Friday, June 20, 2025

কৃষি জমি বন্ধক রাখা কি জায়েজ

 প্রশ্ন: কৃষি জমি বন্ধক রাখা কি জায়েজ? অর্থাৎ যে টাকা নিয়ে জমি বন্ধক রাখা হয়েছে, সে টাকা ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত টাকা প্রদানকারী জমি ভোগ করবে। অতঃপর টাকা দিলে জমি ফেরত দিবে এভাবে জমি বন্ধক রাখা কি জায়েজ?

▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর “কৃষিজমি বন্ধক রাখার পদ্ধতির মধ্যে সাধারণত দুটি রীতি পরিলক্ষিত হয় এর একটিকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে বৈধ গণ্য করা হয়, আর অপরটি শরিয়তের দৃষ্টিতে স্পষ্টরূপে হারাম।”
.
▪️প্রথম পদ্ধতি: কৃষি জমি বন্ধকদাতা ও বন্ধকগ্রহীতার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিদিষ্ট একটি জমি ব্যবহার করার চুক্তি করা, এই চুক্তির আওতায়, নির্ধারিত মেয়াদে বন্ধকগ্রহীতা তথা চাষাবাদকারী জমিটি চাষাবাদ করে জমির ফসল একাই ভোগ করেন, আর বন্ধকদাতা তথা জমির মালিক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিকৃত ঋণের অর্থ গ্রহণ করেন। অতঃপর নির্ধারিত মেয়াদ শেষে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জমির মালিক ঋণকৃত সম্পূর্ণ টাকা বন্ধকগ্রহীতা তথা চাষাবাদকারী কে ফিরত দিলে চাষাবাদকারী জমির মালিককে তার জমি ফেরত দেয় এর মাঝে কেটে যাওয়া সময়ে টাকার মালিক তথা চাষাবাদকারী জমিটা একাই ভোগ করে। এই ধরনের চুক্তি ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী এবং সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এটা জায়েজ নয় বরং আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে এই ধরনের বন্ধক হারাম।
.
সুদের পরিচয়ে ইসলামের সর্বসম্মত একটি মূলনীতি হল, القرض الذي يؤدي إلى نفع مشترط للمقرض؛ فهو ربا “ঋণ দানকারীর শর্তসাপেক্ষ সুবিধার ফলস্বরূপ ঋণকে সুদ বলে।” অর্থাৎ ঋণদাতার সাথে যদি এ মর্মে শর্ত থাকে যে, ঋণের বিনিময়ে সে ফায়দা/সুবিধা গ্রহণ করবে বা তাকে ফায়দা/সুবিধা দেয়া হবে তাহলে তা সুদ বলে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে একটি হাদিস রয়েছে। তা হল প্রখ্যাত সাহাবী আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: كُلُّ ‌قَرْضٍ ‌جَرَّ مَنْفَعَةً، فَهُوَ رِبًا ‘যে ঋণ মুনাফা বয়ে আনে, সেটাই এক প্রকার সূদ”।(বায়হাকী; আস সুনানুল কুবরা; ১১/২৯৪ হা/১১০৩৭) এ হাদিসটি সনদের বিচারে দুর্বল হলেও এর মর্মার্থটা সঠিক।(ইবনু উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতি; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১০৮-১০৯) আর হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদগ্রহণকারী, সুদদাতা, সুদের লেখক, সুদের সাক্ষীদ্বয় সকলকে লানত করেছেন এবং বলেছেন: তারা সবাই সমান।”(সহিহ মুসলিম হা/১৫৯৮)।
.
দুঃখজনক হলেও সত্যি জমি বন্ধকের এই পদ্ধতিটাই আমাদের সমাজে বেশি চলে।অথচ আলেমরা এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, যে ঋণ ঋণদাতাকে কোন প্রকার উপকার দেয় সেটাই সুদ। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:
وَكُلُّ قَرْضٍ شَرَطَ فِيهِ أَنْ يَزِيدَهُ ، فَهُوَ حَرَامٌ بِغَيْرِ خِلَافٍ ، قَالَ ابْنُ الْمُنْذِرِ : أَجْمَعُوا عَلَى أَنَّ الْمُسَلِّفَ إذَا شَرَطَ عَلَى الْمُسْتَسْلِفِ زِيَادَةً أَوْ هَدِيَّةً ، فَأَسْلَفَ عَلَى ذَلِكَ : أَنَّ أَخْذَ الزِّيَادَةِ عَلَى ذَلِكَ رَبًّا .وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ، وَابْنِ عَبَّاسٍ ، وَابْنِ مَسْعُودٍ ، أَنَّهُمْ نَهَوْا عَنْ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةً
“যে ঋণে বৃদ্ধির শর্ত করা হয়েছে সেটা হারাম হওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত নেই। ইবনুল মুনযির বলেন: তারা (আলেমগণ) এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, ধারদাতা যদি ধারগ্রহীতার কাছে অতিরিক্ত বা উপহারের শর্ত করে এবং সেটার উপর ভিত্তি করে ধার দেয়; তাহলে অতিরিক্ত অংশ গ্রহণ করা সুদ বলে গণ্য হবে। উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা এমন ঋণ থেকে নিষেধ করেছেন যেটা কোনো প্রকার উপকার দেয়।”(ইবনু কুদামাহ আল-মুগনী; খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪০)।
.
ইমাম কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত দলিলের ভিত্তিতে মুসলিমগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে ঋণের ভিত্তিতে কোনো শর্তসাপেক্ষ অতিরিক্ত কিছু আদায় করাকে সুদ বলা হয়, হোক না তা এক মুঠো পশুখাদ্য বা একটি শস্যদানা মাত্র; যেমনটি ইবনু মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন।…ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে কোনো উপহার দিতে পারবে না, আর ঋণদাতার পক্ষেও তা গ্রহণ করা বৈধ নয় যদি না তাদের মধ্যে এমন উপহার লেনদেন পূর্ব থেকেই প্রচলিত থাকে।”(তাফসীর কুরতুবী; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২২৫-২২৬)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,” ঋণদাতার জন্য ঋণগ্রহীতার নিকট ঋণ প্রদানের বিনিময়ে লাভবান হওয়ার শর্তারোপ করা জায়েয নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ نَفْعًا فَهُوَ رِبًا”এমন প্রত্যেকটি ঋণ যা লাভ আনয়ন করে সেটিই সূদ’। আলেমগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সুতরাং ঋণ প্রদানের বিনিময়ে জমি থেকে উৎপন্ন ফসল দ্বারা লাভবান হওয়া জায়েয নয়। কেননা বন্ধকের উদ্দেশ্যে হল মালের নিরাপত্তা ও ঋণ আদায়ে সহায়তা করা, লাভবান করা নয়।”(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ; খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ১৭৭-১৭৮)।
.
▪️দ্বিতীয় পদ্ধতি: কৃষি জমি বন্ধকদাতা ও বন্ধকগ্রহীতার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিদিষ্ট একটি জমি ব্যবহার করার চুক্তি করা, এই চুক্তির আওতায়, নির্ধারিত মেয়াদে জমি বন্ধকগ্রহীতা তথা চাষাবাদকারী জমিটি চাষাবাদ করে ফসল ভোগ করবে বা তার যে কোনও বৈধ প্রয়োজনে জমিটি ব্যবহার করবে। আর বন্ধকদাতা তথা জমির মালিক চুক্তিকৃত অর্থ গ্রহণ করে ভোগ করবে। তারপর চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে বন্ধকগ্রহীতা (অর্থ দাতা চাষাবাদকারী) বন্ধকদাতা তথা জমির মালিক-কে তার জমি ফেরত দিবে। কিন্তু জমির মালিক তাকে কোন টাকা (পূর্ণ অথবা কিছু কম) ফেরত দিবে না কিংবা চাষাবাদকারীও জমির মালিকের কাছে তার প্রদত্ত কোনও অর্থও দাবী করতে পারবে না। বরং উভয় পক্ষই চুক্তি অনুযায়ী তাদের দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এভাবে জমি লিজ/ভাড়া দেয়া হলে তা হবে হালাল এবং শরিয়ত সম্মত। এই ধরনের চুক্তি ইসলামে বৈধ হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে এটি “খাই-খালাসি” নামে পরিচিত। তবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে জমি বা পুকুর কেবল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়ায় বা লিজে দেওয়া যাবে, কিন্তু স্থায়ীভাবে বিক্রয়ের মতো কোনো চুক্তি করা যাবে না, যা পরবর্তীতে সুদ বা হারাম লেনদেনে রূপ নিতে পারে।
.
জমি বা পুকুর লিজ দেওয়া ও নেওয়া দাতা এবং গ্রহীতার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বৈধ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাফি’ বিন খাদিজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “‏ إِنَّمَا يَزْرَعُ ثَلاَثَةٌ رَجُلٌ لَهُ أَرْضٌ فَهُوَ يَزْرَعُهَا وَرَجُلٌ مُنِحَ أَرْضًا فَهُوَ يَزْرَعُ مَا مُنِحَ وَرَجُلٌ اسْتَكْرَى أَرْضًا بِذَهَبٍ أَوْ فِضَّةٍ ‏”‏ ‏.‏ “তিন ব্যাক্তি জমি চাষাবাদ করবে। যথা: (১).যার জমি আছে সে তা চাষাবাদ করবে, (২).যাকে ধারে জমি দান করা হয়েছে সে তার চাষাবাদ করবে এবং (৩).যে ব্যক্তি নগদ সোনা-চাঁদি দ্বারা অর্থাৎ নগদ টাকায় জমি ভাড়া নেয়।”(সহীহ বুখারি হা/১২৮৬; সহীহ মুসলিম হা/১৫৪৬) অপর বর্ননায় নাফি’ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ ইবনু ‘উমার (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ে এবং আবূ বকর, ‘উমার, উসমান (রাঃ) মু’আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনের শুরু ভাগে নিজের ক্ষেতে বর্গাচাষ করতে দিতেন।”(সহিহ বুখারী হা/২৩৪৩) আরেক বর্ননায় আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার(রদিয়াল্লাহু আনহু ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বার বাসীদেরকে উৎপাদিত ফল বা ফসলের অর্ধেক ভাগের শর্তে জমি বর্গা দিয়েছিলেন”(সহীহ বুখারী, হা/২৩২৮ ‘চাষাবাদ’ অধ্যায়)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَفَعَ إِلَى يَهُوْدِ خَيْبَرَ نَخْلَ خَيْبَرَ وَأَرْضَهَا عَلَى أَنْ يَّعْتَمِلُوْهَا مِنْ أَمْوَالِهِمْ وَلِرَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَطْرُ ثَمَرِهَا”রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বারের বাগান ও যমীন খায়বারের ইহুদীদেরকে দিয়েছিলেন। তারা নিজেদের অর্থে তাতে চাষাবাদ করবে। আর রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ফল ও ফসলের অর্ধেক পাবেন (সহীহ মুসলিম হা/১৫৫১; মিশকাত হা/২৯৭২) সহীহ বুখারীতে আরো এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বারকে ইহুদীদের দিয়েছিলেন। তারা তাতে পরিশ্রম করবে ও শস্য ফলাবে এবং সেখানে যা উৎপাদিত হবে, তারা তার অর্ধেক পাবে”(সহীহ বুখারী হা/২২৮৫; মিশকাত হা/২৯৭২) এ থেকে সুস্পষ্ট যে, ইসলামে নির্দিষ্ট শর্ত ও পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে জমি লিজ বা ভাড়া দেওয়া বৈধ ও অনুমোদিত। এটি অর্থের বিনিময়ে হতে পারে, আবার উৎপাদিত ফসল ভাগাভাগির মাধ্যমেও হতে পারে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate