Friday, June 20, 2025

কুরবানির দিনে কুরবানির পশু জবাই হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু না খেয়ে থাকা সুন্নত

 প্রশ্ন: কুরবানির দিনে কুরবানির পশু জবাই হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু না খেয়ে থাকার কি কোনো নিয়ম আছে? থাকলে এটি কার জন্য প্রযোজ্য?

▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর ঈদুল আজহার দিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানা খেতেন না, যতক্ষণ না তিনি ঈদগাহ থেকে ফিরে আসতেন, অতঃপর তিনি কুরবানি গোস্ত থেকে ভক্ষণ করতেন। মুসলিম উম্মার জন্য সুন্নত হল ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা। আর ঈদুল আযহা-তে ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির মাংস খাওয়া সুন্নত।দলিল হচ্ছে:দলিল হচ্ছে; বুরায়দা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الفِطْرِ حَتَّى يَطْعَمَ وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ الأَضْحَى حَتَّى يُصَلِّيَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে বের হতেন না। এবং ঈদুল আযহার দিন সালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছু খেতেন না”।(তিরমিযী হা/৫৪২; ইবনু মাজাহ হা/১৭৫৬;সহীহ ইবনু হিব্বান হা/২৮১২; সহীহ আল জামি হা/৪৮৪৫) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ﷺ) ঈদুল ফিৎরের দিন কিছু না খেয়ে বের হ’তেন না। আর ঈদুল আযহার দিনে কুরবানী না করে কিছু খেতেন না”(মুসনাদে আহমাদ হা/২১৯৬৪, সনদ হাসান) অপর বর্ণনায় আছে,.…তিনি (ﷺ) ঈদুল আযহার দিন খেতেন না (পশু) যবেহ না করা পর্যন্ত”।(সহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৪২৬; বায়হাক্বী হা/৫৯৫৪; সহীহুল জামে‘, হা/৪৮৪৫, সনদ সহীহ)। অবশ্য কুরবানীর গোশত দিয়ে খাওয়া উত্তম। কেননা বিদায় হজ্জের দিন তিনি ১০০টি উটের প্রতিটি থেকে একটু করে অংশ নিয়ে এক পাত্রে রান্না করে সেখান থেকে গোশত খেয়েছিলেন ও ঝোল পান করেছিলেন (সহীহ মুসলিম, হা/৩০০৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৭৪; মিশকাত, হা/২৫৫৫)।
.
উপরোক্ত হাদীসসমূহ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সুন্নাহ অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের দিনে সালাতের আগে কিছু খেয়ে নেওয়া উচিত, আর ঈদুল আযহার দিনে সালাতের পরেই আহার করা উত্তম। ঈদুল আযহায় দেরিতে খাওয়ার পেছনে হিকমত এই যে, এ দিন কুরবানীর মাধ্যমে দিনের সূচনা করা হয় এবং কুরবানীর গোশত দিয়েই খাবার গ্রহন করা উত্তম বলে গণ্য হয়। যাইন ইবনু মুনীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”দু’টি ঈদেরই নির্ধারিত সদাক্বাহ রয়েছে ঈদুল ফিতরের সদাক্বাহ ঈদগাহে যাওয়ার আগে আদায় করতে হয়, আর ঈদুল আযহার সদাক্বাহ হল কুরবানীর পশু জবেহ করার পরের ইবাদত।”(মিশকাতুল মাসাবিহ হা/১৪৪০ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
▪প্রশ্ন হচ্ছে, ঈদুল আযহার দিনে কুরবানির আগে না খেয়ে থাকা এবং কুরবানির গোশত দিয়ে প্রথম আহার করার সুন্নাহ কি কেবল কুরবানিদাতার জন্য নাকি সকল মুসলমানের জন্যই প্রযোজ্য? আর কখন থেকে খাওয়া থেকে বিরত থাকা সুন্নত?
.
এই প্রশ্নের জবাবে আলেমগন বলেছেন: হাদীসের বক্তব্য থেকে যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় তা হলো—এটি মূলত কেবল সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য প্রযোজ্য, যিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজ ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানীর ইচ্ছা পোষণ করেছেন। অন্য কারো ক্ষেত্রে এটি বাধ্যতামূলক নয়। অতএব,যারা কুরবানি দেওয়ার পরিকল্পনা করেননি, তারা চাইলে ঈদের সালাতের আগে খাবার গ্রহণ করতে পারেন কিংবা ইচ্ছা হলে তা থেকে বিরতও থাকতে পারেন উভয় অবস্থাই বৈধ।পাশাপাশি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার সময় সম্পর্কে আলেমগন বলেছেন; কুরবানি দাতার জন্য মুস্তাহাব (সুন্নাত) হচ্ছে ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর কোনো কিছু না খেয়ে ঈদের নামাজ আদায় করা, এরপর কুরবানি সম্পন্ন করে নিজের কুরবানির গোশত দিয়ে প্রথম আহার করা। এটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আমল দ্বারা প্রমাণিত।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেন,قال أحمد: والأضحى لا يأكل فيه حتى يرجع إذا كان له ذبح، لأن النبي صلى الله عليه وسلم أكل من ذبيحته، وإذا لم يكن له ذبح لم يبال أن يأكل. ا “ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,যার কুরবানী রয়েছে সে ফিরে আসার পর খাবে কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাবাহকৃত গোশত খেয়েছেন ফিরে আসার পর। আর যার কুরবানী নেই তার খাওয়াতে বাধা নেই।”(ইবনু কুদামাহ আল মুগনী; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২২৮; ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৫৮৩২৬)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:يُستحب أن لا يأكل يوم الأضحى حتى يصلي، فإن كان له أضحية، أكل منها”ইদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের পূর্বে কিছু না খাওয়া সুন্নত হিসেবে বিবেচিত হয়। আর যার কুরবানির পশু আছে, তার জন্য উত্তম হলো কুরবানির পর সেই পশুর গোশত থেকে আহার করা।”(ইমাম নববী; আল-মাজমু; খন্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৬)।
.
শাফেয়ি মাযহাবের আলেম ইবনে হাজার হাইতামি (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর তুহফাতুল মুহতাজ নামক গ্রন্থে বলেন:“ويُستحب لمن له أضحية أن لا يأكل يوم الأضحى حتى يأكل من أضحيته، أما من لا أضحية له فله الأكل.”যার কুরবানির পশু রয়েছে, তার জন্য সুন্নত হলো ঈদুল আযহার দিন কুরবানির আগে কিছু না খাওয়া, বরং কুরবানির পশু থেকে খেয়ে ঈদের খাবার শুরু করা। আর যার কুরবানি নেই,তার জন্য খাওয়া-দাওয়ায় কোনো বাধা নেই।”(তুহফাতুল মুহতাজ খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ৬০) ভারতবর্ষের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, সুনানুত তিরমিযীর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী’র সম্মানিত মুসান্নিফ (লেখক), আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ ‘আব্দুর রহমান বিন আব্দুর রহীম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থে এবং ইমাম যাইলাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাবঈনুল হাকায়েক গ্রন্থে একই মত দিয়েছেন।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, ঈদুল আজহার দিনে ফজরের পর খাবার গ্রহণ করা নিষিদ্ধ নয়। তবে যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা হবে, তাদের জন্য কুরবানির পূর্বে না খাওয়াই উত্তম, কারণ এটি প্রিয় নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সুন্নাহ। অন্যদের জন্য এই বিষয়ে শিথিলতা রয়েছে তারা চাইলে আহার করতে পারে, কিংবা ইচ্ছা হলে বিরতও থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও, মুসলিমদের উচিত এ পবিত্র ও বরকতময় দিনগুলোতে নবীজীর সুন্নাহ সর্বোচ্চভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করা। কারণ, তাঁর আদর্শেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত কল্যাণ ও চূড়ান্ত সফলতা। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate