Tuesday, March 2, 2021

পুরো সম্পদের বিনিময় জান্নাত কিনেছেন আবু দাহদাহ (রা)


 মদিনার আনসারী গোত্রের এক এতিম কিশোরের একটি খেজুর বাগান ছিল। বাগানটি অন্য লোকের বাগানের সঙ্গে লাগানো ছিল। তার নাম আবু লুবাবা। এতিম ছেলেটি তার বাগানের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের চিন্তা করল। যাতে প্রত্যেকের অংশ পৃথক হয়ে যায়। প্রাসের দিতে গিয়ে সে দেখল, প্রতিবেশী আবুল বাবার বাগানের একটি খেজুর গাছ তার সীমানার মধ্যে পড়ে আছে; যে কারণে তার প্রাচীরটি সোজা করে নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবেশী আবুল বাবার কাছে গিয়ে ছেলেটি বলল, আপনার বাগানে অনেক খেজুর গাছ আছে। এই গাছটি আমাকে দিলে আপনার কোন সমস্যা হবে না। গাছটি আপনার; কিন্তু তা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

গাছটি আমার হলে দেয়াল সোজা করে উত্তোলন করা যাবে। তাই আপনি আমাকে কাজটি দিয়ে দিন। সে বলল, আল্লাহর শপথ, আমি তোমাকে খেজুর গাছ দিতে পারব না। ছেলেটি বলল, তাহলে খেজুর গাছ টি আমার কাছে বিক্রি করুন।

আবু লুবাবা উত্তর দিলো, আমি এর কিছুই করতে পারবোনা। কোন উপায় না পেয়ে এতিম ছেলেটি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা জানালো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু লুবাবাকে ডাকলেন। আবু লুবাবা মসজিদে নববীতে আসলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেই খেজুর গাছ টি অর্থের বিনিময়ে বিক্রি অথবা এতিম ছেলেটিকে দান করতে বললেন।

আবু লুবাবা বলল আমি কোনভাবেই খেজুর গাছ টি তাকে দিব না। রাসূল (সাঃ) কয়েক বার বলার পরেও যখন সে রাজি হলেন না; তখন রাসূল সাঃ আবু লুবাবা কে বললেন, তোমার এতিম ভাইকে ওই খেজুর গাছ টি দিয়ে দাও। আমি তোমার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছের জিম্মাদার হবো। আবু লুবাবা এই ঘোষণাটি শোনার পরও খেজুর গাছ টি দিতে অস্বীকার করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ হয়ে গেলেন।

সাহাবাগণ সেই মজলিসের কথোপকথন নিশ্চুপ শুনছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আবু দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। মদিনায় তার ৬০০ সুস্বাদু খেজুর গাছের খুবই প্রসিদ্ধ একটি বাগান ছিল এবং সে বাগানে কয়েকটি ঘর এবং কয়েকটি পানির কূপ ছিল। সেখানে তিনি পরিবার সহ বসবাস করতেন।

হযরত আবু দাহদাহ (রাঃ) বিশ্ব নবীর কথা শুনছিলেন। তিনি ভাবলেন, এই দুনিয়া কি? পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের কাছে এ দুনিয়া তুচ্ছ। বরং যদি জান্নাতী একটি  খেজুর গাছ পাওয়া যায় তাহলে আর কি চাই! তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি জান্নাতে যে খেজুর গাছের কথা বললেন, এটা কি শুধু আবু লুবাদার জন্যই? আমি যদি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ওই খেজুর গাছ বিক্রয় করে এতিম ছেলেটিকে দেয়ার ব্যবস্থা করি, তাহলে আমিও কি জান্নাতে খেজুর গাছের মালিক হবো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তোমার জন্য জান্নাতে খেজুর গাছ থাকবে। আবু দাহদাহ ওই ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বললেন- হে আবু লুবাবা শোনো! তুমি আমার বাগান সম্পর্কে অবগত আছ, যেখানে ৬০০ খেজুর গাছ আছে, সঙ্গে ঘর ও কয়েকটি কূপও আছে! আবু লুবাবা উত্তর দিলো, মদিনাতে এমন কে আছে, যে আপনার বাগান সম্পর্কে জানে না? তিনি বললেন, তাহলে তুমি আমার ঐ সম্পূর্ণ বাগান গ্রহণ করে তোমার একটি খেজুর গাছ আমাকে দিয়ে দাও। আবু লুবাবা তার এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে আবু দাহদাহ (রাঃ) দিকে তাকাল। অতঃপর লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা লক্ষ্য করো আবু দাহদাহ কি বলছে? লোকজন যখন আবু দাহদাহর প্রস্তাবের সাক্ষী হলো তখন সে বলল, হ্যাঁ আমি তোমার খেজুর বাগান গ্রহণ করলাম এবং ঐ খেজুর গাছ টি তোমাকে দিয়ে দিলাম। আবু দাহদাহ ঐ খেজুর গাছের মালিক হয়ে গেলেন এবং এতিম ছেলেটিকে বললেন, এখন থেকে ঐ খেজুর গাছ টি তোমার। আমি তোমাকে উপহার দিলাম। এখন তোমার বাগানের প্রাচীর সোজা করতে আর কোন বাধা নেই। আবু দাহদাহ (রাঃ) বিশ্ব নবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি কি জান্নাতে খেজুর গাছের মালিক হলাম? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন আবু দাহদাহর জন্য জান্নাতে এখন কত বিশাল বিশাল খেজুর বাগান অপেক্ষা করছে! হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আল বলেন, এই কথারি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক, দুই বা তিনবার নয়; বরং খুশি হয়ে বারবার বলতে থাকেন। অবশেষে আবু দাহদাহ (রাঃ) জান্নাতের বাগানের সুসংবাদ নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন। এরপর নিজের বাগানের দরজায় গিয়ে স্ত্রীকে ডাক দিলেন-হে উম্মে দাহদাহ! উম্মে দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা অত্যন্ত অবাক হলেন যে, আজকে আবু দাহদাহ বাগানের বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভিতরে আসছেন না কেন? আবারো আওয়াজ আসলো! উম্মে দাহদাহ! বাচ্চাদেরকে নিয়ে এবাদন থেকে বের হয়ে আসো। উম্মে দাহদাহ বললেন, আমি বাগান থেকে বের হয়ে আসবো? আবু দাহদাহ বললেন, হ্যাঁ আমিয়ে বাগান বিক্রি করে দিয়েছি।উম্মে দাহদাহ বললেন, আপনি কার নিকট বিক্রি করেছেন? কত দাম দিয়ে বিক্রি করলেন? আবু দাহদাহ বললেন, আমি জান্নাতে একটি খেজুর গাছের বিনিময়ে তা বিক্রি করে দিয়েছি। উম্মে দাহদাহ বললেন, আল্লাহু আকবার, হে আবু দাহদাহ! আপনি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা করেছেন। জান্নাতের একটি বৃক্ষ, যার নিচে (একজন) অশ্বারোহী একশত বছর পর্যন্ত চলার পরেও তার ছায়া শেষ হবে না(বুখারী) কি সৌভাগ্য আমাদের, আমরা জান্নাতে একটি (খেজুর) গাছ পাবো ( মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরেকে হাকিম)

সুবাহানাল্লাহ

★জান্নাতবাসীরা হাসি-তামাশা লিপ্ত থাকবে। (সূরা ইয়াসিন আয়াত:৫৫-৫৮)

★ সঙ্গে তারা পালঙ্কে হেলান দিয়ে থাকবে। (সূরা ইয়াসিন আয়াত:৫৫-৫৮)

★সেখানে তাদের জন্য ফল-ফলাদি ও তারা যা চাইবে তা থাকবে। (সূরা ইয়াসিন আয়াত:৫৫-৫৮)

★ দয়াময় রবের পক্ষ থেকে তাদের জন্য সালাম বর্ষিত হবে। (সূরা ইয়াসিন আয়াত:৫৫-৫৮)

আবু দাহদাহ বাগানের পত্রপল্লবিত বৃক্ষরাজি, ফল-ফলাদি ও সুশীতল ছায়ায় ঘেরা জীবন ফেলে রেখে কষ্টকর সঙ্কীর্ণ জীবন-যাপন গ্রহণ করলেন। আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা পরিহার করে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হন, বাকি জীবন আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়ে দেন। জান্নাতের স্বপ্ন যে মানুষ দেখেছে, দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট তো তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য। (সহি বুখারী ও সহীহ মুসলিম অবলম্বনে)






সালাতে একাগ্রতা ও খুশুর জন্য ৩৩ টি উপায়

 সালাত ইসলামের একটি শরীরিক ইবাদত, বড় রুকন। একাগ্রতা ও বিনয়াবনতা এর প্রাণ, শরিয়তের অমোঘ নির্দেশও। এদিকে অভিশপ্ত ইবলিশ মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত করার শপত নিয়ে অঙ্গীকার করেছে,

‘তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’। (আল-আরাফ : ১৭)
কাজেই তার মূল উদ্দেশ্য মানবজাতিকে সালাত হতে বিভিন্ন ছলে-বলে অন্য মনস্ক করা। ইবাদতের স্বাদ, সওয়াবের বিরাট অংশ থেকে বঞ্চিত করার নিমিত্তে সালাতে বিভিন্ন ধরনের ওয়াসওয়াসা ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটানো। তবে বাস্তবতা হল, শয়তানের আহবানে মানুষের বিপুল সাড়া, দ্বিতীয়ত, সর্বপ্রথম সালাতের একাগ্রতা পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়া, তৃতীয়ত, শেষ জমানা। এ হিসেবে আমাদের উপর হুজায়ফা রা. এর বাণী প্রকটভাবে সত্যতার রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন,
‘সর্বপ্রথম তোমরা নামাজের একাগ্রতা হারা হবে, সর্ব শেষ হারাবে সালাত। অনেক নামাজির ভেতর-ই কোনো কল্যাণ বিদ্যমান থাকবে না। হয়তো মসজিদে প্রবেশ করে একজন মাত্র নামাজিকেও সালাতে বিনয়ী-একাগ্রতা সম্পন্ন দেখবে না।’ (মাদারিজুস সালিকিন, ইবনুল কায়্যিম ১/৫২১)
তা সত্বেও কতক মানুষের আত্মপ্রশ্ন, অনেকের সালাতে ওয়াসওয়াসা ও একাগ্রতাহীনতার অভিযোগ।
বিষয়টির আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক অপরিসীম। সে জন্যেই নিম্নে বিষয়টির উপর সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে।আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘মুমিনগণ সফলকাম, যারা সালাতে মনোযোগী’। (সূরা আল-মুমিনূন: ১-২) অর্থাৎ আল্লাহ ভীরু এবং সালাতে স্থির।
‘খুশু হল-আল্লাহর ভয় এবং ধ্যান হতে সৃষ্ট স্থিরতা, গাম্ভীর্যতা ও নম্রতা।(‘দার-আশশুআব প্রকাশিত ইবনে কাসির : ৬/৪১৪)
‘বিনয়াবনত এবং আপাত-মস্তক দীনতাসহ আল্লাহর সমীপে দন্ডায়মান হওয়া’। (আল-মাদারেজ : ১/৫২০)
মুজাহিদ বলেন, ‘কুনুতের অর্থ : আল্লাহর ভয় হতে উদ্‌গত স্থিরতা, একাগ্রতা, অবনত দৃষ্টি, সর্বাঙ্গীন আনুগত্য। (তাজিমু কাদরিস সালাত ১/১৮৮)
খুশু তথা একাগ্রতার স্থান অন্তর তবে এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রতঙ্গে। ওয়াসওয়াসা কিংবা অন্যমনস্কের দরুন খুশুতে বিঘ্নতার ফলে অঙ্গ-প্রতঙ্গের ইবাদতেও বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়। কারণ, অন্তকরণ বাদশাহ আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ আজ্ঞাবহ-অনুগত সৈনিকের ন্যায়। বাদশার পদস্খলনে সৈনিকদের পদস্খলন অনস্বীকার্য। তবে কপট ও বাহ্যিকভাবে খুশু তথা একাগ্রতার ভঙ্গিমা নিন্দনীয়। বরং ইখলাসের নিদর্শন হল একাগ্রতা প্রকাশ না করা।
হুজায়ফা রা. বলতেন, ‘নেফাক সর্বস্ব খুশু হতে বিরত থাক। জিজ্ঞাসা করা হল, নেফাক সর্বস্ব খুশু আবার কি? উত্তরে বললেন, শরীর দেখতে একাগ্রতাসম্পন্ন অথচ অন্তর একাগ্রতা শূন্য।’
ফুজায়েল বলেন, ‘আগে অন্তরের চেয়ে বেশী খুশু প্রদর্শন করা ঘৃণার চোখে দেখা হত।’
জনৈক বুজুর্গ এক ব্যক্তির শরীর ও কাঁধে খুশুর আলামত দেখে বললেন, এই ছেলে ! খুশু এখানে, বুকের দিকে ইশারা করে। এখানে নয়, কাঁধের দিকে ইশারা করে। (মাদারিজ: ১/.৫২১)
সালাতের ভেতর খুশু একমাত্র তারই অর্জিত হবে, যে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে সালাতের জন্য ফারেগ করে নিবে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে সালাতকে স্থান দিবে। তখনই সালাতের দ্বারা চোখ জুড়াবে, অন্তর ঠান্ডা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
সালাতেই আমার চোখের শান্তি রাখা হয়েছে। (মুসনাদু আহমাদ: ৩/১২৮)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় খুশুর সহিত সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য ধার্যকৃত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা প্রদান করেছেন। ( সূরা আল-আহজাব : ৩৫) খুশু বান্দার উপর সালাতের দায়িত্বটি স্বাভাবিক ও হালকা করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ. ﴿البقرة:৪৫﴾
আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা খুশুওয়ালা-বিনয়ী ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন। ( সূরা আল-বাকারা : ৪৫)
অর্থাৎ সালাতের কষ্ট বড় কঠিন, তবে খুশু ওলাদের জন্য কোন কষ্টই নয়।” (তাফসিরে ইবনে কাসির : (১/১২৫) খুশু যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন কঠিন ও দূর্লভ, বিষেশ করে আমাদের এ শেষ জামানায়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘এই উম্মত হতে সর্ব প্রথম সালাতের খুশু উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তালাশ করেও তুমি কোনো খুশু ওয়ালা লোক খুঁজে পাবে না।’ (তাবরানি)
 খুশু তথা একাগ্রতার হুকুম
 নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে খুশু ওয়াজিব। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলার বাণী,وَ
”তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর, তবে সালাতে একাগ্রতা বঞ্চিতদের জন্য তা খুব কঠিন।” (সূরা আল-বাকারা : ৪৫)- এর মাধ্যমে খুশুহীনদের দুর্নাম ও নিন্দা করা হয়েছে। অর্থাৎ খুশু ওয়াজিব। কারণ, ওয়াজিব তরক করা ছাড়া কারো দুর্নাম করা হয় না।
 অন্যত্র বলেন,
”মুমিনগণ সফল, যারা সালাতে একাগ্রতা সম্পন্ন…তারাই জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে।” ( সূরা আল-মোমেনুন : ১-১১) এ ছাড়া অন্যরা তার অধিকারী হবে না। এর দ্বারাও প্রমাণিত হয়, খুশু ওয়াজিব। খুশু হল বিনয় ও একাগ্রতার ভাব ও ভঙ্গি। সুতরাং যে ব্যক্তি কাকের মত মাথা ঠোকরায়, রুকু হতে ঠিক মত মাথা উঁচু করে না, সোজা না হয়ে সেজদাতে চলে যায়, তার খুশু গ্রহণ যোগ্য নয়। সে গুনাহগার-অপরাধি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৫৫৩-৫৫৮)
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন। যে ভাল করে ওজু করবে, সময় মত সালাত আদায় করবে এবং রুকু-সেজদা ঠিক ঠিক আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোনো দায়িত্ব নেই। শাস্তিও দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন। (আবু দাউদ : ৪২৫, সহিহ আল-জামে : ৩২৪২)
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
”যে সুন্দরভাবে ওজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে দু’রাকাত সালাত পড়ে, (অন্য বর্ণনায়-যে সালাতে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (অন্য বর্ণনায়- তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।) (বোখারি : ১৫৮, নাসায়ি : ১/৯৫)
 খুশু ও একাগ্রতা সৃষ্টি করার কয়েকটি উপায়
 খুশু তৈরীর উপায় ও বিষয় নিয়ে গবেষণা করার পর স্পষ্ট হয় যে, এগুলো দু’ভাগে ভিবক্ত।
এক. খুশু তৈরী ও শক্তিশালী করণের উপায় গ্রহণ করা।
দুই. খুশুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো পরিহার ও দুর্বল করা।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, খুশুর সহায়ক দুটি জিনিস। প্রথমটি হল- নামাজি ব্যক্তির প্রতিটি কথা, কাজ, তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়া গভীর মনোযোগ সহকারে আদায় করা। আল্লাহকে দেখে এসব আদায় করছি এরূপ নিয়ত ও ধ্যান করা। কারণ, নামাজি ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। হাদিসে জিবরীলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে,
”আল্লাহর ইবাদত কর, তাকে দেখার মত করে। যদি তুমি তাকে না দেখ, সে তো অবশ্যই তোমাকে দেখে।” ( বোখারি মুসলিম )
এভাবে যতই সালাতের স্বাদ উপভোগ করবে, ততই সালাতের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। আর এটা সাধারণত ঈমানের দৃঢ়তার অনুপাতে হয়ে থাকে। ঈমান দৃঢ় করারও অনেক উপায় রয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ”তোমাদের দুনিয়ার তিনটি জিনিস আমার নিকট প্রিয়। নারী ও সুগন্ধি, আর সালাত তো আমার চোখের প্রশান্তি।”
আরেকটি হাদিসে এসেছে, ”ও বেলাল, সালাতের মাধ্যমে (প্রশান্তি) মুক্তি দাও।”
দ্বিতীয়টি হল- প্রতিবন্ধকতা দূর করা। অন্তরের একাগ্রতা বিনষ্টকারী জিনিস ও চিন্তা-ফিকির পরিত্যাগ করা। যা ব্যক্তি অনুসারে সকলের ভেতর হয়ে থাকে। যার ভেতর প্রবৃত্তি ও দ্বীনের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা কোনো জিনিসের প্রতি আসক্তি রয়েছে, তার ভেতর ওয়াসওয়াসাও অধিক হবে। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৬০৬-৬০৭ )
 খুশু সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ
 এক. সালাতের জন্য প্রস্ততি গ্রহণ ও তৈরী হওয়া।
যেমন, মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে আজানের শব্দগুলো উচ্চারণ করা এবং আজান শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়া।
আজান-ইকামতের মাঝখানে দোয়া করা, বিসমিল্লাহ বলে পরিশুদ্ধভাবে ওজু করা, ওজুর পরে দোয়া পড়া। যেমন,
মুখ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মেসওয়াকের প্রতি যত্নশীল থাকা, যেহেতু কিছক্ষণ পরেই সালাতে তেলাওয়াত করা হবে পবিত্র কালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমরা কোরআন পড়ার জন্য মুখ ধৌত কর।” ( বর্ণনায় বায্‌যার)
সুন্দর পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে পরিপাটি হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا
”ও বনি আদাম, তোমরা প্রতি সালাতের সময় সাজ-সজ্জা গ্রহণ কর।” (সূরা আল আরাফ: ৩১)
আল্লাহর জন্য পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা অধিক শ্রেয়। কারণ, পরিস্কার পরিচ্ছদ ও সুগন্ধির ব্যাবহার নামাজির অন্তরে প্রফুল্লতার সৃষ্টি করে। যা শয়নের কাপড় কিংবা নিম্নমানের কাপড় দ্বারা সম্ভব নয়। তদ্রুপ সালাতের প্রস্তুতি স্বরূপ, শরীরের জরুরি অংশ ঢেকে নেয়া, জায়গা পবিত্র করা, জলদি সালাতের জন্য তৈরী হওয়া ও ধীর স্থিরভাবে মসজিদ পানে চলা। আঙ্গুলের ভেতর আঙ্গুল দিয়ে অলসতার অবস্থা পরিহার করা। সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। মিলে মিলে এবং কাতার সোজা করে দাড়ানো। কারণ, শয়তান কাতারের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাতে আশ্রয় নেয়।
দুই : স্থিরতা অবলম্বন করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি অঙ্গ স্বীয় স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন
সালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ”এভাবে না পড়লে তোমাদের কারো সালাত শুদ্ধ হবে না।”[১]
আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”সালাতে যে চুরি করে, সেই সবচে নিকৃষ্ট চোর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল সালাতে কীভাবে চুরি করে ? তিনি বললেন, রুকু-সেজাদ ঠিক ঠিক আদায় করে না।” ( আহমাদ ও হাকেম) [২]
আবু আব্দুল্লাহ আশআরি রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
”যে ব্যক্তি রুকু অসর্ম্পর্ণ রাখে আর সেজাদাতে শুধু ঠোকর মারে, সে ঐ খাদকের মত যে দুই-তিনটি খেজুর খেল অথচ কোনো কাজে আসল না।”[৩] ( তাবরানি)
ধীরস্থিরতা ছাড়া খুশু সম্ভব নয়। কারণ, দ্রুত সালাতের কারণে খুশু নষ্ট হয়। কাকের মত ঠোকর মারার কারণে, সাওয়াব নষ্ট হয়।
তিন : সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তুমি সালাতে মৃত্যুর স্মরণ কর। কারণ, যে সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করবে, তার সালাত অবশ্যই সুন্দর হবে। এবং সে ব্যক্তির ন্যায় সালাত পড়, যাকে দেখেই মনে হয়, সে সালাতে আছে।”[৪] (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ)
আবু আইউব রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশ দিয়ে বলেন,
”যখন সালাতে দাড়াবে, মৃত্যুমুখী ব্যক্তির ন্যায় দাড়াবে।”[৫] (আহমদ)
মৃত্যু প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নিশ্চিত। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই শেষ সালাত চিন্তা করলে এ সালাতই এক বিশেষ ধরনের সালাতে পরিণত হবে। হতে পারে এটাই জীবনের শেষ সালাত।
 চার : পঠিত আয়াত ও দোয়া-দরূদে ফিকির করা, ও গভীর মনোযোগ দিয়ে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা এবং সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়া।
কারণ, কোরআন নাজিল হয়েছে মূলত: চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করার জন্যই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آَيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿২৯﴾ ( ص:২৯)
”জ্ঞানীদের উপদেশ গ্রহণ ও গবেষণার জন্য আমি একটি মোবারক কিতাব আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা সাদ: ২৯)
আর এর জন্য প্রয়োজন পঠিত আয়াতের অর্থানুধাবন, উপদেশ গ্রহণ করণ ও জ্ঞানার্জন। তবেই সম্ভব- গবেষণা, অশ্রু ঝরানো ও প্রভাবিত হওয়া। আল্লাহ তাআলা রহমানের বান্দাদের প্রসংশা করে বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآَيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا ﴿৭৩﴾ ( الفرقان : ৭৩)
আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে অন্ধ ও বধিরদের মত পড়ে থাকে না। (সূরা আল ফোরকান: ৭৩)
এর দ্বারাই বুঝে আসে তাফসিরের গুরুত্ব। ইবনে জারির রহ. বলেন, ”আমি আশ্চর্য বোধ করি, যে কোরআন পড়ে অথচ তাফসির জানে না, সে কিভাবে এর স্বাদ গ্রহণ করে।” (মাহমূদ শাকের কর্তৃক তাফসিরে তাবারির ভূমিকা: ১/১০)
গবেষণার আরো সহায়ক, বার বার একটি আয়াত পড়া এবং পুনঃপুনঃ তার অর্থের ভেতর চিন্তা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল এরূপই ছিল। বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-
إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿المائدة : ১১৮﴾
আয়াতটি পড়তে পড়তে রাত শেষ করে দিয়েছিলেন। ( ইবন খুযাইমা ও আহমাদ) [৬]
আয়াতের তেলাওয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়াও চিন্তার সহায়ক। হুজায়ফা রা. হতে বর্ণিত,
”আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোনো এক রাতে সালাত পড়েছি। লক্ষ্য করেছি, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোনো আয়াত আসতো, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসতো, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসতো, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন।” (সহিহ মুসলিম : ৭৭২)
আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”আমি এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত পড়েছি। তার নিয়ম ছিল, রহমতের কোনো আয়াত আসলে, আল্লাহর কাছে রহমত চাইতেন। শাস্তির আয়াত আসলে আল্লাহর নিকট শাস্তি হতে পানাহ চাইতেন। আল্লাহর পবিত্রতার আয়াত আসলে, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করতেন।” (তাজিমু কাদরিস সালাত: ১/৩২৭)
এ ঘটনাগুলো তাহাজ্জুতের সালাতের ব্যাপারে।
সাহাবি কাতাদা ইবনে নুমান এর ঘটনা, ”তিনি এক রাতে সালাতে দাড়িয়ে, বার বার শুধু সূরায়ে এখলাস পড়েছেন। অন্য কোন সূরা পড়েননি।” (বোখারি – ফতহুল বারি : ৯/৫৯, আহমাদ : ৩/৪৩)
সালাতে তেলাওয়াত ও চিন্তা-ফিকির করার জন্য কোরআন হিফজ করা এবং সালাতে পড়ার দোয়া-দরূদ মুখস্থ করাও একাগ্রতা অর্জনে সহায়ক।
তবে নিশ্চিত, কোরআনের আয়াতে চিন্তা-গবেষণা করা এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া একাগ্রতা অর্জনের জন্য বড় হাতিয়ার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا ﴿১০৯﴾ (الإسراء :১০৯)
‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। (সূরা ইসরা : ১০৯)
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি, যার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতে চিন্তা, একাগ্রতা এবং কোরআনের আয়াতে গবেষণার চিত্র ফুটে উঠবে, আরো ফুঠে উঠবে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা। তাবিয়ী রহ. বলেন, আমি এবং উবাইদ ইবনে ওমায়ের আয়েশা রা.-এর নিকটি গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা শুনান। আয়েশা রা. এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন, অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি আমার প্রভুর ইবাদত করি। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য পছন্দ করি এবং আপনার পছন্দের জিনিসও পছন্দ করি। আয়েশা রা. বলেন, তিনি উঠে ওজু করলেন এবং সালাতে দাড়ালেন। আর কাঁদতে আরাম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বক্ষ ভিজে গেল। আরো কাঁদলেন, কাঁদতে কাঁদতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) সালাতের সংবাদ দিতে এসে দেখেন, তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন! অথচ আল্লাহ আপনার আগে-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ? রাসূল বললেন, আমার কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে মনে চায় না? আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত অবর্তীণ হয়েছে, যে এগুলো পড়বে আর এতে চিন্তা ফিকির করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ নিম্নোক্ত আসুরায়ে ফাতেহার পর আমিন বলাও আয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়ার একটি নমুনা। এর সাওয়াবও অনেক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যখন ইমাম আমিন বলে, তোমরাও আমিন বল। কারণ, যার আমিন ফেরেস্তাদের আমিনের সাথে মিলবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” ( সহিহ েিবাখারি : ৭৪৭)
তদ্রুপ ইমামের سمع الله لمن حمده এর জায়গায় মুক্তাদির ربنا ولك الحمد، বলা। এতেও রয়েছে অনেক সাওয়াব। রেফাআ জারকি রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে সালাত পড়ছিলাম। যখন তিনি রুকু হতে سمع الله لمن حمده বলে মাথা উঠালেন, পিছন থেকে একজন বলল, ربنا ولك الحمد حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه، রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করে বললেন, কে বলেছে? সে বলল আমি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ত্রিশজনেরও বেশি ফেরেশতাদের লক্ষ্য করেছি, এর সাওয়াব লেখার জন্য দৌড়ে ছুটে আসছে। কে কার আগে লিখবে। ( বোখারি, ফাতহুল বারি ২/২৮৪)
 পাঁচ : প্রতিটি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করে করে পড়া।
এ পদ্ধতি চিন্তা ও বোঝার জন্য সহায়ক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতও বটে। উম্মে সালামা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল, প্রথমে بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ পড়তেন। এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, الحمد لله رب العالمين এরপর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, الرحمن الرحيم এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, مالك يوم الدين، এভাবে এক একটি আয়াত ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তেন।
رواه أبوداود رقم (৪০০১) وصححه الألباني في الإرواء وذكر طرقه (২/৬০).
প্রতি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করা সুন্নত। যদিও পরবর্তী আয়াতের সাথে অর্থের মিল থাকে।
 ছয় : সুন্দর আওয়াজে তারতিল তথা ধীর গতিতে পড়া।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন আবৃত্তি কর। (আল-মুজ্জাম্মেল : ৪)
রাসূলুল্লাগ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তেলাওয়াতও ছিল, একটি একটি অক্ষর করে সুবিন্যস্ত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারতিল সহকারে সূরাগুলো তেলাওয়াত করতেন। একটি লম্বা সূরার তুলনায় পরবর্তী সুরাটি আরো লম্ব হত। ( সহিহ মুসলিম : ৭৩৩)
তারতিলের সাথে ধীরগতির পড়া খুশু ও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুত গতির পড়া একাগ্রতার প্রতিবন্ধক। সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করাও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপদেশ
”তোমরা সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত কর। কারণ, সুন্দর আওয়াজ কোরআনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।” (আল-হাকেম : ১/৫৭৫, সহিহ আল-জামে : ৩৫৮১)
তবে সাবধান! সুন্দর আওয়াজে পড়ার অর্থ অহংকার কিংবা গান-বাজনার ন্যায় ফাসেক-ফুজ্জারদের মত আওয়াজে নয়। এখানে সৌন্দর্যের অর্থ চিন্তার গভীরতাসহ সুন্দর আওয়াজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”সবচে’ সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি যার তেলাওয়াত শুনে মনে হয় সে আল্লাহকে ভয় করছে।” (ইবনে মাজাহ : ১/১৩৩৯, সহিহ আল-জামে : ২২০২)
সাত : মনে করা আল্লাহ তাআলা সালাতের ভেতর তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সালাতকে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আমার বান্দা যা চাবে তা পাবে। যখন আমার বান্দা বলে,
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল জগতের রব) আল্লাহ তাআলা বলেন, عبدي حمدني ( আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল) যখন বলে, الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ( পরম দয়ালু অতীব মেহেরবান) আল্লাহ বলেন, أثنى علي عبدي ( আমার বান্দা আমার গুণগান করল) যখন বলে, مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ ( বিচার-প্রতিদান দিবসের মালিক)আল্লাহ তাআলা বলেন, مجدني عبدي ( আমার বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল) যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ( আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি, কেবল আপনার কাছেই সাহায্য চাই) আল্লাহ তাআলা বলেন, هذا بيني وبين عبدي ولعبدي ما سأل، (এটি আমি ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে, পাবে) যখন বলে ( আমাদের সরল পথ দেখান, তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ নিপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি) আল্লাহ তাআলা বলেন, هذا لعبدي ولعبدي ما سأل. ( এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে পাবে) (সহিহ মুসলিম : ৩৯৫)
হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো নামাজি এর অর্থ ধ্যানে রাখলে সালাতে চমৎকার একাগ্রতা হাসিল হবে। সূরা ফাতেহার গুরুত্বও প্রনিধান করবে যতেষ্টভাবে। যেহেতু সে মনে করছে, আমি আল্লাহকে সম্বোধন করছি, আর তিনি আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন। সুতারাং এ কথপোকথনের যথাযথ মূল্যায়ন করা একান্ত কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমাদের কেউ সালাতে দাড়ালে সে, মূলত: তার রব-আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। তাই খেয়াল করা উচিত কিভাবে কথপোকথন করছে।”
مستدرك الحاكم (১/২৩৬) وهو في صحيح الجامع رقم (১৫৩৮).
 আট : সামনে সুতরা রেখে সালাত আদায় করা এবং সুতরার কাছাকাছি দাড়ানো।
এর দ্বারাও সালাতে একাগ্রতা অর্জন হয়। দৃষ্টি প্রসারিত হয় না, শয়তান থেকে হেফাজত এবং মানুষের চলাচল থেকেও নিরাপদ থাকা যায়। অথচ এ সকল জিনিস দ্বারাই সালাতে অন্যমস্কতার সৃষ্টি হয়, সাওয়াব কমে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”তোমাদের কেউ যখন সালাত পড়বে, সামনে সুতরা নিয়ে নেবে এবং তার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে।” (আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়ানোতে অনেক উপকার নিহিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
”যখন তোমাদের কেউ সুতরার সামনে সালাত পড়বে, সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়াবে।”(আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
যাতে শয়তান তার সালাত নষ্ট না করতে পারে। সুতরার নিকটবর্তী হওয়ার সুন্নত তরিকা হলো, সুতরা এবং তার মাঝখানে তিন হাত ব্যবধান রাখা। সুতরা এবং সেজদার জায়গার মাঝখানে একটি বকরি যাওয়ার মত ফাক রাখা। (বোখারি -ফতহুল বারি : ১/৫৭৪, ৫৭৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যেন সুতরার সামনে দিয়ে যেতে কাউকে সুযোগ না দেয়। তিনি বলেন, ”যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করে, সালাতের সম্মুখ দিয়ে কাউকে যাওয়ার সুযোগ দিবে না। যথাসাধ্য তাকে প্রতিরোধ করবে। যদি সে অস্বীকার করে তবে তাকে হত্যা করবে। কারণ, তার সাথে শয়তান। ( সহিহ মুসলিম : ১/২৬০, সহিহ আল-জামে : ৭৫৫)
ইমাম নববি রহ. বলেন, ”সুতরার রহস্য হলো, এর ভেতর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখা, যাতায়াত বাধাগ্রস্থ করা, শয়তানের চলাচল রুদ্ধ করা। যাতে তার গমনাগমন বন্ধ হয়, সালাত নষ্ট করার সুযোগ না পায়। (সহিহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ : ৪/২১৬)
নয় : ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে দাড়াতেন, ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন। তিনি বলেন, ”আমরা হলাম নবীদের জমাত। আমাদেরকে সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।”
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ”সালাতের ভেতর এক হাতের উপর আরেক হাত রাখার মানে কি? তিনি বলেন, এটি মহান আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত অবস্থা।”
ইবনে হাজার রহ. বলেন, আলেমগণ বলেছেন, ”এটি অভাবী-মুহতাজ লোকদের যাঞ্চনা করার পদ্ধতি। দ্বিতীয়ত: এর কারণে অহেতুক নড়া-চড়ার পথ বন্ধ হয়, একাগ্রতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। (ফতহল বারি : ২/২২৪)
দশ : সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখা।
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের সময় মাথা অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি দিতেন মাটির দিকে।”
”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশ করে, বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেজদার জায়গাতেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছেন।”
যখন তাশাহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, ”তিনি যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সে দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতেন।”
رواه ابن خزيمة (১/৩৫৫ رقم ৭১৯) وقال المحقق : إسناده صحيح، وانظر صفة الصلاة ص: ১৩৯.
অন্য আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”তিনি শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে ইশারা করেছেন। আর দৃষ্টি এ ইশারা অতিক্রম করেনি।”رواه أحمد (৪/৩)، وأبو داود رقم (৯৯০).
একটি মাসআলা : অনেক নামাজির অন্তরে ঘোরপাক খায়, সালাতে চোখ বন্ধ রাখার বিধান কি? বিষেশত: এর দ্বারা অনেকে অধিক একাগ্রতাও উপলব্ধি করেন।
উত্তর : চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত সুন্নত এর খেলাফ। যা পূর্বের বর্ণনাতে স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এর দ্বারা সেজদার জায়গা ও শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সুন্নত ছুটে যায়। আরো অনেক হাদিস বর্ণিত আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে চোখ খোলা রাখতেন। যেমন, সালাতে কুছুফে জান্নাত দেখে ফলের থোকা ধরার জন্য হাত প্রসারিত করা, জাহান্নাম দেখা, বিড়ালের কারণে শাস্তি ভোগকারী নারীকে দেখা, লাঠির আঘাতে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে দেখা, সালাতের সামনে দিয়ে অগ্রসরমান জানোয়ার ফিরানো, তদ্রুপ শয়তানের গলা চিপে ধরা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ্য করা এসব ঘটনা ছাড়াও আরো ঘটনা আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় সালাতে চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ নয়।
তবে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ কি-না এ ব্যাপারে আলেমদের মতদ্বৈততা আছে। ইমাম আহমদসহ অনেকে বলেছেন, এটি ইহুদিদের আমল, সুতরাং মাকরূহ। অপর পক্ষ বলেছেন, এটি বৈধ, মাকরূহ নয়।… সঠিক উত্তর হলো, যদি চোখ খোলা রাখার কারণে, একাগ্রতায় কোনো বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়, তবে খোলা রাখাই উত্তম। আর যদি মসজিদের অঙ্গ-সজ্জা কিংবা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে একাগ্রতাতে বেঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ হবে না। বরং এ ক্ষেত্রে শরয়ি নিয়ম-কানুনের দৃষ্টিকোণ থেকে চোখ বন্ধ রাখা মোস্তাহাব হিসেবেই বিবেচিত। সংক্ষিপ্ত : زاد المعاد (১/২৯৩) ط. دار الرسالة.
 মুদ্দা কথা, সালাতে চোখ খোলা রাখাই সুন্নত। তবে একাগ্রতায় বিঘ্নতা সৃষ্টিকারী বস্তু হতে হেফাজতের জন্য চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ নয়।
 এগারো : শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করা।
অধিকাংশ নামাজি এর ফজিলত ও একাগ্রতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা কত বেশি তা তো জানেই না, উল্টো একে ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”লোহার তুলনায় এর আঘাত শয়তানের উপর অধিক কষ্টদায়ক।”
رواه الإمام أحمد (২/১১৯) بسند حسن كما في صفة الصلاة ص : ১৫৯.
কারণ, এর দ্বারা বান্দার মনে আল্লাহর একত্ব ও ইখলাসের কথা স্মরণ হয়। যা শয়তানের উপর বড়ই পিড়াদায়ক। الفتح الرباني للساعاتي (৪/১৫).
এজন্যই আমরা লক্ষ্য করি, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর জন্য একে অপরকে উপদেশ দিতেন, নিজেরাও এ ব্যাপারে যত্নবান থাকতেন। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আজ আমাদের কাছে অবহেলা ও অমনোযোগের শিকার। হাদিসে এসেছে, ”সাহাবায়ে কেরাম এ জন্য একে অপরকে নাড়া দিতেন, সতর্ক করতেন। অর্থাৎ আঙ্গুলের ইশারার জন্য।”
رواه ابن أبي شيبة بسند حسن كما في صفة الصلاة ص: ১৪১، المصنف ( ১০/৩৮১ رقم ৯৭৩২) ط. الدار السلفية، الهند.
আঙ্গুলের ইশারায় সুন্নত হলো, তাশাহুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আঙ্গুল কেবলার দিকে উঠিয়ে রাখা।
 বার : সালাতের ভেতর সব সময় একই সূরা ও একই দোয়া না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া-দরূদ পড়া।
এর দ্বারা নতুন নতুন অর্থ ও ভাবের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এ আমল সে ব্যক্তিই করতে পারে, যার বিভিন্ন সূরা ও অনেক দোয়া মুখস্থ আছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এমননি করতেন। তিনি কোনো একটি সূরা বা কোনো একটি দোয়া বার বার এক জায়গায় পড়েননি। যেমন তাকবিরে তাহরিমার পরে নিম্নোক্ত দোয়াগুলো থেকে একেক সময় একেকটা পড়তেন।
১. আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শুরু করে কিছু সময় চুপ থাকতেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল- আপনার উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ- তাকবির এবং কেরাতের মাঝখানে চুপ থাকেন কেন? তিনি বললেন, আমি এ সময় বলি,
২. আবু সাইদ, আয়েশা রা. ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শুরু করে এ দোয়াটি পড়তেন
৩. ইবনে ওমর রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত আদায় করছিলাম, এক লোক বলল,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ কালিমাগুলো কে বলল ? আমাদের ভেতর থেকে একজন বলল, আমি বলেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আশ্চর্য হলাম এর জন্য আসমানের সমস্ত দরজাই খুলে দেয়া হয়েছে। ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এ কথা শুনার পর আর কোন দিন এগুলো পড়া ছাড়িনি। ( সহিহ মুসলিম: ১/৪২০)
৪. আলী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দাড়িয়ে বলতেন,
وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين، إن صلاتي، ونسكي، ومحياي، ومماتي لله رب العالمين، لاشريك له وبذلك أمرت وأنا من المسلمين. اللهم أنت الملك لا إله إلا أنت. أنت ربي وأنا عبدك، ظلمت نفسي واعترفت بذنبي فاغفرلي ذنوبي جميعا إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت واهدني لأحسن الأخلاق لا يهدي لأحسنها إلا أنت، واصرف عني سيئها، لا يصرف عني سيئها إلا أنت، لبيك وسعديك، والخير كله بيديك، والشر ليس إليك، أنا بك وإليك، تباركت وتعاليت، أستغفرك وأتوب إليك. ( أخرجه مسلم ১/৫৩৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাত এ দোয়ার মাধ্যমে আরম্ভ করতেন।
اللهم رب جبرائيل، وميكائيل، وإسرافيل فاطر السموات والأرض، عالم الغيب والشهادة، أنت تحكم بين عبادك فيما كانوا فيه يختلفون. اهدني لما اختلف فيه من الحق بإذنك إنك تهدي من تشاء إلى صراط مستقيم.) أخرجه مسلم ১/৫৩৪(
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাতে দাড়িয়ে কখনো নিম্নেক্ত দোয়া পাঠ করতেন :
ت) .)ا ৩/৩ و১১/১১৬و ১৩/৩৭১، ৪২৩،৪৬৫ ومسلم مختصرا بنحوه ১/৫৩২(
এ সমস্ত দোয়া হতে কোনো একটি সর্বদার জন্য নির্দিষ্ট করে পড়েননি।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ সকল দোয়া অনুসন্ধান করে বলেন,
১. সবচে’ উত্তম জিকির হলো যেগুলোতে শুধু আল্লাহর প্রসংশা ও গুণ-র্কীতন রয়েছে।
২. এর পর যেগুলোতে বান্দার ইবাদত-আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
৩. এর পর যেগুলোতে দোয়া-প্রার্থনা রয়েছে।
সবচে’ উত্তম জিকির যেমন,
سبحانك اللهم وبحمدك، وتبارت اسمك، وتعالى جدك، ولاإله غيرك.
এবং দোয়া,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
এ দুটি দোয়ার মাঝে প্রথমটির ফজিলত বেশী। কারণ, এতে আছে, কোরআনের পর সবচে’ মর্যদাশীল কলিমা, سبحانك اللهم وبحمدك এবং কোরআনের শব্দ وتبارت اسمك، وتعالى جدك এ জন্যই অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম এর মাধ্যমে সালাত আরাম্ভ করতেন। ওমর রা. এ দোয়া জোরে জোরে পড়তেন এবং মানুষদের শিক্ষা দিতেন। এর পর দ্বিতীয় প্রকার দোয়া যেমন, وجهت وجهي للذي فطر السموات…. এতে আনুগত্যের বর্হিপ্রকাশও রয়েছে, দোয়াও রয়েছে। প্রথম প্রকার দোয়া শেষে এ দোয়াটি পড়লে মূলত দোয়ার তিন প্রকারই পড়া হবে। তৃতীয় প্রকার দোয়া যেমন, اللهم باعد بيني وبين خطاباي… ইত্যাদি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৩৯৪-৩৯৫)
সালাতের ভেতর সূরা তেলাওয়াত করার সময়ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূরা পড়তেন। ফজর সালাতে সাধারণত পড়তেন, তেওয়ালে মুফাস্‌সল : ওয়াকিয়া, তুর, ক্বাফ। কেসারে মুফাস্‌সল : তাকওয়ীর, জিলজাল, সূরা নাস ও ফালাক। সূরা রোম, ইয়াসিন, এবং সাফ্‌ফাতও পড়েছেন। জুমার দিন ফজর সালাতে পড়তেন, সূরা সেজদাহ ও সূরা দাহর।
জোহর সালাতে এক এক রাকাতে ত্রিশ আয়াত পরিমাণ পড়তেন। সূরায়ে তারেক, বুরূজ এবং লাইলও পড়েছেন।
আছর সালাতে এক এক রাকাতে পনের আয়াত পরিমাণ পর্যন্ত পড়তেন। সূরা তারেক, বুরূজ এবং সূরা লাইলও পড়েছেন।
মাগরিব সালাতে কেসারে মুফাস্‌সল : সূরা ত্বীন পড়তেন। আবার সূরা মুহাম্মদ, তুর ও মুরসালাত ইত্যাদিও পড়েছেন।
এশার সালাতে আওসাতে মুফাস্‌সল : সূরা শামস, ইনশেকাক পড়তেন। মুয়াজ রা.-কে এশার সালাতে সূরায়ে আ’লা, কালাম এবং সূরায়ে লাইল পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাতের সালাতে লম্বা লম্বা সূরা পড়তেন। দুই’শ একশ পঞ্চাশ আয়াত পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনো এরচে’ কমও পড়েছেন।
রুকুর বিভিন্ন তাসবিহ, যেমন :
১- سبحان ربي العظيم.
২- سبحان ربي العظيم وبحمده.
৩- سبوح قدوس رب الملائكة والروح. ৪
– اللهم لك ركعت، وبك آمنت، ولك أسلمت، وعليك توكلت، أنت ربي، خشع لك سمعي وبصري ودمي ولحمي وعظمي وعصبي لله رب العالمين.
রুকু হতে উঠার পর তাসবিহ। যেমন,
১- سمع الله لمن حمده.
২- ربنا ولك الحمد.
৩- ربنا لك الحمد.
৪ – اللهم ربنا لك ولك الحمد.
৫ – ملء السموات ومل الأرض وملء ما شئت من شيئ بعد. أهل الثناء والمجد، اللهم لا مانع لما أعطيت، ولا معطي لما منعت، ولا ينفع ذا الجد منك الجد.
সেজদার তাসবিহ সমূহ। যেমন,
১- سبحان ربي الأعلى.
২ – سبحان ربي الأعلى وبحمده.
৩- سبوح قدوس رب الملائكة والروح.
৪- سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي.
৫- اللهم لك سجدت، وبك آمنت، ولك أسلمت، سجد وجهي للذي خلقه وصوره وشق سمعه وبصره، تبارك الله أحسن الخالقين.

Translate