Monday, May 7, 2018

সুরা বাকারার ১-৪৩ নম্বর আয়াতের তাফসির

সুরা বাকারার ১-৪৩ নম্বর আয়াতের তাফসির সূরা বাকারা বিশেষ আঙ্গিকে শুরু হয়েছে। কয়েকটি অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া এ সূরাটি যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি শব্দ সাধারণত কয়েকটি অক্ষর নিয়ে গড়ে ওঠে এবং এর অর্থ আছে। অর্থহীন অক্ষর সমষ্টিকে শব্দ হলা হয় না। কিন্তু আল্লাহ পাক পবিত্র কোরানের ১১৪টি সূরার মধ্যে ২৯টি শুরু করেছেন কয়েকটি অক্ষর দিয়ে, কোন শব্দ দিয়ে নয়। ঐ অক্ষরগুলো প্রত্যেকটি আলাদাভাবে উচ্চারিত হয়। যেমন সূরা বাকারার প্রথম আয়াতটি আমরা “আলাম” পড়ি না বরং পড়ি আলিফ-লাম-মিম। এ ধরনের ভঙ্গিমা আরবী ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন এবং নজীরবিহীন। কোরআন বিশ্লেষকগণ একে “হরুফে মুকাত্বায়া” বলেন। অর্থাৎ এ সব অক্ষর বিচ্ছিন্ন এবং আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চারিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অক্ষরের পর আয়াত এসেছে, যাতে কোরআনের অলৌকিকত্ব ও মহত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। যেমন সূরা শুরায় বলা হয়েছে- “এভাবে আল্লাহ পাক আপনার উপর এবং আপনার পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের উপর অহী নাযিল করেন।” যেন আল্লাহ পাক বলতে চান-আমি আমার অলৌকিক গ্রন্থকে এই সব বর্ণমালা দিয়েই সাজিয়েছি। কোন অপরিচিত বর্ণমালা, শব্দ বা অক্ষর দিয়ে নয়। যারা দাবী করে যে কোরআন অলৌকিক এবং মোজেযা নয়, তারা পারলে এই বর্ণমালা দিয়েই কোরআনের মত গ্রন্থ রচনা করুক; যা বাক্য, শব্দ ও বিষয় বস্তুর দিক থেকে হবে নজীরবিহীন। হ্যাঁ এটি সম্পূর্ণ আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি সাধারণ বর্ণমালা দিয়েই এমন কিতাব রচনা করেছেন যার একটি সূরার মত কেউ কিছু রচনা করতে পারবে না। যেমন আল্লাহ পাক প্রাণহীন মাটি থেকে অসংখ্য গাছ-পালা, ফল-মূল সৃষ্টি করেন, অথচ ঠিক এই মাটি থেকেই মানুষ তৈরী করে ইট, বাসন-কোসন। এ সূরাতেও সূরা শুরার মতো আল্লাহ পাক বিচ্ছিন্ন বর্ণের পর বলেন- “এটি সেই গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং খোদা ভীরু পরহেযগারদের জন্য এটি পথ নির্দেশক।” অতীতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো বই। বর্তমান যুগের মানুষের জন্য এ বই নিরব ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট ভাব ও জ্ঞান পৌঁছে দেয়। কোরআন কোন গ্রন্থ আকারে নাযিল হয়নি। কিন্তু রাসূলে খোদা ঐশী বাণীকে যে কোন বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে, তাঁর উপর যা কিছুই অবতীর্ণ হতো, তা-ই পড়ে শোনাতেন। লেখকরা তা লিখে নিত এবং অনেকেই মুখস্ত করে নিত। মানুষ যদি এই ঐশী গ্রন্থ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ে, বিষয়বস্তু উপলদ্ধি করে, তাহলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে এই কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য পেশ করা সম্ভব নয়। তাও আবার ১৪শ’ বছর আগের একটি মূর্খ সমাজে বসবাসকারী কোন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব। যেমনটি আমরা কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে বলেছি, পবিত্র কোরআন মানুষকে সৌভাগ্য ও সফলতার দিকে পরিচালিত হবার সব উপায় বলে দিয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি সফলকাম হতে চায় তাকে অবশ্যই স্রষ্টার কাছ থেকে প্রেরিত দিক নির্দেশনার শরণাপন্ন হতে হবে। যে সব জিনিস তার দেহ কিংবা মনের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন- “পবিত্র কোরআন মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য নাযিল করা হয়েছে।” তবে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এ ঐশী গ্রন্থ থেকে কেবলমাত্র তারাই উপকৃত হবে, যারা সত্যকে বুঝতে চায় এবং সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রস’ত থাকবে। গোঁড়া ও সংকীর্ণমনা ব্যক্তিরা কখনও সত্যকে গ্রহণ করতে চায় না। সত্য তাদের কাছে প্রমাণিত হলেও তারা তা অস্বীকার করে। কোরআনের শিক্ষা তাদের কোন উপকারে আসে না। কাজেই কোরআনের পথনির্দেশনা তাদের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করে, যাদের মনে খোদা ভীতি রয়েছে। সুতরাং এ আয়াতে বলা হয়েছে-“কোরআন খোদা ভীতি ও পরহেযগার লোকদের জন্য পথ নির্দেশক।” এবারে দেখা যাক এ আয়াতে কী কী শিক্ষণীয় বিষয় আছে। প্রথমত: রাসূলে খোদা(সা:) এর সঙ্গী-সাথীরা পবিত্র কোরআন লেখা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক ছিলেন। কাজেই আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ আয়াতগুলো এখন গ্রন্থাকারে আমাদের মাঝে রয়েছে। এ ঐশী গ্রন্থের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। দ্বিতীয়ত: পবিত্র কোরআন মানব জাতির পথ প্রদর্শক। এটি বিশেষ কোন শ্রেণীর মানুষের জন্য অবতীর্ণ হয়নি। কাজেই পবিত্র কোরআনে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন কিংবা গণিতের বিষয়বস্তু খোঁজা অর্থহীন। তৃতীয়ত: পবিত্র কোরআনের জ্যোতি কেবল তখনই আমাদের অন্তরকে প্রভাবিত করবে যখন আমরা সত্যকে গ্রহণ করার জন্য তৈরী হব। মাটি কিংবা ময়লার মধ্যে আলোর বিকিরণ ঘটেনা, আলো কেবল স্বচ্ছ আয়নার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। ( ৩-৪ নং আয়াত ) আজ এ সূরার তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরবো। সূরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতে কোরআনের পথনির্দেশনা ও হেদায়েতকে মুত্তাকী ও পরহেযগারদের জন্য বলে মন্তব্য করা হয়েছে। পরের আয়াতগুলোয় ঐ পরহেযগারদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে- “মুত্তাকী ও পরহেযগার তারাই যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে এবং তাদেরকে যে জীবিকা দেয়া হয়েছে তা থেকে দান করে।” পবিত্র কোরআন বিশ্বজগতকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। একটি অদৃশ্য জগত যা আমরা চর্মচক্ষুতে দেখতে পাইনা, আর অপরটি হচ্ছে দৃশ্যমান জগত। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জগত অনুভব করি; সেই বস্তুগত জগত কেবলমাত্র চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায় এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় এমন সব বিষয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে। অথচ আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ের পক্ষে সমস্ত সৃষ্টিজগত অনুভব করা সম্ভব নয়। যেমন আমরা নীচের দিকে বস্তুর পতন থেকে বুঝি যে পৃথিবীর আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। অর্থাৎ আকর্ষণ শক্তিকে আমরা এর প্রভাব থেকে বুঝি। এমন অনেক লোক আছে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করার জন্য তাঁকে চোখে দেখতে চায়। যেমন বনি ইসরাইল গোত্র হজরত মূসা(আ:) কে বলেছিল-“আল্লাহকে স্পষ্টভাবে না দেখা পর্যন্ত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো না।” অথচ আল্লাহপাক কোন বস্তুগত কিছু নন যে তাঁকে দেখা যাবে। তবে আমরা সৃষ্টিজগতে বিরাজমান অসংখ্য নিদর্শন থেকে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হই এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনি। সত্য অনুসন্ধানী ও তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা শুধু এই বস্তুগত জগতের মধ্যেই তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারা অদৃশ্য জগত অর্থাৎ আল্লাহপাক, ফেরেশতাকুল, আখেরাত যা পঞ্চ-ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না তার প্রতিও বিশ্বাস রাখেন। অবশ্য ঈমান জ্ঞানের উর্দ্ধে। ঈমান হলো এমন পর্যায় যাতে মানুষের অন্তর ও আত্মাও কোন কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, ভালবাসে। এটা স্পষ্ট যে এ ধরনের ঈমান ও বিশ্বাস থেকে সৎ কাজ উৎসারিত হবে। মূলত: ইসলামের দৃষ্টিতে আমল বা বাস্তব কর্ম ছাড়া শুধু ঈমান দিয়ে মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতি অর্জিত হবে না। এই আয়াতে বলা হয়েছে মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তিরা অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখেন। তারা নামায পড়েন এবং দান-খয়রাত করেন। নামাযের মাধ্যমে তারা আল্লাহকে স্মরণ করেন, নিজেদের মন ও আত্মার প্রয়োজন পূরণ করেন এবং লাভ করেন অনাবিল প্রশান্তি। অপরপক্ষে নিজেদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদের একটি অংশ অভাবগ্রস্তদের হাতে তুলে দিয়ে সমাজের চাহিদা পূরণ করেন, যাতে সমাজেও শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে। অবশ্য কেবল নামায পড়া যথেষ্ট নয় বরং নামায কায়েম করতে হবে। অর্থাৎ নিজেও নামায পড়তে হবে অপরকেও নামাযের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। আযানের পরপরই উত্তম সময়ে নামায পড়তে হবে এবং নামায আদায় করতে হবে মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়ে। এভাবে সমাজে নামায প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দানের ক্ষেত্রেও শুধু আর্থিক দানই ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য রাখতে হবে কোরআনে বলা হয়েছে-” যা কিছু তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা থেকে দান কর।” ধন-সম্পদ, শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, বুদ্ধি এবং আল্লাহর দেয়া সব কিছু এঅন্তর্ভূক্ত। সূরা বাকারার ৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক এবার তুলে ধরা যাক। প্রথমত: এই বিশ্বজগত কেবল বস্তুজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এমন বহু বিষয় আছে যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। তবে আমাদের অন্তর ও বিচারবুদ্ধি সেসবের অস্তিত্ব স্বীকার করে। তাই সেসব অদৃশ্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাস করা উচিৎ। দ্বিতীয়ত: ঈমান কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মুমিন ও বিশ্বাসী ব্যক্তি কাজের লোক। অবশ্য ঐসব কাজ যার নির্দেশ আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। তৃতীয়ত: নামাজ হলো ঈমানদার ব্যক্তিদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু। চতুর্থত: আমাদের যাকিছু আছে সবই আল্লাহর। তাই এর কিছু অংশ আল্লাহর জন্য দান করবো। আর আল্লাহও দুনিয়া এবং আখেরাতে আমাদেরকে এর উত্তম প্রতিদান দেবেন। সূরা বাকারার এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো-ইসলামকে সামাজিক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা। ইসলাম সমাজ পরিচালনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। এ ধর্ম আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কথাও বলে, আবার মানুষের সাথে সম্পর্কের কথাও বলে। একই সাথে সমাজের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেয়। এবারে কোরআনের ভাষায় মুমিন ব্যক্তিদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যাক। সূরা বাকারার ৪র্থ আয়াতে বলা হয়েছে-“মুত্তাকী ও পরহেযগার তারাই যারা তোমার উপর এবং তোমার আগের পয়গম্বরদের উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি, পরকালের প্রতিও পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। আল্লাহকে চেনার একটি পথ হলো অহী। আর তাই তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা অহীতে বিশ্বাস করেন। এর আগের আয়াতে যেমনটি বলেছি উপলদ্ধি ক্ষমতা শুধু মানুষের ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বস্তুগত জগতের উর্দ্ধেও ভিন্ন জগত রয়েছে যার অস্তিত্বকে মানুষের আক্ল বা বিচারবুব্ধি প্রবলভাবে সমর্থন করে। তবে এই আক্লও নিখুঁতভাবে ঐ জগত উপলদ্ধিতে অক্ষম। আর এ জন্যে আল্লাহপাক অহী পাঠিয়ে আমাদের ক্ষমতাকে পূর্ণ করেছেন। আমাদের আক্ল বা বিচারবুদ্ধি বলে-একজন স্রষ্টা আছেন। কিন্তু অহী আমাদেরকে ঐ স্রষ্টার গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দেয়। আমাদের বিচারবুদ্ধি বলে, মানুষকে উপযুক্ত পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার জন্য মহাবিচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর অহী আমাদেরকে বলে, কেয়ামতের মাধ্যমেই হবে সেই মহাবিচার। অতএব দেখা যাচ্ছে, বিচারবুদ্ধি ও অহী একে অন্যের পরিপূরক, আর ঈমানদার ব্যক্তিরা উভয় পন্থা ব্যবহার করেন। অহী শুধু মহানবী মোহাম্মদ (স:) এর উপরই নাযিল হয়নি, বরং সব নবীর উপরই নাযিল হয়েছে আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা অহী। তাই পরহেযগার ও খোদাভীরু লোকদের অযৌক্তিক কোন বিদ্বেষ নেই। তারা পূর্ববর্তী নবীদের অস্বীকার করেন না, বরং নবীজীর পাশাপাশি তারা আল্লাহর সব পয়গম্বর এবং তাদের উপর নাযিলকৃত অহীতে বিশ্বাস করেন। এ ছাড়াও সূরা বাকারার ৪ নম্বর আয়াতে মুমিনদের আরেকটি বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো আখেরাত। পরকালও একটি অদৃশ্য বিষয়। পরকাল সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে অহীর উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। এর ভিত্তিতে মুমিন ব্যক্তিরা কেয়ামতে পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন এবং মৃত্যুকে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি বলে মনে করেন না। সূরা বাকারার এ আয়াতটি থেকে আমাদের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: প্রথমত: সকল নবী রাসূলের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তাই সব আসমানী গ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত: ঐশী গ্রন্থগুলোর উত্তরাধিকারী হলো মুসলিম উম্মাহ। তাই মুসলমানদের আসমানী কিতাব সংরক্ষণের চেষ্টা চালাতে হবে। ( ৫-৭ নং আয়াত ) কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এর আগের আয়াতগুলোয় মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা বাকারার ৫ম আয়াতে বলা হয়েছে-“ঐ মুমিন ব্যক্তিরা তাদের প্রতিপালকের নির্দেশিত পথে রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।” এই আয়াতে পরহেযগার ব্যক্তিদের পরিণাম “সফলতা” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলেই এ সফলতায় পৌঁছায়। সফলতা মানে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হওয়া এবং নৈতিক উৎকর্ষ অর্জন। আরবী ভাষায় কৃষককে বলা হয় “ফাল্লাহ্”। কারণ কৃষক তার পরিশ্রমের মাধ্যমে মাটির তলদেশ থেকে বীজের অঙ্কুরোদ্গম এবং ফসল বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করে। সফলতা মানুষের পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়। কারণ কোরআনের আয়াত অনুযায়ী সৃষ্টিজগত মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ এবাদতের জন্য এবং এবাদত হলো তাকওয়ায় পৌঁছার জন্য। আর এ আয়াতে বলা হয়েছে মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তিরা সফলকাম হবেন। এ আয়াত আমাদেরকে দুটি প্রধান বিষয় শিক্ষা দেয়। প্রথমত: কল্যাণ ও সৌভাগ্যবান হতে হলে আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুযায়ী চলতে হবে। আর দ্বিতীয়ত: চেষ্টা ছাড়া কল্যাণ অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞান ও বিশ্বাসের যেমন দরকার আছে তেমনি কাজ ও উত্তম আমলেরও প্রয়োজন আছে। সূরা বাকারার ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তুমি তাদেরকে সতর্ক কর বা না কর, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান। তারা ঈমান আনবে না।”মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পর এই আয়াতে কাফেরদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেররা বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে এমন বিদ্বেষী হয়ে পড়ে যে সত্য কথা তাদের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলে না এবং তারা ঈমান আনে না। আরবী ভাষায় ‘কুফর’ শব্দের অর্থ হলো ঢেকে ফেলা, উপেক্ষা করা। সুতরাং কাফের মানে ঐ ব্যক্তি যে সত্য গোপন করে এবং সত্যকে উপেক্ষা করে। আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে সব মানুষ ঈমান আনতে বাধ্য হতো। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া বিশ্বাসের কোন মূল্য নেই। আল্লাহই চান মানুষ যাতে স্বেচ্ছায় ঈমান আনে। তাই সব মানুষ পরহেযগার, ঈমানদার ও মুত্তাকী হয়ে যাবে-এমনটি আশা করা আমাদের উচিৎ নয়। সূরা বাকারার ৬ নম্বর আয়াত থেকে আমরা যে কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করছি তা হলো-প্রথমত: কুফরী, বিদ্বেষ- মানুষকে পাথরের মত কঠিন করে ফেলে। তাই কোন উপদেশ বা ভালো কথাও তার মধ্যে কোন প্রভাব ফেলেনা। আর দ্বিতীয়ত: যদি মানুষ সত্য গ্রহণে ইচ্ছুক না হয় তাহলে নবীদের আহ্বান কাজে আসবে না। নবীদের আহ্বান হলো বৃষ্টির মত। যদি উর্বর মাটিতে পড়ে তাহলে ফুল ফোটে, আর যদি নোনা ও শক্ত মাটিতে পড়ে তাহলে জংলী আগাছা আর কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় জন্মায়। তৃতীয়ত: যদিও আমরা জানি যে কাফেররা ঈমান আনবে না, কিন্তু তবুও আমাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে এবং তাদেরকে সদুপদেশ দিতে হবে। সূরা বাকারার ৭ম আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহ তাদের হৃদয় ও কান মোহর করে দিয়েছেন। তাদের চোখের উপর আবরণ আছে এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” মানুষ হিসাবে কাফেরদেরও বিবেক-বুদ্ধি, চোখ ও কান আছে। কিন্তু খারাপ কাজ, অযৌক্তিক বিদ্বেষ, একগুঁয়ে ও হিংসার কারণে এমন পর্দা সৃষ্টি হয় যে তারা সত্য দেখা, শোনা ও উপলদ্ধির শক্তি হারিয়ে ফেলে। এটি হলো দুনিয়াতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি। আর তাছাড়া কেয়ামতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, আর তা হলো আল্লাহ যদি নিজেই কাফেরদের চোখ,কান বন্ধ করে দেয় তাহলে খোদাদ্রোহিতার ক্ষেত্রে তাদেরতো কোন দোষ নেই? কারণ তারা বাধ্য হয়েই কাফের হয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তর খোদা কোরআনেই স্পষ্টভাবে দিয়েছে। সূরা মুমিনের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহ প্রত্যেক উদ্ধত ও অত্যাচারী ব্যক্তির হৃদয় মোহর করে দেন।” সূরা নিসার ১৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য আল্লাহ তাদের হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে এসব আয়াতে মানুষ সম্পর্কে আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। যদি মানুষ সত্যের সামনে ঔদ্ধত্য, গর্ব ও একগুঁয়েমি দেখায় তাহলে শেষ পর্যন্ত তার সত্যকে চেনার শক্তি লোপ পাবে, সত্যকে সে উল্টো দেখতে পাবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন পরিণতির শিকার হবে। সূরা বাকারার ৭ম আয়াতের দুটি প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-কেউ জেনে শুনে সত্য প্রত্যাখ্যান করলে আল্লাহপাকও তার অন্তর্চক্ষু ঢেকে দেন এবং এটি আল্লাহর শাস্তি। এছাড়াও জীব-জন্তুর উপর মানুষের মর্যাদার কারণ হলো তার বিবেক-বুদ্ধি, উপলদ্ধি ক্ষমতা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু মানুষ সত্য প্রত্যাখ্যান এবং আল্লাহ ও তার নিদর্শনাবলী অবিশ্বাসের মাধ্যমে এই মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। ( ৮-১০ নং আয়াত ) কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের এ পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে-আমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী। অথচ তারা বিশ্বাসী নয়।” হেদায়েত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থ কোরআন আমাদের জন্য মুমিন, কাফের ও মুনাফেকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে। যাতে আমরা নিজেদের সম্পর্কেও জানতে পারি যে, কোন দলে আছি এবং অন্যদেরকেও চিনতে পারি। এ ভাবে সচেতনভাবে আমরা সমাজের সদস্যদের সাথে উপযুক্ত আচরণ করতে পারি। সূরা বাকারার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ৪টি আয়াতে মুমিনদের এবং দুটি আয়াতে কাফেরদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াত এবং পরবর্তী আয়াতগুলোয় তৃতীয় একটি দলের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম দলের সদস্যদের মধ্যে যে ঈমানী নূর রয়েছে তাও এ দলের সদস্যদের মধ্যে নেই। আবার দ্বিতীয় দলের সদস্যদের মতো ঔদ্ধত্য এদের মধ্যে নেই। এ তৃতীয় দলের সদস্যদের অন্তরে কোন ঈমান নেই এবং মুখেও এরা খোদাদ্রোহিতামূলক কিছু প্রকাশ করে না। এরা ভীতু মুনাফিক যারা কিনা অন্তরের অবিশ্বাস ও কুফরী গোপন করে রাখে এবং বাহ্যিকভাবে ইসলামের দাবী করে। ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ(সা:) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুশরিকরা এ যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে পরাজয় বরণ করার পর মক্কা ও মদীনার কিছু লোক ইসলামে বিশ্বাস না করলেও জান-মাল রক্ষা কিংবা মুসলমানদের মধ্যে কোন উঁচু পদে আসন হবার জন্য বাহ্যিকভাবে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসের দাবী করে। তারা বাহ্যিকভাবে আচার-আচরণে নিজেদেরকে অন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলে। এটা স্পষ্ট যে এ ধরনের লোকেরা ভীতু এবং কাফেরদের মত প্রকাশ্যে ইসলামকে অস্বীকারের সাহস তাদের মধ্যে নেই। যেকোন সামাজিক পরিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে বহুরূপী ও দ্বিমুখী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই যারা মুখে ঈমানের কথা বলে, তারা অন্তরেও যে একই ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে সে কথা ভাবা ঠিক নয়। এমন বহু লোক আছে যারা বাহ্যিকভাবে ধর্ম পরায়ণ মুসলমান,অথচ সবার অলক্ষ্যে তারা ইসলামের উপর আঘাত হানে। সূরা বাকারার এই ৮ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-ঈমান অন্তরের ব্যাপার, মৌখিক কিছু নয়। তাই কোন ব্যক্তিকে চেনার জন্য শুধু তার মৌখিক ব্যক্তব্যকে যথেষ্ঠ মনে করা উচিৎ নয়। সূরা বাকারার ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তারা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদেরকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ছাড়া কাউকে প্রতারিত করেনা তা বুঝতে পারে না।” মুনাফিকদের ধারনা তারা অত্যন্ত চালাক এবং তাদের চালাকি কেউ ধরতে পারে না। তারা নিজেদেরকে ঈমানদার হিসাবে প্রকাশ করে মনে করে মুসলমানদের মতো বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে পারবে এবং আল্লাহকে ধোকা দিতে পারবে। তারা পয়গম্বর ও মুমিনদেরকে ধোকা দিয়ে মোক্ষম সময়ে ইসলামের উপর আঘাত হানতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তরের বিশ্বাস অবিশ্বাস এবং দ্বিমুখী চরিত্র সম্পর্কে জানেন। উপযুক্ত সময়ে তিনি তাদের মুখোশ উন্মোচিত করেন এবং মুমিনদের কাছে এদের কদর্য চেহারা প্রকাশ করে দেন। কোন অসুস্থ লোক যদি চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র মেনে না চলে চিকিৎসককে মিথ্যা কথা বলে তাহলে সে নিজেকেই ধোকা দিল। যদিও সে ভাবে যে সে মিথ্যা বলে চিকিৎসককে ধোকা দিয়েছে। কোরআনে বর্ণিত মুনাফিকরাও এরকম। এই বহুরুপী লোকেরা মনে করে তারা আল্লাহকে ধোকা দিয়েছে। আসলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রতারিত করে থাকে। সূরা বাকারার ৯ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরা যাক। প্রথমত: মুনাফিকরা ধোকাবাজ। মানুষের বাহ্যিক চেহারা ও আচরণ দেখে যাতে ধোকা না খায়, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: অন্যদের সাথেও প্রতারণা করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কারণ প্রতারণার কুফলে খোদ প্রতারকই আক্রান্ত হয়। তৃতীয়ত: মুনাফিকরা ইসলামের সাথে যে ধরনের আচরণ করে তাদের প্রতি ইসলামের ব্যবহারও সেরকম। অর্থাৎ বাহ্যত: মুনাফিকরা মুসলমান হওয়ার ভাব দেখায়, তাই ইসলামও বাহ্যিকভাবে তাকে মুসলমান হিসাবেই জানে। তার অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র নেই, তাই কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে কাফেরদের মত শাস্তি দেবেন। চতুর্থত: মুনাফিক ব্যক্তি নিজেকে খুব চালাক বলে মনে করে, অথচ সে নির্বোধ। সে জানে না যে তার প্রতিপক্ষ আল্লাহ সবার মনের গোপন খবর রাখেন। সূরা বাকারার ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তাদের অন্তরে রোগ আছে। এরপর আল্লাহ তাদের রোগ বৃদ্ধি করেন। তাদের মিথ্যাবাদিতার কারণে তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।” অন্তরের অসুস্থতার যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় তার মনুষ্যত্ব ধ্বংস করে দেয়। ‘নিফাক’ বা কপটতা আত্মার অন্যতম বিপদ জনক ব্যাধি যা আমাদের সবার মন ও আত্মার জন্য হুমকির সৃষ্টি করে। সুস্থ ব্যক্তি বহুরূপী নয়। তার দেহ ও আত্মার মধ্যে রয়েছে পূর্ণ সমন্বয়। মনে যা আছে তাই সে বলে এবং তার চিন্তার সাথে আচরণের মিল থাকে। কপটতার রোগ অন্য বেশ কিছু আত্মার রোগ সৃষ্টি করে। ব্যক্তির মধ্যে হিংসা, লোভ, কৃপণতা এসব কিছু সহজেই দেখা যায় কপটতা থেকে। এই কপটতা ক্যান্সারের মত দিন দিন মুনাফিক ব্যক্তির মনে-প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআন মিথ্যাচারকে ‘কপটতা’ রোগের মূল উৎস বলে অভিহিত করে। মিথ্যা থেকেই এ কপটতা শুরু হয় এবং মিথ্যার মাধ্যমেই তা অব্যাহত থাকে। আর মিথ্যা বলা থেকে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন মৃত দেহ যখন পানিতে পড়ে থাকে তখন সেটা থেকে ভীষণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। বৃষ্টির পানিতে ঐ লাশের দুর্গন্ধ মোটেও কমে না বরং পঁচে গলে ঐ লাশ থেকে আরো বিকট গন্ধ বের হতে থাকে। নিফাককে ঠিক লাশের সাথে তুলনা করা যায়। এই নিফাক বা কপটতা যদি কোন ব্যক্তির মনে শিকড় গেড়ে বসে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে যত হুকুম নাযিল হোক না কেন কোন লাভ হবে না। বরং মুনাফিক ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার পরিবর্তে বাহ্যিকভাবে ভালো ও সৎ ব্যক্তির মত আচরণ করে। ফলে তার কপটতা বাড়তে থাকে এবং এটি তার মনের মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে নেয়। নিফাক শব্দটির অর্থ বেশ ব্যাপক, মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে যে কোন ধরনের অসংগতিও এই শব্দের আওতায় পড়ে। একজন মুমিন ব্যক্তির মধ্যেও এ ধরনের অসামঞ্জস্য থাকতে পারে। ইবাদতের মধ্যেও নিফাক কপটতা থাকতে পারে। যদি কোন লোক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ইবাদত করে সেটাও এক ধরনের নিফাক। রাসূলে খোদা(সা:) বলেছেন কোন ব্যক্তি যত নামাজ রোজাই করুক না কেন তিনটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে সেই হবে মুনাফিক। আমানতের খিয়ানত করা, মিথ্যা কথা বলা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: নিফাক হচ্ছে এক ধরনের মানসিক রোগ। সে পুরোপুরি সুস্থও নয় আবার মৃতও নয়। মুমিনও নয় আবার কাফেরও নয়। দ্বিতীয়ত: নিফাক ক্যান্সারের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি এর চিকিৎসা না হয় তাহলে মানুষের পুরো অস্তিত্ব হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত: মিথ্যাই হচ্ছে নিফাকের উৎস। মুনাফিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মিথ্যা বলা। ( ১১-১৩ নং আয়াত) কোরআনের আলোর এ পর্বে সূরা বাকারার ১১, ১২, ও ১৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তাদেরকে যখন বলা হয়-পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরাতো কেবল সংস্কার সাধনকারী। জেনে রাখ এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না।” নিফাক বা কপটতা এক ধরনের সংক্রামক রোগ। যদি এ রোগের চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে এ রোগে সমাজের বহু মানুষ আক্রান্ত হবে। সমাজ কলুষিত হয়ে পড়বে ভণ্ডামী, তোষামোদী, মিথ্যা বলা, পরচর্চা, কুৎসা রটনার মত নানা রকম ব্যাধিতে। মুনাফিক যেহেতু নিজে ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলেনা, তাই চায় মুমিন ব্যক্তিরাও তার মত হয়ে যাক। বিভিন্নভাবে সে মুমিনদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায়। আল্লাহর নির্দেশকে অবিরাম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মানুষকে তাদের কর্তব্যের প্রতি অমনোযোগী করে তোলে। মুনাফিকদের এ ধরনের অন্যায় আচরণের কিছু উদাহরণ পবিত্র কোরআনের সূরা তওবায় উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে এ মুনাফিকরা ইসলামের দুশমনদের সাথে লড়াইয়ের সময় যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যেত। মুজাহিদদের মনোবল দুর্বল করতো কিংবা দানের ক্ষেত্রে মুনাফিকদেরকে উপহাস করতো। সমাজে সব রকম অপরাধের উৎসই হলো নিফাক। কিন্তু মুনাফিক সত্যকে দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাই সে নিজের অন্যায় অপরাধকে সংস্কার বলে মনে করে। কপট ব্যক্তির দৃষ্টিতে শত্রুর সাথে আপোষ এবং রক্তপাতের বিরোধিতার মধ্যে সমাজের মঙ্গল নিহিত। তাই যেভাবেই হোক যুদ্ধ-বিগ্রহ যাতে না বাধে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য যদি মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়ে তাতেও মুনাফিকের কিছু আসে যায় না। সূরা বাকারার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবার তুলে ধরছি। প্রথমত: নিফাকের প্রভাব শুধু ব্যক্তির মধ্যেই নয় বরং সমাজের উপরও এর প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে নিয়ে যায় অশান্তির দিকে। দ্বিতীয়ত: নিফাকের একটি বৈশিষ্ট্য হলো আত্মগর্ব। মুনাফিকরা বলে-আমরাই কেবল উপযুক্ত ব্যক্তি এবং সংস্কার সাধনকারী, অন্য কেউ নয়। তৃতীয়ত: কোন ব্যক্তির অন্তরে যদি নিফাক অনুপ্রবেশ করে তাহলে তার উপলব্ধি ক্ষমতা লোপ পায় এবং সত্য কথা শুনতে ও দেখতে চায় না। চতুর্থত: মুনাফিকদের বাহ্যিক চাকচিক্যময় অথচ অন্ত:সারশূণ্য বক্তব্য সম্পর্কে মুমিনদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে মুনাফিকদের ধোকায় তারা না পড়ে। পঞ্চমত: যে চালাকী সত্য পথে এবং সমাজের কল্যাণের জন্য নিবেদিত নয় তা মূলত: বোকামী ও নির্বুদ্ধিতা। সূরা বাকারার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “যখন মুনাফিকদেরকে বলা হয় অন্যান্যদের মত তোমরাও ঈমান আনো, তখন তারা বলে আমরাও কি নির্বোধদের মত ঈমান আনবো? জেনে রাখ এরা নিজেরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা তা বুঝতে পারে না।” গর্ব, অহঙ্কার অন্য মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এ সবই নিফাকের বৈশিষ্ট্য। তারা নিজেদেরকে বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ও চালাক মনে করে। আর মুমিনদেরকে ভাবে নির্বোধ, সহজ-সরল ও বোকা। তাই কপট বা মুনাফিক ব্যক্তিদেরকে যখন বলা হয় কেন তোমরা নিজেদেরকে অন্যান্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছ এবং তাদের মত ঈমান আনোনা। তখন তারা ঈমানদার ও বিশ্বাসীদেরকে বোকা বলে অভিহিত করে। যে মুমিন ব্যক্তিরা সুখ-দু:খ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝড়-ঝঞ্ঝা সর্বাবস্থায় তাদের ধর্ম ও নেতার পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করে, তাদেরকে মুনাফিকরা নির্বোধ বলে মনে করে। আর পবিত্র কোরআন তাদের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার জবাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে-তোমরা যারা মুমিনদেরকে নির্বোধ মনে কর, তারাই আসল নির্বোধ। তবে সমস্যা হলো তারা তাদের এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে জানেনা। তারা তাদের অজ্ঞতা সম্পর্কেই কিছু জানে না। তাই তারা ভাবে অন্যরা কেউ কিছু জানেনা আর তারা সব কিছু জানে বোঝে। সূরা বাকারার ১৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরছি। প্রথমত: মুমিনদের খাটো করা, অপমান করা মুনাফিকদের একটি পন্থা। এভাবে তারা নিজেদেরকে অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে চায়। দ্বিতীয়ত: অহঙ্কারী ব্যক্তির সাথে তার মতো আচরণ করা উচিৎ। যে ব্যক্তি মুমিনদের হেয় করে তাকেও সমাজে হেয় করতে হবে যাতে তার মিথ্যা অহঙ্কার ও দর্প চূর্ণ হয়। তৃতীয়ত: উপহাস ও হেয় করা নির্বোধের কাজ। বুদ্ধিমান ব্যক্তি যুক্তির ভাষায় কথা বলে, আর নির্বোধ ব্যক্তি কথা বলে উপহাসের ভাষায়। চতুর্থত: আল্লাহপাক মুনাফিকদেরকে এ দুনিয়াতেই অপদস্ত করেন। এবং তাদের কদর্য চেহারা উন্মোচিত করেন। ( ১৪-১৬ নং আয়াত) কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সুরা বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “মুনাফিকরা যখন ঈমানদারদের সংস্পর্শে আসে তখন তারা বলে-আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন তারা তাদের শয়তান সহযোগীদের সাথে গোপনে মিলিত হয় তখন তারা বলে-আমরাতো তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা শুধু ঈমানদারদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি। নিফাক বা কপটতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুনাফিকের কোন নিজস্ব স্বাধীন ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নেই। মুনাফিকরা যে পরিবেশে যায় সেই পরিবেশের রং ধারন করে। তারা যখন মুমিনদের মাঝে যায়, তখন মুমিনের ভাব দেখায়। আবার যখন ইসলামের নেতা ও মুমিনদের দুশমনদের সাথে মিলিত হয়, তাদের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায়, মুমিনদের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং তাদের সুনজরে পড়ার জন্য মুমিনদেরকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-তামাশা করে। এই আয়াতও আমাদেরকে সতর্ক করে দেয় যাতে লোকজনের বাহ্যিক আচরণে আমরা ধোকা না খাই। ঈমানের দাবী করলেই তাকে মুমিন ভাবা ঠিক নয় এবং দেখতে হবে ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি কাদের সাথে ওঠা বসা করে এবং তার বন্ধুই বা কারা। কেউ মুমিন হবে আবার ইসলামের নেতাদের শত্রু ও ধর্মের দুশমনদের বন্ধু হবে-এটা মেনে নেয়া যায় না। ঈমান, ইসলামের শত্রুদের সাথে আপোষ এবং বন্ধুত্বের পরিপন্থী। ঈমানের আবশ্যিক দিক হলো আল্লাহর দুশমনদের সাথে শত্রুতা। সূরা বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: শয়তান শুধু জ্বীন জাতির শয়তান নয় বরং যেসব মানুষ অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে তারাও শয়তান এবং তাদেরকে পরিহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত: সত্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গোপন বৈঠক ও শলা-পরামর্শের অর্থ হলো মত প্রকাশে সাহসিকতার অভাব। মুনাফিকরা যারা বিশ্বাসীদেরকে উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তারা ভীতু ও দুর্বল চিত্তের অধিকারী। তৃতীয়ত: মুনাফিকরা হলো সমাজে দুশমনদের হাতিয়ার এবং তাদেরই ইচ্ছা অনুযায়ী চলে। তাদেরকে বলে “ইন্না মাআকুম”- আমরা তোমাদের সাথে আছি, মুমিনদের সাথে নয়। এবারে সূরা বাকারার ১৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “আল্লাহও তাদেরকে উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রানে-র মত ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন। রাসূলে খোদার আহলে বাইতের সদস্য ইমাম মূসা রেজা(আ:) বলেন-“আল্লহপাক ধোকাদানকারী বা উপহাসকারী নন। কিন্তু দুশমনদের ধোকা ও উপহাসের শাস্তি তিনি দেন।” মুনাফিকরা যে বিভ্রান্তি ও হৃদয়ের অন্ধত্বের শিকার হয় তার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? আল্লাহর নিয়ম হলো তিনি অত্যাচারী পাপীদের সময় দেন। এ সময়টিকে যদি মানুষ তওবা ও অনুশোচনার জন্য ব্যবহার করে তাহলে তা হবে তার জন্য রহমত। তা না হলে তারা আরো পাপের মধ্যে ডুবে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে। মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর শাস্তি হলো তাদেরকে নিজেদের অবস্থায় ছেড়ে দেয়া। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের নেই কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং নেই কোন শান্তি। সূরা বাকারার ১৫ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: মানুষের গুনাহ্ যেরকম, আল্লাহর শাস্তিও সেরকম। তাই উপহাসের শাস্তিও উপহাস। দ্বিতীয়ত: আমাদেরকে যে সময় দেয়া হয়েছে তাতে অহঙ্কারী হওয়া উচিত নয়। হয়তো এটিও আল্লাহর এক ধরনের রহমত। তৃতীয়ত: আল্লাহপাক মুমিনদের সাহায্যকারী। মুনাফিকরা যদি মুমিনদের উপহাস করে তাহলে আল্লাহও তাদেরকে উপহাস করবেন এবং শাস্তি দেবেন। এবারে সুরা বাকারার ১৬ নম্বর আয়াত। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “এরাই সৎ পথের বিনিময়ে ভ্রান্ত পথ কিনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা সৎ পথও পায়নি।” আমরা যে দুনিয়ায় বাস করছি, তা একটি বাজারের মত। আমাদের সবাইকে ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করতে হয়। যৌবন, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা জ্ঞান, শক্তি, জীবন এবং আল্লাহর দেয়া সব যোগ্যতাকে সম্পদ হিসাবে বিক্রি করতে হয়। এ বাজারে একদল মুনাফা অর্জন করে, অন্যদল দেউলিয়া হয়ে পড়ে। যারা দেউলিয়া হয়ে পড়ে, তারা লাভতো দূরের কথা এমনকি মূলধন পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। এ যেন অনেকটা বরফ বিক্রেতার মত। বরফ বিক্রেতা যদি তার জিনিস বিক্রি না করে তা হলে মুনাফাতো নয়ই বরং তার মূলধন পানি হয়ে যাবে এবং সে তার সর্বস্ব হারাবে। আল্লাহপাক কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষের ভালো ও মন্দ কাজকে ব্যবসার সাথে তুলনা করেছেন। যেমন সূরা সাফের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে ঈমান ও জেহাদকে লাভজনক ব্যবসা আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে- “হে ঈমানদারগণ! আমি কি এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব যা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? আর তা হলো-তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম কর।” এ আয়াতে মুনাফিকদেরকে এমন বিক্রেতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে যারা হেদায়েত বিক্রি করে ভ্রান্তি কিনে নিয়েছে। সম্ভবত: এ আয়াত থেকে বোঝানো হচ্ছে যে- আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা ও প্রকৃতিগত প্রবণতার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। কিন্তু মুনাফিকরা কপটতা ও পাপ কাজে অভ্যস- হয়ে আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা হাত ছাড়া করে। কারণ মুনাফিকরাতো হেদায়াতেরই অধিকারী নয় যে তারা তা হাত ছাড়া করবে এবং এর বিনিময়ে ভ্রান্তি কিনে নেবে। এই ব্যবসায় তারা কোন মুনাফা অর্জন করেনি এবং অশুভ লক্ষ্যেও পৌঁছতে পারেনি বরং ইসলাম আরো সুদৃঢ় হয়েছে এবং তারা অপদস- হয়েছে। সূরা বাকারার ১৬ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: কেবল বস্তুগত লাভ-লোকসানের কথা ভাবা ঠিক নয় বরং দেখতে হবে আমাদের মন-প্রাণ ও আত্মাকে কোথায় বিক্রি করছি এবং এর বিনিময়ে কী অর্জন করছি? এই বেচা-কেনা থেকে সৌভাগ্যবান হচ্ছি নাকি বিভ্রান্তির স্বীকার হচ্ছি? দ্বিতীয়ত: হেদায়াত এবং বিভ্রান্তি আমাদের নিজেদেরই কর্মফল। আল্লাহর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া কিছু নয় কিংবা তাঁর ইচ্ছা, মর্জি বা তকদির নয় বরং তাতে আমাদের কর্মের প্রভাব রয়েছে। তৃতীয়ত: নিফাক বা ভণ্ডামীর শেষ পরিণতি হলো বিভ্রান্তি ও ধ্বংস। অপর পক্ষে ঈমান বা বিশ্বাস মানুষকে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যায়। ( ১৭-১৯ নং আয়াত ) কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতের সহজ ব্যাখ্যা তুলে ধরব। সূরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “এ মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত তাদের মত-যেমন কেউ আগুন জ্বালালো, ঐ আগুন যখন তাদের চারদিক আলোকিত করল তখন আল্লাহ তাদের জ্যোতি সরিয়ে নিলেন এবং তাদেরকে এমন ঘোর অন্ধকারের মধ্যে ফেললেন যাতে তারা কিছুই দেখতে না পায়।” এর আগের আয়াতগুলোয় মুনাফিকদের কথা ও আচরণের কিছু দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছিল। এ আয়াতে তাদেরকে অন্ধকার প্রান্তে অগ্নী প্রজ্জ্বলনকারী ব্যক্তির সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে-মুনাফিকদের ঈমানের আলো আগুনের আলোর মত দুর্বল, অস্থায়ী এবং এতে রয়েছে ধোঁয়া, ছাই ও অন্তর্জ্বালা। মুনাফিকরা ঈমানের আলোর বহি:প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু তাদের ভেতর রয়েছে কুফরী বা খোদাদ্রোহিতার আগুন। এই দুর্বল আলো মানব প্রকৃতিতে দেয়া আল্লাহর সেই পবিত্র নূরেরই অংশ। কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষ ও একগুঁয়েমির কারণে ঐ নূর ক্রমেই নিষপ্রভ হয়ে আসে। এ ভাবে ধীরে ধীরে একসময় অজ্ঞতা ও অন্ধকারের পর্দায় তা আচ্ছাদিত হয়ে যায় এবং মুনাফিকদের সমস্ত অস্তিত্ব ছেয়ে পড়ে কুফুরী বা খোদাদ্রোহিতার নিকষ কালো অন্ধকারে। মুনাফিকরা কপটতার পথ বেছে নিয়ে মনে করে নরকবাসী কাফেরদের খুশী রাখতে পারবে এবং একই সাথে বেহেশতবাসী মুমিনদেরও সন’ষ্ট করতে পারবে। কাফেরদের দুনিয়া থেকেও লাভবান হবে এবং মুমিনদের পরকাল থেকেও বঞ্চিত হবে না। তাই কোরআন মুনাফিকদেরকে এমন ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছে যে আগুন জ্বালিয়ে আগুন ও আলো অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার সমন্বয় ঘটায় যাতে এ দুটো থেকেই লাভবান হতে পারে। কিন্তু জীবন হলো অন্ধকার প্রান্তরের মত। এ দুর্গম প্রান্তর অতিক্রম করে নিশ্চিন্তে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য উজ্জ্বল ও স্থায়ী আলোর প্রয়োজন। কারণ ঝড়-ঝঞ্ঝা যে কোন দুর্বল আলোর শিখা নিভিয়ে দেয় এবং মানুষকে নিমজ্জিত করে গভীর অন্ধকারে। সূরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: মুনাফিকের আলো আগুনের আলোর মত অস্থায়ী এবং দুর্বল। দ্বিতীয়ত: মুনাফিকের অস্তিত্ব হলো অশান্তি ও আগুনের উৎস। তৃতীয়ত: মুনাফিকরা সত্যিকার আলো বা হকে পৌঁছবার জন্য আগুন ব্যবহার করে। কিন্তু এর ফলে জ্বালা-পোড়া, ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া অন্য কিছু পায় না। চতুর্থত: শেষ পর্যন্ত আল্লাহপাক মুনাফিককে পর্যুদস্ত করেন এবং তাদের বাহ্যিক জ্যোতিও ছিনিয়ে নেন। পঞ্চমত: মুনাফিকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং তাদের মুক্তির কোন আশা নেই। ষষ্ঠত: আল্লাহর সামনে তাদের কপটতা ও দ্বিমুখী আচরণ তাদের বুদ্ধিমত্তার বহি:প্রকাশ নয় বরং তাদের এ আচরণ তাদের জন্য বয়ে আনে অন্ধকার ও ধ্বংস। এবারে সুরা বাকারার ১৮ নম্বর আয়াত। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “তারা মূক, বধির ও অন্ধ। সুতরাং তারা প্রত্যাবর্তন করবে না।” অন্যান্য মানুষের মত মুনাফিকদেরও চোখ, কান ও মুখ আছে। কিন্তু তাদের চোখ যেহেতু সত্য দেখতে ও উপলদ্ধি করতে প্রস’ত নয়, তাদের কান যেহেতু সত্য কথা শুনতে রাজী নয় এবং তাদের জীভ যেহেতু সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকে তাই কোরআন তাদেরকে এমন ব্যক্তিদের সাথে তুলনা করেছে যারা কথা বলতে পারে না, চোখে দেখে না এবং কানে শোনে না। বিদ্বেষ ও অন্ধ অনুসরণের পরিণতি হলো সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা হাতছাড়া করা। মুনাফিকের অভ্যন্তরীণ কুফরী ও অবিশ্বাস তার চোখ, কান ও বাক শক্তিকে এমন ভাবে ঢেকে দেয় এবং সত্যকে আচ্ছাদিত করে যে, সে কাফেরের মতই সত্যকে উল্টো দেখতে পায়। সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে যে ঈমানের আলো সরে যাওয়ার পর অবিশ্বাসের অন্ধকার মুনাফিকদের সমস্ত অস্তিত্ব এমন ভাবে ঢেকে ফেলে যে তারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে তারা শুধু দৃষ্টিশক্তিই নয় একই সাথে শ্রবন ও সত্য কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। অন্ধকারের মধ্যে তাদের পথ চলার পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয় এবং এ থেকে ফিরে আসার কোন পথ নেই। এবারে সূরা বাকারার ১৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “কিংবা তাদের মত যারা আকাশ থেকে মুষলধারে ভারী বৃষ্টির সময় ঘোর অন্ধকার, বজ্রধ্বনিও বিদ্যুৎ চমকের মধ্যে আক্রান্ত। তারা বজ্রের শব্দে মৃত্যুভয়ে কানে আঙ্গুল দেয়। কিন্তু আল্লাহ কাফেরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন। সূরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক মুনাফিকদেরকে এমন দিগভ্রান্তদের সাথে তুলনা করেছেন যারা তাদের পথের আলো হারিয়ে ফেলেছে এবং নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে উদ্‌ভ্রান্তের মত পথ হাতড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের সঠিক পথ পাওয়ার কোন আশা নেই, আশা নেই প্রত্যাবর্তনের। কিন্তু এই ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে যে, মুনাফিকরা কাদার মধ্যে আটকে আছে, আর মুষলধারে বৃষ্টি, অন্ধকার, রক্তহিম করা বজ্রপাতের শব্দ চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ চমকানী এবং ভয়ঙ্কর মৃত্যুভয় তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু বৃষ্টি থেকে নিজেদেরকে রক্ষার কোন আশ্রয়স’ল তাদের নেই এবং অন্ধকার, বিদ্যুৎ ঝলক, বজ্রপাতের শব্দ থেকেও তাদের নিস্তার নেই। সূরা বাকারার ১৯ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: মুনাফিকরা সমস্যায় জর্জরিত এবং সন্ত্রস্ত। এ দুনিয়াতে ভয় ও শঙ্কায় সব সময় তারা আক্রান্ত। দ্বিতীয়ত: মৃত্যুভয়ে মুনাফিকরা সব সময় শঙ্কিত। এই ভয় ও আশঙ্কার কারণে তাদের আত্মায় শান্তি নেই। তৃতীয়ত: আল্লাহপাক মুনাফিকদেরকে ঘিরে রেখেছেন এবং তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। চতুর্থত: নিফাক বা কপটতার ফলে শেষ পর্যন্ত কুফুরী বা অবিশ্বাসের জন্ম হয়। পঞ্চমত: আকাশ থেকে বর্ষিত বৃষ্টি থেকে মুনাফিকদের ভাগ্যে কেবল বজ্রপাতই জোটে। কোরআন মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত। কিন্তু মুনাফিকের জন্য এই কোরআন হলো বিপদ ঘন্টা এবং অপমানের উৎস। ( ২০-২২ নং আয়াত) কোরআনের তাফসীর বিষয়ক অনুষ্ঠান কোরআনের আলোর ১১তম পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ সূরা বাকারার ২০, ২১, ও ২২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি শক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। আসমানের বিদ্যুৎ যখন অন্ধকার প্রান্তরে তাদের জন্য আলো নিয়ে আসে, তখন তারা কয়েক কদম অগ্রসর হয়। কিন্তু যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন তারা থমকে দাঁড়ায়। আল্লাহ চাইলে তাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতেন। নিশ্চয়ইই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। আকাশের বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাতের শব্দ বৃষ্টির আলামত। এ হলো পৃথিবীবাসীদের জন্য নব প্রাণ, সবুজ ও সজীবতার আগমনী বার্তা। কিন্তু এই আগমনী বার্তা সবার জন্য সুসংবাদ নয়। বরং তাদের জন্য শুভবার্তা যারা আল্লাহর এই রহমত থেকে উপকৃত হতে প্রস্তুত। তাহলে ঐ উদ্ভ্রান্ত যাত্রীর কি অবস্থা হবে? উদ্ভ্রান্ত যাত্রী বা মুনাফিক অন্ধকার প্রান্তরে যে আগুন জ্বালিয়েছে তার দুর্বল আলো এবং আকাশের বিদ্যুৎ চমকানীর চোখ ধাঁধাঁনো আলোর কোনটাই তাকে জীবন চলার পথে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারবে না। কারণ আগুনের আলো হলো অস্থায়ী, আর বিদ্যুৎ চমকের ফলে যে আলো সৃষ্টি হয় তা বৃষ্টির বার্তা বয়ে আনে এবং এতে মুনাফিকদের জন্য দু:খ ছাড়া আর কিছু নেই। আল্লাহর অহী হলো আসমানের চোখ ধাঁধাঁনো বিদ্যুৎ ঝলকের মত। এটি দেখার সাধ্য ও ক্ষমতা মুনাফিকদের নেই। তারা পয়গম্বরদের কাছ থেকে আগত আল্লার ওহী থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করে না। যদিও মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে ঈমানদার হওয়ার দাবী করে এবং এই নূর থেকে উপকৃত হতে চায়। কিন্তু বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নেয়, তাদের জন্য এগুবার পথ বন্ধ করে দেয়। মুনাফিকদেরকে কোরআন এমনভাবে অপদস্থ করে যে তারা মুনাফিকদের সাথে পথ চলা অব্যাহত রাখতে পারে না। তাদের সামনের দিকে যাওয়ার যেমন পথ থাকেনা তেমনি পিছু হটারও কোন উপায় থাকেনা। তারা পথ হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত উদ্বেগ উত্তেজনায় পথ হাতড়াতে থাকে। এসব হলো আল্লাহ এবং মুমিনদের সাথে কপটতার দুনিয়াবী ফল। আল্লাহ যদি তাদেরকে শাস্তি দিতে চান তাহলে তারা শুধু চলার শক্তিই হারাবে না একই সাথে দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তিও হারিয়ে বসবে। সূরা বাকারার ২০ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: আল্লাহর নূর দেখার শক্তি মুনাফিকদের নেই। আল্লাহর বাণী আকাশের বিদ্যুৎ চমকের মত তাদের দৃষ্টি শক্তি হরণ করে নেয়। দ্বিতীয়ত: মুনাফিকদের নিজস্ব কোন আলো নেই তাই তারা মুমিনদের আলোয় পথ চলার চেষ্টা করে। তৃতীয়ত: মুনাফিকরা অনেক সময় কয়েক কদম অগ্রসর হলেও মূলত: অগ্রসর হতে পারে না এবং অবশেষে থমকে দাঁড়ায়। চতুর্থত: মুনাফিকরা তাদের অপকর্মের কারণে যে কোন সময় আল্লাহর গজবের শিকার হতে পরে। পঞ্চমত: মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোকা দিতে পারবে না এবং আল্লাহর শাস্তি থেকেও পালাতে পারবেনা। কারণ আল্লহপাক সর্বশক্তিমান এবং কোন কাজই তার অসাধ্য নয়। এবারে সূরা বাকারার ২১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের এবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী ও পরহেজগার হও।” সূরা বাকারার আগের ২০টি আয়াতে আল্লাহপাক তিন শ্রেণীর মানুষের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এই তিন শ্রেণী হলো-পরহেজগার, কাফের ও মুনাফিক। এই তিন শ্রেণীর লোকদের বৈশিষ্ট্য, চিন্তাধারা ও আচরণ তুলনা করার পর এই আয়াতে কল্যাণ ও মুক্তির পথনির্দেশ করে বলা হয়েছে-প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এবং তাকওয়া বা খোদাভীরুতার অধিকারী হওয়ার জন্য কেবল একটি পথ রয়েছে। আর তা হলো সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর প্রতি আসক্ত হওয়া, যে আল্লাহ আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অন্যদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একমাত্র তারই দাসত্ব করতে হবে। এমন অনেক মানুষ আছে যারা আল্লাহকে বিশ্ব জগত ও মানুষের স্রষ্টা বলে স্বীকার করে, কিন্তু নিজের ও সমাজ জীবনের দিকনির্দেশনা ও জীবনাদর্শ গ্রহণ করে অন্যদের কাছ থেকে। যেন আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন যাতে তারা তাদের খুশীমত চলে। এই আয়াতে এ ধরণের চিন্তা-ভাবনার জবাবে বলা হয়েছে-“তোমাদের স্রষ্টা, তোমাদের প্রতিপালকও বটে। তোমাদের বিকাশ ও বেড়ে ওঠার জন্য কিছু দায়িত্ব ও কর্মসূচী নির্ধারণ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা ও ব্যবস্থা ঠিক করে দিয়েছে। আইন ও বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর যিনি কিনা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।” অতএব একমাত্র তারই উপাসনা করতে হবে, তার আনুগত্য করতে হবে এবং তার দেয়া বিধান মেনে চলতে হবে। স্রষ্টা ও প্রতিপালকের আনুগত্য এবং তার দেয়া আইন মেনে চললে মানুষেরই লাভ। এর ফলে মানুষ মন্দ ও অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবে এবং উত্তম ও কল্যাণের অধিকারী হবে। সূরা বাকারার ২১ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: সত্য ও কল্যাণের দিকে পয়গম্বরদের আহ্বান সার্বজনীন। কোন বিশেষ শ্রেণী, জাতি বা গোত্রের জন্য নির্ধারিত নয়। তাই পবিত্র কোরানে প্রায় ২০ বার সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে-“ইয়া আইয়ুহান্নাস”। দ্বিতীয়ত: আল্লাহর এবাদত ও উপাসনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আমাদের প্রতি এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি আল্লাহপাকের অশেষ নেয়ামতের প্রতি শোকর আদায় করা। তৃতীয়ত: আমাদেরকে সৃষ্টি করা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এ মহান নেয়ামতের বিনিময়ে আল্লাহর নির্দেশের সামনে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত। চতুর্থত: তাকওয়া ও নিষ্কলুষতার উৎস হলো এবাদত। যদি কোন এবাদত আমাদের মধ্যে তাকওয়া ও সংযমের বৃদ্ধি না ঘটায় তাহলে তা এবাদতই নয়। পঞ্চমত: আমাদের পূর্ব পুরুষদের আচার-আচরণ ও বিশ্বাসকে আল্লাহর নির্দেশের উপর প্রাধান্য দেয়া উচিত হবেনা। কারণ তারাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাদেরকে অনুসরণ করতে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা চলবে না। ষষ্ঠত: আমাদের এবাদত-বন্দেগী ও উপাসনার কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। আমাদের নামাজ-রোজা ও অন্যান্য এবাদত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বকে বৃদ্ধি বা হ্রাস করে না। বরং নিজেদের বিকাশ ও পূর্ণতার জন্যেই আমাদেরকে তার এবাদত করতে হবে এবং তাঁর পূর্ণ অনুগত থাকতে হবে। সপ্তমত: লক্ষ্য রাখতে হবে নিজেদের এবাদতের কারণে অহঙ্কারী না হয়ে পড়ি। মুত্তাকী ও পরহেজগার হওয়ার পথে বড় বাধা হচ্ছে অহঙ্কার ও লোক দেখানো এবাদত। এবারে সূরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ সুরায় বলা হয়েছে-” প্রতিপালক পৃথিবীকে আমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন, এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষন করে তা দিয়ে তোমাদের জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। সুতরাং জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না।” এ আয়াতে আল্লাহপাক বেশ কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, যে নেয়ামতগুলো আবার অন্য বেশ কিছু নেয়ামতের উৎস। আল্লাহ পৃথিবীকে মানুষের জন্য বিছানার মত করে সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীর পাহাড় প্রান্তর, মাটি, পানি, মাটির ওপর ও ভেতরকার হরেক রকমের খনিজ ও প্রাকৃতিক দ্রব্য সব কিছু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য উত্তম ব্যবস্থায় সৃষ্টি করেছে। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে চমৎকার সমন্বয়ের ফলে বৃষ্টি ঝরে পড়ে, বেড়ে ওঠে গাছ-পালা, ফল-মূল। এভাবে মানুষ খাদ্য ও জীবিকা লাভ করে। এ সব কিছুই সংঘটিত হয় আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার বলে। তাই অন্যরা যখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল তখন কিভাবে তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বিবেচনা করবো? কি করে আল্লার নির্দেশ বাদ দিয়ে তাদের নির্দেশ মানা সম্ভব? সূরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রথমত: আল্লাহকে চেনা, তাঁর আনুগত্য করা এবং আল্লাহর এবাদতের সর্বোত্তম উপায় হলো তাঁর নেয়ামতের প্রতি লক্ষ্য করা। তাই এর আগের আয়াতে আল্লাহর উপাসনার নির্দেশ দেয়ার পর এ আয়াতে মানুষের প্রতি আল্লাহর কিছু নেয়ামতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার চমৎকার সমন্বয় ও শৃংখলা হলো এক মহা ক্ষমতাবান ও জ্ঞানী স্রষ্টার অস্তিত্বের সেরা দলিল। তৃতীয়ত: এ আয়াত থেকে বোঝা যায় আল্লাহপাক সৃষ্টি জগতকে মানব জাতির জন্য সৃষ্টি করেছেন। অন্য সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। চতুর্থত: সৃষ্টি জগতের প্রত্যেক অংশের মধ্যে বিরাজমান সমন্বয় ও শৃংখলা থেকে এক খোদার অস্তিত্ব বোঝা যায়। এ দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে হতে হবে একত্ববাদী এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করানো চলবে না। চতুর্থত: আল্লাহকে জানা এবং তার উপাসনা করা মানুষের সহজাত বিষয়। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে এ দুই অনুভূতির অস্তিত্ব রয়েছে। তাই সূরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমরা নিজেরাই জানো।” পঞ্চমত: পানি ও মাটি হলো গাছ-পালা বেড়ে ওঠার মাধ্যম। কিন্তু এ সবের বিকাশ-বৃদ্ধি সব আল্লার হাতে। তাই আল্লাহপাক বলেছেন-“তিনিই তোমাদের জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। (২৩-২৪ নং আয়াত) কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সূরা আনো। আর যদি সত্যবাদী হও তাহলে এ কাজের জন্য আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাক্ষীকে আহ্বান কর। প্রত্যেক নবীকে তার নবুয়্যত প্রমাণ করার জন্য মুজিযা আনতে হয়। মুজিযা অর্থাৎ এমন অলৌকিক কাজ তাকে দেখাতে হয় যা অন্যদের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা:)এর মুজিযা হলো পবিত্র কোরআন। মানব জাতি ভাষা কিংবা অর্থের দিক থেকে কোরআনের মত গ্রন্থ সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অক্ষম। আল্লাহপাক ইসলাম বিরোধীদের প্রতি বহুবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন-“তোমরা যদি কোরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মনে না করো এবং একে মানব রচিত গ্রন্থ বলে মনে করো তাহলে আমার মতো একটি গ্রন্থ নিয়ে আসো।” মজার ব্যাপার হলো কোরআন দুশমনদেরকে বার বার তার চ্যালেঞ্জের শর্ত সহজ করে দিয়েছে। একবার বলেছে-কোরআনের মত কোন গ্রন্থ নিয়ে আসো। আরেক জায়গায় বলেছে-কোরআনের মত দশটি সূরা নিয়ে আসো। আর এ আয়াতে বলছে-কোরআনের মত অন্তত একটি সূরা নিয়ে আসো। এ ছাড়াও কোরআন ইসলাম বিদ্বেষীদেরকে এ চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হবার জন্য উৎসাহিত করে বলে এ কাজের সহায়তার জন্য তোমরা সারা বিশ্বে তোমাদের সব সাহায্যকারী ও সমমনা ব্যক্তিদেরকে ডাক দাও। কিন্তু জেনে রাখো যে এ কাজ করার সাধ্য তোমাদের নেই। আল্লাহর সব নবীরই মুজিযা ছিল। কিন্তু মহানবী (সা:)এর মুজিযা অর্থাৎ কোরআনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরছি। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ মুজিযা হলো সবাক। অর্থাৎ অন্যান্য নবীদের মুজিযার নিজস্ব কোন ভাষা ছিল না এবং মুজিযার অধিকারী পয়গম্বরদেরকে এর সাথে থেকে বলতে হয় যে এটি আমার মুজিযা। কিন্তু কোরআনকে কারো পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। বরং কোরআন নিজেই অবিশ্বাসীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এবং তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। কোরআন নিজেই আইন এবং নিজেই আইনের ভিত্তি। কোরআনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এটি চিরন্তন। অন্যান্য নবীদের মুজিযা একটি বিশেষ সময়ে সংঘটিত হয়েছে এবং শুধু ঐ যুগের মানুষই তা দেখেছে ও শুনেছে। কিন্তু কোরআন শুধু রাসূলে খোদা (সা:)এর যুগের জন্য মুজিযা নয় বরং সর্ব যুগের জন্য এটি মুজিযা। কালের পরিক্রমায় এ ঐশী গ্রন্থ নির্জীব তো হবেই না বরং দিন দিন এর বিষয়বস্তু আরো স্পষ্ট ও বিকশিত হবে। রাসূলে খোদার মুজিযা পবিত্র কোরআনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশ্বজনীনতা। কোরআন যেমন কোন কালের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয় তেমনি কোন বিশেষ ভূখণ্ড বা স্থানের জন্য নির্ধারিত নয়। কোরআন যাদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছে, তারা শুধু আরবভাষী হিজাবের অধিবাসী নয় বরং পৃথিবীর সকল জাতি, বর্ণ, গোত্র সবাইকে উদ্দেশ্য করে কোরআন কথা বলেছে। তাই এ আসমানী কিতাবের একটি জায়গাতেও “হে আরব জাতি” কথাটি আসেনি। বরং পৃথিবীর সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে কোরআন বলেছে “হে মানব জাতি”। মুজিযা হিসাবে কোরআন মজিদের ৪র্থ বৈশিষ্ট্য হলো এর আধ্যাত্মিকতা। অন্যান্য নবীদের মুজিযা ছিল দৈহিক ও বস্তুগত। সেসব অলৌকিক ঘটনা মানুষের চোখ কানকে বিস্মিত করত। কিন্তু কোরআন সাধারণ বর্ণমালা দিয়ে রচিত হলেও মানুষের অন্তরের মধ্যে এত গভীর প্রভাব ফেলে যে খুব সহজেই তা মানুষের জ্ঞানকে বিস্ময়ে অভিভূত করে এবং তার মন ও আত্মাকে বিমোহিত করে ফেলে। সূরা বাকারার ২৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার একে একে তুলে ধরছি। প্রথমত: পয়গম্বরগণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা আল্লাহর পূর্ণ অনুগত এবং একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করেন। তাই কোরআনের বহু জায়গায় নবীদেরকে “আমার বান্দা বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে “কোরআনকে আমি আমার বান্দার উপর নাযিল করেছি।” দ্বিতীয়ত: কোরআন হলো যুক্তির গ্রন্থ। এ গ্রন্থ কোন সন্দেহ বা সংশয়ের আবকাশ রাখে না। তাই বলা হয়েছে “যদি তোমরা সন্দেহ কর তাহলে” অর্থাৎ কোরআনের মত অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আসো। তৃতীয়ত: কোরআন হলো আল্লাহর চিরন্তন ও সার্বজনীন মুজিযা। এটি প্রত্যেক যুগেই মানুষের প্রতি তার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। চতুর্থত: ইসলাম চিরন্তন ও বিশ্বজনীন ধর্ম। কারণ ইসলামের মুজিযা কোরআন এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পঞ্চমত: আমাদের ধর্মের মূল নীতির ব্যাপারে আমাদের মধ্যে যাতে কোন সন্দেহ বা সংশয় না থাকে। সংশয়ের উদ্রেক হলে কাল বিলম্ব না করে তা দূর করা উচিৎ। যাতে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নড়বড়ে না হয়ে যায়। ষষ্ঠত: সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক হলো বিবেক। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে তোমাদের সমমনা লোকেরাও যদি সাক্ষী দেয় যে তোমাদের আনা বিষয়টি কোরআনের মত তাহলেও আমি তা মেনে নেব। অর্থাৎ আল্লাহ স্বয়ং মানুষকেই বিচারক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। সপ্তমত: কোরআনের সত্যতা এত অকাট্য যে বিরুদ্ধবাদীরা কোরআনের মত একটি সূরাও যদি আনতে পারে তাহলে আমরা সেটিকে সমগ্র কোরআনের স্থলে গ্রহণ করে নেব। এবারে সূরা বাকারার ২৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“যদি তোমরা না আনো যা কিনা কখনই পারবেনা, তাহলে সেই আগুনকে ভয় করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর। সেই আগুন প্রস্তুত রয়েছে কাফেরদের জন্য।” এর আগের আয়াতে কোরআন বিরুদ্ধবাদীদেরকে একটি সূরা নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। আর এ আয়াতে বলছে এ কাজ কখনোই সম্ভব নয়। যারা রাসূলের কথা ও বাচনভঙ্গীর সাথে পরিচিত এবং তার যুগে বসবাস করেছে তারা যেমন কোরআনের মত একটি সূরা তৈরী করতে পারবেনা, তেমনি ভবিষ্যতেও এ কাজ অসম্ভব। এরপর কোরআন অবিশ্বাসীদেরকে দোজখের আগুনের ব্যাপারে হুশিয়ারী করে দিয়ে বলে জাহান্নামের আগুনের উপকরণ হিসাবে অপরাধীদের দেহ পাথরের পাশাপাশি জ্বলবে। এ আয়াতে ‘পাথর’ বলতে পীট কয়লা বোঝানো হচ্ছে যা দোজখের আগুন সৃষ্টি করে, কিংবা পাথরের মূর্তি বোঝানো হচ্ছে । যেসব মূর্তিকে রাসূলে খোদার দুশমনরা উপাসনা করতো, আল্লাহ তাদের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে পাথরের ঐ মূর্তিগুলোকে কেয়ামতের সময় হাজির করবেন। যাতে মূর্তি পূজকেরা তাদের কৃতকর্মের কথা অস্বীকার করতে না পারে। সূরা বাকারার ২৪ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের সাথে দৃঢ়তার সাথে কথা বলতে হবে এবং ইসলামের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। এ আয়াতে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে-‘তোমরা কোরআনের মত কোন সূরা আনতে পারোনি এবং কখনও তা পারবেও না। দ্বিতীয়ত: মানুষ অবিশ্বাসের ফলে পাথর ও জড় পদার্থের কাতারে গিয়ে ঠাঁই করে নেয়। এ আয়াতে বলা হয়েছে-‘দোযখের আগুনের জ্বালানী হলো মানুষ ও পাথর। তৃতীয়ত: যে অন্তর পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে এবং কোরআনের বাণী গ্রহণ করে না, কেয়ামতের দিন সেই অন্তরের পুনরুত্থান হবে পাথরের সাথে। চতুর্থত: কোরআন কেবল রাসূলের যুগের জন্যেই মুজিযা নয় এবং এ আসমানী গ্রন্থ সব যুগের জন্য মুজিযা। তাই বলা হয়েছে-“ভবিষ্যতেও কোরআনের মত কিছু রচনা করতে পারবে না। (২৫-২৬ নং আয়াত) কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৫ ও ২৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“যারা বিশ্বাস করে এবং সৎ কাজ করে তাদের সুসংবাদ দাও যে তাদের জন্যই বেহেশত যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। যখনই তাদের তা হতে ফল-মূল খেতে দেওয়া হবে, তখনই তারা বলবে আমাদের পূর্বে জীবিকা হিসাবে যা দেওয়া হতো এতো তাই-ই। তাদেরকে অনুরূপ ফলই দেয়া হবে এবং সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী রয়েছে, তারা সেখানে স্থায়ী হবে।” আগের আয়াতে কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখানোর পর, এ আয়াতে মুমিনদের প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে করে কাফের ও মুমিনদের পরিণতি যাচাইয়ের পর সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য ঈমান সৎ কাজ ছাড়া ফলপ্রসূ হবে না। শুধু ঈমান বা শুধু ভালো কাজ কোনটিই একক ভাবে মানুষের সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে পারে না। ঈমান হচ্ছে গাছের মূল বা শিকড়ের মত আর ভালো কাজ হচ্ছে বৃক্ষের ফল স্বরুপ। গাছের সুমিষ্ট ও ভালো ফল, ঐ গাছের সুস্থ ও সবল মূলের প্রমাণ দেয়। আর সবল ও সুস্থ মূলের গাছই ভালো ফল দিতে পারে। অবিশ্বাসী বা কাফেররাও অনেক সময় ভালো কাজ করে, কিন্তু তাদের অন্তরে ঈমানের মজবুত ভিত না থাকায়, সে সব কাজ স্থায়ী হয় না। কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিন মুমিন ব্যক্তিদের স্থান হবে বেহেশত। বেহেশতের বাগানগুলো চির সবুজ এবং ফলে-ফুলে ভরা। কেননা সজীবতার উৎস পানির নহর গাছগুলোর নীচ দিয়ে সবসময় বয়ে যাচ্ছে। বেহেশতের ফলগুলো দেখতে বাহ্যত: এ দুনিয়ার মতো যাতে বেহেশবাসীরা সেগুলো দেখেই চিনতে পারে। ফলগুলো যেন তাদের কাছে অদ্ভুত বা অপরিচিত মনে হয় না। তবে স্বাদ ও গন্ধের দিক থেকে সেগুলো অনেক ভিন্ন। বেহেশতে কেউ জন্ম গ্রহণ করে না। তবে মানুষ যেহেতু সঙ্গী বিহীন থাকতে পারে না তাই বেহেশতবাসীদের জন্য সেখানে সঙ্গীনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুত-পবিত্রতা তাদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যদিও পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে বস্তুগত অনেক নেয়ামত, যেমন বাগান, প্রাসাদ, সঙ্গীনী প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আবার অনেক আয়াতে এগুলোর সাথে বেহেশতে আধ্যাত্মিক নেয়ামতের কথাও বলা হয়েছে। যেমন সূরা তওবার ৭২ নম্বর আয়াতে বেহেশতের বস্তুগত বা বৈষয়িক নেয়ামতের কথা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে-“আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ”। সূরা বায়্যেনার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” পবিত্র কোরানে বেহেশতী নেয়ামত ও ঐশ্বর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেহেশতবাসীদের স্থান ও আবাসস্থল সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘এটাই তাদের একমাত্র পুরস্কার নয়।’ এ ছাড়াও পয়গম্বর, ওলি-আউলিয়া এবং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো ও সৎ ব্যক্তিদের মাঝে অবস্থান তাদের আত্মিক প্রশান্তি বয়ে আনবে এবং এটা তাদের জন্য স্বর্গীয় উপহার। এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- প্রথমত : সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখানোর পাশাপাশি উৎসাহেরও প্রয়োজন আছে। কাফেরদেরকে জাহান্নামের ভয় দেখানোর পর এ আয়াতে মুমিনদেরকে বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত : ঈমানের বাহ্যিক রূপ হচ্ছে ভালো কাজ। এজন্য পবিত্র কোরানে এ দুটি অর্থাৎ ঈমান ও সৎ কাজ সব সময় এক সাথে এসেছে। তৃতীয়ত : পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে ভালো কাজ সেটাই যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হবে। সুতরাং সামাজিক সেবা বা সম্পূর্ণ নিজস্ব ইচ্ছায় ভালো কাজ করলে সেটা কোরআনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ঈমান আনার পর সৎ কাজ করলে সেটাই কেবল গ্রহণযোগ্য। এ দুনিয়ায় হালাল হারাম বাছতে গিয়ে মুমিন ব্যক্তিকে অনেক কিছু বর্জন করতে হয়। তবে বেহেশতে এ সব কিছু পুষিয়ে দেয়া হবে। চতুর্থত : দুনিয়ার ঐশ্বর্য ও সুখ-সমৃদ্ধি ক্ষণিকের জন্যে এবং তা অস্থায়ী। কাজেই মানুষ তা হাতছাড়া করলে দু:খ পায় এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু আখেরাত বা পরকালের ঐশ্বর্য ও সুখ-সমৃদ্ধি চিরন্তন ও তা সব সময় স্থায়ী থাকবে। কাজেই তা হারাবার ভয় থাকবে না। আর এ জন্যেই এই আয়াতে বলা হয়েছে-‘বেহেশতবাসীরা সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করবে।’ পঞ্চমত : উপযুক্ত সঙ্গীনী তাকেই বলা যায় যে সর্ব দিক থেকেই পবিত্র, বাহ্যিক কাজ-কর্ম ও অন্তরে যার কোন কলুষতা নেই। সূরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“নিশ্চয়ইই মহান আল্লাহ মশা কিংবা তারচেয়ে বড় উপমা দিতে সংকোচ বোধ করেন না। সুতরাং যারা বিশ্বাসী তারা জানে যে, এ সত্য উপমা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে এসেছে এবং যারা অবিশ্বাস করে তারা বলে এই উপমাতে আল্লাহর অভিপ্রায় কি? এর দ্বারা তিনি অনেককেই বিভ্রান্ত করেন, আবার বহু লোককে সৎ পথে পরিচালিত করেন। কিন্তু অসৎ লোক ছাড়া তিনি কাউকে বিভ্রান্ত করেন না।” ইসলামের বিরুদ্ধবাদী কাফেররা যখন পবিত্র কোরআনের অনুরুপ একটি গ্রন্থ রচনা করতে ব্যর্থ হলো, তখন তারা কোরআনের উপমাগুলোকে বাহানা হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল। তারা বললো, এ সব উপমা থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার স্থান অনেক উর্ধ্বে। সৃষ্টিকর্তা মশা, মাছি ও মাকড়সার মত তুচ্ছ উপমা দিতে পারেন না, এসব মানুষেরই কাজ। আসলে ইসলামে অবিশ্বাসী কাফেররা আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তাকেই বিশ্বাস করতো না। এ সব কথা বলার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোরআন ও পয়গম্বরের উপর মুসলমানদের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দেয়া এবং তাদের ঈমানকে দুর্বল করে দেয়া। তা ছাড়া পবিত্র কোরআনের সব উপমাই এ ধরণের নয়। যেমন এর আগে মুনাফিক বা কপট ব্যক্তিদেরকে অন্ধকারে আলোহীন বিপদ সংকুল পথে আটকে পড়া পথিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর উদাহরণ বা উপমা ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তব অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে তোলা। যখন কেউ দুর্বল প্রতিপক্ষের বর্ণনা দিতে চায়, তখন কোন দুর্বল বস্তু বা প্রাণীর উপমা দিয়ে তার বর্ণনা তুলে ধরে। যেমন পবিত্র কোরআনের সুরা হজ্জ্বের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা কর তারা তো কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এমনকি এ উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হলেও। এবং মাছি যদি কিছু নিয়ে চলে যায় তাও তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না।” সূরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহপাক মাছি বা তারচেয়ে ছোট প্রাণীকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করেন না। কেননা উপমাতো কেবল বাস্তব অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে বোঝাবার জন্য। তাই মানুষের জন্য অধিক বোধগম্য বিষয়কেই উপমা হিসাবে ব্যবহার করা উচিৎ। উপমা বা উদাহরণের ক্ষেত্রে মশা বা বিশাল হাতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যেটা বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই ব্যবহার করা উচিৎ। অবশ্য পবিত্র কোরআনের উপমাগুলো সম্পর্কে দুই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন মানুষ দেখা যায়। এর মধ্যে যারা সত্য সন্ধানী এবং কোরআনের উপমাগুলোর নিগূঢ় তত্ত্ব উপলদ্ধি করতে সক্ষম তারা এ সব উপমা থেকে সত্যের সন্ধান লাভ করেন এবং বস্তুজগতের নিগূঢ় তত্ত্ব তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। অপর দিকে যাদের অন্তর পবিত্র কোরআন ও ইসলামের মহান নবীর প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতায় পূর্ণ তারা পবিত্র কোরআনের অর্থ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং কোরআন ও পয়গম্বরের ব্যাপারে দোদুল্যমনার কারণে ঐশী পথ নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। এ আয়াত দুটি থেকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-কোন গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয় সব সময় সহজ ভাষায় বর্ণনা করা উচিৎ যাতে সাধারণ মানুষও ভালো করে বুঝতে পারে এবং মহান আল্লাহর ক্ষেত্রেও এ কাজ দোষণীয় নয়। পবিত্র কোরানে অত্যন্ত বাস্তব ভিত্তিক উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য কখনো কোন প্রাণীকে, আবার কখনো প্রকৃতির কোন ঘটনা যেমন বৃষ্টি ও বজ্রপাতকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গুনাহ বা পাপ মানুষকে সত্য উপলদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং বিভ্রান্তি ও বিপথগামীতায় নিমজ্জিত করে। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে সবই সত্য ও বাস্তব। সৎ পথ প্রাপ্তি বা বিপথগামীতা ঐ মহা সত্যের ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ফল। (২৭-২৮ নং আয়াত) কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের এ পর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। তো চলুন প্রথমেই সূরা বাকারার ২৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“যারা আল্লাহর অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যা অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” আগের আয়াতে ফাসেক লোকদের বিভ্রান্তির কথা বলা হয়েছিল, আর এ আয়াতে ফাসেকদের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত: তারা আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং নিজেদের কামনা বাসনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। এ আয়াতে আল্লাহর অঙ্গীকার বলতে মানুষের অন্তরে ঐশী বিশেষ প্রেরণার কথা বোঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে এই সহজতর ঐশী প্রবণতাসহ সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যা বিচার করতে পারে এবং নবীদের আহ্বানে সাড়া দিতে পারে। দ্বিতীয়ত: মহান আল্লাহ যে সব অঙ্গীকার রক্ষা করতে বলেছেন ফাসেক ব্যক্তি তা ভঙ্গ করে। এসব অঙ্গীকার নবী রাসূলদের সাথে ধর্মীয় অঙ্গীকারই হোক বা অপরাপর মুমিন ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক কিংবা আত্মীয় স্বজনদের সাথে পারিবারিক প্রতিশ্রুতিই হোক। মন্দ কাজও অনাচারের বি¯তৃতি ঘটায়। তারা মনে করে তাদের পাপের প্রতিফল কেবল তারাই ভোগ করবে, অথচ তারা জানে না পাপের সামাজিক প্রভাব ব্যক্তিক প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশী। পাপ ও অনাচার সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, যে ব্যক্তি এশী অঙ্গীকার এবং মানুষের সাথে তার প্রতিশ্রুতি ও সম্পর্কের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না এবং নিজের খেয়াল খুশীমত কাজ করে, সে নিজেরই ক্ষতি বয়ে আনে। কারণ সে তার পার্থিব এবং ঐশী সম্পদ দুটিই হাত ছাড়া করে এবং পরিণামে অপমান ও অপদস্থ হয়। সূরা বাকারার ২৭ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে- প্রথমত: অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অপছন্দনীয় কাজ। মুমিন ব্যক্তি কখনও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনা, এমনকি কাফেরদের সাথেও সে তার অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কথা সে চিন্তাও করেনা। দ্বিতীয়ত: বিচারবুদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির রায়কে উপেক্ষা করলে মানুষ সাধারণতঃ পাপে লিপ্ত হয় এবং সমাজ পাপ-পঙ্কিলতায় ভরে ওঠে। ইসলামের বিধি-বিধান ও সহজাত ঐশী প্রবণতাকে উপক্ষা করলে, মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূরা বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ” আমার প্রতিশ্রুতি, অত্যাচারীদের উপর পড়ে না।” এ আয়াত অনুযায়ী ঐশী নেতৃত্ব ও ইমামত হচ্ছে আল্লাহর অঙ্গীকার। এ আয়াতে বলা হয়েছে ফাসেক লোকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ ধরণের অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। ইসলাম, মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা বিভেদ চায় না। আর এ জন্যেই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বিশেষ করে পিতামাতার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং সম্পর্ক জোরদার করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ইসলাম পরিবার বা সমাজ থেকে দূরে থাকার বিরোধী। ইসলাম চায় মুসলমানরা দলদ্ধভাবে থাকুক। এজন্য জুমার নামাজ এবং জামাতে নামাজ পড়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থদের দেখতে যাওয়া দুঃস্থদের সাহায্য এবং প্রতিবেশীদের বিপদে আপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া, ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই পছন্দনীয় কাজ। ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবারে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা যাক। হাদীস শরীফে এসেছে, তোমরা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে। এতে করে দরিদ্রতা দূর হবে, জীবিকা বৃদ্ধি পাবে এবং জীবন হবে বরকতময়। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রক্তের সম্পর্ক রক্ষার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে, যদিও তারা তোমাকে উপেক্ষা করে এবং সৎলোক না হয়। এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি হাদীস হচ্ছে-প্রথমত: রক্তের সম্পর্ক রক্ষার জন্য এক বছর ধরে হাটার প্রয়োজন হলে কিংবা সালাম দেয়া অথবা পানি পান করাবার মত সামান্য সময়টুকু থাকলেও তা পালন কর। দ্বিতীয়ত: যে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে মৃত্যু এবং পরকালের হিসাব তার জন্য সহজ হবে এবং বেহেশতে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হবে। এবারে সূরা বাকারার ২৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- ” কিভাবে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার কর, অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনিই তোমাদের জীবিত করেছেন আবার তোমাদের নির্জীব করবেন। পূনরায় তোমাদের জীবিত করবেন, অবশেষে তারই দিকে তোমরা ফিরে যাবে।” আল্লাহকে চেনার সর্বোত্তম উপায় হলো বিশ্বজগত এবং মানব সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা। জীবন ও মৃত্যু নিয়ে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে মানুষ এ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে যে, আমি যদি নিজেই আমার স্রষ্টা হতাম তাহলে অবশ্যই চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী হতাম। কিন্তু একসময় আমরা ছিলাম না, পরে অস্তিত্ব লাভ করেছি এবং পূনরায় মৃত্যুবরণ করতে করতে হবে। কাজেই এই প্রাণ বা জীবনই হচ্ছে আমাদের জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ বা নেয়ামত। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত অগ্রসর হবার পরও এখন পর্যন্ত এই প্রাণের স্বরূপ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। আমরা নিজের ইচ্ছায় আসিনি, কাজেই নিজ ইচ্ছায় যেতেও পারব না। স্রষ্টা আমাদের অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আমল বা কাজই হচ্ছে আমাদের একমাত্র সম্বল। সুতরাং যে স্রষ্টার হাতে আমাদের শুরু এবং শেষ, তার অস্তিত্বকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? অথবা মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থানকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? কেননা পুনরুত্থান বা মৃত্যুর পর পূনরায় জীবিত করা প্রথমবার সৃষ্টির করার চেয়ে অনেক সহজ কাজ। যে স্রষ্টা আমাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে, অস্তিত্ব বা প্রাণ দিয়েছেন, তিনি কি মৃত্যুর পর মানুষকে পূনরায় জীবিত করতে পরবেন না? এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: মানুষকে হেদায়েতের জন্য কুরআনের একটি বিশেষ পন্থা হচ্ছে, মানুষের বুদ্ধি বিবেক এবং সহজাত প্রবৃত্তির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া। যাতে চিন্তার মাধ্যমে মানুষ সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারে। দ্বিতীয়ত: মানুষের জীবন আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে, আর মৃত্যু পুনরুত্থান দিবসের ইঙ্গিত বহন করে। তৃতীয়ত: নিজেকে জানা, খোদাকে চেনারই ভূমিকা মাত্র। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টাকেও চিনতে পারে। কেননা সে বুঝতে পারে তার নিজস্ব বলতে কিছুই নেই, সব কিছু মহান আল্লাহর। চতুর্থত: মানুষের পূর্ণতার সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে, মহান প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন করা। পঞ্চমত: মৃত্যুই মানব জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং এর মাধ্যমে নতুন জীবনের সুচনা হয়। ষষ্ঠত: মৃত্যুকে অস্বীকার করার পেছনে কাফেরদের কোন যুক্তি-প্রমাণ ছিলো না। তাই তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করতো। পবিত্র কোরআন মানুষের সর্বপ্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তাদের সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিয়েছে। ( ২৯-৩০ নং আয়াত) কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আমরা সূরা বাকারার ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা বাকারার ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দেন এবং তা সপ্ত আকাশে বিন্যস্ত করেন। তিনি সব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করার পর, আমাদের আরাম আয়েশের জন্য সব উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করে তা, মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। কেননা মানুষই হচ্ছে খোদার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কাজেই জমিন ও আসমানের সকল জীব-জন্তু, গাছপালা এবং সব জড় বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ জন্যই পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে-“এ ভূপৃষ্ঠের সব কিছুই মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।” এছাড়া সুরা জাসিয়ার ১৩ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।” মহান আল্লাহর একত্ববাদের একটি অন্যতম দলিল হচ্ছে, আকাশের অত্যন্ত জটিল ও সুসমন্বিত গঠন প্রকৃতি। বিজ্ঞানীরা আকাশের এ জটিল সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। এ ভূপৃষ্ঠ যেখানেই নানা রকম উদ্ভিদ, গাছপালা, জীব-জন্তু, হাজার রকমের ফল-ফলাদি ও বহু ঐশ্বর্যের সমাহার দেখা যায়, তা হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রহ। পবিত্র কোরআন এ ক্ষেত্রে এক বচন (আল আরদ্) শব্দটি ব্যবহার করেছে। তবে আসমানের ক্ষেত্রে কোরআনের বহু আয়াতে বহু বচনের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন একটি আয়াতে রয়েছে-“মহান আল্লাহ বিশেষ প্রজ্ঞা ও শক্তির মাধ্যমে সপ্ত আসমান সৃষ্টি করে, তা মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।” পবিত্র কোরআনের মতে আকাশ হিসাবে মানুষ যা দেখতে পায় তা মূলত: আকাশের সবচেয়ে নীচের স্তর। আকাশের অন্য একটি স্তর মানুষের নাগালের বাইরে। এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ বিশ্বজগত মূলত: মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: মহান আল্লাহ এ সৃষ্টিজগতকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন, কাজেই আমাদের উচিত একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করা। তৃতীয়ত: এ বিশ্বপ্রকৃতির কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করা হয়নি বরং প্রতিটি বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও এর অনেক কিছুর উপকারীতা সম্পর্কে মানুষ এখনও অজ্ঞ। চতুর্থত: এ পৃথিবী মানুষের জন্য। মানুষকে পৃথিবীর জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। এ পৃথিবী লক্ষ্যস্থল নয় বরং এটি অতিক্রম করার স্থান মাত্র। পঞ্চমত: প্রকৃতির যে কোন ঐশ্বর্যকে কাজে লাগাতে কোন বাধা নেই। তবে ঐশী বিধান কিংবা মানুষের বিবেক বুদ্ধি যদি কোন কিছুকে মানুষের জন্য অকল্যাণকর মনে করে, তবে তা ব্যবহার করা বৈধ নয়। এবারে সূরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন নিশ্চয়ইই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করবো, তারা বললো আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? আমরাইতো আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।” আগের আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য অফুরন্ত বস্তুগত ঐশ্বর্য্য প্রেরণার কথা বলেছেন। আর এ আয়াতে মানুষ যে বিশেষ মর্যাদার কারণে এতসব নেয়াতম ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার পর ফেরেশতাদেরকে আদমের বিশেষ মর্যাদা ও গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত করে এবং জানায় যে মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা শুনে ফেরেশতারা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলে, যার সন্তানরা পৃথিবীতে রক্তপাত ঘটাবে এবং অশান্তি সৃষ্টি করবে, তাকে কিভাবে আল্লাহর প্রতিনিধি বানানো যাবে? ফেরেশতাদের প্রস্তাব ছিল, মহান আল্লাহ যদি একান্তই পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি পাঠাতে চায় তাহলে এমন একজনকে নির্বাচন করা উচিৎ যে সব ধরণের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত এবং আল্লাহর একান্ত অনুগত হবে। আর এ জন্যই আদম বা মানুষের কথা শুনে ফেরেশতারা বিষ্মিত হয়। কারণ মানুষের প্রবণতা এবং সহজাত গুণাবলী সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল। আর এ কারণেই ফেরেশতারা যারা সর্বক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন তাদের পরিবর্তে কেন মানুষকে এ মর্যাদা দেয়া হলো, তারা তা জানতে চান। ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তরে মহান আল্লাহ বলেন-“তোমরা কেবল দুর্বল দিকগুলো দেখেছো, মানুষের মর্যাদা ও বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে তোমরা অজ্ঞ। আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। তোমরা ফেরেশতারা সর্বক্ষণ আমার ইবাদত ও প্রশংসায় মশগুল থাকার কারণে যদি নিজেদেরকে আমার প্রতিনিধি হবার যোগ্য মনে কর, তবে জেনে রাখো মানুষের মধ্যেও এমন অনেকে রয়েছেন যারা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং মর্যাদা লাভের যোগ্য।” তবে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি নয়। আল্লাহর প্রতিনিধি হবার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহ যিনি মানুষের মধ্যে নিজ রুহ ফুঁকে দিয়েছেন, তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হবার সব ধরণের যোগ্যতা ও সামর্থ রয়েছে। এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো নবী-রাসূল, ইমামগণ, শুহাদা এবং সৎ ব্যক্তিরা। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা এ ঐশী প্রেরণাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে, মানবতার সর্বনিু স্তরে গিয়ে পৌঁছায়। পবিত্র কোরআন এ ধরণের লোকদের সম্পর্কে বলেছে-“তারা হচ্ছে চতুষ্পদ জন্তুর মতো, এমনকি তার চেয়ে নীচু ও নিকৃষ্ট। মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে নির্ধারণ করার অর্থ এই নয় যে, মহান আল্লাহ এ পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে অক্ষম বরং এর মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। মহান আল্লাহ নিজেই এ পৃথিবীর সকল কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হলেও তিনি বিভিন্ন সরঞ্জামের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করেন। যেমন ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-“এ বিশ্বজগত পরিচালনার দায়িত্ব তাদের, অথচ মহান আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত পরিচালক।” এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- প্রথমত: সৃষ্টিজগতে মানুষের মর্যাদা এত উপরে যে মহান আল্লাহ মানুষের সৃষ্টি বা মানুষকে তার প্রতিনিধি বানাবার বিষয়টি ফেরেশতাদের কাছে উত্থাপন করেছেন। দ্বিতীয়ত: প্রতিনিধি নিয়োগের পুরো দায়িত্ব মহান আল্লাহর অন্য কারো নয়। তৃতীয়ত: কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা হলো, প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং পরে তার বর্ণনা দেয়া। মহান আল্লাহ মানব সৃষ্টি এবং মানুষকে তার প্রতিনিধি বানাবার ক্ষেত্রে এ পন্থা প্রয়োগ করেছেন এবং এ সম্পর্কে ফেরেশতাদের অজ্ঞতা দূর করেছেন। চতুর্থত: শাসক বা ঐশী প্রতিনিধিকে ন্যায় বিচারক হতে হবে। ফাসেক বা কলুষিত ব্যক্তি এ মর্যাদার উপযুক্ত নয়। আর এ জন্যই ফেরেশতারা বলেছিলো, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মানুষ কি করে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারে? পঞ্চমত: নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করার সময়, অপরের কেবল দোষ-ত্রুটি ও দুর্বল দিক, আর নিজের ভালো দিকটাই দেখা ঠিক নয়। ষষ্ঠত: ইবাদত কেবল মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। ফেরেশতারা আল্লাহর ইবাদত ও প্রশংসা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে অগ্রগামী হওয়া সত্ত্বেও, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারেনি। সপ্তমত: কিছু লোকের অনিষ্টতা ও বিভ্রান্তির কারণে, অন্যদের বিকাশ লাভের পথ রুদ্ধ করে দেয়া ঠিক নয়। মহান আল্লাহ এটা ভালো করেই জানতেন যে, এক শ্রেণীর মানুষ ভুল পথে চলবে, কিন্তু তারপরও তিনি মানুষকে তার প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেননি। অষ্টমত: কোন কিছু সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করতে দোষ নেই। ফেরেশতারা আল্লাহর কাজের প্রতিবাদ জানাবার জন্য প্রশ্ন করেননি বরং নিজেদের ধারণা আরো স্পষ্ট করার জন্যই প্রশ্ন করেছিলেন। (৩১-৩৩ নং আয়াত) আজকের পর্বে সূরা বাকারার ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ আদমকে সমস্ত নাম শিক্ষা দিলেন। এরপর ফেরেশতাদের সামনে হাজির করলেন এবং বললেন যদি তোমরা সত্যবাদী হও, এই সমস্তের নাম আমাকে বল। তারা বলল আপনি পরম পবিত্র, আপনি যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই।” মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে মানুষের মর্যাদা তুলে ধরার জন্য উভয় দলকেই পরীক্ষা করেন। মানুষ ও ফেরেশতা উভয়কেই তিনি জ্ঞান শিক্ষা দেন এবং পরে এ সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন করেন। তবে এই জ্ঞান কী ধরনের ছিল সে সম্পর্কে কোরআন কিছু বলেনি। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, মহান আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতেই এ বিশ্বজগত ও প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিয়েছেন এবং এগুলোর নামের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আর এটাই হচ্ছে মানুষের সহজাত জ্ঞান, যার মাধ্যমে মানুষ কোন বস্তুকে চিনতে পারে। যেহেতু ফেরেশতারা ভেবেছিল ইবাদতের কারণে তারা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাই মহান আল্লাহ প্রথমে তাদেরকেই পরীক্ষা করেন এবং বলেন, যদি তোমরা নিজেদের দাবী সম্পর্কে নিশ্চিত হও তাহলে আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয় শিক্ষা দিয়েছি সেগুলো এবার বল। ফেরেশতাদের ভুল ভাঙ্গে এবং তারা বুঝতে পারে কেবল ইবাদতই আল্লাহর প্রতিনিধি হবার জন্য যথেষ্ট নয় বরং এর জন্য উন্নত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। কাজেই আল্লাহর প্রশ্নের জবাবে তারা বললো- আপনি পরম পবিত্র, নিশ্চয়ইই মানব জাতিকে পৃথিবীতে আপনার প্রতিনিধি হিসাবে নির্ধারণ করার পেছনে বিশেষ কোন যুক্তি বা বৃহৎ স্বার্থ রয়েছে। আর এ কারণেই আপনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বাইরে কোন কিছুই আমরা জানি না। মানুষের বিশেষ ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ ছিলাম। হে মহান প্রতিপালক! আপনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী এবং প্রতিটি কাজ যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে সম্পন্ন করেন। সূরা বাকারার ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- এক : মহান স্রষ্টাই হলেন মানব জাতির প্রথম শিক্ষক। কেননা তিনিই মানুষকে সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষের জন্য মানুষ এ ঐশী প্রেরণার কাছে ঋণী। দুই : মানুষ এ বিশ্বজগতের সকল রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষমতা রাখে, যদিও এ ব্যাপারে এখনও সে তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। তিন : ফেরেশতা সহ অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা শক্তির কারণে। চার : ঐশী প্রতিনিধি হবার জন্য ইবাদতের চেয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বেশী প্রয়োজন। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তার জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেকের কথা উল্লেখ করেছেন। পাঁচ : মহান আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত শিক্ষক। বইপত্র কিংবা শিক্ষক হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম মাত্র। ছয় : অশোভনীয় বা অনুচিত কথা বলার পর, সাথে সাথে মাফ চেয়ে নেয়া ঐশী রীতি। কেননা ফেরেশতারা যখনই তাদের ভুল উপলব্ধি করলো, তখনই সুবহানাকা শব্দটি উচ্চারণ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাত : অজ্ঞতা প্রকাশে কুণ্ঠা বোধ করা ঠিক নয়। কারণ এতে লজ্জার কোন কারণ নেই। আল্লাহর ফেরেশতারা খুব সহজেই নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আট : অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষ মুক্তি পেতে পারে। ফেরেশতারা ভেবেছিলো ইবাদতের কারণে তারা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার পরপরই তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং মহান আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু শয়তান আগুন থেকে সৃষ্টি হবার কারণে নিজেকে মাটির তৈরী মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে। এ ব্যাপারে গোঁড়ামী ও একগুঁয়েমির কারণে শয়তান মহান আল্লাহর দরবার থেকে বহি®কৃত হয়। এবারে সূরা বাকারার ৩৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ বললেন হে আদম! এদের সবার নাম বলে দাও। যখন সে তাদের এসব নাম বলে দিল, তিনি বললেন-আমি কি তোমাদের বলিনি যে নিশ্চয়ই আমি আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ে অবগত আছি এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও গোপন কর তাও আমি জানি।” আল্লাহর পরীক্ষায় আদম সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন এবং ঐশী শিক্ষার আলোকে সৃষ্টিজগতের সকল রহস্য ফেরেশতাদের কাছে বর্ণনা করলেন। ফলে ফেরেশতারা বুঝতে পারলেন যে, মহান আল্লাহ মানুষকে শিক্ষার যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়েছেন, আর তারা এ যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত। এ পরীক্ষা শেষ হবার পর, মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা ভেবেছিলে ঐশী প্রতিনিধিত্ব পাবার পুরোপুরি যোগ্য কেবল তোমরাই। তোমরা এ ধারণা মনের মধ্যে লালন করছিলে। কিন্তু কখনও তা প্রকাশ করোনি। জেনে রাখো মহান আল্লাহ যেমনিভাবে তোমাদের প্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে জানেন, তেমনি তোমাদের অন্তরের কথাও তিনি জানেন। সৃষ্টি জগতের সব কিছুই তারই আওতাধীন। মহান আল্লাহ মানুষ ও প্রতিটি বস্তুর প্রকাশ্য ও গোপন দিক সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। এ আয়াতে এ বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যেহেতু বিশ্ব প্রকৃতির গূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবহিত নয় এবং শুধু মাত্র বাহ্যিক দিকটিই দেখতে পায় কাজেই আল্লাহর সিদ্ধান্তে সে যেন অযথা বিচলিত না হয় এবং কোন বিরুপ মনোভাব পোষণ না করে। কেননা মহান আল্লাহ সীমাহীন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এবং সে মোতাবেক প্রতিটি কাজ করেন। এ বিশ্ব জগতের কোথাও যদি মানুষের কাছে কোন কিছু অসামঞ্জস্য মনে হয়, তা মূলত মানুষের অজ্ঞতা প্রসূত। আল্লাহর কাজে কোন খুঁত নেই। এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: মানুষ জ্ঞান ও শিক্ষার দিক থেকে ফেরেশতাদের উর্ধ্বে। মানুষের শেখার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু ফেরেশতাদের এ বৈশিষ্ট্য নেই। ফলে আদম(আঃ) যে সব কথা বলতে পেরেছিলেন, ফেরেশতারা তা বলতে পারেননি। দ্বিতীয়ত: যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন। মহান আল্লাহ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের কাছে তা প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষার আয়োজন করেছেন। তৃতীয়ত: ফেরেশতারা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে ঠিক ততটুকুই জানেন, মহান আল্লাহ তাদের যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন। কেননা আগের একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-“আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।” আর এ আয়াতে বলেছেন-“আমি পৃথিবী ও আকাশের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছি। চতুর্থত: মানুষের প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরী করা উচিত। মহান আল্লাহ পরীক্ষার আয়োজন করে আদম(আঃ)এর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন যাতে মানুষ তার যোগ্যতা সম্পর্কে অবগত হয় এবং অন্যরাও তা বুঝতে পারে। (৩৪-৩৫ নং আয়াত) কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজ আমরা সূরা বাকারার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম তোমরা আদমের প্রতি সিজদা কর, ইবলিশ ছাড়া সবাই সিজদা করলো, সে অমান্য ও অহংকার করলো এবং অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হল।” আগের আয়াতগুলোতে মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক নেয়ামত এবং সুযোগ সুবিধার কথা এক এক করে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে মানুষের বিশেষ মর্যাদার করণেই তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব দেয়া হয়েছে। আর এ আয়াতে মানুষের জন্য একটি মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে আদমের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদার বিষয়টি। যেমনটি সূরা স্বোয়াদ এবং সূরা হেজরে রয়েছে, মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সময় ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলেছেন-“যখন আমি মানুষকে সুগঠিত করবো, তখন তার মধ্যে স্বীয় প্রাণ সঞ্চার করবো। এরপর তোমরা তার সামনে সেজদাকারীরূপে প্রণত হইও। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের জন্য ফেরেশতারা মানুষকে সেজদা করেননি, বরং মানব হিসাবে সৃষ্টির কারণেই তাকে সিজদা করেছিলেন। আদমের উপর ঐশী প্রতিনিধিত্ব অর্পন করার পর যদি মহান আল্লাহ সেজদার নির্দেশ দিতেন তাহলে সেটা ফেরেশতাদের জন্য গৌরবের কারণ হতো না। কারণ তখন তারা আদমের বিশেষ মর্যাদার কারণেই তার সামনে মস্তক অবনত করতেন। আল্লাহর নির্দেশ পালন করাটা তাদের জন্য মূখ্য হয়ে উঠতো না। সূরা কাহাফের ৫০ নম্বর আয়াতের আলোকে বলা যায়, জ্বীন সম্প্রদায়ের ইবলিস একনিষ্ঠ ইবাদতের কারণেই ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। কিন্তু অহংকার ও আত্মম্ভরীতার কারণে সে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। সে ভেবেছিলো সৃষ্টির দিক থেকে সে আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা মর্যাদাবান। কাজেই আদমকে সেজদা করা তার জন্য মোটেই শোভনীয় নয় বরং আদমের উচিত তাকে সেজদা করা। ইবলিস কেবল কাজের ক্ষেত্রেই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে পাপ করেনি। বরং ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকেও সে আল্লাহর নির্দেশকে ইনসাফহীন ও অবিবেচনা প্রসূত ভেবে কুফরী করেছে এবং ইমান হাতছাড়া করেছে। ফেরেশতারা উপাসনার উদ্দেশ্যে আদমকে সিজদা করেননি। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা বৈধ নয়। বরং তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য আদমের সম্মানার্থে সিজদা করেছেন। কাজেই ফেরেশতারা মূলত আল্লাহকেই সেজদা করেছেন। এবারে সূরা বাকারার ৩৪ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো তুলে ধরছি। প্রথমত: আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কোন কাজ করাই প্রকৃত ইবাদত। আল্লাহর যে নির্দেশ বা বিধান মানুষের মনপুত: হবে, তা পালনের মাধ্যমে ইবাদত সম্পন্ন হয় না। ইবলিস কয়েক শতাব্দী ধরে আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করতে প্রস্তুত ছিলো, কিন্তু আদমের সামনে মূহুর্তের জন্যও সেজদা করতে রাজি হয়নি। দ্বিতীয়ত: সমস্ত ফেরেশতা মানুষকে সিজদা করবে অথচ মানুষ আল্লার সামনে সেজদা করবে না, এটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। তৃতীয়ত: স্রষ্টার সামনে অহঙ্কার ও আত্যম্ভরীতা করলে মানুষ বেঈমান ও ধর্মহীন হয়ে পড়ে। চতুর্থত: আল্লাহর নির্দেশে অন্য কারো সামনে সেজদা করা শিরক তো নয়ই বরং ইবাদতের শামিল। পঞ্চমত: বয়স এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ফেরেশতারা যুগ বা কালের দিক থেকে অনেক পুরনো হওয়া সত্ত্বেও আদমকে সিজদা করেছেন। ষষ্ঠত: আদমকে সেজদার উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তি আদমকে সেজদা করা নয় বরং মানব জাতির সামনে নত হওয়া। যেমন সূরা আরাফের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তারপর তোমাদের রূপদান করি, অতপর ফেরেশতাদের বলেছিলাম আদমকে সেজদা কর।” এবারে সূরা বাকারার ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি বললাম হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান থেকে যা ইচ্ছা তাই খাও। কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়োনা, অন্যথায় তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্বের জন্য মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য প্রথমেই তার জন্য সঙ্গিনীও সৃষ্টি করেন। যাতে আদমের প্রশান্তির পাশাপাশি পৃথিবীতে মানবজাতির বংশ বিস্তার ঘটে। তিনি তাদের জন্য সুন্দর দুটি বাগানও তৈরী করেন, যাতে সেখানে তারা বসবাস করতে পারেন এবং নানা রকম খাদ্যেরও সংস্থান হয়। এভাবে মহান প্রতিপালক হযরত আদমের জন্য পৃথিবীতে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন যাতে ধীরে ধীরে তারা এসবের ব্যবহার করতে শেখে। সব খাবার দাবারই মানুষের জন্য উপকারী নয়। তাই মহান আল্লাহ, বিশেষ কিছু খাবার দাবার বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা এসব ফল-মূল বা খাবার খেলে দেহের ক্ষতির পাশাপাশি, মানুষের আত্মারও ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। এমনকি বেহেশত থেকে বহিস্কারের সম্ভাবনা ছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে হযরত আদম যে বেহেশতে ছিলেন সেটা পরকালের প্রতিশ্রুত বেহেশত নয়। কেননা ঐ বেহেশত মূলত: ভলো কাজের প্রতিদান দেবার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাছাড়া হযরত আদম(আ:) তখনও কোন ভালো কাজ করেননি তাই প্রতিদান পাওয়ার অর্থই হয়না। যেমন সূরা আল ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-“তোমরা কি মনে কর যে তোমরাই বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং যারা জিহাদ করে এবং যারা ধৈর্যশীল, আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে এখনও তাদেরকে প্রকাশ করেননি?” যারা প্রতিশ্রুত বেহেশতে প্রবেশ করবেন তারা সেখান থেকে বহিস্কৃত হবেন না। যেমনটি সূরা হিজরের ৪৮ নম্বর আয়াতে রয়েছে-“তারা জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হবেন না।” এছাড়া প্রতিশ্রুত বেহেশতে নিষিদ্ধ গাছের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানকার সবকিছু হালাল এবং বৈধ। পৃথিবীর বিভিন্ন সবুজ শ্যামল বাগানের ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহ ‘জান্নাত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কাজেই কেবলমাত্র পরকালের প্রতিশ্রুত বেহেশতের জন্যই ‘জান্নাত’ শব্দটির ব্যবহার হয়না। সূরা ক্বালামের ১৭ নম্বর আয়াতে রয়েছে-“আমি ওদের পরীক্ষা করবো, যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান অধিপতিদেরকে” সূরা বাকারার ৩৫ নম্বর আয়াতের শিক্ষনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- প্রথমত: স্ত্রী, বাসস্থান, ও খাদ্য হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের আরাম-আয়েশ ও প্রশান্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত স্বরূপ। দ্বিতীয়ত: গৃহে নারী, পুরুষের অধীন। এ আয়াতে সব ক্ষেত্রে হযরত আদম ও হাওয়াকে উদ্দেশ্য করে সব কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু বাসস্থানের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র হযরত আদমকে সম্বোধন করা হয়েছে, আর তার স্ত্রী হাওয়াকে তার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, হে আদম আপনি নিজ সহধর্মিনীর সাথে জান্নাতে বসবাস করুণ। তৃতীয়ত: কোন জিনিস নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে সেই প্রয়োজন মেটাবার সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে হবে। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন। এজন্যই মহান আল্লাহ প্রথমে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের ব্যবস্থা করার পর তাদেরকে একটি বিশেষ বৃক্ষের ফল গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। চতুর্থত: গুনাহ বা পাপ এত বিপদ জনক যে, তা থেকে দূরে থাকা উচিত। আর এজন্যই মহান আল্লাহ, এ বিশেষ বৃক্ষটি খেয়োনা এর পরিবর্তে বলেন অর্থাৎ এ বৃক্ষের কাছে যেয়ো না। পঞ্চমত: আল্লাহর নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে তার ক্ষতি মূলত: মানুষেরই হয়। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা নিজের উপর জুলুম করারই শামিল। এর ফলে মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ষষ্ঠত: খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও মানুষকে পুরোপুরি আল্লাহর অনুগত হতে হবে। আল্লাহ যেসব খাবার মানুষের জন্য উপকারী ও বৈধ করেছেন তাই খাওয়া উচিত। আর যেসব খাবার নিষিদ্ধ করেছেন, সেসব বর্জন করা উচিত। (৩৬-৩৭ নং আয়াত) আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“এরপর শয়তান, আদম ও তার স্ত্রীকে পথভ্রষ্ট করলো এবং তারা যে বেহেশতে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিস্কৃত করল। সে সময় তাদেরকে বললাম তোমরা নীচে নেমে যাও একে অন্যের শত্র” হিসাবে। পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। গত পর্বেও আমরা হজরত আদম(আঃ) এর সৃষ্টির ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছি। তখন বলেছিলাম আল্লাহপাক হজরত আদম ও বিবি হাওয়ার জন্য বেহেশতের মত একটি বাগানে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে তাদের জন্য সব ধরণের খাবার ও ফলমূলের ব্যবস্থা করা হয়। শুধু নিষেধ করা হয় একটি বিশেষ গাছের ফল খেতে। কারণ ঐ ফল ছিল তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের আত্মার উপর জুলুমের শামিল। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শয়তান হযরত আদমকে সেজদা না করায় আল্লাহ তাকে তার দরবার থেকে বহিষ্কার করেন। আর এজন্য শয়তান প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে উঠে। তার সব রোষ গিয়ে পড়ে হযরত আদম(আঃ)এর উপর। শয়তান প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। যেভাবেই হোক হযরত আদমকে শান্তিপূর্ণ ও আরামের স্থান থেকে বহিষ্কার করবে বলে ঠিক করলো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শয়তান নানা কূটবুদ্ধি, ওয়াস-ওয়াসা ও চাল চেলে বুঝালো সে হযরত আদম আর বিবি হাওয়ার মঙ্গল চায়। ঐ নিষিদ্ধ ফলের সীমাহীন প্রশংসা আর উপকারীতা বর্ণনার ফলে একসময় সত্যি সত্যিই হযরত আদম আর বিবি হাওয়া শয়তানের ফাঁদে পা দিয়ে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত শয়তানের কুমন্ত্রনায় তারা ঐ নিষিদ্ধ ফল খেলেন। হযরত আদম(আঃ) এবং বিবি হাওয়ার অবশ্য আল্লাহর নির্দেশ আমান্য করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল অনেকটা ঐ শিশুর মত, যারা কিনা মিথ্যা, ধোকাবাজি ও কুটকৌশলের কোন অভিজ্ঞতাই নেই। শিশু যেমন সবাইকে সৎ সত্যবাদী মনে করে তেমনি সৃষ্টির প্রথম মানব হযরত আদম ও প্রথম মানবী বিবি হাওয়া শয়তানকে সত্যবদী ভেবে বসল। শয়তান যখন কসমের পর কসম খেয়ে তাদেরকে নিষিদ্ধ করার ফলে উপকারীতা ও গুনাগুন বর্ণনা করলো তখন তারা তাকে সরল শিশুর মত বিশ্বাস করে ধোকা খেল। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ফলে তারা বেহেশত থেকে বহি®কৃত হলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো তোমরা আল্লাহর দরবার থেকে নীচে নেমে যাও। শয়তান ও তোমরা শত্র”তে পরিণত হয়েছো এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে পৃথিবীতে বসবাস করতে হবে। আদমকে সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীতে তার খেলাফত বা প্রতিনিধিত্ব করা। তাই হযরত আদমকে পৃথিবীতে আসতেই হতো। এজন্য আল্লাহপাক প্রথমে তার জন্য সমস্যামুক্ত শান্তিপূর্ণ একটি স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন, যাতে তিনি পৃথিবীতে আগমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পরেন। পৃথিবীর অবস্থার সাথে পরিচিত হন এবং প্রকৃত শত্র” অর্থাৎ শয়তানকে ভালোভাবে চিনতে পারেন। সূরা বাকারার ৩৬ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত:শয়তানের আনুগত্য মানুষকে শুধু আল্লাহর কাছ থেকেই দুরে সরিয়ে নেয়না, একই সাথে মানুষকে প্রকৃত শান্তি থেকেও বঞ্চিত করে এবং তাকে নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ফেলে। যেমনটি হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার জীবনে লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয়ত: মানুষের সাথে শয়তানের শত্রুতার ইতিহাস অতি প্রাচীন এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু হয়ে এখনও তা চলছে। তৃতীয়ত: পৃথিবী মানুষের অস্থায়ী আবাস। তাই বেহেশতে স্থায়ী আবাস গড়ার চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হবে। চতুর্থত: আল্লাহর দেয়া অশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভার কারণে প্রত্যেক মানুষই বেহেশতী। কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করার ফলে সে অতল গহ্বরে গিয়ে পড়ে। পঞ্চমত: কোন মানুষ পাপ ও ভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়। যদি না আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। যে আদম পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা এবং ফেরেশতাদের সাহচায লাভ করেছেন সেই হজরত আদম(আঃ) মুহূর্তের গাফলতীর জন্য আল্লাহর দরবার থেকে বহি®কৃত হন। অবশ্য হজরত আদম(আঃ) এর এই ভুল ছিল তার নবুয়্যত লাভের আগের ঘটনা। এবারে সূরা বাকারার ৩৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ সূরা বলা হয়েছে-“এরপর আদম তার প্রতিপালকের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা লাভ করল। এরপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল দয়াময়।” সেই শান্তিময় স্থান থেকে বহিষ্কৃত হয়ে কষ্টকর পৃথিবীতে নেমে আসার পর আদম তার ভুল এবং শয়তানের ধোকা বুঝতে পারলেন। তাই তিনি অনুশোচনা করতে লাগলেন এবং কিভাবে তওবা করা যায় সে পথ খুঁজতে লাগলেন। এখানেও আল্লাহপাক হযরত আদমকে অসহায়ভাবে ছেড়ে দিলেন না। তিনি হজরত আদমকে তওবা এবং অনুশোচনা করার ভাষা শিক্ষা দিলেন। সেই বাণী সূরা আরাফের ২৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে-“তারা বলল হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি। যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না কর, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভক্ত হবো।” এই ভাষা কেবল হযরত আদম (আঃ) এর তওবার জন্যেই নির্দিষ্ট নয় বরং হযরত ইউনুস ও হযরত মুসা (আঃ)এর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন কোরানে হযরত মুসা (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে-“তিনি বললেন-হে আমার প্রতিপালক,আমি আমার নিজের উপর জুলুম করেছি। তুমি আমায় ক্ষমা কর।” অবশ্য হযরত আদম (আঃ) তার তওবা কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া শাফায়াতকারীদের নাম উচ্চারন করেন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত আলেম আল্লামা সুয়ূতি(রঃ) তার লেখা দোরুল মানসুর তাফসীর গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় বেশ কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন। সেসব হাদিসে এসেছে যে হযরত আদম(আঃ) আল্লাহর কাছে তার তওবা কবুল হওয়ার জন্য হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) এবং তার বংশধরদেরকে উসিলা হিসাবে উপস্থাপন করে। হযরত ইবনে আব্বাস(রঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে-“আদম(আঃ) আল্লাহর কাছে হজরত মোহাম্মদ(সাঃ) এবং তার আহলে বাইতকে উসিলা হিসাবে তুলে ধরেন যাতে তার তওবা কবুল হয়।” শাব্দিকভাবে তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন। এ শব্দটি যখন মানুষ সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন তার অর্থ হলো পাপ কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন। আর যখন তওবা শব্দটি আল্লা সম্পর্কে ব্যবহৃত হয় তখন তার অর্থ হলো আল্লাহর দয়া ও রহমত ফিরে আসা। অর্থাৎ মানুষের পাপ কাজের কারণে আল্লাহ তার দয়া ফিরিয়ে নেয়ার পর মানুষ যখন পাপ কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তখন আল্লাহ পুনরায় দয়া ফিরিয়ে দেন। আল্লাহপাক নিজে তাওয়াব বা ক্ষমাশীল। যেমন সূরা বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তাই আল্লাহর দয়া সম্পর্কে মানুষের নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা থাকলে আল্লাহর দয়া করুণার ধারাও থাকবে অবিরাম। সূরা বাকারার ৩৭ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় করেকটি বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: মানুষের তওবা করার তওফিক যেমন আল্লাহর হাতে তেমনি কিভাবে তওবা করা উচিত সেই পথও পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে। তাই এ আয়াতে হজরত আদম(আঃ)এর তওবা সম্পর্কে বলা হয়েছে তওবার ভাষা ও শব্দ আল্লা তাকে শিখিয়েছেন। দ্বিতীয়ত: মানুষের তওবা যদি সত্যিকার তওবা হয় তাহলে আল্লাহ তা কবুল করবেন। কারণ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। তৃতীয়ত: আল্লাহপাকের ক্ষমা হলো দয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত। এতে নেই কোন অপমান এবং নেই কোন ভৎর্সনা। চতুর্থত: যদি আমরা কোন সময় তওবা করে তা ভঙ্গ করি এবং পুনরায় পাপে লিপ্ত হই, তারপরও আল্লাহর করুনা থেকে নিরাশ হতে নেই। কারণ তিনি তাওয়াব বা তওবা গ্রহণকারী। যদি আবারও আমরা তওবা করি তাহলে তিনি আমাদের তওবা কবুল করে নেবেন। (৩৮-৩৯ নং আয়াত) কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি বললাম তোমরা এখান থেকে নীচে নেমে যাও। পরে যখন আমার কাছ থেকে তোমাদের কাছে পথ নির্দেশনা আসবে তখন যারা আমার উপদেশ অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।” আল্লাহর কাছে হযরত আদম(আঃ)এর তওবা কবুল হওয়ার পর নির্দেশ এলো নীচে নেমে যাও, যাতে এ রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় যে তওবা কবুল হওয়ার ফলে তিনি পুনরায় বেহেশতে ফিরে আসবেন। আল্লাহর ক্ষমার ফলে শাস্তি লাঘব হয় কিন্তু গুনার ফলে যে প্রভাব পড়ে তার অবসান হয়না। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার স্বাভাবিক পরিণতি ছিল হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার বেহেশত থেকে বহি®কৃত হওয়া। তওবার ফলে এই স্বাভাবিক প্রভাব দূর হয়নি। তাই হযরত আদম(আঃ) ও বিবি হাওয়া বেহেশত থেকে বেরিয়ে আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীর সুযোগ সুবিধাবিহীন একটি স্থানে বসবাস করতে লাগলেন। বেহেশত থেকে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার বেরিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের সন্তানেরাও বেহেশতের বাইরে পৃথিবীতে বসবাস করবে বলে ঠিক হয়। তবে একই সাথে উল্লেখ করা হয় মানবজাতির পথ নির্দেশনার বিষয়টি। আল্লাহপাক বলেন আমি তোমাদের জন্য সঠিক পথে চলার উপকরণ পাঠাবো। পথপ্রদর্শনের জন্য কিতাব এবং রাসূল প্রেরণের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু মানুষ দুটি দলে বিভক্ত। একদল আল্লাহর আদেশ নিষেধ অনুসরণ করে এবং অপর দল হলো অবিশ্বাসী ও কাফের। আল্লাহপাক সৃষ্টির শুরুতেই তাবত দুনিয়ার সকল সত্তা, সৃষ্টি ও সব কিছুর নাম হযরত আদমকে শিখিয়ে দেন। তার সত্তায় সপে দেন জ্ঞান অর্জনের অফুরন্ত ক্ষমতা। আর এই জ্ঞানই হলো ফেরেশতাদের উপর তার মর্যাদার মূল কারণ। কিন্তু উপলদ্ধি ক্ষমতা ও বিচার-বুদ্ধি তাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। তাই সেই শুরুতেই হযরত আদম(আঃ) ধোকা খেলেন এবং পড়ে গেলেন বিভ্রান্তিতে। তাই আল্লাহপাক হযরত আদম(আঃ)এর তওবা কবুল করে তাকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর তার জন্য পথনির্দেশনার ব্যবস্থা করলেন। যাতে তিনি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারেন, চিনতে পারেন ভালো-মন্দ এবং ভুল পথে পা না বাড়ান। আল্লাহপাক মানব জাতিকে বিচার-বুদ্ধি বা আকল দেয়ার পাশাপাশি দ্বিতীয় যে মহান নেয়ামত দিয়েছেন তাহলো অহী। নবীদের মাধ্যমে অহী নাজিল এবং মানুষের পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা আল্লাহর জন্য অবশ্যকীয় বিষয়। তবে হেদায়েত লাভ করা সম্পূর্ণ মানুষের ইচ্ছার অধীন। মানুষ চাইলে সঠিক পথের অধিকারী হবে আর না চাইলে আল্লাহ তাকে জোর করে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন না। মানুষ তার পথ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর কোন জোর জবরদস্তি নেই। মানুষের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা হলো তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। মানুষ নিজে অতীত জীবনের দিকে তাকালে হতাশ হয়ে পড়ে। সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে না লাগানোর বেদনায় সে মুষড়ে পড়ে। তাই নিজের অজান্তেই ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মধ্যে বারবার আশঙ্কার জন্ম হয়। তবে যে আল্লাহর পথনির্দেশনা অনুযায়ী চলবে আল্লাহ নিজেই তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবেন। তখন তার মধ্যে থাকবে না কোন উদ্বেগ, কোন শঙ্কা, অতীত নিয়ে সে যেমন বেদনায় ভোগে সেরকম বেদনায় সে ভুগবে না। কারণ সে তার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করছে। তার কাজের ফলাফল এখন পাওয়া না গেলেও তা কি রকম হবে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত এবং আশাবাদী। সূরা বাকারার ৩৮ নম্বর আয়াতের কয়েটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: কখনো একটি ভুলের জন্য গোটা জাতিকে এর ফল ভোগ করতে হয়। হযরত আদম(আঃ) কেবল একটি ভুল করেছিলেন । কিন্তু ঐ একটি ভুলের ফলে তিনি ও তার ভবিষ্যৎ বংশধর বেহেশত থেকে বহি®কৃত হয়। দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তার অপার দয়া ও রহমত থেকে কখনোই মানুষকে বঞ্চিত করেন না। হযরত আদম(আঃ)এর অবাধ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহপাক তাকে তওবার পথ দেখিয়ে দিলেন এবং হেদায়েতের উপকরণও তাকে দিলেন। তৃতীয়ত: মানুষ পৃথিবীতে বসবাস শুরু করার সাথে সাথেই আল্লাহর পথনির্দেশনা আরম্ভ হয়। আর প্রকৃত পথ নির্দেশনার মালিক একমাত্র আল্লাহ। চতুর্থত: মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সে নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। আল্লাহর দেয়া দিক নির্দেশনা মেনে চলতে সে বাধ্য নয়। তাই মানব জাতির একটি অংশ মুমিন এবং অপর অংশ কাফের হয়ে যায়। পঞ্চমত:হেদায়েত লাভকারী ব্যক্তি প্রকৃত শান্তিতে বসবাস করেন। তার মধ্যে থাকেনা কোন উদ্বেগ, থাকেনা কোন উৎকণ্ঠা। এবারে সূরা বাকারার ৩৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে তারা দোজখের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” এদের বিপরীতে যারা স্বেচ্ছায় আল্লাহর দিক-নির্দেশনা মেনে নেয় তারা অবশেষে সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। এ আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে সমাজে একদল লোক আছে যারা অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের কারণে আল্লাহর নিদর্শন উপেক্ষা করে এবং সেগুলোকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করে। সঠিক পথে চলার জন্য আল্লাহ যে উপকরণ দিয়েছেন, সেগুলো তার স্পষ্ট নিদর্শন। তবে কেউ যদি আবিশ্বাস আর সত্যকে ঢাকা দেয়ার মন মানসিকতা নিয়ে আল্লাহর নিদর্শনাবলীর দিকে তাকায়, তাহলে ঐ নিদর্শনগুলো মেনে নেয়াতো দূরের কথা সেগুলোর সত্যতাও অস্বীকার করবে। আখ্যায়িত করবে সেগুলোকে মিথ্যা হিসাবে। পরকালে এধরণের লোকদের স্থান হলো দোজখের আগুন। কারণ বিদ্বেষ ও একগুয়েমী তাদের চিরাচরিত স্বভাব এবং তাদের এ স্বভাব পরিবর্তন হবে না। তাই দোজখ হবে তাদের চিরকালীন আবাসস্থল। সূরা বাকারার ৩৯ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, আল্লাহপাক কাফেরদের জন্যও হেদায়েতের উপকরণ দিয়েছেন। কিন্তু তারা নিজেরাই সঠিক পথে চলতে চায় না। এভাবে তারা নিজ হাতে দোজখের আগুন ক্রয় করেছে। (৪০-৪৩ নং আয়াত) কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৪০,৪১,৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের যে সুখ ও সম্পদ দান করেছি তা স্বরণ কর এবং আমার অঙ্গীকার পূরণ কর। আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর। আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার ভুলে যাওয়ায় হযরত আদম(আঃ)এর বেহেশত থেকে বহি®কৃত হওয়া এবং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ সম্পর্কে কাহিনী বর্ণনার পর, এই আয়াতে আল্লাহপাক আরেকটি কাহিনীর বর্ণনা দেন। হযরত আদম(আঃ)এরই সন্তান অর্থাৎ বনী ইসরাইল গোত্র কি পরিণতির শিকার হয়েছিলো সেকথাই এখানে বলা হয়েছে। হযরত ইয়াকুব (আঃ)এর অপর নাম ছিলো ইসরাইল। বনী ইসরাইল বলতে তারই সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের বুঝানো হচ্ছে। ইতিহাসে এই গোত্রের রয়েছে দীর্ঘ চড়াই-উৎরাইয়ের কাহিনী। কোরআনের বহু আয়াতে এই গোত্রের কাহিনী বলা হয়েছে। এই আয়াতে তিনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহ প্রদত্ত সকল কর্মসূচীর উৎস। প্রথমত: আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের কথা স্বরণ করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে শোকর আদায়ের অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তার আনুগত্যের স্পৃহা জেগে ওঠে। দ্বিতীয়ত: আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও সুখ-সম্পদ শর্তহীনভাবে দেয়া হয়নি। একই সাথে আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। তাই মানুষের বিশেষ কিছু দায়িত্ব আছে। সে যদি আল্লাহ নির্দেশিত পথে চলে তাহলে আল্লাহর দেয়া দয়া ও অনুগ্রহ থেকে পুরোপুরি লাভবান হতে পারবে। এই আয়াতের তৃতীয় নির্দেশ হলো আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন শক্তিকে ভয় পেলে চলবে না। শত্রুদের হুমকী ও প্রচারণা যাতে মানুষের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলতে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এবারে সূরা বাকারার ৪১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থক হিসাবে আমি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে ঈমান আনো। আর তোমরাই এর প্রথম প্রত্যাখ্যানকারী হয়োনা এবং আমার আয়াতকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করো না। তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করবে।” এই আয়াতে ইহুদী পন্ডিতদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তোমরা তওরাতের সুসংবাদ অনুযায়ী ইসলামের নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলে। এখন তার গ্রন্থ কোরআন যা কিনা তোমাদের তওরাতের সাথে সংগতিপূর্ণ তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। নিজেদের অবস্থান জানার জন্য তওরাতের যেসব বাণীতে ইসলামের নবীর বিভিন্ন নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে তা গোপন করোনা এবং পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে ধর্মকে বিক্রি করোনা। কিংবা কোরআনকে তোমরা প্রথম অবিশ্বাস করোনা। তাহলে অন্য ইহুদীরা তোমাদের অনুসরণে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে। মুসলিম ব্যক্তি সকল আসমানী গ্রন্থ ও পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি বিশ্বাস রাখে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম হলো সর্বশেষ ধর্ম। এর আগের সব ঐশী গ্রন্থ বিকৃতির শিকার হয়েছে। তাই একজন মুসলমান শুধু মাত্র ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)এর অনুসারী। এজন্যে কোরআন পূর্ববর্তী ধর্মের অনুসারীদেরকে কোরআনের প্রতি ঈমান আনতে বলে। একই সাথে একথাও বলে যে, কোরআনের বিষয়বস্তু পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ। পার্থক্য হলো পবিত্র কোরআন বিকৃতির উর্দ্ধে। মহাগ্রন্থ কোরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে নয় বরং শুধু আল্লাহর নির্দেশের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এবারে সূরা বাকারার ৪২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে,”তোমরা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।” পন্ডিত ব্যক্তিদের যে বিষয়টি তাদের জাতি ও ধর্মকে হুমকীগ্রস্ত করে তাহলো সত্য গোপন করা কিংবা নিজেদের খেয়াল খুশী মত সত্য ও মিথ্যা বর্ণনা দেয়া। এর ফলে জনগণ অজ্ঞতা, মূর্খতা কিংবা বিভ্রান্তি ও সংশয়ের মধ্যে পড়ে। একটি জাতির পন্ডিত ও শীর্ষ ব্যক্তিরা যেসব অপরাধ করে তার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হলো এটি। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী(আঃ) নাহজুল বালাগা গ্রন্থের ৪৯ নম্বর বাক্যে এ সম্পর্কে বলেন, মিথ্যা যদি সরাসরি বর্ণনা করা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই। কারণ মানুষ ঐ বিষয়টি যে ভুল তা বুঝতে পারবে এবং নিজেরাই সেটি বর্জন করবে। আর যদি সত্য সরাসরি এবং অবিকৃতভাবে বর্ণনা করা হয়, তাহলে বিরোধীদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে এবং জনগণও তা মেনে নেবে। বিপদ ঘটে তখনই যখন সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে বর্ণনা করা হয়। ঐ অবস্থায় শয়তান সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এবারে সূরা বাকারার ৪৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে,”তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। শুধু সত্যকে চেনা ও জানাই যথেষ্ট নয়। বরং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তিকে কাজের লোক হতে হবে। আর সর্বোত্তম কাজ হলো আল্লাহর এবাদত এবং তার সৃষ্টির সেবা করা।” কোরআনের অধিকাংশ আয়াতে নামাজ ও জাকাতের বিষয়টি পাশাপাশি এসেছে। এর অর্থ হলো নামাজ ও এবাদতের পাশাপাশি একজন মুসলমানকে মানুষের প্রতি সেবা ও দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। এমনকি নামাজ পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনায় জনগণের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার উপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে জামাতে নামাজ পড়বে এবং অন্যান্য মুসলমানদের সাথে রুকু ও সেজদা করবে। এর কারণ হলো সমাজে নিঃস্বঙ্গ জীবন-যাপনকে ইসলাম অনুমোদন করে না। সূরা বাকারার ৪০, ৪১,৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি প্রধান শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে- প্রথমত: আল্লাহপাক আমাদের পরিবার ও সমাজকে যে সব নেয়ামত দিয়েছেন সেগুলো সব সময় স্মরণ করতে হবে। আল্লাহর নেয়ামতের কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, যাতে আল্লাহর শোকর আদায় এবং তাকে অনুসরণ ও ভালোবাসার স্পৃহা জন্ম নেয়। দ্বিতীয়ত: দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহপাক আমাদের ফিতরাত বা প্রকৃতি কিংবা ঐশী বিধানের মাধ্যমে আমাদের যে অঙ্গীকার নিয়েছেন সেই অঙ্গীকার আমাদের মেনে চলতে হবে। আর মনে রাখতে হবে আল্লাহর বিশেষ দয়া পেতে হলে তার নির্দেশিত পথে চলতে হবে। তৃতীয়ত: আল্লাহর বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে কোন শক্তিকে ভয় পাওয়া চলবে না। এ ছাড়াও শ্রেফ ধন-সম্পদ ও নিজেদের মর্যাদার জন্য আল্লাহর বাণী প্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্যে যাতে অগ্রীম না হই সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চতুর্থত: মানুষের প্রত্যেক অঙ্গ বিশেষ কিছু পাপ করার ক্ষমতা রাখে জিভের একটি প্রধান পাপকাজ হলো জেনে শুনে সত্য বলা থেকে বিরত থাকা। ঈমান আমল থেকে পৃথক কিছু নয়। সকল ঐশী ধর্মের প্রথম নির্দেশ হলো নামাজ। ষষ্ঠত: নামাজ মূলত: জামাতে পড়া উচিত। এটি মুসলমানদের একটি ধর্মীয় দায়িত্ব।# সুরা বাকারার তাফসির দ্বিতীয় অংশ (৪৪-১০২ নম্বর আয়াত) সুরা বাকারার তাফসির দ্বিতীয় অংশ (৪৪-১০২ নম্বর আয়াত) সূরা বাকারাহ’র ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- َتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (44) “তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও,অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না?” (২:৪৪) গত পর্বে আমরা বলেছি আল্লাহপাক ইহুদী পণ্ডিতদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন তোমরা কেন সত্য গোপন কর এবং মানুষকে তা জানতে দাও না? এ আয়াতেও তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, “ইসলামের নবীর আগমনের পূর্বে তোমরা যারা জনগণকে ওই নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিতে,এখন তোমরা কেন তার প্রতি ঈমান আনলে না? অথচ তোমরা তওরাত সম্পর্কে অনেক জান।” যদিও এ আয়াতে বনি ইসরাইল ও তাদের পণ্ডিতদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, কিন্তু আয়াতটির অর্থ অনেক ব্যাপক। সব ধর্ম ও মতবাদের প্রচারকরদের ক্ষেত্রে এই আয়াত প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে রাসূলে খোদার বিশিষ্ট বংশধর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, মানুষকে মুখ দিয়ে নয় নিজের কর্ম দিয়ে সৎ কাজের দিকে আহ্বান জানাও। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) এ সম্পর্কে বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি নিজে করি না এমন কোন কাজ করতে তোমাদেরকে উৎসাহ দেই না, আর আমি এমন কাজে তোমাদেরকে বাধা দেই যা থেকে আমি নিজে বিরত থাকি।” পবিত্র কোরআনের সূরা জুমার ৫ নম্বর আয়াতে আমলবিহীন জ্ঞানী ব্যক্তিকে গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে কেবল বইয়ের বোঝা বহন করে আর অন্যরা ঐসব বই থেকে উপকৃত হয় অথচ নিজে ভার বহন ছাড়া তা থেকে লাভবান হয় না। এই সূরার ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ (45 “তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। আর নিশ্চয়ই এ কাজ বিনয়ী ও খোদাভীরু ছাড়া অন্যদের জন্য কঠিন।” (২:৪৫) মানুষের ভেতরের কামনা-বাসনা ও বাইরের সমস্যার মোকাবেলায় মানব জীবনের সর্বোত্তম সাথী হলো দৃঢ়তা ও অবিচল থাকা। এই অবিচলতা তার মধ্যে জোগায় অফুরন্ত শক্তি। আর এই শক্তির বলে সে বিনীতভাবে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন ও তাঁরই এবাদত করতে পারে। এই আয়াতে যে ধৈর্য্যের কথা বলা হয়েছে কিছু হাদীসে তাকে ” রোজা ” বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে রোজা কেবল ধৈর্য্য এবং সংযমের একটি রূপ। এ ছাড়াও ধৈর্য্যের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাই রাসূলে খোদা (সাঃ) বলেছেন,”ধৈর্য্য বা সবর তিন ধরনের। একটি হলো বিপদ-আপদের সময় ধৈর্য্য, আরেকটি হলো পাপ কাজের ব্যাপারে ধৈর্য্য অবলম্বন এবং তৃতীয় হলো, আল্লাহর নির্দেশ ও এবাদত পালনের ক্ষেত্রে ধৈর্য্য।” নবী বংশের সদস্য ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, “যখন দুনিয়ার কোন দুঃখে তুমি আক্রান্ত হবে তখন অজু করে মসজিদে চলে যাবে। সেখানে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। কারণ আল্লাহপাক নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন।” যাদের অন্তর পবিত্র তারা নামাজকে সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করে, কিন্তু যারা অহঙ্কারী তারা নামাজকে ভারী বোঝা বলে মনে করে। তারা নামাজের দিকে মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে নামাজ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। এরপর ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (46 “বিনীত তারাই যারা বিশ্বাস করে যে তাদের প্রতিপালকের সাথে অবশ্যই তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে এবং তাঁরই দিকে তারা প্রত্যাবর্তন করবে।” (২:৪৬) পরকাল ও আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার বিশ্বাস মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলে বিনয়, খোদাভীরুতা ও দায়িত্ব অনুভূতি। এই বিশ্বাস তার জীবনকে পরিণত করে একটি আদালতে যেখানে তাকে সব কাজের জবাবদিহিতা করতে হবে। আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাতের যে কথাটি এ আয়াতে বলা হয়েছে, তার অর্থ দৈহিক সাক্ষাত নয়। কারণ আল্লাহ পাকের কোন আকৃতি নেই যে মানুষ পরকালে তাকে চোখে দেখতে পাবে। বরং আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাতের অর্থ হলো, তার পুরস্কার ও শাস্তি দানের মধ্য দিয়ে তার শক্তি অবলোকন করা। ওই সময় মানুষ হৃদয় ও অন্তরে আল্লাহপাকের দর্শন লাভ করবে, যেন আল্লাহকে সে সরাসরি অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পাচ্ছে এবং দর্শন সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় নেই। হযরত আলী (আঃ)-এর একজন সহচর একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আল্লাহকে দেখেছেন? হযরত আলী জবাবে বললেন, যে আল্লাহকে আমি দেখি না কিভাবে আমি তার এবাদত করবো? এর পর ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, চর্ম চক্ষুতে তাকে দেখা যায় না ঠিকই, তবে ঈমানের নূরে আলোকিত অন্তর তাকে উপলদ্ধি করতে পারে। এরপর এই সূরার ৪৭নং আয়াতে বলা হয়েছে- يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ (47 “হে বনী ইসরাইল, আমার সেই নেয়ামতের কথা স্মরণ করো, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি। আর আমিই তো তোমাদেরকে বিশ্বে সবার ওপর উচ্চমর্যাদা দান করেছি।” (২:৪৭) ইহুদী জাতির প্রতি আল্লাহর অন্যতম দয়া ছিল তারা ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মিশরের শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং অসংখ্য বস্তুগত সুখ-সম্পদ আল্লাহ তাদেরকে দান করেন। এ আয়াতে তৎকালীন যুগে অন্যান্য জাতির তুলনায় বনী ইসরাইল জাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে তারা যাতে আল্লাহর মহা নেয়ামতের শোকর আদায় করে। অন্যান্য জাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্বের এ মর্যাদা হযরত মূসা (আঃ) এর নেতৃত্বের ফলে অর্জিত হয়। তাই নবী ইসরাইল জাতিকে আল্লাহ তা’লা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। সূরা বাকারাহ’র ৪৪,৪৫,৪৬,৪৭ নম্বর আয়াতের প্রধান কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে। এক. মুখে নয় বরং কর্মের মাধ্যমে সৎকাজের প্রতি অন্যদেরকে আহ্বান জানাতে হবে অর্থাৎ অন্যদের বলার আগে নিজেকে তা আমল করতে হবে। দুই. সমস্যার ওপর জয়ী হবার জন্য দু’টি বিষয়ের প্রয়োজন। একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি, আর তা হলো ধৈর্য্য ও অবিচলতা। অপর বিষয়টি বাহ্যিক শক্তি, আর তা হলো নামাজ ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক। তিন. পরকালের প্রতি গভীর বিশ্বাসতো বটেই এমনকি এর অস্তিত্বের ব্যাপারে ধারণাও মানুষকে যেকোন অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারে। চার. মানুষ আল্লাহর নবীদের নেতৃত্বের ফলে শুধু পরকালে বেহেশতই লাভ করে না বরং দুনিয়াতেও বস্তুগত সুখ-সম্পদ লাভ করে। তাদের নেতৃত্বে মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। সূরা বাকারাহ’র ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ (48 “আর সেদিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না;কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না।” (২:৪৮) এই আয়াতে পরকাল সম্পর্কে মানুষের চার ধরনের ভুল ধারণা তুলে ধরে সেগুলোর জবাব দেয়া হয়েছে। ইহুদীরা মনে করত তাদের পূর্বপুরুষেরা তাদেরকে পরকালের আজাব থেকে রক্ষা করতে পারবে। অথবা তাদের ধর্মীয় নেতারা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। কিংবা তাদের বন্ধুরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে। ইহুদীদের মধ্যে অনেকে আবার ভাবতো ক্ষতিপূরণ দেয়ার মাধ্যমে তারা পরকালের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে। পবিত্র কোরআন তাদের এসব ভুল ধারণার জবাবে বলেছে,ওই দিন কেউ কাউকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। কেয়ামতের দিন সবাই ব্যস্ত নিজের মুক্তি চিন্তায়। তাই তোমরা শুধু তোমাদের ঈমান ও সৎকাজের ওপর আস্থা রেখ। অবশ্য আল্লাহ তার অফুরন্ত দয়া ও রহমতের কারণে সৎ পথে ফিরে আসার পথ বন্ধ রাখেননি। দুনিয়াতে তওবা আর পরকালে সুপারিশের পথ খুলে দিয়ে আল্লাহ গুনাহগারদেরকে ক্ষমা লাভের আশা দিয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সুপারিশের কিছু শর্ত আছে। ওইসব শর্তের ফলে মানুষের মধ্যে পাপকাজের সাহস থাকে না এবং সে পুনরায় অপরাধ করা থেকে দূরে থাকে। তাই এ আয়াতে নিঃশর্ত সুপারিশের যে ধারণা ইহুদীদের মধ্যে ছিল তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর খ্রিস্টানদের বিশ্বাস হচ্ছে হযরত ঈসা মাসিহ (আ) তাঁর অনুসারীদের পাপ মার্জনার জন্য নিজের জীবনকেই উৎসর্গ করেছেন। কোরআন এই ধারণাও বাতিল করে দিয়েছে। এরপর ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ نَجَّيْنَاكُمْ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَاءَكُمْ وَفِي ذَلِكُمْ بَلَاءٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَظِيمٌ (49) “হে বনী ইসরাইল,তোমরা ওই সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন আমি ফেরাউনী সম্প্রদায় থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলাম যারা তোমাদেরকে অত্যন্ত মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিত। তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে দাসী হিসাবে ব্যবহার করার জন্য জীবিত রাখত। এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ছিল এক মহা পরীক্ষা।” (২:৪৯) ফেরাউন তার শাসন ক্ষমতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে বনী ইসরাইল জাতির তরুণ ও পুরুষদেরকে হত্যা করতো। আর ওই গোত্রের মহিলাদেরকে ব্যবহার করতো ক্রীতদাসীর মত। এভাবে ফেরাউন ও তার দলবল বনী ইসরাইল জাতিকে দুর্বল করে রেখেছিল। কোরআনের দৃষ্টিতে ওই দুঃখ-দুর্দশা এবং এই মুক্তি ও শান্তি, দু’টিই মানুষের জন্য পরীক্ষা। মানুষের প্রকৃত অবস্থা যাতে উন্মোচিত হয় এবং সে পূর্ণতায় পৌঁছে, সেজন্যে আল্লাহ পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন। এরপর ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ فَرَقْنَا بِكُمُ الْبَحْرَ فَأَنْجَيْنَاكُمْ وَأَغْرَقْنَا آَلَ فِرْعَوْنَ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ (50 “হে বনী ইসরাইল,তোমরা ওই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলাম। তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলাম কিন্তু ফেরাউনী সম্প্রদায়কে নিমজ্জিত করেছিলাম। আর তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।” (২:৫০) এই আয়াতে ফেরাউনের হাত থেকে বনী ইসরাইল জাতি কিভাবে রক্ষা পেয়েছিল,তা ইঙ্গিত করা হয়েছে। বনী ইসরাইল জাতির উদ্ধার পাওয়ার ঘটনাটি ছিল স্পষ্ট মুজেযা এবং আল্লাহর অলৌকিক কাজের দৃষ্টান্ত। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মূসা (আঃ) তার জাতিকে মিশর থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যখন হযরত মূসা ( আঃ) নীল নদের কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন বুঝতে পারলেন যে, ফেরাউন ও তার বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করছে। প্রচণ্ড উদ্বেগ আর আতঙ্কে বনী ইসরাইল গোত্র কাঁপতে থাকল। তখন আল্লাহর আদেশে হযরত মূসা (আঃ) তার হাতের লাঠিখানা দিয়ে সাগরে আঘাত করলেন। সাগরের পানি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং নীল নদ অতিক্রমের জন্য একটি পথ সৃষ্টি হলো। ফেরাউনের বাহিনী নীল নদের মধ্যেই তাদের পিছু ধাওয়া করল। কিন্তু যখন তারা মাঝামাঝি পৌঁছল তখন নীল নদের পানি একত্রিত হল এবং ফেরাউন বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল। বনী ইসরাইল জাতি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেল। তারা আল্লাহর মুজেযা দেখলো ও স্বচক্ষে দুশমনদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করলো। এর চেয়ে বড় দয়া ও নেয়ামত আর কি হতে পারে ? এর পরের আয়াতে বনী ইসরাইলীদের পাপে লিপ্ত হওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- وَإِذْ وَاعَدْنَا مُوسَى أَرْبَعِينَ لَيْلَةً ثُمَّ اتَّخَذْتُمُ الْعِجْلَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَنْتُمْ ظَالِمُونَ (51 “(হে বনী ইসরাইল!) তোমরা স্মরণ কর যখন মূসার জন্য চল্লিশ রাত নির্ধারণ করেছিলাম। তার প্রস্থানের পর তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলে। আর এ কাজের মাধ্যমে তোমরা নিজের ওপরই জুলুম করেছিলে।” (২:৫১) ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বনী ইসরাইল জাতি উদ্ধার পাবার পর ৪০ দিনের জন্য হযরত মূসা (আঃ)কে তুর পাহাড়ে যেতে হলো। সেখানে তিনি গেলেন তওরাতের বাণী গ্রহণের জন্য। কিন্তু এই অল্প সময়েই বনী ইসরাইল জাতির জন্য এক বড় পরীক্ষা আসল। সামেরী নামের এক অতি ধূর্ত ব্যক্তি মানুষের সোনা-দানা দিয়ে একটি গরুর বাছুরের প্রতিকৃতি তৈরী করল। মুর্তিটি থেকে গরুর ডাক ভেসে আসত এবং জনগণ অবাক হয়ে যেত। সামেরী তখন জনগণকে স্বর্ণের তৈরী অদ্ভুত ওই মুর্তির উপাসনার দিকে আহ্বান জানায়। বেশীরভাগ মানুষ সামেরীর দলে যোগ দিল এবং বাছুর পূজা শুরু করল। এ কাজের মাধ্যমে তারা নিজের ওপর যেমন জুলুম করলো তেমনি সুযোগ্য নেতা ও নবী হযরত মূসা (আঃ)এর ওপর জুলুম করলো। অথচ হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষার জন্য কি কষ্টই না সহ্য করেছিলেন। অবশ্য তুর পাহাড় থেকে হযরত মূসা ফিরে আসার পর জনগণ তাদের অন্যায় বুঝতে পারলো। আল্লাহ তখন তাদের এই শিরকের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন। সূরা বাকারাহ’র ৫২ নম্বর আয়াতে বিষয়টির বর্ণনা এ ভাবে দেয়া হয়েছে, ثُمَّ عَفَوْنَا عَنْكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (52 “ওই বড় অপরাধের পরও আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।” (২:৫২) বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের একটি হলো অপরাধের জন্য সাথে সাথে তিনি শাস্তি দেন না বরং তিনি তাদেরকে অনুশোচনা ও তওবা করার সুযোগ দেন। এ ঘটনাতেও আল্লাহ বনী ইসরাইলের শিরকের মত বড় পাপ ক্ষমা করে দিলেন। সূরা বাকারাহ’র ৪৮,৪৯,৫০,৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক. দৈনন্দিন জীবনে পরকালের কথা মনে রাখতে হবে। ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা বা বন্ধুত্বের জন্য পাপ করা ঠিক নয়। কারণ ওই দিন কেউ কারো সাহায্য করতে পারবে না। কোন ধন-সম্পদ সুপারিশের কাজে আসবে না। দুই. ফেরাউন সম্প্রদায়ের মত খোদাদ্রোহী শক্তির প্রথম লক্ষ্য হলো তরুণ সমাজ। বর্তমান পৃথিবীতেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো উশৃঙ্খলতা ও বিভিন্ন গর্হিত কাজে আসক্তি সৃষ্টি করে যুবসমাজকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পোশাক-আশাক সাজ-গোজ এ সব ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে তারা নারীকে তাদের কামনা বাসনার উপাদানে পরিণত করেছে। বনী ইসরাইলীদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পাক সূরা বাকারাহ’র ৫৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন, وَإِذْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَالْفُرْقَانَ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ (53) “আর (স্মরণ কর) যখন আমি মূসাকে কিতাব এবং ফোরক্বান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বিধানকারী নির্দেশ) দান করেছি, যাতে তোমরা সরল পথ প্রাপ্ত হতে পার।” (২:৫৩) ফোরক্বান শব্দের অর্থ হলো সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথককারী। আসমানী কেতাব ও নবীদের মোজেজার মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করা যায় বলেই আসমানী কিতাব ও নবীদের মোজেজাকে ফোরক্বান বলা হয়। মহান আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে আসমানী কিতাব বা ঐশী গ্রন্থ এবং পথনির্দেশক হিসাবে নবীদেরকে পাঠিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি মানুষের কাছে মিথ্যাবাদী ও সত্যবাদীদেরকে চিহ্নিত করার জন্য পয়গম্বরদেরকে অলৌকিক নিদর্শন বা মোজেজা প্রদর্শনের ক্ষমতা দিয়েছেন। এরপর ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ (54) “এবং যখন মূসা নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল,হে আমার সম্প্রদায়!তোমরা বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে ঘোর অনাচার করেছ, সুতরাং তোমরা তোমাদের স্রষ্টার দিকে ফিরে যাও এবং তোমরা নিজ নিজ প্রাণ উৎসর্গ কর। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় বা কল্যাণকর। তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হবেন, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। ” (২:৫৪) তুর পাহাড় থেকে ৪০ দিন পর হযরত মূসা (আঃ) যখন ফিরে এলেন, তখন তিনি দেখলেন তার জাতি গরুর বাছুরের পূজা করছে। এই আয়াতে মূসা (আঃ)এর সম্প্রদায়কে দু’টি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথমত: তাদেরকে এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, তোমরা এ কাজ করে নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছ এবং বাছুরকে উপাস্য করে মানুষের মর্যাদা ও সম্মানকে পদদলিত করেছ। দ্বিতীয়ত: তোমাদের অপরাধ কুফরীর চাইতেও বেশী। কারণ তোমরা সত্যকে উপলব্ধি করে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করার পর পুনরায় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ। এ ভাবে তোমরা কট্টর বা চরম অবিশ্বাসী হিসাবে মূর্তাদ হয়ে গেছ। আর মূর্তাদ হবার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড বা প্রাণহরণ। মহান আল্লাহ দয়া ও করুণার আধার। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি মানবজাতির একজন আন্তরিক ও কল্যাণকামী অভিভাবক। তাই আল্লাহ মাঝে মধ্যে তিরস্কার ও কঠিন শাস্তির মাধ্যমে অন্যদেরকে এ শিক্ষা দিতে চান যে, ধর্ম নিয়ে কেউ যেন হেলা-ফেলা না করে এবং এভাবে আল্লাহ সমাজকে নোংরা ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে মুক্ত করেন। মূর্তি পূজা ও গরুর বাছুর পূজা এমন কোন সাধারণ বা ছোট-খাট অপরাধ নয় যে শুধু মৌখিক ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমেই ক্ষমা লাভ করা যেতে পারে। বিশেষ করে কোন সম্প্রদায়ের এ ধরনের অপরাধকে সহজেই ক্ষমা করা যায় না, যারা আল্লাহর নিদর্শনগুলো দেখেছিল এবং আল্লাহর অনেক নেয়ামত বা অনুগ্রহ ভোগ করে তার প্রতি বিশ্বাস বা ঈমানও এনেছিল। এরপর ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَى لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ (55) “হে বনী ইসরাইল! স্মরণ কর যখন তোমরা বলেছিলে,হে মূসা! আমরা আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে না দেখা পর্যন্ত তোমাকে কখনও বিশ্বাস করবো না। তখন তোমরা বজ্রাহত হয়েছিলে এবং তোমরা প্রত্যক্ষ করেছিলে।” (২:৫৫) এখানে বনী ইসরাইল বা ইহুদী জাতির আরেকটি বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা একবার গরুর বাছুর পূজায় লিপ্ত হয়েছিল সে কথা এরআগে বলা হয়েছে। এরপর তারা হযরত মূসার কাছে এই দাবী তোলে যে আমরা আল্লাহকে নিজ চোখে সরাসরি দেখতে চাই। আর আল্লাহকে এভাবে দেখার পরই তোমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করব এবং তোমার অনুগত হব। আল্লাহ তাদেরকে এটা বোঝাতে চাইলেন যে, মানুষ চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখা তো দূরের কথা তার অনেক সৃষ্টিকে দেখারও ক্ষমতা রাখে না। তাই আল্লাহর নূর বা আলোর এমন এক ঝলক তাদের ওপর এসে পড়লো যে,তারা বজ্রাহত হয়ে ভয়ে-আতঙ্কে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। এরপর ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘ ثُمَّ بَعَثْنَاكُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (56) “অতঃপর আমি মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম যাতে তোমরা আমার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।'”(২:৫৬) বজ্রপাতের ঘটনায় বনী ইসরাইল বা ইহুদীগোত্রের ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মারা গিয়েছিল। হযরত মূসা (আঃ)এর দোয়ার কারণে আল্লাহ তাদের পুনরায় জীবিত করেন, যাতে তারা ও পুরো ইহুদীগোত্র আল্লাহ ও তার শক্তিতে বিশ্বাস করে। সূরা বাকারাহ’র ৫৩,৫৪,৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক. খোদা নয়,পাপীরা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করে। মানুষের প্রকৃত সত্ত্বা তার দেহ নয় বরং আত্মা। আর পাপ বা গোনাহ মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে এবং আত্মাকে রোগাক্রান্ত করে। ফলে আত্মার মৃত্যু ঘটে। আর তখন মানুষের মধ্যে পাশবিক কাঠামো ছাড়া আর কিছুই বাকী থাকে না। দুই. প্রত্যেক গোনাহ বা পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা তওবা হতে হবে পাপের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে গরুর বাছুরের উপাসনার পাপ শুধু কান্না ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মোচন হতে পারে না। মৃত্যুদণ্ড গ্রহণের মাধ্যমেই এই পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। তিন. অনেকেই বলে থাকেন যে আল্লাহকে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তারা হয় অজ্ঞতা অথবা একগুঁয়েমীর কারণেই এ ধরনের কথা বলেন। কারণ আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। অবশ্য আল্লাহর শক্তি, ক্ষমতা ও মহত্বকে মানুষ নিজেদের মধ্যে ও সমগ্র সৃষ্টিজগতে দেখতে পারে। চার. মৃতদেরকে জীবিত করা অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। মহান আল্লাহ এই পৃথিবীতেই অনেক মৃত মানুষকে জীবিত করেছেন। যেমন বজ্রপাতের ঘটনায় যে ৭০ জন ইহুদী নেতা মারা গিয়েছিল, হযরত মূসা (আঃ)-এর দোয়ায় আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। সূরা বাকারাহ’র ৫৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ (57) “(হে বনী ইসরাইল!) আমি তোমাদের ওপর মেঘ দ্বারা ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের জন্য মান্না ও সালওয়া প্রেরণ করেছিলাম। আর বলেছিলাম তোমাদের যে জীবিকা দান করলাম সেই পবিত্র বস্তু হতে খাও। তারা (আমার নির্দেশ অমান্য করে) আমার কোন অনিষ্ট করেনি বরং নিজেদেরই অনিষ্ট করেছিল।” (২:৫৭) মহান আল্লাহ ফেরাউনের কবল থেকে বনী ইসরাইলকে রক্ষা করার পর তাদেরকে ফিলিস্তিনে যাবার নিদের্শ দেন। কিন্তু সেখানে অত্যাচারীদের শাসন ব্যবস্থা বিরাজ করছে এই অজুহাত দেখিয়ে ইহুদীরা সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে আল্লাহর ক্রোধ তাদেরকে ঘিরে ফেলল। অর্থাৎ তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে এল এবং প্রায় ৪০ বছর ধরে তারা সিনাই উপত্যকায় ভবঘুরের মত ও অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াল। এই দীর্ঘ সময়ে অবশ্য তাদের অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হলো এবং মহান আল্লাহ পুনরায় তাদের ওপর দয়া করলেন। আর ওই দয়া ও অনুগ্রহের কথাই এ আয়াতে বলা হয়েছে। ওই তপ্ত ও শুষ্ক মরুভূমির ওপর ছায়াদান ছাড়াও আল্লাহ তাদেরকে সেখানে দু’ধরনের খাবার দিচ্ছিলেন। প্রথম ধরনের খাবার ছিল মধু জাতীয় এক ধরনের খাবার যা গাছের রস থেকে তৈরি হতো। এ খাবারকে বলা হতো মান্না। আর সালওয়া অর্থাৎ দ্বিতীয় ধরনের খাবার ছিল কবুতর জাতীয় এক ধরনের পাখি। এরপরের আয়াতে অর্থাৎ ৫৮নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوا هَذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَدًا وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَقُولُوا حِطَّةٌ نَغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ وَسَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ (58 “স্মরণ কর যখন তোমাদের বলেছিলাম এই শহর অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ কর এবং সেখান থেকে যা ইচ্ছে স্বাচ্ছন্দে আহার কর। দরজার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করার সময় নত শিরে প্রবেশ কর এবং বল আমরা আমাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই। তাহলে আমি তোমাদের ক্ষমা করব এবং অচিরেই ভালো লোকদেরকে অতিরিক্ত দান করব।” (২:৫৮) ইহুদীরা সিনাই উপত্যকায় ৪০ বছর ধরে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ায়। এরপর তাদের পাপ ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা’লা তাদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য ‘হেত্বাতুন’ শব্দটি বার বার উচ্চারণ করতে বললেন। এই শব্দের অর্থ হলো, আমাদের পাপ বা গোনাহগুলো মুছে ফেল ও আমাদেরকে ক্ষমা কর। এই আয়াত থেকে এটাও বোঝা গেল যে, পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশের সময় বিশেষ সম্মান বা ভক্তি প্রদর্শন জরুরী। আর প্রার্থনা এবং ক্ষমা প্রার্থনার বাক্য ও রীতিও আল্লাহর কাছ থেকে শিখতে হবে। পরবর্তী আয়াতে ইহুদীদের পক্ষ থেকে কুৎসিত পন্থায় আল্লাহর আদেশ অমান্যের কথা বলা হয়েছে। সুরা বাকারাহ’র ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَنْزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا رِجْزًا مِنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (59) “কিন্তু যারা অন্যায় করেছিল, তারা তাদের যা বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে অন্য কথা বলল। তাই অনাচারীদের প্রতি আমি আকাশ হতে শাস্তি প্রেরণ করলাম যেহেতু তারা সত্য ত্যাগ করেছিল।” (২:৫৯) অপরাধী ইহুদীদের অনেকে বিদ্রুপের ছলে হেত্বাতু অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমরা ভুল করেছি বা ক্ষমা করে দাও” বলার পরিবর্তে হেনত্বাতু শব্দটি উচ্চারণ করেছিল, যার অর্থ হলো গম। আল্লাহর নির্দেশকে এভাবে খেলাচ্ছলে গ্রহণ করায় তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে এবং তাদের মধ্যে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আয়াতে এটা স্পষ্ট যে, শুধু আদেশ অমান্যকারী ওপরই এই রোগ বা শাস্তি নেমে এসেছিল, সবার ওপর নয়। এই আয়াত থেকে এটা বোঝা যায়, যে সমাজের মানুষ সত্য থেকে পলায়নের চেষ্টা করে বা সত্যকে অমান্য করে কিংবা এ ব্যাপারে ঔদ্ধত্য দেখায়, সেই সমাজের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এরপর ৬০নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذِ اسْتَسْقَى مُوسَى لِقَوْمِهِ فَقُلْنَا اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًا قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَشْرَبَهُمْ كُلُوا وَاشْرَبُوا مِنْ رِزْقِ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ (60 “যখন মূসা নিজ সম্প্রদায়ের জন্য পানি প্রার্থনা করল। আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত কর। ফলে তা থেকে ১২টি ঝর্ণা প্রবাহিত হলো। প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ ঘাট অর্থাৎ পানস্থান জেনে নিল। তাদেরকে বললাম, আল্লাহর জীবিকা থেকে খাও ও পান কর এবং পৃথিবীতে শান্তি ভঙ্গ করে বেড়িও না।” (২:৬০) যদিও হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলের কাছে প্রেরিত নবী বা পয়গম্বর ছিলেন এবং তার মূল দায়িত্ব ছিল আল্লাহর বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐশী পথ-প্রদর্শকরা মানুষের পার্থিব কল্যাণ ও পার্থিব সমস্যা নিয়েও চিন্তা করেন। তাই হযরত মূসা (আঃ) তার জাতির জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করেন এবং অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে তাদেরকে পানি দান করেন। এজন্যে তিনি হযরত মূসা (আঃ)কে তার সেই লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত করতে বলেন,যে লাঠির আঘাতে তিনি নীল দরিয়ায় শুকনো পথ সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবে আল্লাহ তাদের এটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তার নবী যেকোন কাজ করতে সক্ষম। বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধরদের মধ্যে ১২টি গোত্র বা গোষ্ঠী ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের জন্য ১২টি ঝর্ণা বা প্রস্রবন সৃষ্টি হলো, যাতে প্রত্যেক গোত্র আলাদাভাবে পানি পেতে পারে এবং পানির সংকট দেখা না দেয়। এভাবে আল্লাহ একদিকে মান্না ও সালওয়া খাবার পাঠিয়ে এবং অন্যদিকে যথেষ্ট পানির ব্যবস্থা করে ইহুদী জাতির কল্যাণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যাতে তারা পাপাচার, নৈরাজ্য ও হঠকারিতা থেকে দূরে থাকতে পারে। সূরা বাকারাহ’র ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক. আল্লাহ মানুষের জীবিকা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তাই বলে পশুর মত যে কোন পন্থায় পেট ভরানোর চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকা উচিত নয়। তাই মানুষ হিসাবে আমাদেরকে হালাল রিযিকের সন্ধান করতে হবে। যেমনটি সূরা বাকারাহ’র ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-‘তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করলাম সেই পবিত্র বস্তু হতে খাও।’ দুই. আল্লাহ ক্ষমাশীল। কিন্তু তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনা হতে হবে আন্তরিকভাবে। অন্তর থেকে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে মৌখিকভাবেও ক্ষমা স্বীকার করতে হবে। যেমন সূরা বাকারাহ’র ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-নত শিরে প্রবেশ কর এবং বল আমরা ক্ষমা চাই। তিন. আল্লাহর ইবাদত বা নির্দেশ যথাযথভাবে বা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতে হবে। তা না হলে তা পূর্ণ ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না বরং তা হবে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবমাননা ও ঐদ্ধত্য বা হঠকারিতা প্রকাশ। সূরা বাকারাহ’র ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَى لَنْ نَصْبِرَ عَلَى طَعَامٍ وَاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُخْرِجْ لَنَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ مِنْ بَقْلِهَا وَقِثَّائِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَا قَالَ أَتَسْتَبْدِلُونَ الَّذِي هُوَ أَدْنَى بِالَّذِي هُوَ خَيْرٌ اهْبِطُوا مِصْرًا فَإِنَّ لَكُمْ مَا سَأَلْتُمْ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (61) “(হে বনী ইসরাইল) যখন তোমরা বলেছিলে, হে মূসা আমরা একই রকম খাদ্যে কখনও ধৈর্য্য ধারণ করতে পারবো না। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্য প্রার্থনা কর,তিনি যেন ভূমিজাত দ্রব্য শাক-সব্জী,কাঁকুড়, রসুন বা গম,মসুর ও পিয়াঁজ আমাদের জন্য উৎপাদন করেন। মূসা বললেন, তোমরা কি উৎকৃষ্ট জিনিসকে নিকৃষ্ট জিনিসের সাথে বদল করতে চাও? তাহলে এই উপত্যকা থেকে বের হয়ে অন্য কোন শহরে যাও। তোমরা যা চাও তা সেখানে আছে। তারা লাঞ্ছনা ও দরিদ্রগ্রস্ত হলো এবং তারা অল্লাহর ক্রোধের পাত্র হলো, এটা এ জন্যে যে তারা আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনকে অস্বীকার করতো এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনের জন্যই তাদের এ পরিণতি হয়েছিল। ” (২:৬১) মহান আল্লাহ শুষ্ক মরুভূমিতে বনি ইসরাইল বংশের জন্য পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও ইহুদীরা একদিকে অকৃতজ্ঞ এবং অন্যদিকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রত্যাশী ও স্বার্থপর ছিল বলে হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে আরো বেশী খাবারের জন্য দাবি করল। মূসা (আঃ) তাদেরকে জবাবে বললেন, প্রথমত: তোমরা উত্তম স্বর্গীয় খাদ্যের পরিবর্তে নিকৃষ্ট খাদ্য চাচ্ছো। দ্বিতীয়ত: এ ধরনের খাবার পেতে হলে তোমাদেরকে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে এবং এমন এক শহরে যেতে হবে যেখানে তোমরা ওইসব খাবার পেতে সক্ষম হবে। তোমরা যুদ্ধ ও জেহাদের জন্য প্রস্তুত নও অথচ সমস্ত নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে চাও। তোমাদের এ ধরনের ভোগবাদী বা খাই-খাই মনোভাব তোমাদেরকে লাঞ্ছনা ও দূর্দশার মধ্যে ফেলেছে এবং তোমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসবে। তোমরা এ ধরনের অন্যায় দাবি জানিয়ে আল্লাহর নিদর্শন ও ক্ষমতাকে উপহাস করেছ। এমনকি তোমরা আল্লাহর নবীগণকে বৈষয়িক ও পার্থিব স্বার্থ অর্জনের পথে বাধা দেয়ার জন্য হত্যা করেছ। এই আয়াত থেকে এটাই বোঝা যায় যে, স্বার্থপরতা ও ভোগ-লিপ্সার পরিণতি হল ধ্বংস। যে কোন ধরনের সুবিধাবাদের পরিণাম হলো অমর্যাদা ও লাঞ্ছনা। তাই মানুষকে এ অপরাধ থেকে দূরে থাকতে হবে। এরপর ৬২নং আয়াতে বলা হয়েছে- إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (62) “যারা ঈমান এনেছে, ইহুদী, খ্রিস্টান ও সাবেঈনদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার আছে ও তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।” (২:৬২) যে কোন ঐশী ধর্মে পারলৌকিক পুরস্কারের শর্ত হিসাবে বিশ্বাস ও সৎকর্মের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, পুনরুত্থান বা বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস এবং আল্লাহর নির্দেশাবলী মেনে চলার মাধ্যমে ঐশী পুরস্কার পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদী ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কোন বৈষম্য করা হয়নি। অবশ্য পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। সূরা আল ইমরানের ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের অনুসরণ করলে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। তাই যারা নিজেদের যুগের নবীর প্রতি এবং তাদের ওপর অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পাশাপাশি ওই গ্রন্থের বিধান অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন ও সৎকর্ম করেছে, শুধুমাত্র তারাই ঐশী পুরস্কার লাভ করবে। কিন্তু ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের সাথে সাথে অন্যকোন ধর্মেরই আর গ্রহণযোগ্যতা নেই। সূরা বাকারাহ’র ৬২ নম্বর আয়াতে যেসব ঐশী ধর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসবের মধ্যে একটি হলো সাবেঈনদের ধর্ম। এরা সম্ভবত: হযরত নূহ নবী অথবা ইব্রাহীম (আঃ) বা ইয়াহিয়া (আঃ)-এর অনুসারী ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভুল চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। সাবেঈনরা গণকবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। এই আয়াত থেকে এটাও স্পষ্ট যে, সব ঐশী ধর্ম একত্ববাদ ও পুনরুত্থানের ব্যাপারে একমত এবং বিশ্বাস ও সৎকাজকেই মুক্তির উপায় বলে মনে করে। অযৌক্তিক বিশ্বাস ও আকাঙ্খা এই সব ধর্ম অনুযায়ী মুক্তির উপায় নয়। সূরা বাকারাহ’র ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّورَ خُذُوا مَا آَتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (63) “আর আমি যখন তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তুর পর্বতকে তোমাদের মাথার ওপর তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে,তোমাদিগকে যে কিতাব (তওরাত) দেয়া হয়েছে তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা মনে রেখ যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পার।” (২:৬৩) হযরত মূসা (আঃ)কে যখন তাওরাত গ্রন্থ দেয়া হয়, তখন আল্লাহ বনী ইসরাইলীদের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে,ওই গ্রন্থের নির্দেশ তারা মান্য করবে এবং যে কোন ধরনের অবহেলা থেকে বিরত থাকবে, যাতে তারা খোদা ভীরু হতে পারে। খোদার সাথে অঙ্গীকারের পর তারা কি করেছিল তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। ওই আয়াতে বলা হয়েছে, ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَكُنْتُمْ مِنَ الْخَاسِرِينَ (64 “এরপরও তোমরা বিমুখ হলে,সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পা তোমাদের প্রতি না থাকলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে।” (২:৬৪) বনি ইসরাইলীরা আল্লাহর সাথে ওয়াদাবদ্ধ হবার পরও ঐশী নির্দেশকে অমান্য করে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ দয়া করে পুনরায় তাদেরকে শাস্তি দান থেকে বিরত থাকেন। এ আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- এক. অতিরিক্ত পাবার ইচ্ছে বা লোভ ও স্বার্থপরতা মানুষের সম্মান ও মর্যাদাকে ধ্বংস করে। স্বার্থপরতা ও অতিরিক্ত পাবার ইচ্ছা মানুষের জন্য লাঞ্ছনা ও দূর্গতি ডেকে আনে। এর ফলে মানুষ বৈষয়িক স্বার্থ অর্জনের জন্য আল্লাহর বিধানকে পদদলিত করতে প্রস্তুত হয়। দুই. পাপ বা অপরাধ এবং অবাধ্যতা মানুষকে পর্যায়ক্রমে কুফরী বা অবিশ্বাসের দিকে টেনে নেয় এবং সত্যকে অস্বীকার করার মনোভাব তার মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকে তিন. প্রকৃত শান্তি শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি এবং পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাসের মধ্যেই রয়েছে। এই বিশ্বাসের জন্য তাদেরকে উজ্জ্বল ভবিষ্যত বা সৌভাগ্যের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। সূরা বাকারাহ’র ৬৫ ও ৬৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ الَّذِينَ اعْتَدَوْا مِنْكُمْ فِي السَّبْتِ فَقُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ (65) فَجَعَلْنَاهَا نَكَالًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهَا وَمَا خَلْفَهَا وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ (66) “তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের সীমা লঙ্ঘন করেছিল,তাদের (পরিণতি) তোমরা নিশ্চিতভাবে জানো। আমি তাদের বলেছিলাম-অধম বানর হয়ে যাও। আমি এটা তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীগণের জন্য দৃষ্টান্ত এবং সাবধানীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ করেছি।” (২:৬৫-৬৬) এখানে বনি ইসরাইলীদের আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি হল- মহান আল্লাহ তাদের জন্য শনিবারকে বিশ্রামের দিন ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ শনিবারে কাজ-কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারী একদল ইহুদী এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শনিবারে মাছ ধরতো। তারা সাগরের প্রান্তে এক ধরনের ফাঁদ বা গর্ত তৈরি করতো এবং ওইসব গর্তে মাছ প্রবেশ করার পর গর্তের মুখ বা প্রবেশপথ বন্ধ করে দিত এবং পরের দিন অর্থাৎ রোববারে ওইসব মাছ ধরতো। আর এভাবে তারা আল্লাহর নির্দেশকে অবজ্ঞা করেছিল। আল্লাহও তার বিধানকে অমান্য করা ও ঐশি বিধি-বিধানকে অবজ্ঞা করার শাস্তি হিসাবে তাদের চেহারাকে বিকৃত করে দেন এবং তাদেরকে বানরে রূপান্তরিত করেন যাতে অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। যদিও পশুরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত নয়, কিন্তু মানুষকে পশুতে রূপান্তর করার মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে নিজের দরবার ও অনুগ্রহ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এরপর ৬৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً قَالُوا أَتَتَّخِذُنَا هُزُوًا قَالَ أَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ (67 “স্মরণ কর যখন মূসা আপন সম্প্রদায়কে বলেছিল, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের একটি গরু জবাই করার আদেশ দিয়েছেন, তারা বলেছিল-তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছ? মূসা বলল, আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি,যাতে মূর্খদের অন্তর্ভূক্ত না হই।” (২:৬৭) এখানে বনী ইসরাইলের গরুর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ কারণেই এই সূরার নাম বাকারাহ অর্থাৎ গরু রাখা হয়েছে। ৬৭ থেকে ৭৩তম আয়াতে এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি হলো, বনী ইসরাইলীদের মধ্যে নিহত এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেল। কিন্তু হত্যাকারী কে তা জানা গেল না। এ নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। প্রত্যেক গোত্রই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অন্যান্য গোত্রকে দায়ী করছিল। অবশেষে এ বিবাদের মীমাংসার জন্য বনী ইসরাইলের লোকেরা হযরত মূসা (আঃ)-এর শরণাপন্ন হলো। যেহেতু সাধারণ উপায়ে এ সমস্যার সামাধান করা সম্ভব ছিল না, তাই হযরত মূসা (আঃ) অলৌকিক পন্থায় এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি বনী ইসরাইলীদের বললেন, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, একটি গরু জবাই করতে হবে। এরপর জবাই করা গরুর এক টুকরো গোশত নিহত ব্যক্তির গায়ে স্পর্শ করলে সে জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেবে।” তারা এই নির্দেশ শুনে মূসা (আঃ)কে বলল, এ ধরনের পরামর্শ দিয়ে তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছো ? হযরত মূসা (আঃ) জবাবে বললেন, ঠাট্টা বিদ্রুপ করা অজ্ঞ লোকদের কাজ। আল্লাহর নবীরা কখনও এমনটি করেন না। যদি হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে চাও তবে নির্দেশিত এই কাজ করতে হবে। এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, যদি আল্লাহর নির্দেশ আমাদের রুচি ও জ্ঞান অনুযায়ী বোধগম্য না হয়, তাহলেও তাকে অবজ্ঞা করা আমাদের উচিত নয় এবং কখনোই এ ধরনের নির্দেশকে হালকা ও গুরুত্বহীন মনে করা যাবে না। আল্লাহ ইচ্ছে করলে, অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে হত্যাকারীর নাম বা পরিচয় মূসা (আঃ)কে বলে দিতে পারতেন,কিন্তু গরু জবাইয়ের নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ ইহুদীদের মধ্য থেকে বাছুর বা গরুভক্তি বা গরু পূজার প্রচলন ও এ ধরনের মানসিকতা দূর করতে চেয়েছিলেন। এরপর ৬৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে- قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّنْ لَنَا مَا هِيَ قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ لَا فَارِضٌ وَلَا بِكْرٌ عَوَانٌ بَيْنَ ذَلِكَ فَافْعَلُوا مَا تُؤْمَرُونَ (68 “বনী ইসরাইলীরা মূসাকে বলেছিল,তুমি আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল যে, তা কি রকম গরু? মূসা বলল, তিনি অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন, সেই গরু বৃদ্ধও নয়, অল্প বয়স্ক বা শাবকও নয়-মধ্য বয়সী। অতএব তোমরা যেমন আদেশ পেলে তেমনই কর।” (২:৬৮) যখন ইহুদীরা বুঝতে পারলো যে, গরু জবাই করার আদেশ সত্যি বা অবশ্য করণীয়, তখন তারা বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা শুরু করল এবং জানতে চাইল কোন ধরনের গরু জবাই করতে হবে? সম্ভবত এ ধরনের প্রশ্ন প্রকৃত হত্যাকারীর পক্ষ থেকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে এই অপরাধ বা কেলেঙ্কারীর হোতাকে জনগণ চিনতে না পারে। যদিও প্রশ্ন করা ভালো লক্ষণ এবং প্রশ্নের মাধ্যমে অনেক অস্পষ্টতা দূর হয়, কিন্তু ইহুদীরা এ ধরনের প্রশ্ন তুলে উপলদ্ধি বা বোঝার পরিবর্তে দায়িত্ব পালন না করার চেষ্টা করছিল। তাই তারা অভদ্রভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে, যেমন তারা বলেছে, ‘হে মূসা! তোমার খোদার কাছে প্রার্থনা কর।’ ভাবটা এমন যে, মূসা (আঃ)এর খোদা ও তাদের খোদা যেন দুই ভিন্ন খোদা। এরপর এই সূরার ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّنْ لَنَا مَا لَوْنُهَا قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ صَفْرَاءُ فَاقِعٌ لَوْنُهَا تَسُرُّ النَّاظِرِينَ (69 “তারা বলল- তুমি আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের গরুর রং কেমন তা বর্ণনা করেন। মুসা বললেন, তিনি ( আল্লাহ) বলেছেন, সেই গরুর বর্ণ গাঢ় হলুদ যা দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।” (২:৬৯) পুনরায় যখন গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেয়া হল, তখনও তারা ওই নির্দেশ পালনে অনিচ্ছুক ছিল। তাই তারা আরো প্রশ্ন করা শুরু করে এবং জানতে চায় যে, ওই গরুর রং কেমন হতে হবে? অথচ আল্লাহর প্রথম নির্দেশে গরুর কোন নির্দিষ্ট রঙের কথা উল্লেখ করা ছিল না। যদি রঙের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হত তবে আল্লাহ প্রথম নির্দেশেই তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু আল্লাহ তাদের অজুহাত সৃষ্টির পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পরে নির্দিষ্ট রঙের কথা উল্লেখ করেন। অন্যদিকে তারা এটাও যেন বুঝতে পারে, যে গরুর জবাইয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা যেন কুৎসিৎ ও অকেজো বা মূল্যহীন না হয়ে মধ্য বয়স্ক এবং চোখ জুড়ানো উজ্জ্বল রঙের হয়। সূরা বাকারাহ’র ৬৫ নম্বর থেকে ৬৯ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক. আল্লাহর নির্দেশ মান্য করার ক্ষেত্রে প্রতারণা বা ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেয়া যাবে না। ধর্মের শুধু বাহ্যিক দিক রক্ষা করে আমরা যেন খোদার বিধানের মূল বিষয়কে পরিবর্তন না করি। কারণ বাহ্যিক দিক নয় বরং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা লক্ষ্যই হল খোদার বিধানের মূল দিক। তাই মর্মার্থ হতে দূরে থেকে ধর্মের চেহারাকে বিকৃত করা হলে মানবতার মূল চেহারা বা প্রকৃতি বা চরিত্রেও বিকৃতি দেখা দেবে। বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা শনিবারে মাছ ধরতো তাদের মধ্যে এ বিকৃতি দেখা দেয়। দুই. খোদায়ী শাস্তি শুধু পরকালের জন্যই নির্ধারিত নয়, অনেক সময় আল্লাহ কোন কোন অপরাধের জন্যে পৃথিবীতেই শাস্তি দিয়ে থাকেন, যাতে করে ওই যুগের মানুষ ও ভবিষ্যত প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা নেয়। তিন. আল্লাহর বিধানকে আমরা যেন ঠাট্টা ও উপহাস না করি। বরং আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে যেসব নির্দেশ বা বিধান দিয়েছেন তা মানবসমাজের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্যই দিয়েছেন। সূরা বাকারাহ’র ৭০ ও ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে- قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّنْ لَنَا مَا هِيَ إِنَّ الْبَقَرَ تَشَابَهَ عَلَيْنَا وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ لَمُهْتَدُونَ (70) قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ لَا ذَلُولٌ تُثِيرُ الْأَرْضَ وَلَا تَسْقِي الْحَرْثَ مُسَلَّمَةٌ لَا شِيَةَ فِيهَا قَالُوا الْآَنَ جِئْتَ بِالْحَقِّ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُوا يَفْعَلُونَ (71) “বনী ইসরাইল মূসাকে বললো, গরুটি কি ধরনের হতে হবে তা তোমার প্রতিপালককে আমাদের জন্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল। আমাদের কাছে গরুতো একই রকম। আর আল্লাহ চাইলে আমরা নিশ্চয়ই সঠিক পথ পাব। মূসা জবাবে বললেন, আল্লাহ বলছেন তা এমন এক গরু যা জমি চাষ ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়নি-সুস্থ ও নিখুঁত। তারা বললো, এখন তুমি ঠিক কথা বলেছ। এরপর তারা গরুটি জবাই করলো, যদিও তারা প্রায় এ কাজ বর্জনে উদ্যত হয়েছিল।” (২:৭০-৭১) গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, আল্লাহপাক হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। বনী ইসরাইল গোত্রের একাংশ নানা অজুহাত খাড়া করতে লাগল এবং উপহাস করে গরুর রং ও বয়স জিজ্ঞাসা করতে থাকে। এ আয়াতেও বনি ইসরাইল বা ইহুদীদের আনা একের পর এক অজুহাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহপাক গরুর রং ও বয়স বলে দেয়ার পরও তারা বললো, হে মূসা! ওই গরুকে চেনার জন্য আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলো। হযরত মূসা যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওই গরুর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দিল তখন বনি ইসরাইলীদের আর কোন অজুহাত থাকল না এবং তারা ওই গরুকে জবাই করলো। যদিও আল্লাহর নির্দেশ মানার কোন আগ্রহ তাদের ছিল না। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানুষের একগুঁয়েমি তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়,যে সে নিজের ইচ্ছা ও মতকেই শুধু সঠিক বলে মনে করে। তাই দেখা যায় হযরত মূসা (আঃ)গরু সম্পর্কে এত বর্ণনা দেয়ার পরও বনী ইসরাইল ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে বলে, “এতক্ষণে তুমি সঠিক বলেছো। ” এবারে সূরা বাকারাহ’র ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে, وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًا فَادَّارَأْتُمْ فِيهَا وَاللَّهُ مُخْرِجٌ مَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ (72) فَقُلْنَا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا كَذَلِكَ يُحْيِي اللَّهُ الْمَوْتَى وَيُرِيكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (73) “স্মরণ কর যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করছিলে। কিন্তু তোমরা যা গোপন রাখছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন। এরপর আমি বললাম, গরুর কোন একটি অংশ দিয়ে নিহত ব্যক্তিকে স্পর্শ কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং নিজের নিদর্শন তোমাদেরকে দেখিয়ে থাকেন। যাতে তোমরা উপলদ্ধি কর।” (২:৭২-৭৩) এর আগের আয়াতগুলোয় বনী ইসরাইলের নানারকম অজুহাতের কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। এ দুই আয়াতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তোমরা হত্যা করেছিলে এবং হত্যাকারীর পরিচয় গোপন রেখেছিলে। কিন্তু আল্লাহ তার অসীম ক্ষমতার মাধ্যমে তোমাদের অন্যায় ফাঁস করে দিয়েছেন। তাই জেনে রাখ আল্লাহ অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করার ক্ষমতা রাখেন। মৃতকে জীবিত করার অসীম ক্ষমতা যে আল্লাহ রাখেন এ আয়াত তারই নিদর্শন। আল্লাহর এ ধরনের ক্ষমতা দেখে মানুষ যাতে পরকালের ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে এবং জেনে রাখে যে আল্লাহ ইচ্ছা করলে একটি মৃত দেহের ওপর আরেকটি মৃতের অংগের স্পর্শে জীবিত করতে পারেন। এরপর ৭৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (74 “অতঃপর এ ঘটনার পরে তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন। পাথরের মধ্যে এমনও আছে; যা থেকে ঝরণা প্রবাহিত হয়, এমনও আছে, যা বিদীর্ণ হয়,এরপর তা থেকে পানি নির্গত হয় এবং এমনও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে (পাহাড় থেকে) খসে পড়তে থাকে! আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।” (২:৭৪) সূরা বাকারাহ’র ৪৯ নম্বর আয়াত থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বনী ইসরাইলীদের প্রতি আল্লাহর বহু নেয়ামত ও মোজেযার কথা বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি, নীল নদ দু’ভাগে বিভক্ত হওয়া, বাছুর পূজার তওবা কবুল, ঐশী খাবার-দাবার লাভ, মেঘকে ছায়া হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর সর্বশেষ ঘটনা হলো- অলৌকিক উপায়ে হত্যাকারীর পরিচয় উদ্ঘাটন। কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার এতসব নিদর্শন ও মোজেযা দেখার পরও বনী ইসরাইল আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পন করেনি বরং আল্লাহর হুকুম এড়িয়ে যাবার জন্য নানারকম পাঁয়তারা করছিল। যাকে কিনা কোরআন ‘পাষাণ হৃদয়’ বিশেষণে আখ্যায়িত করেছে। মানুষ অনেক সময় এমন অধঃপতনের শিকার হয় যা তাকে জীব-জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্টে পরিণত করে কিংবা তাকে পাথরের চেয়ে কঠিন করে ফেলে। এ আয়াতে বলা হয়েছে- কঠিন পাথর অনেক সময় ফেটে তা থেকে পানি প্রবাহিত হয় কিংবা অন্তত: নীচের দিকে ধ্বসে পড়ে। কিন্তু কিছু মানুষের অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত। কোন ভালবাসা কিংবা প্রেমে তাদের অন্তর বিগলিত হওয়াতো দূরের কথা আল্লাহর ভয়েও তাদের হৃদয় কাঁপে না। তাই তারা মানুষের উপকারও করে না এবং আল্লাহর হুকুম-নির্দেশও মেনে চলে না। সূরা বাকারাহ’র ৭০ থেকে ৭৪ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে- এক. আল্লাহর নির্দেশ এড়ানোর জন্যে ছলচাতুরির আশ্রয় কিংবা একগুঁয়েমি করা ঠিক নয়। এ উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করাও অন্যায়। কারণ দেখা যায়, প্রশ্ন অনেক সময় জানার জন্যে নয় বরং দায়িত্ব এড়ানোর জন্য প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। দুই. আল্লাহর নির্দেশে যে পশু জবাই করা হবে তা নিখুঁত হওয়া দরকার। তাই হজ্বের সময় হাজীরা কোরবানীর ঈদের দিন ত্রুটিমুক্ত পশু জবাই করেন। তিন. আমাদের প্রকাশ্য-গোপন সব কাজের ব্যাপারেই আল্লাহ পূর্ণ অবগত। তিনি চাইলে আমাদের ঐসব কাজ প্রকাশ করে আমাদের অপদস্ত করতে পারেন। তাই পাপ করা উচিত নয় কিংবা নিজের পাপ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। চার. অনেক ক্ষেত্রে এ দুনিয়াতেই আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার শক্তি প্রদর্শন করেন এবং আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন কেয়ামত সম্পর্কে গভীর চিন্তা করতে। সূরা বাকারাহ’র ৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- أَفَتَطْمَعُونَ أَنْ يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِنْ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (74 “(হে মুসলমানগণ!) তোমরা কি আশা কর যে,তারা (ইহুদীরা) তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিল,যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; এরপর বুঝে-শুনে তা বিকৃত করত এবং তারা তা অবগত ছিল।”(২:৭৫) ইসলাম আবির্ভাবের পর আশা করা হয়েছিল যে, ইহুদীরা অন্যদের আগে ইসলাম গ্রহণ করবে। কারণ তারা মুশরিকদের মত ছিল না বরং তাদের কাছে ছিল আসমানী কিতাব। তারা তাদের ওই গ্রন্থ থেকে ইসলামের নবীর বৈশিষ্ট্য জেনে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও তারা কার্যত মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাথে জোটবদ্ধ হয়। তাই এ আয়াতে আল্লাহ পাক মহানবী (সাঃ) ও মুসলমানদেরকে সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন যে, ইহুদীরা যদি ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এতে নিজেদের ঈমান ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া ঠিক নয়। ইহুদী সম্প্রদায় সহজেই ঐশি ধর্ম গ্রহণ করবে এমন আশা করা অনুচিত। কারণ এরা হলো তাদেরই বংশধর যারা হযরত মূসার সাথে তুর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহর বাণী শুনেছে এবং তার বিধান উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু তারপরও তারা তা অবলীলায় বিকৃত করেছে এবং ঐশি ধর্মের বিরুদ্ধাচারণে লিপ্ত হয়েছে। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়-প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পণ্ডিত ব্যক্তিরা সত্যকে বিকৃত করে গোটা জাতিকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ ধরনের পণ্ডিত ব্যক্তিরা সত্যকে জেনেও এমনভাবে তা তুলে ধরে যাতে জনগণ বিভ্রান্তিতে পড়ে। এরপর ৭৬ ও ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آَمَنُوا قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ قَالُوا أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ لِيُحَاجُّوكُمْ بِهِ عِنْدَ رَبِّكُمْ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (76) أَوَلَا يَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ (77 “যখন তারা মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত হয়,তখন বলে আমরা মুসলমান হয়েছি। আর যখন পরস্পরের সাথে নিভৃতে অবস্থান করে,তখন বলে, আল্লাহ তোমাদেরকে (ইসলামের নবীর বৈশিষ্ট সম্পর্কে ) যে ধারণা দিয়েছেন তা কি তাদেরকে (মুসলমানদেরকে) বলে দিয়েছ ? তাহলে যে তারা এ নিয়ে আল্লাহর সামনে (কেয়ামতের দিন) তোমাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। তোমরা কি তা উপলব্ধি কর না? তারা কি জানে না যে, যা তারা গোপন রাখে কিংবা প্রকাশ করে নিশ্চিতভাবে আল্লাহ তা জানেন?” (২:৭৬-৭৭) ইসলামের প্রাথমিক যুগে অনেক ইহুদী মুসলমানদেরকে দেখলে বলতো, তোমাদের পয়গম্বরের নিদর্শনগুলো আমাদের তাওরাত গ্রন্থের ভবিষ্যদ্বানীর সাথে মিলে যাওয়ায় আমরাও তোমাদের ধর্মের ওপর ঈমান আনব। কিন্তু যখন তারা অন্যান্য ইহুদীদের সাথে মিলিত হত, তখন তারা শেষ নবীর নিদর্শনগুলো মুসলমানদেরকে বলে দেয়ার জন্যে পরস্পরকে তিরস্কার করতো এবং তারা বলতো মুসলমানরা এ বিষয়কে কেয়ামতের সময় তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। ইহুদী পণ্ডিতরা সত্যকে বিকৃত করায় বর্তমানেও অনেক লোক ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসরণ করছে। এরপর ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ (78 “ইহুদীদের মধ্যে এমন অনেক অশিক্ষিত লোক আছে যারা আল্লাহর গ্রন্থকে কল্পনা বা মিথ্যা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া অন্য কিছু মনে করে না এবং শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং তারা অনুমান বা কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু জানে না।” (২:৭৮) এই আয়াতে বনী ইসরাইলের অন্য একটি দলের কথা বলা হয়েছে, যারা ছিল তাওরাত গ্রন্থ বিকৃতকারী পণ্ডিতদের বিপরীতে সাধারণ অশিক্ষিত ইহুদী। এরা তাওরাত গ্রন্থ সম্পর্কে কোন খবর রাখতো না এবং নিজেদের খেয়াল-খুশী মত জীবন যাপন করত। তারা মনে করতো, তাওরাত গ্রন্থে ইহুদী জাতিকে উন্নত জাতি বলে ধারণা দেয়া হয়েছে এবং তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র। আর পরকালে শুধু মাত্র ইহুদীরাই মুক্তি বা পরিত্রাণ পাবে এবং তারা নরক বা জাহান্নামে যাবে না, যদি তাদেরকে শাস্তি দেয়াও হয় তবে তা কয়েক দিনের বেশী স্থায়ী হবে না। এ ধরনের ভুল ধারণা অন্যান্য ঐশী ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই জানতে হবে এইসব শুধুমাত্র অশিক্ষা ও ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। কারণ কোন ঐশী ধর্মেই এ ধরনের অবাস্তব কথা বলা হয়নি। এ সূরার ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ (79 “সুতরাং তাদের জন্য আফসোস,যারা স্বহস্তে গ্রন্থ রচনা করে ও সামান্য মূল্য পাবার আশায় বলে যে, তা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। আক্ষেপ, তাদের হাত যা রচনা করেছে এবং আক্ষেপ যা তারা উপার্জন করেছে।” (২:৭৯) ইতিহাসে সব সময়ই অনেক পণ্ডিত ধর্মকে নিজেদের পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করেছে, এখনো অনেকে তা করছে। দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা যেমন পণ্য বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে, তেমনি অনেক অর্থলোভী ধর্মের মুখোশ পরে ধর্মকে বিক্রি করে সম্পদশালী হচ্ছে। মানুষকে খুশী করার জন্য অথবা শাসকদের কাছ থেকে উঁচু মর্যাদা বা পদ পাবার জন্য কিংবা ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য আল্লাহর বিধানের নামে অনেকে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়। পবিত্র কোরআন কঠোর ভাষায়-আক্ষেপ শব্দের পুনরাবৃত্তি করে এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। আজকের আলোচিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- এক. সব মানুষ বিশ্বাসী হবে বা ঈমান আনবে এমনটি আশা করা ভাল, কিন্তু এটাও সত্য যে,বহু মানুষ সত্যকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নয়। তাই তাদের অবিশ্বাস যেন আমাদের বিশ্বাসের মধ্যে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। দুই. মন গড়া ধর্ম তৈরি ও ধর্ম বিক্রি করা হলো দুর্নীতি পরায়ণ পণ্ডিতদের কাজ। তাই কোন ব্ক্তব্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সাবধান হতে হবে। এ ধরনের পণ্ডিতরা ধর্মের মুখোশ পরে থাকলেও জনগণকে সাবধান হতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ’র ৮০ নম্বর আয়াতে বলেছেন- وَقَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَعْدُودَةً قُلْ أَتَّخَذْتُمْ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدًا فَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ عَهْدَهُ أَمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ (80) “বনী ইসরাইল বললো : দোজখের আগুন আমাদেরকে অল্প কয়েক দিন ছাড়া কখনো স্পর্শ করবে না। হে নবী! আপনি তাদের বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার পেয়েছ যে, আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন না। কিংবা তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলছো যা তোমরা জানো না।” (২:৮০) গত পর্বে বলা হয়েছে, সাধারণ ইহুদীদের অনেকেরই ঐশী কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না, অথচ তারা অযথাই ভাবতো যে, ইহুদী জাতি বুঝি শ্রেষ্ঠ জাতি এবং আল্লাহর প্রিয়। তারা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বলতো, ‘ইহুদীরা কোন গুনাহ করলেও আল্লাহ অন্যদের চেয়ে তাদেরকে কম শাস্তি দেবেন এবং শুধু অল্প কয়েক দিনের জন্যে তারা শাস্তি ভোগ করবে।’ এ আয়াত ইহুদীদের ওই অলীক ধারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, এটা আল্লাহর প্রতি তোমাদের মিথ্যা অপবাদ। কারণ তিনি শাস্তি বা পুরস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর বান্দাদের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করেন না। প্রকৃতপক্ষে বংশ ও গোত্রের ভিত্তিতে কোন রকম মর্যাদার দাবি করা কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু মাত্র তাকওয়া ও সৎকাজ মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি। পরকালেও আল্লাহ মানুষকে পুরস্কৃত বা সাজা দেবেন খোদাভীরুতা ও সৎ কাজের ভিত্তিতে। এরপরের দুই আয়াত অর্থাৎ ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (81) وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (82 “যে পাপ কাজ করে এবং সে পাপ তাকে পরিবেষ্টন করে ফেলেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী, আর সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে তারা বেহেশতবাসী এবং সেখানেই তারা চিরদিন থাকবে।” (২:৮১-৮২) ইহুদীরা দোজখে যাবে না বলে যে ধারণা করতো, এর আগের আয়াতে তা উল্লেখ করে বিষয়টিকে আল্লাহর প্রতি ইহুদীদের অপবাদ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই দুই আয়াতে পরকালে আল্লাহর সাজা ও পুরস্কারের মাপকাঠির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ পাপ করলে এবং পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হলে, তার অবস্থান যেন আগুনের মধ্যে, ফলে ওই আগুন থেকে পালানোর কোন উপায় তার নেই। আর এই শাস্তির ক্ষেত্রে ইহুদী জাতির সাথে অন্যান্য জাতির কোন পার্থক্য নেই। আর চিরস্থায়ী বেহেশতে প্রবেশের জন্য শর্ত হলো ঈমান ও সৎকাজ। শুধু ঈমান কিংবা শুধু সৎকাজের মাধ্যমে বেহেশতে যাওয়া সম্ভব নয়,বরং দু’টিই থাকতে হবে। এবারে সূরা বাকারাহ’র ৮৩ নম্বর আয়াতের দিকে যাচ্ছি। এ আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مُعْرِضُونَ (83 “স্মরণ কর যখন বনী ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো এবাদত করবে না। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন,এতিম ও দরিদ্রদের প্রতি সদাচরণ করবে,মানুষের সঙ্গে সদালাপ করবে,নামাজ কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। কিন্তু অল্প কিছু লোক ছাড়া তোমরা সবাই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে।” (২:৮৩) এর আগে কয়েকটি আয়াতে বনী ইসরাইল আল্লাহর সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলো, শুধু সে কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু অঙ্গীকারের বিষয়বস্তুর বর্ণনা দেয়া হয়নি। তবে এ আয়াতে এবং এর পরের আয়াতগুলোয় বনী ইসরাইলীদের অঙ্গীকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে। ইহুদীরা তাদের ওয়াদা লঙ্ঘন করায় এসব আয়াতে আল্লাহপাক তাদেরকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেন। নবীদের মাধ্যমে আল্লাহর প্রেরিত নির্দেশ, মানুষের বিবেক ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই সঁপে দিয়েছিলেন ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রবণতা। সব নবীর মূল কথা তৌহিদ ও এক আল্লাহর উপাসনা করা। অর্থাৎ মানুষের কাজ যদি আল্লাহকেন্দ্রীক হয় তবেই তা কল্যাণ বয়ে আনবে। আল্লাহর এবাদতের পর তার দ্বিতীয় নির্দেশ হলো পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের প্রতি উত্তম আচরণ করা। কারণ তাদের মাধ্যমেই আমরা জন্মলাভ করি এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ আসে তাদের মাধ্যমে। বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণের পাশাপাশি সমাজের দুঃস্থ বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনদেরকে সাহায্যের কথাও বলা হয়েছে। যাতে মানুষ শুধু নিজের কথা এবং পরিবারের কথাই না ভাবে এবং সমাজের প্রতিও লক্ষ্য রাখে। মানব সেবার পাশাপাশি বিশেষ উপায়ে আল্লাহর উপাসনা অর্থাৎ নামাজের কথা বলা হয়েছে। কারণ স্রষ্টার সাথে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কের প্রয়োজন উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। শুধু আচার-আচরণেই নয়,একজন খোদাভীরুকে কথা বার্তায়ও হতে হবে সুন্দর। শুধু নিজ ধর্মের ও গোত্রের লোকদের সাথেই নয় বরং মুমিন, কাফের নির্বিশেষে সবার সাথে তাকে সদালাপী হতে হবে। এরপর ৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ لَا تَسْفِكُونَ دِمَاءَكُمْ وَلَا تُخْرِجُونَ أَنْفُسَكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ ثُمَّ أَقْرَرْتُمْ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ (84 “সেই সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন তোমাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে,তোমরা কেউ কারো রক্তপাত করবে না এবং পরস্পরকে নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করবে না। এরপর তোমরা ত্রুটি স্বীকার করেছিলে এবং এ ব্যাপারে তোমরাই তার সাক্ষী।” (২:৮৪) এর আগের আয়াতে আল্লাহর ৬টি নির্দেশ বর্ণনার পর এ আয়াতে আরো দু’টি নির্দেশের কথা বলা হয়েছে। একটি মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এবং অন্যটি হলো মাতৃভূমি ও ঘর-বাড়ির ওপর মানুষের অধিকার সংক্রান্ত। একটা সমাজের ন্যূনতম প্রাথমিক চাহিদাগুলোর একটি হলো জনগণের প্রাণের নিরাপত্তা। সকল ঐশী ধর্মে প্রাণের নিরাপত্তা ও মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের। সে যে জাতি, ধর্ম বা গোত্রেরই হোক না কেন কেউ মানুষের এ অধিকার হরণ করতে পারে না। তাই হত্যা করা কবিরা গুনাহ এবং দুনিয়াতে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আর পরকালের শাস্তি হলো চিরস্থায়ী জাহান্নাম। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত ও প্রবৃত্তিগত ব্যাপার। তাই ধর্মও এ অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে থাকে। এজন্য মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকার থেকে কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারে না। ৮০ থেকে ৮৪ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়গুলো একে একে এবার তুলে ধরছি। এক. ধর্মের দৃষ্টিতে বর্ণবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং পৃথিবীর সব মানুষ আল্লাহর কাছে সমান। দুই. আল্লাহর দেয়া পুরস্কার ও শাস্তির মাপকাঠি হলো মানুষের ঈমান ও কাজ। সৎকাজ ছাড়া কেউ যদি নিছক আশা করে তাতে কোন লাভ হবে না। তিন. অনেক সময় পাপ মানুষের অস্তিত্বে এমনভাবে প্রবেশ করে যে, তার হৃদয় ও আত্মাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে এবং তার কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মে মন্দ ছাড়া কিছু থাকে না। চার. মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহপাক মানুষের কাছ থেকে যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-তওহীদ ও এক আল্লাহর উপাসনা, পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, দুঃস্থ লোক জন, আত্মীয়-স্বজন ও এতিমদের সাহায্য, মানুষের সাথে সদালাপ, নামাজ কায়েম,যাকাত দান,হত্যা ও রক্তপাত পরিহার এবং অন্যের ঘর-বাড়ি ও মাতৃভূমির ওপর আগ্রাসন চালানো থেকে বিরত থাকা। সূরা বাকারাহ’র ৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ثُمَّ أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ تَقْتُلُونَ أَنْفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِنْكُمْ مِنْ دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ عَلَيْهِمْ بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِنْ يَأْتُوكُمْ أُسَارَى تُفَادُوهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (85 “অতঃপর সেই তোমরাই প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তোমাদের একে অন্যকে হত্যা করছ এবং তোমরাই একদলকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বের করে দিচ্ছ, তোমরা তাদের প্রতি অন্যায় ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরকে সাহায্য করছ এবং তারা বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসলে তোমরা মুক্তিপণ নাও। অথচ তাদেরকে বহিষ্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ অবিশ্বাস কর ? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তারা পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া অন্য কিছু পাবে না এবং পুনরুত্থান বা কিয়ামতের দিনে তারা কঠোর শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। আর তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন।” (২:৮৫) এ আয়াতে বনী ইসরাইলকে তিরস্কার করে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে একে অন্যকে হত্যা করেছে এবং তাদেরই একদলকে মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করেছে। অথচ অদ্ভুত বিষয় হলো, তারা তাওরাত গ্রন্থের বিধান অনুযায়ী বন্দীদের মুক্তি দেয়ার জন্য মুক্তিপণ নেয়। মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দেয়া যেমন তাওরাতের বিধান তেমনি হত্যা না করা ও কাউকে তার ঘর বাড়ী থেকে তাড়িয়ে না দেয়াও তাওরাতের বিধান। প্রকৃতপক্ষে তোমরা আসমানী গ্রন্থের পরিবর্তে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়েছিল। তারা খোদার যেসব বিধানকে নিজেদের রুচি ও ইচ্ছের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করতো শুধু সেগুলোকেই মান্য করতো,আর নিজেদের মনমত না হলে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করতে। এই আয়াত অনুযায়ী মানুষের প্রকৃত ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায় তার কাজে-যেসব কাজের জন্য আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন। ঈমানের পরিচয় সে ধরনের কাজে পাওয়া যায় না যেসব কাজ মানুষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পছন্দ অনুযায়ী কারে থাকে। কারণ এ ধরনের কাজ আল্লাহর ইবাদত নয় বরং নিজেরই পূজা বা উপাসনা। শুধু পাপ করা নয়, পাপীকে সহযোগিতা করাও নিষিদ্ধ। রাসূল (সাঃ)-এর আহলে বাইত হযরত ইমাম কাজেম (আঃ) একজন মুসলমানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদের দরবারের জন্য উট ভাড়া দেয়া জায়েজ নয়। যদি তারা হজ্বে যাবার জন্যেও ভাড়া নিতে চায় তবুও উট ভাড়া দেয়া জায়েজ হবে না। কারণ তারা সফর থেকে নিরাপদে ফিরে এসে তোমাকে ভাড়ার অর্থ পরিশোধ করুক এটাই তুমি চাইবে। কিন্তু কোন অত্যাচারী বেশি দিন বেঁচে থাকুক এই কামনা করাও তো পাপ। এবারে সূরা বাকারাহ’র ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآَخِرَةِ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ (86 “এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। সুতরাং তাদের শাস্তি হ্রাস করা হবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।”(২:৮৬) এই আয়াতে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করা, হত্যা করা এবং অন্যদেরকে ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বনী ইসরাইলীরা শুধু দুনিয়ার জীবনের পিছনেই ছুটছে এবং শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষাকারী বিধানগুলোই পালন করছে। কিন্তু আখেরাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের প্রতি তারা উদাসীন। এত দুনিয়া পূজা ও পাপ করা সত্ত্বেও ইহুদীরা পরকালে শাস্তি পাবে না বলে দাবি করতো। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে যে,তাদের এই দূরাশার বিপরীতে অন্যান্য পাপীদের মত তারাও তাদের পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করবে এবং কেউই তাদের সাহায্য করবে না। এরপর ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ (87) “অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি। এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসূল পাঠিয়েছি। আমি মরিয়ম তনয় ঈসাকে সুস্পষ্ট মোজেযা দান করেছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে শক্তিদান করেছি। অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে, যা তোমাদের মনে ভাল লাগেনি, তখনই তোমরা অহংকার করেছ। শেষ পর্যন্ত তোমরা একদলকে মিথ্যাবাদী বলেছ এবং একদলকে হত্যা করেছ।” (২: ৮৭) এ আয়াতে মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর অবিরাম অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে মহান আল্লাহ মূসা (আঃ)এর পর বনী ইসরাইলের কাছে অন্যান্য নবীদের পাঠিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন অন্যতম। কিন্তু ইহুদীরা দুনিয়াপূজা ও আত্মপূজার কারণে নিজেদের অবাধ্যতার চিরাচরিত রীতি অনুসরণের মাধ্যমে ঐসব নবীদের অস্বীকার করেছে, এমনকি তাদের অনেককে শহীদ করেছে। কারণ নবীরা ইহুদীদের অবৈধ দাবি মেনে নিতে রাজি হননি। ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ بَلْ لَعَنَهُمُ اللَّهُ بِكُفْرِهِمْ فَقَلِيلًا مَا يُؤْمِنُونَ (88) “তারা (নবীদেরকে) বলেছিল, আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত, (আমরা তোমাদের বক্তব্যের কিছুই বুঝি না)। আসলে তা নয় বরং অবাধ্যতার জন্য আল্লাহ তাদের অভিশাপ দিয়েছেন (আর এ জন্যই তারা বুঝতে পারছে না) এবং তাদের অল্প সংখ্যকই বিশ্বাস করে। ” (২:৮৮) দাম্ভিক ও অবাধ্য ইহুদীরা নবীদের আহ্বানের জবাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বলতো আমরা এসব কথা বুঝি না এবং যা আমরা বুঝতে পারি না তা গ্রহণও করতে পারব না। পবিত্র কোরআন তাদের এই বিদ্রুপের জবাবে বলেছে, নবীদের বক্তব্য জনগণের জন্য দুর্বোধ্য নয়। আসলে গোয়ার্তুমি ও সত্যকে ঢাকা দেয়ার চেতনার কারণেই একদল ইহুদী সত্যকে বুঝতে পারছে না এবং তারা খুব কমই বিশ্বাস করে। নফস বা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে আত্মপূজার প্রবল চেতনা তাদের চিন্তাধারা ও হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং তারা সত্য ও বাস্তবতাকে পার্থিব বা বৈষয়িক দৃষ্টি দিয়ে দেখে বলে শুধু বাহ্যিক দিকই দেখতে পায়। আর এ জন্যেই তারা ঐশী জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে। এ আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এক. আমাদেরকে আল্লাহর সকল বিধান মেনে নিতে হবে। যেসব বিধান আমাদের পছন্দের বা মনপুত শুধু সেসব মানলেই হবে না। যদি আমরা আল্লাহর বিধান মানার ক্ষেত্রে শুধু পছন্দনীয় বিধানগুলো মানি আর অপছন্দনীয় বিধানগুলো না মানি তাহলে তা হবে আল্লাহর অনুগত্যের পরিবর্তে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ। দুই. আমরা যা-ই করি না কেন আল্লাহ যে তা দেখছেন তা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং এটা মনে রাখতে হবে যে আমরা আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন হলেও আল্লাহ আমাদের ব্যাপারে কখনো উদাসীন নন। আমরা যা কিছু করছি সে সম্পর্কে আল্লাহ সবই জানেন। তিন. আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সকল মানুষ সমান। অনেকে মনে করেন তাদের জাতি সেরা এবং আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। আর এ ধরনের ভুল ধারণার বা দূরাশার জন্য অপরাধীদের শাস্তি মোটেও হ্রাস পাবে না। চার. আল্লাহ মানুষের মুক্তির জন্য অনেক নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু মানুষ কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে নবীদেরকে অস্বীকার করেছে এবং অনেক নবীকে শহীদও করেছে। সূরা বাকারাহ’র ৮৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْكَافِرِينَ (89 “আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের কাছে রাখা নিদর্শনের সমর্থক কিতাব আসার পরও তারা সেই কিতাব অগ্রাহ্য করল। অথচ এর আগে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে তারা তাদের কাছে রাখা নিদর্শনের সাহায্যে বিজয় প্রার্থনা করত। কিন্তু যখন তাদের কাছে তা আসল,তখন তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করল। সুতরাং অবিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ।”(২:৮৯) এর আগের আলোচনায় হযরত মূসা ও তওরাতের বিধানের প্রতি বনী ইসরাইল জাতির বিদ্বেষ ও গোড়ামীর কথা উল্লেখ করেছিলাম৷ আর এ আয়াতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইহুদীদের কথা বলা হয়েছে, যারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী ইসলামের নবীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল এবং নিজেদের ঘর-বাড়ি ও মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল হিজাজে ৷ মদিনা ও মদিনার আশেপাশে বসতিস্থাপনকারী ইহুদীরা মুশরিকদেরকে বলত, খুব শিগগিরই আবির্ভূত হবেন মুহাম্মদ নামের একজন নবী যিনি শত্রুদের ওপর বিজয় লাভ করবেন৷ ইহুদীরা ওই নবীর প্রতি ঈমান আনারও কথা বলত। কিন্তু সত্যিই যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবির্ভূত হলেন এবং মদীনায় হিজরত করলেন, তখন দেখা গেল ইহুদীরা তাদের গোঁড়ামী ও বস্তুপূজার কারণে ঈমান আনতে অস্বীকার করল। অপরদিকে মদিনার মুশরিকরা দলে দলে ঈমান আনল এবং গ্রহণ করল ইসলাম। এ আয়াত থেকে বোঝা যায় স্রেফ জ্ঞানই যথেষ্ট নয় বরং সত্যকে গ্রহণ ও তা মেনে চলার মনোভাবেরও প্রয়োজন ৷ ইহুদীরা এবং তাদের পুরোহিতরা মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও সত্য গ্রহণ ও তা মেনে নিতে পারেনি। এরপর ৯০তম আয়াতে বলা হয়েছে- بِئْسَمَا اشْتَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ أَنْ يَكْفُرُوا بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ بَغْيًا أَنْ يُنَزِّلَ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ فَبَاءُوا بِغَضَبٍ عَلَى غَضَبٍ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ مُهِينٌ (90 “তারা অত্যন্ত নিকৃষ্ট মূল্যে নিজেদেরকে বিক্রি করেছে। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তা হিংসা বশবর্তী হয়ে প্রত্যাখ্যান করে শুধু এ কারণে যে আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। অতএব,তারা ক্রোধের ওপর ক্রোধ অর্জন করেছে। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” (২:৯০) ইহুদীরা আশা করেছিল ইসলামের নবী আসবে তাদের বনী ইসরাইল গোত্র থেকে আর তাহলেই কেবল তারা ওই নবীর প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু তাদের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় গোত্রীয় হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি। এমনকি তারা আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়ে বসে। ইহুদীরা তাদের এ আচরণের মাধ্যমে ক্ষতিকর লেনদেনের স্বীকার হয়েছে। কারণ তারা প্রতিশ্রুত নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্যে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। এ জন্যে তাদেরকে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই পরিণত হয় ইসলামের শত্রুতে। কেবল গোঁড়ামী আর হিংসার কারণেই তারা নবীর প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে এবং নিজেদেরকে বিক্রি করে হিংসার মূল্যে। এভাবে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়। এরপর ৯১তম আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آَمِنُوا بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا نُؤْمِنُ بِمَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا وَيَكْفُرُونَ بِمَا وَرَاءَهُ وَهُوَ الْحَقُّ مُصَدِّقًا لِمَا مَعَهُمْ قُلْ فَلِمَ تَقْتُلُونَ أَنْبِيَاءَ اللَّهِ مِنْ قَبْلُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (91 “যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তাতে বিশ্বাস কর। তারা বলে আমাদের নবীর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাস করি। তা ছাড়া সব কিছুই তারা প্রত্যাখ্যান করে। যদিও এ কোরআন সত্য এবং তাদের কাছে যা আছে তা (কোরআনকে) সমর্থন করে। হে নবী! আপনি তাদের বলুন, যদি তোমরা অতীতে তোমাদের ওপর অবতীর্ণ হওয়া বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসী হতে তবে কেন তোমরা অতীতে নবীদেরকে হত্যা করেছিলে?” (২:৯১) এ আয়াতে ইহুদীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনছো না এ জন্যে যে, তিনি তোমাদের গোত্রের নন। তোমরা যদি সত্যিই ঐশি গ্রন্থ মেনে চল তবে কেন তোমরা অতীতে নবীদেরকে হত্যা করেছিলে? এ থেকে বোঝা যায় তোমরা মূলত: সত্যের বিরোধী ৷ ওই সত্য তোমাদের নবীই বলুক অথবা ইসলামের নবীই বলুক তাতে তোমাদের কিছু এসে যায় না৷ কোরআনের বাণীকে তোমরা যেমন অগ্রাহ্য করেছ তেমনি তওরাতের কথাও তোমরা গ্রহণ করনি ৷’ মূলত: আসমানী গ্রন্থের সব বিষয় এসেছে এক আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং সেসব কোন বিশেষ জাতি বা গোত্রের জন্যে আসেনি বরং এসেছে তাবত মানুষের জন্যে। তাই এটা কারো বলার অধিকার নেই যে, আমি কেবল আমার জাতির নবীকে অনুসরণ করব, অন্য কাউকে নয় । সব ঐশী ধর্মের বিষয়বস্তুর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক এবং একটির সঙ্গে অন্যটির কোন বিরোধ নেই ৷ এরপর ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَقَدْ جَاءَكُمْ مُوسَى بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ اتَّخَذْتُمُ الْعِجْلَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَنْتُمْ ظَالِمُونَ (92) “নিশ্চয় মূসা তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছে৷ কিন্তু তোমরা তার অনুপস্থিতিতে বাছুর পূজা শুরু করেছিলে। সত্যিই তোমরা ছিলে বড় অত্যাচারী।” (২:৯২) ইহুদীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার পেছনে যে যুক্তি এনেছিল তাহলো, মহানবী (সাঃ) আরব, আর অন্যদিকে হযরত মূসা ছিলেন বনী ইসরাইল৷ কিন্তু হযরত মূসা তাদের জন্য মোজেযাসহ আসার পর যখন তুর পাহাড়ে গেলেন, তখন বনী ইসরাইল জাতি বাছুর পূজার দিকে ঝুঁকে পড়ল৷ হযরত মূসার দীর্ঘ দিনের শ্রম এক নিমিষে পানি হয়ে গেল৷ এভাবে ইহুদীরা জুলুম করেছিল তাদের নবীর প্রতি৷ এবারে সূরা বাকারাহ’র ৯৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে, وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّورَ خُذُوا مَا آَتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاسْمَعُوا قَالُوا سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا وَأُشْرِبُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْعِجْلَ بِكُفْرِهِمْ قُلْ بِئْسَمَا يَأْمُرُكُمْ بِهِ إِيمَانُكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (93) “স্মরণ কর যখন তোমাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তুরকে তোমাদের উর্ধ্বে স্থাপন করেছিলাম৷ বলেছিলাম তাওরাত ও এর যেসব বিধান তোমাদেরকে দিলাম সেসব দৃঢ়ভাবে গ্রহণ কর এবং শ্রবণ কর ৷ কিন্তু তারা বললো, আমরা শ্রবণ করলাম ও অমান্য করলাম।” (২:৯৩) কুফরী ও অবিশ্বাসের কারণে তারা তাদের অন্তরে বাছুরকে স্থান দেয়৷ হে নবী আপনি তাদের বলুন যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তাহলে তোমাদের বিশ্বাস যা নির্দেশ দেয় তা কত নিকৃষ্ট। এর আগে বলেছি- ইহুদীরা মহানবী (সাঃ)এর প্রতি ঈমান না আনার অজুহাত হিসাবে বলেছিল- রাসূলে খোদা বনী ইসরাইল জাতির লোক না ৷ তারা বলেছিল আমরা কেবল এমন নবীর প্রতি ঈমান আনবো যে আমাদের গোত্রের হবে৷ আর আমরা কেবল মূসার আনা কিতাব তাওরাতই মেনে চলব৷ এর আগের কয়েকটি আয়াতে উদাহরণ দেয়া হয়েছে যা দেখে বুঝা যায়, ইহুদীরা তাদের নবী মূসা ও তার ধর্মগ্রন্থ মেনে চলা দূরের কথা বরং তার বিপরীতভাবে চলে৷ আর এ আয়াতে সেরকম আরেকটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তুর পাহাড়ে আল্লাহপাক বনী ইসরাইলের কাছ থেকে কিছু বিষয়ে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন ৷ কিন্তু তারা সেগুলো জেনে শুনে বেমালুম ভুলে গেল৷ কারণ তাদের অন্তরের ভেতর শিরক্ ও দুনিয়া পূজা এমন গভীরভাবে গেড়ে বসল যে, সেখানে চিন্তা ও বিশ্বাসের কোন স্থান ছিল না ৷ তাদের এ দুনিয়া পূজার বিষয়টি ফুটে উঠে স্বর্ণের বাছুর পূজার মাধ্যমে৷ আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে- আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঈমানেরও দাবি করত৷ পবিত্র কোরআন তাদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন করে তাদেরকে জবাব দেয়৷ প্রশ্ন করা হয়, তোমাদের ঈমান কি তোমাদেরকে আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গের নির্দেশ দেয়? ওই বিশ্বাস কি বাছুর পূজা এবং আল্লাহর নবীদের হত্যা করতে বলে? যদি তোমাদের ঈমান এ ধরনের হয়, তবেতো সে খুব নিকৃষ্ট নির্দেশই তোমাদের দিচ্ছে৷ সূরা বাকারাহ’র ৮৯ নম্বর থেকে ৯৩ নম্বর মূল শিক্ষা হচ্ছে- এক. আজ ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে ইসলাম গ্রহণ না করতে দেখলেও ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ করা উচিত নয়৷ কারণ তাদের অনেকে সত্য বোঝার পরও প্রবৃত্তিগত কারণে ইসলাম মেনে নিতে রাজী হয় না ৷ যেমনিভাবে মদীনার ইহুদীরা নবীজিকে চিনেও ইসলাম গ্রহণ করে নি ৷ দুই. হিংসা হলো কুফরী, অবিশ্বাস ও সত্য প্রত্যাখ্যানের উৎস ৷ বনী ইসরাইল যখন দেখল রাসূলে খোদা তাদের গোত্রের নয় তখন তারা হিংসা বশবর্তী হয়ে অবিশ্বাস করতে লাগল ৷ তিন. আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন কিছুর প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বিপজ্জনক৷ কারণ এ জাতীয় আকর্ষণ মানুষকে সত্যের ব্যাপারে অন্ধ করে ফেলে৷ সূরা বাকারাহ’র ৯৪ ও ৯৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- قُلْ إِنْ كَانَتْ لَكُمُ الدَّارُ الْآَخِرَةُ عِنْدَ اللَّهِ خَالِصَةً مِنْ دُونِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (94) وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ (95) “(ওই ইহুদীদের) বলে দিন,যদি পরকালের বাসস্থান আল্লাহর কাছে একমাত্র তোমাদের জন্যই বরাদ্দ হয়ে থাকে-অন্য লোকদের বাদ দিয়ে,তবে তোমরা নিজেদের মৃত্যু কামনা কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।” (২:৯৪) “কিন্তু তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য কখনোই মৃত্যু কামনা করবে না। আর আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের সম্পর্কে অবহিত ৷” (২:৯৫) অতীতকাল থেকে ইহুদীরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করতো। তারা বিশ্বাস করতো বেহেশত তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং দোজখের আগুন তাদেরকে স্পর্শ করবে না। আর তারা আল্লাহর সন্তান ও তারই বন্ধু। এই মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা একদিকে তাদের খুশীমত জুলুম-অত্যাচার ও পাপ কাজ করতো আর অন্যদিকে আক্রান্ত হতো আত্মম্ভরিতা,গর্ব ও অহঙ্কারের ব্যাধিতে। ফলে এই আয়াতে তাদের বিবেকের ওপর বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, “বেহেশত একমাত্র ইহুদীদের জন্য” যদি তোমাদের এ দাবি সত্য হয় তাহলে তোমরা কেন দ্রুত বেহেশতে যাওয়ার জন্য মৃত্যু কামনা কর না? কেন মৃত্যুকে ভয় পাও? মৃত্যু ভয় অনেকটা চালকের ভ্রমণভীতির মত। ওই চালকই সফর করতে ভয় পায় যে রাস্তা চেনে না,জ্বালানি নেই কিংবা অপরাধ করেছে, অথবা চোরাই মাল বহন করছে বা গন্তব্যস্থলে থাকার কোন জায়গা নেই৷ কিন্তু প্রকৃত মোমিন রাস্তা চেনে,সৎকাজের মাধ্যমে জ্বালানি সংগ্রহ করেছে,তওবার মাধ্যমে অপরাধ মার্জনা করে নিয়েছে, তার কাছে চোরাই কিছু নেই এবং পরকালেও তার রয়েছে বাসস্থান বা বেহেশত। অধিকাংশ মানুষ যারা মৃত্যুকে ভয় পায়,তাদের ভীতি মূলত: দু’টি কারণে৷ প্রথমত: তারা মৃত্যুকেই চূড়ান্ত ধ্বংস মনে করে। দ্বিতীয়ত: তারা হয়ত পরকালে বিশ্বাস করে, কিন্তু নিজেদের পাপ ও অন্যায় কাজের জন্যে মৃত্যুকে ভয় পায়। কারণ মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয় মানুষের কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ। আর তাই মৃত্যু যাতে দেরীতে আসে ইহুদীরা সেটাই কামনা করতো। কিন্তু নবী-রাসুল এবং আল্লাহর অলীরা মৃত্যুকে বিনাশ ও ধ্বংস মনে করেন না বরং একে আরেকটি জীবনের সূচনা বলে বিশ্বাস করেন। তারা তাদের কর্মে ও চিন্তায় কোন অপরাধ করেননি বলে মৃত্যুকে ভয় পান না বরং উদ্যম ও আগ্রহের সাথে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন,খোদার কসম! মৃত্যুর প্রতি আমার আকর্ষণ মাতৃস্তনের প্রতি নবজাতকের আকর্ষণের চেয়ে বেশী৷ ৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ (96) “আপনি তাদেরকে (ইহুদীদেরকে) জীবনের প্রতি সবার চাইতে,এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তারা যা কিছু করে আল্লাহ তা দেখেন।” (২:৯৬) রাসূলে খোদা (সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে এ আয়াতে বলা হয়েছে, বেহেশতের দাবিদার ইহুদীরা মৃত্যু কামনাতো করেই না বরং অন্যান্য মানুষ এমনকি মুশরিকরা যারা পরকালে বিশ্বাস করে না এবং মৃত্যুকে জীবনের ধ্বংস বলে মনে করে, তাদের চেয়েও এ দুনিয়ার প্রতি তারা বেশী লোভী। তারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি এতই আসক্ত যে, পৃথিবীতে হাজার বছর জীবন-যাপন করতে চায়। যাতে আল্লাহর শাস্তি থেকে দূরে থাকা যায় এবং জমা করা যায় দুনিয়ার ধন-সম্পদ। কিন্তু আল্লাহপাক জবাবে বলেন, তাদেরকে এক হাজার বছর বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া হলেও ওই দীর্ঘায়ূ তাদের প্রাপ্য শাস্তি ঠেকাতে পারবে না। কারণ তাদের সমস্ত কাজ আল্লাহ দেখেন, কাজেই এই শিশুসুলভ চিন্তা তাদের জন্য কোন ফল বয়ে আনবে না ৷ এরপর ৯৭ ও ৯৮ নম্বর আল্লাহ পাক বলেছেন- قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَهُدًى وَبُشْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ (97) مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ (98) “আপনি বলুন-যে জীবরাঈলের শত্রু সে জেনে রাখুক, জিবরাঈল আল্লাহর নির্দেশে আপনার হৃদয়ে কোরআন পৌঁছে দিয়েছে, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও শুভ সংবাদ। যে কেউ আল্লাহ, তার ফেরেশতা, রাসূলগণ এবং জিবরাঈল ও মিকাঈলের শত্রু, সে জেনে রাখুক আল্লাহ নিশ্চয় সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের শত্রু ৷” (২:৯৭-৯৮) রাসূলে খোদা (সাঃ) যখন মদীনায় আসলেন তখন কিছু ইহুদী তাদের একজন পুরোহিতসহ রাসূলের কাছে এসে কিছু প্রশ্ন করল। তাদের একটি প্রশ্ন ছিল, তোমার কাছে যে ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসে তার নাম কি? রাসূলে খোদা জবাবে বলেন, জিবরাঈল। তখন ইহুদীরা বলল,যদি ওহীর ফেরেশতা মিকাঈল হতো তাহলে আমরা ঈমান আনবো। কারণ জিবরাঈল আমাদের শত্রু। সে আমাদের জন্য জেহাদের মত কঠিন বিধান নিয়ে আসে৷ মানুষ যখন সত্যকে মেনে নিতে চায় না তখন অজুহাত খুঁজে বেড়ায়৷ এমনকি তারা আল্লাহর ফেরেশতাকেও অযৌক্তিকভাবে দায়ী করে যাতে সত্য থেকে পালিয়ে থাকা যায়। জিবরাঈল, মিকাঈল প্রমুখ ফেরেশতাগণ নিজের থেকে কোন বাণী আনেন না। তাঁরা আল্লাহর বাণী পয়গম্বরদের কাছে পৌঁছে দেন। তারা কেবল আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে মাধ্যম হিসাবে কাজ করেন৷ তাই এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে ইহুদীবাদীদের এ দাবি ছিল ইসলাম গ্রহণ না করার একটি বাহানা। আজকের আলোচিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- এক. প্রত্যেক মানুষকে এমনভাবে জীবন-যাপন করা উচিত ,যাতে সে যেকোন সময় মৃত্যুর জন্যে তৈরি থাকতে পারে।এই পৃথিবীতে কেউ যদি সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে এবং অপরাধের জন্য তওবা করে তাহলে মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই । দুই. দীর্ঘ জীবন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। একমাত্র আল্লাহর নৈকট্যের মাধ্যমেই জীবন হয়ে উঠে মূল্যবান৷ তাই দেখা যায় ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) তার এক দোয়ায় বলেছেন, হে আল্লাহ! আমার আয়ু যদি তোমাকে মেনে চলার মাধ্যম হয় তাহলে তা বাড়িয়ে দাও৷ আর যদি শয়তানের অনুসরণের জন্য হয় তাহলে তা সংক্ষিপ্ত করে দাও । তিন. ধর্ম হলো অনেকগুলো বিশ্বাসের সমষ্টি৷ তাই কেউ যদি বলে আল্লাহকে বিশ্বাস করি কিন্তু তার ফেরেশতা আমার শত্রু বা ওই নবীকে বিশ্বাস করি না তাহলে তার ঈমান নেই৷ সুতরাং একজন প্রকৃত মুমিন হলো সেই যে আল্লাহ, সব নবী ও সব ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাস রাখে। সূরা বাকারাহ’র ৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَلَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ آَيَاتٍ بَيِّنَاتٍ وَمَا يَكْفُرُ بِهَا إِلَّا الْفَاسِقُونَ (99) “হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি স্পষ্ট নিদর্শন অবতীর্ণ করেছি যা অবাধ্যরা ছাড়া অন্য কেউ অস্বীকার করে না।” (২:৯৯) মদীনার ইহুদীরা ইসলাম গ্রহণ না করার জন্য নানা অজুহাত উত্থাপন করতো ৷ এর মধ্যে একটি ছিল, ফেরেশতা জিবরাইল রাসূলে খোদার কাছে ওহী আনায় তারা রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে না। কারণ ফেরেশতা জিবরাঈল(আ.)-কে তারা শত্রু মনে করত। আর এ আয়াতে তাদের আরেকটি অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে৷ ইহুদীরা বলতো আমরা এ কিতাবের কিছু বুঝি না এবং এর বিষয়বস্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আর তাই আমরা মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আনব না এবং কোরআনকেও তার মোজেযা হিসাবে গ্রহণ করব না। অথচ পড়লে ও কোরআনের বক্তব্য নিয়ে একটু চিন্তা করলেই ইসলামের নবীর সত্যতা এবং কোরআনের অলৌকিত্ব বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। অবশ্য এই সত্য তারাই উপলদ্ধি করতে পারে যাদের অন্তর পাপে কলুষিত হয়নি এবং যাদের মধ্যে সত্যকে মেনে নেয়ার মনোভাব আছে। কারণ পাপ কাজ কুফরী বা সত্যকে প্রত্যাখ্যানের পটভূমি সৃষ্টি করে। মানুষ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা অনুসরণের মাধ্যমে কুফরীর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সত্যকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করে। কারণ ওই সত্য গ্রহণ করলে সে আর অনায়াসে পাপ কাজ করতে পারবে না। এরপরের আয়াত অর্থাৎ একশ’ নম্বর আয়তে বলা হয়েছে- أَوَكُلَّمَا عَاهَدُوا عَهْدًا نَبَذَهُ فَرِيقٌ مِنْهُمْ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ (100) “কি আশ্চর্য, যখন তারা (ইহুদীরা আল্লাহ ও তার পয়গম্বরদের সঙ্গে) কোন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, তখন তাদের একদল তা ছুঁড়ে ফেলে,বরং অধিকাংশই বিশ্বাস করে না।” (২:১০০) এ আয়াতে রাসূলে খোদা (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, যাতে তিনি ইহুদীদের কার্যকলাপে দুঃখ না পান৷ কারণ ইহুদীদের আচরণ বিস্ময়কর। তারা তাদের নিজেদের গোত্রের নবীদের প্রতি দেয়া অঙ্গীকার রাখেনি। তারা হযরত মূসা (আ.)এর সাথে বিভিন্ন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর নানা অজুহাতে সেটা অমান্য করতো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনায় আসার পর সেখানকার ইহুদীরা নবীজীর সাথে অঙ্গীকার করলো যে অন্তত তারা মুসলমানদের শত্রুকে সাহায্য করবে না৷ কিন্তু অচিরেই তারা তাদের সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে আহযাবের যুদ্ধে তারা মুশরিকদের সাথে হাত মিলায়। একইভাবে আজও ইসরাইলের ইহুদীবাদীরা কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও অঙ্গীকার মেনে চলছে না। কোন চুক্তি করার পরপরই তারা অবলীলায় তা ভঙ্গ করে বসে। কারণ এরা হলো বর্ণ বিদ্বেষী ও সুবিধাবাদী জাতি। এরপর ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَمَّا جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِيقٌ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (101) “যখন রাসূলে খোদা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসাবে তাদের কাছে এলেন এমন কিছু নিদর্শন নিয়ে যার সাথে তাদের কাছে রাখা নিদর্শনের মিল ছিল, তখন ঐশী গ্রন্থের অনুসারীদের একদল আল্লাহর কিতাবকে অগ্রাহ্য করে বসে৷ যেন তারা সে সম্পর্কে কিছুই জানে না।” (২:১০১) রাসূলে খোদা (সাঃ)এর আবির্ভাবের আগে ইহুদী পণ্ডিতরা জনগণকে তার আগমন সম্পর্কে সুসংবাদ দিতো। তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তওরাতে নবীজী সম্পর্কে যেসব নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে সেগুলো জনগণের মধ্যে বলে বেড়াতো। কিন্তু সত্যিই সর্বশেষ নবীর আগমন হয় তখন তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে এমনভাবে অস্বীকার করলো যেন তাঁর সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। মূলত: পদমর্যাদার লোভ অধিকাংশ মানুষের জন্য বিশেষ করে পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য একটি বিপজ্জনক বিষয়। যখন ইহুদী পণ্ডিতরা মনে করলো যে, তারা মহানবী (সাঃ)এর নবুয়্যতের সত্যতা স্বীকার করলে নিজেদের দুনিয়াবী পদমর্যাদা হাতছাড়া হবে, তখন তারা তাঁর নবুয়্যাতকে বেমালুম অস্বীকার করে বসলো। তবে ইহুদীদের মধ্যে যারা সত্যপন্থী এবং সৎ তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পবিত্র কোরআন বলেছে, অধিকাংশ লোক সত্যকে অস্বীকার করলেও তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ব্যক্তি সত্য গ্রহণ করেছিল ৷ সূরা বাকারাহ’র ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (102) “ইহুদীরা (তওরাত অনুসরণের পরিবর্তে) সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তান যা আবৃত্তি করতো তার অনুসরণ করতো। অথচ সুলায়মান কখনো যাদু করেনি এবং সত্য প্রত্যাখ্যান করেনি। কিন্তু শয়তান মানুষকে যাদু শিক্ষা দিতো এবং কাফের হয়ে গিয়েছিল। ইহুদীরা বাবেল শহরের দুই ফেরেশতা হারুত ও মারুতের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছিল তা অনুসরণ করত। ‘আমরা তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ-সুতরাং যাদুকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে কাফের হইও না’-এ কথা না বলে ওই দুই ফেরেশতা কাউকে কিছু শিক্ষা দিত না৷ কিন্তু তারা ওই দুই ফেরেশতা থেকে শুধু এমন কিছু শিখত যা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। অথচ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না। তারা শুধু ওই সব অংশই শিখত যা ছিল তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের জন্য কোন ধরনের উপকারী ছিল না। আর তারা নিশ্চয়ই জানত, যে এ পণ্য ক্রয় করবে পরকালে তার কোন মুনাফা পাবে না ৷ যে জিনিসের বদলে তারা নিজেদের বিক্রি করল তা বড়ই নিকৃষ্ট, যদি তারা জানত ৷” (২:১০২) হযরত সোলায়মান (আ.)এর যুগে যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্র বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাই হযরত সোলায়মান (আ.) যাদুকরদের সব কাগজ-পত্র এক জায়গায় জমা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু হযরত সোলায়মানের পর একদল লোক ওই কাগজ-পত্রের খোঁজ পায় এবং শরু করে যাদু শিক্ষা ও তার চর্চার। এ আয়াতে বলা হয়েছে- বনী ইসরাইলের কিছু লোক ঐশী গ্রন্থ তওরাত অনুসরণের পরিবর্তে ওই যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আর তারা তাদের এ কাজকে জায়েয করার জন্যে বলে বেড়াতে লাগলো যে,এই বই-পত্রতো সোলায়মানের এবং তিনি ছিলেন শক্তিশালী যাদুকর। পবিত্র কোরআন তাদের এ মিথ্যা দাবির জবাবে বলেছে সোলায়মান কখনোই যাদুকর ছিলেন না। বরং তিনি হলেন আল্লাহর নবী। তিনি যেসব অলৌকিক নিদর্শন দেখাতেন সেসব ছিল আল্লাহর দেয়া মোজেযা। বরং তোমরা এর মাধ্যমে ওইসব শয়তানের অনুসরণ করছো যারা যাদু চর্চা ছড়িয়ে দিয়েছে৷ অবশ্য আরেকটি উপায়েও ইহুদীরা যাদুবিদ্যা অর্জন করেছিল। আল্লাহর নির্দেশে বাবেল শহরে একবার হারুত ও মারুত নামে দুই ফেরেশতার আগমন ঘটে। মানুষরূপী এ দুই ফেরেশতার কাজ ছিল মানুষকে যাদু-তন্ত্রের প্রভাব নস্যাৎ করার উপায় বাতলে দেয়া। এ দুই ফেরেশতা একইসঙ্গে মানুষকে সতর্ক করে দিতো যাতে কেউ যাদু বিদ্যার অপব্যবহার করে নিজেদের বস্তুগত স্বার্থ হাসিল না করে। কিন্তু ইহুদীরা ওই দুই উপায়ে যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্র শিখে এর মাধ্যমে নিজেদের অন্যায় স্বার্থ পূরণ করতো। যদিও তারা জানতো যে, যাদুর কাজ কুফরীর শামিল এবং এরমাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবার ও সমাজ। এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, যাদু ও তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সব কিছুর উর্দ্ধে একমাত্র আল্লাহ। তাই তার আশ্রয় প্রার্থনা,তার ওপর ভরসা,দোয়া এবং সদকা বা দান-খয়রাতের মাধ্যমে যাদুর দুষ্ট প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সূরা বাকারাহ’র ৯৯ থেকে ১০২ নম্বর আয়াতের মূল শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক. ধর্মের প্রতি অনেকের অবিশ্বাস থেকে ধর্মের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করা উচিৎ নয়, বরং মনে রাখতে হবে পাপ কাজের কারণে মানুষের আত্মা সত্য গ্রহণের মনোভাব হারিয়ে ফেলে ৷ দুই. কেবল বিদ্যা শিক্ষাই যথেষ্ট নয় বরং এর সাথে সত্য গ্রহণের মনোভাব থাকাও জরুরী৷ ইহুদী পণ্ডিতরা তওরাতের বদৌলতে ইসলামের নবীর শুভ আগমনের কথা জানতো৷ কিন্তু তারা নিজেরাও নবীজীর প্রতি ঈমান আনেনি এবং অন্যদেরকেও নিষেধ করেছে ঈমান আনতে৷ তিন. জ্ঞান সব সময় মানুষের জন্য উপকারী নয়৷ বরং জ্ঞান হলো ধারালো চাকুর মতো৷ যদি তা অস্ত্রোপচারকারী ডাক্তারের হাতে পড়ে তাহলে তা দিয়ে তিনি রুগীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। আর যদি খুনীর হাতে পড়ে তাহলে সে তা দিয়ে হত্যা করে নিরপরাধ মানুষকে ৷ চার. শয়তান পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ ও বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। আর অন্যদিকে ফেরেশতারা চেষ্টা করে তাদের মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি স্থাপনের। একইভাবে মানুষও দু’দলে বিভক্ত৷ একদল শয়তানের পথে আরেক দল ফেরেশতাদের পথে। সুরা বাকারার তাফসির তৃতীয় অংশ (১০৩-১৫২ নম্বর আয়াত) সুরা বাকারার তাফসির তৃতীয় অংশ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ’র ১০৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন- وَلَوْ أَنَّهُمْ آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَمَثُوبَةٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ خَيْرٌ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (103 “যদি তারা ঈমান আনত এবং খোদাভীরু হতো, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত। যদি তারা জানত।” (২:১০৩) এর আগের পর্বে আমরা বলেছিলাম ইহুদীরা তাওরাত ও অন্যান্য ঐশি গ্রন্থ অনুসরণের পরিবর্তে যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান করত। তারা এ ব্যাপারে যুক্তি দেখিয়ে বলত, হযরত সোলায়মান (আ.) যাদুর উৎস। কিন্তু পবিত্র কোরআন হযরত সোলায়মান (আ.) সম্পর্কে ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, ইহুদীরা যদি প্রকৃত বিশ্বাসী হতো ও এ ধরনের ভুল ধারণা থেকে মুক্ত থাকত তাহলে তাদের জন্যই কল্যাণকর হতো৷ কারণ শুধু ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করা যথেষ্ট নয়; খোদাভীরুতা ও আত্মসচেতনতাও জরুরী৷ খোদাভীরুতা বা তাকওয়ার অর্থ শুধু মন্দ বা খারাপ কাজ থেকেই দূরে থাকা নয়, এটা হল এমন এক অভ্যন্তরীণ শক্তি যা মানুষকে নোংরা তৎপরতা যেমন, মিথ্যা বলার মত মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি তাদেরকে ভালো কাজ করতেও উৎসাহিত করে৷ ভালো কাজ বলতে নামাজ পড়া, অন্যায়-অবিচার প্রতিরোধ প্রভৃতি ভালো কাজকে বোঝানো হয়েছে৷ এরপর ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انْظُرْنَا وَاسْمَعُوا وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ (104) “হে বিশ্বাসীগণ রাসূল (সাঃ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ‘রায়েনা’ শব্দটি বল না, বরং ‘উনজুরনা’বল এবং শুনে রাখ অবিশ্বাসীদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে৷” (২:১০৪) ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূল (সাঃ) যখন বক্তৃতা দিতেন বা কোরআনের আয়াত পড়ে শোনাতেন তখন মুসলমানরা রাসূল (সাঃ)এর বক্তব্যকে ভালোভাবে উপলদ্ধির জন্য রাসূলের কাছে আবেদন করতেন-যাতে রাসূল(সাঃ) তাদের অবস্থা দেখে বক্তব্য রাখেন৷ তারা তাদের এই আবেদন জানাতেন ‘রায়েনা’ নামক শব্দটি ব্যবহার করে৷ আরবীতে রায়েনা শব্দের অর্থ ‘অন্যকে রক্ষা করা বা দেখা-শোনা করা’৷ কিন্তু হিব্রু ভাষায় এই শব্দের অর্থ হলো ‘বোকা’৷ ইহুদীরা মুসলমানদের পরিহাস করে বলতো তোমরা নিজেদেরকে বোকা বা আহাম্মক করার জন্য তোমাদের নবীর কাছে আবেদন জানাচ্ছো। আর এ জন্যে কোরআনের আয়াতে এ নির্দেশ দেয়া হয় যে, রায়েনার পরিবর্তে মুসলমানরা যেন উনযুরনা বলে-যাতে শত্রুরা অপব্যাখ্যার সুযোগ না পায় ৷ ‘উনযুরনা’ শব্দের অর্থ হলো ‘আমাদের দিকে লক্ষ্য করুন’৷ এ শব্দটি ব্যবহার করলে শত্রুরা মুসলমান ও তাদের নবীকে উপহাস করার সুযোগ পাবে না৷ এ আয়াতের মূল বক্তব্য হল শত্রুরা ব্যঙ্গ বা উপহাস করতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, ইসলাম বড়দের সাথে ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলার সময় উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার এবং সম্মান প্রদর্শন ও আদব-কায়দা রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়৷ একইসঙ্গে যেসব কাজ ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি উপহাস বা অবমাননার সুযোগ করে দেয় এবং শত্রুদেরকে অপব্যাখ্যার সুযোগ দেয়, সেসব কাজ থেকে মুসলমানদেরকে বিরত থাকতে হবে৷ ১০৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- مَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَلَا الْمُشْرِكِينَ أَنْ يُنَزَّلَ عَلَيْكُمْ مِنْ خَيْرٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَاللَّهُ يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (105 “আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের,তাদের মনঃপুত নয় যে, তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হোক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ ভাবে স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহদাতা।” (২:১০৫) এই আয়াতে ঈমানদারদের প্রতি কাফের ও মুশরিকদের চরম শত্রুতা ও বিদ্বেষের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কাফের মুশরেকরা মুসলমানদেরকে ভীষণ হিংসা করত। মুসলমানরা যে স্বতন্ত্র ঐশিগ্রন্থ এবং স্বতন্ত্র নবীর অনুসারী এটা ইহুদী-খ্রিস্টানরা মেনে নিতে চাইত না। আল্লাহ পাক এ আয়াতে বলেছেন, তিনি যার জন্য ভালো মনে করেন তাকেই অনুগ্রহ প্রদান করেন এবং যাদের জন্য দরকার মনে করেন, তাদের কাছেই নবী পাঠান৷ আর এ ক্ষেত্রে তিনি কারো এমন কোন ইচ্ছের পরোয়া করেন না । এরপর সূরা বাকারাহ’র ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- مَا نَنْسَخْ مِنْ آَيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (106) “আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর ওপর শক্তিমান?” (২:১০৬) প্রথম দিকে মুসলমানদের কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস৷ ইহুদীরা এটাকে যুক্তি দেখিয়ে বলত: মুসলমানদের তো আলাদা কোন ধর্মই নেই। আর এ জন্যেই তারা আমাদের কেবলার মুখোমুখী হয়ে প্রার্থনা করে। এ কারণেই আল্লাহ মুসলমানদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কেবলা মক্কায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেন৷ কিন্তু এবার ইহুদীরা অন্য আপত্তি উত্থাপন করে বলে যে, যদি প্রথম কেবলা ঠিক ছিল-তাহলে কেন কেবলা পরিবর্তন করা হল? আর যদি দ্বিতীয় কেবলা সঠিক হয় তাহলে তোমাদের পূর্ববর্তী সব আমল নষ্ট হয়ে গেছে৷ আল্লাহ পাক এইসব বিতর্কের জবাবে বলেছেন, আমি কোন বিধান বা হুকুমকে রহিত করি না বা কোন বিধানকে বিলম্বিতও করি না-যতক্ষণ না ওই রকম কোন বিধান বা তার চেয়ে ভালো কোন বিধান তার স্থলাভিষিক্ত করি। কেবলা পরিবর্তন ও কাবাকে মুসলমানদের কেবলা হিসাবে ঘোষণা দেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করার অনেক যুক্তি ও উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এসব বিষয় সম্পর্কে তোমরা অবগত নও৷ ইসলামী বিধান কল্যাণময় ও প্রজ্ঞাময় ৷ আর তাই স্থান, কাল ও পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন বিষয়ের কল্যাণকর দিক পরিবর্তিত হয় বলে পূর্ববর্তী নির্দেশ বা বিধান পরিবর্তন করে তার স্থলে নতুন বিধান দেয়া হয়৷ অবশ্য খোদায়ী বিধানের মূলনীতি স্থির ও অপরিবর্তনযোগ্য৷ এই আয়াত এটাও নির্দেশ করে যে, ইসলামে কোন অচলবস্থার বা স্থবিরতার অবকাশ নেই৷ ইসলাম বিশ্বজনীন ও স্থায়ী ধর্ম বলে ইসলামের স্বার্থে এতে স্থায়ী বিধানের পাশাপাশি পরিবর্তনশীল বা অস্থায়ী বিধানও থাকতে পারে৷ সূরা বাকারাহ’র ১০৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ (107 “তুমি কি জান না যে, একমাত্র আল্লাহর জন্যেই আসমান ও জমিনের আধিপত্য। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।” (২:১০৭) খোদায়ী কোন কোন বিধান রহিত করার বিষয়ে আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে এই আয়াতে। এতে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর কোন বিধান রহিত করার বিষয়ে আপত্তি করছে, তারা কি আল্লাহর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের বিষয়ে উদাসীন? তারা কি জানে না-আল্লাহ মানুষসহ সমস্ত সত্ত্বার ওপর কর্তৃত্বশীল এবং তিনি তার প্রজ্ঞা অনুসারে বিধান ও নির্দেশাবলীতে যে কোন ধরনের পরিবর্তন আনার অধিকার রাখেন। দুঃখজনকভাবে বনী ইসরাইলীরা আল্লাহর কর্তৃত্ব সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করত। কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আল্লাহর হাত বাধা রয়েছে বলে বিশ্বাস করত। অথচ সৃষ্টি কর্মেই হোক বা বিধান ও নির্দেশের ক্ষেত্রেই হোক-সব কিছুর ক্ষেত্রেই আল্লাহ পরিবর্তন আনতে পারেন। এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে- এক. শুধু ঈমান বা বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে তাকওয়া বা খোদাভীরুতা অবলম্বনও জরুরী। দুই. শত্রুরা আমাদের সমস্ত তৎপরতা ও এমনকি শব্দ চয়ন পর্যন্ত ভালোভাবে লক্ষ্য করে। তাই আমাদেরকে এমন সব ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্য থেকে দূরে থাকতে হবে যা শত্রুদেরকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা বা অপব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। তিন. ইসলামের শত্রুরা চায় সব ধরনের উন্নতি ও অগ্রগতি তাদের মধ্যেই সীমিত থাকুক এবং তারা চায় না যে, মুসলমানদের কোন কল্যাণ হোক ও মুসলমানরা কোন বরকতের অধিকারী হোক। তাই তাদের দিকে তাকিয়ে না থেকে বা তাদের ওপর ভরসা না করে মুসলমানদের উচিত সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর নির্ভর করা। সূরা বাকারাহ”র ১০৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- أَمْ تُرِيدُونَ أَنْ تَسْأَلُوا رَسُولَكُمْ كَمَا سُئِلَ مُوسَى مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَتَبَدَّلِ الْكُفْرَ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ (108 “তোমরা কি তোমাদের রাসূলের নিকট সে ধরনের প্রশ্ন বা আবদার করতে চাও যেরকম পূর্বে মূসাকে করা হয়েছিল? জেনে রাখ যে, এ ধরনের বাহানা এনে বিশ্বাসের পরিবর্তে যে অবিশ্বাসকে গ্রহণ করে, সে নিশ্চিতভাবে সরল পথ হারায়৷” (২:১০৮) কিছু দুর্বল ঈমানের অধিকারী লোক অদ্ভুত ধরনের মোজেযা বা অলৌকিক শক্তি দেখানোর জন্য নবীজীর কাছে আবদার করত, যেমন বলত আমাদের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে আসুন। তাদের এ ধরনের দাবি ছিল হযরত মূসা(আ.)এর প্রতি বনী ইসরাইলের দাবির মত ৷ বনী ইসরাইল বলেছিল, আমরা আল্লাহকে দেখতে চাই, আপনি আল্লাহকে দেখানোর বন্দোবস্ত করুন, তাকে আমরা স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈমান আনবো। মূলত: মোজেযার উদ্দেশ্য হলো নবুয়্যত প্রমাণিত করা। প্রত্যেকের ইচ্ছা পূরণ করা নবীর কাজ নয়। যেমন একজন প্রকৌশলী তার দাবির প্রমাণ হিসাবে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করে। কিন্তু যে কেউ তাকে দালান কোঠা বানাতে বললেই সে বানায় না৷ এরপর এই সূরার ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ فَاعْفُوا وَاصْفَحُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (109 “আহলে কিতাবদের কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে অনেকে হিংসার কারণে, তোমাদেরকে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী হিসাবে পেতে চায়। কিন্তু তোমরা তাদেরকে ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর, যতক্ষণ না আল্লাহ কোন নির্দেশ দেন ৷ আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান৷” (২:১০৯) মদীনায় বসবাসরত ইহুদীরা সবসময় মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে সরিয়ে নেয়ার কিংবা তাদের ঈমান দুর্বল করার চেষ্টা করত। পবিত্র কোরআন এ প্রসঙ্গে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে তারা নিজেদেরকে সত্যপন্থী মনে করে বলেই এ কাজ করছে৷ বরং তারা ইসলাম ও কোরআনের সত্যতা উপলদ্ধি করেছে, কিন্তু তাদের হিংসা ও বিদ্বেষের কারণে তারা এ কাজ করছে। সে সময় মুসলমানদের শক্তি কম থাকায় আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন, মুসলমানরা যাতে শত্রুদের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে চলে এবং যতক্ষণ না কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ আসে ততক্ষণ আত্ম সংশোধনে নিয়োজিত হয়। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রথমেই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া ঠিক নয়, বরং ইসলামী নৈতিকতা অনুযায়ী প্রথমে ক্ষমা প্রদর্শন করতে হবে যাতে তারা সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ পায়৷ এরপরও তারা সঠিক পথে না এলে তাদের মোকাবেলা করতে হবে ৷ এরপর সূরা বাকারাহ’র ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (110 “তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে আগে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।” (২:১১০) দুশমনরা যখন মুসলমানদের ঈমান দুর্বল করতে চায় তখন আল্লাহ মুসলমানদের ঈমান শক্তিশালী করার জন্য তাদেরকে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দেন৷ একইসাথে যাকাতের মাধ্যমে অন্যান্য মুসলমান বিশেষ করে দুঃস্থদের সাথে সম্পর্ক জোরদারের আহবান জানান। পবিত্র কোরআনে সাধারণত নামাজের নির্দেশের পাশাপাশি যাকাতের কথাও বলা হয়েছে৷ এর কারণ সম্ভবত এটাই যে, মানুষের সেবা করা ছাড়া আল্লাহর এবাদত যথেষ্ট নয়। অপর পক্ষে শুধু মানব সেবার কথাও বলা হয়নি। কারণ আল্লাহর আনুগত্যহীন মানব সেবার ফলে জন্ম নিতে পারে অহঙ্কার, গর্ব ও অন্যকে হেয় করার প্রবণতা। মানুষের একটি সাধারণ আশঙ্কা হলো, অন্যরা বুঝি তার সেবা ও খেদমতের কথা জানাতে পারবে না এবং জানলেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে না। তাই মানুষের মধ্যে ভালো কাজের প্রবণতা কমে যায়। এ আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা উদ্বিগ্ন হইও না কারণ তোমরা যা কিছু কর তার সব আল্লাহ দেখতে পান এবং পুরস্কার আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত আছে। এবারে সূরা বাকারাহ’র ১১১ ও ১১২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক৷ এ দুই আয়াত বলা হয়েছে- وَقَالُوا لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ كَانَ هُودًا أَوْ نَصَارَى تِلْكَ أَمَانِيُّهُمْ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (111) بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (112 “তারা বলে ইহুদী বা খ্রিস্টান ছাড়া আর কেউ কখনও বেহেশতে প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা। বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে প্রমাণ পেশ কর। যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তার ফল তার প্রতিপালকের কাছে আছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (২:১১১-১১২) মুসলমানদের মনোবল দুর্বল করার জন্য ইহুদী খ্রিস্টানদের একটি অন্যতম প্রচারণা ছিল যে, তারা বেহেশতকে নিজেদের অধীন বলে দাবি করত এবং বলত, বেহেশতে যেতে চাইলে তোমাদেরকে ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান হতে হবে। পবিত্র কোরআন তাদের এ দাবির জবাবে বলেছে, তোমাদের এ ধারণা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। এর পেছনে তোমাদের কোন যুক্তি প্রমাণ নেই৷ কারণ পবিত্র জান্নাত কোন গোত্র বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং বেহেশতে প্রবেশের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি। যে কেউ ওই মাপকাঠির ভিত্তিতে বেহেশতে যেতে পারে। বেহেশতে প্রবেশের চাবি হলো- আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। মানুষ আল্লাহর প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে, যদি একমাত্র তারই উদ্দেশ্যে সৎকাজ করে তাহলে সে বেহেশতে যেতে পারে। কেউ যদি আল্লাহর নির্দেশের কিছু অংশ মান্য করে এবং কিছু অংশ বাদ দেয় তাহলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে ৷ প্রকৃতপক্ষে গোত্রীয় বিদ্বেষ ও বর্ণ-বিদ্বেষের সঙ্গে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের কোন মিল নেই। দু’টি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী। ইসলাম যে সত্য ধর্ম-এটা বোঝার পরও যারা তাদের বিদ্বেষের কারণে ঈমান আনেনি, তারা বেহেশতে যেতে পারবে না। এমনকি তারা আহলে কিতাব বা পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি আল্লাহর দেয়া কিতাবের অনুসারী হলেও কোন লাভ হবে না। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে সে কোন কিছুকেই ভয় পায় না। সবসময় আল্লাহকে নিজের কাছে অনুভব করে এবং তারই আশ্রয়ে নিজেকে খুঁজে পায়৷ এ কয়েকটি আয়াতের মূল শিক্ষা হচ্ছে- এক.মানুষ আল্লাহর অলী-আউলিয়াদের কাছ থেকে অনেক সময় যেসব অবাঞ্চিত আশা বা দাবি করে আসলে তা কুফরী বা অবিশ্বাসের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। কারণ আল্লাহর অলীগণ মানুষের অর্থহীন দাবি পূরণ করেন না। ফলে ওই ব্যক্তির বিশ্বাস দুর্বল হয়ে যায়৷ দুই. কাফের-মুশরেকদের সাথে দৃঢ় আচরণের আগে আন্তরিক ব্যবহার ও ক্ষমা প্রদর্শন করতে হবে। এই সহৃদয় আচরণ দুর্বলতার নিদর্শন নয় বরং এ হলো তাদেরকে আকর্ষণ ও সংশোধনের উপায় ৷ তিন. আমাদের কখনই ভাবা ঠিক নয় যে, বেহেশত কোন একটি নির্দিষ্ট জাতি বা গোত্রের জন্য নির্ধারিত। আমরা মুসলমান- কেবল এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই যে বেহেশতে যাবো তা নয়। বরং আমাদের বেহেশতে যাবার শর্ত হলো ঈমান ও সৎকাজ৷। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ”র ১১৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন- وَقَالَتِ الْيَهُودُ لَيْسَتِ النَّصَارَى عَلَى شَيْءٍ وَقَالَتِ النَّصَارَى لَيْسَتِ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ (113 “ইহুদীরা বলে খ্রিস্টানদের কোন ভিত্তি নেই অর্থাৎ তারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং খ্রিস্টানরা বলে ইহুদীরা সত্যের অনুসারী নয়,অথচ তারা (উভয় সম্প্রদায়ই) আল্লাহর গ্রন্থ পাঠ করে। একইভাবে মূর্তি পুজারী ও মুশরিকরা যারা (আল্লাহর গ্রন্থ সম্পর্কে) কিছুই জানে না তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ রয়েছে, আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে তার মীমাংসা করবেন৷” (২:১১৩) আগের পর্বে আমরা বলেছি, ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা বেহেশতকে একমাত্র তাদের জন্য নির্ধারিত বলে মনে করে৷ এই আয়াতে তাদের এই চিন্তাধারাকে নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে যে,অন্যায় বিদ্বেষ বা হিংসার কারণেই ইহুদী ও খ্রিস্টানরা পরস্পরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে৷ অথচ এ দুই জাতির কাছেই ঐশী গ্রন্থ নাজেল হয়েছিল এবং তারা ছিল আল্লাহর নবীদেরই উম্মত বা অনুসারী৷ কিন্তু মজার বিষয় হলো-মুশরিক ও মূর্তিপূজারীরা ঐশী বা খোদায়ী গ্রন্থের অনুসারী না হওয়া সত্ত্বেও তারা ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মত একই দাবি করত। অর্থাৎ দাবি করত যে, একমাত্র তারাই বেহেশতে যাবে-অন্য কেউ নয়৷ আসলে হিংসা ও প্রধান্য বিস্তারের মনোভাব মানুষকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে৷ ফলে তারা সত্যকে মেনে নিতে পারে না, শুধু নিজেদেরকেই সত্যের অনুসারী বলে মনে করে এবং অন্যরা যাই হোক না কেন তাদের মতে সত্যের অনুসারী নয়৷ এই আয়াতে স্পষ্ট করে এটাও বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন অন্যায়ভাবে বিদ্বেষী হয়ে পড়ে, তখন জ্ঞানীই হোক আর মুর্খই হোক সবাই একই ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে। আহলে কিতাব বা আসমানী কিতাবের অনুসারীরা তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও মূর্তিপূজারী ও মুশরিক-মূর্খদের মত একই কথা বলেছে এবং এরা কোন যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই অন্যদেরকে বাতিল বা মিথ্যার অনুসারী বলে মনে করে৷ এরপর ১১৪নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللَّهِ أَنْ يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا أُولَئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَنْ يَدْخُلُوهَا إِلَّا خَائِفِينَ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ (114 “যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় জালেম আর কে হতে পারে? এদের পক্ষে মসজিদে প্রবেশ করা সঙ্গত নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। তাদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।” (২:১১৪) ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় দেখা গেছে, বহুবার আল্লাহর ঘর বা মসজিদ হয় ধ্বংস করা হয়েছে নতুবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ কারণ মসজিদ ও উপাসনালয় সব সময়ই ঐশী ধর্ম পরিচালনার কেন্দ্র এবং ঐশী ধর্মের অনুসারীদের সংগঠিত হওয়ার ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই অত্যাচারী শাসক ও বিভ্রান্ত ব্যক্তিরা সব সময়ই মসজিদের আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক কাঠামো বা ভিত্তি ধবংসের চেষ্টা করেছে। যেমন,মক্কার মুশরিকরা অনেক বছর ধরে মুসলমানদের জন্য কাবা ঘর বা বায়তুল হারামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল৷ বর্তমানেও ইসলামের শত্রুরা বায়তুল মোকাদ্দাসে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদকে ধবংসের চেষ্টা করছে। ভারতে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ধ্বংস করেছে। অবশ্য মসজিদ ধবংসের অর্থ শুধু মসজিদের বাহ্যিক ভিত্তি ধ্বংস করা নয়। যেমনটি মসজিদের উন্নয়নের অর্থ শুধু মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়। প্রকৃতপক্ষে যেসব কাজ মসজিদের প্রভাব বা মসজিদের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দেয় এবং যেসব কাজের ফলে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় ও মসজিদ থেকে দূরে থাকে সেসব কাজ করাও মসজিদের ধ্বংস সাধনের শামিল। অনৈতিক ছবি,ভিডিও বা সিনেমা প্রদর্শন হচ্ছে ইসলামী বা মুসলিম দেশের যুব সমাজকে মসজিদ ও ধর্মীয় সভা থেকে দূরে রাখার লক্ষ্য সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র। এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (115) “পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই জন্য, অতএব তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও সে দিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী, মহাজ্ঞানী ৷(২:১১৫) আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা যখন বায়তুল মোকাদ্দাসের পরিবর্তে মক্কাকে তাদের কেবলা হিসেবে নির্ধারণ করে, তখন ইহুদীরা কিছু প্রশ্ন তোলে। এসব সম্পর্কে আমরা এর আগেও আলোচনা করেছি। যেমন তারা এ প্রশ্ন তোলে যে, যদি আগের কেবলাই সঠিক ছিল, তাহলে কেন তা পরিবর্তন করা হলো? আর যদি আগের কেবলা সঠিক না হয়, তাহলে আগের ইবাদত কি সঠিক হবে? এই সন্দেহ বা প্রশ্নের উত্তরে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কোন নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকা নেই ৷ পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকেই আল্লাহ আছেন। অর্থাৎ যেদিকেই মুখ ফেরানো হোক না কেন আল্লাহ সেদিকেই আছেন। যদি কাবাঘর অথবা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তা এই অর্থে যে, নামাজ ও অন্যান্য সামষ্টিক ইবাদতের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। যেসব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করে এবং সব সময় মুসলমানদেরকে এইসব উদ্দেশ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ৷ যতদিন পর্যন্ত ইহুদীরা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা হিসেবে গ্রহণ করার কারণে মুসলমানদের মুসলমানদেরকে কটাক্ষ করেনি ততদিন মুসলমানরা ওই দিকে ফিরে নামাজ আদায় করত। কিন্তু যখন এই কেবলাকে মুসলমানদের দুর্বল করার ও তাদেরকে হেয় করার মাধ্যমে পরিণত করা হয় তখন আল্লাহ তালা হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর স্মৃতির নিদর্শন কাবা ঘরকে মুসলমানদের কেবলা হিসাবে নির্ধারণ করেন ৷ এরপর ১১৬ ও ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَقَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُونَ (116) بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (117) “তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র, বরং নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে এ কথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।” (২:১১৬-১১৭) ঐশী গ্রন্থের অনুসারী ইহুদী ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মের সত্যতা প্রদর্শনের জন্য যেসব ভুল ধারণা প্রচার করত, সেসবের মধ্যে অন্যতম হল তাদের নবীরা নাকি ছিলেন আল্লাহর সন্তান। ইহুদীরা বলতো, উজাইর ছিল আল্লাহর সন্তান। খ্রিস্টানরা বলতো, ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র। মজার বিষয় হলো, মক্কার মুশরিকরাও ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলে মনে করত। আর তাদের মতে ‘আল্লাহর কন্যারা’ নাকি আল্লাহর কাজ সম্পন্ন করত। এই আয়াতে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচলিত এসব ভুল ও অযৌক্তিক ধারণাকে নাকচ করা হয়েছে এবং আল্লাহকে সন্তান-সন্ততি থেকে মুক্ত ও পবিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, আল্লাহ সমস্ত আকাশ ও জমিনের এবং সেসবের ওপর তাঁরই আধিপত্য রয়েছে। তাই আল্লাহর এমন কি কম রয়েছে যে, এই অভাব বা চাহিদা পুরণের জন্যে তাকে সন্তান গ্রহণ করতে হবে? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বা প্রভুর সাথে মানুষের তুলনা এবং আল্লাহকে মানুষের মত করে চিন্তা করা হচ্ছে-এমন এক ভ্রান্ত চিন্তা যে, এর ফলে মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহর সত্ত্বার বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, কোন কিছুই আল্লাহর মত কিংবা তাঁর সমতুল্য নয়। এ পর্বের আলোচিত আয়াত ক’টির শিক্ষণীয় দিকগুলো একে একে তুলে ধরা হলো- এক. মসজিদ হলো-কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘাঁটি। আর এ জন্যেই ইসলামের শত্রুরা মসজিদের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি ধ্বংসের চেষ্টা করে। তাই আমাদেরকে এমনভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে মসজিদ হয় মুসল্লিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ এবং যাতে শত্রুরা মসজিদে প্রভাব ফেলতে ভয় পায়। দুই. বাবা-মা, অভিভাবক, মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন সাহেব এটা মনে রাখতে হবে যে, এমন কোন আচরণ করা উচিত হবে না যাতে কিশোর বা যুবকরা মসজিদে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বরং সব সময়ই শিশু-কিশোরদেরকে মসজিদে যেতে উৎসাহিত করা তাদের দায়িত্ব। তিন. আল্লাহ কোন বিশেষ দিকে বা স্থান জুড়ে বিরাজ করেন না। আমরা যেদিকেই মুখ ফেরাবো সেদিকেই তাকে পাব। অর্থাৎ তিনি আছেন সব দিকেই, কিন্তু কেবলার তাৎপর্য হলো ইবাদতের বৃহৎ সমাবেশ হবে একমূখী ও সমন্বিত। আর তাও হবে তৌহিদের প্রথম কেন্দ্র কাবা অভিমূখী। চার. আল্লাহ মানুষ নন। তাই তার সন্তান ও স্ত্রীর প্রয়োজন নেই৷ তিনি সকল নারী, পুরুষ ও তাদের সন্তানদের সৃষ্টিকর্তা। কারণ তিনিই সমগ্র সত্ত্বা ও অস্তিত্বের স্রষ্টা ও সব কিছুর ওপরই কর্তৃত্বের অধিকারী৷ আমরা আল্লাহ সম্পর্কে যেসব অলীক কল্পনা করি সেসব তারই সৃষ্টি ও সেসব আমাদের স্রষ্টা নয় ৷ সূরা বাকারাহ’র ১১৮ ও ১১৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ لَوْلَا يُكَلِّمُنَا اللَّهُ أَوْ تَأْتِينَا آَيَةٌ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِثْلَ قَوْلِهِمْ تَشَابَهَتْ قُلُوبُهُمْ قَدْ بَيَّنَّا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ (118) إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَا تُسْأَلُ عَنْ أَصْحَابِ الْجَحِيمِ (119 “যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না? এমনিভাবে তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও তাদেরই মত কথা বলেছে। তাদের অন্তর একই রকম। নিশ্চয় আমি প্রকৃত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি। নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। দোযখবাসীদের সম্পর্কে আপনাকে কোন জিজ্ঞাসা করা হবে না।” (২:১১৮-১১৯) অজ্ঞ ও বিদ্বেষী লোকেরা নবীজি’র কাছে যেসব আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপন করত, তার মধ্যে অন্যতম আপত্তি ছিল-আল্লাহ ও তাদের মধ্যে একজন নবীকে মাধ্যম নির্বাচিত করার কি দরকার ছিল? আল্লাহ কেন সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বলেন না? এবং তাদের কাছে কেন আল্লাহ তার বাণী বা আয়াত নাজেল করেন না? এরকম হলেই তো আমরা আল্লাহর বাণী মেনে নিতাম। তাদের এইসব অযৌক্তিক আবদারের জবাবে ইসলামের নবী ও মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলছেন, এ ধরনের আপত্তি নতুন কিছু নয়। এদের আগেও অনেকে এ ধরনের অযৌক্তিক আবদার করেছে। কারণ এই সমস্ত একগুঁয়ে লোকদের অন্তর অন্যান্য সত্য বিরোধীদের মতই। এ ধরনের লোকেরা আল্লাহর নবীকে মেনে নেয়া বা সত্যকে উপলদ্ধি করার যোগ্য নয়। এমনকি যদি তাদের ওপরও আল্লাহর আয়াত নাজেল হতো, তবুও তারা এসব আয়াত মেনে নিত না। কারণ তারা অজুহাতের সন্ধানেই ব্যস্ত ও সত্য মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর বাণী প্রচার করাই নবীদের দায়িত্ব এবং তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জনগণকে পরামর্শ দেন, তারা প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ফলাফলের জামিনদার নয়। তাই তারা জনগণকে সত্য গ্রহণের জন্য বাধ্য করেন না। ফলে কেউ যদি বিভ্রান্ত হয় এবং দোজখে যায় তাহলে তা তার নিজেরই পছন্দের ফল। নবীরা এ জন্যে দায়ী নয়। এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ (120 “ইহুদী ও খ্রিস্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্ম অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। জ্ঞান প্রাপ্তির পর যদি আপনি তাদের আকাঙ্ক্ষার অনুসরণ করেন,তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার কোন সাহায্যকারী বা অভিভাবক থাকবে না।” (২:১২০) কেবলা পরিবর্তনের পর মুসলমানদের ওপর ইহুদীদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। অনেক মুসলমান বায়তুল মোকাদ্দাসকেই কেবলা রাখতে চেয়েছিল যাতে মদীনার ইহুদীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে জীবন-যাপন করা যায়। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেনি যে, ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের ঘটনাকে মুসলমানদের বিরোধিতা করার জন্য অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে। ইহুদীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে তো প্রস্তুত ছিলই না বরং তারা চাইতো মুসলমানরা যেন ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে। এই আয়াতে একটি সামগ্রিক মূলনীতি তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো, সত্যের পথ থেকে মুসলমানরা যতই পিছু হটবে, শত্রুরা ততই মিথ্যা ও কুফরীর দিকে তাদেরকে ধাবিত করবে। তাই কোরআন মুসলমানদেরকে ধর্মের শত্রুদের সাথে আপোষ করতে নিষেধ করেছে৷ এরপর ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (121 “যাদেরকে কিতাব দান করা হয়েছে, যারা তা সঠিকভাবে পাঠ করে, তারাই এতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, আর যারা তা অস্বীকার করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷” (২:১২১) ঐশি গ্রন্থের অনুসারীদের অধিকাংশেরই ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়নি,কিন্তু তাদের মধ্যে যারা সত্য সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঐশী গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে তারা আল্লাহর নবী ও কোরআনের ওপর ঈমান আনার তওফিক লাভ করবে। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে এটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কোরআনের শব্দাবলী সম্মানের সাথে তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট নয়, পথনির্দেশ লাভ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হলে কোরআনের আয়াতের অর্থ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে হবে। এরপর সূরা বাকারাহ’র ১২২ ও ১২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ (122) وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ (123 “হে বনী-ইসরাঈল! আমার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের দিয়েছি। আমি তোমাদেরকে বিশ্বাবাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। তোমরা ভয় কর সে দিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।” (২:১২২-১২৩) পাঠক, আপনাদের হয়তো মনে আছে যে, সূরা বাকারাহ’র ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতেও একই ধরনের বক্তব্য এসেছে। তাই এ দুই আয়াতের ব্যাখ্যা জানার জন্য অনুগ্রহ করে ৪৭ ও ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা পড়ে নিন। এ পর্বে আলোচিত আয়াতগুলোর মূল শিক্ষা হচ্ছে- “সত্যকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে-তা অন্যদের কাছ থেকে হলেও। আমরা যেন এমন ধারণা না করি যে, যা কিছুই ‘আমি’ ‘আমার দল’ বা ‘গোষ্ঠী’ বলবে, শুধু তাই সত্য এবং অন্যরা যা-ই বলুক না কেন তা মিথ্যা বা পরিত্যাজ্য। আল্লাহর নবীরা মানুষকে উপদেশ, পরামর্শ, ভয় প্রদর্শন ও সুসংবাদ দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। মানুষকে জোর করে ঈমানদার করা তাদের দায়িত্ব নয়। তাই যারা বিভ্রান্ত তাদের তৎপরতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ তারা নিজেরাই বিভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদেরকে ধর্মের দিকে আহবান করতে যেয়ে ধর্মের মূলনীতি বিসর্জন দেয়া যাবে না। ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এমনকি বিরোধীদের প্রতিও ন্যায় বিচার করতে হবে। সূরা বাকারাহ”র ১২৪তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ (124) “যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও (ইমাম) নিযুক্ত করুন। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।” (২:১২৪) পয়গম্বরদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন বিশেষভাবে মর্যাদাবান। তাঁর নাম পবিত্র কোরআনের ২৫টি সূরায় ৬৯ বার এসেছে এবং তাকে মহানবী (সাঃ)-এর মতোই আদর্শ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই সূরাতেই এই আয়াত থেকে শুরু করে ১৮টি আয়াতে পবিত্র কাবাঘরের প্রতিষ্ঠাতা আল্লাহর এ নবীর কথা বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইমামত লাভ করেন। এই আয়াতে ‘কালিমাত’ বলে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ওপর অর্পিত কিছু কঠিন দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে যা কিনা তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছিল। ওইসব কঠিন দায়িত্বের কয়েকটি দিক হচ্ছে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার গোত্রের মধ্যে একমাত্র একত্ববাদী ছিলেন। কিন্তু তিনি একাই অসীম সাহসিকতার সাথে শিরক্ ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন। মূর্তিগুলো যেখানে রাখা হতো একদিন সেখানে ঢুকে তিনি সমস্ত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। মূর্তি ভাঙ্গার দায়ে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ় ঈমান ও স্থিরচিত্তে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন। কিন্তু সবাই লক্ষ্য করল আল্লাহর ইচ্ছায় আগুন ঠাণ্ডা হয়ে গেল এবং তার কোন ক্ষতিই হলো না। হযরত ইব্রাহীমের জন্য আল্লাহর আরেকটি পরীক্ষা ছিল, তার পুত্র সন্তানকে কোরবানীর নির্দেশ। দীর্ঘদিন সন্তান থেকে বঞ্চিত থাকার পর আল্লাহ তাকে পুত্র সন্তান ইসমাইলকে দান করলেন। আল্লাহর নির্দেশে বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানকেই তিনি কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানী হয় এক পশু। এভাবে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আল্লাহতালা তাঁকে ইমামতের মর্যাদা দান করলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে তার বংশধরদের জন্যেও ইমামতের মর্যাদাদানের প্রার্থনা করেন৷ আল্লাহপাক তার এই প্রার্থনার জবাবে বললেন, ইমামতের এই মর্যাদা বংশানুক্রমিক নয় বরং যার যোগ্যতা আছে সেই এ মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে। রাসূলের দায়িত্ব হলো- আল্লাহর বাণী ও বিধি-বিধান পৌঁছে দেয়া এবং জনগণকে ভালো কাজের সুসংবাদ ও মন্দ কাজের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া। অপরপক্ষে ইমামের দায়িত্ব হলো সমাজে ওই বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সূরা বাকারাহ’র এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, ইমামত আল্লাহর অঙ্গীকার ও আমানত, যা জালিম, অন্যায়কারী ও গুনাহগার ব্যক্তিরা পাবে না। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা জীবনে গুণাহ করেছে তারা ইমামতের দায়িত্ব পেতে পারে না। এরপর ১২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ (125) “(সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন কাবাঘরকে মানবজাতির সম্মিলন স্থল ও নিরাপদ কেন্দ্র করেছিলাম আর বলেছিলাম তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়াবার স্থানকেই নামাজের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর৷ আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাইলের সাথে অঙ্গীকার করেছি যে আমার ঘর তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী, রুকুকারী ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখবে।” (২:১২৫) এর আগের আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের সুউচ্চ মর্যাদা ও ইমামতের কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের মহান অবদান পবিত্র কাবাঘরের কথা বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ঘর মানব ইতিহাসে একত্ববাদীদের মিলনস্থল। তাওয়াফ, নামাজ ও এবাদতের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ কেন্দ্র। হজ্ব যাত্রীরা মক্কা শরীফে গিয়ে কাবাঘর তাওয়াফের পর দু”রাকাত নামাজ পড়েন। তাদের এ নামাজ পড়তে হয় মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে। মাকামে ইব্রাহীম হলো কাবাঘর ঘেষা ওই পবিত্র স্থান যেখানে কাবাঘরের দেয়াল তৈরির সময় তিনি দাঁড়াতেন। আল্লাহপাক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কষ্টের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে হাজীরা মাকামে ইব্রাহীমকে পেছনে রেখে নামাজ না পড়েন। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) শুধু কাবাঘরের নির্মাতাই ছিলেন না, তারা একইসাথে ওই পবিত্র ঘরের খাদেম বা সেবকও ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে তারা মসজিদুল হারামকে যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করতেন যাতে আল্লাহর বান্দারা সেখানে নামাজ ও এবাদত করতে পারেন। মূলত: মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর। আর এ ঘরের খাদেম বা সেবককেও হতে হবে পবিত্র এবং আল্লাহর অলী। যে কেউ মসজিদ দেখা শোনার মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অধিকারী হতে পারে না। এরপর ১২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا بَلَدًا آَمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آَمَنَ مِنْهُمْ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ قَالَ وَمَنْ كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلَى عَذَابِ النَّارِ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ (126) “স্মরণ কর যখন ইব্রাহীম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! একে নিরাপদ শহরে পরিণত কর আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করবে তাদেরকে বিভিন্নভাবে ফলের দ্বারা রিযিক দাও৷ আল্লাহপাক ইব্রাহীমের প্রার্থনার জবাবে বললেন, কাফেরদেরকেও আমি কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগের সুযোগ দেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করবো এবং তা কত নিকৃষ্ট পরিণাম!” (২:১২৬) হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবাঘর প্রতিষ্ঠার পর সেটি এবাদতের জন্য প্রস্তুত করলেন এবং একইসঙ্গে মক্কাশরীফের অধিবাসীদের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’টি জিনিসের আবেদন জানালেন। একটি নিরাপত্তা ও শান্তি আর অপরটি হলো জীবন ধারণের জন্য রিজিকের ব্যবস্থা। যদিও ইব্রাহীম (আ.) কেবল মুমিনদের জন্য দোয়া করেছেন, কিন্তু তারপরও আল্লাহপাক জবাবে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবার জন্যে বস্তুগত রিজিক দান করবেন। তিনি কাফেরদেরকে তাদের অবিশ্বাসের জন্য দুনিয়ার ধন-সম্পদ বা ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত করেন না। যদিও তারা তাদের কাজের জন্য পরকালে দোজখে প্রবেশ করবে। এ আয়াতে দু’টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে- প্রথমত: মুমিনদের জন্য দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা ও বস্তুগত কল্যাণের প্রয়োজন আছে এবং সেজন্যেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে তা চেয়েছেন ৷ দ্বিতীয়ত: কাফেররা পার্থিব ধন-সম্পদের অধিকারী হলেও তা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বা সৎ পথে থাকার প্রমাণ বহন করে না। বরং এ থেকে আল্লাহর কাছে পার্থিব সম্পদ যে মূল্যহীন তাই ফুটে উঠে। এবারে সূরা বাকারাহ’র ১২৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (127) “যখন ইব্রাহীম ও ইসমাইল কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল তখন তারা দোয়া করেছিলেন-হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এ কাজ গ্রহণ কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (২:১২৭) হযরত আদম (আ.)এর সময় থেকেই কাবা ঘর ছিল ৷ কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) তা পুনঃনির্মাণ করেন। কারণ মক্কায় যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার স্ত্রী সন্তানকে বসবাসের জন্য নিয়ে গেলেন তখন বললেন, হে প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরকে এই শুষ্ক ও চাষবাসহীন এলাকায় তোমার ঘরের পাশে থাকার ব্যবস্থা করলাম৷ সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ইব্রাহীম (আ.) যখন মক্কায় আসেন তখন সেখানে আল্লাহর ঘর অর্থাৎ কাবাঘরের অস্তিত্ব ছিল৷ এছাড়াও সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে কাবাকে এবাদতের প্রথম ঘর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে৷ সূরা বাকারাহ’র ১২৭ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, যদি নিয়ত আল্লাহমুখী হয় তাহলে মিস্ত্রির কাজও এবাদত। মূলত: কাজ কি সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আল্লাহর দরবারে ওই কাজ কবুল হওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা যদি কাবা ঘরও নির্মাণ করি আর সে নির্মাণ কাজ যদি আল্লাহর দরবারে কবুল না হয় তাহলে তার কোন মূল্য নেই। এবারে আজকের আলোচিত কয়েকটি আয়াতের মূল শিক্ষা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। এক. আল্লাহপাক ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান করেন। দুনিয়ার নানা ঘটনা হলো আল্লাহর এক ধরনের পরীক্ষা, যাতে মানুষ সেসবের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে পারে এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পৌঁছুতে পারে। দুই. ইমামত ও নেতৃত্ব খোদার দেয়া একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, এটি দুনিয়াবী কোন পদমর্যাদা নয়। সুতরাং ইসলামী সমাজের ওপর যে কেউ শাসন চালাতে পারে না এবং যেকারো নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার নেই ৷ তিন. মসজিদ আল্লাহর ঘর এবং বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদার অধিকারী৷ তাই সৎ ও মুত্তাকী লোকদেরকে মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে ৷ চার. মক্কা হলো একটি আদর্শ ইসলামী শহরের দৃষ্টান্ত। এটি যেমন এবাদতের স্থান তেমনি নিরাপত্তার কেন্দ্র। মূলত: আল্লাহর এবাদত হতে হবে নিরাপত্তা ও শান্তির ছায়াতে। কারণ ধর্ম বৈষয়িক বিষয় থেকে আলাদা কিছু নয়। সূরা বাকারাহ”র ১২৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ (128) “(হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) বলেছেন) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত এক উম্মত সৃষ্টি কর। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের ওপর ক্ষমা পরবশ হও৷ তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” (২:১২৮) হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর সকল নির্দেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। এটাই তাঁর সাফল্যের মূল কারণ। এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো তিনি আল্লাহর নির্দেশের কারণে নিজের সন্তান ইসমাইলকে জবাই করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আর এই একই লক্ষ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে, শুধু তিনি নিজেই নন, তাঁর সন্তান ইসমাইল ও তাঁর বংশধররাও যেন ঐশী বিধানের অনুগত হয়। কারণ সমস্ত পূর্ণতা হলো আল্লাহর দাসত্বের মধ্যে এবং তাঁর একক সত্ত্বার এবাদতের মধ্যে। অবশ্য ইবাদত বা আরাধনা হতে হবে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে,সব ধরনের কুসংস্কার ও বেদআত বা কু-প্রথা থেকে মুক্ত হয়ে। আর এ জন্যেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করেছেন যে, হে খোদা! তোমার ইবাদতের পন্থা তুমি আমাদেরকে শিখিয়ে দাও, যাতে তুমি যেভাবে চাও সেভাবে তোমার ইবাদত করতে পারি ৷ সূরা বাকারাহ’র ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে- رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (129) “হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুণ, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াত তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (২:১২৯) একদিকে বংশধরদের জন্য চিন্তা ও আন্তরিকতা এবং অন্যদিকে ভবিষ্যৎ চিন্তার কারণে ইব্রাহীম (আ.) তাঁর দোয়ায় নিজের জন্য আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার আগে ভবিষ্যৎ বংশধরদের মুক্তি ও সৌভাগ্যের জন্য দোয়া করলেন। যেহেতু সৌভাগ্য আল্লাহর পথ-নির্দেশনা ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু ইব্রাহীম (আ.) মানুষের জন্য একজন ঐশী পথ-নির্দেশক বা পয়গাম্বর পাঠানোর আবেদন জানান, যাতে করে তিনি তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটান ৷ এরপর ১৩০ ও ১৩১ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآَخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ (130) إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (131) “বোকা বা নির্বোধ ছাড়া আর কে ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ থেকে বিমুখ হবে ! নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর তখন তিনি বলেছিলেন, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্ম-সমর্পণ করলাম।”(২:১৩০-১৩১) এই আয়াতে হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে আল্লাহর মনোনীত একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তাঁর ধর্ম ও আদর্শ অন্য সকল মানুষের জন্য আদর্শ হতে পারে। এটা কি নির্বুদ্ধিতা নয় যে, এমন একটি পবিত্র ও বিশুদ্ধ ধর্মকে ছেড়ে দিয়ে মানুষ শির্ক ও কুফরীর মত গোমরাহীর দিকে ছুটবে? অথচ এ ধর্ম হচ্ছে মানুষের প্রকৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইব্রাহীম (আ.)এর ধর্ম এত গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের নবী গর্ব করে বলেছেন, তাঁর পথ হলো ইব্রাহীমেরই পথ, যে ইব্রাহীম যুক্তি দিয়ে কাফের বা অবিশ্বাসীদের নির্বাক করেছিলেন এবং সাহসিকতার মাধ্যমে একাই সমস্ত মূর্তিকে কুঠার দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন৷ ইব্রাহীম(আ.) আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রেও চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন৷ তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানকে মক্কার উত্তপ্ত মরুতে পরিত্যাগ করেন এবং নিজের তরুণ সন্তানকে কোরবানী দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এসবের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, তার অন্তর স্ত্রী ও সন্তানের জন্য অন্ধ ছিল না বরং তার অন্তর ছিল শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত। এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ এ ধরনের মানুষকে যোগ্যতা দিয়ে মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে অন্যদের নবী ও নেতা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন ৷ তাই ইব্রাহীম (আ.)এর পথ থেকে দূরে থাকা নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতা ছাড়া অন্য কিছু নয় ৷ এরপর ১৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (132) “ইব্রাহীম ও ইয়াকুব এ সম্পর্কে তাদের পুত্রদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, হে পুত্রগণ, আল্লাহ তোমাদের জন্য এই ধর্ম মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলমান না হয়ে অন্য কোন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করো না ৷” (২:১৩২) একজন আন্তরিক ও দয়ালু পিতা শুধু সন্তানের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষারই চিন্তা করেন না বরং সন্তানদের চিন্তাধারার সুস্থতা ও বিচ্যূতিহীনতার দিকেই তিনি বেশী লক্ষ্য রাখেন। মৃত্যুর সময় আল্লাহর মনোনিত ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদেরকে শুধু পার্থিব ধন-সম্পদ বন্টনের ব্যাপারেই ওসিয়ত করেননি, একইসঙ্গে তৌহিদ ও ইবাদতের ব্যাপারেও পরামর্শ দিয়েছেন। এরপরের আয়াত অর্থাৎ ১৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَهَكَ وَإِلَهَ آَبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (133) “ইয়াকুবের মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এল, তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? সে যখন তার পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করবে? তারা তখন বলেছিল-আমরা আপনার ও আপনার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাইল ও ইসহাকের যে একক প্রভু রয়েছেন-তাঁরই উপাসনা করব এবং আমরা তারই নিকট আত্মসমর্পণকারী ৷” (২:১৩৩) একদল ইহুদী মনে করে, ইয়াকুব মৃত্যুর সময় তাঁর সন্তানদেরকে তৎকালীন ইহুদী ধর্মের যে বিশ্বাস তা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন। আল্লাহ এই দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, তোমরা কি ইয়াকুবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলে যে এমন দাবি করছ? বরং সে তার সন্তানদেরকে এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল এবং তার সন্তানরা ওয়াদা করেছিল যে তারা শুধু এক আল্লাহরই ইবাদত বা দাসত্ব করবে৷ তৌহিদের অন্যতম যুক্তি হলো সব নবীই এক খোদার কথা বলেছেন এবং ইব্রাহীম, ইসমাইল ও ইসহাকের খোদা ছিল একই ৷ যদি অন্য কোন খোদার অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে তারাও মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য নবী পাঠাতেন ও নিজেকে মানুষের মধ্যে পরিচিত করতেন ৷ আলোচিত আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- এক. মানুষ শুধু আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করবে। কারণ আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর কাছে নিজেকে সপে দেয়ার মাধ্যমেই ইহকাল ও পরকালে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। দুই. দোয়া করার সময় শুধু নিজের বৈষয়িক দিকের কথা চিন্তা না করে বরং সন্তান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সৌভাগ্যের জন্যও দোয়া করা উচিত। তিন. অশিক্ষিত ব্যক্তিই নির্বোধ নয় বরং নির্বোধ সেই যে জ্ঞান-বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়। সূরা বাকারাহ’র ১৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ (134) “সেই উম্মত (দল) চলে গেছে, তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের, তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের, তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে না।” (২:১৩৪) বনী ইসরাইল বা ইহুদীরা তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করতো৷ তাদের ধারণা ছিল, তারা নিজেরা যতই ভুল-ভ্রান্তি বা পাপ করুক না কেন, তাদের পূর্বপুরুষদের ভালো কাজের কারণে তারাও ক্ষমা লাভ করবে। তাই তারা নিজেদের সংশোধনের পরিবর্তে তাদের পূর্বপুরুষদের কাজ-কর্ম স্মরণ করতো এবং সর্বত্র বলে বেড়াত। কিন্তু এই আয়াতে তাদেরকে ও মুসলমানসহ অন্যান্যদেরকে এই বলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষ নিজে নিজের কাজের জন্য দায়ী থাকবে এবং কিয়ামত বা পুনরুত্থানের সময় পিতা, সন্তান ও আত্মীয়ের সম্পর্ক কারো কোনই কাজে আসবে না। তাই পূর্বপুরুষের ভালো কাজের জন্য যেন তারা আনন্দিত না হয়৷ আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, মানুষের মর্যাদা তার মহত্ব বা অধ্যবসায়ের মধ্যে নিহিত, পূর্ববর্তীদের নষ্ট হয়ে যাওয়া হাঁড়ের মধ্যে নয়। এরপর ১৩৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَقَالُوا كُونُوا هُودًا أَوْ نَصَارَى تَهْتَدُوا قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (135) “তারা বলে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রিস্টান হয়ে যাও,তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, (কখনই নয়) বরং আমরা ইব্রাহীমের ধর্মে আছি যা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সে মুশরিক বা অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (২:১৩৫) ইহুদীরা নিজেদেরকে সঠিক পথের অনুসারী বলে দাবী করে ও খ্রিস্টানদেরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা নিজেদেরকে সত্যের অনুসারী ও ইহুদীদেরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। এভাবে তারা পরস্পরকে নিজেদের ধর্মের দিকে আহবান করত৷ কোরআন এই কর্তৃত্বকামী প্রচেষ্টার জবাবে বলেছে, মুক্তি লাভের পথ কোন দলের আনুগত্য করে পাওয়া যাবে না বরং মুক্তি পেতে হলে সত্য পথের অনুসারি হতে হবে৷ এক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) একটি আদর্শ কারণ কখনও শির্ক ও আত্মপূজায় লিপ্ত হননি। এই আয়াত আমাদেরকে এটা শিক্ষা দেয় যে, ইহুদী হওয়া বা খ্রিস্টান হওয়া বড় কথা নয় । তৌহিদ বা একত্ববাদের অনুসরণ করাই হল গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- قُولُوا آَمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (136) “তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদের বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।” (২:১৩৬) পূর্ববর্তী আয়াতে ধর্ম নিয়ে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছিল৷ তারই রেশ ধরে এ আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পয়গম্বর বা ঐশী পথনির্দেশকদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই৷ কারণ তাঁদের সবাই এক খোদার পক্ষ থেকে এসেছেন৷ তাঁদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাও এক আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে৷ তাই একত্ববাদের অনুসারীদের উচিত সমস্ত ঐশী পথ প্রদর্শকদের মেনে নেয়া এবং তাঁদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিশ্বাস করা৷ শুধু নিজেদের পয়গম্বরকে মানব ও অন্যদের পয়গম্বরকে ও তাদের গ্রন্থগুলোকে অস্বীকার করব-এটা ন্যায় বিচার হতে পারে না৷ আল্লাহর নবীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মত, যারা একটা নির্দিষ্ট সময়ে মানুষকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পেয়েছেন এবং চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষের অগ্রগতির সাথে সঙ্গতি রেখে আল্লাহ গ্রন্থসমূহ ও অধিকতর পূর্ণাঙ্গ আইন-বিধান নাজিল করেছেন, যাতে করে মানুষকে সুপথ প্রদর্শন করা যায়৷ এরপর ১৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে।- فَإِنْ آَمَنُوا بِمِثْلِ مَا آَمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (137) “তোমরা যাতে বিশ্বাস করেছ তারাও যদি একই রকম বিশ্বাস করে তবে তারা সুপথ পাবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতায় রয়েছে। সুতরাং এখন তাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।” (২:১৩৭) এ আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, যদি তথাকথিত ঐশিগ্রন্থের অনুসারীরা আত্মকেন্দ্রীকতা ও বংশীয় কলহ বিদ্বিষ ছেড়ে দিয়ে মুসলমানদের মতই সমস্ত নবী ও তাদের উপর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান আনত, তাহলে তারা সঠিক পথ খুঁজে পেত৷ কিন্তু যদি তারা নিজেদেরকে সত্যের মানদণ্ড বলে মনে করে ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ও তাদের পয়গম্বরদের বিভ্রান্ত বলে মনে করে, তবে তাহলো সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষণ এবং সত্যানুসন্ধানীদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার লক্ষণ৷ এই আয়াতের শেষে মুসলমানদেরকে সাহস যুগিয়ে বলা হচ্ছে যে, ধর্মের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আল্লাহই মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট৷ কারণ তোমাদের সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে ও যে সব পরিকল্পনা করা হচ্ছে-সেসবই আল্লাহপাক অবগত আছেন ৷ এরপর ১৩৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে- صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ (138) “আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রঙ এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে? আমরা তাঁরই এবাদত করি।”(২:১৩৮) আল্লাহ হচ্ছেন সমগ্র জগতের রঙদানকারী শিল্পী৷ তিনি মানুষ সৃষ্টির শুরুতে মানুষের আত্মাকে পবিত্র স্বভাব বা প্রকৃতি দিয়ে রঙীন করেছেন৷ কিন্তু মানুষ আল্লাহর দেয়া রঙের ওপর নিজেদের ইচ্ছে মত রঙ লাগাচ্ছে। যেমন প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে৷ আর এভাবে আল্লাহর দেয়া স্বভাবগত রঙকে নিজের অস্তিত্ব থেকে মুছে ফেলছে। ব্যক্তিগত দলীয় ও গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ হলো এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা রঙ, যা মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই এসব গোত্রীয় ও বংশীয় সকল রঙ বা বৈশিষ্ট্য দূর করতে হবে যাতে আল্লাহর রঙ মানুষের মধ্যে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রঙ ছাড়া সকল রঙই সময়ের পরিক্রমায় ম্লান ও ধীরে ধীরে বর্ণহীন হয়ে যায়৷ কিন্তু শুধু আল্লাহর রঙই সুদৃঢ় ও অম্লান হয়ে টিকে থাকে৷ সব রঙই বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি ডেকে আনে৷ কিন্তু আল্লাহর রঙ হলো ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মানদণ্ড এবং তা এক আল্লাহর দাসত্বের ছায়াতলে অবস্থিত৷ আজকের আলোচিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে , এক. পূর্ব পুরুষদের নিয়ে গর্ব না করে নিজেদের কাজের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে৷ প্রত্যেককেই তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে৷ অন্যরা যখন তাদের পারলৌকিক মুক্তির জন্য আপ্রাণ সচেষ্ট, তখন আমরা নিজেদের বংশ নিয়ে গর্ব মত্ত না থাকি। দুই. আমাদেরকে সত্যপন্থী হতে হবে, দল পন্থী নয়৷ সত্যপন্থী হলে মানুষের চোখ ও কান সত্য উপলদ্ধির জন্য খোলা থাকে৷ কিন্তু যারা দলপন্থী তারা মানুষকে অন্যদের ভালো দিক ও পূর্ণতা এবং নিজেদের দূর্বলতা সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখে৷ তিন. অন্তরে বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি কাজেও আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হবে৷ একদিকে ঈমানের দাবী করা ও অন্যদিকে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা স্ব-বিরোধিতা মাত্র ৷ সূরা বাকারাহ’র ১৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- قُلْ أَتُحَاجُّونَنَا فِي اللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ وَلَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُخْلِصُونَ (139) “হে নবী, আপনি আহলে কিতাবদের বলুন, আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা কি আমাদের সঙ্গে বিতর্ক করতে চাও? অথচ তিনি আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের জন্য এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য, আমরা তাঁর প্রতি অকপট।” (২:১৩৯) এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, কোন কোন ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন যে, তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহ শুধু তাদের নিয়েই ভাবেন ও তাদের জন্যই পথ-প্রদর্শক পাঠিয়েছেন। তাই তারা অন্য কোন নবী বা তাদের অনুসারীদের গ্রহণ করতে চান না। অথচ আল্লাহর কাছে সকল মানুষই সমান এবং একমাত্র মানুষের আমল বা কৃতকর্মই আল্লাহর সাথে মানুষের দূরত্ব বা নৈকট্য সৃষ্টির মানদণ্ড। তবে মানুষ যে সব কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আঞ্জাম দেয় তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এজন্য মানুষকে শির্ক বা অংশীবাদের কদর্যতা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং ইমানের আলোয় নিজের অন্তর ও আত্মাকে আলোকিত করতে হবে। এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মানুষ এতটাই আত্ম কেন্দ্রীক যে সৃষ্টিকর্তাকেও তারা নিজের অধিকার ভুক্ত বিবেচনা করার চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ কোন ধর্ম, জাতি বা সমাজের একক অধিকারভুক্ত নন। তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীরই পালনকর্তা। এরপর ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- أَمْ تَقُولُونَ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطَ كَانُوا هُودًا أَوْ نَصَارَى قُلْ أَأَنْتُمْ أَعْلَمُ أَمِ اللَّهُ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَتَمَ شَهَادَةً عِنْدَهُ مِنَ اللَّهِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (140) “হে আহলে কিতাব! তোমরা কি বলতে চাও ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণ ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান ছিল? হে নবী, আহলে কিতাবদের বলুন, তোমরা বেশী জান,না আল্লাহ ? তার চাইতে অত্যাচারী কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে প্রমাণিত সাক্ষ্যকে গোপন করে? তোমরা যা কর আল্লাহ তা অবগত আছেন।” (২:১৪০) হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আঃ) এর কোন কোন অনুসারী তাদের ধর্মের সত্যতা প্রমাণের জন্য দাবি করে থাকেন যে স্বয়ং হযরত ইব্রাহীম ও তার পরবর্তীকালের নবীরাও তাদের ধর্মেরই অনুসারী ছিলেন। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আঃ) ও পরবর্তীকালের নবীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ ধরনের দাবির পেছনে বিদ্বেষ ছাড়া গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তি নেই। পবিত্র কোরআন সত্যের বিকৃতিকে সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে মনে করে। কারণ সত্যের বিকৃতি বহু যুগ ধরে বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং এর ফলে সমাজের বিকাশ ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ বাধাগ্রস্থ হয়। এরপর ১৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ (141) “সে সম্প্রদায় অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদের জন্যে এবং তোমরা যা করছ, তা তোমাদের জন্যে। তাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না।” (২:১৪১) এই আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ভিত্তিহীন দাবির জবাব দেয়া হয়েছে। এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, কেন তারা তাদের ইতিহাসকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর যুগ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে? একটি জীবন্ত বা গতিশীল সমাজের মূল্যায়ন হবে সেই সমাজের কর্ম ও বৈশিষ্ট্যের উপর। অতীত ইতিহাসের ওপর নয়। অতীতের সমস্ত নবী ও জাতি গত হয়ে গেছে। তাদের কর্ম তাদের সঙ্গেই সম্পর্কিত। তেমনি ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে তাদের কাজকর্মের জন্য নিজেদেরকেই জবাবদিহিতা করতে হবে। গুণাবলী হল অর্জন করার বিষয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজকে নিজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। গুণাবলী উত্তরাধিকারের মত কোন বিষয় নয় যে তা সন্তানরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে লাভ করবে। এরপর সূরা বাকারার ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- سَيَقُولُ السُّفَهَاءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلَّاهُمْ عَنْ قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُوا عَلَيْهَا قُلْ لِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (142) “নির্বোধ লোকেরা বলবে, তারা এ যাবৎ যে কেবলা অনুসরণ করে আসছিল তা থেকে কিসে তাদেরকে ফিরিয়ে দিল? বলুন, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই, তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।” (২:১৪২) এর আগেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তনের বিষয়টিকে ইহুদীরা মুসলমানদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। এই আয়াতে ও পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে এ বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট আলোচনা এবং ইহুদীদের আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়্যত লাভের পর মক্কায় থাকাকালীন সময়ে অর্থাৎ দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ রেখে নামাজ পড়তেন। এর কারণ ছিল- প্রথমত : আগে একত্ববাদীদের কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস এবং সমস্ত ঐশী ধর্মের কাছেই বায়তুল মোকাদ্দাস অত্যন্ত সম্মানিত স্থান হিসেবে বিবেচিত হত। দ্বিতীয়ত : তৎকালীন মুশরিকরা কাবা ঘরকে মূর্তির ঘরে রূপান্তরিত করেছিল। এ অবস্থায় ইসলামের নবী (সাঃ) যদি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন, তাহলে বাস্তবে তা হতো মূর্তিদের দিকে মুখ ফেরানো। মদীনায় হিজরত করার পরও কয়েক মাস পর্যন্ত মুসলমানরা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন। আর ইহুদীরা এ বিষয়কে অজুহাত করে বলতো,মুসলমানরা তো আমাদের অনুসারী। কারণ তাদের স্বতন্ত্র কেবলা নেই। এ নিয়ে উপহাস ও বিদ্রুপ মুসলমানদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় আল্লাহ তা’লা কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দিলেন। একদিন রাসূল (সাঃ) যখন মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করছিলেন, তখন জিব্রাইল ফেরেশতার প্রতি নির্দেশ দেয়া হলো, নামাজের মধ্যেই রাসূল (সাঃ)কে যেন কাবামুখী করা হয়। সেই থেকে ওই মসজিদ জু-কেবলাতাইন অর্থাৎ দুই কেবলার অধিকারী মসজিদ হিসাবেই খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু বাহানাবাজ ইহুদীরা এবার নতুন আপত্তি তুলে মুসলমানদেরকে বলল, যদি আগের কেবলা সঠিক হয়, তাহলে কোন কারণে তা বাতিল করা হলো? এবং কেন এতকাল পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়া হলো? পবিত্র কোরআনে এর জবাবে বলা হয়েছে, কেবলার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ স্থান বা কোন অঞ্চল নিয়ে আছেন বা আল্লাহ পশ্চিম দিকে আছেন বা পূর্ব দিকে আছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই আছেন এবং সবই তার মালিকানাধীন। আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন স্থানেরই বিশেষ কোন মর্যাদা নেই। আল্লাহর নির্দেশেই আমরা কোন বিশেষ স্থানকে সম্মান করি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহর নির্দেশের অনুগত হওয়া। আল্লাহ যেদিকেই মুখ ফেরানোর নির্দেশ দেন, সেদিকেই আমাদের মুখ ফেরানো উচিত-তা কাবাই হোক বা বায়তুল মোকাদ্দাস হোক। তারাই আল্লাহর সহজ ও সঠিক পথে পরিচালিত হবে, যারা আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করবে। সূরা বাকারাহ’র ১৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنْتَ عَلَيْهَا إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ وَإِنْ كَانَتْ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (143) “এভাবেই তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পার এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পারে। (হে রাসূল!) আপনি এ যাবত যে কেবলা অনুসরণ করেছিলেন, তাকে এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম-যাতে জানতে পারি কে রাসূলের অনুসরণ করে এবং কে ফিরে যায়। আল্লাহ যাদের সৎ পথে পরিচালিত করেছেন তারা ব্যতীত অপরের নিকট তা নিশ্চয় কঠিন। আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের বিশ্বাসকে ব্যর্থ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি স্নেহশীল দয়াময়। ” (২:১৪৩) গত পর্বে কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কে ইহুদীদের আপত্তিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ এ সব আপত্তির জবাবে বলেছেন, পূর্ব পশ্চিম আল্লাহরই মালিকানাধীন। আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথে চলার মধ্যেই রয়েছে মুক্তি বা সুপথ। এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই যে, আল্লাহ পূর্বে অথবা পশ্চিমে বিরাজ করছেন এবং শুধু সেদিকেই মুখ ফেরাতে হবে। এই আয়াতে মুসলিম জাতিকে সব ধরনের চরমপন্থা থেকে মুক্ত মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম জাতি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে বস্তুগত,অর্থনৈতিক,আধ্যাত্মিক,বিশ্বাসগত প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্যের সীমানার মধ্যে রয়েছে। এ আদর্শ সমগ্র মানবজাতির জন্য উপযোগী। এটা স্পষ্ট যে, সমস্ত মুসলমান এরকম নয় এবং মুসলমানদের অনেকেই চিন্তা অথবা কাজে চরমপন্থা অবলম্বন করে থাকতে পারে। তাহলে এ আয়াতের মূল উদ্দেশ্য কি? এই আয়াতের মূল উদ্দেশ্য এটা বোঝানো যে, ইসলামী বিধান বা ধর্ম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থী ধর্ম। কেউ যদি ইসলামের সমস্ত বিধান মেনে চলে, তাহলে একমাত্র সেই এমন অবস্থানে উপনীত হবে যে আল্লাহ তাকে মানুষের জন্য তার নিজের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করবেন। যেমনটি রাসূল (সাঃ)এর আহলে বাইতগণ ঐশী নির্দেশনাবলীর প্রথম বাস্তবায়নকারী ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং সত্যিকারের মুসলিম জাতির পূর্ণাঙ্গ সাক্ষী বা আদর্শ ছিলেন। তারা বলেছেন, মধ্যপন্থী জাতি বলে আল্লাহ যাদেরকে মানুষের ওপর তার নিজের সাক্ষী বলে ঘোষণা করেছেন, আমরাই হলাম সেই জাতি। এই আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে,কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আল্লাহর অন্যান্য নির্দেশের মতই একটি নির্দেশ ও পরীক্ষা-যাতে এটা জানা যায় যে কারা আল্লাহর অনুগত এবং কারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর এ জন্যেই যারা আল্লাহর পথ নির্দেশনা বা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য এ নির্দেশ পালন করা কঠিন এবং তারাই এ ক্ষেত্রে আপত্তি ও প্রশ্ন তুলছে। এরপর ১৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ (144) “নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের (কাবা শরীফের) দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা অবশ্যই জানে যে, (এ ধর্মগ্রন্থ) তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রেরিত সত্য। তারা যা করে তা আল্লাহর অজানা নেই।” (২:১৪৪) ইহুদীরা যখন মুসলমানদের এই বলে বিদ্রুপ করছিল যে, তাদের কোন স্বতন্ত্র কেবলা নেই, তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ জোহরের নামাজের সময় আল্লাহর রাসূলের ওপর এ নির্দেশ অবতীর্ণ হয় এবং রাসূল (সাঃ) বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মুখ ফিরিয়ে মক্কার দিকে মুখ করায় তার পেছনে জামাতে সমবেত মুসলমানরাও কাবামুখী হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামের নবী দুই কেবলার দিকে মুখ করে নামাজ পড়বেন এবং ইসলামের নবীর অন্যতম এক নিদর্শন হবে এই ঘটনা। তাই এই আয়াতে আহলে কিতাবদের হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে- তোমরাই যখন জান যে, এই নির্দেশ সত্য তবুও কেন প্রতিবাদ করছ? এরপর ১৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آَيَةٍ مَا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ وَمَا أَنْتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ وَمَا بَعْضُهُمْ بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّكَ إِذًا لَمِنَ الظَّالِمِينَ (145) “হে নবী জেনে রাখুন যাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল পেশ করেন তবুও তারা আপনার কেবলার অনুসারী হবে না এবং আপনিও তাদের কেবলার অনুসারী নন এবং যেমনটি তাদের কেউ কেউ অন্য কারো কেবলার অনুসারী হবে না। আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও আপনি যদি তাদের বাসনার অনুসরণ করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি হবেন অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত।” (২:১৪৫) এই আয়াতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হচ্ছে-যদি আহলে কিতাব আপনার কেবলাকে গ্রহণ না করে, তবে আপনি দুঃখিত হবেন না। কারণ হিংসা তাদেরকে সত্য গ্রহণের সুযোগ দেবে না। তাই আপনি যত যুক্তিই দেখান না কেন, তারা কিছুতেই যুক্তি গ্রহণ করবে না। কিন্তু তারা গ্রহণ না করলেও আপনি যেন আপনার কেবলা সম্পর্কে নীরব না হন বরং দৃঢ়তার সাথে এটা ঘোষণা করবেন যে, আমরা এসব হৈ-চৈ বা আপত্তিতে নত হব না এবং আমাদের অবস্থান থেকে মোটেই পিছু হটব না। ইসলাম ধর্মে সবার জন্য একই বিধান থাকায় আল্লাহ তার নবীকেও হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, আপনি নিজেও যদি তাদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে নিজের সঠিক কেবলার অনুসরণ না করেন তাহলে আপনি নিজের উম্মতের ওপর বড় ধরনের জুলুম করার দায়ে দোষী হবেন। এরপর ১৪৬ ও ১৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (146) الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ (147) “আমি যাদেরকে গ্রন্থ দিয়েছি, তারা তাকে সেরূপ জানে, যেরূপ জানে আপন সন্তানগণকে এবং তাদের একদল জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে। সত্য তোমার প্রতিপালকের, সুতরাং তুমি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হইও না।” (২: ১৪৬-১৪৭) তাওরাত ও ইঞ্জিল গ্রন্থে শেষ নবীর বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। আর তাই আহলে কিতাবগণ নবী (সাঃ) কে চিনত কিন্তু বিদ্বেষ ও একগুঁয়েমীর কারণে তারা এই সত্যকে অন্যদের কাছে গোপন রাখত বা সত্যকে বিকৃত করত। অবশ্য আহলে কিতাব রাসূল (সাঃ) এর বৈশিষ্ট্য দেখে তার প্রতি ঈমান এনেছিল। এইসব শারীরিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য পূর্ববর্তী গ্রন্থে এমনভাবে উল্লেখিত হয়েছিল যে, কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তারা নবী (সাঃ)কে নিজের সন্তানের মতই চিনত। শেষের এই আয়াতে যে বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে জোর দেয়া হয়েছে তা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নাজেল হয়েছে একমাত্র তাই সত্য। মানুষের বিরোধিতা এমনকি অধিকাংশ মানুষও যদি বিরোধিতা করে তাহলেও ঐশী নির্দেশের সত্যতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সন্দিহান হওয়া উচিত নয়। এবারে সূরা বাকারার ১৪৩ থেকে ১৪৭ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক- এক. কেবলায় একদিকে যেমন রয়েছে স্বাধীনতার রহস্য, তেমনি এটি আত্মসমর্পনেরও নিদর্শন। স্বাধীনতা বলতে কর্তৃত্বকামী সকল ধর্ম ও জাতি থেকে মুসলমানরা আলাদা বা স্বতন্ত্র। আত্মসমর্পন বলতে বোঝায়, আল্লাহ যে নির্দেশই দেন না কেন নির্দ্বিধায় কোন প্রশ্ন ছাড়াই তা মেনে নেয়া। দুই. ইসলাম হলো ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থী ধর্ম। যদি মুসলমানরা আল্লাহর নির্দেশিত সঠিক পথে চলে তাহলে তারা অন্যান্য জাতির জন্য আদর্শ ও তাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে। তিন. গোঁয়ার্তুমী ও বিদ্বেষ সব ধরনের যুক্তি, বিদ্বেষ ও সত্য অনুসন্ধানের বিরোধী। আর তাই ধর্ম এই দাম্ভিক মনোভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। সূরা বাকারাহ’র ১৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ أَيْنَ مَا تَكُونُوا يَأْتِ بِكُمُ اللَّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (148) “প্রত্যেকের জন্যে একটি দিক আছে যেদিকে সে মুখ করে দাঁড়ায়, অতএব তোমরা সৎ কাজের দিকে এগিয়ে যাও। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে একত্রিত করবেন, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (২:১৪৮) কোরআনের আলোর গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, কেবলা কোন দিকে তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ ইতিহাসে দেখা যায়, অতীতেও একেক ঐশি ধর্মের জন্য কেবলার দিক ভিন্ন ভিন্ন ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করা। তাই ধর্মের মূল নীতি নয়, এমন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে তারাই প্রিয় যারা সৎকাজ করে। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানদণ্ড হচ্ছে-সৎকাজ। মানুষকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী হতে হবে এবং তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে কাজে প্রমাণ দিতে হবে। প্রতিযোগীতা এমন একটি বিষয় যা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কখনও খেলাধুলার ক্ষেত্রে কখনও জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে মানুষ। কিন্তু পবিত্র কোরআন বিশেষ কোন ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ না করে যা কিছু মানুষ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর সেসব বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে বলেছে এবং এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে বলেছে। তবে এই প্রতিযোগীতা যেন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এরপর ১৪৯ ও ১৫০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِنَّهُ لَلْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (149) وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَيْكُمْ حُجَّةٌ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِي وَلِأُتِمَّ نِعْمَتِي عَلَيْكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ (150) “হে নবী, যেখানেই আপনি বের হন, আপনার মুখমন্ডল (নামাজের সময়) কাবা শরীফের দিকে ফেরান। এটা নিশ্চয় আপনার প্রতিপালকের কাছ থেকে পাঠানো সত্য। (হে মুসলমানরা!) তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ উদাসীন নন। হে নবী! (পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি) আপনি যেখান থেকেই বের হন (মাসজিদুল হারাম) পবিত্র মসজিদের দিকে মুখ ফেরাবেন এবং (তোমরা মুসলমানরা) যেখানেই থাক না কেন ওই মসজিদের দিকে মুখ ফেরাও যাতে তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী ছাড়া অন্য কেউ তোমাদের সাথে বিতর্ক না করে। অতএব তাদেরকে ভয় কর না, শুধু আমাকেই ভয় কর। যাতে আমি তোমাদের জন্যে আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করে দেই এবং তাতে যেন তোমরা সরলপথ প্রাপ্ত হও। (২:১৪৯-১৫০) এই দুই আয়াতে পুনরায় মক্কার কাবা ঘরকে কেবলা হিসেবে উল্লেখ করে ইসলামের নবী ও মুসলমানদের কাছে এর বিভিন্ন যুক্তি থাকার কথা বলা হয়েছে। প্রথমতঃ ইহুদীদের ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ভয়ের কারণে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ মেনে চলা অনেক মুসলমানের জন্য কঠিন ছিল। দ্বিতীয়তঃ ঐশীগ্রন্থ অনুসরণের দাবিদাররা তাদের গ্রন্থে এটা পড়েছিল যে ইসলামের নবী দুই কেবলার দিকে নামাজ পড়বেন। যদি এই বিষয়টি বাস্তবায়িত না হতো, তাহলে তারা বলত আসমানী গ্রন্থগুলোতে শেষ নবীর যেসব লক্ষণ বা নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই নবীর মধ্যে সেসব নেই। এরপর ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন- كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آَيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ (151) “(হে মুসলমানরা, আমি আমার সম্পদ বা নেয়ামত তোমাদেরকে পূর্ণভাবে দান করেছি ও তোমাদের মুক্তি বা পথ প্রদর্শনের মাধ্যমগুলো দিয়েছি)-যেমন আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াত সমূহ তোমাদের কাছে পাঠ করে, তোমাদের পবিত্র করে, গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়।” (২: ১৫১) মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী আয়াতে কেবলা পরিবর্তনের অন্যতম যুক্তি হিসেবে মুসলমানদেরকে আল্লাহর নেয়ামত পূর্ণভাবে দান করা ও তাদেরকে পথ প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এই আয়াতে বলা হয়েছে-মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে আরও অনেক বড় নেয়ামত উপহার দিয়েছেন। আর সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত হলো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী পাঠানো। এই নবীরা ছিলেন জনগণের শিক্ষক। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর আয়াত ও বিধান শিক্ষা দিতেন এবং একজন আন্তরিক প্রশিক্ষক হিসেবে মানুষের সংশোধন ও উন্নয়নের চিন্তা করতেন। নবীরা শুধুমাত্র নৈতিকতা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই মানুষের পরিচালক ছিলেন না, একইসঙ্গে সমাজের চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশ্য ঈমান ও বিশ্বাসের ছায়াতেই তারা জ্ঞান প্রচার করতেন। এই সূরার ১৫২ নং আয়াতে বলা হয়েছে- فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ (152) “অতএব তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব, তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী হইও না।” (২:১৫২) আল্লাহ মানুষকে এত নেয়মত ও কল্যাণ দান করেছেন যে তা হিসাব করে শেষ করা যাবে না। ফলে এসব নেয়ামত তিনি যেভাবে ব্যবহার করলে সন্তষ্ট হন সেভাবেই ব্যবহার করা উচিত। যদি মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়-তাহলে তার প্রতি আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের কথাও তার মনে থাকে না, এই অবস্থায় আল্লাহও তাকে তার নিজের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন। আল্লাহকে স্মরণ করা বলতে শুধু মুখে মুখে স্মরণ করা বোঝায় না বরং আন্তরিক চিত্তে বাস্তবে তাকে স্মরণ করা বোঝায়। মানুষ যখন পাপে লিপ্ত হবার উপক্রম হয়, তখন সে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় তা থেকে দূরে থাকে। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বলতে শুধু মুখে মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে বোঝায় না। আল্লাহর প্রতি বাস্তবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলে আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতকে যথাযথ ক্ষেত্রে এবং যে লক্ষ্যে ওইসব নেয়ামত দেয়া হয়েছে ঠিক সে লক্ষ্যেই ব্যবহার করতে হবে।

No comments:

Post a Comment

Translate