Saturday, March 6, 2021

জান্নাতে প্রবেশ করার ২৫ টি সহজ উপায়





১. শাহাদাত ও শিরক হতে বিরত থাকাঃ জান্নাতে প্রবেশের প্রথম উপায় হলো: শাহাদাত অর্থাৎ একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর সত্য কোন ইলাহ নেই, যিনি একক, যার কোন শরীক নেই। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সুতরাং যে ব্যক্তি ইসলামের এ সাক্ষ্য প্রদান করবে, এর যাবতীয় আরকান পালন করবে, আর এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদাত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

‘‘যে ব্যক্তি এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, ‘এক অদ্বিতীয় আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং আল্লাহর কালেমা যাকে তিনি মারিয়ামের নিকট প্রেরণ করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ, আর জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য’। আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, তার আমল যাই হোক না কেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]

আল্লাহ বলেন: ‘‘নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর এ কথার উপর সুদৃঢ় থাকে। তাদের কোন ভয় ভীতি নেই, তাদের কোন চিন্তা নেই। তারাই জান্নাতবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এ জান্নাত তারা তাদের কৃত কর্মের ফল স্বরূপ লাভ করবে”। [সূরা আল আহক্বাফ: ১৩-১৪]

আয়াতে উল্লেখিত الاستقامة শব্দটির অর্থ হল: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘জান্নাত পেতে আগ্রহী নয় এমন ব্যক্তি ছাড়া আমার সকল উম্মাতই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কে এমন ব্যক্তি আছে যে জান্নাতে যেতে অস্বীকৃতি জানায়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার নাফরমানী করবে ও অবাধ্য হবে, সেই জান্নাতে যেতে অস্বীকার করে’’। [বুখারী ]

২. আসমাউল হুসনাঃ আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামসমূহ মুখস্থ করা এবং এ নামগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জান্নাতে প্রবেশের একটি উপায়। আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আল্লাহর নিরানববইটি নাম আছে। যে ব্যক্তি এ নামগুলো গণনা করবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [বুখারী ও মুসলিম]

৩. আল কুর’আনঃ আল কুরআনের অনুসারীগণ, যারা আল্লাহর আহল ও তাঁর খাস বান্দা, কুরআন তাদের জান্নাতে প্রবেশের উপায় হবে। আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘আলকুরআনের সঙ্গীকে বলা হবে: কুরআন পাঠ কর, আর মর্যাদার উচ্চশিখরে আরোহণ কর। আর তেলাওয়াত করতে থাক। যেমন দুনিয়াতে তেলাওয়াত করছিলে; কেননা তোমার মর্যাদা হলো কুরআনের শেষ আয়াত পর্যন্ত যা তুমি পাঠ করবে’’। [তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আরো প্রমাণিত রয়েছে যে, কতিপয় সূরা ও আয়াত জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম।

আবু উমামা থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি প্রতি ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে জান্নাতবাসী হবে’’। [নাসায়ী, তাবারানী, ইবনে হিববান এটি বর্ণনা করেছেন ও আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘৩০ আয়াত বিশিষ্ট কুরআনের একটি সূরা, এর পাঠকের জন্য জান্নাতে না নেয়া পর্যন্ত সুপারিশ করতেই থাকবে। সূরাটি হল তাবারাকা’’ (তথা সূরা মূলক)। [তাবারানী এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী বিশুদ্ধ বলেছেন]

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি মাসজিদে কোবায় আনসার সাহাবীদের ইমামতি করতেন। তিনি প্রতি রাকাতেই সূরা ইখলাস পাঠ করতেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি কোন কারণে প্রতি রাকাতে এ সূরাটি পাঠ কর? উত্তরে সে সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এ সূরাটি খুব পছন্দ করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, এ সূরাটি পছন্দ করার কারণেই তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে। [ইমাম বুখারী হাদীসটি সনদবিহীন বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী ও আলবানী হাদীসটিকে উত্তম ও সহীহ বলেছেন]

৪. ইলম অর্জনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হয়, এর বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন’’। [মুসলিম]

৫. আল্লাহ তা’লার যিক্‌র: আল্লাহর তাসবীহ (স্তুতি), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং তাকবীরের ফযীলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘মেরাজের রাতে ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মাতকে আমার সালাম বলো এবং তাদেরকে এ সংবাদ দাও যে, জান্নাতের মাটি সুন্দর, পানি মিষ্টি, আর জান্নাত সমতল এবং এর বৃক্ষরাজি সুবহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার’’। [তিরমিযী এটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী তাকে উত্তম বলেছেন]

৬. প্রতি সালাতের পর আল্লাহর যিক্‌র পাঠ: জান্নাতে প্রবেশের উপায়সমূহের মধ্যে আরো একটি হল প্রতি সালাতের পর আল্লাহর যিক্‌র পাঠ: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, গরীব মুহাজিরগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বললেন. ধনী ও বিত্তবান লোকেরা তো আল্লাহর নিকট সুউচ্চ মর্যাদা এবং নানাবিধ নেয়ামত লাভে ধন্য হয়ে গেল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কীভাবে? তারা জবাব দিলেন যে, আমরা যেমন সালাত আদায় করি তারাও সালাত আদায় করে। আমরা যেমন রোযা পালন করি তারাও রোযা পালন করে। কিন্তু তারা দান সদকা করে আমরা তা করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে আমরা তা করি না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছু শিক্ষা দেব, যার দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রবর্তীদের সমকক্ষ হবে, আর তোমাদের পরবর্তীদের চেয়ে অগ্রগামী হবে? আর তোমাদের চেয়ে উত্তম কেউ হবে না, সে ব্যক্তি ছাড়া যে তোমাদের মতই এ কাজগুলো করবে। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে সে কাজ শিক্ষা দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, আর ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করবে’’। [মুসলিম]

৭. অনুরূপভাবে অযুর পর কালিমায়ে শাহাদাত পাঠও জান্নাতে যাওয়ার উপায়। উকবাহ ইবন আমের বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ সুন্দর করে অযু করার পর যদি বলে:

أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله

তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজাই উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিম]

৮. لا حول ولا قوة إلا بالله এ দো‘আ হল জান্নাতের ভান্ডার: আবু মুসা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমি কি তোমাকে জান্নাতের ভান্ডার সমূহের একটি ভান্ডার সম্পর্কে অবহিত করব? আমি বললাম: হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, বলো: لا حول ولا قوة إلا بالله অর্থ্যাৎ: ‘‘আল্লাহর আশ্রয় ও শক্তি ছাড়া আর কারো কোন ক্ষমতা নাই’’। [বুখারী, মুসলিম]

৯. জান্নাত লাভের জন্য দো’আ করাঃ আল্লাহর নিকট জান্নাত চেয়ে দো‘আ করলে জান্নাত তখন আমীন আমীন বলে সমর্থন করে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যাক্তি ৩ বার আল্লাহর নিকট জান্নাত চায়, জান্নাত তখন বলে: হে আল্লাহ্! ঐ ব্যাক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাও। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ৩ বার জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি চেয়ে দো‘আ করে, জাহান্নাম বলে: হে আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তিকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দাও। [তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।

১০. গুনাহ মাফের প্রধান দো’আঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগফেরাত কামনার দো‘আকে সাইয়্যেদুল্ ইসস্তিগফার বা গুনাহ মাফ চাওয়ার প্রধান দো‘আ বলে অভিহিত করেছেন এবং জান্নাতে প্রবেশের কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং প্রিয় পাঠক! দো‘আটি মুখস্থ করুন এবং সকাল সন্ধ্যা পাঠ করুন।

শাদ্দাদ ইবন আওস রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ননা করেন তিনি বলেন, ইস্তেগফারের প্রধান দো‘আ হলো:

اللهم أنت ربي لا إله إلا أنت خلقتني وأنا عبدك وأنا على عهدك ووعدك ما استطعت، أعوذ بك من شر ما صنعت، أبوء لك بنعمتك عليَّ وأبوء لك بذنبي فاغفر لي فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت

‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতানি ওয়া আনা ’আবদিকা ওয়া আন্না ’আলা ’আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাস্তাতা’তু আবু’উ লাকা বিনি’মাতিকা ওয়া আবু’উ লাকা বিযাম্বি, ফাগফিরলী ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুযযুনুবা ইল্লা আনতা। আ’উযুবিকা মিন শাররী মা সানা’তু, আবু’উ লাকা বিনি’মাতিকা ’আলাইয়া, ওয়া আবু লাকা বিযাম্বি ফাগফিরলী ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুযযুনুবা ইল্লা আনতা।”(বুখারী)

‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার রব। তুমি ছাড়া আর কোন সত্য মা’বুদ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার বান্দা। আমি তোমার ওয়াদা ও অঙ্গিকারের উপর সাধ্যানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত। আমি অনিষ্টকর যা কিছু করেছি তা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার উপর তোমার যে নেয়ামত আছে তার স্বীকৃতি দিচ্ছি। তোমার নিকট আমার গুনাহের স্বীকৃতি দিচ্ছি। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও; কেননা তুমি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না’’।

যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে দিনে এ দো‘আ পাঠ করে, সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই যদি তার মৃত্যু হয়, তাহলে সে জান্নাতবাসী হবে। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে রাতে পাঠ করে এবং সকাল হওয়ার পূর্বেই মারা যায়, সে জান্নাতবাসী হয়’’। [বুখারী]

১১. সালাতের প্রতি যত্নবান হওয়াঃ সালাত হলো দ্বীনের খূঁটি। আল্লাহ আমাদের উপর দিন রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। আল্লাহর নিকট প্রিয় ইবাদাত হলো তাঁর ফরয কাজসমূহ। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফরয কাজসমূহ আদায় করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ওবাদা ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি সালাতসমূহের হকে কোন প্রকার কমতি ও তাচ্ছিল্য না করে সঠিকভাবে সেগুলো আদায় করে, তার জন্য আল্লাহর এ অঙ্গিকার যে, তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে এগুলোর ব্যাপারে কমতি ও তাচ্ছিল্য করে তা আদায় করবে, তার প্রতি আল্লাহর কোন অঙ্গিকার নেই। তিনি চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন, আবার ক্ষমাও করতে পারেন’’। [হাদীসটি মোয়াত্তায়ে মালিক, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে। আর আলবানী একে সহীহ বলেছেন]।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর ও আসরের দু’ ওয়াক্ত সালাতের পৃথক মর্যাদা দিয়ে এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘বারাদাইন’ অর্থাৎ দু’টি শীতল ওয়াক্তের সালাত। আবু মূসা আশআ’রী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: অর্থাৎ ‘‘যে ব্যক্তি শীতল ওয়াক্তের দুই সালাত (ফজর -আসর) আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [বুখারী ও মুসলিম]

১২. কতিপয় সুন্নাত ও নিয়মিত সালাত আছে যেগুলো দ্বারা ফরয সালাতগুলোর কমতি পূরণ করা হয় এবং এগুলোর পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন। সুতরাং সেগুলো আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হোন, তাহলে আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করবেন।

উম্মে হাবীবা রাদি আল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন: ‘‘যে মুসলিম ব্যক্তিই ফরযের অতিরিক্ত প্রতিদিন ১২ রাকাত সুন্নাত সালাত আল্লাহর জন্য আদায় করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করবেন’’। [মুসলিম]

এ সুন্নাত সালাতগুলোর বর্ণনা এভাবে এসেছে: ‘‘যোহরের পূর্বে ৪ রাকাআত, পরে ২ রাকাআত, মাগরিবের পরে ২ রাকাআত, ইশার পর ২ রাকাআত এবং ফজরের পূর্বে ২ রাকাআত’’।

১৩. কোন ব্যক্তি যখন অযু করে, তখন তার জন্য ২ রাকাআত সালাত আদায় করা সুন্নাত। এ সালাত যখন সে নিষ্ঠার সাথে ও একাগ্রচিত্তে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আদায় করে, তখন তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে যায়।

উকবাহ ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘ যে ব্যক্তিই সুন্দর করে অযু করে উপস্থিত মন নিয়ে ও একাগ্রচিত্তে দু’ রাকাআত সালাত আদায় করবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে’’। [মুসলিম]

১৪. ইসলামের উত্তম দিকগুলোর প্রসারঃ দ্বীন ইসলামের উত্তম দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে: সালামের প্রসার করা, খাদ্য দান করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। আর সত্যবাদীদের গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে তারা হল রাতের নফল সালাত আদায়কারী। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘তারা রাতের কম অংশই নিদ্রায় মগ্ন থাকে। আর শেষ রাতে তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে’’। [সূরা আযযারিয়াত: ১৭-১৮]

যারা উপরোক্ত কাজগুলো করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘ হে মানব সকল! সালামের প্রসার কর। খাদ্য দান কর। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ। লোকেরা ঘুমিয়ে গেলে রাতে নফল সালাত আদায় কর। তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।

১৫. ফজরের সালাতসহ অন্যান্য সালাতের উদ্দেশ্যে মাসজিদে গমন করার কারণে আল্লাহ তা’লা আপনার জন্য জান্নাতে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করবেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যা মাসজিদে যায়, তার জন্য আল্লাহ সকাল বিকাল যখনই সে গমন করে জান্নাতের মধ্যে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]

১৬. সালাতের কাতারে ফাঁকা স্থান পূরণঃ মুসল্লীদের মাঝে যে ফাঁক দেখা যায় তা আপনি পূরণ করলে আপনার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরী করা হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি সালাতের কাতারের ফাঁকা জায়গা পূরণ করলো, এর দরূন আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন’’। [তাবারানী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]।

১৭. মাসজিদ নির্মাণ: আপনি যদি মাসজিদ নির্মাণ করেন অথবা মাসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা করেন, তাহলে আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মাসজিদ তৈরী করলো, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরী করবেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]

১৮. আযানের জবাবঃ দিনরাতে পাঁচবার মুয়াযযিনের আযানের জবাব দেয়া জান্নাতে প্রবেশের আরো একটি কারণ। উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘মুয়াযযিন যখন আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার (২বার) বলে, তখন তার উত্তরে কেউ যদি অনুরূপ বলে; অতঃপর মুয়াযযিন (أشهد أن لا إله إلا الله) বললে সে তার মতো (أشهد أن لا إله إلا الله) বলে। মুয়াযযিন যখন (أشهد أن محمدا رسول الله) বলে, সেও তাই বলে। তারপর (حي على الصلاة) বললে সে (لا حول ولا قوة إلا بالله) বলে এবং (حي على الفلاح) বললেও সে (لا حول ولا قوة إلا بالله) বলে। তারপর মুয়াযযিন আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার বললে সেও আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার বলে। এরপর মুয়াযযিন যখন বলে (لا إله إلا الله) তখন সেও (لا إله إلا الله) আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে বললে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [মুসলিম]

১৯. আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকাঃ প্রিয় পাঠক! আপনি যদি আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসাবে মেনে নেন, তাহলে আপনার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে। আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘ হে আবু সাইদ! যে ব্যক্তি আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসাবে গ্রহণ করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে’’। [মুসলিম]

২০. রোযাদারদের জন্য জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম ‘রাইয়ান’, রোযাদার ছাড়া এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। সাহল ইবন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘জান্নাতের ভেতর ‘রাইয়ান’ নামে একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এখান দিয়ে রোযাদারগণ ঢুকবে। তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশাধিকার পাবে না। বলা হবে: কোথায় রোযাদারগণ? তখন তারা সেখান দিয়ে ঢুকবে। তারা ছাড়া সেখান দিয়ে আর কেউ ঢুকবে না। তারা প্রবেশ করার পর তা বন্ধ করে দেয়া হবে। তারপর আর কেউ ঢুকতে পারবে না’’। [বুখারী ও মুসলিম]

২১. পূণ্যময় হজ্জের প্রতিদান জান্নাতঃ ইসলামের পঞ্চম রুকন হল আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা। এ হজ্জের প্রতিদান হলো জান্নাত। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী সকল গুনাহের জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ। আর পূণ্যময় হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়’’। [বুখারী ও মুসলিম]

২২. আল্লাহর পথে জিহাদঃ যার মাধ্যমে আল্লাহ তা’লা দ্বীন ইসলামকে বুলন্দ এবং সুউচ্চ করেছেন তা হলো আল্লাহর পথে জিহাদ। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণীকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জিহাদ করে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং তাঁর কথাকে সত্য বলে প্রমাণিত করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়। অথবা তাকে জিহাদের সাওয়াব ও গণীমত লাভে ধন্য করে গাজী হিসাবে ঘরে ফিরিয়ে আনেন’’। [বুখারী ও মুসলিম]

২৩. আল্লাহর পথে ব্যয়ঃ আল্লাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর মুত্তাকী বান্দাদেরকে এ বলে আখ্যায়িত করেছেন যে, তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান খয়রাত করে, এর দরূন তাকে জান্নাতে দেয়া হবে’’। [আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]

২৪. কোন ব্যক্তিকে অর্থ ঋণ দিয়ে তাকে তা স্বচ্ছলতার সাথে আদায় করার সুযোগ করে দেয়াঃ হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন: ‘‘এক ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার পর জান্নাতে প্রবেশ করলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো: তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে লোকটি বললো: আমি মানুষের সাথে কেনাবেচা করতাম। বিপদগ্রস্ত দরিদ্রদেরকে ঋণ পরিশোধের সময় দিতাম এবং কিছু টাকা পয়সা মাফ করে দিতাম। ফলে আল্লাহ তাকেও মাফ করে দিয়েছেন’’। [মুসলিম]

২৫. লজ্জাস্থান ও জবানের হেফাযতঃ যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যস্থিত অঙ্গ(জিহ্বা) এবং দুই উরুর মধ্যস্থিত অঙ্গের(গোপনাঙ্গ) হেফাযত করবে, আল্লাহর রাসূল তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।(বুখারী)

লেখক : ইউসুফ ইবন মুহাম্মাদ আল ‘উয়াইয়েদ

অনুবাদ : ড. মোহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী 

সহীহ হাদিসের আলোকে পানির মত সহজসাধ্য কিছু প্রচুর সওয়াবের আমল

 সহীহ হাদিসের আলোকে পানির মত সহজসাধ্য কিছু প্রচুর সওয়াবের আমল… দুই-তিন মিনিট সময় নিয়ে পড়ুন।আখিরাতের জন্য প্রচুর উপকার হবে।

♦ জুমার দিন কেউ গোসল করে বাড়ি থেকে ওযু করে পায়ে হেঁটে মসজিদে গিয়ে আদবের সাথে বসে, কোন দুষ্টামি না করে সব নামায পড়ে আবার আদবের সহিত বাসায় ফিরলে তাঁর আসা যাওয়ার প্রতি কদমে ১ বছরের নফল রোযা ও ১ বছরের সারারাত তাহায্যুদ নামায পড়ার সওয়াব তাঁকে দেওয়া হবে!! (তিরমিজী ৪৯৬)
♦ কোন ব্যক্তি বাসা থেকে অযু করে যদি জামাতের সহিত নামায পড়ার জন্য মসজিদমুখী হয় তবে তাঁকে একটি পরিপূর্ন হজ্জের সওয়াব দেওয়া হয়। (মেশকাত ৭২৮)
♦হাসিমুখে কথা বলুন।হাসিমুখে কথা বলা সদকা স্বরুপ। অর্থাৎ
আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়া পাওয়া যায়।
( বুখারী ২৭৬৭)
♦ “আসসালামুআলাইকুম” বলে কেউ সালাম দিলে তাঁর জন্য ১০টা নেকি লেখা হয়!কেউ যদি “আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লা” বলে তবে ২০ টা নেকি লেখা হয়!! আর কেউ যদি “আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু” বলে সালাম দেয় তবে ৩০ টা নেকি তাঁর জন্য লেখা হয়!!!( আবু দাউদ ৫১৯৫)
♦দুজন ব্যক্তি মিলিত হওয়ার পর মুসাফাহ করে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাঁদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়। আরেক হাদিসে অাছে যখন মুসাফাহ করে তখন দুই হাতের ফাঁক দিয়ে গুনাহগুলো ঝরে পড়ে!
(আবু দাউদ ৫২১২)
♦কোন ব্যক্তি রাস্তায় কোন ক্ষতিকর বস্তু যেমন গাছের ডাল, কাঁটা, কষ্টদায়ক অন্য কোনকিছু দেখলে সে যদি মনে মনে ভাবেযে সে এটা ফেললে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিবেন এবং পরে এটা তুলে ফেলে দিলো তবে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করালেন।(আহমাদ ১০২৮৯)
♦কোন ব্যক্তি প্রথম আঘাতে টিকটিকি মারতে পারলে তাঁর জন্য ৭০ টি নেকি লেখা হয়।অন্য হাদিসে আছে, প্রথম হাদিসে বেশি নেকী, দ্বিতীয় আঘাতে মারলে তার চেয়ে কম, তৃতীয় আঘাতে তার চেয়ে কম নেকী লেখা হয়।(আবু দাউদ ৫২৬৪)
♦সর্বোত্তম নেকীর কাজ হচ্ছে পিতার বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক অটুট রাখা।( মুসলিম ৬৬৭৭)
♦কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি অপর কোন অসুস্থ মুসলিমকে সকাল বেলা দেখতে যায় তবে ৭০ হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া করতে থাকে। আর যদি সন্ধ্যায় দেখতে যায় তাহলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য দোয়া করে।
(তিরমিজী ৮৯১)
♦সূরা ইখলাস তিনবার পড়লে ১ খতম কোরআন পড়ার সওয়াব পাওয়া যায়।(বুখারী ৪৬২৭)
♦একবার দুরুদ পড়লে ১০ টি নেকি, ১০ টি সম্মাণ লাভ হয় এবং ১০ টি গুনাহ মাফ হয়।(বুখারীর আদাবুল মুফরাদ ৬৪৩)
♦যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কিছু ব্যয় করে, অাল্লাহ তার ঐ ব্যক্তির আমলনামায় তা ৭০০ গুন করে (বৃদ্ধি করে) সওয়াব লিখে রাখে।
(আহমদ ১৯০৩৬)
♦কোন মুসলিম বান্দা যখন ওযুর সময় মুখমণ্ডল ধুয়ে ফেলে তখন তাঁর চোখের গুনাহ সমূহ পানির সাথে ঝরে পড়ে,যখন হাত ধৌত করে তখন দুই হাতের গুনাহ ঝরে পড়ে, যখন পা ধৌত করে তখন পায়ের গুনাহ ঝরে পড়ে। এভাবে তাঁর সকল গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়।
(মুসলিম ৬০০)
♦কেউ ওযু করে ঘুম গেলে সারারাত তার পাশে থেকে একটা ফেরেশতা ঘুমন্ত ব্যক্তির ক্ষমার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকে।(আত তারগিব ৫৯৭)
♦মানুষের শরীরে ৩৬০ টি গ্রন্থি রয়েছে। এগুলো প্রত্যেকটার জন্য সাদক্বাহ (দান) করা ওয়াজিব। যদি কোন ব্যক্তি মসজিদের ভিতরে কোন ময়লা পরিষ্কার করে কিংবা রাস্তার কোন আবর্জনা দেখলে তা সরিয়ে দেয় তবে ৩৬০টি গ্রন্থির সাদক্বাহ হয়ে যাবে। তা না পারলে, দুপুরের পূর্বে দু রাকাত চাশতের নামায পড়ে নিলে হবে।
(আহমদ ২২৯৯৮)
#আল্লাহ আমাদেরকে উপরোক্ত সহজসাধ্য আমল গুলো করার তাওফিক দান করুক… আর হ্যাঁ, অবসর সময়ে জিকির করুন। সারাদিন বকবক না করে অন্ততপক্ষে প্রতিদিন ১০ মিনিট জিকির করুন… আর এই দশমিনিটে আপনি প্রচুর পরিমান সওয়াব পাবেন ইন-শা-আল্লাহ! আপনার টাইমলাইনে কপিপেস্ট করে রেখে দিন।collected 

কি ঘটেছিল কারবালায়? কারা হুসাইন (রা:) কে হত্যা করেছে?

 

কি ঘটেছিল কারবালায়? কারা হুসাইন (রা:) কে হত্যা করেছে?
(কারবালার ঘটনা সম্পর্কে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-যা অনেক ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিবে ইনশাআল্লাহ)
এই প্রবন্ধে যে সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে সেগুলো হল:
১) ভূমিকা
২) কারবালার প্রান্তরে রাসূলের দৌহিত্র হুসাইন (রা:) নিহত হওয়ার প্রকৃত ঘটনা।
৩) ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার কিচ্ছা।
৪) কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের সাথে আরও যারা নিহত হয়েছেন।
৫) কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত ধারণা ঠিক নয়।
৬) হুসাইন (রা.) বের হওয়া ন্যায় সংগত ছিল কি?
৭) কারবালার ঘটনাকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব?
৮) মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করার ক্ষেত্রে শিয়া মাজহাবের মতামত।
৯) আশুরার দিনে আমাদের করণীয় কী?
১০) শিয়াদের বর্ণনায় আশুরার রোজা।
১১) আশুরার দিনে মাতম করার ভিত্তি কোথায়?
১২) হুসাইন (রা.) হত্যায় ইয়াজিদ কতটুকু দায়ী?
১৩) তাহলে কে হুসাইন (রা:)কে হত্যা করল?
১৪) হুসাইন (রা.) হত্যাকারী নির্ধারণে ইবনে উমর (রা:)এর অভিমত।
১৫) হুসাইন (রা.) এর ভাষণই প্রমাণ করে যে ইয়াজিদ তাঁর হত্যার জন্য সরাসরি দায়ী নয়।
১৬) আলী বিন হুসাইন (রা.) তাঁর পিতা হুসাইনকে হত্যার জন্য কুফা বাসীদেরকে দায়ী করেছেন?
১৭) হুসাইন রা. এর মাথা কোথায় গিয়েছিল?
১৮) যেমন কর্ম তেমন ফল।
 ১৯) ইয়াজিদ সম্পর্কে একজন মুসলিমের ধারণা কেমন হওয়া উচিত।
২০) উপসংহার।

১) ভূমিকা:
প্রশংসা মাত্রই আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবার এবং সকল সাহাবীর উপর।
সৌভাগ্যবান শহীদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র সায়্যেদ হেসাইন বিন আলী (রা:)এর কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়াকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই প্রসিদ্ধ রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের অনেক মুসলিমের মধ্যে এ বিষয়ে বিরাট বিভ্রান্তি রয়েছে। দেশের রাষ্ট্র প্রতি, প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতাগণ, ইসলামী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ এ দিন উপলক্ষে জাতির সামনে প্রতিবছর বিশেষ বাণী তুলে ধরেন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে। এ দিন আমাদের দেশে সরকারী ছুটি থাকে। তাদের সকলের কথা ঘুরে ফিরে একটাই। স্বৈরাচারী, জালেম, নিষ্ঠুর ও নরপশু ইয়াজিদের হাতে এ দিনে রাসূলের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। এ জন্য এটি একটি পবিত্র দিন। বিশেষ একটি সম্প্রদায় এ দিন উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বিষাদসিন্ধু নামক একটি উপন্যাস পড়ে বা এর কিছু বানোয়াট ও কাল্পনিক কাহিনী শুনে সুন্নি মুসলিমগণও এ বিষয়ে ধুম্রজালে আটকা পড়েছেন।
জাতির ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনের জন্য আজ আমি এ বিষয়ে সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য প্রকাশ করার কাজে অগ্রসর হতে বাধ্য হলাম। মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত আকারে একটি ভূমিকা পেশ করতে চাই। মন দিয়ে ভূমিকাটি পড়লে মূল বিষয় বুঝতে সহজ হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি আরও বিশ্বাস করি যে, আমার লেখাটি পড়ে এ বিষয়ে অনেকের আকীদাহ সংশোধন হবে। আর যারা বিষয়টি নিয়ে সংশয়ে আছেন, তাদেরও সংশয় কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ইমাম ইবনে কাছীর (র:) বলেন: প্রতিটি মুসলিমের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র সায়্যেদ হেসাইন বিন আলী (রা:)এর কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়ার ঘটনায় ব্যথিত হওয়া ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তিনি ছিলেন মুসলিম জাতির নেতা ও ইমামদের অন্যতম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ কন্যা ফাতেমার পুত্র ইমাম হুসাইন (রা:) একজন বিজ্ঞ সাহাবী ছিলেন। তিনি ছিলেন একধারে এবাদত গুজার, দানবীর এবং অত্যন্ত সাহসী বীর। হাসান ও হুসাইনের ফজিলতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একাধিক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। অন্তর দিয়ে তাদেরকে ভালবাসা ঈমানের অন্যতম আলামত এবং নবী পরিবারের কোন সদস্যকে ঘৃণা করা ও গালি দেয়া মুনাফেকির সুস্পষ্ট লক্ষণ। যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত কেবল তারাই ইমাম হুসাইন বা নবী পরিবারের পবিত্র সদস্যদেরকে ঘৃণা করতে পারে।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামআতের আকীদাহ অনুযায়ী ইমাম হুসাইন বা অন্য কারও মৃত্যুতে মাতম করা জায়েজ নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল মুসলিম জাতির বিরাট একটি গোষ্ঠী ইমাম হুসাইনের মৃত্যুতে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকে। যারা হুসাইনের মৃত্যু ও কারবালার ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন, তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন করা খুবই যুক্তিসংগত মনে করছি। যে সমস্ত সুন্নি মুসলিম সঠিক তথ্য না জানার কারণে এ ব্যাপারে সন্দিহান ও বিভ্রান্তিতে আছেন তাদের কাছেও আমার একই প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই প্রকৃত ঘটনা বুঝা খুব সহজ হবে ইনশা-আল্লাহ।
প্রথম প্রশ্ন: হুসাইনের পিতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী বিন আবু তালেব (রা:) হুসাইনের চেয়ে অধিক উত্তম ছিলেন। তিনি ৪০ হিজরী সালে রমযান মাসের ১৭ তারিখ জুমার দিন ফজরের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় আব্দুর রাহমান মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। তারা হুসাইনের মৃত্যু উদযাপনের ন্যায় তাঁর পিতার মৃত্যু উপলক্ষে মাতম করে না কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: আহলে সুন্নত ওয়াল জামআতের আকীদাহ অনুযায়ী উসমান বিন আফ্ফান ছিলেন আলী ও হুসাইন (রা:)এর চেয়ে অধিক উত্তম। তিনি ৩৬ হিজরী সালে যুল হজ্জ মাসের আইয়ামে তাশরীকে স্বীয় বাস ভবনে অবরুদ্ধ অবস্থায় মাজলুম ভাবে নিহত হন। ন্যায় পরায়ণ এই খলীফাকে পশুর ন্যায় জবাই করা হয়েছে। তারা তাঁর হত্যা দিবসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করে না কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন: এমনভাবে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) উসমান এবং আলী (রা:) থেকেও উত্তম ছিলেন। তিনি ফজরের নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন এবং মুসলমানদেরকে নিয়ে জামআতের ইমামতি করছিলেন। এমন অবস্থায় আবু লুলু নামক একজন অগ্নি পূজক তাঁকে দুই দিকে ধারালো একটি ছুরি দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথে তিনি ধরাশায়ী হয়ে যান এবং শহীদ হন। লোকেরা সেই দিনে মাতম করে না কেন?
চতুর্থ প্রশ্ন: ইসলামের প্রথম খলীফা এবং রাসূলের বিপদের দিনের সাথী আবু বকরের মৃত্যু কি মুসলিমদের জন্য বেদনাদায়ক নয়? তিনি কি রাসূলের পরে এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন না? তার মৃত্যু দিবসে তারা তাজিয়া করে না কেন?
পঞ্চম প্রশ্ন: সর্বোপরি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া ও আখেরাতে সমস্ত বনী আদমের সরদার। আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে অন্যান্য নবীদের ন্যায় স্বীয় সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছেন। সাহাবীদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর চেয়ে অধিক বড় আর কোন মুসীবত ছিল না। তিনি ছিলেন তাদের কাছে স্বীয় জীবন, সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের চেয়েও অধিক প্রিয়। তারপরও তাদের কেউ রাসূলের মৃত্যুতে মাতম করেন নি। হুসাইনের প্রেমে মাতালগণকে রাসূলের মৃত্যু দিবসকে উৎসব ও শোক প্রকাশের দিন হিসেবে নির্ধারণ করতে দেখা যায় না কেন?
ষষ্ঠ প্রশ্ন: সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে হুসাইনের চেয়ে বহুগুণ বেশী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মৃত্যু দিবসকে বাদ দিয়ে ইমাম হুসাইনের মৃত্যুকে বেছে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি শুরু করা হল কেন? এর উত্তর আমার এই লেখার শেষ পর্যায়ে উলে¬খ করেছি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখাটি পাঠ করলে উত্তরটি সহজেই বোধগম্য হওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ সর্বোপরি ইসলামে কারও জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালন করার এবং কারও মৃত্যুতে মাতম করা, উচ্চ স্বরে বিলাপ করা এবং অন্য কোন প্রকার অনুষ্ঠান করার কোন ভিত্তি নেই। শুধু তাই নয় এটি একটি জঘন্য বিদআত, যা পরিত্যাগ করা জরুরী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তাঁর কোন সাহাবী কারও জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালন করেন নি।

২) কারবালার প্রান্তরে রাসূলের দৌহিত্র হুসাইন (রা:) নিহত হওয়ার প্রকৃত ঘটনা:
৬০ হিজরিতে ইরাক বাসীদের নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, হুসাইন (রা:) ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হাতে বয়াত করেন নি। তারা তাঁর নিকট চিঠি-পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দিল যে ইরাক বাসীরা তাঁর হাতে খেলাফতের বয়াত করতে আগ্রহী। ইয়াজিদকে তারা সমর্থন করেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিল। তারা আরও বলল যে, ইরাক বাসীরা ইয়াজিদের পিতা মুয়াবিয়া (রা:)এর প্রতিও মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। চিঠির পর চিঠি আসতে লাগল। এভাবে পাঁচ শতাধিক চিঠি হুসাইন (রা:)এর কাছে এসে জমা হল।
প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য হুসাইন (রা:) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে পাঠালেন। মুসলিম কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেন, আসলেই লোকেরা হুসাইনকে চাচ্ছে। লোকেরা মুসলিমের হাতেই হুসাইনের পক্ষে বয়াত নেওয়া শুরু করল। হানী বিন উরওয়ার ঘরে বয়াত সম্পন্ন হল।
সিরিয়াতে ইয়াজিদের নিকট এই খবর পৌঁছা মাত্র বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য পাঠালেন। ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন কুফা বাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইনের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন। সে হুসাইনকে হত্যা করার আদেশ দেন নি।
উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করতে লাগলেন এবং মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। পরিশেষে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, হানী বিন উরওয়ার ঘরে হুসাইনের পক্ষে বয়াত নেওয়া হচ্ছে।
অতঃপর মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্বিপ্রহরের সময় উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। এ সময় উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি ইয়াজিদের সেনা বাহিনীর ভয় দেখালেন। তিনি এমন ভীতি প্রদর্শন করলেন যে, লোকেরা ইয়াজিদের ধরপাকড় এবং শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে পলায়ন করতে শুরু করল। ইয়াজিদের ভয়ে কুফা বাসীদের পলায়ন ও বিশ্বাস ঘাতকতার লোমহর্ষক ঘটনা জানতে চাইলে পাঠকদের প্রতি ইমাম ইবনে তাইমীয়া (র:) কর্তৃক রচিত মিনহাজুস সুন্নাহ বইটি পড়ার অনুরোধ রইল। যাই হোক কুফা বাসীদের চার হাজার লোক পালাতে পালাতে এক পর্যায়ে মুসলিম বিন আকীলের সাথে মাত্র তিন জন লোক অবশিষ্ট রইল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল দেখলেন, হুসাইন প্রেমিক আল্লাহর একজন বান্দাও তার সাথে অবশিষ্ট নেই। এবার তাকে গ্রেপ্তার করা হল। উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। মুসলিম বিন আকীল উবাইদুল্লাহএর নিকট আবেদন করলেন, তাকে যেন হুসাইনের নিকট একটি চিঠি পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। এতে উবাইদুল্লাহ রাজী হলেন। চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল এ রকম:
“হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।” অতঃপর যুল হজ্জ মাসের ৯ তারিখ আরাফা দিবসে উবাইদুল্লাহ মুসলিমকে হত্যার আদেশ প্রদান করেন। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, মুসলিম ইতিপূর্বে কুফা বাসীদের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে হুসাইনকে আগমনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উপর ভিত্তি করে যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন (রা:) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইবনে উমর হুসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন: হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীছ শুনাবো। জিবরীল (আঃ) আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। হুসাইন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বিরতি করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর হুসাইনের সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন।
সুফীয়ান ছাওরী ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস (রা:) হুসাইনকে বলেছেন: মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম।
বের হওয়ার সময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) হুসাইনকে বলেছেন: হোসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বলেছেন: হুসাইন তাঁর জন্য নির্ধারিত ফয়সালার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর বের হওয়ার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে কখনই তাকে যেতে দিতাম না। তবে বল প্রয়োগ করে আমাকে পরাজিত করলে সে কথা ভিন্ন। (ইয়াহ্-ইয়া ইবনে মাঈন সহীস সূত্রে বর্ণনা করেছেন)
যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির বিষয় অবগত হয়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন। পথিমধ্যে ইয়াজিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের গতিরোধ করল। হুসাইন সেখানে অবতরণ করে আল্লাহর দোহাই দিয়ে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন।
হুসাইন বিন আলী (রা:) এবং রাসূলের দৌহিত্রকে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক। তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াজিদের হাতে বয়াত গ্রহণ করবেন। কেননা তিনি জানতেন যে, ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করতে চান না। অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক।
অথবা তাঁকে কোন ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করবেন এবং রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে আত্ম নিয়োগ করবেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)
ইয়াজিদের সৈন্যরা কোন প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না। তারা বলল: উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা তা ব্যতীত অন্য কোন প্রস্তাব মানতে রাজী নই। এই কথা শুনে উবাইদুল্লাহএর এক সেনাপতি (হুর বিন ইয়াজিদ) বললেন: এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে না? আল্লাহর কসম! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করত, তাহলে তা ফেরত দেয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না। এরপরও তারা উবাইদুল্লাহএর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই দৃঢ়তা প্রদর্শন করল। সেই সেনাপতি ঘোড়া নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলেন এবং হুসাইন ও তাঁর সাথীদের দিকে গমন করলেন। হুসাইনের সাথীগণ ভাবলেন: তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসছেন। তিনি কাছে গিয়ে সালাম দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে উবাইদুল্লাহএর সৈনিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের দুইজনকে হত্যা করলেন। অতঃপর তিনিও নিহত হলেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)
সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে হুসাইনের সাথী ও ইয়াজিদের সৈনিকদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান ছিল। হুসাইনের সামনেই তাঁর সকল সাথী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হলেন। অবশেষে তিনি ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না। তিনি ছিলেন সিংহের মত সাহসী বীর। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের মুকাবিলায় তার পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা সম্ভব হল না। কুফা বাসী প্রতিটি সৈনিকের কামনা ছিল সে ছাড়া অন্য কেউ হুসাইনকে হত্যা করে ফেলুক। যাতে তার হাত রাসূলের দৌহিত্রের রক্তে রঙ্গিন না হয়। পরিশেষে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি হুসাইনকে হত্যার জন্য উদ্যত হয়। তার নাম ছিল সীমার বিন যুল জাওশান। সে বর্শা দিয়ে হুসাইনের শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলল। অতঃপর ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তিনি শাহাদাত অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন।
বলা হয় এই সীমারই হুসাইনের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেউ কেই বলেন: সিনান বিন আনাস আন্ নাখঈ নামক এক ব্যক্তি তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে। আল্লাহই ভাল জানেন।

৩) ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার কিচ্ছা:
বেশ কিছু গ্রন্থ তাকে ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। আর বলা হয় যে, তিনি পানির পিপাসায় মারা যান। এ ছাড়াও আরও অনেক কথা বলে মানুষকে আবেগময় করে যুগে যুগে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এবং মূল সত্যটি উপলব্ধি করতে তাদেরকে বিরত রাখার হীন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ সব কাল্পনিক গল্পের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ঘটনার যতটুকু সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে আমাদের জন্য ততটুকুই যথেষ্ট। কোন সন্দেহ নেই যে, কারবালার প্রান্তরে হুসাইন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনা দায়ক। ধ্বংস হোক হুসাইনের হত্যাকারীগণ! ধ্বংস হোক হুসাইনের হত্যায় সহযোগীরা! আল্লাহর ক্রোধ তাদেরকে ঘেরাও করুক। আল্লাহ্‌ তায়ালা রাসূলের দৌহিত্র শহীদ হুসাইন এবং তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা আচ্ছাদিত করুক।

৪) কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের সাথে আরও যারা নিহত হয়েছেন:
• আলী (রা:)এর সন্তানদের মধ্যে থেকে আবু বকর, মুহাম্মাদ, উসমান, জাফর এবং আব্বাস।
• হোসাইনের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকর, উমর, উসমান, আলী আকবার এবং আব্দুল্লাহ।
• হাসানের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকর, উমর, আব্দুল্লাহ এবং কাসেম।
• আকীলের সন্তানদের মধ্যে হতে জাফর, আব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন আকীল।
• আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানদের মধ্যে হতে আউন এবং আব্দুল্লাহ। ইতি পূর্বে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের নির্দেশে মুসলিম বিন আকীলকে হত্যা করা হয়। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হোন। আমীন

৫) কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত ধারণা ঠিক নয়:
হুসাইন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুতে আকাশ থেকে রক্তের বৃষ্টি হওয়া, সেখানের কোন পাথর উঠালেই তার নীচ থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া এবং কোন উট জবাই করলেই তা রক্তে পরিণত হয়ে যাওয়ার ধারণা মিথ্যা ও বানোয়াট। মুসলমানদের আবেক ও অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ সমস্ত বানোয়াট ঘটনা বলা হয়ে থাকে। এগুলোর কোন সহীহ সনদ নেই।
ইমাম ইবনে কাছীর (র:) বলেন: হুসাইনের মৃত্যুর ঘটনায় লোকেরা উল্লেখ করে থাকে যে, সে দিন কোন পাথর উল্টালেই রক্ত বের হত, সে দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আকাশের দিগন্ত লাল হয়ে গিয়েছিল এবং আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হয়েছিল। এসব কথা সন্দেহ মূলক। প্রকৃত কথা হচ্ছে, এগুলো বিশেষ একটি গোষ্ঠীর বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বিষয়টিকে বড় করার জন্য এগুলো রচনা করেছে।
কোন সন্দেহ নেই যে, কারবালার ময়দানে সপরিবারে হুসাইনের শাহাদাত বরণ একটি বিরাট ঘটনা। কিন্তু তারা এটিকে কেন্দ্র করে যে মিথ্যা রচনা করেছে, তার কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
ইসলামের ইতিহাসে হুসাইনের মৃত্যুর চেয়ে অধিক ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে সমস্ত ঘটনায় উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোনটিই সংঘটিত হয় নি। হুসাইনের পিতা আলী (রা:) আব্দুর রাহমান মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মম ভাবে নিহত হন। সকল আলেমের ঐকমতে হুসাইনের চেয়ে আলী (রা:) অধিক শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ছিলেন। তার শাহাদাতের দিন কোন পাথর উল্টালেই রক্ত বের হয় নি, সে দিন সূর্যগ্রহণ হয় নি, আকাশের দিগন্ত লাল হয়ে যায় নি এবং আকাশ থেকে পাথরও বর্ষিত হওয়ারও কোন প্রমাণ নেই।
উসমান বিন আফফান (রা:)এর বাড়ি ঘেরাও করে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করে। তিনি মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে এসবের কোনটিই সংঘটিত হয় নি। উসমান (রা:)এর পূর্বে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব ফজরের নামাযে দাঁড়ানোর সময় নির্মমভাবে নিহত হন। এই ঘটনায় মুসলিমগণ এমন মুসীবতে পড়েছিলেন, যা ইতিপূর্বে কখনও পড়েন নি। তাতে উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায় নি।
আল্লাহর সর্বশেষ্ঠ বান্দা সমগ্র নবী-রাসূলের সরদার রাহমাতুল লিল আলামীন মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে এমন কিছু সংঘটিত হয় নি। যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিশু পুত্র ইবরাহীম মৃত্যু বরণ করেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ লেগেছিল। লোকেরা বলতে লাগল: ইবরাহীমের মৃত্যুতে আজ সূর্যগ্রহণ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যগ্রহণের নামায আদায় করলেন এবং খুতবা প্রদান করলেন। খুতবায় তিনি বর্ণনা করলেন যে, সূর্য এবং চন্দ্র কারও মৃত্যু বা জন্ম গ্রহণের কারণে আলোহীন হয় না। এগুলো আল্লাহর নিদর্শন। তিনি এগুলোর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকেন।

৬) হুসাইনের বের হওয়া ন্যায় সংগত ছিল কি?
বিজ্ঞ সাহাবীদের মতে কুফার উদ্দেশ্যে হুসাইনের বের হওয়াতে কল্যাণের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় নি। এ জন্যই অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছেন এবং তাঁকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি বিরত হন নি। কুফায় যাওয়ার কারণেই ঐ সমস্ত জালেম ও স্বৈরাচারেরা রাসূলের দৌহিত্রকে শহীদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তার বের হওয়া এবং নিহত হওয়াতে যে পরিমাণ ফিতনা ও ফসাদ সৃষ্টি হয়েছিল, মদিনায় অবস্থান করলে তা হওয়ার ছিল না। কিন্তু মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা ও তকদীরের লিখন বাস্তবে পরিণত হওয়া ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় ছিল না। হুসাইনের হত্যায় বিরাট বড় অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু তা নবীদের হত্যার চেয়ে অধিক ভয়াবহ ছিল না। আল্লাহর নবী ইয়াহ-ইয়া (আঃ)কে পাপিষ্ঠরা হত্যা করেছে। জাকারিয়া (আঃ)কেও তাঁর জাতির লোকেরা নির্মমভাবে শহীদ করেছে। এমনি আরও অনেক নবীকে বনী ইসরাইলরা কতল করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قل قد جاءكم رسل من قبلي بالبينات وبالذي قلتم فلم قتلتموهم إن كنتم صادقين

“তুমি তাদের বলে দাও, তোমাদের মাঝে আমার পূর্বে বহু রসূল নিদর্শনসমূহ এবং তোমরা যা আবদার করেছ তা নিয়ে এসেছিলেন, তখন তোমরা কেন তাদেরকে হত্যা করলে যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক।” (সূরা আল-ইমরান: ১৮৩)
এমনভাবে উমর, উসমান ও আলী (রা:)কেও হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং তাঁর হত্যা কাণ্ড নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার কোন যুক্তি নেই।

৭) কারবালার ঘটনাকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব?
যে মুসলিম আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করা, শরীর জখম করা, গাল, মাথা ও বুক থাবড়ানো বা এ রকম অন্য কিছু করা জায়েজ নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

ليس منا من لطم الخدود و شق الجيوب

“যে ব্যক্তি মুসীবতে পড়ে নিজ গালে চপেটাঘাত করল এবং শরীরের কাপড় ছিঁড়ল, সে আমাদের দলের নয়।” (বুখারী)
তিনি আরও বলেন:
“মুসীবতে পড়ে বিলাপকারী, মাথা মুন্ডনকারী এবং কাপড় ও শরীর কর্তনকারীর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:

إن النائحة إذا لم تتب فإنها تلبس يوم القيامة درعاً من جرب و سربالاً من قطران

“মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে কিয়ামতের দিন খাঁজলীযুক্ত (লোহার কাঁটাযুক্ত) কোর্তা পড়ানো হবে এবং আলকাতরার প্রলেপ লাগানো পায়জামা পড়ানো হবে।” (মুসলিম)
তিনি আরও বলেন:

أربع في أمتي من أمر الجاهلية لا يتركونهن: الفخر في الأحساب و الطعن في الأنساب و الاستسقاء بالنجوم و النياحة

“আমার উম্মতের মধ্যে জাহেলী যুগের চারটি স্বভাব বিদ্যমান রয়েছে। তারা তা ছাড়তে পারবে না।
(১) বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব করা,
(২) মানুষের বংশের নাম তুলে দুর্নাম করা,
(৩) তারকারাজির মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং
(৪) মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা। তিনি আরও বলেন: মানুষের মাঝে দুটি জিনিষ রয়েছে, যা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের বংশের বদনাম করা এবং মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা।” (মুসলিম)
তিনি আরও বলেন:

النياحة من أمر الجاهلية و إن النائحة إذا ماتت و لم تتب قطع الله لها ثيابا من قطران و درعاً من لهب النار

“মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ আলকাতরার প্রলেপ লাগানো জামা পড়াবেন এবং অগ্নি শিখা দ্বারা নির্মিত কোর্তা পরাবেন।” (ইবনে মাজাহ)
একজন বিবেকবান মুসলিমের উপর আবশ্যক হচ্ছে সে এ ধরণের মুসীবতের সময় আল্লাহর নির্দেশিত কথা বলবে। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন:

الذين إذا أصابتهم مصيبة قالوا إنا لله وإنا إليه راجعون

“যখন তাঁরা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।” (সূরা বাকারাঃ ১৫৬)
হুসাইনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলী বিন হুসাইন, মুহাম্মাদ এবং জাফর জীবিত ছিলেন। তাদের কেউ হুসাইনের মৃত্যুতে মাতম করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা ছিলেন আমাদের হেদায়েতের ইমাম ও আদর্শ।
বিলাপ করা, গাল ও বুকে চপেটাঘাত করা বা এ জাতীয় অন্য কোন কাজ কখনই এবাদত হতে পারে না। আশুরার দিনে ক্রন্দনের ফজিলতে যে সমস্ত বর্ণনা উল্লেখ করা হয় তার কোনটিই বিশুদ্ধ নয়। বিলাপ করা জাহেলী জামানার আচরণ বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন।

৮) মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করার ক্ষেত্রে শিয়া মাজহাবের মতামত:
বিলাপ থেকে বিরত থাকার আদেশ শুধু সুন্নি মুসলিম বা বনী উমাইয়াদের জন্য নয় কিংবা এটি কেবল তাদেরই আচরণ নয় যে, শিয়ারা তা গ্রহণ করতে পারেন না; বরং আহলে বাইতের কথাও তাই। আহলে সুন্নত এবং শিয়া উভয় শ্রেণীর নিকটই মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা নিষিদ্ধ।
শিয়া আলেম ইবনে বাবুওয়াই আল-কুম্মী বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
বিলাপ করা জাহেলী জামানার কাজ। (দেখুন শিয়াদের কিতাব: من لايحضره الفقيه)
মাজলেসী থেকে অপর বর্ণনায় এসেছে,

النياحة عمل الجاهلية

অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির উপর উচ্চ স্বরে রোদন করা জাহেলিয়াতের কাজ। (দেখুন: বিহারুল আনওয়ার ১০/৮২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞার কারণেই আহলে সুন্নত ওয়াল জামআতের লোকেরা যে কোন মুসীবতের সময় মাতম ও বিলাপ করা থেকে বিরত থাকেন।

৯) আশুরার দিনে আমাদের করণীয় কীঃ
সুন্নি মুসলিমগণ এই দিনে রোজা রাখেন। কারণ এটি এমন একটি দিন যাতে আল্লাহ তায়ালা মুসা ও তাঁর জাতির লোকদেরকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউন সম্প্রদায়কে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন। আহলে সুন্নত ওয়াল জামআতের লোকেরা মনে করেন, খালেস দিলে রোজা অবস্থায় হুসাইনের জন্য দুয়া করা জাহেলী জামানার আচরণের মত মাতম ও বিলাপ করার চেয়ে অনেক উত্তম। এ দিনে রোজাদারের জন্য দুটি কল্যাণ রয়েছে। একটি হচ্ছে সম্মানিত দিনে রোজা রাখার ফযিলত আর অন্যটি হচ্ছে, রোজা অবস্থায় দুয়া করার ফজিলত। এই দুআর একটি অংশ বা সম্পূর্ণটাই তিনি ইচ্ছা করলে হুসাইনের জন্য করতে পারেন।
আশুরার দিনে রোজা রাখার ফজিলতে যা বর্ণিত হয়

“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখলেন ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এটি কোন রোজা। তারা উত্তর দিল যে, এটি একটি বিরাট পবিত্র দিন। এদিনে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাইলকে তাদের শত্র“দের কবল থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন। তাই মুসা (আঃ) এ দিন রোজা রেখেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন: তাদের চেয়ে মুসা (আঃ)এর সাথে আমার সম্পর্ক অধিক। সুতরাং তিনি রোজা রাখলেন এবং সাহাবীদেরকে রোজা রাখার আদেশ দিয়েছেন।” (বুখারী)

“আয়েশা (রা:) বলেন: আইয়ামে জাহেলিয়াতেও কুরাইশরা আশুরার রোজা রাখত। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামও এ দিনে রোজা রাখতেন। মদিনায় হিজরত করে এসেও তিনি এ দিন রোজা রেখেছেন এবং লোকদেরকে রোজা রাখার আদেশ দিয়েছেন। যখন রমাযানের রোজা রাখা ফরজ করা হল তখন আশুরার রোজা ছেড়ে দিলেন। সুতরাং তখন থেকে যার ইচ্ছা রোজা রাখত আর যার ইচ্ছা রোজা রাখা ছেড়ে দিত।” (বুখারী)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আশুরার রোজা রাখলেন এবং রোজা রাখার আদেশ দিলেন, তখন সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো এমন একটি দিন, যাতে ইয়াহুদ-নাসারারাও সম্মান করে। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: আগামী বছর ইনশা-আল্লাহ্‌ নয় তারিখেও রোজা রাখবো। কিন্তু আগামী বছর আসার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন। (বুখারী)

১০) শিয়াদের বর্ণনায় আশুরার রোজা:
আলী বিন আবু তালেব (রা:) বলেন:

صوموا العاشوراء ، التاسع والعاشر ، فإنّه يكفّر الذنوب سنة

তোমরা আশুরার অর্থাৎ নয় এবং দশ তারিখে রোজা রাখো। কেননা ইহা পূর্বের এক বছরের গুনাহকে মোচন করে দেয়। (দেখুন: الاستبصار ২/১৩৪ (الحر العاملي في وسائل الشيعة৭/৩৩৭)
জাফর (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,
আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহর কাফফারা স্বরূপ।

১১) আশুরার দিনে মাতম করার ভিত্তি কোথায়?
বর্তমানে আশুরার দিনে হুসাইনীয়াত নামে যে অনুষ্ঠান, মাতম, বুক ও গাল থাবড়ানো, উচ্চ স্বরে ক্রন্দন এবং বিলাপ করে থাকে তার কোন ভিত্তি নেই। আহলে বাইতের মাজহাবেও তার কোন দলীল নেই এবং সর্বোপুরি ইসলামী আকীদার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। শিয়ারা যেহেতু বলে থাকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা হালাল করেছেন কিয়ামত পর্যন্ত তা ছাড়া অন্য কিছু হালাল নয় এবং তিনি যা হারাম করেছেন কিয়ামত পর্যন্ত তা ছাড়া অন্য কিছু হারাম নেই সেহেতু তাদের কাছে প্রশ্ন হল: আপনারা যদি উপরোক্ত কথাটি বিশ্বাস করেন তাহলে বাক্যটির বাস্তবায়ন কোথায়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নিষিদ্ধ জাহেলী জামানার একটি অভ্যাসকে আপনারা ইসলাম ও আহলে বাইতের নিদর্শন নির্ধারণ করেছেন কেন?
আশ্চর্যের কথা হচ্ছে তাদের মাশায়েখগণ আশুরার দিনে মাতম ও হায় হুসাইন হায় হুসাইন বলে চিৎকার করাকে আল্লাহর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে নিম্নের আয়াতটিকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন:

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ

এটা শ্রবণযোগ্য। কেউ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের অল্লাহ্ভীতি প্রসূত। (সূরা হজ্জ: ৩২)
অতএব তারা বিলাপ করা, গাল ও বুক থাবড়ানো, আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের সাহাবীদেরকে গালাগালি করাকে আল্লাহর সম্মানিত নিদর্শন মনে করেই করে থাকেন। এর চেয়ে অধিক মূর্খতা আর কি হতে পারে?
আরও আশ্চর্যের কথা হচ্ছে আশুরার রোজার ব্যাপারে সুস্পষ্ট হাদীছ থাকা সত্ত্বেও এগুলোকে তারা জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। অপর পক্ষে তাদের আলেমগণ এই বর্ণনাগুলোকে বারবার আহলে সুন্নত ও বনী উমাইয়াদের বানানো বলে অপবাদ দিয়ে থাকেন। তারা আরও বলেন যে, বনী উমাইয়াগণ হুসাইনের মৃত্যু উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার জন্য এই রোজার প্রচলন করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ্) অথচ সুন্নি ও শিয়া উভয় মাজহাবের হাদীছের কিতাবেই এই রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পবিত্র পরিবার এবং সাহাবীগণ আশুরার রোজা রেখেছেন। তিনি মুসলিমদেরকে রোজা রাখার আদেশ দিয়েছেন।
এখন তাদের কাছে প্রশ্ন হল: যে ব্যক্তি আশুরার দিনে রোজা রেখে, জিকির-আজকার করে, কুরআন তেলাওয়াত করে এবং অন্যান্য এবাদতের মাধ্যমে এই দিন অতিবাহিত করে সে হুসাইনের মৃত্যুতে আনন্দের অনুষ্ঠান করল? না যে ব্যক্তি মানুষের মাঝে গোশত, খাদ্য-পানীয় এবং অন্যান্য বস্তু বিতরণ করল এবং বিভিন্ন শির্কী কবিতা আবৃতি করে রাত পার করে দিল সে হুসাইনের মৃত্যু উদযাপন করল? মূলত: তাদের কথার মধ্যে সুস্পষ্ট স্ববিরোধীতা রয়েছে।

১২) হুসাইনের হত্যায় ইয়াজিদ কতটুকু দায়ী?
প্রথমেই বলে নিতে চাই যে আমার এই কথা ইয়াজিদের পক্ষে উকালতি করার জন্য নয়; বরং মূল সত্যকে বিশ্বের সকল বাংলাভাষী মুসলিমের সামনে তুলে ধরার জন্যে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (র:) বলেন: সকল মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকের ঐকমতে ইয়াজিদ বিনম মুয়াবিয়া হুসাইনকে হত্যার আদেন দেন নি। বরং তিনি উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে চিঠির মাধ্যমে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইরাকের জমিনে হুসাইনকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দেন। এতটুকুই ছিল তার ভূমিকা। বিশুদ্ধ মতে তার কাছে যখন হুসাইন নিহত হওয়ার খবর পৌঁছল তখন তিনি আফসোস করেছেন। ইয়াজিদের বাড়িতে কান্নার ছাপ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি হুসাইন পরিবারের কোন মহিলাকে বন্দী বা দাসীতে পরিণত করেন নি; বরং পরিবারের সকল সদস্যকে সম্মান করেছেন। সসম্মানে হুসাইন পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন।
যে সমস্ত রেওয়াতে বলা হয়েছে যে, ইয়াজিদ আহলে বাইতের মহিলাদেরকে অপদস্থ করেছেন এবং তাদেরকে বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে বেইজ্জতি করেছেন, তার কোন ভিত্তি নেই। বনী উমাইয়াগণ বনী হাশেমকে খুব সম্মান করতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন ফাতেমা বিনতে আব্দুল্লাহ বিন জাফরকে বিয়ে করলেন তখন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান এই বিয়ে মেনে নেন নি। তিনি হাজ্জাজকে বিয়ে বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দিয়েছেন।
শুধু তাই নয় হুসাইন হত্যার জন্য দায়ী উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে যখন হুসাইনের পরিবারের মহিলাদেরকে উপস্থিত করা হল তখন তিনি আলাদাভাবে তাদের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করলেন এবং তাদের ভরণ-পোষণ ও পরিধেয় বস্ত্রের ব্যবস্থা করলেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)
ঐতিহাসিক ইজ্জত দাররুযা বলেন: হুসাইন হত্যার জন্য ইয়াজিদকে সরাসরি দায়ী করার কোন দলীল নেই। তিনি তাঁকে হত্যার আদেশ দেন নি। তিনি যেই আদেশ দিয়েছেন, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, তাঁকে ঘেরা করা হোক এবং তিনি যতক্ষণ যুদ্ধ না করবেন ততক্ষণ যেন তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করা হয়।
ইমাম ইবনে কাছীর (র:) বলেন: এটি প্রায় নিশ্চিত যে ইয়াজিদ যদি হুসাইনকে জীবিত পেতেন, তাহলে তাঁকে হত্যা করতেন না। তাঁর পিতা মুআভীয়া (রা:) তাকে এ মর্মে অসীয়তও করেছিলেন। ইয়াজিদ এই কথাটি সুস্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছিলেন।

১৩) তাহলে কে হুসাইনকে হত্যা করল:
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কে হুসাইনকে হত্যা করল। সুন্নি মুসলিমগণ? আমীর মুআভীয়া? ইয়াজিদ বিন মুআভীয়া? না অন্য কেউ?
উত্তরটি মেনে নেওয়া অনেক মুসলিমের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হলেও তা প্রকাশ না করে পারছি না। প্রকৃত ও সঠিক তথ্য হল শিয়াদের একাধিক কিতাব বলছে যে, শিয়ারাই (ইরাক বাসীরাই) হুসাইনকে হত্যা করেছে।
সায়্যেদ মুহসিন আল-আমীন বলেন: বিশ হাজার ইরাক বাসী হুসাইনের পক্ষে বয়াত নেয়। পরবর্তীতে তারা তাঁর সাথে খেয়ানত করেছে, তাঁর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছে এবং তাঁকে হত্যা করেছে। (দেখুন: আয়ানুশ শিয়া ১/৩৪)

১৪) হুসাইনের হত্যাকারী নির্ধারণে ইবনে উমর (রা:)এর অভিমত:
ইবনে আবী নু’ম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন:

আমি একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন একজন লোক তাঁকে মশা হত্যা করার হুকুম জানতে চাইল। তিনি তখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কোন দেশের লোক? সে বলল: ইরাকের। ইবনে উমর (রা:) তখন উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা এই লোকটির প্রতি লক্ষ্য কর। সে আমাকে মশা হত্যা করার হুকুম জিজ্ঞেস করছে। অথচ তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাতিকে হত্যা করেছে। আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল। (বুখারী, হাদীছ নং- ৫৯৯৪) অন্য বর্ণনায় মশার স্থলে মাছির কথা এসেছে।

১৫) হুসাইনের ভাষণই প্রমাণ করে যে ইয়াজিদ তাঁর হত্যার জন্য সরাসরি দায়ী নয়:
হুসাইন (রা:) নিহত হওয়ার পূর্বে ইরাক বাসীদেরকে ডেকে বলেছেন: তোমরা কি পত্রের মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান করো নি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করো নি? অকল্যাণ হোক তোমাদের! যেই অস্ত্র দিয়ে আমরা ও তোমরা মিলে ইসলামের শত্র“দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এখন সেই অস্ত্র তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছে। মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার পক্ষে কৃত বয়াত থেকে সড়ে যাচ্ছ, পোঁকা-মাকড়ের ন্যায় তোমরা উড়ে যাচ্ছ এবং সকল ওয়াদা-অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছ। ধ্বংস হোক এই উম্মতের তাগুতের দলেরা! (দেখুন আল-ইহতেজাজ লিত্ তাবরুসী)
ইমাম হুসাইনের এই ভাষণের কোন স্থানেই তিনি ইয়াজিদকে দায়ী করেন নি। ঘুরেফিরে ভাষণটি এই কথার প্রমাণ করে যে, তাঁর করুন পরিস্থিতির জন্য ইরাক বাসীগণই।
অতঃপর হুর বিন ইয়াজিদ নামক হুসাইনের একজন সমর্থক কারবালার প্রান্তরে দাড়িয়ে ইরাক বাসী সৈনিকদেরকে ডাক দিয়ে বললেন: তোমরা কি এই নেককার বান্দাকে এখানে আসতে আহবান করো নি? তিনি যখন তোমাদের কাছে এসেছেন তখন তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছ এবং তাঁকে হত্যা করার জন্য তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছ। আর তিনি এখন তোমাদের হাতে বন্দী হয়েছেন। আল¬াহ যেন কিয়ামতের দিন তোমাদের পিপাসা না মেটান এবং তার উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন! (দেখুন: الإرشاد للمفيد ২৩৪ ، إعلام الورى بأعلام الهدى)
এই পর্যায়ে হুসাইন তাঁর পূর্বের সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটি বদদুআ করলেন। তিনি বলেন:

“হে আল্লাহ! আপনি যদি তাদের হায়াত দীর্ঘ করেন, তাহলে তাদের দলের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে দিন। তাদেরকে দলে দলে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তাদের শাসকদেরকে তাদের উপর কখনই সন্তুষ্ট করবেন না। তারা আমাদেরকে সাহায্য করবে বলে ডেকে এনেছে। অতঃপর আমাদেরকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়েছে।
হুসাইনের এই দুয়া প্রমাণ করে যে, ইয়াজিদ প্রত্যক্ষভাবে হুসাইনের হত্যায় জড়িত ছিল না। কেননা তিনি দুয়ায় বলেছেন: হে আল্লাহ! আপনি তাদের শাসকদেরকে তাদের উপর কখনই সন্তুষ্ট করবেন না। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ইরাক বাসীগণ (শিয়াগণ) উমাইয়া শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় হুসাইনের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে এবং তাঁর সাথে খেয়ানত করেছে। বাস্তবে তাই হয়েছে। পরবর্তীতে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকেও নির্মম ও নিকিৃষ্টভাবে হত্যা করা হয়েছে।

১৬) আলী বিন হুসাইন তাঁর পিতা হুসাইনকে হত্যার জন্য কুফা বাসীদেরকে দায়ী করেছেন?
শিয়া ঐতিহাসিক ইয়াকুবী বলেন: আলী বিন হুসাইন যখন কুফায় প্রবেশ করলেন তখন দেখলেন কুফার মহিলারা হুসাইন হত্যার বেদনায় ক্রন্দন এবং বিলাপ করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কি আমাদের হত্যায় বিলাপ করছে? তাহলে আমাদেরকে হত্যা করল কে? অর্থাৎ তারা ব্যতীত আমাদের পরিবারের লোক ও আত্মীয়দেরকে অন্য কেউ হত্যা করে নি (দেখুন: তারিখে ইয়াকুবে ১/২৩৫)
উপরে বর্ণিত পৃষ্ঠা নাম্বারসহ তাদের কিতাবগুলোর তথ্য প্রমাণ করে যে, যারা নিজেদরোকে হুসাইনের সমর্থক ও প্রেমিক বলে দাবী করেন, তারাই তাঁকে হত্যা করেছেন। অতঃপর এই মারাত্মক অপরাধের জ্বালা অন্তর থেকে দূর করার জন্য তারাই পরবর্তীতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন এবং যাদের কান্না আসে নি, তারাও অযথা কান্নার ভান করেছেন। এই খেলা-তামাশা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং এখনও চলছে। তাদের অনুসারীরা এখনও হুসাইনের জানাজা বহন করছেন।
হুসাইনের মৃত্যুতে রোদন করা যদি আহলে বাইতের প্রতি তাদের প্রকৃত ভালবাসার প্রমাণ হয়, তাহলে হুসাইনের প্রতি তাদের ভালবাসা সত্য হলে তারা হামজাহ (রা:)এর মৃত্যুতে রোদন করে না কেন?
হুসাইনের উপর তাদের এই কান্না যদি আহলে বাইতের প্রতি অগাধ ভালবাসার কারণেই হত, তাহলে শহীদদের সরদার রাসূলের চাচা হামজা (রা:)এর মৃত্যুতে তারা ক্রন্দন করে না কেন? তাঁকে যে নির্মমভাবে ও পাশবিকতার হত্যা করা হয়েছে, হুসাইন হত্যার পাশবিকতার চেয়ে তা কোন অংশে কম নয়। সায়্যেদ হামজাকে হত্যা করে তাঁর পেট ফেরে কলিজা বের করা হয়েছে। তারা কেন এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বাৎসরিক মাতম করে না? তাদের বুক ও চেহারায় আঘাত করে না কেন? কাপড় টেনে ছিঁড়ে না কেন? প্রতি বছর যখন উহুদ যুদ্ধের দিন ও তারিখ আসে তখন তলোয়ার খেলায় মেতে উঠে না কেন? সায়্যেদ হামজাহ কি আহলে বাইতের একজন সম্মানিত সদস্য নন? এখানেই শেষ নয়; রাসূলের মৃত্যুর চেয়ে অধিক বড় কোন মুসীবত আছে কি? তাঁর মৃত্যুতে তাদের ক্রন্দন ও মাতম কোথায়? সচেতন পাঠকদেরকেই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে নিতে হবে এবং কারও আকীদায় ত্রুটি থাকলে লেখাটি পড়েই তা সংশোধন করে নিতে হবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের কাছে হুসাইনই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কি কারণে তাদের কাছে এত প্রিয়? উত্তর পূর্বে উল্লেখ করেছি। সেটিই আসল কারণ? না ইমাম হুসাইন কর্তৃক একজন পারস্য মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, তাই এত ভালবাসা? উভয়টিই এর কারণ হতে মানা কোথায়? হুসাইন ও তাঁর পিতা আলী বিন আবু তালিব সম্পর্কে তাদের অন্যান্য আকীদাহ-বিশ্বাসের দিকে না গিয়ে এখানেই ছেড়ে দিলাম।

১৭) হুসাইন রা. এর মাথা কোথায় গিয়েছিল?
দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে হুসাইনের মাথা প্রেরণের বর্ণনা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয় নি। বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, তিনি কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। তাঁর সম্মানিত মাথা কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আনাস বিন মালিক (রা:) বলেন: হুসাইনের মাথা উবাইদুল্লাহ এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাঁর মাথাকে একটি থালার মধ্যে রেখে একটি কাঠি হাতে নিয়ে তা নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন এবং তাঁর সৌন্দর্য দেখে সম্ভবত বেখেয়ালে কিছুটা বর্ণনাও করে ফেলেছিলেন। হাদীছের শেষের দিকে আনাস (রা:) বলেন: হুসাইন (রা:) ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। (বুখারী)
অন্য বর্ণনায় আছে, আনাস (রা:) বলেন: আমি উবাইদুল্লাহকে বললাম, তোমার হাতের কাঠি হুসাইনের মাথা থেকে উঠিয়ে ফেল। কারণ আমি তোমার কাঠি রাখার স্থানে রাসূলের পবিত্র মুখ দিয়ে চুমু খেতে দেখেছি। এতে কাঠি সংকোচিত হয়ে গেল। (দেখুন: ফতহুল বারী ৭/৯৬)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এরপর কোথায় হুসাইনের কবর হয়েছে এবং তাঁর মাথা কোথায় গিয়েছে, তা সঠিক সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় নি। প্রকৃত ও সঠিক জ্ঞান আল্লাহর নিকটেই।

১৮) যেমন কর্ম তেমন ফল:
পরবর্তীতে আল-আশতার নাখয়ীর হাতে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ নির্মমভাবে নিহত হন। যখন নিহত হলেন তখন তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মসজিদে রাখা হল। তখন দেখা গেল একটি সাপ এসে মাথার চারপাশে ঘুরছে। পরিশেষে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বের হল। ফের মুখ দিয়ে প্রবেশ করে নাকের ছিদ্র দিয়ে তিনবার বের হতে দেখা গেল। (দেখুন: তিরমিযী, ইয়াকুব বিন সুফীয়ান)

১৯) ইয়াজিদ সম্পর্কে একজন মুসলিমের ধারণা কেমন হওয়া উচিত:
তাফসীর, হাদীছ, আকীদা, এবং ইতিহাস ও জীবনীর কিতাবগুলো অধ্যয়ন করে যতদূর জানতে পেরেছি, তাতে দেখা যায় সালফে সালেহীনের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অনুকরণীয় কোন ইমামের কিতাবে ইয়াজিদের উপর লানত করা বৈধ হওয়ার কথা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাই নি। কেউ তার নামের শেষে রাহিমাহুল্লাহ বা লাআনা হুল্লাহ- এ দু’টি বাক্যের কোনটিই উল্লেখ করেন নি। সুতরাং তিনি যেহেতু তার আমল নিয়ে চলে গেছেন, তাই তার ব্যাপারে আমাদের জবান দরাজ করা ঠিক নয়। তাকে গালাগালি করাতে আমাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু অর্জিত হবে না। তার আমল নিয়ে তিনি চলে গেছেন। আমাদের আমলের হিসাব আমাদেরকেই দিতে হবে। তার ভাল মন্দ আমলের হিসাব তিনিই দিবেন।
ইমাম যাহাবী ইয়াজিদের ব্যাপারে বলেন:

لانسبه ولانحبه

অর্থাৎ “আমরা তাকে গালি দিবো না এবং ভালও বাসবো না।” মদ পান করা, বানর নিয়ে খেলা করা, ফাহেশা কাজ করা এবং আরও যে সমস্ত পাপ কাজের অপবাদ ইয়াজিদের প্রতি দেয়া হয়, তা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে তাঁর চেয়ে হুসাইন যে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সুতরাং তিনি মুসলিম ছিলেন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে আমরা যেহেতু উপস্থিত ছিলাম না, তাই তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই অধিক নিরাপদ। তা ছাড়া বুখারী শরীফের একটি হাদীছে তার ক্ষমা পাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেখানে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার উম্মতের একটি দল কুস্তুনতীনিয়ায় যুদ্ধ করবে। তাদেরকে ক্ষমা করা দেয়া হবে। জানা যাচ্ছে, ইয়াজিদ বিন মুআভীয়া ছিলেন সেই যুদ্ধের সেনাপতি। আর হুসাইন তাতে সাধারণ সৈনিক হিসেবে শরীক ছিলেন। সুতরাং ইয়াজিদও ক্ষমায় শামিল হতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন।

২০) উপসংহার:
হুসাইনরে মৃত্যু নিয়ে লোকেরা তিনভাগে বিভক্ত। একদলের মতে তিনি অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য ইয়াজিদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাই তাঁকে হত্যা করা সঠিক ছিল। তারা বুখারী শরীফের এই হাদীছ দিয়ে দলীল দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

من جاءكم وأمركم على رجل واحد يريد أن يفرق جماعتكم فاقتلوه

“একজন শাসকের সাথে তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় যদি তোমাদের জামআতে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য কেউ আগমন করলে তাকে হত্যা করো।” (বুখারী)
তারা বলেন: মুসলিমরা ইয়াজিদের শাসনের উপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। হুসাইন এসে সেই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছেন। সুতরাং তাঁকে হত্যা করা যুক্তিসংগত হয়েছে।
অন্যদল মনে করেন হুসাইনই ছিলেন খেলাফতের একমাত্র হকদার। তাঁর আনুগত্য করা ব্যতীত অন্য কারও অনুসরণ করা বৈধ ছিল না। জামআত, জুমআসহ ইসলামের কোন কাজই তাঁর পিছনে বা তাঁর নিয়োগ কৃত প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কারও অনুসরণ করে সম্পাদন করলে তা বাতিল হবে। এমন কি তাঁর অনুমতি ব্যতীত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাও বৈধ ছিল না। এমনি আরও অনেক কথা। এই দলের কথার সমর্থনে কোন সুস্পষ্ট দলীল খুঁজে পাওয়া যায় নি।
আর উপরোক্ত উভয় দলের মাঝখানে হচ্ছে আহলে সুন্নত ওয়াল জামআতের মাজহাব। তাঁরা উপরের দুটি মতের কোনটিকেই সমর্থন করেন না। বরং তাঁরা বলেন: হুসাইন মজলুম ও শহীদ অবস্থায় নিহত হয়েছেন। তিনি মুসলিম জাতির নির্বাচিত আমীর বা খলীফা ছিলেন না। সুতরাং দ্বিতীয় মতের পোষণকারীদের কথা ঠিক নয়।
আর যারা বুখারী শরীফের হাদিছকে দলীল হিসেবে পেশ করে হুসাইনকে হত্যা করা বৈধ হওয়ার কথা বলে থাকেন তাদের দলীল গ্রহণ সঠিক নয়। হাদীছ কোনভাবেই তাদের কথাকে সমর্থন করে না। কারণ তিনি যখন তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলের চিঠি পেলেন তখন খেলাফতের দাবী ছেড়ে দিয়ে ইয়াজিদের সৈনিকদের কাছে তিনটি প্রস্তাব পেশ করেছেন।
• সিরিয়ায় গিয়ে তাঁকে ইয়াজিদের সাথে সাক্ষাত করতে দেয়া হোক।
• অথবা তাকে মুসলিম রাজ্যের কোন সীমান্তের দিকে যেতে দেয়া হোক।
• অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক।
কিন্তু তারা কোন প্রস্তাবই মেনে নেয় নি। বরং তারা তাঁকে আত্ম সমর্পণ করে তাদের হাতে বন্দী হওয়ার প্রস্তাব করল। অস্ত্র ফেলে দিয়ে তাদের পাল্টা প্রস্তাব মেনে নেওয়া হোসাইনের উপর মোটেই ওয়াজিব ছিল না। সুতরাং তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করাকেই বেছে নিলেন এবং ইয়াজিদের বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করে শাহাদাত বরণ করলেন।
পরিশেষে বলতে চাই যে, হুসাইনের মৃত্যু ও কারবালার ঘটনা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা কোন মুসলিমের কাজ হতে পারে না। এই হত্যা কাণ্ডের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অন্যান্য মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড থেকে আলাদা কোন ঘটনা নয়। এ জাতিয় সকল ঘটনাকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। বিষাদসিন্ধু মুসলিমদের কোন মূলনীতির গ্রন্থ নয়। এটি একটি কাল্পনিক উপন্যাস মাত্র। তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম জাতি ঐতিহাসিকভাবে একটি প্রমাণিত সত্যকে বাদ দিয়ে কাল্পনিক কাহিনীকে কখনই সত্য হিসাবে গ্রহণ করতেপারে না।

هذا وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين
রচনায়: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী
জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।

Translate