Saturday, October 1, 2022

জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে সফলতা লাভের জন্য করণীয় আমল ও দুআ

 প্রশ্ন: কোনও কাজে ব্যর্থ হলে বা উদ্দেশ্য সাধনে বিলম্ব হলে- এ অবস্থায় এমন কোনও দুআ বা আমল আছে কি যা করলে সফল হওয়া যায়?

উত্তর: জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পূর্বশর্ত হল, সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সু পরিকল্পিতভাবে কঠোর অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও সাধনা করা। পাশাপাশি আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর সাহায্য ও দয়া লাভ করা।
শুধু চেষ্টা-পরিশ্রম দ্বারা প্রত্যাশিত সফলতা আশা করা যায় না যদি না মহান আল্লাহ তাঁর রহমত ও সাহায্য দ্বারা সিক্ত করেন। অনুরূপভাবে সফলতা লাভের জন্য কেবল আল্লাহর দয়ার আশায় হাত গুটিয়ে বসে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ, মহান আল্লাহ মানুষকে শ্রম নির্ভর করেই সৃষ্টি করেছেন।

◆ আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ

“নিশ্চয় আমি মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।” [সূরা বালাদ: ৪]

◆ তিনি আরও বলেন,

وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ

“এবং মানুষ তাই পায়, যা সে করে।” [সূরা নাজম: ৩৯]

◆ দুনিয়াবি ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করার জন্য যেমন কষ্ট-পরিশ্রম করা জরুরি তেমনি আল্লাহর নৈকট্য হাসিল ও তাঁর সান্নিধ্য লাভের জন্যও প্রয়োজন কষ্ট ও পরিশ্রম। তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَىٰ رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ

“হে মানুষ, তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। অতঃপর তার সাক্ষাৎ ঘটবে।” [সূরা ইনশিকাক: ৬]

◆ তবে পরিশ্রম করার পর আল্লাহর উপর ভরসা করাও অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
“কাজে-কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর উপর ভরসা কারীদেরকে ভালবাসেন।” [সূরা আল-ই ইমরান: ১৫৯]

এ বিষয়ে আরও বহু আয়াত রয়েছে।

◆ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال: «لو أنكم كنتم توَكَّلُون على الله حق توَكُّلِهِ لرزقكم كما يرزق الطير، تَغْدُو خِمَاصَاً، وتَرُوحُ بِطَاناَ»

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “তোমরা যদি যথার্থভাবে আল্লাহ তাআলার ওপর তাওয়াককুল (ভরসা) করতে তাহলে তিনি পাখিদের যেভাবে রিজিক দেন সেভাবে তোমাদেরও রিজিক দিতেন। পাখিরা সকালে খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে।” [সহীহ-এটি তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন]

এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে, পাখিরা পেটে ক্ষুধা নিয়ে অলসতা করে বাসায় বসে থাকে না বরং তারা রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, ঠাণ্ডা ও প্রতিকুল পরিবেশেও আল্লাহর উপর ভরসা করে রিজিকের সন্ধানে বের হয়, দীর্ঘ পথ উড়ে যায়, শিকারির ফাঁদে পড়ে জীবন নাশের ঝুঁকি নেয়। তারপর আল্লাহ তাদেরকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেন। ফলে তারা সকালে খালি পেটে বের হলেও সন্ধ্যা তারা তাদের নীড়ে ফিরে আসে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে উদর ভর্তি করে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ কতই না উত্তম রিজিক দাতা!

সুতরাং মানুষও যদি জীবনে সফলতা লাভ করতে চায় তাকে কষ্ট-পরিশ্রম করতে হবে, দৌড়-ঝাঁপ করতে হবে, ঝুঁকি মাথায় নিতে হবে এবং পরম ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহ কাজে লেগে থাকতে হবে। তাহলে হয়তো দয়াময় আল্লাহ তাকে সফলতা দান করবেন। আরবিতে একটা কথা প্রচলিত আছে, من جد وجد “যে চেষ্টা করে সে পায়।”

যাহোক, দুনিয়া কিংবা আখিরাত উভয় ক্ষেত্রে সফলতা লাভের অন্যতম শর্ত হল, চেষ্টা ও সাধনা, কষ্ট ও পরিশ্রম করা। কিন্তু পাশাপাশি আল্লাহর রহমতও প্রয়োজন। আল্লাহর দয়া ছাড়া কেউ সফলতা পাবে না। তা না হলে, কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর পরও অনেক সময় ঘরে ফসল তুলতে পারে না, অনেক দম্পতি একটি সন্তানের অপেক্ষায় নিদারুণ কষ্ট বুকে নিয়ে সারাটা জীবন অতিবাহিত করে দেয় কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণ হয় না। তাই আল্লাহর রহমত ও সাহায্য প্রাপ্তির জন্য আমাদের করণীয় হল, যেসব কাজে আল্লাহর সাহায্য ও রহমত প্রাপ্তির আশা করা যায় সেগুলো বেশি পরিমাণে করা।

❑ জীবনে সফলতার জন্য আল্লাহর সাহায্য ও রহমত প্রাপ্তির কতিপয় আমল:

◍ ১. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ। কেননা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একবার দরুদ পাঠ করলে দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে দশটি রহমত অবতীর্ণ হয়। [সহিহ বুখারি]

◍ ২. বেশি বেশি ইস্তিগফার তথা আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ মোচনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। ইস্তিগফার করার বিনিময়ে আল্লাহ বান্দাকে নানাভাবে সাহায্য করেন। [দেখুন: সূরা নূহ: ৯-১]

◍ ৩. ঈমান ও তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অবলম্বন। এটি আল্লাহর রহমত, বরকত ও হেদায়েত প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। [দেখুন: সূরা আরাফ: ৬৯]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরও বলেন,

وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مِنۡ أَمۡرِهِۦ يُسۡر
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে (আল্লাহ ভীতি অবলম্বন করে), আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।” [সূরা তালাক: ৪]

◍ ৪. দুআ করা। দুআ কবুলের অধিক সম্ভাবনাময় সময় ও ক্ষেত্রগুলোতে সফলতা প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে দুআ করা। যেমন: সালাতের সেজদা অবস্থায়, আজান ও ইকামতের মাঝামাঝি সময়, জুমার দিন আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়ের মাঝে, ভোর রাতে, সফর অবস্থায়, রোজা অবস্থায়, যে কোনও নেকির কাজ করে তার ওসিলা দিয়ে দুআ করা, পিতামাতা ও নেককার লোকদের নিকট থেকে দুআ নেওয়া ইত্যাদি।

◍ ৫. কুরআন তিলাওয়াত শুনাও আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির অন্যতম মাধ্যম। [দেখুন: সূরা আরাফ: ২০৪]

◍ ৬. আল্লাহর সাহায্য লাভের নিমিত্তে আল্লাহর নাম নিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কাজ শুরু করা।

❑ এ ছাড়াও যা করণীয়:

◍ ৭. যে কোনও কাজ করার পূর্বে সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করা।
◍ ৮. অভিজ্ঞজনদের পরামর্শ গ্রহণ করা।
◍ ৯. কাজ শুরুর পূর্বে ইস্তিখারার সালাত আদায় করা।
◍ ১০. কাজে একবার ব্যর্থ হলে, ধৈর্যহারা না হয়ে তা বারবার চেষ্টা করা। কবি বলেন, “এক বার না পারিলে দেখো শত বার।” দীর্ঘ সময় অবিরাম ধারায় পানির ফোটা পতনের ফলে শক্ত শীল খণ্ডেও গর্ত সৃষ্টি হতে পারে।
◍ ১১. এক পদ্ধতি সফলতা না আসলে ভিন্ন উপায় ও ভিন্ন পথ খোঁজা। কারণ অনেক সময় পদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে সফলতা আসে।

◍ ১২. পাশাপাশি নিম্নোক্ত দুআ দুটি অধিক পরিমাণে পাঠ করা:
ক.
اللَّهمَّ لا سَهلَ إلَّا ما جَعَلتَه سَهلًا، وأنتَ تَجعَلُ الحَزْنَ إذا شِئتَ سَهلًا

উচ্চারণ: ‘আল্লা-হুম্মা লা-সাহলা ইল্লা মা জাআলতাহু সাহলা, ওয়া আনতা তাজআলুল হাযনা ইযা শি’তা সাহলা।”

অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি যা সহজ করে দেন তা ছাড়া কোনও কিছুই সহজ নেই। আর আপনি চাইলে পেরেশানি যুক্ত কাজও সহজ করে দেন।” [সহিহ ইবনে হিব্বান: ৯৭৪, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেছেন, এই হদিসটি সহীহ।]

খ. অলসতা থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। এমন একটি দুআ হল:

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ العَجزِ وَالكَسَلِ
وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الجُبنِ وَالبُخلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ غَلَبَةِ الدَّينِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হুযনি, ওয়া আউযুবিকা মিনাল আজযি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউযুবিকা মিনাল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া আউযুবিকা মিন গলাবাতিদ দাইনি ওয়া ক্বাহরির রিজাল।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা থেকে আশ্রয় চাই। আমি আশ্রয় চাই অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই ঋণের বোঝা ও মানুষের রোষানল থেকে।” [বুখারি: ২৮৯৩]

সর্বোপরি, মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা বান্দার কখনো অকল্যাণ করেন না। যদি কোনও কাজে সফলতা না আসে তাহলে বুঝতে হবে, হয়ত এতেই তার জন্য কল্যাণ নিহিত আছে-যদিও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে না জানার কারণে ব্যর্থতায় হা-হুতাশ ও কান্নাকাটি করে। কিন্তু মহাবিশ্বের মহাপরিচালক আল্লাহ তাআলা অবশ্যই জানেন, কিসে আমাদের কল্যাণ আর কিসে আমাদের অকল্যাণ রয়েছে। তাই কাজে সফলতা না আসলেও আল্লাহর প্রতি কু ধারণা পোষণ করা যাবে না, হতাশা ও অস্থিরতায় ভোগা যাবে না বরং আল্লাহর তাকদির ও ফয়সালার প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস পোষণ করতে হবে। এটিই হল, একজন একনিষ্ঠ বিশ্বাসী মুমিনের পরিচায়ক।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়াও আখিরাতের সফলতা দান করুন এবং সব ধরণের অকল্যাণ ও অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

সালাতে হাত বাঁধার বিশুদ্ধ নিয়ম

 প্রশ্ন: সালাতে হাত বাঁধার বিশুদ্ধ নিয়ম কোনটি?নাভীর নিচে বাঁধতে হবে না-কি বুকের উপর?

▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাতে হাত বাঁধার নিয়মের ব্যাপারে সমাজে দু’টি পদ্ধতি চালু রয়েছে। যেমন, নাভীর নীচে হাত বাঁধা এবং বুকের উপর হাত বাঁধা। তবে নাভীর নীচে হাত বেঁধে সালাত আদায় করার পক্ষে যতগুলো বর্ণনা পেশ করা হয়, সেগুলো সবই ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ নাভীর নীচে হাত বাঁধার নিয়ম আমলযোগ্য নয়। বরং হাত বুকের উপর বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।সালাতে রাসূল (ﷺ) তাঁর দুই হাতের আংগুল সমূহ ক্বিবলামুখী খাড়াভাবে কাঁধ অথবা কান পর্যন্ত উঠিয়ে দুনিয়াবী সবকিছুকে হারাম করে দিয়ে স্বীয় প্রভুর মহত্ত্ব ঘোষণা করে ‘আল্লা-হু আকবার’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)’ বলে ‘তাকবীরে তাহরীমা’ দিয়ে দু’হাত কান অথবা কাঁধ বরাবর উঠিয়ে বুকের উপর বাঁধবে।(মুসলিম হা/৯১২, ১/১৭০ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৬৯); বুখারী হা/৬৬৬৭, ২/৯৮৬ পৃঃ; মিশকাত হা/৭৯০)। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন,রাসূল (ﷺ) বলেছেন-নিশ্চয় আমরা নবীদের দল। আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমরা যেন দ্রুত ইফতার করি এবং দেরিতে সাহারী করি। আর সালাতের মধ্যে আমাদের ডান হাত বাম হাতের উপর যেন রাখি। (ইবনু হিববান হা/১৭৬৭; সনদ সহীহ, ছিফাতু ছালাতিন নাবী, পৃঃ ৮৭; ইবনু ক্বাইয়িম, তাহযীব সুনানে আবী দাঊদ ১/১৩০)।
.
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হতো যেন তারা সালাতের সময় ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখে। আবু হাযেম বলেন যে,সাহাবী সাহল বিন সা‘দ এই আদেশটিকে রাসূল (ﷺ)-এর দিকে সম্পর্কিত করতেন বলেই আমি জানি।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৪০, ১/১০২ পৃঃ, ইফাবা হা/৭০৪, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০২, ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৭, মিশকাত হা/৭৯৮, সালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০)। ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ وَضْعِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى সালাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ।’ (সহীহ বুখারী ১/১০২ পৃঃ)।
.
ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে সালাত আদায় করলাম। এমতাবস্থায় দেখলাম যে, তিনি বাম হাতের উপরে ডান হাত স্বীয় বুকের উপরে রাখলেন।’ (সহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৭৯; আবুদাঊদ হা/৭৫৫, ইবনু মাস‘ঊদ হ’তে; ঐ, হা/৭৫৯, ত্বাঊস বিন কায়সান হ’তে; সালাত’ অধ্যায়-২, সালাতে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা’ অনুচ্ছেদ-১২০)।

বুকে হাত বাঁধার তাৎপর্য:ত্বীবী বলেন, ‘হৃৎপিন্ডের উপরে বুকে হাত বাঁধার মধ্যে হুঁশিয়ারী রয়েছে এ বিষয়ে যে, বান্দা তার মহা পরাক্রান্ত মালিকের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে হাতের উপর হাত রেখে মাথা নিচু করে পূর্ণ আদব ও আনুগত্য সহকারে,যা কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না’। (মির‘আত ৩/৫৯ পৃঃ, হা/৮০৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

◾এবার যুগ শ্রেষ্ঠ কয়েকজন আলেমের ফতোয়া লক্ষ করুনঃ
_______________________________________
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,من السنة وضع كف اليمنى على كف اليسرى والرسغ والساعد فوق الصدر أثناء القراءة في القيام. দণ্ডায়মান অবস্থায় ক্বিরআত পাঠকালে ডান হাতকে বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর উপর রেখে বুকের উপর হাত বাঁধা সুন্নাত।’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৬/৩৭০-৩৭২ পৃ.)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, সালাতের মধ্যে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা সুন্নাত। সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, كانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أنْ يَضَعَ الرَّجُلُ اليَدَ اليُمْنَى علَى ذِرَاعِهِ اليُسْرَى في الصَّلَاةِ قَالَ أَبُوْ حَازِمٍ لَا أَعْلَمُهُ إِلَّا يَنْمِي ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ قَالَ إِسْمَاعِيْلُ يُنْمَى ذَلِكَ. ‘লোকদের নির্দেশ দেয়া হত যে,সালাতে প্রত্যেকে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে।’ আবু হাযিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এ হাদীসটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করতেন বলেই জানি। ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতেই বর্ণনা করা হত।’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৪০; মুওয়াত্তা মালিক, হা/৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৪৯)। এখন প্রশ্ন হল, হস্তদ্বয়কে কোথায় রাখতে হবে?বিশুদ্ধতার সর্বাধিক নিকটবর্তী ও অধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী হস্তদ্বয়কে বুকের উপর রাখতে হবে, যা ওয়াইল ইবনু হুজর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে বুকের উপর রাখতেন। (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/৪৭৯, ১/২৪৩ পৃ.; বুলূগুল মারাম, হা/২৭৫)। অন্যান্য হাদীসের তুলনায় এটিই বিশুদ্ধতার সর্বাধিক নিকটবর্তী। অপরদিকে নাভীর নিচে হস্তদ্বয়কে রাখার ব্যাপারে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে যে আছার বর্ণিত হয়েছে, তা যঈফ। বরং ওয়াইল ইবনু হুজর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসই এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী। (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল ইবনে উসাইমীন, ১৩/৯৭ ও ৭৩ পৃ.; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৩/৩৬-৩৭ পৃ.)।

ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَلَا شَيْءَ فِي الْبَابِ أَصَحُّ مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ الْمَذْكُوْرِ فِيْ صَحِيْحِ ابْنِ خُزَيْمَةَ. হাত বাঁধা বিষয়ে সহীহ ইবনু খুযায়মাতে ওয়াইল ইবনু হুজর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসের চাইতে বিশুদ্ধতম কোন হাদীছ আর নেই।’ (নায়লুল আওত্বার, ৩/২৫ পৃ.)।

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যিরার উপর ডান হাত রাখার আদেশ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, হাত বুকের উপরেই বাঁধতে হবে। নচেৎ তার নিচে ঐভাবে হাত রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, ‘বুকের উপরে হাত বাঁধার পদ্ধতি সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। আর এর বিপরীত হয় যঈফ, না হয় ভিত্তিহীন।’ (সিফাতু সালাতিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, পৃ. ৮৮)। এছাড়া আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) আবু দাঊদের তাহক্বীক্বে বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস সহীহ বলেছেন (হা/৭৫৯)। তিনি তাঁর ‘সিফাতু সালাতিন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’ গ্রন্থে হাত বাঁধা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শিরোনাম দিয়েছেন, وضعهما على الصدر ‘বুকের উপর দু’হাত রাখা’। অতঃপর হাদীস উল্লেখ করে নিচে টীকা লিখেছেন। যা বন্ধনীর মধ্যে দেখানো হল। ‘নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর ডান হাত রাখতেন।’ (আবূ দাঊদ, হা/৭২৩, ৭২৬-৭২৭, ৭৫৫, ৭৫৯, ৯৫৭; নাসাঈ, হা/৮৮৭-৮৮৮; ইবনু মাজাহ, হা/৮০৯-৮১১)। এ বিষয়ে তিনি স্বীয় সাহাবীগণকেও আদেশ প্রদান করেছেন। (সহীহ বুখারী, হা/৭৪০; মুওয়াত্তা মালিক, হা/৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৪৯)। তিনি কখনো ডান হাত দ্বারা বাম হাত আঁকড়ে ধরতেন। (নাসাঈ, হা/৮৮৭-৮৮৮, দারাকুত্বনী)।
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, বুকের উপর হাত বাঁধার বিষয়টি সুন্নাত থেকে প্রমাণিত। (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/৪৭৯, ১/২৪৩ পৃ.; বুলূগুল মারাম, হা/২৭৫; ছিফাতু ছালাতিন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পৃ. ৬৯)। এর বিপরীতে নাভীর নিচে হাত বাঁধার বিষয়টি হয় যঈফ না হয় ভিত্তিহীন। সুনানু ইবনু মাজার ভাষ্যকার মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল হাদী আস-সিন্দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সুন্নাত অনুযায়ী হাত বাঁধার স্থান বুকের উপর ব্যতীত অন্য কোন স্থান নয়। পক্ষান্তরে সালাতের মধ্যে নাভীর নিচে হাতের পাতার উপর হাতের পাতা রাখা হাদীসটি সর্বসম্মতিক্রমে যঈফ।’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫৯৯৫৭)।
.
উল্লেখ্য যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখা সম্পর্কে ১৮ জন সাহাবী ও ২ জন তাবিঈ থেকে মোট ২০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এর বিপরীত কোন আমল বর্ণিত হয়নি এবং এটাই অধিকাংশ সাহাবী ও তাবিঈনের অনুসৃত পদ্ধতি (নায়লুল আওত্বার, ৩/২২ পৃ.; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/১০৯ পৃ., কায়রো ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.)।পক্ষান্তরে নাভীর নিচে হাত বাঁধা সম্পর্কে আহমাদ, আবু দাঊদ, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ প্রভৃতি গ্রন্থে চারজন সাহাবী ও দু’জন তাবিঈ থেকে যে চারটি হাদীস ও দু’টি আছার বর্ণিত হয়েছে,সেগুলো সম্পর্কে মুহাদ্দিছীনের বক্তব্য হল, لَا يَصْلُحُ وَاحِدٌ مِنْهَا لِلْاِسْتِدْلَالِ ‘যঈফ হওয়ার কারণে এগুলোর একটিও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’ (মির‘আতুল মাফাতীহ, ৩/৬৩ পৃ.; তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৮৯ পৃ.; ফিক্বহুস সুন্নাহ, পৃ,১০৯) বাজারে প্রচলিত ‘নামায শিক্ষা’ বইগুলোতে উক্ত যঈফ, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বর্ণনা দ্বারা নাভীর নীচে হাত বাঁধার দলীল পেশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাওলানা আব্দুল মতিন প্রণীত ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ একটি। উক্ত লেখক শুধু বানোয়াট বর্ণনাই পেশ করেননি, বরং রীতি মত সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে রাসূল (ﷺ)-এর আমলকে যবাই করে নিজেদেরকে ‘প্রকৃত আহলে হাদীস’ বলে দাবী করেছেন। (দলিলসহ নামাযের মাসায়েল , পৃঃ ২৪) কথায় বলে ‘অন্ধ ছেলের নাম পদ্মলোচন’। কারণ অন্ধ মাযহাবের মরণ ফাঁদে পড়ে কেউ আহলে হাদীস পরিচয় ব্যক্ত করতে পারে না। এ জন্য ‘আহলে হাদীস’ পরিচয় দেয়ার সাহস হয় না। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

কীভাবে বুঝব আমার তওবা কবুল হয়েছে

 প্রশ্ন: দয়াময় আল্লাহর কাছে তওবা করলে তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু তিনি যদি ক্ষমা করেন তাহলে আমরা কীভাবে বুঝবো? সে রকম কোনও আলামত আছে কি?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করত: আমাদের পাপরাশী ক্ষমা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন,
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
“বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি অতি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” [সূরা যুমার: ৫৩]।

তিনি আরও বলেন,
وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” [সূরা নূর: ৩১]। তাই আমাদের উপর আবশ্যক হলো, আমরা কোন অন্যায়-অপকর্ম বা পাপাচারিতায় লিপ্ত হলে তৎক্ষণাৎ তা পরিত্যাগ করা এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তবে আশা করা যায় তিনি আমাদের প্রাপরাশি মোচন করবেন এবং তাঁর অবারিত ক্ষমা ও দয়া দ্বারা সিক্ত করবেন। নিশ্চয় ই তিনি পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তবে কী করে বুঝব যে, আল্লাহ আমাদের তওবা কবুল করেছেন? হ্যাঁ, তা বোঝার কিছু আলামত রয়েছে। যেমন:

✪ অন্তরে পাপাচার ও খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হওয়া যার ফলে তওবাকারী আর কখনো উক্ত পাপের দিকে পা বাড়াবে না,
✪ ইবাদত-বন্দেগিতে তৃপ্তি অনুভূত হওয়া,
✪ অন্তরে ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করা,
✪ অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি গভীর ভালবাসা তৈরি হওয়া,
✪ সৎকর্মে আরও বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করা,
✪ কুরআন-হাদিস পড়লে, কুরআন-হাদিসের আলোচনা শুনলে অথবা সৎ লোকদের সংশ্রবে গেলে মন-মুকুরে গভীর ভালো লাগা কাজ করা।
মোটকথা, আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবা কবুল করে নিলে তার চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় ইতিবাচক ও কল্যাণকর পরিবর্তন ঘটিয়ে দেন। ফলে সে আরও বেশি আল্লাহ মুখী হয় এবং পাপাচার থেকে দূরে থাকে।

এমন মানসিক অবস্থায় আমাদের উচিৎ, আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি আরও অধিক পরিমাণে আরও বেশি সৎকর্ম করা এবং জেনে-বুঝে আর কখনো অন্যায়ের দিকে পা না বাড়ানো।

❖ শাইখ বিন বায রাহ. বলেন,
من دلائل أن الله قبل توبتك استقامتك على الحق، وحذرك من العودة إلى السيئات والمعاصي التي تبت منها، فعليك بحسن الظن بالله، والحذر من العودة إلى المعاصي
“তওবা কবুলের অন্যতম প্রমাণ হল, হকের উপরে আপনার দৃঢ়তা এবং যে সব গুনাহ ও নাফরমানি থেকে তওবা করেছেন সেগুলোতে পুনরায় ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন। অতএব, আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখুন এবং গুনাহের দিকে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হোন।” আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

সালাতুল ইস্তিখারা সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: সালাতুল ইস্তিখারা কী? যেকোনো কাজে কল্যাণ লাভ করার জন্য ‘ইস্তিখারা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। আজ আমরা ইস্তিখারা সম্পর্কে আলোচনা করবো। যদিও লিখাটি একটু বড় তবে পড়লে উপকৃত হবেন ইন শাহ্ আল্লাহ।

▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
❑ ইস্তিখারা কী: আরবি ‘ইস্তিখারা’استخارة শব্দের অর্থ হলো কল্যাণ কামনা করা, ভালো কিছু চাওয়া। ইমাম ইবনে হাজার রহঃ বলেন,ইস্তিখারা শব্দটি বিশেষ্য। আল্লাহ্‌র কাছে ইস্তিখারা করা মানে কোন একটি বিষয় বাছাই করার ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র সাহায্য চাওয়া। উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তিকে দুটো বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় বাছাই করে নিতে হবে, সে যেন ভালটিকে বাছাই করে নিতে পারে সে প্রার্থনা।

শরীয়তের পরিভাষায় ইস্তিখারা হলো,যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করলে, কাজটি করার পূর্বে আল্লাহর সাথে পরামর্শ পথনির্দেশনা চেয়ে সেই কাজটির মধ্যে কল্যাণ প্রার্থনা করা এবং কাজটিতে কোনো অকল্যাণ থাকলে আল্লাহ্ যেন তা দূর করে দেন এবং সঠিক পথনির্দেশ দেখিয়ে দেন, সেটি কামনা করা। অর্থাৎ যেকোন বৈধ বিষয় বা কাজে (যেমন ব্যবসা, সফর, বিবাহের ব্যাপারে) ভালো মন্দ বুঝতে না পারলে, মনে ঠিক-বেঠিক, উচিৎ-অনুচিত বা লাভ-নোকসানের দ্বন্দ্ব হলে আল্লাহর নিকট মঙ্গল প্রার্থনা করতে দুই রাকআত নফল সালাত পড়ে ইস্তিখারার দু’আ পাঠ করা সুন্নত। আরো সহজ করে বলতে গেলে ইস্তিখারা করা হয় দুটো বৈধ কাজের মধ্যে কোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে। ধরুন, একই সাথে দুটো চাকরির অফার এসেছে। দুটো চাকরিই হালাল। বুঝতে পারছেন না, কোনটিতে জয়েন করবেন কিংবা কোনটি আপনার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে। তখন আপনি ইস্তিখারা করবেন। আশা করা যায়, আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন।
.
❑ ইস্তিখারা কখন করতে হয়? ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে দুই ক্ষেত্রে ইস্তিখারা করা যায়। যেমন:
.
➤১। যখন কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে চায়, তখন ইস্তিখারা করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা। যেমন: কোনো কষ্টকর ঝুঁকিপূর্ণ সফরে বের হওয়ার আগে ইস্তিখারা করা। ইস্তিখারার পর যদি মন সায় দেয়, তবে বের হবে, অন্যথা অন্য চিন্তা করবে বা অন্যদিন বের হবে। এভাবে যেকোনো কাজ শুরু করার আগে ইস্তিখারা করা উত্তম।
.
➤২। যখন দুটো বৈধ কাজের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হয়, তখন ইস্তিখারার মাধ্যমে তুলনামূলক ভালো (better) কাজটি নির্বাচন করার জন্য আল্লাহর তাওফিক চাওয়া। বিশেষত, যে কাজটিতে অধিক কল্যাণ রয়েছে, সেটি কামনা করা। যেমন: একই সাথে দুটো চাকরি হলো বা দুটো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ এলো কিংবা বিয়ের দুটো প্রস্তাব এলো। এমতাবস্থায় একটিকে বেছে নিতে হবে, কিন্তু আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তখন ইস্তিখারা করবেন। এরপর মন যেটির দিকে সায় দেবে, সেটি বেছে নেবেন।
.
❑ ইস্তিখারার গুরুত্ব ও উপকারিতা:
.
জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ্ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রতিটি বিষয়ে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) ইস্তিখারা করতে শেখাতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের সুরা শেখাতেন।’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ১১৬২]। ইস্তিখারা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। ইস্তিখারা করে কোনো কাজ করলে, সেই কাজে গতি পাওয়া যায় এবং এতে আল্লাহর সাহায্য থাকে। ইস্তিখারা করার মাধ্যমে হীনম্মন্যতা দূর হয় এবং মানসিকভাবে সুদৃঢ় থাকা যায়।
.
ইস্তিখারা করার পর আর পেছনে না তাকিয়ে কাজে নেমে পড়তে হয়। কারণ ইস্তিখারার পর যে সিদ্ধান্তটিতে মন সায় দেবে, সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, ধরে নিতে হয়। এ ব্যাপারে উমার (রা.) বলেন, ‘কোনো কোনো মানুষ ইস্তিখারার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য (সিদ্ধান্ত) বাছাই করে দেন। কিন্তু (বাহ্যিক দৃষ্টিতে বান্দার কাছে তা কল্যাণকর মনে না হওয়ায়) সে আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এরপর যখন বিষয়টির সুন্দর পরিণাম দেখতে পায়, তখন বুঝতে পারে, সেই ফায়সালা তার জন্য কতো কল্যাণকর ছিলো।’ [ইমাম ইবনুল মুবারক, কিতাবুয যুহদ: ১২৮]।
.
❑ইস্তেখারা করা কতটুকু সঠিক?
.
এই ব্যাপারে ইতিহাস বিখ্যাত ইমাম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন: “সে ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না যে স্রষ্টার নিকট ইস্তেখারা করে এবং মানুষের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল থাকে।” আল্লাহ তাআলা বলেন:“আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরামর্শ কর। অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদের পছন্দ করেন।“ [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]।

কাতাদা (রহঃ) বলেন: “মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তাওফীক দেন।” ইমাম নববী রহ. বলেন: “আল্লাহ তায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভাল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরিমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দুর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়। (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং ১১৯৮১)।
.
❑ ইস্তিখারার সংক্ষিপ্ত রূপ: ইস্তিখারার বিশুদ্ধ পদ্ধতি হল:
.
প্রথমে অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অযু করা, তারপর ইস্তেখারার উদ্দেশ্যে দুই রাকআত সাধারণ নফল সালাতের ন্যায় সালাত আদায় করা। বিশেষ কোনো নিয়ম নেই।এক্ষেত্রে সূরা ফাতেহার পর যেকোন সূরা পড়া যায় তারপর সালাত শেষে সালাম ফিরিয়ে আল্লাহ তায়ালা বড়ত্ব ও মর্যাদার কথা মনে জাগ্রত করে একান্ত বিনয় ও আন্তরিকতা সহকারে অর্থের দিকে খেয়াল রেখে নিচের দুয়াটি পাঠ করা। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা করবে, প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এরপর বলবে:
.
اَللّٰهُمّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ
আল্লাহুম্মা ইন্নী আসতাখীরুকা বি‘ইলমিকা
[হে আল্লাহ! আমি আপনার ইলমের উসিলায় আপনার কাছে (আমার উদ্দিষ্ট বিষয়ের) কল্যাণ চাই]
.
وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ
ওয়া আসতাক্বদিরুকা বিক্বুদরাতিকা
[আপনার কুদরতের উসিলায় আপনার কাছে (কল্যাণ অর্জনের) শক্তি চাই]
.
وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ
ওয়া আসআলুকা মিন ফাদ্বলিকাল ‘আযীম
[আর আপনার কাছে আপনার মহান অনুগ্রহের কিছুটা আমি চাই]
.
فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ
ফাইন্নাকা তাক্বদিরু, ওয়া লা আক্বদির
[কেননা, (সকল বিষয়ে) আপনার ক্ষমতা রয়েছে; আমার কোনো ক্ষমতা নেই]
.
وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ
ওয়া তা‘অ্লামু, ওয়া লা আ‘অলাম
[আপনি (সবকিছু) জানেন, আমি কিছুই জানি না]
.
وَأَنْتَ عَلَّامُ الغُيُوْبِ
ওয়া আনতা ‘আল্লামুল গুয়ূব
[আপনি অদৃশ্যের সকল বিষয়ে সর্বজান্তা]
.
اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ
আল্লাহুম্মা ইন কুনতা তা‘অ্লামু
[হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন]
.
أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ
আন্না ★হাযাল আমরা★ খাইরাল লী
[★এই কাজটি★ আমার জন্য কল্যাণকর]
.
فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ
ফী দী-নী, ওয়া মা‘আ-শী, ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী [আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে]
.
فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ
ফাক্বদুরহু লী, ওয়া ইয়াসসিরহু লী
[তাহলে আমার জন্য তা নির্ধারণ করে দিন এবং বিষয়টিকে আমার জন্য সহজ করে দিন]
.
ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ
সুম্মা বা-রিক লী ফীহি
[অতঃপর এতে আমার জন্য বরকত দান করুন]
.
وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ
ওয়া ইন কুনতা তা‘অ্লামু
[আর, যদি আপনি জানেন]
.
أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِيْ
আন্না ★হাযাল আমরা★ শাররুল লী
[★এই কাজটি★ আমার জন্য অকল্যাণকর]
.
فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ
ফী দী-নী, ওয়া মা‘আ-শী, ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী [আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে]
.
فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ
ফাসরিফহু ‘আন্নী, ওয়াসরিফনী ‘আনহু
[আপনি তা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন]
.
وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ
ওয়াক্বদুর লিয়াল খাইরা ‘হাইসু কা-না
[আর আমার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন; তা যেখানেই হোক]
.
ثُمَّ أَرْضِنِيْ بِه
সুম্মা আরদ্বিনী বিহি
[অতঃপর তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট রাখুন]
.
জাবির (রা) বলেন, দু‘আটির যে দুই জায়গায় هَذَا الأَمْرَ হাযাল আমর (যার অর্থ) ‘‘এই কাজটি’’ বলা আছে, সেখানে নিজ প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে। (কিংবা অন্তত মনে মনে সেটি কল্পনা করবে) [সহীহ বুখারি ১১৬৬; তিরমিযি ৪৮০; আবুদাঊদ হা/১৫৩৮; মিশকাত হা/১৩২৩ ‘ঐচ্ছিক সালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৯; মির‘আত ৪/৩৬২)। উক্ত দু‘আ শেষ করার পর মন যেদিকে সায় দেবে এবং যেভাবে কাজটি করা কল্যাণকর মনে হবে, সেটিকে সঠিক ভেবে কাজ শুরু করবেন। ধরুন, আপনার কোথাও যাওয়া দরকার আবার বাসার মধ্যেও থাকা দরকার। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তখন ইস্তিখারা করবেন। ইস্তিখারার পর যদি মনে হয়, বাসায় থাকাটাই আপনার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে, তাহলে আপনি সেটিই করবেন এবং ভেবে নিবেন, এই সিদ্ধান্তটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে আর এতেই আপনার কল্যাণ রয়েছে।
.
ইস্তিখারা করার সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের জন্য ইস্তিখারা করলে এক বেলা বা কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিনও অপেক্ষা করতে পারেন। তবুও সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হলে প্রয়োজনে একাধিকবার ইস্তিখারা করতে পারেন। এটিও জায়েয। এরপর মন যেদিকে ঝুঁকবে, সেদিকেই কল্যাণ আছে ভেবে নেবেন। এর সাথে সাথে নিজের বিবেক-বুদ্ধির সাহায্য নেবেন এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সাথেও পরামর্শ করবেন।

❑প্রিয় পাঠক,যেকোনো বৈধ কাজে (হোক সেটি দ্বীনি অথবা দুনিয়াবি) সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং কাজটিতে সফলতা ও কল্যাণ লাভ করতে তিনটি কাজ করুন।
_______________________________________
➤ (১) প্রথমে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করে সেই কাজ ও সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, উপকারী-অনুপকারী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবুন।নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমার জন্য যা কল্যাণকর, তা অর্জনের জন্য তুমি প্রলুব্ধ হও আর আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও। কখনই হতাশ হবে না।’’ [সহিহ মুসলিম: ২৬৬৪]।
.
➤(২) এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দু‘আর মাধ্যমে ইস্তিখারা করুন ও আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করুন। [সহিহ বুখারি: ১১৬৪, তিরমিযি: ৪৮০]।
.
➤(৩) একই সাথে আপনার আপনজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করুন। আল্লাহ্ বলেন, ‘‘তুমি তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]।

❑পরামর্শ আগে না ইস্তেখারার নামায আগে?* এ ব্যাপারে আহালুল আলেমগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে সবচেয়ে সঠিক হল, বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এর মত যা তিনি রিয়াদুস সালিহীনের ব্যাখ্যা গ্রন্থে প্রাধান্য দিয়েছেন।তিনি বলেন, আগে ইস্তেখারার সালাত আদায় করতে হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالأمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ তোমাদের কেউ কোন কাজের মনস্থ করলে সে যেন, (সালাতুল ইস্তিখারার) দুরাকাআত সালাত আদায় করে।” এখানে প্রিয় নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করার কথা বলেছেন। (সহীহ বুখারী:১১৬৬; রিয়াদুস সালেহীন: ৭২২; হাদীসের ব্যাখ্যা দষ্টব্য)।

❑ইস্তিখারা সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে রাখা ভাল। যেমন:
_______________________________________
➤(১) মহানবী (ﷺ) এই দুআ সাহাবীগণকে শিখাতেন, যেমন কুরআনের সূরা শিখাতেন। আর এখান থেকেই ছোট-বড় সকল কাজেই ইস্তিখারার গুরুত্ব প্রকাশ পায়।তাই ছোট-বড় সকল বিষয়ে ইস্তিখারা করার অভ্যাস গড়ে তোলা ভাল।

➤(২) একটি বিষয়ের জন্য একবার ব্যতীত একাধিকবার ‘সালাতুল ইস্তেখা-রাহ’ আদায়ের কথা রাসূল (ﷺ) থেকে স্পষ্টভাবে কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো দো‘আ করলে একই সময়ে তিনবার করে দো‘আ করতেন এবং কিছু চাইলে তিনবার করে চাইতেন। (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭, ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, অনুচ্ছেদ-৪)। এই সহীহ হাদীসের উপরে ভিত্তি করে ইস্তেখারাহর দো‘আ পাঠের উদ্দেশ্যে অত্র সালাত ইস্তিসক্বার সালাতের ন্যায় একাধিকবার পড়া যায় বলে ইমাম শাওকানী মন্তব্য করেছেন। ইমাম নববী বলেন, উক্ত দো‘আ পাঠের সময় হৃদয়কে যাবতীয় ঝোঁক প্রবণতা হতে খালি করে নিতে হবে এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করতে হবে। নইলে ঐ ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে কল্যাণপ্রার্থী না হয়ে বরং নিজের প্রবৃত্তির পূজারী হিসাবে গণ্য হবে।(নায়লুল আওত্বার ৩/৩৫৬, ‘ইস্তেখা-রাহর সালাত’ অনুচ্ছেদ)। তবে একটি বিষয়ে একাধিকবার ইস্তিখারার বিষয়ে সাহাবিগণের আমল পাওয়া যায়। যেমন: আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা.) কা’বা ঘর পুনর্নির্মাণ করার আগে তিন দিন ইস্তিখারা করেন। এরপর সেই কাজ করেন। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৩১৩৬]। অতএব, কোনো বিষয়ে একাধিকবার ইস্তিখারা করা জায়েয। তবে, একবার করা উত্তম। সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে একাধিকবার করা যায়।
.
➤(৩) খুব তাড়াহুড়া বা একান্ত জরুরী প্রয়োজন না হলে যে সকল সময়ে সাধারণ নফল নামায পড়া নিষিদ্ধ সে সকল সময়ে সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করা থেকে বিরত থাকুন। তবে তাড়াহুড়া থাকলে নিষিদ্ধ সময়গুলোতেও তা পড়া যাবে।

➤ (৪) মহিলাদের ঋতু স্রাব বা সন্তান প্রসব জনিত রক্ত প্রবাহের সময় অন্যান্য সালাতের ন্যায় সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে এমতাবস্থায় নামায না পড়ে শুধু ইস্তিখারার দুয়াটি পড়া যাবে।

➤(৫) ইস্তিখারা করতে হবে হাদিসে বর্ণিত উপায়ে। কোনো অনির্ভরযোগ্য বইয়ের নিয়মে এটি করা যাবে না। ইস্তিখারা নামাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সুরা নেই। যেকোনো সুরাই পড়া যাবে। ইস্তিখারার দুয়া মুখস্ত না থাকলে দেখে দেখে তা পড়তে অসুবিধা নেই। তবে মুখস্ত করার চেষ্টা করা ভাল।ইস্তিখারার দুয়াতে যেন অতিরিক্ত কোন শব্দ যোগ না হয় বা সেখান থেকে কোন শব্দ বাদ না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখুন। বরং হাদীসে বর্ণিত শব্দাবলী যথাযথভাবে পড়ার চেষ্টা করুন।

➤(৬) ইস্তিখারার পর মন যেদিকে ঝুঁকবে সেই দিকটি ইসলামী শরিয়ত ও সুস্থ বিবেকের বিচারেও উত্তম হওয়া জরুরি। কোনো হারাম বা নাজায়েয কাজে ইস্তিখারা নেই। কেবল বৈধ কাজের ব্যাপারেই ইস্তিখারা করা যায়।
.
➤(৭) একথাও মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী ভালো-মন্দ উভয়ের সমষ্টি। তাই ইস্তিখারার পর যে দিকটি অবলম্বন করা হবে, তাতে ইনশাআল্লাহ কল্যাণের অংশই বেশি হবে। তবে, অকল্যাণের কিছু অংশ তাতে থাকা বিচিত্র নয়। অর্থাৎ অধিক কল্যাণের বিবেচনাই এখানে মূখ্য বিষয়।

➤(৮) ইস্তিখারার পর যে পথ ও পন্থা অবলম্বন করা হবে, ইনশাআল্লাহ তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হবে। অর্থাৎ ইসতিখারার পর বান্দার জন্য কল্যাণের পথই উন্মুক্ত হবে। অকল্যাণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর এই কল্যাণ ধরে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নিজের খারাপ আমল, উদাসীনতা কিংবা অন্য কোনো কারণে সেই কল্যাণ যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: ইস্তিখারার পর কোনো গাড়ি, বাড়ি বা কোনো জমি সংগ্রহ করা হলো, কিংবা কোনো মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হলো বা ছেলেকে বিয়ে করানো হলো; এখন এসবের হক আদায় করে সেই কল্যাণ বজায় রাখতে হবে। নিজের কোনো খারাপ আমলের কারণে যদি কোনো ধরনের অকল্যাণ প্রকাশ পায়, সেটার জন্য ইস্তিখারাকে দোষারোপ করা যাবে না।
.
➤(৯) আখিরাতের কল্যাণই মুমিনের প্রকৃত কল্যাণ। সুতরাং দুনিয়ার জীবনে যদি কোনো সমস্যা, সংকট বা পেরেশানি হয়, কিন্তু আখেরাতের হিসাবে তা কল্যাণকর হয়, তাহলে এতেই মুমিনের অধিক কল্যাণ। সুতরাং ঈমানদারকে আল্লাহর যেকোনো ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের কাছে হয়তো কোনো একটি বিষয় পছন্দনীয় নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার, হয়তো কোনো একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ তোমাদের জন্য তা অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” [সুরা বাকারাহ, আয়াত: ২১]।
.
➤(১০) স্বপ্ন শরিয়তের দলিল নয়। তাই, ইস্তিখারার রেজাল্ট জানার জন্য স্বপ্নের মাধ্যমে ইঙ্গিত পাওয়ার ধারনা সঠিক নয়। সুতরাং ইস্তিখারা দিনে বা রাতের যেকোনো সময় বা রাতের যেকোনো সময়েই করতে পারেন।ছাহেবে মির‘আত বলেন, ইস্তেখারাহর পরে যেটা প্রকাশিত হয় বা ঘটে যায়, সেটাই করা উচিৎ। এজন্য তাকে ঘুমিয়ে যাওয়া এবং স্বপ্ন দেখা বা কাশ্ফ হওয়া অর্থাৎ হৃদয় খুলে যাওয়া শর্ত নয়।(মির‘আত ৪/৩৬৫।)
.
➤(১১) নিজে না করে অন্যকে দিয়ে ইস্তিখারা করানো একটি ভুল পদ্ধতি। তবে, সন্তানাদির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে বাবা-মা ইস্তিখারা করতে পারবেন।
.
➤(১২) অদৃশ্যের বিষয় জানার জন্য ইস্তিখারা করা শির্ক। তাছাড়া, এটি হাস্যকর ব্যাপার। এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইস্তিখারা মানে কল্যাণ কামনা করা; কোনো অদৃশ্য বিষয় জানা নয়।
.
➤(১৩) ইস্তিখারা করার পর আর হীনম্মন্যতায় ভোগা উচিত নয়। বরং দৃঢ় মনোবল রাখা উচিত। আল্লাহ বলেন, “আর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ফেল, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করো।” [সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]। তবে, ইস্তিখারা করার পর দেখা গেলো, যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন, সেটিতে সরাসরি সমস্যা হচ্ছে। তখন কোনো আলিমের সাথে বিষয়টি শেয়ার করতে পারেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
.
❑পরিশেষে,ইস্তিখারা সম্পর্কে উমর (রা.)-এর একটি মূল্যবান মন্তব্যের মাধ্যমে শেষ করছি। উমর (রা.) বলেন, অনেক সময় মানুষ ইস্তিখারার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তার জন্য সেই বিষয়টিই নির্বাচন করেন, যাতে তার কল্যাণ নিহিত। কিন্তু (বাহ্যিক দৃষ্টিতে বান্দার কাছে তা কল্যাণকর মনে না হওয়ায়) সে আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এরপর যখন বিষয়টির সুন্দর পরিণাম দেখতে পায়, তখন সে বুঝতে পারে, সেই ফায়সালা কত কল্যাণময় ছিল।’ [ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, পৃষ্ঠা ৩৩, রিওয়ায়াত: ১২৮]।
.
উমর (রা.) এর কথাটি যেন কুরআনের একটি আয়াতেরই ব্যাখ্যা। আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের কাছে হয়তো কোনো একটি বিষয় পছন্দনীয় নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার, হয়তো কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ তোমাদের জন্য তা অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” [সূরা বাকারাহ, আয়াত: ২১]।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার বিধান

 প্রশ্ন: দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার বিধান কি? বিস্তারিত জানতে চাই।

▬▬▬▬▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। এর প্রতিটি বিধিবিধান নবী রাসূল (ﷺ) আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এমনকি প্রস্রাব-পায়খানার নিয়মও শিক্ষা দিয়েছেন।(সহীহ মুসলিম, হা/২৬২; মিশকাত,হা/৩৩৬)।প্রস্রাব সম্পর্কে হাদীসের কিতাবে ৫ টি হাদীস পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩টি সহীহ। এর একটিতে আম্মাজান আয়িশা (রা.) রাসূল (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে অস্বীকার করেছেন। ২য়টিতে রাসূল (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আর ৩য়টিতে বসে প্রস্রাব করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আর ২টি হাদীস যঈফ। তার একটিতে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। অপরটিতে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে অহমিকার সাথে বিশেষিত করা হয়েছে। যেমন:

(১) আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তোমাদের বলে যে, রাসূল (ﷺ) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন, তোমরা তার কথা বিশ্বাস করবে না। (কেননা) তিনি বসেই প্রস্রাব করতেন।’ (নাসাঈ হা/২৯; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭সিলসিলা সহীহাহ হা/২০১)।

(২) হুযায়ফাহ (রাঃ) বলেন, আমি (কোন এক সফরে) রাসূল (ﷺ)এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি কোন এক সম্প্রদায়ের ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গায় এসে পৌছলেন। অতঃপর সেখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেন, ‘আমি তখন দূরে সরে গেলাম। তিনি বললেন, কাছে এসো। আমি তার নিকটে গেলাম এমনকি একেবারে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি ওযু করলেন। অতঃপর তাঁর উভয় মোযার উপর মাসাহ করলেন। (সহীহ মুসলিম হা/৫১২ ‘ইঃ ফাঃ৫১৫ মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ)।

(৩) আব্দুর রহমান ইবনে হাসানাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (ﷺ) একদা আমাদের কাছে আগমন করলেন। তাঁর হাতে চামড়ার তৈরি ঢালের মত একটি বস্ত্ত ছিল। তিনি তা স্থাপন করলেন। এরপর তার পেছনে বসলেন এবং সেদিকে ফিরে প্রস্রাব করলেন।(সহীহ : ইবনু মাজাহ্ ৩৪৬, আবূ দাঊদ, সহীহুত্ তারগীব ১৬২।মিশকাতুল মাসাবিহ, ৩৭১ সনদ সহীহ)।

(৪) উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে দেখে বললেন,‘উমার! (আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের ন্যায়) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করো না। অতঃপর আমি আর কক্ষনো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করিনি। (য‘ঈফ : ইবনু মাজাহ্ ৩০৮, য‘ঈফাহ্ ৯৩৪, তিরমিযী ১২)।কারণ এর সানাদে ‘আবদুল কারীম ইবনু আবুল মাখরিক্ব নামে একজন দুর্বল রাবী রয়েছে।(মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৩৬৩ হাদিসের মান: দুর্বল হাদিস)।

(৫) বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন: তিনটি কাজ অহমিকার অন্তর্ভর্ুক্ত। দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, সালাত সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কপাল মুছা ও সাজদার সময় ফুঁক দেয়া। (সনদ মুনকার; ইমাম বুখারী তারীখে,৪৯৬ উল্লেখ করেছেন, বায্যার (১/৫৪৭)।
.
উপরোক্ত হাদীসগুলোর কারণে বিদ্বানগণ দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার হুকুমের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনটি অভিমত পাওয়া যায়। (আল-মাজমূ (২/৯৮), ওয়াসত (১/৩৩৩)।

▪️১ম অভিমত: কোন ওযর ছাড়া দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা মাকরূহ। এটা আয়িশা, ইবনে মাসউদ ও উমার এর দু’টি অভিমতের মধ্যে একটি অভিমত। আবু মূসা, শা’বী, ইবনে উয়াইনা, হানাফী ও শাফেঈগণ এ অভিমত পোষণ করেছেন।

▪️২য় অভিমত: এটা সাধারণভাবে জায়েয। উমার (রাঃ) অন্য এক বর্ণনা মতে এ অভিমত পোষণ করেছেন। আলী, যায়েদ বিন সাবিত, ইবনে উমার, সাহল ইবনে সাদ, আনাস, আবু হুরাইরা ও হুযাইফা (রাঃ) এ মতামত ব্যক্ত করেছেন। হাম্বলীগণ এ মতের অনুসারী।

▪️৩য় অভিমত: যদি এমন নরম জায়গায় প্রস্রাব করা হয় যেখান থেকে প্রস্রাব শরীরে ছিটকে আসা সম্ভব নয় তাহলে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা যাবে। নচেৎ যাবে না। এটা ইমাম মালিকের অভিমত। ইবনে মুনযির এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

উপরোক্ত তিনটি মতের মধ্যে বিশুদ্ধ মতামত হলো, যদি প্রস্রাব শরীরে ছিটা গায়ে এসে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা জায়েজ, মাকরূহ নয়। এর কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ:

▪️(১) এর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) থেকে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না।
▪️(২) মহানাবী (ﷺ) এর বসে প্রস্রাব করাটা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা জায়েয হওয়াকে বাধা দেয় না। বরং উভয়টিই বৈধ হওয়াকেই সমর্থন করে।
▪️(৩) মহানাবী (ﷺ) থেকে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার হাদীস সাব্যস্ত হয়েছে।
▪️(৪) মূলতঃ আয়িশা এর পক্ষ থেকে মহানবী (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ব্যাপারে যে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে তা ছিল তাঁর বাড়িতে থাকা অবস্থায়। তাই তিনি শুধু দাঁড়িয়ে প্রস্রাব না করার ব্যাপারেই জানতেন। সুতরাং তা বাইরে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ঘটনাকে না বোধক করে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকাটা কোন জ্ঞানকে না বোধক করে না। এ বিষয়ে হুযাইফাসহ অন্যরা জানতেন। সুতরাং, এটা যারা জানতেন না তাদের উপর প্রমাণ। আর হাঁ বোধক বিষয় না- বোধকের উপর প্রধান্য পায়। আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন! (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ প্রথম খন্ড ইসতিনজা অধ্যায়)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে কোন ব্যক্তির জন্য কি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা জায়েয আছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দাড়িয়ে প্রস্রাব করাতে কোন দোষ নেই।বিশেষ করে যখন প্রয়োজন হয়,যদি জায়গাটি এমনভাবে ঢেকে রাখা হয় যে কেউ আসলে তার গোপনাঙ্গ দেখতে না পারে এবং প্রস্রাবের ছিটা থেকে বাঁচতে হবে। অর্থাৎ প্রস্রাবের ছিটা যেন কাপড় বা শরীরে এসে না পড়ে। হুযাইফা (রাঃ) থেকে প্রমাণিত যে, রাসূল (ﷺ) একদল লোকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতেন, তার সত্যতার উপর একমত, তবে বসে প্রস্রাব করা উত্তম কেননা এটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রধান কাজ, এবং এটি গোপনাঙ্গকে আড়াল করে এবং প্রস্রাবের ছিটা দ্বারা আঘাত করা থেকে দূরে থাকে। (সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/৩৬৪ শাইখ ইবনে বাযের মোট ফতোয়া ও প্রবন্ধ (৬/৪৪৫)। অনুরূপ বক্তব্য অপর শাইখ ইবনে উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) ও বলেছেন।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, বসে প্রস্রাব করাই শরী‘আতের বিধান। তবে একান্ত অসুবিধায় দাঁড়িয়ে পেশাব করা জায়েজ। এক্ষেত্রে শর্ত হল, পেশাবের ছিটা যেন দেহে না লাগে। (সহীহ বুখারী,মিশকাত হা/৩৩৮) এবং নির্লজ্জতা প্রকাশ না পায়। (সহীহ বুখারী মিশকাত হা/৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত

 প্রশ্ন: আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত আদায় করে। আজ আমরা আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত নফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: نَفْلٌ আরবী শব্দ, একবচন। বহুবচনে نَوَافِلٌ অর্থ: অতিরিক্ত, বাড়তি, ঐচ্ছিক ইত্যাদি। সুন্নাত, নফল, মানদূব ও মুস্তাহাব এসবই সমার্থক। সবগুলো শব্দই কাছাকাছি একই অর্থ বহন করে। নফল সালাত আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একটি বড় মাধ্যম। এর মাধ্যমে হাশরের মাঠের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমি পূর্বের পর্বেও বলেছি ফরয ব্যতীত সকল সালাতই নফল বা অতিরিক্ত। যে সকল সালাত পড়া বাধ্যতামূলক নয়, যা ত্যাগ করলে গুনাহ হয় না, কিন্তু পড়লে অসংখ্য সওয়াব হয় সেই সকল সালাতকে শরীয়তের পরিভাষায় নফল বা অতিরিক্ত সালাত বলা হয়। নফল সালাত মূলত দুই প্রকার। যেমন: (ক) সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ বা সুন্নাতে রাতেবাহ (খ) গায়ের মুওয়াক্কাদাহ। আর সুন্নতে গায়ের মুওয়াক্কাদাহ বা যায়েদাহ সালাত সমূহের মধ্যে আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত নফল সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। কেউ যদি তা আদায় করে তাহলে বিরাট ফজিলতের অধিকারী হবেন। আর এমনিতেও নফল সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। যেমন: আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি,কিয়ামতের দিন সব জিনিসের পূর্বে বান্দার যে আমলের হিসাব হবে, তা হলো সালাত। যদি তার সালাত সঠিক হয়, তাহলে সে সফলকাম হবে ও নাজাত পাবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি ফরয সালাতে কিছু ভুল হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে বলবেন, দেখো আমার বান্দার নিকট নফল সালাত আছে কি-না? তাহলে সেখান থেকে এনে বান্দার ফরয সালাতের ত্রুটি পূরণ করে দেওয়া হবে। এরপর এ বান্দার অন্যান্য হিসাব নেওয়া হবে।’ (আবু দাঊদ, হা/৮৬৪; তিরমিযী, হা/৪১৩; নাসাঈ, হা/৪৬৬; মিশকাত, হা/১৩৩০)।
.
আসরের ফরজ সালাতের পূর্ব ৪ রাকাআত নফল সালাত সম্পর্কে আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘আসরের সলাতের (ফার্‌যের) পূর্বে চার রাক্‘আত সলাত আদায় করতেন। এ চার রাক্‘আতের মধ্যখানে সালাম ফিরানোর দ্বারা নিকটবর্তী মালাক (ফেরেশ্‌তা) এবং তাদের অনুসারী মুসলিম ও মু’মিনীনদের মাঝে পার্থক্য করতেন। (সুনানে তিরমিযী ৪২৯ মিশকাতুল মাসাবিহ,হা/ ১১৭১ সনদ হাসান)।
.
অপর বর্ননায় ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত আদায় করে।”(আবু দাঊদ ১২৭১, আত্ তিরমিযী ৪৩০, আহমাদ ৫৯৮০, ইবনু খুযায়মাহ্ ১১৯৩, ইবনু হিব্বান ২৪৫৩, সুনান আল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪১৬৭সহীহ আল জামি‘ ৩৪৯৩,মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ১১৭০,আল্লামা আলবানী (রহঃ) হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন, সহীহুত তরাগীব ওয়াত তরাহীব, হা/৫৮৮)।
.
ইমাম নাবাবী (রাহিমাহুল্লাহ) মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, আমাদের সাথীদের মাঝে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, আসরের পূর্বে এ চার রাক‘আত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। যারা এ চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন তাদের মাঝে ‘আলী (রাঃ) অন্যতম। ইবরাহীম নাখ্‘ঈ বলেন, সাহাবীগণ এ চার রাক্‘আত সালাত আদায় করতেন। তবে তা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ মনে করতেন না। যারা ‘আসরের পূর্বে সালাত আদায় করতেন না তাদের মধ্যে সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, হাসান বসরী, সা‘ঈদ ইবনু মানসূর ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম ও আবুল আহ্ওয়াস অন্যতম। (মিশকাতুল মাসাবিহ ১১৭০ হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী,শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে আসরের পূর্ব চার রাকাআত সালাত আদায় করার হুকুম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শাইখ বলেন, আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। এটি মুস্তাহাব হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, কারণ এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা ঐ লোকের ওপর রহ্‌মাত বর্ষণ করেন, যে লোক ‘আস্‌রের (ফার্‌য সলাতের) পূর্বে চার রাক্‘আত সলাত আদায় করে। (ফাতাওয়া নূর ‘আলা আল-দারব (১০/৩১৭)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন, আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার অথবা দু’রাক‘আত সালাত সাধারণ সুন্নাত হিসাবে আদায় করা যায়; সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ হিসাবে নয়। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৬/১২৮)।

◾ উক্ত চার রাকাআত নফল সালাত কয় সালামে পড়া উত্তম?
_______________________________________
চার রাক‘আত বিশিষ্ট নফল সালাত এক সালামে বা দুই সালামে উভয়ভাবেই পড়া যাবে। (সূনানে নাসাঈ হা/৮৭৫; ইবনু মাজাহ হা/১৩২২)। তবে উত্তম হল দুই রাকাত করে পড়া এই ব্যাপারে তিরমিযী’র ভাষ্যকার আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যোহরের পূর্বের চার রাক‘আত সুন্নাত সালাতকে সালাম দ্বারা বিভক্ত করে পড়া অথবা এক সালামে পড়া কোন পক্ষেই কোন মারফূ সহীহ হাদীস সম্পর্কে আমি অবগত হতে পারিনি। ফলে কেউ এক সালামে পড়তে চাইলে পড়তে পারবে অথবা দুই সালামে পড়তে চাইলেও পড়তে পারবে।’ [আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৪১১ পৃ.]

ইমাম শাফিঈ এবং ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর মতে, রাত এবং দিনের (ফরয নামায ছাড়া অন্যান্য সব) নামায দুই রাকাআত করে আদায় হবে। তারা উভয়ে আসরের পূর্বের চার রাকাআতে দুই রাকাআত পর পর সালাম ফিরানোই পছন্দ করেছেন। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: صلاة الليل والنهار مثنى مثنى “রাত ও দিনের নফল (ফরজ ছাড়া অন্যান্য নামায) দু রাকাআত রাকাআত করে। (সহীহ বুখারী ৪৭২-৭৩, ৯৯১, ৯৯৩, ৯৯৫, ৯৯৮, ১১৩৭; মুসলিম ৭৩১-৪, ৭৪১-৩, ৭৫০, ৭৫১-৩, ৭৫১-২, ৭৫৩; তিরমিযী ৪৩৭, ৪৬১, ৪৬৭, ৪৬৯, ৫৯৭; নাসায়ী ১৬৬৬-৭৪, ১৬৮২, ১৬৮৯-৯৫; আবূ দাঊদ ১২৯৫, ১৩২৬, ১৪২১, ১৪৩৬, ১৪৩৮)। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের সাথে সাথে নফল সালাতের প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে মূল্যায়ন করা সংক্রান্ত হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা

 প্রশ্ন: পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে মূল্যায়ন করা সংক্রান্ত হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা কি? বিস্তারিত জানতে চাই।

▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পাঁচ জিনিসের পূর্বে পাঁচ জিনিসের মূল্যায়ন সম্পর্কিত হাদিসটি মুসলিম উম্মার প্রতি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর নসিহত এবং বিশেষ অসিয়ত। যেন উম্মতের প্রতিটি সদস্য সৌভাগ্যবান, সফল ও সর্বাঙ্গীণ সুন্দর জীবন লাভ করতে পারে। আমর ইবনু মায়মুন আল আওদী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জনৈক ব্যক্তিকে নাসীহাতস্বরূপ বললেন: পাঁচ জিনিসের পূর্বে পাঁচ জিনিসকে মূল্যায়ন করো। তা হল:
.
●(১) যৌবনকে মূল্যায়ন করো বার্ধক্যের আগে।
●(২) সুস্থতাকে মূল্যায়ন করো অসুস্থতা আসার আগে।
●(৩) স্বচ্ছলতাকে মূল্যায়ন করো দারিদ্র্যতা আসার আগে।
●(৪) অবসরকে মূল্যায়ন করো ব্যস্ততা আসার আগে।
●(৫) এবং জীবনকে মূল্যায়ন করো মৃত্যু আসার আগে।

(সহীহুল জামি ১০৭৭, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৩৫৫, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৪৩১৯, শুআবুল ঈমান ১০২৪৮, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৭৮৪৬, মিশকাত,৫১৭৪)।
.
হাদীসটির ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে মুমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) নসিহত করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:
.
❒ (১): شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ “বার্ধক্য আসার আগেই যৌবনকে গুরুত্ব দাও।”
.
উল্লেখিত হাদীসে বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকালকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মানব জীবনের তিনটি কালের মধ্যে যৌবনকাল নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে একজন মানুষের যৌবন হচ্ছে তার সমস্ত কর্ম তৎপরতার উৎস। যৌবন মানুষকে কর্মঠ, দৃঢ়চেতা ও সাহসী করে তোলে। যৌবনের এই সময়ে মানুষ কঠোর পরিশ্রম করতে পারে, দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারে, ইচ্ছা করলে সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগীও সে করতে পারে। কিন্তু বুড়ো হয়ে গেলে যেমন পরিশ্রম করতে পারে না, তেমনি ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদতও করতে পারে না। যৌবন বয়সে মানুষের শরীরে যে শক্তি-সামর্থ থাকে বুড়ো হওয়ার সাথে সাথে সেটা নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন অনেক চেষ্টা করেও কোন কাজ করতে পারে না। এজন্য রাসূল (ﷺ) বলেছেন যৌবনের এ শক্তিকে কাজে লাগাও। বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনের শক্তিকে আল্লাহর পথে ব্যয় কর। ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা কর, তাহলেই তুমি নাজাত পাবে। তাই মুমিনের উপর আবশ্যক যে, সে মহান আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর যৌবন ও শক্তির সদ্ব্যবহার করবে। সে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বাঁধা প্রদান করবে, রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ অনুসারে জীবনকে পরিচালনা করবে। আর এসব কিছু করবে বার্ধক্য আসার আগে – যখন সে ইবাদত আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়বে। প্রিয় নবী রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যৌবনকাল ইবাদতে কাটানো যুবক সেই সাত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে মহান আল্লাহ কেয়ামতের কঠিন অবস্থায় তাঁর আরশের ছায়াতলে স্থান দান করবেন আর সেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। (সহীহ বুখারী ৬৬০, মুসলিম ১০৩১, নাসায়ী ৫৩৮০, তিরমিযী ২৩৯১, আহমাদ ৯৬৬৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪৮৬, ইরওয়া ৮৮৭, মিশকাত ৭০১)।
.
এমনকি আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন এই যৌবনকালের শক্তি-সামর্থ কোন পথে ব্যয় হয়েছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) “পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত ক্বিয়ামত দিবসে আদম সন্তানের পদদ্বয় নড়বে নাঃ (১) তার বয়স সম্পর্কে কিভাবে তা ক্ষয় করেছে। (২) তার যৌবন সম্পর্কে কিভাবে তা অতিবাহিত করেছে। (৩) তার সম্পদ সম্পর্কে কিভাবে তা উপার্জন করেছে? (৪) কোন পথে তা খরচ করেছে। (৫) আর যা শিখেছে সে অনুযায়ী কি আমল করেছে?” (এ হাদীসটি ও বর্ণনা করেছেন তিরমিযী ২৪১৭, সহীহুল জামে ৭৩০০, সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব হাদিস নং ১২৮)।
.
❒(২): وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ “অসুস্থতার পূর্বেই সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও।”
.
অত্র হাদীসে প্রতিটি সুস্থ মূহুর্তকে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। সুস্থতা মানুষের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার এক অপার মহিমা বিশাল নেয়ামত। সুস্থ অবস্থায় মানুষ আল্লাহর ইবাদত করার যে সামর্থ রাখে অসুস্থ হলে তার আর সামর্থ থাকেনা। কারণ মানুষের শরীর একটা স্বয়ংক্রীয় যন্ত্র বিশেষ। তাই এ যন্ত্রের একটু ব্যতিক্রম হলেই শরীরে নানা ধরণের বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তার নাম অসুস্থতা। সুস্থতা আল্লাহর একটি বড় নিয়ামত। মানুষ সুস্থ থাকলে সবকিছু করতে পারে কিন্তু অসুস্থ হয়ে গেলে আর কোন কাজ করতে পারে না। তাই যখন সে সুস্থ থাকে তখন তাকে নেয়ামত মনে করে ইবাদতে মশগুল হওয়া প্রয়োজন। কেননা সে জানে না যে, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে পরবর্তীতে অবস্থা আরো অবনতি হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থা সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) অন্য হাদীসে বলেছেন, যে ব্যক্তি তার দিনটি পারিবারিক নিরাপত্তাবোধ ও সুস্থতার মধ্য দিয়ে শুরু করতে পারলো এবং নিজের দিনটিকে কাজে লাগাতে পারলো সে যেন সমগ্র দুনিয়া অধিকার করলো।” (সুনানে তিরমিযি ২৩৪৬, ইবনে মাজা ৪১৪১)।
.
❒(৩): وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ “দারিদ্রতার পূর্বেই স্বচ্ছলতাকে গুরুত্ব দাও।”।
.
অর্থনীতির পরিভাষায় ‘অভাব অফুরন্ত’। মানুষের অভাব একটি পুরণ হলে আর একটি এসে হাজির হয়। এজন্য সে মনে করে আর একটু স্বচ্ছল হলে অমুক ভালো কাজটি করব। কিন্তু সে জানে না বর্তমানের চেয়ে সে আরো দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। মানব দেহে যেমন যে কোন সময় অসুস্থতা আসতে পারে, ঠিক তেমনি যে কোন সময় মানব জীবনে দারিদ্রতাও এসে যেতে পারে। কারণ স্বচ্ছলতা এবং অস্বচ্ছলতা এর কোনটাই মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় তোমার রব যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযিক বাড়িয়ে দেন। যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযিক সংকীর্ণ করে দেন। তিনি অবশ্যই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত, পূর্ণ দ্রষ্টা।” (সুরা বনী ইসরাইল ৩০)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ অর্থ: আর আল্লাহ যাকে চান, বেহিসাব রিয্ক দান করেন। (সূরা আল-বাকারা ২১২)। আল-কুরআনের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকে সম্মান দান করেন, রিযিক দান করেন, আবার যাকে ইচ্ছা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। বল, ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে চান বিনা হিসাবে রিয্ক দান করেন। (সূরা আলে-ইমরান ২৬-২৭)।
.
এ কথা মনে রাখতে হবে, কখন আপনার অর্থ সম্পদ আপনার হাত থেকে চলে যাবে, কখন আপনি দরিদ্র হয়ে যাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই যে কোন সময় দারিদ্রতা এসে যেতে পারে এই চিন্তা করে অর্থ-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ আগামী কাল কি হবে এর কোন তথ্যই মানুষের কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। আর তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং মাতৃগর্ভে যা আছে তা তিনি জানেন। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন স্থানে সে মারা যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা লুকমান ৩৪)। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: ইবনে উমার (রা.) নবী করীম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, গাইব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি। যথা: ১. আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না যে মায়ের গর্ভে কি তৈরী হচ্ছে। ২. শুধু তিনিই জানেন যে, আগামী কাল কী হবে। ৩. বৃষ্টি কখন হবে তাও কেবল তারই জানা। ৪. কোন প্রাণী জানে না যে, কোথায় তার মৃত্যু হবে এবং ৫. এটাও জানে না যে, কিয়ামত কবে হবে। (সহীহ বুখারী:৪৭৭৭, মুসলিম: ৯, ১০)।
.
❒(৪) وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغُلُكَ “ব্যস্ততা আসার পূর্বেই অবসরকে গুরুত্ব দাও।”।
.
হাদীসের এ অংশে অবসরকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এবং ইসলামে অলস সময় কাটানোকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে ব্যস্ততা ও অবসর দু’টোই বান্দাহর জন্য নেয়ামত। ব্যস্ততা এজন্য নেয়ামত যে, ব্যস্ততা মানুষের অনেক অন্যায় ও বেহুদা কাজ থেকে বিরত রাখে। আর অবসর এই অর্থে নিয়ামত যে, সে এই অবসরে অনেক ভালো কাজ সম্পন্ন করে নেকী লাভ করতে পারেন। ব্যস্ততা মানব জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কার কখন ব্যস্ততা এসে যাবে এটা কেউ বলতে পারেনা। আর অত্যাধিক ব্যস্ততা মানুষকে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ থেকে অপারগ বানিয়ে ফেলে। এটাকে মনে রেখেই মানুষকে কর্ম পরিকল্পনা করতে হবে। মানব জীবনের একটি দূর্বলতা বা প্রবণতা আছে কোন কাজ তার সামনে এলে মনে করে একটু পরে কাজটি করে ফেলব। কিন্তু দেখা যায় একটু পরেই তার সামনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ উপস্থিত হয়ে গেল। সেটা শেষ করতে না করতেই আরো একটা উপস্থিত হলো। এভাবে প্রথম যে কাজটি অনায়াসে করা যেতো, সেটা করার কোন সুযোগই পাওয়া যায় না। তাই যখন সুযোগ পাওয়া যায় তখনই কাজটি সম্পন্ন করে ফেলা উচিত।অনুরূপভাবে আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারেও যদি কেউ মনে করে এখন না, একটু পরে ইবাদতটা করব, তার পরিণতিও অনুরূপ। সে ইবাদতটি করার সুযোগ আর নাও পেতে পারে। এভাবে প্রতিনিয়ত মানুষের যে সময় অতীত হয়ে যাচ্ছে সে সময় আর কখনও ভবিষ্যতে ফিরে আসবে না। তাই বর্তমানে যে সময়টা অবসর আছে এটাকে নেয়ামত মনে করে অপেক্ষাকৃত বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক লাভজনক কাজ গুলো সম্পন্ন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, বহু মানুষ সে দু’টির ব্যাপারে ধোঁকায় আছে। (তা হল) সুস্থতা ও অবসর।’ (সহীহুল বুখারী ৬৪১২, তিরমিযী ২৩০৪, ইবনু মাজাহ ৪১৭০, আহমাদ ২৩৩৬, ৩১৯৭, দারেমী ২৭০৭, রিয়াদুস সলেহিন হাদিস নং ৯৮)।
.
❒(৫) وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ “মৃত্যু আসার পূর্বেই জীবনকে গুরুত্ব দাও।”।
.
মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই মানুষের জীবন শুরু হয় এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তার জীবনের অবসান ঘটে। তবে পৃথিবী নামক এই গ্রহে কার অবস্থান কতটুকু সময় তা আমরা কেউ বলতে পারব না। কারণ জীবন-মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। কে কখন কিভাবে মৃত্যু বরণ করবে এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলেছেন, قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ অর্থ: বল যে মৃত্যু হতে তোমরা পলায়ন করছ তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। (সূরা জুমুআ ৮)। আর মৃত্যুর পরেই মানুষের পরকালীন জীবনের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে যায়। আর প্রত্যেক আত্মাকে মরতেই হবে। আল্লাহ বলেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ الْمَوْتِ ‘প্রত্যেক আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে’ (সূরা আলে ইমরান ১৮৫)। মরণের সময় মানুষের কৃতকর্মই তার সাথী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَجَاءَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَّعَهَا سَائِقٌ وَّشَهِيْدٌ ‘প্রত্যেক ব্যক্তি আগমন করবে, তার সাথে থাকবে চালক ও কর্মের সাক্ষী’ (সূরা কাফ ৫০/২১)। যে শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ দুনিয়াতে পাপাচার করে, সে আল্লাহর কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বলবে, আমি তাকে পাপ কাজে লিপ্ত করিনি; বরং সে নিজেই পাপ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, قَالَ قَرِيْنُهُ رَبَّنَا مَا أَطْغَيْتُهُ وَلَكِنْ كَانَ فِيْ ضَلاَلٍ بَعِيْدٍ ‘তার সঙ্গী শয়তান বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি। বস্ত্ততঃ সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত।’ (সূরা কাফ ৫০/২৭)। পরকালে প্রত্যেকে স্বীয় কর্ম দেখতে পাবে। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব কেউ অণুপরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণুপরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’(সূরা যিলযাল ৯৯/৭-৮)। ইহকাল ক্ষণস্থায়ী ও পরকাল চিরস্থায়ী। আল্লাহ বলেন, وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى ‘অথচ আখেরাতের জীবনই উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সূরা আ’লা ৮৭/১৭)। উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী মৃত্যু কখন আসবে সেটা একমাত্র আল্লাহ জানেন, তাই আমাদের সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণে রেখে পরকালীন পাথেয় সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে, কারণ মৃত্যুর ঘন্টা বেজে গেলে আর কোন ভালো কাজ করা সম্ভব হবে না। আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে,আর আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। কেননা তখন সে বলবে, হে আমার রব, যদি আপনি আমাকে আরো কিছু কাল পর্যন্ত অবকাশ দিতেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম। আর সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। আর আল্লাহ কখনো কোন প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে। আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। (সূরা মুনাফিকুন ১০-১১) উপরের বক্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়, মানুষের মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই, তাই এখনই মৃত্যু এসে যেতে পারে এই চিন্তা করে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগানোই হচ্ছে মুমিন জীবনের প্রধানতম কাজ।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত হাদীস থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, যৌবনই হলো পরকালীন সাফল্য অর্জন করার সর্বত্তোম সময়, কাজেই আমাদের উচিত এটাকে ভালো কাজে ব্যয় করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। সুস্থতা ও অবসর সময়কে কুরআন-হাদীসের জ্ঞান চর্চা ও দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করা। যে কোন সময় অস্বচ্ছল হয়ে যেতে পারি এই চিন্তা করে বেশী বেশী আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করার চেষ্টা করা। সর্বোপরি মৃত্যুর কথা চিন্তা করে জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত ‘আমলে সালেহ’ বা ভালো কাজে ব্যয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।আমাদের আরো মনে রাখা দরকার, উক্ত হাদীসে উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি আর একটির পরিপূরক, তবে শেষের বিষয়টা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মধ্যে অন্য ৪টি বিষয় বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের সুস্থতা-অসুস্থতা, ব্যবস্ততা-অবসর, স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতা, যৌবন-বার্ধক্য সবই জীবনেরই একটা মুহুর্তের অংশ। তাই সর্ববস্থায় মৃত্যুকে স্মরণ করে নিজের জীবনের প্রতিটা কাজ করলে বাকী চারটার গুরুত্বও দেওয়া হয়ে যায়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উপলব্ধি করে কাজে পরিণত করার তাওফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬❂▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Translate