Saturday, August 30, 2025

যিহার সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: যিহারের পরিচয় কি? কোন ধরনের কথা বা কাজের মাধ্যমে যিহার সংঘটিত হয়? ইসলামে যিহারের শারঈ হুকুম এবং এর কাফফারা কীভাবে আদায় করতে হয়?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂◉❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর জাহেলি যুগে প্রচলিত বহু কুসংস্কার ও প্রথা পরবর্তীতে মুসলিম সমাজেও প্রবেশ করেছিল। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো যিহার। জাহেলী যুগে আরবদের কাছে “যিহার” তালাক বা তার চেয়ে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা বলে মনে করা হত। কারণ তাদের দৃষ্টিতে এর অর্থ ছিল এই যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্কই শুধু ছিন্ন করছে না বরং তাকে নিজের মায়ের মত হারাম করে নিচ্ছে। এ কারণে আরবদের মতে তালাক দেয়ার পর তা প্রত্যাহার করা যেত। কিন্তু যিহার প্রত্যাহার করার কোন সম্ভাবনাই অবশিষ্ট থাকত না।ইসলামি ফিকহে যিহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; কারণ এর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের হালাল-হারামের মতো গুরুতর বিধান জড়িয়ে রয়েছে। একই সঙ্গে জাহেলি যুগ থেকে প্রচলিত এর অপব্যবহার সম্পর্কে ইসলামের সঠিক নির্দেশনা জানা মুসলিমদের জন্য অপরিহার্য।তাই আমরা এই মাসালা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
.
যিহারের সাধারণ সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আহালুল আলেমগন বলেন, تشبيه الزوج زوجته في الحرمة بمحرمه“স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনও মাহরাম নারীর সাথে সাদৃশ্য দেওয়াকে যিহার বলা হয়।”অথবা تشبيه المنكوحة بمن تحرم عليه “বিবাহিত স্ত্রীকে এমন মহিলার সাথে সাদৃশ্য দেওয়া যে তার জন্য হারাম।”(ইমাম মুহাম্মদ মুখতার শানকিতি;শারহু যাদিল মুস্তাকনি। শাইখ উক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন মাজহাবের আলোকে যিহারের আরও একাধিক সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন] উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো পুরুষ হারাম করার নিয়তে তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন “তুমি আমার জন্য হারাম, যেমন আমার মা আমার জন্য হারাম” অথবা “যেমন আমার বোন আমার জন্য হারাম” এরকম কোনো বাক্য উচ্চারণ করলে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হয়। যিহারের বিভিন্ন রূপ রয়েছে, এবং এর সংজ্ঞা ও শর্তসমূহ ফিকহের গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যিহার প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ“তোমাদের মধ্যের যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ (মায়ের মত হারাম বলে ঘোষণা করে) করে- তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মা তো কেবল তারাই, যারা তাদেরকে জন্মদান করেছে। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয় আল্লাহ মার্জনা কারী, ক্ষমাশীল।”(সূরা মুজাদিলা: ২) সাধারণভাবে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য বা বিরোধের সময় স্বামী রাগের বশে যিহার প্রকাশ করেন। উদাহরণস্বরূপ,ভিবিন্ন তাফসির গন্থে বর্ণিত হয়েছে যে খাওলা বিনত সালাবা ও তার বৃদ্ধ স্বামী আউস ইবনুস সামিত (রা.) এর মধ্যে মনোমালিন্য হলে আউস রা. ক্রোধান্বিত হয়ে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: «أنتِ عليَّ كظهرِ أُمِّي “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত।” অর্থাৎ যেভাবে আমার মা আমার ওপর হারাম, তেমনি তুমি আমার জন্য হারাম। জাহেলি যুগে কেউ যদি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইতো, সে প্রায়শই এই ধরনের কথা বলত।যাহোক, এই ঘটনা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন তিনি তাদের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। এরপর সূরা মুযাদালা-তে যিহার সম্পর্কিত আয়াতসমূহ নাজিল হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আউস রা. কে যিহারের কাফফারা প্রদান করতে সহায়তা করেছিলেন। (সংক্ষেপিত: তাফসির ইবনে কাসির সূরা মুজাদিলা: ২ নং আয়াতের তাফসির]
.
▪️কোন ধরনের কথা বা কাজের মাধ্যমে যিহার সংঘটিত হয়?
.
যিহার সংঘটিত হওয়ার জন্য স্বামী প্রায়শই কিছু নির্দিষ্ট বাক্য ব্যবহার করেন। যেমন: “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের সমতুল্য।” যেমন আমার বোন আমার জন্য হারাম, তেমনি তুমি আমার জন্য হারাম।” তোমার এক চতুর্থাংশ আমার জন্য আমার ধাত্রীমায়ের মতো হারাম।” যদিও এই ধরনের উক্তি সাধারণত যিহারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তবে এগুলো সরাসরি যিহারের স্পষ্ট শব্দ নয়। বরং এগুলো বলার মাধ্যমে যিহারের সম্ভাবনা থাকতে পারে, আবার অন্য কোনো অর্থ বোঝানোর সম্ভাবনাও থাকে।কারন এই উক্তিগুলোর মাধ্যমে যিহার সংগঠিত হবে কিনা তার শারঈ বিধান নির্ভর করে স্বামীর উদ্দেশ্য, নিয়ত এবং যে পরিস্থিতিতে কথা বলা হয়েছে, সেই প্রসঙ্গ-প্রমাণের ওপর। যেমন:
.
নিয়তের দিক থেকে: যদি স্বামী এ কথার দ্বারা এটাই বোঝাতে চায় যে স্ত্রী তার কাছে মায়ের মতো হারাম হয়ে গেছে, তাহলে তা যিহার হবে। আর যদি তার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রীকে মায়ের মতো সম্মান করা, ভালোবাসা, বা মর্যাদা দেওয়া,তাহলে তা যিহার হবে না, এবং এর জন্য কিছুই প্রযোজ্য হবে না।
প্রসঙ্গ-প্রমাণের দিক থেকে: কথার পরিস্থিতি বা ঘটনাপ্রবাহ কখনো প্রমাণ করে যে স্বামী আসলে যিহার উদ্দেশ্যেই বলেছে। যেমন যদি স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার সময় তাকে বলে: “তুমি আমার কাছে মায়ের মতো।” তাহলে কথার এই প্রেক্ষাপটে পরিষ্কার বোঝা যায়, সে যিহারের অর্থেই বলেছে। ফলে এটি যিহার গণ্য হবে।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলল:তুমি আমার কাছে আমার মা ও বোনের মতো।
তিনি উত্তরে বলেন:إنْ كَانَ مَقْصُودُهُ أَنْتِ عَلَيَّ مِثْلُ أُمِّي وَأُخْتِي فِي الْكَرَامَةِ فَلا شَيْءَ عَلَيْهِ . وَإِنْ كَانَ مَقْصُودُهُ يُشَبِّهُهَا بِأُمِّهِ وَأُخْتِهِ فِي ” بَابِ النِّكَاحِ ” فَهَذَا ظِهَارٌ عَلَيْهِ مَا عَلَى الْمُظَاهِرِ فَإِذَا أَمْسَكَهَا فَلا يَقْرَبُهَا حَتَّى يُكَفِّرَ كَفَّارَةَ ظِهَارٍ”যদি তার উদ্দেশ্য হয় ‘তুমি আমার কাছে আমার মা ও বোনের মতো সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে,’ তাহলে এতে তার ওপর কিছুই (বাধ্যবাধকতা) আসবে না। কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রীর সাথে নিকাহ (বিবাহ ও যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে) মায়ের ও বোনের সাথে তুলনা করা, তবে এটি হবে যিহার। অতএব, তার ওপর যিহারকারীর জন্য যে বিধান প্রযোজ্য, সেটিই প্রযোজ্য হবে। সুতরাং, যদি সে স্ত্রীকে দাম্পত্য সম্পর্কে রাখে, তবে সে তাকে স্পর্শ করতে পারবে না যতক্ষণ না সে যিহারের কাফফারা আদায় করে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা: ৫)
ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন:وَإِنْ أَرَادَ بِهَا عِنْدِي مِثْلُ أُمِّي . أَيْ فِي الامْتِنَاعِ عَنْ وَطْئِهَا وَالاسْتِمْتَاعِ بِهَا وَنَحْوِ ذَلِكَ مِمَّا يَحْرُمُ مِنْ الأُمِّ فَهِيَ مِثْلُ أُمِّي الَّتِي لَيْسَتْ مَحَلا لِلاسْتِمْتَاعِ بِهَا : فَهَذَا مُظَاهِرٌ يَجِبُ عَلَيْهِ مَا يَجِبُ عَلَى الْمُظَاهِرِ ، فَلا يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَطَأَهَا حَتَّى يُكَفِّرَ كَفَّارَةَ الظِّهَارِ ، فَيَعْتِقَ رَقَبَةً ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا”যদি সে এর দ্বারা উদ্দেশ্য করে আমার কাছে তুমি আমার মায়ের মতো; অর্থাৎ তোমার সাথে সহবাস করা, উপভোগ করা এবং অন্যান্য সেইসব বিষয় থেকে বিরত থাকব যেগুলো মায়ের ক্ষেত্রে হারাম। তাহলে (স্ত্রীকে এভাবে বলা) তার মায়ের মতোই হবে,যিনি উপভোগের জন্য বৈধ নন। এ অবস্থায় সে ‘যিহারকারী’ হিসেবে গণ্য হবে, এবং তার ওপর যিহারকারীর হুকুম প্রযোজ্য হবে। সুতরাং, তার জন্য স্ত্রীকে সহবাস করা বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে যিহারের কাফফারা আদায় করে।
আর সেই কাফফারা হলো: (১).একটি দাস মুক্ত করা; (২).যদি তা না পায়, তবে ধারাবাহিক দুই মাস সাওম রাখা; (৩).আর যদি সেটিও না পারে, তবে ষাটজন মিসকীনকে আহার করানো।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা: ৭)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,وَإِنْ قَالَ : أَنْتِ عَلَيَّ كَأُمِّي . أَوْ : مِثْلُ أُمِّي . وَنَوَى بِهِ الظِّهَارَ , فَهُوَ ظِهَارٌ , فِي قَوْلِ عَامَّةِ الْعُلَمَاءِ ; مِنْهُمْ أَبُو حَنِيفَةَ , وَصَاحِبَاهُ , وَالشَّافِعِيُّ , وَإِسْحَاقُ . وَإِنْ نَوَى بِهِ الْكَرَامَةَ وَالتَّوْقِيرَ , أَوْ أَنَّهَا مِثْلُهَا فِي الْكِبَرِ , أَوْ الصِّفَةِ , فَلَيْسَ بِظِهَارٍ . وَالْقَوْلُ قَوْلُهُ فِي نِيَّتِهِ”যদি (স্বামী) তার স্ত্রীকে বলে: ‘তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতো’ অথবা ‘আমার মায়ের সমতুল্য’, আর এ কথার মাধ্যমে যদি সে যিহারকে উদ্দেশ্য করে, তবে তা যিহার হিসেবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে অধিকাংশ আলেম একমত; তাদের মধ্যে আছেন ইমাম আবু হানিফা, তাঁর দুই সঙ্গী, ইমাম শাফেঈ এবং ইসহাক।কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া, অথবা কেবল বয়সে তার মায়ের মতো, কিংবা কোনো বিশেষ গুণাবলীতে তার মতো তাহলে তা যিহার হবে না।এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে স্বামীর নিজস্ব নিয়তের উপর,অর্থাৎ: এখানে আসল রেফারেন্স হলো স্বামী নিজেই; অন্য কেউ নয়,তার নিয়তই নির্ধারণ করবে বিষয়টি।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৬০)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,”إذا قال الزوج لزوجته : أنا أخوك أو أنت أختي ، أو أنت أمي أو كأمي ، أو أنت مني كأمي أو كأختي، فإن أراد بذلك أنها مثل ما ذكر في الكرامة أو الصلة والبر أو الاحترام أو لم يكن له نية ولم يكن هناك قرائن تدل على إرادة الظهار ، فليس ما حصل منه ظهارا ، ولا يلزمه شيء ، وإن أراد بهذه الكلمات ونحوها الظهار أو قامت قرينة تدل على الظهار مثل صدور هذه الكلمات عن غضب عليها أو تهديد لها فهي ظهار ، وهو محرم وتلزمه التوبة وتجب عليه الكفارة قبل أن يمسها ، وهي : عتق رقبة ، فإن لم يجد فصيام شهرين متتابعين ، فإن لم يستطع فإطعام ستين مسكينا”যদি স্বামী তার স্ত্রীকে বলে: আমি তোমার ভাই, অথবা তুমি আমার বোন, কিংবা তুমি আমার মা, অথবা তুমি আমার মায়ের মতো, অথবা তুমি আমার কাছে আমার মা কিংবা আমার বোনের মতো তাহলে, যদি তার উদ্দেশ্য হয়  সম্মান, আত্মীয়তার সম্পর্ক, সৌহার্দ্য, স্নেহ, মর্যাদা বা শ্রদ্ধা প্রকাশ করা, অথবা একেবারেই কোনো নিয়ত না থাকে, এবং এমন কোনো প্রমাণ-পরিস্থিতিও না থাকে যা দ্বারা বোঝা যায় যে সে আসলে যিহারের উদ্দেশ্য করেছে তাহলে এরূপ কথা যিহার নয়। এ অবস্থায় তার ওপর কোনো কিছু ওয়াজিবও হবে না।কিন্তু যদি সে এসব শব্দ দ্বারা যিহারকেই উদ্দেশ্য করে থাকে, অথবা এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যা দ্বারা বোঝা যায় যে সে যিহার উদ্দেশ্যেই বলেছে (যেমন: স্ত্রীর ওপর রাগের সময় বা তাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এসব কথা বলা) তাহলে তা যিহার গণ্য হবে।যিহার হলো হারাম কাজ। এ জন্য স্বামীর তওবা করা আবশ্যক। আর স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করার আগে তার ওপর যিহারের কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব।সেই কাফফারা হলো: (১). একটি দাস মুক্ত করা। (২).যদি তা সম্ভব না হয়, তবে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস রোযা রাখা (৩).আর যদি সেটাও না পারে, তবে ষাট জন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো।”(ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ; খণ্ড ২; পৃষ্ঠা: ২৭৪)
.
এমনকি নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেও বা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি যিহারের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে, তবে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে।যেমন স্বামী বলে: “তুমি আমার বোনের মতো, যতক্ষণ না আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট হই’ এটি যিহারের একটি অস্থায়ী রূপ। অর্থাৎ, যেহেতু এটি স্বামী সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত প্রযোজ্য, তাই যদি স্বামী সন্তুষ্ট হওয়ার আগে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তবে কাফফারা প্রয়োজন হবে। আর যদি সন্তুষ্ট হওয়ার পরে সহবাস করে, তাহলে কোনো কাফফারা প্রযোজ্য হবে না।”
.
শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন: ” ويصح الظهار مؤقتا ، مثل أن يقول : أنت علي كظهر أمي شهرا ، أو حتى ينسلخ شهر رمضان . فإذا مضى الوقت زال الظهار ، وحلّت المرأة بلا كفارة ، ولا يكون عائدا إلا بالوطء في المدة . وهذا قول ابن عباس وعطاء وقتادة والثوري وإسحاق وأبي ثور ، وأحد قولي الشافعي . . . لحديث سلمة بن صخر ، وقوله : ظاهرت من امرأتي حتى ينسلخ شهر رمضان . وأخبر النبي صلى الله عليه وسلم أنه أصابها في الشهر ، فأمره بالكفارة . ولم [ينكر] عليه تقييده “
“যিহার (সময় নির্দিষ্ট করে) করা বৈধ। যেমন কেউ বলে: ‘তুমি আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো এক মাসের জন্য বা বলে: রমযান মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত। সুতরাং যখন সেই সময় চলে যাবে, তখন যিহার বাতিল হয়ে যাবে, এবং স্ত্রী বৈধ হয়ে যাবে, কোনো কাফফারা ছাড়াই। আর সে (স্বামী) ঐ সময়ের মধ্যে সহবাস করলে তবেই কাফফারা দিতে হবে। এটাই ইবনু আব্বাস, আত্বা, ক্বতাদা, সাওরী, ইসহাক, আবূ সাওর এবং ইমাম শাফেয়ীর একটি অভিমত।সালামা ইবনু সাখর (রা.) এর হাদীস আছে তিনি বলেছিলেন: আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যিহার করেছি যতক্ষণ না রমযান মাস শেষ হয়। কিন্তু তিনি রমযানের মধ্যে সহবাস করেছিলেন, তখন নবী সা. তাকে কাফফারা দিতে আদেশ করেছিলেন। আর নবী সা. তার ঐ শর্ত বেঁধে দেওয়াকে (অর্থাৎ সময় নির্দিষ্ট করে যিহার করাকে) অস্বীকার করেননি।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খন্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৬৮)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] যিহারের নির্দিষ্ট সময়ের উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন: وهذا ربما يجري ويحصل من الإنسان أن يغضب من زوجته لإساءة عشرتها فيقول : أنت علي كظهر أمي كل هذا الأسبوع ، أو كل هذا الشهر ، أو ما أشبه ذلك ، فهذا يصح ظهارا ، وليس معنى قولنا : ” إنه يصح ” أنه يحِل ، بل المعنى أنه ينعقد . فإذا مضت المدة التي وقّت بها الظهار وجامعها بعد مضي الوقت لا تجب الكفارة ؛ لأن المدة انتهت فزال حكم الظهار . فإن وطئ الزوج زوجته في الوقت الذي وقّت فيه الظهار وجبت عليه الكفارة ، وإن فرغ الوقت ووطئ بعد الفراغ زال الظهار”এমনটা হতে পারে যে মানুষ তার স্ত্রীর খারাপ আচরণ দেখে রেগে গিয়ে বলে: তুমি আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো এই পুরো সপ্তাহের জন্য বা এই পুরো মাসের জন্য, কিংবা এর অনুরূপ কিছু। এটা যিহার হিসেবে গণ্য হবে। আর আমরা যখন বলি এটা বৈধ এর মানে এই নয় যে এটা হালাল হয়ে গেল, বরং এর মানে হলো এটা কার্যকর হলো। তাহলে যখন নির্দিষ্ট করা সময় শেষ হয়ে যাবে, তারপর সে যদি স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তার উপর কোনো কাফফারা আসবে না; কারণ সময় শেষ হয়ে গেলে যিহার বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু যদি স্বামী সেই নির্দিষ্ট করা সময়ের মধ্যেই স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তবে তার উপর কাফফারা ফরজ হবে। আর সময় শেষ হয়ে গেলে এবং পরে সে সহবাস করলে যিহারও শেষ হয়ে যাবে।”(ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৫৯৩)।
.
❑ যদি কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে, অথবা কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে, নিজের মাহরামদের কারো সাথে বা নিজের শরীরের বিশেষ কোনো অঙ্গের সাথে তুলনা করে, তবে এর শারঈ বিধান কী?
.
কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর শারীরিক গঠন, সৌন্দর্য বা গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে বলে যে, তোমার চোখ দেখতে আমার মায়ের মতো, তোমার চেহারা আমার বোনের মত ইত্যাদি অথবা কোন মহিলা তার স্বামীকে বলে, তোমার দেহের গঠন আমার ভাই বা পিতার মত তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। অনুরূপভাবে সম্মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে বা বৈশিষ্টগত ভাবে তুমি আমার মা/বাবার অনুরূপ তাহলেও তা যিহারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ হারাম করার নিয়ত না থাকলে যিহার বলে গণ্য হবে না। যদিও কিছু আলেম মনে করেন যে স্বামী যদি যিহারের উদ্দেশ্য ছাড়া কেবল স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীকে “হে আমার মা” বা “হে আমার বোন” বলে সম্বোধন করেন, তবে সেটি মাকরূহ। এ মতকে তারা সমর্থন করেছেন আবু দাউদে বর্ণিত (হাদিস নং ২২১০) একটি রেওয়ায়েত দ্বারা। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বললো, হে আমার বোন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সে কি তোমার বোন? তিনি তার এরূপ সম্বোধনরকে অপছন্দ করলেন এবং এরূপ করতে নিষেধ করলেন।”(আবু দাউদ হা/২২১০) কিন্তু সঠিক মত হলো এটি মোটেও মাকরূহ নয়, কারণ উক্ত হাদিসটি সহীহ নয়। ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটিকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন।
.
এছাড়াও বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:কেবল ভালোবাসা ও স্নেহ প্রকাশের উদ্দেশ্যে কি স্বামী তার স্ত্রীকে ‘হে আমার বোন’ বা ‘হে আমার মা’ বলে সম্বোধন করতে পারে?
উত্তরে শাইখ বলেন:” نعم , يجوز له أن يقول لها يا أختي , أو يا أمي , وما أشبه ذلك من الكلمات التي توجب المودة والمحبة , وإن كان بعض أهل العلم كره أن يخاطب الرجل زوجته بمثل هذه العبارات , ولكن لا وجه للكراهة , وذلك لأن الأعمال بالنيات , وهذا الرجل لم ينو بهذه الكلمات أنها أخته بالتحريم والمحرمية , وإنما أراد أن يتودد إليها ويتحبب إليها , وكل شيء يكون سبباً للمودة بين الزوجين , سواء كان من الزوج أو الزوجة فإنه أمر مطلوب“হ্যাঁ, স্বামী তার স্ত্রীকে ‘হে আমার বোন’, ‘হে আমার মা’ কিংবা এ জাতীয় শব্দ দ্বারা সম্বোধন করতে পারে, যা পারস্পরিক স্নেহ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। যদিও কিছু আলেম স্বামীর জন্য স্ত্রীকে এভাবে সম্বোধন করা (মাকরূহ) অপছন্দ করেছেন,বাস্তবে এর মধ্যে অপছন্দের কোনো কারণ নেই। কারণ কর্মের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যক্তি যখন স্ত্রীকে এভাবে ডাকেন, তখন তিনি তাকে আসলেই বোন বা মা হিসেবে বোঝাতে চান না যাতে মহরামত্ব বা হারাম হওয়ার কোনো দিক যুক্ত হয়—বরং তিনি কেবল আন্তরিকতা, স্নেহ ও মমতা প্রকাশ করতে চান। আর যে কোনো বিষয়, তা স্বামী অথবা স্ত্রী যেই করুক না কেন, যদি তা তাদের মাঝে ভালোবাসা ও মমতা বৃদ্ধির মাধ্যম হয়, তবে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে কাঙ্ক্ষিত এবং প্রশংসনীয়।”(ইবনু উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৮৩৩৮৬)
.
❑ যিহারের শারঈ বিধান এবং এর কাফফারা কী?
.
ইসলামে যিহার একটি ঘৃণিত এবং হারাম কাজ। আল্লাহ তাআলা এটিকে “মুনকার ও মিথ্যা বক্তব্য” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এজন্য, যিহারের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহ তওবা করার পাশাপাশি কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যিনি তার স্ত্রীর সাথে যিহার করেন, তার জন্য কাফফারা আদায় করা আবশ্যক। কাফফারা আদায়ের আগ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিলন হারাম। জাহেলি যুগে যিহারকে স্বাভাবিকভাবে তালাকের সমতুল্য ধরা হতো, ফলে স্ত্রী চিরস্থায়ীভাবে স্বামীর কাছ থেকে হারাম হয়ে যেত। যেমন, তাফসিরে কুরতুবীতে উল্লেখ করা হয়েছে:
“ذلك كان طلاق الرجل امرأته في الجاهلية
“জাহেলি যুগে এটি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাকের সমতুল্য ছিল।
কিন্তু ইসলাম এই নিয়মটি পরিবর্তন করেছে। যিহার ইসলামিক দৃষ্টিতে চিরস্থায়ী হারাম নয়, বরং অস্থায়ী হারামের সীমার মধ্যে রাখা হয়েছে।অর্থাৎ কোনও স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যিহার করলে কাফফারা প্রদান করলে তা হালাল হয়ে যাবে।যিহারের কাফফারা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِن نِّسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِّن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۚ ذَٰلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ -‏ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۖ فَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ۚ ذَٰلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ۚ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ“যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে ফেলে, অতঃপর তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে, তাদের কাফফারা হল, একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাসকে মুক্তি দিবে। এটা তোমাদের জন্যে উপদেশ হবে। আল্লাহ খবর রাখেন তোমরা যা কর। যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা রাখবে। যে এতেও অক্ষম হয় সে ষাট জন মিসকিনকে আহার করাবে। এটা এজন্যে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(সূরা মুজাদিলা: ৩ ও ৪) অর্থাৎ যিহারের কাফফারা রমজান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসের কাফফারার অনুরূপ। তা হল: (১). একটি মুমিন দাস মুক্ত করা। কিন্তু বর্তমান যুগে দাস-দাসী প্রথা প্রচলিত না থাকার কারণে তা প্রযোজ্য নয়। (২).এটি সম্ভব না হলে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা থাকা। এ ক্ষেত্রে ঈদ উপলক্ষে রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলোতে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। অত:পর রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলো অতিবাহিত হলে যথারীতি রোজা রাখা শুরু করবে। (৩).তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন মিসকিন (দরিদ্র-অসহায় মানুষ) কে এক বেলা খাবার খাওয়ানো অথবা খাদ্য দ্রব্য দান করা। খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ, প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য (যেমন: আমাদের দেশে চাল) থেকে প্রায় সোয়া কেজি। এর সমপরিমাণ টাকা দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ কুরআনে খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এর ব্যতিক্রম করা বৈধ নয়।
.
❑ স্ত্রীর পক্ষ থেকে কি স্বামীর সাথে যিহার হয়?
পবিত্র কুরআনের সূরা মুজাদিলা, আয়াত ২-এর আলোকে অধিকাংশ উলামা বলেন যে, যিহার কেবল স্বামীর পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়; স্ত্রীর পক্ষ থেকে নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে শুধুমাত্র স্বামীদের কথার উল্লেখ করেছেন। অতএব, যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন,“তুমি আমার জন্য হারাম, যেমন আমার পিতা বা আমার ভাই আমার জন্য হারাম,” তাহলে অধিকাংশ বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী এটি ‘যিহার’ হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এই ধরনের উক্তি হারামকে হারাম ঘোষণা করার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং গুনাহের কাজ। এটি এক প্রকার শপথ বা কসম হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে তার কর্তব্য হলো কসম ভঙ্গের জন্য নির্ধারিত কাফফারা পূর্ণ করা।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আমার স্ত্রী আমাকে সবসময় বলে, তুমি আমার স্বামী, তুমি আমার ভাই, তুমি আমার বাবা, আর তুমি আমার সবকিছু দুনিয়াতে। এই কথাগুলো কি তাকে আমার জন্য হারাম করে দেয়, না কি না?
উত্তরে শাইখ বলেন:
:هذا الكلام منها لا يحرمها عليك ؛ لأن معنى قولها ” أنت أبي وأخي ” وما أشبه ذلك : معناها : أنت عندي في الكرامة والرعاية بمنزلة أبي وأخي ، وليست تريد أن تجعلك في التحريم بمنزلة أبيها وأخيها .على أنها لو فُرض أنها أرادت ذلك : فإنكَ لا تحرم عليها ؛ لأن الظهار لا يكون من النساء لأزواجهن ، وإنما يكون من الرجال لأزواجهم ، ولهذا إذا ظاهرت المرأة من زوجها بأن قالت له ” أنتَ عليَّ كظهر أبي ، أو كظهر أخي ” أو ما أشبه ذلك : فإن ذلك لا يكون ظهاراً ، ولكن حكمه حكم اليمين ، بمعنى أنها لا يحل لها أن تمكنه من نفسها إلا بكفارة اليمين ، فإن شاءت دفعت الكفارة قبل أن يستمتع بها ، وإن شاءت دفعتها بعد ذلك .وكفارة اليمين : إطعام عشرة مساكين ، أو كسوتهم ، أو عتق رقبة ، فإن لم يجد : فصيام ثلاثة أيام .”
“(স্ত্রীর পক্ষ থেকে) এই কথাগুলো তাকে আপনার জন্য হারাম করে না। কারণ, তার এ কথার অর্থ তুমি আমার কাছে সম্মান ও যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার বাবা ও ভাইয়ের মতো। সে এভাবে বোঝাতে চায় না যে, তোমাকে সে তার বাবা বা ভাইয়ের মতো করে হারামের মর্যাদা দিতে চায়। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, সে আসলেই এ উদ্দেশ্যে বলেছে, তবুও আপনি তার জন্য হারাম হবেন না। কারণ যিহার (ظهار) যিহার (কাউকে বাবা বা ভাইয়ের সমতুল্য বলে হারাম করা) নারীরা তাদের স্বামীর জন্য করতে পারে না; বরং যিহার শুধুমাত্র পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে করে থাকে। এ কারণে, যদি কোনো নারী তার স্বামীর প্রতি বলে তুমি আমার জন্য আমার বাবার মতো, অথবা আমার ভাইয়ের মতো। কিংবা এ ধরনের কথা বলে, তবে তা যিহার হবে না; বরং এর হুকুম হবে শপথের হুকুমের মতো।অর্থাৎ, সে স্বামীকে নিজের কাছে ভোগ করতে দেওয়া তার জন্য হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে শপথের কাফফারা আদায় করে। সে চাইলে স্বামীর সঙ্গে মিলনের আগে কাফফারা আদায় করবে, আর চাইলে পরে আদায় করবে।শপথ ভঙ্গের কাফফারা হলো: ক. দশজন মিসকীনকে খাওয়ানো, অথবা খ. তাদের পোশাক পরানো, অথবা গ. একজন দাস মুক্ত করা। কোনোটিই যদি সম্ভব না হয়, তবে তিন দিন রোযা রাখা।”(ইবনু উসাইমীন;ফাতাওয়াউল মারআতিল মুসলিমাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮০৩)
.
অত:এব কোনও স্ত্রী যদি তার স্বামীকে এভাবে বলে যে, “তুমি আমার জন্য হারাম যেমন আমার জন্য আমার পিতা হারাম অথবা যেমন আমার ভাই আমার জন্য হারাম” তাহলে অধিক বিশুদ্ধ মতে তা ‘যিহার’ বলে গণ্য হবে না। বরং তা হালালকে হারাম করার অন্তর্ভুক্ত। এটিও হারাম ও গুনাহের কাজ।এটি কসম হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তার করণীয় হল, কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা।
.
❑ কোনও স্বামী যদি সাধারণভাবে তার স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম ঘোষণা করে তাহলে তার বিধান কী?
.
যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে কোনো মাহরাম নারীর সঙ্গে তুলনা না করে সাধারণভাবে হারাম ঘোষণা করে, যেমন বলে: “তুমি আমার জন্য হারাম”, অথবা স্ত্রীকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বলে: “তুমি যদি এ কাজ করো তবে তুমি আমার জন্য হারাম” তাহলে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এ ধরনের কথা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ এটি আল্লাহ কর্তৃক হালাল করা বিষয়কে হারাম ঘোষণা করার শামিল। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি কসম (শপথ) হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যদি সে তার এ কথার মাধ্যমে শর্ত ভঙ্গ করে, তবে তার উপর কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব হবে।আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ
“হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যাহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক।” [সূরা তাহরিম: ১ ও ২] উপরোক্ত আয়াতের আলোকে ইবনে আব্বাস রা. বলেন,إِذَا حَرَّمَ الرَّجُلُ عَلَيْهِ امْرَأَتَهُ فَهِيَ يَمِينٌ يُكَفِّرُهَا“যদি কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে তার জন্য হারাম করে দেয় তাহলে তা হল, একটি কসম। যার জন্য কাফফারা আদায় করবে।”(সহীহ বুখারি হা/৪৯১১ ও মুসলিম, হা/১৪৭৩) উল্লেখ্য যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হালাল কৃত কোনও খাবার, পানীয়, পোশাক বা অন্য যে কোনও কিছুকে নিজের জন্য হারাম বলে ঘোষণা দেয় তাহলে তার উপর একই বিধান বর্তাবে। অর্থাৎ তার জন্য কসম ভঙ্গের কাফফারারা আদায় করা আবশ্যক। তবে কেউ যদি উক্ত বাক্য বলার মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নিয়ত করে তাহলে তালাক বলে গণ্য হবে। কারণ “নিয়তের উপর সকল কর্ম নির্ভরশীল।” [সহিহ বুখারি]
.
❑ রাগান্বিত ব্যক্তির যিহার কার্যকর হয়?
.
আহলুল আলেমগন রাগান্বিত ব্যক্তির উচ্চারিত বাক্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন,তারা বক্তব্য অনুযায়ী রাগের তিনটি অবস্থা হতে পারে:
প্রথম অবস্থা: এত তীব্র রাগ উঠা যে, ব্যক্তি তার অনুভুতি হারিয়ে ফেলা। পাগল বা উন্মাদের মত হয়ে যাওয়া। সকল আলেমের মতে, এ লোকের যিহার কিংবা তালাক কার্যকর হবে না। কেননা সে বিবেকহীন পাগল বা উন্মাদের পর্যায়ভুক্ত।
দ্বিতীয় অবস্থা: রাগ তীব্র আকার ধারণ করা। কিন্তু সে যা বলছে সেটা সে বুঝতেছে এবং বিবেক দিয়ে করতেছে। তবে তার তীব্র রাগ উঠেছে এবং দীর্ঘক্ষণ ঝগড়া, গালি-গালাজ বা মারামারির কারণে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। এগুলোর কারণেই তার রাগ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ লোকের যিহার বা তালাকের ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। অগ্রগণ্য মতানুযায়ী, এ লোকের তালাকও কার্যকর হবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ইগলাক এর অবস্থায় তালাক কিংবা দাস আযাদ নেই”।(সুনানে ইবনে মাজাহ (২০৪৬), শাইখ আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ কিতাবে হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন] ইগলাক শব্দের অর্থে আলেমগণ বলেছেন: জবরদস্থি কিংবা কঠিন রাগ।
তৃতীয় অবস্থা: হালকা রাগ। স্ত্রীর কোন কাজ অপছন্দ করা কিংবা মনোমালিন্য থেকে স্বামীর এই রাগের উদ্রেক হয়। কিন্তু এত তীব্র আকার ধারণ করে না যে, এতে বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে কিংবা নিজের ভাল-মন্দের বিবেচনা করতে পারে না। বরং এটি হালকা রাগ। আলেমগণের সর্বসম্মতিক্রমে এ রাগের অবস্থায় তালাক বা যিহার কার্যকর হবে।রাগাম্বিত ব্যক্তির তালাকের মাসয়ালায় বিস্তারিত ব্যাখ্যামূলক এটাই সঠিক অভিমত। ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়্যূম এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যার সারকথা হচ্ছে: কঠিন রাগ; যে রাগের কারণে মানুষ কী বলছে তা উপলব্ধি করতে পারে না; এমন রাগ তালাক কার্যকরে বাধা দেয়। অনুরূপভাবে এমন তীব্র রাগ যা মানুষকে তালাক দেয়ার প্রতি প্ররোচিত করে ও ধাবিত করে; সে যদি নিজে যা বলছে সেটা উপলব্ধি করেও তদুপরি তালাক পতিত হবে না। আর হালকা রাগ মানুষের তালাক দেয়ার ইচ্ছার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। হালকা রাগ থাকা সত্ত্বেও তালাক কার্যকর হবে।তালাক সম্পর্কে যা বলা হয়, তা যিহার সম্পর্কেও বলা যেতে পারে, কারণ উভয়ই একই প্রকৃতির। বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু কাইয়ুম ইগাসাতুল লাহফান; পৃষ্ঠা: ১৯; ইমাম বিন বায এর ‘ফাতাওয়াত তালাক’ পৃষ্ঠা: ১৫-২৭; ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৪৪৪)
.
❑ কসম/শপথ ভঙ্গের কাফ্‌ফারা কিভাবে আদায় করতে হবে?
.
আল্লাহ তাআলা তাঁর নিম্নোক্ত বাণীতে শপথ ভঙ্গের কাফ্‌ফারা বর্ণনা করেছেন:لا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ “তোমাদের অনর্থক শপথের জন্য আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। তারপর এর কাফ্‌ফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি। অতঃপর যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফ্‌ফারা। আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর”। (সূরা মায়িদা,আয়াত: ৮৯)
সুতরাং একজন মানুষ তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে কোন একটি বাছাই করে নিতে পারেন:
.
(১) দশজন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো। নিজের ফ্যামিলিকে যে ধরনের খাবার খাওয়ানো হয় সে ধরণের মধ্যম মানের খাবার। প্রত্যেক মিসকীনকে দেশীয় খাদ্যদ্রব্যের অর্ধ সা’ দিতে হবে। যেমন চাল বা এ জাতীয় অন্য কিছু। অর্ধ সা’এর পরিমাণ হচ্ছে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। যদি কোন দেশে ভাতের সাথে তরকারি খাওয়ার প্রচলন থাকে, অনেক দেশে এটাকে তাবিখ (রান্নাকৃত) বলা হয় সেক্ষেত্রে চালের সাথে তাদেরকে তরকারী বা গোশত দেয়া উচিত। আর যদি দশজন মিসকীনকে একত্রিত করে দুপুরে বা রাতের খাবার খাওয়ানো হয় তাহলে সেটাও যথেষ্ট।
(২) দশজন মিসকীনকে বস্ত্র দান করা। যে কাপড় দিয়ে নামায আদায় করা যায় প্রত্যেক মিসকীনকে এমন ড্রেস দিতে হবে। পুরুষদের জন্য জামা (জুব্বা) কিংবা লুঙ্গি ও চাদর। আর নারীদের জন্য গোটা দেহ আচ্ছাদনকারী পোশাক এবং ওড়না।
(৩) একজন ঈমানদার ক্রীতদাস আদায করা। যে ব্যক্তির এর কোনটি করার সামর্থ্য নেই সে ব্যক্তি লাগাতার তিনদিন রোযা রাখবে। জমহুর আলেমের অভিমত হচ্ছে নগদ অর্থ দিয়ে কাফ্‌ফারা দিলে আদায় হবে না।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:لا يُجْزِئُ في الكفارة إِخراج قيمة الطعام ولا الكسوة، لأن الله ذكر الطعام فلا يحصل التكفير بغيره، ولأن الله خَيَّرَ بين الثلاثة أشياء ولو جاز دفع القيمة لم يكن التَخْييرُ منحصراً في هذه الثلاث… “কাফ্‌ফারা আদায় করার ক্ষেত্রে খাদ্য কিংবা বস্ত্রের মূল্য দিয়ে দিলে কাফ্‌ফারা আদায় হবে না। কেননা আল্লাহ্‌ খাদ্যের কথা উল্লেখ করেছেন সুতরাং অন্য কিছু দিয়ে কাফ্‌ফারা আদায় হবে না। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলা তিনটি পদ্ধতি থেকে একটি চয়ন করার সুযোগ দিয়েছেন। যদি মূল্য দেয়া জায়েয হত তাহলে তিনটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন অর্থ থাকে না।”(ইবনে কুদামা এর আল-মুগনি; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৫৬)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:(على أن تكون الكفارة طعاما لا نقودا، لأن ذلك هو الذي جاء به القرآن الكريم والسنة المطهرة، والواجب في ذلك نصف صاع من قوت البلد، من تمر أو بر أو غيرهما، ومقداره كيلو ونصف تقريبا، وإن غديتهم أو عشيتهم أو كسوتهم كسوة تجزئهم في الصلاة كفى ذلك، وهي قميص أو إزار ورداء.) কাফফারা অবশ্যই খাদ্য হতে হবে; অর্থ নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাহ্‌তে খাদ্যের কথাই এসেছে। আবশ্যকীয় পরিমাণ হচ্ছে অর্ধ সা’ দেশীয় খাদ্যদ্রব্য; যেমন- খেজুর, গম ইত্যাদি। আধুনিক পরিমানের হিসাবে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। আর যদি আপনি তাদেরকে দুপুরের খাবার খাইয়ে দেন বা রাতের খাবার খাইয়ে দেন কিংবা পোশাক পরিয়ে দেয়, যে পোশাক দিয়ে নামায পড়া জায়েয হবে সেটাও যথেষ্ট। এমন পোশাক হচ্ছে– একটা জামা (জুব্বা) কিংবা একটা লুঙ্গি ও চাদর।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৮১)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:”فإن لم يجد الإنسان لا رقبة ولا كسوة ولا طعاماً فإنه يصوم ثلاثة أيام، وتكون متتابعة لا يفطر بينهما.”যদি কেউ ক্রীতদাস না পায়, পোশাক বা খাবার দিতে না পারে তাহলে সে তিনদিন রোযা রাখবে। এ রোযাগুলো লাগাতারভাবে রাখতে হবে। মাঝে কোনদিন রোযা ভাঙ্গা যাবে না।”(ফাতাওয়া মানারুল ইসলাম; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬৬৭) আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করে সে আলোকে জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate