Monday, January 23, 2023

পরপুরুষ, পরমহিলা, অমুসলিম ইত্যাদির নিকট কাপড় ধৌত করা, ইস্ত্রি করা বা সেলাই করা সংক্রান্ত শরঈ মাসায়েল

 প্রশ্ন:

১. কাজের মহিলা যে বাসায় কাজ করে সেই বাসার পুরুষদের আন্ডারওয়্যার ধুতে পারবে কী?
২. কোনও মহিলা তার স্বামী-সন্তান ব্যতিরেকে তার শ্বশুর, দেবর-ভাসুর ইত্যাদি বাড়ির অন্যান্য পুরুষদের আন্ডারওয়্যার ধুতে পারবে কী?
৩: মহিলাদের জামা-কাপড়, শাড়ি, ব্লাউজ, বোরকা ইত্যাদি পোশাক আয়রন/ইস্ত্রি করার জন্য দোকানে দেওয়া জায়েজ হবে‌ কী?
৪. পাক অথবা নাপাক কাপড় বিধর্মী পরিচালিত লন্ড্রিতে ধৌত করতে দিলে তা কি পবিত্র হবে? অর্থাৎ সেই কাপড়ে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে কী?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: নিম্নে উপরোক্ত প্রশ্ন সমূহের সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রদান করা হল:
وبالله التوفيق

◈ প্রশ্ন ১. কাজের মহিলা যে বাসায় কাজ করে সেই বাসার পুরুষদের আন্ডারওয়্যার ধুতে পারবে কী?
উত্তর: কাজের মহিলা যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়ির কর্তা ও ছেলেদের আন্ডারওয়্যার ধৌত করতে পারে। এতে কোনও বাধা নেই। তবে যদি আন্ডার ওয়্যারে বীর্য দৃশ্যমান থাকে তাহলে যারা তা ব্যবহার করে তাদের উচিৎ, সে অবস্থায় কাজের মহিলাকে ধোয়ার জন্য না দেয়া বরং তাদের উচিৎ, বীর্য লেগে শুকিয়ে গেলে তা আঙ্গুল দ্বারা ঘষে ফেলা বা ঐ অংশটুকু পানি দ্বারা পরিষ্কার করে নেওয়া। কারণ এটি স্বভাবত: একজন নারীর জন্য লজ্জাবোধের কারণ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হাম্মাম ইবনে হারিস রাহ. বর্ণনা করেন যে,
ضَافَ عَائِشَةَ ضَيْفٌ فَأَمَرَتْ لَهُ بِمِلْحَفَةٍ صَفْرَاءَ فَنَامَ فِيهَا فَاحْتَلَمَ فَاسْتَحْيَا أَنْ يُرْسِلَ بِهَا وَبِهَا أَثَرُ الاِحْتِلاَمِ فَغَمَسَهَا فِي الْمَاءِ ثُمَّ أَرْسَلَ بِهَا فَقَالَتْ عَائِشَةُ لِمَ أَفْسَدَ عَلَيْنَا ثَوْبَنَا إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيهِ أَنْ يَفْرُكَهُ بِأَصَابِعِهِ وَرُبَّمَا فَرَكْتُهُ مِنْ ثَوْبِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِأَصَابِعِي ‏
একবার আয়েশা রা. এর কাছে একজন মেহমান আগমণ করলো। তিনি তাকে একটি হলুদ রঙ্গের চাদরে বিশ্রাম করতে দিলেন। উক্ত মেহমান তা গায়ে জাড়িয়ে ঘুমালেন। কিন্তু ঘুমের মধ্যে তার স্বপ্নদোষ হলে বীর্যের দাগসহ চাদরটি আয়েশা রা.-এর কাছে ফেরত পাঠাতে তার খুব লজ্জাবোধ হল। তাই এটি পানিতে চুবিয়ে ধুয়ে তিনি তা ফেরত পাঠালেন। আয়েশা রা. তা দেখে বললেন, সে আমাদের কাপড়টা নষ্ট করল কেন? আঙ্গুল দিয়ে তা ঘষে ফেললেই তো যথেষ্ট হতো। অনেক দিনই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাপড় থেকে আমি তা অঙ্গুল দিয়ে রগড়ে ঘষে সাফ করে দিয়েছি।” [ইবনে মাজাহ ৫৩৮, মুসলিম, তিরমিযি হা/১১৬-আল মাদানি প্রকাশনী]

◈ প্রশ্ন ২. কোনও মহিলা কি তার স্বামী-সন্তান ছাড়া শ্বশুর, দেবর, ভাসুর ইত্যাদি বাড়ির অন্যান্য পুরুষদের আন্ডারওয়্যার ধুতে পারবে কী?
উত্তর: ইসলামের দৃষ্টিতে একজন স্ত্রীর জন্য তার স্বামী ছাড়া স্বামীর বাবা (শ্বশুর), ভাই (দেবর-ভাসুর) ইত্যাদি লোকজনের বিভিন্ন ধরণের সেবা করা, কাপড় ধৌত করা ইত্যাদি আবশ্যক না হলেও এটি আমাদের সমাজের প্রচলিত রীতি। অর্থাৎ আমাদের সমাজে যৌথ পরিবারে সাধারণত বৌরাই বাড়ির সকল সদস্যের জামা-কাপড় ধৌত করে থাকে।
তাই স্বামী যদি এতে অনুমতি বা নির্দেশ দেয় তাহলে স্ত্রী তার স্বামী-সন্তান ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাপড়-চোপড়ও ধৌত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অন্য পুরুষদের আন্ডার ওয়্যারও ধৌত করতে পারে যদি ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকে। কিন্তু স্বামী ব্যতিরেকে অন্য কোন পুরুষের আন্ডারওয়ার ধৌত করার বিষয়টি সামাজিকভাবে ঘৃণিত এবং আত্মমর্যাদা পরিপন্থী কাজ। তাই কোন মহিলাকে এই দায়িত্ব দেওয়া অনুচিত। অবশ্য বর্তমান আধুনিক যুগে ওয়াশিং মেশিনের সাহায্যে কাপড় ধৌত করা হলে এ ক্ষেত্রে সমস্যা আরও কমে যায় আল হামদুলিল্লাহ।

◈ প্রশ্ন ৩. মহিলাদের জামা-কাপড়, শাড়ি, ব্লাউজ, বোরকা ইত্যাদি পোশাক আয়রন/ইস্ত্রি করার জন্য দোকানে দেওয়া জায়েজ হবে কী?
উত্তর: মহিলাদের ব্যবহৃত পোশাক প্রয়োজনবোধে ধৌত ও ইস্ত্রি করার উদ্দেশ্যে পুরুষ পরিচালিত লন্ড্রিতে বা ছেঁড়া-ফাটা কাপড় সেলাই করার উদ্দেশ্যে পুরুষ দর্জির দোকানে দিতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। কেননা ইসলামি শরিয়তে এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে কোনও নারী যদি ব্যক্তিগত আত্মমর্যাদার কারণে তার ব্যবহৃত পোশাক কোন পুরুষকে দেখাতে না চায় তাহলে তা‌ ধৌত করা, ইস্ত্রি/আইরন করা বা প্রয়োজনীয় সেলাইয়ের কাজ সম্ভব হলে কোন নারীর মাধ্যমে সম্পন্ন করবে অথবা নিজেই করবে।

◈ প্রশ্ন ৪. পাক অথবা নাপাক কাপড় বিধর্মী পরিচালিত লন্ড্রিতে ধৌত করতে দিলে কি তা পবিত্র হবে? অর্থাৎ সেই কাপড়ে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে কি?
উত্তর: কোন অমুসলিমও যদি পাক পানি দ্বারা ভালোভাবে কাপড় ধৌত করে তাহলে তা পাক হবে। পক্ষান্তরে কোন মুসলিমও যদি নাপাক পানি দ্বারা কাপড় ধৌত করে তাহলে তা পাক হবে না। মোটকথা, কোন পানি দ্বারা কাপড় ধৌত করা হয় সেটাই ধর্তব্য। যে ধৌত করল সে মুসলিম কি না তা ধর্তব্য নয়। উল্লেখ্য যে, অমুসলিমরা ঈমান না থাকার কারণে বিধানগতভাবে নাপাক হলেও বাহ্যিকভাবে তাদের শরীর নাপাক নয় যদি তারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। সুতরাং তাদের সেলাই কৃত পোশাক-আশাক এবং তাদের তৈরি কৃত আসবাবপত্র ব্যবহার করা নাজায়েজ নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবিগণ তৎকালীন দামেশক (সিরিয়া) ও ইয়েমেন থেকে আমদানিকৃত অমুসলিমদের তৈরি কৃত পোশাক-আশাক এবং আসবাব সামগ্রী ব্যবহার করতেন। আল্লাহু আলাম।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ফরজ গোসলের বিধান

 প্রশ্ন: রাতে স্বপ্নদোষ হলে এই শীতের সকালে গোসল সম্ভব নয়। তাহলে এ ক্ষেত্রে নামাজ পড়তে চাইলে কী করা উচিত?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: স্বপ্নদোষ হওয়া বড় নাপাকির অন্তর্ভুক্ত। এ থেকে পবিত্রতার জন্য গোসল করা ফরজ। সুতরাং এমনটি ঘটলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সময় পানি গরম করে গোসল করতে হবে। কিন্তু যদি এমন পরিস্থিতির মধ্যে থাকেন যে, সেখানে পানি গরমের কোনো ব্যবস্থা নেই এবং ঠাণ্ডা পানিতে গোসলের কারণে অসুস্থ হওয়ার কিংবা রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে তাহলে এক্ষেত্রে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েজ। কিন্তু পানি গরমের ব্যবস্থা থাকলে তায়াম্মুম করা জায়েজ হবে না।
◆ আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُم
“তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করো।” [সূরা তাগাবুন: ১৬]
◆ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ
“আমি যদি তোমাদেরকে কোন বিষয়ে আদেশ করি তাহলে সাধ্য অনুসারে তা পালন করবে।” [সহিহ বুখারি]

◆ হাদিসে আরও এসেছে, প্রখ্যাত সাহাবী আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
احتَلمتُ في ليلةٍ باردةٍ في غزوةِ ذاتِ السُّلاسلِ فأشفَقتُ إنِ اغتَسَلتُ أن أَهْلِكَ فتيمَّمتُ، ثمَّ صلَّيتُ بأصحابي الصُّبحَ فذَكَروا ذلِكَ للنَّبيِّ صلَّى اللَّهُ عليهِ وسلَّمَ فقالَ: يا عَمرو صلَّيتَ بأصحابِكَ وأنتَ جنُبٌ ؟ فأخبرتُهُ بالَّذي مَنعَني منَ الاغتِسالِ وقُلتُ إنِّي سَمِعْتُ اللَّهَ يقولُ:( وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا ) فضحِكَ رسولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عليهِ وسلَّمَ ولم يَقُلْ شيئًا
“যাতুস সালাসিল যুদ্ধের সময় এক প্রচণ্ড শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হয়। আমার ভয় হল, আমি যদি গোসল করি তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হব। তাই আমি তায়াম্মুম করে লোকজনকে নিয়ে সালাত আদায় করলাম। পরে তারা বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানালে তিনি বললেন, “হে আমর, তুমি নাকি জুনুবি (নাপাক) অবস্থায় তোমার সাথীদের নিয়ে সালাত আদায় করেছো?” তখন আমি গোসল না করার কারণ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলাম এবং বললাম, আমি আল্লাহর এই বাণী শুনেছি, (আল্লাহ বলেছেন,)
وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
“আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড়ই দয়াবান’’ (সূরা নিসা: ২৯)। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন এবং কিছুই বললেন না।” [আবু দাউদ-সহিহ] এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মতির মাধ্যমে এমন পরিস্থিতিতে তায়াম্মুম করার বৈধতা প্রমাণিত হয়।

❑ শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,
إذا كان في محل لا يستطيع فيه تدفئة الماء وليس هناك كن يستكن به للغسل بالماء الدافي وخاف على نفسه فإنه يصلي بالتيمم
ولا حرج عليه
“যদি সে এমন জায়গায় থাকে যেখানে সে পানি গরম করতে পারে না এবং গরম পানি দিয়ে গোসল করার জন্য সেখানে এমন কোনো ঘর না থাকে যেখানে (ঠাণ্ডা থেকে) আত্মরক্ষা করবে এবং (ঠাণ্ডা পানি ব্যবহারের কারণে) শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে তাকে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করবে। এতে কোনও আপত্তি নেই।” [binbaz]

🔸উল্লেখ্য যে, এই বিধান স্বপ্নদোষের পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী মিলন কিংবা জাগ্রত অবস্থায় বীর্যপাতের মাধ্যমে জুনুবি (নাপাক) হওয়ার ক্ষেত্রে, মহিলাদের ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হওয়া ও প্রসূতি নারীর পবিত্রতার জন্য গোসলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

তাবলিগ জামাতকে না বলার ১২টি কারণ

 الحمد لله و الصلاة و السلام على رسول الله -أما بعد:

নিম্নে তাবলিগ জামাতকে ‘না’ বলার বা প্রত্যাখ্যান করার অসংখ্য কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুতর ১২টি কারণ উল্লেখ করা হল:

◈ ১. তাবলিগ জামাতের অবস্থা হল, ঘরের ফাউন্ডেশন মজবুত ভাবে তৈরি না করে ডেকোরেশন নিয়ে ব্যস্ত থাকার মত বা ভেঙ্গে পড়া ঘরকে মজবুত ভিত্তির উপরে নির্মাণ করার পরিবর্তে কোনমতে ঠেকা দিয়ে রাখার মত কিংবা যে গাছের শেকড়ে ঘুণ ধরেছে তার মূল সমস্যা বাদ দিয়ে গাছের আগায় পানি ঢালার মত। কেননা মানুষের আকিদা সংশোধন, শিরক, বিদআত, ইসলামবিরোধী নানা মতবাদ, ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার থেকে এদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, লম্বা দাড়ি রাখা, মাথায় পাগড়ি পরা, লম্বা জুব্বা পরা, বোরকা পরা, মিসওয়াক করা, চিল্লায় বের হওয়া ইত্যাদি।

◈ ২. চতুর্দিকে শিরকের জমজমাট আসর, মানুষ কবর পূজায় লিপ্ত ও বিভিন্ন বাতিল দল ও ফিরকায় দিশেহারা। কিন্তু এসব ব্যাপারে তাদের কোন বক্তব্য নেই। কেননা এসব বিষয়ে কথা বললে নাকি সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে!

◈ ৩. মানুষ বিদআত, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ এসব বিষয়ে কথা বললে নাকি ‘হাজার বছরের ঐক্য’ নষ্ট হবে এবং মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া সৃষ্টি হবে।

◈ ৪. এই জামাতের ভিত্তি জাহালত বা মূর্খতার উপরে প্রতিষ্ঠিত। ফলে মানুষকে দীনী ইলম বা ইসলামের বিশুদ্ধ জ্ঞানান্বেষণের দিকে উৎসাহিত করার চেয়ে তাদের কথিত ‘চিল্লা’য় বের হওয়ার জন্য উৎসাহিত করাই তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। ফলশ্রুতিতে মূর্খরা মাথায় পাগড়ি বেঁধে ফাজায়েলের কিতাব নিয়ে জনগণের সামনে ওয়াজ করতে দাঁড়িয়ে যায়।তারপর স্বভাবতই ইসলাম সম্পর্কে উল্টাপাল্টা ও ভুলভাল ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে।
অনুরূপভাবে দীন সম্পর্কে অজ্ঞ মহিলারাও পাড়ায়-মহল্লায় দ্বীন সম্পর্কে সাধারণ মহিলাদের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ও বিদআতি কথাবার্তা প্রচারে নিয়োজিত রয়েছে। অথচ ইসলাম সম্পর্কে কথা বলা এবং আমল করার পূর্বে ইলম (জ্ঞান) অর্জন করা ফরজ।

◈ ৫. দীনী ইলম অর্জনে অনীহা ও গুরুত্ব হীনতা:

যার কারণে আপনি দেখবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাবলিগের একজন মুরুব্বি যে, ১০-১৫ বা ২০ বছর ধরে তাবলিগের মেহনতের সাথে জড়িত তাকে যদি ইসলামের প্রাথমিক এবং মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে তার উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। যেমন:
– ইসলাম ও ঈমান কাকে বলে?
– ইসলাম এবং ঈমানের রোকন কয়টি ও কী কী?
– দীনের স্তর কয়টি ও কী কী?
– ইবাদত কাকে বলে?
– ইবাদতের রোকন কয়টি ও কী কী?
– ইবাদত কবুলের শর্তাবলী কয়টি ও কী কী?
– ঈমান ভঙ্গের কারণগুলো কী কী?
– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সঠিক অর্থ এবং এর শর্তাবলী কয়টি ও কী কী?
– এছাড়াও শিরক, কুফর, নিফাক, উসিলা, শাফাআত ইত্যাদি। বিষয়টি আপনারা নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

◈ ৬. উদ্ভট কিচ্ছা-কাহিনী এবং জাল-জইফ হাদিস বর্ণনা:
এই মূর্খদের ওয়াজ বা বয়ানের মূল ভিত্তি হলো, বুজুর্গদের বুজুর্গির বর্ণনা, উদ্ভট স্বপ্ন, কিচ্ছা-কাহিনী, জাল-জইফ হাদিসের বয়ান এবং ভিত্তিহীন ফজিলতের ফুলঝুরি। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা হাদিস বর্ণনার পরিণতি জাহান্নাম।

◈ ৭. সংস্কার ও সংশোধনে অনীহা:

তাবলিগ জামাতের প্রধান সিলেবাস ফাজায়েল নামক কিতাবগুলো অসংখ্য ভ্রান্ত কথাবার্তা, জাল-জইফ হাদিস এবং ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে পরিপূর্ণ। এসব কিতাবের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন করে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় শত শত গ্রন্থ রচিত হলেও তারা মোটেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না‌। বরং তারা উল্টো সংস্কার প্রত্যাশীদেরকে গালাগালি, নানা অপবাদ ও তির্যক বাক্যবাণে জর্জরিত করে ছলে-বলে-কৌশলে ভুলগুলোকেই সঠিক প্রমাণের অপচেষ্টায় লিপ্ত!

◈ ৮. দলাদলি, কোন্দল ও রক্তপাত:

এই জামাতটি বর্তমানে দুই ভাগে (জুবায়ের পন্থী ও সাদ পন্থী) বিভক্ত হয়ে একে অপরের সাথে চরম কোন্দলে লিপ্ত হয়েছে। মসজিদ ভাগাভাগি, মসজিদে মারামারি, এক মসজিদে দু গ্রুপের আলাদা আলাদা জামাত, একই ময়দানে আলাদা আলাদা ইজতিমা। এমনকি একদল আরেক দলকে কাফের বা ইহুদি-খ্রিষ্টানের দালাল বলেও আখ্যায়িত করছে। সর্বোপরি টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে দুই গ্রুপের লোমহর্ষক রক্তাক্ত মারামারি জাতিকে স্তম্ভিত করেছে।

◈ ৯. এদের মাধ্যমে কিছু মানুষ দাড়ি ছেড়েছে, মাথায় টুপি পরেছে, মহিলারা বোরকা পরেছে, নামাজি হয়েছে, নানা পাপকর্ম থেকে ফিরে এসেছে তা ঠিক। কিন্তু শিরক যুক্ত ঈমান এবং বিদআত যুক্ত আমল আল্লাহর কাছে কোনই কাজে লাগবে না সে ব্যাপারে তারা নিতান্তই বেখবর। তাই তো আল্লাহ বলেছেন,
قُلۡ هَلۡ نُنَبِّئُكُم بِٱلۡأَخۡسَرِینَ أَعۡمَـٰلًا
ٱلَّذِینَ ضَلَّ سَعۡیُهُمۡ فِی ٱلۡحَیَوٰةِ ٱلدُّنۡیَا وَهُمۡ یَحۡسَبُونَ أَنَّهُمۡ یُحۡسِنُونَ صُنۡعًا
“(হে নবী আপনি বলুন), আমি কি তোমাদেরকে সেসব মানুষের ব্যাপারে বলবো যারা আমলের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত? তারা হল, সে সব লোক, যাদের কর্ম প্রচেষ্টা দুনিয়ার জীবনেই বাতিল যায় অথচ তারা মনে করে যে, তারা ভালো কাজ করেছে!” [সূরা কাহফ: ১০৩ ও ১০৪]

◈ ১০. এই জামাতটি নিজেদের টাকায় দাওয়াতি কাজ করে বলে গর্ব করে। কিন্তু তারা নিজেদের টাকায় মূলত: বিদআত প্রচারে লিপ্ত। নিজে বিদআত করার চেয়ে বিদআত প্রচারের ভয়াবহতা বেশি। কারণ এর দ্বারা যত মানুষ বিদআতি কাজ করবে তাদের প্রত্যেকের সমপরিমাণ গুনাহ প্রচারকারীর আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হবে।

◈ ১১. কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা:

তাবলিগ জামাত জি/হাদের আয়াতগুলোকে তাদের কথিত চিল্লা ও গাশতের পক্ষে ব্যবহার করে, ‘চিল্লা’র জন্য নির্ধারিত ৩ দিন, ৪০ দিন (এক চিল্লা), ১২০ দিন (তিন চিল্লা) বা ১ সাল ইত্যাদির পক্ষে কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে এগুলোকে বৈধ প্রমাণের চেষ্টা, টঙ্গীর মাঠে এক ওয়াক্ত নামাজের ফজিলত ৪৯ কোটি গুণ সওয়াবের বর্ণনা, তিন বার টঙ্গীর ইজতিমায় শরিক হলে এক হজের সমপরিমাণ সওয়াব বা এটিকে ‘গরিবের হজ’ বলা। (সাধারণ কিছু মূর্খ এমন কথা বললেও তাবলিগ জামাতের কেন্দ্র থেকে এর প্রতিবাদ বা সংশোধনী মূলক বক্তব্য করা হয়েছে বলে জানা যায় না)।
টঙ্গী ইজতেমার বিশেষ আকর্ষণ হল, আখেরি মুনাজাত। মানুষ এখন ফরজ সালাত আদায়ের চাইতে আখেরি মুনাজাতে যোগদান করাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। আখেরি মুনাজাতে শরিক হওয়ার জন্য নামাজি, বেনামাজি, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী, বিদআতি, দুষ্কৃতিকারী ইত্যাদি মানুষ দলে দলে টঙ্গীর ময়দানের দিকে ছুটতে থাকে। কেউ ট্রেনের ছাদে, কেউ বাসের হ্যান্ডেল ধরে, নৌকায় বসে, পিকআপ প্রভৃতির মাধ্যমে ইজতিমায় যোগদান করে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে, প্রধানমন্ত্রী গণভবনে, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীগণও সেখানে গিয়ে আঁচল পেতে প্রার্থনা করেন। টিভিতে সরাসরি এই মুনাজাত সম্প্রচারিত হয়। রেডিও শুনে রাস্তার ট্রাফিকগণও হাত তুলে আমিন আমিন বলতে থাকে। সে দিন ঢাকা শহরে অফিস-আদালতে অঘোষিত ছুটি পালিত হয়। কারণ তাদের বিশ্বাস, এই আখেরি মুনাজাতে অংশ গ্রহণ করতে পারলে জীবনের সব গুনাহ মোচন হয়ে যায়। অথচ এভাবে নিয়ম করে সম্মিলিত মুনাজাত করাই বিদআত (দীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত কাজ)। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।

◈ ১২. উম্মতের শ্রেষ্ঠ মুহাক্কিক সালাফি আলেমগণ (যেমন: শাইখ বিন বায, শাইখ উমাইমিন, শাইখ আলবানি, শাইখ সালেহ আল ফাওযান প্রমুখ) তাবলিগ জামাতের সাথে বের হওয়া, তাদের বই পড়া এবং তাদের ইজতিমায় শরিক হওয়াকে হারাম বলেছেন এবং উম্মতকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

➤ তাবলিগ জামাতের কোথায় কী সমস্যা এবং সেগুলোর খণ্ডন বিষয়ে নিম্নোক্ত বইগুলো পড়া যেতে পারে:

■ ১. শাইখ হামুদ বিন আব্দুল্লাহ আত তুওয়াইজিরি কর্তৃক রচিত এবং শায়খ মুখলেসুর রহমান বিন মনসুর অনুদিত নিম্নোক্ত গ্রন্থটি:
القول البليغ في التحذير عن جماعه التبليغ
“প্রচলিত তাবলীগ জামাত •সংশয় •সতর্কতা •সমাধান”
বইটি ক্রয় করা যাবে এখান থেকে:
■ ২. তাবলীগ জামা’ য়াত ও দেওবন্দিগণ
সম্পাদনায়: শাইখ আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম
বইটি ক্রয় করা যাবে এখান থেকে:
➣ অথবা এখান থেকে:
■ ৩. ডাউনলোড করুন: (PDF): ইলিয়াসী তাবলীগ ও দীনে ইসলামের তাবলীগ

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Tuesday, January 10, 2023

ইমাম বুখারী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

 

ইমাম বুখারী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু
undefined

ভূমিকা:

ইমাম বুখারী। কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী। আসুন, খুব সংক্ষেপে আমরা এই মনিষীকে জানার চেষ্টা করি।

নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন।

শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ

শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন। তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে।

ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ

১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন।
তাঁর জীবনীতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যখন বসরার মুহাদ্দিছদের হাদীছের ক্লাশে হাজীর হতেন তখন অন্যান্য ছাত্রগণ খাতা-কলম নিয়ে বসে উস্তাদের নিকট থেকে হাদীছ শুনতেন এবং প্রতিটি হাদীছই লিখে ফেলতেন। কিন্তু ইমাম বুখারী তা করতেন না। কয়েক দিন পর তাঁর সাথীগণ জিজ্ঞেস করলঃ আপনি শুধু আমাদের সাথে বসে থাকেন কেন? হাদীছগুলো না লেখার কারণই বা কি? এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ কি? বন্ধুরা যখন পিড়াপিড়ি করতে থাকলো তখন ১৬ দিন পর তিনি বললেনঃ আপনারা আমার নিকট বারবার একই প্রশ্ন করছেন। আপনারা যে সমস্ত হাদীছ লিখেছেন তা আমাকে পড়ে শুনান। বন্ধুরা তা দেখানোর পর তিনি সমস্ত হাদীছ মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন এবং আরও অতিরিক্ত পনের হাজার হাদীছ শুনালেন। অতঃপর তাঁর সাথীগণ তাদের কাছে রক্ষিত কিতাবের হাদীছগুলো ইমাম বুখারীর মুখস্ত কৃত হাদীছের সাথে মিলিয়ে ভুল-ভ্রান্তি ঠিক করে নিলেন। অতঃপর তিনি বন্ধুদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ এরপরও কি তোমরা বলবে যে, আমি এখানে অযথা সময় নষ্ট করছি? সে দিন থেকেই হাদীছ শাস্ত্রে তারা ইমাম বুখারীকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করলেন।
ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি।
ইমাম বুখারীর বাল্যকালের একটি ঘটনা অত্যন্ত চমকপ্রদ। তখন তিনি দশ বছর বয়সের কিশোর। এ সময় তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ইমাম দাখিলীর ক্লাশে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করছিলেন। মুহাদ্দিছ দাখিলী এই সনদে একটি হাদীছ উপস্থাপন করলেনঃ
سفيان عن أبي إبي الزبير عن إبراهيم
“সুফিয়ান বর্ণনা করেন আবুয্ যুবাইর হতে আর আবুয যুবাইর বর্ণনা করেন ইবরাহমী হতে।” বালক বুখারী প্রতিবাদ করে বললেনঃ আবুয যুবাইর ইবরাহীম হতে হাদীছ হাদীছটি বর্ণনা করেন নি। মুহাদ্দিছ দাখিলী তাঁকে ধমক দিয়ে বললেও তিনি প্রশান্ত চিত্তে বললেনঃ أبو الزبير عن إبراهيم নয়: বরং زبير بن عدي عن إبراهيم আপনি দয়া করে একবার আপনার পান্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখুন। অতিরিক্ত জোর দেয়ার কারণে উস্তাদের মনে সংশয় দেখা দিল। তিনি পান্ডুলিপি দেখে ইমাম বুখারীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমার কথাই ঠিক। তখন মুহাদ্দিছ দাখিলী তার জন্য প্রাণ খুলে দুআ করলেন।

হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ

হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর।

বাগদাদে আগমণ ও তাঁর স্মরণ শক্তির পরীক্ষাঃ

তৎকালীন সমগ্র ইসলামী রাজ্যে যখন মুহাদ্দিছ হিসেবে ইমাম বুখারীর কথা ছড়িয়ে পড়ল তখন সেই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিছগণ তাঁকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তিনি যখন বাগদাদে আগমণ করলেন তখন চারশত মুহাদ্দিছ একত্রিত হয়ে ১০০টি সহীহ হাদীছ নির্বাচন করে তার সনদ ও মতন পাল্টিয়ে দিয়ে ১০ ভাগে বিভক্ত করে দশজন মুহাদ্দিছের হাতে সোপর্দ করলেন। অতঃপর তাঁর জন্য হাদীছের মজলিস স্থাপন করা হলো। তিনি যখন আসন গ্রহণ করলেন তখন প্রথমে একজন মুহাদ্দিছ ১০টি হাদীছ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি একটি করে সবগুলো হাদীছ পাঠ করে শেষ করলেন। প্রতিটি হাদীছ পড়া শেষ হলেই ইমাম বুখারী বলতেনঃ لاأعرفه অর্থাৎ এ ধরণের কোন হাদীছ আমার জানা নেই। এমনিভাবে ১০ জন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ১০০টি হাদীছ তাঁর সামনে পাঠ করলেন। সকল হাদীছের ক্ষেত্রেই তিনি বার বার একই কথা বললেন।
পরিশেষে তিনি সকলকে ডেকে উলটপালট কৃত হাদীছগুলোর প্রত্যেকটি হাদীছকে তার আসল সনদের দিকে ফিরিয়ে দিলেন এবং ঠিক করে দিলেন। হাদীছগুলোর সনদ থেকে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি এবং মতনসমূহ থেকে একটি শব্দও ছুটে যায় নি। এমনকি হাদীছগুলো সঠিকভাবে সাজানোতে মুহাদ্দিছগণ তাঁর কোন ভুল-ত্র“টি ধরতে পারেন নি। বলা হয় যে, সমরকন্দে যাওয়ার পরও তাঁকে একই নিয়মে পরীক্ষা করা হয়েছিল। এতে সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসেবে সকলেই তাঁকে স্বীকৃত প্রদান করলেন।

ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ

ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন। প্রত্যেক সাক্ষাতের সময়ই ইমাম আহমাদ তাঁকে খোরাসান ছেড়ে দিয়ে বাগদাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।

সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ

ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও যঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম যঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন।
তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতে এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেন যে, এক দিন আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইয়ের মসজিদে বসা ছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমাদের কেউ যদি হাদীছের এমন একটি গ্রন্থ করতো, যাতে শুধু সহীহ হাদীছগুলোই স্থান পেতো তাহলে খুবই সুন্দর হতো। মজলিসে উপস্থিত সকলেই তাঁর কথা শুনলেও এ কাজে কেউ অগ্রসর হওয়ার সাহস পায় নি। ইসহাকের কথাগুলো ইমাম বুখারীর অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি সেই দিন হতেই এই মহান দায়িত্ব পালন করবেন বলে মনে মনে স্থির করলেন।
তাঁর জীবনীতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীরে মাছি বসছে। তিনি এতে কষ্ট পাচ্ছেন। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানোয়াট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়।

সহীহ বুখারী রচনায় ইমাম বুখারীর শর্ত ও সতর্কতাঃ

ইমাম বুখারী তাঁর কিতাবে কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছগুলোই বর্ণনা করেছেন। কোন হাদীছকে সহীহ হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য এবং তা সহীহ বুখারীতে লিপিদ্ধ করার জন্য যদিও তিনি সুস্পষ্ট করে কোন শর্তের কথা উল্লেখ না করলেও আলেমগণ তাঁর কাজের উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত শর্তগুলো বের করেছেনঃ
১) হাদীছের রাবী তার উপরের রাবীর সমসাময়িক হতে হবে এবং উভয়ের মাঝে সাক্ষাত হওয়া প্রমাণিত হতে হবে। অর্থাৎ সাক্ষাৎ করা এবং হাদীছ শুনা প্রমাণিত হওয়া জরুরী। এই শর্তে তিনি অন্যান্য মুহদ্দিছদের খেলাফ করেছেন। এই ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিমের মর্ত হচ্ছে উভয়ের মাঝে সাক্ষাৎ সম্ভব হলেই চলবে। জীবনে কমপক্ষে একবার সাক্ষাত হয়েছে বলে প্রমাণিত হওয়া এবং নির্দিষ্ট কোন হাদীছ শুনা জরুরী নয়।
২) রাবী ছিাকাহ তথা নির্ভরযোগ্য হতে হবে।
৩) ন্যায়পরায়ন তথা মানুষের সাথে কথা-বার্তায় ও লেনদেনে সত্যবাদী হতে হবে।
৪) রাবী পূর্ণ ম্মরণশক্তি সম্পন্ন হওয়া।
৫) হাদীছের সনদ মুত্তাসিল হওয়া। অর্থাৎ মাঝখান থেকে কোন রাবী বাদ না পড়া।
কোন হাদীছে উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া গেলেই ইমাম বুখারী স্বীয় কিতাবে তা লিখে ফেলেন নি। বরং প্রতিটি হাদীছ লেখার আগে তিনি গোসল করে দুই রাকআত নামায পড়েছেন এবং ইস্তেখারা করেছেন। তাঁর অন্তরে যদি হাদীছটি সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ জাগতো তাহলে সে হাদীছটি শর্ত মোতাবেক সহীহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহীহ বুখারীতে লিখতেন না। এইভাবে মসজিদে নববীতে বসে তিনি তা লেখা শুরু করেন এবং একটানা ১৬ বছর এই কাজে দিন রাত পরিশ্রম করেন।
লেখা শেষ করেই তাড়াহুড়া করে তা মানুষের জন্য প্রকাশ করেন নি; বরং কয়েকবার তিনি তাতে পুনদৃষ্টি প্রদান করেছেন, ভুল-ত্রুটি সংশোধন করেছেন এবং পরিমার্জিত করেছেন। তিনবার তিনি তা লিপিবদ্ধ করেন। সর্বশেষ লিখিত কপিটিই বর্তমানে মুসলিম জাতির নিকট অমূল্য রত্ম হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও বন্ধুগণের নিকট কিতাবটি পেশ করলে তাদের সকলেই তা পছন্দ করেছেন। যারা এই কিতাবটির প্রশংসা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আহমাদ বিন হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদীনী, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন এবং আরও অনেকেই। তারা সকলেই এর সকল হাদীছকে সহীহ বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।তাদের পরে এই উম্মাত আল্লাহ্ তাআলার কিতাবের পরই এটিকে সর্বাধিক সহীহ বলে কবুল করে নিয়েছে।

ইমাম বুখারীর দানশীলতা ও উদারতাঃ

ইমাম বুখারী প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিলেন। মুহাম্মাদ বিন আবু হাতিম বলেনঃ ইমাম বুখারীর এক খন্ড যমীন ছিল। এ থেকে তিনি প্রতি বছর সাত লক্ষ দিরহাম ভাড়া পেতেন। এই বিশাল অর্থ থেকে তিনি খুব সামান্যই নিজের ব্যক্তিগত কাজে খরচ করতেন। তিনি খুব সীমিত খাদ্য গ্রহণ করতেন। বেশীর ভাগ সময়েই খাদ্য হিসেবে শসা, তরমুজ ও সবজি গ্রহণ করতেন। সামান্য খরচের পর যে বিশাল অর্থ অবশিষ্ট থাকতো তার সম্পূর্ণটাই তিনি ইলম অর্জনের পথে খরচ করতেন এবং অভাবীদের অভাব পূরণে ব্যয় করতেন। তিনি সব সময় দিনার ও দিরহামের থলে সাথে রাখতেন। মুহাদ্দিছদের মধ্যে যারা অভাবী ছিলেন তাদেরকেও তিনি প্রচুর পরিমাণ দান করতেন।

তাঁর জীবনীর সাথে সম্পৃক্ত একটি স্মরণীয় ঘটনাঃ

তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার একটি থলের ভিতর একহাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে হাদীছ অন্বেষণের সফরে বের হলেন। সফর অবস্থায় কোন এক চোর এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো দেখে ফেলে এবং তা চুরি করার জন্য ইমাম বুখারীর পিছনে লাগে। কিন্তু চোর তা চুরি করার সকল প্রকার চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়। পথিমধ্যে ইমাম বুখারী পানি পথে ভ্রমণের জন্য জাহাজে আরোহন করলে চোরও তাঁর সাথে যাত্রা শুরু করে। সেখানেও সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরিশেষে চোর মুদ্রাগুলো চুরি করার নতুন এক কৌশল অবলম্বন করে। সে এই বলে চিৎকার করতে থাকে যে, এই জাহাজে উঠার পর আমার একহাজার স্বর্ণমুদ্রা চুরি হয়ে গেছে। মুদ্রাগুলো একটি থলের ভিতর ছিল। সে থলেটির ধরণও বর্ণনা করল, যা সে ইতিপূর্বে ইমামের কাছে দেখেছিল। চিৎকার ও কান্নাকাটির মাধ্যমে চোরটি জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
মাঝি-মাল্লাগণ এক এক করে সকল যাত্রীর পকেট ও শরীর চেক করা শুরু করল। এই দৃশ্য দেখে ইমাম বুখারী চিন্তা ও হতাশায় পড়ে গেলেন। চোরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তিনি ভাবলেন এখন যদি আমাকে তল্লাশি করা হয় তাহলে তো আমার কাছে একহাজার স্বর্ণমুদ্র পাওয়া যাবে আর আমিই চোর হিসাবে সাব্যস্ত হবো। আমি অভিযোগ অস্বীকার করলেও আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না। আর আমি যদি আজ চোর হিসেবে ধরা পড়ি তাহলে সারা দুনিয়ায় খবর ছড়িয়ে পড়বে যে, মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা চুরি করেছে। আমার সারা জীবনের সাধনা ব্যর্থ হবে। আমি যে সমস্ত সহীহ হাদীছ সংগ্রহ করেছি, তাও লোকেরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং পবিত্র ইলমে হাদীছের অবমাননা হবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার মায়া ত্যাগ করে রাসূলের হাদীছে মর্যাদ অক্ষুন্ন রাখার সিদ্বান্ত গ্রহণ করলেন।
তাই তল্লাশ কারীগণ তাঁর শরীরে তল্লাশি চালানোর আগেই অতি গোপনে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রাসহ থলেটি পানিতে ফেলে দিলেন। এরপর সকলের মাল-পত্র ও শরীর তল্লাশির এক পর্যায়ে ইমাম বুখারীর শরীরও তল্লাশি করা হলো। জাহাজের কারও কাছে কোন থলের ভিতর এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল না।
পরিশেষে জাহাজের লোকেরা চোরকেই মিথ্যাবাদী হিসেবে সাব্যস্ত করে সকলকে হয়রানি করার শাস্তি প্রদান করলো এবং আল্লাহ্ তাআলা তাকেই অপদস্ত করলেন। পরে চোর তাঁর সাথে একান্তে মিলিত হয়ে বললঃ জনাব আপনার সাথের এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা আপনি কোথায় রেখেছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ তোমার চক্রান্ত বুঝতে পেরে আমি তা পানিতে ফেলে দিয়েছি।
আল্লাহ্ তাআলা ইমাম বুখারী এবং তাঁর সংগ্রহীত সহীহ হাদীছের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখলেন।

আলেমদের মূল্যায়নে সহীহ বুখারীঃ

সংক্ষিপ্তভাবে কিতাবটি সহীহ বুখারী হিসোবে প্রসিদ্ধতা অর্জন করলেও এর পূর্ণ নাম হচ্ছে الجامع الصحيح المسند من أمور رسول الله صلى الله عليه وسلم وسننه وأيامه আল জামেউস সহীহহুল মুসনাদু মিন উমরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। তবে কারও মতে দীর্ঘ নামটির মধ্যে শব্দের তারতম্য রয়েছে। এই কিতাবে তিনিই সর্বপ্রথম হাদীছসমূহকে আধুনিক পদ্ধতিতে সুবিন্যাস্ত করেন। কিতাবটি রচনার জন্য তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় গমণ করেন। মসজিদে নববীতে বসে একটানা ১৬ বছর কঠোর পরিশ্রম এবং ঐকান্তিক সাধনার ফলশ্র“তিতে সম্পাদিত এই গ্রন্থটি সর্বযুগের সকল আলেমের নিকট সমাদৃত হয়। সমকালীন মুহাদ্দিছ ও হাদীছ বিশেষজ্ঞ পন্ডিতমন্ডলী এই মহাগ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিচার-বিবেচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন। সমগ্র উম্মত সর্বসম্মতভাবে এই গ্রন্থটিকে أصح الكتاب بعد كتاب الله আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও নির্ভুল বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। উপরে বলা হয়েছে যে, প্রায় নব্বই হাজার লোক ইমাম বুখারীর নিকট হতে এই কিতাবটির পুনরাবৃত্তি শ্রবণ করেছেন। বর্তমান মুসলিম জাহানের এমন কোন স্থান ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যেখানে এই কিতাবটি শিক্ষা দান করা হয় না। ইসলামী শিক্ষার শিক্ষার্থীগণ এই গ্রন্থটি অধ্যয়ন ও পাঠ দানের যোগ্যতা অর্জন করার মাধ্যমেই বড় আলেম রূপে স্বীকৃত হয়ে থাকেন।
এ যাবৎ সহীহ বুখারীর যতগুলো ব্যাখ্যা গ্রন্থ বের হয়েছে হাদীছের অন্য কোন কিতাবের এত বেশী সংখ্যক ব্যাখ্যা বের হয় নি। এই ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল্লামা হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী কর্তৃক রচিত ফতহুল বারী সর্বশ্রেষ্ট স্থান দখল করে আছে। কেউ কেউ সহীহ বুখারীর উপর লিখিত ব্যাখ্যা গ্রন্থ শতাধিক বলে মন্তব্য করেছেন।

ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও কঠিন পরীক্ষাঃ

ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয় নি। বুখারার তৎকালীন আমীরের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমীর স্বীয় সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য ইমামের কাছে প্রস্তাব করলো। আমীর আরও প্রস্তাব করলো যে, তার সন্তানদের পড়ানোর জন্য ইমাম বুখারীকে রাজ দরবারে আসতে হবে। কারণ সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে বসে আমীরের ছেলেদের পক্ষে সহীহ বুখারী পড়া সম্ভব নয়।
ইমাম বুখারী তাঁর মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেড়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমীরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোতে ইলমে হাদীছের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে, আমি কখনও হাদীছের ইলমকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারবো না এবং এই মহান রত্মকে আমীর-উমারাদের দারস্থ করতে পারবো না। আমীর যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীছের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তাঁর সন্তানদেরসহ আমার বাড়িতে ও মসজিদে উপস্থিত হন।
এতে আমীর ইমামের প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য দুনিয়া পূজারী কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমীরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান। বুখারা থেকে বের হওয়ার সময় ইমাম আল্লাহর কাছে এই দুআ করেন যে, হে আল্লাহ্! সে আমাকে যেভাবে অপমান করে বের করে দিলো তুমিও তাকে অনুরূপ লাঞ্চিত করো। মাত্র এক মাস পার হওয়ার পূর্বেই খুরাসানের আমীর খালেদ বিন আহমাদের বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাকে ক্ষমতা ছাড়া করলো। পরবর্তীতে বাগদাদের জেলে থাকা অবস্থায় সে মৃত্যু বরণ করে। শুধু তাই নয় যারাই ইমাম বুখারীর বিরুদ্ধে তার সহযোগীতা করেছে তারাই পরবর্তীতে লাঞ্চিত হয়েছে।

ইমাম বুখারী সম্পর্কে আলেমদের কিছু অভিমতঃ

১) ইমাম ফাল্লাস (রঃ) বলেনঃ যে হাদীছ সম্পর্কে ইমাম বুখারী জানেন না, সেটি হাদীছ নয়।
২) ইমাম আবু নুআইম আহমাদ বিন হাম্মাদ (রঃ) বলেনঃ ইমাম বুখারী হচ্ছেন এই উম্মতের ফকীহ। ইয়াকুব বিন ইবরাহীমও অনুরূপ বলেছেন।
৩) কোন কোন বিদ্যান ফিকহ ও হাদীছ শাস্ত্রে ইমাম বুখারীকে আহমাদ বিন হাম্বাল এবং ইসহাক বিন রাহওয়াইয়ের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।
৪) কুতাইবা বলেনঃ পৃতিবীর পূর্ব ও পশ্চিম হতে আমার নিকট অনেক লোক এসেছে কিন্তু মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী যতবার এসেছে আর কেউ এত বেশীবার আগমণ করে নি।
৫) ইমাম আবু হাতিম রাযী বলেনঃ যে সমস্ত মুহাদ্দিছ বাগদাদে আগমণ করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক জ্ঞানী হলেন ইমাম বুখারী।
৬) ইমাম তিরমিজী (উরঃ) বলেনঃ হাদীছের ইল্লত, ইতহিাস এবং সনদ সম্পর্কে বুখারীর চেয়ে অধিক জ্ঞানী ইরাক এবং খোরাসানের যমীনে আর কাউকে দেখি নি।
৭) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর অনুরূপ আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি।
৮) ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (রঃ) বলেনঃ ইমাম বুখারীর সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।
৯) মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন নুমাইর ও আবু বকর ইবনে আবী শায়বা বলেনঃ তাঁর মত আর কাউকে দেখি নি।
১০) আলী বিন হাজার বলেনঃ তাঁর মত আর কেউ আছে বলে আমার জানা নেই।

তাঁর এবাদত-বন্দেী ও পরহেজগারীতার কিছু বিবরণঃ

হাদীছ চর্চায় সদা ব্যস্ত থাকলেও এবাদত বন্দেগীতে তিনি মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর জীবনীতে উল্লেখিত হয়েছে যে, তিনি প্রতি বছর রামাযান মাসের প্রতিদিনের বেলায় একবার কুরআন খতম করতেন। আবার তারাবীর নামাযের পর প্রতি তিন রাত্রিতে একবার খতম করতেন। মুহাম্মদ বিন আবু হাতিম আল ওয়াররাক বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত মোতাবেক তিনি শেষ রাতে তের রাকআত তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। তিনি আরও বলেন যে, আমি তাঁর সাথে থাকা সত্বেও আমাকে কখনই জাগাতেন না। আমি বলতামঃ আপনি আমাকে ঘুম থেকে কখনই না জগ্রত করার কারণ কি? উত্তরে ইমাম বুখারী বলতেনঃ তুমি যুবক লোক। আমি তোমার ঘুমকে নষ্ট করতে চাই না।

সহীহ বুখারী ছাড়াও ইমাম বুখারীর আরও কয়েকটি কিতাবঃ

সহীহ আলবুখারী ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে রয়েছেঃ
১) আল আদাবুল মুফরাদ। (বাংলায় অনুবাদ হয়েছে) [এই লিংক থেকে ডাউনলোড করুন]
২) তারীখুল কাবীর। এতে তিনি হাদীছের রাবীদের জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
৩) তারীখুস সাগীর। এতে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীসহ বেশ কিছু রাবীর জীবনী উল্লেখ করেছেন।
৪) খালকু আফআলিল ইবাদ। এতে তিনি মুতাজেলাদের একটি ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিবাদ করেছেন।
৫) রাফউল ইয়াদাইন ফিস্ সালাত।
৬) জুযউল কিরাআত খালফাল ইমাম।
৭) কিতাবুয যুআ-ফাউস সাগীর।
৮) কিতাবুল কুনা (মুহাদ্দিছদের উপনাম সম্পর্কে)
৯) আত্ তাওয়ারীখ ওয়াল আনসাব
১০) কিতাবুত তাওহীদ
১১) আখবারুস সিফাত। এ ছাড়াও আরও তাঁর অনেক গ্রন্থ রয়েছে গেছে।

ইমাম বুখারীর মৃত্যুঃ

ইমাম বুখারী শেষ বয়সে অনুরূপ ফিতনা ও অবাঞ্চিত ঘটনাবলীতে পার্থিব জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এক দিন তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের আল্লাহর নিকট এ বলে আবেদন জানান যে, “হে আল্লাহ্! এ সুবিশাল পৃথিবী আমার জন্য একান্তই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অতএব আপনি আমাকে আপনার নিকট তুলে নিন। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা ইমাম বুখারীর ব্যাথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সবিনয় নিবেদন কবুল করলেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইলমে হাদীছের এই খাদেম দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।
সমরকন্দের খরতঙ্গ জনপদেই ৬২ বছর বয়সে হিজরী ২৫৬ সালের ঈদুল ফিতরের রাত্রিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। ঈদের দিন যোহরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর অসীয়ত মোতাবেক তিনটি সাদা কাপড় দিয়ে তাঁকে কাফনে জড়ানো হয়। এতে কোর্তা ও পাগড়ি ছিল না।
তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দাফন করার পর তাঁর কবর থেকে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। বেশ কিছু দিন এই অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। লোকেরা তাঁর কবর থেকে মাটি নেওয়া শুরু করে দেয়। অতঃপর বিষয়টি নিয়ে মানুষ ফিতনায় পড়ার আশঙ্কায় প্রাচীর দিয়ে মজবুতভাবে কবরটি ঢেকে দেয়া হয়।
আল্লাহর কাছে দুআ করি তিনি যেন এই মহান ব্যক্তিকে জান্নাতের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দান করেন। আমীন।
তথ্যসূত্রঃ
১) আলবেদায়া ওয়ান নেহায়া
২) আল ওয়াফী ফিল ওয়াফিয়াত
৩) সিয়ারু আলামিন্ নুবালা
সংকলনঃ আব্দুল্লাহ বিন শাহেদ আল-মাদানী
ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার

REPORT THIS AD

সূত্র : কুর’আনের আলো

আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ:) এর জীবনী

 

আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ:) এর জীবনী

আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ:) এর জীবনী
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
প্রিয় বন্ধুগণ, আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব এমন একজন ব্যক্তিত্বের সাথে যাকে বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। হাদীস গবেষণায় যিনি বর্তমান পৃথিবীতে একজন আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহান ব্যক্তি। ইলম চর্চায় তার জীবনীতে আমাদের প্রেরণার যথেষ্ট খোরাক রয়েছে। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অসীম সাহস, সুদৃঢ় মনোবল আর ইখলাস ভরা প্রত্যয় থাকলে কিভাবে একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সাধারণ ঘড়ির মেকার থেকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদে পরিণত করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন আল্লামা আলাবানী। অত:এব আর কাল বিলম্ব না করে আসুন, আমরা হাদীসে নববীর এই নিরলস খাদেম, সালফে সালেহীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, মুহাদ্দিস, ফকীহ, দাঈ, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ:) এর সাথে পরিচিত হই।
প্রারম্ভিকা: আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ:) আধুনিক যুগে মুসলিম জাহানের একজন স্বনামধন্য আলেম। আধুনিক বিশ্বে শাইখ আলবানীকে ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীলের[1] ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রতিভাধারী আলেম হিসেবে গণ্য করা হয়। ইলমে মুস্তালাহুল হাদীসের[2] ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বক্তিত্ব।
মুহাদ্দিসগণ বলেছেন: “তিনি যেন ইবনে হাজার আসকালানী, হাফেয ইবনে কাসীর প্রমুখ ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীলের আলেমদের যুগকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন।”

জন্ম ও পরিচয়:

নাম: মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন (১৯১৪-১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ) পিতার নাম: আলহাজ্ব নূহ। দাদার নাম: নাজাতী। ডাক নাম: আবু আব্দুর রহমান। ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আলবেনিয়ায় তার জন্ম হওয়ায় তাকে আলবানী বলা হয়। তিনি ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে আলবেনিয়ার রাজধানী স্কোডার (Shkodër-বর্তমান নাম তিরানা) এ জন্ম গ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল দরিদ্র। কিন্তু দীনদারী ও জ্ঞানার্জন তাদের দারিদ্রতার উপর ছিল বিজয়ী। তার পিতা ছিলেন আলবেনিয়ার একজন বিজ্ঞ আলেম। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য মানুষ তার কাছে ছুটে যেত। তিনি সাধ্যানুযায়ী মানুষকে দ্বীনের জ্ঞান দিতেন এবং তাদেরকে দিক নির্দেশনা প্রদান করতেন। তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে শরীয়াহ বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।
আলবেনিয়ায় প্রেসিডেন্ট আহমদ জাগু পশ্চাত্য সেকুলার সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়ে নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করলে তিনি শিশু আলবানীকে নিয়ে সপরিবারে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হিজরত করেন।
শিক্ষা জীবন:

দামেস্ক আসার পর আলবানীর বয়স নয় বছরের কাছাকাছি হলে তার পিতা তাকে সেখানকার ‘স্কুল অব এইড চ্যারিটি’ নামক একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানেই তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
প্রচলিত একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দীন সম্পর্কে ভাল জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। বিধায় তার পিতা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ ছেলের পড়া-শোনার ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টি পোষণ করতেন। এ কারণে, তিনি নিজে সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা সিলেবাস তৈরি করে তার মাধ্যমে তাকে আল কুরআনুল কারীম, তাজবীদ, নাহু, সরফ এবং হানাফী ফিকাহ ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা দিতে লাগলেন। ফিকাহের মধ্যে হানাফী ফিকাহের অন্যতম কিতাব মুখতাসরুল কুদুরী পড়ান। তিনি তার পিতার কাছেই হাফস বিন আসেম এর রেয়াওয়াত অনুযায়ী কুরআনের হিফয সমাপ্ত করেন।
এরপর তার পিতার বন্ধু বিশিষ্ট আলেম শাইখ সাঈদ আল বুরহানীর নিকট হানাফী ফিকাহের কিতাব মুরাকিল ফালাহ, নাহুর কিতাব শুযূরুয যাহাব এবং আধুনিক যুগের লিখা আরবী সাহিত্য ও ইলমুল বালাগাহর কিছু কিতাবাদি পড়েন। এর পাশাপাশি তিনি তখনকার দামেস্কের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা মুহাম্মদ বাহজা আল বাইতারের বিভিন্ন দারসে অংশ গ্রহণ করতেন।
তিনি তার পিতার কাছেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শিখেন এবং এ ক্ষেত্রে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঘড়ি মেরামতকেই জীবীকার পেশা হিসেবে বেছে নেন। এই পেশায় তিনি ব্যক্তিগত পড়া-লেখা ও বিভিন্ন কিতাবাদী অধ্যয়নের পর্যাপ্ত সময় পান। এভাবে সিরিয়ায় হিজরতের মাধ্যমে তার জন্যে আরবী ভাষা ও মূল উৎস থেকে শরীয়তের জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়।
হাদীস অধ্যয়ন:

হাদীস অধ্যয়নের প্রতি তার মনোনিবেশ:
যদিও তার পিতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল তার ছেলে যেন হানাফী মাজহাবের তাকলীদ করে। যার কারণে তিনি তাঁকে ইলমে হাদীস চর্চায় মনোনিবেশ করতে সতর্ক করতেন। তথাপি আলবানী ইলমুল হাদীস ও হাদীস চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রেরণা যোগায় শাইখ মুহাম্মদ রশীদ রেজা কর্তৃক প্রকাশিত আল মানার নামক একটি মাসিক ম্যাগাজিন। সেখানে হাদীস বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সন্দর্ভ প্রকাশিত হয় এবং তিনি সেগুলো নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন। এভাবে ধীরে ধীরে হাদীস চর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। তারপর ব্যাপক আগ্রহ সহকারে হাদীস চর্চা শুরু করেন। ফলে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন।
এবার তিনি হাদীসের সেবায় কলম ধরলেন। সর্ব প্রথম যে কাজটি করলেন তা হল, তিনি হাফেজ ইরাকী (রহ:) এর লিখা “المغني عن حمل الأسفار في تخريج ما في الإحياء من الأخبار”  নামক কিতাবটি কপি করে তাতে টিকা সংযোজন করলেন।
শাইখের এই কাজটি তার সামনে হাদীস নিয়ে গবেষণার বিশাল দরজা খুলে দেয়। এরপর ইলমে হাদীস নিয়ে গবেষণা করা তার প্রধান কাজে পরিণত নয়। ক্রমেই তিনি দামেস্কের ইলমী জগতে এ বিষয়ে পরিচিতি লাভ করেন।
যার পরিপ্রেক্ষিতে দামেস্কের জাহেরিয়া লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ তার জন্য বিশেষ একটি কক্ষ নির্ধারণ করে দেয়, যেন তিনি সেখানে অবস্থান করে গবেষণা কর্ম চালাতে পারেন। সেই সাথে লাইব্রেরীর একটি চাবিও তাকে দেয়া হয় যেন তিনি যখন খুশি তাতে প্রবেশ করতে পারেন।
তবে বই-পুস্তক লেখা শুরু করেন তার জীবনে দ্বিতীয় স্তরে। এই পর্যায়ে এসে তিনি সর্ব প্রথম যে গ্রন্থটি রচনা করে তা হল:  تحذير الساجد من اتخاذ القبور مساجد এটি একটি দলীল নির্ভর তুলনামূলক আলোচনা ভিত্তিক ফিকাহের কিতাব। এটি একাধিক বার মুদ্রিত হয়েছে।
ইলমে হাদীসের রীতি অনুসারে হাদীসের তাখরীজ সংক্রান্ত প্রথম পর্যায়ের অন্যতম একটি গ্রন্থ হল:
الروض النضير في ترتيب و تخريج معجم الطبراني الصغير”
যা এখানো পাণ্ডুলিপি আকারেই রয়েছে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের সাথে যুক্ত থাকার কারণে শাইখ আলবানীর মধ্যে সালাফী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। সেই সাথে সালাফী ধারার বিশ্ব বরেণ্য আলেম শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এবং তার ছাত্র ইবনুল কাইয়েম (রহ.) রচিত গ্রন্থাদী অধ্যয়ন করার ফলে এই রীতির উপর তার দৃঢ়তা আরও মজবুত হয়।
শাইখ আলবানী এবার সিরিয়ায় তাওহীদ ও সুন্নাহর দিকে দাওয়াতের পতাকা তুলে ধরলেন। ফলে সিরিয়ার অনেক আলেম ওলামা তার সাক্ষাতে আসেন এবং শাইখ ও ঐ সকল আলেমদের মাঝে তাওহীদের বিভিন্ন মাসআলা, কুরআন-সন্নাহর অনুসরণ, মাজহাবী গোঁড়ামি, বিদআত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়।
ফলে মাজহাবের অন্ধভক্ত গোঁড়া আলেম-ওলামা, সুফি, বিদআতী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন একশ্রেণীর নামধারী আলেমদের পক্ষ থেকে তিনি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ সকল ব্যক্তিরা সাধারণ অজ্ঞ-মূর্খ লোকদেরকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। তাকে ‘পথভ্রষ্ট ওহাবী’ বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং জনসাধারণকে শাইখ থেকে সর্তক করতে থাকে।
অপরপক্ষে তার দাওয়াতের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন দামেস্কের ইলম ও পরহেজগারীতায় প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য আলেম-ওলামাগণ। তারা শাইখকে তার দাওয়াতের পথে দৃঢ় কদমে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেন। সে সকল ওলামাগণের মধ্যে অন্যতম হলেন: বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন আল্লামা বাহজাত আল বাইতার, সিরিয়া মুসলিম যুব সংঘের প্রধান শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আল ইমাম, শাইখ তাওফীক আল বাযারাহ প্রমুখ।
শাইখ আলবানীর দাওয়াহ কার্যক্রম:

নিয়মিত দারস:
তিনি প্রতি সপ্তাহে দুদিন আকীদাহ, ফিকাহ, উসুল এবং ইলমুল হাদীস ইত্যাদি বিষয়ে দারস প্রদান করতেন। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও উপস্থিত হতেন। এতে তিনি যে সকল বইয়ের উপর দারস প্রদান করতেন সেগুলো হল:
১)  ফাতহুল মাজীদ, লেখক: আব্দুর রহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব।
فتح المجيد لعبد الرحمن بن حسن بن محمد بن عبد الوهاب
২) আর রওজাতুন নাদিয়াহ শারহুদ দুরারুল বাহিয়্যাহ লিশ শাওকানী শারহু সিদ্দীক হাসান খাঁন।
الروضة الندية شرح الدرر البهية للشوكاني شرح صديق حسن خان.
৩) উসূলুল ফিকাহ, লেখক: আব্দুল ওয়াহাব খাল্লাফ।
أصول الفقه لعبد الوهاب خلاف
৪) আল বায়িসুল হাসীস শারহু ইখতিসারি উলূমিল হাদীস লি ইবনে কাসীর, লেখক: আহমদ শাকের।
الباعث الحثيث شرح اختصار علوم الحديث لابن كثير شرح احمد شاكر
৫) মিনহাজুল ইসলাম ফিল হুকম, লেখক: মুহাম্মদ আসাদ।
منهاج الإسلام في الحكم لمحمد أسد
৬) ফিকহুস সুন্নাহ, লেখক: সাইয়েদ সাবিক।
فقه السنه لسيد سابق
খ) প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে তিনি দাওয়াতী সফরে বের হতেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি মাসে এক সপ্তাহ দাওয়াতী কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন জেলায় দাওয়াত নিয়ে যেতেন। পাশাপাশি জর্ডানের বিভিন্ন এলাকায়ও সফর করতেন এবং অবশেষে তিনি জর্ডানের রাজধানী আম্মানে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই কারণে তার কিছু দুশমন সিরিয় সরকারের কাছে তার ব্যাপারে চুগলখোরি করলে সরকার তাকে জেলে পাঠায়।
কষ্টে ধৈর্য ধারণ ও হিজরত:

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে শাইখ সিরিয়া ক্ষমতাসীনদের নজরদারীতে পড়েন যদিও তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। যা তার সামনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তিনি দুবার গ্রেফতার হয়েছেন। প্রথমবার ৬৮ সালের আগে দামেস্কের কেল্লা কারাগারে বন্দি ছিলেন একমাসের জন্য। এটা সেই কারাগার যেখানে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ:)কে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ৬৮ সালের যুদ্ধের সময় সিরিয় সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্ত করে দিলে তিনিও মুক্ত হন।
কিন্তু যুদ্ধ আরও কঠিন রূপ ধারণ করলে শাইখকে পুনরায় কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু এবার কেল্লা কারাগারে নয় বরং দামেস্কের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের আল হাসাকা কারাগারে। শাইখ এখানে আট মাস অতিবাহিত করেন। কারাগারে অবস্থানের এই আট মাস সময়ে তিনি হাফেয মুনযেরীর লেখা মুখতাসার সহীহ মুসলিম তাহকীক করেন এবং সেখানে অন্যান্য বড় বড় রাজবন্দী ব্যক্তিত্বের সাথে মিলিত হন।
পরবর্তীতে তিনি সিরিয়া ছেড়ে জর্ডানে পাড়ি জমান এবং রাজধানী আম্মানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।
কার্যক্রম ও অবদান:

শাইখের অনেক ইলমী অবদান ও খেদমত রয়েছে। তন্মধ্যে:
১) শাইখ দামেস্ক একাডেমীর কতিপয় শিক্ষকদের সাথে আল্লামা বাহজাত আল বাইতারের বিভিন্ন দারসে অংশ গ্রহণ করতেন। সে সকল শিক্ষকদের একজন হলেন ইযযুদ্দীন আত তানূহী (রহ:)।
২) দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ফ্যাকাল্টির পক্ষ থেকে তাকে ইসলামী ফিকাহ কোষ এর বুয়ূ বা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত হাদীসগুলো তাখরীজ করার জন্য মনোনীত করা হয় যা ১৯৫৫ইং সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
৩) মিসর ও সিরিয়া একীভূত হওয়ার যুগে হাদীসের কিতাব সমূহ তাহকীক ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। শাইখকে এই প্রকল্প তত্ত্বাবধান কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়।
৪) ভারতের ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া বেনারসে হাদীসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য তার নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু তৎকালীন সময় ভারত-পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ চলছিল। তাই স্ত্রী-পরিবার নিয়ে যাওয়া কঠিন হওয়ায় তিনি সেখানে যেতে অপারগতা পেশ করেন।
৫) সৌদি আরবের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শাইখ হাসান আলুশ শাইখ আব্দুল্লাহ ১৩৮৮ হিজরীতে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের হায়ার ডিপ্লোমা ইন ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাঁর নিকট আবেদন করেন কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।
৬) ১৩৯৫ হিজরী থেকে ১৩৯৮ হিজরী পর্যন্ত মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয়।
৭) স্পেনের মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন এর আহবানে তিনি সেখানে গিয়ে অত্যন্ত সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন যা পরবর্তীতে ‘আকীদা ও আহকাম উভয় ক্ষেত্রেই হাদীস স্বয়ং সম্পন্ন প্রমাণ’ এই শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
৮) কাতার সফরে গিয়ে সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যের বিষয় ছিল: “ইসলামে সন্নাহর মর্যাদা।”
৯) সৌদি আরবের মহামান্য গ্র্যান্ড মুফতী শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ.) এর পক্ষ থেকে তিনি মিসর ও মরক্কো এর ফতোয়া ও গবেষণা বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। অনুরূপভাবে ব্রিটেনের তাওহীদ ও কুরআন-সন্নাহর দিকে আহবানের জন্য গঠিত একটি ইসলামী সংগঠনের প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
১০) তাঁকে দেশে-বিদেশে অনেক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে আহবান করা হয়। কিন্তু তিনি তার জ্ঞান-গবেষণার কাজে ব্যস্ততার দরুন অনেক দাওয়াতে সাড়া দিতে পারেন নি।
১১) তিনি কুয়েত ও আরব আমিরাতে সভা-সেমিনারে অনেক বক্তব্য প্রদান করেন। অনুরূপভাবে ইউরোপের কয়েকটি দেশে গমন করে সেখানকার মুসলিম অভিবাসী ও শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অনেক মূল্যবান দারস পেশ করেন। এছাড়াও তিনি ব্রিটেন এবং জার্মানিতে দাওয়াতী উদ্দেশ্যে সফর করেন।
১২) শাইখের নিকট থেকে শিক্ষা অর্জন করে অগণিত ছাত্র বের হয়েছে যারা পরবর্তীতে বড় বড় গবেষক হিসেবে ইসলামে সেবায় আত্ম নিয়োগ করে করেছেন।
তাঁর লিখিত কিতাবাদী ও গবেষণা:

শাইখের অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক ও গবেষণা কর্ম রয়েছে। সেগুলোর সংখ্যা শতাধিক। তন্মধ্যে অনেকগুলোই বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কোন কোনটি একাধিক বার মুদ্রিত হয়েছে। সেগুলো থেকে নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বইয়ের তালিকা প্রদান করা হল:
১) ইরওয়াউল গালীল ফী তাখরীজি আহাদীসি মানারিস সাবীল। (নয় খণ্ডে সমাপ্ত)
إرواء الغليل في تخريج أحاديث منار السبيل
২) সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ। (সহীহ হাদীস সিরিজ এবং সেগুলোর কিছু ব্যাখ্যা ও শিক্ষা।) (সাত খণ্ডে সমাপ্ত)
 وسلسلة الأحاديث الصحيحة و شيء من فقهها و فوائدها
৩) সিলসিলাতুল আহাদীসিয যাঈফাহ ওয়া মাযূআহ (দূর্বল ও বানোয়াট হাদীস সিরিজ এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তার কুপ্রভাব)। (চৌদ্দ খণ্ডে সমাপ্ত)
 سلسلة الأحاديث الضعيفة و الموضوعة و أثرها السيئ في الأمة
৪) সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান আবূ দাউদ (সুনান আবুদাউদের হাদীসগুলো তাখরীজ এবং তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (দশ খণ্ডে সমাপ্ত)
صحيح وضعيف سنن أبي داود
৫) সাহীহ ও যাঈফ সুনান নাসাঈ (সুনান নাসাঈর হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (সাত খণ্ডে সমাপ্ত)
صحيح وضعيف سنن النسائي
৬) সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান তিরমিযী (সুনান তিরমিযীর হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।)  (সাত খণ্ডে সমাপ্ত)
صحيح وضعيف سنن  الترمذي
৭) সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান ইবনে মাজাহ (সুনান ইবনে মাজার হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (ছয় খণ্ডে সমাপ্ত)
صحيح وضعيف سنن  ابن ماجه
৮) সহীহ ওয়া যঈফুত তারগীব ওয়াত তারহীব। (তারগীব ওয়াত্ তারহীব কিতাবের হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত)
صحيح وضعيف الترغيب والترهيب
৯) তাববীব ওয়া তারতীবু আহাদীসিল জামে’ আসসাগীর।
تبويب وترتيب أحاديث الجامع الصغير وزياداته على أبواب الفقه
১০) সহীহ ওয়া যাঈফুল জামে’ আস সাগীর ওয়া যিয়াদাহিহী।
صحيح وضعيف الجامع الصغير وزياداته
১১) আত তা’লীকাতুল হিসান আলা সাহীহ ইবনে হিব্বান।
التعليقات الحسان على صحيح ابن حبان
১২) সহীহুল আদাবুল মুফরাদ। (এই গ্রন্থে ইমাম বুখারী (রহ:) রচিত আল আদাবুল মুফরাদ কিতাবের সহীহ হাদীসগুলো তাহকীক করে পৃথক করা হয়েছে।(
صحيح الأدب المفرد
১৩) যঈফুল আদাবুল মুফরাদ। (এই গ্রন্থে ইমাম বুখারী (রহ:) রচিত আল আদাবুল মুফরাদ কিতাবের দূর্বল হাদীসগুলো তাহকীক করে পৃথক করা হয়েছে।)
ضعيف الأدب المفرد
১৪) তামামুল মিন্নাহ ফীত্ তা’লীক আলা ফিকহিস সুন্নাহ। (আল্লামা সাইয়েদ সাবিকের লেখা ফিকহুস সুন্নাহ গ্রন্থের তাহকীক ও তাতে টিকা সংযোজন।(
تمام المنة في التعليق على فقه السنة
১৫) তাহকীক মিশকাতিল মাসাবীহ লিত তিবরীযী। (মিশকাতুল মাসাবীহের তাহকীক(
تحقيق كتاب مشكاة المصباح للتبريزي
১৬) আস সুমুরুল মুসতাত্বাব ফী ফিকহিস সুন্নাহ ওয়া কিতাব।
الثمر المستطاب في فقه السنة والكتاب
১৭) আত তাওহীদ আওয়ালান ইয়া দুয়াতাল ইসলাম। (হে ইসলাম প্রচারকগণ, সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দিন)
التوحيد أولاً يا دعاة الإسلام
১৮) ফাযলুস সালাতি ‘আলান্নাবী। (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরুদ পাঠের ফযীলত)
فضل الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم
১৯) ফিতনাতুত তাকফীর। (মুসলমানকে কাফির বলার ফিতনা)
فتنة التكفير
২০) তাহযীরুস সাজিদ মিন ইত্তিখাযিল কুবূরি মাসাজিদ। (কবরকে মসজিদ বানানোর ব্যাপারে সতর্কতা)
تحذير الساجد من اتخاذ القبور مساجد
২১) শারহুল আকীদাহ আত ত্বহাবীয়্যাহ। (আকীদা ত্বহাবিয়ার ব্যাখ্যা(
شرح العقيدة الطحاوية
২২) তাহকীক মুখতাসারুর উলূ’ লিল আলিয়্যিল গাফফার (ইমাম যাহাবীর লেখা মুখতাসার আল ঊলূ কিতাবের তাহকীক(
تحقيق مختصر العلو للعلي الغفار لمحمد بن أحمد بن عثمان الذهبي
২৩) কিতাবুল ঈমান (ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত কিতাবুল ঈমানের তাহকীক ও তাখরীজ(
 الإيمان لابن تيمية
২৪) জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ (মুসলিম নারীর পর্দা)
جلباب المرأة المسلمة
২৫) হিজাবুল মারআহ ও লিবাসুহা ফিস সালাহ (শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ:) রচিত নামাযে নারীর পর্দা ও পোষাক শীর্ষক কিতাবের তাহকীক ও তাতে টিকা সংযোজন(
حجاب المرأة  ولباسها في الصلاة  تأليف: شيخ الإسلام ابن تيمية
২৬) আর রাদ্দুল মুফহিম (যারা নারীদের মুখ ওহস্তদয়কে ঢাকাকে ওয়াজিব বলে তাদের প্রতিবাদ)
الرد المفحم، على من خالف العلماء وتشدد وتعصب، وألزم المرأة بستر وجهها وكفيها وأوجب، ولم يقتنع بقولهم: إنه سنة ومستحب
২৭) তাহরীমু আলাতিত ত্বরব। (বাদ্য যন্ত্র হারাম)
التوسل
২৮) আত তওয়াসসুল (ওসীলার প্রকার ও বিধিবিধান)
تحريم آلات الطرب
২৯) আহকামুল জানাইয (জানাযার বিধান)-বাংলায় অনুদিত।
أحكام الجنائز
৩০) যিলালুল জান্নাহ (জান্নাতের ছায়া)
ظلال الجنة
৩১) আদাবুয যুফাফ (বাসর শয্যার আদব)
آداب الزفاف
৩২) মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরাহ (হজ্জ ও উমরার বিধিবিধান)
مناسك الحج والعمرة في الكتاب والسنة وآثار السلف وسرد ما ألحق الناس بها من البدع
৩৩) কিয়ামু রামাযান (রামাযান মাসে তারাবীহর নামাযের ফযীলত, নিয়ম-কানুন, জামায়াতে আদায়ের বৈধতা এবং ইতেকাফ সংক্রান্ত আলোচনা)
قيام رمضان
৩৪) সালাতুত তারাবীহ (তারাবীহর সালাত)
صلاة التراويح
৩৫) সহীহু সীরাতিন নববিয়্যাহ (বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের জীবনী(
صحيح السيرة النبوية
৩৬) সালাতুল ঈদাইন ফিল মুসাল্লা (ঈদগাহে ঈদের নামায পড়া সুন্নত(
صلاة العيدين في المصلى هي السنة
৩৭) তাহকীক ফিকহিস সীরাহ (মুহাম্মদ গাযালী রচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী বিষয়ক গ্রন্থের তাহকীক(
تحقيق فقه السيرة لمحمد الغزالي
৩৮) কিতাবুল ইলম (ইমাম নাসাঈ রচিত কিতাবুল ইলম গ্রন্থের তাহকীক, তাখরীজ ও তাতে টিকা সংযোজন)
كتاب العلم تأليف الحافظ أبي خيثمة زهير بن حرب النسائي
৩৯) কালিমাতুল ইখলাস (হাফেয ইবনে রজব হাম্বলী (রহ:) রচিত কালিমাতুল ইখলাস কিতাবের তাহকীক ও তাখরীজ)
كلمة الإخلاص  وتحقيق معناها تأليف الحافظ ابن رجب الحنبلي
৪০) মুখতাসারুশ শামাইলিল মুহাম্মাদিয়্যাহ। (ইমাম তিরমিযী রচিত শামাইলে মুহাম্মাদিয়া বা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বভাব-চরিত্র ও দেহাবয়ব গঠন বিষয়ক কিতাবের তাহকীক ও সংক্ষিপ্ত করণ)
مختصر الشمائل المحمدية  للإمام أبي عيسى محمد بن سورة الترمذي صاحب السنن
৪১) মুসাজালাহ ইলমিয়্যাহ (দুজন মহামান্য ইমাম আল ইয ইবনু আব্দিস সালাম ও ইবনুস সালাহ এর মাঝে সংঘটিত মুনাযারা(
مساجلة علمية بين الإمامين الجليلين العز بن عبد السلام و ابن الصلاح
৪২) সালাতুর রাগাইব (রজব মাসের অন্যতম বিদআত সালাতুর রাগাইব প্রসঙ্গ(
حقيق حول صلاة الرغائب المبتدعة  محمد ناصر الدين الألباني ومحمد زهير الشاويش
৪৩) নাসবুল মাজানীক (গারানিকের ঘটনা প্রসঙ্গে বিভ্রান্তির জবাব)
نصب المجانيق لنسف قصة الغرانيق
৪৪) কিসসাতুল মাসীহিদ দাজ্জাল ও নুযুলি ঈসা আলাইহিস সালাম (দাজ্জাদ ও ঈসা আলাইহিস সালাম এর অবতরণ প্রসঙ্গ(
قصة المسيح الدجال ونزول عيسى عليه الصلاة و السلام وقتله إياه على سياق رواية أبي أمامة رضي الله عنه مضافا إليه ما صح عن غيره من الصحابة رضي الله عنهم
৪৫) ফিকহুল ওয়াকি (দাওয়াহর ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতির জ্ঞান থাকা প্রসঙ্গে একটি গবেষণা মূলক বই(
حول فقه الواقع
৪৬) সিফাতুল ফাতওয়া (ইমাম আহমাদ বিন হামদান রচিত ফতোয়া, মুফতী এবং ফতোয়া প্রার্থীর বিবরণ শীর্ষক কিতাবের তাহকীক)
تحقيق صفة الفتوى والمفتي والمستفتي  للإمام أحمد بن حمدان الحراني الحنبلي
৪৭) হুকুকুন নিসা (মুহাম্মদ রশীদ রেযা কর্তৃক রচিত ইসলামে নারী অধিকার শীর্ষক কিতাবের তাহকীক ও তাতে টিকা সংযোজন)
حقوق النساء في الإسلام وحظهن من الإصلاح المحمدي العام  تأليف : محمد رشيد رضا
৪৮) হুকমু তারিকিস সালাহ (সালাত পরিত্যাগ কারীর বিধান)।
 حكم تارك الصلاة
৪৯) সিফাতুস সালাহ (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সালাত -তাকবীর থেকে সালাম পর্যন্ত যেন আপনি তাঁকে দেখছেন)।
صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم
৫০) তারাজুতুশ শাইখ আল আলবানী (আল্লামা আলবানী (রহ:) যে সকল হাদীসের উপর সহীহ কিংবা যঈফ হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে মত পরিবর্তন করেছেন)
تراجعات الشيخ الألباني في بعض أحكامه الحديثية
এছাড়াও আল্লামা আলবানী (রহ:) এর লিখিত হাদীসের খেদমতে এবং ইসলামে বিভিন্ন বিষয় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় সেগুলো এখানে উল্লেখ করা হল না। এই লিংক থেকে শাইখের লিখিত অনেকগুলো কিতাবাদী পাওয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক বাদশাহ ফায়সাল পুরষ্কার:

ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা ও ইসলামী শিক্ষার প্রচারে অবদানের জন্য তাকে ১৪১৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৯৯ ইং সনে আন্তর্জাতিক বাদশাহ ফায়সাল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। তার পুরষ্কারের শিরোনাম ছিল: “প্রায় একশ’র অধিক পুস্তক রচনার মধ্য দিয়ে হাদীসের তাহকীক, তাখরীজ ও গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হাদীসের সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য সিরিয় নাগরিক সম্মানিত শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানীকে এ পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হল।”
তাঁর ব্যাপারে আলেমগণের ভূয়সী প্রশংসা:

১) শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ:) বলেন:
“বর্তমান বিশ্বে আসমানের নিচে আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানীর মত এত বড় হাদীসের আলেম আমি দেখি নি।”
শাইখ বিন বায (রহ:) এর নিকট এই হাদীসটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তায়ালা প্রতি একশ বছরের মাথায় এই উম্মতের জন্য এমন একজনকে পাঠাবেন যিনি দ্বীন-ইসলামকে সংস্কার করবেন।” তিনি বলেন: আমার ধারণা, শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী হলেন এ যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। আল্লাহ সব চেয়ে ভাল জানেন।
২) আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (রহ.) বলেন:
“শাইখের সাথে বৈঠকাদীতে বসার পর (যদিও তা কম) যা বুঝতে পেরেছি তা হল: তিনি সন্নাহর প্রতি আমল এবং আমল-আকীদা উভয় ক্ষেত্রেই বিদয়াত উৎখাতে খুবই আগ্রহী। আর তার লিখিত বই-পুস্তক পড়ে তার ব্যাপারে জানতে পারলাম যে, তিনি হাদীসের সনদ ও মতন উভয় ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী। এ সকল বই-পুস্তক দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেক মানুষকে উপকৃত করেছেন-যেভাবে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে তারা লাভবান হয়েছে তদ্রূপ নীতি নির্ধারণ এবং ইলমে হাদীসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তারা লাভবান হয়েছেন। এটি মুসলমানদের জন্য বড় একটি বড় প্রাপ্তি। আল হামদুলিল্লাহ। আর ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে তার জ্ঞানগর্ভ গবেষণা সত্যি চমৎকৃত হওয়ার মত।”
৩) খ্যাতনামা মুফাসসির আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ আল আমীন আশ শানকীতী:
শাইখ আব্দুল আজীজ আল হাদ্দাহ বলেন: আল্লামা শানকীতী শাইখ আলবানীকে বিষ্ময়করভাবে সম্মান করতেন। তিনি মদীনার মসজিদে হারামে দারস প্রদান করার সময় যদি শাইখ আলবানীকে হেঁটে যেতে দেখতে তিনি তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং সালাম প্রদান করতেন।
৪) শাইখ মুকবিল আল ওয়াদাঈ:
“আমি যে আকীদা পোষণ করি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে দ্বীন হিসেবে মনে করি তা হল, শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী হলেন সে সকল মুজাদ্দিদগণের অন্তর্ভুক্ত যাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীসটি প্রযোজ্য: “আল্লাহ তায়ালা প্রতি একশ বছরের মাথায় এই উম্মতের জন্য এমন একজনকে পাঠাবেন যিনি দ্বীন-ইসলামকে সংস্কার করবেন।“
আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. এর অন্তিম ওসিয়ত:

প্রথমত: আমি আমার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব ও যারা আমাকে ভালবাসে তাদের নিকট এই ওসিয়ত করছি, যখন তাদের কাছে আমার মৃত্যু সংবাদ পৌছবে তারা যেন আমার জন্য আল্লাহর নিকট রহমত ও মাগফিরাত কামনা করে দুয়া করে এবং আমার মৃত্যুতে কেউ যেন নিয়াহা বা উচ্চ আওয়াজে ক্রন্দন না করে।
দ্বিতীয়ত: যেন অনতি বিলম্বে আমাকে দাফন করা হয় এবং প্রয়োজনীয় কাফন-দাফনের প্রস্তুতির জন্য যাদেরকে না হলেই নয় তাদেরকে ছাড়া নিকটাত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবকে মৃত্যুর সংবাদ দিতে গিয়ে যেন দাফন কর্ম বিলম্ব না করে। আমাকে গোসল দেয়ার দায়িত্ব পালন করবে, ইজ্জত খাযার আবু আব্দুল্লাহ এবং তিনি যাকে এ কাজে সহযোগিতার জন্য পছন্দ করবেন। তিনি আমার প্রতিবেশী এবং একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু।
তৃতীয়: তিনি মৃত্যুর আগেই তার বাড়ির অদূরেই কবরের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দেন। যেন গাড়িতে উঠিয়ে তার লাশ বহন করে দূরে নিতে না হয় কিংবা কবর দিতে আসা লোকজনকে গাড়িতে চড়ে লাশের সাথে যেতে না হয়। সেই সাথে এমন পুরনো গোরস্থানে যেন তাকে কবর দেয়া হয় যেটার ব্যাপারে আশা করা যায় যে, সেটা আর খুঁড়া-খুঁড়ি করা হবে না।
আমি যদি দেশের বাইরে মারা যাই তবে আমার দাফন কর্ম সমাধান করার আগে যেন দেশে আমার সন্তান সন্তান-সন্ততি বা অন্য লোকজনকে খবর না দেয়া হয়। অন্যথায় তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে হয়ত এমন কিছু করবে যার কারণে আমার দাফন কর্ম বিলম্ব হয়ে যাবে।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, আমি যেন তার সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করি যে, তিনি মৃত্যুর আগেই আমার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।
আর আমার লাইব্রেরীর ব্যাপারে ওসিওয়ত হল, লাইব্রেরীর প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, পাণ্ডুলিপি, আমার লেখা বা অন্যের লেখা সকল বই-পুস্তক মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াকফ করছি। যেন কুরআন-সুন্নাহ ও সালফে-সালেহীনের মানহাজের দিকে দাওয়াতের পথে এগুলো স্মৃতি হিসেবে অবশিষ্ট থেকে যায়। কারণ, আমি এক কালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। আল্লাহর নিকট আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি যেভাবে আমার মাধ্যমে ছাত্রদের উপকার করেছেন ঠিক সেই ভাবে আমার লাইব্রেরীতে যে সকল মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য আসবে তারাও যেন এগুলো থেকে উপকৃত হয়। আর আমি নিজেও যেন তাদের দুয়ার মাধ্যমে লাভবান হই।
رب أوزعني أن أشكر نعمتك التي أنعمت علي و على والدي و أن أعمل صالحاً ترضاه و أصلح لي في ذريتي إني تبت إليك و إني من المسلمين
“হে প্রভু, তুমি আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে যে নেয়ামত দিয়েছ তার শুকরিয়া আদায়ের তাওফীক দান কর। আরও তাওফীক দান কর এমন নেক আমল করার যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আমার উপকারের জন্যে আমার সন্তান-সন্ততিকে পরিশুদ্ধ করে দাও। আমি তোমার নিকট তওবা করলাম। নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।”
২৭ জুমাদাল আওয়াল ১৪১০ হিজরী।
মৃত্যু:

আল্লামা আলবানী রহ. এর ওফাত হয়, শনিবার, ২২ জুমাদাল আখেরা, ১৪২০ হিজরী, মোতাবেক ২ অক্টোবর, ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ। ইশার সালাতের পরে তাকে দাফন দেয়া হয়। দুটি কারণে শাইখের দাফন তাড়াতাড়ি দেয়া হয়:
প্রথমত: তার ওসীয়ত বাস্তবায়ন।
দ্বিতীয়ত: শাইখের মৃত্যুর সময়কালটা ছিল খুব গরম। তাই যেন দাফন দিতে আসা লোকজনের কষ্ট না হয়ে যায় ।
যদিও শাইখের মৃত্যুর সংবাদ নিকটাত্মীয় ও কাফন-দাফনে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষ কিছু লোককে ছাড়া অন্য কাউকে দেয়া হয় নি এবং মৃত্যু বরণের পর দাফন করতে তেমন বিলম্বও করা হয় নি তথাপি তারা জানাজায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। কারণ, যে ব্যক্তিই তার মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছে সেই অন্য ভাইকে এই খবর পৌঁছিয়ে দিয়েছে।
আমরা দুয়া করি, ইলমে হাদীসের এই মহান খাদেমকে আল্লাহ তায়ালা যেন মুসলিম জাতির পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করেন। আমীন।
_________________________________________________________________________________
১) হাদীস বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত অবস্থা পর্যালোচনা মূলক জ্ঞানকে ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীল বলা হয়।
২) যে ইলমের মাধ্যমে গ্রহণীয় বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দিক দিয়ে বর্ণনাকারী ও বর্ণিত হাদীস বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয় তাকে ইলমে মুস্তালাহুল হাদীস বলা হয়।
_________________________________________________________________________________

উৎস: এই জীবনীর অধিকাংশ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে শাইখ আলবানী (রহ:) এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে। তার ওয়েব সাইটের ঠিকানা হল: http://www.alalbany.net
 ইংরেজীভাষায় অনুবাদকৃত শাইখের জীবনী এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই ও প্রবন্ধ পাওয়া যাবে এখানে
অনুবাদ ও গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব,
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।
২রা জুন, ২০১২ইং

Translate