Tuesday, March 22, 2022

কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম কোন নবীকে কাপড় পরানো হবে

 প্রশ্ন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম কোন নবীকে কাপড় পরানো হবে?

উত্তর:
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ইবরাহিম আ. কে কাপড় পরিধান করানো হবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّكُمْ مَحْشُورُونَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلاً (كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيْدُهُ) الآيَةَ وَإِنَّ أَوَّلَ الْخَلاَئِقِ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ
“নিশ্চয়ই তোমাদের হাশর করা হবে নগ্ন পা, নগ্ন দেহে ও খতনা বিহীন অবস্থায়। আয়াত: كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيْدُهُ “আল্লাহ বলেন, যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে আবার সৃষ্টি করব।” [সূরা আম্বিয়া: ১০৫]
আর কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ইবরাহিম আ.-কে পোশাক পরিধান করানো হবে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ৮১/ সদয় হওয়া, পরিচ্ছেদ: ৮১/৪৫. হাশরের অবস্থা কেমন হবে]
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে,
أن إبراهيم يؤتى له بكرسي على يمين العرش، فيكسى حلة تشرئب إليه أعناق البشر
“আরশের ডান দিকে ইবরাহিম আ. এর জন্য একটি কুরসি (চেয়ার) আনা হবে। এরপর তাকে এমন উন্নত পোশাক পরানো হবে যা মানুষ ঘাড় উঁচু করে দেখবে।” [বায়হাকী-কিতাবুল আসমা ওয়াস সিফাত ২/২৭৬, হা/৮৩৯]

আলেমগণ বলেছেন, এর কারণ হতে পারে, তিনি একমাত্র নবী যাকে কাফের সম্প্রদায় অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিলো উলঙ্গ অবস্থায়। তাই আল্লাহ তাআলা এর প্রতিদান হিসেবে কিয়ামতের দিন তাঁকে এই মর্যাদায় ভূষিত করবেন। এ বিষয়ে আরও একাধিক মতের মধ্যে এটি সর্বাধিক সঠিক বলে নির্ভরযোগ্য আলেমগণ মত ব্যক্ত করেছেন।
আল্লাহু আলাম।

▬▬▬✪✪✪▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

স্বামী মৃত্যুবরণ করলে নাকফুল, কানের দুল, হাতের চুড়ি, মালা ইত্যাদি খুলে ফেলা কি শিরক

 প্রশ্ন: স্বামী মৃত্যুবরণ করলে নাক ফুল, কানের দুল, হাতের চুড়ি, মালা ইত্যাদি খুলে ফেলা কি শিরক? এ প্রথা না কি হিন্দুদের থেকে এসেছে। এ কথা কি সঠিক?

উত্তর:
স্বামী মৃত্যুবরণ করলে ইদ্দত পালনের সময় নাক ফুল, কানের দুল, হাতের চুড়ি, মালা ইত্যাদি সৌন্দর্য বর্ধক অলংকারাদি ব্যবহার করা জায়েজ নাই। কেউ আগে থেকে ব্যবহার করলে তা খুলে রাখবে। ইদ্দত অতিক্রম করার পরে পুনরায় সেগুলো পরতে পারে। কিন্তু এগুলো খুলে ফেলাকে শিরক বলা বা হিন্দু রীতি বলা মারাত্মক বাতিল ও ভ্রান্ত কথা। এমন কথা বলা জায়েজ নাই। কোনও আলেম এমন কথা বলে থাকলে তা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী উম্মে সালামা রা. সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
الْمُتَوَفَّى عَنْهَا زَوْجُهَا لَا تَلْبَسُ الْمُعَصْفَرَ مِنَ الثِّيَابِ، وَلَا الْمُمَشَّقَةَ، وَلَا الْحُلِيَّ، وَلَا تَخْتَضِبُ، وَلَا تَكْتَحِلُ
“কোনও মহিলার স্বামী মারা গেলে সে রঙ্গিন পোশাক, কারুকার্য খচিত জামা ও অলংকার পরবে না, খিজাব (চুল, হাত বা শরীরের অন্য কোথাও কলপ) ও সুরমা ব্যবহার করবে না।” [সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: ৭/ তালাক, পরিচ্ছেদ: ৪৬. ইদ্দত পালন কারিনী ইদ্দতকালে যা বর্জন করবে]

❑ এ ব্যাপারে নিম্নে সম্মানিত ফকিহদের অভিমত তুলে ধরা হল:

◍ বিখ্যাত ফকিহ ইমাম ইবনে আব্দুল বার রাহ. [মৃত্যু: ৪৬৩ হি.] বলেন,
”وأما الحلي والخاتم وما فوقه فلا يجوز للحاد لبسه
“গহনা, আংটি এবং তার উপরে যা আছে, ইদ্দত পালনকারী নারীর জন্য পরিধান করা জায়েজ নয়।” [আল কাফি ফী ফিকহি আহলিল মাদিনাহ, ২/৬২২]

◍ আবু ইসহাক শিরাজি রাহ. [মৃত্যু: ৩৯৩] বলেন,
والإحداد : أن تترك الزينة ، فلا تلبس الحلي
“মহিলাদের শোক পালন হল, সাজসজ্জা পরিত্যাগ করা। সুতরাং গহনা পরিধান করবে না…।” [আত তানবিহ, ১/২০১]

◍ অনুরূপভাবে বিখ্যাত হানাফি ফকিহ আবুল লাইস সামরকান্দি [মৃত্যু: ৩৭৩ হি.]ও মহিলাদের অলঙ্কার পরিধান থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। [তুহফাতুল ফুকাহা, ২/২৫১]
قال السمرقندي في تحفة الفقهاء (2 / 251): “تَفْسِير الْإِحْدَاد : هُوَ الاجتناب عَن جَمِيع مَا يتزين بِهِ النِّسَاء من الطّيب ، وَلبس الثَّوْب الْمَصْبُوغ ، والمطيب بالعصفر والزعفران ، والاكتحال ، والادهان ، والامتشاط وَلبس الْحلِيّ والخضاب ، وَنَحْو ذَلِك ” انتهى.

◍ আধুনিক যুগের বিশিষ্ট ফকিহ সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায বলেন,
الأمر الثالث: عدم الحلي، لا تلبس الحلي لا الذهب ولا الفضة ولا ولا الماس ولا الخواتيم كلها لا تلبس شيء، وإذا كانت عليها تزيلها؛ لأن الرسول
ﷺ نهى عن لبس الحلي للمحادة.
“তৃতীয়ত: অলংকার ব্যবহার না করা। স্বর্ণ-রৌপ্য ডায়মন্ড আংটি ইত্যাদি কোন কিছু ব্যবহার করবে না। এগুলো তার শরীরে থাকলে খুলে ফেলবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোক পালনকারিণী নারীর জন্য অলংকার ব্যবহার নিষেধ করেছেন।”

সুতরাং কোনও মহিলার স্বামী মারা গেলে ইদ্দত পালন কালীন সময় (গর্ভবতী না হলে চার মাস দশ দিন আর গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত) কোনও ধরণের সাজসজ্জা গ্রহণ, মেহেদি ও রং এর ব্যবহার, কানের দুল, নাকের ফুল, হাতের চুরি, গলার মালা ইত্যাদি পরিধান করা বৈধ নয়। কেউ পরে থাকলে তা খুলে ফেলবে। এটাই ইসলামের বিধান।

আল্লাহ আমাদেরকে দীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং সব ধরণের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬✪✪✪▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

ধূমপায়ী স্বামীর সাথে ঘরসংসার করার বিধান

 প্রশ্ন: স্বামী ধূমপান করে। কিন্তু স্ত্রী তাকে বুঝানোর পরেও তা পরিত্যাগ করে না। এমন স্বামীর সাথে ঘরসংসার করা কি জায়েজ?

উত্তর:
➤ প্রথমত: ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপান হারাম। কারণ তা একটি নিকৃষ্ট বস্তু। আর তা শুধু ধূমপানকারী ব্যক্তির জন্যই ধ্বংসাত্মক নয় বরং তার স্ত্রী-পরিবার, সহকর্মী এবং পরিবেশের জন্যও হুমকি। ধূমপান সরাসরি ধূমপানকারীর নিজের ক্ষতি করে আর পরোক্ষভাবে তার নিকটস্থ লোকদের ক্ষতি করে।

❑ ধূমপানের পরোক্ষ ক্ষতি:

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীগণ বলে, “একটা সিগারেটের গোড়া (ফিলটার) পুড়তে থাকার সময় যে ধোঁয়া বের হয় তা ধূমপায়ীর টেনে নেওয়া ধোঁয়াটুকুর চেয়ে ক্ষতিকর, কেননা এই ধোঁয়াটুকু কোনো রকম ছাঁকাছাঁকির ভেতর দিয়ে যায় না। আর এই ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণাগুলোও অনেক ছোট হয়। ফলে সেগুলো অনেক বেশি সময় ধরে বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে।’ এভাবেই পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিলেন ভারতের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতাল এবং মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক এসপি রায়।

এই জাতীয় পরোক্ষ ধূমপান ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসনালীসংক্রান্ত হাঁপানি, স্থায়ী শ্বাসকষ্ট, নানা ধরনের অ্যালার্জি এবং ফুসফুসের অন্যান্য রোগের জন্যও দায়ী বলে জানিয়েছেন গ্লোবাল হসপিটালসের মেডিকেল অঙ্কোলজি বিভাগের চিকিত্সক নিলেশ লোকেশ্বর। ধূমপায়ীদের স্ত্রী বা স্বামী এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপানের ক্ষেত্রে সহকর্মীরা এ ধরনের অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। এ ছাড়া নারী ও শিশুরা বরাবরই ধূমপান জনিত রোগের ঝুঁকিতে বেশি পড়ে।”

প্রতিবেদনে আও বলা হয়,

‘বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ মারা যায় কোনো না কোনোভাবে তামাকজনিত নানা অসুস্থতার কারণে। আর এর মধ্যে প্রায় ছয় লাখ মানুষ ধূমপায়ী না হয়েও মারা যায় পরোক্ষ ধূমপানজনিত কারণে।” [দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা]

➤ ২য়ত: ধূমপায়ী স্বামীকে এর ভয়াবহতা, ক্ষয়-ক্ষতি ও ইসলামে তা হারাম হওয়ার বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে, ধূমপানে নিষেধ করতে হবে এবং নানাভাবে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। অত:পর সে যদি এই বদভ্যাস পরিত্যাগ করে এবং তার আচার-আচরণ ভালো হয় ও দীনমূখী হয় তাহলে তার সাথে সংসার অব্যাহত রাখায় আপত্তি নাই। কিন্তু সে যদি তা পরিত্যাগ না করে বরং আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত থাকে এবং তার সাথে ঘর সংসার করার কারণে স্ত্রী তার নিজের ও সন্তানদের স্বাস্থ্যগত, দীনদারিত্ব ও চারিত্রিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করে এবং নানা চেষ্টার পরও তাকে এ পথ থেকে ফেরানো সম্ভব না হয় তাহলে খোলা তালাকের মাধ্যমে তার থেকে সংসার ভঙ্গ করা জায়েজ আছে।

বিশিষ্ট ফকিহ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. এক প্রশ্নের উত্তরে ধূমপানের ক্ষতিকারিতা ও ইসলামে তা হারাম হওয়া প্রসঙ্গে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের পর ধূমপায়ী স্বামীর সাথে ঘর সংসার করার ব্যাপারে বলেন,
نوصيك بعدم مطالبته بالطلاق إذا كان يصلي وسيرته طيبة وترك التدخين، أما إن استمر على المعصية فلا مانع من طلب الطلاق
“আপনাকে আমরা উপদেশ দিব তালাক না চাওয়ার জন্য যদি সে নামাজ পড়ে, তার আচার-আচরণ ভালো হয় এবং ধূমপান ত্যাগ করে। কিন্তু যদি আল্লাহর নাফরমানি অব্যাহত রাখে তাহলে তালাক চাইতে বাধা নেই।” (শাইখের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট)
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬✪✪✪▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

মহিলাদের মুখে নিকাব পরিধান করার বিধান কী এবং এ ক্ষেত্রে চোখের কী পরিমাণ খোলা রাখা জায়েজ

 প্রশ্ন: অনেক সময় দেখা যায়, ফরসা বা সুন্দর চোখ বিশিষ্ট নারী কালো বোরখা পরিধান করে শুধু দুটি চোখ খোলা রাখে। এমন নারীকে খুব আকর্ষণীয় লাগে। এতে তার সৌন্দর্য যেন আরও বেশি প্রকাশ পায়। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের নিকাব পরিধান করার বিধান কী এবং রাস্তা চলাচলের জন্য চোখের কতটুকু খোলা রাখা জায়েজ?

উত্তর:
নিম্নে দুটি পয়েন্টের উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল:

◯ ক. ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের মুখে নিকাব পরিধান করার বিধান কী?

ইসলামের দৃষ্টি মহিলাদের মুখে নিকাব পরিধান করা জায়েজ। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, হজ ও ওমরার ইহরাম অবস্থায় মহিলারা মুখে নিকাব পরিধান করবে না। যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا تَنْتَقِبْ الْمَرْأَةُ الْمُحْرِمَةُ ، وَلَا تَلْبَسْ الْقُفَّازَيْنِ
“ইহরাম কারীনী মুখে নিকাব এবং হাতে হাত মোজা পরিধান করবে না।” [সহিহ বুখারি, অধ্যায়: ২২/ হজ, পরিচ্ছেদ: ১১৫৫. মুহরিম পুরুষ ও মহিলার জন্য নিষিদ্ধ সুগন্ধি সমূহ। আয়েশা রা. বলেন, মুহরিম নারী ওয়ারস কিংবা জাফরানে রঞ্জিত কাপড় পরিধান করবে না]

উল্লেখ্য যে, এ অবস্থায় তারা নেকাব ও হাত মোজা পরিধান না করলেও মাথার ওড়না উপর থেকে ফেলে মুখমণ্ডল এবং হাতের লম্বা আস্তিন দ্বারা হাতের কব্জি দ্বয় পরপুরুষ থেকে ঢেকে রাখবে।

এ হাদিস থেকে বুঝা গেল, ইহরাম ছাড়া অন্য অবস্থায় নিকাব পরিধান করা জায়েজ।

◯ খ. নিকাব কাকে বলে এবং চোখের কী পরিমাণ খোলা রাখা জায়েজ?

● বিশিষ্ট ভাষাবিদ, ফকিহ, মুহাদ্দিস ও ইলমুর রিজাল শাস্ত্রবীদ আবু উবায়েদ আল কাসেম বিন সাল্লাম (মৃত্যু: ২২৪ হি.) আরবের নিকাবের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন,
هو الذي يبدو منه محجر العين
“(আরবি মহিলাদের) নিকাব হল, এমন জিনিস যা পরিধান করলে চোখের পাতা দ্বয় প্রকাশিত হয়।”

● ইমাম রামলি আশ শাফেয়ী বলেন,
حرم النظر إلى المنتقبة التي لا يبين منها غير عينيها ومحاجرها
“এমন নিকাব ধারী মহিলার দিকে তাকানো জায়েজ নাই যার কেবল চোখ ও চোখের পাতা দ্বয় ছাড়া আর কিছু প্রকাশিত নয়।” [নিহায়াতুল মুহতাজ ৬/১৮৮]

আর নিকাব পরিধান করা হলে, রাস্তা চলাচলের স্বার্থে দু চোখ (ভ্রূ’র নিম্নাংশ ও গালের উপরিভাগ) খোলা রাখা জায়েজ আছে। তবে শর্ত হল, ইচ্ছাকৃত ভাবে যেন চোখের ভ্রূ দ্বয় কিংবা চোখের নিচে গালের কোনও অংশ অতিরিক্ত প্রকাশ না করা হয়।

মোটকথা, নিকাব পরিধানকারী নারীর জন্য পরপুরুষদের সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে চোখের ভ্রু বা গালের কিয়দংশ প্রকাশ করা জায়েজ নয়। আর নিকাব পরিধান করার ক্ষেত্রে চোখের পাপড়ি দ্বয় আকর্ষণীয়ভাবে সাজ-সজ্জা করা থেকেও বিরত থাকা অপরিহার্য। কিন্তু নিকাবধারী নারী যদি চোখের পাপড়ি ও ভ্রূকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজসজ্জা করে বাইরে বের হয় তাহলে তা তাকে মানুষের নিকট আরও আকর্ষণীয় করে ফুটিয়ে তোলে, বিশেষ করে সুন্দরী নারীদেরকে- যা ফিতনা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এটি আল্লাহ তাআলা কর্তৃক পরপুরুষদের সামনে নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশ করার নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ ۖ
“…তারা যেন যা সাধারণত: প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নি পুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপনাঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে…।” [সূরা নূর: ৩১ নং আয়াত]
আল্লাহু আলাম।
[অধিকাংশ তথ্য নেওয়া হয়েছে islamqa থেকে]

▬▬▬✪✪✪▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

মাংস-গোশত বিতর্ক নিতান্ত অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন

 প্রশ্ন: গোস্ত/গোশত নাকি মাংস? মাংস শব্দ দ্বারা নাকি মায়ের অংশ বুঝায়? হিন্দুরা মাংস বলে তাই নাকি মুসলিমদের জন্য এই শব্দ ব্যবহার করা হারাম? এ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা জানতে চাই।

উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে বাংলা ভাষায় মাংস অথবা গোস্ত/গোশত-এ দুটি শব্দের যে কোনটি ব্যবহারে কোনও আপত্তি নাই। যারা এ বিষয়ে বিতর্ক করে তাদের ব্যাখ্যা ও যুক্তিগুলো নিতান্ত কুযুক্তি ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ছাড়া কিছু নয়।

❑ এ শব্দ দ্বয়ের আভিধানিক বিশ্লেষণ:

উৎপত্তিগতভাবে মাংস শব্দটি সংস্কৃত। অর্থ: “প্রাণীর দেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী শরীরের অংশবিশেষ।” [ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৯৬৮]
আর গোস্ত/গোশত শব্দটি ফারসি (گوشت-যা উর্দুতেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ দুটি শব্দই বাংলা ভাষায় আত্তীকরণ ঘটেছে। যার ফলে একই অর্থে উভয় শব্দই বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

❑ বিশিষ্ট বাংলা ভাষা গবেষক, এ বিষয়ে বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)-এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ আমীন গোশত, মাংস ও মাংশ শব্দ সমূহের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন:

◆ গোশত: ফারসি গোশত অর্থ জীবদেহের অভ্যন্তরে হাড়কে আবৃত করে রাখে এমন নরম কোমল পেশি বা কোষগুচ্ছ, জীবদেহের অভ্যন্তরস্থ হাড় এবং চামড়ার মধ্যবর্তী নরম ও কোমল অংশ, মাংস।
◆ মাংস: সংস্কৃত মাংস অর্থ জীবদেহের অভ্যন্তরস্থ হাড় এবং চামড়ার মধ্যবর্তী নরম ও কোমল অংশ, গোশত (কোরবানির মাংস), মাস , মানুষের আহার্য মনুষ্যেতর প্রাণীর আমিষ বা পলল। চর্যাপদেও শব্দটির বাংলা বানান মাস (মাংস); আপণা মাসে হরিণা বৈরী।
◆ মাংশ: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে মাংশ বানানের কোনো শব্দ নেই। অনেকে বলেন মাংশ মানে মায়ের অংশ, কীভাবে বলেন জানি না। শব্দটি কোথায় পেয়েছেন তাও জানি না। যাদের বাংলা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে তারা এমন বলতে পারেন না। যাই হোক, হয়তো মাংশ মানে মায়ের অংশ বলেই অভিধানে এমন শব্দ নেই। এবং কেউ (বাংলা বানান জানেন) মাংশ লেখেন না। চর্যাযুগেও ছিল না। [draminbd]

❑ হিন্দুরা মা তথা গরুর অংশ বুঝাতে ‘মাংস’ বলে-এ কথা কি ঠিক?

‘হিন্দুরা মা তথা গরুর অংশ বুঝাতে ‘মাংস’ বলে’-এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। কারণ তারা কেবল গরুর গোশতের ক্ষেত্রেই ‘মাংস’ শব্দ ব্যবহার করে না বরং ছাগল, হাস, মুরগি বা পাখির গোশতের ক্ষেত্রেও ‘মাংস’ শব্দ ব্যবহার করে কিন্তু ছাগল, হাস, মুরগি ইত্যাদি তো তাদের তাদের ‘মা’ নয়।

তাছাড়া বানান দেখুন। সঠিক বানান হল, মাংস; মাংশ নয়। বরং মাংশ শব্দটি বাংলা অভিধানে কোথাও নেই। সুতরাং ‘মাংস’ শব্দের বানান ‘মাংশ’ লেখা যেমন ভুল তেমনি ‘মায়ের (গরুর) অংশ’ ব্যাসবাক্যে সন্ধিবিচ্ছেদ করাটাও ভুল। যারা এমনটি বলে তারা নিতান্তই অজ্ঞতা বশত: বলে। সুতরাং বাংলা ব্যাকরণের দিক থেকেও এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।

মোটকথা, মাংস-গোশত বিতর্ক নিতান্ত অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন।
▬▬▬✪✪✪▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

যিহারের পরিচয়, কাফফারা এবং এ সংক্রান্ত জরুরি বিধি-বিধান

 যিহার: পরিচয়, কাফফারা এবং এ সংক্রান্ত জরুরি বিধি-বিধান

▬▬▬❂◉❂▬▬▬
ইসলামি ফিকহে যিহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। কারণ এর সাথে দাম্পত্য জীবনের হালাল-হারামের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান জড়িয়ে আছে। তাছাড়া জাহেলি যুগ থেকে চলে আসা এর অব্যবহারে ব্যাপারে ইসলামের সঠিক নির্দেশনা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

তাই নিম্নে যিহারের সংজ্ঞা, এর কাফফারা এবং এ সংক্রান্ত জরুরি কিছু বিধান সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে সহজ ভাষায় আলোচনা করা হল: وبالله التوفيق

❑ যিহার কী?

সম্মানিত ফিকাহবিদগণ যিহার এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,
تشبيه الزوج زوجته في الحرمة بمحرمه
“স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনও মাহরাম নারীর সাথে সাদৃশ্য দেওয়াকে যিহার বলা হয়।”
অথবা تشبيه المنكوحة بمن تحرم عليه “বিবাহিত স্ত্রীকে এমন মহিলার সাথে সাদৃশ্য দেওয়া যে তার জন্য হারাম।” [শারহু যাদিল মুস্তাকনি-শাইখ মুহাম্মদ মুখতার শানকিতি। শাইখ উক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন মাজহাবের আলোকে যিহারের আরও একাধিক সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন]
উদাহরণ: কোনও পুরুষ যদি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে যে, তুমি আমার জন্য হারাম যেমন আমার মা আমার জন্য হারাম বা যেমন আমার বোন আমার জন্য হারাম…বা এ জাতীয় বাক্য তাহলে এটাকে যিহার বলা হয়। এর বিভিন্ন রূপ আছে এবং সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও কিছু ভিন্নতা আছে-যেগুলো ফিকহের কিতাব সমূহে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে।

যিহার প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ
“তোমাদের মধ্যের যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ (মায়ের মত হারাম বলে ঘোষণা করে) করে- তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মা তো কেবল তারাই, যারা তাদেরকে জন্মদান করেছে। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয় আল্লাহ মার্জনা কারী, ক্ষমাশীল।” [সূরা মুজাদিলা: ২]

সাধারণত: স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বামীর পক্ষ থেকে রাগ বশত: যিহার সংঘটিত হয়। যেমন: তাফসিরে উল্লেখ করা হয় যে, খাওলা বিনত সালাবা এবং তার অতিবৃদ্ধ স্বামী আউস ইবনুস সামিত রা. এর মাঝে মনোমালিন্য হওয়ার প্রেক্ষাপটে আউস রা. ক্রোধান্বিত হয়ে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, «أنتِ عليَّ كظهرِ أمِّي» “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত।” অর্থাৎ আমার মা যেমন, আমার উপর হারাম তেমনি তুমিও আমার জন্য হারাম। জাহেলি যুগে কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে এভাবে বলতো।
যাহোক ঘটনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি তাদের মাঝে সমঝোতা করার চেষ্টা করছিলেন ইত্যবসরে তার উপর সূরা মুজাদালার জিহার সংক্রান্ত আয়াত সমূহ নাজিল হয়। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যিহারের কাফফারা প্রদানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। [তাফসিরে ইবনে কাসির-সংক্ষেপায়িত]

❑ যিহারের বিধান কী?

ইসলামে যিহার একটি অন্যায় আচরণ এবং হারাম কাজ। কেউ এমনটি করলে তার জন্য কাফফারা আদায় করা আবশ্যক। কাফফারা আদায়ের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী মিলন হারাম। জাহেলি যুগে যিহার করাকে তালাক হিসেবে গণ্য করা হতো। ফলে চিরস্থায়ী ভাবে স্ত্রী মিলন নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হত। যেমন: তাফসিরে কুরতুবিতে এসেছে,
وذلك كان طلاق الرجل امرأته في الجاهلية
“জাহিলি যুগে এটাই স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাক ছিলো।” কিন্তু ইসলাম তা স্থায়ী হারামের পরিবর্তে অস্থায়ী হারামে রূপান্তরিত করেছে। অর্থাৎ কোনও স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যিহার করলে কাফফারা প্রদান করলে তা হালাল হয়ে যাবে।

❑ যিহারের কাফফারা কী?

যিহারের কাফফারা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِن نِّسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِّن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۚ ذَٰلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ -‏ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۖ فَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ۚ ذَٰلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ۚ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ
“যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে ফেলে, অতঃপর তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে, তাদের কাফফারা হল, একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাসকে মুক্তি দিবে। এটা তোমাদের জন্যে উপদেশ হবে। আল্লাহ খবর রাখেন তোমরা যা কর। যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা রাখবে। যে এতেও অক্ষম হয় সে ষাট জন মিসকিনকে আহার করাবে। এটা এজন্যে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি।” [সূরা মুজাদিলা: ৩ ও ৪]
অর্থাৎ যিহারের কাফফারা রমজান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসের কাফফারার অনুরূপ। তা হল:

● ১. একটি মুমিন দাস মুক্ত করা। কিন্তু বর্তমান যুগে দাস-দাসী প্রথা প্রচলিত না থাকার কারণে তা প্রযোজ্য নয়।
● ২. এটি সম্ভব না হলে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা থাকা। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের হায়েজ বা নেফাস শুরু হলে সে দিনগুলোতে রোজা থেকে বিরত থাকবে। অনুরূপভাবে ঈদ উপলক্ষে রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলোতে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। অত:পর হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হলে এবং ঈদে রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলো অতিবাহিত হলে যথারীতি রোজা রাখা শুরু করবে।
● ৩. তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন মিসকিন (দরিদ্র-অসহায় মানুষ) কে এক বেলা খাবার খাওয়ানো অথবা খাদ্য দ্রব্য দান করা। খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ, প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য (যেমন: আমাদের দেশে চাল) থেকে প্রায় সোয়া কেজি। এর সমপরিমাণ টাকা দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ কুরআনে খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এর ব্যতিক্রম করা বৈধ নয়।

❑ স্ত্রীর পক্ষ থেকে কি স্বামীর সাথে যিহার হয়?

পূর্বোক্ত আয়াতের আলোকে অধিকাংশ আলেম বলেন, যিহার কেবল স্বামীর পক্ষ থেকে হয়; স্ত্রীর পক্ষ থেকে নয়। কারণ আল্লাহ উক্ত আয়াতে কেবল স্বামীদের কথাই উল্লেখ করেছেন।
অত:এব কোনও স্ত্রী যদি তার স্বামীকে এভাবে বলে যে, “তুমি আমার জন্য হারাম যেমন আমার জন্য আমার পিতা হারাম অথবা যেমন আমার ভাই আমার জন্য হারাম” তাহলে অধিক বিশুদ্ধ মতে তা ‘যিহার’ বলে গণ্য হবে না। বরং তা হালালকে হারাম করার অন্তর্ভুক্ত। এটিও হারাম ও গুনাহের কাজ।
এটি কসম হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তার করণীয় হল, কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা।

শাইখ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, কোন হতভাগা স্বামী স্ত্রীকে ‘তুই আমার মা বা মায়ের মত’ বললে ‘যিহার’ হয়। কিন্তু যদি কোন হতভাগী স্ত্রী ‘তুমি আমার পিতা বা পিতার মত’ বলে। তাহলে তার বিধান কি?
তিনি উত্তরে বলেন, “এ ক্ষেত্রে মহিলার পক্ষ থেকে যিহার হবে না। কেবল মহিলাকে কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে।” [দ্বীনী প্রশ্নোত্তর, বিবাহ ও দাম্পত্য- শাইখ আবদুল হামীদ ফাইযী]
শাইখ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. ও অনুরূপ কথা বলেছেন।

❂ কসম ভঙ্গের কাফফারা:

● দশজন মিসকিনকে মধ্যম ধরণের খাবার খাওয়ানো। (টাকা দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়)
● অথবা ১০ জন মিসকিন (দরিদ্র-অসহায় মানুষকে) পোশাক দেয়া।
● অথবা একটি দাস মুক্ত করা।
● এ তিনটির কোনটি সম্ভব না হলে (লাগাতার) তিনটি রোজা রাখা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّـهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَـٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ الْأَيْمَانَ ۖ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ ۖ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ۚ ذَٰلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ ۚ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; কিন্তু পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্যে যা তোমরা মজবুত করে বাঁধ। অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; মধ্যম শ্রেণির খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা, তাদেরকে বস্তু প্রদান করবে অথবা, একজন ক্রীতদাস কিংবা দাসী মুক্ত করে দিবে। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না, সে তিন দিন রোজা রাখবে। এটা কাফফরা তোমাদের শপথের, যখন শপথ করবে। তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” [সূরা মায়িদা: ৮৯]

সুতরাং কেউ যদি আর্থিক সংকটের কারণে উপরোক্ত তিনটি জিনিসের কোনটি দ্বারা কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে লাগাতার তিনটি রোজা রাখবে।

❑ কোনও স্বামী যদি সাধারণভাবে তার স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম ঘোষণা করে তাহলে তার বিধান কী?

কোনও স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তার কোনও মাহরাম নারীর সাথে সাদৃশ্য না দিয়ে সাধারণভাবে হারাম ঘোষণা করে। যেমন: সে বলল, “তুমি আমার জন্য হারাম।” অথবা স্ত্রীকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বলল, তুমি যদি এ কাজ করো তাহলে তুমি আমার জন্য হারাম বা এ জাতীয় বাক্য তাহলে তা যিহার বলে গণ্য হবে না।

এটিও ইসলামে হারাম। কারণ তা আল্লাহর হালাল কৃত বিধানকে হারাম করার শামিল। এটিও কসম হিসেবে গণ্য হবে এবং এ ক্ষেত্রেও কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ
“হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যাহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক।” [সূরা তাহরিম: ১ ও ২]

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে ইবনে আব্বাস রা. বলেন,

إِذَا حَرَّمَ الرَّجُلُ عَلَيْهِ امْرَأَتَهُ فَهِيَ يَمِينٌ يُكَفِّرُهَا
“যদি কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে তার জন্য হারাম করে দেয় তাহলে তা হল, একটি কসম। যার জন্য কাফফারা আদায় করবে।” [বুখারি হা/৪৯১১ ও মুসলিম, হা/১৪৭৩]
উল্লেখ্য যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হালাল কৃত কোনও খাবার, পানীয়, পোশাক বা অন্য যে কোনও কিছুকে নিজের জন্য হারাম বলে ঘোষণা দেয় তাহলে তার উপর একই বিধান বর্তাবে। অর্থাৎ তার জন্য কসম ভঙ্গের কাফফারারা আদায় করা আবশ্যক।

তবে কেউ যদি উক্ত বাক্য বলার মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নিয়ত করে তাহলে তালাক বলে গণ্য হবে। কারণ “নিয়তের উপর সকল কর্ম নির্ভরশীল।” [সহিহ বুখারি]

❑ কোনও ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে বা কোনও স্ত্রী তার স্বামীকে তার কোনও মাহরামের সাথে বা তার বিশেষ কোনও অঙ্গের সাথে তুলনা করে তাহলে তার বিধান কী?

কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর শারীরিক গঠন, সৌন্দর্য বা গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে বলে যে, তোমার চোখ দেখতে আমার মায়ের মতো, তোমার চেহারা আমার বোনের মত ইত্যাদি অথবা কোন মহিলা তার স্বামীকে বলে, তোমার দেহের গঠন আমার ভাই বা পিতার মত তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। অনুরূপভাবে সম্মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে বা বৈশিষ্টগত ভাবে তুমি আমার মা/বাবার অনুরূপ তাহলেও তা যিহারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ হারাম করার নিয়ত না থাকলে যিহার বলে গণ্য হবে না। [আল মুগনি-ইবনে কুদামা]
قال ابن قدامة: وإن نوى به الكرامة والتوقير، أو أنها مثلها في الكبر، أو الصفة، فليس بظهار, والقول قوله في نيته.
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করে সে আলোকে জীবন যাপনের তওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬❂◉❂▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় নির্জনতা অবলম্বনের গুরুত্ব এবং অদূর ভবিষ্যতে ছাগল হবে মুসলিমের উত্তম সম্পদ এ হাদিসের ব্যাখ্যা

 প্রশ্ন: একটি হাদিসে এসেছে, “অদূর ভবিষ্যতে ছাগল হবে মুসলিমের উত্তম সম্পদ।” এই হাদিসটিতে কী বুঝানো হয়েছে?

উত্তর:
এটি ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় লোকালয় থেকে দূরে কোথাও নির্জনতা অবলম্বন করা প্রসঙ্গে হাদিস। এ বিষয়ে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

◉ আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে,
يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ، يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنَ الْفِتَنِ
“অদূর ভবিষ্যতে ছাগল হবে মুসলিমের উত্তম সম্পদ। সে ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে নিজের দীন রক্ষার্থে তা নিয়ে পর্বতের চূড়া অথবা উপত্যকায় পলায়ন করবে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ২/ ঈমান, পরিচ্ছেদ: ১২/ ফিতনা থেকে পলায়ন দ্বীনের অংশ]

◈ শাইখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ. বলেন, “ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে নিজের দীন রক্ষার্থে তা নিয়ে পর্বতের চূড়া অথবা উপত্যকায় পলায়ন করবে।” এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন, “ঈমানদার ব্যক্তি যখন গ্রাম ও শহরগুলোতে নিজের দীনের ব্যাপারে ভয় করবে তখন ফিতনা থেকে বাঁচতে তার ছাগল নিয়ে পাহাড়ের চূড়া এবং বৃষ্টির স্থান (উপত্যকা, মরুভূমি, সমতল ভূমি, বাগ-বাগিচা ইত্যাদি) স্থানে চলে যাবে।”

◈ তিনি আরও বলেন, “এমনটি ঘটেছে। যখন আলি রা. ও মুয়াবিয়া রা. এবং তৎপরবর্তী সময় বিভিন্ন ফিতনা-ফ্যাসাদ সংঘটিত হয়েছিল তখন কিছু মানুষ এ সব ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে দূরে সরে নির্জন স্থানে চলে গিয়েছিল।” [alathar]

◉ ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় নির্জনতা অবলম্বন প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস:

সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন,
رَجُلٌ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِمَالِهِ وَنَفْسِهِ
“সে মুমিন যে তার জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে।”
সে ব্যক্তি বলল, তারপর কে?
তিনি বললেন,
‏ مُؤْمِنٌ فِي شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَعْبُدُ اللَّهَ رَبَّهُ وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ
“যে মুমিন কোন পাহাড়ি উপত্যকায় নির্জনে বসে তার প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং স্বীয় অনিষ্ট থেকে লোকজনকে রক্ষা করে।” [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ৩৪। প্রশাসন ও নেতৃত্ব, পরিচ্ছেদ: ৩৪. জিহাদ ও রিবাত (শত্রুর মুকাবিলায় বিনিদ্র প্রহরা) এর ফজিলত]

❑ ব্যখ্যা:

◍ ইমাম নওবী এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,
وَلَيْسَ الْمُرَاد نَفْس الشِّعْب خُصُوصًا ; بَلْ الْمُرَاد الانْفِرَاد وَالاعْتِزَال , وَذَكَرَ الشِّعْب مِثَالا لأَنَّهُ خَالٍ عَنْ النَّاس غَالِبًا اهـ
“এখানে ‘পাহাড়ি উপত্যকা’ দ্বারা নির্দিষ্টভাবে তা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হল, একাকীত্ব ও নির্জনতা অবলম্বন। পাহাড়ি উপত্যকা উল্লেখ করেছেন উদাহরণ হিসেবে। কারণ তা সাধারণত: জন মানবহীন হয়ে থাকে।” [শারহু সহিহ মুসলিম, ১৩/৩৪]

◍ ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,
وَالْخَبَر دَالّ عَلَى فَضِيلَة الْعُزْلَة لِمَنْ خَافَ عَلَى دِينه
“এ হাদিস প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তি তার দীনের বিষয়ে ফিতনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা করে তার জন্য নির্জনতা অবলম্বন করা উত্তম।” [ফাতহুল বারী ১৩/৪২]

◍ সিন্দি বলেন,
فِيهِ أَنَّهُ يَجُوز الْعُزْلَة بَلْ هِيَ أَفْضلُ أَيَّام الْفِتَن
“ফিতনার সময় নির্জনতা অবলম্বন করা শুধু জায়েজ নয় বরং উত্তম।” [হাশিয়ায়ে নাসাঈ, ৮/১২৪]

❑ কেমন ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় নির্জনতা অবলম্বন করা উচিৎ এবং কখন উচিৎ নয়?

জুমহুর আলেমদের মতে, চতুর্দিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ফিতনা-ফ্যাসাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে পরিস্থিতি যদি এমন জটিল আকার ধারণ করে যে, মানুষের জন্য হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে অপারগ হওয়ার কারণে দীনের উপর টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যায় তখন সব কিছু ছেড়ে নির্জনে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এভাবে সে ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে এবং দীনকে হেফাজত করতে পারবে।

কিন্তু পরিস্থিতি যদি এতটা জটিল না হয় বরং সমাজে দীনের জ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা থাকে, মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে, মসজিদে মসজিদে জুমা ও জামাতে সালাত প্রতিষ্ঠিত হয়, ঈদের সালাত কায়েম হয়, মাদরাসা-মসজিদগুলো আবাদ থাকে, দাওয়াতি কার্যক্রম চালু থাকে, মানুষ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার সুযোগ পায়, সমাজে পাপাচার থাকলেও চেষ্টা করলে অনেক পাপ থেকে বাঁচা সম্ভব হয় তাহলে এমন পরিস্থিতিতে সমাজে বসবাস করা উত্তম। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

‏ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا كَانَ مُخَالِطًا النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنَ الْمُسْلِمِ الَّذِي لاَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَلاَ يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ

“মুসলিমদের মাঝে যে ব্যক্তি লোকজনের সাথে মেশে না এবং তাদের পক্ষ থেকে কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করে না তার চেয়ে উত্তম হল ঐ ব্যক্তি, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং তাদের কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করে।” [সহীহ, ইবনে মাজাহ ৪০৩২, তিরমিজী, হা/ ২৫০]

এর ফলে সমাজে দীনের দাওয়াত অব্যাহত রাখা, মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানো, সমাজ থেকে অন্যায় দুরীকরণে অবদান রাখা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ, অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, ঈমানদারের মৃত্যুতে তার জানাজায় অংশ গ্রহণ, রোগীর সেবা-শুশ্রূষা, ঈদ, জুমা ও জামাতে সালাত প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে অবারিত সওয়াব লাভ করা সম্ভব হবে।

ইমাম নওবি রাহ. বলেন, “নবীগণ এবং অধিকাংশ সাহাবি, তাবেঈ, আলেম এবং যাহেদগণ মানুষের সাথে মিশতেন।” [শরহে মুসলিম]

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরণের ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা করুন এবং আমরণ ইসলামের উপর টিকে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের খেলাধুলা এবং খেলাধুলার ক্ষেত্রে ইসলামি মূলনীতি

 প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলারা কি খেলাধুলা করতে পারবে? খেলাধুলার ক্ষেত্রে ইসলামি মূলনীতি কী?

উত্তর:
শারীরিক সুস্থতা, মানসিক বিকাশ, হালাল বিনোদন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে শরীরচর্চা করা এবং কিছু খেলাধুলা উপকারী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাধুলার ফলে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সচল থাকে এবং শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফলে আল্লাহর রহমতে সবল দেহ, সচল মন এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয়। এতে মানসিক দিক থেকেও উপকৃত হওয়া যায়।
বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শহুরে জীবনে নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা অধিকাংশই খেলাধুলা বলতে বোঝে অনলাইন ভিডিও গেম বা মোবাইল গেইম অথচ এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে যেমন ক্ষতিকর তেমনই মানসিক বিকাশের পথেও বড় বাধা।
সুতরাং শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষ সকলের জন্য কিছু শরীর চর্চা করা ও হালাল খেলাধুলা করা নাজায়েজ নয়।

তবে এ ক্ষেত্রে কতিপয় ইসলামি মূলনীতি মেনে চলা আবশ্যক। যেমন:

১. খেলাধুলা অবশ্যই হালাল হতে হবে। যেমন: হাঁটা বা দৌড়, সাঁতার কাটা, ঘোড় দৌড়, বিভিন্ন ধরণের শারীরিক কসরত ইত্যাদি।
২. খেলাধুলার পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করা। কারণ একজন ইমানদার ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. খেলাধুলার কারণে নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন না করা।
৪. খেলাধুলায় সীমাতিরিক্ত মত্ত না থাকা-যার কারণে স্বামী-সন্তান, পরিবার ও পেশাগত দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়।
৫. খেলাধুলায় এত সময় ব্যয় না করা যার ফলে চাকুরী বা জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
৬. এমন পোশাক পরিধান করা জায়েজ নাই যার কারণে পর্দা লঙ্ঘিত হয় বা শরীরের গোপন অঙ্গ ও লজ্জা স্থানগুলো অন্যের সামনে দৃশ্যমান হয়।
৭. শরীর চর্চা বা খেলাধুলার ক্ষেত্রে মিউজিক ব্যবহার করা জায়েজ নাই।
৮. খেলাধুলায় বাজি বা জুয়া না থাকা।
৯. খেলাধুলাকে অর্থ উপার্জন এবং জীবিকার পেশা হিসেবে গ্রহণ না করা।
১০. মার্শাল আর্ট তথা জুডো, কারাতে, কুংফু ইত্যাদিতে প্রশিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনার্থে মাথা বা শরীর ঝুঁকিয়ে বাউ (Bow) না করা।
উপরোক্ত শর্তাবলীর পাশাপাশি মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শর্ত হল,
১১. অবশ্যই তা সম্পূর্ণ ফিতনা-ফ্যাসাদ মুক্ত নিরাপদ পরিবেশে হতে হবে।
১২. পরপুরুষের সহবস্থান মুক্ত পর্দাবৃত স্থানে হতে হবে।
১৩. নির্জনে নন মাহরাম ব্যক্তির নিকটে অবস্থান করা যাবে না ইত্যাদি।

❂ মহিলাদের খেলাধুলার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বিশ্বনন্দিত ফকিহ, দাঈ ও আলেম শাইখ বিন বায রাহ. বলেন,
“পবিত্র শরীয়ত লঙ্ঘন করে না এমন ক্ষেত্রে মহিলাদের খেলাধুলায় কোনও ক্ষতি নেই। যেমন: তারা এমন সংরক্ষিত স্থানে অধিক পরিমাণে হাঁটবে যেখানে পরপুরুষরা মহিলাদের সাথে মেশে না এবং পরপুরুষরা তা দেখতে পায় না। অথবা বাড়িতে মহিলাদের মাঝে বা মহিলাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে সাঁতার কাটবে-যেখানে তাদেরকে পরপুরুষরা দেখে না এবং সেখানে পরপুরুষদের কোনও সংযোগ নাই।
তিনি আরও বলেন, যে সব খেলাধুলা নারীদের জন্য নির্ধারিত এবং যাতে ইসলাম নিষিদ্ধ কোনও কিছু নেই, নারী-পুরুষ সহবস্থান নেই বরং নারী-পুরুষ সংশ্রব মুক্ত ও পর্দাবৃত স্থানে খেলাধুলায় কোন দোষ নেই- চাই তা হাঁটা, সাঁতার কাটা বা এ জাতীয় খেলাধুলা যাই হোক না কেন। অনুরূপভাবে (এ সকল শর্ত সাপেক্ষে) তাদের মধ্যে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা করাও দূষণীয় নয়।” [শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◈◯◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

নাশিদ তথা ইসলামি সঙ্গীত, গান-গজল ইত্যাদি চর্চা, পরিবেশন ও শ্রবণ করার বিধান

 নাশিদ তথা ইসলামি সঙ্গীত, গান-গজল ইত্যাদি চর্চা, পরিবেশন ও শ্রবণ করার বিধান: এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের অভিমত

▬▬▬▬◈♫◈▬▬▬▬
বর্তমান সময়ে নাশিদ বা ইসলামি সংগীত, ইসলামি গান, গজল ইত্যাদি যেন এক শ্রেণীর ইসলামপন্থী যুবকদের মন-মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে। এগুলোর পেছনে তারা নেশার মত বুদ হয়ে থাকে। কথিত ইসলামি সঙ্গীত ও গান ছাড়া যেন তাদের জীবন শুষ্ক মরুভূমি। এই সুযোগে এটিকে রীতিমত একটি শিল্প বা প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করার হিড়িক পরিলক্ষিত হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে নানা শিল্পীগোষ্ঠী। বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠান এমন কি ওয়াজ মাহফিল গুলোতেও আনা হচ্ছে ভাড়া করা কথিত নাশিদ শিল্পী। বর্তমানে নাশিদ এর ব্যান্ড দলের মাধ্যমে কনসার্ট পরিবেশিত হচ্ছে! ইউটিউবে এইসব গান-গজলের ভিউ সংখ্যা অকল্পনীয়।

‌ যাহোক, এ পর্যায়ে এই সব নাশিদ বা ইসলামি সংগীত বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

প্রথমত বলব, একজন সচেতন ও কর্তব্য পরায়ন সচেতন মুমিনের জন্য এইসব কথিত সংগীত গজল ও নাশিদ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। কারণ এগুলো মূলত শিয়া, বিদআতি ও সুফিদের মাধ্যমে উৎপত্তি হয়েছে এবং কাল পরিক্রমায় বর্তমান যুগে এই আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ইসলামের প্রথম যুগে এগুলোর কোনও অস্তিত্ব ছিল না।

এগুলো শোনার নানা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন:

কুরআন তেলাওয়াত বা শোনার প্রতি অন্তরে গাফিলতি বা অমনোযোগিতা সৃষ্টি হওয়া, দুআ এবং জিকির-আজকার পাঠে অলসতা সৃষ্টি হওয়া, দীনের ইলম চর্চায় অবহেলা করা ইত্যাদি।

এসব কথিত নাশিদ বা ইসলামি সংগীত চর্চা করা ও পরিবেশনার জন্য শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করা বা এ কাজকে প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করা এবং শোনার প্রতি নেশা সৃষ্টি হওয়া গর্হিত কাজ। বিশেষ করে যেগুলোতে নারী কণ্ঠ, বিভিন্ন মিউজিক্যাল বা সিনেমার গানের সুর নকল, শিরক-বিদআত, অতিরঞ্জন ও শরিয়তে বিকৃতি মূলক কথাবার্তা হয়েছে। সেই সাথে যদি তাতে বাদ্যযন্ত্রের সংযোগ ঘটে তাহলে তা হারাম হওয়ার দিকটি আরও জটিল হবে-তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বাস্তবতা হচ্ছে, এ নাশিদ শিল্পীদের মন-মস্তিষ্কে সার্বক্ষণিক সঙ্গীত, নাশিদ, গান, সূর, তাল, লয়, ভোকাল, গায়কি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঘুরপাক খায়। তাদের চিন্তা জগতে যে বিষয়টা কাজ করে তা হলো, কিভাবে নাশিদ বা সঙ্গীত পরিবেশ করে মানুষের চিত্ত রঞ্জন করা যায়, গলার সুর দ্বারা কিভাবে শ্রোতা-দর্শককে মুগ্ধ করা যায়, কিভাবে আরও বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করা যায়, কিভাবে প্রশংসা ও বাহবা কুড়ানো যায়, কিভাবে আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় ইত্যাদি।

আর যারা নাশিদের সুরকার বা সুর ডিজাইনার তারা সাধারণত: সুর সৃষ্টির জন্য হারমোনিয়াম, সারেগামা এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে। অন্যথায় আকর্ষণীয় সুর সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

❑ নাশিদ শোনার ব্যাপারে ইসলামি স্কলারদের অভিমত:

এসব নাশিদ বা ইসলামি গান-গজল শোনা যাবে কি না সে ব্যাপারে আলেমদের মাঝে দু ধরণের অভিমত পাওয়া যায়। কতিপয় আলেম কিছু শর্ত সাপেক্ষে সেগুলো শোনা যাবে বলে মতামত দিয়েছে। যেমন: যেসব সঙ্গীত বা নাশিদে চরিত্র গঠন, ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান, মানব কল্যাণে উদ্দীপনা সৃষ্টি, তাওহিদ ও সন্নাহর দিকে আহ্বান, শিরক বিদআত ও অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধাচরণ, অন্যায়ের প্রতিবাদ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিকারী বা শিক্ষা মূলক ইসলামি কথাবার্তা আছে। এগুলো যদি মিউজিক, দফ বা হারাম বিষয়াদি থেকে মুক্ত হয় তাহলে তা সীমিত পরিসরে কখনো শুনলে গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ। তবে তাদের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট যে, এগুলো শোনা পছন্দনীয় কাজ নয়।
পক্ষান্তরে কোনও কোনও আলেম, এগুলোকে বিদআতি ও হিজবীদের আলামত হিসেবে উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন।

অবশ্য কবিতা আবৃত্তি করা বা শোনা শরিয়তে অনুমোদিত। কবিতা ও নাশিদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

নাশিদ বা ইসলামি সঙ্গীত বিষয়ে আধুনিক বিশ্বের কয়েকজন ইসলামি স্কলারের মতামত তুলে ধরা হল:

◯ ১. যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানি রাহ. বলেন,
إذا كانت هذه الأناشيد ذات معانٍ إسلامية ، و ليس معها شيء من المعازف و آلات الطرب كالدفوف و الطبول و نحوِها ، فهذا أمرٌ لا بأس به ، و لكن لابد من بيان شرطٍ مهم لجوازها ، وهو أن تكون خالية من المخالفات الشرعية ؛ كالغلوّ ، و نَحوِه ، ثم شرط آخر ، و هو عدم اتخاذها دَيدَناً ، إذ ذلك يصرِفُ سامعيها عن قراءة القرآن الذي وَرَدَ الحضُّ عليه في السُنَّة النبوية المطهرة ، و كذلك يصرِفُهُم عن طلب العلم النافع ، و الدعوة إلى الله سبحانه ) [العدد الثاني من مجلة الأصالة ، الصادر بتاريخ 15 جمادى الآخرة 1413هـ ]
“যদি এই নাশিদগুলো ইসলামিক অর্থবোধক হয় এবং তাতে কোনও মিউজিক ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার-যেমন: দফ, তবলা/ড্রাম ইত্যাদি না থাকে তাহলে এতে সমস্যা নেই। তবে তা জায়েজ হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত অবশ্যই স্পষ্ট করা উচিত। তা হল, শরিয়ত বিরোধী বিষয়াদি থেকে মুক্ত হওয়া। যেমন: অতিরঞ্জন মূলক কথাবার্তা ইত্যাদি।
আরও আরেকটি শর্ত হল, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা যাবে না। কারণ শ্রোতাদেরকে এগুলো কুরআন তেলাওয়াত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় অথচ কুরআন শোনাার প্রতি সুন্নতে নববীতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে তা তাদেরকে উপকারী জ্ঞান অন্বেষণ এবং আল্লাহর পথে দাওয়াত থেকেও দূরে সরিয়ে দেয়।” [আল আসালা ম্যাগাজিন, সংখ্যা ২, তারিখ: ১৫/৬/১৪১৩]

◯ ২. সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ও বিশ্বনন্দিত ফকিহ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,
الأناشيد الإسلامية تختلف فإذا كانت سليمة ليس فيها إلا الدعوة إلى الخير والتذكير بالخير وطاعة الله ورسوله والدعوة إلى حماية الأوطان من كيد الأعداء والاستعداد للأعداء ونحو ذلك فليس فيها شيء ، أما إذا كانت فيها غير ذلك من دعوة إلى المعاصي واختلاط النساء بالرجال أو تكشف عندهم أو أي فساد فلا يجوز استماعها ) اهـ “مجموع فتاوى ومقالات متنوعة” (3/437) .
“ইসলামি নাশিদ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যদি সেগুলো দোষমুক্ত হয়- যেগুলোতে কল্যাণের পথে আহ্বান, ভালো কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য, শত্রুদের চক্রান্ত থেকে দেশ রক্ষা ও শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতি উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছু না থাকে তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি তাতে এসব ছাড়া পাপাচারের দিকে আহ্বান, নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা, পর্দা হীনতা অথবা কোনও ধরণের খারাপ বিষয় থাকে তাহলে সেগুলো শোনা জায়েজ নাই।” [মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত মুতানাওয়িয়াহ (ফতোয়া ও বিবিধ প্রবন্ধ সমগ্র) ৩/৪৩৭]

◯ ৩. বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. বলেন,
ولا يمكن للإنسان أن يفتي بإنها جائزة على كل حال و لا بإنها ممنوعة على كل حال ، لكن إن خلت من الأمور التي أشرت إليها فهي جائزة ، أما إذا كانت مصحوبة بدُفٍ ، أو كانت مختاراً لها ذوو الأصوات الجميلة التي تَفتِن ، أو أُدِّيَت على نغمات الأغاني الهابطة ، فإنّه لايجوز الاستماع إليها

“কারও পক্ষে ফতোয়া দেওয়া সম্ভব নয় যে, এটি সর্বাবস্থায় জায়েজ অথবা সর্বাবস্থায় হারাম। তবে আমি যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি (দফ ব্যবহার, ফিতনা সৃষ্টি করে, ফিতনা সৃষ্টিকারী সুন্দর কণ্ঠস্বর, হারাম গানের সূর ইত্যাদি) যদি সেগুলো থেকে মুক্ত হয় তাহলে তা জায়েজ। কিন্তু যদি তাতে দফ বাজানো হয়, ফিতনা সৃষ্টিকারী সুন্দর কণ্ঠ নির্বাচন করা হয় অথবা নিকৃষ্ট গানের সূরে পরিবেশন করা হয় তাহলে সেগুলো শ্রবণ করা জায়েজ নাই।”
[আস সাহওয়াহতুল ইসলামিয়াহ (ইসলামিক জাগরণ), ১৬৮ পৃষ্ঠা]

◯ ৪. অপরপক্ষে বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ এবং সৌদি আরবের সিনিয়র স্কলার্স বোর্ডের সদস্য শাইখ ফাওযান (হাফিজাহুল্লাহ) নাশিদের ব্যাপারে বলেন,
ما في الإسلام أناشيد, هذا اسم مُحدَث, والأناشيد الغالب عليها إما أن تكون للصوفية لأنهم يتعبدون بالأناشيد وإما أن تكون للحزبيين الذين لهم مناهج خاصة ويشجعون أتباعهم بهذه الأناشيد على متابعتهم, فهي شعار إما للصوفية وإما للحزبيين
“ইসলামে নাশিদ বলে কিছু নেই। এটি একটি বিদআতি নাম। প্রধানত নাশিদ সুফিদের। কারণ তারা নাশিদ দ্বারা ইবাদত করে অথবা হিজবিদের (দল পন্থীদের)- যাদের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। তারা এ নাশিদগুলোর মাধ্যমে তাদের অনুসারীদেরকে তাদের অনুসরণ করতে উত্সাহিত করে।
সুতরাং তা হয় সুফিদের অথবা হিজবিদের আলামত।” [ar.alnahj-শাইখের ভয়েস রেকর্ড থেকে অনুদিত]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◈♫◈▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

সালাফে সালেহিন কাদের বলা হয় এবং সালাফি কারা?

 প্রশ্ন: ‘সালাফে সালেহিন’ কাদের বলা হয় এবং সালাফি কারা?

উত্তর:
‘সালাফে সালেহিন’ অর্থ: পুণ্যবান পূর্বসূরি। আর সালাফে সালেহিন বা সালাফ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর ঐ সকল পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গ যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ’ হিসেবে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। যেমন: বুখারি ও মুসলিম সহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে মুতাওয়াতির সূত্রে একদল সাহাবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ، ثُمَّ الَّذيِنَ يَلُونَهُمْ ، ثُمَّ الَّذيِنَ يَلُونَهُمْ
“সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হল, আমার যুগের মানুষ অত:পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ অত:পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ।” [বুখারি ও মুসলিম]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইমরান ইবনে হুসাইন রা. সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
خَيْرُ أُمَّتِي الْقَرْنُ الَّذِينَ بُعِثْتُ فِيهِمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، وَاللَّهُ أَعْلَمُ أَذَكَرَ الثَّالِثَ أَمْ لَا، ثُمَّ يَظْهَرُ قَوْمٌ يَشْهَدُونَ، وَلَا يُسْتَشْهَدُونَ، وَيَنْذِرُونَ، وَلَا يُوفُونَ، وَيَخُونُونَ، وَلَا يُؤْتَمَنُونَ، وَيَفْشُو فِيهِمُ السِّمَنُ
“আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম হল তারা যাদের মধ্যে আমি প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর যারা তাদের সঙ্গে সংলগ্ন। আল্লাহই ভালো জানেন যে, তিনি তৃতীয় স্তরটি উল্লেখ করেছেন কি না। তারপর এমন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা সাক্ষী হিসেবে তাদেরকে না ডাকা হলেও সাক্ষ্য দিবে। তারা মান্নত করে তা পূর্ণ করবে না, তারা খিয়ানত করবে; আমানত রক্ষা করবে না। আর তাদের মধ্যে মেদ-ভুঁড়ি প্রকাশ পাবে।” [সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: ৩৫/ সুন্নাহ, পরিচ্ছেদ: ১০. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবিগণের মর্যাদা]

এই তিন যুগের পূণ্যবান মানুষদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ’ হিসেবে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। ‌আর সালাফিগণ এই পূর্বসূরিদের সাথে সম্পৃক্ত।

➤ শাইখ আলাবানি রাহ. বলেন,

“মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে বিভিন্ন জামায়াত বা দলের মত সালাফি আন্দোলন কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত নয়। বরং এই সম্পৃক্ততা হল, পবিত্র ও নিষ্কলুষ একটি আদর্শের সাথে। কারণ পূর্বসূরিগণ সম্মিলিতভাবে গোমরাহির উপর থাকবেন-এটা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে পরবর্তী যুগের মানুষের ব্যাপারে শরিয়তে প্রশংসা বর্ণিত হয় নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিন্দাবাদ বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি পূর্বোক্ত হাদিসের শেষাংশে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইঙ্গিত করে বলেছেন,

ثُمَّ يأتي مِن بعدِهِم أقوامٌ يَشْهَدُون ولا يُسْتَشْهَدُون إلى آخر الحديث

“এরপর তাদের পরে এমন সব মানুষের আবির্ভাব ঘটবে যারা সাক্ষ্য দিবে কিন্তু তাদের নিকট সাক্ষ্য চাওয়া হবে না…।”
তিনি অন্য আরেক হাদিসেও এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। উক্ত হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, তিনি সেখানে মুসলিমদের একটি দলের প্রশংসা এবং ‘অধিকাংশ’ লোকের নিন্দা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ ِ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ أَوْ حَتّى تَقُوْمَ السَّاعَة

“আমার উম্মতের একটি দল সত্যের উপর বিজয়ী থাকবে। বিরোধিতা কারীরা আল্লাহর হুকুম আসা পর্যন্ত তথা কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” এই হাদিসে শেষ জামানার একটি দলের বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে। আরবি طَائِفَةٌ শব্দের মানে হল, একটি ছোট জামায়াত বা দল। আভিধানিক অর্থে এক বা একাধিক ব্যক্তি বুঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

অত:এব যখন আমরা সালাফিয়াতের অর্থ জানলাম, আরও জানলাম যে সালাফিগণ পূর্বসূরিদের সাথে সম্পৃক্ত এবং কোন মুসলিম যদি এই পূর্বসূরিদের আদর্শকে গ্রহণ করে তবে সেটাই সব চেয়ে নিরাপদ তখন কোন ব্যক্তি সালাফি ছাড়া অন্য অন্য কিছু হতে পারে না; সম্ভব নয়। কারণ, সালাফিয়াতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অর্থ হল এক নিরাপদ, নিষ্কলুষ এবং পবিত্র নীতি ও আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া।”

[সালাফি মতাদর্শ কী? আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আলবানি রহ.]

সালাফি আকিদার ভিত্তি হল, সাহাবি, তাবেয়ি ও তাদের একনিষ্ঠ অনুসারী পূর্ববর্তী আহলে ইলমদের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা এবং এই দুটো জিনিসকে আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি, আচার-আচরণ, খাদ্য-পোশাক, নীতি-নৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্য সকল মানুষের মতামত, ফতোয়া, চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া। সেই সাথে শিরক, বিদআত, অন্ধ অনুকরণ এবং সকল প্রকার অপসংস্কৃতি মূলোৎপাটনে কাজ করা।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate