Wednesday, February 22, 2023

জুয়া এবং প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত কতিপয় জরুরি বিধি-বিধান

 জুয়ার পরিচয় ও ভয়াবহতা, অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ এবং প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত কতিপয় জরুরি বিধি-বিধান।

নিম্নে জুয়ার পরিচয়, ইসলামে এর নিষিদ্ধতা, অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার বিধান এবং প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত কতিপয় জরুরি মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল। وبالله التوفيق

❑ জুয়া কাকে?

জুয়া খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ বা বস্তু (যা পুরস্কার হিসেবে ধার্য করা হয়) নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনও একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হার-জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায় সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে।
এই খেলায় হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়াতে উভয় পক্ষেরই ঝুঁকি নিতে হয়। [ইউকিপিডিয়া বাংলা]

শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিরা রাহ. বলেন,

أن يؤخذ مال الإنسان وهو على مخاطرة : هل يحصل له عوضه أو لا يحصل

“জুয়া (قمار) বলা হয়, এমনভাবে মানুষের নিকট অর্থ গ্রহণ করা যে, সে তার বিনিময় পাবে নাকি না সে ব্যাপারে ঝুঁকিতে থাকে।” [মাজমুল ফাতাওয়া ১৯/২৮৩]

কোনও কোনও ফকিহের মতে, জুয়া হল,
كل لعب يشترط فيه أن يأخذ الغالب من المغلوب شيئا
“যে খেলায় এই শর্ত থাকে যে, বিজয়ী ব্যক্তি পরাজিত ব্যক্তি থেকে কোনও কিছু গ্রহণ করবে।” [almaany]

❑ জুয়া সম্পর্কে ইসলামের বিধান:

ইসলামে জুয়া জাহেলি কর্ম, কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ

“হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা এখন ও কি নিবৃত্ত হবে?” [সূরা মায়িদা: ৯০]

❑ জুয়ার নেতীবাচক প্রভাব:

জরীপে জানা গেছে প্রাথমিকভাবে যারা কেবল বিনোদনের জন্য জুয়া খেলা শুরু করেছিল তাদের অনেকেই এটাতে আসক্ত হয়ে গেছে।এই আসক্তি তাদের বিভিন্ন কুকর্মের দিকে ঠেলে দেয়। জুয়ার অর্থ জোগারের জন্য তারা খারাপ কাজ করতে শুরু করে। জুয়ায় হারানো অর্থ ফেরত পাবার জন্য জুয়ারীরা বারবার জুয়া খেলে। জুয়া ব্রেইনে মারাত্মক প্রভাব পরে, জুয়ারীরা চিন্তাগ্রস্থ ও অসহায়ত্ব অনুভব করে অসুস্থ হয়ে যায়।

❑ তিনটি প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়:

ইসলামে কোনও একপক্ষ বিজয়ী হলে পরাজিত পক্ষ থেকে অর্থ গ্রহণ করার পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতা করা হারাম। কারণ এটা হল, জুয়া। তবে তিনটি ক্ষেত্রে তা জায়েজ- যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথক উক্ত বিধান থেকে পৃথক করেছেন। তা হল,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا سَبَقَ إِلَّا فِي نَصْلٍ أَوْ حَافِرٍ أَوْ خُفٍّ

আবু হুরায়রা রা. সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তীর, ঘোড়া এবং উট ব্যতীত অন্য কোনও কিছুতে বাজি ধরা যাবে না।” (অর্থাৎ এ তিনটি বিষয় ছাড়া অন্য কোনও কিছুতে দু পক্ষের বাজি ধরার মাধ্যমে বিনিময় (অর্থকড়ি) অর্জন করা জায়েজ নয়)।[সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ২৮/ ঘোড়া, পরিচ্ছেদ: ১৪. প্রতিযোগিতা]

শাইখ উসাইমিন রাহ. বলেন,

سَبَقَ : بالفتح، السَّبَق هو العوض الذي يؤخذ عن المسابقة

السَّبَق (এর মধ্যাক্ষরে ফাতহ/যবর সহকারে, উচ্চারণ: সাবাক) শব্দের অর্থ: প্রতিযোগিতায় যে বিনিময় (অর্থকড়ি বা পুরষ্কার ইত্যাদি) গ্রহণ করা হয়।
তিনি উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন,
المسابقة فيها بعوض وأمّا غيرها فلا يجوز، وهذا الإستثناء استثناء مِن شبه الميسر أو من الميسر نفسه، لأنّ المسابقة إذا أُخذ عليها عوض صارت من الميسر، إذ أنّ الدّاخل فيها بين غانم وغارم وهذا هو حقيقة الميسر.
“এই তিনটি ক্ষেত্রে বিনিময় ((অর্থকড়ি বা পুরষ্কার ইত্যাদি)এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করা জায়েজ। কিন্তু এ তিনটি ছাড়া অন্য কোনও ক্ষেত্রে তা জায়েজ নয়। এটি হল, ব্যতিক্রম, এটি জুয়ার সদৃশ বা মূল জুয়া থেকে ব্যতিক্রম। কারণ প্রতিযোগিতায় যদি বিনিময় গ্রহণ করা হয় তাহলে তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। কারণ এখানে প্রতিযোগী হয় আর্থিকভাবে লাভবান হবে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এটাই হল, জুয়ার প্রকৃত রূপ।”

তিনি আরও বলেন,
أنّه أبيح أبيح لأنّ ذلك ممّا يعين على الجهاد في سبيل الله، فالإبل تحمل أمتعة المجاهدين وأسلحتهم وتحمل المجاهدين أيضا
والنّصل يرمي به المجاهد فيدافع عن نفسه ويهاجم عدوّه.
وأمّا الحافر فكذلك يكرّ عليه ويفرّ، فهو ممّا ينتفع به في الحرب في الجهاد في سبيل الله.
“এটা জায়েজ হওয়ার কারণ হল, এগুলোর মাধ্যমে মুজা/হিদগণ আল্লাহর পথে জিহাদে উপকৃত হয়। কারণ উট মু-জাহি/দদের আসবাব-সামগ্রী ও অস্ত্র-শস্ত্র বহন করে। মুজা/হিদদেরকেও বহন করে। তীরের সাহায্য মুা/জাহিদ তী/র নিক্ষেপের পাশাপাশি আত্মরক্ষা করে এবং শত্রুর উপর আ/ক্রমণ পরিচালনা করে। আর ঘোড়া শত্রুর উপর আঘাত হেনে পালিয়ে যায়। যার মাধ্যমে রণা/ঙ্গনে আল্লাহর পথে জিহা/দের ক্ষেত্রে লাভবান হওয়া যায়।”
[উৎস: alathar-শাইখ উসাইমিন রাহ. কর্তৃক বুলুগুল মারামের ব্যাখ্যা, কিতাবুল জি/হাদ (৮ম অধ্যায়)]

❑ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের বিধান এবং এ বিষয়ে কতিপয় ফতোয়া:

শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রাহ.-এর সংজ্ঞার আলোকে যদি কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য (রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ) নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের শর্তারোপ করা হয় তাহলে সে অর্থ লেনদেন নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং তা হারাম।
কারণ অংশগ্রহণকারীরা এখানে ঝুঁকিতে থাকবে যে, সে তার প্রদান কৃত অর্থের বিনিময় ফেরত পাবে কি না। কেননা এতে বিজয়ী হবে হাতে গোণা কয়েকজন। এতে তারা পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে লাভবান হবে। কিন্তু অন্যান্য অর্থ প্রদানকারীরা নিশ্চিতভাবেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ বিষয়ে নিম্নে কতিপয় ফতোয়া প্রদান করা হল:

◈ ১. আহকামুল জাওয়ায়েয ওয়াল মুসাবাকাত (পুরস্কার ও প্রতিযোগিতার বিধিবিধান), লেখক: প্রফেসর ডক্টর খালিদ আল মুশাইকিহ বলেন,

النوع الأوَّل: أن تكون الجائزةُ عن طريق دفْع رسوم للدُّخول في المسابقة وهذا النَّوْع من الميسِر المحرَّم

“১ম প্রকার হল, প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য ফি প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কার দেওয়া হলে এই প্রকার প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।” [আহকামুল জাওয়ায়েয ওয়াল মুসাবাকাত, প্রথম প্রকাশ, প্রকাশকাল ১৪৩৪ হিজরি-দাম্মাম, সৌদি আরব]

◈ ২. সৌদি আরবের হাইয়াতুল কিবারিল ওলামা বা সিনিয়র স্কলারস এসোশিয়েশন-এর সদস্য ডক্টর শাইখ নাসের বিন সাদ আস শিসরি বলেন,

المسابقات التي يدفع جميع المتسابقين رسماً لدخولها وتكون الجائزة محددة سلفاً قبل الدخول وقبل العلم بعدد المتسابقين لا يجوز الدخول فيها بالإجماع

“যে প্রতিযোগিতায় সকল প্রতিযোগী অংশগ্রহণের জন্য একটা ফি প্রদান করে এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং প্রতিযোগীদের সংখ্যা জানার আগেই পুরস্কারটি পূর্ব-নির্ধারিত থাকে তাহলে ইজমা বা আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তাতে অংশগ্রহণ করা জায়েজ নয়।” [উৎস: midad-৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর]

◈ ৩. কাতার ভিত্তিক ফতোয়া বিষয়ক ওয়েব সাইটের ফতোয়া:

প্রশ্ন: একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শারীরিক কসরত মূলক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয় এবং এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এই টাকা নেয়। এই অর্থ গ্রহণ কি জায়েজ নাকি হারাম?
উত্তর:
فإن صورة هذه المسابقة هي صورة القمار الذي عرَّفه أهل العلم بقولهم: “دخول شخص في أمر يتردد فيه بين الغرم والغنم “والداخل في هذه المسابقة إما أن يخسر ما دفعه إذا فشل وسُبق، أو يربح ما دفعه ودفعه غيره من المتسابقين إذا سَبق وعليه؛ فإن هذا المال المأخوذ بهذه الطريقة حرام

“এই প্রতিযোগিতার পদ্ধতিটি জুয়ার পদ্ধতি। জুয়ার ব্যাপারে আলেমগণ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন এভাবে যে, জুয়া হল, একজন ব্যক্তি এমন বিষয়ে অংশ গ্রহণ করবে যেখানে সে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলে লাভবান হবে আর পরাজিত হলে লোকসানের শঙ্কার মধ্যে থাকে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি হয় যে অর্থ প্রদান করেছিলো তা হারাবে যদি সে পরাজিত হয়। অথবা সে তার এবং অন্যান্য প্রতিযোগীদের প্রদত্ত অর্থ পেয়ে লাভবান হবে যদি সে বিজয়ী হয়। সুতরাং এ পদ্ধতিতে গৃহীত অর্থ হারাম।

অন্যত্র বলা হয়েছে,
والحاصل أنه لا يجوز أن يدفع الإنسان شيئا مقابل اشتراكه في مسابقة قد يربح فيها وقد يخسر ، وهو آثم سواء ربح أم خسر، وننصح القائمين على مثل هذه المسابقات من المسلمين أن يتقوا الله في أنفسهم ، ويكفوا عن الترويج لمثل هذه المسابقات المحرمة، وأن يبحثوا عن أساب مشروعة لتنمية مواردهم
“উপসংহার হল যে, কোনও ব্যক্তির জন্য এমন কোনও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বিনিময়ে কোনও কিছু প্রদান করা জায়েজ নয় যাতে সে জিততে পারে বা হারতে পারে। সে জিতুক বা হারুক উভয় অবস্থায় সে গুনাহগার হবে।” [islamweb]

সুতরাং যদি কোনও প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের নিকট নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ গ্রহণের শর্তারোপ করা হয় (যাকে রেজি. ফি বলা হয়)-যা প্রদান ব্যতিরেকে কেউ তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না তাহলে এ জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং সেগুলোতে অংশ গ্রহণ করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। কারণ তা জুয়া। আর আল্লাহ তাআলা কুরআনের জুয়াকে মদের সাথে যুক্ত করে নাপাক এবং শয়তানের কর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।

❑ প্রতিযোগিতায় যে কোনও পক্ষের দান গ্রহণ করা জায়েজ:

কোনও প্রতিযোগিতায় যদি দান বা উপহার হিসেেব প্রতিযোগীদের মধ্যে থেকে কেউ বা তৃতীয় কোনও পক্ষ (স্পন্সর) বিজয়ীকে উৎসাহিত করার জন্য অর্থ বা পুরস্কার সামগ্রী প্রদান করে তাহলে তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং তা জায়েজ। কারণ এখানে প্রতিযোগীদের কেউ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

শাইখ জিবরিন রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়:

প্রশ্ন: সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের একজনের পক্ষ থেকে অথবা সকলের পক্ষ থেকে অথবা বাইরের অন্য কোনও পক্ষ থেকে বিনিময় গ্রহণ করার বিধান কী?

তিনি উত্তরে বলেন,

اذا كانت هذه المسابقة مفيدة للمتسابقين يكتسبون منها علماً نافعاً وسعة اطلاع، وفوائد دينية أو ثقافية، جاز أخذ العوض فيها، سواء كان ذلك العوض من المتسابقين أو أحدهما أو من غيرهما. والله أعلم

“যদি এই প্রতিযোগিতা প্রতিযোগীদের জন্য উপকারী হয়-যাতে তারা উপকারী ইলম অর্জন, ব্যাপক জানাশোনা এবং দীন বা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে লাভবান হয় তাহলে তাতে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ। চাই তা প্রতিযোগীদের নিকট থেকে নেওয়া হোক অথবা তাদের কোনও একজন থেকে নেওয়া হোক অথবা অন্য কারও নিকট থেকে নেওয়া হোক।” [cms.ibn-jebreen]

➧ দৃষ্টি আকর্ষণী:

কেউ কেউ শাইখ জিবরিন রাহ.-এর উক্ত ফতোয়াটিকে প্রতিযোগীর নিকট থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য আবশ্যিকভাবে প্রদেয় ‘রেজিস্ট্রি ফি’ গ্রহণের পক্ষে উপস্থাপন করছে।
কিন্তু তা তাদের বুঝার ভুল। কারণ ফতোয়ার উদ্দেশ্য হল, কোন উপকারী বা দীনী ইলমি বিষয়ক প্রতিযোগিতায় যদি প্রতিযোগীদের একজন কিংবা সকলের পক্ষ থেকে অথবা তৃতীয় কোন পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতার বিনিময় (পুরস্কার সামগ্রী বা পুরস্কার বাবদ অর্থ) নেওয়া হয় তাহলে তা জায়েজ। অর্থাৎ এক্ষেত্রে যদি প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে কেউ একজন অথবা সকলে মিলে অথবা তৃতীয় কোনও পক্ষ (স্পন্সর) প্রতিযোগিতার বিনিময় বা পুরস্কার দান করে তাহলে সেটা গ্রহণ করা জায়েজ আছে।

এখানে ‘দান’ উদ্দেশ্য না হলে একজন ব্যক্তি ও তৃতীয় পক্ষের প্রসঙ্গ আসতো না।

মোটকথা, প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে কেউ একজন অথবা তৃতীয় কোনও পক্ষ যদি প্রতিযোগীদের পুরস্কার বাবদ সমূদয় অর্থ ও ব্যয়ভার বহন করে তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নেই। এমনকি সকল প্রতিযোগীও সম্মিলিতভাবে যদি এই ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেয় তাতেও কোনও সমস্যা নেই।

শাইখের ফতোয়ায় প্রতিযোগীর নিকট আবশ্যিকভাবে গৃহীত ফি (যা রেজিস্ট্রেশন বাবদ নেওয়া হয়) সম্পর্কে বক্তব্য নেই। এটা ফতোয়ার উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং উক্ত ফতোয়া ভুল অর্থে গ্রহণ করার সুযোগ নাই।

➧ উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইসলামি সংগঠন, সামাজিক ক্লাব ইত্যাদি কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকদের জন্য যে সব প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে এবং তারা নিজেদের পক্ষ থেকে পুরস্কারের আয়োজন করে এতে অংশ গ্রহণ করায় কোনও সমস্যা নেই। (যদি প্রতিযোগিতায় অন্য কোনও হারামের সংশ্লিষ্টতা না থাকে)। কারণ এখানে প্রতিযোগীদের নিকট থেকে কোনও অর্থকড়ি নেওয়া হয় না। ফলে বিজয়ী হলেও কোনও প্রতিযোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

❑ পুরস্কার ছাড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনে ব্যয়ভার উত্তোলনের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগীদের নিকট থেকে অর্থ নেওয়া জায়েজ?

প্রশ্ন: রেজিস্ট্রেশন ফ্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই যদি পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয় সেটা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এরকম একটি আয়োজন করতে পুরস্কারের অর্থ ছাড়াও একটা বড় ধরনের অর্থের প্রয়োজন হয়। যেমন: প্রচার-প্রচারণা, প্রশ্নপত্র তৈরি করা ইত্যাদি। তাছাড়া এসব কাজে বহু লোকবল খাটানোর প্রয়োজন পড়ে। সে দিক বিবেচনায় ন্যূনতম একটি রেজিস্ট্রেশন ফি ধরা হলে তাও কি হারামের মধ্যে গণ্য হবে?
উত্তর: কেউ যদি এহেন ইসলামি জ্ঞান চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তার উদ্দেশ্যে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অংশ গ্রহণ করে (স্পন্সর করে) তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই। চাই তা পুরস্কারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হোক অথবা প্রতিযোগিতার অন্যান্য খরচের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা হোক। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ‘আবশ্যিক শর্ত’ হিসেবে রাখা জায়েজ নেই। এটাকে আলিমগণ ‘জুয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এক্ষেত্রে কেবল হাতেগোনা কতিপয় ব্যক্তি বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে লাভবান হবে আর বেশিরভাগ প্রতিযোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

❑ প্রশ্ন: রেজিস্ট্রেশন ফি না নিলে মানুষ অমনোযোগী হয়ে রেজিস্ট্রেশন করে এবং ঠিক মত স্টাডি না করেই এমনিতেই এক্সামে অংশগ্রহণ করবে। এ যুক্তিতে কি রেজি. ফি নেওয়া যাবে?
উত্তর: যার জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ঘোষিত পুরস্কার অর্জন করতে চায় তারা অবশ্যই পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়েই অংশগ্রহণ করবে। কিছু মানুষ হয়তো এমনিতেই অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু তা তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি আগামীতে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা হবে ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু এ যুক্তিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য অর্থ প্রদানকে ‘আবশ্যিক শর্ত’ করা যাবে না। কেননা এটি নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত বলেই বিজ্ঞ আলেমগণ উল্লেখ করেছেন-যেমনটি আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি।

❑ প্রতিযোগীদের কেউ যদি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাহলে তা জায়েজ:

প্রশ্ন: কোন ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় যদি সকলে মিলে সমান টাকা দেয় এবং ফাইনালে বিজয়ী প্রতিযোগীগণ সহ অংশগ্রহণকারী সবাই মিলে জমা কৃত টাকা দিয়ে সম্মিলিত খাবারের আয়োজন করে এবং উভয় পক্ষের সকলে মিলে সে খাবার খায় তাহলে এতে কি কোনও সমস্যা আছে?
বি.দ্র. কারো জন্য অতিরিক্ত কোন প্রাইজ মানি বা পুরস্কার নেই। শুধু সকলে মিলে প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে খাবার খাওয়া হবে।
উত্তর: এটা নাজায়েজ নয়। কারণ এখানে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং যারা টাকা দিয়েছে তারা সকলেই (বিজয়ী এবং পরাজিত উভয় পক্ষ) নিজেদের টাকার বিনিময়ে খাবার খাচ্ছে। সুতরাং এটা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে এই খেলার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়ত যেন লঙ্ঘিত না হয় বা অন্য কোন হারাম কাজ সংগঠিত না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

আলি রা. কে ঘুমানোর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কর্তৃক পাঁচটি উপদেশ সংক্রান্ত হাদিসটি বানোয়াট

 প্রশ্ন: নিম্নোক্ত বর্ণনাটি সহিহ?

“একদিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলি রা. কে বললেন, “প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৫টি কাজ করবে। যথা:
১. ৪ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) সদকা করবে।
২. একবার কুরআন খতম করবে।
৩..জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করবে।
৪..দু জন ব্যক্তি যদি দু জনের উপর রাগ করে থাকে তাইলে সেই রাগ ভাঙ্গিয়ে তাদেরকে খুশি করে তুলবে।
৫. একবার হজ করবে। তারপর ঘুমাতে যাবে।
আলি রা. তখন বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, এটা তো মনে হচ্ছে অসম্ভব। আমি এই পাঁচটি কাজ কীভাবে করতে পারবো?
তখন নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

১. “সূরা ফাতিহা ৪ বার পড়লেই চার হাজার দিনার সদকা করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।
২. সূরা ইখলাস ৩বার পড়লে একবার কুরআন খতমের সাওয়াব পাবে।
৩. তিনবার যেকোনো একটি দরুদ শরিফ পড়বে, তাহলে জান্নাতের মুল্য পরিশোধ করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যাবে। (যেমন: সবচেয়ে ছোট দরুদ শরীফ হচ্ছে, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
৪. যেকোনো ইস্তাগফার বা আস্তাগফিরুল্লাহ ১০ বার পাঠ করলে দু জন অখুশি মানুষকে খুশি করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।
৫. সর্বশেষ কালেমা শাহাদত চারবার পাঠ করলে একটি হজ সমপরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যাবে।

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: এই জাতীয় একটা হাদিস (কিছু শব্দের কম-বেশি সহকারে) ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত। তা বিভিন্ন ফজিলতের কিতাবেও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় দীনের গভীর জ্ঞান নেই এমন কিছু মসজিদের ইমাম, খতিব ও বক্তার মুখেও তা শোনা যায়। এ কথাগুলো আমাদের দেশে রঙ্গিন পোস্টার আকারে বাজারে কিনে পাওয়া যায়। কোনো কোনো বাড়ির দেওয়ালেও তা ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার। অর্থাৎ এটি একটি বানোয়াট হাদিস।

◾সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন:
هذا الحديث لا أصل له ، بل هو من الموضوعات ، من كذب بعض الشيعة كما نبَّه على ذلك أئمَّة الحديث .
” فتاوى اللجنة الدائمة ” ( 4 / 462 ، 463 )

“এই হাদিসটির কোন ভিত্তি নেই। বরং তা কতিপয় শিয়াদের মিথ্যাচার ও বানোয়াট হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। যেমনটি এ ব্যাপারে হাদিসের ইমামগণ সতর্ক করেছেন।” [ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ, ৪/৪৬২ ও ৪৬৩]

◾সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রহ. বলেন,
هذا باطل، مكذوب على الرسول ﷺ قد نبهنا على هذا أكثر من مرة، مكذوب، ولكن هذه الأذكار طيبة، الإنسان يقولها، طيبة يذكر الله، ويقرأ القرآن طيب، لكن هذا مكذوب على الرسول ﷺ الكلام هذا.
“আমরা এ বিষয়ে একাধিকবার সতর্ক করেছি যে, এটি একটি ভ্রান্ত কথা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার। তবে এই সকল জিকির-আজকারগুলো ভালো। মানুষগুলো এসব জিকির পাঠ করবে। জিকির করা ভালো। কুরআন তেলাওয়াত করা ভালো। কিন্তু উপরোক্ত কথাগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার।” [Binbaz]

◾ বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সালেহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,
هذا الحديث الذي ذكره أن النبي صلى الله عليه وسلم أوصى علي بن أبي طالب رضي الله عنه بهذه الوصايا : كذب موضوع على النبي صلى الله عليه وسلم ، لا يصح أن يُنسب إلى الرسول صلى الله عليه وسلم
“যে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিয রা.কে এ সকল উপদেশ দিয়েছেন তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যাচার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম-এর দিকে তা সম্বন্ধ করা ঠিক নয়।” [ফাতাওয়া ইসলামিয়া ৪/১১১]
অথচ বহু হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে জেনে-বুঝে মিথ্যাচার করাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে সতর্ক করা হয়েছে। [সহিহ বুখারি]
إنَّ كَذِبًا عَلَيَّ ليسَ كَكَذِبٍ علَى أَحَدٍ، مَن كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

কেউ যদি এই বানোয়াট হাদিস অনুযায়ী আমল করে তাহলে তা বিদআত (দীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বিষয়) হিসেবে পরিগণিত হবে। আর প্রতিটি বিদআতি আমল প্রত্যাখ্যাত হবে। [সহিহ বুখারী] শুধু তাই নয়, বিদআতি ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারের পানি পান করা‌ থেকে বিতাড়িত করা হবে। [সহিহ বুখারি]

সুতরাং এই সকল ভ্রান্ত, বাতিল ও হাদিসের নামে মিথ্যা কথাবার্তা মুসলিম সমাজে প্রচার করা জায়েজ নেই।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ধর্মের নামে সব ধরনের ভ্রান্ত, বাতিল এবং বিদআতি কথাবার্তা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

প্রতিবেশীর হক

 প্রশ্ন: ইসলামে প্রতিবেশীর হকগুলো কী কী?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ মর্মে কুরআন-সুন্নাহ তাদের প্রতি করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের কতিপয় হক অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল:
১) তাকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।
২) সে কষ্ট দিলে যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করা।
৩) তার প্রতি দয়া ও বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করা।
৪) তাকে সম্মান করা।
৬) বিপদাপদে সাহায্য করা।
৭) তার সাথে যথাসম্ভব বিবাদে লিপ্ত না হওয়া।
৮) রোগ-ব্যাধিতে দেখতে যাওয়া বা প্রয়োজনীয় সেবা করা।
৯) দেখা হলে হাসি মুখে কথা বলা।
১০) সালাম বিনিময় করা।
১১) মারা গেলে কাফন-দাফন ও জানাজায় অংশ গ্রহণ করা।
১২) কেউ তার ক্ষতি করতে চাইলে যথাসম্ভব তাকে প্রতিহত করা।
১৩) তার সাথে ভালবাসা পূর্ণ সম্পর্ক রাখা।
১৪) ক্ষতিকর কিছু ঘটলে যথাসাধ্য সাহায্য করা ও সমবেদনা জানানো।
১৫) তার খুশিতে শরিক হওয়া।
১৬) মাঝে-মধ্যে তার বাড়িতে উপহার পাঠানো।
১৭) তার মাঝে শরিয়ত বিরোধী কিছু দেখলে তাকে আন্তরিকভাবে নসিহত করা।
১৮) দীনী বিষয়ে না জানলে জ্ঞানদান করা।
১৯) কাফির হলে দীনের দাওয়াত দেওয়া।
২০) তার মধ্যে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখলে তা লোক সম্মুখে প্রকাশ না করা এবং যথাসাধ্য গোপনে সংশোধন করার চেষ্টা করা ইত্যাদি।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

বিড়াল সংক্রান্ত একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর

 ◾সালাতরত অবস্থায় সামনে দিয়ে বিড়াল চলাচল করা:

প্রশ্ন: আমার একটা পালিত বিড়াল আছে। যখন আমি কোন সময় ঘরে একাকী নামাজ আদায় করি তখন বিড়ালটা জায়নামাজের উপর শুয়ে-বসে থাকে এবং সামনে দিয়ে হাঁটা-চলা করে। এতে কি আমার নামাজের কোন ক্ষতি হবে?
উত্তর: সালাতের সময় বিড়াল সামনে দিয়ে চলাফেরা করলে বা তা গায়ের সাথে লাগলেও সালাতের কোন ক্ষতি হবে না। কেননা বিড়াল পবিত্র প্রাণি। তবে যদি নাপাক বস্তুর উপর দিয়ে চলাফেরা করার কারণে তার পায়ে নাপাক বস্তু লেগে থাকে তাহলে ঐ অবস্থায় জায়নামাজে চলাফেরা করলে তাতে নাপাকি লেগে তা নাপাক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং এ বিষয়ে সতর্কতা কাম্য। তাছাড়া সালাতের সামনে দিয়ে বিড়াল চলাফেরা করলে সালাতে মনোযোগ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সম্ভব হলে বিড়ালকে ঘর থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে সালাত আদায় করবেন।
আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।

প্রশ্ন: কুরআন পড়ার সময় আমাদের বিড়ালটি কুরআনের উপর দিয়ে যায় এবং কুরাআনের উপর পা দিয়ে লাফ দেয়। এতে কি আমার গুনাহ হবে? এখন আমার করণীয় কী?
উত্তর: যদি আপনার অসতর্ক অবস্থায় বিড়াল কুরআনের উপর দিয়ে পা দিয়ে অতিক্রম করে তাহলে ইনশাআল্লাহ আপনার কোনও গুনাহ হবে না। তবে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন যেন, বিড়াল সে সুযোগ না পায়। কোনভাবেই যেন দয়াময় আল্লাহর বাণী মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সম্মানহানি না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য। তবে এজন্য কোন কাফফারা আদায় অথবা আলাদা কোন কিছু করার প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন: বিড়ালের মুখ দেওয়া খাবার খাওয়া কি জায়েজ আছে?
উত্তর: বিড়াল পবিত্র প্রাণি। সুতরাং বিড়াল যদি খাদ্য-পানীয়তে মুখ দেয় তাহলে তা নাপাক হবে না। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ كَبْشَةَ بِنْتِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ- وَكَانَتْ تَحْتَ ابْنِ أَبِي قَتَادَةَ – أَنَّ أَبَا قَتَادَةَ، دَخَلَ فَسَكَبَتْ لَهُ وَضُوءًا، فَجَاءَتْ هِرَّةٌ فَشَرِبَتْ مِنْهُ، فَأَصْغَى لَهَا الإِنَاءَ حَتَّى شَرِبَتْ، قَالَتْ كَبْشَةُ: فَرَآنِي أَنْظُرُ إِلَيْهِ، فَقَالَ: أَتَعْجَبِينَ يَا ابْنَةَ أَخِي؟ فَقُلْتُ: نَعَمْ ‏.‏ فَقَالَ: إِنَّ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ إِنَّهَا لَيْسَتْ بِنَجَسٍ إِنَّهَا مِنَ الطَّوَّافِينَ عَلَيْكُمْ وَالطَّوَّافَاتِ ‏”‏

কাবশা বিনতে কাব ইবনে মালিক সূত্রে বর্ণিত। তিনি ছিলেন আবু কাতাদা রা. এর পুত্রবধূ। তিনি বলেন, একদা আবু কাতাদা (বাহির থেকে) আসলে আমি তার জন্য অজুর পানি দিলাম। এমন সময় একটি বিড়াল এসে তা থেকে পানি পান করতে লাগল। আবু কাতাদা বিড়ালের জন্য পাত্রটি কাত করে ধরলেন। ফলে বিড়ালটি তৃপ্তি সহকারে পান করল। কাবশা বলেন, আবু কাতাদা দেখলেন, আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি বললেন, হে ভাতিজী, তুমি কি আশ্চর্যবোধ করছ? আমি বললাম, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “বিড়াল নাপাক নয়। এরা তোমাদের আশেপাশে বিচরণকারী প্রাণি।”
[তিরমিযী, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: বিড়ালের উচ্ছিষ্ট সম্পর্কে, হা/৯২, সনদ হাসান]
অতএব বিড়ালের মুখ দেওয়া খাদ্যদ্রব্য খেতে আপত্তি নেই। অবশ্য তার মুখে ময়লা বা নাপাক কোন কিছু লেগে থাকলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে ময়লা বা নাপাকি দূর করে বাকি খাবার খাওয়া জায়েজ আছে যদি রুচি হয়। অন্যথায় ফেলে দেবে। তবে মুখে নাপাক বস্তু লেগে থাকা অবস্থায় তরল পানীয় দ্রব্য (যেমন: দুধ) আছে এমন পাত্রে মুখ দিলে তা পুরোটাই ফেলে দিতে হবে। কারণ তাতে মুখ দেওয়ার সাথে সাথে নাপাকি তরল পানীয়ের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

◾বিড়াল নাপাক প্রাণি নয় তবে তার পেশাব-পায়খানা নাপাক:

প্রশ্ন: আমরা জানি, ‌বিড়াল নাপাক প্রাণি নয়। তাহলে বিড়াল যদি পোশাকে প্রস্রাব করে দেয় তাহলে সেই পোশাকে সালাত আদায় করা যাবে কী?
উত্তর: বিড়াল বাহ্যিকভাবে পবিত্র। অর্থাৎ যদি শরীর বা পোশাকের সাথে বিড়ালের স্পর্শ লাগে তাহলে তা নাপাক হবে না। অনুরূপভাবে যদি সে খাবার বা পান পাত্রে মুখ দেয় তাহলেও তা নাপাক হবে না। কারণ এ ব্যাপারে একাধিক হাদিস রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওজুর পাত্র থেকে বিড়ালকে পানি পান করিয়ে অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওজু করেছেন এবং বলেছেন,
إِنَّهَا لَيْسَتْ بِنَجَسٍ إِنَّهَا مِنَ الطَّوَّافِينَ عَلَيْكُمْ وَالطَّوَّافَاتِ
“বিড়াল নাপাক প্রাণি নয়। এটা তোমাদের আশেপাশে বিচরণকারী।”
[তিরমিযী, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: বিড়ালের উচ্ছিষ্ট সম্পর্কে, হা/৯২, সনদ হাসান]
কিন্তু তার গোশত খাওয়া হারাম।‌ কারণ তা হিংস্র প্রাণির অন্তর্ভূক্ত।
আর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي، ثَعْلَبَةَ قَالَ نَهَى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَنْ أَكْلِ كُلِّ ذِي نَابٍ مِنَ السَّبُعِ
আবু সালাবা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিংস্র পশু খেতে নিষেধ করেছেন।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন),‌ অধ্যায়: ৩৫/ শিকার ও জবেহকৃত জন্তু এবং যে সব পশুর গোশত খাওয়া হালাল, পরিচ্ছেদ: ৩. হিংস্র পশু ও নখরওয়ালা পাখি খাওয়া হারাম]
আর ইসলামের মূলনীতি হল, যে প্রাণির গোস্ত খাওয়া হারাম তার পেশাব-পায়খানাও নাপাক। (অধিক বিশুদ্ধ মতে)। সুতরাং বিড়ালের পেশাব-পায়খানা কাপড় বা শরীরে লাগলে তা নাপাক হয়ে যাবে। যেমন: মানুষ বাহ্যত পবিত্র কিন্তু তার পেশাব-পায়খানা অপবিত্র।
তাই যে পোশাকে বিড়ালের পেশাব লেগেছে তা ধৌত করা জরুরি। অন্যথায় উক্ত পোশাকে সালাত সহিহ হবে না।
আল্লাহু আলাম।

◾ বিড়ালের ক্ষয়-ক্ষতি থেকে বাঁচতে তা হত্যা করার বিধান:

প্রশ্ন: আমাদের বাড়িতে আমরা কবুতর পালন করি। কিন্তু বেশ কিছুদিন থেকে বিড়াল কবুতরের ডিম এবং বাচ্চা সব কিছুই খেয়ে ফেলছে। কিছুতেই বিড়ালকে থামানো যাচ্ছে না। সুযোগ পেলেই ডিম এবং বাচ্চা সবই খেয়ে নিচ্ছে। এমনকি বড় কবুতরকেও তাড়া করছে। এ অবস্থায় আমরা কি বিড়ালকে মারার কোন ব্যবস্থা করতে পারি?
উত্তর: বিড়ালকে না মেরে যদি অন্য কোন পদ্ধতিতে কবুতরের বাচ্চা ও কবুতর রক্ষা করা সম্ভব হয় তাহলে সে চেষ্টা করা উচিত। যদি দূরে কোথাও ফেলে আসা সম্ভব হয় তাও করা যেতে পারে। কিন্তু এতে কাজ না হলে তখন তার ক্ষতির হাত থেকে আত্মরক্ষার স্বার্থে মেরে ফেলা জায়েজ আছে। মোটকথা, যদি কোন পশু বা জীবজন্তু মানুষের ক্ষতি করে তাহলে তার ক্ষতির হাত থেকে আত্মরক্ষার বিকল্প কোন পথ না থাকলে তাকে হত্যা করা জায়েজ।
সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায ক্ষতিকর বিড়াল সম্পর্কে বলেন,
إذا تيسر طرده وإبعاده وتخويفه حتى يبتعد فلا يقتل فإذا اضطر الإنسان إلى قتل القط لإيذائه، وعدم التخلص منه بغير ذلك، فلا بأس لكن بغير النار
“যদি তাকে তাড়িয়ে দেওয়া বা দূরে ফেলে দেওয়া অথবা ভয়-ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে হত্যা করা যাবে না। কিন্তু যদি তার ক্ষয়ক্ষতির জন্য হত্যা করা আবশ্যক হয়ে যায় এবং এছাড়া বাঁচার কোন বিকল্প না থাকে তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু আগুন দিয়ে হত্যা করা যাবে না।” [Binbaz]

◾কাঠবিড়ালির ক্ষয়-ক্ষতি থেকে বাঁচতে তা হত্যা করা:

প্রশ্ন: কাঠবিড়ালি মারা কি জায়েজ? উল্লেখ্য, কাঠবিড়ালি আমাদের বাড়ির গাছের পেয়ারা, ডাব সহ আরো বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে ফেলছে।
উত্তর: প্রথমত: যদি হত্যা না করে বিকল্প পন্থায় কাঠবিড়ালির ক্ষয়-ক্ষতি থেকে ফল-ফসল রক্ষা করা সম্ভব হলে তাই করা উচিৎ। কিন্তু যদি বিকল্প কোনভাবেই তার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব না হয় তখন হত্যা করা জায়েজ আছে।

◾রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিড়াল প্রসঙ্গে প্রচলিত ভিত্তিহীন কথা:

প্রশ্ন: “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুয়েজ্জা নামে একটা বিড়াল ছিল এমন কিছু কথা কেউ কেউ বলে থাকে। সাথে এ বিষয়ে বেশ বিভিন্ন ঘটনাও বলে। কিন্তু মনে হয় না সেগুলো সত্য। যাই হোক, এই সম্পর্কে আপনার মতামত আশা করছি।
উত্তর: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনও বিড়াল পালতেন বলে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায় না। যেমন: কাতার ভিত্তিক বিখ্যাত ফতোয়ার ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে,
لم يثبت فيما نعلم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم اتخذ قطة، فضلاً عن اصطحابها للصلاة
“আমাদের জানামতে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিড়াল প্রতিপালন করেছেন বলে প্রমাণিত হয়নি, সাথে করে সালাতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তো আরও দূরের কথা।” [Islamweb]
তবে বহু হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বিড়াল ভালোবাসতেন এবং বিড়ালকে পবিত্র প্রাণি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (যেমন উপরে উল্লেখিত হাদিস সমূহ)।

প্রশ্ন: আমাদের নবী‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কি কোন পোষা বিড়াল ছিল যার নাম মুয়েজ্জা?
উত্তর: এটি‌ ভিত্তিহীন কথা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কোন বিড়াল পুষতেন না। এই নামে তার কোন বিড়াল ছিল না। তবে তিনি বিড়াল ভালবাসতেন। এবং তিনি বিড়ালকে পবিত্র প্রাণি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার ওজুর পাত্র থেকে পিপাসার্ত বিড়ালকে পানি পান করিয়ে পরে ওই পানি দ্বারাই ওজু করেছেন। (দেখুন উপরে উল্লেখিত হাদিস সমূহ), এক মহিলা খাঁচায় একটি বিড়ালকে বন্দি রেখেছিলো। এবং তাকে খাদ্য-পানীয় থেকে বঞ্চিত করে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার অপরাধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিণতি জাহান্নাম বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

যার নাম টান সমিতি: ইসলামি বিধান

 প্রশ্ন: আমাদের এলাকায় কিছু মহিলা প্রতি সপ্তাহে একটি খেলা খেলে। খেলাটি হল, ধরুন দশ জন মহিলা ১০০ টাকা করে জমা দিবে। তাহলে সপ্তাহে জমা হবে, ১০০০ টাকা। এই টাকাটা প্রতি সপ্তাহে লটারির মাধ্যমে একজন মহিলা পাবে। অর্থাৎ যার নাম উঠবে সে পাবে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে একজন করে মহিলা কমবে। এই লটারির দায়িত্বটা একজনের কাছে থাকবে। সে প্রত্যেকের নাম আলাদা আলাদা কাগজে মুড়িয়ে লটারি করবে। যে এ দায়িত্ব পালন করবে তাকে কিছু (৩০/৪০) টাকা দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হল, এই খেলাটি কি জায়েজ আছে? হাদিসে তো লটারি নিষেধ আছে। এটা কি সে পর্যায়ে যাবে?

উত্তর: এতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। এটা নিষিদ্ধ লটারির অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ এখানে তারা প্রত্যেকেই সমান টাকা জমা দিবে এবং প্রত্যেকেই তার জমা কৃত পূর্ণ টাকা ফেরত পাবে। কেউ কম-বেশি পাবে না বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু সপ্তাহান্তে জমা কৃত টাকা গুলো একসাথে নেওয়ার ক্ষেত্রে কে আগে নিবে-এটা নির্ধারণের জন্য লটারি করা হয়। এটা দোষের কিছু নয়। এই ধরণের সমিতি অনেক জায়গায় ‘টান সমিতি’ নামে পরিচিত।
মূলত: ইসলামে ওই লটারি হারাম যেটা জুয়া। যেখানে অংশ গ্রহণকারীরা সবাই টাকা জমা দিবে কিন্তু কয়েকজন ব্যক্তি লাভবান হবে আর বাকিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে যে ব্যক্তি লটারি ও টাকা ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি পরিচালনা করে তাকে যে টাকাটা দেওয়া হয় তাতে কোনও আপত্তি নেই। এটা তার পারিশ্রমিক।

■ সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়:
প্রশ্ন: আমরা দশ জনের একদল মানুষ প্রতি মাসে পঁচিশ দিনার প্রদানের মাধ্যমে একটি সমবায় সমিতিতে অংশগ্রহণ করি। এ পরিমাণ দিনার প্রতিমাসে সবাই জমা দিবে কিন্তু পালা অনুযায়ী একজন করে (জমা কৃত সম্পূর্ণ দিনার) গ্রহণ করবে। এভাবে (পালাক্রমে) প্রতি মাসে সবাই তা গ্রহণ করে। এর হুকুম কী? এটা কি জায়েজ? আল্লাহ আপনাকে প্রতিদান দান করুন। আমিন।
উত্তর:
الجواب: ما فيه بأس، إذا تعاونوا لا بأس بهذا المبلغ أو بأكثر أو بأقل، إذا تعاونوا عن سماح نفوسهم فلا بأس بهذا. نعم، هذا من باب التعاون على الخير. نعم.
“এতে দোষের কিছু নেই। তারা সবাই পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এ কাজ করলে কোনও দোষ নেই। চাই (তাদের অর্থের পরিমাণ) কম হোক বা বেশি হোক। তারা যদি উদার মনে এভাবে পারস্পারিক সহযোগিতা করে তাতে কোনও সমস্যা নেই। হ্যাঁ, এটি কল্যাণকর কাজে পারস্পারিক সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত। জি।

➧ সতর্কতা: এ জাতীয় সমিতির অন্যতম একটা সমস্যা হল, সদস্যদের মধ্যে যে ইতোমধ্যে টাকা পেয়ে গেছে সে অন্যান্য মাসে টাকা জমা না দিয়ে আত্মগোপন করতে পারে অথবা টাকা জমার ক্ষেত্রে গড়িমসি করতে পারে। তাই এতে পরিচিত ও বিশ্বস্ত ছাড়া অন্য কাউকে যুক্ত করা উচিত নয়। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

স্ত্রী, পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের সাথে সুন্দর আচরণ এবং একটি প্রসিদ্ধ হাদিসের ভুল অর্থ ও ব্যাখ্যা

 নিম্নোক্ত হাদিসটি আমাদের সমাজে যথেষ্ট পরিচিত: প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ، وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
“তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে ভালো যে তার পরিবারের নিকট সবচেয়ে ভালো আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার পরিবারের নিকট সবচেয়ে ভালো।” [ইবনে মাজহ: হাদিস নং ১৯৭৭, তিরমিযী: হাদিস নং ৩৮৯৫, শায়েখ আলবানিসহ অনেক মুহাদ্দিস এটিকে সহিহ বলেছেন। সহিহ লিগাইরিহি, সহিহ তিরমিযি, হা/৩৮৯৬]

উপরোক্ত হাদিসটি আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিচিত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কাছে তার ভুল অর্থ প্রচলিত। আর তা হল, উক্ত হাদিসকে কেবল স্ত্রীর সাথে খাস করা।‌ অর্থাৎ এভাবে অর্থ করা যে, “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ওই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো…।” (অধিকাংশ অনুবাদক এমনটি অর্থ করেছেন) কিন্তু তা সঠিক নয়। বরং ‘আহল‌’ শব্দের সঠিক অর্থ হলো, ‘পরিবার’ (শুধু স্ত্রী নয়)। আর স্ত্রী, মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন ইত্যাদি সকলেই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কিছু আলেমের মতে, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন বা নিকটাত্মীয়গণও এর মধ্যে শামিল।

🔸নিম্নে উক্ত হাদিসের ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমদের ব্যাখ্যা পেশ করা হলো:

◾সুনানে তিরমিজির অনবদ্য ব্যাখ্যা গ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াজিতে এই হাদিসের ব্যাখায় বলা হয়েছে,
لعياله، وذوي رحمه
“(সবচেয়ে উত্তম হলো সে ব্যক্তি যে), তার পরিবার-পরিজন এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের নিকট ভালো।”
কেউ কেউ বলেন,
لأزواجه وأقاربه
“স্ত্রী ও নিকাটাত্মীয়গণের নিকট ভালো। কারণ এ হাদিসটি সুন্দর আচরণের অর্থ বহন করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন এবং সবচেয়ে সুন্দর আচরণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন, মহান চরিত্রের উপরে প্রতিষ্ঠিত।” [তুহফাতুল আহওয়াজি]

◾সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি বিশ্ব নন্দিত আলেমে দীন শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন,
أهله: زوجته، وأمه، وأبوه، وأولاده، كلهم أهله، يعني: يحسن إليهم، وينفق عليهم، أفضل من الأجانب، والبعيدين.
“আহল অর্থ: স্ত্রী, মা, বাবা ও সন্তান-সন্ততি। এরা সবাই পরিবারভূক্ত। হাদিসটির অর্থ হল, যে ব্যক্তি এদের প্রতি দয়াসুলভ আচরণ করে এবং তাদের জন্য অর্থ খরচ করে সে উত্তম অনাত্মীয় এবং দূরবর্তী লোকদের থেকে।” [binbaz]

◾বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা শাইখ মুহম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,
فإذا كان فيك خير؛ فاجعله عند أقرب الناس لك وليكن أول المستفيدين من هذا الخير
“অতএব যদি তোমার মধ্যে ভালো কিছু থাকে তাহলে তা তোমার কাছের মানুষদেরকে দাও। এই কল্যাণ থেকে তারাই সর্বপ্রথম উপকৃত হোক।”

◾তিনি আরো বলেন,

ومن فوائد هذا الحديث: أنه ينبغي للإنسان أن يقتدي برسول الله صلى الله عليه وسلم في هذا، بحيث يكون مع أهله لينًا هيّنا أليفا لا يبعد عنهم ولا يطيل البعد

“এই হাদিসের অন্যতম একটি শিক্ষা হলো, একজন ব্যক্তির উচিত, আল্লাহর রসূলের আদর্শ অনুসরণ করা, যাতে সে তার পরিবারের সাথে নম্র, সহজ-সরল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারেন। যে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে না বা দীর্ঘ সময় দূরে থাকবে না।” [শারহে বুলুগুল মারাম-alathar]

মোটকথা, আমাদের সুন্দরতম আচার-আচরণ তথা হাসিমুখে কথা বলা, বদান্যতা, মানুষের অশোভন আচরণে ধৈর্য ধারণ করা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া ইত্যাদি উত্তম চরিত্র ও সুন্দর আচার-আচরণের যত বিষয় রয়েছে সেগুলোর সবচেয়ে বেশি হকদার নিজের স্ত্রী, মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি এবং বিশেষ করে রক্ত সম্পর্কীয় বা নিকটাত্মীয়গণ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের সমাজে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। অনেক মানুষ বাইরের লোকদের সাথে খুবই নম্র, ভদ্র, সভ্য ও শালিন আচরণ করে কিন্তু নিজের স্ত্রী-পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের সাথে তার সম্পর্ক ও আচরণ খুব নিম্ন পর্যায়ের। এমনটি হওয়া উচিত নয়।‌ বরং হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে ভালো মানুষ তারাই যারা তাদের স্ত্রী, পরিবার, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুন্দরতম আচরণ করে। আর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী সে ব্যক্তি যার আচার-আচরণ সবচেয়ে সুন্দর এবং এই সুন্দর আচরণের অধিকারীরাই কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সন্নিকটে অবস্থান করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, মা,‌ বাবা, ভাই, বোন রক্তের সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়, সর্বোপরি সকল মানুষের সাথে সুন্দরতম আচরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

সচেতনতা মূলক পোস্ট: তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-ঝাটি করা পথভ্রষ্টতার কারণ

 বর্তমানে মুসলমানদের মাঝে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও মতভেদ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে ভয়ানক আক্রমণাত্মক ভাষায় আঘাত করছে। চলছে গালাগালি আর হিংসার উদগীড়ন। একে অপরকে কুরুচিপূর্ণ শব্দ প্রয়োগে ধোলাই করছেন। সব চেয়ে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, একেবারে সাধারণ মানুষও ইলম ছাড়াই আলেমদের সাথে বিতর্ক জড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে তারা ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতি কোনভাবেই মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণকর নয়। বরং তা গোমরাহির আলামত ও ভ্রষ্টতার পূর্বাভাষ। তাই আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া (তাও শর্ত সাপেক্ষ) নিজেদের মাঝে বিতর্ক পরিহার করা প্রয়োজন।

কারণ আবু উমারা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلَّا أُوتُوا الْجَدَلَ ثُمَّ تَلَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذِهِ الْآيَةَ ((مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ
“কোন জাতি হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার পরে গোমরাহ হয় না যতক্ষণ না তারা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়। অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আয়াতটি পাঠ করলেন:
مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا – بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ
“তারা আপনার সামনে যে উদাহরণ উপস্থাপন করে তা কেবল বিতর্কের জন্যেই করে। বস্তুত: তারা হল এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়।” [তিরমিযি হা/৩১৭৬, ইবনে মাজাহ হা/৪৭, সহীহ তারগীব- হাসান, আলবানি]
সত্য জানার পরেও শুধু প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা ব্যক্তি, দল, মত, বংশ ইত্যাদির স্বার্থে অন্যায় জেনেও তার সমর্থনে তর্ক-বিতর্ক গোমরাহির একটি কারণ।ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “শরিয়তে ঐ তর্ককে তিরস্কার করা হয়েছে যা ইলম ছাড়া অন্যায়ভাবে করা হয়। অথবা সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও করা হয়। সুতরাং এখান থেকে বুঝা যায়, ঝগড়া-ঝাটি ও অন্যায় বিতর্ক গোমরাহির আলামত। পক্ষান্তরে বিতর্কের উদ্দেশ্য যদি হয়, সত্যকে সমর্থন করা বা অন্যায় কে অন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তবে তা কখনো ফরজে আইন; কখনো ফরজে কেফায়াহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ – وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ- إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ
“ডাক তোমার রবের পথে প্রজ্ঞা এবং সুন্দর উপদেশ বাণীর মাধ্যমে আর তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দরতম পন্থায়। নিশ্চয় তোমার রব সব চেয়ে বেশি জানেন, কে তার পথে থেকে বিচ্যুত হয়েছে।” [সূরা নাহল: ১২৫]
উক্ত আয়াতে দাওয়াতের দুটি চমৎকার মূলনীতি বলা হয়েছে। যথা:
🔹 এক. হেকমত তথা কুরআন-সুন্নাহর দলিল দ্বারা দাওয়াত দেয়া।
🔹 দুই. সুন্দর উপদেশ বাণী অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহয় যে সকল উৎসাহ ব্যঞ্জক, সতর্ক বাণী, জান্নাতের নেয়ামতরাজি ও জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া।
অনুরূপভাবে এখানে বিতর্ক করার একটি চমৎকার মূলনীতিও বলা হয়েছে। তা হল: যদি বিতর্কের প্রয়োজন হয় তবে সুন্দরতম পন্থায় তথা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, প্রমাণ উপস্থাপন, ইলম (শরিয়তের জ্ঞান) এবং যৌক্তিক বক্তব্য পেশের মাধ্যমে বিতর্ক করতে হবে। গালাগালি ও চিৎকার-চেঁচামেচি করা হলে বিতর্কের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। বিতর্কের উদ্দেশ্য মানুষকে হেদায়েত করা; প্রতিপক্ষের উপর বিজয় প্রমাণ করা নয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির ও তাফসীরে ইবনে সাদি থেকে সংক্ষেপায়িত)
আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমীন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।

নাস্তিকের জন্য বদদুআ করার বিধান

 প্রশ্ন: একজন নাস্তিক আল্লাহর রাসূল সহ অনেক মুসলিমকে গালাগালি দিচ্ছে এবং নানাভাবে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। এতে আমিও কষ্ট পাচ্ছি।‌ আমি কি তার জন্য বদদুআ করতে পারবো?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচারণ বা তাকে কটুক্তি করা নতুন কোন বিষয় নয়। তাঁর জীবদ্দশায় তাকে কাফের-মুশরিক ও মুনাফিকদের পক্ষ থেকে এ সবের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর তাতে মুসলিমগণ কষ্টপাবেন তা স্বাভাবিক। এটি ঈমানের আলামত। সাধারণভাবে কাফের-মুশরিক, নাস্তিক ও ফাসেক লোকদের প্রতি বদদুআ বা লানতের দুআ করা যাবে। এটি ওলামাদের সর্বসম্মত মত। তবে ব্যক্তি বিশেষকে নির্দিষ্ট করে লানত করা বা তার জন্য বদদুআ যাবে কি না তা দ্বিমতপূর্ণ। সঠিক কথা হল, ব্যক্তি বিশেষকে নির্দিষ্ট করে বদদুআ করা যাবে না। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির নাম ধরে ধরে লানত করেছিলেন তখন কুরআনে আয়াত নাজিলের মাধ্যমে তাকে নিষেধ করা হয়েছে এই আয়াত দ্বারা:

لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ

“হয় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কিংবা তাদেরকে আযাব দেবেন। এ ব্যাপারে আপনার কোন করণীয় নাই। কারণ তারা রয়েছে অন্যায়ের উপর।” [সূরা আলে ইমরান: ১২৮]
উল্লেখ্য যে, ওহুদ যুদ্ধের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু সুফিয়ান, হারিস ইবনে হিশাম ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া প্রমূখ কাফেরদের লিডারদের নাম ধরে ধরেে লানত করেছিলেন। তখন এই আয়াত নাজিলের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিষেধ করা হয়। [দ্র: তাফসীরুল কাবীর/মাফাতিহুল গায়ব] আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

বাবা-মা যদি ভুল ধারণার উপরে ভিত্তি করে বা অন্যায় ভাবে সন্তানের উপর বদদুআ করেন তাহলে কি সন্তান এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে

 প্রশ্ন: অনিচ্ছা বশত আমার‌ দ্বারা একটি ভুল কাজ ঘটে গেছে। কিন্তু আম্মা মনে করেছেন, আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে এ কাজ করেছি। যার কারণে তিনি আমাকে বদদুআ করেন এবং বলেন, যেন আমার আশায় ছাই পড়ে। এখন আমি কি তার বদদুআর শিকার হব এবং দুআ করলেও আমার কোনও আশা পূরণ হবে না?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: নিম্নে চারটি পয়েন্টে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
🔸প্রথমত: বাবা-মার বদদুআ সন্তানের জন্য বিপদজনক। তাই সন্তানের কর্তব্য, পিতা-মাতাকে খুশি রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। আর পিতা-মাতার কর্তব্য হলো, সন্তানের জন্য কখনো বদদুআ না করা।‌ কেননা হাদিসে‌ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন:
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَا تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ وَلَا تَدْعُوا عَلَى أَوْلَادِكُمْ وَلَا تَدْعُوا عَلَى خَدَمِكُمْ وَلَا تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ، لَا تُوَافِقُوا مِنَ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى سَاعَةَ نَيْلٍ فِيهَا عَطَاءٌ فَيَسْتَجِيبَ لَكُمْ ‏”‏ ‏
“তোমরা নিজেদের উপর বদদুআ করো না, তোমাদের সন্তানদের উপর বদদুআ করো না, তোমাদের খাদেমদের (সেবক বা কাজের মানুষদের) উপর বদদুআ করো না এবং তোমাদের ধন-সম্পদের উপর উপর বদদুআ করো না। কেননা হতে পারে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ প্রাপ্তির সময়ের সাথে (দুয়া কবুলের সময়ের সাথে) তোমাদের মিল হয়ে যাবে ফলে তিনি‌ তোমাদের (বদদুআও) কবুল করে নিবেন।” [মুসলিম, অধ্যায়: যুহুদ]

🔸 দ্বিতীয়ত: বান্দার অনিচ্ছাকৃত ভুল স্বয়ং আল্লাহও ক্ষমা করে দিয়েছেন। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْه».
‘নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের অনিচ্ছা বশত: এবং ভুলে যাওয়ার কারণে ঘটে যাওয়া গুনাহ এবং জোর জবরদস্তি মূলক কৃত গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।” [আবু দাউদ, হা/৭২১৯-সহিহ]
সুতরাং আমাদেরও উচিত, মানুষের অনিচ্ছা বশত: ঘটে যাওয়া ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া। এটি নিঃসন্দেহে উন্নত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।

🔸 তৃতীয়ত: যদি কোনও ব্যক্তির আচার-আচরণ, চরিত্র ও কার্যক্রম অধিকাংশই ভালো ও সন্তোষজনক হয় তাহলে তার দ্বারা হঠাৎ কোনও অন্যায় কর্ম ঘটে গেলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। হাদিসে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। অবশ্য ইসলামি আইনে‌ দণ্ডবিধি প্রযোজ্য হয় এমন অপরাধ হলে‌ ভিন্ন কথা। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
أقيلوا ذَوي الهيئاتِ عثَراتِهم إلا الحدودَ
“তোমরা সম্মানিত ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী লোকদের হঠাৎ ঘটে যাওয়া ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দাও দণ্ড যোগ্য অপরাধ ব্যতীত।” [আবু দাউদ, ৪৩৭৫, আহমদ, ২৫৪৭৪, সহীহাহ্ ৬৩৮, সহীহ আল জামি‘ ১১৮৫]

🔸চতুর্থত: মা অথবা বাবা যদি সন্তানের ‘অনিচ্ছাকৃত’ ঘটে যাওয়া কোনও ভুলকে ‘ইচ্ছাকৃত’ মনে করে বদ দুআ করে তাহলে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। কারণ এই বদদুআ যথার্থ হয়নি। কুরআন-হাদিসে মানুষের প্রতি কু ধারণা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকে ধারণার উপরে ভিত্তি করে সন্তানকে বদদুআ দিয়েছে। এ কারণে তার দুআ আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত তো হবেই বরং এতে তিনি গুনাহগার বলে গণ্য হবেন। কারণ, ইসলামে সন্তান-সন্ততির উপরে বদদুআ করাই নিষিদ্ধ। তারপরে আবার যদি দুআর মধ্যে গুনাহের বিষয় থাকে তা আল্লাহ কবুল করবেন না। (সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকে শুধু ভুল ধারণার উপরে ভিত্তি করে বদদুআ করা নিঃসন্দেহে জুলুম, সীমালঙ্ঘন এবং গুনাহ)।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّهُۥ لَا یُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِینَ
“নিশ্চয় তিনি (মহান আল্লাহ) সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সুরা আরাফ: ৫৫]
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
ما من مسلم يدعو بدعوة، ليس فيها إثم ولا قطيعة رحم إلا أعطاه الله بـها إحدى ثلاث : إما أن يعجل له دعوته، وإما أن يدخرها له في الآخرة وإما أن يصرف عنه من السوء مثلها. قالوا : إذا نكثر قال : الله أكثر
“যখন কোনও মুমিন ব্যক্তি দুআ করে, যে দুআতে কোনও গুনাহ থাকে না এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় থাকে না, তখন আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনও এক পদ্ধতিতে তার দুআ অবশ্যই কবুল করে নেন। যে দুআ সে করেছে হুবহু সেভাবে তা কবুল করেন অথবা তার দুআর প্রতিদান আখিরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন কিংবা এ দুআর মাধ্যমে তার অনাগত কোনও বিপদ-মুসিবত তিনি দূর করে দেন। এ কথা শুনে সাহাবিগণ বললেন, আমরা তাহলে অধিক পরিমাণে‌ (দুআ) করব। তিনি বললেন, “আল্লাহ আরও অধিক দাতা” [বুখারি: আদাবুল মুফরাদ ও আহমদ, সহীহ-আলবানি]

তবে আপনার কর্তব্য, আপনার মাকে শান্তভাবে‌ যুক্তি-প্রমাণের আলোকে অনিচ্ছা বশত: ভুল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা যেন আপনার ব্যাপারে তার ভুল ধারণা ভেঙ্গে যায় এবং তিনি নিজের অবস্থান থেকে ফিরে আসেন। আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate