Tuesday, April 2, 2024

সহজ উমরা নির্দেশিকা

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

উমরা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা আত্মিক, মৌখিক, দৈহিক ও আর্থিক ত্যাগ সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর উহা পালন করা অবশ্যকর্তব্য।

◈ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العُمرةُ إلى العُمرةِ كفَّارةُ ما بَيْنَهما
“এক উমরা থেকে অপর উমরা উভয়ের মধ্যবর্তী পাপের কাফফারা স্বরূপ।” [বুখারি ও মুসলিম]

◈ তিনি আরও বলেন,
من أَتَى هذا البيتَ فلم يَرفُثْ ، ولم يَفسُقْ رَجَع كما ولَدَتْه أمُّه
“যে ব্যক্তি (হজ-উমরা করার জন্য) এ ঘরে আসবে। অতপর স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হবে না এবং পাপাচারে লিপ্ত হবে না, সে এমন (নিষ্পাপ) অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে যেমন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল। (অর্থাৎ সে নবজাতক শিশুর মত পবিত্র ও নিষ্পাপ হয়ে যাবে)” [মুসলিম] অবশ্য মানুষের হক নষ্ট করে থাকলে তা আদায় করা পর্যন্ত তওবা দ্বারা তার গুনাহ মোনচ করা হবে না।

এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি বিশুদ্ধভাবে আদায়ের চেষ্টা করা একান্ত ভাবে অপরিহার্য।

❑ এ লক্ষ্যে নিন্ম লিখিত সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলো সকলের জন্য অনুসরণীয়:

১. একনিষ্ঠতার সাথে শুধুমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য উমরা পালন করা।
২. উমরা পালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরিকা (পদ্ধতি) অনুসরণ করা।
৩. হালাল (বৈধ) উপার্জন থেকে উমরা পালন করা।
৪. উমরার বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা।
৫. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সঠিকভাবে আদায় করা। কেননা সালাত আদায় না করলে ওমরা করে কোন লাভ নেই।
৬. যাবতীয় শিরক, বিদআত ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা।

❑ উমরার কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে নিন্মরূপ:

১. ইহরামের পূর্বে শারীরিকভাবে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা তথা- নাভিমূল, বগলের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা।
২. মিকাত থেকে ইহ্‌রাম বাঁধা। (ওয়াজিব)
৩. মিকাতে গিয়ে ইহরামের উদ্দেশ্যে প্রথমে গোসল করা।
৪. সম্ভব হলে মাথা, দাড়ি বা শরীরে আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫. সেলাই বিহীন দুটি কাপড়ে ইহ্‌রাম বাঁধা। (শুধু পুরুষদের জন্য) নারীরা যে কোন কাপড়ে ইহরাম করতে পারে। তাদের জন্য সাদা কাপড় বা বোরখা পরিধান করা আবশ্যক নয়।)
৬. কাপড় দুটি সাদা হওয়া উত্তম। একটি লুঙ্গি অপরটি চাদর হিসেবে।
৭. উমরার উদ্দেশ্যে (অন্তরে) নিয়ত করে ইহ্‌রাম বাঁধা। (রোকন)
৮. ইহরাম বাঁধার সময় বলবে: আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা উমরাতান।
৯. রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পঠিত তালবিয়া জোরে জোরে পাঠ করা।

◆ তালবিয়া:

(لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيْكَ لَكَ) ‘
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা, ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌ না’মাতা লাকা ওয়াল্‌ মুল্‌ক্‌, লা-শারীকা লাক।
১০. মক্কা পর্যন্ত সারা রাস্তা এই তালবিয়া বেশী করে পাঠ করবে এবং অন্যান্য তাসবি-তাহলিলেও লিপ্ত থাকবে।
১১. মক্কায় গিয়ে অজু করে (সম্ভব হলে গোসল করে) পবিত্রতার সাথে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা। (তওয়াফের জন্য পবিত্রতা আবশ্যক)
১২. মসজিদে হারামে প্রবেশের পূর্বে তালবিয়া বলা বন্ধ করা।
১৩. তওয়াফের জন্য সরাসরি হজরে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
১৪. তওয়াফ শুরুর পূর্বে ইযতিবা করা। (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রাখা) নামাযের সময় উভয় কাঁধ ঢেকে রাখা জরুরি।
১৫. ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আক্‌বার’ বলে হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করে বা ইশারা করে তওয়াফ শুরু করা।
১৬. প্রথম তিন চক্করে রমল করা। (ছোট ছোট কদমে দ্রুত চলা)
১৭. তওয়াফ অবস্থায় কোন দুআ নির্দিষ্ট না করে যে কোন দুআ ও জিকির পাঠ করা।
১৮. আল্লাহর ঘর বাম দিকে রেখে তওয়াফ করা।
১৯. হাতিমের বাহির দিয়ে তওয়াফ করা।
২০. রোকনে ইয়ামানি স্পর্শ করা। তা না পারলে ইঙ্গিত না করেই চলতে থাকা।
২১. রোকনে ইয়ামানি এবং হজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে এই দুআ পড়া:
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও ওয়া ক্কিনা আযাবান্নার।”
হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন। এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন। [সূরা বাকারা: ২০১]
২২. একাধারে সাত চক্কর পূর্ণ করা। (রোকন)
২৩. মাকামে ইবরাহিমের পিছনে দু রাকাআত নামাজ পড়া। (সেখানে সম্ভব না হলে মসজিদুল হারামের যে কোন স্থানে তা আদায় করা।)
২৪. সূরা ফাতিহার পর প্রথম রাকাআতে সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা ইখলাস পড়া।
২৫. জমজম-এর পানি পান করা এবং তা মাথায় ঢালা।
২৬. আবার হজরে আসওয়াদে চুম্বন দেওয়া বা ইঙ্গিত করা।
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
“ইন্নাস সাফা ওয়াল মার্‌ওয়াতা মিন শাআয়িরিল্লাহি” বলতে বলতে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করা।
২৭. কিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে তাওহিদ, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আল হামদুলিল্লাহ) ইত্যাদি পাঠ করা।
অতঃপর তিনবার বলবে:
لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ . لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ أنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وهَزَمَ الأحْزاَبَ وَحْدَهُ
এরপর জানা যে কোন দুআ পাঠ করবে।
২৮. সবুজ বাতি দ্বয়ের মধ্যবর্তী অংশে দৌড়ানো। (মহিলারা দৌড়াবে না।)
২৯. সাফা-মারওয়া সাঈ করার সময় কোন দুআ নির্দিষ্ট না করে, জানা যে কোন দুআ পড়া।
৩০. মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করা।
৩১. সেখানেও সাফা পাহাড়ের ন্যায় দুআ করা।
৩২. সাত বার সাফা-মারওয়া সাঈ করা। (রোকন)
৩৩. সাফা থেকে মারওয়া গমন ১ম চক্কর, মারওয়া থেকে সাফা প্রত্যাবর্তন ২য় চক্কর। এভাবে ৭ম চক্কর মারওয়ায় এসে শেষ করা।
৩৪. মাথার চুল মুড়িয়ে বা খাটো করে হালাল হয়ে যাওয়া। (ওয়াজিব)

❑ কতিপয় ভুলত্রুটি:

১. অনেকে ইহরাম বাঁধার সময় থেকেই ইযতেবা তথা (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রেখে দেয়। এমনকি সালাতের সময়ও সেভাবেই থাকে। এরূপ করা সুন্নতের পরিপন্থী। ইযতেবা শুধু তওয়াফের মূহুর্তে করা সুন্নত, অন্য সময় নয়।অনেকে ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্যে রাকাআত সালাত আদায় করে থাকে। মূলত: ইহরামের জন্য কোন সালাত নেই। তবে কোন ফরজ সালাতের সময় হয়ে গেলে, উক্ত সালাত আদায় করার পর ইহরাম বাঁধবে।
২. কাবা ঘরের তওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন দুআ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এসময় অনির্দিষ্টভাবে যে কোন দুয়া বা প্রার্থনা যে কোন ভাষায় করা যাবে। সুতরাং বিভিন্ন ধরনের কিতাবে যে সকল দুয়া লিখিত আছে- ১ম চক্করের দুআ……. ২য় চক্করের দুয়া………. তা নি:সন্দেহে ভুল। কেননা এভাবে নির্দিষ্ট চক্করের জন্য নির্দিষ্ট দুআ না রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়েছেন না তিনি পড়তে বলেছেন, না কোন সাহাবি রা. এরূপ করেছেন।
৩. হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা জরুরি মনে করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়। কেননা একে চুম্বন করা সুন্নত, কিন্তু মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম।
৪. তওয়াফ-সাঈর সময় সশব্দে দুআ পড়া সুন্নতের খেলাফ ও অন্যায় কাজ।
৫. অনেকেই সাফা-মারওয়া সাঈ শেষে মাথার বিভিন্ন দিক থেকে অল্প অল্প করে চুল কাটে। এটা কখনই বৈধ নয়। কেননা সম্পূর্ণ মাথা থেকেই চুল কাটতে হবে। যেমনটি সম্পূর্ণ মাথার চুলই মুণ্ডন করতে হয়।
৬. তানঈম বা মসজিদে আয়েশা বা উমরা মসজিদ থেকে ঘন ঘন ইহরাম বেঁধে এসে নিজের জন্য বা আত্মীয়-স্বজনের নামে উমরা পালন করা বিধি সম্মত নয়। কেননা, একই সফরে এরূপ একাধিক উমরা করা রাসুলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা. ও তাবেঈদের কারো থেকে সাব্যস্ত নেই। [বিস্তারিত দেখুন আল মুগনী ৫/১৭]

❑ মসজিদে নববি জিয়ারত:

মসজিদে নববি মুস্তাহাব। সুন্নতে মুআক্কাদা নয় বা ওয়াজিব ফরজও নয়। আর উহা জিয়ারত করা হজ-উমরার সামান্যতম অংশ বিশেষও নয়। সুতরাং শুধুমাত্র মদিনার মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর জায়েজ (বৈধ)। অন্য কোন উদ্দেশ্যে (যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর মাজার জিয়ারত বা সাহাবির রা. কবর জিয়ারত ইত্যাদি) সফর করা জায়েজ নয়। তবে মসজিদে নববী পৌঁছার পর উক্ত স্থান সমূহ জিয়ারত করতে কোন বাধা নেই। [বুখারি ও মুসলিম]

❑ উমরা এর রোকন ৩টি:

১) ইহরাম বাঁধা।
২) তওয়াফ করা।
৩) সাঈ করা।

❑ উমরার ওয়াজিব ২টি :

১) মিকাত হতে ইহরাম বাঁধা।
২) চুল কামানো বা ছোট করা।

❑ ইহরাম অবস্থায় যা করা নিষিদ্ধ:

১. সেলাইকৃত কাপড় পরা।
২. মুখ ঢাকা।
৩. পুরুষদের মাথা ঢাকা।
৪. হাতমোজা পরিধান করা।
৫. নখ, চুল ইত্যাদি কাটা।
৬. স্থলচর প্রাণী শিকার করা বা তা শিকার করার জন্য ইঙ্গিত করা।
৭. স্ত্রী সহবাস করা।
৮. হারাম এলাকার মধ্যে কোন জিনিস কুড়ানো (মালিকের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার উদ্দশ্য হলে কোনও সমস্যা নেই)
৯. বিয়ে করা বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া।
১০. সুগন্ধি ব্যবহার করা।

❑ উমরা ফরজ হওয়ার শর্তাবলী:

১. ইসলাম [সুরা তাওবাহ: ৫৪]
২. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া
৩. স্বাধীন হওয়া। [আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী]
৪. বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়া। [আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী]
৫. আর্থিক ও শারীরিক ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়া। [আল ইমরান: ৯৭]
৬. মহিলার জন্য স্বামী অথবা মাহরাম থাকা। [বুখারি ও মুসলিম]

❑ বিশেষ দ্রষ্টব্য:

ক. উমরার কোন একটি রোকন ছুটে গেলে উমরা বাতিল হয়ে যাবে।
খ. আর কোন একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে কাফফারা দিতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন এবং সহীহ্‌ হাদিস অনুযায়ী উমরা পালন করে সৌভাগ্যশালীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

সংকলন: মুহা. আবদুল্লাহ্‌ আল কাফী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate