Tuesday, October 25, 2022

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন-সংক্রান্ত প্রচলিত গল্পটি বানোয়াট ও হাদিসের নামে মিথ্যাচার

 প্রশ্ন: নিম্নোক্ত ঘটনাটি কি সহিহ? নবীজীর কাছে তাঁর সকল বিবি বসা ছিলেন। এমন সময়, এক বিবি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আপনার বিবিদের মাঝে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন? কেমন কঠিন প্রশ্ন! কারণ সকল বিবি এখানে উপস্থিত। নবীজী কাকে হাসাবেন আর কাকে কাঁদাবেন? তাই কৌশলে বললেন, আগামী কালকে তার জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।

অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কুমারী স্ত্রী আয়েশা রা. এর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে ২টি খেজুর দিয়ে বললেন, আয়েশা, এই খেজুরের কথা কাউকে বলবে না।

এভাবে সকল বিবির ঘরে প্রবেশ করে সকলকেই ২টি করে খেজুর দিয়ে বললেন, এই খেজুরের কথা কাউকে বলবে না। অতপর পরের দিন সকল বিবি একত্রিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ রাসুল, জবাব দিন, আপনি কোন স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন?

নবীজী উত্তরে বলেন, গত রাতে যাকে আমি ২টি খেজুর দিয়ে ছিলাম। তাকেই সবচাইতে বেশি ভালবাসি। তখন সকল বিবি মনে মনে আনন্দিত হয়ে গেলেন।

নবিজী মুচকি হাসলেন। কারণ নবিজী তো সকলকেই খেজুর দিয়ে ছিলেন। কিন্তু একজনের টা অন্যজন জানে না।

অতএব নবীজীর ভালবাসা সকলের উপর সমান ভাবে চলে গেল। কেউ নারাজ হয়নি। এটাকেই বলে ইনসাফ ও ইসলামি বিনোদন এবং সুন্দর কৌশল! এটার নামই দীন-ইসলাম। কত যে শান্তি ইসলামে আমরা তা বুঝি না। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:
এটি কোনও হাদিস নয় বরং হাদিসের নামে মিথ্যাচার। এ বিষয়টি islamweb, dorar ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত ওয়েব সাইটগুলো এবং বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ স্পষ্ট করেছেন-আল হামদুলিল্লাহ।

এর কয়েকটি কারণ। যথা:

◈ ১. সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু মূর্খ গল্পবাজ বক্তা ছাড়া কোনও হাদিস গ্রন্থে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

◈ ২. তাছাড়া এই মুখরোচক গল্পে ভাষা শৈলির দুর্বলতা স্পষ্ট-যা হাদিসে নব্বীর ভাষার সাথে বেমানান।
◈ ৩. শুধু তাই নয়, সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর রাসুল এবং এমন অতুলনীয় মহাজ্ঞানী মহামানবের পক্ষ থেকে তাঁর স্ত্রীদের সাথে এমন দুর্বল কৌশল অকল্পনীয়। কারণ একাধিক স্ত্রীর মাঝে এ জাতীয় গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। জীবনের কোনও না কোনও সময় তা প্রকাশিত হবে বলেই ধারণা করা যায়। তখন তিনি তাদের সামনে মিথ্যাবাদী ও অবিশ্বস্ত (নাউযুবিল্লাহ) বলে প্রতীয়মান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তা যে বানোয়াট গল্প তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

◈ ৪. আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সকল স্ত্রীর মধ্যে মা জননী আয়েশা রা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন তা স্পষ্ট করেই বলেছেন। যেমন:
عَمْرُو بْنُ الْعَاصِ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَهُ عَلَى جَيْشِ ذَاتِ السَّلاَسِلِ، فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ أَىُّ النَّاسِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ ‏”‏ عَائِشَةُ ‏”‏‏.‏ فَقُلْتُ مِنَ الرِّجَالِ فَقَالَ ‏”‏ أَبُوهَا ‏”‏‏.‏ قُلْتُ ثُمَّ مَنْ قَالَ ‏”‏ ثُمَّ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ ‏”‏‏.‏ فَعَدَّ رِجَالاً‏.‏

আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যাতুস সালাসিল যুদ্ধের সেনানায়ক করে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষের মধ্যে কে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয়?
তিনি বললেন, আয়েশা।
আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে কে?
তিনি বললেন, আয়েশার পিতা (আবু বকর রা.)।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কে?
তিনি বললেন, উমর ইবনুল খাত্তাব। তারপর আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৫. তাছাড়া আয়েশা রা. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন-এ বিষয়টি সাহাবিদের নিকটও সুবিদিত ছিল। তাই তো তিনি যেদিন আয়েশা.-এর ঘরে থাকতেন সেদিন সাহাবিগণ সে দিন তাঁর নিকট উপহার-সামগ্রী পাঠাতেন। হাদিসে এসেছে,
وَكَانَ الْمُسْلِمُوْنَ قَدْ عَلِمُوْا حُبَّ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَائِشَةَ فَإِذَا كَانَتْ عِنْدَ أَحَدِهِمْ هَدِيَّةٌ يُرِيْدُ أَنْ يُهْدِيَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَخَّرَهَا حَتَّى إِذَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ بَعَثَ صَاحِبُ الْهَدِيَّةِ بِهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ

উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামা রা. সাহাবিদের এই উপহার পাঠানোর বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কথা তুললে তিনি কয়েকবার চুপ থাকার পর অবশেষে বললেন,
لَا تُؤْذِيْنِيْ فِيْ عَائِشَةَ فَإِنَّ الْوَحْيَ لَمْ يَأْتِنِيْ وَأَنَا فِيْ ثَوْبِ امْرَأَةٍ إِلَّا عَائِشَةَ

“আয়েশা রা.-এর ব্যাপার নিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। মনে রেখ, আয়েশারা. ব্যতীত আর কোন স্ত্রীর বস্ত্র তুলে থাকা অবস্থায় আমার উপর ওহি নাজিল হয়নি।”

(আয়েশা রা.) বলেন, এ কথা শুনে তিনি (উম্মে সালামা রা.) বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, “আপনাকে কষ্ট দেয়া হতে আমি আল্লাহর নিকট তওবা করছি।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫১/ হেবা ও এর ফজিলত, পরিচ্ছেদ: ৫১/৮. সঙ্গীকে কোন হাদিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অন্য স্ত্রী ছেড়ে কোন স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত দিনের অপেক্ষা করা।]

এসব হাদিস থেকেও প্রমাণিত হয়, আল্লাহর রাসূলের কাছে তাঁর কোনও স্ত্রী সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র তা তাঁদের সকলের জানা ছিল। সুতরাং তাঁদের একসাথে জোট বেঁধে তাঁকে এমন প্রশ্ন করে বিব্রত করার আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না।
অতএব, এটি গল্পবাজ বক্তা ও দীন বিষয়ে মূর্খ লোকদের তৈরি করা হাদিস তা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়।

সুতরাং মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য ছাড়া এ জাতীয় হাদিস প্রচার করা ও বর্ণনা করা হারাম।

● রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানোয়াট হাদিস বর্ণনার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেন,
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর মিথ্যা রোপ করল (মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করল), সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা করে নিলো।” (সহিহ বুখারি, অনুচ্ছেদ: আম্বিয়াদের হাদিস, হাদিস নং ৩২৭৪)

● তিনি আরও বলেন,
كفى بالمرء كذباً أن يحدث بكل ما سمع
“মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সহিহ মুসলিম এর ভূমিকা, আবু দাউদ ৪/২৯৮, ইবনে হিব্বান, ১/২১৩ )

● অন্য বর্ণনায় এসেছে
كفى بالمرء إثما أن يحدث بكل ما سمع
“গুনাহ হওয়ার জন্য এতটুকুই এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সিলসিলা সহিহা হা/২০২৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বানোয়াট হাদিস, ও দলিল বহির্ভূত কিচ্ছা-কাহিনী থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

কাফির রাষ্ট্রে পড়াশোনা ও অবস্থানের বিধান

 আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার অগণিত প্রশংসা দিয়ে শুরু করছি। একইসাথে আশরাফুল আম্বিয়া, সায়্যিদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন, আবুল ক্বাসিম মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দিল্লাহ বিন ‘আব্দিল মুত্তালিব আল-হাশিমী আল-কুরাইশী এর উপর অসংখ্য সালাত ও সালাম কামনা করছি; আল্লাহুম্মা সাল্লি আলাইহি, আল্লাহুম্মা বারিক আলাইহি। সাম্প্রতিক সময়ে আমার পরিচিতদের মাঝে অনেকেরই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে অমুসলিম দেশে ভ্রমণের প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। এবং তাদের সাথে আলাপ করে বুঝলাম তারা অনেকেই এর শরী’ঈ বিধান সম্পর্কে অবগত নয়। তাই এই প্রবন্ধটি সংকলন করতে সচেষ্ট হলাম। আল্লাহর পূর্ণ তাওফীক কাম্য।

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে অমুসলিম দেশে ভ্রমণের হুকুম সম্পর্কে যুগশ্রেষ্ঠ তিন কিংবদন্তী আলিমের ফাতওয়া উল্লেখ করা হয়েছে। আশা করি প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পড়লে পাঠকের খোরাক মিটবে এবং এ বিষয়ে সংশয় নিরসন হবে, ইন শা আল্লাহ।

১. সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি, সামাহাতুশ শাইখ, আল-‘আল্লামাহ্, ইমাম আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দিল্লাহ বিন বায (رحمه الله)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

❝ অমুসলিম দেশগুলিতে ভ্রমণ করা একটি ঝুঁকি যা একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত মুসলিমদের এড়িয়ে চলতে হবে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

“আমি ঐ সমস্ত মুসলিমদের দায়ভার বহন করবো না যারা মুশরিকদের মাঝে থাকে।” [আবু দাউদ: ২৬৪৫, তিরমিযী: ১৬০৪; সনদ: সহিহ (তাহকিক: আলবানি)]

মুসলিম কর্তৃপক্ষসমূহের (ওয়াফফাক্বাহুমুল্লাহ) উচিত নয় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অমুসলিম দেশে লোক পাঠানো। তবে অমুসলিম দেশের প্রতিনিধিদের হতে হবে পরহেজগার, দ্বীন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানী এবং ওসব দেশে ভ্রমনের ফলে নেতিবাচক প্রভাবের আশংকামুক্ত। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়কগণের উচিত অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করা এবং তাদের সার্বক্ষণিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। অমুসলিম দেশে দাওয়াতের উদ্দেশ্য প্রতিনিধি পাঠানো জায়েজ, এমনকি উত্তমও বটে, যাতে করে সেখানে ইসলামের প্রচার হয়। উপরিউক্ত দুটি অবস্থা বাদে অন্য কোনো অবস্থাতে যুবকদের অমুসলিম দেশে পাঠানো কদর্যকাজ (মুনকার) হিসেবে বিবেচিত, যাতে চরম ঝুঁকি রয়েছে। একই হুকুম বর্তাবে অমুসলিম দেশে ব্যাবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এর কারণ হলো সেখানে ফিতনাহ এবং পাপাচারের প্রচার প্রসার, যেখানে ব্যাক্তির সর্বদা শয়তান, তার কুপ্রবৃত্তি এবং অসৎসঙ্গী হতে সতর্ক থাকা উচিত। ❞[১]

২. যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল-‘আল্লামাহ, ইমামুস সালাফিয়্যাহ, শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (رحمه الله) কে উক্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেন,

❝ আমাদের এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে কোনো কাফির দেশে মুসলিমদের বসবাস করা জায়েয নয়। কাউকে যদি কোনো মুসলিম দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়, তাহলে সে অন্য কোনো মুসলিম দেশে চলে যাবে। ❞ [২]

৩. সামাহাতুল ফাক্বীহ, আল-‘আল্লামাহ্, আশ-শাইখুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল-উসাইমীন (رحمه الله) এ বিষয়ে বলেন,

❝ ব্যাক্তিগত এবং বিশেষ কোনো বৈধ প্রয়োজনে সেখানে অবস্থান করা জায়েয, যেমন ব্যাবসা বা চিকিৎসা। তবে তা হতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেখানে অবস্থান করা যাবে না। উলামায়ে কিরাম ব্যাবসার জন্য কাফির রাষ্ট্রে অনুপ্রবেশকে জায়েয বলেছেন এবং এ বিষয়ে দালীল হিসেবে তারা কিছু সংখ্যক সাহাবীর উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।

আর পড়াশুনার জন্য কাফির রাষ্ট্রে অবস্থান করা; এ ধরনের অবস্থান যদিও পূর্বোল্লিখিত প্রয়োজনে কাফির রাষ্ট্রে অবস্থানের অন্তর্ভুক্ত, তথাপি অন্যান্য প্রয়োজনে সেখানে অবস্থানের তুলনায় পড়াশোনার জন্য অবস্থানের বিষয়টি তার দ্বীন ও চরিত্রের জন্য অধিকতর ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। কেননা যে কোন শিক্ষার্থী মর্যাদার দিক দিয়ে নিজেকে ছোট মনে করে এবং তার শিক্ষককে বড় মনে করে থাকে। এক্ষেত্রে তাই এমন হবে যে, সে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, তাদের চিন্তা-চেতনা, মতাদর্শ এবং চাল-চলনকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিবে এবং এভাবে এক সময় সে তাদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে শুরু করবে। তবে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী যাদেরকে আল্লাহ্ হিফাযত করে থাকেন, কেবল তারাই এরূপ পরিস্থিতি থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

তাছাড়া একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রয়োজনে তার শিক্ষকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। এতে করে শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে ভালবাসতে শুরু করে এবং শিক্ষকের গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতাকে সে তোষামোদ করতে থাকে। তাছাড়া ঐসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীর অনেক কাফির সহপাঠী থাকে এবং তাদের মধ্য থেকে সে অনেককে বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। সে তাদেরকে ভালবাসে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ প্রকারের বিপদের কারণে পূর্বোল্লেখিত প্রকারের চেয়ে নিজেকে অধিক হেফাযত প্রয়োজন। আর তাই মৌলিক ২টি শর্তের পাশাপাশি আরো কয়েকটি শর্তারোপ করা হয়েছে। সেগুলো হলো:

i. শিক্ষার্থীকে বিবেক-বুদ্ধির দিক দিয়ে যথেষ্ট পরিপক্ক হতে হবে, যা দ্বারা সে কল্যাণকর এবং ক্ষতিকর বিষয় সমূহের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারবে এবং সুদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তা দেখতে পাবে। আর কম বয়সী এবং অপরিপক্ক বুদ্ধ-জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য কাফিরদের দেশে পাঠানোর কাজটি হবে তাদের দ্বীন, চরিত্র এবং চাল-চলনের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া এটি তাদের জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্যও মারাত্মক বিপজ্জনক। তার এ বিষপান তার ফিরে যাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সংক্রমিত হবে। বাস্তবতা ও পর্যবেক্ষণও তাই সাক্ষ্য দেয়। কেননা পড়াশোনার জন্য পাঠানো বহু শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের পরিবর্তে অন্য কিছু নিয়েই ফিরে এসেছে। তারা দ্বীন, চরিত্র এবং চাল-চলনে বিপথগামী হয়ে ফিরেছে। আর এসব বিষয়ে তাদের নিজেদের এই সমাজের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা তো জানা কথা এবং সাক্ষ্যও তাই বলে। কাজেই অপরিপক্ক জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন এসব কম বয়সী শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার জন্য কাফির রাষ্ট্রে পাঠানো যেন কোন ভেড়ীকে হিংস্র কুকুরের মুখে তুলে দেওয়ার মতই কাজ।

ii. শিক্ষার্থীর নিকট ইসলামী শারীআতের এই পরিমাণ জ্ঞান থাকতে হবে যা দ্বারা সে হক ও বাতিলের মাঝে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে এবং সত্য দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিহত করতে পারে। যাতে করে কাফিরদের বাতিল বিষয়াদি দ্বারা সে প্রতারিত না হয় এবং বাতিলকে যেন সত্য বলে মনে না করে বা বিভ্রান্তিতে যেন না পড়ে কিংবা বাতিলকে প্রতিহত করতে অক্ষম হয়ে দিশেহারা অথবা বাতিলের অনুসারী না হয়ে যায়। হাদীসে বর্ণিত দুআ’য় রয়েছে

اللهم أرني الحق حقا وارزقني اتباعه وأرني الباطل باطلا وارزقني اجتنابه ولا تجعله ملتبسا علي فأضل

“হে আল্লাহ্! সত্যকে সত্য হিসেবে আমাকে দেখাও এবং তা অনুসরণ করার তাওফীক আমাকে দান করো। আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে আমাকে দেখাও এবং তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক আমাকে দান করো এবং সত্য-মিথ্যার বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট রেখো না, তাহলে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবো।”

iii. শিক্ষার্থীর মাঝে এ পরিমাণ ধার্মিকতা থাকতে হবে যা তাকে কুফর এবং পাপাচার থেকে রক্ষা করবে। ধার্মিকতার দিক দিয়ে দুর্বল কোন ব্যক্তি কাফির রাষ্ট্রে অবস্থান করে নিরাপদে থাকতে পারে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে যদি কাউকে নিরাপদে রাখেন তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কেননা সেখানে তাকে আক্রমণকারী বিষয়সমূহ বেশ শক্তিশালী এবং তার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ দুর্বল। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কুফর ও পাপাচারের অসংখ্য শক্তিশালী উপকরণ। এগুলো যদি এমন কোন স্থানে সংঘটিত হয় যেখানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশ দুর্বল, তাহলে যা হবার তাই হবে।

iv. মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণকর যে জ্ঞানার্জন প্রয়োজনীয়তার দাবী, তা অর্জনের মত প্রতিষ্ঠান তার নিজ দেশে নেই। কিন্তু সে বিষয়ে যদি মুসলিম জাতির কোন ফায়দা না থাকে অথবা সে বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা যদি কোন ইসলামী দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকে, তাহলে সে জ্ঞানার্জনের জন্য অমুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থান করা জায়েয নয়। কারণ অমুসলিম দেশে অবস্থান একদিকে যেমন দ্বীন ও আখলাকের জন্য বিপজ্জনক, অন্যদিকে তা প্রচুর অর্থ-সম্পদ অনর্থক অপচয় করার কারণও বটে। ❞ [৩]

পাদটীকা:
[১] https://tinyurl(.)com/binbazstudyabroad
[২] সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, ক্যাসেট নং ৬১৭; বঙ্গানুবাদ: ফাতওয়ায়ে আলবানী, পৃ: ৩৬৬
[৩] শারহু সালাসাতিল উসুল, বঙ্গানুবাদ, আলোকধারা হতে প্রকাশিত, পৃ: ২৮৯

অনুবাদ ও সংকলন: মুহাম্মাদ আখলাকুজ্জামান।
সম্পাদনা: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা।

ঝড়-বৃষ্টিতে যে দুআ পাঠ করতে হয়

 ❒ ঝড় ও বায়ু প্রবাহের সময় দুআ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا تَسُبُّوا الرِّيحَ فَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْهَا مَا تَكْرَهُونَ فَقُولُوا: اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ الرِّيحِ، وَخَيْرَ مَا فِيهَا وَخَيْرَ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ، وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِهِ الرِّيحِ، وَشَرِّ مَا فِيهَا وَشَرِّ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ
“তোমরা বাতাসকে গালি দিও না। যখন এমন বাতাস দেখবে যা তোমরা অপছন্দ করো তখন বলবে:
উচ্চারণ:
“আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকা খায়রাহা ওয়া খায়রা মা ফীহা ওয়া খায়রা মা উরসিলাত বিহী; ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা ফীহা ওয়া মিন শাররি মা উরসিলাত বিহী।”
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট এই বায়ুর কল্যাণ, এর মধ্যে যে কল্যাণ নিহীত আছে এবং যা নিয়ে তা প্রেরিত হয়েছে তার কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এই বায়ুর অনিষ্ট, এর মধ্যে যে অনিষ্ট নিহীত রয়েছে এবং যা নিয়ে তা প্রেরিত হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে।”
[সুনান তিরমিযী, অনুচ্ছেদ: বাতাসকে গালি দেয়া নিষেধ, হা/২১৭৮, সহীহ-আলবানী রহ.]

❒ বৃষ্টির সময় দুআ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বৃষ্টি দেখতেন তখন বলতেন,
اللّهُمَّ صَيِّـباً نافِـعاً
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাইয়িবান নাফিয়ান।
অর্থ: “আল্লাহ, (এই মেঘকে) তুমি কল্যাণময় বৃষ্টি বৃষ্টিতে পরিণত করো।”
[সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: বৃষ্টির সময় যা পাঠ করতে হয়]
হে আল্লাহ, তুমি ধেয়ে আসা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, টর্নেডো ইত্যাদির ভয়াবহ কবল থেকে আমাদেরকে হেফাজত করো। রক্ষা করো তোমার আজাব ও গজব থেকে। আমরা তোমার নিকট আমাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার নিকটই প্রত্যাবর্তন করছি।
আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

বন্ধ হোক এসব উড়াধুড়া কিচ্ছা-কাহিনীর প্রচার ও প্রসার

 খলিফা উমর রা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিতে সাহাবির জিম্মায় ছেড়ে দিলেন এবং সে তিন দিন পর ফিরে এলো!

▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
প্রশ্ন: তাবলিগ জামাতের ‘হায়াতুস সাহাবা’ কিতাবে উল্লেখিত নিম্নোক্ত ঘটনাটা কি সত্য?
❝এই যুবক আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।❞

দোষী যুবককে টেনে-হিঁচড়ে খলিফার দরবারে নিয়ে এসেছেন দুই ব্যক্তি। তারা তাদের পিতার হত্যার বিচার চান।

খলিফা হযরত উমর রা. সেই যুবককে জিজ্ঞেস করলেন যে তার বিপক্ষে করা অভিযোগ সত্য কিনা। অভিযোগ স্বীকার করল যুবক। দোষী যুবক সেই ঘটনার বর্ণনা দিল:
“অনেক পরিশ্রমের কাজ করে আমি বিশ্রামের জন্য একটি খেজুর গাছের ছায়ায় বসলাম। ক্লান্ত শরীরে অল্প সময়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার একমাত্র বাহন উটটি পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে কিছু দূর গিয়ে পেলাম, তবে তা ছিল মৃত। অভিযোগকারী এই দুই ব্যক্তির বাবাকে আমার মৃত উটের পাশে পেলাম। সে আমার উটকে তার বাগানে প্রবেশের অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করেছে। এই কারণে আমি হঠাৎ করে রাগান্বিত হয়ে পড়ি এবং তার সাথে তর্কাতর্কি করতে করতে এক পর্যায়ে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে ফেলি। ফলে সে সেইখানেই মারা যায়। যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে গেছে। এর জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।”

বাদীরা জানালেন- “আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই।” সব শুনে হযরত উমর রা. অপরাধী যুবককে বললেন, “উট হত্যার বদলে তুমি একটা উট দাবি করতে পারতে, কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছ। হত্যার বদলে হত্যা। এখন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তোমার কোন শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো।” নওজোয়ান বলল, “আমার কাছে কিছু ঋণ ও অন্যের রাখা কিছু আমানত আছে। আমাকে যদি কিছু দিন সময় দিতেন, আমি বাড়ি গিয়ে আমানত ও ঋণগুলি পরিশোধ করে আসতাম।”

খলিফা হযরত উমর রা. বললেন, “তোমাকে এভাবে একা ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমার পক্ষ থেকে কাউকে জিম্মাদার রেখে যেতে পারো তবে তোমায় সাময়িক সময়ের জন্য যেতে দিতে পারি।“ নওজোয়ান বলল, “এখানে আমার কেউ নেই যে আমার জিম্মাদার হবে।” যুবকটি তখন নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এই সময় হঠাৎ মজলিসে উপস্থিত একজন সাহাবি হযরত আবু যর গিফারি রা. দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি হবো ঐ ব্যক্তির জামিনদার। তাকে যেতে দিন।”
আবু যর গিফারি রা.-এর এই উত্তরে সভায় উপস্থিত সবাই হতবাক। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি, তার উপর হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী! তার জামিনদার কেন হচ্ছেন আবু যর!
খলিফা বললেন, “আগামী শুক্রবার জুমা পর্যন্ত নওজোয়ানকে মুক্তি দেয়া হল। জুমার আগে নওজোয়ান মদিনায় ফেরত না আসলে নওজোয়ানের বদলে আবু যরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।” মুক্তি পেয়ে নওজোয়ান ছুটল মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির দিকে। আবু যর গিফারি রা. চলে গেলেন নিজ বাড়িতে।

দেখতে দেখতে জুমাবার এসে গেল। নওজোয়ানের আসার কোনও খবর নেই। হযরত উমর রা. রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন আবু যর গিফারির রা. কাছে। পত্রে লিখা, আজ শুক্রবার বাদ জুমা সেই যুবক যদি না আসে, আইন মোতাবেক আবু যর গিফারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আবু যর যেন সময় মত জুম্মার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববিতে হাজির হন। খবর শুনে সারা মদিনায় থমথমে অবস্থা। একজন নিষ্পাপ সাহাবি আবু যর গিফারি আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জুমার পর মদিনার সবাই মসজিদে নববির সামনে হাজির। সবার চোখে পানি। কারণ দণ্ডপ্রাপ্ত যুবক এখনো ফিরে আসেনি। জল্লাদ প্রস্তুত।

জীবনে কত জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছে না জল্লাদ। আবু যরের মত একজন সাহাবি সম্পূর্ণ বিনা দোষে আজ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, এটা মদিনার কেউ মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা উমর রা. নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। হৃদয় তাঁর ভারাক্রান্ত। তবু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারো পরিবর্তনের হাত নেই। আবু যর রা. তখনও নিশ্চিন্ত মনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর পায়ে আবু যর রা. এর দিকে এগুচ্ছেন আর কাঁদছেন। আজ যেন জল্লাদের পা চলে না। পায়ে যেন কেউ পাথর বেঁধে রেখেছে।

এমন সময় এক সাহাবি উচ্চ স্বরে জল্লাদকে বলে উঠলেন, “হে জল্লাদ একটু থামো। মরুভূমির ধুলার ঝড় উঠিয়ে ঐ দেখ কে যেন আসছে। হতে পারে ঐটা নওজোয়ানের ঘোড়ার পদধূলি। একটু দেখে নাও।” ঘোড়াটি কাছে আসলে দেখা যায় সত্যিই এ সেই নওজোয়ান।

নওজোয়ান দ্রুত খলিফার সামনে এসে বলল, “আমিরুল মুমিনিন, মাফ করবেন। রাস্তায় যদি আমার ঘোড়া পায়ে ব্যথা না পেত, তবে যথা সময়েই আসতে পারতাম। বাড়িতে গিয়ে আমি একটুও দেরি করিনি। বাড়ি পৌঁছে গচ্ছিত আমানত ও ঋণ পরিশোধ করি। তারপর বাবা, মা এবং নববধূর কাছে সব খুলে বলে চিরবিদায় নিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এখন আমার জামিনদার ভাইকে ছেড়ে দিন আর আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পবিত্র করুন। কেননা কেয়ামতের দিন আমি খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না।”

আশেপাশের সবাই একেবারেই নীরব। চারিদিকে একদম থমথমে অবস্থা। সবাই হতবাক, কী হতে চলেছে! যুবকের পুনরায় ফিরে আসাটা অবাক করে দিলো সবাইকে।
খলিফা হযরত উমর রা. যুবককে বললেন, “তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, তারপরেও কেন ফিরে এলে?” উত্তরে সেই যুবক বলল- “আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলমান সাহায্য করতে এগিয়ে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গেছিলো।”

এবার হযরত উমর রা. হযরত আবু যর গিফারি রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন না চেনা সত্যেও এর জামিনদার হলেন?” উত্তরে হযরত আবু যর গিফারি রা. বললেন, “পরবর্তীতে কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান বিপদে পড়েছিলো, অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।”

এমন কথা শুনে, হঠাৎ বৃদ্ধের দুই সন্তানের মাঝে একজন বলে উঠল, “হে খলিফা, আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার উপর করা অভিযোগ তুলে নিলাম।”
হযরত উমর রা. বললেন, “কেন তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছ?” তাদের এক ভাই বলে উঠলো, “কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করে নিজেই স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরেও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি।”
[হায়াতুস সাহাবা-৮৪৪]

উত্তর:

এটি নির্ভরযোগ্য কোনও ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় না বরং পাওয়া যায়, কিছু গল্পের বইয়ে-যার কোনও ভিত্তি নাই। সুতরাং এটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কাহিনী তাতে কোন সন্দেহ নেই।

◈ কাতার ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত islamweb ওয়েব সাইটে উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে গবেষকগণ বলেছেন, ”এই গল্পটি পড়লেই তার শুদ্ধতা অনুসন্ধান করার দরকার পড়ে না। কারণ এর মধ্যে এমন সব অদ্ভুত কথাবার্তা আছে যেগুলো সাহাবিদের জ্ঞান-গরিমার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যাহোক, আমরা এর সনদ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেও কোথাও তা পাইনি। তবে পাওয়া গেছে, বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী এবং দুর্বল উপাখ্যান জাতীয় বইয়ে। আমরা যা পেয়েছি তা হল, আল ইতলিদি (বিশিষ্ট গল্প লেখক মুহম্মদ দাইয়াব আল ইতলিদি-মিসর, মৃত্যু: হিজরি ১২ শতকের প্রথম দিকে) তার নাওয়াদেরুল খোলাফা [খলিফাদের দুর্লভ উপাখ্যান-যা ‘ইলামুন নাস বিমা ওয়াকায়া লিল বারামিকা’ إعلام الناس بما وقع للبرامكة নামে প্রসিদ্ধ] কিতাবের সূচনায় [পৃষ্ঠা: ১১] এ গল্পটি উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে আল মাশরিক ম্যাগজিন [Al-Machriq Magazine]-এর প্রতিষ্ঠাতা লুইস চিকো Louis Cheikho [তুরস্কের খৃষ্টান ক্যাথলিক-ক্যালডীয় ধর্মের অনুসারী, জন্ম ১৮৫৯ ও মৃত্যু ১৯২৮ খৃষ্টাব্দ] তার ‘মাজানিল আদব ফী হাদায়েকিল আরব’ مجاني الأدب في حدائق العرب (৪/২৩০) কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

◈ এ ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত dorar ওয়েব সাইট বলা হয়েছে, لم نجدها في كتب الأثار “আমরা পুরাকীর্তি বা পূর্বযুগের ঘটনাবলী সংক্রান্ত কোনও বইয়ে আমরা তা পাইনি।”
সত্যি আবু যর রা.-এর মত একজন প্রবীণ ও বিচক্ষণ সাহাবি এক অজানা-অচেনা মৃত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর জামিন গ্রহণ করে, নিজে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে তাকে ছেড়ে দিবেন-এটা কোনও প্রজ্ঞা পূর্ণ সিদ্ধান্ত ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক হতে পারে না।

সুতরাং যে সব স্টেজ মাতানো ও সুরেলা বক্তারা এ জাতীয় উড়াধুড়া ও মুখরোচক গল্প দ্বারা জনগণকে বোকা বানাচ্ছেন আর যেসব আবেগী মূর্খরা ফেসবুকে এগুলো প্রচার করে মহামূল্যবান (!) লাইক ও কমেন্ট পেয়ে খুশিতে গদগদ করছেন তাদের উচিৎ, আল্লাহকে ভয় করা এবং সাহাবিদের নামে মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা। অনুরূপভাবে তাবলিগ জামাতের প্রখ্যাত আমির মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভি কর্তৃক রচিত হায়তুস সাহাবা নামক বইটিও পড়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। কারণ বইটি সাহাবিদের নামে নানা দুর্বল ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী দ্বারা সাজানো হয়েছে।
আল্লাহ আমাদেরকে আরও সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate