কেননা কোনো মাসআলা জানতে জানতে মৃত্যু বরণ করা ওই মাসআলা সম্পর্কে জাহেল থেকে মৃত্যু বরণ করার চেয়ে উত্তম।’
আবূ রায়হান বিরুনী (রহ.) জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন-ফালসাফা, চিকিৎসাশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বি ব্যক্তি ছিলেন। চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি সর্বজন স্বীকৃত বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সর্বদা ইলম হাসিলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কোনো সময় দৃষ্টি পাঠ থেকে, অন্তর ভাবনা থেকে, হাত লেখালেখি থেকে, যবান বর্ণনা থেকে মুক্ত থাকত না। কেবল নতুন ফসল উঠানোর সময় ছাড়া।
তিনি যখন ‘আল-কানুনুল মাসউদী’ গ্রন্থটি সংকলন করেন তখন সুলতান খুশি হয়ে তাকে রৌপ্যমুদ্রা গ্রহণের অনুমতি দেন। কিন্তু সম্পদের প্রতি বিন্দুমাত্র লালসা না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
একবার তার কাছে জনৈক ভক্ত আসলেন। তখন তিনি নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করছিলেন। সেই মুহূর্তে তিনি আগন্তুককে বললেন, মীরাছের সম্পদে দাদীদের অংশের ব্যাপারে তুমি যেন আমাকে কী প্রশ্ন করেছিলে? আগন্তুক বললেন, এই সময়ে মাসআলার আলোচনা? আল-বিরুনী (রহ.) বললেন, অবগত অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া কি অজ্ঞ অবস্থায় বিদায় নেয়ার চেয়ে উত্তম নয়?
আগন্তুক বলেন, তখন আমি মাসআলাটি উল্লেখ করলাম এবং একটু পরে বের হয়ে এলাম। বের হয়ে রাস্তায় নামতেই কান্নার রোল শুনতে পেলাম।
সাক্কাকী (রহ.)-এর ইলমীযাত্রা
ইমাম সাক্কাকী (রহ.) ইসলামী ইতিহাসের একজন বিরল ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পুরো নাম ইউসুফ ইবন আবূ বকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন আলী আল-খারেযমী এবং উপাধি সিরাজুদ্দিন সাক্কাকী (রহ.)। তিনিই বিখ্যাত ‘মিফতাহুল উলুম’ গ্রন্থের মুসান্নিফ। গ্রন্থটিতে তিনি বারোটি আরবী ইলম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অথচ তিনি নিজে আরবী ছিলেন না!
জীবনের প্রথমযাত্রায় সাধারণ একজন কামার ছিলেন। সুন্দর ও আকর্ষণীয় তৈজসপত্র ও শিল্পসামগ্রী বানাতে পারতেন। একদিন তিনি সুন্দর আকৃতির একটি লোহার সিন্দুক বানালেন। এতে বিস্ময়কর একটি তালা লাগালেন। অথচ সিন্দুকের ওজন ছিল মাত্র এক রিতল এবং তালার ওজন ছিল এক কিরাত!
এরপর তিনি সিন্দুকটা ওই যুগের বাদশাকে উপঢৌকন হিসেবে দিলেন। বাদশা ও রাজন্যবর্গ সিন্দুকটি দেখে বিস্মিত হয়ে প্রস্তুতকারীকে উপহার দিলেন এবং তার উপস্থিতিতে তার পরম প্রশংসা করতে লাগলেন। পুরো মজলিসজুড়ে যখন তার কীর্তির প্রশংসা চলছিল ঠিক সে সময় একজন আগন্তুকের আগমন ঘটল। বাদশা আগন্তুকের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নিজ আসনে তাকে বসতে দিলেন। সাক্কাকী ঘটনাটি দেখে অবাক বলেন এবং জানতে পারলেন, আগন্তুক একজন বিশিষ্ট আলেম। এটা জেনে সাক্কাকী (রহ.) ভাবলেন, তিনিও যদি আলেম হন তবে সিন্দুক বানিয়ে যে বাহবা কুড়িয়েছেন এরচেয়ে ঢের বেশি সম্মান, মর্যাদা ও মূল্য পাবেন। ফলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তখনই মাদরাসার দিকে রওয়ানা হলেন।
যখন এই কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি, তখন তার বয়স ছিল ত্রিশ বছর! তাই মাদরাসার শিক্ষক বললেন, তোমার যে বয়স তাতে সম্ভবত তুমি ইলম হাসিল করতে পারবে না! আর তোমার মেধা ও মনমানসিকতার যে অবস্থা, আমি অনুমান করতে পারছি তাতে তুমি ঠিকভাবে ইলম হাসিল করতে সক্ষম হবে না এবং এই বয়সের ইলম তোমার কাজেও আসবে না। অতএব আগে একটা পরীক্ষা নেওয়া যাক। একথা বলে ওই মুদাররিস তার মাযহাব অনুযায়ী তাকে একটি দরস দিলেন এবং বললেন-
قال الشيخ: جلد الكلب يطهر بالدباغة،
‘শায়খ বলেছেন, কুকুরের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ (দাবাগাত) করলে তা পবিত্র হয়।’
উস্তাদ কথাটা তাকে বারবার আওড়াতে বললেন। পরেরদিন সাক্কাকী (রহ.) দরসে হাযির হলে উস্তাদ গতকালের সবক শুনতে চাইলে সাক্কাকী (রহ.) সবক শোনাতে গিয়ে বললেন-
قال الكلب: جلد الشيخ يطهر بالدباغة
‘কুকুর বলেছে, শায়খের চামড়া দাবাগাত করার দ্বারা তা পবিত্র হয়!’
তার কথায় মজলিসে হাস্যরোলের সৃষ্টি হলো। যাহোক, এরপর উস্তাদ তাকে আরেকটি সবক দিলেন। এভাবে পারা না পারার মধ্য দিয়ে তার অক্লান্ত জ্ঞানসাধনা চলতে থাকল এবং দীর্ঘ দশ বছর এই সাধনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। কিন্তু তবু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে এবং উস্তাদের ভষিদ্বাণী সত্য হতে দেখে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়লেন সাক্কাকী (রহ.)। গোটাজগত যেন তার কাছে সংকুচিত হয়ে আসে। সেই হতাশার মধ্যে একদিন তিনি পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে একটি বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন, একটা শক্ত পাথরে ওপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানিয়ে গড়িয়ে পড়ছে এবং পানি পড়ার স্থানে জায়গায় জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। এই দৃশ্য তাকে দারুণভাবে নাড়া দিল। তিনি ভাবলেন এবং মনে মনে বললেন-
ليس قلبك بأقسى من هذه الحجرة ولا خاطرك أصلب منها حتى لا يتأثر بالتحصيل
‘তোমার অন্তর এই পাথরের চেয়ে শক্ত নয় এবং চিন্তাশক্তি এরচেয়ে দুর্ভেদ্য নয় যে, তুমি তালিম দ্বারা প্রভাবিত হবে না।’
একথা বলে তিনি আবার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাদরাসায় ছুটে গেলেন। মজবুতভাবে ইলম হাসিলে লেগে রইলেন। আল্লাহ তা‘আলা এই মুজাহাদা ও ত্যাগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। ফলে ত্যাগের নজরানা পেশ করতে পারায় তিনি তার জন্য ইলম ও মারেফাতের দ্বার খুলে দিলেন। যার ফলে তিনি নিজ যমানার অনেক মনীষীকে ইলম-কামালে ছাড়িয়ে গেলেন। তাই সাক্কাকী (রহ.) আজ ইতিহাসের বিরাট অংশের হকদার। কত কিতাব তিনি সংকলন করলেন, কতভাবে জাতি আজ তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে! কিন্তু তিনি যদি সেদিন দমে যেতেন, পাথর আর পানির দৃশ্য দেখে অনুপ্রাণিত না হতেন তবে কি ইতিহাসের কোনো পাতায় সাক্কাকী নামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত?
বস্তুত ইলম হাসিল করতে এভাবেই অনুপ্রাণিত হতে হয়, হতাশ ও নিরাশ না হয়ে নিজের প্রতিজ্ঞা পালনে দৃঢ় কদমে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তবেই পৌঁছা যায় পরম গন্তব্যে, দখল করা যায় ইতিহাসের তাজাপাতা।
ইলম ও মুআল্লিমের প্রতি ইমাম রাযীর (রহ.) সম্মান প্রদর্শনের বিস্ময়কর ঘটনা
ইয়াকুত আল-হামাবী (রহ.) ‘মু‘জামুল উদাবা’ গ্রন্থে আবূ তালেব আজিজুদ্দীন (হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের একজন আরবী আদীব)-এর বরাতে উল্লেখ করেন, তিনি বলেন, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ.) মারভ এলাকায় আগমন করলেন। এখানে তার সীমাহীন কদর, মর্যাদা, সম্মান ও মূল্যায়ন ছিল। কেউ তার কথা কাটতে সক্ষম হতেন না। উপকৃত হতে আমিও তার মজলিসে উপস্থিত হলাম।
একদিন তিনি আমাকে বললেন, আমি চাই তুমি আমার জন্য ‘সিলসিলাতুত ত্বলিবীন’ (আবূ তালেবের আওলাদদের নাম) সংকলন করবে, যা আমি পাঠ করব। আমি এই ব্যাপারে জাহেল থাকতে চাই না।
আমি বললাম, নসবনামা ‘শাজারা’ (বংশের ধারাবাহিকতা) অনুসারে লিখব নাকি ছন্দাকারে? তিনি বললেন, আমি চাই এভাবে লিখবে, যাতে তা স্থায়ীভাবে আত্মস্থ করা সম্ভব হয়। আর শাজারা আকারে লেখা হলে এই উদ্দেশ্য হাসিলে বিঘ্ন ঘটে।
আমি বললাম, আপনার আদেশ শিরোধার্য। একথা বলে আমি ঘরে চলে গেলাম এবং কিতাবটি লিখে নামকরণ করলাম ‘আলফাখরী’ এবং তা ইমাম রাযী (রহ.)-এর সামনে হাজির করলাম।
আমার হাতে সংকলিত কিতাব দেখে তিনি স্বীয় মসনদ থেকে নেমে পড়লেন এবং চাটাইয়ের ওপর বসে পড়লেন। আর আমাকে বললেন, আপনি এই মসনদের ওপর বসুন!
আমি চিন্তা করলাম, তার উপস্থিতিতে তারই মসনদে উপবেশন করা ধৃষ্টতা প্রদর্শন বৈ কিছু নয়। কিন্তু তিনি অত্যন্ত অলঙ্ঘনীয়ভাবে আমাকে সেখানে বসার আদেশ দিয়ে বললেন-اجلس في المكان الذي أقوله لك
‘আমি যেখানে বসতে বলছি সেখানে বসুন।’
ফলে ভক্তি-ভীতি এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মসনদে বসলাম। তিনি আমার সামনে মুখোমুখি বসলেন এবং কিতাব পাঠ শুরু করলেন। এসময় তিনি আমাকে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলেন। এভাবে একপর্যায়ে পূর্ণ কিতাব পড়া শেষ করলেন। অতপর বললেন-
الآن اجلس أي مكان تريده لأن في هذا الكتاب علماً وأنت في هذا العلم أستاذي وأنا تلميذك
‘এখন থেকে আপনি যেখানে চান বসতে পারেন। কেননা এই কিতাবে ইলম আছে এবং এই ইলমের ব্যাপারে আপনি আমার উস্তাদ এবং আমি আপনার ছাত্র। আমি এখন থেকে আপনার উপস্থিতিতে ছাত্রের বেশ ধারণ করব, যাতে আপনার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারি!’
এরপর আমি অনুরোধ করলাম যাতে তিনি তার মসনদে বসেন এবং আমি আমার স্থানে বসি। আমি যাতে স্বাচ্ছন্দে আগের মতো ইলম হাসিল করতে পারি।
আরেকটি ঘটনা:
কাজী আবূ বকর ইবনুল আরাবী (রহ.) আহকামুল কুরআন (১/১৮২-১৮৩) গ্রন্থে এ ধরনের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ ইবন কাসেম উসমানী (রহ.) আমাকে অনেকবার ঘটনাটি বলেছেন। তিনি বলেন, আমি একবার ফুস্তাত এলাকায় গমন করলাম এবং শায়খ আবূল ফজল জাওহারী (রহ.)-এর দরসের মজলিসে বসলাম। দরসে আরো বহু লোকের সমাগম ছিল। আমি প্রথমবার যে মজলিসে শরীক ছিলাম সেই মজলিসে তিনি দরস প্রদান করতে গিয়ে একটি হাদীছ উল্লেখ করলেন। যথা-
إن النبي صلى الله عليه وسلم طلَّق ، وظاهر ، وآلى الخ
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালাক প্রদান করেছেন এবং জিহার ও ইলাও করেছেন।’
তিনি সেদিন দরস শেষ করে বের হলে আমিও পিছে পিছে তার ঘর পর্যন্ত গেলাম। ঘরেও একদল লোকের ভিড় ছিল। তিনি আমাদেরকে দেহলিজে বসালেন এবং সকলের কথা শুনে ও প্রয়োজন মিটিয়ে আমার দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আমার কিছু কথা আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, আমি একাকিত্বে কথাটা বলতে চাচ্ছি। তাই তিনি মজলিস খালি করার আদেশ করলেন। মজলিস খালি হলে আমি বললাম, আমি বরকত লাভের উদ্দেশ্যে আপনার মজলিসে বসেছিলাম। দরসে আপনার বর্ণনা শুনলাম, আপনি বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইলা’ করেছেন ঠিক আছে। তালাক প্রদান করেছেন সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু জিহারের ব্যাপারে যা বলেছেন, তা ঠিক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেন নি এবং তাঁর দ্বারা তা সংঘটিত হওয়া সম্ভবও নয়। কেননা জিহার হচ্ছে, অবাস্তব কথার নাম। আর তা কোনো নবীর দ্বারা প্রকাশিত হওয়া অসম্ভব।
আমার কথা শুনে তিনি আমাকে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন, মাথায় চুম্বন করলন এবং বললেন-
أنا تائب من ذلك ، جزاك الله عني من معلِّمٍ خيراً
‘আমি আমার ওই বক্তব্যের কারণে তওবা করছি। আল্লাহ তা‘আলা আমার পক্ষ থেকে মুআল্লিমকে নেক প্রতিদান প্রদান করুন।’
এরপর আমি সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম এবং পরের দিন খুব সকালে তার মজলিসে শরীক হলাম। দেখলাম তিনি আমার আগেই পৌঁছেছেন এবং মিম্বারে আরোহণ করেছেন। জামে মসজিদের প্রধান দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই তিনি আমাকে দেখে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, ‘আমার উস্তাদকে স্বাগতম’, ‘আমার উস্তাদের আসার পথ করে দাও’। তার এই ডাক শুনে অসংখ্য লোক আমার দিকে দৃষ্টি দিতে লাগলেন। সকলে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং তারা আমাকে মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যেতে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করলেন।
লজ্জায় আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। সংকোচে এতটাই উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলাম, বুঝতেই পারছিলাম না, আমি কোথায় আছি।
এরপর শায়খ উপস্থিত লোকদের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং বললেন, ‘আমি তোমাদের উস্তাদ। আর আমার উস্তাদ এ! কেননা গতকাল আমি তোমাদেরকে যা বলেছিলাম তোমরা তার সব মেনে নিয়েছিলে এবং কোনো বিষয়ে দ্বিমত করনি। কিন্তু ইনি আমার বাড়িতে গেছেন এবং একটি ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। তাই আমি গতকালের সেই ভুলের জন্য তওবা করেছি এবং তার কল্যাণে হকের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি। সুতরাং গতকালের যারা এখানে উপস্থিত আছো তারা ভুল শুধরে নাও এবং যারা অনুপস্থিত আছে তাদেরকে এই সংবাদ পৌঁছে দাও।’
এরপর তিনি মাহফিলের সকল লোককে নিয়ে আমার জন্য দু‘আ করলেন। লোকেরা সমস্বরে আমীন আমীন বললেন।
বস্তুত প্রকৃত ইলমের মজা ও স্বাদ যারা পান তারা এভাবেই বিনয় ও সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হন। অন্যথায় সারাদেশ জুড়ে যার এত যশখ্যাতি, তার পক্ষে কী করে সম্ভব হয়েছিল ভরা মজলিসে নিজের দোষ স্বীকার করে একজন ছাত্রকে উস্তাদের আসনে স্থান দেয়া? এই ঘটনা উল্লেখ করার পর ইমাম কুরতুবী (রহ.) নিজের বিস্ময়কর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন,
فانظروا رحمكم الله إلى هذا الدين المتين ، الاعتراف بالعلم لأهله على رؤوس الملأ: مِن رجلٍ ظهرت رياسته ، واشْتَهرتْ نفاسته ؛ لغريبٍ مجهول العين لا يعرف من؟ ولا من أين؟ فاقتدوا به ترشدوا
‘আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের সকলের প্রতি রহম করুন; দেখুন দীন হচ্ছে কত মজবুত ভিত্তির নাম। কীভাবে একজন সম্মানী ব্যক্তি, যার সুনাম-সুখ্যাতি দেশ জুড়ে বিস্তৃত, তিনি ভরা মজলিসে একজন অপরিচিত, অখ্যাত ব্যক্তির সামনে নিজের ইলমের ত্রুটি প্রকাশ করে তাকে সম্মানীত করছেন। অতএব, তাদের আদর্শ অনুসরণ করুন।’
পূর্বসূরী মহান ব্যক্তিত্বদের এমন নিরূপম ঘটনা আমাদেরকে বলতে অনুপ্রাণিত করে-
أولئك أبائي فجئنا بمثلهم * إذا جمعت يا جرير المجامع!
‘এঁরাই আমার পূর্বসূরী,
এদের নিয়ে গর্ব করি;
ওহে জারীর! দেখাও তুমি
বিশ্বসভায় তাদের জুড়ি।”
বড় সতীন
আমাদের পূর্বসূরীগণ ইলম অন্বেষণ, পঠন-পাঠন ও রচনা-সংকলনের কাজে এত বেশি মাত্রায় মগ্ন থাকতেন যে, তাদের স্ত্রীগণের কাছে এগুলো সতীনের চেয়েও ভারি মনে হতো! যেমন, যুবায়র ইবন আবূ বাক্কার (রহ.) বলেন, একবার আমার ভাগ্নি আমার স্ত্রীকে বলল, ‘স্ত্রীর পক্ষে আমার মামাই সবচেয়ে উত্তম। কেননা তিনি দ্বিতীয় কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং দাসীও গ্রহণ করেননি।’ জবাবে আমার স্ত্রী বললেন,
تقولُ المرأةُ (أي زوجته) والله لَهَذه الكتب أشدُّ عليَّ من ثلاثِ ضرائر
‘মহিলা (তার স্ত্রী) বললেন, আল্লাহর কসম, তোমার মামার এই কিতাবগুলো তিনজন সতীনের চেয়েও আমার কাছে বেশি কঠিন!’
মৃত্যুলগ্নেও ইলম সাধনা
মৃত্যুক্ষণ জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। কোনো ব্যক্তির পক্ষে ওই সময়ের প্রকৃত পরিস্থিতি উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। কেননা এই ঘটনা মানুষের জীবনে একবারই আসে। আর যার কাছে আসে সে চিরদিনের জন্য অপারে চলে যায় এবং ফিরে আসতে পারে না। ফলে কেউ সেই পরিস্থিতির কথা যথাযথভাবে ব্যক্তও করতে পারে না। তবু মা বাবা, ছেলেসন্তান, স্ত্রী-পরিজন, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে অচেনা-অজানা দেশে রওয়ানা দেয়ার কষ্ট কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যায়। জীবিতরা একেবারে সামান্য হলেও সে কথা অনুধাবন করতে পারি। সেই অনুধাবনশক্তি থেকে বলতে পারি, এই সময়টা কেবলই বিহবলতার, ভয়ের, আতঙ্কের। তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সেই সময়ে ইলম হাসিল, ইলম বর্ধনের চিন্তাই আসার কথা নয়। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরীগণ এই নাযুক মুহূর্তেও ইলম বৃদ্ধি এবং দীনের উপকারার্থে ইলম হাসিল করার চেষ্টা করেছেন। তারা আমল করেছেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বাণীর ওপর। যথা-
عَنْ عَمْرِو بْنِ كَثِيرٍ عَنِ الْحَسَنِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ جَاءَهُ الْمَوْتُ وَهُوَ يَطْلُبُ الْعِلْمَ لِيُحْيِىَ بِهِ الإِسْلاَمَ فَبَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّبِيِّينَ دَرَجَةٌ وَاحِدَةٌ فِى الْجَنَّةِ
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার কাছে মৃত্যু হাজির হয় আর সে দীন যিন্দা করার জন্য ইলম হাসিল করে তবে তার এবং জান্নাতের মাঝে ব্যবধান হচ্ছে একটিমাত্র দরজা।’ [সুনানে দারামী: ৩৬২, যঈফ]
দীন যিন্দার এই প্রয়াস অতি প্রশংসনীয় বলেও হাদীছে ইরশাদ হয়েছে। যথা-
«مَنْهُومَانِ لَا يَشْبَعَانِ: طَالِبُ الْعِلْمِ، وَطَالِبُ الدُّنْيَا»
‘দুই শ্রেণীর মানুষ কখনও পরিতৃপ্ত হয় না। এক. ইলমের অন্বেষক এবং দুই. দুনিয়ালোভী।’ [হাকেম, মুস্তাদরাক ‘আলাস-সহীহাইন: ৩১২]
আমাদের পূর্বসূরীগণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই পবিত্রবাণীগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-
إلى متى تطلب العلم؟ قال: من المحبرة إلى المقبرة.
‘কতদিন পর্যন্ত মানুষ ইলম হাসিল করবে? জবাবে তিনি বললেন, সিন্দুক থেকে কবর পর্যন্ত।’
নিম্নে হাদীছের ওপর আমলকারী কয়েকজন পূর্বসূরীর ঘটনা তুলে ধরা হলো।
১. ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর ঘটনা:
কারাশী (রহ.) ‘আল জাওয়াহিরুল মুদিয়্যা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর শাগরেদ ইবরাহীম ইবন জাররাহ তামিমী বলেন, আমি ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর মৃত্যুশয্যায় হাজির হলাম। তখন তিনি বেহুঁশ ছিলেন। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে আমাকে বললেন, হে ইবরাহীম! রময়ে জিমারের ক্ষেত্রে উত্তম কে, পদব্রজী নাকি সওয়ারী? আমি বললাম, সওয়ারী। তিনি বললেন, তুমি ভুল বলছ। তখন আমি শুধরে বললাম, তাহলে পদব্রজী। তিনি এবারও বললেন, তুমি ভুল বলছ! তখন আমি বাধ্য হয়ে বললাম, আল্লাহ তা‘আলা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হন, আপনিই তাহলে বিষয়টি বলুন। ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) বললেন, যদি দু‘আর জন্য সেখানে অবস্থান করা হয় তবে পদব্রজে কংকর নিক্ষেপ করা উত্তম। আর যেখানে অবস্থান করা যায় না সেখানে সওয়ারী হয়ে কংকর নিক্ষেপ করা উত্তম।
এরপর আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি তার ঘরের মূল ফটক পর্যন্তও পৌঁছিনি, এমন সময় কান্নার শব্দ পেলাম। তিনি পরম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড আগেও তার মধ্যে ইলম অন্বেষণের প্রতি ছিল এমন ব্যগ্রতা!
২. আহত আবূ যুরআ রাযীর (রহ.) মৃত্যুর আগে হাদীছ বর্ণনা:
আবূ যুরআ (রহ.) আহত অবস্থায় মারা যান। তার কপাল থেকে আঘাতজনিত কারণে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। সে সময় আবূ হাতেম (রহ.) মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করেন-
ما تحفظ في تلقين الموتى: لا إله إلا الله
‘আপনি মৃতের তালকীন সম্পর্কে কী জানেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ?’
জবাবে মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম বলতে শুরু করলেন, মুআয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত…
তিনি কথাটি শেষও করতে পারলেন না। ইত্যবসরে যখম ও মাথায় পট্টি নিয়েই মুহাম্মাদ ইবন যুরআ মাথা উত্তোলন করে বললেন-
حَدَّثَنَا مَالِكُ بْنُ عَبْدِ الْوَاحِدِ الْمِسْمَعِيُّ، حَدَّثَنَا الضَّحَّاكُ بْنُ مَخْلَدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْحَمِيدِ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنِي صَالِحُ بْنُ أَبِي عَرِيبٍ، عَنْ كَثِيرِ بْنِ مُرَّةَ، عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ»
অর্থাৎ তিনি মুআয ইবন জাবালের পূর্বের পূর্ণ সনদ উল্লেখ করে হাদীছ বর্ণনা করলেন যে, যার শেষ কথা হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [আবূ দাউদ: ৩১১৬, সহীহ]
হাদীছটি বর্ণনা করা মাত্রই ঘরে কান্নার রোল উঠল। কারণ হাদীছ বর্ণনা করে হাদীছ অনুযায়ী আমল করেই তিনি দুনিয়াকে সালাম জানালেন।
৩. আবূ জাফর তাবারী (রহ.)-এর মৃত্যুকালীন জ্ঞানসাধনা:
‘আল-জালিসুস সালেহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, জনৈক ব্যক্তি আবূ জাফর তাবারী (রহ.)-এর ইন্তেকালের মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে তার সামনে উপস্থিত হলেন। সে সময় তার সামনে এই দু‘আটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো-
يا سابق الفوت، ويا سامع الصوت، ويا كاسي العظام لحمًا بعد الموت
জবাবে তিনি সহীফা তলব করলেন এবং লিখে দিলেন। তাকে বলা হলো, এই নাযুক সময়েও ইলমচর্চা? উত্তরে তিনি বললেন-
ينبغي للإنسان أن لا يدع اقتباس العلمِ حتى يموت
‘মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে, মৃত্যুক্ষণেও ইলম অন্বেষণের কোনো সুযোগ হাতছাড়া না করা।’ [আল-জালিসুস সালেহ: ৩/২২২]
ইয়াকুত আল-হামাবী (রহ.) ইরশাদুল আদীব গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ফকীহ ওয়ালওয়ালেজী (রহ.) বলেন, আমি আবূ রায়হান মুহাম্মদ ইবন আহমাদ খারেজমী (রহ.) এর কাছে গমন করলাম। সে সময় তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন এবং তার বুকের ভেতর থেকে মৃত্যুর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেই নাযুক সময়ে তিনি আমাকে বললেন, আপনি নানীর মীরাছের মাসআলা সম্পর্কে সেদিন কী যেন বলেছিলেন? আমি বললাম, এই নাযুক সময়ে সেই মাসআলার আলোচনা করতে হবে? তিনি জবাবে বললেন-
يا هذا! أُوَدِّعُ الدنيا وأنا عالم بهذه المسألة ألا يكون خيرًا من أن أُخلِّيها وأنا جاهلٌ بها
‘হে ব্যক্তি! একটি মাসআলা সম্পর্কে অবগত হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া ওই মাসআলা সম্পর্কে জাহেল থেকে বিদায় নেয়ার চেয়ে উত্তম নয় কি?’
আমি তার কথার কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না। তাই মাসআলাটি পুনরায় ব্যক্ত করলাম। আর তিনি মুখস্থ করলেন। এরপর আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম এবং রাস্তার মাঝখানে আছি এমন সময় তার পরিবার থেকে মৃত্যুর কান্না শুনতে পেলাম।
বার্ধক্যেও তারুণ্যের উদ্দীপনা
আজ আমরা তারুণ্যের শাণিত খুনেও নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। অকর্মন্য, অলসতা, গাফলত আমাদেরকে ভয়ানকভাবে জেঁকে ধরেছে। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরীগণ ছিলেন এমন, যাদের ইলম অন্বেষণ ও জ্ঞানসাধনার কাছে বার্ধক্য হার মানতে বাধ্য হতো। বার্ধক্যকে জয় করে চিরতরুণের মতো ইলমী তারাক্কীর জন্য মেহনত করেছেন। বিখ্যাত মনীষী শিহাবুদ্দিন আবূল আব্বাস আহমাদ ইবন আবূ তালেব (রহ.)-এর কথা চিন্তা করুন। তিনি তখন একশত দশবছরের অশীতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু মনের তারুণ্য কত বেগবান! এসময় এমনিতেই বয়সের ছাপে নিষ্কর্ম হওয়ার কথা। তারপর যদি মৃত্যুকালীন সময় হয় তবে তো কথাই নেই। কিন্তু বার্ধক্য আর মৃত্যুর যাকান্দানী ভোঁতা প্রমাণিত হলো তার কাছে। এই বয়সে যেদিন মারা গেলেন সেদিনও ছাত্রদেরকে পুরোদস্তুর দরস দিলেন। যেন দরস ছিল প্রাক-বিবাহ প্রস্তুতি আর মৃত্যু ছিল পালকি! মহান আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগের সময়টাকে তাই মিলিত হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে গ্রহণ করলেন। প্রিয় মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগের সময়টাতে মানুষ কত পুলকবোধ করে! শিহরিত হয়! আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তাই মিলনকে স্বার্থক করার জন্য নানা রকমের প্রস্তুতি নেয়। আমাদের পূর্বসূরীগণও সবচেয়ে প্রিয়বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে সুন্দর প্রস্তুতিটাই নিতেন। সেটা হতো ইলমের চর্চা। বন্ধুর কাছে যে ইলমের দাম বেশি, অনেক বেশি! ইলমই যে তার কাছে সবচেয়ে দামি সুবাস! তাই যাওয়ার আগে দেহে এই ইলমের সুবাসই মেখে যেতেন তারা!
আমাদের কি এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত নয়? যেখানে আমরা তরুণরাই বার্ধক্যপীড়িতদের চেয়েও বেশি বুড়িয়ে গেছি! ফলে অলসতা, গাফলতি আমাদের নিতসঙ্গী হয়েছে! পূর্বসূরীগণদের অনেকের ব্যাপারে জানা যায়, তারা বার্ধক্যেও তরুণদের চেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত, আগ্রহী ছিলেন। বয়সের ভার তাদেরকে নোয়াতে পারেনি। বার্ধক্য যাদের জ্ঞানসাধনার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি।
আবূল ওয়াফা ইবন আকীল হাম্বলী (রহ.) বলেন,
إني لأجد من حِرْصي على العلم وأنا في عَشْرِ الثماني أشدّ مما كنت أجده وأنا ابنُ عشرين سنة
‘আমি ইলম অন্বেষণে আশি বছর বয়সে বিশ বছর বয়সের চেয়ে বেশি স্বাদ ও উদ্দীপনা পাই।’ [আয-যায়ল আলা তাবাকাতিল হানাবিলা: ১/১৪৬]
আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত ইলম ও আলেমের ফযীলত, এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীছ, সাহাবায়ে কেরাম, বুযুর্গানে দীনের বক্তব্য, তাঁদের বিস্ময়কর নানা ঘটনা উল্লেখ করেছি। এ পর্যায়ে আমরা ইলম শিক্ষার কিছু জরুরী আদব ও নিয়ম-কানুন উল্লেখ করার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
ইলম, আলেম, ছাত্র-সহপাঠী, মাদরাসা ও উস্তাদদের সঙ্গে আচার-আচরণ ও ব্যবহারবিধি প্রসঙ্গে:
প্রথম পর্ব:
ইলম অর্জনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
এক. ইলম অর্জনের একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং দুনিয়াবী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের নিয়ত থেকে বেঁচে থাকা।
কেননা ইলম হচ্ছে একটি ইবাদত। যেমন পূর্বসূরীগণ বলেন, طلب العلم عبادة
আর যেহেতু ইলম ইবাদত, তাই এই ইবাদত পালনে সুদৃঢ় ইচ্ছা থাকা চাই। আর সর্বাগ্রে চাই নিয়তের বিশুদ্ধতা। অবশ্য কখনও কখনও এমন অপরিণত বয়সে মাদরাসায় আসা হয় যখন নিয়ত সম্পর্কে তালেবে ইলমের কোনো ধারণাই থাকে না। এরা পরে নিয়ত ঠিক করে নেবে। অনেক সময় শিখতে শিখতেই নিয়ত ঠিক হয়ে যায়। ইবন মুবারক (রহ.) বলতেন,
طلبنا العلم وليس لنا فيه نية
‘আমরা ইলম শিক্ষা করেছি, অথচ আমাদের তখন কোনো নিয়তই ছিল না।’ তবে যখন নিয়ত করার মতো বুঝ হবে তখন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিরই নিয়ত করতে হবে। পূর্বসূরীগণ বলতেন, ইলমের নিয়ত হচ্ছে অজ্ঞতা দূর করে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত-বন্দেগি যথাযথভাবে পালন করার ইচ্ছা করা। আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.) বলতেন,
النية في العلم أن تنوي به رفع الجهل عن نفسك
‘ইলমের নিয়ত হচ্ছে নিজের মধ্যকার জাহালত তথা অজ্ঞতা দূর করা।’
নিজের মধ্যকার কীসের অজ্ঞতা দূরা করা? জাহালত হচ্ছে বড় তিনটি দোষের নাম। যথা, রব সম্পর্কে অজ্ঞতা, দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। প্রতিটি নর-নারীকে কবরে এই তিনটি বিষয়েই প্রশ্ন করা হবে। সুতরাং এই প্রশ্নগুলোর সমাধান থেকে গাফেল থাকার নামই হচ্ছে জাহালত বা অজ্ঞতা। আর ইলমে নাফের মাধ্যমে এই তিনটি বস্তুর অজ্ঞতা দূর করা যায়। রব সম্পর্কে জাহালত দূর করার ফলে বান্দা আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ, একমাত্র তিনিই ইবাদত-বন্দেগীর যোগ্য হওয়া, তাঁর সিফাত ও গুণাবলী, মাহাত্ম্য ও বড়ত্ব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সঠিক ইলম হাসিল করতে সক্ষম হবে। আর দীনের বিষয়গুলো দালিলিকভাবে আত্মস্থ করার ফলে দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর হবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যথাযথ ইলম হাসিল হওয়ায় তাঁর হক, গুণাবলি, উম্মতের প্রতি তাঁর অবদান, তাঁর সুন্নাতের অনুসারী হওয়ার অপরিহার্যতা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান হাসিল হবে।
সুতরাং ইলম হাসিলে প্রথম নিয়ত থাকতে হবে নিজের মধ্যকার অজ্ঞতা দূর করে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর দীন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান হাসিল করা।
এসব নেক নিয়তেই ইলম হাসিল করবে। পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে ইলম হাসিল করবে না। যেমন, ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, যশ-খ্যাতি, সুনাম-সুখ্যাতি কিংবা অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ইত্যাদি হীন উদ্দেশ্যে ইলম হাসিল করবে না। এমনিভাবে জাগতিক কোনো স্বার্থে প্রয়োগ করে ইলম ও তালিমকে অপদস্ত না করা, যদিও তা হাদিয়ার নামে হয়। সুফিয়ান ইবন উয়ায়না (রহ.) বলতেন,
كنت قد أوتيت فهم القرآن فلما قبلت الصرة من أبي جعفر سلبته نسأل الله المسامحة
‘আমাকে কুরআনের সমঝ দান করা হয়েছিল। কিন্তু যখনই আবূ জাফরের কাছ থেকে হাদিয়ার থলি গ্রহণ করেছি তখন তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করুন।’
যে কোনো ইলমী পদক্ষেপের আগে নিয়ত সহীহ করে নেওয়া একান্ত জরুরী। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
وددت أن الخلق تعلموا مني هذا العلمِ على أن لا ينسب إلي حرف منه الله ما ناظرت أحداً قط على الغلبة، ووددت إذا ناظرت أحداً أن يظهر على يديه وقال: ما كلمت أحداً قط إلا وددت أن يوفق ويسدد ويعان ويكون عليه رعاية من الله وحفظ
‘আমি কামনা করি সারা বিশ্বের মানুষ আমার কাছ থেকে ইলম হাসিল করুক কিন্তু কেউ যেন এই ইলমের একটি হরফও আমার দিকে সম্বোধন না করে।’ তিনি আরো বলতেন, ‘আমি কখনই কারো সঙ্গে প্রাধান্য বিস্তার কিংবা বিজয় লাভের জন্য বিতর্ক করিনি। বরং যখন মোনাজারা করেছি তখন মনেপ্রাণে কামনা করেছি যাতে প্রতিপক্ষ হক ও সত্যের এবং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য পান।’
ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) বলতেন,
يا قوم أريدوا بعلمكم الله، فإني لم أجلس مجلساً قط أنوي فيه أن أعلوه
‘হে কওম! আমি ইলম শিক্ষা দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই কামনা করি। কখনও আমি ইলমের মজলিস কায়েম করে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করিনি।’
নিয়ত বিশুদ্ধ করে ইলম শিক্ষা করতে হবে, মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ বা তাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করা যাবে না। শিক্ষা করতে হবে শুধু ইলম অনুযায়ী আমল করার জন্য। তাফসীরে আলবাহরুল মাদীদ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে-
ولما أراد موسى عليه السلام أن يفارقه، قال له: أوصني، قال: لا تطلب العلم لتحدث به، واطلبه لتعمل به. هـ
‘মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর সেই বিখ্যাত ঘটনার পরিসমাপ্তিতে পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সময় মূসা (আ.) খিজির (আ.)-কে কিছু উপদেশ প্রদানের অনুরোধ করলে তিনি তাঁকে উপদেশ দিয়ে বললেন, বাহাছ করার জন্য কিংবা বয়ান করার নিয়তে ইলম শিক্ষা করবেন না, বরং ইলম শিক্ষা করবেন একমাত্র আমল করার নিয়তে।’ [আল-বাহরুল মাদীদ: ১১/২৭৭]
দুই. প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বদা আল্লাহর মোরাকাবা করা
আলেম ও তালেবে ইলমের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে, যাবতীয় কাজকর্ম, চালচলন এবং কথাবার্তায় আল্লাহকে ভয় করা। কেননা, একজন আলেম তার প্রাপ্ত ইলম ও জ্ঞানবৃদ্ধির আমানতদার। এই আমানতদারী রক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইরশাদ করেন-
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَخُونُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ وَتَخُونُوٓاْ أَمَٰنَٰتِكُمۡ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٧ ﴾ [الانفال: ٢٧]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ-রাসূল এবং তোমাদের স্বীয় আমানতের খেয়ানত করো না।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৭}
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন, ‘ইলম মুখস্ত বিদ্যার নাম নয়। ইলম হচ্ছে উপকারিতার নাম।’
আর আলেমের কর্তব্য হচ্ছে সর্বদা ভারিত্ব, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা বজায় রেখে চলা। ইমাম মালেক (রহ.) হারুনুর রশীদকে সম্বোধন করে লিখেছিলেন-
إذا علمت علماً فلْيُرَ عليك أثره، وسكينته وسمته، ووقاره، وحلمه. لقوله صلى الله عليه وعلى آله وسلم: العلماء ورثة الانبياء
‘যখন ইলম হাসিল হবে তখন এর কোনো আছর, ভাবগাম্ভীর্য, সহনশীলতা এবং উচ্চতা আপনার মধ্যে প্রকাশ পাওয়া চাই। কেননা ইলম হচ্ছে নবীগণের উত্তরাধিকার।’
মু‘জামে ত্বাবারানীতে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ، وَتَعَلَّمُوا لِلْعِلْمِ السَّكِينَةَ، وَالْوَقَارَ، وَتَوَاضَعُوا لِمَنْ تَعْلَمُونَ مِنْهُ»
‘ইলম শিক্ষা করো এবং ইলম শিক্ষার জন্য গাম্ভীর্য ও বিনয়ের গুণ অর্জন করো। আর যারা ইলম শিক্ষা করতে আসে তাদের প্রতি বিনয়ী হও।’ [মু‘জামুল আওসাত: ৬১৮৪, যঈফ]
সালফে সালেহীন বলতেন,
حق على العالم أن يتواضع لله في سره وعلانيته ويحترس من نفسه ويقف عما أشكل عليه
‘আলেমের কর্তব্য হচ্ছে প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ তা‘আলার জন্য বিনয়ী হওয়া। নিজের ব্যাপারে সন্ত্রস্ত থাকা এবং যে কাজ প্রশ্নের সম্মুখীন করে তা থেকে বিরত থাকা।’
তিন. ইলমের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করা
আল্লাহ তা‘আল ইলমের যে ইজ্জত ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন পার্থিব কোনো লালসায় পড়ে সেই ইজ্জত ও সম্মান নষ্ট না করা চাই। দুনিয়াদার কোনো লোকের কাছে বিনা কারণে কিংবা অত্যাবশ্যক কারণ ছাড়া আলেমের না যাওয়া উচিত। এমনকি দুনিয়াদার কোনো লোককে ইলম শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের ঘরে না যাওয়া, যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রাজা-বাদশা হন না কেন। বরং ইলমের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তাদেরকেই দরসগাহে আসতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা।
এক্ষেত্রে ইমাম বুখারী (রহ.)-এর ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি জীবনে মোট চারবার বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। চতুর্থ ও সবচেয়ে বড় বিপদটি ছিল ইলমের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে। আর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল তার জীবনের শেষ বয়সে। শেষ বয়সে তিনি বুখারাতেই বসবাস করছিলেন। সে সময় বুখারার আমীর ছিলেন খালেদ যুহলী। তিনি ইমাম বুখারী (রহ.)-এর নিকট এই মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন ঘরে এসে তার সন্তানদেরকে দীনী ইলম শিক্ষা দেন। ইমাম বুখারী (রহ.) বললেন আমীর ও বাদশাদের ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে আমি ইলমে হাদীছকে অপমানিত করতে চাই না। কেউ পড়তে চাইলে সে আমার কাছে এসে আমার দরসে শরীক হয়ে পড়ুক। আমি ফেরিওয়ালা নই যে, এই ইলম নিয়ে বাদশাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবো! এটা ইলমে নববীর মর্যাদার খেলাফ।
তার জবাব পেয়ে আমীর দ্বিতীয় প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি বললেন, তাহলে আপনার দরসে একটা স্বতন্ত্র মজলিস কায়েম করা হোক। সেই মজলিসে কেবল আমার সন্তানেরাই লেখাপড়া করবে, অন্য কেউ তাতে শরীক হতে পারবে না।
ইমাম বুখারী (রহ) এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আমি অন্যদেরকে ইলম হাসিল করা থেকে বঞ্চিত করলাম কিংবা বাধা দিলাম।
আমীর মনে করেছিলেন অন্যদের সঙ্গে তার সন্তানদের পড়ালেখা তার জন্য অবমাননাকর। তাই তিনি আলাদা একটি মজলিস কায়েমের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু যারা এক সঙ্গে বসে ইলম হাসিল করাকে অবমাননাকর ভাবে তাদের জন্য দরসের আলাদা মজলিস কায়েম করা ইমাম বুখারী (রহ)-এর দৃষ্টিতে চরম আপত্তিকর বলে মনে হলো। ফলে তিনি এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমীর খুব বেশি পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ফলে বাধ্য হয়ে ইমাম বুখারী (রহ) বললেন, হ্যাঁ, এক কাজ করা যেতে পারে। আপনি যদি এই মর্মে শাহী ফরমান জারি করেন যে, বুখারীর মজলিসে সাধারণ ছাত্ররা বসতে পারবে না তখন আমি অপরাগ বিবেচিত হবো এবং তখন বিষয়টি ভেবে দেখব। হয়ত ওই সময় আপনার সন্তানের জন্য আলাদা দরস কায়েম করা যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আম জলসার অনুমতি থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কারও জন্য আলাদা মজলিস কায়েম করতে পারব না।
ইমাম বুখারী (রহ)-এর এই প্রস্তাবে আমীর চরম নাখোশ হলেন এবং এর প্রতিশোধ নিতে তিনি তার বিরদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করলেন। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তার নামে তিনি নানারকম মিথ্যা রটনা করতে থাকেন এবং হাজার রকম অপবাদ দেওয়া শুরু করেন। এভাবে তাকে বুখারা থেকে বের করে দেয়ার জোর তৎপরতা শুরু হয় এবং এসব ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও মিথ্যা অপবাদের সূত্র ধরে একপর্যায়ে তাকে বুখারা থেকে বের করে দেয়ার আদেশও জারি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার এই প্রিয় বান্দার বদদু‘আ কার্যকর হতে সময় লাগে নি। ফলে স্বয়ং আমীর খালেদই সীমাহীন অপদস্থ হন। খলীফা তাকে বরখাস্ত করেন এবং তার আদেশে গভর্নরকে গাধায় চড়িয়ে সারা শহর ঘুরানো হয়।
ইসলামী ইতিহাসে এধরনের আরো অনেক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়। একবার খলীফা মাহদী ইমাম মালেক (রহ.)-এর কাছে তার দুই সন্তানকে পড়ানোর জন্য আবেদন করলে তিনি বললেন-
العلم أولى أن يوقر ويؤتى وفي رواية: العلم يزار ولا يزور ويؤتى ولا يأتي وفي رواية: أدركت أهل العلم يؤتون ولا يأتون
‘ইলমের শান হচ্ছে একে সম্মান করা এবং হাসিল করার জন্য ইলমের কাছে আসা। অন্য বর্ণনামতে, ইলম দর্শনার্থ; দর্শনার্থী নয়। একে হাসিল করতে আসতে হয়। এ কারো কাছে যায় না। আমি আহলে ইলমকে পেয়েছি, তারা ইলম বিস্তার করতে কারো কাছে ঘুরে বেড়াতেন না বরং ইলম শিখতে হলে তাদের কাছে আসতে হতো।’
তিনি আরো বলেন, একবার আমি খলীফা হারুনের কাছে গমন করলে তিনি আমাকে বললেন, আপনি বারবার আমাদের কাছে আসবেন। যাতে ঘরের বাচ্চারা আপনার কাছে মুআত্বা পাঠ করতে পারে। ইমাম মালেক (রহ.) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে সম্মানীত করুন। আমি তো দেখছি ইলম আপনাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে!… ইলম কারো কাছে যায় না। ইলমের কাছে যেতে হয়।’
খলীফা বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এরপর বাচ্চাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা মসজিদে যাও এবং অন্যদের সঙ্গে ইলম শিক্ষা করো।
বর্ণিত আছে, একবার হারুনুর রশীদ তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার বসবাসের ঘর আছে? জবাবে তিনি বললেন না। তখন খলীফা তাকে তিন হাজার দিনার দিয়ে বললেন, এগুলো দিয়ে ঘর বানাবেন। ইমাম মালেক (রহ.) দিনারগুলো গ্রহণ করলেন বটে কিন্তু খরচ করলেন না। এর কিছুদিন পর খলীফা ইরাক পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ইমাম মালেক (রহ.)-কে সঙ্গে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। জবাবে ইমাম মালেক (রহ.) বললেন, আপনার সঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা আমার নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
«الْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ »
‘মদীনা তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা অনুধাবন করে।’ [মুসলিম: ১৩৬৩]
অন্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمَدِينَةُ تَنْفِي خَبَثَهَا كَمَا ينْفَى الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ»
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মদীনা নগরী পাপ দূর করে যেভাবে হাপড় লোহার মরিচা দূর করে।’ [শারহু মা‘আনিল আছার: ১৮২৬; বুখারী: ৭২০৯ {বুখারীর বর্ণনা কিছুটা ভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে।]
এরপর তিনি বললেন, এই নিন আপনার দেওয়া সেই দিনারসমূহ। এই দিনারের কারণেই আপনি আমাকে মদীনা ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন। আমি ওই সময়েই এই আশঙ্কা করেছিলাম এবং সে কারণেই দিনারগুলো স্বস্থানে যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আমি কখনই দীনের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেব না।’
সাধারণ মানুষ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সম্মান করতে হবে বটে কিন্তু তাদেরকে তোয়াজ ও মাত্রাতিরিক্ত খাতির করা যাবে না। এক্ষেত্রে সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-এর ঘটনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, হারুনার রশিদ খলীফা হিসেবে নিযুক্ত হলে দেশের প্রায় সব আলেম তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এলেন। কিন্তু সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) এলেন না। অথচ দুইজনের মধ্যে এর আগে খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। নবনিযুক্ত খলীফা হারুনের কাছে ব্যাপারটি কষ্টদায়ক মনে হলো। তাই তিনি সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-এর কাছে একটি চিঠি লিখলেন। যার ভাষা ছিল নিম্নরূপ:
আল্লাহর নামে শুরু করছি। এটি আমীরুল মুমিনীন হারুনের পক্ষ থেকে দীনী ভাই সুফিয়ান ছাওরীর উদ্দেশ্যে লিখিত।
পরসমাচার, হে বন্ধু! আপনি জানেন যে, আল্লাহ তা‘আলা মুমিনীনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। সেই সূত্রেই আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছি। এই বন্ধুত্বের মধ্যে সামান্যতম কৃত্রিমতা আছে বলে আমি মনে করি না। আল্লাহ তা‘আলা যদি আমার ঘাড়ে এই দায়িত্বের বোঝা না চাপাতেন তাহলে অবশ্যই আমি আপনার সমীপে হাজির হতাম এবং তা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও। কেননা আমি আপনার শূন্যতা খুব বেশি অনুভব করছি। আর অন্যান্য পরিচিতজনের সবাই আমার সঙ্গে সাক্ষাত করে গেছেন এবং আমাকে আমার দায়িত্ব গ্রহণের কারণে সাধুবাদ জানিয়েছেন। শুধু আপনি একাই আছেন, যিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেননি। তবে অন্যের তুলনায় আমি আপনার সাক্ষাতকেই বেশি পছন্দ করি।
আমি আমার মালের ভাণ্ডারের মুখ খুলে দিয়েছি। এতে আমি সন্তুষ্ট, আমার চোখ এতে শীতল হয়। এমন এক সুসময়ে আপনার অনুপস্থিতি আমাকে নিদারুণ মর্মাহত করছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে পত্র লেখা। এতে আমি আমার ভালোবাসা ও প্রবল আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছি। হে আব্দুল্লাহ! আপনি তো জানেন মুসলিমের সঙ্গে মুসলিমের সাক্ষাত ও ভ্রাতৃত্বের ফযীলত কত বেশি! সুতরাং এই চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন বলে আশা রাখি।’
চিঠিটা লিখে খলীফা হারুন আব্বাদ তালেকানীর হাতে দিলেন এবং এর গুরুত্ব বুঝিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত তা সুফিয়ান ছাওরীর হাতে পৌঁছে দেয়ার আদেশ দিলেন।
আব্বাদ তালেকানী (রহ.) বলেন, আমি চিঠিটা গ্রহণ করে কুফা অভিমুখে রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে আমি সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-কে মসজিদে দরস প্রদান করতে দেখলাম। আমি মসজিদের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম কিন্তু তিনি আমার দিকে ভ্রূক্ষেপই করলেন না বরং তীর্যকভাবে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আগন্তুকের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’
আব্বাদ বলেন, এরপর তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। অথচ তখন সালাতের সময় ছিল না। আমি মসজিদে প্রবেশ করে তাঁর ছাত্রদের সালাম দিলাম। কিন্তু ছাত্ররাও কেউ সালামের জবাব দিলেন না, এমনকি মাথা পর্যন্ত উঠালেন না।
আমি অনেকক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠলাম। কেউ আমাকে বসার কথাটুকুও বললেন না। তাদের এই আচরণ আমাকে হতবাক করে দিল। অগত্যা আমি দূর থেকেই সুফিয়ান ছাওরীর (রহ.) উদ্দেশ্যে খলীফা হারুনের লেখা চিঠিটি ছুঁড়ে মারলাম।
তিনি চিঠিটি পেয়ে কেঁপে উঠলেন। যেন তাঁর মেহরাবে ভয়ানক কোনো সাপ কিংবা বিচ্চু ঢুকে পড়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পতিত হলেন এবং সালাম ফিরিয়ে জেবে হাত ঢুকালেন এবং পেছনের একজনকে তা পড়ার ইঙ্গিত করে বললেন, আমি ওই বস্তু স্পর্শ করা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি ও তার কাছে ক্ষমা চাই, যে বস্তু (চিঠি) একজন জালেম তার হাতে স্পর্শ করেছে। কিন্তু ছাত্ররা কেউ তা স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়ালেন না। আর তিনিও কাঁপছিলেন, যেন এটা চিঠি নয়- বিষাক্ত সাপ!
অবশেষে একজন ছাত্র চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলেন। তার পড়া শুনে সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) অবাক হয়ে মিটিমিটি করে হাসছিলেন। ছাত্রের পড়া শেষ হলে সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) বললেন, এই চিঠির অপর পিঠেই জালেম বরাবর জবাব লিখে দাও!
কেউ একজন বললেন, হে আব্দুল্লাহ! হারুন একজন খলীফা, তাকে নতুন একটা কাগজে জবাব দিলে ভালো হয় না? তিনি বললেন, জালেমের কাছে চিঠির উল্টো পিঠেই জবাব লিখে দাও। কেননা, সে যদি হালালভাবে তা উপার্জন করে থাকে, তাহলে এটাই যথেষ্ট। আর যদি হারাম উপার্জন হয় তাহলে সে এই হারামের আগুনে জ্বলবে। আর আমরা জালেমের হাত স্পর্শ করা কোনো হারাম বস্তু এখানে রেখে দিতে চাই না। কেননা, তা আমাদের দীনকে বরবাদ করবে। তাকে বলা হলো; চিঠির জবাবে কী লেখা হবে? তিনি বললেন, লিখ:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আল্লাহ তা‘আলার বান্দা সুফিয়ানের পক্ষ হতে আশা-আকাঙ্ক্ষায় ধোঁকা খাওয়া-প্রতারিত হারুনের প্রতি- যার ঈমানের স্বাদ ও কুরআন তিলাওয়াতের মজা কেড়ে নেওয়া হয়েছে- পরসমাচার, তোমাকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছি যে, আমি তোমার বন্ধুত্বের রশি ছিন্ন এবং ভালোবাসার বন্ধন কর্তন করে ফেলেছি। তুমি নিজেই চিঠির মাধ্যমে আমাকে অবহিত করেছ যে, তুমি মুসলিমের সম্পদ উন্মুক্ত করে তার অপব্যবহার শুরু করেছ। আল্লাহর বিধানের বাইরে গিয়ে তা খরচ করছ। তুমি শুধু অন্যায় করেই ক্ষান্ত হও নি। বরং আমাকে তোমার পাপের সাক্ষীও বানিয়েছ!
অতএব, আমি এবং আমার সঙ্গে যারা তোমার চিঠি পাঠের সময় উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই আগামী দিন ন্যায়পরায়ণ মহান বিচারক আল্লাহর কাছে এর যথাযথ সাক্ষ্য পেশ করবেন। হে হারুন! তুমি মুসলিমের সন্তুষ্টি ছাড়া তাদের সম্পদের কোষাগার খুলে দিয়েছ। তোমার কাজে কি যাকাত উসূলকারী, আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ এবং অভাবীরা সন্তুষ্ট? আহলে ইলম এবং কুরআনের বাহকরা কি তাতে সম্মত? ইয়াতিম বিধবা নারীরাও কি তাতে সন্তুষ্ট? অথবা সন্তুষ্ট তোমার প্রজারা?
হে হারুন! তুমি তোমার কোমরের কাপড় বেঁধে নাও এবং জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দাও। বিপদ প্রতিহত করার জন্য চাদর জড়িয়ে নাও। তুমি জেনে রেখ, অতিসত্ত্বর তোমাকে ন্যায়পরায়ণ বিচারকের সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, তোমার কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ মিটে গেছে, ইলম ও যুহদের মজা নিঃশেষ হয়ে গেছে। নেককার ও সৎ লোকের সান্নিধ্য তোমার অপ্রিয় লাগা শুরু হয়েছে। আর তুমি জালেম ও জালেমের সহায়তাকারী হওয়া পছন্দ করছ!
হে হারুন! তুমি সিংহাসনে আরোহন করা মাত্রই রেশমি পোশাক পরিধান করা শুরু করেছ! তোমার দরজার সামনে পর্দা টাঙিয়ে রাব্বুল আলামীনের শক্তির সাদৃশ্যতা অবলম্বন করেছ! এরপর তুমি এমন জালেম প্রহরীদেরকে পর্দার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছ, যারা নিজেরা জালেম, মানুষের প্রতি ইনসাফ করে না। তারা শরাবপানকারীদেরকে দণ্ড দেয় অথচ নিজেরাই শরাব পান করে! তারা ব্যভিচারিদেরকে বেত্রাঘাত করে অথচ নিজেরাই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়! চোরের হাত কাটে আবার গোপনে নিজেরাই চুরি করে! এসব শাস্তি অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার আগে নিজেদের ওপরই কি প্রয়োগ করা উচিত ছিল না?
আগামী দিন কী হবে হে হারুন! যে দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একজন ঘোষক একথার ঘোষণা করবেন যে, জালেম ও জালেমের সহায়তাকারীদেরকে একত্রিত করো। আর সেদিন তুমি ঘাড়ে দুহাত বাঁধা অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার সামনে দণ্ডায়মান হবে?
তোমার ইনসাফ তোমাকে বাঁধন থেকে মুক্তি দেবে নাকি তোমার আশেপাশের জালেমরা তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে? অথবা তুমি তাদের জাহান্নামে টেনে নেবে? যেমন ফেরাউনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
﴿ يَقۡدُمُ قَوۡمَهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فَأَوۡرَدَهُمُ ٱلنَّارَۖ وَبِئۡسَ ٱلۡوِرۡدُ ٱلۡمَوۡرُودُ ٩٨ ﴾ [هود: ٩٨]
‘সে তার সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে এবং তাদেরকে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেখানে তারা প্রবেশ করবে তা কত নিকৃষ্ট স্থান!’ {সূরা হুদ, আয়াত: ৯৮}
হে হারুন! আমি অনুভব করতে পারছি, তুমি তোমার নেককর্ম দেখতে পাবে অন্যের পাল্লায় আর অন্যের পাপ দেখবে তোমার পাল্লায়। বিপদের ওপর বিপদ এবং অন্ধকারের ওপর অন্ধকার। অতএব, হে হারুন! তুমি তোমার প্রজাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের ব্যাপারে সজাগ থাকো।
তুমি আরো জেনে রেখো, এই রাজত্ব ও খেলাফত তোমার কাছে চিরদিনের জন্য আসেনি। অতিসত্ত্বর তা অন্যের কাছে স্থানান্তরিত হবে। দুনিয়া এভাবেই একের পর আরেকজনকে নিয়ে খেলা করে। তাদের মধ্যে কেউ আছে যে পাথেয় সঞ্চয় করে আর কেউ আছে যে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টিকে বরবাদ করে।
তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এরপর তুমি কখনও আর আমার কাছে চিঠি লিখবে না। লিখলে আমি তার জবাব দেব না।
-ওয়াসসালাম
এরপর তিনি চিঠিটা ভাঁজ ও দস্তখত করা ছাড়াই আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আমি তা গ্রহণ করলাম এবং কূফার বাজারের দিকে ছুটলাম। সুফিয়ান ছাওরীর প্রতিটি কথা ও আচরণ আমার মধ্যে রূপান্তরের ঝড় বইয়ে দিল। তার উপদেশমালা সমুদ্রের ঊর্মিমালা হয়ে আমার হৃদয়পাড়ে আছড়ে পড়তে লাগল। বাজারে গিয়ে আমি উচ্চস্বরে ঘোষণা দিলাম- ওই ব্যক্তিকে কে ক্রয় করবে, যে আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় পলায়ন করতে ইচ্ছুক?
বাজারের লোকজন আমার ঘোষণা শুনে দিনার দিরহাম নিয়ে হাজির হলো। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করে বললাম, আমার এসবের প্রয়োজন নেই। বরং একটি পশমের জুব্বা দরকার। এগুলো কে দিতে পারবে?
আমাকে এগুলোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। আমি শাহী লেবাস ছুঁড়ে ফেলে দিলাম এবং ওই মোটা জুব্বা পরিধান করে নগ্নপদে হারুনের দরবারে উপস্থিত হলাম। দরবারের রক্ষী আমাকে এই অবস্থায় দেখে আটকে দিল। আমি পুনরায় অনুমতি চাইলাম। খলীফা আমাকে দেখে ফেললেন এবং আক্ষেপ ও নিজের প্রতি অনুযোগ করে বললেন, ‘প্রেরিত সফল হয়েছে আর প্রেরক ব্যর্থ হয়েছে।’
আমি তার দিকে সেভাবেই চিঠিটি ছুঁড়ে মারলাম যেভাবে সুফিয়ান ছাওরী আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। খলীফা চিঠিটি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করলেন এবং পাঠ করে বিপুল পরিমাণে অশ্রুপাত করলেন।
চিঠির ভাষ্য কতক দরবারী লোককে পীড়া দিল। তাদের একজন প্রস্তাব দিয়ে বলল, আমীরুল মুমিনীন! সুফিয়ান ছাওরী আপনার প্রতি চরম দুঃসাহস দেখিয়েছেন। অতএব তাকে পাকড়াও করে কঠোর সাজা দিন। জেলের ঘানি টানার ব্যবস্থা করে দিন। অন্তত অন্যরা এ থেকে শিক্ষা পাবে।
হারুন বললেন, হে দুনিয়ার দাসকুল! সুফিয়ানকে তার অবস্থায় থাকতে দাও। প্রতারিত ও হতভাগা সে, যার সান্নিধ্যে তোমরা আছো। সুফিয়ান তো সুফিয়ানই সুফিয়ানই!
এরপর তিনি আদেশ দিলেন, প্রতিবার দরবার বসার আগে যেন তার এই চিঠিটি পাঠ করে শোনানো হয়। [আল-আহকামুস সুলতানিয়া: ২/১৬১-১৬৩]
আমাদের পূর্বসূরী আলেমগণ ইলমের ইজ্জত-সম্মান রক্ষার ব্যাপারে এরকমই তৎপর ছিলেন। ইলমের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে কখনও তারা রাজন্যবর্গকে প্রশ্রয় দেননি। ইতিহাসে এরকম হাজারও ঘটনা সংরক্ষিত আছে। খতীব বাগদাদী (রহ.) হাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, একবার আমি হাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.)-এর নিকট গমন করলাম। আমি তার সঙ্গে বসা আছি এমন সময় মুহাম্মাদ ইবন সুলায়মানের দূত দরজায় করাঘাত করল। অতপর সে ঘরে প্রবেশ করে সালাম প্রদান করল এবং মুহাম্মাদ ইবন সুলায়মানের প্রেরিত চিঠি পেশ করল। হাম্মাদ বললেন, তুমি পড়ো। চিঠিতে সালাম ও দু‘আর পর উল্লেখ করা হয়েছে, আমার একটি মাসআলাগত সমাধান প্রয়োজন। দয়া করে চিঠিটি পাওয়ার পর আমার কাছে আগমন করবেন। আপনার কাছ থেকে মাসআলার সমাধান জেনে নেব।’
জবাবে হাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.) বললেন, চিঠির অপর পৃষ্ঠায় লিখে দাও যে, ‘আমরা আমাদের পূর্বসূরীগণকে পেয়েছি তারা অন্যের কাছে যেতেন না। বরং যার সমস্যা হতো তিনিই সমাধানের জন্য আসতেন। অতএব আপনার যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে আপনিই আমার কাছে আসুন। আর আপনি যদি আসেনই তবে একা আসবেন এবং পদব্রজে আসবেন। সঙ্গে কাউকে নিয়ে আসবেন না এবং সওয়ারী হয়েও আসবেন না।’
এর কিছুক্ষণ পর পুনরায় দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা গেল। দরজা খোলা হলে দেখা গেল স্বয়ং মুহাম্মাদ ইবন সুলায়মান উপস্থিত! তিনি ঘরে প্রবেশ করে বললেন, কী ব্যাপার! আপনার দিকে তাকিয়ে প্রথমে আমার সারা শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল যে! তখন হাম্মাদ (রহ.) বললেন,
سمعت ثابتاً البناني يقول: سمعت انس بن مالك يقول: سمعت رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم يقول: إنَّ العالِمَ إذا أراد بعلمِه وجهَ اللهِ هابه كلُّ شيءٍ , وإن أراد أن يكنِزَ به الكنوزَ هاب من كلِّ شيءٍ .
‘আমি ছাবেত বুনানীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি আনাছ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে ইলম হাসিল করে পৃথিবীর সব মাখলুক তাকে সমীহ করে। আর যদি দুনিয়ার কোনো সম্পদ পাওয়ার লোভে ইলম হাসিল করে তবে সে পৃথিবীর সবাইকে ভয় পায় ও সমীহ করে।’ [জামে ছগীর: ৩৮৩; আলবানী, সিলসিলা যয়ীফা: ৩৯২৮, যঈফ]
অবশ্য বিশেষ কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে এবং দীনী কল্যাণের প্রশ্ন হলে সেক্ষেত্রে নিয়ত ঠিক রেখে বিত্তশালী এবং রাজন্যবর্গের কাছে যাওয়াতে দোষ নেই। এমনিভাবে রাজন্যবর্গ যদি ইলমী মাকামের হয় তবে তাদের কাছেও যাতায়াত করাতে দোষ নেই। সালফে সালেহীনের অনেকেই শুধু এসব কারণে কখনও কখনও এরকম লোকদের শরণাপ্নন হয়েছেন এবং তাদের কাছে গেছেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কখনই দুনিয়া কিংবা পার্থিব স্বার্থ ছিল না।
চার. যথাসম্ভব শরীয়ত নির্দেশিত যুহদ, দুনিয়াবিমুখতা, অনাড়ম্বরতার জীবনযাপন করা:
আর আলেমের এ বিষয়ের সর্বনিম্ন অবস্থা হচ্ছে দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করা এবং দুনিয়া হারানোকে পাত্তা না দেয়া। কেননা তারাই পার্থিব জীবনের হীনতা, মূল্যহীনতা ও তাচ্ছিল্যতা, দ্রুত হাতবদল হওয়া, ফেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে বেশি অবগত।
পাঁচ. সর্বদা নিকৃষ্ট ও নিম্নমানের পন্থায় দুনিয়া উপার্জন থেকে বিরত থাকা:
লোভ-লালসা ও সন্দেহের স্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে। এমন কিছু করা যাবে না যাতে নিজের ব্যক্তিত্ব খর্ব ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যদিও তা বাহ্যিকভাবে জায়েযই হোক না কেন। কেননা নিজেকে অপবাদের জায়গা থেকে দূরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে সাধারণ মানুষ অহেতুক সন্দেহে পতিত না হয়। আর কোনো বৈধ কারণে যদি এধরনের কিছুতে অংশগ্রহণ করতেই হয় তবে যে তা প্রত্যক্ষ করেছে তাকে সেই কাজের কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করা। যাতে সে খারাপ ধারণা পোষণ করে গুনাহগার না হয় কিংবা তার ব্যাপারে সন্দেহ করে উপকৃত হওয়ার ধারা ছিন্ন না করে। এ কারণেই একবার রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার সঙ্গে সন্ধ্যার পরে কথা বলা অবস্থায় দু’জন লোক দেখতে পেলে তিনি তাদেরকে দাঁড় করালেন এবং বললেন, এ হচ্ছে আমার স্ত্রী সাফিয়্যা! এর কারণও বর্ণনা করলেন তিনি। তা হচ্ছে শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় চলাচল করে ধোঁকা দেয় এবং অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে। হাদীছটি নিম্নরূপ:
عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَيٍّ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُعْتَكِفًا فَأَتَيْتُهُ أَزُورُهُ لَيْلًا، فَحَدَّثْتُهُ، ثُمَّ قُمْتُ، فَانْقَلَبْتُ، فَقَامَ لِيَقْلِبَنِي، وَكَانَ مَسْكَنُهَا فِي دَارِ أُسَامَةَ، فَمَرَّ رَجُلَانِ مِنَ الْأَنْصَارِ، فَلَمَّا رَأَيَا النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَسْرَعَا، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «عَلَى رِسْلِكُمَا، إِنَّهَا صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَيٍّ» ، فَقَالَا: سُبْحَانَ اللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: «إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنَ الْإِنْسَانِ مَجْرَى الدَّمِ، وَإِنِّي خَشِيتُ أَنْ يَقْذِفَ فِي قُلُوبِكُمَا شَرًّا» ، أَوْ قَالَ: «شَيْئًا»
সাফিয়্যাহ বিনতে হুইয়াই থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফে ছিলেন, আমি রাতে তাঁর সাক্ষাতের জন্য আসি। আমি তার সাথে কথা বলি, অতঃপর রওয়ানা দেই ও ঘুরে দাঁড়াই, তিনি আমাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন। তার ঘর ছিল উসামা ইব্‌ন যায়েদের বাড়িতে। ইত্যবসরে দু’জন আনসার অতিক্রম করল, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে দ্রুত চলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন: থাম, এ হচ্ছে সাফিয়্যাহ বিনতে হুইয়াই। তারা আশ্চর্য হল: সুবহানাল্লাহ হে আল্লাহ রাসূল! তিনি বললেন: নিশ্চয় শয়তান মানুষের রক্তের শিরায় বিচরণ করে, আমি আশঙ্কা করছি, সে তোমাদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে পারে।’ [বুখারী: ৩২৮১; মুসলিম: ২১৭৫]
ছয়. ইসলামী শিআর-নিদর্শন ও বাহ্যিক বিধানাবলি পালনে যত্নবান হওয়া:
যেমন, মসজিদে জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় করা, আম-খাস সকলের মধ্যে সালামের প্রচলন ঘটানো, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে বাধা প্রদান। আর এগুলো করতে গিয়ে প্রভাবশালীদের কষ্ট সহ্য করা এবং এতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। কোনো ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনায় কান না দেয়া। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীর কথা সদা অন্তরে জাগরুক রাখা। যথা-
﴿ يَٰبُنَيَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَآ أَصَابَكَۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ١٧ ﴾ [لقمان: ١٧]
এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীর কষ্টের কথাও মনে করে ইলম প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা ও কষ্টের বিষয়টি মেনে নেয়া। সুন্নাত প্রতিষ্ঠা এবং বিদআত নির্মূলে সচেষ্ট হওয়া। দীনের যাবতীয় বিধান ও আদর্শ প্রতিষ্ঠাকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে স্থীর করা। বিশুদ্ধপন্থায় মুসলিমের কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হওয়া। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণভাবে শুধু স্বাভাবিক বৈধ কাজেই সন্তুষ্ট না হয়ে সর্বোচ্চ সুন্দর ও ভালো কাজে অভ্যস্ত হওয়া। কেননা ওলামায়ে কেরাম হলেন মানুষের লক্ষ্যস্থল ও আদর্শগ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু। তারাই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য দলিল স্বরূপ। তাই যারা জানে না তারা তাদেরকে দেখে অনুস্বরণ করবে, আমল করবে। সুতরাং স্বয়ং আলেমই যদি নিজ ইলম অনুযায়ী আমল না করেন তবে অন্যদের আমল করা তো আরো পরের কথা। এ কারণেই আলেমের পদস্খলনকে অন্য যে কোনো ব্যক্তির পদস্খলনের চেয়ে অনেক ভয়াবহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা তাদের অনুসরণ করে অন্যদেরও পদস্খলন ঘটার ভয় থাকে।
সাত. নফল ও মুস্তাহাব যাবতীয় ভালো কাজ পালনে যত্নবান হওয়া:
শরীয়তপ্রণেতা তথা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ও আদর্শ বুলন্দের জন্য প্রাণপণ মেহনত করা। তাই কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, দিনরাতের বিভিন্ন দু‘আ, বিভিন্ন কাজের শুরু-শেষের দু‘আ, নফল সালাত ও রোজা, হজ-ওমরা পালন করা, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা। আর সাধারণ মানুষের মতো কুরআন তিলাওয়াত না করা। বরং তিলাওয়াতের সময় কুরআনের আদেশ-নিষেধ, হেকমত-প্রজ্ঞা, সুসংবাদ-আজাবের ভয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তা করা। এমনিভাবে কুরআন হিফজ করার পর তা ভুলে যাওয়ার শাস্তির কথাও স্মরণে রাখা। সহজে কুরআন ইয়াদ রাখার পন্থা হচ্ছে অন্তত সাতদিনে একবার মুখস্থ কুরআন তিলাওয়াত করা।
আট. সামাজিক আচার-আচরণে দায়িত্ব ও করণীয়
মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়া। তাদেরকে খানা খাওয়ানো। সাধারণ লোকদের কেউ মূর্খতাবশত ভুল-ভ্রান্তি করে থাকলে ক্ষমা করে দেয়া। মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বেঁচে থাকা। কেউ উপকার করলে তার শোকর আদায় করা। এই গুণটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু আমাদের মধ্যে এর নিদারুণ অভাব। এটা চরম অসৌজন্যতাও বটে। পশ্চিমা দেশগুলো ইসলাম না মানলেও পরোক্ষভাবে ইসলামের আদর্শগুলো খুব ভালো করে অনুসরণ করে। তাদের মধ্যে সৌজন্যতাবোধের ঘাটতি নেই। আপনি সামান্য উপকার করলেও তারা আপনার প্রতি অসামান্য কৃতজ্ঞ দেখাবে। অথচ গুণটি থাকা দরকার ছিল আমাদের মধ্যে, বিশেষ করে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে। তাই এবিষয়ে সচেতন হওয়া চাই। অভাবীর হাজত পূরণে সচেষ্ট হওয়া। প্রতিবেশি ও নিকটাত্মীয়দের হক আদায় করা। এদের কাউকে সালাত তরক কিংবা পাপকাজে লিপ্ত হতে দেখলে হেকমত ও নম্রতার সঙ্গে শোধরানোর চেষ্টা করা। সৎকাজে আদেশ ও পাপকাজে বাধা প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বদা হেকমত অবলম্বন করা। এক্ষেত্রে আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মসজিদে পেশাব করা সেই বেদুইনের সঙ্গে নম্রতা অবলম্বনের ঘটনা দ্বারা শিক্ষা নিতে পারি।
নয়. ধোঁকা-প্রতারণা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বাঁচা
বিরোধীতা-বিদ্রোহ, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো কারণে ক্রোধান্বিত হওয়া, অহংকার-লৌকিকতা, আত্মম্ভরিতা, কৃপণতা, কাপুরুষতা, লোভ-লালসা, গর্ব-দাম্ভিকতা, দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্য কারো সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জাগতিক বিষয়ে অহংকার প্রদর্শন, আত্মপ্রশংসা কামনা করা, আত্মচিন্তা, আত্মস্বার্থ, মানুষের দোষ তালাশের পেছনে লেগে থাকা, নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টা না করা, বংশীয় ও গোত্রীয় গোঁড়ামী, গিবত-চোগলখোরি, মিথ্যাচার, মিথ্যা অপবাদ প্রদান, কাজে ও কথায় অশ্লীলতা, মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ইত্যাদি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যাবতীয় নিম্নমানের ও নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা এবং সুন্দর ও পবিত্র স্বভাব দ্বারা নিজেকে ঋদ্ধ করা। বিশেষভাবে নিকৃষ্ট আখলাক থেকে নিজেকে বাঁচানো। কেননা এটাই যাবতীয় অকল্যাণের মূল। বিশেষ করে হিংসা, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, লৌকিকতা এবং মানুষকে তাচ্ছিল্য করা- এই চারটি মারাত্মক বদস্বভাব থেকে দূরে থাকা। আর এগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হচ্ছে; হিংসা থেকে বাঁচার জন্য এই চিন্তা করা যে, এটা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার হেকমতের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তাছাড়া এতে নিছক আমারই কষ্ট, অন্তরকে খামোখা এই কাজে ব্যাপৃত রাখা ইত্যাদি। عجب النفس বা আত্মম্ভরিতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হচ্ছে এই চিন্তা করা যে; ইলম ও প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও হিকমত, মেধা ও সাহিত্যজ্ঞান ইত্যাদি আল্লাহ তা‘আলার দান। তিনি যখন তখন এসব নেয়ামত ফিরিয়ে নিতে পারেন। وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ ‘আল্লাহ তা‘আলার জন্য এটা মোটেও কঠিন ব্যাপার নয়।’
তাই এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। লৌকিকতার ব্যধি দূর করার জন্য এই ফিকির করা যে, কোনো মাখলুক কারো কোনো উপকার করতে পারে না। ক্ষতিও করতে পারে না। অতএব নিজের আমল কাউকে দেখানোতে লাভও নেই ক্ষতিও নেই। প্রতিদান পেতে হলে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকেই পেতে হবে। তিনি অন্তর্যামী। অতএব নিয়তের এই খারাবীর কারণে আমলের প্রতিদান বরবাদ হয়ে যাবে। কেননা হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ أَبِي بَكَرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ رَاءَى رَاءَى اللَّهُ بِهِ»
‘আবূ বাকরা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি শোনানোর জন্য আমল করে তার আমলের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা কেয়ামত দিবসে অন্যদেরকে শুনিয়ে দেবেন যে, এই লোকটি শুধু মানুষকে শোনানোর এবং দেখানোর জন্যই আমল করত। (এভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে কেয়ামতবাসীর সামনে লাঞ্ছিত করবেন)। এবং যে ব্যক্তি দেখানোর জন্য আমল করবে তার সঙ্গেও অনুরূপ আচরণই করা হবে।’ [বুখারী: ৬৪৯৯; মুসলিম: ২৯৮৬]
আর মানুষকে তাচ্ছিল্য করার ব্যাধি দূর করতে অন্তরে সর্বদা এই আয়াত হাজির রাখা। যথা-
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ ﴾ [الحجرات: ١١]
‘কোনো লোক যেন অন্য লোককে বিদ্রুপ না করে। হতে পারে যাকে বিদ্রুপ করা হয় সে বিদ্রুপকারীর চেয়ে উত্তম।’ {সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১১}
উত্তম-অনুত্তমের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। অতএব বাহ্যিক সাফল্য-ব্যর্থতার ভিত্তিতে কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগ নেই। কুরআন বলে-
﴿ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ ﴾ [الحجرات: ١٣]
‘তোমাদের সেই ব্যক্তিই আল্লাহ তা‘আলার নিকট বেশি সম্মানী, যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ {সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩}
অন্য আয়াতে নিজের শূচিতা দাবির নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যথা-
﴿ فَلَا تُزَكُّوٓاْ أَنفُسَكُمۡۖ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَنِ ٱتَّقَىٰٓ ٣٢ ﴾ [النجم: ٣٢]
‘সুতরাং তোমরা নিজেদের আত্মার পবিত্রতার দাবি করো না। কারণ তিনিই জানেন, তোমাদের মধ্যে কে বেশি মুত্তাকি।’ {সূরা আল-নাজম, আয়াত: ৩২]
সঙ্গে সঙ্গে একথাও ভাবা যে, না জানি যাকে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে সে আমার চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট কত বেশি উত্তম। অতএব অধম হয়ে উত্তমকে তাচ্ছিল্য করা যায় না।
إِن اللهّ تعالى أخفى ثلاثة في ثلاثة وليه في عباده، ورضاه في طاعته، وغضبه في معصيته
‘আল্লাহ তা‘আলা তিনটি বস্তুকে তিনটি বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন। যথা- নৈকট্য ইবাদতের মধ্যে, সন্তুষ্টি আনুগত্যের মধ্যে এবং ক্রোধ নাফরমানীর মধ্যে।’
মনে রাখতে হবে, আজ দুনিয়ায় নিজেকে অন্যের চেয়ে উচ্চতায় ভাবার পরিণাম কেয়ামত দিবসে ভয়াবহ রকমের বিপদের কারণ হতে পারে। যাদেরকে আজ আমি তুচ্ছ ভাবছি, কেয়ামত দিবসে আমার ঠিকানা হতে পারে তাদের পায়ের নিচে। এবিষয়ে একটি স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ করি।
عَنِ الْحَارِثِ بْنِ مُعَاوِيَةَ الْكِنْدِيِّ أَنَّهُ رَكِبَ إِلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يَسْأَلُهُ عَنْ ثَلَاثِ خِلَالٍ قَالَ فَقَدِمَ الْمَدِينَةَ فَسَأَلَهُ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ مَا أَقْدَمَكَ قَالَ لِأَسْأَلَكَ عَنْ ثَلَاثِ خِلَالٍ قَالَ وَمَا هُنَّ قَالَ رُبَّمَا كُنْتُ أَنَا وَالْمَرْأَةُ فِي بِنَاءٍ ضَيِّقٍ فَتَحْضُرُ الصَّلَاةُ فَإِنْ صَلَّيْتُ أَنَا وَهِيَ كَانَتْ بِحِذَائِي وَإِنْ صَلَّتْ خَلْفِي خَرَجَتْ مِنْ الْبِنَاءِ فَقَالَ عُمَرُ تَسْتُرُ بَيْنَكَ وَبَيْنَهَا بِثَوْبٍ ثُمَّ تُصَلِّي بِحِذَائِكَ إِنْ شِئْتَ وَعَنْ الرَّكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعَصْرِ فَقَالَ نَهَانِي عَنْهُمَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ وَعَنْ الْقَصَصِ فَإِنَّهُمْ أَرَادُونِي عَلَى الْقَصَصِ فَقَالَ مَا شِئْتَ كَأَنَّهُ كَرِهَ أَنْ يَمْنَعَهُ قَالَ إِنَّمَا أَرَدْتُ أَنْ أَنْتَهِيَ إِلَى قَوْلِكَ قَالَ أَخْشَى عَلَيْكَ أَنْ تَقُصَّ فَتَرْتَفِعَ عَلَيْهِمْ فِي نَفْسِكَ ثُمَّ تَقُصَّ فَتَرْتَفِعَ حَتَّى يُخَيَّلَ إِلَيْكَ أَنَّكَ فَوْقَهُمْ بِمَنْزِلَةِ الثُّرَيَّا فَيَضَعَكَ اللَّهُ تَحْتَ أَقْدَامِهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقَدْرِ ذَلِكَ
‘একবার হারেছ ইবন মুআবিয়া কিন্দি উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট মদিনায় আগমন করলেন তিনটি বিষয় জানার জন্য। …(হাদীছের দীর্ঘ বর্ণনার পর) আরেকটি হলো, কিস্সা বর্ণনা সম্পর্কে। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এই কাজের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে বললেন, ‘তুমি যা চাও।’ হারেছ কিন্দি বললেন, আমি আপনার সুস্পষ্ট বক্তব্য শুনতে চাই। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমার ভয় হয় তুমি মানুষের মধ্যে কিসসা বর্ণনা করে কোনো পর্যায়ে গিয়ে নিজেকে তাদের চেয়ে উচ্চ ভাবতে শুরু করবে। মনে করবে তাদের তুলনায় তোমার স্থান ছুরাইয়া তারকার মতো উঁচুতে। ফলে কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে তোমার ধারণার পরিমাণ অনুযায়ী তাদের পায়ের নিচে স্থান দেবেন।’ [মুসনাদ আহমাদ: ১১১]
সুতরাং আমাদের নিয়তের স্বচ্ছতা, পবিত্রতা ও শুদ্ধতা থাকা দরকার। বিশেষ করে অন্যকে ছোটো ও তাচ্ছিল্য করার হীনপ্রবৃত্তি থেকে বাঁচা একান্ত কর্তব্য।
উত্তম আখলাকের আরেকটি আলামত হচ্ছে, সার্বক্ষণিক তাওবার আমল জারি রাখা, ইখলাসের সঙ্গে আমল করা, ইয়াকিন মজবুত করা, তাকওয়া-পরহেজাগারী, সবর-ধৈর্য, অল্পেতুষ্টি, যুহদ-দুনিয়াবিমুখতা, তাওয়াক্কুল, আত্মসমর্পণ, অভ্যন্তরীণ নিষ্কলুষতা, ক্ষমা-উদারতা, সদ্ব্যবহার, ইহসান-শোকর, মাখলুকের প্রতি সদয় হওয়া, আল্লাহ তা‘আলা ও মানুষের প্রতি লজ্জাশীলতা এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মহব্বত পোষণ করা ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে এই শেষোক্ত গুণ হচ্ছে সমস্ত ভালোগুণের আধার এবং তা হাসিল হয় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের মধ্য দিয়ে। আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে। যেমন-
﴿ قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١ ﴾ [ال عمران: ٣١]
‘আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসো তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তা‘আলাও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩}১
দশ. নিজেকে সর্বদা মুজাহাদা ও চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা:
কেরাত, মুতালা‘আ, যিকির-ফিকির, সংকলন, লেখালেখি ইত্যাদি নেককাজে কাজে ব্যাপৃত থাকা। খাওয়া-দাওয়া, পেশাব-পায়খানা, প্রয়োজনীয় ঘুম-বিশ্রাম, পারিবারিক হক আদায়, জীবিকা উপার্জন এবং সাংসারিক অতি জরুরী কাজ ছাড়া জীবনের মূল্যবান সময় ইলম-আমল ছাড়া অন্য কাজে ব্যয়িত না করা। এসব কাজ ছাড়া মুমিনের অবশিষ্ট জীবনের কোনো মূল্য নেই। যার ভালোমন্দ উভয় দিন সমান সে তো প্রতারিত। ইলম হাসিল করতে গিয়ে সামান্য রোগ-ব্যাধিকে প্রশ্রয় না দেয়া। আমাদের সলফে সালেহীন রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করতেন ইলমে দীন হাসিল করার মাধ্যমে। কেননা ইলমের দরজা হচ্ছে মিরাছে আম্বিয়া। আর এই মর্যাদা সামান্য রোগ-শোক বরদাশত ও কষ্ট-মেহনত ছাড়া হাসিল হয় না। ইয়াহইয়া ইবন আবী কাছির (রহ.) বলতেন,
لا يستطاع العلم براحة الجسم
‘শারীরিক সুখ বজায় রেখে ইলম হাসিল করা যায় না।’
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «حُفَّتِ الْجَنَّةُ بِالْمَكَارِهِ، وَحُفَّتِ النَّارُ بِالشَّهَوَاتِ»
‘আনাছ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জান্নাত সাজানো হয়েছে কষ্টকর বস্তুর আবরণ দিয়ে। আর জাহান্নাম সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তি দ্বারা।’ [মুসলিম: ২৮২২; বুখারী: ৬৪৮৭]
অর্থাৎ আমলের কষ্ট মাড়াতে পারলেই কেবল জান্নাতের বাধা ডিঙানো যাবে।
কবি বলেন,
تريدين إدراك المعالي رخيصة … و لا بد دون الشهد من إبر النحل
‘তুমি স্বল্পমূলে উচ্চমর্যাদা হাসিল করতে চাও? মনে রেখো, মধুমক্ষিকার হুল খাওয়া ছাড়া মধু হাসিল হয় না।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) সম্পর্কে রবী (রহ.) বলেন,
لم أر الشافعي آكلاً بنهار ولا نائماً بليل لاشتغاله بالتصنيف،
‘আমি ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-কে দিনে খানা খেতে এবং রাতে ঘুমাতে দেখিনি। কেননা সর্বদা মুতালাআ‘ জ্ঞানসাধনা এবং সংকলন ও লেখালেখিতেই ব্যস্ত থাকতেন তিনি।’
এগার. ইলম হাসিলে লজ্জাবোধ না থাকা:
যে বিষয়ের ইলম নেই তা হাসিল করার ব্যাপারে কোনোরুপ লজ্জাবোধ করা উচিত নয়। এমনকি যদি বয়স, পেশা, মর্যাদা, সম্মান ও সবদিক দিয়ে নিজের চেয়ে কম অবস্থানের লোকের কাছ থেকেও তা হাসিল করতে হয় তাতেও লজ্জাবোধ করতে নেই। বরং ইলম ও হিকমত হাসিলের ব্যাপারে সর্বদা এই হাদীছের কথা স্মরণে রাখা চাই-
الحكمة ضالة المؤمن يلتقطها حيث وجدها
‘ইলম ও হিকমত হচ্ছে মুমিনের হারানো সম্পদ।’ সুতরাং তা যেখানেই পাওয়া যাবে মুমিন সেখান থেকেই যেন তা সংগ্রহ করে।
কোনো ব্যক্তি কি নিজের হারানো মূল্যবান সম্পদ রিক্সাওয়ালা বা কুলি-মজদুর পেয়ে থাকলে তার কাছ থেকে তা ছাড়িয়ে নিতে লজ্জাবোধ করে? তবে এরচেয়ে হাজারগুণ মূল্যবান সম্পদ ইলম হাসিল করতে ব্যক্তি বিশেষের দোহাই দিয়ে নিজেকে বঞ্চিত করার অর্থ কী?
মনে রাখতে হবে চেষ্টা ও মুজাহাদা ছাড়া কোনো কিছুই অর্জিত হয় না। এ সম্পর্কে একটি হাদীছ উল্লেখ করা যেতে পারে:
عَنِ الأَحْنَفِ بْنِ قَيْسٍ ، عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ، قَالَ: إن داود عَلَيْهِ السَّلاَمُ قَالَ: يَا رَبِ إنَّ بَنِي إسْرَائِيلَ يَسْأَلُونَك بِإِبْرَاهِيمَ ، وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ، فَاجْعَلْنِي يَا رَبِّ لَهُمْ رَابِعًا ، قَالَ: فَأَوْحَى اللَّهُ إلَيْهِ: يَا دَاوُد ، إنَّ إبْرَاهِيمَ أُلْقِيَ فِي النَّارِ فِي سببي فَصَبَرَ فِيَّ وَتِلْكَ بَلِيَّةٌ لَمْ تَنَلْك ، وَإِنَّ إِسْحَاقَ بَذَلَ مهجة دمه في سببي فَصَبَرَ , وََتِلْكَ بَلِيَّةٌ لَمْ تَنَلْك ، وَإِنَّ يَعْقُوبَ أَخَذَتُ حَبِيبُهُ حَتَّى ابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ فَصَبَرَ ، وَتِلْكَ بَلِيَّةٌ لَمْ تَنَلْك
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একবার নবী দাউদ (আ.) আল্লাহ তা‘আলার কাছে আবেদন জানিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! বনী ইসরাঈলের লোকেরা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের নামের উসিলায় আপনার কাছে প্রার্থনা করে। আমাকে আপনি তাদের চতুর্থজন বানিয়ে দিন। জবাবে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করলেন, হে দাউদ! নবী ইবরাহীম আমার জন্য অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো, অথচ তুমি সেই কষ্ট-মুজাহাদার সম্মুখীন হওনি। নবী ইসহাক আমার কারণে নিজের দেহের রক্ত প্রবাহিত করেছিল অতপর আমার রেজামন্দির জন্য ছবর করেছিল। অথচ তুমি সেরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওনি। আর ইয়াকুবের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু (তথা সন্তান) ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল আর সে তার অপেক্ষায় দুই চোখ সাদা করা সত্ত্বেও আমার জন্য সবর করেছিল। অথচ তুমি সেই কষ্ট-মুজাহাদা করো নি।’ [মুসান্নাফ ইবন আবি শায়বা: ৩৫৪০৩]
আলোচ্য হাদীছে একথার শিক্ষা পাই যে, কষ্ট-মুজাহাদা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া উঁচু মাকাম হাসিল করা যায় না। সাঈদ ইবন জুবায়ের (রহ.) বলেন,
لا يزال الرجل عالماً ما تعلم فإذا ترك التعلم وظن أنه قد استغنى واكتفى بما عنده فهو أجهل ما يكون
‘একজন ব্যক্তি কখনই আলেম হতে পারবে না, যদি না সে অবিরাম ইলম হাসিল করতে থাকে। আর যখন সে ইলম অন্বেষণ ছেড়ে দেবে এবং একথা ভাববে যে, সে যথেষ্ট পরিমাণ ইলম শিখে ফেলেছে এবং তার কাছে যা আছে তা তার জন্য যথেষ্ট, তবে সে যা শিখেছে তার চেয়ে বেশি অজ্ঞ ও জাহেল।’
জনৈক কবি বলেন,
وليس العمى طول السؤال وإنما … تمام العمى طول السكوت على الجهل
‘বারবার প্রশ্ন করা মূর্খতার আলামত নয়। বরং মূর্খতার আলামত হচ্ছে না জানা সত্ত্বেও প্রশ্ন না করা।’
আমাদের পূর্বসূরীগণ না জানা বিষয় স্বীয় ছাত্রদের কাছ থেকে শিখতেও লজ্জাবোধ করতেন না। শাফেয়ী (রহ.)-এর ছাত্র হুমায়দী (রহ.) বলেন,
صحبت الشافعي من مكة إلى مصر فكنت أستفيد منه المسائل وكان يستفيد مني الحديث
‘আমি ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর সঙ্গে মক্কা থেকে মিসর পর্যন্ত সফর করেছি। সফরের পুরো সময় আমি তার কাছ থেকে শিখতাম বিভিন্ন মাসআলা। আর তিনি আমার কাছে শিখতেন হাদীছ।’
সাহাবাগণ তাবেঈগণ থেকে ইলম শিক্ষা করতে লজ্জাবোধ করতেন না। আর এরচেয়ে বড় দলিল কী হতে পারে যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ শাগরেদ উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করতেন?
বারো. যোগ্যতার ভিত্তিতে লেখালেখির মাধ্যমে ইলমের প্রসার ঘটানো:
ইলমচর্চার ধারাবাহিকতা সাদাকায়ে জারিয়ায় পরিণত করতে যোগ্যতার শর্তে সংকলন ও তাসনীফ-তালীফের কাজ করা উচিত। সংকলন ও তাসনীফ-তালীফের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে খতীব বাগদাদী (রহ.) বলেন,
يثبت الحفظ، ويذكي القلب، ويشحذ الطبع، ويجيد البيان، وبكسب جميل الذكر وجزيل الأجر، ويخلده إلى الابد
‘(লেখিলেখি) এর দ্বারা হেফজ শক্তিশালী, অন্তর ধারালো, তবিয়ত সুচারু এবং বর্ণনা তীক্ষ্ন হয়। যুগ যুগ ধরে প্রশংসা জারি থাকে এবং ছাওয়াব হাসিল হয় এবং এটা তাকে শেষদিন পর্যন্ত অমর করে রাখে।’ যেমন বলা হয়-
يموَت قوَم فيحيى العلم ذكرهم … و الجهل يلحق أمواتاً بأموات
‘জাতি মরে যায় কিন্তু ইলম তাদের স্মরণ জীবিত রাখে। আর জাহেলরা মরার পর মৃতদের সঙ্গে মিলিত হয়।’
আরেকজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন,
علم الإنسان ولده المخلد
‘মানুষের ইলম হচ্ছে তার অমর সন্তান।’
আবূল ফাতহ আলী ইবন মুহাম্মাদ আলবুস্তী বলেন,
يقولون ذكر المرء يبقى بنسله … و ليس له ذكر إذا لم يكن نسل
فقلت لهم نسلي بدائع حكمتي … فمن سره نسل فإنا بذا نسلو
‘মানুষ বলে, বংশ দ্বারা মানুষ স্মরণীয় হয়, এর দ্বারা তার নাম বাকি থাকে। তাই যদি বংশ না থাকে তবে কেউ তাকে স্মরণ করে না। আমি তাদেরকে বলব, আমার বংশ হচ্ছে আমার ইলম ও হেকমতের দুষ্প্রাপ্যতা। সুতরাং কেউ যদি স্মরণকারী বংশ চায় তবে সে যেন এই পথই বেছে নেয়।’
আর সংকলনের ক্ষেত্রে মানুষের হাতে নেই এমন বিষয় বেছে নেওয়া কিংবা পুরান বিষয় হলে তাতে নতুনত্ব আনতে আলোচনার আঙ্গিক পরিবর্তন করে সংকলনের কাজ সম্পন্ন করা প্রশংসনীয়। সংকলনের ক্ষেত্রে অতি বিস্তারিত আলোচনা কিংবা বুঝতে অক্ষম সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উভয়টি পরিহার করা উচিত। বারবার পাঠ ও অসংখ্যবার নজর দেওয়া ছাড়া পাণ্ডুলিপি না ছাড়া। সংশোধন ও পরিমার্জন করার পরই কেবল পাণ্ডুলিপি ছাড়া। তবে যোগ্যতা অর্জন করা ছাড়া এসব কাজে হাত না দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা এটা নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট এবং পাঠককে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়া আর কিছু নয়।
দ্বিতীয় পর্ব:
দরস বিষয়ে উস্তাদের করণীয়
এক. দরসের মজলিসে বসার পূর্বে সকল প্রকার নাপাকি থেকে দেহ ও কাপড় পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করা এবং সম্ভব হলে সুগন্ধি ব্যবহার করা। কাপড় পরিধানের ক্ষেত্রে যমানার নেককার লোকদের অনুসরণ করা, যাতে ইলম ও শরীয়তের মর্যাদা বুলন্দ হয়। ইমাম মালেক (রহ.) হাদীছের দরসে বসার আগে গোসল করতেন, সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, নতুন কাপড় পরিধান করতেন এবং মাথার ওপর চাদর ঝুলিয়ে দিতেন। অতপর দরসের মসনদে উপবেশন করতেন। আর দরস শেষ না হওয়া পর্যন্ত মজলিসে সুগন্ধিযুক্ত কাঠি জ্বালিয়ে রাখতেন। তিনি বলতেন,
أحب أن أعظم حديث رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم
‘আমি এভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে ভালোবাসি।’
বস্তুত সাধ্য থাকা অবস্থায় কাপড়-চোপড়ে শান-শওকত অবলম্বন করা মন্দ বা নিন্দনীয় নয়। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
أجد الثياب إذا اكتسيت فإنها … زين الرجال بها تعز وتكرم
دع التواضع في الثياب تحرياً … فالله يعلم ما تجن وتكتم
فرثاث ثوبك لا يزيدك زلفة … عند الإله وأنت عبد مجرم
و بهاء ثوبك لا يضرك بعد أن … تخشى الإله وتتقي ما يحرم
‘কাপড় নতুন ও পরিচ্ছন্ন রাখো। কেননা তা পুরুষের সৌন্দর্য এবং এর দ্বারা তুমি সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে। কাপড়ের ক্ষেত্রে বিনয় পরিহার করো। কেননা তুমি মনে যা গোপন করো আল্লাহ তা‘আলা তা জানেন। জীর্ণশীর্ণ বস্ত্র তোমাকে রবের নিকটবর্তী করে না; যদি তুমি অপরাধী হও। পক্ষান্তরে বস্ত্রের চাকচিক্য তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, যদি তুমি প্রভুকে ভয় করো।’
দরসে যাওয়ার আগে দুই রাকাত ইস্তেখারা সালাত আদায় করা উচিত (যদি মাকরূহ সময় না হয়)। অবশ্য প্রত্যেক ব্যক্তির দিনে অন্তত একবার এই সালাত আদায় করা দরকার। জাহেলী যুগের লোকেরা তাদের সব কাজ শুরু করার আগে استقسام بالأزلام তথা ভাগ্য গণনার শর দ্বারা শুরু করত। ইসলাম এর বিরুদ্ধে এমন এক পন্থা বাতলে দিয়েছে যাতে তাওহীদ ও একত্ববাদ, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মুখাপেক্ষিতা ও নিজের সবকিছু তার ওপর হাওয়ালা করার অনুশীলনী রয়েছে। অতপর নশরে ইলম, তাবলীগে দীন, শরঈ বিধানের প্রচার-প্রসার, রবের হুকুম-আহকাম মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং ইলম বৃদ্ধির নিয়তে দরসে গমন করবেন। দরস শুরু করার আগে সলফে সালেহীনের জন্য দু‘আ করবেন। দরসের উদ্দেশ্যে কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে এই দু‘আ পাঠ করা উচিত-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَضِلَّ أَوْ أُضَلَّ أَوْ أَزِلَّ أَوْ أُزَلَّ أَوْ أَظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ أَوْ أَجْهَلَ أَوْ يجْهَلَ عَلَيَّ
সেই সঙ্গে নিম্নোক্ত দু‘আটিও পাঠ করা চাই-
بسم الله توكلت على الله لا حول ولا قوة إلا بالله
দরসের মজলিসে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার জিকির জারি রাখা উচিত। মজলিসে পৌঁছার পর সর্বপ্রথম উপস্থিত সকলকে সালাম প্রদান করা চাই। অতপর আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাওফীক ও সাহায্য কামনা করে উস্তাদ দরস শুরু করবেন। চেষ্টা করবেন কেবলামুখী হয়ে দরসের মজলিসে উপবেশন করতে। কেননা হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيه وسَلَّم: أَكْرَمُ الْمَجَالِسِ مَا اسْتُقْبِلَ بِهِ الْقِبْلَةُ
‘ওই মজলিস সর্বোত্তম যা কিবলামুখি হয়।’ [মু‘জামুল আওসাত: ৮৩৬১]
অত্যন্ত বিনয়, নম্রতা, গাম্ভীর্যতার সঙ্গে চারজানু অথবা মাকরূহ নয় এমন যে কোনো পন্থায় উপবেশন করবেন। কিন্তু এক পা উঠিয়ে, পা ছড়িয়ে দিয়ে, ডানদিক কিংবা বামদিক অথবা পেছনের দিকে কোনো বস্তুর সঙ্গে হেলান দিয়ে উপবেশন করা উচিত নয়। দরসের মজলিসে অহেতুক হাসি-মশকরা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। কেননা এর দ্বারা নিজের ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য হ্রাস পায়। যেমন বলা হয়-
من مزح استخف به، ومن أكثر من شيء عرف به
‘যে অহেতুক হাসি-মশকরা করে সে এর দ্বারা হালকা হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি যে কাজ বেশি করে সে সেই কাজ দ্বারা পরিচিত হয়।’
ক্ষুধা, পিপাসা, দুশ্চিন্তা, রাগ-ক্রোধ, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা কিংবা অতিরিক্ত গরমের সময় এবং মানসিক পেরেশানির অবস্থায় দরস দেওয়া উচিত না। কেননা এসব পরিস্থিতিতে দরস দিলে অনেক সময় ভুল উত্তর কিংবা ভুল ফাতাওয়া দেয়ার আশঙ্কা থাকে।
তিন. মজলিসে একটু উঁচু স্থানে উপবেশন করা বাঞ্ছনীয়। উপস্থিত লোকদের মধ্যে ইলম ও বয়সের দিক দিয়ে জৈষ্ঠকে বিশেষ সম্মান করা কাম্য। আর অবশিষ্টদের সঙ্গেও কোমল ব্যবহার করা চাই। দরসে শরীক সকলকে সালামের মাধ্যমে সম্মান জানানো, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কথাবার্তা বলা শোভনীয়। উপস্থিত ছাত্রদের প্রতি প্রয়োজনের সময় পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে তাকানো এবং বক্রভাবে না তাকানো। কেউ যে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কিংবা দরস বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তার সঙ্গে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে কথা বলা এবং উত্তর প্রদান করা একজন আদর্শ উস্তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রশ্নকর্তাকে দুর্বল ভেবে তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা অহংকারের লক্ষণ। এটা উস্তাদের জন্য কখনই মানানসই নয়।
চার. যে কোনো বিষয়ের দরস শুরু করার আগে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে নেওয়া উত্তম। কেরাত পাঠ সমাপ্ত হওয়ার পর নিজের জন্য, ছাত্রদের জন্য এবং সকল মুসলিমের জন্য দু‘আ করা যেতে পারে। অতপর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পাঠ এবং হামদ-ছানা ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ করবেন। এরপর সম্ভব হলে ইমাম, মুজতাহিদ, স্বীয় উস্তাদ-মাশায়েখে কেরাম ও মা-বাবার জন্য বিশেষ দু‘আ করে তারপর দরস শুরু করবেন।
পাঁচ. একাধিক দরসের বিষয় হলে মর্যাদার দিক বিবেচনা করে একটিকে আরেকটির আগে রাখা উচিত। সুতরাং প্রথমে তাফসীরুল কুরআন, তারপর হাদীছ, এরপর উসুলে দীন, উসূলে ফিকহ, অতপর ইখতেলাফী বিষয়, নাহব-সরফ ইত্যাদি পাঠদানের ব্যবস্থা করা উচিত। দরসে যেখানে বিরতি দেওয়ার সেখানে বিরতি দেওয়া এবং যেখানে সবক চালিয়ে নেওয়া দরকার সেখানে চালিয়ে নেওয়া ভালো। দীনের বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে এমন কিছু দরসে উপস্থাপন করলে তার জবাব দিতে বিলম্ব করা উচিত নয়। হয়ত ওই বিষয় ও তার জবাব একসঙ্গে উল্লেখ করতে হবে নতুবা কোনোটাই উল্লেখ করা যাবে না। আর দরস বিরক্তিকর দীর্ঘ কিংবা বুঝতে অক্ষম সংক্ষিপ্ত করাও অনুচিত। এসব ক্ষেত্রে ছাত্রদের গ্রহণ ক্ষমতার কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
ছয়. দরসে প্রয়োজনের চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলা শোভনীয় নয়। আবার বেশি নিচু স্বরেও হওয়া অনুচিত। পাশে অন্য দরস চললে তাদের যেন সমস্যা না হয় সেটা উস্তাদ-ছাত্র সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা নিম্নস্বর পছন্দ এবং উচ্চস্বর অপছন্দ করতেন। বর্ণিত হয়েছে-
إن الله يحب الصوت الخفيض ويبغض الصوت الرفيع
‘আল্লাহ তা‘আলা নিম্নস্বর পছন্দ এবং উচ্চস্বর অপছন্দ করেন।’ [মুসনাদে উমর]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল এমনভাবে কথা বলা যাতে শ্রোতারা তা উপলব্ধি করতে পারে এবং তিনি কথা শেষ করে কিছুটা বিরতি দিতেন, যাতে কেউ কোনো বিষয়ে না বুঝলে জিজ্ঞেস করতে পারে। আর ছাত্রদের উচিত, উস্তাদের কথা শেষ করতে দেওয়া এবং কোনো কিছু জানার প্রয়োজন হলে তিনি নিজ থেকে কথা থামালে তখন জিজ্ঞেস করা। অন্যথায় আলোচনার বিষয় বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-কে দরসে মধ্যে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন,
نفرغ من هذه المسألة ثم نصير إلى ما تريد
‘আগে আমার কথা শেষ করি তারপর তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে।’
দরসে উপস্থিত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হক বস্তু জানা। অতএব হক জাহির হয়ে যাওয়ার পর তা সহজে মেনে নিতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা অনেক সময় তা ঝগড়া ও মনমালিন্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই মজমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গলের মাধ্যম বলে মনে করতে হবে। আর স্মরণে থাকবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী-
﴿ لِيُحِقَّ ٱلۡحَقَّ وَيُبۡطِلَ ٱلۡبَٰطِلَ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُجۡرِمُونَ ٨ ﴾ [الانفال: ٨]
‘যাতে তিনি সত্যকে সত্য প্রমাণিত করেন এবং বাতিলকে বাতিল করেন, যদিও অপরাধীরা তা অপছন্দ করে।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৮}
অর্থাৎ হক সাব্যস্ত ও বাতিল প্রকাশিত করার নিয়তে দরস প্রদান ও গ্রহাণ করা।
আট. দরসে কেউ শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করলে কিংবা হাসি-তামাশা, অন্যের সঙ্গে কথা বলে, অমনোযোগী হয়, বিনা প্রয়োজনে উচ্চবাচ্য করে, সঙ্গীদের কাউকে বিদ্রুপ করে, হক জাহির হয়ে যাওয়ার পরও তা মানতে সংকোচ করে কিংবা দরসের জন্য অশোভনীয় কোনো কাজ করে তবে তাকে শাসানো উস্তাদের একান্ত দায়িত্ব। অবশ্য এরজন্য হেকমত অবলম্বন করা এবং এমন কোনো পন্থা গ্রহণ করা যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।
নয়. দরসের আলোচনায় ইনসাফের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। প্রশ্নকর্তার জ্ঞানের পরিধি বিবেচনা করে তার উত্তর দিতে হবে। বুঝতে অক্ষম এমন তাফসিলী জবাব প্রদান করা ঠিক নয়। নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে তার আকল অনুযায়ী আচরণ করা। আর কোনো ছাত্র যদি নিজের না জানা বিষয়ে প্রশ্ন করে তবে নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া- لا أعلم ‘আমি জানি না।’
বস্তুত এটা আদৌ দোষের কিছু নয়। বরং সৎসাহস ও ইলমী আমানত রক্ষার আলামত। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
يا أيها الناس من علم شيئاً فليقل به ومن لم يعلم فليقل الله اعلم فإن من العلم أن يقول لما لا يعلم: الله أعلم.
‘হে লোক সকল! যে ব্যক্তি জানে কেবল সেই যেন কথা বলে। আর যে জানে না সে যেন বলে, ‘আল্লাহই ভালো জানেন’। কেননা না জানা বিষয়ে ‘আল্লাহই ভালো জানেন’ বলাও ইলমেরই এক অংশ।’
জনৈক পূর্বসূরী মনীষী বলেছেন-
لا أدري نصف العلم.
‘আমি জানি না বলতে পারা ইলমের অর্ধেক।’
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
إذا أخطأ العالم لا أدري أصيبت مقاتله
‘যে আলেম ‘আমি জানি না’ কথাটি বলতে ভুলে যায় তার কথা ভুলে পতিত হয়।’
শুধু নিজেই নয়, শিক্ষার্থীদেরকেও এ কথাটির প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে যে, ‘আমি জানি না’ কথাটি বললে সম্মান কমে না বরং বাড়ে। কেননা হাজার হাজার মাসআলা থেকে দুয়েকটি জানার বাইরে থাকা আদৌ দোষের বিষয় নয়। তাই এ কথাটি তার আমানতদারী, সততা, বিশ্বস্ততা, মানসিক স্বচ্ছতা এবং রবকে ভয় করার আলামত।
সালফে সালেহীন বলেন, কথাটি বলতে কেবল তারাই সংকোচ ও লজ্জাবোধ করে, যাদের দীনদারী দুর্বল এবং আল্লাহ তা‘আলাকে যথাযথভাবে ভয় করে না। কেননা, জানি না বলে মানুষের চোখ থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে আল্লাহ তা‘আলার চোখ থেকে পড়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও না জানা সত্ত্বেও তা বলার কারণে পরে ভুল ধরা পড়ে। ফলে মানুষের চোখে বড় হওয়ার নিয়তে বলতে গিয়ে উল্টো তাদের দৃষ্টিতে ছোট হয়ে যায়। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই ওলামায়ে কেরামকে এই শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। খিজির (আ.) ও মূসা (আ.)-এর ঘটনা এর প্রমাণ।
দশ. দূর থেকে আগত তালেবে ইলমের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা চাই। তাদের প্রতি অধিক স্নেহসুলভ আচরণ করা দরকার। যাতে তার একাকীত্ব ঘুচে যায়। আর তার দিকে বারবার অপরিচিতের দৃষ্টিতে তাকানো কাম্য নয়। কারণ এতে তার মানসিক অবস্থা ভেঙে যায়।
এগার. দরস শেষে والله أعلم কথা বলার প্রচলন আছে। তবে উত্তম হলো দরস শেষ করার আগে এমন কোনো কথা বলা যা দরস শেষ হওয়ার আলামত বলে অনুভূত হয়। দরস শেষ হওয়া মাত্রই উস্তাদ মজলিস থেকে উঠবেন না। বরং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন। এতে বিশেষ ফায়েদা রয়েছে। যেমন কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে সে ওই সময়ে তা জিজ্ঞেস করতে পারবে। তাছাড়া ছাত্রদের ভীড়ে পড়ার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হবে না। মজলিস শেষ করে দাঁড়ানোর মুস্তাহাব দু‘আর কথা ভুলবেন না। যথা-
«سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ »
‘তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসার সাথে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নাই। আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার দিকে তওবা (প্রত্যাবর্তন) করছি।’ [তিরমিযী: ৩৪৩৩]
বারো. যে বিষয়ে জানাশোনা নেই দরসে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করাই ঠিক নয়:
কেউ এ রকম কথা ওঠালে তা তড়িৎ থামিয়ে দেয়াই উত্তম। কেননা এটা দীন নিয়ে তামাশা করা এবং মানুষের মধ্যে নিজেকে বড় করে তোলার মিথ্যা প্রয়াস। এ ব্যাপারে হাদীছে কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُتَشَبِّعُ بِمَا لَمْ يُعْطَ كَلَابِسِ ثَوْبَيْ زُورٍ»
‘যাকে যা দেওয়া হয়নি তার সেটার দাবিদার মিথ্যার পোশাক পরিধানকারীর ন্যায়।’ [বুখারী: ৫২১৯; মুসলিম: ২১২৯]
ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) বলেন,
من طلب الرياسة في غير حينه لم يزل في ذل ما بقي
‘যে সময় আসার আগেই নেতৃত্ব চায়, সে অবশিষ্ট জীবন লাঞ্ছনার মধে কাটায়।’
এছাড়া এর দ্বারা শ্রোতারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তারা ভুল জিনিসের জ্ঞান নিয়ে পরবর্তী জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হয়। আবূ হানীফা (রহ.)-কে বলা হলো-
في المسجد حلقة ينظرون في الفقه فقال الَهُمْ رأس؟ قالوا: لا قال لا يفقه هؤلاء أبداً
‘এক মজলিসে ফিকহের আলোচনা চলছে। তিনি বললেন, তাদের কোনো যিম্মাদার আছে কি? তারা জানালেন, না। তিনি বললেন, এরা কখনই ফিকহ হাসিল করতে পারবে না।’
তৃতীয় পর্ব:
ছাত্রদের সঙ্গে উস্তাদের আচার-আচরণ
এক. তালীম ও শিক্ষাদীক্ষা প্রদানকে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন, ইলমের প্রচার-প্রসার, ইয়াহইয়ে দীন, হক জাহির ও দায়েম রাখা, বাতিল ধ্বংস করা, আলেমের সংখ্যা বাড়িয়ে উম্মতের কল্যাণ বৃদ্ধি করা, এদের সর্বশেষ ব্যক্তি থেকেও সদকায়ে জারিয়ার একটি অংশ এবং তাদের পক্ষ থেকে রহমত প্রাপ্তির দু‘আ লাভ, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ইলমের সিলসিলায় প্রবিষ্ট করা এবং দীনের বাহক ও ইলমে ওহীর ধারকের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নেক কাজের অংশ বলে মনে করা চাই। কেননা ইলমে দীন শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়া দীনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
দুই. তালেবে ইলমের ইখলাস নাই- এই অযুহাতে তাকে ইলম থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না। কেননা তার নেক নিয়তের আশা সুদূরপরাহত নয়। অনেক সময় তালেবে ইলমের সহীহ সমঝ না থাকার কারণে প্রথমে নেক নিয়ত থাকে না কিন্তু বুঝ আসার পর নিয়ত ঠিক হয়ে যায়। পূর্বসূরীগণ বলতেন,
طلبنا العلم لغير الله فأبى أن يكون إلا لله،
‘প্রথমে গায়রুল্লাহর জন্য ইলম শিখতাম কিন্তু তা আল্লাহ তা‘আলার জন্য হওয়া বৈ অস্বীকার করেছে।’
কথাটির অর্থ হচ্ছে হয়ত প্রথম প্রথম নিয়ত সহীহ ছিল না বটে, কিন্তু পরবর্তীতে বুঝ আসার পর তা ঠিক হয়ে গেছে। আর উস্তাদের কর্তব্য হচ্ছে ছাত্রদেরকে নিয়ত সহীহ করার জন্য তাগিদ দেয়া। তাদের অন্তরে একথা বদ্ধমূল করতে প্রচেষ্টা চালানো যে, একমাত্র নেক নিয়তের দ্বারাই উচ্চমর্যাদা, ইলম-আমল ও হিকমত লাভ করা সম্ভব।
তিন. আল্লাহ তা‘আলা ওলামায়ে কেরামের মর্যাদার যে ঘোষণা দিয়েছেন ছাত্রদের অধিকহারে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং তাদের কুরআন, হাদীছ, শের-আশআর ও বিভিন্ন প্রবন্ধে ইলমের যে ফযীলতের কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে তাদের ধারণা ও জ্ঞান দেয়া। যাতে তারা হীনমন্যতায় না ভোগে।
চার. উস্তাদ নিজে যা পছন্দ করবেন ছাত্রদের জন্যও তাই পছন্দ করা উচিত। নিজের সন্তানকে যেভাবে মায়ামমতা প্রদান করা হয় তালেবে ইলমের প্রতিও সেই মায়ামমতা প্রদর্শন করা কর্তব্য। খুব সাধারণ ভাবেই কখনও কখনও তাদের দ্বারা ভুলভ্রান্তি প্রকাশ পাবে। এরজন্য কখনও শাসনও করতে হবে আবার কখনও মাফও করে দিতে হবে। উস্তাদগণ একথা অবশ্যই মনে রাখবেন যে, কঠোরতাই সংশোধনের একমাত্র পথ নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে আদেশ উপদেশের দ্বারা কঠোরতার চেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায়।
পাঁচ. দরস প্রদানের ক্ষেত্রে ফলপ্রসু পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। ছাত্রদেরকে নীতিমালা, কায়েদা-কানুন এবং সূক্ষ্ম ও উপকারী বিষয়াদি মুখস্ত করাতে উৎসাহিত করা খুবই জরুরী। আর অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন জ্ঞান- যা ছাত্রদের মস্তিষ্ককে বিচলিত করে- তা থেকে দূরে রাখা একান্ত বিচক্ষণতার লক্ষণ।
ছয়. মাসআলা ও আলোচনা বুঝানোর জন্য গ্রহণযোগ্য ও সরল উপস্থাপনা অবলম্বন একজন আদর্শ উস্তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয় এ ধরনের আলোচনা করা যাবে না। উস্তাদ প্রথমে উদাহরণের সাহায্যে মাসআলাটি তুলে ধরবেন। ছাত্রদের মধ্যে যারা ধারণক্ষমতা রাখে না তাদের জন্য শুধু মাসআলার কাঠামো ও উদাহরণ পেশ করেই ক্ষান্ত হবেন। আর যারা সামর্থ্য রাখে তাদের সামনে মাসআলার দলিলের উৎস, হেকমত, ইল্লত এবং অন্যান্য সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। মজলিসে যদি এমন কেউ উপস্থিত থাকে যার সামনে সরাসরি কোনো শব্দ উল্লেখ করা যায় না, তখন কোনো ইঙ্গিতবাহী শব্দ ব্যবহার করা উচিত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করতেন।
সাত. কোনো ব্যাখ্যামূলক দরস শেষ করার পর ছাত্রদের মেধা পরীক্ষার জন্য মাসআলা সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছাত্রদের সামনে পেশ করা যেতে পারে। কেউ জবাব দিতে পারলে তার প্রশংসা করা বাঞ্ছনীয়। আর কেউ না পারলে তাকে হেকমতের সঙ্গে পুনরায় বুঝিয়ে দেবেন।
আট. মাঝেমধ্যে ছাত্রদের পূর্বের মুখস্ত করা বিষয় জানতে চাইবেন। পূর্বে উল্লিখিত জরুরীমাসায়েল, দুর্লভ বিষয়, কায়েদাকেন্দ্রিক শাখাগত মাসআলা ইত্যাদি উল্লেখ করে স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নেওয়া দরকার। যে ছাত্র জবাব দিতে পারবে অন্যের সামনে তার প্রশংসা করে তার হিম্মত ও অন্যের অনুপ্রেরণা বাড়াবেন। আর কেউ না পারলে অন্যের সামনে তাকে হেয় করবেন না। বরং উৎসাহিত করবেন।
নয়. কোনো ছাত্রকে তার সাধ্যের বাইরে চেষ্টা-মুজাহাদা করতে দেখলে সহজতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যাতে তিনি উম্মতকে তার সাধ্যের বাইরে কাজ করতে বারণ করেছেন। এক্ষেত্রে তার বাণীটি প্রবাদের মতো সর্বজনবিদিত হয়ে আছে। যথা-
« فَإِنَّ الْمُنْبَتَّ لَا أَرْضًا قَطَعَ وَلَا ظَهْرًا أَبْقَى»
‘দিনরাত চলমান বাহন গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না এবং তার পৃষ্ঠদেশও ঠিক থাকে না।’ [শু‘আবুল ঈমান: ৩৮৮৬, যঈফ]
অন্য হাদীছে ইরশাদ করেন-
اكفلوا من العمل ما تطيقون
‘যতটুকু সাধ্য আছে ততটুকু আমলের বোঝা বহন করো।’
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সর্বত্র সহজতা দান করেছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো সাহাবী সেই সহজতা গ্রহণ না করে নিজের ওপর কঠিন আমল চাপিয়ে নিয়েছিলেন। পরে সেজন্য অনেকে অনুশোচনাও করেছেন। যেমন আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজের ওপর দীর্ঘ কিয়াম আবশ্যক করে নিয়ে পরে তাতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন-
ليتنى قبلت رخصة رسول الله
‘ইশ, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেওয়া অবকাশই যদি গ্রহণ করতাম!’
কারণ হচ্ছে, ধারাবাহিক আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুবই প্রিয়। তাই কিছুদিন সাধ্যের বাইরে মেহনত-মুজাহাদায় লিপ্ত থেকে পরে দুর্বল হয়ে সেটা বাদ দেয়ার চেয়ে সার্বক্ষণিক অল্প মুজাহাদাই উত্তম।
দশ. সর্বদা ছাত্রের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চাল-চলন, আদব-আখলাস ও স্বভাব-চরিত্রের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখবেন। তাদের দ্বারা নাজায়েয, মাকরূহ, অশিষ্টাচার, উস্তাদদের প্রতি বেয়াদবি কিংবা অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্ট ছাত্রের নাম উল্লেখ না করে শাসন করা বেশি কার্যকর। এতে কাজ না হলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে বারণ করতে হবে। তাতেও কাজ না হলে তখন প্রকাশ্যে কঠোরভাবে শাসন করা যাবে। যাতে তার শাস্তি দেখে অন্যরাও শিক্ষা পায়। আর তাতেও কাজ না হলে তখন শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
এগার. ছাত্রদের কল্যাণ সাধন এবং তাদের মন স্থির রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবেন। দরকার হলে এবং সাধ্য থাকলে আর্থিক সহযোগিতা করবেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ওই বান্দার সঙ্গে থাকেন যে বান্দা অপরজনের উপকার করে। আর এই বিষয়টি যদি তালেবে ইলমের ক্ষেত্রে হয় তাহলে তো এর ফযীলতের তুলনাই নেই। কোনো ছাত্র নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি অনুপস্থিত থাকলে তার খোঁজখবর নেবেন, প্রয়োজনে চিঠি বা ফোনের মাধ্যমে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করবেন। কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা-যত্ন করবেন। কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করবেন। পেরেশান হলে তাকে স্বান্তনা দেবে। মনে রাখতে হবে নেককার তালেবে ইলম উস্তাদের জন্য দুনিয়া-আখেরাতের সবচেয়ে বড় সাফল্য বয়ে আনে এবং সেই তার সবচেয়ে বড় আত্মীয়-আপনজন।
বারো. ছাত্রদের সঙ্গে কোমল আচরণ করবেন, যদি তারা তাদের যাবতীয় দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেন। তার প্রতি কোমলতার ডানা সম্প্রাসারিত করবেন। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করে বলেন,
﴿ وَٱخۡفِضۡ جَنَاحَكَ لِمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢١٥ ﴾ [الشعراء: ٢١٥]
‘আপনি মুমিনদের মধ্যে আপনার অনুসারীদের জন্য বিনয়ের ডানা সম্প্রসারিত করুন।’ {সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত ২১৫}
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ اللَّهَ أَوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا »
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে বিনয়ী হওয়ার আদেশ করেছেন।’ [মুসলিম: ২৮৬৫]
অন্য হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللَّهُ
‘যে ব্যক্তি বিনয়ী হয় আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’ [মুসলিম: ২৫৮৮]
এটা তো সাধারণ মানুষের প্রতি বিনয়ী হওয়ার ফায়েদা। আর এটা যদি হয় সন্তানতূল্য তালেবে ইলমের প্রতি তাহলে তার মর্যাদা কত উঁচুতে হতে পারে? হাদীছে আরো বলা হয়েছে-
لينوا لمن تعلمون ولمن تتعلمون منه
‘তোমরা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করো।’ [তাখরীজু আহাদীছিল এহইয়া: ৩/২১৮, যঈফ]
ফুজাইল (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে-
إِن الله يحب العالم المتواضع ويبغض الجبار ومن تواضع لله ورثه الله الحكمة
‘আল্লাহ তা‘আলা বিনয়ী আলেমকে পছন্দ করেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার জন্য বিনয়ী হয় তিনি তাকে হিকমতের অধিকারী করেন।’
ছাত্রদের সঙ্গে তাদের মর্যাদা বজায় রেখে কথা বলা, সম্বোধন করা এবং সুন্দর নাম ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত-
كان رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم، يكني أصحابه إكراماً لهم.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে তাদের সম্মান রক্ষার্থে উপনামের সঙ্গে সম্বোধন করতেন।’
সুতরাং ছাত্ররা সাক্ষাত করতে এলে তাদেরকে মারহাবা বলা, হাসিমুখে কথা বলা আলেমের শান হওয়া চাই। আর যাদের মধ্যে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যায় তাদের প্রতি একটু বেশি যত্ন নেওয়া বিচক্ষণতার পরিচয়। কারণ, হেকমতকে যথাস্থানে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
চতুর্থ পর্ব:
ছাত্রদের দায়িত্ব ও করণীয়
এক. নিজেকে ধোঁকা-প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ, বদ আকীদা, বদমেজাজ ইত্যাদি পাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। যাতে করে নিজের মধ্যে ইলম ও ইলমের সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয় প্রবেশ করার পথ খুলে যায়। কেননা বলা হয়ে থাকে-
إن العلم صلاة السر، وعبادة القلب، وقربة الباطن
‘ইলম হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সালাত, কলবের ইবাদত এবং গোপন নৈকট্য।’
সুতরাং সালাত যেমন বাহ্যিক অপবিত্রতামুক্ত হওয়া ছাড়া সহীহ হয় না তেমনিভাবে কলবের সালাত ইলমও সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতার সঙ্গে কবুল হবে না। সালাফে সালেহীন আরো বলেন,
يطيب القلب للعلم كما تطيب الأرض للزرع، فإذا طيب العلم ظهرت بركته
‘ভূমি যেমন শস্য ও ফসলাদি দ্বারা সজীব হয়ে ওঠে তেমনিভাবে অন্তরও ইলম দ্বারা সজীব ও জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর যখন ইলমের সজীবতা সৃষ্টি হয় তখন বাহ্যিকভাবে এর নমুনা প্রকাশ পায়।’
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
« أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً، إِذَا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ، فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ»
‘দেহে একটি গোস্তপিণ্ড আছে। যদি সেই গোস্তপিণ্ড ঠিক হয়ে যায় তবে সারা দেহ ঠিক থাকে। আর যদি সেটা ফাসেদ হয় তবে গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে সেই গোস্তপিণ্ড হচ্ছে কলব।’ [বুখারী: ৫২; মুসলিম: ১৫৯৯]
সাহল (রহ.) বলেন,
حرام على قلب أن يدخله نوَر وفيه شيء مما يكره الله عز وجل
‘ওই কলবের ভেতর ইলমের নূর প্রবেশ করানো হারাম, যে কলবে আল্লাহ তা‘আলার অপছন্দনীয় কিছু বিদ্যমান থাকে।’
দুই. ইলম হাসিলে নিয়ত সহীহ করে নেবে। আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন, দীন-ইসলামের প্রচার-প্রসার, নিজের ক্বলবকে নূরান্বিত করা, বাতেনকে সুশোভিত করা এবং সর্বোপরি উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে দীনী জাগরণ সৃষ্টি করার নিয়ত করতে হবে। নিয়তকে ঠিক রাখাই আসলে সবচেয়ে কঠিন কাজ। সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) বলেন,
ما عالجت شيئاً أشد من نيتي،
‘আমি নিয়তের পরিচর্যার চেয়ে বেশি কোনো বস্তুর পরিচর্যা করা কঠিন মনে করিনি।’
ইলম অর্জন করার দ্বারা কখনও দুনিয়া কামানোর নিয়ত করবে না। কেননা এটা হবে উত্তম বস্তুর তুলনায় অনুত্তম বস্তু গ্রহণ করা। কারণ ইলম হচ্ছে একটি ইবাদত। তাই এতে এখলাস থাকা অপরিহার্য। তবেই এতে বরকত হয়। পক্ষান্তরে যদি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কিছুর নিয়ত করা হয় তবে আমল বাতিল হবে এবং সেটা চরম আক্ষেপ ও আফসোসের কারণ হবে।
তিন. যৌবনের মূল্যবান সময়গুলোকে ইলম অর্জনের পেছনে ব্যয় করবে। ইলম বৈ অন্য কোনো কাজে ব্যয় করবে না। এজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও মেধা ব্যয় করতে হবে। মনে রাখবে-
العلم لا يعطيك بعضه حتى تعطيه كلك.
‘তুমি তোমার সর্বোচ্চ অংশ না দিলে ইলম তোমাকে কিছুই দান করবে না।’
চার. নিজের আর্থিক সঙ্গতির ওপরেই সন্তুষ্ট থাকবে। মনে রাখবে, অর্থকষ্ট ছাড়া ইলমের প্রশস্ততা হাসিল করা যায় না। যদি অন্তরকে যাবতীয় লোভ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত রাখা যায় তবেই দিলে হেকমতের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
لا يطلب أحد هذا العلم بالملك وعز النفس فيفلح ولكن من طلبه بذل النفس وضيق العيش وخدمة العلماء أفلح
‘ইজ্জত ও রাজত্ব দিয়ে ইলম হাসিল করতে গিয়ে কেউ সফল হয়নি। বরং যে নিজের নফসকে বিলিয়ে দিয়ে, সংকীর্ণ জীবিকাতে সন্তুষ্ট হয়ে এবং ওলামায়ে কেরামের খেদমত করে ইলম হাসিল করেছে একমাত্র সেই সফল হয়েছে।’
তিনি আরো বলতেন,
لا يدرك العلم إلا بالصبر على الذل
‘নফসের যিল্লতি ছাড়া ইলম হাসিল করা যায় না।’
যে ব্যক্তি পেশা ও অর্থ উপার্জনের ওপর ইলম অর্জনকে প্রাধান্য দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এর বদলায় উত্তম ব্যবস্থা করবেন এবং তাকে কল্পনাতীত রিযিক দান করবেন।
পাঁচ. সময়কে ভাগ করে কাজে লাগাবে। হিফজের জন্য সর্বোত্তম সময় হচ্ছে রাতের শেষপ্রহর, গবেষণার জন্য ভোর, লেখালেখির জন্য দিনের মধ্যভাগ এবং মুতালাআ-মুজাকারার জন্য রাত। রাতের বেলায় হিফজ করা দিনের বেলায় হিফজ করার চেয়ে বেশি উপকারী এবং ক্ষুধার্তের সময় পরিতৃপ্তি সময়ের চেয়ে বেশি উপকারী। আর হিফজ করার স্থান হিসেবে মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটায় এধরনের প্রাকৃতিক ও সৌন্দর্যময় স্থান থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। যেমন, সবুজ বাগান, নদীর পাড়, রাস্তার পার্শ্ব, হইচই-চেচামেচির স্থান ইত্যাদি। কেননা এসব স্থান মানুষের কলবের স্থিতি নষ্ট করে।
ছয়. ইলমের সূক্ষ্ম বিষয় চর্চা, সহীহ সমঝ হাসিল এবং ক্লান্তি থেকে বেঁচে থাকার নিরাপদ উপায় হচ্ছে অল্প পরিমাণ হালাল খাদ্য গ্রহণ করা। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন,
ما شبعت منذ ست عشرة سنة
‘আমি ষোল বছর ধরে পেট পূর্ণ করে খানা খাইনি।’
এর কারণ হচ্ছে অধিক আহার অধিক পিপাসার কারণ। আর অধিক পিপাসা ঘুম আনয়ন করে, মেধা দুর্বল করে এবং শারীরিক প্রফুল্লতা খতম করে। এছাড়া শারীরিক রোগ-ব্যাধির ব্যাপার তো আছেই। বলা হয়-
فإن الداء أكثر ما تراه … يكون من الطعام أو الشراب
‘অধিকাংশ রোগ যা তোমরা দেখ, তা হয়ে থাকে খাদ্য বা পানীয়ের কারণে।’
সুতরাং যে ব্যক্তি অধিক পানাহার সত্ত্বেও ইলম অর্জনে সাফল্য চায় সে বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে। তাই খাবার গ্রহণে স্বল্পতা আবশ্যক। এক্ষেত্রে হাদীছের নির্দেশ অনুযায়ী আমল করলে অধিক ফল পাওয়া যাবে। হাদীছে বলা হয়েছে-
قَالَ رَسُولُ اَللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – { مَا مَلَأَ ابْنُ آدَمَ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ حَسْبُ ابْنَ آدَمَ لُقَيْمَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ فَإِنْ كَانَ لَا مَحَالَةَ فَثُلُثٌ لِطَعَامِهِ وَثُلُثٌ لِشَرَابِهِ وَثُلُثٌ لِنَفَسِهِ
‘মানবসন্তানের পেট পূর্ণ করার চেয়ে অন্য কোনো পাত্র পূর্ণ করা এত নিকৃষ্ট নয়। তার জন্য তো মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমাই যথেষ্ট। আর যদি তাতে না হয় তবে কেন সে পেটের একভাগ খাবার, একভাগ পানি এবং একভাগ তার নিজের জন্য বরাদ্দ করে না?’ [মুসনাদ আহমাদ: ১৭১৮৬]
হাদীছের ব্যাখ্যায় পূর্বসূরীগণ বলেন,
لَيْسَ لِلْبِطْنَةِ أَنْفَعُ مِنْ جَوْعَةٍ تَتْبَعُهَ
‘পেটের জন্য অব্যাহত ক্ষুধানিপীড়নের চেয়ে উপকারী কোনো বস্তু নেই।’
সাত. যাবতীয় কাজকর্মে তাকওয়া-পরহেজগারী অবলম্বন করবে। পানাহার, লেবাস-পোশাক সর্বত্র হালাল পন্থা অবলম্বনে কঠোর থাকবে। সকল প্রকার সন্দেহজনক বস্তু থেকে দূরে থাকবে।
আট. শরীর ও জেহেন সুস্থ রাখে এই পরিমাণ ঘুমাবে। রাতদিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টার বেশি ঘুমাবে না। এটাই হচ্ছে দিনের এক তৃতীয়াংশ। আর যদি এর চেয়ে কম পারা যায় তবে সেটাই করা উচিত। আর মাঝেমধ্যে নফস, কলব, জেহেন এবং দৃষ্টিকে চাঙ্গা করার জন্য বৈধ কৌতুক করা যেতে পারে। তবে এটা করতে গিয়ে সময়, দীন ও আমলের কোনোরূপ ক্ষতি করা যাবে না। আমাদের পূর্বসূরীগণগণের অনেকে তাদের ছাত্রদেরকে বিনোদনের স্থানে জমায়েত করতেন এবং দীনের ক্ষতি হয় না- এমন বিষয় নিয়ে হাসি-কৌতুকও করতেন। তবে অবশ্যই অবৈধ হাসি-কৌতুক, ঠাট্টা-মশকরা, অট্টহাসির আশ্রয় নেওয়া যাবে না।
নয়. তালেবে ইলমের অপরিহার্য দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষতিকর বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকা। বিশেষ করে যদি ভিন্ন শ্রেণীর এবং খেলাধূলায় অভ্যস্ত ও নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে গাফেল বন্ধু হয় তবে তো কথাই নেই। সুতরাং তালেবে ইলমের কর্তব্য হচ্ছে এমন ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব রাখা, যে নিজেও উপকৃত হয় এবং অন্যকেও উপকৃত করে।
আলেমের প্রতি মহব্বত লাভের জন্য ইলমের প্রতি মহব্বত থাকা পূর্বশর্ত। সুতরাং মহব্বতের মাপকাঠি হওয়া দরকার ইলম। অতএব যে ব্যক্তি বন্ধু হবে তাকে অবশ্যই ইলমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং সে বন্ধুর ইলম হাসিলে ক্ষতিকর এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।
যদি ইলমের জন্য ক্ষতিকর কোনো লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েই যায় তবে দ্রুত তা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। বিলম্ব হলে তা দূর করা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। তাই আবার বলি, বন্ধুত্ব করতে চাইলে এমন লোকের সঙ্গেই করতে হবে, যে নেককার, দীনদার, মুত্তাকি, অধিক কল্যাণের আধার, কম খারাপের অধিকারী, সদাচার। যদি ভুলে যায় তবে স্মরণ করিয়ে দেয়, তাকে স্মরণ করালে সহজে মেনে নেয়। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
لا تصحب أخا الجهل … و إيَّاك وإيَّاه
فكم من جاهل أردى … حليماً حين آخاه
‘তুমি কখনও জাহেলকে বন্ধু বানিয়ো না। অনেক জাহেল ধৈর্যশীল ব্যক্তিকে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করায় নিকৃষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।’
কেউ কেউ বলেন,
إن أخاك الصدق من كان معك … و من يضر نفسه لينفعك
‘তোমার প্রকৃত বন্ধু সেই, যে নিজের ক্ষতি করে হলেও তোমার উপকার করে।’
দশ. কষ্ট করা ছাড়া ইলম হাসিল করা যায় না- সর্বদা একথা মনে রাখবে। কেননা ইলম অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীর কোনো বস্তু দিয়ে এর মূল্য পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আর একথা চিরসত্য যে, মূল্যবান বস্তু কষ্ট স্বীকার করেই হাসিল করতে হয়। মূল্যবান বস্তু শ্রম দেওয়া ছাড়া হাসিল হওয়ার কোনো নজির নেই। একারণে আমাদের পূর্বসূরীগণ ইলম হাসিলের জন্য কষ্ট স্বীকার করাকে ইলমের সুন্নাত বলে মনে করতেন। তারা নিজেরাও কষ্ট স্বীকার করতেন এবং অন্যকেও এব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। তারা বলতেন, সুদীর্ঘকাল সম্মানিত হতে হলে সামান্য সময় কষ্ট স্বীকার ও নিজেকে বিলিয়ে দিতেই হবে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
يا نَفسُ ما هِيَ إِلّا صَبرُ أَيّامِ … كَأَنَّ مُدَّتَها أَضغاثُ أَحلامِ
يا نَفسُ جوزي عَنِ الدُنيا مُبادِرَةً … وَخَلِّ عَنها فَإِنَّ العَيشَ قُدامي
‘হে আত্মা! এ তো সামান্য সময়ের জন্য ধৈর্য ধারণ মাত্র। যেন এর সময়কাল ভ্রান্ত স্বপ্নকালের মতোই সংক্ষিপ্ত। হে আত্মা! দুনিয়া থেকে দ্রুত পৃথক হয়ে যাও। কেননা সুখ-সমৃদ্ধি তো সব সামনে।’
৫ম পর্ব:
উস্তাদ ও শায়খদের সঙ্গে তালেবে ইলমের ব্যবহার
এক. ছাত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কোন মাদরাসায় ও কোন উস্তাদের কাছ থেকে ইলম হাসিল করবে তা ইস্তেখারার মাধ্যমে নির্ধারণ করা। কোথায় তার মেধার বিকাশ ঘটবে, উস্তাদগণের স্নেহপ্রবণতায় নিজের ইলমী যোগ্যতা বিকশিত হবে, তাকওয়া-পরহেজগারী, সততা-দীনদারী অর্জন হবে, লেখাপড়ার মান নিশ্চিত হবে ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। তবে বেশি ইলম হাসিল করতে গিয়ে কিংবা প্রসিদ্ধি হাসিল করতে গিয়ে দীন, আমল ও শিষ্টাচার বিসর্জন দিতে হয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা যাবে না। আকাবিরে সলফ বলতেন,
هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم
‘এটা হচ্ছে দীন। সুতরাং আপনি দেখুন, কার কাছ থেকে ইলম তথা দীন হাসিল করবেন।’
আমলহীন প্রসিদ্ধ লোকদের কাছ থেকে ইলম হাসিল করার চেষ্টা করবে না। ইমাম গাযালী (রহ.) এটাকে অহংকারের মধ্যে শামিল করেছেন। কারণ মূল হচ্ছে ইলম হাসিল করা। বলা হয়-
الحكمة ضالة المؤمن يلتقطها حيث وجدها
‘প্রজ্ঞা মুমিনের হারানো সম্পদ, যেখানে তা পায় কুড়িয়ে নেয়।’ অতএব এখানে ব্যক্তিত্বের অহংবোধ গৌণ। তাই যেখানেই বিশুদ্ধ ইলম পাওয়া যাবে সেখানেই ছুটে যাবে এবং বাঘ থেকে পলায়ন করার ন্যায় মূর্খতা থেকে পলায়ন করবে। আর বাঘ থেকে পলায়নকারী ব্যক্তি কিন্তু যে-ই তাকে মুক্তির পথ দেখায় তার কথাই মানে। তার ব্যক্তিত্বের খোঁজ-খবর করতে যায় না। আবূ নুআইম হিলয়াগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জয়নুল আবেদীন (রহ.) গোলাম যায়দ ইবন আসলামের কাছে যেতেন এবং তার মজলিসে বসে ইলম হাসিল করতেন। কেউ তাকে বললেন, আপনি সাইয়েদ বংশের লোক হয়ে এই গোলামের কাছে যাচ্ছেন! জবাবে তিনি বললেন-
العلم يُتَبع حيث كان ومن كان
‘ইলম হচ্ছে অনুসরণীয়। চাই যার কাছেই হোক এবং যেখানেই হোক।’
‘তাই মর্যাদায় নিচু হলেও তার কাছ থেকে ইলম হাসিল করাতে দোষ নেই এবং এতে মর্যাদা বাড়বে, ইলমে বরকত হবে। অবশ্য মুত্তাকী, পরহেগার ব্যক্তি হলে তার মাধ্যমে তো আরো বেশি উপকৃত হওয়া যাবে, এত কোনো সন্দেহ নেই। কিতাবের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। যে কিতাব দ্বারা সত্যিকারের ইলমী উপকারিতা হাসিল হয়, আমলের উন্নতি ঘটে তা পাঠ করতে কার্পণ্য করবে না।
তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, উস্তাদ যেন শরীয়তের ইলমের ব্যাপারে দক্ষ হন। তার ব্যাপারে সমকালীন ব্যক্তিগণ আস্থাশীল থাকেন। যে আলেম শুধু কিতাবের পেট থেকে ইলম হাসিল করেছেন তার কাছে ইলম হাসিল করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
من تفقه من بطون الكتب ضيع الأحكام،
‘যে ব্যক্তি কিতাবের পেট থেকে ইলম হাসিল করে সে আহকামকে ধ্বংস করে।’
অন্য এক বুযুর্গ বলেন,
من أعظم البلية مشيخة الصحيفة، أي الذين يتعلمون من الصحف
‘কিতাবী শায়খ’ হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ অর্থাৎ যারা শুধু কিতাবের পাতা থেকে ইলম অর্জন করে তারা জাতির জন্য বিপদের কারণ।’
দুই. উস্তাদকে জটিল রোগীর দক্ষ চিকিৎসক মনে করে তার যাবতীয় আদেশ ও পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। তার সন্তুষ্টির প্রতি খেয়াল রাখবে এবং খেদমত করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল করার চেষ্টা করবে। আর একথার দৃঢ়বিশ্বাস রাখবে যে, উস্তাদের জন্য নিজের যিল্লতিতে প্রকৃত সম্মান, বিনয়ী হওয়াতে ফখর এবং নম্র হওয়াতে উচ্চমর্যাদা নিহিত। ইবন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের মতো এমন সম্মানী ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও যায়দ ইবন ছাবেতের বাহনের রেকাবি ধরতেন। কারণ তিনি তার কাছ থেকে ইলম হাসিল করেছিলেন। আর তিনি একথা বলতেন,
هكذا أمرنا إن نفعل بعلمائنا
‘আমরা আমাদের উস্তাদ ও আলেমদের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করতেই আদিষ্ট হয়েছি।’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ، وَتَعَلَّمُوا لِلْعِلْمِ السَّكِينَةَ، وَالْوَقَارَ، وَتَوَاضَعُوا لِمَنْ تَعْلَمُونَ مِنْهُ»
‘ইলম হাসিল করো এবং ইলম হাসিল করার জন্য গাম্ভীর্য শিক্ষা করো। আর যার কাছ থেকে ইলম হাসিল কর, তার প্রতি বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হও।’ [মু‘জামুল আওসাত: ৬১৮৪, যঈফ]
মনে রাখতে হবে বিনয়ী হওয়া ছাড়া এবং আনুগত্য প্রদর্শন করা ছাড়া ইলম হাসিল করা যায় না। অতএব ইলমী বিষয়ে উস্তাদের যে কোনো পরামর্শ মাথা পেতে মেনে নেবে। নিজের ‘সঠিক বুঝে’র ওপর উস্তাদের ‘ভুল বুঝ’কেই প্রাধান্য দেবে।
তিন. উস্তাদকে সর্বদা মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখতে হবে। তার মর্যাদায় বিশ্বাস রাখবে। কেননা এটা নিজের উপকারিতার জন্য খুবই ফলদায়ক। জনৈক দার্শনিক বলেন,
حسن الأدب ترجمان العقل
‘শিষ্টাচার ব্যক্তির আকলের মুখপাত্র।’
উস্তাদকে সরাসরি ‘আপনি’, ‘সে’, ‘তিনি’ইত্যাদি শব্দে সম্বোধন করবে না। বরং: يا شيخنا ويا أستاذنا ‘মুহতারাম’, ‘সাইয়েদ’ ইত্যাদি পূর্ণ সম্মানজনক বাক্যে সম্বোধন করবে। ‘উস্তায এ বিষয়ে কী বলেন’, ‘এ ব্যাপারে উস্তাযের রায় কী’ এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করবে। আর অনুপস্থিতিতে এমন কোনো শব্দ উল্লেখ করে তাকে স্মরণ করবে না, যাতে তার মর্যাদাহানী হয়। বরং সম্মান ও মর্যাদাজ্ঞাপক শব্দে স্মরণ করবে। যেমন, মুহতারাম শায়খ….বলেছেন, উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা…বলেছেন ইত্যাদি।
চার. উস্তাদের মর্যাদা ও হক রক্ষা করে চলবে। তার মর্যাদাহানী ঘটাবে না। আবূ উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
من علم عبداً آية من كتاب الله فهو مولاه
‘যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে একটি আয়াত শিক্ষা দিলো তবে তিনি তার মুনিব।’
এসব কারণে উপস্থিত-অনুপস্থিত উভয় অবস্থাতেই উস্তাদের সম্মান করবে। আর যদি একান্তই এসব করতে না পারে তবে ওই মজলিস ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে। ছাত্রদের কর্তব্য হচ্ছে, জীবদ্দশায় উস্তাদের জন্য দু‘আ করবে, তার সন্তান-সন্ততি ও নিকটাত্মীয়দের জন্য দু‘আ করবে এবং মৃত্যুর পরও তার হক রক্ষা করবে এবং কবর যিয়ারত ও ইস্তেগফার করবে। তার পক্ষ থেকে কিছু দান-সদকা করবে। উস্তাদের ইক্তেদা ও আদর্শ কখনও পরিত্যাগ করবে না।
পাঁচ. উস্তাদ কর্তৃক কোনো কঠোরতার সম্মুখীন হলে তাতে সবর করবে এবং এর ভালো ব্যাখ্যা দাঁড় করবে। এর জন্য কখনই তার মহব্বত ও বিশ্বাস ত্যাগ করবে না। এতেই ছাত্রদের অফুরন্ত কল্যাণ। এক মনীষী বলেন,
من لم يصبرعلى ذل التعليم بقي عمره في عملية الجهالة، ومن صبر عليه آل أمره إلى عز الدنيا والآخرة.
‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করতে গিয়ে উস্তাদের লাঞ্ছনা বরদাশত করতে পারে না, সারাজীবন তার মূর্খতার মধ্যে কেটে যায়। আর কেউ বরদাশত করলে সেটা তার দুনিয়া-আখেরাতের মর্যাদায় পরিণত হয়।’
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
ذللت طالباً فعززت مطلوباً
‘ছাত্র থাকতে লাঞ্ছনা বরদাশত করেছি। তাই উস্তাদ হয়ে মর্যাদা লাভ করতে পেরেছি।’
জনৈক মনীষী বলেন,
اصبر لدائك إن جفوت طبيبه … و أصبر لجهلك إن جفوت معلما
‘যদি চিকিৎসকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করো তবে অসুস্থতার ওপর সন্তুষ্ট থাকো এবং যদি উস্তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো তবে মূর্খতার ওপর ধৈর্যধারণ করো।’
ছয়. উস্তাদের কঠোরতা ও শাসনকে নিজের জন্য একথা ভেবে নেয়ামত বলে মনে করবে যে, তিনি আমার সংশোধন ও ভালোর জন্য আমার প্রতি খেয়াল রাখছেন বলেই শাসন ও কঠোরতা করছেন।
সাত. আম মজলিস ছাড়া অনুমতি ছাড়া উস্তাদের অবস্থানকক্ষে প্রবেশ করবে না। চাই তার সঙ্গে অন্য কেউ থাকুক বা না থাকুক। বার বার অনুমতি তলব করবে না। যদি জানা যায় যে, উস্তাদ তার অনুমতি তলবের বিষয়ে অবগত আছেন তবে তিনবারের বেশি অনুমতি তলব করবে না। যদি দরজায় করাঘাত করতে হয় তবে খুব মৃদভাবে, আঙুলের নখ দিয়ে আঘাত করবে। অতপর আঙুল দিয়ে করবে। শেষে হাতের তালু দিয়ে করবে। অনুমতি লাভ করার পর যদি আম মজলিস লক্ষ্য করা যায় তবে পর্যায়ক্রমে মর্যাদার দিক দিয়ে অগ্রগণ্য ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করতে থাকবে। আর উচিত হচ্ছে উস্তাদের কাছে পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় গায়ে প্রবেশ করা। হাত-পায়ের নখ কর্তিত এবং চুল পরিপাটি থাকা। উস্তাদের কাছে কেউ থাকলে এবং তারা কথাবার্তায় লিপ্ত থাকলে সেখানে গিয়ে কথা না বলে নিশ্চুপ থাকা। আর উস্তাদ যদি একাকী থাকেন কিংবা সালাত, যিকির, লেখা বা মুতালাআয় নিমগ্ন থাকেন এবং তিনি নিজে থেকে কথা শুরু না করেন তবে সালাম দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যাবে। হ্যাঁ, তিনি অবস্থান করার ইশারা করলে অবস্থান করবে এবং অনুমতি ছাড়া সেখানে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করবে না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও ফারেগ কলব নিয়ে উস্তাদের কাছে হাজির হবে। মানসিক উত্তেজনা, ক্ষুৎপিপাসা, রাগ-ক্রোধ, ঘুম-তন্দ্রাভাব ইত্যাদি অবস্থায় প্রবেশ করবে না। যাতে উস্তাদ থেকে উপকৃত হওয়া যায় এবং তিনি যা বলেন তা যথাযথভাবে ধরে রাখা যায়। উস্তাদের কাছে এমন কোনো সময় পড়া জিজ্ঞেস করবে না, যখন তা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিংবা যে সময় তার একান্তই অন্য কাজের জন্য নির্দিষ্ট। উস্তাদের কাছে নিজের জন্য কোনো সময় খাস করে নেবে না, যাতে অন্য কেউ শরীক না হতে পারে। কেননা এটা অবাঞ্ছিত বড়ত্ব ও উস্তাদের প্রতি মূর্খদের আচরণের শামিল।
আট. উস্তাদের সামনে ভদ্রভাবে উপবেশন করবে। সে সময় নম্রতা, বিনয় ও নিরবতা পালন করবে। উস্তাদের প্রতি তাকিয়ে থাকবে এবং কর্ণ খাড়া রাখবে। সব কথা মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করবে যাতে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন না হয়। এদিক ওদিক তাকাবে না এবং হাতের আস্তিন গোটাবে না, হাত-পা নিয়ে খেলা করবে না। দাড়ি-গোঁফ ও নাকে হাত দেবে না এবং নাক থেকে কিছু বের করবে না। কেননা এটা খুবই আপত্তিকর এবং ঘৃণিত স্বভাব। মুখ খোলা রাখবে না এবং দাঁত দিয়ে আওয়াজ করবে না। হাতের তালু দিয়ে মাটিতে আঘাত করবে না কিংবা হাতের আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ টানবে না। হাতের আঙুল হাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করবে না। উস্তাদের সামনে দেয়াল বা অন্য কিছুর সঙ্গে হেলান দেবে না। উস্তাদের দিকে পিঠ বা পার্শ্ব দিয়ে বসবে না। প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত কথা বলবে না। এমন কোনো কথা বলবে না, যাতে হাসির উদ্রেক হয় কিংবা যাতে অশ্লীল বাক্য মেশানো থাকে অথবা অশিষ্টাচারপূর্ণ সম্বোধন থাকে। বিনা কারণে হাসাহাসি করবে না এমনকি কারণ থাকলেও উস্তাদের সামনে অমার্জিত ভঙ্গিতে হাসবে না। যদি একান্তই হাসির উদ্রেক হয় তবে শব্দ না করে মুচকি হাসি দেবে। প্রয়োজন ছাড়া গলা খাকাড়ি দেবে না। থুথু নিক্ষেপ করবে না। নাক থেকে শ্লেষ্মা বের করবে না। বরং বিনা শব্দে তা রুমাল বা কাপড়ের টুকরায় মুছে ফেলবে। আলোচনা-পর্যালোচনার সময় হাত ও পা সংযত রাখবে।
উস্তাদকে এরূপ বলবে না যে, ‘অমুকে আপনার মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।’ তার সামনে কারো গীবত করবে না এবং যদি তার দ্বারা কোনো ভুলত্রুটি হয়ে যায় তবু তার দোষ তালাশ করবে না। নিঃসন্দেহে একজন আলেম মুমিনের মর্যাদা অনেক। তাদের কেউ মারা গেলে ইসলামে এমন একটি ছিদ্র দেখা দেয়, যা কোনো কিছু দ্বারা ভরাট করা সম্ভব নয়। খতীব বাগদাদী (রহ.) ‘আল-জামে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
وإن المؤمن العالم لأعظم أجراً من الصائم القائم الغازي في سبيل الله، وإذا مات العالم، انثلمت في الِإسلام ثلمة لا يسدها شيء إلى يو م القيامة.
‘একজন আলেম নিঃসন্দেহে প্রতিদানপ্রাপ্তির বিবেচনায় রোজাদার, নফল সালাতে রাত্রিজাগরণকারী এবং আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় মুজাহিদের চেয়ে বড়। আর একজন আলেম মারা গেলে ইসলামে একটি ছিদ্র সৃষ্টি হয়, যা কেয়ামত পর্যন্ত কোনো বস্তু দ্বারা ভরাট করা সম্ভব নয়।’
উস্তাদের আসনে, বিছানায় বা জায়নামাজে বসবে না। উস্তাদ যদি বসতে বলেন তবু না বসার চেষ্টা করবে। আর যদি একান্তই আদেশ করেন এবং তা পালন না করলে তার মনোকষ্ট হয় তখন বসবে এবং পরে আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।
নয়. উস্তাদ কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে কান পেতে তা শ্রবণ করবে এবং এমনভাবে তা শ্রবণ করবে যেন কোনোদিন তা শোনা হয়নি। এটা শ্রোতার শিষ্টাচার। আতা (রহ.) বলেন, ‘আমি অনেক সময় কোনো ব্যক্তির মুখ থেকে একটি কথা শুনি। সে সম্পর্কে আমি বেশি জানি তবু এমন ভাব করি যাতে মনে হয় তিনি আমার চেয়ে বেশি জানেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক সময় যুবক-তরুণ আমার সামনে কথা বলে আর তা আমি এভাবে শ্রবণ করি যে, মনে হয় আমি কোনোদিন তা শ্রবণ করিনি। অথচ আমি তার বহু আগ থেকেই তা জানি!’
উস্তাদ যদি তার বক্তব্য শুরু করার আগে ছাত্ররা জানে কিনা- জিজ্ঞেস করেন এবং ছাত্রদের তা জানাও থাকে, তবু হ্যাঁ বলবে না। কেননা এটা উস্তাদের ইলমের প্রতি অনীহা বুঝায়। আবার না-ও বলবে না। কেননা তা মিথ্যাকথন হয়ে যায়। বরং বলবে, উস্তাযের মুখে শুনতে চাই অথবা উস্তাযের বর্ণনা আমাদের জানার চেয়ে বেশি শুদ্ধ ইত্যাদি।
দশ. উস্তাদের কথার আগে কথা বলবে না এবং তার বক্তব্যের আগে বক্তব্য শুরু করবে না। উস্তাদের আগ থেকেই উক্ত বিষয় জানার দাবি করবে না এবং উস্তাদ যে ধরনের বিষয়েই কথা বলুন না কেন, সে কথা কাটার চেষ্টা করবে না। বরং তার কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করবে। সাহাবীগণের আমল ছিল এরূপ-
إن النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم كان إذا تكلم أطرق جلساؤه، كأن على رؤوسهم الطير، فإذا سكت تكلموا
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কথা বলতেন, তখন সাহাবীগণ মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখতেন। যেন তাদের মাথার ওপর পাখি বসা রয়েছে। তিনি যখন নীরব হতেন সাহাবীগণ তখন কথা বলা শুরু করতেন।’
এগার. উস্তাদ কোনো কিছু প্রদান করলে ডানহাতে গ্রহণ করবে এবং তাকে দেয়ার সময়েও ডানহাত দিয়ে দেবে। উস্তাদের কোনো বস্তুর ওপর নিজের বস্তু রাখবে না। তার দিকে হাত, চোখ বা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ দিয়ে ইশারা করবে না। তাকে লেখার জন্য কলম দেয়ার প্রয়োজন হলে দেয়ার আগে কলমের হেড খুলে দেবে। সামনে দোয়াত রাখলে মুখ খুলে দেবে এবং তড়িৎ লেখার উপযোগী করে পেশ করবে। তার ছুরি ইত্যাদি দিলে ধারালো অংশ আড়ালে রেখে বাড়িয়ে দেবে। আর কখনও উস্তাদের খেদমত করে ক্লান্তি বা লজ্জাবোধ করবে না। বলা হয়ে থাকে-
أربعة لا يأنف الشريف منهم وإن كان أميراً، قيامه من مجلسه لأبيه وخدمته للعالم يتعلم منه والسؤال عما لا يعلمه وخدمته للضيف.
‘চার ক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি লজ্জাবোধ করে না, যদিও তিনি বাদশা হোন না কেন। পিতার কাছে পুত্রের দণ্ডায়মান হওয়া, উস্তাদের খেদমতে তালেবে ইলমের নিয়োজিত হওয়া, না জানা বিষয় জিজ্ঞেস করা এবং মেহমানের খেদমত করা।’
বার. উস্তাদের সঙ্গে রাতে চললে সামনে সামনে এবং দিনে চললে পেছনে পেছনে চলবে। অবশ্য এর বিপরীত কোনো অবস্থা পালন করতে হলে সেটা ভিন্ন কথা। অপরিচিত জায়গায় আগে আগে চলবে। অপরিচিত লোকদের সামনে উস্তাদকে পরিচিত করিয়ে দেবে। উস্তাদ দূরে থাকলে উচ্চস্বরে ডাক দেবে না এবং পিছন থেকেও ডাকবে না। উস্তাদ কোনো বিষয়ে ভুল করে থাকলে সরাসরী সেটাকে ভুল আখ্যায়িত করবে না এবং এরূপ বলবে না যে, আপনার এই কাজটা ভুল বা এটা কোনো মতই নয়। বরং মার্জিতভাবে তাকে স্বীয় ভুল সম্পর্কে অবহিত করবে। যেমন এরূপ বলবে যে, ‘মনে হয় এরূপ করা ভালো হবে।’ কিন্তু ‘আমার মতে এরূপ করা ভালো হবে’ এরকম কথা বলবে না।
৬ষ্ঠ পর্ব:
দরসের আদব
এক. প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব দিয়ে শুরু করবে। সুতরাং তা মজবুতভাবে হিফজ করবে এবং এর অর্থ ও তাফসীর আত্মস্থ করতে সচেষ্ট হবে। কেননা এটাই হচ্ছে ইলমের উৎস ও জননী। এরপর অন্যান্য শাস্ত্রের প্রয়োজনীয় বিষয়াদী সংক্ষিপ্ত আকারে মুখস্ত করবে। ফিকহ, উসুলে ফিকহ, হাদীছ, উলুমে হাদীছ, নাহব, সরফ, মানতেক ইত্যাদি শাস্ত্র মজবুতভাবে আয়ত্ব করবে। কিন্তু কুরআন বাদ দিয়ে নয়। আর কুরআন ও অন্যান্য শাস্ত্র নিয়মিত চর্চা করবে। কুরআনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা শিখবে এবং তা ধরে রাখবে। শাস্ত্র আত্বস্ত করতে গিয়ে নিছক কিতাবের ওপর নির্ভর করবে না বরং শাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য নেবে।
দুই. দরসের সূচনাতেই মাসআলাগত মতভেদের মধ্যে পড়বে না এবং মানতেক-দর্শনশাস্ত্রও না। কেননা এগুলো জেহেনকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। বরং প্রথমে নির্দিষ্ট কোনো শাস্ত্রের একটি কিতাব পাঠ করবে। তবে সমর্থ থাকার শর্তে উস্তাদের সম্মতি ও পরামর্শ সাপেক্ষে একই পদ্ধতিতে একাধিক শাস্ত্রের একাধিক কিতাব পাঠ করা যেতে পারে। যে উস্তাদ মাজহাব ও মতভেদ উল্লেখ করে নির্দিষ্ট কোনো রায় বা সমাধান প্রদান করেন না তার দরসে শরীক হওয়া লাভের চেয়ে ক্ষতিকর। এমনিভাবে সূচনাতে নানান কিসিমের একাধিক শাস্ত্র অধ্যায়ন করাও ক্ষতিকর। এতে সময় ও জেহেন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বরং নিয়ম হলো একটি শাস্ত্র নিয়ে তা পুরোপুরি আত্বস্থ করে অন্য শাস্ত্র ধরা। ইমাম বায়হাকী (রহ.) লেখেন, ‘ইমাম শাফেয়ী (রহ.) জনৈক আদীবের কাছে গেলেন এবং তাকে বললেন, ছাত্রদের ইসলাহ করার আগে নিজের নফস শুদ্ধ করুন। কেননা তাদের দৃষ্টি থাকবে আপনার চোখে নিবদ্ধ। সুতরাং তাদের কাছে তাই সুন্দর, যা আপনার কাছে সুন্দর। আর তা অসুন্দর, যা আপনি পরিহার করেন। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব শিক্ষা দিন। তবে এর জন্য জোড়াজুড়ি করবেন না। কেননা তাতে বিরক্তি সৃষ্টি হবে। আবার একেবারে ছেড়েও দেবেন না। এতে তারা কুরআন শিক্ষা ছেড়ে দেবে। শিক্ষার্থীকে কবিতার সুন্দর অংশ শিক্ষা দিন। উত্তম কথার বর্ণনা দিন। ইলম ছাড়া তাদেরকে অন্য কিছুতে নিয়ে যাবেন না। কেননা, একসঙ্গে একাধিক বিষয় শ্রবণ ভ্রষ্টতা সৃষ্টি করে।’
আর ছাত্ররা যখন পরিণত হবে তখন সব শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং তাতে পাণ্ডিত্য অর্জন করাতে দোষ নেই। কারণ এটা তার ভবিষ্যত জীবনে কাজে দেবে। নূন্যতম মূর্খতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য আসবে। তবে ইলমের মূল লক্ষ্য আমলের কথা কখনই ভোলা যাবে না!
তিন. উস্তাদের তত্ত্বাবধানে বিশুদ্ধ ইলম হাসিল করার পর তা মুখস্থ করবে। শুদ্ধ করার আগে কোনো বস্তু মুখস্থ করবে না। কেননা তাতে বিকৃতি ঘটে এবং পরে শুদ্ধতায় ফিরে আসা কঠিন হয়। আমরা আগেই বলে এসেছি, কিতাবকে উস্তাদ বানিয়ে ইলম হাসিল করা খুবই বিপদজনক ব্যাপার। একারণে কেউ কেউ দরসের মজলিসে লিখতে বারণ করে থাকেন। কেননা এতে উস্তাদের কথা বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
চার. হাদীছ পাঠের ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। গতানুগতিকভাবে এই দরস শেষ করবে না। কারণ হাদীছ হচ্ছে ইলমের দ্বিতীয় প্রধান বাহু। সুতরাং হাদীছের অর্থ, তাৎপর্য, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শাব্দিক অর্থ, ইতিহাস, সনদ ইত্যাদি বিষয় অধ্যয়ন করবে। বর্তমান সময়ে প্রচলিত হাদীছের দরস ব্যবস্থার ওপর আত্মতুষ্টি প্রকাশ করবে না, বরং উচ্চতর গবেষণায় লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করবে।
পাঁচ. ছাত্রকে ইলম অন্বেষণের ব্যাপারে উচ্চ হিম্মতের অধিকারী হতে হবে। সুতরাং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে সামান্য ইলমে সন্তুষ্ট থাকা এবং ইরছে নববীর সামান্য অংশ পেয়েই পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যাবে না। ইলমী ফায়েদা হাসিল হওয়ার সুযোগ আসলে সেটা হাতছাড়া করা যাবে না। ভবিষ্যতে শেখা যাবে- এরূপ ধারণায় ইলমী ফায়েদা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অবকাশ নেই। কেননা বিলম্ব আর গাফলতিতে বঞ্ছনা ছাড়া কিছু নয়। কেননা আজ একটা শিখলে ভবিষ্যতে আরেকটা শেখা যাবে। কিন্তু আজ না শিখলে তখন কোনটা শিখবে, আজকের ফেলা যাওয়াটা না সেই সময়েরটা? অবসর এবং মুক্ত সময়ের গুরুত্ব দেবে এবং কাজে লাগাবে। সুস্থতা, তারুণ্য, মানসিক প্রফুল্লতা এবং কম ব্যস্ততার সময়ের মূল্যায়ন করবে। মুখস্থ বিষয়গুলো ধরে রাখার চেষ্টা করবে এবং সামনে আরো বেশি নতুন বিষয় শেখার চেষ্টা করবে। মনে রাখবে, কাঁধে দায়িত্ব চেপে বসলে তখন আর ইলম চর্চার সুযোগ পাবে না। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
تَفَقَّهُوا قَبْلَ أَنْ تُسَوَّدُو ا
‘দায়িত্ব ও নেতৃত্ব লাভের আগেই ইলম হাসিল করে নাও।’
কেননা একবার নেতৃত্ব কাঁধে আসলে পুনরায় ইলমের মজলিসে বসার সুযোগ নাও হতে পারে। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, কোনো ব্যক্তি যখন রবিআর মজলিসে বসতেন এবং রাজদায়িত্ব গ্রহণ করতেন পরে আর ইলমের মজলিসে ফিরে আসার সুযোগ হতো না। ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মাঈন (রহ.) বলেন,
من عاجل الرئاسة فاته علم كثير.
‘যে ব্যক্তি একবার ক্ষমতার মসনদে বসে সে অনেক ইলম থেকে বঞ্চিত হয়।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন,
تفقه قبل إن ترأس، فإذا ترأست فلا سبيل إلى الفقه
‘নেতা হওয়ার আগে ফিকহ অর্জন করো। কেননা নেতা হওয়ার পর ফিকহ হাসিলের পথ পাবে না।’
আর নিজের চোখে নিজেকে পূর্ণ ভাবার এবং উস্তাদের প্রয়োজনীয়তা শেষ মনে করার ব্যধি থেকে হেফাজতে থাকবে। কেননা এটা স্পষ্ট মূর্খতা। কারণ যে কোনো মানুষের জানার চেয়ে না জানার পরিমাণ বেশি। সাঈদ ইবন জুবায়র (রহ.) বলেন,
لا يزال الرجل عالماً ما تعلم
‘মানুষ ততদিনই আলেম থাকে যতদিন সে শেখে।’
যখন সব শাস্ত্রে পূর্ণ দক্ষতা এবং অধ্যয়নের যোগ্যতা পয়দা হবে তখন লেখালেখি শুরু করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই আকাবিরের অনসৃত পথ ধরে চলতে হবে।
ছয়. উস্তাদের দরসে নিয়মিত হাজির থাকবে। কেননা তা কেবল কল্যাণ ও ইলম, আদব ও মর্যাদাই বৃদ্ধি করবে। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
ولا تشبع من طول صحبته، فإنما هو كالنخلة ينتظر متى يسقط عليك منها شيء
‘উস্তাদের সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় থাকায় পরিতৃপ্ত হয়ো না। কেননা তিনি একটি খেজুর গাছের মতো, যা থেকে তোমার ওপর সর্বদা কিছু পড়ার আশা করা যায়।’
দরসে উস্তাদ হাজির হওয়ার আগেই নিজেরা হাজির হবে এবং উস্তাদ হাজির হওয়ার পর কোনোভাবেই অনুপস্থিত থাকা যাবে না। জনৈক বুযুর্গ বলেন,
من الأدب مع المدرس إن ينتظره الفقهاء ولا ينتظرهم
‘উস্তাদের প্রতি আদব হচ্ছে তার অপেক্ষায় থাকা, তাকে অপেক্ষায় রাখা নয়।’
আরো আদব হচ্ছে দরসে তন্দ্রা-নিদ্রা, কথাবার্তা, হাসি-তামাশা থেকে বিরত থাকা। উস্তাদ যে বিষয়ে আলোচনা করছেন সে বিষয়ের বাইরে কথা না বলা। তার খেদমতের জন্য সদা তৎপর থাকা। কেননা এটা তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব আনয়নকারী। দরস শেষে জেহেন বিক্ষিপ্ত হওয়ার আগেই পঠিত বিষয়গুলো পুনরায় মুজাকারা করে নেওয়া এবং পরেও মুজাকারা করা। আর মুজাকারার সর্বোত্তম সময় হচ্ছে রাত্রি। আমাদের পূর্বসূরীগণ রাতে মুজাকারা করতেন এবং কখনও কখনও ফজরের আযান শুনে মুজাকারা ছাড়তেন! কোনো ছাত্র যদি মুজাকারার সঙ্গী না পায় তবে নিজে নিজেই মুজাকারা করবে। অন্তরে ওই শব্দের অর্থ বারবার বসাবে। কেননা বারবার অন্তরে অর্থ স্থান দেওয়া জবানে বারবার তাকরার করার মতোই। ওই ব্যক্তি কমই সফল হয়েছে, যে উস্তাদের দরসে শোনা বিষয় পরে আর মুজাকারা করেনি।
সাত. দরসের মজলিস কায়েম হওয়ার পর সকলকে সালাম প্রদান করবে এবং উস্তাদের প্রতি বিশেষ সম্মান ও তাজিম প্রকাশ করবে। উস্তাদের কাছে পৌঁছার জন্য অন্যদের ডিঙিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। বরং যেখানে জায়গা পাবে সেখানেই বসে যাবে। হাদীছে এভাবেই আমল করতে বলা হয়েছে। অবশ্য উস্তাদ যদি আদেশ করেন কিংবা তার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থাকে অথবা অন্যরা তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামনে যেতে বলে তবে সেটা ভিন্ন কথা। আর উস্তাদের কাছাকাছি বসার ব্যাপারে অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য দেবে না। হ্যাঁ, মর্যাদা, সম্মান, বয়স, বুযুর্গী ইত্যাদি কারণ থাকলে সেটা করতে পারে। ছাত্র অধিক হলে উচিত হচ্ছে সবাই উস্তাদ বরাবর সামনে বসা। যাতে উস্তাদের দৃষ্টি সবার দিকে নিবদ্ধ করা সহজ হয়।
আট. উস্তাদের মজলিসে উপস্থিত অন্যদেরকে সম্মান করবে। কেননা এটাও উস্তাদকে সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত। মজলিসের দুইজনের মাঝখানে অনুমতি ছাড়া বসবে না। অনুমতি দিয়ে জায়গা খালি করে দিলে জমে বসে যাবে। আর নিজেও অন্যকে সুযোগ করে দেয়ার চেষ্টা করবে।
মজলিসে উপস্থিত লোকদের আরো কর্তব্য হচ্ছে, আগত ব্যক্তিকে মারহাবা বলা এবং তার জন্য জায়গার ব্যবস্থা করা। দরসের মধ্যে কোনো কথা বলার ইচ্ছা জাগলেও নীরবতার লাগাম দ্বারা তা থামিয়ে রাখা। দরসে কোনো ছাত্র খারাপ ব্যবহার করলে তাকে উস্তাদ বৈ নিজে শাসন না করা।
নয়. যা বুঝে আসেনি সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ না করা। তবে বুঝার জন্য মার্জিত ও ভদ্রভাষায় জিজ্ঞেস করা। বলা হয়ে থাকে-
من رقّ وجهه عند السؤال، ظهر نقصه عند اجتماع الرجال.
‘যে ব্যক্তি কিছু জানার সময় চেহারা সংকুচিত করে জনসমাগমে তার নিচুতা ধরা পড়ে।’
দরসে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করবে না এবং উস্তাদ জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকলে পীড়াপীড়ি করবে না। আর উস্তাদ ভুল জবাব দিলে তখন তা প্রকাশ করবে না। বরং পরে সুযোগমতো একাকী বলবে। ছাত্রদের জন্য যেমন সওয়াল করা দোষের নয়, তেমনিভাবে উস্তাদ জিজ্ঞেস করলে ‘বুঝিনি’ বলাও দোষের নয়। কেননা এতে বর্তমান-ভবিষ্যত উভয় রকমের উপকারিতা রয়েছে। নগদ উপকারিতা হচ্ছে মাসআলা হল হওয়া এবং উস্তাদের আস্থা অর্জন করা। আর ভবিষ্যতের উপকারিতা হচ্ছে মিথ্যা ও কপটতা থেকে হেফাজত থাকা।
দশ. নিজের হকের রেয়ায়াত করবে এবং হকদারের অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ তাতে অগ্রসর হবে না। অবশ্য খতীব বাগদাদী বলেন, অগ্রাধিকার প্রাপকের জন্য অপরিচিতকে সুযোগ দেওয়া মুস্তাহাব। আর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত পেশাব-পায়খানা, অজু ইত্যাদি জরুরতের কারণে বাইরে গেলে এতে তার হক রহিত হবে না।
এগার. কিতাবাদী নিয়ে উস্তাদের সামনে তাজিমের সঙ্গে বসবে এবং তার অনুমতি পাওয়ার পর পাঠ করতে শুরু করবে। পাঠ বা অন্য সময় কিতাবকে অশোভনীয় ও এলোমেলোভাবে কিংবা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখবে না।
বার. যখন নিজের পড়ার পালা আসবে তখন উস্তাদের অনুমতিক্রমে পাঠ করা শুরু করবে এবং প্রথমে আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আল্লাহর প্রশংসা, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠ করবে। অতপর উস্তাদ, তার মাশায়েখ এবং পিতামাতা, নিজের এবং সকল মুসলিমের জন্য দু‘আ করবে। প্রত্যেক দরস, মুতালাআ. তাকরার এবং মুজাকারার সময় এরূপ আমল করবে। উস্তাদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি উভয় অবস্থায় দু‘আ করবে এবং উস্তাদের জন্য দু‘আয় বলবে-
ورضي الله عنكم وعن شيخنا وإمامنا
‘আল্লাহ আপনাদের ওপর, আমাদের শায়খ ও গুরুর ওপর সন্তুষ্ট হোন।’ ছাত্র যেমন উস্তাদের জন্য দু‘আ করবে উস্তাদও তেমনিভাবে ছাত্রের জন্য দু‘আ করবে। আর ছাত্র যদি উল্লিখিত নিয়মে পাঠ শুরু করতে ভুলে যায় তবে উস্তাদ সুন্দরভাবে তা বুঝিয়ে দেবেন। কেননা এটাই নিয়ম।
তেরো. দরসের অন্য ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করবে। তাদের পেরেশানি ও হতাশা-নিরাশা দূর করার চেষ্টা করবে। তার যে ফায়েদা হাসিল হয়েছে অন্যদেরকেও তাতে শরিক করবে। দীনের ব্যাপারে তাদেরকে নসিহত করবে। এর দ্বারা তাদের ক্বলব আলোকিত হবে, আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। কিন্তু কখনই নিজের ইলমের জন্য ফখর কিংবা অন্যকে ছোট ভাববে না। বরং এরজন্য সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে শোকরিয়া জানাবে।
সপ্তম পর্ব:
ইলমের মাধ্যম কিতাবাদীর সঙ্গে আচরণ
এক. ছাত্রদের উচিত হচ্ছে ইলম হাসিলের মাধ্যম জরুরীকিতাবগুলো ক্রয় করে পাঠ করা। তবে শুধু কিতাব সংগ্রহ করাকে ‘ইলম হাসিল হয়ে গেল’ বলে মনে করবে না। জনৈক বুযুর্গ বলেন,
إذا لم تكن حافظاً واعياً، فجمعك للكتب لا ينفع
‘তুমি যদি নিজে সংরক্ষণকারীই না হও, তবে সংগ্রহকৃত কিতাব তোমার উপকারে আসবে না।’
কিতাব কেনা সম্ভব হলে দরসের আলোচ্য বিষয় লিখে নেয়ার দরকার নেই। অপরাগতা ছাড়া সর্বদা এই লিখে নেয়ার চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকা কাম্য নয়। ক্রয় বা ইজারা নেয়ার সুযোগ থাকা অবস্থায় কিতাব ধার নেয়ার চেষ্টা করবে না। কিতাব লিখতে হস্তাক্ষর সুন্দর করার চেষ্টা করবে বটে, তবে সুন্দর হস্তাক্ষরের চেয়ে বিশুদ্ধ করার প্রতি নজর বেশি দেবে।
দুই. ক্ষতি করার আশঙ্কা না থাকলে কাউকে কিতাব ধার দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। কেননা কিতাব ধার দেয়াও ইলমের সহযোগিতা করার শামিল। অথচ সাধারণ বস্তু ধার দেয়াতেই অনেক ফযীলত রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি বিখ্যাত মনীষী আবূল আতাহিয়াকে বললেন, ‘আমাকে আপনার কিতাব ধার দিন। জবাবে তিনি বললেন, আমি কিতাব ধার দেওয়া অপছন্দ করি। তখন ওই লোকটি বললেন, আপনি কি জানেন না যে, সম্পর্ক বজায় থাকে অপ্রিয়তার মধ্য দিয়েই? তার কথা শুনে তিনি তাকে কিতাব ধার দিলেন।’
আর ধারগ্রহীতার উচিত হচ্ছে ধারদাতার শোকরিয়া আদায় ও কিতাবের হেফাজত করা। প্রয়োজন ছাড়া দীর্ঘ সময় নিজের কাছে ওই কিতাব না রাখা। ধার নেওয়া কিতাবে কোনো কিছু না লেখা। মালিকের অনুমতি ছাড়া তাতে কোনো কিছু সংযোজন না করা এবং তা তৃতীয় কাউকে না দেয়া। তবে কিতাব যদি অনির্দিষ্টভাবে ওয়াকফের হয় তবে সতর্কতার সঙ্গে তাতে কিছু যোগ করা বা যোগ্যতার শর্তে তাতে ভুল থাকলে সংশোধন করার অবকাশ আছে। জনৈক ব্যক্তি বুঝি কিতাব ধার দিয়ে ভোগান্তিতে পড়েই নিম্নোক্ত কবিতাটি বলেছিলেন!
أيها المستعير مني كتاباً … ارض لي فيه ما لنفسك ترضى
‘হে আমার কিতাবগ্রহীতা! এতে আমার ব্যাপারে তাই পছন্দ করো যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ করো!
তিন. পাঠ বা লেখার সময় কিতাব ভূমিতে ছড়িয়ে রাখবে না। বরং বেঞ্চ বা কিতাব রাখার সাধারণ স্থানে রাখবে। যাতে কিতাব হেফাজতে থাকে এবং মলাট দ্রুত খুলে না যায়। ভূমি থেকে উঁচু ও শুষ্কস্থানে কিতাব রাখবে, যাতে তা ভিজে না যায়। তাকের ওপর কিতাব রাখার সময় মর্যাদা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রাখবে। অতএব কুরআন মাজীদ হলে তা সবার ওপরে রাখবে। আর উচিত হচ্ছে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন তাকে কুরআন মাজীদ রাখা। অতপর ধারাবাহিকভাবে নিরেট হাদীছ, তাফসীর, উসুলে দীন, উসুলে ফিকহ, ফিকহ, নাহব, সরফ, আরবী শের ইত্যাদি কিতাব রাখা। যদি দুটি কিতাব শাস্ত্রীয় মর্যাদায় সমান হয় তবে যাতে কুরআনের আয়াত বা হাদীছ বেশি সেটা ওপরে রাখা। যদি তাতেও সমান হয় তবে মুসান্নিফের মর্যাদা অনুসারে ওপরে-নিচে রাখা। যদি এতেও দুইজন সমান সমান হন তবে সংকলনে যিনি অগ্রগামী এবং মানুষের হাতে যার কিতাব বেশি সেটা ওপরে রাখা। কিতাবের নাম শেষ পৃষ্ঠায় নিচে লিখবে, যাতে অনেকগুলোর মধ্যে থেকে তা বের করা সহজ হয়। সাবধান! কিতাবকে কখনও পাখার কাজে ব্যবহার করবে না, এর সঙ্গে হেলান দেবে না এবং এর দ্বারা মশা, মাছি মারবে না বা তাড়াবে না কিংবা এর ওপর মশা বসলে সেখানেই মশা মেরে ফেলবে না।
চার. কারো কাছ থেকে কিতাব ধার নিলে যথাযথ অবস্থায় ফেরত দেবে। ভাজ করা, দাগ কাটা, অপ্রাসাঙ্গিক কিছু লেখা ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত থাকবে।
পাঁচ. শরঈ ইলমের কোনো কিতাব লিখলে শরীর, কাপড় ও মনের পবিত্রতা নিয়ে কিবলামুখী হয়ে বসবে। যে কোনো কিতাব – بسم الله الرحمن الرحيم দ্বারা শুরু করবে। কিতাবের ভূমিকা হলে এর সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার হামদ এবং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদও যুক্ত করবে। এরপর কিতাবের মূল বিষয় লিখবে। লিখনীর মধ্যে যতবার আল্লাহ তা‘আলার নাম আসবে ততবার তাজিমসূচক কোনো শব্দ যুক্ত করবে। যেমন, তা‘আলা, সুবহানাহু, আয্যা ওয়া জাল্লা, তাকাদ্দাসা ইত্যাদি। আর যতবার রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম আসবে ততবার সালাত ও সালাম পাঠ করবে।
বুযুর্গানে কেরাম সালাত ও সালাম উভয়টি পাঠ করতেন এবং এর সঙ্গে তাঁর পরিবার-পরিজনকেও শামিল করে এভাবে বলতেন,
صلى الله عليه وعلى آله وسلم
যদি বারবারও লেখার প্রয়োজন পড়ে তবু দরূদের কোনো বাক্য সংক্ষিপ্ত করবে না। যেমন, (সা.), (দ.) (আ.) কিংবা আরবীতে লিখলে, صلع، أو صلم، أو صلم،
এসব সংকীর্ণতা ও কৃপণতা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান সত্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সাহাবায়ে কেরামের নাম আসলে রাদিয়াল্লাহ তা‘আলা আনহু, পুণ্যবান পুর্বসুরী ও নেককার ব্যক্তিত্বগণের নাম আসলে রাহিমাহুল্লাহ তা‘আলা লিখবে।
ছয়. অতি সূক্ষ্ম এবং অস্পষ্ট হস্তাক্ষরে কোনো কিছু লিখবে না। বুযুর্গানে কেরাম বলেন, তুমি সেটাই লিখ, প্রয়োজনের সময় যা তোমার কাজে দেয়। তা লিখ না, প্রয়োজনের সময় যা তোমাকে কাজে দেয় না। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শেষ বয়স ও বার্ধক্যকাল। অনেকে নানা কারণে সংক্ষেপ ও ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখে। কিন্তু মনে রাখা উচিত, বার্ধক্যের সময় ক্ষুদ্রলেখা পাঠ করতে সমস্যা হবে।
সাত. নিজের লেখা বা কিতাবের কোনো বিষয় উস্তাদ বা অন্য কোনো কিতাবের সাহায্যে সহীহ-শুদ্ধ করে নেয়ার সময় হরকত দিয়ে আলামতযুক্ত করে রাখবে। ভুলের স্থানও চিহ্নিত করে রাখবে। শুদ্ধ ও সংস্কার করে নেয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করার রীতি আছে সেগুলো ব্যবহার করবে।
আট. লেখার শিরোনাম, উপশিরোনাম, অধ্যায়, পর্ব, ভূমিকা, উপসংহার ইত্যাদি লাল বা মোটা হরফে লেখাতে দোষ নেই। কেননা এভাবে পাঠোদ্ধার সহজ হয়। এমনিভাবে মাযহাব, ইমামের নাম, তাদের বক্তব্য, অভিধান, সংখ্যা ইত্যাদি ভিন্ন কালিতে লেখা যেতে পারে। কিতাবে কোনো বিষয় নতুন যুক্ত করলে কিংবা সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করলে শুরুতে পাঠককে সে ব্যাপারে অভিহিত করবে। যাতে প্রকৃত মর্ম উদ্ধার করা সহজ হয়।
নয়. কোনো কিছু মুছে ফেলার দরকার হলে লেখার ওপরে দাগ টেনে দেবে। খুটিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করবে না। বলা হয়ে থাকে- الضرب أولى من الحك
লেখাপড়া, আমল-আখলাক, চাল-চলন, কাজকর্ম সবকিছুতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আহলে বায়ত, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, ফকীহ, মুহাদ্দিসীন, মুসান্নিফ, মুআল্লিফ, রাহবার, শায়খ-উস্তাদ প্রত্যেককে তার প্রাপ্য সম্মান প্রদান করবে। তাদের আন্তরিক দোয়াকে নিজের জীবনের সফলতা লাভের সিঁড়ি বলে মনে করবে।
শিশুদের প্রতি অবশ্যই সহমর্মী ও কোমল হতে হবে
মানুষের স্বভাব কোমলতাপ্রিয়। শিশু ও কিশোর বয়সে স্বভাব তো আরো বেশি কোমল থাকে। এই সময় শিশু ও কিশোররা প্রতিটি বস্তু কোমলভাবে পেতে চায়। আর এটাই বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতা দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের স্বভাব গড়েছেন। তাই উস্তাদগণকে সর্বদা এই ফিতরী স্বভাবের প্রতি খেয়াল করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলাও তো বান্দার ওপর কঠিন কোনো কাজ চাপিয়ে দেননি। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
‘আল্লাহ বান্দার জন্য দুঃসাধ্য কোনো কিছু আরোপ করেন নি।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬}
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠোরতা চান না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
সুতরাং শিশু-কিশোরদের প্রতি কঠোরতা করা বাঞ্ছনীয় নয়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুর প্রতি সীমাহীন করুণাকামী ও কোমল ছিলেন। তিনি ইরশাদ করেন-
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَلَمْ يَعْرِفْ حَقَّ كَبِيرِنَا »
‘যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বড়দের অধিকার সম্পর্কে জানে না, সে আমাদের দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ [মু‘জামুল কাবীর: ৮১৫৪]
সুতরাং শিশুদের মনে ক্লান্তি সৃষ্টি করে এধরনের কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাদেরকে স্নেহশীলতার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার বিষয়টি সর্বদা মাথায় রাখা চাই।
পরিশিষ্ট: বিবিধ প্রসঙ্গ
আলেমগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামর্থ থাকার প্রয়োজনীয়তা
আলেমগণ হালাল-হারাম সম্পর্কে সম্যক অবগত। তাই হালাল-হারাম মেনে চলার দায়িত্বও তাদের বেশি। হালাল-হারামের প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় জীবিকার ক্ষেত্রে। তাই জীবিকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হালালপন্থা অবলম্বন করা এবং হারাম ও সন্দেহজনকপন্থা থেকে দূরে রাখা পবিত্র দায়িত্ব। কোনো কোনো হাদীছে হালাল উপার্জনকে অন্যতম ফরয বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য হাদীছে ব্যবসা এবং হাতের কামাইকে সর্বোত্তম উপার্জন আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন-
أفضلُ الكَسْبِ بَيْعٌ مَبْرُورٌ وَعَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ
‘মানুষের সর্বোত্তম উপার্জন হলো বৈধ ব্যবসা এবং হাতের কাজের উপার্জন।’ [ছহীহুল জামে‘: ১১২৬, সহীহ]
শেষ জমানায় হারামের ছড়াছড়ি এবং হালাল উপার্জনের ঘাটতি দেখা দেবে বলে হাদীছে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং গোটা উম্মতের এই ক্রান্তিলগ্নে অন্তত আলেমকে যে কোনো মূল্যে হারাম থেকে বাঁচা এবং হালালপন্থা আকড়ে ধরে রাখা একান্ত কর্তব্য। শেষ জমানায় দীন সাপের গুহায় প্রবেশের ন্যায় মদীনার দিকে বিদায় নিতে থাকবে। ওই দুর্যোগের সময়েও আলেমগণ সহীহ দীন ধরে রাখবেন এটাই একান্ত কাম্য। আর এই প্রচেষ্টা নবীদেরই পবিত্র আখলাকের অন্যতম অংশ। যেমন, হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أُمِرَتِ الرُّسُلُ أنْ لا تَأْكُلَ إلاَّ طَيِّباً ولا تَعْمَلَ إلاَّ صالِحاً
‘রাসূলগণকে একমাত্র হালাল ভক্ষণ এবং একমাত্র নেক কাজের আদেশ করা হয়েছে।’ [ছহীহুল জামে‘: ১৩৬৭, হাসান]
আল্লাহ তা‘আলা অলস লোক পছন্দ করেন না। বস্তুত হালাল উপার্জনে সাধারণ পেশা অবলম্বন করা আদৌ দোষের বিষয় নয়। স্বয়ং নবী-রাসূলগণও সাধারণ পেশা অবলম্বন করতে লজ্জাবোধ করতেন না। আল্লাহর নবী মূসা (আ.) কায়িক শ্রম করেছেন। আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও শারীরিক পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন।
আর বিশেষ করে আলেমদের জন্য হালাল রুজির স্বল্পতায় বিচলিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট রিজিক পূর্ণ না করে মৃত্যুবরণ করবে না।
অবৈধ বা সন্দেহজনকপন্থা পরিহার করে হালাল রুজির পন্থা অবলম্বন করাই একজন আলেমের বড় শান। হাদীছে এ ধরনের সাহসী লোকদের প্রশংসা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
التَّاجِرُ الجَبانُ مَحْرُومٌ والتَّاجِرُ الجَسُورُ مَرْزُوقٌ
‘ভীরু ব্যবসায়ী বঞ্চিত এবং সাহসী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয়।’ [জামে ছগীর: ৩৩৯৫, হাসান]
দীনী খেদমতের পাশাপাশি যদি বৈধ কোনো ব্যবসার সুযোগ এসে যায়, তবে তা হাতছাড়া করা ঠিক নয়। অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাও অপছন্দ করেন। অন্যের কাছে হাত পাতার চেয়ে নিজে যে কোনো হালাল পন্থায় উপার্জন করা উচিত। হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: «الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى، وَالْيَدُ الْعُلْيَا الْمُنْفِقَةُ، وَالسُّفْلَى السَّائِلَةُ»
‘ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, উচু হাত নিচু হাত থেকে উত্তম। খরচকারী হাত হলো উচু হাত আর নিচু হাত হলো প্রার্থনাকারী হাত।’ [মুসলিম: ১০৩৩]
সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) বলেন,
المال سلاح المؤمن في هذا الزمان
‘এই যুগে মুমিনের সম্পদ আত্মরক্ষাকারী অস্ত্রের মতো অপরিহার্য।’
পুত্রকে খালেদ ইবন সাফওয়ানের উপদেশ-
يا بني أوصيك باثنتين لن تزال بخير ما تمسكت بهما درهمك لمعاشك ودينك لمعادك
‘হে বৎস! আমি তোমাকে দুটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত তা ধারণ ও লালন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে। যথা, দিরহাম রাখবে দুনিয়ার জন্য আর দীনকে রাখবে আখেরাতের জন্য।’
বিদ্বানগণ বলেন,
لا خير فيمن لا يجمع المال يصونُ به عرضَه، ويحمي به مروءتَه ويصل به رحِمَه
‘ওই ব্যক্তির মধ্যে কল্যাণ নেই, যে নিজের সম্ভ্রম ও আভিজাত্য রক্ষা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখার জন্য মাল-সম্পদ সঞ্চয় করে না।’
সর্বোপরি শক্তিশালী মুমিনকে হাদীছে দুর্বল মুমিনের চেয়ে শ্রেয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। সহীহ হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلا تَعْجَزْ
‘শক্তিশালী মুমিন উত্তম ও আল্লাহর কাছে প্রিয়, দুর্বল মুমিনের চেয়ে। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ এবং যা তোমার জন্য কল্যাণকর তা হাসিল করো, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর এবং অপারগ হয়ো না।’ [মুসলিম: ২৬৬৪]
ছাত্রদের পরীক্ষার সময় করণীয়
পরীক্ষা ছাত্রজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। সারাবছরের শ্রম ও মেহনতের ফসল তোলা হয় পরীক্ষার বোঝা বহন করে। তাই পরীক্ষা ছাত্রজীবনের যেমন গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তেমনিভাবে সফলতা লাভেরও দ্বার। এজন্যই বলা হয়-
عند الامتحان يكرم الرجل أو يهان
‘পরীক্ষার সময় কেউ সম্মানীত এবং কেউ লাঞ্ছিত হয়।’
তবে পরীক্ষায় সাফল্য লাভের জন্য বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে। সেগুলো অবলম্বন করলে আশা করা যায় আশাতীত সাফল্য লাভ করা যাবে। নিম্নে সেসব বিষয় তুলে ধরা হলো।
পরীক্ষায় সাফল্য লাভে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে-পরে অব্যাহতভাবে দু‘আ করা এবং আল্লাহ তা‘আলার দিকে মনোনিবেশ। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছাড়া কোনো কিছু হয় না। তাই পরীক্ষার সাফল্য লাভে তারই দিকে মনোনিবেশ করা। আর দু‘আ যে কোনো শরঈ শব্দ দ্বারা হতে পারে। যেমন-
﴿ رَبِّ ٱشۡرَحۡ لِي صَدۡرِي ٢٥ وَيَسِّرۡ لِيٓ أَمۡرِي ٢٦ وَٱحۡلُلۡ عُقۡدَةٗ مِّن لِّسَانِي ٢٧ يَفۡقَهُواْ قَوۡلِي ٢٨ ﴾ [طه: ٢٥، ٢٨]
‘হে আমার রব, আমার বুক প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন।যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ {সূরা ত-হা, আয়াত: ২৫-২৮}
পরীক্ষার দিনের করণীয় হচ্ছে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা এবং নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষার হলে যাওয়া। হলে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় যাবতীয় বস্তু সঙ্গে রাখবে। যেমন, কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, ঘড়ি এবং প্রয়োজনীয় ও পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য আসবাবপত্র। কেননা উত্তম প্রস্তুতি উত্তম জবাব প্রদানে সহায়ক। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বের হওয়ার দু‘আর কথা তো বলাই বাহুল্য। যথা-
عن أنس رضي الله عنه، قَالَ: قَالَ رَسُول الله ﷺ: «مَنْ قَالَ – يَعْني: إِذَا خَرَجَ مِنْ بَيتِهِ -: بِسمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ، وَلا حَولَ وَلا قُوَّةَ إلاَّ باللهِ، يُقالُ لَهُ: هُدِيتَ وَكُفِيتَ وَوُقِيتَ، وَتَنَحَّى عَنْهُ الشَّيطَانُ»رواه أبو داود والترمذي والنسائي وغيرهم . وَقالَ الترمذي: «حديث حسن»، زاد أبو داود: «فَيَقُولُ – يَعنِي: اَلشَّيْطَانُ لِشَيْطَانٍ آخَر: كَيفَ لَكَ بِرجلٍ قَدْ هُدِيَ وَكُفِيَ وَوُقِيَ ؟»
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজ গৃহ থেকে বের হওয়ার সময় বলে, বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, অলা হাওলা অলা ক্বুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। (অর্থাৎ আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পাপ থেকে ফিরা এবং পুণ্য করা সম্ভব নয়।) তাকে বলা হয়, তোমাকে সঠিক পথ দেওয়া হল, তোমাকে যথেষ্টতা দান করা হল এবং তোমাকে বাঁচিয়ে নেওয়া হল। আর শয়তান তার নিকট থেকে দূরে সরে যায়। [আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ প্রমুখ]
তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। আবু দাউদ এই শব্দগুলি বাড়তি বর্ণনা করেছেন, ফলে শয়তান অন্য শয়তানকে বলে যে, ওই ব্যক্তির ওপর তোমার কিরূপে কর্তৃত্ব চলবে, যাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা হয়েছে, যাকে যথেষ্টতা দান করা হয়েছে এবং যাকে (সকল অমঙ্গল) থেকে বাঁচানো হয়েছে? [তিরমিযী: ৩৪২৬; আবূ দাউদ: ৫০৯৫]
পরীক্ষা শুরু করার আগে অবশ্যই বিসমিল্লাহ বলবে। কেননা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে বিসমিল্লাহ বলা জরুরীএবং তা বরকত লাভের মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য পাওয়ার উপায় এবং তাওফীক প্রাপ্তির মহা নিয়ামক।
পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে এবং পরীক্ষার পড়াশোনার সময় সাথী-সঙ্গীর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করবে। তাদেরকে আশান্বিত করবে এবং তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও হতাশাগ্রস্থ করবে না। বরং তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে। পরীক্ষায় সাফল্য লাভের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করবে ও বিভিন্নভাবে শুভ লক্ষণ বুঝাবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রাণিত করতেন এবং শুভ লক্ষণ দিতেন। যেমন, সুহাইল নামের শুভ লক্ষণ নিতেন ‘সব কাজ সহজ হয়ে যাওয়া বলে।’ আর তিনি ঘর হতে বের হওয়ার সময়-
يا راشد يا نجيح
‘হে রাশেদ, হে সফলকাম।’ এ ধরনের বাক্য শুনতে পছন্দ করতেন। কেননা রাশেদ শব্দের অর্থ হচ্ছে পথপ্রাপ্ত আর নাজিহ শব্দের অর্থ মুক্তিপ্রাপ্ত।
অতএব, ছাত্ররা নিজে এবং অন্যদের জন্য শুভলক্ষণ নেবে এবং সঙ্গীদেরকে বলবে, ‘অবশ্যই তুমি পরীক্ষায় সফল ও কামিয়াব হবে।’
আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ পেরেশানি দূর করার অব্যর্থ ওষুধ। সুতরাং যখনই কোনো পেরেশানিতে পড়বে কিংবা কোনো প্রশ্নের জবাবের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়বে তখনই দুয়েকবার আল্লাহ তা‘আলার নাম স্মরণ করবে এবং তাঁর কাছে দু‘আ করবে, যাতে তিনি উপস্থিত সমস্যার সমাধান করে দেন।
শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রহ.) কোনো বিষয়ে অবোধগম্যতার সম্মুখীন হলে এবং কোনো বিষয় সহজে বুঝে না আসলে এরূপ দু‘আ করতেন,
يا معلّم ابراهيم علمني ويا مفهّم سليمان فهمني .
‘হে ইবরাহীমের শিক্ষক আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন এবং হে সুলায়মানকে বুঝিয়েদাতা আমাকে বুঝিয়ে দিন।’
আপনিও পরীক্ষার হলে কিংবা মুতা‘আলার সময় এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে উল্লিখিত দু‘আটি পাঠ করতে পারেন। আশা করা যায় ভালো ফল পাওয়া যাবে।
পড়াশোনার জন্য ভালো স্থান নির্বাচন করুন এবং পরীক্ষার হলেও মাদরাসার পক্ষ থেকে সিট নির্দিষ্ট না করা হলে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও নিরিবিলি স্থানে আপনার বসার স্থান নির্ধারণ করুন। আর নির্দিষ্ট করা থাকলে সেখানে সুন্দরভাবে, সুন্নাত তরিকায় উপবেশন করুন।
প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত পূর্ণ সময়কে আপনি ভাগ করে ফেলুন এবং মোট সময়ের অন্তত দশ ভাগ সময় গভীরভাবে ও মনোযোগসহকারে প্রশ্ন পাঠের জন্য নির্ধারণ করুন। এরপর প্রশ্নের পরিস্থিতি অনুযায়ী আবশ্যকীয় জবাব লেখার জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করুন এবং প্রতিটি জবাব নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ করার বিষয়টি নিশ্চিত করুন।
প্রশ্ন পাঠ করে প্রতিটি প্রশ্নের চাওয়া জবাবের মূল অংশ কোনটি- সেটা চি‎‎হ্নিত করার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, প্রতিটি প্রশ্নে চাওয়ার একটা মূল জায়গা থাকে। সেই অংশটুকু যদি সুন্দর করে লেখা যায় তবে ওই প্রশ্নের অন্য আনুষঙ্গিক অংশে ঘাটতি থাকলেও তাতে তেমন প্রভাব ফেলে না। পক্ষান্তরে প্রশ্নে চাওয়া বিষয়ের বাইরে গিয়ে অনেক কিছু লিখলেও নাম্বার পাওয়ার ক্ষেত্রে তা তেমন কাজে দেয় না।
লেখা শুরু করার আগে অপেক্ষাকৃত সহজগুলো দাগ দিয়ে চি‎‎হ্নিত করুন এবং সেগুলোই আগে লেখা শুরু করুন। জবাব শুরু করার আগে কোন্ প্রশ্নে মৌলিকভাবে কী বিষয় উপস্থাপন করতে হবে পারলে তাও চি‎হ্নিত করে নিন।
এরপর যে জবাব সবচেয়ে বেশি ভালো জানা আছে, আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে সেই জবাব আগে শুরু করুন এবং ধারাবাহিকভাবে এই নিয়মই বজায় রাখুন এবং সর্বশেষে লেখার তালিকায় রাখুন সেই জবাব, যে ব্যাপারে আপনার জানাশোনা তুলনামূলক কম এবং সে ব্যাপারে আপনি সন্দিহান।
জবাব লেখার সময় সাবলীলতার সঙ্গে ধীর-স্থীরতা অবলম্বন করুন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি কাজে এমন পন্থাই অবলম্বন করতেন। তিনি ইরশাদ করেন-
«التَّأَنِّي مِنَ اللَّهِ وَالْعَجَلَةُ مِنَ الشَّيْطَانِ»
‘ধীরস্থীরতা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এবং তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে।’ [বাইহাকী: ৪০৫৮; হাসান, আলবানী, সিলসিলা সহীহা: ১৭৯৫]
সঠিক উত্তর নির্ণয়ের যে প্রশ্ন থাকে (যেমন, বলা থাকে, সঠিক উত্তরের পাশে (টিক) চি‎হ্ন দাও) সেসব প্রশ্নের উত্তর নির্ণয়ের জন্য বারবার ফিকির করতে হবে এবং ফিকির করার পর সহীহ জবাবের ব্যাপারে দৃঢ়বিশ্বাস সৃষ্টি হলে ওয়াসওয়া ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব মন থেকে তাড়িয়ে দেবে। আর কোনো বিষয়ে দৃঢ়তা পয়দা না হলে সম্ভাব্য জবাবগুলোর মধ্য থেকে সহীহ জবাব খুঁজে বের করার জন্য চেষ্টা করবে এবং প্রবল ধারণা অনুযায়ী যেটাকে সহীহ জবাব বলে মনে হবে সেটাকে চি‎হ্নিত করবে।
আর কোনো জবাবকে সহীহ বলে চি‎‎হ্নিত করার পর শুধু দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে সেটাকে কেটে দেবে না। হ্যাঁ, যদি অন্যটা সহীহ হওয়ার ব্যাপারে প্রবল ধারণা এবং আগেরটা ভুল হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ধারণা হয় তবে সেটা ভিন্ন কথা।
লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে জবাব লেখা শুরুর আগে জেহেনকে স্থীর ও মনোযোগী করে নেবে। সম্ভব হলে কিছু হরফ দিয়ে ইশারা করে রাখবে, যাতে জবাবের কোনো বিশেষ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত থাকবে। জবাবের প্রধান ও মূল অংশ শুরুতে লিপিবদ্ধ করবে। এর দ্বারা পরীক্ষকের আস্থা তৈরি হয় এবং ছাত্রটি জবাবের গভীরে পৌঁছতে পেরেছে বলে উস্তাদ বিশ্বাস করেন। ফলে এতে যথাযথ নাম্বার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
প্রশ্নপত্রে নজরে ছানী বা পুনরায় দেখার জন্য অবশ্যই কিছু সময় নির্দিষ্ট করবে এবং তা শতকরা হারেও হতে পারে। আর নজরে ছানী অবশ্যই ধীরেসুস্থে হতে হবে এবং এখানে কোনোক্রমেই তাড়াহুড়া করা যাবে না। বিশেষ করে যদি অংক পরীক্ষা কিংবা হিসাব জাতীয় পরীক্ষা হয়। যেমন, মিরাছের সিরাজী কিংবা এধরনের কোনো পরীক্ষা।
প্রশ্নপত্র জমা দেয়ার ব্যাপারে কখনই তাড়াহুড়ো করবে না এবং যারা তাড়াহুড়ো করে খাতা দিয়ে হল থেকে বের হয়ে যায় তাদের দ্বারা উৎসাহিত হবে না। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার হলে একদল ছাত্র এমন থাকবেই, যারা দ্রুত হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। সুতরাং কখনই তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করবে না।
পরীক্ষার পর কোনো উত্তরপত্রে ভুল ধরা পড়লে তাতে বিমর্ষ না হয়ে পরবর্তী পরীক্ষা ভালো করার জন্য মনোযোগী হবে এবং পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে তাড়াপ্রবণ না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করবে। সর্বোপরী আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালার ওপর তুষ্ট থাকবে এবং এই বিশ্বাস নেবে যে, তার ইশারা ছাড়া কলম নড়ে না। অতএব ভুল যা হওয়ার তা এড়ানো সম্ভব ছিল না। তাই সামনে যাতে ভুল না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে আরো ভালো প্রস্তুতি নেবে। আরো মনে রাখবে যে, ভুলের জন্য হা-পিত্যেস করলে কেবল কষ্টই বাড়বে, কোনো ফল হবে না। এক্ষেত্রে হাদীছের কথা স্মরণ করবে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ، فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ»
‘কোনো কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে এমন বলো না, ‘যদি এরূপ করতাম তবে এরূপ হতো’। বরং এরূপ বলো, যা হওয়ার তা আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালায় হয়েছে। কেননা, ‘যদি’ বলা শয়তানের পথ খুলে দেয়।’ [সহীহ মুসলিম: ২৬৬৪]
মনে রাখবে ধোঁকাবাজি সর্বাবস্থায় হারাম। চাই তা যে ভাষারই হোক না কেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنَّا»
‘যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ [মুসলিম: ১০২; তিরমিযী: ১৩১৫]
সুতরাং পরীক্ষার হলে অবৈধ উপায়ে নাম্বার লাভ করা এবং এর ভিত্তিতে সনদ কিংবা ক্লাসের মর্যাদা লাভ করা জুলুম এবং হারামপন্থা বলে বিবেচিত হবে। ধোঁকাবাজীর সংজ্ঞার ব্যাপারে সবাই একমত যে, এটা হচ্ছে পাপ ও অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করা। অতএব হারাম থেকে বেঁচে থাকবে। তবে আল্লাহ তা‘আলা নিজের পক্ষ থেকে রহম ও অনুগ্রহের ফয়সালা করবেন। তাই অবৈধ যাবতীয় পন্থা পরিহার করে চলবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কোনো বস্তু তরক করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এরচেয়ে উত্তম বস্তু দান করেন। শুধু নিজেই অন্যায় ও অবৈধ উপায় অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকবে না বরং কাউকে এরূপ করতে দেখলে তা রোধ করার চেষ্টা করবে এবং উস্তাদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এটা গীবত কিংবা চোগলখোরির অন্তর্ভুক্ত হবে না, বরং মন্দকাজে বাধা দেয়ার মহৎ কাজ বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং কেউ ইন্টারনেট কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে চাইলে তাকে বাধা দেবে এবং এই কাজের পাপের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। আজকাল শিক্ষার্থীরা অবৈধ উপায় অবলম্বন করতে গিয়ে যে পরিমাণ সময় ও অর্থ ব্যয় করে সেই পরিমাণ সময় ও অর্থ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ব্যয় করলে অনেক ভালো ও ফলদায়ক হতো এবং এভাবে নিন্দনীয় পথে গিয়ে লাঞ্ছিত হওয়ার প্রয়োজন হতো না।
আর দুনিয়ার পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আখেরাতের পরীক্ষা এবং আখেরাতে মুমিনদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যা প্রস্তুত করে রেখেছেন সে কথা মনে রাখবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন।
যোগ্যতা অর্জন করা ছাড়া দরস কায়েম না করা
ইলমের সূত্র গভীরে প্রোথিত। বাহ্যিক কিছু হরফ বা অক্ষরজ্ঞানকে অন্য যে পরিভাষাতে হোক অন্তত ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় ইলম বলা যায় না। ইলমে দীনের সঙ্গে রূহানীয়াতের সম্পর্ক গভীরে। এই রূহানীয়াতের অন্যতম দিক হলো ‘সিনা ব সিনা’ তথা উস্তাদ পরম্পরায় এবং উস্তাদের নেক দু‘আ ও পরামর্শ নিয়ে ইলমী খেদমতে নিয়োজিত হওয়া। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন পদক্ষেপ নিলে উস্তাদের দু‘আ ও পরামর্ম সাপেক্ষে তা করা। উস্তাদ ও রূহানী মুরুব্বীর পরামর্শ ছাড়া বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে অনেক সময় ব্যর্থতা সঙ্গী হয় এবং গৃহীত পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়ে। একারণে শফীক উস্তাদের পরামর্শ ও দু‘আ নিয়ে যে কোনো শুরু করা দরকার। এসম্পর্কে আমরা ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর বিখ্যাত সেই ঘটনাটি উল্লেখ করতে পারি। ঘটনা মানাকেবে কারদারিতে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) একবার মারাত্মক রোগাক্রান্ত হলেন। স্নেহের এই শিষ্যকে দেখতে স্বয়ং তার ঘরে আসলেন ইমাম আজম আবূ হানীফা (রহ.)। বিভিন্ন কথাবার্তার পর তিনি তাকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি আমার পর তোমাকে মুসলিম জাতির দায়িত্ব প্রদান করে যাবো। আর এখন যদি তোমার কিছু হয়ে যায় তবে ইলমের বিরাট অংশের মৃত্যু ঘটবে।
এরপর ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং আত্মতুষ্টিতে নিজেই স্বতন্ত্র একটি দরসগাহ কায়েম করলেন। কথাটা ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) অন্যের মাধ্যমে জানতে পারলেন। স্নেহের শিষ্যকে হাতে-কলমে ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। একজন আলেমকে ছয়টি মাসআলা শিখিয়ে তার কাছে পাঠালেন।
ওই ছাত্র উস্তাদের কৌশল অনুযায়ী ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-কে প্রশ্নগুলো করতে থাকলেন। কিন্তু সেটার সন্তোষজনক জবাব দিতে না পেরে তিনি লজ্জিত হলেন এবং দৌড়ে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর কাছে ছুটে এলেন। আবূ হানীফা (রহ.) তাকে দেখে বললেন, বুঝতে পারছি ওই মাসআলাগুলোই আমাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। এরপর তিনি তার ব্যাপারে একটি ঐতিহাসিক মন্তব্য করলেন-
تزببت قبل أن تحصرم
‘ফল চয়ন করার আগেই কিসমিসে পরিণত হয়েছো!’ অর্থাৎ যোগ্যতা অর্জন করার আগেই দরস কায়েম করেছো!
রাত্রিজাগরণের সহায়ক ১০৩ উপায়
রাত্রিজাগরণ তলবে ইলমের শান। পূর্বসূরীগণগণের শিআর এবং আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়। কিন্তু অলসতা, গাফলতি ও আখেরাতের ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে আমরা ক্রমশ: রাত্রিজাগরণের এই গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ফলে বঞ্চিত হচ্ছি অমূল্য রত্নভাণ্ডার থেকে। রহমত থেকে এবং আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ থেকে। অবশ্য আমরা মনেপ্রাণে প্রত্যেকেই চাই রাত্রিজাগরণ করতে। নিস্তব্ধ শেষরজনীতে জেগে প্রভুর দরবারে বিনম্রশ্রদ্ধায় দু‘আর হাত উত্তোলন করতে। কিন্তু সব স্বপ্ন, রাত্রিজাগরণের পবিত্র আশা নিষ্ফল হয়ে যায় অলসতা এবং শয়তানের ধোঁকার কাছে। তবে কিছু পন্থা ও উপায় আছে যা অবলম্বন করতে পারলে তলবে ইলম ও আখেরাতপ্রত্যাশীদের জন্য রাত্রিজাগরণ করা সহজ হয়। নিম্নে এরূপ কয়েকটি উপায় উল্লেখ করা হলো।
১. রাত্রিজাগরণের ব্যাপারে পূর্ণ নিষ্ঠাবান হওয়া এবং সে অনুযায়ী যত্মবান হওয়া।
২. মনে একথার অনুভূতি সঞ্চারণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলা রাত্রে আমাকে আহ্বান করেন।
৩. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রিজাগরণের জন্য আহ্বান করেছেন ও গুরুত্বারোপ করেছেন।
৪. পূর্বসূরীগণ রাত্রিজাগরণের মধ্যে ইবাদতের স্বাদ লাভ করেছেন- একথা স্মরণ করা।
৫. ডানপাশে শোয়া।
৬. এ কথার বিশ্বাস স্থাপন করা যে, রাত্রিজাগরণ অন্তর থেকে গাফলতি দূর করে।
৭. আল্লাহ তা‘আলা আমার রাতের সালাত বিশেষভাবে দেখেন- অন্তরে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করা।
৮. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রিজাগরণের জন্য কীরূপ কষ্ট করেছেন- তা মনের মধ্যে সজা জাগরুক রাখা।
৯. রাত্রিজাগরণকারীদের গুণাবলী অর্জনের তীব্র বাসনা থাকা।
১০. আল্লাহ তা‘আলা যেন রাত্রিজাগরণ সহজ করে দেন- সেটার জন্য দু‘আ করা।
১১. পবিত্র অবস্থায় রাত্রিযাপন করতে যাওয়া।
১২. রাত্রিজাগরণকারীদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট ও খুশি হন তা স্মরণে রাখা।
১৩. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচণ্ড অসুস্থতার সময়েও তাহাজ্জুদ সালাত ত্যাগ করেননি- সে কথা সর্বদা মনে হাজির রাখা।
১৪. রাত্রিজাগরণে সাহাবায়ে কেরামের সাধনার কথা মনে রাখা।
১৫. ইশার পর দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া।
১৬. তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার দ্বারা হুরে ঈন লাভ করা যায়- সে কথা মনে রাখা।
১৭. রাতে জাগার নিয়তে ঘুমাতে যাওয়া।
১৮. রাত্রিজাগরণ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নিয়ে ফেরেস্তাদের সঙ্গে গর্ব করেন- একথা মনে রাখা।
১৯. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদের ময়দানেও তাহাজ্জুদ ছাড়েননি- সে কথা মনে রাখা।
২০. গুনাহ ও পাপ থেকে বেঁচে থাকা।
২১. ঘুমের আগে সুন্নাত দু‘আ-ওজিফাগুলো আদায় করা।
২২. রাত্রিজাগরণ করার ফযীলতগুলো স্মরণে রাখা।
২৩. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরেও তাহাজ্জুদ ছাড়তেন না- তা মনে রাখা।
২৪. নারী সাহাবীগণ রাত্রিজাগরণে খুব তৎপর ছিলেন তা মনে রাখা।
২৫. দিনের কিছু সময় কায়লূলা করা।
২৬. রাত্রিজাগরণ কলবের সৌভাগ্য এবং অন্তর খুলে যাওয়ার মাধ্যম তা অনুধাবন করা।
২৭. বেশি খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকা।
২৮. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীগণকে রাত্রিজাগরণে সদা সজাগ ছিলেন- তা মনে রাখা।
২৯. পূর্ববর্তী খলীফা ও আমীরগণ তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ে তৎপর ছিলেন- তা জানা।
৩০. শয়তান তাহাজ্জুদ সালাত থেকে মানুষকে বিরত রাখতে চায়- তা স্মরণ করা।
৩১. তাহাজ্জুদ সালাত জিহাদের ময়দানে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য লাভে সহায়ক- একথা মনে রাখা।
৩২. কোনো কারণে রাতে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতে না পারলে দিনে তার কাজা করে নেয়ার প্রতিজ্ঞা রাখা।
৩৩. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যাগণকে কীভাবে রাত্রিজাগরণে সচেষ্ট ছিলেন তা স্মরণে রাখা।
৩৪. রাত্রিজাগরণকারী আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে কথোকপথনকারী- একথা মনে রেখে ঘুমাতে যাওয়া।
৩৫. রাত্রিজাগরণ জাহান্নামের আগুনের প্রতিবন্ধক- তা মনে রাখা।
৩৬. মাত্রাতিরিক্ত ঘুমানোর অভ্যাস পরিহার করা।
৩৭. রাত্রিজাগরণের প্রতি পূর্বসূরীগণগণের ওসিয়তের কথা স্মরণ করা।
৩৮. আত্মার পরিশুদ্ধি ও মুহাসাবার জন্য ঘুম তরক করার ব্যাপারে নিজেকে প্রস্তুত করা।
৩৯. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে রাত্রিজাগরণের ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত করেছেন সে কথা মনে রাখা।
৪০. তাহাজ্জুদ সালাত জান্নাত লাভের উপায়, এই বিশ্বাস নিয়ে বিছানায় যাওয়া।
৪১. ঘুম কমিয়ে নফসের সঙ্গে মুজাহাদা করার অভ্যাস গড়ে তোলা।
৪২. ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর মাছনূন দু‘আগুলো আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।
৪৩. রাত্রিজাগরণ কিয়ামত দিবসে হিসেব সহজ হওয়ার মাধ্যম- একথা মনে রাখা।
৪৪. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে তাহাজ্জুদ সালাতে উপস্থিত দেখতে চাইতেন এবং তাদেরকে রাত্রিজাগরণে উদ্বুদ্ধ করতেন, সে কথা জানা।
৪৫. পূর্বসূরীগণ কোনোদিন তাহাজ্জুদ আদায় করতে না পারলে কীরূপ কষ্ট পেতেন এবং অনুশোচনায় কান্নাকাটি করতেন সে সব ঘটনাবলি জানা এবং নিজেদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া।
৪৬. তাহাজ্জুদ গুনাহ মাফের কারণ। তাই তাহাজ্জুদের মাধ্যমে গুনাহ মাফের ব্যবস্থা করা।
৪৭. হালাল রিজিক গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া।
৪৮. পরস্পরে তাহাজ্জুদ সালাতের ব্যাপারে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।
৪৯. পূর্বসূরীগণ নিজেদেরকে এবং অন্যদেরকে রাত্রিজাগরণে কীরূপ পন্থা অবলম্বন করতেন তা জানা এবং নিজেরাও সেরূপ আমল করতে সচেষ্ট হওয়া।
৫০. রাত্রিজাগরণই একজন মুমিনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এবং এতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব সে কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং এই গুণ নিয়ে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করা।
৫১. তাহাজ্জুদ সালাতের প্রতি ওলামায়ে কেরামের আগ্রহ ও বাসনার অভিজ্ঞতা জানা এবং নিজেরাও সেরূপ আমল করা।
৫২. উচ্চমর্যাদা লাভের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ লাভ করা।
৫৩. এই বিশ্বাস রাখা যে, তাহাজ্জুদ সালাত আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী।
৫৪. জান্নাতের নেয়ামতের কথা স্মরণ করা।
৫৫. রাত্রিজাগরণ করার উদ্দেশ্যে ঘুম ছেড়ে ওঠার মুহূর্তে মুখমণ্ডলে পানি ছিঁটিয়ে দেয়া।
৫৬. তাহাজ্জুদ সালাত শেষ পরিণতি উত্তম হওয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। শেষ পরিণতি সুন্দর হওয়ার বাসনায় তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হতে সচেষ্ট হওয়া।
৫৭. ওলী-বুযুর্গগণ স্ত্রী-সন্তানদের সান্নিধ্যের চেয়ে তাহাজ্জুদ সালাতে বেশি মজা ও স্বাদ লাভ করতেন। নিজেদের মধ্যেও সেই মজা ও স্বাদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া।
৫৮. রাত্রিজাগরণে কসুর করায় নফসকে ভর্ৎসনা করা।
৫৯. জাহান্নামের আগুন, শাস্তি ও এর ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ঘুমের তীব্রতা দূর করা এবং এভাবে তাহাজ্জুদ আদায়ে সহায়তা লাভ করা।
৬০. রাত্রিতে ওঠার পর মেসওয়াক করা।
৬১. তাহাজ্জুদ সালাতের পর দু‘আ কবুল হয়। দু‘আর মাধ্যমে নিজের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য তাহাজ্জুদ সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।
৬২. নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করলে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়। তাই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৬৩. আগের যুগের নেককার নারীগণ তাদের স্বামীদেরকে বিভিন্ন কৌশলে তাহাজ্জুদের জন্য জাগ্রত করতেন। তাদের সে সব কাহিনী ঈমানী চেতনা জাগরুক এবং শিক্ষণীয়। সেসব ঘটনা পাঠ করে নিজেরা শিক্ষা লাভ করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
৬৪. কৃপ্রবৃত্তি দমন করা মুমিনের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে তাহাজ্জুদের ভূমিকা অনেক। তাই এই উদ্দেশ্যে তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৬৫. তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার দ্বারা দীনের ওপর অবিচল থাকা যায়। তাই দীনের ওপর অবিচল থাকার দৃঢ়প্রত্যয়ে নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৬৬. তাহাজ্জুদ সালাতের বদৌলতে দুনিয়াবিমুখতার গুণ হাসিল হয়। আর এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় গুণ। সুতরাং এই গুণ হাসিলের জন্য নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৬৭. মাঝেমধ্যে ডাকাডাকি ছাড়া জামাতের সঙ্গে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৬৮. তাহাজ্জুদ সালাতের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা লাভ হয়। আর জগতে এরচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কী হতে পারে? তাই এই সম্পদ লাভের জন্য তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৬৯. অধিক হাসাহাসি ও অনর্থক কাজকর্ম থেকে দূরে থাকা।
৭০. সালফে সালেহীন তাহাজ্জুদ সালাতে এত স্বাদ ও মজা পেতেন যে, কেবল এই স্বাদের জন্যই তারা আল্লাহ তা‘আলার কাছে দীর্ঘ হায়াত কামনা করতেন।
৭১. আখিরাতের জীবনের প্রতি ধাবিত হওয়া।
৭২. তাহাজ্জুদ সালাতের বাহ্যিক ফায়েদা হচ্ছে; এর দ্বারা চেহারার ঔজ্জ্বল্য ও কমনীয়তা বৃদ্ধি পায়। তাই এই নেয়ামত লাভের স্বার্থে নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৭৩. জাগতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা সংক্ষিপ্ত করা এবং মৃত্যুর কথা বেশি বেশি মনে করা। এই গুণও তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়ার সহায়ক।
৭৪. তাহাজ্জুদ সালাত নিঃসন্দে কঠিন এক ইবাদত। কিন্তু এতে অভ্যস্ত হলে আল্লাহ তা‘আলার অন্যান্য ইবাদত করাও সহজ হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় বিধান সহজে পালনের সুবিধার্থে তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৭৫. স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যদেরকেও তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য জাগ্রত করা।
৭৬. তাহাজ্জুদ নামাযী কেয়ামত দিবসে তার সঙ্গীর জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা ও অধিকার লাভ করবে। এই সুবিধা লাভের জন্য তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৭৭. বুযুর্গানে কেরামও মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করার সময়েও তাহাজ্জুদের পাবন্দি করতেন। তাই তাদের অনুকরণে আমাদেরকেও অন্তত সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় তাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৭৮. আল্লাহ তা‘আলা ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি প্রতিযোগিতার অভ্যস্ত গড়ে তোলা এবং তাহাজ্জুদের মাধ্যমে সেই প্রতিযোগিতার অনুশীলন করা।
৭৯. রাত্রিজাগরণ সাধারণের মধ্যে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে। তাই মানুষের মধ্যে দীনী প্রভাব বিস্তার করার স্বার্থে তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৮০. কবরজগত এবং এর ভয়াবহতার কথা ফিকির করা।
৮১. তাহাজ্জুদ সালাত ও রাত্রিজাগরণ আল্লাহ তা‘আলার রহমত আনয়ন করে। তাই আল্লাহ তা‘আলার রহমতপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৮২. রাতে জাগিয়ে দেয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো লোককে নির্দিষ্ট করা।
৮৩. বুযুর্গানে কেরাম তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারলে আনন্দিত হতেন এবং ছুটে গেলে মারাত্মক ব্যথিত হতেন। আমাদের মধ্যেও এই অভ্যাস গড়ে তোলা।
৮৪. নিয়মিত ও দায়েমীভাবে রাতজাগরণের চেষ্টা করা।
৮৫. কেয়ামত দিবস এবং এই দিনের ভয়াবহতার কথা স্মরণে রাখা।
৮৬. প্রথমে সংক্ষিপ্ত দুই রাকাতের মাধ্যমে সালাত শুরু করা।
৮৭. রাতের শেষভাগের সময়গুলোর মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করার চেষ্টা করা।
৮৮. তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করলে শারীরিক বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই শারীরিক সুস্থতার নেয়ামত লাভের জন্য তাহাজ্জুদ সালাতে অভ্যস্ত হওয়া।
৮৯. ক্রমান্বয়ে রাকাতের সংখ্যা এবং দীর্ঘ কিয়ামের দিকে অগ্রসর হওয়া।
৯০. পূর্বসূরী পুণ্যবানরা অসুস্থ অবস্থাতেও তাহাজ্জুদ ছাড়তেন না। এসব ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা হাসিল করা।
৯১. রাতের নামাযীদের কেরাত, দু‘আ, দরূদ ইত্যাদি ফেরেশতারা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেন। তাই নিজেও এই সৌভাগ্যের অংশীদার হওয়া।
৯২. তাহাজ্জুদ সালাত মূলত ইখলাস ও আল্লাহভক্তির প্রশিক্ষণ। তাই এই দুটি গুণ হাসিলের স্বার্থে নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৯৩. নেককারগণ তাদের স্ত্রী, সন্তান ও পরিবার-পরিজনকে তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য খুবই অনুপ্রাণিত করতেন। সে সব ঘটনা থেকেও দীক্ষা নেয়া।
৯৪. তাহাজ্জুদ সালাত এত গুরুত্বপূর্ণ সালাত যে, পূর্ববতী উম্মতের মধ্যেও এই আমলের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাই পূর্ববতী উম্মতের আমলের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক অধিকহারে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৯৫. সালাত অবস্থায় এমন পন্থা অবলম্বন করা, যাতে তন্দ্রাচ্ছন্নতা ও ঘুমের ভাব দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯৬. সালফে সালেহীনগণ কীভাবে নিজেদের আদরের ও প্রিয় সন্তানদেরকে রাতে জাগিয়ে তুলে তাহাজ্জুদের জায়সালাতে দাঁড় করিয়ে দিতেন, সেসব ইতিহাস পাঠ করে সে অনুযায়ী তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার মাধ্যমে নিজেদেরকেও সেভাবে গড়ে তোলা।
৯৭. শেষ রাতে প্রাণীকুল আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে থাকে। সে সময় আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে নির্লজ্জতা প্রদর্শনী না করে তাদের সঙ্গে নিজেও আল্লাহ তা‘আলার জিকির তথা তাহাজ্জুদ সালাতে লিপ্ত হওয়া।
৯৮. তাহাজ্জুদ সালাত আত্মিকব্যাধি ও অন্যান্য বিপদ দূর করে। আর নিঃসন্দেহ বস্তু দুটি অতি মূল্যবান। তাই এই নেয়ামত লাভ করার নেক নিয়তে নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
৯৯. পূর্বসূরীগণ মেহমানদেরকেও তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য জাগ্রত করতেন! নিজেদের মধ্যেও এই মহৎগুণাবলী অর্জন করা।
১০০. সালাতের রুকু ও বসার মধ্যে সুষ্পষ্ট পার্থক্য বজায় রাখা।
১০১. রাত্রিজাগরণ উচ্চমর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে আত্মাকে প্রশিক্ষিত করার বড় একটা মাধ্যম।
১০২. পূর্বসূরীগণ তাদের শিষ্যদেরকে তাহাজ্জুদ সালাত ও রাত্রিজাগরণের ব্যাপারে খুব তাগিদ করতেন। তাদের অনুসরণ করত নিজেকেও তাহাজ্জুদের জন্য প্রস্তুত করা এবং নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতে থাকা।
১০৩. দিনের নফল সালাতের চাইতে রাতের সালাতের ফযীলত বেশি। তাই বেশি ফযীলতের সালাতের জন্য তাহাজ্জুদ আদায় ও রাত্রিজাগরণ করা।
[1]. আলবানী যঈফ বলেছেন।
[2]. শায়খ আলবানী যঈফ বলেছেন।
[3]. হাদীছের সূত্র যঈফ তথা দুর্বল। তবে অর্থগত দিক থেকে এটি সহীহ। কেননা পবিত্র কুরআনে শিক্ষা দান করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
[4] মুসনাদে আহমাদ ৫/২১৯।
_________________________________________________________________________________
সংকলন: আবু বকর সিরাজী
সম্পাদনা: আলী হাসান তৈয়ব
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

Translate