Friday, April 22, 2022

পহেলা বৈশাখ পালনের বিধান এবং এ উপলক্ষে সরকারী নির্দেশে আমাদের করণীয়

 প্রশ্ন: ‘পহেলা বৈশাখ’ উপলক্ষে পান্তা-ইলিশ খাওয়া যাবে কি? বর্তমান সরকার এ উৎসব উপলক্ষে ছাত্র/ছাত্রী ও শিক্ষকদেরকে স্কুল-কলেজে উপস্থিত থাকা ও তা পালন করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?

উত্তর:
ইসলামে মুসলিমদের জন্য দুটি জাতীয় উৎসবের দিন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একটি হল, ঈদুল আজহা অপরটি হল, ঈদুল ফিতর। এ দুটি ছাড়া মুসলিমদের জন্য ৩য় কোন আনন্দ-উৎসব জাতীয়ভাবে উদযাপন করার সুযোগ নেই।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখলেন, মদিনা বাসী খেলা-ধুলার মধ্য দিয়ে দুটি দিবস উদযাপন করে থাকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কী?

তারা বলল, এ দুটি দিবস জাহেলি যুগে আমরা খেলা-ধুলার মধ্য দিয়ে উদযাপন করতাম। তিনি বললেন,
إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ
“আল্লাহ তোমাদের জন্য এর থেকে উত্তম দুটি দিবসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একটি হল, ঈদুল আজহা এবং অপরটি হল, ঈদুল ফিতর।” [সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ৯৫৯ সনদ-সহীহ, আলবানি]
উপরোক্ত হাদিস থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ইসলামি শরিয়তে ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর ব্যতিরেকে জাতীয়ভাবে তৃতীয় কোন ঈদ বা উৎসব পালনের সুযোগ নেই। অথচ দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের মুসলিম সমাজে বর্তমানে কত ধরণের ঈদ-উৎসব জমজমাট ভাবে পালন করা হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। যেমন: ঈদে মিলাদুন নবী বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম উৎসব। বরং এটাকে ‘সকল ঈদের শ্রেষ্ঠ ঈদ’ বলে জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে। যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিসের সুস্পষ্ট বিরোধী। অনুরূপভাবে তথাকথিত পহেলা বৈশাখ, খৃষ্ট নববর্ষ, এপ্রিল ফুল, বড় দিন (Xmas Day) ইত্যাদি অগণিত উৎসব আমদের মুসলিমগণ অবলীলায় পালন করে যাচ্ছে কিন্তু একবারও চিন্তা করে দেখে না যে, আসলে এগুলোর উৎস কোথায়? এসব মূলত: হিন্দু ও খৃষ্টানদের থেকে আমদানিকৃত সংস্কৃতি যার সাথে মুসলমানের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলে গেছেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করল সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” [আবু দাউদ হাদিস নং ৩৫১২, সনদ-সহীহ, আলবানী]
সুতরাং আমাদের সমাজে ইদানীং পহেলা বৈশাখ পালনের যে মহা আয়োজন দেখা যাচ্ছে এর সাথে মুসলিমদের কোন সম্পর্ক নেই। বরং এ সব অনুষ্ঠান উপলক্ষে যা কিছু দেখা যাচ্ছে সেগুলো অধিকাংশ হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ।

তাই এ উপলক্ষে কোন ধরণের অনুষ্ঠান করা, শুভেচ্ছা বিনিময় করা, কথিত প্রভাত ফেরী ও মঙ্গল শোভা যাত্রায় অংশ গ্রহণ করা, পণ্যটা-ইলিশ খাওয়া এ সব জাহেলিয়াত পূর্ণ কাজ। এগুলোতে কোন মুসলিম সন্তানের অংশ গ্রহণ করা বৈধ নয়।

সরকার যদি অন্যায় ভাবে মুসলিমদের উপর কোন অনৈসলামিক অনুষ্ঠান চাপিয়ে দেয় তাহলে তা মান্য করা যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
“স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।” [মুসনাদ আহমদ-সহীহ] বরং আইন সঙ্গত পন্থায় তার প্রতিবাদ করতে হবে। কিন্তু যদি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা না থাকে বা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ না করলে জান-মালের ক্ষতির আশংকা থাকে তাহলে ঘৃণা সহকারে তাতে অংশ গ্রহণ করা যাবে। এটুকু হল ঈমানের সর্ব নিম্ন আলামত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহীহ হাদিসে বলেছেন,
«مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ»
“তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় দেখবে সে যেন তা তার হাত দিয়ে বাধা দেয়, আর যদি হাত দিয়ে বাধা না দিতে পারে তবে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়, আর যদি মুখ দিয়ে বাধা না দিতে পারে তবে যেন অন্তর দিয়ে বাধা দেয়, আর এটি হলো দুর্বল ঈমানের পরিচয়।” [সহিহ মুসলিম, হা/৪৯]
আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের বিজাতীয় সংস্কৃতি ও অন্ধ অনুকরণ থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

সহবাসের সময় আজান হলে কী করণীয়?

 প্রশ্ন: সহবাসের সময় আজান হলে কী করণীয়?

উত্তর:
স্ত্রী সহবাসের সময় আজান শুনলে স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করবে। তবে এ সময় মুখে উচ্চারণ করে আজানের জবাব দেয়া সমীচীন নয়।
ইমাম নওবি রহ. বলেন,
ويكره للقاعد على قضاء الحاجة أن يذكر الله تعالى بشيء من الاذكار فلا يسبح ولا يهلل ولا يرد السلام ولا يشمت العاطس ولا يحمد الله تعالى اذا عطس ولا يقول مثل ما يقول المؤذن. قالوا وكذلك لا يأتي بشيء من هذه الأذكار في حال الجماع، وإذا عطس في هذه الاحوال يحمد الله تعالى في نفسه ولا يحرك به لسانه. وهذا الذي ذكرناه من كراهة الذكر في حال البول والجماع هو كراهة تنزيه لا تحريم فلا إثم على فاعله. انتهى.
“প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বসা অবস্থায় সময় কোনও প্রকার আল্লাহর জিকর-আজকার করা মাকরুহ (অ পছন্দনীয়)। সুতরাং এ সময় মুখে উচ্চারণ করে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (ইত্যাদি জিকির-আজকার) পাঠ করা, সালামের জবাব দেয়া, হাঁচির জবাব দেয়া, হাঁচি দিলে আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করা এবং মুয়াজ্জিনের আজানের জবাব দেয়া যাবে না। এ অবস্থায় হাঁচি দিলে মনে মনে আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করবে। জিহ্বা নাড়িয়ে উচ্চারণ করবে না।
উল্লেখিত বিষয়গুলো পেশাব-পায়খানা এবং স্ত্রী সহবাস রত অবস্থায় করা মাকরুহ তানযিহি; তাহরিমি নয়। সুতরাং কেউ তা করলেও গুনাহ হবে না।” (শরহে মুসলিম)
তবে রমজান মাসে ফজরের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করার পর ফজরের আজান শুনার সাথে সাথে সহবাস থেকে বিরত হওয়া আবশ্যক। এর পরে সহবাস অব্যাহত রাখা জায়েজ নেই। অন্যথায় উক্ত রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং এ কারণে তওবা-ইস্তিগফারের পাশাপাশি কাফফারাও দিতে হবে।
তবে নফল রোজার ক্ষেত্রে স্ত্রী সহবাস বন্ধ করা আবশ্যক নয়। এ ক্ষেত্রে তা অব্যাহত রাখলে উক্ত রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে সম্ভব হলে তা পরবর্তীতে কাজা করে নেয়া উত্তম। এতে কোনও কাফফারা নেই।

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।

অমুসলিমদেরকে ইফতার বা সাধারণ খাবার খাওয়ানো যাবে কি

 প্রশ্ন : অমুসলিমদেরকে ইফতার বা সাধারণ খাবার খাওয়ানো যাবে কি?

উত্তর :
অমুসলিমদের সামনে ইসলামের উদারতা, সৌন্দর্য এবং মহানুভবতা প্রকাশ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাদের অন্তরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার অন্যতম উপায়। সুতরাং ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোন অমুসলিমকে মুসলিমদের ইফতার খাওয়ার জন্য ডাকা জায়েজ রয়েছে। হতে পারে, এটি তার হেদায়েতের ওসিলা হয়ে যাবে।
অনুরূপভাবে যে কোন অভাবী বা নি:স্বকে খাদ্য খাওয়ানো বিরাট সওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে কুরআন-হাদিসে বহু বক্তব্য এসেছে। তাই কোন গরিব-অসহায় কাফিরকে যদি ইফতারের খাবার দেওয়া হয় তাতেও সওয়াব রয়েছে ইনশাআল্লাহ যদি সে মুহারিব তথা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত না হয়। তবে শর্ত হল তার সাথে আন্তরিক ভালবাসা পূর্ণ সম্পর্ক রাখা চলবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَّا يَنْهَاكُمُ اللَّـهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন।” (সূরা মুমতাহিনাহ: ৮)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُم مِّنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ ۙ أَن تُؤْمِنُوا بِاللَّـهِ رَبِّكُمْ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে। তারা রসূলকে ও তোমাদেরকে বহিষ্কার করে এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখ।” (সূরা মুমতাহিনাহ: ১)

মোটকথা, ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে কাফিরদেরকে ইফতার খাওয়ানো জায়েজ।
অনুরূপভাবে যে কোন অভাবী, গরিব-অসহায় মানুষকে-চাই সে মুসলিম হোক বা কাফির হোক- খাদ্যদানে সওয়াব রয়েছে।
তবে যদি কোন কাফির মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হয় বা ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে বা অভাবী না হয় তাহলে তাদেরকে ইফতার খাওয়ার জন্য ডাকা ঠিক নয়। বরং সে ক্ষেত্রে মুসলিম, দ্বীনদার ও নিকটাত্মীয়রা এই খাদ্য খাওয়ার বেশি হকদার। আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সউদী আরব।।

Monday, April 11, 2022

মানুষের কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণের ফযিলত এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও রাগ সংবরণের উপায়

 প্রশ্ন: আমি যদি কারো ব্যবহারে কস্ট পাই বা কারো উপর বিরক্ত হই কিন্ত মুখে কিছু না বলি বা অন্তরে ও প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা না রাখি শুধু মনের মধ্যে কস্ট টা অনিচ্ছা সত্তেও থেকে যায়। এটা কি কারো জন্য মনে বিদ্বেষ রাখা হবে?

আসলে মনে বিদ্বেষ রাখা বলতে কি বুঝায়? এবং মনকে বিদ্বেষ মুক্ত রাখার জন্য আমাদের কী করা উচিৎ?
উত্তর:
আপনি যদি কারও আচরণে কষ্ট পান বা বিরক্ত হন আর তার প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ধৈর্যের পরিচয় দেন এবং তার সাথে চলাফেরা অব্যহত রাখেন (যদিও মনে কষ্ট বিদ্যমান থাকে) তবে এতে গুনাহ হবে না এবং এটিকে ‘বিদ্বেষ’ও বলা যাবে না বরং এটি উন্নত চরিত্রের বর্হি:প্রকাশ।
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন:
(الْمُؤْمِنُ الَّذِي يُخَالِطُ النَّاسَ، وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ، خَيْرٌ مِنَ الَّذِي لا يُخَالِطُ النَّاسَ، وَلا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ))

“যে ঈমানদার ব্যক্তি মানুষের সাথে মেলামেশা করে এবং তারা কষ্ট দিলে সবর করে ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম যে মানুষের সাথে মেলামেশা করে না এবং তাদের কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করে না।”* (ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী-সনদ হাসান)

❍ ❍ বিদ্বেষ অর্থ: ঈর্ষা, হিংসা, শত্রুতা-যেটা ভালোবাসার বিপরীত
কারও প্রতি রাগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই রাগকে দমন করাই বিরত্বের পরিচায়ক।
পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ছাড়া কারও প্রতি হিংসা রাখা বা শত্রুতা ঠিক নয়। যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে আর আল্লাহর জন্যই কারো প্রতি শত্রুতা পোষণ করে হাদীসে তার বিশেষ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
রাসূলুল্লাহ (ﷺ ) বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلَالِي الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّي
‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, আমার মহত্ত্বের নিমিত্তে পরস্পর ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনকারীরা কোথায় ? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় ছায়া দান করব। আজ এমন দিন, যে দিন আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া নেই।’’
(মুসলিম, কিতাবুল বিররি ওয়াস-সিলাহ, হাদিস নং৪৬৫৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ الْحُبُّ فِي اللَّهِ وَالْبُغْضُ فِي اللَّهِ

‘‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালবাসা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারো সাথে শত্রুতা রাখা।’’
(আহমদ, মুসনাদুল আনসার, হাদিস নং২০৩৪১)

✳ মনকে হিংসা ও বিদ্বেষ মুক্ত রাখার কতিপয় উপায়:
১) আল্লাহর নিকট দুআ করা
২) এ কথা মনে রাখা যে, যে ব্যক্তি হিংসা বা বিদ্বেষ করবে সে নিজেই নিজের ক্ষতি করবে।
৩) যার প্রতি হিংসা সৃষ্টি হবে, তার বরকতের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করা।
৪) এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখা যে, হিংসা দ্বারা কারও ক্ষতি করা সম্ভব নয়। কারণ, ভালো-মন্দ সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। হিংসা দ্বারা কেউ কারও ক্ষতি করতে পারবে না।
৫) কারও ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা জাগ্রত হলে এ চিন্তা করা যে, কারো ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকাও একটি সদকার সওয়াব। (বুখারী ও মুসলিম)

✳ ক্রোধ/রাগ সংবরণের উপায়:

আবু যার (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীছে ক্রোধ সংবরণের কৌশল বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ক্রদ্ধ হবে তখন দাঁড়িয়ে থাকলে সে যেন বসে যায়। এতেও যদি তার রাগ দূর না হয় তাহ’লে সে যেন শুয়ে পড়ে’। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূদাঊদ হা/৪৭৮২, মিশকাত, হা/৫১১৪)
অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَإِذَا غَضِبْتَ فَاسْكُتْ. ‘যখন তুমি ক্রদ্ধ হবে তখন চুপ থাকবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১৩২০)
সুলায়মান ইবনু ছুরাদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-এর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন দু’জন লোক গালাগালি করছিল। তাদের একজনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার রগগুলো ফুলে গিয়েছিল।
তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি এমন একটি দো‘আ জানি, যদি এই লোকটি তা পড়ে তবে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে যদি পড়ে ‘আ‘উযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রজীম’- (‘আমি বিতাড়িত শয়তানের কাছ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি’) তবে তার রাগ চলে যাবে। তখন লোকেরা তাকে বলল, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, তুমি আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় চাও। সে (রাগে) বলল, আমি কি পাগল হয়েছি’ । (বুখারী হা/৩২৮২ ‘সৃষ্টি সূচনা’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৬১০)
ক্রোধ সংবরণ করার ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‌ বলেন, ‘যে ব্যক্তি বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রাগ চেপে রাখে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের সামনে তাকে আহবান করে যে কোন হূর নিজের জন্য পসন্দ করার অধিকার দিবেন’। (ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৬; তিরমিযী হা/২০২১)
আল্লাহ আমাদের অন্তরকে ক্ষতিকারণ রাগ এবং সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ থেকে হেফাযত করুন। আমীন।।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

খিটখিটে মেজাজ সমাধানে কিছু পরামর্শ

 প্রশ্ন: আমার মেজাজ সব সময় অনেক খিটখিটে হয়ে থাকে। সব সময় কেমন জানি রাগ উঠেই থাকে। আমি অনেক চেষ্টা করি তবুও কন্ট্রোল করতে পারি না। মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে সব সময়। আমি কী করলে আমার খিটখিটে মেজাজ ভালো হবে? প্লিজ দয়া করে উত্তর টা দিবেন।

উত্তর:
আমাদের জানা দরকার যে, বিভিন্ন কারণে মানুষের মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। যেমন: রোগ-ব্যাধি, ঘুম কম হওয়া, পারিবারিক সমস্যা, কর্মস্থলে বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত কোনও ঘটনা, মানসিক চাপ, অস্থিরতা, অশান্তি, দুঃখ-কষ্ট, টেনশন, মহিলাদের পিরিয়ড কালীন সময় ইত্যাদি। সুতরাং কী কারণে আপনার এমনটি ঘটছে তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

যদি শারীরিক রোগ-ব্যাধির কারণে এমনটি ঘটে তাহলে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আর যদি কোন কারণে অতিরিক্ত মানসিক চাপ অনুভব করেন বা মানসিক অশান্তিতে থাকেন তাহলে তা চিহ্নিত করে তা থেকে মুক্তি লাভের উপায় খুঁজতে হবে। বিশেষ কোনও সমস্যা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং মানসিক প্রশান্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

❑ খিটখিটে মেজাজ মুহূর্তেই ভালো করবে চার খাবার:

দৈনিক কালের কণ্ঠ (অনলাইন) লিখেছে,
টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করেছে এমন কিছু খাবারের কথা, যা আপনার মেজাজ ভালো করে, তরতাজা ও উৎফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। চলুন জেনে নেয়া যাক সে খাবারগুলো সম্পর্কে-

◍ চকলেট:

চকলেটে ফিনাইলিথ্যালাইমিনের বেশ কয়েকটি কার্যকর মিশ্রণ রয়েছে যা এন্ডোরফিন এবং আনন্ডামাইডকে বাড়ায়। চকলেট সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা দেখায় যে, এটি মেজাজ এবং জ্ঞানকে উন্নত করতে পারে, পাশাপাশি এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, আয়রন এবং ম্যাগনেসিয়ামের একটি সমৃদ্ধ উৎস।

◍ বাদাম:

আখরোট, চিনা বাদাম, পেস্তা, কিসমিসের আশ্চর্যজনক পুষ্টিমান রয়েছে। এগুলো অবশ্যই আপনার খাবারের তালিকায় যুক্ত করা উচিত। এগুলো ফাইবার, প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাটে পূর্ণ সুপার হেলথ খাবার।কাজু বাদাম এবং অন্যান্য বাদাম অল্প করে খান যাতে আপনার কার্ব এবং ক্যালোরি স্তর ঠিক থাকে। সকাল ১১টার দিকে একমুঠো মিশ্র বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করুন। এটি স্বাস্থ্যকর নাস্তা। বাদামে আপনার মেজাজ, ত্বক এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার জন্য ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে।

◍ ডিম:

আমরা সবাই বিভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করা ডিম খেতে পছন্দ করি। সুসংবাদ হল; ডিম খেলে আপনার মেজাজ ভালো থাকবে। ডিমে প্রোটিন, ভিটামিন ডি, বি ১২ বেশি থাকে এবং কোলিনযুক্ত থাকে, এটি এমন একটি পুষ্টি যা স্নায়ুতন্ত্রকে সমর্থন করে। যা আপনার মেজাজ ভালো রাখতে কাজ করে। এছাড়াও ডিম খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং এটি খাওয়ার অনেক পদ্ধতি রয়েছে।

◍ অ্যাভোকাডো এবং বেল পেপার (ক্যাপসিকাম):

অ্যাভোকাডোর পুষ্টিকর ফ্যাট এবং সুপার ক্রিম যুক্ত টেক্সচার মেজাজ ভালো রাখার খাবার হিসেবে বিবেচিত। এতে ভিটামিন বি ৬, ভিটামিন বি ৫, ফাইবার, ভিটামিন ই, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই খাবার ভিটামিন এবং পুষ্টি নিউরোট্রান্সমিটার সংশ্লেষ করতে সাহায্য করে। রঙিন বেল পেপার (ক্যাপসিকাম) রাখুন খাবারের তালিকায়। এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি বেশি রয়েছে যা মেজাজ উন্নত করতে ও সঙ্কট হ্রাস করতে সাহায্য করে।
আল্লাহ আপনার মানসিক অবস্থা ঠিক করে দিন এবং সমস্যা থেকে মুক্তি দান করুন- আমরা সে জন্য দোয়া করি। এছাড়াও নিম্নোক্ত লেখাগুলো পড়ার অনুরোধ করছি।।

▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Sunday, April 10, 2022

আমরা কি পরকালের জন্য প্রস্তুত?

 এক বাদশার একটি বাগান ছিল।

বাগানটি ছিল অনেক বড় এবং বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট। বাদশাহ একজন লোককে ডাকলেন। তার হাতে একটি ঝুড়ি দিয়ে বললেন, আমার এই বাগানে যাও এবং ঝুড়ি বোঝাই করে নানা রকম ফলমুল নিয়ে আস। তুমি যদি ঝুঁড়ি ভরে ফল আনতে পার আমি তোমাকে পুরস্কৃত করব। কিন্তু শর্ত হল, বাগানের যে অংশ তুমি পার হবে সেখানে তুমি আর যেতে পারবে না। লোকটি মনে করলো এটা তো কোন কঠিন কাজ নয়। সে এক দরজা দিয়ে বাগানে প্রবেশ করল। দেখল, গাছে গাছে ফল পেকে আছে। নানা জাতের সুন্দর সুন্দর ফল। কিন্তু এগুলো তার পছন্দ হল না। সে বাগানের সামনের  অংশে গেল। এখানকার ফলগুলো তার কিছুটা পছন্দ হল। কিন্তু সে ভাবল আচ্ছা থাক সামনের অংশে গিয়ে দেখি সেখানে হয়ত আরো উন্নত ফল পাব, সেখান থেকেই ফল নিয়ে ঝুঁড়ি ভরব। সে সামনে এসে পরের অংশে এসে অনেক উন্নত মানের ফল পেল। এখানে এ সে তার মনে হল এখান থেকে কিছু ফল ছিড়ে নেই। কিন্তু পরক্ষণে ভাবতে লাগলো যে সবচেয়ে ভা ফলই ঝুড়িতে নিবে। তাই সে সামনে এগিয়ে বাগানের সর্বশেষ অংশে প্রবেশ করল। সে এখানে এসে দেখল ফলের কোন চিহ্ন ই নেই। অতএব সে আফসোস করতে লাগল আর বলতে লাগল, হায় আমি যদি বাগানে ঢুকেই ফল সংগ্রহ করতাম তাহলে আমার ঝুড়ি এখন খালি থাকত না। আমি এখন বাদশাকে কি করে মুখ দেখাব। ঘটনা বর্ণনা করার পর শায়েখ গজালি (রহ:) বলেন, বন্ধুগণ, বাদশাহ হলেন আল্লাহ, আর বাগানে প্রবেশ কারি লোকটি হল তুমি। আর ঝুড়ি দ্বারা উদ্দেশ্য হল তোমার আমলনামা। আর বাগান দ্বারা উদ্দেশ্য হল তোমার জীবন। বাগানের বিভিন্ন অংশ তোমার জীবনের বিভিন্ন ধাপ। আর তোমাকে নেক কাজের ফল ছিড়তে বলা হয়েছে, কিন্তু তুমি প্রতিদিনই ভাব, আগামী কাল থেকে ফল ছেড়া আরম্ভ করব। আগামী দিন আগামী দিন করতে করতে তোমার জীবনে আর আগামী দিন আসবে না। এভাবেই তুমি রিক্ত হস্তে মাওলার সামনে হাজির হবে।

আপনি নিজেকে কিভাবে গুনাহ থেকে বাঁচাবেন?

 একটি অসাধারন গল্প। সবাই পড়ুন

এবং শেয়ার করুন।
একদিন এক যুবক একজন আলেমের কাছে এসে বললঃ “হুযুর, আমি একজন তরুণ যুবক ।কিন্তু সমস্যা হল, আমার মাঝে মাঝে প্রবল খায়েশ কাজ করে । আমি যখন রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করি, তখন আমি মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে পারি না । আমি এখন কি করতে পারি ?” তখন ঐ আলেম কিছুক্ষন চিন্তা করলেন । চিন্তা করার পর তাকে একটা দুধ ভর্তি গ্লাস দিলেন । গ্লাস পুরোটায় দুধে কানায় কানায় পরিপুর্ণ ছিল । অতঃপর ঐ আলেম তাকে বললেনঃ “আমি তোমাকে বাজারের একটি ঠিকানা দিচ্ছি, তুমি এই দুধটুকু সোজা সেখানে পৌছিয়ে দিয়ে আসবে । ঐ আলেম তাকে আরও নির্দেশ দিলেন যে, গ্লাস থেকে এক ফোঁটা দুধও যাতে না পরে । অতঃপর ঐ আলেম, উনার এক ছাত্রকে ঐ যুবকের সহযোগী করে আদেশ দিলেনঃ “তুমি এই যুবকের সাথে বাজারে যাও, এবং সে যদি যাওয়ার সময় এই গ্লাস
থেকে এক ফোঁটা দুধও ফেলে দেয়, তাহলে তুমি তাকে চরম ভাবে পিটাতে থাকবে । ঐ যুবকটি সহজেই দুধটুকু বাজারে পৌছিয়ে দিল এবং এই সংবাদ হুযুরকে জানানোর জন্য দৌড়ে ছুটে আসল । হুযুর জিজ্ঞাসা করলেনঃ “তুমি যাওয়ার সময় কয়টি মেয়ের চেহারা দেখেছ?” যুবকটি সবিস্ময়ে বললঃ “হুযুর, আমি তো বুঝতেই পারি নি আমার চারপাশে কি চলছিল । আমি তো এই ভয়েই তটস্থ ছিলাম যে, আমি যদি দুধ ফেলে দিই তবে রাস্তায় সমবেত সকল মানুষের সামনে আমাকে মারা হবে । হুযুর হাসলেন এবং বললেনঃ “মুমিনরা ঠিক এভাবেই আল্লাহকে ভয় করে । এবং মুমিনরা সবসময় চিন্তা করে, যদি সে আল্লাহর উপর বিশ্বাস ঐ দুধের ন্যায় ছিটকে ফেলে তবে তিনি সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কিয়ামত দিবসে সমগ্র সৃষ্টিজগতের সামনে তাকে অপমানিত করবেন । এভাবে সর্বদাই বিচার দিবসের চিন্তা, মুমিনদের গুনাহ হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখে ।”
==============================
========
এই পোস্টটি শেয়ার করার ফলে যদি কোন একজন ভাল হয় তাহলে তার সওয়াবের ভাগিদার আপনিও হবেন।শেয়ার করুন। ভাল কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার সুযোগ নিন।

“ভালবাসবো বাসবো রে বন্ধু “

 রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

লেখক: ব্লগার স্বপ্নচারী | সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী

আজকে একটা সম্ভাব্য প্রেমের ধ্বংস দেখতে পেলাম !!

অফিস থেকে ফিরছিলাম, রিকসা থেকে যেখানে নামলাম, সেখানে অচেনা দু’টো ছেলে আর একটা মেয়ে দাঁড়ানো, একটা রিকসা দাঁড়ানো পাশে। সেই মেয়েটার বান্ধবীকে সম্ভবত একটা’ ছেলে ‘লাইক’ করে, সেই কথাটা বন্ধুটা মেয়েটাকে বলছিল বলে বুঝলাম। মেয়েটা কিছু একটা উত্তর দিলো। পরে শুনলাম বন্ধুটি মেয়েটিকে বলল, ”ও কি ফ্রেন্ডশিপ টাইপের রিলেশনও করবেনা?”। মেয়েটা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, “তোমরা রাগ কইরো না, ঠিকাছে? ভালো থাইকোওও, বাআআই!! ” (একটু সুর করে)

বেচারা প্রেমিক ছেলেটা কষ্টে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানো। সারাদিন কাজের চাপে সময় কাটানোর পর দিনশেষে এই কষ্ট পাওয়ার ঘটনা দেখে আমিও স্তব্ধ। বন্ধুটি সেই রোমিও প্রেমিককে ঠেলে রিকশায় তোলা পর্যন্ত ওদের দেখলাম। রিকসা রওনা হবার পর আমিও একটু বিষণ্ণ মন নিয়ে হাঁটা ধরলাম। এরকম করে দেখা অনেক দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। এমন কত প্রেমের শুরু-শেষ দেখলাম এইটুকু জীবনেই!

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘোরা স্কুল-কলেজের এই ছেলে মেয়েগুলোর জীবনে প্রেম একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। এটা আজ থেকে দশ বছর আগে ছিল না। বিলবোর্ড, মিউজিক ভিডিও, নাটক-সিরিয়াল, শাহরুখ খান-শাহেদ কাপুর, কারিনা-প্রিয়াঙ্কা-রনবীরদের সিনেমা দেখে প্রেম করাটাকে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় কাজ বানিয়ে ফেলেছে। তাই যেকোনো মেয়ে দেখলেই তাদের নিজেদের রোমিও বানাতে ইচ্ছে হয়। আমার ভাইবোনদের কাছে শুনতে পাই, কলেজে বা ভার্সিটিতে ক্লাসের কোন মেয়ে (যে কিনা প্রেম করেনা) পেলেই সবাই তাকে ‘অফার’ দিয়ে বসে। এই আতঙ্কে অনেক মেয়ে নিজেকে ‘ইন এ রিলেশনশিপ’ দেখিয়ে থাকে!!✔স্বভাবগতভাবে কোমল আর কিছুটা ‘ভদ্র’ ছেলেরা দুঃখ পায় এবং ছ্যাঁকা খেয়ে অনেক কাজে অমনোযোগী হয়ে যায়। আমার অনেক বন্ধুরা সেই সময়েই সিগারেট ধরে “দুইডা টান” দিয়েছিলো আর সেখান থেকেই জীবনের মতন শুরু হয়ে যায়।

অন্যদিকে, যেসব ছেলের স্বভাবে ছোট থেকেই কোমলতা বর্জিত হয়ে গেছে, ছোটবেলা থেকেই যারা প্রয়োজনীয় পারিবারিক শিক্ষা কম পেয়ে বড় হয়েছে, তারা প্রেম করতে না চাওয়া সেই মেয়ের পিছু ছাড়েই না। মেয়েটা এই অফারকে ফিরিয়ে দিলেও ‘প্রেমের নেশায় কাতর’ নাছোড়বান্দা ছেলেটা ক্রমাগতভাবে ফোনে, ক্লাসে, রাস্তায়, ফেসবুকে মেয়েটিকে ফলো করার চেষ্টা করতে থাকে। আসলে এটাকে ‘বিরক্ত’ করা বলাটাই সঠিক হবে। এই বিরক্ত করার স্কেল যেসব ছেলে যত বেশি নোংরা আর পশু তাদের কাছে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়। আর বখে যাওয়া ছেলেরা তখন “জোর করে” ভালোবাসা আদায়ে অনেক মেয়েরই ক্ষতি করতে চায় — যা কিনা স্বাভাবিক প্রাণীজ গুণাবলী। এই প্রাণী থেকে মানুষ হতে চেষ্টা করতে হয়।

আর সমাজের আধুনিকা ইয়ো-টাইপের মেয়ে অথবা পরিস্থিতির শিকারে পড়ে মেয়েরা এই অফার গ্রহণ করে, প্রেম খেলা শুরু হয়। স্কুল কলেজের বাইরে রাস্তার উপরে, ফাস্ট-ফুডের দোকানে, বাসের কাউন্টারের সামনে, কোন পার্কে বা বসুন্ধরা সিটিতে তাদের একসাথে দেখা যায়। প্রচুর ফোনালাপ শুরু হয় — কী খেয়েছ, তুমি কী পছন্দ করো, তোমার স্বপ্ন কী, তুমি কোথায় বেড়াতে যেতে চাও, তোমার কোন রঙ পছন্দ — এইসব বলে এফএনএফ নাম্বারের ব্যাপক উসুল করা হয়। জীবনের সমস্ত কথা এক দুই সপ্তাহেই বলা শেষ হয়ে যায়। তারপর ছেলেটা যদি উত্তম চরিত্রের না হয়, আর কোন একটা আদিম চাওয়া পূরণ করতে চাইলে তা না দেয়ায় মেয়েটা পুনরায় আবার দোষী হয় এবং এতকিছুর পরেও ছেলেটা তার উপরে খেপে যায়। মেয়েটা এমন অবস্থায় পেছানোর চেষ্টা করে কিন্তু অনেক দিনের অনেক অন্তরঙ্গতায় বাধা পড়ে সেখানেই আটকে যায়। স্মৃতিরা বাঁধা হয়ে যায়। শুরু হয় “প্রেমের নাম বেদনা” টাইপের অবস্থা।আবার, কোন একদিন তৃতীয় কোন ছেলের বা মেয়ের আগমন হয়, ঝগড়া আর ভুল বোঝাবোঝির শুরু। অথবা কেউ একজন ছেলে বন্ধু-মেয়েবন্ধুর স্বাধীনতা চায়, অপরজন তাকে আপন করে চায় আবার শুরু হয় যুদ্ধ। আবারো এই সম্পর্ক ভাঙ্গনের পথে যায়, একসময় আবারো পিছনে লাগা স্টেজ। দুইজন তাদের সম্ভাব্য সকল বন্ধু মহলে অপরের নামে খারাপ কথা বলতে থাকে, যাকে গীবত বলা যায়। এখানে প্রতিহিংসার আগমন হয়। ক্রোধের আগমন হয়।

এইরকম আরও বহু ধাপ পেরিয়ে বাবা-মা পর্যন্ত এসে আবার থেমে যায় প্রেমের স্রোত। তখন ডানে বামে শোনা যায় — প্রেম করলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে হয়। এই জায়গায় কানপড়া পাওয়া যায় “ভালো কিছু পেতে হলে কিছু তো ত্যাগ হবেই”।অবশেষে এই প্রেম নামের ভালো কিছুর জন্য সারাজীবন সবকিছুতে সাথে থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনের যাবতীয় অপছন্দ উপেক্ষা করে, রাগারাগি আর গালাগালির পরে হয়তবা তারা একসাথে হয়। কিন্তু বিয়ের পরের জীবন? সে এক ইতিহাস। সেইটা অন্যরকম আলোচনার বিষয়।

অনেকে আবার ‘সেই একজন’ কে না পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে চোখের পানি ঝরাতে থাকে। তাকে পাওয়ার জন্য শুরু হয় প্রার্থনা। হয়ত তাকে চেনাই হয়নি ঠিকমতন, কিন্তু এই মোহগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা তারা। ছেলে হোক, মেয়ে হোক… এমন ঘটনা অজস্র।

উপরের কোন ঘটনা জীবনে নেই — এমন ছেলে বা মেয়ে খুব বেশি না মনে হয়। বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড কি আমাদেরই এই সমাজে ছিল পনের-বিশ বছর আগে? তখন কি আমাদের বড় ভাই-বোনেরা থাকতে পারেননি? আর সমাজের ওই রক্ষণশীলতা ছিল বলেই এত হাজার রকমের আতংক, ভয়ে নীল হয়ে থাকতে হতো না সমাজের মেয়েদের, মায়েদের, বাবাদের।

আফসোস!! আমাদের জীবন, আমাদের অনুভূতি, আমাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য এখন আমরা ছেড়ে দিয়েছি কিছু মোবাইল অপারেটর আর কর্পোরেট কোম্পানিদের বিজ্ঞাপনের কাছে, মুভি আর সিরিয়ালের কাছে।বলিউডের কেথ্রিজি, কুচ কুচ হোতা হ্যায়, মোহাব্বাতেইন, জাব উই মিট দেখে প্রেমিক-প্রেমিকা পাবার এবং হবার যেই আকাঙ্ক্ষাতে আমার ভাইবোনদের হৃদয় দোলে সেই নায়ক-নায়িকা, ক্যামেরা ম্যান-প্রস্ততকারক, প্রযোজক সবাই এ থেকে কেবল মুনাফাই অর্জন করেন। আর সেই ব্যবসা সফলতা থেকেই তাদের এমন সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়ে। সেই সিনেমায় সত্য কতখানি, তার প্রভাব কতখানি আমাদের সমাজে সেই হিসেব কেইবা রাখে? ভুক্তভোগী যারা, সাবধানতা তাদের থেকেই তো আগে আসা উচিত, তাই নয় কি?

অথচ এই প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে আমরা প্রেমাক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণা দিই আমাদের মা কে। আমাদের দুঃখিনী মা ক’বার গিয়েছেন তিনি এদেশেরই মাধবকুণ্ড ঝর্ণার কাছে? ক’বার গিয়েছেন তিনি কেএফসি আর ফ্যান্টাসি কিংডমে? তার কী একটা জীবন কেবলই আমাদের জন্য ভাত আর তরকারি রান্নার জন্য? আমাদের শরীরের খবর নেয়ার জন্য? কেন এই কাজ করবেন তারা? ছোটবেলা কত শত রাত আমরা এই মা-কে ঘুমাতে দিইনি — কেন এই মায়েদের অশান্তি দিয়ে এই ভালোবাসা বাসি? কেন হয়ত আমার কারণে অন্য আরেকটা ছেলে বা মেয়ের মা-বাবাকে অশান্তি দেয়া? পরিবারের শান্তি কেন আমরা নষ্ট করতে চাই?

ভালোবাসা মানে কী তবে? ভোগ করা?

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটাকে অগ্রাহ্য করলেই কেন ওই মেয়েটা শত্রু হয়ে যায়? তার মানে কি সেই মেয়ের কিছুটা সময়, তার কণ্ঠের অনুরণন, তার কিছু দৃষ্টিকে, তার সহজাত সম্পদগুলোকে ভোগ করতে না পেরেই আমি তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা করতে শুরু করলাম? কী হাস্যকর রকমের সস্তা ব্যাপার, তাইনা? যাকে ভালোবাসি, তাকে না পেলেও তো আমার ভালোবাসা থাকারই কথা তাইনা? এই স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হতে পারলে সেদিন নিজেকে মুক্ত করা যাবে পশুত্ব থেকে।

ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ক্লাসমেট ছেলেটা তার প্রেমিকাকে ছুরি দিয়ে গেঁথে খুন করে ফেলার ঘটনাতে কি এই ভয়ংকর জিনিসগুলোই পরিষ্কার করে দেয় না? মানবীয় গুণাবলী যেখানে হারিয়ে যায়, তখন প্রেমের নামে এই সাময়িক মোহ কেটে যেতে কেবলই একটা মূহুর্ত লাগে!প্রিয় ভাইয়ারা, জীবনটাকে জটিল করতে, পাপময় করতে, রাগ-ক্ষোভ-হতাশার স্ফুরণ ঘটাতে কেন তোমরা ফিরে ফিরে রোমিও, মজনু, ফরহাদ হতে চাও? তুমি সেই মেয়েটিকেই খুঁজো, যার মতন একটা কন্যা সন্তান পেলে তুমি খুশি হবে জীবনে। কিংবা এমন মেয়ে খুঁজো যাকে তুমি তোমার সন্তানদের মা হিসেবে চাও! মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট থেকে দূরে রেখে ঘরের আলো নিভিয়ে নিজেকে একটুখানি সময় দাও। তারপর নিজের আত্মাকে জিজ্ঞেস করো তো এই একটা দেহ, প্রাণ, সে কি শুধুই কোন নারীর পেছনে ছোটার জন্য? তোমার ভাইবোন, মা-বাবার কষ্টার্জিত জীবন, রাস্তার পাশের কষ্টে থাকা মানুষগুলো কি কখনই তোমাকে ভাবায় না? যেদিন তুমি হবে সুন্দর চরিত্রের উদার প্রাণের ছেলে, দেখবে তোমার চাইতেও চমৎকার একজন তোমারই জন্য অপেক্ষা করবে এই জীবনের বাকিটা সময়, অনন্তকালের অসীম সময়ে সঙ্গ দিতে। চোখকে সংযত করা উচিত, কেননা এই নির্লজ্জ অবাধ্য দৃষ্টি অনেক বোনদেরকে কষ্ট দেয়, অশান্তি দেয়। হতে পারে সে আমাদেরই কারো মা-বোন। আর আখিরাতে আল্লাহর হিসেব তো হবে খুবই কঠিন!

আচ্ছা আপু, এই রূপ-সৌন্দর্য-যৌবন কতদিন থাকে জানো তো? সর্বোচ্চ ১৫-২০ বছর। তারপর? এই শরীর ভেঙ্গে যাবে, চামড়া কুঁচকে যাবে। তখন কে দেখবে তোমাকে? তুমি বরং এমন ছেলেকেই খুঁজো, যার মতন ছেলে গর্ভে পেলে তুমি খুশি হবে। কিংবা এমন ছেলে খুঁজো যাকে তুমি তোমার সন্তানদের বাবা হিসেবে চাও। তথাকথিত দারুণ স্মার্ট ছেলের আক্রমণাত্মক, ড্যাম কেয়ার আর “ম্যানলি” আচরণে মুগ্ধ হয়ে, তার প্রতি অনেক মেয়েরা মুগ্ধ বলে তাকে নিজের জীবনে চাইলে — মনে রেখো আপু, সে যদি তোমার হয়ও কখনো, তখনো সে এমনই থাকবে। সেদিন তার এই আক্রমণের আচরণের খারাপ দিকগুলো তুমি ভোগ করবে প্রতিদিন, প্রতি বেলা। আসলে, কোমল আর ধৈর্য্যশীল ছেলেরা বোধকরি সবচাইতে ভালো ছেলে। সংসার জীবনে প্রাপ্য সম্মান পাওয়াটা ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে বেশি প্রয়োজনীয়।

মনে রাখা উচিত, এই জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আবার তার কাছেই আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে। পৃথিবীতে এসেছিলাম তখনো একা, যাবোও একা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবসময়েই সাথে আছেন। মন অস্থির হলে, চঞ্চল হলে, একা লাগলে — আল্লাহকে স্মরণ করতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন:“… জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়… ” [সুরা আর রা’দঃ ২৮]

এই জগতে কত আত্মার প্রশান্তি আছে! কী অপার ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে আমাদেরই চারপাশে। আমাদের প্রিয়তম জনকে ভালবাসলে, সবসময়ে স্মরণ করে সমস্ত জীবনটা কতটা সুন্দর হতে পারে — সেটা যারা চেষ্টা করে তারাই পায়! আল্লাহই আমাদের আপনজন, তিনিই সবকিছুর মালিক।

যারা অবিবাহিত, তাদের প্রয়োজন নিজেদের সংযত করা। দরকার আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দুয়া করা, যেই সুন্দর দুয়া পবিত্র কুরআনুল কারীমেই আমরা শিখেছি। আল্লাহর কাছে আমাদের এমন একজন জীবনসঙ্গী চাওয়া উচিত, যাকে দেখলে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়, যার সাথে আমরা দুনিয়াতে একসাথে থাকবো, আখিরাতেও আল্লাহর দেয়া জান্নাতে একসাথে থাকতে পারবো, চিরসবুজ, চির যুবা হয়ে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন আর তার ভালোবাসায় সিক্ত স্নিগ্ধ-শান্ত-মিষ্ট হৃদয় ধারণ করার তাওফিক দান করুন। সেই সুন্দর দু’আ হল– “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইয়ুনিন ওয়া জা’আলনা লিল মুত্তাক্কিনা ইমামা।”

“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” [সূরা ফুরক্কানঃ ৭৪]

Tuesday, April 5, 2022

সেহরি সঠিক হবে নাকি সাহরি

 প্রশ্ন: ‘সেহরি’ সঠিক হবে নাকি ‘সাহরি’? এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।

উত্তর:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً
“তোমরা সাহুর (সেহেরি) করো, কারণ সাহুরে (সেহেরিতে) বরকত রয়েছে।” (বুখারি ও মুসলিম)

উক্ত হাদিসে ভোর রাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহুর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ‘সেহরি’ ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সেহেরি শব্দটি এখন বাংলা। এটাই যুগে যুগে বাংলা সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস, পুঁথি-কবিতা ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং সর্বস্তরের মানুষের নিকট সুপরিচিত।

আর বাংলা ব্যাকরণের দৃষ্টিতে বিদেশী কোন শব্দ যখন বাংলা ভাষায় ‘আত্তীকরণ’ হয় তখন সেটাকে পরিবর্তন করা ভাষা বিকৃতির শামিল। যেমন: ইংরেজিতে Table (টেবল) কিন্তু সেটা বাংলায় টেবিল। Apple (এ্যাপল) বাংলায় আপেল। এমন বহু বিদেশী শব্দ বাংলায় প্রবেশ করেছে। এখন কোন অতি পণ্ডিত ব্যক্তি এসে যদি বাংলায় কথা বলার সময় টেবিলকে ‘টেবল’ আর আপেলকে ‘এ্যাপল’ বলা শুরু করে তাহলে তা নি:সন্দেহে হাস্যকর ও ভাষা বিকৃতির শামিল বলে গণ্য হবে।

সে কারণে প্রচলিত ‘সেহরি’ শব্দকে ভুল আখ্যা দিয়ে ‘সাহরি; বলা অনুচিত বলে মনে করি। কারণ সেহরি শব্দটি বহুল প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ বাংলা। তাছাড়া প্রকৃতপক্ষে ভোররাতের খাওয়া বুঝাতে হাদিসে ‘সাহুর; শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে; সাহরি নয়।

সুতরাং কেউ হুবহু হাদিসের শব্দ ব্যবহার করতে চাইলে ‘সাহুর’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারে; সেহেরি বা সাহরি কোনটাই নয়।

◍ ‘সেহেরি’ মানে কি যাদু?

অনেকেই বলছেন, ‘সেহরি’ মানে না কি যাদু। কিন্তু এ কথা সঠিক নয়। বরং আরবিতে সাহরুন বা সিহরুন শব্দের অর্থ: যাদু। যেমন: আরবি অভিধানে লেখা হয়েছে,
سحَرَ يَسحَر ، سَحْرًا وسِحْرًا ، فهو ساحِر ، والمفعول مَسْحور
আর ‘আস সাহারু’ অর্থ: শেষ রাত-ফজরের পূর্ব মূহুর্ত।
السَّحَرُ :آخرُ الليل قبيل الفجر
সুতরাং দেখা গেল, ‘সেহেরি’ শব্দটির অর্থ যাদু বলা অভিধান সঙ্গত নয়।

◍ ভোররাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহরি’ শব্দটি শুদ্ধ নয়:

ভোর রাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহরী’ শব্দটি শুদ্ধ নয়। কারণ হল, হাদিসে ‘সাহরী’ শব্দের অর্থ: আমার বক্ষ বা সিনা। যেমন: নিম্নোক্ত হাদিসটি,

আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি প্রায়ই বলতেন,
تُوُفِّيَ فِيْ بَيْتِيْ وَفِيْ يَوْمِيْ وَبَيْنَ سَحْرِيْ وَنَحْرِيْ
“আমার প্রতি আল্লাহর এটা নি’য়ামাত যে, আমার ঘরে, আমার পালার দিনে এবং আমার গণ্ড ও সিনার মাঝে রসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকাল হয়।” [সহিহ বুখারি, হা/ ৪৪৪৯]

সর্বোপরি, এটা এমন কোন শব্দ নয় যে, পরিবর্তন করলে তা শরিয়ত পরিপন্থী কাজ হবে বা গুনাহ হবে। যেমন: কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম ইত্যাদি।এগুলো পরিবর্তন করা শরিয়ত সম্মত নয়।

মোটকথা, সর্বস্তরের বাংলাভাষী মানুষ যে শব্দটি উচ্চারণ করে ও বুঝে এবং বাংলা ভাষা সাহিত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সে শব্দটি অবিকৃত রাখাই ভালো মনে করি। সুতরাং ‘সাহরি’ নয় বরং ‘সেহেরি’ বলাই অধিক উপযুক্ত।
এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এ ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে যে কেউ দ্বিমত করার অধিকার রাখে। আল্লাহু আলাম।
—————
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।।
জুবাইল, সৌদি আরব।।

মহিলাদের কপালে টিপ পরার বিধান

 প্রশ্ন: মহিলাদের কপালে টিপ ব্যবহার কি হারাম? এ ব্যাপারে ইব্রাহীম আ. কে আগুনে নিক্ষেপের সময় কতিপয় উলঙ্গ বেশ্যা মহিলাকে টিপ পরানো হয়েছিলো- মর্মে যে ঘটনা বলা হয় তা কি সঠিক?

উত্তর:

বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব ওয়েব সাইটে কতিপয় তাফসীরের রবাত দিয়ে মহিলাদের টিপ পরার ইতিহাস বলা হয়েছে এভাবে:

“মুসলিম জাহানের পিতা হযরত ইবরাহীম আ.কে যখন আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য নমরুদ ৮ মাইল পরিমাণ জায়গা আগুন জ্বালাল তখন একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল। আগুনের উত্তাপ এতই বেশি ছিল যে, তার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। তাই একটা চরক বানানো হল যার মাধ্যমে ইবরাহীম আ.কে দূর থেকে ছুড়ে আগুনে নিক্ষেপ করা যায়। কিন্তু রহমতের ফেরেশতাগণ চরকের একপাশে ভর করে থাকায় চরক ঘুরানো যাচ্ছিল না। তখন শয়তান এসে নমরুদকে কুবুদ্ধি দিয়েছিল যে, সমাজে যারা অনৈতিক কার্যকলাপ করে (বেশ্যা) এমন কয়েকজন মেয়ে এনে চরকের সামনে বসিয়ে দিতে। কারণ এ অবস্থায় রহমতের ফেরেশতাগণ থাকতে পারবেন না। তাই করা হল। ফেরেশতাগণ চলে গেলেন, আর ঠিক তখনি তারা ইবরাহীম আ. কে আগুনে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হল।
কিন্তু আগুন আল্লাহর হুকুমে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে জ্বালানোর বদলে ফুলের বাগান হয়ে গেলো।
পরবর্তীতে ঐ বেশ্যা মহিলাগুলোকে মেয়েগুলোকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করা হল যাদের কারণে রহমতের ফেরেশতাগণ চরক ছেড়ে দূরে সরে গিয়েছিলেন এবং তাদের মাথায় তিলক পরানো হল। যেটা এখন আমাদের কাছে টিপ নামে পরিচিত যা মেয়েরা নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে ব্যবহার করে।“

ইন্টারনেট ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া উক্ত ঘটনাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানে তাফসীরের কিতাবগুলোতে এ সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। বেশ কিছু বিজ্ঞ আলেমকে জিজ্ঞাসা করেও কাজ হয় নি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ ঘটনাটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হতে পারে।

(যদিও কেউ যদি নির্ভরযোগ্য কোনও তাফসীরের কিতাব বা ইতিহাসের বইয়ে এই ঘটনা নিজে পড়ে থাকেন তাহলে আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন। দয়া করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা রেফারেন্স কপি-পেস্ট করে দিবেন না।)

🔴 যাহোক, হিন্দুদের অনুকরণে মাথার সিঁথির মাঝখানে বা কপালে সিঁদুর পরা হারাম। এ মর্মে আলেমদের মাঝে কোনও দ্বিমত নাই। কারণ এটি হিন্দুদের ধর্মীয় রীতি। ধর্মীয় রীতি অনুসারে তাদের কেবল বিবাহিত নারীরাই মাথায় সিঁথির মাঝখানে লম্বা করে সিঁদুর লাগায়। বিয়ের পূর্বেও লাগায় না; বিয়ের পর স্বামী মারা যাওয়ার পরও লাগায় না। আর এ কথা স্বত:সিদ্ধ যে, ইসলামে কাফেরদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতি বিষয়ে সাদৃশ্য অবলম্বন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেমন:
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।“ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০৩১, সহীহুল জামে-আলবানী হা/২৮৩১)

🔴 তবে সাজ-সজ্জার অংশ হিসেবে মহিলাদের কপালে লাল বা অন্যান্য রঙের গোল টিপ পরা জায়েয কি না সে ব্যাপারে আলেমদের মাঝে দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়।

🔹 একদল আলেমের মতে কপালে টিপ পরা মূলত: ভারত বর্ষের মহিলাদের সাজ-সজ্জার একটি উপকরণ মাত্র। এটা ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত নয়। যার কারণে প্রাচীন কাল থেকেই অত্র অঞ্চলে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মহিলাদের কপালে টিপ পরার প্রথা প্রচলিত রয়েছে।

দুনিয়াবি কোনও বিষয়কে স্পষ্ট দলীল ছাড়া হারাম বলার সুযোগ নাই। তবে শর্ত হল, সেজেগুজে পরপুরুষের সামনে ঘুরে বেড়ানো নাজায়েজ। কারণ ইসলামে স্বামী, নিজস্ব মাহরাম পুরুষ এবং মহিলা অঙ্গন ছাড়া অন্য কারো সামনে মহিলাদের সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করা বৈধ নয়।

🔹 অন্য একদল আলেমের মতে, মুসলিম মহিলাদের জন্য টিপ পরা বৈধ নয়। তাদের মতে, টিপ পরা মূলত: সিঁদুরেরই একটি অংশ যা-হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং টিপ পরিধান করলে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি চর্চা করা হয়-যা ইসলামে হারাম।

 উপসংহারে আমরা বলব, যেহেতু বিষয়টি দ্বিমত পূর্ণ সেহেতু দ্বিমত থেকে বাঁচার স্বার্থে টিপ পরিধান না করাই উত্তম।

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

Saturday, April 2, 2022

সালাতে পায়ের সাথে পা ও কাঁধের সাথে কাঁধ লাগানোর বিধান কী? এবং তা না করলে কি সালাতের কোনও ক্ষতি হবে?

 প্রশ্ন: জামাতে সালাত আদায়ের সময় পরস্পরে পায়ের সাথে পা এবং কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়ানোর বিধান কি? কাতারের মাঝে ফাঁকা রাখলে কি গুনাহ হবে? আমি কাতারের মাঝে ফাঁক রাখতে চাই না বরং পায়ের সাথে পা ও কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে চাই কিন্তু পাশে থাকা মুসল্লি ফাঁকা হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় ফাঁকা রাখলে কি গুনাহ বা নামাজের কোনও ক্ষতি হবে?

উত্তর:
পায়ের সাথে পা লাগানোর বিষয়টি একটি দ্বিমত পূর্ণ মাসআলা। তবে একাধিক হাদিস এবং সাহাবিদের আমল দ্বারা এটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত হওয়ার বিষয়টি অধিক অগ্রাধিকার যোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস, সাহাবিদের আমল, আলেমদের অভিমত এবং সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পেশ করা হল:

✪ ১. আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي وَكَانَ أَحَدُنَا يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَقَدَمَهُ بِقَدَمِهِ

“তোমরা তোমাদের কাতার সোজা করো। কেননা, আমি তোমাদিগকে আমার পিঠের পিছন থেকে দেখতে পাই।” আনাস রা. বলেন, (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে) আমাদের একজন তাঁর কাঁধ ও পা তাঁর পাশের ব্যক্তির কাঁধ ও পায়ের গোড়ালি (গোছ) এর সাথে লাগিয়ে রাখতো।” [সহিহ বুখারি, অধ্যায়: ৪৭: আজান, পরিচ্ছেদ: ৪৬৮. কাতারে কাঁধের সাথে কাঁধ ও পায়ের সাথে পা মেলানো।]

ইমাম বুখারি উক্ত অনুচ্ছেদের পরে উল্লেখ করেছেন,
وَقَالَ النُّعْمَانُ بْنُ بَشِيرٍ رَأَيْتُ الرَّجُلَ مِنَّا يُلْزِقُ كَعْبَهُ بِكَعْبِ صَاحِبِهِ
“আর নুমান ইবনে বশীর রা. বলেন, আমাদের লোকজনকে তার পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির পায়ের গিঁঠের সাথে পায়ের গিঁঠ লাগিয়ে রাখতে দেখেছি।” ইমাম বুখারি কর্তৃক উক্ত নুমান বিন সাবিত রা. এর উক্ত কথাটি মূলত: আবু দাউদে বর্ণিত একটি পূর্ণ হাদিসের অংশ। পূর্ণ হাদিসটি হল:

✪ ২. নুমান ইবনে বশীর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
أَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى النَّاسِ بِوَجْهِهِ فَقَالَ أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ ‏”‏ ‏.‏ ثَلاَثًا ‏”‏ وَاللَّهِ لَتُقِيمُنَّ صُفُوفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللَّهُ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ ‏ قَالَ فَرَأَيْتُ الرَّجُلَ يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَرُكْبَتَهُ بِرُكْبَةِ صَاحِبِهِ وَكَعْبَهُ بِكَعْبِهِ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমবেত ব্যক্তিদের নিকট উপস্থিত হয়ে তিনবার বলেন, “তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। আল্লাহর শপথ! তোমরা কাতার সোজা করে দণ্ডায়মান হবে, অন্যথায় আল্লাহ তা’আলা তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করবেন।”
বর্ণনাকারী (নোমান রা.) বলেন, “অতঃপর আমি মুসল্লিদেরকে পরস্পর কাঁধে কাঁধ, পায়ের গিঁঠের সাথে গিঁঠ লাগিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি।” [সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: ২/ সালাত, পরিচ্ছেদ: ১০০. কাতার সোজা করা।]

হাদিসে বর্ণিত الكَعْبُ শব্দের অর্থ: العظْمُ الناتِىءُ عند ملتقى الساق والقدم، وفي كل قدم كعبان عن يَمْنَتِها وعن يَسْرتِها “নলা এবং পায়ের পাতার সংযোগস্থলে অবস্থিত উঁচু হাড্ডি। প্রত্যেক পায়ের পাতায় ডানে ও বামে দুটি করে উঁচু হাড্ডি আছে। সেগুলোকেই كَعْبُ বলা হয়। এটাই হল, পায়ের গোছ, গ্রন্থি বা গিঁঠ।

আর يُلْزِقُ শব্দটি এসেছে لزق শব্দমূল থেকে। যার আভিধানিক অর্থ: لَزِقَ الشيءُ بالشيء: اتصل به لا يكون بينهما فجوة “একটা জিনিসের সাথে অন্য একটা জিনিস এমনভাবে যুক্ত থাকা যে, তাদের মাঝে কোনও ফাঁক থাকে না।” [অনলাইন ভিত্তিক আরবি অভিধান almaany]

উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে প্রমাণিত হল যে, সাহাবিগণ সালাতে একে অপরের কাঁধ এবং পায়ের গোছ (গোড়ালির উপরিস্থ পায়ের গিঁঠ) এর সাথে লাগিয়ে এমনভাবে দণ্ডায়মান হতেন যে, তার মধ্যে কোনও ফাঁক থাকতো না।

✪ ৩. আনাস বিন মালিক রা. উক্ত আমলটির ব্যাপারে মানুষের অনীহার বিষয়টি এভাবে বলেছেন,
“فلقد رأيت أحدنا يلصق منكبه بمنكب صاحبه، وقدمه بقدمه، فلو ذهبت تفعل هذا اليوم؛ لنفر أحدكم كأنه بغل شموس- مصنف ابن أبي شيبة (1/ 351) بإسنادٍ صحيح
“আমি দেখেছি, আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তার পাশের ব্যক্তির কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা লাগিয়ে রাখতো। কিন্তু আজ যদি এমনটি করতে যাও তাহলে দেখবে যে, সে পলায়নপর বন্য খচ্চরের মত পালাচ্ছে!! [মুসান্নাফ ইবনে শায়বা ১/৩৫১, সনদ সহিহ]

এটাই দু:খ জনক বাস্তবতা। বর্তমানেও আমাদের সমাজে অধিকাংশ মসজিদে যদি কোনও মুসল্লি সুন্নত পালনার্থে পাশের মুসল্লির পায়ের সাথে পা বা কাঁধের সাথে কাঁধ মিলাতে যায় তাহলে তারা দূরে তো সরবেই বরং সালাত শেষে তাকে বেয়াদব, অশিক্ষিত, অভদ্র ইত্যাদি বলে গালমন্দ করবে এবং মারাত্মক ক্ষিপ্ত হবে। এটা পরীক্ষিত বাস্তবতা। মনে হবে, এটা হয়ত কোনও বিদআত এবং মারাত্মক অন্যায় কাজ! (আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন)।

✪ ৪. জাবির ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট বাড়ি বের হয়ে এসে বললেন,
أَلاَ تَصُفُّونَ كَمَا تَصُفُّ الْمَلاَئِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا ‏”‏ ‏.‏ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَكَيْفَ تَصُفُّ الْمَلاَئِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا قَالَ ‏”‏ يُتِمُّونَ الصُّفُوفَ الأُوَلَ وَيَتَرَاصُّونَ فِي الصَّفِّ
“তোমরা কি কাতার বদ্ধ হবে না যেভাবে ফেরেশতাগণ তাঁদের রবের সামনে কাতার বদ্ধ হয় তাঁরা বললেন, ফেরেশতাগণ তাদের রবের সামনে কীভাবে কাতার বদ্ধ হন?
তিনি বললেন, তারা প্রথম কাতার পূর্ণ করে। তারপর কাতারে পরস্পর মিশে দাঁড়ান।”
[সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ৪/ কিতাবুস সালাত, পরিচ্ছেদ: ২৭. সালাতে নড়াচড়া করা, সালামের সময় হাতের ইশারা করা ও হাত উঠান নিষেধ এবং সামনের কাতার পূর্ণ করা ও পরস্পর হয়ে এবং একত্রিত হয়ে দাঁড়ানোর নির্দেশ।]

আরবি অভিধানের আলোকে يَتَرَاصُّونَ শব্দটি الرص শব্দমূল থেকে উৎসারিত হয়েছে। এর অর্থ:
الرص: يُقال: رصّ البناء يرصّه رصًّا إذا ألصقت بعضه ببعض
“ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যেভাবে একটা ইটের সাথে আরেকটা ইট সংযুক্ত থাকে।” অর্থাৎ মুসল্লিগণ প্রত্যেকেই একে অপরের পায়ের সাথে পা ও কাঁধের সাথে কাঁধ যুক্ত করে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবে।
ورَصَصْتُ الشيء أَرُصّهُ رَصّاً أَي أَلْصَقْتُ بعضَه ببعض، ومنه: بُنْيان مَرْصوصٌ

✪ ৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,
«أقيمُوا الصُّفُوفَ، وَحَاذُوا بَيْنَ المَنَاكِبِ، وَسُدُّوا الخَلَلَ، ولا تَذَرُوا فُرُجَاتٍ للشَّيْطَانِ، وَمَنْ وَصَلَ صَفًّا وَصَلَهُ اللهُ، وَمَنْ قَطَعَ صَفًّا قَطَعَهُ اللهُ»

“কাতার সোজা করো, কাঁধের সাথে কাঁধ বরাবর করো, ফাঁক বন্ধ করো, শয়তানের জন্য কোন ফাঁক রাখবে না। যে ব্যক্তি কাতারের সংযোগ স্থাপন করে আল্লাহও তার সাথে সংযোগ স্থাপন করেন, আর যে কাতার ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সাথে সংযোগ ছিন্ন করেন।” [আবু দাউদ, অধ্যায়: সালাত, অনুচ্ছেদ: ৯৫। এই হাদিসটি ইমাম ইবনে খুযায়মা ও ইমাম হাকিম সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। [ইবনে হাজার আসকালানি, ফাতহুল বারী; ২/২১১]

এ সব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাতার সোজা করে দাঁড়ানোর নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি দু জনের পায়ের মধ্যখানে কোন ফাঁকা না রাখার ব্যাপারেও নির্দেশ দিয়েছেন। আর সে জন্যেই সাহাবিগণ একে অপরের পায়ের সাথে পা এবং কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে দণ্ডায়মান হতেন।
মোটকথা, পায়ের সাথে পা লাগানো যেমন সুন্নত তেমনি কাঁধের সাথে কাঁধ মিলানও সুন্নত।

➤ শাইখ উসাইমিন রহ. বলেন,
أما إلصاق الكعبين بعضهما ببعض فلا شك أنه وارد عن الصحابة رضي الله عنهم، فإنهم كانوا يسوون الصفوف بإلصاق الكعبين بعضهما ببعض، أي: أنّ كل واحد منهم يلصق كعبه بكعب جاره لتحقيق المساواة. و اهذا إذا تمت الصفوف و قام الناس
(-جمع أشرف عبد الرحيم – (1/ 436 – 43

“এতে কোনও সন্দেহ নাই যে, একে অপরের সাথে পায়ের গোছ বা গিঁঠ লাগানোর বিষয়টি সাহাবিদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। কারণ তারা প্রত্যেকেই একে অপরের পায়ের গোছের সাথে গোছ সংযুক্ত করে কাতার সোজা করতেন। অর্থাৎ সবাই তার পার্শ্বস্থ ব্যক্তির পায়ের গোছের সাথে গোছ লাগাতেন এ জন্য যেন, কাতার সোজার করার বিষয়টি ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়। আর এটা ঐ সময় যখন কাতার পূর্ণ হয়ে যেতো এবং লোকজন দণ্ডায়মান হতো। ” [ফাতাওয়াশ শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল উসাইমিন রাহ. ১/৩৩৬-৪৩৭]

অনেক আলেম পরস্পরের কাঁধ বরাবর দাঁড়ানোর বিষয়টিকে সমর্থিত করলেও পায়ের সাথে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোর বিষয়টি সমর্থন করেন নি। তাদের মতে, এ সকল হাদিস দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কাতার সোজা করার ক্ষেত্রে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং কাছাকাছি দাঁড়ানো। পায়ের সাথে পা লাগানোর প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য নয়। যেমনটি ইবনে হাজার আসকালানি সহ অনেক আলেম অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

হাফেজ ইবনে হাজার বলেন,
المراد بذلك المبالغة في تسوية الصفوف و تقاربها ، لاحقيقة الإلتصاق و يمكن أن أحدهم يمس منكبه منكب الآخر، فأما القدم و الركبة فلا يلزم التماس، و ذلك لأن البعض قد يتأذى من التلاصق و التقارب الشديد ، و القصد هو تراص الصفوف و سدّ الخلل فيها حتى لا تدخل بينهم الشياطين
“নুমান বিন বাশীর রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের দ্বারা উদ্দেশ্য হল, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খুব ভালোভাবে কাতার সোজা করা। পায়ের সাথে পা লাগানো উদ্দেশ্য নয়। একে অপরে কাঁধের সাথে কাঁধ স্পর্শ করা সম্ভব। কিন্তু পা ও হাঁটু স্পর্শ করা আবশ্যক নয়। কারণ খুব বেশি কাছাকাছি হলে বা লাগালাগি করে থাকলে কারও কারও কষ্ট হতে পারে। মুখ্য বিষয় হল, কাতার সোজা করা ও তাতে ফাঁক বন্ধ করা যেন, মুসল্লিদের মাঝে শয়তান প্রবেশ করতে না পারে।” [ফাতহুল বারি]

কিন্তু পূর্বোক্ত একাধিক হাদিসের আলোকে সাহাবিদের বুঝ ও আমল দ্বারা এটাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, তারা এমনভাবে দণ্ডায়মান হতেন যে, তাদের মাঝে কোনও ফাঁক থাকতো না।

যাহোক, জামাতে সালাত আদায়ের সময় পায়ের সাথে পা এবং কাঁধের সাথে কাঁধ বিলাতে গিয়ে যদি হানাফি মাজহাবের অনুসারী কোন ভাই বিরক্তি অনুভব করে তাহলে তার সাথে জোরাজুরি করতে যাওয়া সমীচীন নয়। বরং সে ক্ষেত্রে পা লাগানো ছাড়াই কাতারা যথাসম্ভব কাছাকাছি দাঁড়াতে হবে। এতে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোর সুন্নতের প্রতি আমলের নিয়ত থাকার কারণে সওয়াব অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। আর বিষয়টি যেহেতু ওয়াজিব বা রোকন পর্যায়ের নয় বরং সুন্নত পর্যায়ের আমল সেহেতু কেউ তা না করলেও সালাতেরও কোনও ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ। অতএব এ বিষয়টি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করা বা বাড়াবাড়ি করা অনুচিত।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

সালাতের মাকরূহ বা অপছন্দীয় কাজ সমূহ

 প্রশ্ন: সালাতের মাকরূহ কাজগুলো কী কী? এতে কি সালাত ভঙ্গ হয়ে যায়?

উত্তর:
মাকরূহ শব্দের অর্থ: অ পছন্দনীয়। এতে সালাত ভঙ্গ হয় না বা তাতে কোনও গুনাহ নেই কিন্তু না করা ভালো। সালাতের বিনয়-নম্রতা এবং সৌন্দর্য রক্ষায় এসব বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
নিম্নে সর্বাধিক প্রচলিত দশটি মাকরূহ বিষয় উল্লেখ করা হল:
১. সালাত রত অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে আড় চোখে উপরের দিকে বা ডানে-বামে তাকানো।
২. বিনা প্রয়োজনে চোখ বন্ধ করে সালাত আদায় করা। তবে নামাজির সামনে যদি এমন কিছু থাকে যার কারণে সে দিকে বারবার দৃষ্টি চলে যায় তাহলে চোখ বন্ধ করায় কোনও দোষ নেই।
৩. তাশাহুদের বৈঠকে ইকা (إيقاع) করা। এর একাধিক পদ্ধতি আছে। যেমন:
ক. দু পায়ের পিঠ মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে দুই গোড়ালির উপর বসা।
খ. পায়ের আঙ্গুলগুলো মাটিতে রেখে গোড়ালি দ্বয় খাড়া রেখে এতদুভয়ের মাঝে নিতম্ব রেখে বসা।
গ. দুই পায়ের পাতা খাড়া রেখে দু পায়ের গোড়ালির উপর বসা। (এটি দুই সেজদার মাঝে কখনো কখনো করা সুন্নত। কিন্তু তাশাহুদের বৈঠকে করা মাকরূহ।)
৪. পেশাব-পায়খানার চাপ নিয়ে সালাত আদায় করা।
৫. পেটে ক্ষুধা নিয়ে খাবারের উপস্থিতিতে সালাত আদায় করা।
৬. মাটিতে দু বাহু বিছিয়ে সেজদা দেওয়া।
৭. সালাতে আঙ্গুল ফুটানো বা আঙ্গুলের মধ্যে আঙ্গুল প্রবেশ করানো।
৮. কোমরে হাত বেঁধে দাঁড়ানো।
৯. এক পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা।
১০. অনর্থক কাজ। যেমন: বিনা প্রয়োজনে দাড়ি, হাত, পা, কাপড় ইত্যাদি নড়াচড়া করা, শরীর মুচড়া-মুচড়ি করা এবং বিনা প্রয়োজনে সেজদার স্থান বা কপাল থেকে ধুলাবালি ঝাড়া ইত্যাদি।
কেউ বেখেয়ালে এসব করলে তার উচিৎ, স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে সতর্ক হওয়া এবং তা অব্যাহত না রাখা। অন্যথায় এতে সালাত ভঙ্গ না হলেও তা মাকরূহ বা অ পছন্দনীয় কাজ হিসেবে গণ্য হয়। এতে সালাতের সওয়াব কমে যাবে। কারণ মুমিন ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতা, বিনয় ও ভয়-ভীতি সহকারে সালাত আদায় করতে নির্দেশিত।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

ঋতুমতী নারীর লজ্জাবশত রমজানের রোজা রাখা বা রোজা রাখার ভান করা

 প্রশ্ন: ঋতুমতী নারীর রোজা রাখার বিধান কি? বাড়িতে পুরুষ থাকার কারণে লজ্জা বশত: কোনও ঋতুমতী নারী যদি রোজা রাখে তাহলে কি তার গুনাহ হবে?

উত্তর:
প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর মাসিক ঋতুস্রাব বা পরিয়ড হওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। এটি তার শারীরিক সুস্থতা এবং গর্ভধারণে সক্ষমতার আলামত। পিরিয়ডের দিনগুলো অন্য স্বাভাবিক দিনগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন রকম থাকে। হরমোনের কারণে কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে৷ এই সময় মেয়েদের শরীর অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি দুর্বল থাকে। অনেকের জরায়ু নিচের দিকে নেমে আসে, তলপেট স্ফীত হয়! ব্যথা করে৷এমনকি বমিও হয়।

তাই এ অবস্থায় তাদের কষ্ট লাঘবে দয়াময় আল্লাহ নামাজ-রোজার বিধান রহিত করেছেন। সুতরাং এ সময় তাদের জন্য নামাজ-রোজা করা জায়েজ নাই।

◆ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أليس إذا حاضت المرأة لم تصل ولم تصم؟
“এমন কি নয় যে, ঋতু কালীন সময়ে একজন নারী সালাত পড়ে না ও রোজা রাখে না”? [সহীহ বুখারী, হা/২৯৮; সহীহ মুসলিম, হা/৮০]
তবে ঋতুমতী নারী পবিত্র হলে শুধু রোজাগুলো কাজ করবে; নামাজগুলো কাজা করবে না।
◆ মা-জননী আয়েশা রা. বলেন,
كنا نحيض على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فكنا نؤمر بقضاء الصوم، ولا نؤمر بقضاء الصلاة
“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঋতুমতী হতাম। আমাদেরকে তখন রোজাগুলো কাজা করার নির্দেশ প্রদান করা হত; কিন্তু নামাজ গুলো কাজা করার নির্দেশ দেওয়া হত না”।[সহীহ বুখারী, হা/৩১৫, সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫]

সুতরাং নারীদের জন্য ঋতুস্রাব অবস্থায় নামাজ-রোজা করা জায়েজ নাই। আর লোকলজ্জার কারণে ঋতুস্রাব অবস্থায় নামাজ-রোজা অব্যাহত রাখলে সেগুলো শুধু বাতিল বলেই গণ্য হবে না বরং এ জন্য গুনাহগারও হতে হবে।
তবে কোন মেয়ে যদি তার ঋতুস্রাব হওয়ার বিষয়টি কোন পুরুষের নিকট প্রকাশিত হওয়াতে লজ্জাবোধ করে বা শরিয়ত সম্মত কোনও কারণে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে চায় আর এ কারণে সে তাদের সামনে রোজার ভান ধরে বা সেহেরি বা ইফতারের সময় পরিবারের সবার সাথে খাওয়া-দাওয়া করে তাহলে তাতে কোন গুনাহ নেই। তবে রোজার নিয়ত করবে না। অন্যথায় তা গুনাহের কারণ হবে।
শাইখ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, কোনও মহিলা যদি মাসিক ঋতুস্রাবের কারণে লজ্জাবশত রমজানের রোজা রাখার ভান করে তাহলে তার গুনাহ হবে কি?

তিনি বলেন,
ليس عليها إثم إذا ما بينت أنها حائض، لكن لا تصم لا تنو الصيام، أما إذا سكتت ولم تقل: إني حائض ولم تقل: إني مفطرة ما يضرها ذلك، لكن إذا كانت تنوي الصوم هذا لا يجوز هذا منكر الصوم باطل

“এতে তার কোন গুনাহ নেই যদি সে প্রকাশ না করে যে, সে ঋতুমতী। কিন্তু সে রোজা রাখবে রাখবে না বা রোজার নিয়ত করবে না। কিন্তু যদি সে চুপ থাকে- বলে না যে, আমি ঋতুমতী আবার এও বলেন না যে, আমি রোজা ভঙ্গকারী। এতে তার কোনও ক্ষতি নেই। তবে যদি সে রোজা রাখার নিয়ত করে করে তবে তা জায়েজ হবে না। এটা গর্হিত কাজ আর এই রোজাও বাতিল।” [binbaz]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Friday, April 1, 2022

ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি শিয়াদের আসল চেহারা

 ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি শিয়াদের আসল চেহারা

মূল: প্রফেসর ডক্টর সুলাইমান বিন সালিহ আল গুসন
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

الْحَمْدُ لِلّهِ والصَّلاَةُ السَّلامُ عَلي رَسُوْلِ اللهِ وعَلى آلِه وصَحْبِه ومَنْ وَالَاه وبَعْدُ

ভূমিকা:

হুতি নামটি বর্তমানে অনেকের কাছে পরিচিত। ইয়েমেনে যাদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ‘আসিফাতুল হাযম’ নামে একটি যুদ্ধ পরিচালিত করেছে। কিন্তু বাংলাভাষী অনেকেই এই হুতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। ফলে বিভিন্ন শিয়া প্রভাবিত এবং ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়ার কারণে অনেকে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। অথচ মুসলিম বিশ্বের উপর এই ঘটনা-প্রবাহের সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে-তাতে কোন সন্দেহ নাই। তাই এ সম্পর্কে মুসলিম যুবকদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী।

এই প্রেক্ষাপটে সউদী আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত কিং সউদ ইউনিভার্সিটি’র ‘আকিদা ও সমকালীন মতবাদ’ এর অধ্যাপক প্রফেসর ডক্টর সুলাইমান বিন সালিহ আল গুসন রচিত বক্ষ্যমাণ পুস্তিকাটি অনুবাদ করা হল যেন, বাংলাভাষী মুসলিমগণ এই ফিতনার ব্যাপারে সচেতন হতে পারে।

অত্র পুস্তিকাটিতে শিয়া হুতি সম্প্রদায়ের উৎস, পরিচিতি, ক্রমবিকাশ, কার্যক্রম, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক ভাবে রাফেযীয়া-ইমামিয়া-ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা তার জমিনে সত্যের পতাকা উড্ডীন করুন। বাতিল ও মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

অনুবাদক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
তারিখ: ১৯-০৪-২০১৫ইং
——————————

❑ হুতিদের উৎস ও পরিচয়:

হুতিরা হল, উত্তর ইয়েমেনের সা’দাহ[1] এলাকার একটি সম্প্রদায়ের নাম। এদের উৎপত্তি জারুদিয়া সম্প্রদায় থেকে। জারুদিয়ারা হল, শিয়া-যায়দিয়াদের একটি গোঁড়া ও উগ্রপন্থী ফিরকা।

হুতিরা রাফেযীয়া-ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের মত উগ্রপন্থী আকিদা-বিশ্বাস প্রচার শুরু করে এবং ইরানের সাহায্য-সহযোগিতা ও আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে শিয়া বিপ্লবের নায়ক খোমেনির আদর্শ ও পদ্ধতির আলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতে থাকে।

হুতি সম্প্রদায়ের পরিচয়ের আগে জারুদিয়াদের সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। যাতে স্পষ্ট হয়, জারুদিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এই হুতি এবং রাফেযী ইসনা আশারিয়াদের মাঝে কতটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে আর কিভাবে তারা ইমামিয়া-ইসনা আশারিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

❑ জারুদিয়া সম্প্রদায়ের পরিচয়:

প্রতিষ্ঠাতা: জারুদিয়ার সম্প্রদায়টির নাম করণ হয় আবুল জারুদ নামক এক ব্যক্তির নামানুসারে। তার পুরো নাম, যিয়াদ বিন মুনযির আল হামাদানী আল কূফী।

আহলে সুন্নাহ’র পূর্বসূরি ইমামগণ এ ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[2] শুধু তাই নয়, শিয়াদের কিছু বই-পুস্তকেও তার বদনাম করা হয়েছে।[3]

❑ জারুদিয়াদের কিছু মৌলিক আকিদা:

১) তারা বিশ্বাস করে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরে খলীফা হিসেবে আলী (রা.) কে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি আলী (রা.) এর নাম না নিলেও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার মাধ্যমে তাঁকেই বুঝিয়েছিলেন।
২) তাদের মতে, আলী (রা.) এর মর্যাদা অন্য সকল সাহাবীর চেয়ে বেশী।
৩) আলী (রা.) এর পরে ইমাম হবে কেবল হাসান-হুসাইন ও তাদের বংশধরের মধ্য থেকে।
৪) তারা সাহাবীদেরকে কাফের মনে করে। কারণ, সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরে আবু বকর (রা.) কে খলীফা হিসেবে মনোনীত করেছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বলে যাওয়া গুণ-বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সে বৈশিষ্ট্যের আলোকে তারা আলী (রা.) কে খলীফা নিয়োগ করে নি। [4]
৫) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরে যারা আলী এবং তাঁর বংশধর থেকে ইমাম হওয়াকে আবশ্যক মনে করে না তারা কাফের।
৬) আবু বকর (রা.)ও উমরা (রা.)থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তাদেরকে গালাগালি করা। অনুরূপভাবে আয়েশা (রা.), মুয়াবিয়া (রা.)এবং আমর ইবনুল আস (রা.)কে গালাগালি করা।
৭) জারুদিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মনে করে যে, তাদের যে সব ইমাম মারা গেছে তারা পুনরায় ফিরে আসবেন।
৮) তাদের মধ্যে অনেকে মুতা বিবাহ (চুক্তি ভিত্তিক সাময়িক বিয়ে)কে বৈধ মনে করে।[5]
জারুদিয়াদের এসব আকিদা দেখলে বুঝা যাবে, তারা রাফেযীয়া- জাফরিয়া- ইমামিয়া- ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে।

❑ হুতিদের ইতিহাস এবং প্রেরণার উৎস:

হুতিদের চরমপন্থি নেতা নাম হুসাইন বিন বদরুদ্দীন হুতি। তার পিতা বদরুদ্দীন বিন আমীরউদ্দিন আল হুতি হল তাদের ধর্মগুরু এবং রূহানী নেতা।

এই ধর্মগুরু ১৩৪৫ হিজরিতে উত্তর ইয়েমেনের সা’দাহর উপকণ্ঠে জন্ম গ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। তাকে জারুদিয়াদের বড় আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হয়।

যায়দিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় আলেমদের সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ইরান চলে যান এবং তেহরানে কয়েক বছর বসবাস করেন। পরবর্তীতে সমঝোতার মাধ্যমে তাকে নিজ এলাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি ১৪৩১ হিজরির যিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে মৃত্যু বরণ করেন।

হুসাইন বিন বদরুদ্দীন হুতি হল বদরুদ্দীনের বড় ছেলে। তিনি সা’দায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তারপর সুদান থেকে শরীয়া বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করার পর ডক্টরেট শুরু করেন। কিন্তু পড়ালেখা বাদ দিয়ে দেন এবং মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন এই যুক্তিতে যে, একাডেমিক সার্টিফিকেট জ্ঞান-বুদ্ধিকে জমাটবদ্ধ করে দেয়।

১৯৯০ সালে ইয়েমেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর যখন রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়ত তখন হুসাইন হুতি শিয়া ‘হিযবুল হক’ নামক একটি দল প্রতিষ্ঠায় অংশ গ্রহণ করেন এবং দলের পক্ষ থেকে তিনি ১৯৯৩-১৯৯৭ইং সেশনের জন্য পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।

এদিকে দক্ষিণ ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কম্যুনিস্টরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে হুসাইন হুতি তাদের পক্ষাবলম্বন করেন। যার কারণে সরকার তার বসত বাড়িতে সশস্ত্র অভিযান চালায়। ফলে তিনি সুদান পালিয়ে যান এবং সুদান থেকে ইরানে আত্মগোপন করে। অত:পর ইরানের কুম শহরে তার পিতার সাথে কয়েক মাস অবস্থান করেন।

সেখান থেকে লেবানন যান হিযবুল্লাহ গ্রুপের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য।

এ দিকে সরকার তার প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করলে তিনি পুনরায় ইয়েমেনে ফিরে আসেন।

ইয়েমেনে ফিরে আসার পর তিনি তার ভক্ত ও অনুসারীদের মাঝে বক্তৃতা ও দরস দেয়া শুরু করেন এবং বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যেগুলোতে শতশত ছাত্র ভর্তি হয়।

❑ আশ শাবাবুল মুমিন (মুমিন যুবক) নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা:

বদরুদ্দীন হুতি হিযবুল হক দলের সহ সভাপতি হিসেব কাজ করতেন। কিন্তু সংগঠনের সভাপতি মাজদুদ্দীন আল মুয়াইদীর সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। মতবিরোধের কারণ ছিল দুটি:

১) ইমামিয়া মাসয়ালায় হুতি এবং তার অনুসারীদের গোঁড়ামিপূর্ণ ধ্যান-ধারণা পোষণ করা।

২) ইরানের খোমেনি বিপ্লবের আদর্শের দিকে প্রচণ্ড ভাবে ঝুঁকে পড়া।

এই মতবিরোধের জের ধরে হুতি এবং তার অনুসারীরা হিযবুল হক থেকে বের হয়ে আশ শাবাবুল মুমিন (মুমিন যুবক) সংগঠনে যোগ দেয়। যে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তারা ইতোপূর্বে ১৯৯৭ সালে অংশ গ্রহণ করেছিল।

ইরান এবং তৎকালীন ইয়েমেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আশ শাবাব সংগঠনটি তাদের কর্মপরিধি বৃদ্ধি করে উত্তর ইয়েমেনের সাদাহ অঞ্চল সহ কয়েকটি জেলার অনেক যুবক,অল্প বয়সী তরুণ এবং বিভিন্ন গোত্রের সাধারণ জনগণকে তাদের দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়।

১৯৯৭ সালে বদরুদ্দীন হুতি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তার সংগঠনের কাজে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে।

এরপর শিয়া রাফেযী, ইমামিয়া, ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় সাধন করে তাদের সাথে একীভূত হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে এবং ইরান বিপ্লবের স্তুতি গাইতে থাকে-যাতে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তারা ইয়েমেনের মাটিতে বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হয়।

তারপর তিনি তার অনুসারীদেরকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করেন এবং তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যেন তারা অন্ধভাবে তার নির্দেশ পালন করে।

তারপর ইয়েমেন সরকারের জুলুম-শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেয় এবং বাস্তবেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়ে। ২০০৪ সালে সরকারী বাহিনীর সাথে হুতি বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু এ বছরই তিনি সরকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। তার নিহত হওয়ার মাধ্যমে এসব আক্রমণ ও যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

✪ আব্দুল মালিক হুতি:

হুসাইন হুতি নিহত হওয়ার পর তার ভাই আব্দুল মালিক হুতি আশ শাবাব সংগঠনের নেতৃত্বে আসে। তিনি ছিলেন প্রভাব সৃষ্টিকারী সুবক্তা। তিনি তার ভায়ের পদাঙ্ক অনুসরণে ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধ বিদ্রোহী আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

✪ হুতিদের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আকিদা ও মতবাদ:

কতিপয় গবেষক নিশ্চিতভাবে বলেছেন যে, হুসাইন হুতি শিয়াদের ইমামি ইসনা আশারিয়া মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার লিখিত বই-পুস্তক এবং বক্তৃতার বিভিন্ন ক্যাসেট দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়।

হুতিদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, বক্তৃতা এবং কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে তাদের বেশ কিছু আকিদা ও মতবাদ স্পষ্ট হয়। সেগুলোর সারাংশ নিম্নরূপ:

১) তাদের দাওয়াতের মূল কথা হল,

● ক) ইমামিয়া আকিদাকে মজবুত করা।

● খ) এই আকিদা পোষণ করা যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরে আলী (রা.) কে খলীফা হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন।

● গ) আলী (রা.) এর পরে ইমাম হবেন হাসান (রা.) এবং হুসাইন (রা.)।

● ঘ) ইমাম হওয়ার পরম্পরা হাসান-হুসাইন (রা.) এর বংশধর থেকে কখনো বাইরে যাবে না।

● ঙ) কোন ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম আকিদা পোষণ করলে সে কাফের।

২) খুলাফায়ে রাশেদীন-বিশেষ করে তিন খলীফা (আবু বকর (রা),উমর (রা.),এবং উসমান (রা.) থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং অন্যান্য সাহাবীদেরকে কাফের মনে করা। কারণ, তাদের আকিদা হল, মুসলিম বিশ্বে আজ পর্যন্ত যত ফেতনা-ফ্যাসাদ আর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণ হল, এই তিন খলীফা সহ অন্য সাহাবীগণ।

বদরুদ্দীন হুতি বলেন,“আমি বিশ্বাস করি,তারা (অর্থাৎ সাহাবীরা) কাফের। কারণ,তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে।”

হুসাইন হুতি নিশ্চিত করে বলেন,

“আবু বকর এর বাইয়াত গ্রহণের অনিষ্ট এবং কুপ্রভাব এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণেই মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং শত্রুরা মুসলিম জাতির উপর চড়াও হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন যে, আবু বকর, উসমান এবং মুয়াবিয়া সকলেই উমরের অন্যায় কার্যক্রমের ফসল।

৩) এ মর্মে দাওয়াত দেয়া যে,কেবল কুরআন অনুসরণ করতে হবে এবং কুরআন ছাড়া ইসলামী শরিয়ার অন্য সকল বিষয় বর্জন করতে হবে। কারণ তাদের মতে, হাদিস সাহাবী ও তাবেঈনদের মাধ্যমে বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণিত হয় নি। ফলে যে হাদিস মুসলিম বিশ্বের কাছে যুগ পরিক্রমায় পরম নির্ভরতার সাথে গ্রহণীয় হয়ে আসছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য শরঈ উৎস নয়। এ কারণে, তারা সহীহ বুখারি ও মুসলিমকে সরাসরি কটাক্ষ করে থাকে।

৪) তাদের দাবী হল,তাফসীর এবং উসুলে ফিকহের ক্ষেত্রে হাদিসকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। এর মূল উদ্দেশ্য হল,এই মতবাদে বিশ্বাসীরা যেন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থেকে অন্ধভাবে তাদেরকে অনুসরণ করে। এভাবে অনুসারীদেরকে মূল রহস্য সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করা যাবে এবং অন্যান্য রাফেযী আকিদা গ্রহণ করানো সহজ হবে।

৫) জনগণকে উত্তেজিত করে সেই জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার আহবান জানানো যাদের মধ্যে ইমাম হওয়ার শর্তাবলী বিদ্যমান নয়। তাদের মতে ইমাম হওয়ার অন্যতম শর্ত হল,হাসান ও হুসাইন (রা.) এর বংশোদ্ভূত হওয়া।

এ ধরণের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

সংগঠনের সদস্য ও সহযোগী লোকজনকে নিশ্চিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করে ব্যাপক অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তোলার আহবান জানানো।

৬) আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের লোকদেরকে এই যুক্তিতে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা যে, তারা তাদের সন্তানদেরকে বাতিল আকিদা শিক্ষা দিচ্ছে। যে কারণে ইতিহাস পরিক্রমায় মুসলিম জাতিকে খেসারত দিতে হচ্ছে।

আহলে সুন্নাহর লোকদেরকে বয়কট করা। কারণ, তারা আবু বকর (রা.), উমর (রা.) ও উসমান (রা.)কে ভালবাসে এবং তাদেরকে আলী এর উপর অগ্রাধিকার দেয়।

৭) ইরানের খোমেনী বিপ্লব এবং লেবাননের হিযবুল্লাহকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা। কারণ, তারা মনে করে সম্মান, মর্যাদা এবং মুক্তির জন্য এগুলোকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা কর্তব্য।

৮) মানুষের অনুভূতি ও চেতনায় উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য ইরান থেকে আমদানি করা কিছু অন্তঃসারশূন্য শ্লোগান দেয়া। যেমন: আমেরিকা ধ্বংস হোক, ইসরাইল ধ্বংস হোক, ইহুদিদের উপর লানত, ইসলামের বিজয়…ইত্যাদি।

৯) তাদের শিয়া যায়দিয়া সম্প্রদায়ের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য সমালোচনা ও কান্নাকাটি করা এবং সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে তাদেরকে বিপ্লবের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।

১০) তাদের অনুসারীদেরকে আহলে সুন্নতের তথাকথিত ‘ওয়াহাবী’দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং হারামাইনের দেশকে তাদের কবল থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানানো।

আহলে সুন্নাহর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিন্তাকে বোকামি প্রসূত চিন্তা বলে আখ্যায়িত করা।

১১) গাদ্দারি, বিশ্বাস ঘাতকতা এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ ইত্যাদি অপকর্মে হুতিদের খ্যাতি রয়েছে।

✪✪ ইরান এবং শিয়া-ইসনা আশারিয়া মতবাদের সাথে হুতিদের সম্পর্ক:

যায়দিয়া সম্প্রদায়ের কিতাবাদি রাফেজী-ইমামিয়া-ইসনা আশারিয়া সম্প্রদায়ের সমালোচনায় ভরপুর..বরং তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট ও কাফির হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ইমামিয়াদের কিতাবাদী যায়দিয়াদের সমালোচনা ও কুফরির ফতোয়ায় পরিপূর্ণ।[6]

এমন পরস্পর বিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার পরও ইরানী বিপ্লব ‘তাকিয়া’ (তথা চরম গোপনীয়তা রক্ষা) নীতির অন্তরালে যায়দিয়াদের কাতারে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী হুতি জারুদীদের চিন্তা-চেতনার মাঝে তাদের হারানো মানিকের সন্ধান পায়।

তারা দেখল ইয়েমেনের মাটিতে তাদের বিপ্লব ও আকিদা-বিশ্বাস রপ্তানির জন্য হুতিরা সবচেয়ে ভালো প্রতিনিধি, অনুগত ছাত্র বা সৈনিক হওয়ার উপযুক্ত। এদের মাধ্যমেই ইয়েমেনে তাদের আদর্শ,চিন্তা-চেতনা ও মতবাদ প্রচার করার পাশাপাশি তাদের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

উল্লেখ্য যে,বদরুদ্দীন হুতি এবং তার ছেলে হুসাইন হুতি ইতোপূর্বে ইরানে বসবাস করে রাফেযী আকিদা এবং ব্যাপক-বিস্তর বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা গলধঃকরণ করে এসেছে।

এটাও অজানা নয় যে,এই হুতি ইরানের খোমেনী বিপ্লবের প্রতি মুগ্ধ। তিনি এই বিপ্লবকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে থাকে। তিনি এটিকে আল্লাহর রহমত ও নিয়ামত মনে করেন। তিনি বলেন, “ইমাম খোমেনী ছিলেন একজন ন্যায়-নিষ্ঠ ইমাম। আল্লাহ ভীরু ইমাম। তিনি এমন ন্যায় পরায়ণ ইমাম ছিলেন যার দুয়া বিফলে যায় না।”

ইয়েমেনের যায়দিয়া সম্প্রদায়ের আলেমগণ এ মর্মে সতর্ক করেছিলেন যে, হুতিরা গোঁড়া ও বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসনা আশারিয়া মতবাদ ও কর্মপদ্ধতি বহন করছে। এ ব্যাপারে তারা একটা বিবৃতিও প্রকাশ করেছিল।

বাস্তবেই হুতিদের হাত ধরেই ইসনা আশারিয়া এবং ইরান বিপ্লবের সাথে যায়দিয়াদের ঐকমত্য সৃষ্টি ও কাছাকাছি আসার প্রবণতা বিস্তার লাভ করে।

◍◍ ইরান এবং শিয়া-ইসনা আশারিয়া মতবাদের সাথে হুতিদের সম্পর্কের প্রমাণ:

ধারাবাহিক ভাবে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে গভীর সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:

১) ‘গাদির খুম’ দিবস পালন করা। এটি ইয়েমেনের মাটিতে একটি নতুন বিষয়। এ দিন তারা বড় বড় মিছিল বের করে। এতে থাকে চমকপ্রদ নানা শ্লোগান আর বক্তৃতা।

হুসাইন হুতি তার এক বক্তৃতায় বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী বিন আবি তালিব (রা.)কে উম্মতের জন্য পরবর্তী খলীফা ঘোষণা করার আগে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন নি।

২) হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত দিবস পালন এবং এ উপলক্ষে হুসাইনী মাহফিলের আয়োজন করা।

৩) আবু বকর (রা.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণকারী সকল সাহাবী এবং তাদের পথের অনুসারী সকল মানুষকে কাফের মনে করা।

এ প্রসঙ্গে হুসাইন হুতি এক দরসে বলেন, আলী’র ইমামত ও খেলাফত বিষয়ে যাদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ পৌঁছার পরও তা অমান্য করে তারা কাফের।

৪) হুতি ও ইরানীদের মাঝে একাধিক দ্বিপাক্ষিক সফর এবং গোপন বৈঠকের আয়োজন করা।

ইরাকে অবস্থিত ইরান দূতাবাসের পক্ষ থেকে ইসনা আশারিয়া আকিদার প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে নাজাফে ইয়েমেনি হুতিদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৫) হুতিদের পক্ষ থেকে ইরানী বিপ্লব ও পদ্ধতির প্রশংসা করা এবং তাদের শ্লোগান ব্যবহার করা। অনুরূপভাবে লেবাননের হিযবুল্লাহর শ্লোগান ব্যবহার করা এবং তাদের কোন কোন সেন্টারে হিযবুল্লাহর পতাকা উত্তোলন করা।

৬) ইরানের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, বক্তৃতা-বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে হুতিদের এবং ইয়েমেনে তাদের বিপ্লবী কার্যক্রমকে মিডিয়া গত সাপোর্ট দেয়।

৭) ইরান এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের রাফেযীদের পক্ষ থেকে ইয়েমেনে হুতিদের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার সুযোগে তাদের অনুসারী ও অনুরাগীদের মাঝে বিতরণের উদ্দেশ্যে প্রচুর আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করা হয়।

৮)ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহর পক্ষ থেকে হুতিদেরকে সামরিক সহায়তা প্রদান করা হয়। ইরানী অস্ত্র-শস্ত্র হুতিদের কাছে পৌঁছানো হয় বিভিন্ন পথে। তন্মধ্যে ইয়েমেনের বিভিন্ন দ্বীপ-উপদ্বীপ ও সমুদ্র বন্দর। এগুলো দিয়ে তেহরান থেকে পাঠানো অস্ত্রের চালান চোরাই পথে হুতিদের হাতে এসে পৌঁছে।

তাছাড়া ইরান ও লেবাননের অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা হুতি এবং তাদের সাথে যে সব রাফেযী এসে যুক্ত হয় তাদেরকে বিভিন্ন ধরণের উন্নতমানের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। যেন ইয়েমেনে হুতিদের একটি ক্ষমতা সম্পন্ন ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা সেখানে তাদের আলাদা মজবুত অবস্থান তৈরি হয়। যাদের মাধ্যমে ইয়েমেন ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ইরানী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা যায়-যেভাবে করা হয় লেবাননের হিযবুল্লাহর মাধ্যমে।

সম্প্রতি দেখা গেছে, সা’দাহ জেলা প্রশাসনের মদদে হুতিদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে এবং ইয়েমেনের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি,সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার দুর্বলতা, সেনাবাহিনীর অদক্ষতা, উন্নত ও আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের স্বল্পতা ও সর্বোপরি দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ইত্যাদির সুযোগে অন্যান্য এলাকা দখলের চেষ্টা করা হয়েছে।

হুতিরা আহলুস সুন্নাহর লোকদেরকে সা’দাহ জেলা থেকে বিতাড়নের চেষ্টা করত। এ জন্য তারা তাদেরকে নানা চাপের মুখে রাখত, চেক পয়েন্টে তাদেরকে তল্লাশি করত বরং পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছিল যে, তাদেরকে ঘেরাও করে তাদের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিত। যেমনটি ঘটেছে ইয়েমেনের দাম্মাজ এলাকায়। সেখানে উপর্যুপরি বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে তারা হত্যা করেছে।

৯) প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদির আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা। তারা দাবী করত যে, হুসাইন হুতি হল ইমাম মাহদি। তিনি নিহত হওয়া পর্যন্ত তাদের মাঝে এই বিশ্বাসই জীবিত ছিল। পরবর্তীতে ঘোষণা করা হল, তিনি উধাও হয়ে গেছেন। অবশেষে প্রায় দশ বছর পরে তার নিহত হওয়ার কথা তারা স্বীকার করেছে।

১০) ইসনা আশারিয়া আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি আহবান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ।

১১) ইরানের পক্ষ থেকে হুতি ও হুতি সমর্থক ছাত্রদেরকে পড়ালেখার জন্য ইরান নিয়ে আসা হয়। তারপর তাদের মাঝে ইমামিয়া রাফেযী আকিদা এবং খোমেনী বিপ্লবের চিন্তাধারার বীজ বপন করা হত যাতে এরা ইরানী শিয়া মতাদর্শের ধারক-বাহক, প্রচারক ও সৈনিক হিসেবে ফিরে আসে এবং এদের মাধ্যমে ইরানের পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

◍◍ রাফেযী সম্প্রদায়ের কতিপয় মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাস:

ইরান বিপ্লব যে মতাদর্শে বিশ্বাসী তা হল ‘ইমামিয়া ইসনা আশারিয়া’ মতবাদ। এটি একটি গোঁড়া শিয়া-রাফেযী ফিরকা।

এদের মৌলিক কিছু আকিদা নিম্নরূপ:

১) আল্লাহর সাথে শিরক: অর্থাৎ এ মতবাদে বিশ্বাসীরা তাদের ইমামদের নিকট দুয়া করে, তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে, তাদের কবরে যায় হজ্জ করার উদ্দেশ্যে, তাদের কবরে তওয়াফ করে, কবর জাপটে ধরে বরকত নেয়। এরা এই সব করবকে কাবা এবং বায়তুল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে।

২) তারা এ দাবী করে যে, ইমামত হল দীনের একটি রোকন বা স্তম্ভ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে গেছেন। তিনি ইমাম হওয়ার বিষয়টি বারো জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন।

৩) তারা বলে, ইমামগণ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। তারা নিষ্পাপ। তারা অদৃশ্যের সব খবর রাখেন এবং এ বিশ্বজগত পরিচালনায় তাদেরও ক্ষমতা রয়েছে।

৪) তারা মনে করে প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী বর্তমানে ইরাকের সিরডাপ সামুররায় আত্মগোপন করে আছে।

৫) তারা মনে করে কুরআনকে বিকৃত করা হয়েছে এবং তা অপূর্ণ।

৬) চারজন সাহাবী (আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা.) ছাড়া সব সাহাবীকে কাফের মনে করা এবং গালাগালি করা। বিশেষ করে আবু বকর (রা.), উমর (রা.), এবং আয়েশা (রা.),কে।

৭) ‘তাকিয়া’ (চরম গোপনীয়তা রক্ষা) নীতি অবলম্বন করা। এরা আহলে সুন্নাহর প্রতি ভয়ানক শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে কিন্তু বাহ্যিক আচরণে সেটা প্রকাশ করে না।

৮) তারা বাদাআত মতবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নিকট এমন কিছু প্রকাশিত হয় যা তিনি আগে জানতেন না। যার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।

৯) যে সব আহলে সুন্নতের লোকেরা তাদের বিরোধিতা করে তাদেরকে তারা শুধু কাফিরই মনে করে না বরং মনে করে তাদেরকে হত্যা করা এবং সম্পদ লুণ্ঠন করা তাদের জন্য বৈধ।

১০) মুতা বিবাহ তথা (শরীয়ত সম্মত বিবাহ ছাড়া) নারী সম্ভোগ করা বৈধ।

এই হল হুতি সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং তাদের কার্যক্রম, উৎস, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

আল্লাহর নিকট দুয়া করি, তিনি যেন তাদেরকে হেদায়েত দান করেন এবং মুসলমানদেরকে তাদের অনিষ্ট ও ষড়যন্ত্রের কবল থেকে হেফাজত করেন। নিশ্চয় তিনি এ সব ব্যাপারে ক্ষমতাশীল।

صَلَّى اللهُ عَلى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَ عَلَى آلِه وَصِحْبِه وَسَلَّمَ

———-টিকা———
[1] ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ২৪২ কি:মি: দূরে অবস্থিত একটি জেলা।

[2] দ্রষ্টব্য: মীযানুল ইতিদাল ২/৯৩, আল কামিল ৩/১০৪৬-১০৪৮

[3] দ্রষ্টব্য: রিজালুল কিশশী, পৃষ্ঠা নং ১৯৯, আল ফিহরিস্ত, ইবনে নাদীম, পৃষ্ঠা নং ২৫৩

[4] দ্রষ্টব্য: আল ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃষ্ঠা নং ৩০-৩২

[5] দ্রষ্টব্য: যিয়াদ ইবনে মুনযেরের জীবনী, মীযানুল ইতিদাল-ইমাম যাহাবী। রাফিযাতুল ইয়ামান, পৃষ্ঠা নং ১২৬-১২৮, মুহাম্মদ ইমাম, যায়দিয়া: পরিচয় ও আকিদা-বিশ্বাস, কাযী ইসমাইল আল আকওয়া, পৃষ্ঠা নং ২৪-২৫

[6] দ্রষ্টব্য:আল ইমামাতুল ইসনা আশারিয়া লিয যায়দিয়া বাইনা আদায়িল আমস ওয়া তকিয়াতুল ইয়াওম-মুহাম্মদ আল খুযার।

———————————–

حَقِيْقَةُ الحُوْثِيِّيْنَ
تأليف: سليمان بن صالح الغصن

ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি শিয়াদের আসল চেহারা
মূল: প্রফেসর ডক্টর সুলাইমান বিন সালিহ আল গুসন
অধ্যাপক, কিং সউদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব
প্রকাশনায়: ধর্ম মন্ত্রণালয়, সউদী আরব।।

Translate