Friday, December 15, 2023

গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ শরিয়ত এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ

 প্রশ্ন: গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ করা কি উচিৎ?

উত্তর: ওয়াজ মাহফিল বা সভা-সমাবেশে ব্যাপক পরিমাণে জনসমাগম হলে সভাস্থলে মাইক ব্যবহার করা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলগুলোতে গভীর রাত পর্যন্ত যেভাবে চতুর্দিকে মাইক লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে ওয়াজ ও বক্তৃতা প্রচার করা হয় তা উচিৎ নয়। তা ইসলামি শরিয়ত পরিপন্থী হওয়ার পাশাপাশি এতে নানাবিধ ক্ষয়-ক্ষতির কারণ রয়েছে (যেগুলো নিম্নে পেশ করা হয়েছে) বরং তা এতটুকু আওয়াজে হওয়া উচিৎ যেন, মাহফিলে উপস্থিত শ্রোতারা শুনতে পায়। এটাই যৌক্তিক এবং ইসলাম সম্মত।

সর্বোচ্চ রাত দশটা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। কারণ তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য এবং দেশেরও আইন সম্মত (নিম্নে এ সংক্রান্ত আইন পেশ করা হয়েছে)।

সুতরাং ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য, গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিল অব্যাহত না রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহার বন্ধ করা। কেননা এতে নানা ধরণের ক্ষতি হয়। যেমন:

◍ ১. গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ শুনে বাড়িতে ফিরে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যথাসময়ে ফজরের সালাত পড়তে পারে না।
◍ ২. বাড়িতে পর্যাপ্ত লোকজনের অনুপস্থিতির কারণে অনেক সময় বাড়ির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
◍ ৩. এটি অনস্বীকার্য নয় যে, অনেক যুবক-যুবতী ওয়াজের নামে রাত-বিরেতে বাড়ি থেকে বের হয়ে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন এবং পাপাচারের পথে ধাবিত হয়। এ সংক্রান্ত বহু ঘটনা যার সাক্ষ্য।
◍ ৪. রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ওয়াজ মাহফিলে ব্যবহৃত মাইকের উচ্চ আওয়াজ আশে-পাশের বহু মানুষের আরাম ও ঘুম কেড়ে নেয়। অনেক ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মানুষ, ঘুমন্ত ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী নারী, বিভিন্ন ওজরের কারণে বাড়িতে অবস্থান কারী লোকজন, পরীক্ষার্থী, অধ্যয়নরত, গবেষক, নামাজ, দুআ ও জিকিরে নিমগ্ন ব্যক্তিদের ঘুম ও কার্যক্রমে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং অন্য ধর্মের মানুষেরও ঘুমের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। আর ইসলামে এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়া অনুমোদিত নয়।

◍ ৫. এভাবে মানুষকে বাধ্য করে ওয়াজ শুনানোর কারণে হয়ত কারো মনে ইসলামের প্রতি বিরক্তি ও বিরূপ মনোভাবও সৃষ্টি হতে পারে- যার ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম।

ওয়াজ মাহফিল তো পরের কথা বরং হাদিসে পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, দুআ-তাসবিহ ইত্যাদি ইবাদতে যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সে জন্য উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন:
عن أبي سعيدٍ قالَ اعتَكفَ رسولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عليْهِ وسلَّمَ في المسجدِ فسمِعَهم يجْهَرونَ بالقراءةِ فَكشفَ السِّترَ وقالَ ألا إنَّ كلَّكم مُناجٍ ربَّهُ فلا يؤذِيَنَّ بعضُكم بعضًا ولا يرفعْ بعضُكم على بعضٍ في القراءةِ أو قالَ في الصَّلاةِ
আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে (মসজিদে নববী) ইতিকাফ করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন, লোকেরা উঁচু স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করছে। তখন তিনি পর্দার কাপড় সরিয়ে তাদের লক্ষ্য করে বললেন, “মনে রাখবে, তোমাদের সবাই তার পালনকর্তার সঙ্গে একান্ত নিভৃত আলাপচারিতায় নিমগ্ন রয়েছ। অতএব তোমাদের একজন অপরজনকে কষ্ট দিবে না এবং তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে (অথবা তিনি বলেছেন: সালাতের ক্ষেত্রে) একজন অপরজনের উপর আওয়াজ উঁচু করবে না।”
[সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৩৩২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস: ১১৬৫; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১১৮৯৬; মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩১০]

আবুল ওয়ালিদ আল বাজি বলেন, (উক্ত হাদিসে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করতে নিষেধ করা হয়েছে এ জন্য যে,) لأن في ذلك إيذاء بعضهم لبعض “এতে পরস্পরকে কষ্ট দেওয়া হয়।” [আল মুন্তাকা শরহুল মুওয়াত্তা]

قال الحافظ ابن رجب في فتح الباري: ما لا حاجة إلى الجهر فيه، إن كان فيه أذى لغيره ممن يشتغل بالطاعات، كمن يصلي لنفسه ويجهر بقراءته، حتى يغلط من يقرأ إلى جانبه أن يصلي، فإنه منهي عنه.

◍ ৬. সর্বোপরি এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফদের রীতি ছিল না।

ওমর রা.-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদ-ই-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করেন। এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা রা.-এর কাজে ব্যাঘাত হতো। তাই তিনি ওমর রা.-কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে তিনি তাকে শাস্তি দেন। [আখবারু মদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ : ১/১৫]

উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রেও একই কথা। একইভাবে আমাদের সমাজে গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল, ওরস মাহফিল, শবিনা খতম, কনসার্ট, ডিজে পার্টি, যাত্রা পার্টি, হিন্দুদের পূজা ইত্যাদিতে যেভাবে মাইক ও হাই ভলিউমে মিউজিক বা গান চালানো হয় তা এক দিকে আল্লাহর নাফরমানি, প্রকাশ্য পাপাচার অন্য দিকে শব্দ দূষণ ও চারপাশের মানুষদেরকে কষ্ট দেয়ার নামান্তর। এগুলো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। তবে আজানের বিষয়টি ভিন্ন। কারণ তা খুব অল্প সময়ের জন্য হয় এবং এটি আল্লাহর বিধান।

সুতরাং অপ্রয়োজনীয় মাইক ব্যবহারে সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ হওয়া উচিত।

◆ উচ্চ আওয়াজে মাইক ব্যবহার এবং শব্দ দূষণ বিষয়ে আইন কী বলে?

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়৷ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মান-মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে৷ আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না৷ ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ হাসান জানান, ‘‘আইনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ আরো কিছু বিষয়ে ব্যতিক্রম আছে৷ তবে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর কোনোভাবেই উচ্চ শব্দের কোনও অনুষ্ঠান করা যাবে না৷ পুলিশের স্ব প্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে৷ আর পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নেয়ার বিধান রয়েছে৷” [উৎস: dw]
আল্লাহ আমাদেরকে নববী সুন্নতের আলোকে আমাদের জীবনের প্রতিটি কর্ম বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন এবং সব ধরণের অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

মৃত্যুর পূর্বে কাউকে জানাজা বা কাফন-দাফনে অংশ গ্রহণ করতে নিষেধ করা এবং এমন‌ ওসিয়ত পালন করার বিধান

 প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার জানাজা বা কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করতে বারণ করে যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে‌ ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কী করণীয়?

উত্তর: কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পূর্বে যদি তার উত্তরাধিকারী বা পরিবার-পরিজনকে ওসিয়ত (অন্তিম নির্দেশনা) দিয়ে যায় যে, উমুক ব্যক্তি যেন তার জানাজায় না আসে বা তার কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ না করে বা কবরে মাটি না দেয় তাহলে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি নয়। বরং এ ধরনের ওসিয়ত করাই হারাম। কেননা এটি সম্পর্কচ্ছেদ, শত্রুতা ও বিদ্বেষ মূলক ওসিয়ত। আর মৃত ব্যক্তির হারাম ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা জায়েজ নাই। অর্থাৎ এই ধরনের ওসিয়ত করা যেমন হারাম তেমনি তা বাস্তবায়ন করাও হারাম।

▪️ইবনে রুশদ (স্পেনের বিখ্যাত ফকিহ। মৃত্যু: ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন,

” لا يلزم أن يُنفَّذ من الوصايا إلا ما فيه قربة وبر”
“যে ওসিয়তে আল্লাহর নৈকট্য এবং সৎকর্ম আছে তাছাড়া অন্য কোনো ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা অবশ্যক নয়।” [আল বায়ানু ওয়াত তাহসিল ২/২৮৭]
▪️কুয়েতের ফিকহ বিশ্বকোষ-এ বলা হয়েছে যে, ওসিয়ত বৈধ হওয়ার একটি শর্ত হলো,

أَلا يَكُونَ الْمُوصَى بِهِ مَعْصِيَةً أَوْ مُحَرَّمًا شَرْعًا
“ওসিয়ত কৃত বিষয়টি আল্লাহর নাফরমানি মূলক বা শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম না হওয়া।” [আল মাওসুয়াতুল‌ ফিকহিয়া ৪৩/২৫৮]

আরো বলা হয়েছে,

الْقَصْدُ مِنَ الْوَصِيَّةِ تَدَارُكُ مَا فَاتَ فِي حَالِ الْحَيَاةِ مِنَ الإِحْسَانِ ، فَلا يَجُوزُ أَنْ يَكُونَ الْمُوصَى بِهِ مَعْصِيَةً ” انتهى .
“ওসিয়ত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জীবনে যে জনকল্যাণমূলক বা ভালো কাজ করা হয়নি তা পূরণ করা। তাই আল্লাহর নাফরমানি মূলক কাজের অসিয়ত করা জায়েজ নেই।”

অর্থাৎ অসিয়ত হলো, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বা অন্যান্য জিনিসপত্র কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে উত্তরাধিকারী বা আত্মীয়-স্বজনের নিকট তার ইচ্ছা প্রকাশ করা। আর অসিয়তের উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পক্ষ থেকে জনকল্যাণমূলক বা সৎকর্ম সম্পাদন করা। তাই এমন কোনো কাজের অসিয়ত করা যাবে না যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
উদাহরণস্বরূপ: একজন ব্যক্তি অসিয়ত করতে পারেন যে, তার সম্পত্তি অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করা হবে কিংবা মসজিদ, মাদরাসা বা এতিমখানায় দান করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু তিনি অসিয়ত করতে পারেন না যে, তার সম্পত্তি দিয়ে মন্দ কাজ করা হবে।
মোটকথা, কারো প্রতি দুঃখ, কষ্ট বা রাগ ক্ষোভের কারণে মৃত্যুর পূর্বে তাকে তার জানাজা বা কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা জায়েজ নাই। কেউ তা করে গেলেও তা পালন করা আবশ্যক নয়।
🔸তবে এখানে যে বিষয়ে‌ আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি তা হলো, একজন মানুষের সাথে কোন ধরনের মনোমালিন্য বা ঝগড়াঝাঁটি হয়ে থাকলে বিষয়টি যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তি করে নেওয়া, কোন মানসিক দুঃখ, কষ্ট, রাগ বা ক্ষোভ থেকে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া বা যেকোনো ভাবে তার সুরাহা করা আবশ্যক। অনুরূপভাবে মানুষর প্রাপ্য হক আদায়ের ব্যাপারে সবোর্চ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কেননা আমরা কেউ জানি না, কার দুয়ারে কখন মৃত্যু দূত এসে করাঘাত করবে। তখন হয়তো কারো প্রতি বুক ভরা ক্ষোভ বা কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যেতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটেই সাধারণত মানুষ মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার কাফন-কাফন বা জানাজায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করে যায়। তাই এমন প্রেক্ষাপট যেন‌ তৈরি না‌ হয় সে ব্যাপারে আমাদের সকলের সচেতন থাকা ও সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। আল্লাহ হেফাজত করুন।‌ আমিন। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate