Friday, December 29, 2023

সালাত শুরু করার পূর্বে সশব্দে নিয়ত ও জায়নামাজের দুআ পাঠের বিদআত

 সালাত শুরু করার পূর্বে সশব্দে ‘নিয়ত’ ও ‘জায়নামাজের দুআ’ পাঠের বিদআত: যে বিদআতে নিমজ্জিত অধিকাংশ নামাযী

▬▬▬◉◯◉▬▬▬
প্রশ্ন: সালাতে দাঁড়িয়ে জায়নামাজের দুআ “ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া…” ও নিয়ত “নাওয়াইতো আন…” পাঠ করার বিধান কি?

উত্তর: সালাতে দাঁড়িয়ে মুখে উচ্চারণ করে প্রচলিত গদ বাধা নিয়ত পাঠ করা বিদআত। চাই আরবিতে “নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি…” পাঠ করা হোক বা বাংলায় তার অনুবাদ পাঠ করা হোক। অনুরূপভাবে তথাকথিত ‘জায়নামাজের দুআ’ হিসেবে “ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া” অথবা আঊযু বিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, দরুদ শরিফ ইত্যাদি পাঠ করাও বিদআত। কেননা সালাত শুরু করার পূর্বে বিশেষ কোন দুআ, তাসবীহ বা অন্য কিছু পাঠ করার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় কোনো নির্দেশনা নেই। সাহাবিগণও কখনো এমন আমল করেন নি। এমন কি চার মাজহাবের সম্মানিত ইমামগণ তথা ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল প্রমুখ মনিষীগণ কেউই তা পড়ার কথা বলেন নি।

◉◉ সশব্দে নিয়ত পাঠ করার ব্যাপারে বিশ্বখ্যাত আলেমদের বক্তব্য:

নিম্নে এ প্রসঙ্গে কতিপয় আলেমের বক্তব্য তুলে ধরা হল:

◖ক. মোল্লা আলী কারী হানাফি রহ. বলেন,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ত্রিশ হাজার ওয়াক্ত নামায আদায় করেছেন। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই কথা বর্ণিত নেই যে, আমি অমুক অমুক ওয়াক্ত নামাযের নিয়ত করছি। সুতরাং মুখে নিয়ত উচ্চারণ না করাটাই সুন্নাত। জেনে রাখুন, শব্দ উচ্চারণ করে মুখে নিয়ত করা জায়েজ নয়। কারণ এটা বিদআত। সুতরাং যে কাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেন নি তা যে করে সে বিদআতি। [দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬-৩৭]

◖খ. আল্লামা ইবনুল হুমাম হানাফি রহ. বলেন:

হাদিসের বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ ও যঈফ কোন সনদেও এই কথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি নামায আরম্ভ করার সময় বলতেন যে, আমি এই এই নামায আদায় করেছি। কোন সাহাবী এবং তাবেঈ থেকেও প্রমাণিত নেই। বরং এই কথা বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায আরম্ভের সময় কেবল শুধু তাকবীর বলতেন। তাই মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। [ফাতহুল কাদীর, ১/৩৮৬, কাবীরী, পৃষ্ঠা ২৫২]
.
◖ গ. হাফিয ইবনুল ক্বাইয়্যিম রহ. বলেনঃ

মুখে নিয়ত পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ কারো হতেই কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। মুখে পাঠের এই পদ্ধতি শয়তানের একটি কুমন্ত্রণা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন শুধু “আল্লাহু আকবার” বলতেন। আর আগে কিছু বলতেন না। সুতরাং মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। চার ইমামও এরূপ নিয়তনামা পড়াকে পছন্দ করেন নি। [ইগাসাতুল লাহফান, ১/১৩৬ ।। যাদুল মাআদ, ১/৫১]
.
◖ঘ. সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রাহ. বলেনঃ

“আরবি নিয়ত শব্দের অর্থ হল মনে ইচ্ছা পোষণ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটা (মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা) প্রমাণিত নেই। না প্রমাণিত আছে কোন সাহাবী এবং তাবেঈ থেকেও। তাই মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত।” [ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ৩৩৯-৩৪০ পৃষ্ঠা]
(উপরোল্লিখিত আলেমদের বক্তব্যগুলো উমর ইবনুল খাত্তাব এর লেখা থেকে সংকলন করা হয়েছে।)

এছাড়াও এ প্রসঙ্গে বহু বিশ্ববরেণ্য আলেমদের বক্তব্য রয়েছে।

অত্র আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা দ্বীনের মধ্যে এটি নব আবিষ্কৃত বা নব সংযোজিত বিদআত। সুতরাং তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা প্রতিটি বিদআতই গোমরাহি। আর গোমরাহির পরিণতি জাহান্নাম।

আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

◉◉ সালাত শুরু করার সঠিক পদ্ধতি:

সালাত শুরু করার সঠিক পদ্ধতি হল, প্রথমে কোন সালাত পড়া হবে তা অন্তরে স্থির করা। (যেমন: ফরয, সুন্নত, নফল, কাযা ইত্যাদি) অত:পর মহান আল্লাহর সীমাহীন সম্মান-মর্যাদার কথা স্মরণ করে অন্তরে ভয়ভীতি, বিনয়-নম্রতা ও একাগ্রতা সহকারে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সালাত শুরু করা।
তারপর হাদিসে বর্ণিত সানা বা দুআউল ইস্তিফতাহ (সালাত শুরুর দুআ) এর একাধিক দুআ থেকে যে কোনো একটি দুআ পাঠ করা।
তারপর “আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম” পাঠ করার পর “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” সহকারে সূরা ফাতিহা পাঠ করা। এরপর যথারীতি সালাত শেষ করা।

◉◉ নিয়ত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা:

মনে রাখতে হবে, নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদতই আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হয় না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
“আমল সমূহ নিয়তের (ইচ্ছার) উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে।” [সহিহ বুখারির প্রথম হাদিস]

এ হাদিসের আলোকে সালাত, সিয়াম, হজ, যাকাত, কুরবানি সহ যে কোন ইবাদতের শুরুতে নিয়তের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। কিন্তু তা হবে অন্তরে। কেননা নিয়তের নিয়ত আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ: ইচ্ছা করা, মনস্থ করা, এরাদা করা, সংকল্প করা। [মুনজিদ, ৮৪৯/ ফতহুল বারী, ১/১৭]

ইবনুল কাইয়েম রাহ. বলেনঃ “নিয়ত হচ্ছে, কোন কিছু করার ইচ্ছা করা এবং সংকল্প করা। উহার স্থান হচ্ছে অন্তর জবানের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণে না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আর নাা কোন সাহাবী হতে নিয়তের শব্দ বর্ণিত হয়েছে”। [ইগাসাতুল্ লাহ্ফান, ১/২১৪]

সুতরাং সালাত শুরু করার পূর্বে কোন সালাত, কয় রাকআত, তা ফরয, সুন্নত না কি নফল এ বিষয়গুলো অন্তরে জাগ্রত থাকলে তাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট।
আসুন, আমরা সুন্নাত অনুযায়ী সালাত আদায় করি এবং বিদআত বর্জন করি। সুন্নতে রয়েছে মুক্তি আর বিদআতে রয়েছে ধ্বংস। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।
▬▬▬◉◯◉▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল, সৌদি আরব।

Friday, December 15, 2023

গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ শরিয়ত এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ

 প্রশ্ন: গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ করা কি উচিৎ?

উত্তর: ওয়াজ মাহফিল বা সভা-সমাবেশে ব্যাপক পরিমাণে জনসমাগম হলে সভাস্থলে মাইক ব্যবহার করা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলগুলোতে গভীর রাত পর্যন্ত যেভাবে চতুর্দিকে মাইক লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে ওয়াজ ও বক্তৃতা প্রচার করা হয় তা উচিৎ নয়। তা ইসলামি শরিয়ত পরিপন্থী হওয়ার পাশাপাশি এতে নানাবিধ ক্ষয়-ক্ষতির কারণ রয়েছে (যেগুলো নিম্নে পেশ করা হয়েছে) বরং তা এতটুকু আওয়াজে হওয়া উচিৎ যেন, মাহফিলে উপস্থিত শ্রোতারা শুনতে পায়। এটাই যৌক্তিক এবং ইসলাম সম্মত।

সর্বোচ্চ রাত দশটা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। কারণ তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য এবং দেশেরও আইন সম্মত (নিম্নে এ সংক্রান্ত আইন পেশ করা হয়েছে)।

সুতরাং ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য, গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিল অব্যাহত না রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার বন্ধ করা। কেননা এতে নানা ধরণের ক্ষতি হয়। যেমন:

◍ ১. গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ শুনে বাড়িতে ফিরে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যথাসময়ে ফজরের সালাত পড়তে পারে না।
◍ ২. বাড়িতে পর্যাপ্ত লোকজনের অনুপস্থিতির কারণে অনেক সময় বাড়ির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
◍ ৩. এটি অনস্বীকার্য নয় যে, অনেক যুবক-যুবতী ওয়াজের নামে রাত-বিরেতে বাড়ি থেকে বের হয়ে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন এবং পাপাচারের পথে ধাবিত হয়। এ সংক্রান্ত বহু ঘটনা যার সাক্ষ্য।
◍ ৪. রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ওয়াজ মাহফিলে ব্যবহৃত মাইকের উচ্চ আওয়াজ আশে-পাশের বহু মানুষের আরাম ও ঘুম কেড়ে নেয়। অনেক ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মানুষ, ঘুমন্ত ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী নারী, বিভিন্ন ওজরের কারণে বাড়িতে অবস্থান কারী লোকজন, পরীক্ষার্থী, অধ্যয়নরত, গবেষক, নামাজ, দুআ ও জিকিরে নিমগ্ন ব্যক্তিদের ঘুম ও কার্যক্রমে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং অন্য ধর্মের মানুষেরও ঘুমের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। আর ইসলামে এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়া অনুমোদিত নয়।

◍ ৫. এভাবে মানুষকে বাধ্য করে ওয়াজ শুনানোর কারণে হয়ত কারো মনে ইসলামের প্রতি বিরক্তি ও বিরূপ মনোভাবও সৃষ্টি হতে পারে- যার ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম।

ওয়াজ মাহফিল তো পরের কথা বরং হাদিসে পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, দুআ-তাসবিহ ইত্যাদি ইবাদতে যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সে জন্য উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন:
عن أبي سعيدٍ قالَ اعتَكفَ رسولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عليْهِ وسلَّمَ في المسجدِ فسمِعَهم يجْهَرونَ بالقراءةِ فَكشفَ السِّترَ وقالَ ألا إنَّ كلَّكم مُناجٍ ربَّهُ فلا يؤذِيَنَّ بعضُكم بعضًا ولا يرفعْ بعضُكم على بعضٍ في القراءةِ أو قالَ في الصَّلاةِ
আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে (মসজিদে নববী) ইতিকাফ করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন, লোকেরা উঁচু স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করছে। তখন তিনি পর্দার কাপড় সরিয়ে তাদের লক্ষ্য করে বললেন, “মনে রাখবে, তোমাদের সবাই তার পালনকর্তার সঙ্গে একান্ত নিভৃত আলাপচারিতায় নিমগ্ন রয়েছ। অতএব তোমাদের একজন অপরজনকে কষ্ট দিবে না এবং তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে (অথবা তিনি বলেছেন: সালাতের ক্ষেত্রে) একজন অপরজনের উপর আওয়াজ উঁচু করবে না।”
[সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৩৩২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস: ১১৬৫; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১১৮৯৬; মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩১০]

আবুল ওয়ালিদ আল বাজি বলেন, (উক্ত হাদিসে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করতে নিষেধ করা হয়েছে এ জন্য যে,) لأن في ذلك إيذاء بعضهم لبعض “এতে পরস্পরকে কষ্ট দেওয়া হয়।” [আল মুন্তাকা শরহুল মুওয়াত্তা]

قال الحافظ ابن رجب في فتح الباري: ما لا حاجة إلى الجهر فيه، إن كان فيه أذى لغيره ممن يشتغل بالطاعات، كمن يصلي لنفسه ويجهر بقراءته، حتى يغلط من يقرأ إلى جانبه أن يصلي، فإنه منهي عنه.

◍ ৬. সর্বোপরি এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফদের রীতি ছিল না।

ওমর রা.-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদ-ই-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করেন। এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা রা.-এর কাজে ব্যাঘাত হতো। তাই তিনি ওমর রা.-কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে তিনি তাকে শাস্তি দেন। [আখবারু মদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ : ১/১৫]

উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রেও একই কথা। একইভাবে আমাদের সমাজে গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল, ওরস মাহফিল, শবিনা খতম, কনসার্ট, ডিজে পার্টি, যাত্রা পার্টি, হিন্দুদের পূজা ইত্যাদিতে যেভাবে মাইক ও হাই ভলিউমে মিউজিক বা গান চালানো হয় তা এক দিকে আল্লাহর নাফরমানি, প্রকাশ্য পাপাচার অন্য দিকে শব্দ দূষণ ও চারপাশের মানুষদেরকে কষ্ট দেয়ার নামান্তর। এগুলো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। তবে আজানের বিষয়টি ভিন্ন। কারণ তা খুব অল্প সময়ের জন্য হয় এবং এটি আল্লাহর বিধান।

সুতরাং অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ হওয়া উচিত।

◆ উচ্চ আওয়াজে মাইক ব্যবহার এবং শব্দ দূষণ বিষয়ে আইন কী বলে?

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়৷ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মান-মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে৷ আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না৷ ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ হাসান জানান, ‘‘আইনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ আরো কিছু বিষয়ে ব্যতিক্রম আছে৷ তবে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর কোনোভাবেই উচ্চ শব্দের কোনও অনুষ্ঠান করা যাবে না৷ পুলিশের স্ব প্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে৷ আর পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নেয়ার বিধান রয়েছে৷” [উৎস: dw]
আল্লাহ আমাদেরকে নববী সুন্নতের আলোকে আমাদের জীবনের প্রতিটি কর্ম বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন এবং সব ধরণের অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

মৃত্যুর পূর্বে কাউকে জানাজা বা কাফন-দাফনে অংশ গ্রহণ করতে নিষেধ করা এবং এমন‌ ওসিয়ত পালন করার বিধান

 প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার জানাজা বা কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করতে বারণ করে যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে‌ ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কী করণীয়?

উত্তর: কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পূর্বে যদি তার উত্তরাধিকারী বা পরিবার-পরিজনকে ওসিয়ত (অন্তিম নির্দেশনা) দিয়ে যায় যে, উমুক ব্যক্তি যেন তার জানাজায় না আসে বা তার কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ না করে বা কবরে মাটি না দেয় তাহলে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি নয়। বরং এ ধরনের ওসিয়ত করাই হারাম। কেননা এটি সম্পর্কচ্ছেদ, শত্রুতা ও বিদ্বেষ মূলক ওসিয়ত। আর মৃত ব্যক্তির হারাম ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা জায়েজ নাই। অর্থাৎ এই ধরনের ওসিয়ত করা যেমন হারাম তেমনি তা বাস্তবায়ন করাও হারাম।

▪️ইবনে রুশদ (স্পেনের বিখ্যাত ফকিহ। মৃত্যু: ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন,

” لا يلزم أن يُنفَّذ من الوصايا إلا ما فيه قربة وبر”
“যে ওসিয়তে আল্লাহর নৈকট্য এবং সৎকর্ম আছে তাছাড়া অন্য কোনো ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা অবশ্যক নয়।” [আল বায়ানু ওয়াত তাহসিল ২/২৮৭]
▪️কুয়েতের ফিকহ বিশ্বকোষ-এ বলা হয়েছে যে, ওসিয়ত বৈধ হওয়ার একটি শর্ত হলো,

أَلا يَكُونَ الْمُوصَى بِهِ مَعْصِيَةً أَوْ مُحَرَّمًا شَرْعًا
“ওসিয়ত কৃত বিষয়টি আল্লাহর নাফরমানি মূলক বা শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম না হওয়া।” [আল মাওসুয়াতুল‌ ফিকহিয়া ৪৩/২৫৮]

আরো বলা হয়েছে,

الْقَصْدُ مِنَ الْوَصِيَّةِ تَدَارُكُ مَا فَاتَ فِي حَالِ الْحَيَاةِ مِنَ الإِحْسَانِ ، فَلا يَجُوزُ أَنْ يَكُونَ الْمُوصَى بِهِ مَعْصِيَةً ” انتهى .
“ওসিয়ত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জীবনে যে জনকল্যাণমূলক বা ভালো কাজ করা হয়নি তা পূরণ করা। তাই আল্লাহর নাফরমানি মূলক কাজের অসিয়ত করা জায়েজ নেই।”

অর্থাৎ অসিয়ত হলো, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বা অন্যান্য জিনিসপত্র কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে উত্তরাধিকারী বা আত্মীয়-স্বজনের নিকট তার ইচ্ছা প্রকাশ করা। আর অসিয়তের উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পক্ষ থেকে জনকল্যাণমূলক বা সৎকর্ম সম্পাদন করা। তাই এমন কোনো কাজের অসিয়ত করা যাবে না যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
উদাহরণস্বরূপ: একজন ব্যক্তি অসিয়ত করতে পারেন যে, তার সম্পত্তি অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করা হবে কিংবা মসজিদ, মাদরাসা বা এতিমখানায় দান করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু তিনি অসিয়ত করতে পারেন না যে, তার সম্পত্তি দিয়ে মন্দ কাজ করা হবে।
মোটকথা, কারো প্রতি দুঃখ, কষ্ট বা রাগ ক্ষোভের কারণে মৃত্যুর পূর্বে তাকে তার জানাজা বা কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা জায়েজ নাই। কেউ তা করে গেলেও তা পালন করা আবশ্যক নয়।
🔸তবে এখানে যে বিষয়ে‌ আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি তা হলো, একজন মানুষের সাথে কোন ধরনের মনোমালিন্য বা ঝগড়াঝাঁটি হয়ে থাকলে বিষয়টি যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তি করে নেওয়া, কোন মানসিক দুঃখ, কষ্ট, রাগ বা ক্ষোভ থেকে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া বা যেকোনো ভাবে তার সুরাহা করা আবশ্যক। অনুরূপভাবে মানুষর প্রাপ্য হক আদায়ের ব্যাপারে সবোর্চ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কেননা আমরা কেউ জানি না, কার দুয়ারে কখন মৃত্যু দূত এসে করাঘাত করবে। তখন হয়তো কারো প্রতি বুক ভরা ক্ষোভ বা কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যেতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটেই সাধারণত মানুষ মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার কাফন-কাফন বা জানাজায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করে যায়। তাই এমন প্রেক্ষাপট যেন‌ তৈরি না‌ হয় সে ব্যাপারে আমাদের সকলের সচেতন থাকা ও সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। আল্লাহ হেফাজত করুন।‌ আমিন। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Friday, December 8, 2023

জাযাল্লাহু আন্না মুহাম্মাদান মা-হুয়া আহলুহ হাদিসটি সহিহ সূত্রে প্রমাণিত নয়

 নিম্নোক্ত হাদিসটি আমাদের দেশে খুবই প্রসিদ্ধ:

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ قَالَ: جَزَى اللَّهُ عَنَّا مُحَمَّدًا بِمَا هُوَ أَهْلُهُ ، أَتْعَبَ سَبْعِينَ كَاتِبًا أَلْفَ صَبَاحٍ
“যে ব্যক্তি একবার এই দুআ পাঠ করবে, সত্তর জন ফেরেশতা এক হাজার দিন পর্যন্ত বিরতি হীনভাবে উহার সাওয়াব লিখতে থাকবে।” [মুজামুল কাবির লিত ত্ববারানি, হা/ ১১৫০৯, আওসাত, হা/২৩৫, হিলিয়া লি আবি নুয়াইম ৩/২০৬]
এ দুআটি অনেক ফজিলতের কিতাবে লেখা হয়েছে এবং অনেক আলেম জনগণকে তা আমল করার জন্য উৎসাহিত করেন। কিন্তু হাদিসটি যে সহিহ সনদে প্রমাণিত নয় সে বিষয়ে তারা কথা বলেন না বা মানুষকে সচেতন করেন না। অথচ আলেমদের জন্য তা অপরিহার্য ছিল।

যাহোক, নিম্নে এ হাদিসটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের অভিমত ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হল:

◍ ইমাম সাখাবী বলেন, এর সনদে ‘হানী ইবনুল মুতাওয়াক্কিল’ নামক একজন বর্ণনাকারী আছে। তিনি জয়ীফ (দুর্বল)। [সূত্র: আল কাওলুল বাদি/৬৬]
একই কথা বলেছেন,
◍ ইমাম যাহাবী [মিযানুল ইতিদাল ৪/২৯১]
◍ ইমাম হায়সামী [মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ১০/১৬৬]
◍ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী [লিসানুল মিযান: ৮/৩২১]

এই ‘হানি ইবনুল মুতাওয়াক্কিল’ মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে متروك الحديث (হাদিসের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য)
قال ابن حبان كانت تدخل عليه المناكير وكثرت ، فلا يجوز الاحتجاج به بحال ، وقال أبو حاتم الرازي أدركته ولم أكتب عنه “لسان الميزان” (6 /186)
◍ দিময়াতী বলেন: সাকীম (রোগাক্রান্ত/দুর্বল) [সূত্র: আল মাতজার আর রাবিহ, ২৪৭]
◍ শাইখ আলবানি বলেন: ضعيف جداً অত্যন্ত দুর্বল। [যঈফুর তারগিব, হা/১০৩৬] অন্যত্র তিনি এটিকে ‘মুনকার’ বলেছেন।

এ হাদিসের সনদ সম্পর্কে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসীনদের বিশ্লেষণ ও অভিমত বিস্তারিত নিম্নরূপ:
هذا الحديث رواه الطبراني في “المعجم الأوسط” (235) ، وفي “المعجم الكبير” (11509) ، وأبو نعيم في “الحلية” (3/206) ، وإسماعيل الأصبهاني في “الترغيب والترهيب” (2/331) ، والخلعي في “الفوائد المنتقاة” (2/153) ، والخطيب في “تاريخه” (9/295) كلهم من طريق هَانِئ بْن الْمُتَوَكِّلِ قَالَ: نا مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ جَعْفَرِ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( مَنْ قَالَ: جَزَى اللَّهُ عَنَّا مُحَمَّدًا بِمَا هُوَ أَهْلُهُ ، أَتْعَبَ سَبْعِينَ كَاتِبًا أَلْفَ صَبَاحٍ ) .
وقال الطبراني عقبه : ” لَمْ يَرْوِ هَذَا الْحَدِيثَ عَنْ عِكْرِمَةَ إِلَّا جَعْفَرُ بْنُ مُحَمَّدٍ ، وَلَا عَنْ جَعْفَرِ إِلَّا مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، تَفَرَّدَ بِهِ : هَانِئُ بْنُ الْمُتَوَكِّلِ ” .
وقال أبو نعيم عقبه : ” هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ مِنْ حَدِيثِ عِكْرِمَةَ وَجَعْفَرٍ وَمُعَاوِيَةَ ، تَفَرَّدَ بِهِ هَانِي بْنُ الْمُتَوَكِّلِ الْإِسْكَنْدَرَانِيُّ ” .
وهانئ بن المتوكل هذا متروك الحديث ، قال ابن حبان كانت تدخل عليه المناكير وكثرت ، فلا يجوز الاحتجاج به بحال ، وقال أبو حاتم الرازي أدركته ولم أكتب عنه “لسان الميزان” (6 /186) .
وأورد الشيخ الألباني رحمه الله هذا الحديث في “الضعيفة” (5109) من هذا الطريق وقال ” منكر ” .
وله طريق آخر :
أخرجه محمد بن خلف وكيع في “أخبار القضاة” (3/ 273) ، وقوام السنة في “الترغيب والترهيب” (2/331) من طريق جعفر بْن عيسى الْحَسَني القاضي قَالَ: حَدَّثَنَا رشيد بْن سعد عَن معاوية بْن صالح ، به .
وهذا إسناد واه أيضا ، جعفر بن عيسى : قال أبو حاتم: جهمى ضعيف ، وقال أبو زرعة : صدوق .
“ميزان الاعتدال” (1 /413) .
وذكره الذهبي في “الضعفاء” (1/133) .
ورُشَيد بن سعد : ، قال ابن معين : ” ليس حديثه بشيء” اهـ من “تاريخ يحي بن معين، رواية ابن محرز” (1/51) .
فهذا الحديث ضعيف الإسناد جدا بطريقيه ، لا يصح عن النبي صلى الله عليه وسلم.
(Source: Islamqa)

উপরোক্ত আলোচনা এবং বিজ্ঞ হাদিস বিশারদগণের মতামতের আলোকে প্রমাণিত হল যে, এ হাদিসটি সহিহ নয় বরং তা ‘মুনকার’ ও ‘অত্যধিক দুর্বল’। তা সাধারণ সামান্য দুর্বলতা সম্পন্ন কোনও হাদিস নয় যে ব্যাপারে কতিপয় আলেম ‘ফজিলতের ক্ষেত্রে জয়ীফ হাদিস আমলযোগ্য’ বলে মত দিয়েছেন। বরং তা ‘মুনকার’ (মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল) এবং ‘যাইফ জিদ্দান’ (অত্যধিক দুর্বল)-যা উসুলে হাদিসের বিধান অনুযায়ী আমল যোগ্য নয়।
হাদিসের কিতাবগুলোতে আমলযোগ্য অসংখ্য বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হাদিস রয়েছে-আল হামদুলিল্লাহ। আমাদের কর্তব্য হল, সে সকল সহিহ হাদিসের আমলের প্রতি অধিক যত্নশীল হওয়া এবং অপ্রমাণিত, জাল, জইফ, মুনকার ইত্যাদি হাদিসগুলো পরিত্যাগ করা।
আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

এক মহিলাকে গোসল রত অবস্থায় দেখার কারণে সাহাবি সালাবা এর কান্না এবং পাহাড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা সহিহ নয়

 প্রশ্ন: সালাবা নামক এক সাহাবির কথা শুনা যায়, যিনি এক মহিলাকে গোসল রত অবস্থায় দেখেছিলেন। অতঃপর, তিনি গুনাহের ভয়ে কান্না করতে করতে পাহাড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই কাহিনীটা কি সত্য?

উত্তর: সাহাবি সালাবা বিন আব্দুর রহমান আল আনসারি রা. কোনও এক গোসল রত নারীকে দেখে ফেলার কারণে কাঁদতে কাঁদতে পাহাড়ে চলে যাওয়া বিষয়ে একটি ঘটনা ফেসবুকে যথেষ্ট ভাইরাল। ঘটনার আগে-পরে জোড়-তালি লাগিয়ে এবং রং মাখিয়ে একেকজন একেকভাবে পোস্ট করছে। এ হাদিসটি মূলত: বর্ণিত হয়েছে, হিলয়াতুল আওয়ালিয়া [৯/৩২৯-৩৩১] এবং মারিফাতুস সাহাবা [১/৪৯৮] ইত্যাদি গ্রন্থে।

কিন্তু বাস্তবতা হল, বিজ্ঞ হাদিছ বিশারদগণের দৃষ্টিতে এটি موضوع বা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন ঘটনা। কারও মতে জইফ।

ইবনুল জাওযী রাহ. এ কাহিনীটিকে তার বিখ্যাত বানোয়াট হাদিস সংকলন আল মাউযুআত الموضوعات [৩/১২১] এবং সুয়ুতী রাহ. তার “আল লাআলি আল মাসনুয়া” اللآلئ المصنوعة في الأحاديث الموضوعة গ্রন্থে ‘বানোয়াট হাদিস’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মুহাদ্দিস ইবনে ইরাক আল কিনানি এটিকে জইফ/দুর্বল বলেছেন। [দ্রষ্টব্য: তানযিহুশ শরিয়াহ ২/২৮৩]

সুতরাং এই জাতীয় অপ্রমাণিত ভিত্তিহীন-বানোয়াট ঘটনা বর্ণনা করা, ফেসবুকে পোস্ট করা বা শেয়ার করা হারাম। তবে এর মূল অবস্থা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে হলে ভিন্ন কথা। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

ভূমিকম্প সম্পর্কে শায়খ বিন বায এর নসিহত‍‌

 বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে যে সকল ভূমিকম্প দেখা যায়, নি:সন্দেহে তা আল্লাহর এক প্রকার নিদর্শন। তিনি এর মাধ্যমে বান্দাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করতে চান। যেমন: তিনি বলেন,

وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلا تَخْوِيفًا

“আমি শুধু ভয় দেখানোর জন্য আমার নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করে থাকি।” [বনি ইসরাইল: ৫৯]
ভূমিকম্প আল্লাহর এক প্রকার বড় নিদর্শন। যা ঠেকানোর ক্ষমতা পৃথিবীতে কারো নেই। উন্নত বিশ্বের সব ধরণের টেকনোলোজি এখানে ব্যর্থ। কিন্তু ভূমিকম্পের মাধ্যমে মানুষের যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়, বিপদে পড়ে তাদের জান-মাল নষ্ট হয় তার মূল কারণ হচ্ছে শিরক ও পাপাচার। যেমন: আল্লাহ বলেন,

وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ

“তিনি তোমাদের ওপর যে মসিবতই এসেছে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে এসেছে। আর বহু সংখ্যক অপরাধের শাস্তি না দিয়েই তিনি ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন।” [সূরা শূরা: ৩০]
তিনি আরও বলেন,

مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ

“হে মানুষ! যে কল্যাণই তুমি লাভ করে থাকো তা আল্লাহর দান এবং যে বিপদ তোমার ওপর এসে পড়ে তা তোমার নিজের উপার্জন ও কাজের বদৌলতেই আসে। [সূরা নিসা: ৭৯]
তিনি আরও বলেন,

فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُمْ مَنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

“শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে আমি তার অপকর্ম ও গুনাহের জন্য পাকড়াও করি। তারপর তাদের কারোর ওপর আমি পাথর বর্ষণকারী বাতাস প্রবাহিত করি এবং কাউকে একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ আঘাত হানে। আবার কাউকে আমি ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভূমি ধস দিয়ে ভূগর্ভে প্রোথিত করি এবং কাউকে (বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-প্লাবন প্রভৃতির মাধ্যমে) পানিতে ডুবিয়ে দিই। আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেন না, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করছিল। [আনকাবুত: ৪০]

তাই সকলের উপর আবশ্যক হচ্ছে, আল্লাহর কাছে তওবা করা, তাঁর দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে তার উপর অটল থাকা। শিরক-বিদআতসহ সকল প্রকার অন্যায়-অনাচার পাপাচার থেকে সতর্ক থাকা। যাতে করে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাপত্তা দান করেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

“যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকত সমূহের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তো সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তারা যে অপকর্ম করে যাচ্ছিলো তার জন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি।” [আরাফ: ৯৬]

ওমর বিন খাত্তাব রা.-এর যুগে মদিনায় ভূমিকম্প হলে তিনি মানুষকে ওয়াজ-নসিহত করেছিলেন। এতে তিনি বলেছিলেন,

ما أسرع ما أحدثتم والله لئن عادت لأخرجن من بين أظهركم
(رواه بن عيينة عن عبيد الله بن عمر عن نافع عن صفية)

“কত দ্রুত তোমরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছ! পুনরায় যদি ভূমিকম্প হয় তবে আমি তোমাদের মাঝ থেকে (মদিনা থেকে) বের হয়ে অন্যত্র চলে যাব।” বর্ণিত হয়েছে যে, ওমর বিন আবদুল আজিজের যুগে একবার ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন তিনি বিভিন্ন শহরের আমিরদেরকে চিঠি লিখে জনগণকে দান-সদকা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।” [মূল আরবী রচনাটি নেট থেকে সংগৃহীত]
অনুবাদক: শাইখ আবদুল্লাহ আল কাফী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি

ইসলামে কন্যা সন্তানের মর্যাদা

 প্রশ্ন: প্রথমে কন্যা সন্তান হওয়া বরকতের কারণ”-এ কথাটি কি সঠিক? ইসলামে কন্যা সন্তানের মর্যাদা কী?

উত্তর: কন্যা সন্তান অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ কিন্তু প্রথমে কন্যা সন্তান হওয়া বরকতের কারণ কথাটি ঠিক নয়। প্রথমে কন্যা সন্তান হওয়া বরকতের কারণ-এ মর্মে কিছু হাদিস পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলো একটিও বিশুদ্ধ নয়। বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ সেগুলোর কোন কোনটিকে জঈফ আর কোন কোনটিকে মউজু বা বানোয়াট হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। ইমাম সাখাবি তার মাকাসেদে হাসানাহ গ্রন্থে, সুয়ুতি কাশফুল খাফা গ্রন্থে এবং আলবানি সিলসিলা যঈফা গ্রন্থে এ সব জাল-জঈফ হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য, হাদিস যাচায়-বাছায় করা ছাড়া সেগুলো প্রচার না করা। সাবধান!

❑ ইসলামে কন্যা সন্তানের মর্যাদা:

অনেক ভাইকে দেখা যায়, কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তারা বেজায় নাখোশ হন। তারা কি ভেবে দেখেছেন তাদের এ মনোভাব কাদের সঙ্গে মিলে যায়? কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাতে রুষ্ট হওয়া মূলত জাহেলি চরিত্রের প্রকাশ, আল্লাহ তাআলা যার সমালোচনা করেছেন পবিত্র কুরআনে।

◈ আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ – يَتَوَٰرَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ مِن سُوٓءِ مَا بُشِّرَ بِهِۦٓۚ أَيُمۡسِكُهُۥ عَلَىٰ هُونٍ أَمۡ يَدُسُّهُۥ فِي ٱلتُّرَابِۗ أَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ

“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!” [সূরা নাহল: ৫৮-৫৯]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যাদের বড় ভালোবাসতেন। মেয়েরা ছিল তাঁর আদরের দুলালী। আজীবন তিনি কন্যাদের ভালো বেসেছেন এবং কন্যা সন্তান প্রতিপালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

◈ আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ وَضَمَّ أَصَابِعَهُ»

“যে ব্যক্তি সাবালক হওয়া পর্যন্ত দুটি কন্যার ভার বহন করবে কিয়ামতের দিন আমি আর সে আবির্ভূত হব। একথা বলে তিনি তার হাতের দুই আঙ্গুল একসঙ্গে করে দেখান।” [মুসলিম: ৬৪৬৮]

◈ আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَتْنِى امْرَأَةٌ وَمَعَهَا ابْنَتَانِ لَهَا فَسَأَلَتْنِى فَلَمْ تَجِدْ عِنْدِى شَيْئًا غَيْرَ تَمْرَةٍ وَاحِدَةٍ فَأَعْطَيْتُهَا إِيَّاهَا فَأَخَذَتْهَا فَقَسَمَتْهَا بَيْنَ ابْنَتَيْهَا وَلَمْ تَأْكُلْ مِنْهَا شَيْئًا ثُمَّ قَامَتْ فَخَرَجَتْ وَابْنَتَاهَا فَدَخَلَ عَلَىَّ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- فَحَدَّثْتُهُ حَدِيثَهَا فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم: «مَنِ ابْتُلِىَ مِنَ الْبَنَاتِ بِشَىْءٍ فَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ»

“আমার কাছে এক মহিলা এলো। তার সঙ্গে তার দুই মেয়ে। আমার কাছে সে কিছু প্রার্থনা করল। সে আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। আমি তাকে সেটি দিয়ে দিলাম। সে তা গ্রহণ করল এবং তা দুই টুকরো করে তার দুই মেয়ের মাঝে বণ্টন করে দিল। তা থেকে সে কিছুই খেল না। তারপর সে ও তার মেয়ে দুটি উঠে পড়ল এবং চলে গেল। ইত্যবসরে আমার কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলেন। আমি তাঁর কাছে ওই মহিলার কথা বললাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যাকে কন্যা দিয়ে কোনও কিছুর মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয় আর সে তাদের প্রতি যথাযথ আচরণ করে, তবে তা তার জন্য আগুন থেকে রক্ষাকারী হবে।” [মুসলিম: ৬৮৬২]

কন্যা সন্তান প্রতিপালনে শুধু পিতাকেই নয়; ভাইকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বোনের কথাও বলা হয়েছে হাদিসে। যেসব ভাই মনে করেন, মেয়ে বা বোনের পেছনে টাকা খরচ করলে ভবিষ্যতের তার কোনও প্রাপ্তি নেই তারা আসলে ভুলের মধ্যে আছেন।

◈ আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لَا يَكُونُ لِأَحَدٍ ثَلَاثُ بَنَاتٍ، أَوْ ثَلَاثُ أَخَوَاتٍ، أَوْ ابْنَتَانِ، أَوْ أُخْتَانِ، فَيَتَّقِي اللهَ فِيهِنَّ وَيُحْسِنُ إِلَيْهِنَّ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ»

“কারও যদি তিনটি মেয়ে কিংবা বোন থাকে অথবা দুটি মেয়ে বা বোন থাকে আর সে তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাদের সঙ্গে সদাচার করে, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [মুসনাদ আহমদ: ১১৪০৪; বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৭৯]

◈ আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ أَوِ ابْنَتَانِ أَوْ أُخْتَانِ فَأَحْسَنَ صُحْبَتَهُمْ ، وَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ وَاتَّقَى اللَّهَ فِيهِنَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ.»

“যার তিন মেয়ে অথবা তিনটি বোন কিংবা দুটি মেয়ে বা দুটি বোন রয়েছে, সে তাদের সঙ্গে সদাচার করে এবং তাদের (বিবিধ সমস্যায়) ধৈর্য ধারণ করে আর তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে, সে জান্নাতে যাবে।” [মুসনাদ হুমাইদি: ৭৭২]

কন্যা সন্তান প্রতিপালনে যাতে বৈষম্য না করা হয়, বস্তুবাদী ব্যক্তিরা যাতে হীনমন্যতায় না ভোগেন, তাই তাদের কন্যা প্রতিপালনে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেয়া হয়েছে। শোনানো হয়েছে পরকালে বিশাল প্রাপ্তির সংবাদ।

◈ আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ كَانَتْ لَهُ ثَلاثُ بَنَاتٍ فَصَبَرَ عَلَى لأْوَائِهِنَّ، وَعَلَى ضَرَّائِهِنَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ، زَادَ فِي رِوَايَةِ مُحَمَّدِ بْنِ يُونُسَ: فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَاثْنَتَيْنِ ؟ قَالَ: وَاثْنَتَيْنِ، قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَوَاحِدَةً؟ قَالَ: وَوَاحِدَةً»

“যার তিনটি কন্যাসন্তান থাকবে এবং সে তাদের কষ্ট-যাতনায় ধৈর্য ধরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুহাম্মদ ইবনে ইউনুসের বর্ণনায় এ হাদিসে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে এসেছে) একব্যক্তি প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসূল, যদি দু জন হয়? উত্তরে তিনি বললেন, দু জন হলেও। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, যদি একজন হয় হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, একজন হলেও।” [বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১১]

◈ আউফ বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ كَانَ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ يُنْفِقُ عَلَيْهِنَّ حَتَّى يَبِنَّ أَوْ يَمُتْنَ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ»

“যার তিনটি মেয়ে রয়েছে, যাদের ওপর সে অর্থ খরচ করে বিয়ে দেওয়া বা মৃত্যু পর্যন্ত, তবে তারা তার জন্য আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে।” [বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩১২]

◈ আউফ বিন মালেক আশজায়ী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَا مِنْ عَبْدٍ يَكُونُ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ فَيُنْفِقُ عَلَيْهِنَّ حَتَّى يَبِنَّ أَوْ يَمُتْنَ إِلَّا كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ» فَقَالَتِ امْرَأَةٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، وَاثْنَتَانِ ؟ قَالَ: «وَاثْنَتَانِ»

“যে বান্দার তিনটি মেয়ে রয়েছে, যাদের ওপর সে অর্থ খরচ করে বিয়ে দেওয়া অথবা মৃত্যু পর্যন্ত, তবে তারা তার জন্য আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। তখন এক মহিলা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আর দুই মেয়ে? তিনি বললেন, “দুই মেয়েও”।”[বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩১৩]

◈ আবু আম্মার আউফ বিন মালেক রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أَنَا وَامْرَأَةٌ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ كَهَاتَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ” وَجَمَعَ بَيْنَ أُصْبُعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى ” امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ آمَتْ مِنْ زَوْجِهَا، حَبَسَتْ نَفْسَهَا عَلَى أَيْتَامِهَا حَتَّى بَانُوا أَوْ مَاتُوا »

“আমি এবং গাল মলিন কারী মহিলা কিয়ামতের দিন এভাবে উঠবো।” এ কথা বলে তিনি তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল একত্রিত করে দেখান। (আর গাল মলিন কারী হলেন) “ওই মহিলা যিনি সুন্দরী ও সুবংশীয়া, তার স্বামী মারা গিয়েছেন। তথাপি তিনি তার এতিম সন্তানদের জন্য তাদের বিয়ে বা মরণ পর্যন্ত নিজেকে (কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে) বিরত রেখেছেন”। [মুসনাদ আহমদ : ২৪০৫২; আবু দাউদ : ৫১৫১; বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৫১৪৯]

[যেসব মহিলা স্বামী মারা যাবার পর এতিম সন্তানদের পেছনেই জীবন কাটিয়ে দেন, তারা সাধারণত নিজের সৌন্দর্য চর্চার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার অবকাশ পান না। তাদের ওপর দিয়ে বরং অনেক ঝক্কি-ঝামেলা যায় বলে চেহারার স্বাভাবিক লাবণ্য বজায় থাকে না। “গাল মলিন কারী” বলে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ]

◈ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَكُونُ لَهُ ابْنَتَانِ فَيُحْسِنُ إِلَيْهِمَا مَا صَحِبَهُمَا وَصَحِبَتَاهُ إِلَّا أَدْخَلَتَاهُ الْجَنَّةَ»

“যে কোনও মুসলিমের দুটি মেয়ে থাকবে আর সে তাদের সঙ্গে সদাচার করতে যতদিন সে তাদের সঙ্গে থাকবে এবং তারা যতদিন তার সঙ্গে থাকবে, তবে তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।” [বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩১৪; মুসনাদে আবী ইয়ালা: ২৫৭১, সহিহ ইবনে মাজাহ: ২৯৭৫]

◈ মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“«مَنْ كَانَتْ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ أَوْ أَخَوَاتٍ فَكَفَّهُنَّ وَأَوَاهُنَّ وَرَحِمَهُنَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ “، قَالُوا: أَوِ اثْنَتَانِ ؟ قَالَ: ” أَوِ اثْنَتَانِ “، قَالَ: حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُمْ لَوْ قَالُوا: أَوْ وَاحِدَةً قَالَ: أَوْ وَاحِدَةً »

“যার তিন তিনটি কন্যা অথবা বোন আছে আর সে তাদের থেকে অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে, তাদের আশ্রয় দেয় এবং তাদের ওপর দয়া করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। সাহাবীরা বললেন, আর দু জন? তিনি বললেন, দু জনও। বর্ণনাকারী বলেন, এমনকি আমরা মনে করলাম যদি তারা বলতেন, আর একজন? তবে তিনি বলতেন, আর একজনও।” [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩১৫]

◈ উকবা বিন আমর জুহানি রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,

“«مَنْ كَانَ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ، فَأَطْعَمَهُنَّ وَسَقَاهُنَّ وَكَسَاهُنَّ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّار»

“যার তিনটি কন্যা সন্তান থাকে আর সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধরে, তাদেরকে খাওয়ায়, পান করায় এবং তাদের পোশাকের ব্যবস্থা করে, তবে সে কন্যারা তার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে।” [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান: ৮৩১৭; মুসনাদ আহমদ: ১৭৪০৩; আবী ইয়া”লা, মুসনাদ: ১৭৬৪]

মনে রাখতে হবে, আজ যে অবিবেচক পিতা কন্যা সন্তান দেখে রাগান্বিত হচ্ছেন, কন্যার মাকে যাচ্ছে তাই গালমন্দ করছেন, কাল তিনি এর জন্য আফসোস করতে পারেন। ছেলেদের অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ এ পিতাকে এ মেয়েই একদিন আমোদিত ও সার্থক পিতা বানাতে পারে। আমরা ভুলে যাই স্থূল দৃষ্টিতে অনেক কিছু মন্দ মনে হলেও অনেক সময় তা মঙ্গল বয়ে আনে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا

“আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন।” [সূরা নিসা: ১৯]
[সংগৃহীত: উৎস: tnews247]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।

বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়ায় আল্লাহর প্রতি এক নারীর আক্ষেপ এবং তার প্রতি উপদেশ ও দিকনির্দেশনা

 প্রশ্ন: আমার আপুর স্বামী আর শাশুড়ি খারাপ মানুষ হওয়ায় ছয় মাস আগে ডিভোর্স হয়। চলতি মাসে আমারও ডিভোর্স হয়। কারণ আমার মধ্যে শুচিবায়ু রোগ থাকায় তারা আমাকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা দেয়! এখন লোকজন আমাকে অনেক খারাপ ও নিচুমানের কথাবার্তা বলছে। দু বোনের জন্য মা-বাবাও অসুস্থ হয়ে গেছে। আমার প্রশ্ন হলো, আল্লাহ কি আছেন? আল্লাহ থাকলে সাহায্য করছেন না কেন? বিয়ে যদি আল্লাহর হুকুমে হয় তাহলে বিয়ে ভঙ্গ হওয়াটা আল্লাহ আটকাতে পারেননি কেন? আমাদেরতো কেউ বিয়ে করবে না। এখন কী করবো? সমাজের কেউ কথা বলছে না। আপনজনরা অনেক অপমান করছে। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করছেন না কেন?

উত্তর: আমরা আপনাদের দুই ডিভোর্সি বোনের জন্য অনেক অনেক সমবেদনা জানাচ্ছি এবং দুআ করছি, তিনি যেন আপনাদেরকে ধৈর্য ধারণের তাওফিক দেন ও কল্যাণের উপরে মৃত্যু অবধি প্রতিষ্ঠিত রাখেন। আমিন।

অতঃপর আপনাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেছে এ জন্য ‘আল্লাহ আছেন কিনা’ এমন সংশয় প্রকাশ করা কি কোন ইমানদারের জন্য শোভনীয়? পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার বিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে। অতীতেও হয়েছে।‌ ভবিষ্যতেও হবে। এসবের পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ থাকে। সেজন্য কি আল্লাহকে দোষারোপ করা যায়?

▪️ মানুষের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী:

মানুষকে আল্লাহ কত চমৎকার দেহবায়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন! অতঃপর তাকে খাদ্য-পানীয় ও আলো-বাতাস ও অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দ্বারা প্রতিপালন করেছেন।‌ তাঁর অবাধ্যতা করার পরেও তিনি বান্দার অসংখ্য পাপাচার ক্ষমা করে দেন‌ এবং তাকে দয়া ও মমতা দিয়ে পরিবেষ্টন করে রাখেন। তারপরেও মানুষ ‌নিজেদের কৃতকর্মকে আল্লাহর দোষ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়! এর থেকে বড় অকৃতজ্ঞতা ও ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে?

আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَأَمَّا ٱلۡإِنسَٰنُ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ رَبُّهُۥ فَأَكۡرَمَهُۥ وَنَعَّمَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّيٓ أَكۡرَمَنِ وَأَمَّآ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ فَقَدَرَ عَلَيۡهِ رِزۡقَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّيٓ أَهَٰنَنِ

“মানুষ তো এরূপ যে, তার রব যখন তাকে পরীক্ষা করেন এবং সম্মান ও অনুগ্রহ দান করে তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন।‌ আর যখন তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার রিজিক সংকুচিত করেন তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে হীন করেছেন!” [সূরা আল ফজর: ১৫ ও ১৬]

তিনি আরো বলেন,

إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ خُلِقَ هَلُوعًا- إِذَا مَسَّهُ ٱلشَّرُّ جَزُوعٗا – وَإِذَا مَسَّهُ ٱلۡخَيۡرُ مَنُوعًا

“নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে সে হয় অতি কৃপণ।” [সূরা মাআরিজ ১৯, ২০, ২১]

▪️এখন করণীয়:

মনে রাখতে হবে, বিয়ে করা যেমন আল্লাহর হুকুম তেমনি উভয় পক্ষের মিলমিশ না হলে ডিভোর্স দেওয়াও আল্লাহর বিধান। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর বিধান মেনে শরিয়তসম্মত কারণে ডিভোর্স দেয় তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি জুলুম করে তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই জালিমের বিচার করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সব চেয়ে বড় ন্যায়বিচারক। আপনাদের পূর্ব স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন থাকলে হয়তোবা আপনাদের জীবনের জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হতো। আপনারা আরও বড় ফিতনায় পতিত হতেন। সে কারণে আল্লাহ আপনাদেরকে সেখান থেকে রক্ষা করেছেন এবং আপনাদের জন্য যা কল্যাণকর তিনি তাই করবেন ইনশাআল্লাহ। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা কেউই অবহিত নই।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

“আর তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয় অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না। [সূরা বাকারা: ২১৬]

ভুলে গেলে চলবে না যে, মানব জীবনের ভালো-মন্দ সব কিছু‌ আল্লাহর তকদিরের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়-এর উপরে বিশ্বাস করা ঈমানের ছয়টি রোকন বা স্তম্ভের একটি। সুতরাং আল্লাহর ফায়সালার উপর বিশ্বাস রাখা এবং তাতে একজন মুক্তিকামী মুসলিমের জন্য আবশ্যক। তাই আপনাদের দুঃখজনক এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করুন। ধৈর্যের মধ্যেই মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَجَباً لأمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ لَهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَلِكَ لأِحَدٍ إِلاَّ للْمُؤْمِن: إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْراً لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خيْراً لَهُ.
“ইমানদারের বিষয়টি বিস্ময়কর। তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যতিত অন্য কারো জন্য এমনটি নেই। সে সুখকর কিছু লাভ করলে শুকরিয়া আদায় করে যা তার জন্য কল্যাণকর। আর বেদনাদায়ক কিছু ঘটলে ধৈর্য ধারণ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর।” [সহিহ মুসলিম অধ্যায়: ৫৬/ যুহুদ ও দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণহীনতা সম্পর্কিত বর্ণনা, পরিচ্ছেদ: ১২. মুমিন ব্যক্তি একই গর্তে দু বার দংশিত হয় না]

বিপদে ধৈর্য হারাবেন না, হতাশ হবেন না, সাহস হারাবেন না। মুমিন কখনো হতাশ হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَا۟یۡـَٔسُوا۟ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا یَا۟یۡـَٔسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ

“এবং আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না। কারণ আল্লাহর রহমত হতে কেউই নিরাশ হয় না, কাফির সম্প্রদায় ছাড়া। [সূরা ইউসুফ: ৮৬]

ইমানদার ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হলো, সে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাঁর প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হয় এবং নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে। এ ভাবে সে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে যায়। আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

ইসলামে বৃক্ষ রোপনের গুরুত্ব

 ইসলামে বৃক্ষ রোপনের গুরুত্ব কতটুকু? সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে ফুল গাছ লাগানো কি অপচয়?

প্রশ্ন: ইসলামে‌ বৃক্ষ রোপনের গুরুত্ব কতটুকু? আমি যদি শুধুমাত্র ভালো লাগার উদ্দেশ্যে কিছু ফুল গাছ লাগাই তাহলে এতে কি আমার গুনাহ হবে? একজন আমাকে বলেছে যে, যাতে কোন উপকার নাই তা করা উচিত নয়। সে বলে, সবজি বা ফল গাছ লাগালে একটা পাখি খেলেও সওয়াব রয়েছে। তাই আমার ফুল গাছ লাগানো নাকি ফুজুল (অনর্থক) খরচ! এ কথা কি সঠিক? ফুলের রেনু থেকে তো মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে থাকে। উল্লেখ্য যে, আমি দামী গাছ কিনি না। আমাকে দয়া করে উত্তর দিবেন।

উত্তর: ইসলামে বৃক্ষ রোপনের ব্যাপারে পর্যাপ্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বহু হাদিস পাওয়া যায়। নিম্নে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো:

১. আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا إِلَّا كَانَ مَا أُكِلَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَة، وَمَا سُرِقَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ، وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ مِنْهُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ، وَمَا أَكَلَتِ الطَّيْرُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ، وَلَا يَرْزَؤُهُ أَحَدٌ إِلَّا كَانَ لَهُ صَدَقَةٌ.

“একজন মুসলিম যখন কোনো গাছ লাগায় তো এর যে ফল খাওয়া হবে এটা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে। এ থেকে যা চুরি যাবে তাও সদকা হিসেবে গণ্য হবে। হিংস্র প্রাণীও যদি তা থেকে খায় তাও সদকা হবে। পাখি খেলে সদকা হবে। (এমন কি) যে কেউ যে কোনোভাবে এ থেকে (উপকার) গ্রহণ করবে তা সদকা হিসেবে গণ্য হবে।” [সহীহ মুসলিম, হা/ ১৫৫২]

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‌ আরো বলেন,

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ، إِلَّا كَانَ لَهُ بِه صَدَقَةٌ.

“যখন কোনো মুসলিম কোন বৃক্ষ রোপন করে অথবা কোনো ফসল বোনে, আর মানুষ, পাখি বা পশু তা থেকে খায় তা রোপণকারীর জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়।” [সহীহ বুখারী, হা/২৩২০; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৫৩]

৩. আরেক বর্ণনায় এসেছে, “কিয়ামত পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন গাছটি বেঁচে থাকবে বা তা থেকে উপকার গ্রহণ করা হবে) সে গাছ তার জন্য সদকায়ে জারিয়া (যে দানের সোয়াব অবিরাম ধারায় অব্যাহত থাকে) হিসেবে গণ্য হবে।” [সহীহ মুসলিম, হা/১৫৫২]

মূলত যে কোন গাছ মানুষের জন্য কল্যাণকর। তা ফুল, ফল, কাঠ, ঔষধি, ছায়াদার অথবা সাধারণ সৌন্দর্য বর্ধক ইত্যাদি যে গাছই হোক না‌ কেন।

▪️পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের অপরিসীম অবদান:

গাছ আমাদের কী কী উপকার করে তার ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা দেখি, গাছ আমাদেরকে ফল-ফসল দেয়, ফুল দেয়, ছায়া দেয়, কাঠ দেয় কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। গাছ আমাদের আরো অনেক উপকার করে। যেমন:
গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং সুস্থভাবে আমাদেরকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। আমরা গাছ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি আর আমাদের শরীর থেকে যে কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয় তা শুষে নেয়।
গাছ থেকে আমরা কাঠ পাই, যা দ্বারা আসবাব-পত্র তৈরি করি। ঔষধি গাছ থেকে আমরা ঔষধ বানাই। ফুল গাছ আমাদের আঙিনা সুন্দর করে; রং-বে রঙের ফুল আমাদের হৃদয়কে রাঙিয়ে দেয়। বিভিন্ন মৌসুমে নানান রকম ফলের স্বাদে-ঘ্রাণে আমরা বিমোহিত হই। এছাড়াও আমরা আরো কত শত উপকার লাভ করি গাছ থেকে!
মোটকথা, পৃথিবী বাসোপযোগী থাকা ও মানুষের জীবন ধারণের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে গাছ বা বৃক্ষ। ফলে ইসলাম বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহিত করেছে এবং একে ‘সদকায়ে জারিয়া’ হিসেবে গণ্য করেছে।

বিশেষ করে ফুল গাছ পরিবেশের সৌন্দর্যকে অনেক গুণ বৃদ্ধি করে, ফুলের সৌন্দর্য দেখে মানুষ বিমোহিত হয় এবং অন্তরে প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা লাভ করে। ফুলের পাপড়িতে নানা মেয়ের রংয়ের সুনিপুণ ছোঁয়া চিন্তাশীল হৃদয়ে মহান স্রষ্টার সৃষ্টি জগৎ সম্পর্কে চিন্তার খোরাক যোগায়, ফুলের রেনুতে বসে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। যে মধুর উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না।

▪️ শোভা বর্ধন ও সুগন্ধির উদ্দেশ্যে ফুল গাছ লাগানোর ব্যাপারে ফতোয়া:

বিশিষ্ট ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহ. কে শুধুমাত্র শোভা বর্ধন এবং সুগন্ধির উদ্দেশ্যে গোলাপ ফুলের গাছ লাগানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,

ليس في هذا بأس، ليس على الإنسان بأس أن يزرع في البيت من الأشجار والروائح الطيبة ما ينشرح له الصدر وتنبسط إليه النفس؛ فإن هذا من نعم الله على العباد

“এতে কোনো অসুবিধা নেই। মানুষ যদি বাড়িতে সাধারণ গাছ বা সুগন্ধি যুক্ত ফুলের গাছ রোপন করে তাহলে এতে অন্তরে প্রশান্তি ও পুলক অনুভূত হয়। এটিও বান্দার উপরে আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম।”
আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate