Tuesday, October 25, 2022

বন্ধ হোক এসব উড়াধুড়া কিচ্ছা-কাহিনীর প্রচার ও প্রসার

 খলিফা উমর রা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিতে সাহাবির জিম্মায় ছেড়ে দিলেন এবং সে তিন দিন পর ফিরে এলো!

▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
প্রশ্ন: তাবলিগ জামাতের ‘হায়াতুস সাহাবা’ কিতাবে উল্লেখিত নিম্নোক্ত ঘটনাটা কি সত্য?
❝এই যুবক আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।❞

দোষী যুবককে টেনে-হিঁচড়ে খলিফার দরবারে নিয়ে এসেছেন দুই ব্যক্তি। তারা তাদের পিতার হত্যার বিচার চান।

খলিফা হযরত উমর রা. সেই যুবককে জিজ্ঞেস করলেন যে তার বিপক্ষে করা অভিযোগ সত্য কিনা। অভিযোগ স্বীকার করল যুবক। দোষী যুবক সেই ঘটনার বর্ণনা দিল:
“অনেক পরিশ্রমের কাজ করে আমি বিশ্রামের জন্য একটি খেজুর গাছের ছায়ায় বসলাম। ক্লান্ত শরীরে অল্প সময়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার একমাত্র বাহন উটটি পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে কিছু দূর গিয়ে পেলাম, তবে তা ছিল মৃত। অভিযোগকারী এই দুই ব্যক্তির বাবাকে আমার মৃত উটের পাশে পেলাম। সে আমার উটকে তার বাগানে প্রবেশের অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করেছে। এই কারণে আমি হঠাৎ করে রাগান্বিত হয়ে পড়ি এবং তার সাথে তর্কাতর্কি করতে করতে এক পর্যায়ে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে ফেলি। ফলে সে সেইখানেই মারা যায়। যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে গেছে। এর জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।”

বাদীরা জানালেন- “আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই।” সব শুনে হযরত উমর রা. অপরাধী যুবককে বললেন, “উট হত্যার বদলে তুমি একটা উট দাবি করতে পারতে, কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছ। হত্যার বদলে হত্যা। এখন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তোমার কোন শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো।” নওজোয়ান বলল, “আমার কাছে কিছু ঋণ ও অন্যের রাখা কিছু আমানত আছে। আমাকে যদি কিছু দিন সময় দিতেন, আমি বাড়ি গিয়ে আমানত ও ঋণগুলি পরিশোধ করে আসতাম।”

খলিফা হযরত উমর রা. বললেন, “তোমাকে এভাবে একা ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমার পক্ষ থেকে কাউকে জিম্মাদার রেখে যেতে পারো তবে তোমায় সাময়িক সময়ের জন্য যেতে দিতে পারি।“ নওজোয়ান বলল, “এখানে আমার কেউ নেই যে আমার জিম্মাদার হবে।” যুবকটি তখন নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এই সময় হঠাৎ মজলিসে উপস্থিত একজন সাহাবি হযরত আবু যর গিফারি রা. দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি হবো ঐ ব্যক্তির জামিনদার। তাকে যেতে দিন।”
আবু যর গিফারি রা.-এর এই উত্তরে সভায় উপস্থিত সবাই হতবাক। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি, তার উপর হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী! তার জামিনদার কেন হচ্ছেন আবু যর!
খলিফা বললেন, “আগামী শুক্রবার জুমা পর্যন্ত নওজোয়ানকে মুক্তি দেয়া হল। জুমার আগে নওজোয়ান মদিনায় ফেরত না আসলে নওজোয়ানের বদলে আবু যরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।” মুক্তি পেয়ে নওজোয়ান ছুটল মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির দিকে। আবু যর গিফারি রা. চলে গেলেন নিজ বাড়িতে।

দেখতে দেখতে জুমাবার এসে গেল। নওজোয়ানের আসার কোনও খবর নেই। হযরত উমর রা. রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন আবু যর গিফারির রা. কাছে। পত্রে লিখা, আজ শুক্রবার বাদ জুমা সেই যুবক যদি না আসে, আইন মোতাবেক আবু যর গিফারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আবু যর যেন সময় মত জুম্মার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববিতে হাজির হন। খবর শুনে সারা মদিনায় থমথমে অবস্থা। একজন নিষ্পাপ সাহাবি আবু যর গিফারি আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জুমার পর মদিনার সবাই মসজিদে নববির সামনে হাজির। সবার চোখে পানি। কারণ দণ্ডপ্রাপ্ত যুবক এখনো ফিরে আসেনি। জল্লাদ প্রস্তুত।

জীবনে কত জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছে না জল্লাদ। আবু যরের মত একজন সাহাবি সম্পূর্ণ বিনা দোষে আজ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, এটা মদিনার কেউ মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা উমর রা. নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। হৃদয় তাঁর ভারাক্রান্ত। তবু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারো পরিবর্তনের হাত নেই। আবু যর রা. তখনও নিশ্চিন্ত মনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর পায়ে আবু যর রা. এর দিকে এগুচ্ছেন আর কাঁদছেন। আজ যেন জল্লাদের পা চলে না। পায়ে যেন কেউ পাথর বেঁধে রেখেছে।

এমন সময় এক সাহাবি উচ্চ স্বরে জল্লাদকে বলে উঠলেন, “হে জল্লাদ একটু থামো। মরুভূমির ধুলার ঝড় উঠিয়ে ঐ দেখ কে যেন আসছে। হতে পারে ঐটা নওজোয়ানের ঘোড়ার পদধূলি। একটু দেখে নাও।” ঘোড়াটি কাছে আসলে দেখা যায় সত্যিই এ সেই নওজোয়ান।

নওজোয়ান দ্রুত খলিফার সামনে এসে বলল, “আমিরুল মুমিনিন, মাফ করবেন। রাস্তায় যদি আমার ঘোড়া পায়ে ব্যথা না পেত, তবে যথা সময়েই আসতে পারতাম। বাড়িতে গিয়ে আমি একটুও দেরি করিনি। বাড়ি পৌঁছে গচ্ছিত আমানত ও ঋণ পরিশোধ করি। তারপর বাবা, মা এবং নববধূর কাছে সব খুলে বলে চিরবিদায় নিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এখন আমার জামিনদার ভাইকে ছেড়ে দিন আর আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পবিত্র করুন। কেননা কেয়ামতের দিন আমি খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না।”

আশেপাশের সবাই একেবারেই নীরব। চারিদিকে একদম থমথমে অবস্থা। সবাই হতবাক, কী হতে চলেছে! যুবকের পুনরায় ফিরে আসাটা অবাক করে দিলো সবাইকে।
খলিফা হযরত উমর রা. যুবককে বললেন, “তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, তারপরেও কেন ফিরে এলে?” উত্তরে সেই যুবক বলল- “আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলমান সাহায্য করতে এগিয়ে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গেছিলো।”

এবার হযরত উমর রা. হযরত আবু যর গিফারি রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন না চেনা সত্যেও এর জামিনদার হলেন?” উত্তরে হযরত আবু যর গিফারি রা. বললেন, “পরবর্তীতে কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান বিপদে পড়েছিলো, অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।”

এমন কথা শুনে, হঠাৎ বৃদ্ধের দুই সন্তানের মাঝে একজন বলে উঠল, “হে খলিফা, আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার উপর করা অভিযোগ তুলে নিলাম।”
হযরত উমর রা. বললেন, “কেন তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছ?” তাদের এক ভাই বলে উঠলো, “কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করে নিজেই স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরেও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি।”
[হায়াতুস সাহাবা-৮৪৪]

উত্তর:

এটি নির্ভরযোগ্য কোনও ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় না বরং পাওয়া যায়, কিছু গল্পের বইয়ে-যার কোনও ভিত্তি নাই। সুতরাং এটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কাহিনী তাতে কোন সন্দেহ নেই।

◈ কাতার ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত islamweb ওয়েব সাইটে উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে গবেষকগণ বলেছেন, ”এই গল্পটি পড়লেই তার শুদ্ধতা অনুসন্ধান করার দরকার পড়ে না। কারণ এর মধ্যে এমন সব অদ্ভুত কথাবার্তা আছে যেগুলো সাহাবিদের জ্ঞান-গরিমার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যাহোক, আমরা এর সনদ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেও কোথাও তা পাইনি। তবে পাওয়া গেছে, বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী এবং দুর্বল উপাখ্যান জাতীয় বইয়ে। আমরা যা পেয়েছি তা হল, আল ইতলিদি (বিশিষ্ট গল্প লেখক মুহম্মদ দাইয়াব আল ইতলিদি-মিসর, মৃত্যু: হিজরি ১২ শতকের প্রথম দিকে) তার নাওয়াদেরুল খোলাফা [খলিফাদের দুর্লভ উপাখ্যান-যা ‘ইলামুন নাস বিমা ওয়াকায়া লিল বারামিকা’ إعلام الناس بما وقع للبرامكة নামে প্রসিদ্ধ] কিতাবের সূচনায় [পৃষ্ঠা: ১১] এ গল্পটি উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে আল মাশরিক ম্যাগজিন [Al-Machriq Magazine]-এর প্রতিষ্ঠাতা লুইস চিকো Louis Cheikho [তুরস্কের খৃষ্টান ক্যাথলিক-ক্যালডীয় ধর্মের অনুসারী, জন্ম ১৮৫৯ ও মৃত্যু ১৯২৮ খৃষ্টাব্দ] তার ‘মাজানিল আদব ফী হাদায়েকিল আরব’ مجاني الأدب في حدائق العرب (৪/২৩০) কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

◈ এ ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত dorar ওয়েব সাইট বলা হয়েছে, لم نجدها في كتب الأثار “আমরা পুরাকীর্তি বা পূর্বযুগের ঘটনাবলী সংক্রান্ত কোনও বইয়ে আমরা তা পাইনি।”
সত্যি আবু যর রা.-এর মত একজন প্রবীণ ও বিচক্ষণ সাহাবি এক অজানা-অচেনা মৃত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর জামিন গ্রহণ করে, নিজে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে তাকে ছেড়ে দিবেন-এটা কোনও প্রজ্ঞা পূর্ণ সিদ্ধান্ত ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক হতে পারে না।

সুতরাং যে সব স্টেজ মাতানো ও সুরেলা বক্তারা এ জাতীয় উড়াধুড়া ও মুখরোচক গল্প দ্বারা জনগণকে বোকা বানাচ্ছেন আর যেসব আবেগী মূর্খরা ফেসবুকে এগুলো প্রচার করে মহামূল্যবান (!) লাইক ও কমেন্ট পেয়ে খুশিতে গদগদ করছেন তাদের উচিৎ, আল্লাহকে ভয় করা এবং সাহাবিদের নামে মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা। অনুরূপভাবে তাবলিগ জামাতের প্রখ্যাত আমির মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভি কর্তৃক রচিত হায়তুস সাহাবা নামক বইটিও পড়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। কারণ বইটি সাহাবিদের নামে নানা দুর্বল ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী দ্বারা সাজানো হয়েছে।
আল্লাহ আমাদেরকে আরও সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate