পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর আমাদের মধ্যে যারা এখনো বিশুদ্ধ ও সুদৃঢ় আক্বীদা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি, তারা যেন খালেস নিয়তে বিশুদ্ধ আক্বীদার ইলম অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি ইমাম শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এর অনুসৃত ছোট্ট একটি মূলনীতি দৃঢ়ভাবে অন্তরে ধারণ করে চলে যাতে আমাদের আক্বীদা নিরাপদ ও সঠিক থাকে।”
.
শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৫০ হি: মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন,
, آمَنْتُ بِاللَّهِ، وبِمَا جَاءَ عَنِ اللَّهِ، عَلَى مُرَادِ اللَّهِ، وَآمَنْتُ بِرَسُوْلِ اللَّهِ، وَبِمَا جَاءَ عَنْ رَسُوْلِ اللَّهِ، عَلَى مُرَادِ رَسُولِ اللَّهِ
“আমি আল্লাহর উপর এবং যা কিছু আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে তাতে আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী অর্থের উপরে ঈমান আনলাম। আমি আল্লাহর রাসূলের এবং যা কিছু তাঁর পক্ষ হতে এসেছে তাতে আল্লাহর রাসূলের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অর্থের উপরে ঈমান আনলাম।”(ইমাম বায়হাক্বী, মানাকিবুশ শাফি‘ঈ খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪১৫; ইবনু কুদামাহ লুম’আতুল ই’তিক্বাদ পৃষ্ঠা: ৭; ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩৫৪; ইবনু উসাইমীন; শারহু আকীদাতুল ওয়াসিতীয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৭৬)।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
ما تَضَمَّنَهُ كلامُ الإِمامِ الشافعيِّ:تَضَمَّنَ كلامُ الإِمامِ الشافعيِّ مَا يأتي:
1- الإِيمانُ بما جاءَ عن اللهِ تعالَى في كتابِهِ المُبينِ على ما أرادَهُ اللهُ مِنْ غيرِ زِيادَةٍ ، وَلا نَقْصٍ ، ولا تَحْرِيفٍ .
2- الإِيمانُ بما جاءَ عنْ رسولِ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ في سُنَّةِ رسولِ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ على ما أرادَهُ رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ مِنْ غيرِ زيادةٍ ، ولا نَقْصٍ ، ولا تحريفٍ .
وفي هذا الكلامِ ردٌّ على أهلِ التأويلِ وأهلِ التمثيلِ ؛ لأنَّ كلَّ واحدٍ منهم لم يُؤْمِنْ بما جاءَ عن اللهِ ورسولِهِ على مرادِ اللهِ ورسولِهِ ؛ فإنَّ أهلَ التأويلِ نَقَصُوا ، وأهلَ التمثيلِ زَادُوا
ইমাম শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এর বক্তব্যে নিম্নের বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
(১). আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর স্বীয় সুস্পষ্ট কিতাবে যা এসেছ, কোন (زِيادَةٍ), বাড়তি, (نَقْصٍ) কমতি,
ও (تَحْرِيفٍ) বিকৃতি করা ছাড়াই আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী অর্থে তার উপর ঈমান আনা।
(২). রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পক্ষ থেকে তাঁর স্বীয় হাদীসে যা এসেছে, কোন (زِيادَةٍ), বাড়তি, (نَقْصٍ) কমতি,
ও (تَحْرِيفٍ) বিকৃতি করা ছাড়াই রাসূল (ﷺ) এর উদ্দেশ্য অনুযায়ী অর্থে তার উপর ঈমান আনা।
.
এই বক্তব্যে তাওয়ীলপন্থী (আল্লাহর গুণাবলীতে ভুল ব্যাখ্যা আরোপকারীগণ) এবং তামসীলপন্থীদের (আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা ব্যক্তিগণ) বিরুদ্ধে খণ্ডন রয়েছে; কারণ এদের কেউই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যা এসেছে, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ঈমান আনেনি। বরং তাওয়ীলপন্থীরা কমিয়ে দিয়েছে (অর্থাৎ আল্লাহর গুণাবলীর প্রকৃত অর্থ বিকৃত করেছে), আর তামসীলপন্থীরা বাড়িয়ে দিয়েছে (অর্থাৎ আল্লাহর গুণাবলীর সাথে সৃষ্টির সাদৃশ্য স্থাপন করেছে)।”(ইবনু উসাইমীন; শারহু লুমআতিল ই’তিকাদ: https://www.afaqattaiseer.net/…/showthread.phpt=300&utm…)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ডের বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতী প্রথিতযশা মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৬২ হি./১৯৪৩ খ্রি.] বলেছেন:
كلامُ الإمامِ الشَّافعيِّ واضحٌ ، وقد استدلَّ به المؤوِّلةُ ؛ بأنَّ الشَّافعيَّ – رحمَهُ اللهُ – لا يعلم معانيَ تلك الآياتِ والأحاديثِِ الَّتي في الصِّفاتِ فقال : (آمنت باللهِ وبما جاء عن اللهِ على مرادِ اللهِ، وآمنت برسولِ اللهِ – صلى اللهُ عليه وسلم – وما جاء عن رسولِ اللهِ على مرادِ رسولِ اللهِ صلَّى الله عليه وسلَّم ) .
فقالوا : هذا يعني أنَّه أحالَ المعنى على مرادِ من تكلَّم به ، وهذا يدلُّ على أنَّهُ لم يفهمِ المعنى ؛ وهو الإمامُ الشَّافعيُّ .
والجوابُ : أنَّه لم يُردْ ذلك ، وإنَّما هذا إيمان مجمل ، فنحنُ نقول كما قال الإمامُ الشَّافعيُّ : (آمنَّا باللهِ، وبما جاء عن اللهِ، فيما علمنا وما لم نعلمْ، على مرادِ الله) هذا يقتضي تمامَ التَّسليمِ وتمامَ الامتثالِ لما أُمرْنا به، كذلك آمنَّا برسولِ اللهِ – صلى اللهُ عليهِ وسلم – وبما جاء عن رسولِ اللهِ – صلى اللهُ عليهِ وسلم – على مرادِ رسولِ اللهِ -صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ- ما علمنا من النُّصوصِ وما لم نعلمْ .
فهذا إيمانٌ مجملٌ ، معناه أنَّنَا لا نتركُ شيئا ممَّا جاء عن اللهِ ولا عن رسولِ الله -صلَّى الله عليه وسلَّم- إلا ونحن مؤمنون به ، ما علمنا منه وما لم نعلمْ ، كلٌّ من عندِ ربِّنَا .
والشَّافعيّ – رحمه اللهُ – قال هذه الكلمةَ اتِّباعاً لما أمر اللهُ – جلَّ وعلا – به في كتابه ؛ حيثُ قال: {والرَّاسخون في العلمِ يقولونَ آمنَّا به كلٌّ من عندِ ربِّنَا} فما علمنا معناه واضحٌ الإيمانُ به ، وما جهلنا معناه واشتبَهَ علينا نقولُ : آمنَّا به على مرادِ ربِّنا – جلَّ وعلا – وعلى مرادِ رسولِنَا – صلَّى اللهُ عليه وسلَّم – حتَّى نسألَ فيه أهلَ العلمِ ، فإذا سألنا فيه أهلَ العلمِ وبيَّنُوا لنا معاني الكتابِ والسّنَّةِ ، هنا نعتقدُ المعنى كما نعتقدُ في الألفاظِ.
“ইমাম শাফি‘ঈর বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার।কিন্তু কিছু মুআওয়্যিলা (অর্থবিকৃতিকারী) তাঁর এই বক্তব্যকে দলীল হিসেবে পেশ করেছে যে, ইমাম আশ শাফি‘ঈ সিফাতসংক্রান্ত সেসব আয়াত ও হাদীস্ত্রের অর্থ জানতেন না। একারণেই তিনি (শাফি‘ঈ) বলেছেন,”আমি আল্লাহর উপর এবং যা কিছু আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে তাতে আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী অর্থের উপরে ঈমান আনলাম। আমি আল্লাহর রাসূলের এবং যা কিছু তাঁর পক্ষ হতে এসেছে তাতে আল্লাহর রাসূলের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অর্থের উপরে ঈমান আনলাম।” তারা (আহলুত-তা’উইল) বলেছে: এ কথার অর্থ হলো, তিনি (ইমাম শাফি‘ঈ)-এর অর্থ আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন এটা প্রমাণ করে যে, তিনি (শাফি‘ঈ) অর্থ বুঝতে পারেননি। অথচ তিনি ইমাম শাফি‘ঈ! এর জবাব হলো, তিনি (ইমাম শাফি‘ঈ) এমনটি উদ্দেশ্য করেননি। বরং এটিই ঈমান মুজমাল (إیمان مُجْمَل) তথা সাধারণ ঈমান। অতএব ইমাম শাফি‘ঈর মত আমরাও বলি, আমরা আল্লাহর উপর ও তাঁর পক্ষ যা এসেছে তাতে ঈমান এনেছি। যা আমরা জেনেছি ও যা জানতে পারিনি সকলটুকুতেই। আর তা আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী। এটিই পূর্ণাংগ আত্মসমর্পনকে নির্দেশ করে। তেমনি নির্দেশ করে আমাদের প্রতি আদেশকৃত বিষয়ে পূর্ণাংগ অনুসরণকে। একইরূপে আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর রাসূল ও তাঁর পক্ষ যা এসেছে তার উপর। আর তা রাসূলুল্লাহ এ এর উদ্দেশ্য অনুযায়ী। এসবের যা কিছু আমরা নস (আয়াত-হাদীস) তথা ভাষ্যে জানতে পেরেছি অথবা যা জানতে পারিনি, সব ক্ষেত্রেই। এটিই ঈমান মুজমাল তথা সাধারণ ঈমান। এর অর্থ হচ্ছে: আমরা আল্লাহ হতে ও আল্লাহর রাসুল হতে যা কিছু এসেছে, এসবের যা কিছু আমরা জানি বা যা কিছু জানিনা, তার কোন কিছুতেই ঈমান না এনে উল্টো তরক করব না।ইমাম শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এই বক্তব্যটি দিয়েছেন—আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর কিতাবে যে আদেশ দিয়েছেন তা অনুসরণ করে। যেমন আল্লাহ বলেন:(وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِۦ كُلٌّۭ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا)”আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, আমরা এগুলোতে ঈমান রাখি, সবই আমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে।”(সূরা আলে ইমরান: ৩/৭) সুতরাং যার অর্থ আমরা জানি, তাতে আমাদের ঈমান সুস্পষ্ট। আর যার অর্থ আমাদের কাছে অজ্ঞাত ও যার অর্থ নিয়ে সংশয় রয়েছে, সেক্ষেত্রে আমরা বলি, আমরা এতে ঈমান এনেছি আমাদের রব জাল্লা ওয়া আলা এর উদ্দেশ্য অনুযায়ী ও আমাদের রাসূল এর উদ্দেশ্য অনুযায়ী। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা আহলুল ইলম তথা আলেমদের কাছ থেকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন না করি। সুতরাং যদি এ সম্পর্কে আমরা আহলুল ইলমকে জিজ্ঞেস করি ও তাঁরা আমাদের আল কিতাব ও সুন্নাহর অর্থ ব্যাখ্যা করে দেন, তখন আমরা এর অর্থ ঠিক সেভাবে বিশ্বাস করি, যেভাবে এর শব্দমালা এসেছে।”(সালিহ বিন আবদিল আযীয বিন মুহাম্মাদ আলুশ শায়খ, শারহু লুমআতিল ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা: ৪২-৪৩)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! আকীদা ও ঈমানের ক্ষেত্রে সঠিক পথ অনুসরণের প্রকৃত রূপ এই যে একজন মু’মিনের কর্তব্য হলো, সে আল্লাহ তা’আলার প্রতি এবং বিশুদ্ধ দলিলের পভিত্তিতে তাঁর পক্ষ থেকে আগত প্রতিটি বিষয়ে নির্ভেজাল ও পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করবে যেভাবে তা বুঝেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবায়ে কিরাম, এবং তাঁদের অনুগামী সৎ পূর্বসূরি সালাফগণ। এই বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বিকৃতি, বাড়াবাড়ি, কল্পনাপ্রসূত ব্যাখ্যা কিংবা মনগড়া মতামতের স্থান নেই। বরং আল্লাহ যেভাবে তা বোঝাতে চেয়েছেন, সেভাবেই সরলতা ও বিনয় সহকারে, নির্ভেজালভাবে তা গ্রহণ করাই হচ্ছে প্রকৃত ঈমানের দাবি। তদ্রূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান এবং তাঁর পক্ষ থেকে আগত প্রতিটি সত্য বাণী বিশেষ করে সহীহ হাদীসসমূহ যেগুলোর মধ্যে আকীদাসংক্রান্ত বিষয়াবলিও রয়েছে সেগুলোও গ্রহণ করতে হবে পূর্ণ ঈমান ও অনুগত্যের সাথে। যেভাবে তা বুঝিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং যেভাবে বুঝেছেন তাঁর সাহাবায়ে কিরাম এবং তাঁদের অনুগামী সৎ পূর্বসূরি সালাফগণ। এক্ষেত্রে নিজস্ব যুক্তি, অনুমান বা ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা দ্বারা নয়; বরং সম্পূর্ণরূপে নববী ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করেই ঈমানকে শুদ্ধ, সঠিক ও মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment