Wednesday, December 1, 2021

পুরুষের নারীর বেশ ধারণ এবং নারীর পুরুষের বেশ ধারণ প্রসঙ্গে।

 بَاب الْمُتَشَبِّهُونَ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتُ بِالرِّجَالِ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا غُنْدَرٌ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ‏.‏ تَابَعَهُ عَمْرٌو أَخْبَرَنَا شُعْبَةُ‏.‏

৫৮৮৫. ইবনু ‘আববাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সব পুরুষকে লা’নত করেছেন যারা নারীর বেশ ধরে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধরে। আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৩)

‘আমরও এরকমই বর্ণনা করেছেন। আমাদের কাছে শু‘য়বা এ সংবাদ দিয়েছেন।

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক (كتاب اللباس)
হাদিস নম্বরঃ ৫৮৮৬

নারীর বেশধারী পুরুষদের ঘর থেকে বের করে দেয়া প্রসঙ্গে।

بَاب إِخْرَاجِ الْمُتَشَبِّهِينَ بِالنِّسَاءِ مِنْ الْبُيُوتِ حَدَّثَنَا مُعَاذُ بْنُ فَضَالَةَ، حَدَّثَنَا هِشَامٌ، عَنْ يَحْيَى، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَعَنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمُخَنَّثِينَ مِنَ الرِّجَالِ، وَالْمُتَرَجِّلاَتِ مِنَ النِّسَاءِ وَقَالَ ‏ “‏ أَخْرِجُوهُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ ‏”‏‏.‏ قَالَ فَأَخْرَجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فُلاَنًا، وَأَخْرَجَ عُمَرُ فُلاَنًا‏.‏
৫৮৮৬. ইবনু ‘আববাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ হিজড়াদের উপর এবং পুরুষের বেশধারী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ওদেরকে ঘর থেকে বের করে দাও। ইবনু ‘আববাস বলেছেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে বের করেছেন এবং ‘উমার অমুককে বের করে দিয়েছেন। আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৪)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক (كتاب اللباس)
হাদিস নম্বরঃ ৫৮৮৭

নারীর বেশধারী পুরুষদের ঘর থেকে বের করে দেয়া প্রসঙ্গে।
بَاب إِخْرَاجِ الْمُتَشَبِّهِينَ بِالنِّسَاءِ مِنْ الْبُيُوتِ حَدَّثَنَا مَالِكُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ، حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ عُرْوَةَ، أَنَّ عُرْوَةَ، أَخْبَرَهُ أَنَّ زَيْنَبَ ابْنَةَ أَبِي سَلَمَةَ أَخْبَرَتْهُ أَنَّ أُمَّ سَلَمَةَ أَخْبَرَتْهَا أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ عِنْدَهَا وَفِي الْبَيْتِ مُخَنَّثٌ، فَقَالَ لِعَبْدِ اللَّهِ أَخِي أُمِّ سَلَمَةَ يَا عَبْدَ اللَّهِ إِنْ فُتِحَ لَكُمْ غَدًا الطَّائِفُ، فَإِنِّي أَدُلُّكَ عَلَى بِنْتِ غَيْلاَنَ، فَإِنَّهَا تُقْبِلُ بِأَرْبَعٍ وَتُدْبِرُ بِثَمَانٍ‏.‏ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لاَ يَدْخُلَنَّ هَؤُلاَءِ عَلَيْكُنَّ ‏”‏‏.‏ قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ تُقْبِلُ بِأَرْبَعٍ وَتُدْبِرُ بِثَمَانٍ يَعْنِي أَرْبَعَ عُكَنِ بَطْنِهَا، فَهْىَ تُقْبِلُ بِهِنَّ، وَقَوْلُهُ وَتُدْبِرُ بِثَمَانٍ‏.‏ يَعْنِي أَطْرَافَ هَذِهِ الْعُكَنِ الأَرْبَعِ، لأَنَّهَا مُحِيطَةٌ بِالْجَنْبَيْنِ حَتَّى لَحِقَتْ وَإِنَّمَا قَالَ بِثَمَانٍ‏.‏ وَلَمْ يَقُلْ بِثَمَانِيَةٍ‏.‏ وَوَاحِدُ الأَطْرَافِ وَهْوَ ذَكَرٌ، لأَنَّهُ لَمْ يَقُلْ ثَمَانِيَةَ أَطْرَافٍ‏.‏
৫৮৮৭. উম্মু সালামাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা তাঁর ঘরে ছিলেন। তখন ঐ ঘরে এক হিজড়া ছিল। সে উম্মু সালামাহর ভাই ‘আবদুল্লাহ্কে বললঃ হে ‘আবদুল্লাহ! আগামীকাল তায়েফের উপর যদি তোমরা জয়ী হও, তবে আমি তোমাকে বিন্ত গাইলানকে দেখাব। সে সামনের দিকে আসলে, তার পেটে) চার ভাঁজ দেখা যায়। আর যখন সে পিছনের দিকে যায়, তখন তার পিঠে) আট ভাঁজ দেখা যায়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ওরা যেন তোমাদের কাছে কক্ষনো না আসে। [৪৩২৪] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৫)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক (كتاب اللباس)
হাদিস নম্বরঃ ৫৯৫০

ক্বিয়ামাতের দিন ছবি নির্মাতাদের শাস্তি প্রসঙ্গে।

৫৯৫০. মুসলিম (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একবার) মাসরূকের সাথে ইয়াসার ইবনু নুমাইরের ঘরে ছিলাম। মাসরূক ইয়াসারের ঘরের আঙিনায় কতগুলো মূর্তি দেখতে পেয়ে বললেনঃ আমি ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ থেকে শুনেছি এবং তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছেন যে, ক্বিয়ামাতের দিন) মানুষের মধ্যে সব থেকে শক্ত শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি তৈরি করে।[1][মুসলিম ৩৭/২৬, হাঃ ২১০৯, আহমাদ ৩৫৫৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৩)

[1] প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। প্রাকৃতিক দৃশ্য বা জড় বস্ত্ত এর অন্তর্ভুক্ত নয়। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক (كتاب اللباس)
হাদিস নম্বরঃ ৫৯৫১

ক্বিয়ামাতের দিন ছবি নির্মাতাদের শাস্তি প্রসঙ্গে।

৫৯৫১. ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যারা এ জাতীয় প্রাণীর) ছবি তৈরী করে, ক্বিয়ামাতের দিন তাদের শাস্তি দেয়া হবে। তাদের বলা হবেঃ তোমরা যা বানিয়েছিলে তাতে জীবন দাও। [৭৫৫৮; মুসলিম ৩৭/২৬, হাঃ ২১০৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৪)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

জাযাকা-আল্লাহু খাইরন এর উত্তরে কি বলবো

 আল্লাহর নামে শুরু করছি।

আল্লাহর রসূল ছল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াছাল্লাম বলেছেনঃ “কেউ

যদি কারো উপকার করে এবং এর জন্য সে যদি তাকে “জাযাকা-আল্লাহু খাইরন ( ﺟَﺰَﺍﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺧَﻴﺮً )” বলে তাহলে সে যেনো তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো” (বর্ণনায়ঃ আল-তিরমিযী,২০৩৫; শাইখ আলবানী সহীহ আল তিরমিযীতে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)।

যেটা বলা সুন্নাহঃ ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য বলা “জাযাকা-আল্লাহু খাইরন ( ﺟَﺰَﺍﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺧَﻴﺮً )

কিন্তু আমরা দেখি অনেকে শুধু বলে “জাযাকা-আল্লাহ” অথবা শুধু “জাযাক” অথবা শুধু “JZK”- এগুলো ব্যবহারের জন্য আমরা মোটেই পরামর্শ দিই না। কাজেই এগুলোর পরিবর্তে সুন্নাহের উপর আমল করা উচিত এবং সংক্ষেপ করাকে পরিহার করা উচিত। যারা “জাযাকা-আল্লাহু খাইরন” বলে তাদের প্রতি সর্বোত্তম জবাব কোনটি?

যখন উছাইদ ইবনে হাদাইর রদিয়াল্লাহু’আনহু রছুলুল্লাহ

ছল্লাল্লাহু’আলাইহিওয়াছাল্লামকে বললেনঃ “হে আল্লাহর রসূল, জাযাকা- আল্লাহু খাইরন!” তখন রসূল ছল্লাল্লাহু’আলাইহিওয়াছাল্লাম বললেনঃ “ওয়া আনতুম ফা-জাযাকুমু-আল্লাহু খাইরন ( ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻓَﺠَﺰَﺍﻛُﻢُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺧَﻴْﺮًﺍ)” (অর্থঃ তোমাকেও আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন) (শাইখ

আলবানী আল-সহীহার ৩০৯৬ নং হাদিসে একে সহীহ বলেছেন, আল- তা’লিকাতুল হিসান আল সহীহ ইবনে হিব্বান ৬২৩১)।

হাদিসে এমন কোনো প্রমাণ নেই যেখানে নবী ছল্লাল্লাহু’আলাইহিওয়াছাল্লাম “ওয়া ইয়াকুম (ﻭﺇﻳﺎﻛﻢ )” (অর্থঃ তোমার প্রতিও দয়া হোক) বলে জবাব দিয়েছেন। কাজেই সঠিক সুন্নাহর অনুসরণ করাই উত্তম—যার জবাব

হলোঃ “ওয়া আনতুম ফা-জাযাকুমুত-আল্লাহু খাইরন ( ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻓَﺠَﺰَﺍﻛُﻢُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺧَﻴْﺮًﺍ)”। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
===========================
*সূনান আত তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২০৩৫*
باب مَا جَاءَ فِي الْمُتَشَبِّعِ بِمَا لَمْ يُعْطَهُ حَدَّثَنَا الْحُسَيْنُ بْنُ الْحَسَنِ الْمَرْوَزِيُّ، بِمَكَّةَ وَإِبْرَاهِيمُ بْنُ سَعِيدٍ الْجَوْهَرِيُّ قَالاَ حَدَّثَنَا الأَحْوَصُ بْنُ جَوَّابٍ، عَنْ سُعَيْرِ بْنِ الْخِمْسِ، عَنْ سُلَيْمَانَ التَّيْمِيِّ، عَنْ أَبِي عُثْمَانَ النَّهْدِيِّ، عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ فَقَالَ لِفَاعِلِهِ جَزَاكَ اللَّهُ خَيْرًا فَقَدْ أَبْلَغَ فِي الثَّنَاءِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ جَيِّدٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِنْ حَدِيثِ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ ‏.‏ وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم بِمِثْلِهِ وَسَأَلْتُ مُحَمَّدًا فَلَمْ يَعْرِفْهُ ‏.‏ حَدَّثَنِي عَبْدُ الرَّحِيمِ بْنُ حَازِمٍ الْبَلْخِيُّ قَالَ سَمِعْتُ الْمَكِّيَّ بْنَ إِبْرَاهِيمَ يَقُولُ كُنَّا عِنْدَ ابْنِ جُرَيْجٍ الْمَكِّيِّ فَجَاءَ سَائِلٌ فَسَأَلَهُ فَقَالَ ابْنُ جُرَيْجٍ لِخَازِنِهِ أَعْطِهِ دِينَارًا ‏.‏ فَقَالَ مَا عِنْدِي إِلاَّ دِينَارٌ إِنْ أَعْطَيْتُهُ لَجُعْتَ وَعِيَالَكَ ‏.‏ قَالَ فَغَضِبَ وَقَالَ أَعْطِهِ ‏.‏ قَالَ الْمَكِّيُّ فَنَحْنُ عِنْدَ ابْنِ جُرَيْجٍ إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ بِكِتَابٍ وَصُرَّةٍ وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْهِ بَعْضُ إِخْوَانِهِ وَفِي الْكِتَابِ إِنِّي قَدْ بَعَثْتُ خَمْسِينَ دِينَارًا ‏.‏ قَالَ فَحَلَّ ابْنُ جُرَيْجٍ الصُّرَّةَ فَعَدَّهَا فَإِذَا هِيَ أَحَدٌ وَخَمْسُونَ دِينَارًا ‏.‏ قَالَ فَقَالَ ابْنُ جُرَيْجٍ لِخَازِنِهِ قَدْ أَعْطَيْتَ وَاحِدًا فَرَدَّهُ اللَّهُ عَلَيْكَ وَزَادَكَ خَمْسِينَ دِينَارًا ‏.‏

২০৩৫। উসামা ইবনু যাইদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কাউকে অনুগ্রহ করা হলে সে যদি অনুগ্রহকারীকে বলে, “তোমাকে আল্লাহ তা’আলা কল্যাণকর প্রতিদান দিন” তবে সে উপযুক্ত ও পরিপূর্ণ প্রশংসা করল।

সহীহ, মিশকাত (৩০২৪), তা’লীকুর রাগীব (২/৫৫), রাওযুন নায়ীর (৮)।

আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান, জায়্যিদ (উত্তম) গারীব। এটিকে শুধুমাত্র উক্ত সনদে উসামা ইবনু যাইদ (রাঃ)-এর হাদীস বলে আমরা জানি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুরূপ হাদীস আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতেও বর্ণিত হয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (বুখারীকে) কে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি এটি জানেন না বলেছেন।

আব্দুর রহিম ইবনু হাযিম আল বালখী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মাক্কী ইবনু ইবরাহীমকে বলতে শুনেছি, আমরা ইবনু জুরাইজ আল-মাক্কীর নিকট উপস্থিত ছিলাম এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি এসে তার নিকট কিছু চাইল। ইবনু জুরাইজ তার অর্থ সচিবকে বললেন তাকে একটি দীনার দিন। সে বলল, আমার নিকট একটি দীনার ব্যতীত আর কিছু নেই। এটি তাকে দান করলে আমার আপনার পরিবারের সবাইকে উপোস করতে হবে।

একথা শুনে তিনি রাগান্বিত হলেন এবং বললেনঃ তাকে সেটা দাও। মাক্কী বলেন, আমরা ইবনু জুরাইজের নিকট থাকাবস্থায়ই এক ব্যক্তি একটি চিঠি এবং একটি থলে নিয়ে উপস্থিত হলেন। যাহা তার কোন ভাই তার নিকট পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখাছিল আমি পঞ্চাশটি দীনার পাঠাইলাম। বর্ণনাকারী বলেন, ইবনু জুরাইজ থলেটি খুলে দীনার গননা করলেন। তাতে তিনি (৫১) একান্নটি দীনার পেলেন। এতে ইবনু জুরাইজ তার অর্থ সচীবকে বললেনঃ তুমি এক দীনার দান করেছ, আল্লাহ সেটা তোমাকে ফেরত দিয়েছেন তার সাথে অতিরিক্ত আরো পঞ্চাশটি দিয়েছেন।

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
*সূনান আত তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২০৩৪*
باب مَا جَاءَ فِي الْمُتَشَبِّعِ بِمَا لَمْ يُعْطَهُ حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، أَخْبَرَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَيَّاشٍ، عَنْ عُمَارَةَ بْنِ غَزِيَّةَ، عَنْ أَبِي الزُّبَيْرِ، عَنْ جَابِرٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ مَنْ أُعْطِيَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ وَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ فَإِنَّ مَنْ أَثْنَى فَقَدْ شَكَرَ وَمَنْ كَتَمَ فَقَدْ كَفَرَ وَمَنْ تَحَلَّى بِمَا لَمْ يُعْطَهُ كَانَ كَلاَبِسِ ثَوْبَىْ زُورٍ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ وَفِي الْبَابِ عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ وَعَائِشَةَ ‏.‏ وَمَعْنَى قَوْلِهِ ‏”‏ وَمَنْ كَتَمَ فَقَدْ كَفَرَ ‏”‏ ‏.‏ يَقُولُ قَدْ كَفَرَ تِلْكَ النِّعْمَةَ ‏.‏
২০৩৪। জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কাউকে কিছু দান করা হলে পরে তার (দান গ্রহীতার) সংগতি হলে সে যেন এর প্রতিদান দেয়। সংগতি না হলে সে যেন তার প্রশংসা করে। কেননা, যে লোক প্রশংসা করল সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। আর যে তা গোপন রাখল সে অকৃতজ্ঞ হলো। যে লোক এমন কিছু পাওয়ার ভান করল যা তাকে দান করা হয়নি, সে যেন ধোকাবাজি ও প্রতারণার দুটি পোশাক পরল।

হাসান, সহীহাহ (২৬১৭), তা’লীকুর রাগীব (২/৫৫)।

আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান গারব। আসমা বিনতু আবী বাকর ও আইশা (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। “মান কাতামা ফাকাদ কাফারা”-এর অর্থ “যে অনুগ্রহ গোপন করল সে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল”।

হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
===========================
*আল-আদাবুল মুফরাদ হাদিস নম্বরঃ ২১৪*

*যার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয় সে যেন তার উত্তম বিনিময় দেয়।*
بَابُ مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ فَلْيُكَافِئْهُ حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ عُفَيْرٍ قَالَ‏:‏ حَدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ أَيُّوبَ، عَنْ عُمَارَةَ بْنِ غَزِيَّةَ، عَنْ شُرَحْبِيلَ مَوْلَى الأَنْصَارِ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ الأَنْصَارِيِّ قَالَ‏:‏ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم‏:‏ مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ فَلْيُجْزِئْهُ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ مَا يُجْزِئُهُ فَلْيُثْنِ عَلَيْهِ، فَإِنَّهُ إِذَا أَثْنَى فَقَدْ شَكَرَهُ، وَإِنْ كَتَمَهُ فَقَدْ كَفَرَهُ، وَمَنْ تَحَلَّى بِمَا لَمْ يُعْطَ، فَكَأَنَّمَا لَبِسَ ثَوْبَيْ زُورٍ‏.‏

২১৪। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয় সে যেন তাকে তার অনুরূপ বিনিময় দান করে। যদি বিনিময় দান করার সামথ্য না থাকে তাহলে সে তার প্রশংসা করবে। কেননা সে যখন তার প্রশংসা করলো তখন সে যেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। যে ব্যক্তি তা (ভালো ব্যবহার) গোপন রাখলে সে যেন তার প্রতি অকৃজ্ঞতা প্রকাশ করলো। যে ব্যক্তি কোন কিছু না পেয়েও বলে, পেয়েছি, সে দ্বিগুণ মিথ্যাবাদী (তিরমিযী, আবু দাউদ, আহমাদ)।

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
*আল-আদাবুল মুফরাদ হাদিস নম্বরঃ ২১৫*

*যার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয় সে যেন তার উত্তম বিনিময় দেয়।*
بَابُ مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ فَلْيُكَافِئْهُ حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ‏:‏ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم‏:‏ مَنِ اسْتَعَاذَ بِاللَّهِ فَأَعِيذُوهُ، وَمَنْ سَأَلَ بِاللَّهِ فَأَعْطُوهُ، وَمَنْ أَتَى إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ، فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فَادْعُوا لَهُ، حَتَّى يَعْلَمَ أَنْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ‏.‏
২১৫। ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে আশ্রয় প্রার্থনা করে তাকে আশ্রয় দাও। যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কিছু প্রার্থনা করে তাকে দান করো। যে ব্যক্তি তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তোমরা তার প্রতিদান দাও। প্রতিদান দেয়ার মত কিছু না থাকলে তার জন্য দোয়া করো, যাতে সে অনুভব করতে পারে যে, তোমরা তার ভালো কাজের প্রতিদান দিয়েছে (আবু দাউদ, নাসাঈ, আহমাদ)।

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
===========================
*আল-আদাবুল মুফরাদ হাদিস নম্বরঃ ২১৬*

*কারো ভালো ব্যবহারের প্রতিদান দেয়া সম্ভব না হলে তার জন্য দোয়া করবে।*
بَابُ مَنْ لَمْ يَجِدِ الْمُكَافَأَةَ فَلْيَدْعُ لَهُ حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ الْمُهَاجِرِينَ قَالُوا‏:‏ يَا رَسُولَ اللهِ، ذَهَبَ الأَنْصَارُ بِالأَجْرِ كُلِّهِ‏؟‏ قَالَ‏:‏ لاَ، مَا دَعَوْتُمُ اللَّهَ لَهُمْ، وَأَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِمْ بِهِ‏.‏
২১৬। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। মুহাজির সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সমস্ত সওয়াব তো আনসারগণ নিয়ে গেলো। তিনি বলেনঃ না, যতক্ষণ তোমরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকবে এবং তাদের ভালো ব্যবহারের বা উপকারের প্রশংসা করতে থাকবে তোমরাও তাদের সাথে সমান সওয়াব পাবে (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)।

*হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)*

*আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক*
*শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। “কেউ হেদায়েতের* *দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি* *হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪][তিরমিযীঃ২৬৭৪]*

ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবকদের অবদান

 ভূমিকা :

ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবকদের অবদান অতুলনীয়। দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন গতি, অপরিসীম ঔদার্য্য, অফুরন্ত প্রাণ ও অটল সাধনার প্রতীক যুবকদের দ্বারাই হক্বের বিজয়ী পতাকা উড্ডীন হয়েছে এবং বাতিলের পরাজয় সূচিত হয়েছে। তাদেরই অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জান-মালের কুরবানীর বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে তাওহীদ ও সুন্নাতের চির অম্লান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং নমরূদ, ফেরাঊন ও কারূণ এবং যুগে যুগে তাদের উত্তরসূরীরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নিমেণ ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবকদের অবদান উল্লেখ পূর্বক তাদের অবদান থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

১. সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় প্রথম জীবন উৎসর্গকারী হাবীল :

বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম মানুষ ও নবী আদম (আঃ)-এর দু’পুত্র ছিলেন ক্বাবীল ও হাবীল। ক্বাবীল ছিলেন আদমের প্রথম সন্তান ও সবার বড়। আর হাবীল ছিলেন তার ছোট ভাই। তারা দু’ভাই আল্লাহর নামে কুরবানী করেছিলেন (মায়েদা ৫/২৭)। সে যুগে কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন ছিল, আসমান থেকে আগুন এসে কুরবানী নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানীকে আগুন গ্রহণ করত না, সে কুরবানীকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হত। কৃষিজীবী ক্বাবীল কিছু শস্য কুরবানীর জন্য পেশ করলেন। আর পশুপালক হাবীল আল্লাহর মহববতে তার উৎকৃষ্ট দুম্বাটি কুরবানীর জন্য পেশ করলেন। অতঃপর আসমান থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানী নিয়ে গেল। কিন্তু ক্বাবীলের কুরবানী পড়ে রইল। এতে ক্বাবীল ক্ষুদ্ধ হয়ে হাবীলকে বলল, لَأَقْتُلَنَّكَ ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব’। যুবক হাবীল তখন তাকে উপদেশ দিয়ে মার্জিত ভাষায় বলেছিলেন,

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ- لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ.

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাক্বীদের থেকে (কুরবানী) কবুল করে থাকেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও তবে আমি তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হব না। কেননা আমি জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৭-২৮)। ক্বাবীল স্রেফ হিংসার বশবর্তী হয়ে হাবীলকে হত্যা করেছিলেন। তিনি চাননি যে, ছোট ভাই হাবীল তার চাইতে উত্তম ব্যক্তি হিসাবে সমাজে প্রশংসিত হৌক।[1] এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, ভালোর প্রতি মন্দ লোকের হিংসা ও আক্রোশ মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। এর ফলে ভাল লোকেরা সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই লাভবান হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে মন্দ লোকেরা সাময়িকভাবে লাভবান হলেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। নির্দোষ হাবীলকে হত্যা করে ক্বাবীল অনন্ত ক্ষতির মধ্যে পতিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘অতঃপর সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হল’ (মায়েদাহ ৫/৩০)। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার সিলসিলা ক্বাবীলের মাধ্যমে শুরু হয়। বিধায় অন্যায়ভাবে সকল হত্যাকারীর পাপের একটা অংশ কাবীলের আমল নামায় যুক্ত হবে।[2] হত্যা সাধারণত যুবকদের দ্বারাই বেশি সংঘটিত হয়। অতএব অন্যায়ের সূচনাকারীরা সাবধান!

শিক্ষণীয় বিষয় :

(ক) মানুষ অন্যের ইচ্ছাধীন পুতুল নয় বরং সে স্বাধীন প্রাণী হিসাবে তার মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তি বিদ্যমান।

(খ) পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ড যুবক ক্বাবীলের মাধ্যমে সংঘঠিত হয়েছিল কুপ্রবৃত্তির পূজারী হয়ে। তাই কুপ্রবৃত্তির ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

(গ) ভালোর প্রতি মন্দ লোকের হিংসা চিরন্তন। অতএব হিংসা থেকে সাবধান!

(ঘ) অন্যায়ভাবে হত্যা সর্বাপেক্ষা জঘন্য পাপ এবং তওবা ব্যতীত হত্যাকারীর কোন আমল কবুল হবে না।

(ঙ) মু্ত্তাক্বী ব্যক্তিগণ অন্যায়ের পাল্টা অন্যায় করেন না, বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে তাঁর নিকট প্রতিদান কামনা করেন।

(চ) অন্যাকারী এক সময় অনুতপ্ত হয় এবং অন্তর্জালায় দগ্ধীভূত হয়। অবশেষে এর সূচনাকরীদের উপর সকল পাপের বোজা চাপে। অতএব অন্যায়ের সূচনাকারী সকল স্তরের ব্যক্তিগণ সাবধান!

২. স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গকারী তরুণ ইসমাঈল (আঃ) :

বহু অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ আবুল আম্বিয়া ইবরাহীম (&আঃ)-এর ৮৬ বছর বয়সে বিবি হাজেরার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ইসমাঈল। তরুণ ইসমাঈলের বয়স ১৩/১৪ বছর। তিনি যখন বৃদ্ধ পিতার সহযোগী হতে চলেছেন এবং পিতৃ হৃদয় পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন, ঠিক তখনই তাকে কুরবানীর নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

‘যখন সে (ইসমাঈল) পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হল, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে আমার বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে- আমি তোমাকে যবহ্ করছি। এখন বল, তোমার মতামত কী? সে বলল, হে আববা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’ (ছাফ্ফাত ৩৭/১০২)।

তরুণ ইসমাঈল নিজেকে ‘ছবরকারী’ না বলে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজের পিতাসহ পূর্বেকার বড় বড় আত্মোৎসর্গকারীদের মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিজেকে অহমিকামুক্ত করেছেন। যদিও তাঁর ন্যায় তরুণের এরূপ স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছিল বলে জানা যায় না (নবীদের কাহিনী, ১/১৩৯ পৃঃ)। মহান আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ.

‘অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল, তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (ছাফ্ফাত ৩৭/১০৩-১০৫)।

বিশ্ব মুসলিম এই সুন্নাত অনুসরণে ১০ই যিলহজ্জ বিশ্বব্যাপী শরী‘আত নির্ধারিত পশু কুরবানী দিয়ে থাকে। পিতার আহবানে স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গকারী তরুণ ইসমাঈল স্বতস্ফুর্তভাবে সাড়া দিয়েছেন বলেই কুরবানীর গৌরবময় ইতিহাস রচিত হয়েছে। তিনি যদি পিতার অবাধ্য হতেন এবং দৌড়ে পালিয়ে যেতেন তাহলে আল্লাহর হুকুম পালন করা ইবরাহীমের পক্ষে আদৌ সম্ভব হত না। এখানে মা হাজেরার অবদানও ছিল অসামান্য। তাইতো বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন,

মা হাজেরা হৌক মায়েরা সব

যবীহুল্লাহ হৌক ছেলেরা সব,

সবকিছু যাক সত্য রৌক

বিধির বিধান সত্য হৌক।

বর্তমানে বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে প্রতিটি যুবককে ইসমাঈল (আঃ)-এর মত হতে হবে, তবেই সেখানে নেমে আসবে পরম করুণাময় আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা।

শিক্ষণীয় বিষয় :

(ক) আল্লাহর মহববত ও দুনিয়াবী মহববত একত্রিত হলে দুনিয়াবী মহববতকে কুরবানী দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ মানতে হবে।

(খ) পিতা-মাতা ও প্রবীণদের কল্যাণময় নির্দেশনা এবং তরুণদের আনুগত্য ও উদ্দীপনার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিরস্মরণীয় ইতিহাস রচনা করা সম্ভব।

৩. যৌবনের মহাপরীক্ষায় ইউসুফ (আঃ) :

পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ ইউসুফ (আঃ) অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর আযীযে মিসর তথা মিসরের অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রী ক্বিত্বফীর (قطفير )-এর গৃহে পুত্র সেণহে লালিত পালিত হন। অতঃপর যৌবনে পদার্পণকারী অনিন্দ্য সুন্দর ইউসুফের প্রতি মন্ত্রীর নিঃসন্তান পত্নী যুলায়খার আসক্তি জন্মে। সে ইউসুফকে কুপ্রস্তাব দেয়। এ দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন,

وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَنْ نَفْسِهِ وَغَلَّقَتِ الْأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ.

‘আর তিনি যে মহিলার বাড়ীতে থাকতেন ঐ মহিলা তাকে ফুসলাতে লাগল এবং (একদিন) ঘরের দরজা সমূহ বন্ধ করে দিয়ে বলল, কাছে এসো! ইউসুফ বললেন, আল্লাহ (আমাকে) রক্ষা করুন। তিনি (অর্থাৎ আপনার স্বামী) আমার মনিব। তিনি আমার উত্তম বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমালঙ্ঘকারীগণ সফলকাম হয় না’ (ইউসুফ ১২/২৩)।

অতুলনীয় রূপ-লাবণ্যের অধিকারী যুবক ইউসুফ (আঃ) কুপ্রস্তাবে সম্মত না হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে যুলায়খা পিছন থেকে তার জামা টেনে ধরে এবং তা ছিঁড়ে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দু’জন ধরা পড়ে যায় বাড়ীর মালিক ক্বিত্বফীরের কাছে। পরে যুলায়খার সাজানো কথামত নির্দোষ ইউসুফের জেল হয় (নবীদের কাহিনী ১/১৭৭ পৃঃ) সুন্দরী নারীর হাতছানী উপেক্ষা করে ইউসুফ (আঃ) সাত বছর জেল খাটেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন। তবুও তিনি নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা অটুট রাখেন। শুধুমাত্র আল্লাহভীতির বদৌলতে ইউসুফ (আঃ) নোংরা মহিলার কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিনিময়ে নির্দোষ ইউসুফকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। অতএব হে যুবসম্প্রদায়! যাবতীয় নোংরামী ও অশ্লীলতা থেকে নিজেকে বিরত রাখ। তুমিতো আল্লাহভীরু ইউসুফের যোগ্য উত্তরসূরী।

শিক্ষণীয় বিষয় :

(ক) নবীগণ মানুষ ছিলেন এবং মনুষ্যসুলভ স্বাভাবিক প্রবণতাও তাদের মধ্যে ছিল। তবে আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তারা যাবতীয় কাবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত ও নিষ্পাপ ছিলেন।

(খ) জেল-যুলুমসহ দুনিয়াবী বিপদাপদের ভয় থাকলেও নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সর্বদা অটুট রাখতে হবে। তবে কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করা যাবে।

(গ) সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই। তাই দুনিয়াবী হাতছানী ও অপবাদ উপেক্ষা করে সর্বদা ন্যায় পথে অটল থাকতে হবে।

৪. আছহাবুল উখদূদের ঘটনায় বর্ণিত ঈমানদার যুবক :

দ্বীনে হক্ব প্রতিষ্ঠায় যুবকদের অবদান দিবালোকের ন্যায় ফুটে উটেছে আছহাবুল উখদূদের ঐতিহাসিক ঘটনায়। বনী ইসরাঈলের এক ঈমানদার যুবক নিজের জীবন দিয়ে জাতিকে হক্বের রাস্তা প্রদর্শন করে গেছেন। ছুহাইব বিন সিনান আর রূমী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হতে এ বিষয়ে এক দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তা সংক্ষেপে এই যে, বহুকাল পূর্বে এক রাজা ছিলেন, যার ছিল এক বৃদ্ধ যাদুকর। তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আশঙ্কায় একজন বালককে তার নিকটে যাদুবিদ্যা শেখার জন্য নিযুক্ত করা হয়। বালকটির নাম ‘আব্দুল্লাহ ইবনুছ ছামের’। তার যাতায়াতের পথে একটি গীর্জায় একজন পাদ্রী ছিলেন। বালকটি দৈনিক তার কাছে বসত। পাদ্রীর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে সে মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু তা গোপন রাখে। একদিন যাতায়াতের পথে বড় একটি হিংস্র জন্তু রাস্তা আটকে রাখে। বালকটি মনে মনে বলল, আজ আমি দেখব, পাদ্রী শ্রেষ্ঠ না যাদুকর শ্রেষ্ঠ? সে তখন একটি পাথর হাতে নিয়ে বলল ‘হে আল্লাহ! পাদ্রীর কর্ম যাদুকরের কর্ম হতে আপনার কাছে অধিক পসন্দনীয় হলে এ জন্তুটিকে মেরে ফেলুন। এই বলে সে পাথরটি নিক্ষেপ করল এবং ঐ পাথরের আঘাতে জন্তুটি মারা পড়ল।

অতঃপর এ খবর পাদ্রীয় কানে পৌঁছে গেল। তিনি বালকটিকে ডেকে বললেন, ‘হে বৎস’ তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। শীঘ্রই তুমি পরীক্ষায় পড়বে। যদি পড়, তবে আমার কথা প্রকাশ করে দিও না। বালকটির কারামত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তার দো‘আয় জন্মান্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান হতে লাগল, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হতে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হতেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল। ঘটনাক্রমে রাজার এক সভাসদ ঐ সময় অন্ধ হয়ে যান। তিনি বহু মূল্যের উপঢৌকনাদি নিয়ে বালকটির নিকট গমন করেন। বালকটি তাকে বলে, ‘আমি কাউকে রোগমুক্ত করি না। এটা কেবল আল্লাহ করেন। এক্ষণে যদি আপনি আল্লাহর উপর ঈমান আনেন তাহলে আমি আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে পারি। তাতে হয়ত তিনি আপনাকে আরোগ্য দান করবেন’। মন্ত্রী ঈমান আনলে বালক দো‘আ করল। অতঃপর তিনি দৃষ্টি শক্তি পেলেন। পরে রাজদরবারে গেলে রাজার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, আমার পালনকর্তা আমাকে সুস্থ করেছেন। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি? মন্ত্রী বললেন, আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ। তখন রাজার হুকুমে তার উপর নির্যাতন শুরু হয়। একপর্যায়ে তিনি উক্ত বালকের নাম বলে দেন। বালককে ধরে এনে একই প্রশ্নের অভিন্ন জবাব পেয়ে তার উপর চালানো হয় কঠোর নির্যাতন। ফলে একপর্যায়ে সেও পাদ্রীর কথা বলে দেয়। তখন পাদ্রীকে ধরে আনা হলে তিনিও একই জবাব দেন। রাজা তাদেরকে তাদের দ্বীন ত্যাগ করতে বললে তারা অস্বীকার করেন। তখন পাদ্রী ও মন্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় করাতে চিরে তাদের মাথাসহ দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়।

অতঃপর একইভাবে বালকটিও দ্বীন পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে কিছু সৈন্যের সাথে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় তুলে সেখান থেকে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে, পাহাড় কেঁপে উঠে, এতে তার সঙ্গী সাথীরা পাহাড়ের চূড়া হতে নিচে পড়ে মারা যায় এবং বালকটি প্রাণে রক্ষা পায়। অতঃপর তাকে নৌকায় করে সমুদ্রের মাঝখানে নিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু নৌকা উল্টে রাজার লোকজন মারা পড়ে এবং বালকটি বেঁচে যায়। দু’বারই বালকটি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেছিল, হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে এদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন।’ পরে বালকটি রাজাকে বলল, আপনি আমার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না করলে আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। রাজা বলল, সেটা কী? বালকটি বলল, আপনি সমস্ত লোককে একটি ময়দানে জমা করুন এবং সেই ময়দানে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। অতঃপর আমার তূণীর হতে একটি তীর ধনুকে সংযোজিত করে নিক্ষেপের সময় বলুন, بسم الله رب الغلام ‘বালকটির রব আল্লাহর নামে’! রাজা তাই করলেন এবং বালকটি মারা গেল। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। তখন রাজার নির্দেশে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে বিশাল অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে সবাইকে হত্যা করা হল। নিক্ষেপের আগে প্রত্যেককে দ্বীনে হক্ব ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তির কথা বলা হয়। কিন্তু কেউ তা মানেনি। শেষদিকে একজন রমণীকে তার শিশুসন্তানসহ উপস্থিত করা হল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্ততবোধ করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠন إصبر يا امه! فانك علي الحق ‘হে আমার মা! ছবর (করতঃ আগুনে প্রবেশ) করুন। কেননা আপনি হক্ব পথে আছেন’।[3] এ ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, একজন যুবক দ্বীনে হক্বকে প্রচারের খাতিরে স্বেচ্ছায় নিজের হত্যার কৌশল শত্রুর নিকট ব্যক্ত করেছিল। ফলে তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে হাযার হাযার নারী পুরুষ শিরক বর্জন করে তাওহীদ গ্রহণ করতঃ পরকালীন মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছিল। এমনিভাবে যুবকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সমাজে দাম্ভিকদের দম্ভ চূর্ণ হয়ে তদস্থলে হক্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হবে ইনশাআল্লাহ। অকর্মণ্য তরুণ সমাজ উক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে কি!

শিক্ষণীয় বিষয় :

(ক) প্রত্যেক আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্ম গ্রহণ করে।

(খ) রোগ-মুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ; কোন ভন্ড ওলী, দরবেশ, পীর-ফকীর, সাধু-সন্ন্যাসী বা তাবীয-কবয নয়।

(গ) যাবতীয় যাদু-বিদ্যা ও শিরকী কর্মকান্ড ত্যাগ করে আল্লাহর কালাম শিক্ষা করতে হবে।

(ঘ) হক্ব পথের নির্ভীক সৈনিকরা জীবনের তরে কখনো বাতিলের সামনে ঈমান বিকিয়ে দেয় না।

(ঙ) একজন হক্বপন্থী তরুণ ও যুবকের আত্মত্যাগের বিনিময়েই পৃথিবীতে হাযার হাযার মানুষ শিরকী পথ বর্জন করে জান্নাতী পথে জীবন উৎসর্গ করেছে। অতএব যুবকগণ এগিয়ে আসুন সেই জান্নাতী পথে।

৫. সাইয়েদুশ শুহাদা হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) :

ইসলামের প্রাথমিক যুগে যখন মক্কার বিস্তৃত অঞ্চল অন্যায় ও অত্যাচারের ঘনকালো মেঘমালা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল, মুসলমানগণ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন, সে সময় যে সকল অকুতোভয় যুবক ছাহাবী ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় বুকের তাজা খুন ঝরিয়েছিলেন, বাতিলের বিরুদ্ধে হক্বের ঝান্ডা উড্ডীন করতে শাহাদতের অমীয় পেয়ালা পান করেছিলেন হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (ছাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুওঅত প্রাপ্তির ৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষ দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। ঘটনাটি হল, যিলহজ্জ মাসের কোন একদিনে ছাফা পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় আবু জাহল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখে প্রথমে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করল এবং অনেক অপমান সূচক কথাবার্তা বলল। তাতে তাঁর কোন প্রত্যুত্তর ও ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে অবশেষে আবু জাহল একটা পাথর তুলে রাসূলের (ছাঃ) মাথায় আঘাত করল। তাতে তাঁর মাথা ফেটে রক্তধারা প্রবাহিত হতে থাকল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চুপচাপ সবকিছু সহ্য করলেন।

আবু জাহল অতঃপর কা‘বা ঘরের নিকটে গিয়ে তার দলবলের সাথে বসে উক্ত কাজের জন্য গৌরব যাহির করতে থাকল। আব্দুল্লাহ বিন জুদ‘আনের জনৈক দাসী ছাফা পাহাড়ের উপরে তার বাসা থেকে এ ঘটনা আদ্যোপান্ত অবলোকন করে। ঐ সময় বীর সেনানী যুবক হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব শিকার থেকে তীর ধনুক সুসজ্জিত অবস্থায় ঘরে ফিরছিলেন। উল্লেখ্য যে, হামযাহ (রাঃ) শিকারে খুবই দক্ষ ছিলেন। তখন উক্ত দাসীর নিকট সব ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কালমুহূর্ত বিলম্ব না করে হামযা (রাঃ) ছুটলেন আবু জাহলের খোঁজে। তিনি ছিলেন কুরায়েশগণের মধ্যে মহাবীর ও শক্তিশালী যুবক। খোঁজ করতে করতে তাকে পেলেন মসজিদুল হারামে। সেখানে তিনি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তীব্র ভাষায় গালিগালাজ করে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, يا مُصَفِّرَ اسْتَه تشتم ابن أخي وأنا على دينه ‘হে গুহ্যদ্বার দিয়ে রায়ু নিঃসরণকারী (অর্থাৎ কাপুরুষ)! তুমি আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছ, অথচ আমি তার দ্বীনের উপরে আছি? এরপর ধনুক দিয়ে তার মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে, সে চরমভাবে যখম হয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল। ফলে আবু জাহলের বনু মাখযূম গোত্র এবং হামযাহর বনু হাশেম গোত্র পরস্পরের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এমতাবস্থায় আবু জাহল নিজের দোষ স্বীকার করে নিজ গোত্রকে নিরস্ত করল। ফলে আসন্ন খুনোখুনি হতে উভয় পক্ষ বেঁচে গেল।[4] হামযাহর ইসলাম কবুলের এই ঘটনাটি ছিল আকস্মিক এবং ভাতিজার প্রতি ভালবাসার টানে। অতঃপর আল্লাহ তার অন্তরকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন এবং নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য তিনি শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য স্তম্ভরূপে আর্বিভুত হন। হামযাহ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পর নিমেণাক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন!

حمدت الله حين هدي فوادي * الي الاسلام والدين الحنيف

لدين جاء من رب عزيز* خبير بالعباد بهم لطيف

اذا تليت رسائله علينا* تحدر دمع ذي اللب الحصيف

رسائل حاء احمد من هداها* بايات مبينة الحروف

‘আমি মহান আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করছি, যেহেতু তিনি আমার অন্তরকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং একনিষ্ঠ এক দ্বীনের দিকে আমাকে হেদায়াত দান করেছেন। সেটা এমন এক দ্বীন, যা পরাক্রমশালী প্রভুর পক্ষ থেকে এসেছে। সেই প্রভু স্বীয় বান্দাদের খবর রাখেন এবং তাদের ব্যাপারে অত্যন্ত দয়ালু। যখন তাঁর গ্রন্থ আমাদের নিকট তেলাওয়াত করা হয়, তখন কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তির চোখ থেকে অবিরত ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। যে গ্রন্থ আহমাদ নিয়ে এসেছেন এবং যার আয়াত দ্বারা হেদায়াত করেছেন। এর আয়াত সুস্পষ্ট হরফ (অক্ষর) দ্বারা সন্নিবেশিত।[5]

ইসলাম গ্রহণের পর হামযাহ (রাঃ) অনেক জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। ‘সারিয়াতু হামাযাহ’ সংঘটিত হওয়ার সময় (১ম হিজরীর রামাযান মাসে) ইসলামের সর্বপ্রথম ঝান্ডা হামযাহ (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়। ‘আবওয়া’র যুদ্ধেও মহানবী (ছাঃ) হামযাহকে নেতা ও ঝান্ডাবাহী এবং ‘যুল আশীরা’র যুদ্ধেও তাঁকে ঝান্ডাবাহী নিযুক্ত করেছিলেন। বদর যুদ্ধে শায়বাহ মতান্তরে উৎবাহসহ অনেক কুরাইশ নেতা ও সৈন্য তাঁর হাতে নিহত হয়েছিল। ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত বনু কাইনুকার যুদ্ধেও তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং মহানবী (ছাঃ) এ যুদ্ধেও তাঁকে ইসলামী বাহিনীর পতাকা অর্পণ করেছিলেন। তৃতীয় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে সংঘটিত ওহোদ যুদ্ধে যুবক হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) শাহাদত বরণ করেন। তাঁর শাহাদতের ঘটনা হল, ওহোদ যুদ্ধে আলী, তালহা, যুবায়ের, সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ ও আবু দুজানাহ সহ অন্যান্য জানবায মুসলিম বীরদের মত হামযাহ (রাঃ) যুদ্ধ করছিলেন। এ যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য। প্রতিপক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তিনি দু’হাতে এমনভাবে তরবারি পরিচালনা করছিলেন যে, শত্রুপক্ষের কেউ তাঁর সামনে টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এদিকে মক্কার নেতা যুবাইর ইবনু মুত্বঈ‘মের হাবশী গোলাম ওয়াহশী বিন হারব একটি ছোট বর্শা হাতে নিয়ে একটি গাছ বা পাথরের আড়ালে ওঁৎ পেতে বসেছিল হামযাহ (রাঃ)-কে নাগালে পাওয়ার জন্য। জুবায়ের তার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী হত্যার পরিবর্তে ওয়াহশীকে নিযুক্ত করেছিল হামযাহকে হত্যা করার জন্য। আর এর বিনিময়ে তাকে মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছ্যিল। বদর যুদ্ধে তু‘আইমা হামযাহ (রাঃ)-এর হাতে নিহত হয়েছিল।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিবা‘ (سباع ) বিন আব্দুল ওযযা হামযার সামনে আসলে তিনি তাতে আঘাত করেন। ফলে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এদিকে বর্শা তাক করে বসে থাকা ওয়াহশী সুযোগমত হামযার অগোচরে তাঁর দিকে বর্শা ছুঁড়ে মারে। যা তার নাভীর নীচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। এরপরেও তিনি তার দিকে তেড়ে যেতে লাগলে পড়ে যান এবং কিছুক্ষণ পরেই শাহাদত বরণ করেন।[6] এ যুদ্ধে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত হামযাহ একাই ৩০ জনের অধিক শত্রু সেনাকে হত্যা করেন।[7] আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিন উৎবাহ বদর যুদ্ধে তার পিতার হত্যাকারী হামযার উপরে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার বুক ফেড়ে কলিজা বের করে নিয়ে চিবাতে থাকে এবং তাঁর নাক ও কান কেটে কণ্টহার বানায়। হামযাহ (রাঃ)- কে ‘সাইয়েদুশ শুহাদা’ শহীদগণের নেতারুপে এবং আসাদুল্লাহ ও আসাদু রাসূলিল্লাহ (আল্লাহর সিংহ ও আল্লাহ্ র রাসূলের সিংহ) আখ্যায়িত করা হয়।[8] শাহাদতের পর হামযার (রাঃ) বোন ছাফিয়াহ স্বীয়পুত্র যুবাইরকে দু’টি চাদর দিয়ে তাঁর দাফন সম্পন্ন করতে বলেন। কিন্তু এক আনছারীর লাশ তাঁর পাশেই পড়ে থাকতে দেখে আনছারীকে এক চাদরে ও হামযাহকে এক চাদরে কাফন দেয়া হয়। কিন্তু কাপড় এত ছোট ছিল যে, হামযার মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে আসত এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে পড়ত। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে মাথা ও মুখমন্ডল ঢেকে দেয়া হয় ও পায়ের উপর ইযখির ঘাস চাপিয়ে দেয়া হয় এবং তাঁকে ও তাঁর ভাগ্নে আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে একই কবরে ওহোদ প্রান্তরে (শহীদের কবরস্থানে) সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাযায় দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ) এমনভাবে কাঁদেন যে শব্দ উঁচু হয়ে যায়।[9] তাঁর সম্পর্কে মহানবী (ছাঃ) বলেছেন,

دَخَلْتُ الْجَنَّةَ الْبَارِحَةَ فَنَظَرْتُ فِيهَا فَإِذَا جَعْفَرٌ يَطِيرُ مَعَ الْمَلاَئِكَةِ وَإِذَا حَمْزَةُ مُتَّكِئٌ عَلَى سَرِيرٍ

‘আমি গত রাতে জান্নাতে প্রবেশ করে দেখলাম, জা‘ফর ফেরেশতাদের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছেন আর হামযাহ একটি আসনের উপর ঠেস দিয়ে বসে আসেন।[10] সাইয়েদুশ শুহাদা হামযাহ (রাঃ)-এর ত্যাগের প্রতি লক্ষ্য রেখে যুবকদেরকে সমাজ সংস্কারে ও হক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। (চলবে)

[1]. ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী, ১ম খন্ড, ২য় সংস্করণ, ২০১০, পৃ. ৪৪।

[2]. বুখারী হা/৩৩৩৫; মিশকাত হা/২১১ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[3]. ছহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ যুহদ ও রিকাক অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ১৭, আহমাদ হা/২৩৯৭৬, তিরমিযীর বর্ণনা অনুযায়ী ঐ দিন ৭০ হাযার মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। সনদ জাইয়িদ।

[4]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর রাহীকুল মাখতূম (রিয়ায-দারুল মুআয়্যিদ, ২০০০ খ্রীঃ/১৪২১ হিঃ), পৃ. ১০০-১০১; মাসিক আত-তাহরীক, ১৪/২ নভেম্বর ২০১০, পৃ. ৩; ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, প্রবন্ধ : পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নবীর কাহিনী, ২৫/৫ কিস্তি।

[5]. আস-সীরাতুন নাবাবিইয়াহ, ১ম খন্ড পৃ. ২৯৩, টীকা দ্র:; মাসিক আত-তাহরীক ৩/৬ মার্চ ২০০০ পৃ.২৩।

[6]. ইমাম যাহাবী, নুযহাতুল কুযালা তাহযীবু সিয়ারু আলামিন নুবালা, (জেদ্দাহ : দারুল আন্দালুস, ১ম প্রকাশ ১৯৯১/১১৪১) ১/৩২-৩৩; আত-তাহরীক ৩/৬, ২০০০, পৃঃ ২৪।

[7]. আল-ইছাবাহ ২/২৮৬, ক্রমিক সংখ্যা ১১০২, আত-তাহরীক ১৪/৯ জুন ২০১১, পৃঃ ১০।

[8]. আত-তাহরীক ১৪/১০, জুলাই, পৃঃ ৫।

[9]. ইবনুল জাওযী, আল-মুনতামাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম, (বৈরূত : দারুল কুতুব আল ইলমিইয়াহ, তাবি, ৩/১৮২-৮৩ পৃঃ, আত-তাহরীক ৩/৬ মার্চ ২০০০) পৃ: ২৪; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ২৮১।

[10]. আল-মুস্তাদরাকে আলাছ ছহীহায়ন, মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহ আল-হাকিম আননিসাপুরী, বৈরূতঃ দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ ১৪১১/১৯৯০) হা/৪৮৯০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৬৩, সনদ ছহীহ।

চিন্তা ও উৎকন্ঠার ইসলামি এলাজ

 দুশ্চিন্তা-মুসিবত ও পেরেশানী দূর করার উপায়

পার্থিব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ও স্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে দুঃখ, দুঃশ্চিন্তা ও পেরেশানী। কারণ, দুনিয়া কষ্ট, মুসিবত ও সঙ্কটপূর্ণ স্থান। দুনিয়া এবং জান্নাতের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। জান্নাতে নেই কোন দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يَمَسُّهُمْ فِيهَا نَصَبٌ وَمَا هُمْ مِنْهَا بِمُخْرَجِينَ
‘সেখানে তাদেরকে ক্লান্তি স্পর্শ করবে না এবং তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃতও হবে না।’ ( সূরা হিজর : ৪৮)

জান্নাতবাসীদের অন্তর কখনো কলুষিত হবে না এবং কষ্টদায়ক কোন শব্দ তাদের কানে পৌঁছবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا تَأْثِيمًا ﴿25﴾ إِلَّا قِيلًا سَلَامًا سَلَامًا ﴿26﴾
‘তারা সেখানে শুনতে পাবে না কোন বেহুদা কথা, এবং না পাপের কথা; শুধু এই বাণী ছাড়া, ‘সালাম, সালাম।’ ( সূরা ওয়াকেয়া : ২৫-২৬)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবী জীবনের প্রকৃতি হচ্ছে, দুর্ভোগ, যন্ত্রণা ও অসচ্ছলতা। কী গরীব, কী ধনী; কী মুসলিম, কী অমুসলিম; সবাই এর ভুক্তভোগী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ
‘নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে।’ ( সূরা বালাদ : ৪)
মূলত মানুষ অতীত নিয়ে দুঃখিত, ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বর্তমান নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
ইবনুল কাইয়ূম রামাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘অন্তরসমূহ দুশ্চিন্তা ও পেরেশানীর আধিক্য এবং স্থায়িত্বে ইমান-কুফর, আল্লাহর আনুগত্য ও অবাধ্যতার বিচারে দু’প্রকার। প্রথম প্রকার অন্তর রহমানের আরশ : এতে রয়েছে নূর ও হায়াত, আনন্দ ও বিনোদন, ঔজ্জ্বল্য ও কল্যাণের সবকিছু। দ্বিতীয় প্রকার অন্তর শয়তানের আরশ : এতে রয়েছে সংকীর্ণতা ও অন্ধকার, মৃত্যু ও পেরেশানী, দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতা।’ (সূত্র : ফাওয়ায়েদে ইবনুল কাইয়ূম)

• নিম্নে আমরা কুরআন-হাদীসের আলোকে চিন্তা ও পেরেশানী দূর করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে আলোচনা করছি :

১. চিন্তা, পেরেশানী ও মুসিবত দূর করার জন্য বেশি বেশি দোয়া ও ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহর নিকট নিজেকে সম্পূর্ণ সপে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ”
‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব।’ (সূরা গাফের : ৬০)
২. তদ্রূপ আল্লাহর জিকির ও কুরআন তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَلا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ” (الرعد: من الآية28)
‘জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’ ( সূরা রাদ : ২৮)
কুরআন মুমিনদের জন্য শিফা স্বরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا” (الإسراء:82
‘আর আমি কুরআন নাজিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত, কিন্তু তা জালিমদের ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়।’ (সূরা ইসরা : ৮২)
যারা বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করবে, তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা অনেক প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا” الأحزاب: من الآية35
‘আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সূরা আহযাব : ৩৫)
শয়তান চায় বান্দাদের আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল রাখতে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ” المائدة:91
‘শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ ( সূরা মায়েদা : ৯১)
আর যে আল্লাহর জিকির থেকে দূরে থাকবে, তার দুঃখ-কষ্ট বেশিই হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى”طـه:124
‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চিত এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কেয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়।’ (সূরা তাহা : ১২৪)
কুরআন শোনার সঙ্গে সঙ্গে মুমিনের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।’ (সূরা আনফাল : ২)
যাদের অন্তর আল্লাহর জিকির শূন্য তাদেরকে শাসিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَفَمَنْ شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلامِ فَهُوَ عَلَى نُورٍ مِنْ رَبِّهِ فَوَيْلٌ لِلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ أُولَئِكَ فِي ضَلالٍ مُبِينٍ” الزمر:22
‘আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন ফলে সে তার রবের পক্ষ থেকে নূরের ওপর রয়েছে, (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়?) অতএব ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আল্লাহর স্মরণ থেকে । তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত।’ ( সূরা যুমার : ২২)
৩. দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী মুক্ত হওয়ার জন্য সকাল-সন্ধ্যার জিকিরগুলো খুব যত্নের সঙ্গে পড়া। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করা যায়।
৪. গুনা থেকে দূরে থাকা, কারণ গুনা অন্তরে অশান্তি ও পেরেশানীর সৃষ্টি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ * وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ * حَتَّى إِذَا جَاءَنَا قَالَ يَا لَيْتَ بَيْنِي وَبَيْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَيْنِ فَبئسَ الْقَرِينُ * وَلَنْ يَنْفَعَكُمُ الْيَوْمَ إِذْ ظَلَمْتُمْ أَنَّكُمْ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُونَ” (الزخرف: 36 -39
‘আর যে পরম করুণাময়ের জিকির থেকে বিমুখ থাকে আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে হয়ে যায় তার সঙ্গী। আর নিশ্চয় তারাই (শয়তান) মানুষদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়। অথচ মানুষ মনে করে তারা হিদায়েত প্রাপ্ত। আর আজ তা {তোমাদের এই অনুতাপ} তোমাদের কোন উপকারেই আসবে না। যেহেতু তোমরা জুলুম করেছিলে। নিশ্চয় তোমরা আজাবে পরস্পর অংশীদার হয়ে থাকবে। অবশেষে যখন সে আমার নিকট আসবে তখন সে {তার শয়তান সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে} বলবে, হায়, আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব-পশ্চিমের ব্যবধান থাকত। সুতরাং কতইনা নিকৃষ্ট সে সঙ্গী!’ ( সূরা যুখরুফ : ৫৬-৩৯)
৫. উঁচু হিম্মত ও অন্তরে দুর্দান্ত সাহস রাখা। ছোট-খাট কোন বিষয় নিয়ে মাথা না ঘাবড়ানো। যেমন পারিবারিক বিষয় অথবা সামাজিক বিষয়। বরং সম্ভব হলে এগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করা এবং স্বীয় কাজ ও দায়িত্বের স্তূপ না করা।
৬. ধৈর্যধারণ করা ও সালাতে মগ্ন হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ” البقرة:45 .
‘আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।’ (সূরা বাকারা : ৪৫)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ” البقرة:153
‘হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা বাকারা : ১৫৩)
৭. একাকিত্ব ও নির্জনতা ত্যাগ করা। কারণ এ সময় শয়তান অধিক প্রবঞ্চনা দিয়ে থাকে।
৮. অবাস্তব জিনিস নিয়ে বেশি চিন্তা না করা। যেমন, কতক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে ভাবা, যা বাস্তবায়ন করা খুবই কষ্টকর বা দুঃসাধ্য। বিশেষ করে ঘুমের সময়। আর চোখে ঘুম না থাকলে বিছানায় না যাওয়া। কারণ, এ পরিস্থিতি চিন্তা ও অন্তর ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, যার সূত্র ধরে চিন্তা ও পেরেশানীর জন্ম হয়।
৯. সৎ-সঙ্গ অন্বেষণ করা এবং আলেম ও বিজ্ঞজনদের মজলিসে অংশগ্রহণ করা।
১০. সত্যবাদী, বিশ্বস্ত, আমানতদার ও গোপনীয়তা রক্ষাকারী বন্ধু গ্রহণ করা, যে আপনাকে সাহায্য করবে, ভাল পথ দেখাবে এবং আপনার মুসিবত দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
১১. সম্ভাব্য ও সাধ্যের নিরিখে একটি বাস্তবধর্মী রুটিন তৈরি করা ও সে অনুসারে পরিচালিত হওয়া। এবং অবসর সময় কাটানোর জন্য পারিবারিক বা অন্য কোন আমল নির্দিষ্ট করে নেয়া।
১২. দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করার কিছু দোয়া নিম্নে উল্লেখ করা হল :
(ক) বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মুসিবতের সময় বলতেন :
لا إله إلا الله العظيم الحليم، لا إله إلا الله رب العرش العظيم، لا إله إلا الله رب السموات ورب الأرض رب العرش الكريم
(খ) তিরমিজিতে আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
কোন বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন করলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আসমানের দিকে তাকিয়ে বলতেন : “سبحان الله العظيم” এবং খুব দোয়া করতেন ও বলতেন : يا حي يا قيوم
(গ) মুসনাদে আহমদে রয়েছে, ইবনে মাসউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বলেন,
যে কোন বান্দার দুশ্চিন্তা বা পেরেশানী হলে, সে যদি এ দোয়া পড়ে,
اللهم إني عبدك، وابن عبدك، وابن أمتك، ناصيتي بيدك، ماضٍ فيَّ حكمك، عدل فيَّ قضاؤك، أسألك بكل اسم هو لك سميت به نفسك، أو أنزلته في كتابك، أو علمته أحداً من خلقك، أو استأثرت به في علم الغيب عندك أن تجعل القرآن العظيم ربيع قلبي، ونور صدري، وجلاء حزني، وذهاب همّي. إلا أذهب الله همه وحزنه، وأبدله مكانه فرحًا”.
আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দেবেন এবং তার পরিবর্তে দেবেন আনন্দ।
(ঘ) আবু দাউদে রয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আবু উমামাকে বলেন, আমি কি তোমাকে এমন একটি কালেমা শিক্ষা দেব, তুমি যখন তা বলবে, আল্লাহ তোমার দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন এবং তোমাকে ঋণ মুক্ত করে দেবেন। তুমি সকাল-সন্ধ্যায় বল :
اللهم إني أعوذ بك من الجُبن والبخل، وأعوذ بك من غلبة الدين وقهر الرجال
তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কথার ওপর আমল করেছি, আল্লাহ তাআলা আমার দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন এবং আমাকে ঋণ মুক্ত করে দিয়েছেন।
(ঙ) ভবিষ্যতের ব্যাপারে উদ্বিগ্নতা দূর করার জন্য নিম্নের দোয়াটি খুব কার্যকর। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এর মাধ্যমে দোয়া করতেন :
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِي دِينِي الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِي وَأَصْلِحْ لِي دُنْيَايَ الَّتِي فِيهَا مَعَاشِي وَأَصْلِحْ لِي آخِرَتِي الَّتِي فِيهَا مَعَادِي وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِي فِي كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِي مِنْ كُلِّ شَرٍّ رواه مسلم رقم 2720.
আর যদি মুসিবত এসে যায় এবং ব্যক্তি তাতে আক্রান্ত হয়, তবে তো দোয়ার দরজা খোলা রয়েছেই। আল্লাহর দরবারে নক করা হলে ও তার নিকট প্রার্থনা করা হলে, তিনি ডাকে সারা দেবেন এবং প্রার্থনা কবুল করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
‘আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে।’ ( সূরা বাকারা : ১৮৬)
(চ) মুসনাদে আহমদ রয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কোন বিষয়ে দুশ্চিন্তায় পতিত হলে, সালাতের দিকে দৌড়ে ছুটতেন।
ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সূত্রে বর্ণনা করা হয়,
যার চিন্তা ও পেরেশানী বেশি, সে যেন বেশি বেশি পড়ে :
لا حول ولا قوة إلا بالله
(ছ) ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহ আনহু বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মুসিবতের সময় বলতেন,
لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَرَبُّ الأَرْضِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ رواه البخاري، الفتح رقم 6346
(জ) আসমা বিনতে উমাইস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আমাকে বলেন, ‘আমি তোমাকে এমন কিছু বাক্য শিখাবো, যা তুমি মুসিবতের সময় বলবে? অতঃপর তিনি বলেন, তুমি মুসিবতের সময় বলবে,
اللَّهُ اللَّهُ رَبِّي لا أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا. رواه أبو داود كتاب الصلاة : باب في الاستغفار، وهو في صحيح الجامع 2620
(ঝ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন,
মুসিবতগ্রস্ত ব্যক্তির দোয়া হচ্ছে,
اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ وَأَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ.. رواه أبوداود في كتاب الأدب رقم 5090.وحسنه في صحيح الجامع 3388 وفي صحيح سنن أبي داود رقم 4246.
(ঞ) আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা এবং সমস্যার বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (তালাক : ৩)
যে আল্লার ওপর তাওয়াক্কুল করবে, দুশ্চিন্তা তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাকে উদ্বিগ্ন ও পেরেশান করতে সক্ষম হবে না। কারণ, সে জানে এটা মানসিক দুর্বলতা ও ভয়ের ফল। যার কোন বাস্তবতা নেই। সে এটাও জানে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে, আল্লাহ তার সম্পূর্ণ জিম্মাদার। সে আল্লাহর ওপর ভরসা করে এবং তার ওয়াদার ওপর পূর্ণ আস্থাশীল থাকে, তার চিন্তা-পেরেশানী দূর হয়ে যায়, তার অসচ্ছলতা সচ্ছলতার রূপ নেয়, তার দুঃখ হয় পরিণত হয় আনন্দে, তার অনিরাপত্তার পরিবর্তে হয় নিরাপত্তা। আল্লাহর নিকট নিরাপত্তার প্রার্থনা করছি। আরো প্রার্থনা করছি অন্তরের শক্তি ও ধীরতা এবং পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল, যার বদৌলতে তিনি সমস্ত কল্যাণের জিম্মাদার হয়ে যান এবং সব ধরণের অনিষ্ঠ ও অকল্যাণ দূরীভূত করেন।
১৩. বিশেষ প্রয়োজন হলে মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হওয়া।
১৪. তিরমিজিতে রয়েছে, সাদ রাদিআল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সূত্রে বর্ণনা করেন,
দোয়ায়ে ইউনুস পড়ে, যে কোন মুসলিম যে কোন দোয়া করবে, তার দোয়া কবুল করা হবে।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন,
আমি এমন একটি বাক্য জানি, যে কোন মুসিবতগ্রস্ত ব্যক্তি তা পড়বে, আল্লাহ তার মুসিবত দূর করে দেবেন, আর তা হচ্ছে আমার ভাই ইউনুস আলাইহিস সালামের দোয়া।
فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
‘তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম জালিম।’ ( সূরা আম্বিয়া : ৮৭)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“وَإِنَّ يُونُسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ فَسَاهَمَ فَكَانَ مِنْ الْمُدْحَضِينَ فَالْتَقَمَهُ الْحُوتُ وَهُوَ مُلِيمٌ فَلَوْلا أَنَّهُ كَانَ مِنْ الْمُسَبِّحِينَ لَلَبِثَ فِي بَطْنِهِ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ «
‘আর নিশ্চয় ইউনুসও ছিল রাসূলদের একজন। যখন সে একটি বোঝাই নৌযানের দিকে পালিয়ে গিয়েছিল। অতঃপর সে লটারীতের অংশগ্রহণ করল এবং তাতে সে হেরে গেল। তারপর বড় মাছ তাকে গিলে ফেলল। আর সে {নিজেকে} ধিক্কার দিচ্ছিল। আর সে যদি (আল্লার) তাসবীহ পাঠকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হত, তাহলে সে পুরুত্থান দিবস পর্যন্ত তার পেটেই থেকে যেত।’ ( সূরা সাফ্ফাত : ১৩৯-১৪৪)
অন্যত্র বলেন,
“وَذَا النُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَن لّا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ ”
‘আর স্মরণ কর জুননুন (ইউনূস) এর কথা, যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, আমি তার ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না। তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম জালিম।’ (সূরা আম্বিয়া : ৮৭)
لّا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
ইউনুস আলাইহিস সালামকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দিয়েছিল।
لا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
ইউনুস আলাইহিস সালামকে সমুদ্রের গভীরতা থেকে নাজাত দিয়েছিল।
لا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
ইউনুস আলাইহিস সালামকে মাছের পেটের অন্ধকার, সমুদ্রের গভীরতার অন্ধকার ও রাতের অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছিল।
আর এভাবেই আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি।
সুতরাং যখন আপনাকে কোন দুশ্চিন্তা বা পেরেশানীতে পেয়ে বসে তখন বলবেন :
لا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
যখন আপনি সংকীর্ণতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ ও অশান্তি অনুভব করবেন, তখন বলবেন :
لا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
দুনিয়া প্রkস্ত হওয়া সত্বেও যখন তা আপনার জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাবে, তখন বলবেন :
لا إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে চিন্তা ও পেরেশানী থেকে মুক্ত করুন।

সমাপ্ত

লেখক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদক: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব।।

মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি?

 দুনিয়া পরকালের কর্মক্ষেত্র। দুনিয়ায় মানুষের কাজের উপর ভিত্তি করেই আল্লাহ পরকালে জান্নাতে বা জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। পরকালে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত লাভ করাই চূড়ান্ত মুক্তি। আর সেই মুক্তির লক্ষ্যে প্রত্যেকের উচিত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা। কুরআন ও হাদীছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার নির্দেশ থাকলেও মুসলমানগণ বিভিন্ন সময় আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। আর সকল দলই নিজেদেরকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল দাবী করেছে এবং অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছে। এই মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়ছালা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত।

রাসূল (ছাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত দলের নাম বলেননি। বরং তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত দলের বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

خَطَّ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطًّا بِيَدِهِ ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيْلُ اللهِ مُسْتَقِيْمًا، وَخَطَّ خُطُوْطًا عَنْ يَمِيْنِهِ وَشِمَالِهِ، ثُمَّ قَالَ هَذِهِ السُّبُلُ وَلَيْسَ مِنْهَا سَبِيْلٌ إِلَّا عَلَيْهِ شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ ثُمَّ قَرَأَ قوله تعالى وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيْلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ-

‘আমাদের জন্য রাসূল (ছাঃ) নিজ হাতে একটা দাগ টানলেন, অতঃপর বললেন, ‘এটা আল্লাহ তা‘আলার সোজা ও সঠিক রাস্তা। অতঃপর তাঁর ডানে ও বামে আরো কিছু দাগ টানলেন। তারপর বললেন, এগুলি অন্য রাস্তা যাদের প্রত্যেকটার শুরুতে শয়তান বসে মানুষদেরকে তার দিকে ডাকছে। তারপর আল্লাহর বাণী পড়লেন, ‘এটাই আমার সোজা ও সঠিক রাস্তা। সুতরাং তোমরা অবশ্যই এর অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য রাস্তাসমূহের অনুসরণ করো না, তাহ’লে এ রাস্তাসমূহ তোমাদেরকে তাঁর রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তিনি এভাবেই তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যাতে তোমরা মুত্তাক্বী হ’তে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।[1] এ হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুক্তির জন্য একটি সঠিক রাস্তা ছাড়াও শয়তানের তৈরী বিভিন্ন ভ্রান্ত রাস্তা থাকবে।

অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) উম্মতে মুহাম্মাদীর বিভক্তির কথা উল্লেখ করে মুক্তিপ্রাপ্তদের বর্ণনা দিয়ে বলেন,

إِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً فَهَلَكَتْ سَبْعُوْنَ فِرْقَةً وَخَلَصَتْ فِرْقَةٌ وَاحِدَةٌ وَإِنَّ أُمَّتِيْ سَتَفْتَرِقُ عَلَى اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً فَتَهْلِكُ إِحْدَى وَسَبْعِيْنَ وَتَخْلُصُ فِرْقَةٌ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ مَنْ تِلْكَ الْفِرْقَةُ، قَالَ الْجَمَاعَةُ الْجَمَاعَةُ-

‘নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলরা ৭১ দলে বিভক্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭০ দল ধ্বংস হয়ে গেছে এবং একটি দল নাজাত পেয়েছে। আর আমার উম্মত অচিরেই ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে ৭১ দল ধ্বংস হবে (জাহান্নামে যাবে) এবং একটি দল মুক্তিপ্রাপ্ত হবে। ছাহাবাগণ বললেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোন্টি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তারা একটি দল, তারা একটি দল’।[2]অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

أَلَا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ افْتَرَقُوْا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الْأُمَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ-

‘ওহে, অবশ্যই তোমাদের পূর্বে আহলে কিতাবগণ (ইহুদী ও নাছারা) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর নিশ্চয়ই এই উম্মত অচিরেই ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামী ও একদল জান্নাতী। (জান্নাতীরা হ’ল) একটি জামা‘আত বা দল’।[3]

উপরোক্ত হাদীছ থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, মুসলমানদের মধ্যেই ৭২/৭৩টি দল হবে। তন্মধ্যে ৭১/৭২টি দল জাহান্নামে যাবে এবং একটি দল জান্নাতে যাবে। সেটিই মূলত মুক্তিপ্রাপ্ত দল। অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) হক্বপন্থী দল প্রসঙ্গে বলেন, لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِِّنْ أُمَّتِيْ ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ- ‘আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সর্বদা হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, বিরোধীরা বা পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, এই অবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, তারা ঐ অবস্থায়ই থাকবে’।[4]

বর্তমানে সকল নামধারী ইসলামী দলই এই হাদীছগুলিকে উল্লেখ করে নিজেদেরকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল বলার চেষ্টা করে। আর বিরোধী দলকে পথভ্রষ্ট ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রচার করে। আসলে মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোন্টি?

রাসূল (ছাঃ) স্বীয় ছাহাবীদের সম্মুখে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের কথা বর্ণনা করলে তারা রাসূল (ছঃ)-কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোন্টি? রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের প্রশ্নের যে উত্তর দিয়েছেন, সে সম্পর্কে দু’টি বর্ণনা পাওয়া যায়।

(১) রাসূল (ছাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে বলেছেন, هى الجماعة، ‘এটা হ’ল একটা দল’।[5] এ হাদীছ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় না যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি। তাই এই অস্পষ্টতাকে পুঁজি করে অনেক দলই বলে থাকে, এখানে যেহেতু জামা‘আতের কথা বলা হয়েছে সেহেতু জামা‘আত যত বড় হবে তারাই হবে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অধিকারী। দলীল হিসাবে একটি যঈফ হাদীছ পেশ করে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা বড় জামা‘আতের পায়রাবী কর’।[6] ইবনু মাজাহতে আনাস (রাঃ) কর্তৃক এ সম্পর্কিত একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সে হাদীছটিও যঈফ।[7]

জামা‘আতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা ঠিক নয়। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করার আগে আমাদেরকে জামা‘আতের সঠিক সংজ্ঞা জানতে হবে। মূলতঃ জামা‘আতের জন্য লোক বেশী হওয়া শর্ত নয়, হক্বের অনুসারী হওয়া শর্ত। জামা‘আতের সংজ্ঞায় প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, الجماعة ما وافق الحق وان كنت وحدك ‘জামা‘আত হচ্ছে হক্বের অনুগামী হওয়া, যদিও তুমি একাকী হও’।[8]

যেমন আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-কে একটি দল বলেছেন। তিনি বলেন, إِنَّ إِبْرَاهِيْمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتاً لِلّهِ حَنِيْفاً وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মত বিশেষ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (নাহল ১৬/১২০)। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)-কে أمة বা জাতি বলে ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও তিনি ছিলেন একা। এখানে আল্লাহ সংখ্যাধিক্যের দৃষ্টিতে নয়; বরং হক্বের উপরে থাকার কারণে ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রশংসা করেছেন।

আবদুল্লাহ বিন মুবারক (রহঃ)-কে জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, আবূবকর ও ওমর (রাঃ)। তাকে বলা হ’ল, তাঁরাতো ইন্তেকাল করেছেন। তিনি বললেন, তাহ’লে অমুক অমুক। তাকে বলা হ’ল, তারাও তো মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তিনি বললেন, আবু হামযা আস-সুকরী হ’ল জামা‘আত। অর্থাৎ একজন নেক ফাযেল ব্যক্তি সুন্নাত ও সালাফে ছালেহীনের পথের অনুসারীই হচ্ছেন জামা‘আত ও আহলে হক্বের মানুষ। সুতরাং সংখ্যাধিক্য এখানে বিবেচ্য নয়। বরং লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সুন্নাতের অনুসারী হওয়া এবং বিদ‘আত পরিত্যাগ করা’।[9] সুতরাং হক্বের অনুসারী একজন হ’লেও সে বড় দলের অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যায় অধিক হ’লেই বড় দল বা জামা‘আতে হক্ব নয়। অনুরূপভাবে সংখ্যাধিক্য দেখে বড় দলের অনুসরণ করলেই হক্বপন্থী হওয়া যায় না। বরং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসরণ করাই প্রকৃত অর্থে হক্বপন্থী হওয়ার পূর্বশর্ত। এই হক্বপন্থীগণই হ’লেন বড় জামা‘আত। আর তারা হ’লেন ছাহাবায়ে কিরাম, সালাফে ছালেহীন ও তাদের যথাযথ অনুসারীগণ। সুতরাং যারা খুলাফায়ে রাশেদীন ও ছাহাবায়ে কেরামের মাসলাক অনুসরণে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করবেন, তারাই বড় জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। অতএব নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করতে পারলে সংখ্যায় কম হ’লেও তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত দল। পক্ষান্তরে সংখ্যায় বেশী হ’লেও সেখানে কুরআন ও হাদীছ মোতাবেক আমল না থাকলে সেটা হক্বপন্থী ও নাজাতপ্রাপ্ত দল নয়।

অনেক সময় কোন দলে লোক সংখ্যা বেশী দেখে মানুষ মনে করে ঐ দলের লোকেরাই হক্বের পথে আছে। তাদের ধারণা এত লোক মিলে কি ভুল পথে যেতে পারে? আর আমরা হক্বপন্থী হ’লে আমাদের সংখ্যা কম কেন? আবার অনেকে বলেও থাকেন, দশজন যেখানে আল্লাহও সেখানে। এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ হক্বপন্থী হওয়ার জন্য সংখ্যায় বেশী হওয়া শর্ত নয়। বরং বাতিলের সংখ্যা হক্বপন্থীদের তুলনায় বেশী হবে, এটাই স্বাভাবিক। যেমন রাসূল (ছাঃ) হক্ব দল ১টি এবং বাতিল দল ৭২টি উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মতের ৭৩ দলের মধ্যে ৭২ দলই জাহান্নামী আর একটি দলই মাত্র জান্নাতে যাবে। সুতরাং হক্বপন্থীদের সংখ্যা কম হবে, এটাই রাসূলের ভাষ্য।

সাধারণভাবে কোন দলে লোক বেশী থাকাই বাতিল হওয়ার প্রমাণ। কারণ রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মাতের ৭৩টি দলের মধ্যে ৭২টি দলই জাহান্নামে যাবে। সুতরাং বাতিলদের সংখ্যা বেশী হবে, এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সঠিক দলটি খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর মানুষ সাধারণত এ বিষয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় না; বড় দল ও সংখ্যা বেশী দেখে তাদের অনুসরণ করে। এজন্য দিন দিন বাতিলের সংখ্যা বাড়ছেই।

আমরা যদি পৃথিবীর জনসংখ্যার দিকে তাকাই তাহ’লে দেখা যাবে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ মুসলমান। যদি সংখ্যা হক্বপন্থী হওয়ার শর্ত হয়, তাহ’লে ধরে নিতে হবে বিধর্মীরাই হক্বের উপর আছে। অথচ তা কোন মুসলিম স্বীকার করবে না, মেনেও নিবে না। হক্ব-বাতিলের মানদন্ড আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) সংখ্যার দ্বারা নির্ধারণ করেননি; বরং নিঃশর্তভাবে অহি-র অনুসরণ করাই হ’ল হক্বপন্থী হওয়ার জন্য শর্ত।

অপরদিকে মহান আল্লাহ কুরআনে যেসব স্থানে اكثرهم-اكثر-كثيرة-كثيراً-كثير শব্দগুলি উল্লেখ করেছেন, প্রায় সব জায়গায় বলেছেন, অধিকাংশরাই মূর্খ, কাফের, ফাসেক, গাফেল ইত্যাদি। যেমন আল্লাহর বাণী, أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ ‘তাদের অধিকাংশই জানে না’ (আন‘আম ৬/৩৭; আ‘রাফ ৭/১৩১; আনফাল ৮/৩৪; ইউনুস ১০/৫৫; নাহল ১৬/৭৫, ১০১; নামল ২৭/৬১; ক্বাছাছ ২৮/১৩,৫৭; আনকাবুত ২৯/৬৩; দুখান ৪৪/৩৯; হুজুরাত ৪৯/৪; তুর ৫২/৪৭)। অন্য আয়াতে আছে, وَكَثِيْرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُوْنَ ‘তাদের অধিকাংশই ফাসিক’ (হাদীদ ৫৭/১৬,২৬,২৭; মায়েদা ৫/৮১)। অন্য আয়াতে আছে, وَإِنَّ كَثِيْراً مِّنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُوْنَ ‘নিশ্চয়ই অধিকাংশ মানুষ আমার আয়াত সম্পর্কে গাফেল’ (ইউনুস ১০/৯২)। এছাড়া বেশী সংখ্যক লোকদের অবস্থা কি হবে তাও আল্লাহ পাক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيْراً مِّنَ الْجِنِّ وَالإِنسِ لَهُمْ قُلُوْبٌ لاَّ يَفْقَهُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَّ يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَّ يَسْمَعُوْنَ بِهَا أُوْلَـئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُوْنَ-

‘আর আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর রয়েছে, তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ রয়েছে, তা দ্বারা তারা দেখে না। আর তাদের কান রয়েছে, তা দ্বারা তারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তাদের চেয়েও বিভ্রান্ত। তারাই হ’ল গাফেল’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।

অপরদিকে আল্লাহ তা‘আলা কম সংখ্যক লোকদের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, وَقَلِيْلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُوْرُ ‘আমার বান্দাদের মধ্যে কম সংখ্যকই শোকরগুজার’ (সাবা ৩৪/১৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, قَلِيْلاً مَّا تَشْكُرُوْنَ ‘তোমরা অল্প সংখ্যক লোকই শুকরিয়া আদায় কর’ (আ‘রাফ ৭/১০)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, قَلِيْلاً مَا تَذَكَّرُوْنَ ‘তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর’ (হাক্কাহ ৬৯/৪১; আ‘রাফ ৭/৩)। রাসূল (ছাঃ)ও অল্প সংখ্যক লোকদেরকে সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আবূবকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, بَدَأَ الْإِسْلاَمُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَمَا بَدَأَ غَرِيْبًا فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءِ. ‘ইসলাম শুরু হয়েছিল গুটিকতক লোকের মাধ্যমে, আবার সেই অবস্থাপ্রাপ্ত হবে। অতএব সুসংবাদ সেই অল্প সংখ্যক লোকদের জন্য’।[10]

আর এই অল্প সংখ্যক হক্বপন্থী লোকদের কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তাদেরকে নিশ্চিহ্নও করতে পারবে না। তারা সংখ্যায় কম হ’লেও ক্বিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

(২) রাসূল (ছাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় প্রসঙ্গে অন্য হাদীছে বলেন, ما انا عليه وأصحابى. ‘(মুক্তিপ্রাপ্ত দল) হচ্ছে আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে পথের উপর আছি’।[11] অন্য বর্ণনায় এসেছে, سَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةً قِيْلَ َمَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الَّذِيْنَ عَلَى مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ- ‘আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ছাড়া সবাই জাহান্নামে যাবে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ‘যারা আমার ও আমার ছাহাবীদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত’।[12]

এই হাদীছেও রাসূল (ছাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত কোন দলের নাম বলেননি; বরং বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। রাসূল (ছাঃ) কোন দলের নাম বললে সবাই সেই দলের অনুসারী বলে দাবী করত। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, যাতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে আমল করার মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর উদ্দীষ্ট দল তৈরী হয়।

হাদীছের আলোকে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য হ’ল রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যে পথের অনুসারী ছিলেন সে পথের অনুসরণ করা। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর অনুসরণের পাশাপাশি রাসূলের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ أَطِيْعُواْ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِيْنَ- ‘আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের অনুসরণ কর, যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখ নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)। এছাড়াও সূরা নিসা ১৩-১৪, ৫৯, ৬০-৬১, ৭৯-৮০; মায়েদা ৯২; আনফাল ২৪, ৪৬; নহল ৪৪ ও নূর ৬৩ আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে।

রাসূল (ছাঃ)ও বিভিন্ন হাদীছে তাঁর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষত মতপ্রার্থক্যের সময় রাসূলের ও খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন,

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ-

‘তোমাদের মধ্যে থেকে যারা জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। অতএব (মতভেদের সময়) আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য। এ সুন্নাতকে খুব মযবুতভাবে মাড়ির দাঁত দিয়ে অাঁকড়ে ধরে থাক। আর সমস্ত বিদ‘আত থেকে বিরত থাক। কেননা প্রত্যেকটি বিদ‘আতই গুমরাহী’।[13]

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন মতবিরোধ দেখা দিবে তখন তোমরা আমার সুন্নাতের অনুসরণ করবে। আর আমার ছাহাবীগণ আমাকে যেভাবে অনুসরণ করছে, যেভাবে আমল করছে, যে আক্বীদা পোষণ করছে, তোমরা সেভাবেই আমার অনুসরণ করবে। সাথে সাথে ইসলামের নামে নব আবিষ্কৃত বস্ত্ত থেকে দূরে থাকবে। আজকের দিনে এই মতবিরোধপূর্ণ সমাজে যদি আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসারী হ’তে পারি এবং ছাহাবীগণ যেভাবে কুরআন ও হাদীছকে বুঝেছেন ও আমল করেছেন সেভাবে বুঝতে ও আমল করতে পারি, তাহ’লেই আমাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব।

একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ইসলামের মধ্যে কম-বেশী করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। বিদায় হজ্জের দিন আল্লাহ নাযিল করলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيْنًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)।অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يََّبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না এবং ক্বিয়ামতের দিন সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’(আলে ইমরান ৩/৮৫)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইহুদী-নাছারাদের মত মুসলমান নামধারী একদল লোক কুরআনকে পরিবর্তন করতে না পারলেও কুরআনের অপব্যাখ্যা করছে। রাসূলের নামে অসংখ্য জাল হাদীছ তৈরী করেছে। কিন্তু আল্লাহর কিছু বান্দা তাদের চক্রান্তের মোকাবিলায় হাদীছ বাছাই করে আমাদের সামনে ছহীহ হাদীছগুলি তুলে ধরেছেন। আমাদের উচিত কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা ও ছহীহ হাদীছ গ্রহণ করা। তাহ’লে আমাদের মাঝে মতভেদ মতপার্থক্য থাকবে না। আল্লাহ কুরআনে সব সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,وَلاَ يَأْتُوْنَكَ بِمَثَلٍ إِلاَّ جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيْرًا ‘তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করতে পারেনি, যার সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করিনি’ (ফুরক্বান ২৫-৩৩)। অন্য আয়াতে এসেছে,وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ‘আমি এ কুরআনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (যুমার ৩৯/২৭)।

রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত কুরআনের ব্যাখ্যা ও তাঁর বাস্তব জীবনই হ’ল ‘হাদীছ’ বা ‘সুন্নাহ’। এ কুরআন ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের অনুসরণ করা হবে এবং মতবিরোধপূর্ণ সময়ে সঠিক পথ পাওয়া যাবে। বিদায় হজ্জের দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায় রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ إِنْ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابُ اللهِ ‘আমি তোমাদের নিকট যা রেখে যাচ্ছি তা মযবুতভাবে ধরে থাকলে, আমার পরে কখনও তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না; আর সেটা হ’ল আল্লাহর কিতাব’।[14] এখানে কিতাবুল্লাহ বলতে শুধু কুরআনকে ধরে রাখার কথা বলা হয়নি। হাদীছও মেনে চলতে হবে। কারণ কুরআনে রাসূলের অনুসরণ করার নির্দেশ আছে।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা লা‘নত করেছেন ঐসব নারীর উপর, যারা অন্যের শরীরে নাম বা চিত্র অংকন করে এবং যারা নিজ শরীরে অন্যের দ্বারা অংকন করায়। যারা ললাট বা কপালের উপরস্থ চুল উপড়িয়ে কপাল প্রশস্ত করে এবং সৌন্দর্যের জন্য রেত ইত্যাদির সাহায্যে দাঁত সরু ও দু’দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। এসব নারী আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি বিকৃত করে ফেলে। বনী আসাদ গ্রোত্রের উম্মে ইয়াকূব নামীয় এক মহিলা এই বর্ণনা শুনে ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি এ ব্যাপারে লা‘নত করেছেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যার উপর লা‘নত করেছেন, আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লা‘নত করা হয়েছে, তার উপর আমি লা‘নত করব না কেন? তখন মহিলাটি বলল, আমি তো কুরআন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি, তাতে তো আপনি যা বলেছেন, তা পেলাম না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) বললেন, তুমি যদি পড়তে তবে অবশ্যই পেতে। তুমি কি পড়নি, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা নির্দেশ দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে বারণ করেন তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় করে চলো’ (হাশর ৭)। মহিলাটি বলল, হ্যঁা, নিশ্চয়ই। ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) বললেন, ‘রাসূল (ছাঃ) এ বিষয়ে নিষেধ করেছেন’।[15]

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) একবার মক্কায় ঘোষণা করলেন, ‘আমি প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব কুরআন থেকে দিতে পারি, জিজ্ঞেস কর, যা জিজ্ঞেস করতে চাও। জনৈক ব্যক্তি আরয করল, এক ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় প্রজাপতি মেরে ফেলল, এর বিধান কি? ইমাম শাফেঈ (রহঃ) সূরা হাশরের উক্ত (৭নং) আয়াতটি তেলাওয়াত করে হাদীছ থেকে এর বিধান বর্ণনা করে দিলেন’।[16]

উপরের দু’টি ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয় যে, কিতাবুল্লাহ বলতে কুরআন ও হাদীছ উভয়কে বুঝায়। বিষয়টি রাসূল (ছাঃ) অন্য হাদীছে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি; যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্তকে মযবুতভাবে ধরে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বস্ত্ত হ’ল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’।[17]

এ হাদীছে রাসূল (ছাঃ) গোমরাহী থেকে বাঁচার জন্য দু’টি বস্ত্তকে অাঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে রাসূল (ছাঃ) তাকীদ দিয়ে বলেছেন যে, আমার উম্মত দু’টি জিনিস অাঁকড়ে ধরলে কখনো বিভ্রান্ত হবে না।

ছাহাবীগণ ও সালাফে ছালেহীন সত্যের পথে থাকার জন্য ও মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসরণ করেছেন এবং অন্যকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন-

(ক) আলী (রাঃ) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, لا ينفع قول إلا بعملٍ، ولا عمل إلا بقولٍ، ولا قول ولا عمل إلا بنيةٍ، ولا نية إلا بموافقة السنة. ‘আমল ব্যতীত কোন কথা উপকারে আসবে না, কোন আমলও কথা ব্যতীত উপকারে আসবে না। কোন কথা ও আমল নিয়ত ব্যতীত উপকারে আসবে না, আর কোন নিয়তও উপকারে আসবে না সুন্নাতের আনুকূল্য ব্যতীত’।[18]

(খ) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেছেন, عليـكم بالسبـيل والسـنة. ‘তোমরা সঠিক পথ ও সুন্নাত অবধারিত করে নাও’।[19]

(গ) প্রখ্যাত তাবেঈ যুহরী (রহঃ) বলেন, كان من مـضى من علمائنا بقول الاعةـصام بالسنة نجاة. ‘আমাদের আলেমদের মধ্য হ’তে যাঁরা অতীত হয়েছেন, তাঁরা বলতেন সুন্নাতকে ভালভাবে অাঁকড়ে ধরা মুক্তি (রক্ষাকবচ) স্বরূপ’।[20]

(ঘ) ইমাম মালেক (রহঃ) বলেছেন, السـنة سفـينة نوحٍ، من ركبـها نجا، ومن تخـلّف عنها غرق. ‘সুন্নাত হ’ল নূহ (আঃ)-এর নৌকা সদৃশ। যে তাতে আরোহণ করবে সে পরিত্রাণ পাবে, আর যে তা থেকে পিছে অবস্থান করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে’।[21]

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দল হওয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও তাঁর ছাহাবীদের সুন্নাতের উপর আমল করতে হবে। রাসূলকে বাদ দিয়ে বা তাঁর ছহীহ হাদীছের বিরোধিতা করে কোন ইমাম, পীর বা কোন দলের অন্ধ অনুসরণ করে মুক্তি পাওয়া যাবে না। রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং ছাহাবীদের অনুসরণের মাধ্যমে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাবে।

বর্তমান শতধাবিভক্ত সমাজে আমাদেরকে সঠিক দল খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আশ্রয় নিতে হবে। কুরআন ও হাদীছের আলোকে যারা হক্ব তাদেরকেই সঠিক জানতে হবে। অনেকে নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বলে থাকেন। অথচ তাদের কাজগুলি সুন্নাত বিরোধী। সুন্নাতবিরোধী আমল করে কিভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়?

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় দিতে গিয়ে আবু মুহাম্মদ আলী ইবনু হাযম আন্দালুসী (মৃত ৪৫৬ হিঃ) বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, যাদেরকে আমরা হক্বপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলছি তাঁরা হ’লেন, ছাহাবায়ে কেরাম, তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ, আহলে হাদীছগণ, ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ আম জনসাধারণ যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন’।[22]

রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্বীদা ও মাযহাব মুয়াসিরা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ নাছের বিন আবদুল করীম আল-আকল প্রণীত ‘আহলে সুনণাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচিতি’ নামক পুস্তকের তৃতীয় পরিচ্ছেদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এভাবে-

এক. তাঁরা হচ্ছেন নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ। যাঁরা সুন্নাতকে জেনেছেন, তাকে সংরক্ষণ করেছেন এবং তার উপর আমল করেছেন। রিওয়ায়াত ও দিরায়াতের মাধ্যমে তা (সুন্নাত) আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। কর্মনীতি ও কর্মসূচীর দিক হ’তে তাঁরাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রকৃত দাবীদার ও হকদার। কেননা তাঁরাই যুগ, আমল এবং ইলমের দিক দিয়ে সুন্নাতের নিকটবর্তী।

দুই. এরপর হচ্ছেন ছাহাবীদের অনুসারীগণ (তাবেঈগণ), যারা তাঁদের নিকট হ’তে দ্বীনকে গ্রহণ করেছেন, দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, সে অনুযায়ী আমল করেছেন এবং তা প্রচার করেছেন। তাঁরাই তাবেঈন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাবেঈদের অনুসারীগণ। তারাই হচ্ছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। তারা একে অাঁকড়ে ধরেছেন। এতে বিদ‘আত বা নতুন কিছু চালু করেননি। আর মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোন পথও অন্বেষণ করেননি।

তিন. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হচ্ছেন সালাফে ছালেহীন আহলুল কিতাব (আহলুল কুরআন) ওয়াস সুন্নাহ। রাসূল (ছাঃ)-এর হিদায়াতের উপর আমলকারী, ছাহাবা, তাবেঈ এবং বরেণ্য ওলামায়ে কেরামের পদাংক অনুসরণকারী, যারা দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত চালু করেননি বা তাতে কোন পরিবর্তন সাধন করেননি। আর দ্বীনে ইতিপূর্বে ছিল না এ ধরনের নতুন কোন পথ বা মত সৃষ্টি করেননি।

চার. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হচ্ছে ফিরক্বায়ে নাজিয়া বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁরাই আল্লাহর মদদপুষ্ট ও সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসাবে টিকে থাকবে।

পাঁচ. তারা হবে সংখ্যায় কম (অপরিচিত), যখন বিদ‘আত, কুসংস্কার বৃদ্ধি পাবে এবং যুগ খারাপ হবে তখনও তারা হক্বের উপরে থাকবে।

ছয়. তারা হচ্ছেন আছহাবে হাদীছ বা আহলুল হাদীছ; রেওয়ায়াত, দিরায়াত, ইলম এবং আমলের দিক থেকে।[23]

এছাড়াও ‘মুক্তিপাপ্ত দল কোন্টি’ এর পরিচয় দিতে গিয়ে মুহাদ্দিছগণ ‘আহলুল হাদীছ’দের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন-

(ক) আবদুল্লাহ ইবনুল মোবারক বলেন, هم عندى أصحاب الحديث ‘আমার নিকটে তাঁরা হ’ল হাদীছের অনুসারী বা আহলুল হাদীছ’।[24]

(খ) ইমাম বুখারীর (রহঃ)-এর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, هم أهل الحديث ‘তাঁরা হচ্ছেন আহলুল হাদীছ’।[25]

(গ) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, ‘যদি তারা আহলুল হাদীছ না হয়, তাহ’লে আমি জানি না তারা কারা’।[26] উল্লেখ্য যে, মাযহাব চতুষ্টয়ের তিন ইমামই আহলে

হাদীছ হিসাবে পরিচিত ছিলেন।[27]

(ঘ) ইয়াযীদ ইবনে হারূণ (১১৮-২১৭ হিঃ) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১হিঃ) বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ؟ ‘তাঁরা যদি আহলেহাদীছ না হন, তবে আমি জানি না তারা কারা’।[28] ইমাম বুখারীও এবিষয়ে দৃঢ়মত ব্যক্ত করেছেন’। ক্বাযী আয়ায বলেন, أَرَادَ أَحْمَدُ أَهْلَ السُّنَّةِ وَ مَنْ يَّعْتَقِدُ مَذْهَبَ أَهْلِ الْحَدِيْثِ ‘ইমাম আহমাদ (রহঃ) একথা দ্বারা আহলে সুন্নাত এবং যারা আহলুল হাদীছ-এর মাযহাব অনুসরণ করে, তাদেরকে বুঝিয়েছেন’।[29] ইমাম আহমাদ আরও বলেন, لَيْسَ قَوْمٌ عِنْدِىْ خَيْراً مِّنْ أَهْلِ الْحَدِيْثِ، لاَ يَعْرِفُوْنَ إِلاَّ الْحَدِيْثَ ‘আহলেহাদীছের চেয়ে উত্তম কোন দল আমার কাছে নেই। তারা হাদীছ ছাড়া অন্য কিছু চেনে না’।[30]

(ঙ) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) একদা তাঁর দরবার সন্মুখে কতিপয় আহলেহাদীছকে দেখে উল্লসিত হয়ে বলেন, مَا عَلَى الْأَرْضِ خَيْرٌ مِّنْكُمْ ‘ভূপৃষ্ঠে আপনাদের চেয়ে উত্তম আর কেউ নেই’।[31]

(চ) আহমাদ ইবনু সারীহ বলতেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الْفُقَهَاءِ لِاِعْتِنَائِهِمْ بِضَبْطِ الْأُصُوْلِ ـ ‘দলীলের উপরে কায়েম থাকার কারণে আহলেহাদীছগণের মর্যাদা ফক্বীহগণের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে।[32]

(ছ) ইমাম আবূদাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ) বলেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لَانْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يِعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ- ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’।[33]

(জ) ওছমান ইবনু আবী শায়বা একদা কয়েকজন আহলেহাদীছকে হয়রান অবস্থায় দেখে মন্তব্য করেন যে, إنَّ فَاسِقَهُمْ خَيْرٌ مِنْ عَابِدِ غَيْرِهِمْ ‘আহলেহাদীছের একজন ফাসিক্ব ব্যক্তি অন্য দলের একজন আবিদের চেয়েও উত্তম’।[34]

(ঝ) ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন,

مِنَ الْمَعْلُوْمِ لِكُلِّ مَنْ لَهُ خِبْرَةٌ أَنَّ أَهْلَ الْحَدِيْثِ مِنْ أَعْظَمِ النَّاسِ بَحْثًا عَنْ أَقْوَالِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ وَ طَلَبًا لِّعِلْمِهَا وَ أَرْغَبِ النَّاسِ فِىْ اِتِّبَاعِهَا وَ أَبْعَدِ النَّاسِ عَنِ اتَّبَاعِ هَوًى يُخَالِفُهَا … فَهُمْ فِىْ أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِىْ أَهْلِ الْمِلَلِ ـ

‘যার কিছুটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার এটা জানা কথা যে, আহলেহাদীছগণ হ’লেন, মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল­াহ (ছাঃ)-এর বাণীসমূহের ও তাঁর ইল্মের অধিক সন্ধানী ও সে সবের অনুসরণের প্রতি অধিক আগ্রহশীল এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হ’তে সর্বাধিক দূরে অবস্থানকারী, যার বিরোধীতা সে করে থাকে।… মুসলমানদের মধ্যে তাদের অবস্থান এমন মর্যাদাপূর্ণ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান’।[35]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কারা এ প্রশ্নের জবাবে শায়খ মুহাম্মদ বিন ছালিহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘আহলে সুনণাত ওয়াল জামা‘আত তারাই, যারা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরে থাকে ও তার উপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং অন্য কোন দিকে দৃষ্টি দেয় না। এ কারণেই তাদেরকে আহলে সুন্নাত রূপে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তাঁরা সুন্নাহর ধারক ও বাহক। তাদেরকে আহলে জাম‘আতও বলা হয়। কারণ তাঁরা সুন্নাহর উপর জামা‘আতবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ’।[36]

এ কথা পরিষ্কার যে, পরকালে মুক্তিপাপ্ত দলের অন্তর্গত হওয়ার জন্য কোন নামী-দামী দলের সদস্য হওয়া বা কোন নামকরা ইমামের অনুসারী হওয়া শর্ত নয়; বরং যথাযথভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করা শর্ত। সুতরাং যে দল বা সংগঠনের কথা রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের সাথে মিলে যায়, সে দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। পক্ষান্তরে কোন ইমাম বা দলের কথার সাথে যদি রাসূলের হাদীছের বৈপরিত্য পাওয়া যায়, তাহ’লে দল বা ইমাম যত বড়ই হোক না কেন সে ক্ষেত্রে রাসূলের হাদীছের অনুসরণ করাই ঈমানের দাবী। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

[1]. আহমাদ, নাসাঈ, হাকেম, মিশকাত হা/১৬৬; তাফসীরে ইবনে কাছীর সূরা আন‘আমের ১৫৩নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।

[2]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৫০১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৪, সনদ হাসান।

[3]. আহমাদ হা/১৬৯৭৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; মিশকাত হা/১৭২।

[4]. বুখারী হা/৩৯৯২; মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায় হা/১৯২০।

[5]. তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১৭২, সনদ ছহীহ, ‘কিতাব ও সুন্নাহ অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[6]. হাদীছটি যঈফ; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১৭৪-এর টিকা ‘ঈমান‘ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহ অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[7]. যঈফ ইবনু মাজাহ হা/৭৮৮; সিলসিলা যঈফা হা/২৮৯৬।

[8]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব ১৩/৩২২ পৃঃ; সনদ ছহীহ, তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১৭৩, ১/৬১ পৃঃ।

[9]. ড. নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আকল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচিতি, অনুঃ মুহাম্মদ শামাউন আলী, (ঢাকা : ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, জানুয়ারী ১৯৯৭), পৃঃ ৬৪।

[10]. মুসলিম হা/১৪৫; মিশকাত হা/১৫৯ ‘কুরআন ও সুন্নাহ অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[11]. ছহীহ তিরমিযী হা/২১২৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৪৮; হাকেম ১/১২৯; আহমাদ বিন হাম্বল, সুন্নাতের মূলনীতি, বাংলায় ইসলাম, (ইংল্যান্ড দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০০২), পৃঃ ২৪।

[12]. তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১ ‘কুরআন ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৪৮।

[13]. আবূ দাউদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪; আহমাদ হা/১৬৬৯৪; ইবনু খুযায়মা, ‘জুম‘আ’ অধ্যায় হা/১৭৮৫; মিশকাত হা/১৬৫; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৫৭।

[14]. মুসলিম, বাংলা মিশকাত ‘মানাসিক‘ অধ্যায় ‘বিদায় হজ্জের ভাষণ’ অনুচ্ছেদ, হা/২৪৪০।

[15]. বুখারী, ‘কিতাবুত তাফসীর’, সূরা হাশর, হা/৪৫১৮।

[16]. সুয়ুতী, আল-ইতক্বান ২/১২৬।

[17]. হাকেম ১/৯৩; মুওয়াত্ত্বা ‘কদর’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১৮৩।

[18]. আজুররী, কিতাবুশ শরী‘আত, পৃঃ ১২৩। গৃহীত : বায়হাক্বী আল-খুত্বাস সালীমাহ ফী বায়ানি উজুবি ইত্তিবাইস সুন্নাহ আল-ক্বারীমা, পৃঃ ৫।

[19]. শরহু উছুলিল ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, ১/৫৬; আল-খুত্বাস সালীমাহ ফী বায়ানি উজুবি ইত্তিবাইস সুন্নাহ আল-ক্বারীমা, পৃঃ ৬।

[20]. সুনানুদ দারেমী, মুক্বাদ্দামাহ, আছার নং ৯৬, সনদ ছহীহ।

[21]. আল-খুত্বাস সালীমাহ ফী বায়ানি উজুবি ইত্তিবাইস সুন্নাহ আল-ক্বারীমা, পৃঃ ৬।

[22]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন, ৫ম সংস্করণ, পৃঃ ১০।

[23]. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচিতি, পৃঃ ৮২-৮৩।

[24]. শায়খ মুহাম্মদ বিন জামিল, আল-ফিরকাতুন নাজিয়াহ, ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি’ অনুচ্ছেদ।

[25]. ঐ।

[26]. তিরমিযী, ফাৎহুল বারী, ১৩/৩০৬ হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।

[27]. মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, ইসলামী শরীয়াতের উৎস (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, আগষ্ট ১৯৯৪), পৃঃ ৬৯-৭১।

[28]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৬২৮৩ -এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬ হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা; শারফ, পৃঃ ১৫।

[29]. ফাৎহুল বারী ‘ইলম’ অধ্যায় ১/১৯৮ হা/৭১-এর ব্যাখ্যা।

[30]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৭।

[31] . শারফ, পৃঃ ২৮; আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন? পৃঃ ১৩।

[32]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল­ী: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬২ পৃঃ।

[33]. শারফ ২৯ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন? পৃঃ ১৩।

[34]. শারফ ২৭ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন? পৃঃ ১৩।

[35]. আহমাদ ইবনু তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯ পৃঃ।

[36]. ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, (ঢাকা : তাওহীদ পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৭), পৃঃ ৬০।

Translate