Tuesday, April 2, 2024

ইতিকাফ এর গুরুত্ব ও উপকারিতা এবং ফজিলত

 ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ (গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত)। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি মৃত্যু বরণ করেন সে বছর একটানা ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন। [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ইতিকাফ, আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত]

❑ ইতিকাফের কতিপয় উপকারিতা:

ঈমানদারের জন্য ইতিকাফে অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো কয়েকটি উল্লেখ করা হল:
❖ ১. এর মাধ্যমে কিছু দিনের জন্য দুনিয়া থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেবল আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থেকে মহান আল্লাহ নৈকট্য হাসিলের বিশাল সুযোগ পাওয়া যায়।
❖ ২. এ সময় অধিক পরিমাণে নফল সালাত, জিকির-আজকার, দুআ, তাসবিহ, তাকবিরে উলা তথা ইমামের প্রথম তাকবিরে সাথে জামাআতে সালাত, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন তথা কবর আখিরাত, হাশর-নশর, আল্লাহর দরবারে হিসাব-নিকাশ, পুলসিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন মুখস্থ, ইসলামি জ্ঞানার্জন ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়।
❖ ৩. এ ছাড়াও ইতিকাফের ফলে দৃষ্টি হেফাজত, অশ্লীল, অনর্থক ও মিথ্যা কথা থেকে মুখ হেফাজত, গিবত-পরনিন্দা, চুগলখোরি ইত্যাদি অসংখ্য গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়।
❖ ৪. রমজান মাসে ইতিকাফ করার সবচেয়ে বড় ফায়দা হল, শেষ দশকের রাত জেগে ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহ তাওফিক দান করলে ‘লাইলাতুল কদর’ বা শবে কদর লাভ করা সম্ভব হয়-যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। নি:সন্দেহে এটি জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।
❖ ৫. ইতিকাফ-এর মাধ্যমে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আদায় করা হয়-যা বর্তমানে মুসলিম সমাজে প্রায় পরিত্যক্ত।

❑ ইতিকাফের ফজিলতে বর্ণিত হাদিসগুলো সহিহ নয়:

ইতিকাফের ফজিলতে কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনটি জঈফ আর কোনটি জাল। হাদিসগুলোর আরবি টেক্সট (সেগুলোর সনদ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য সহকারে) নিম্নে প্রদান করা হল:

1- روى ابن ماجه (1781) عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فِي الْمُعْتَكِفِ : ( هُوَ يَعْكِفُ الذُّنُوبَ ، وَيُجْرَى لَهُ مِنْ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَاتِ كُلِّهَا ) . ضعفه الألباني في ضعيف ابن ماجه .
( يَعْكِفُ الذُّنُوب ) أي : يَمْنَع الذُّنُوب. قاله السندي .
2- روى الطبراني والحاكم والبيهقي وضعفه عن ابن عباس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ( من اعتكف يوما ابتغاء وجه الله جعل الله بينه وبين النار ثلاث خنادق أبعد مما بين الخافقين ) . ضعفه الألباني في السلسلة الضعيفة (5345). والخافقان المشرق والمغرب .
3- روى الديلمي عن عائشة أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ( من اعتكف إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ) ضعفه الألباني في ضعيف الجامع (5442) .
4- روى البيهقي وضعفه عن الحسين بن علي رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ( من اعتكف عشرا في رمضان كان كحجتين وعمرتين ) . ذكره الألباني في “السلسلة الضعيفة” “. (518) وقال : موضوع .
▬▬▬▬◆◈◆ ▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

সহজ উমরা নির্দেশিকা

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

উমরা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা আত্মিক, মৌখিক, দৈহিক ও আর্থিক ত্যাগ সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর উহা পালন করা অবশ্যকর্তব্য।

◈ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العُمرةُ إلى العُمرةِ كفَّارةُ ما بَيْنَهما
“এক উমরা থেকে অপর উমরা উভয়ের মধ্যবর্তী পাপের কাফফারা স্বরূপ।” [বুখারি ও মুসলিম]

◈ তিনি আরও বলেন,
من أَتَى هذا البيتَ فلم يَرفُثْ ، ولم يَفسُقْ رَجَع كما ولَدَتْه أمُّه
“যে ব্যক্তি (হজ-উমরা করার জন্য) এ ঘরে আসবে। অতপর স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হবে না এবং পাপাচারে লিপ্ত হবে না, সে এমন (নিষ্পাপ) অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে যেমন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল। (অর্থাৎ সে নবজাতক শিশুর মত পবিত্র ও নিষ্পাপ হয়ে যাবে)” [মুসলিম] অবশ্য মানুষের হক নষ্ট করে থাকলে তা আদায় করা পর্যন্ত তওবা দ্বারা তার গুনাহ মোনচ করা হবে না।

এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি বিশুদ্ধভাবে আদায়ের চেষ্টা করা একান্ত ভাবে অপরিহার্য।

❑ এ লক্ষ্যে নিন্ম লিখিত সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলো সকলের জন্য অনুসরণীয়:

১. একনিষ্ঠতার সাথে শুধুমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য উমরা পালন করা।
২. উমরা পালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরিকা (পদ্ধতি) অনুসরণ করা।
৩. হালাল (বৈধ) উপার্জন থেকে উমরা পালন করা।
৪. উমরার বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা।
৫. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সঠিকভাবে আদায় করা। কেননা সালাত আদায় না করলে ওমরা করে কোন লাভ নেই।
৬. যাবতীয় শিরক, বিদআত ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা।

❑ উমরার কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে নিন্মরূপ:

১. ইহরামের পূর্বে শারীরিকভাবে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা তথা- নাভিমূল, বগলের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা।
২. মিকাত থেকে ইহ্‌রাম বাঁধা। (ওয়াজিব)
৩. মিকাতে গিয়ে ইহরামের উদ্দেশ্যে প্রথমে গোসল করা।
৪. সম্ভব হলে মাথা, দাড়ি বা শরীরে আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫. সেলাই বিহীন দুটি কাপড়ে ইহ্‌রাম বাঁধা। (শুধু পুরুষদের জন্য) নারীরা যে কোন কাপড়ে ইহরাম করতে পারে। তাদের জন্য সাদা কাপড় বা বোরখা পরিধান করা আবশ্যক নয়।)
৬. কাপড় দুটি সাদা হওয়া উত্তম। একটি লুঙ্গি অপরটি চাদর হিসেবে।
৭. উমরার উদ্দেশ্যে (অন্তরে) নিয়ত করে ইহ্‌রাম বাঁধা। (রোকন)
৮. ইহরাম বাঁধার সময় বলবে: আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা উমরাতান।
৯. রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পঠিত তালবিয়া জোরে জোরে পাঠ করা।

◆ তালবিয়া:

(لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيْكَ لَكَ) ‘
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা, ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌ না’মাতা লাকা ওয়াল্‌ মুল্‌ক্‌, লা-শারীকা লাক।
১০. মক্কা পর্যন্ত সারা রাস্তা এই তালবিয়া বেশী করে পাঠ করবে এবং অন্যান্য তাসবি-তাহলিলেও লিপ্ত থাকবে।
১১. মক্কায় গিয়ে অজু করে (সম্ভব হলে গোসল করে) পবিত্রতার সাথে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা। (তওয়াফের জন্য পবিত্রতা আবশ্যক)
১২. মসজিদে হারামে প্রবেশের পূর্বে তালবিয়া বলা বন্ধ করা।
১৩. তওয়াফের জন্য সরাসরি হজরে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
১৪. তওয়াফ শুরুর পূর্বে ইযতিবা করা। (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রাখা) নামাযের সময় উভয় কাঁধ ঢেকে রাখা জরুরি।
১৫. ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আক্‌বার’ বলে হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করে বা ইশারা করে তওয়াফ শুরু করা।
১৬. প্রথম তিন চক্করে রমল করা। (ছোট ছোট কদমে দ্রুত চলা)
১৭. তওয়াফ অবস্থায় কোন দুআ নির্দিষ্ট না করে যে কোন দুআ ও জিকির পাঠ করা।
১৮. আল্লাহর ঘর বাম দিকে রেখে তওয়াফ করা।
১৯. হাতিমের বাহির দিয়ে তওয়াফ করা।
২০. রোকনে ইয়ামানি স্পর্শ করা। তা না পারলে ইঙ্গিত না করেই চলতে থাকা।
২১. রোকনে ইয়ামানি এবং হজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে এই দুআ পড়া:
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও ওয়া ক্কিনা আযাবান্নার।”
হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন। এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন। [সূরা বাকারা: ২০১]
২২. একাধারে সাত চক্কর পূর্ণ করা। (রোকন)
২৩. মাকামে ইবরাহিমের পিছনে দু রাকাআত নামাজ পড়া। (সেখানে সম্ভব না হলে মসজিদুল হারামের যে কোন স্থানে তা আদায় করা।)
২৪. সূরা ফাতিহার পর প্রথম রাকাআতে সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা ইখলাস পড়া।
২৫. জমজম-এর পানি পান করা এবং তা মাথায় ঢালা।
২৬. আবার হজরে আসওয়াদে চুম্বন দেওয়া বা ইঙ্গিত করা।
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
“ইন্নাস সাফা ওয়াল মার্‌ওয়াতা মিন শাআয়িরিল্লাহি” বলতে বলতে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করা।
২৭. কিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে তাওহিদ, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আল হামদুলিল্লাহ) ইত্যাদি পাঠ করা।
অতঃপর তিনবার বলবে:
لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ . لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ أنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وهَزَمَ الأحْزاَبَ وَحْدَهُ
এরপর জানা যে কোন দুআ পাঠ করবে।
২৮. সবুজ বাতি দ্বয়ের মধ্যবর্তী অংশে দৌড়ানো। (মহিলারা দৌড়াবে না।)
২৯. সাফা-মারওয়া সাঈ করার সময় কোন দুআ নির্দিষ্ট না করে, জানা যে কোন দুআ পড়া।
৩০. মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করা।
৩১. সেখানেও সাফা পাহাড়ের ন্যায় দুআ করা।
৩২. সাত বার সাফা-মারওয়া সাঈ করা। (রোকন)
৩৩. সাফা থেকে মারওয়া গমন ১ম চক্কর, মারওয়া থেকে সাফা প্রত্যাবর্তন ২য় চক্কর। এভাবে ৭ম চক্কর মারওয়ায় এসে শেষ করা।
৩৪. মাথার চুল মুড়িয়ে বা খাটো করে হালাল হয়ে যাওয়া। (ওয়াজিব)

❑ কতিপয় ভুলত্রুটি:

১. অনেকে ইহরাম বাঁধার সময় থেকেই ইযতেবা তথা (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রেখে দেয়। এমনকি সালাতের সময়ও সেভাবেই থাকে। এরূপ করা সুন্নতের পরিপন্থী। ইযতেবা শুধু তওয়াফের মূহুর্তে করা সুন্নত, অন্য সময় নয়।অনেকে ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্যে রাকাআত সালাত আদায় করে থাকে। মূলত: ইহরামের জন্য কোন সালাত নেই। তবে কোন ফরজ সালাতের সময় হয়ে গেলে, উক্ত সালাত আদায় করার পর ইহরাম বাঁধবে।
২. কাবা ঘরের তওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন দুআ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এসময় অনির্দিষ্টভাবে যে কোন দুয়া বা প্রার্থনা যে কোন ভাষায় করা যাবে। সুতরাং বিভিন্ন ধরনের কিতাবে যে সকল দুয়া লিখিত আছে- ১ম চক্করের দুআ……. ২য় চক্করের দুয়া………. তা নি:সন্দেহে ভুল। কেননা এভাবে নির্দিষ্ট চক্করের জন্য নির্দিষ্ট দুআ না রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়েছেন না তিনি পড়তে বলেছেন, না কোন সাহাবি রা. এরূপ করেছেন।
৩. হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা জরুরি মনে করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়। কেননা একে চুম্বন করা সুন্নত, কিন্তু মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম।
৪. তওয়াফ-সাঈর সময় সশব্দে দুআ পড়া সুন্নতের খেলাফ ও অন্যায় কাজ।
৫. অনেকেই সাফা-মারওয়া সাঈ শেষে মাথার বিভিন্ন দিক থেকে অল্প অল্প করে চুল কাটে। এটা কখনই বৈধ নয়। কেননা সম্পূর্ণ মাথা থেকেই চুল কাটতে হবে। যেমনটি সম্পূর্ণ মাথার চুলই মুণ্ডন করতে হয়।
৬. তানঈম বা মসজিদে আয়েশা বা উমরা মসজিদ থেকে ঘন ঘন ইহরাম বেঁধে এসে নিজের জন্য বা আত্মীয়-স্বজনের নামে উমরা পালন করা বিধি সম্মত নয়। কেননা, একই সফরে এরূপ একাধিক উমরা করা রাসুলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা. ও তাবেঈদের কারো থেকে সাব্যস্ত নেই। [বিস্তারিত দেখুন আল মুগনী ৫/১৭]

❑ মসজিদে নববি জিয়ারত:

মসজিদে নববি মুস্তাহাব। সুন্নতে মুআক্কাদা নয় বা ওয়াজিব ফরজও নয়। আর উহা জিয়ারত করা হজ-উমরার সামান্যতম অংশ বিশেষও নয়। সুতরাং শুধুমাত্র মদিনার মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর জায়েজ (বৈধ)। অন্য কোন উদ্দেশ্যে (যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর মাজার জিয়ারত বা সাহাবির রা. কবর জিয়ারত ইত্যাদি) সফর করা জায়েজ নয়। তবে মসজিদে নববী পৌঁছার পর উক্ত স্থান সমূহ জিয়ারত করতে কোন বাধা নেই। [বুখারি ও মুসলিম]

❑ উমরা এর রোকন ৩টি:

১) ইহরাম বাঁধা।
২) তওয়াফ করা।
৩) সাঈ করা।

❑ উমরার ওয়াজিব ২টি :

১) মিকাত হতে ইহরাম বাঁধা।
২) চুল কামানো বা ছোট করা।

❑ ইহরাম অবস্থায় যা করা নিষিদ্ধ:

১. সেলাইকৃত কাপড় পরা।
২. মুখ ঢাকা।
৩. পুরুষদের মাথা ঢাকা।
৪. হাতমোজা পরিধান করা।
৫. নখ, চুল ইত্যাদি কাটা।
৬. স্থলচর প্রাণী শিকার করা বা তা শিকার করার জন্য ইঙ্গিত করা।
৭. স্ত্রী সহবাস করা।
৮. হারাম এলাকার মধ্যে কোন জিনিস কুড়ানো (মালিকের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার উদ্দশ্য হলে কোনও সমস্যা নেই)
৯. বিয়ে করা বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া।
১০. সুগন্ধি ব্যবহার করা।

❑ উমরা ফরজ হওয়ার শর্তাবলী:

১. ইসলাম [সুরা তাওবাহ: ৫৪]
২. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া
৩. স্বাধীন হওয়া। [আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী]
৪. বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়া। [আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী]
৫. আর্থিক ও শারীরিক ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়া। [আল ইমরান: ৯৭]
৬. মহিলার জন্য স্বামী অথবা মাহরাম থাকা। [বুখারি ও মুসলিম]

❑ বিশেষ দ্রষ্টব্য:

ক. উমরার কোন একটি রোকন ছুটে গেলে উমরা বাতিল হয়ে যাবে।
খ. আর কোন একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে কাফফারা দিতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন এবং সহীহ্‌ হাদিস অনুযায়ী উমরা পালন করে সৌভাগ্যশালীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

সংকলন: মুহা. আবদুল্লাহ্‌ আল কাফী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।

রমজানের শেষ দশক এবং হাজার মাসের চেয়েও সেরা একটি রাত

 সুপ্রিয় ভাই ও বোন, দেখতে দেখতে মাহে রমজান আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমরা এসে পৌঁছেছি শেষ দশকে। সৌভাগ্যবান লোকেরা এ মাসে আঁচল ভরে পাথেয় সংগ্রহ করছে আর হতভাগারা এখনো অন্ধকারের অলি-গলিতে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কল্যাণের বারি বর্ষণ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বন্ধ হয়ে যায়নি তওবার দরজা বরং আরও বেশি সুযোগ নিয়ে মাহে রমজানের শেষ দশক আমাদের মাঝে সমাগত। আজকের এই পোস্টে দেখব, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য এতে কী উপহার সাজিয়ে রেখেছেন এবং আমরা কীভাবে তা সংগ্রহ করতে পারব।

প্রিয় পাঠক, আসুন, আমরা আল্লাহর দেওয়া উপহারগুলো দুহাত ভরে কুড়িয়ে রমজানকে আরও অর্থবহ করে তুলি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

❑ রমজানের শেষ দশকে ইবদের ক্ষেত্রে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কঠোর পরিশ্রম:

◆ ১. রমজানের শেষ দশকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী-পরিবার সহ সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন:

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ

“রমজানের শেষ দশক প্রবেশ করলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন, নিজে সারা রাত জাগতেন এবং পরিবারকেও জাগাতেন।”[1]

কোমর বাধার অর্থ হল: পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত হওয়া। কোন কোন আলেম এর ব্যাখ্যায় বলেন, স্ত্রী সহবাস থেকে দূরে থাকা।

◆ ২. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে যত বেশি পরিশ্রম করতেন অন্য কখনো করতেন না:

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِى غَيْرِهِ

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগিতে) যে পরিমাণ পরিশ্রম করতেন অন্য কখনো করতেন না।” [2]

❑ শবে কদর:

◆ ১. শবে কদরে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে: আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ

“আমি একে (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি শবে কদরে।” [সূরা কদর: ১]

◆২. শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ

“শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” [সূরা কদর: ৩]

◆৩. আল্লাহ তাআলা শবে কদরকে বরকতময় রাত বলে উল্লেখ করেছেন:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ

“নিশ্চয় আমি ইহা (কুরআন)কে অবতীর্ণ করেছি একটি বরকতময় রাতে।” [সূরা দুখান: ৩] (আর এ রাত হল শবে কদর।)

◆. শবে কদরে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করলে পূর্বের সকল ছোট গুনাহ মোচন হয়ে যায়:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সোয়াবের আশায় শবে কদরে রাত জাগরণ করে নফল নামাজ ও ইবাদত বন্দেগি করবে তার পূর্বের সকল (ছোট) গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে।” [3]

❑ শবে কদর কখন হবে?

শবে কদর হবে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে:

◈ ক. আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

« تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ »

“তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান কর।” [4]

◈ খ. আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

« أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أَيْقَظَنِى بَعْضُ أَهْلِى فَنُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الْغَوَابِرِ

স্বপ্নে আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব তোমরা তা রমজানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর।” [5]
কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, দু ব্যক্তির বিবাদের কারণে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ভুলে গেছেন।

❑ শবে কদর কি শুধু রমজানের সাতাইশ রাতের জন্য নির্দিষ্ট?

আমাদের দেশে সাধারণত: মানুষ শুধু রমজানের সাতাইশ তারিখে রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করে এবং ধারণা করে এ রাতেই শবে কদর অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ ধারণা, সুন্নতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ আয়েশা রা. হতে বর্ণিত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

« تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ

“তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।” [6]

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أَيْقَظَنِى بَعْضُ أَهْلِى فَنُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الْغَوَابِرِ»

স্বপ্নে আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব, তোমরা তা রমজানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর।” [7]

❑ শেষ সাত দিনের বেজোড় রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি:
যেমন: নিম্নোক্ত হাদিসটি-

ابْنِ عُمَرَ – رضى الله عنهما – أَنَّ رِجَالاً مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ – صلى الله عليه وسلم – أُرُوا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْمَنَامِ فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – « أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيَهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ »

ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত যে, কয়েকজন সাহাবি রমজানের শেষ সাত রাত্রিতে স্বপ্ন মারফত শবে কদর হতে দেখেছেন। সাহাবিদের এ স্বপ্নের কথা জানতে পেরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি দেখছি তোমাদের স্বপ্নগুলো মিলে যাচ্ছে শেষ সাত রাত্রিতে। অত:এব কেউ চাইলে শেষ সাত রাত্রিতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে পারে।” [সহীহ বুখারী ও মুসলিম]। এ মর্মে আরও হাদিস রয়েছে।
কোন কোন সালাফে-সালেহীন সাতাইশ রাত শবে কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করেছেন। সাহাবিগণের মধ্যে ইবনে আব্বাস রা., মুয়াবিয়া, উবাই ইবনে কা’ব রা. এর মতামত থেকে এটাই বুঝা যায়।

কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এভাবে নির্দিষ্ট করে লাইলাতুল কদর হওয়ার কোন হাদিস নাই। তাই উপরোক্ত সাহাবিদের কথার উপর ভিত্তি করে বড় জোর সাতাইশে রাতে শবে কদর হওয়াকে অধিক সম্ভাবনাময় বলা যেতে পারে। নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। সঠিক কথা হল, শবে কদর কখনো ২১, কখনো ২৩, কখনো ২৫, কখনো ২৭ আবার কখনো ২৯ রাতে হতে পারে।

সুতরাং শুধু সাতাইশ তারিখ নয় বরং কোন ব্যক্তি যদি রমজানের শেষ দশকের উপরোক্ত পাঁচটি রাত জাগ্রত হয়ে ইবাদত-বন্দেগি করে তবে নিশ্চিতভাবে শবে কদর পাবে। কিন্তু শুধু সাতাইশ রাত জাগলে শবে কদর পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। বরং অন্যান্য রাত বাদ দিয়ে শুধু সাতাইশ রাত উদযাপন করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে আমাদের দেশে যেভাবে শুধু সাতাইশ তারিখ নির্দিষ্ট করে নেয়া হয়েছে সেটা বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই বিদআত বর্জন করে সুন্নতি পন্থায় আমল করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।

❑ শবে কদরের বিশেষ দুআ:

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসুল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দুআটি পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি বল:

اللَّهمَّ إنَّك عفُوٌّ تُحِبُّ العفْوَ، فاعْفُ عنِّي

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।

“হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। অত:এব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।” [তিরমিযী, অনুচ্ছেদ, কোন দুআটি শ্রেষ্ঠ। তিনি বলেন, হাদিসটি হাসান-সহীহ। শাইখ আলবানী রহ. এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। দ্র: সহীহুত তিরমিযী, হা/৩৫১৩]

❑ ইতিকাফ:

▪ ক) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত:

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মৃত্যু দেয়া পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।”[সহীহ বুখারী]

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর সফরে যাওয়ায় ইতিকাফ করতে পারেন নি। তাই যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন। [8]

▪ খ) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:

আমাদের দেশে মনে করা হয় যে সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, ইতিকাফ হল একটি সুন্নত ইবাদত। যে কোন মুসলমান তা পালন করতে পারে। যে ব্যক্তি তা পালন করবে সে অগণিত সোওয়াবের অধিকারী হবে। সবার পক্ষ থেকে একজনকে ইতিকাফে বসতেই হবে এমন কোন কথা শরীয়তে নেই।

আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষেত্রে তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নতকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন এবং সকল বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

রেফারেন্স:

[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: শবে কদরের ফজিলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।
[2] সহীহ মুসলিম: রমজানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগিতে) বেশি বেশি পরিশ্রম করা।
[3] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সোয়াবের আশায় রোজা রাখে।
[4] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান করা।
[5] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কদরের ফজিলত।
[6] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কদরের ফজিলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোজা।
[7] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কদরের ফজিলত।
[8] মুসনাদ আহমাদ, সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: রোজা, তিরমিযী, অধ্যায়: রোজা অনুচ্ছেদ। আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।

সেজদার ক্ষেত্রে মহিলাদের পেছনের অংশ মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদিসটি জইফ বা দুর্বল

 প্রশ্ন: নিচের হাদিসটি মান অথবা গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? ইমাম আবু দাউদ রাহ. তাঁর কিতাবুস সুনানের কিতাবুল মারাসীলে বিখ্যাত ইমাম ইয়াযিদ ইবনে আবি হাবিব রাহ.-এর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেন যে,

أن النبى مر على امرأتين تصليان فقال : اذا سجدتما فضما بعض اللحم الى الأرض، فان المرأة ليست فى ذلك كالرجل.

“আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইজন মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারা নামাজ পড়ছিল। তিনি তাদের বললেন, “যখন তোমরা সিজদা করবে তোমাদের শরীরের কিছু অংশ, (অর্থাৎ পিছনের অংশ) মাটির সাথে মিলিয়ে রাখবে। কারণ নারী এই ক্ষেত্রে পুরুষের মত নয়।”

[সূত্র: মারাসিলে আবু দাউদ, হাদিস ৮৭; সুনানে কুবরা, বায়হাকি, হাদিস ৩২০১; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার, বায়হাকি, হাদিস ৪০৫৪]

উত্তর: প্রায় সকল মুহাদ্দিস একমত যে, এ হাদিসটি জইফ বা দুর্বল।

নিচে এ বিষয়ে কয়েকজন মুহাদ্দিসের অভিমত দেওয়া হল:

১. বাইহাকি বলেন, মুনকাতি (বিচ্ছিন্ন সনদ) [এটি দুর্বল হাদিসের অন্তর্ভুক্ত]। [সুনানে কুবরা ২/২২৩]

الراوي:يزيد بن أبي حبيب المحدث:البيهقي المصدر:السنن الكبرى للبيهقي الجزء أو الصفحة:2/223 حكم المحدث:منقطع، وهو أحسن من الموصولين قبله

২) ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, মুরসাল [এটিও দুর্বল হাদিসের অন্তর্ভুক্ত]। তবে অন্য অবিচ্ছিন্ন আরও দুনটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর উভয়টির মধ্যেই متروك ّপরিত্যক্ত বর্ণনাকারী” রয়েছে। [আত তালখিসুল হাবির, ১/৩৯৪]

الراوي:يزيد بن أبي حبيب المحدث:ابن حجر العسقلاني المصدر:التلخيص الحبير الجزء أو الصفحة:1/394 حكم المحدث:مرسل ومن طريقين موصولين، لكن في كل منهما متروك
‘‘
৩) যাহাবী বলেন, মুরসাল হাদিস সমূহের মধ্যে এটি সর্বাধিক দুর্বল।

الراوي:يزيد بن أبي حبيب المحدث:الذهبي المصدر:المهذب الجزء أو الصفحة:2/662 حكم المحدث:من أضعف المراسيل

তিনি আরও বলেছেন, এর সনদে ইসহাক বিন ওয়াসেল নামক একজন বর্ণনাকারী আছে, সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত (অর্থাৎ সে চরম ভাবে
প্রত্যাখ্যান যোগ্য)। [মিযানুল ইতিদাল ১/২০২]

الراوي:- المحدث:الذهبي المصدر:ميزان الاعتدال الجزء أو الصفحة:1/202 حكم المحدث:[فيه] إسحاق بن واصل من الهلكى

৪) ইবনে আসাকির বলেন, এর সনদে একজন বর্ণনাকারী আছে যার নাম: সাঈদ বিন আব্দুল্লাহ বিন দিনার। আবু হাতিম তাকে মাজহুল বা অজ্ঞাত পরিচয় বলে উল্লেখ করেছেন। [তারিখে দিমাশক, ২১/১৭১]

الراوي:الحسن البصري المحدث:ابن عساكر المصدر:تاريخ دمشق الجزء أو الصفحة:21/171 حكم المحدث:مرسل [وفيه] سعيد بن عبد الله بن دينار قال أبو حاتم مجهول

৫) ইবনে আদি বলেন, غير محفوظ “হাদিসটি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি।” [আল কামিল ফিয যুয়াফা, ৬/৪৫১]

الراوي:أبو سعيد الخدري المحدث:ابن عدي المصدر:الكامل في الضعفاء الجزء أو الصفحة:6/451 حكم المحدث:غير محفوظ

৬) ইবনুল কায়সারানী বলেন, এর সনদে ঈসা বিন সুলাইমান নামক যে বর্ণনাকারী আছে সে দুর্বল। [যাখীরাতুল হুফফায, ৪/২০৯১]

الراوي:أبو سعيد الخدري المحدث:ابن القيسراني المصدر:ذخيرة الحفاظ الجزء أو الصفحة:4/2091 حكم المحدث:[فيه] عيسى بن سليمان ضعيف

৭) আলবানি বলেন, জইফ বা দুর্বল। [যঈফুল জামে, ৫৪৪]
إذا سَجَدْتُما فضُمَّا بعضَ اللحمِ إلى الأرضِ ، فإنَّ المرأةَ لَيْسَتْ في ذلك كالرجلِ
الراوي:يزيد بن أبي حبيب المحدث:الألباني المصدر:ضعيف الجامع الجزء أو الصفحة:544 حكم المحدث:ضعيف

সুতরাং আমাদের দেশে মহিলারা যেভাবে সেজদার সময় তার পেছনের অংশ মাটিতে মিশিয়ে দেয় তা সঠিক নয়। কেননা এ বিষয়ে কোনও সহিহ হাদিস সাব্যস্ত হয়নি। সুতরাং যথারীতি তারাও পুরুষদের অনুরূপ সেজদা প্রদান করবেন। আল্লাহু আলাম। ▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

মুসলমান শব্দ ব্যবহারে কোনও আপত্তি আছে কি নাকি মুসলিম শব্দ ব্যবহার করা জরুরি

 প্রশ্ন: আমরা নিজেদের ‘মুসলিম’ বা ‘মুসলমান’ বলে থাকি। কিন্তু ‘মুসলমান’ শব্দটির ব্যাবহার কুরআন ও হাদিস কতটুকু সমর্থন করে? একজন আলিম থেকে শুনলাম যে, ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে; ‘মুসলমান’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। এটি কতটুকু সঠিক?

উত্তর: মূলত: ‘মুসলিম’ আরবি আর ‘মুসলমান’ ফারসি শব্দ। দুটির অর্থ একই। আত্মসমর্পণ কারী বা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। ফারসি ভাষায় এভাবে শব্দের শেষে ‘আন’ (আলিফ+নূন) যুক্ত প্রচুর শব্দ রয়েছে। যেমন: মেহমান, মেজবান, মেহেরবান ইত্যাদি। পাক-ভারত উপমহাদেশ এক সময় ফারসি ভাষী মুসলিমগণ বহু বছর শাসন করার ফলে অত্র অঞ্চলে প্রচুর ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। একই কারণে বাংলা ভাষায় এ জাতীয় বহু আরবি, ফারসি, উর্দু ইত্যাদি শব্দের আত্তীকরণ ঘটেছে।

ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতকের শেষদিকে সম্রাট আকবরের সময়ে বঙ্গদেশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলে ফারসি শব্দ বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। যেমনটি পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনের কারণে বহু ইংরেজি শব্দ এ সব অঞ্চলের মানুষের ভাষার মধ্যে স্থান দখল করে নিয়েছে।

এভাবে বিভিন্ন ভাষার সমন্বয়ে আমাদের নিজস্ব ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বৃদ্ধি পেয়েছে, হয়েছে উন্নত, সমৃদ্ধ ও গতিশীল।

সুতরাং কোন বিদেশী শব্দ যখন অন্য ভাষায় একাকার হয়ে প্রাত্যহিক জীবনে সাধারণ মানুষের ভাষায় রূপান্তরিত হয় এবং অভিধান ও ভাষা সাহিত্যে তার স্থান দখল করে নেয় তখন তাকে সে দেশের ভাষার অংশ হিসেবে গণ্য করতে হয়। আলাদাভাবে ভাবার কোনও সুযোগ থাকে না বরং তা পরিবর্তন করাকেই ভাষা বিকৃতির শামিল বলে গণ্য হয়।

সুতরাং বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ফারসি ইত্যাদি ভাষায় যখন ‘মুসলমান’ শব্দটি আরবি ‘মুসলিম’ শব্দকেই নির্দেশ করে এবং একই অর্থ বহন করে তখন তা ব্যবহারে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনও আপত্তি থাকে না-যদি না তার মধ্যে শরিয়ার সাথে সাংঘষির্ক কোন কিছু থাকে। এমন অনেক ফারসি ইসলামি শব্দ আমাদের মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে। যেমন: নামাজ, রোজা, বেহেশত, ফেরেশতা, পয়গম্বর, জায়নামায, মুর্দা,নেকি, গোনাহ, নেককার, বদকার, পরহেজগার ইত্যাদি। এগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

অনুরূপভাবে দুনিয়াবি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষায় অসংখ্যা ফাসরি শব্দের প্রচল আছে। যেমন: কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, দরবার, দস্তখত, বাদশাহ, বান্দা, আওয়াজ, আন্দাজ, পর্দা, বাগান, রাস্তা বেহায়া, বেশরম, বেহাল, বেগম ইত্যাদি।

সুতরাং “মুসলমান’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না এ বক্তব্য সঠিক নয়।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate