Saturday, February 5, 2022

সাম্প্রদায়িকতা কী? ইসলাম “সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে কী বলে?

 প্রশ্ন: সাম্প্রদায়িকতা কী? ইসলাম “সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে কী বলে?

উত্তর:
সাম্প্রদায়িকতা (Sectarianism) অর্থ: ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, গোষ্ঠী, ভাষা, দেশ, অঞ্চল, লিঙ্গ, দল ইত্যাদি দিক-বিবেচনায় অন্যায়-অবিচারকে সমর্থন করা এবং অপর পক্ষের ক্ষতি সাধন করা। অন্য কথায় এটা হল, গ্রুপবাজি বা গোষ্ঠী তন্ত্র। এর বিপরীতটাই অসাম্প্রদায়িকতা।
ইসলামে এ জাতীয় সাম্প্রদায়িকতা বা গোষ্ঠী তন্ত্রের কোনও স্থান নেই। বরং ইসলাম সবসময় এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং সাম্য ও ন্যায়-নীতির পক্ষে অবস্থান করে। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা অবশ্যই হারাম।

▪️ইসলাম নিজের নিকটাত্মীয়ও যদি অপরাধ করে তবুও তাকে শাস্তি দিতে বলে। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُهَا
“তাঁর শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদও চুরি করতো, আমি তারও হাত কেটে দিতাম।” [সুনান আন-নাসায়ী, অধ্যায়: ৪৭/ চোরের হাত কাটা-সহিহ]
সুবহানাল্লাহ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষের মুখ থেকে এমন ইনসাফ দীপ্ত শক্ত ঘোষণা সত্যি ইসলামের বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা প্রমানের পাশাপাশি স্বজন প্রীতি, গোষ্ঠী প্রীতি এবং অন্যায়-অবিচারের পথকে রুদ্ধ করে দেয়।
▪️ইসলাম নিজের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর বিপক্ষে গেলেও সত্য ও ন্যায়ের কথা বলার নির্দেশ দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ
“যখন তোমরা কথা বলবে তখন ইনসাফ করবে যদিও তা নিকটাত্নীয়ের ব্যাপারে হয়।” [সূরা আনআম: ১৫২]

▪️নির্যাতিত ব্যক্তি ন্যায় বিচার পাবে যদিও সে অমুসলিম হয় এবং অপরাধী শাস্তি পাবে যদিও সে মুসলিম হয়।

▪️ইসলাম জাতি ও গোষ্ঠীগত সাম্প্রদায়িকতাকে ‘জাহেলিয়াত’ বলে আখ্যায়িত করেছে। যেমন: হাদিসে এসেছে,
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ. বলেন যে, আমর রাহ. জাবির রা. কে বলতে শুনেছেন,
আমরা এক যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তখন একজন মুহাজির সাহাবি এক আনসারি সাহাবির পশ্চাদ্দেশে আঘাত করেছিল।
সে সময় আনসারি সাহাবি চীৎকার করে বলল: হে আনসাররা (তোমরা কে কোথায় আছো, ছুটে আসো)! অন্য দিকে মুহাজির ব্যক্তি ডাক দিল, হে মুহাজিরগণ! (তোমরা কে কোথায় আছো ছুটে আসো)।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
‏ مَا بَالُ دَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ؟
“কী ব্যাপার! জাহেলি যুগের মতো হাঁক-ডাক করছ কেন?”
তারা বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! একজন মুহাজির একজন আনসারির পশ্চাতে আঘাত করেছে। তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
‏دَعُوهَا فَإِنَّهَا مُنْتِنَةٌ ‏
“তোমরা এ ধরনের হাঁক-ডাক পরিত্যাগ করো। কেননা তা দুর্গন্ধময় (নিন্দনীয়) কাজ।” [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ৪৬। সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ১৬. ভাইকে সাহায্য করা জালিম হোক কিংবা মাজলুম হোক] এ মর্মে আরও হাদিস আছে।

▪️অন্য হাদিসে এসেছে,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ ). وهو حديث ضعيف كما قال الألباني في ضعيف أبي داود
“যে ব্যক্তি আসাবিয়াহ তথা গোষ্ঠীগত গোঁড়ামির দিকে ডাকে বা গোত্রের দিয়ে আহ্বান করে লোক-জন জমায়েত করে করে সে আমার দলভুক্ত নয়। আর ঐ ব্যক্তিও আমাদের দলভুক্ত নয় যে গোষ্ঠীগত গোঁড়ামির ভিত্তিতে যুদ্ধ করে এবং সেও নয় যে গোষ্ঠীগত গোঁড়ামি উপর মারা যায়।”
[সুনান আবু দাউদ, ৩৬/ শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ১২২. দল প্রীতি বা পক্ষপাতিত্ব-দুর্বল, মিশকাত হা/ ৪৯০৭, গায়াতুল মারাম, হা/ ৩০৪।]
এ হাদিসটি জঈফ হলেও তার মমার্থটা সহিহ হাদিস দ্বারা সমর্থিত-যেমনটি উপরের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

▪️ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَلَا إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى أَعْجَمِيٍّ وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى
“হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতা এক (আদম আ.)।
শুনে রাখো, আরবির উপর অনারবির এবং অনারবির উপর আরবির, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল ‘তাকওয়া’ (আল্লাহ ভীতি)’র ভিত্তিতে।”
(মুসনাদে আহমদ, হা/২২৩৯১, সিলসিলা সহিহা, ৬/১৯৯)

▪️ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বললেন,

“হে লোক সকল! আল্লাহ্ তাআলা জাহেলি যুগের অন্ধ অহমিকা এবং পিতৃপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। মানুষ হল দু ধরনের।
– এক প্রকার হল সৎ, পরহেজগার এবং আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান।
– আরেক প্রকার হল অসৎ, বদবখন এবং আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট।
মানুষ হল আদম-এর সন্তান। আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
يا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
“হে মানুষ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে। যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাবান যে অধিক আল্লাহভীরু। আল্লাহ্ সবকিছু জানেন। সব খবর রাখেন [সূরা হুজুরাত ৪৮: ১৩]।
মোটকথা ইসলাম হল, ন্যায়-ইনসাফ ভিত্তিক জীবনাদর্শের নাম। এখানে সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি, দল বা গোষ্ঠীপ্রীতির কোনও স্থান নেই। সুতরাং যারা ইসলামকে সাম্প্রদায়িক বলে গালমন্দ করে তারা মূলত ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ বিদ্বেষবশত বলে। ইসলামের প্রকৃত পরিচয় ও সৌন্দর্য সম্পর্কে তারা নিতান্তই অজ্ঞ। আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখান। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল-

No comments:

Post a Comment

Translate