Friday, June 20, 2025

কুরবানির জন্য একটি পশুতে সর্বোচ্চ কতটি পরিবার অংশীদার হতে পারে এবং মহিষ কুরবানি করা কি জায়েজ

প্রশ্ন: কুরবানির জন্য একটি পশুতে সর্বোচ্চ কতটি পরিবার অংশীদার হতে পারে? মহিষ কুরবানি করা কি জায়েজ?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর প্রথমেই জানা উচিত, কুরবানির উপযোগী কোন কোন পশু এবং তাদের নির্ধারিত বয়স কত হতে হবে:
.
কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট পশু হচ্ছে ‘আনআম’ শ্রেণীর চতুষ্পদ জন্তু। আনআম হচ্ছে উট, গরু, ছাগল, দুম্বা বা মেষ এগুলো না পেলে সর্বশেষ অপশন হিসেবে মহিষ। কুরবানী করার জন্য পশুর মধ্যে সর্বোত্তম হলো প্রথমেই উট, তারপর গরু যদি কেউ গোটা উট বা গোটা গরু দিয়ে কুরবানী করে। তারপর ভেড়া। তারপর ছাগল। তারপর উটের সাতভাগের একভাগ। তারপর গরুর সাতভাগের একভাগ”। মহান আল্লাহ বলেন:وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ)الحج “আর আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য ‘মানসাক’ এর নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ ‘আনআম’ শ্রেণীর যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন,সে সবের উপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৩৪] আয়াতে بهيمة الأنعام (বাহিমাতুল আনআম) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- উট, গরু, ভেড়া ও ছাগল। আরবদের কাছে بهيمة الأنعام এর এ অর্থই পরিচিত। এটি হাসান, কাতাদা ও আরও অনেকের অভিমত।শরিয়ত নির্ধারিত বয়সে পৌঁছা। ভেড়া হলে ‘জাযআ’ হওয়া (অর্থাৎ ছয়মাস পূর্ণ হওয়া)। আর অন্য শ্রেণীর হলে ‘সানিয়্যা’ হওয়া (অর্থাৎ এক বছর পূর্ণ হওয়া)। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমরা মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হওয়া ছাড়া কোন প্রাণী জবাই করবে না। তবে তোমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেলে ছয় মাস বয়সী ভেড়া জবাই করতে পারো”।[সহিহ মুসলিম] মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হচ্ছে- ‘সানিয়্যা’ ও ‘সানিয়্যা’ এর চেয়ে বেশি বয়স্ক পশু। আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- ‘সানিয়্যা’ চেয়ে কম বয়স্ক পশু।উটের ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ হচ্ছে- যে উটের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। গরুর ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ হচ্ছে- যে গরুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ হচ্ছে- যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- যে পশুর ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং উট,গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কুরবানী শুদ্ধ হবে না। আর ভেড়ার ক্ষেত্রে ‘জাযআ’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কুরবানী হবে না।”(দেখুন: ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৩৭৬; শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন এর ‘আহকামুল উযহিয়্যাহ ও যাকাত’ শীর্ষক পুস্তিকা থেকে। আরো জানতে দেখুন: ইবনু কাসীর,খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৬৬; ফাতহুল কাদীর, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৫৩১)।
.
▪️এবার আমরা জানার চেষ্টা করবো অংশীদারী কুরবানি দেওয়া জায়েজ কিনা এবং একটি পশুতে সর্বোচ্চ কতটি পরিবার অংশীদার হতে পারে:
.
মুক্বীম-মুসাফির সর্বাবস্থায় উট ও গরুতে শরিক হওয়া নাবী ﷺ এর একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস এবং ন্যায়নিষ্ঠ সালাফগণের মহামূল্যবান বাণী ও ফাতাওয়া দ্বারা প্রমাণিত ও সুসাব্যস্ত। এ ব্যাপারে সরাসরি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস নিম্নরূপ:
.
(১). ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فِي سَفَرٍ فَحَضَرَ الأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِي الْجَزُورِ عَنْ عَشَرَةٍ وَالَبَقَرَةِ عَنْ سَبْعَةٍ “আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ছিলাম। ইতোমধ্যে কুরবানির ঈদ এসে গেল। আমরা একটি উট দশজনে এবং একটি গরু সাতজনে শরিক হয়ে কুরবানি করলাম।” [তিরমিযী, হা/৯০৫; নাসাঈ, হা/৪৩৯২; ইবনু মাজাহ, হা/৩১৩১; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]
.
(২). জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, نَحَرْنَا بِالْحُدَيْبِيَةِ مَعَ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ “আমরা হুদাইবিয়াহ নামক স্থানে নাবী ﷺ এর সাথে একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে এবং একটি গরুও সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছি।” [সাহীহ মুসলিম, হা/১৩১৮; আবূ দাউদ, হা/২৮০৯; তিরমিযী, হা/৯০৪, ১৫০২, নাসাঈ, হা/৪৩৮৩; ইবনু মাজাহ, হা/৩১৩২]
.
(৩). জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنَّا نَتَمَتَّعُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِالْعُمْرَةِ فَنَذْبَحُ الْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ نَشْتَرِكُ فِيهَا “আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে তামাত্তু‘ হজ করেছি। তখন আমরা সাত শরিকে মিলে একটি গরু কুরবানি করেছি।” [সাহীহ মুসলিম, হা/১৩১৮; শেষোক্ত হাদীস দুটি একই নম্বরের আওতায় বর্ণিত হয়েছে, শাইখ ফুআদ ‘আব্দুল বাক্বী’র তারক্বীম (নাম্বারিং) অনুযায়ী] কেউ কেউ কুরবানিতে শরিক হওয়া সফর ও হজের সাথে খাস (নির্দিষ্ট) করেছেন। কারণ উপরিউক্ত হাদীসগুলোতে শুধু সফরের কথা এসেছে। আমরা বলি, তাদের এই খাসকরণের পিছনে কোনো দলিল নেই। এই খাসকরণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, উদ্ভট এবং দলিলবিহীন। এর কারণ হচ্ছে, প্রথমত উপরিউক্ত হাদীসগুলো বা শরিকানা কুরবানি সংক্রান্ত অন্যান্য হাদীসগুলোর মধ্যে কোনো একটি হাদীসেও বলা হয়নি যে, মুক্বীম অবস্থায় কুরবানিতে শরিক হওয়া বৈধ নয়। একবারও এ কথা বলা হয়নি যে, শরিকানা কুরবানি শুধুমাত্র সফরের সাথেই খাস। দ্বিতীয়ত সম্মানিত মুহাদ্দিসগণ যেভাবে কুরবানি অধ্যায়ে হাদীসগুলো এনেছেন; এ থেকেও বুঝা যায় যে, তাঁরা ওই সব হাদীসকে সফরের সাথে খাস হওয়া বুঝেননি। এটা সুবিদিত যে, মুহাদ্দিসগণ তাঁদের হাদীস গ্রন্থে যেসব বাব তথা অনুচ্ছেদ রচনা করেন, সেটাই তাঁদের ফিক্বহ (বুঝ)। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মুহাদ্দিসগণের কুরবানি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ দেখুন)। ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থে বলেন:والأضحية للمسافر كما هي للمقيم ولا فرق, وكذلك المرأة ؛ لقول الله تعالى: ( وَافْعَلُوا الْخَيْرَ) والأضحية فعل خير ، وكل من ذكرنا محتاج إلى فعل الخير مندوب إليه , ولما ذكرنا من قول رسول الله صلى الله عليه وسلم في التضحية ولم يخص عليه السلام بادياً من حاضر, ولا مسافراً من مقيم , ولا ذكراً من أنثى , فتخصيص شيء من ذلك باطل لا يجوز“কুরবানির বিধান মুকীমের জন্যে যেমন মুসাফিরের জন্যেও তেমন; কোন পার্থক্য নেই। নারীর জন্যেও তেমন। যেহেতু আল্লাহ্‌ বলেছেন: “তোমরা ভালো কাজ করো”।[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৭৭] কুরবানি করা ভালো কাজ। আমরা যাদের কথা উল্লেখ করলাম তারা প্রত্যেকে ভাল কাজের মুখাপেক্ষী ও সেদিকে আহুত। এবং যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরবানি সংক্রান্ত যে বাণীগুলো আমরা উল্লেখ করেছি সেগুলোতে তিনি শহরবাসী থেকে গ্রামবাসীকে খাস করেননি; মুকীম থেকে মুসাফিরকে খাস করেননি; নারী থেকে পুরুষকে খাস করেননি। এ কারণে কাউকে খাস করা বাতিল ও নাজায়েয।”(সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত ইবনু হাযম আল-মুহাল্লা’ খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩৭) সুতরাং মাসালাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি পরিত্যাজ্য।
.
▪️এবার আমরা জানান চেষ্টা করবো একটি পশুতে সর্বোচ্চ কতটি পরিবার অংশীদার হতে পারে:
(১). ছাগল দুম্বা বা মেষ:
.
এটা সর্বজনবিদিত যে, ছাগল, দুম্বা বা মেষে শরিক কুরবানি বৈধ নয়। বরং কুরবানীর পশু হিসেবে একটি ছাগল, দুম্বা কিংবা মেষ ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে, তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এবং যত মুসলমানের পক্ষ থেকে নিয়ত করে সবার পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। দলিল হচ্ছে আয়েশা (রাঃ) এর হাদিস, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন একটি মেষ আনার নির্দেশ দিলেন যেটির পায়ের রঙ কালো, পেটের রঙ কালো, চোখের রঙ কালো। নির্দেশ অনুযায়ী কোরবানীর জন্য মেষটি আনা হল। তখন তিনি আয়েশা (রাঃ) কে বললেন: হে আয়েশা! তুমি ছুরিটি নিয়ে আসো(অর্থাৎ আমাকে ছুরিটি দাও)। তিনি ছুরিটি নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছুরিটি এবং মেষটিকেও নিলেন। এরপর মেষটিকে শুইয়ে দিয়ে জবাই করলেন (অর্থাৎ জবাই করার প্রস্তুতি নিলেন)। এরপর বললেন: বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ! এটি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং উম্মতে মুহাম্মদীর পক্ষ থেকে কবুল করুন। অতঃপর তিনি সে মেষটি কুরবানী করলেন।[সহিহ মুসলিম] অপর বর্ননায় আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লামের যামানায় একজন ব্যক্তি একটি ছাগল দিয়ে নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দিতো। নিজেরা খেত এবং অন্যদেরকেও খাওয়াত।”।(সুনানে ইবনে মাজাহ ও সুনানে তিরমিযি; তিরমিযি হাদিসটিকে ‘সহিহ’ বলেছেন। আলবানী সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে হা/১২১৬) হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন) অতএব, কোনো লোক যদি একটি ছাগল কিংবা একটি ভেড়া দিয়ে কুরবানী দেয় তাহলে সেটা তার নিজের পক্ষ থেকে, তার পরিবারের মৃত বা জীবিত যত সদস্যদের পক্ষ থেকে নিয়ত করে সকলের পক্ষ থেকে জায়েয হবে। যদি আমভাবে বা খাসভাবে কোনো নিয়ত না করে তাহলে ‘আহলে বাইত’ বা পরিবার বলতে মানুষের ব্যবহারে যাদেরকে বুঝায় কিংবা ভাষাগতভাবে যাদেরকে বুঝায় তারা সকলে এর অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রথাগতভাবে ব্যক্তি যাদের ভরণপোষণ করে স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন তাদেরকে পরিবার বলে। আভিধানিক অর্থে পরিবার বলতে ব্যক্তির সেসব আত্মীয়দেরকে বুঝায় যারা তার নিজের বংশধর, তার পিতার বংশধর, তার দাদার বংশধর কিংবা তার প্রপিতামহের বংশধর। জেনে রাখা ভাল,দুই বা ততোধিক (পরিবার) ব্যক্তি একটি মেষ ক্রয়ে অংশীদার হয়ে সবার পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া জায়েয নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাতে এই মর্মে কিছু উদ্ধৃত হয়নি।(বিস্তারিত দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৩৮৭)
.
▪️(২). উট, গরুতে অংশীদার:
.
একটি পশু একটি পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি দেওয়া অধিক উত্তম। তদ্রূপ একটি গরু বা উটে দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় সর্বোচ্চ সাতজন ব্যক্তি কিংবা সমসংখ্যক পরিবার শরিক হয়ে কুরবানি আদায় করাও বৈধ।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:يجوز أن يشترك سبعة في بدنة أو بقرة للتضحية ، سواء كانوا كلهم أهل بيت واحد أو متفرقين ، أو بعضهم يريد اللحم ، فيجزئ عن المتقرب ، وسواء أكان أضحية منذورة أم تطوعا ، هذا مذهبنا وبه قال أحمد وجماهير العلماء”কুরবানী দেয়ার জন্য একটি উটে কিংবা একটি গরুতে সাতজন অংশীদার হওয়া জায়েয। হোক অংশীদারেরা সকলে একই বাড়ীর লোক কিংবা ভিন্ন ভিন্ন বাড়ীর লোক। কিংবা তাদের কারো কারো উদ্দেশ্য হয় শুধু গোশত সেক্ষেত্রেও কুরবানীকারীর পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। হোক না সে কুরবানীটা মানতের কুরবানী কিংবা নফল কুরবানী। এটাই আমাদের মাযহাব। এটা ইমাম আহমাদ ও জমহুর আলেমের অভিমত।”(ইমাম নববী; ‘আল-মাজমু’ খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৭২)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,وتجزئ البدنة عن سبعة ، وكذلك البقرة ، وهذا قول أكثر أهل العلم . . ثم ذكر بعض الأحاديث الدالة على هذا ، ثم قال :”إذا ثبت هذا ، فسواء كان المشتركون من أهل بيت ، أو لم يكونوا ، مفترضين أو متطوعين ، أو كان بعضهم يريد القربة ، وبعضهم يريد اللحم ; لأن كل إنسان منهم إنما يجزئ عنه نصيبه ، فلا تضره نية غيره”একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। অনুরূপভাবে একটি গরুও। এটি অধিকাংশ আলেমের অভিমত। এরপর তিনি এ অভিমতের সপক্ষে কিছু হাদিস উল্লেখ করেন। অতঃপর বলেন: “এটা যখন সাব্যস্ত হল তখন এতে কোন সমস্যা নেই যে, অংশীদারগণ সবাই একই বাড়ীর হোক কিংবা না হোক। অংশীদারগণ সকলেই ফরয কুরবানী আদায়কারী হোক কিংবা নফল কুরবানী আদায়কারী হোক। অংশীদারদের কেউ কেউ আল্লাহ্‌র নৈকট্যের উদ্দেশ্য কুরবান করুন কিংবা কেউ কেউ শুধু গোশতের জন্য পশু জবাই করুক। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার অংশই আদায় হবে। অন্যের নিয়ত তার কোন ক্ষতি করবে না।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনি’ খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৬৩)।
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,فإذا كان الإنسان يضحي بالواحدة عنه و عن أهل بيته، فإنه بالسبع يضحي عنه و عن أهل بيته؛ لأن هذا تشريك في الثواب، والتشريك في الثواب لا حصر له، وها هو النبي صلى الله عليه وسلم ضحي عن كل أمته، وها هو الرجل يضحي بالشاة الواحدة عنه و عن أهل بيته، و لو كانوا ماءة، أما التشريك في الملك فلا يزيد علي سبعة، فلو اشترك ثمانية في بعير قلنا: لا يجوز، فلا بدّ أن يخرج واحد منكم، فإن رضي واحد منهم أن يخرج فهو هو المطلوب، و إلا فالأخير هو الخارج، و إن لم يعلم الأخير فالقرعة، لكن لو ذبحوها فبانوا ثمانية فماذا يصنعون؟ قيل: يذبحون شاة واحدة لتكمل للثامن، ويحتمل أن يقال: يقترعون فمن خرج بالقرعة خرج و ذبح شاة وحده.فالبدنة و البقرة هل تجزءان عن سبعة رجال أو تجزءان عن سبع شياه؟ الجواب: الثاني، فإذا قلنا بالثاني قلنا: إذا كانت الشاة تجزئ عن الرجل و عن أهل بيته في الثواب، و كذلك يجزئ سبع البدنة و سبع البقرة عنه و عن أهل بيته.“মানুষ যেহেতু নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি গরু বা উট কুরবানি দিতে পারে, সেহেতু নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে তার সপ্তমাংশও কুরবানি দিতে পারবে। এটা হলো সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার করা (শরিক করা)। আর সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার করার মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। এই তো নাবী ﷺ, যিনি তাঁর সকল উম্মতের তরফ থেকে কুরবানি দিয়েছেন। আর একজন ব্যক্তিও তাঁর নিজের তরফ থেকে এবং নিজের পরিবারের তরফ থেকে একটি বকরি কুরবানি দিতে পারবে, যদিও তাদের (পরিবারের সদস্যদের) সংখ্যা একশ পর্যন্ত পৌঁছে। পক্ষান্তরে মালিকানার ক্ষেত্রে সাতজনের বেশি অংশীদার করা (শরিক করা) যাবে না। সুতরাং একটি উটে যদি আটজন শরিক হয়, তবে আমরা বলব, এটা জায়েজ নয়; অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে বের হতে হবে। অতএব তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি বের হতে রাজি হয়, তাহলে সেটাই ভালো ও কাঙ্ক্ষিত। নতুবা সবার শেষে যে এসেছে, সে বেরিয়ে যাবে। আর সবার শেষে কে এসেছে, তা যদি না জানা যায়, তাহলে লটারি করতে হবে। কিন্তু তারা যদি জবেহ করে ফেলে, আর আটজনই পৃথক হয়ে যায়। তাহলে তারা কী করবে? বলা হয়ে থাকে, তারা অষ্টমজনের জন্য একটি ছাগল জবেহ করবে। আবার এটাও বলা যায় যে, তারা লটারি করবে। আর লটারির মাধ্যমে যে নির্বাচিত হবে, সে বের হয়ে যাবে এবং নিজের তরফ থেকে একটি ছাগল কুরবানি করবে।এখন কথা হলো, উট ও গরু কি সাতজন ব্যক্তির তরফ থেকে যথেষ্ট হবে, না কি সাতটি বকরির স্থলে যথেষ্ট হবে? উত্তর: দ্বিতীয়টি (সঠিক)। আমরা যখন দ্বিতীয়টির কথা বলছি, তখন আমরা এটা বলছি যে, একটি বকরি যেমন সওয়াবের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়, ঠিক তেমনিভাবে উট ও গরুর এক সপ্তমাংশও একজন ব্যক্তি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে।”(ইমাম ইবনু উসাইমীন; আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৪২৮) জেনে রাখা ভালো যে,আট বা ততোধিক ব্যক্তি একটি উট কিংবা একটি গরুতে অংশীদার হওয়া জায়েয নেই। কেননা ইবাদতগুলো তাওকিফিয়্যা (দলিলের সীমায় বিধান সীমাবদ্ধ এমন)। এগুলোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না; সেটা সংখ্যাগত সীমা হোক কিংবা পদ্ধতিগত সীমা হোক। তবে, সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার করা যেতে পারে। যেমন সওয়াবের ক্ষেত্রে অগণিত মানুষকে অংশীদার করার কথা উল্লেখ আছে।
.
▪️এমনকি একটি একটি গরু বা উটে সাতের কম অংশীদার হওয়া বৈধ:
.
যেহেতু এক গরুতে সাতজন অংশীদার হওয়া জায়েয সুতরাং সাতজনের চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ অংশীদার হওয়া আরও অধিক যুক্তিযুক্তভাবে জায়েয এবং অতিরিক্ত ভাগ নেয়ার জন্য তারা নফল আমলকারী হিসেবে গণ্য হবেন। যেমন কোনো ব্যক্তি একাই যদি একটি গরু কুরবানী করেন তার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে; অথচ তার জন্য একটি বকরী কুরবানী করাই যথেষ্ট।
.
শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৫০ হি: মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন,”وإذا كانوا أقل من سبعة أجزأت عنهم، وهم متطوعون بالفضل، كما تجزي الجزور (البعير) عمن لزمته شاة، ويكون متطوعا بفضلها عن الشاة“যদি তারা সংখ্যায় সাতের চেয়ে কম হন সেক্ষেত্রেও কুরবানীটি তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। অতিরিক্ত ভাগ বহন করার মাধ্যমে তারা নফল আমলকারী। যেমনিভাবে যে ব্যক্তির উপর বকরী কুরবানী করা আবশ্যক সে উট দিয়ে কুরবানী করলে আদায় হয়ে যায়। বকরীর চেয়ে বেশি কিছু কুরবানী দেয়ার মাধ্যমে সে ব্যক্তি নফল আমলকারী গণ্য হল।”(ইমাম শাফেয়ি আল-উম্ম’ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৪৪)।
.
অপর বর্ননায় কাসানী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘বাদায়েউস সানায়ে’ গ্রন্থে বলেন: وَلَا شَكَّ فِي جَوَازِ بَدَنَةٍ أَوْ بَقَرَةٍ عَنْ أَقَلَّ مِنْ سَبْعَةٍ، بِأَنْ اشْتَرَكَ اثْنَانِ أَوْ ثَلَاثَةٌ أَوْ أَرْبَعَةٌ أَوْ خَمْسَةٌ أَوْ سِتَّةٌ فِي بَدَنَةٍ أَوْ بَقَرَةٍ؛ لِأَنَّهُ لَمَّا جَازَ السُّبْعُ فَالزِّيَادَةُ أَوْلَى، وَسَوَاءٌ اتَّفَقَتْ الْأَنْصِبَاءُ فِي الْقَدْرِ أَوْ اخْتَلَفَتْ؛ بِأَنْ يَكُونَ لِأَحَدِهِمْ النِّصْفُ، وَلِلْآخَرِ الثُّلُثُ، وَلِآخَرَ السُّدُسُ، بَعْدَ أَنْ لَا يَنْقُصَ عَنْ السُّبْعِ“সাতজনের কম সংখ্যক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি উট বা একটি গরু (কুরবানীর জন্য) যথেষ্ট হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। উদাহরণত: দুইজন, তিনজন, চারজন, পাঁচজন বা ছয়জন যদি এক উটে কিংবা এক গরুতে অংশীদার হয়। কেননা এক সপ্তমাংশ ভাগ নেয়া যেহেতু জায়েয সুতরাং এর চেয়ে বেশি ভাগ নেয়া জায়েয হওয়া আরও বেশি যুক্তিযুক্ত; চাই এক্ষেত্রে সবার ভাগ সমান হোক কিংবা ভিন্ন ভিন্ন হোক। যেমন কারো ভাগ হলো অর্ধেক, কারো ভাগ হলো এক তৃতীয়াংশ, কারো ভাগ হলো এক ষষ্ঠাংশ; তবে এক সপ্তমাংশের চেয়ে কম যাতে না হয়।”(কাসানী ‘বাদায়েউস সানায়ে’ খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৭১)।
.
▪️সর্বশেষ মহিষ কোরবানির বিধান:
.
মহিষ কুরআনে আনআম শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত কিনা এবং মহিষ কুরবানী দেওয়া জায়েজ কিনা এই বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, একদল আলেম বলেছেন, মহিষ দ্বারা কুরবানী দেওয়া বৈধ নয়। কেননা শরীয়তে আন’আম শ্রেণীর পশু নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখিত যেমন: উট, গরু, ছাগল, ভেড়া, নর ও মাদী। সুতরাং মহিষ কুরবানি করা যাবেনা কেননা মহিষ উপরিউক্ত আট প্রকার গৃহপালিত জন্তুর অন্তর্ভুক্ত নয়। তাছাড়া রাসূল (ﷺ) কিংবা তার সাহাবীগন মহিষ দ্বারা কুরবানী করেছেন বলে বিশুদ্ধ সূত্র থেকে জানা যায়নি। তাদের এই প্রশ্নের জবাবে অপর পক্ষের আলেমগন বলেছেন, রাসূল ﷺ কিংবা তার সাহাবীদের থেকে মহিষ কুরবানীর দলিল নেই একথা ঠিক তাই বলে মহিষ কুরবানী দেওয়া জায়েজ নয় একথা সঠিক নয় বরং মহিষ ও গরু একই জাতির পশু সে হিসেবে মহিষ কুরবানী দিতে কোন আপত্তি নেই ইনশাআল্লাহ। আর রাসূল (ﷺ) থেকে মহিষ কুরবানীর দলিল না থাকার অন্যতম কারন হচ্ছে তৎকালীন সময়ে আরবদের কাছে এই পশুটি (মহিষ) পরিচিত ছিলনা। তাই মহিষের আলোচনা আসেনি যেমনটি ইমাম ইবনে উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া আহালুল আলেমগন এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, মহিষ ও গরু একই জাতীয় পশু। আর গরুর ন্যায় মহিষেরও যাকাত আদায় করা ফরজ।ইমাম মুনযেরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”ইজমা রয়েছে যে, মহিষের বিধান গরুর মতো”। (দ্রষ্টব্য: আল ইজমা, কিতাবুয যাকাত, পৃষ্ঠা: ৪৩) ।
.
শাইখুল ইসলাম হুজ্জাতুল উম্মাহ ইমামু দারিল হিজরাহ আবূ ‘আব্দুল্লাহ মালিক বিন আনাস আল-আসবাহী আল-মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ন:৯৩ হি: মৃত: ১৭৯ হি.] বলেছেন:-وَكَذَلِكَ الْبَقَرُ وَالْجَوَامِيسُ تُجْمَعُ فِي الصَّدَقَةِ عَلَى رَبِّهَا وَقَالَ إِنَّمَا هِيَ بَقَرٌ كُلُّهَا فَإِنْ كَانَتْ الْبَقَرُ هِيَ أَكْثَرَ مِنْ الْجَوَامِيسِ وَلَا تَجِبُ عَلَى رَبِّهَا إِلَّا بَقَرَةٌ وَاحِدَةٌ فَلْيَأْخُذْ مِنْ الْبَقَرِ صَدَقَتَهُمَا وَإِنْ كَانَتْ الْجَوَامِيسُ أَكْثَرَ فَلْيَأْخُذْ مِنْهَا فَإِنْ اسْتَوَتْ فَلْيَأْخُذْ مِنْ أَيَّتِهِمَا شَاءَ فَإِذَا وَجَبَتْ فِي ذَلِكَ الصَّدَقَةُ صُدِّقَ الصِّنْفَانِ جَمِيعًا.”অনুরূপভাবে গরু ও মহিষের যাকাতের ক্ষেত্রে তার মালিক উভয়কে এক জায়গায়/একত্রিত করে যাকাত আদায় করবে। এমনকি তিনি বলেন: এগুলোর প্রত্যেকটি/সবগুলোই মূলত গরুর অধীনস্থ/অন্তর্ভুক্ত।সুতরাং গরু যদি মহিষের চেয়ে বেশি হয় এবং তার মালিকের উপর একটি গরু যাকাত দেওয়া ওয়াজিব হয়,তাহলে অবশ্যই সে যেন গরুর মধ্য হতে উভয়ের যাকাত আদায় করে।আর যদি গরুর থেকে মহিষ বেশি হয়, তাহলে সে যেন মহিষের মধ্যে হতে উভয়ের যাকাত আদায় করে। অতঃপর যদি উভয়ই সমান হয়,তাহলে তার ইচ্ছানুযায়ী উভয়ের মধ্য হতে যাকাত আদায় করবে (এ সময়ে চাই সে যাকাত হিসেবে গরু প্রদান করুক কিংবা মহিষ;উভয়ই তার অধীনে)। অতঃপর যদি গরু ও মহিষ উভয়ই যাকাতের হিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে অবশ্য উভয়ের মধ্য হতে আলাদা-আলাদাভাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।(মুয়াত্তা মালেক হা/৫৮৪)। সুতরাং মহিষ কুরবানী করা সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও বহু গ্রহণযোগ্য আলেমগণ মহিষকে গরু প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত হিসেবে মহিষ দ্বারা কুরবানি করা বৈধ বলেছেন। তবে আমরা বলবো কুরবানীর সর্বোত্তম পশু হিসেবে উট,গরু ছাগল ইত্যাদি পশু সচরাচর পাওয়া গেলে এবং সেগুলো দ্বারা কুরবানি দেয়ার সামর্থ্য থাকা অবস্থায় এবং মতভেদ থেকে দুরে থাকার জন্য মহিষ দ্বারা কুরবানি না দেয়াই উত্তম। কিন্তু মহিষ দ্বারা কুরবানী হবেনা একথা বলা ঠিক হবেনা। মহিষ কুরবানী বৈধ মর্মে ইতিহাস বিখ্যাত বহু আলেমগণ মতামত দিয়েছেন। যেমন:
.
প্রখ্যাত তাবি‘ঈ ইমাম হাসান বাসরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:১১০হি.] বলেন,الجواميس بمنزلة البقر “মহিষ গরুর স্থলাভিষিক্ত’।(মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/১০৮৪৮)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: ফাজিলাতুশ শায়েখকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, মহিষের অনেক গুণাবলী/বৈশিষ্ট্য গরুর হতে ভিন্ন। যেমন ছাগলের অনেক গুণাবলী/বৈশিষ্ট্য মেষ/ভেড়ার অনেক গুনাবলী/বৈশিষ্ট্য হতে ভিন্ন। আর আল্লাহ তাআলা সূরা আনআমের মধ্যে মেষ ও ছাগলের মাঝে পার্থক্য করে দিয়েছে।অপর দিকে তিনি মহিষ ও গরুর মাঝে কোন পার্থক্য করেননি। অতএব মহিষ কি আল্লাহ তাআলার উল্লেখিত আট প্রকারের জোড়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ফলে তার দ্বারা কুরবানী করা কি বৈধ না বৈধ না? উত্তরে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) যা বলেছেন তার ভাবার্থ হচ্ছে, মহিষ এক ধরনের গরু, আরবরা এই প্রাণীটি চিনত না বলে তার সম্বন্ধে কোন আলোচনা পাওয়া যায়না। কিন্তু মহিষ গরুরই একটি শ্রেণী বা জাত। কাজেই তার বিধান গরুর মতো। অর্থাৎ মহিষ) গরুর অন্তর্ভুক্ত।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইবনে উসাইমীন: মাজমুঊ ফাতওয়া: খন্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা: ২৫)।
.
শাইখ ‘আব্দুল মুহসিন আল-‘আব্বাদ আল-বদর (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৮২ হি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: মহিষ দ্বারা কুরবানী করা কি বৈধ? উত্তরে তিনি বলেন: মহিষ গরুর অন্তর্ভুক্ত। (অর্থাৎ মহিষ দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ)।(দারসে তিরমিজি ১৭২ নং অডিও ক্লিপ)।
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্নঃ আপনারা উল্লেখ করে থাকেন যে, কুরবানী চতুষ্পদ প্রাণীর মধ্য থেকে হতে হবে। আর তা হল গরু, ছাগল ও উট। তাহলে মহিষ কি চতুষ্পদ প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত?
উত্তরে শাইখ বলেন: হ্যাঁ, মহিষ গরুর অন্তর্ভুক্ত। (অর্থাৎ মহিষ দ্বারা কুরবানী বৈধ। (https://youtube.com/watch?v=BrblFuOfU0s&si=RLiE-kfruqTXFkOt
.
ভারতবর্ষে হাদীসশাস্ত্রের আরেক দিকপাল, মিশকাতুল মাসাবীহ’র বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ’র সম্মানিত মুসান্নিফ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ইমাম ‘উবাইদুল্লাহ বিন ‘আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.] মহিষের কুরবানী সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেন: “কোনো ধরনের সংশয় এবং সন্দেহ ব্যাতিরেকে মহিষ কুরবানী করা মুবাহ তথা জায়েজ। আর যারা মহিষ কুরবানী করবে তারা সাওয়াবও পাবেন। কুরআনুল কারীমে সূরা হজ্জের আয়াতের মধ্যে “بهيمة الأنعام” (বাহিমাতুল আনআম) আল্লাহর নামে যবেহ করার এবং তার গোস্ত খাওয়ার ও খাওয়ানোর বর্ণনার উল্লেখ রয়েছে। আর “بهيمة الأنعام” অর্থ হল ঐ প্রকার সকল হালাল পশু যা গৃহপালিত ও গবাদি।অর্থাৎ যেগুলিকে মানুষের দুধ ও গোস্ত খাওয়ার জন্যে নিজ গৃহে লালন পালন করে থাকে।যার মধ্যে উট,গরু,মহিষ, বকরী ভেড়া দুম্বা ইত্যাদি সবই শামিল রয়েছে।জংলী জানোয়ার যেমনটি হরিন, জংলী গাধা কিংবা জেব্রা, নীল গাই ইত্যাদি বিল ইত্তেফাক এই শব্দের আওতা থেকে বহির্ভুত। কিছু সংখ্যক ফুকাহার নিকটে “البُدن” এর মধ্যে গরু শামিল রয়েছে,আর মহিষ গরুরই একটা প্রকরণ বা শ্রেনী। যেমনটি অভিধান বিদ্বগন লিখেছেন।এদিক থেকেও মহিষের কুরবানীর উপরে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকছেনা।অবশ্য উট অথবা গরু,কিংবা বকরী বা ভেড়া ও দুম্বা থাকা সত্ত্বেও মহিষের কুরবানী দেওয়া আফযালের খিলাফ। নাবী (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামদের যামানায় আরব দেশে মহিষ বিদ্যমান ছিলনা বিধায় তাদের থেকে মহিষ কুরবানীর নেপথ্যে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়না যেমনটি মহিষের যাকাতের ব্যাপারেও নিদানের কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়না। কিন্ত এটা দ্বারা এই কথা সাব্যস্ত হয়না যে মহিষের কুরবানী দেওয়া না জায়েয হবে কিংবা এর যাকাত দেওয়া লাগবে না।সর্বাবস্থাতেই মহিষের কুরবানী করা নিঃসন্দিগ্ধভাবে জায়েয।” (গ্রন্থসুত্র: ফাতাওয়া উবাইদুল্লাহ রহামানী মুবারকপুরী পৃষ্ঠা: ১৮৯ ফাতওয়াটি আবুল্লাহ ডালটন ভাই থেকে সংগৃহীত)।
.
বর্তমান সময়ের অন্যতম আলেম শাইখ ড.আব্দুল আজিজ বিন রাইস আর-রাইস (হাফিজাহুল্লাহ)-কে প্রশ্নঃ করা হয়েছিল মহিষ দ্বারা কুরবানী করা কি বৈধ রয়েছে? উত্তরে শাইখ বলেন: চার মাযহাবের আলেমগণ একমত যে, মহিষ দ্বারা কুরবানী করা শুদ্ধ/সহিহ হবে। কারণ মহিষের বিধান মূলত গরুর বিধানের মতই। এমনকি ইবনুল মুনযির এর উপর ইজমা বর্ণনা করেছেন যে, মহিষের যাকাত হলো গরুর যাকাতের মত এবং এটি প্রমাণ করে যে, উভয়ের হুকুম/বিধান একই। (শাইখের বক্তব্য লিংক। https://youtube.com/watch?v=lf46soW45NY&si=sDwPaAur9UkOHEJv
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, মহিষ( بهيمة الانعام “বাহীমাতুল আন‘আম” শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত প্রানী। সুতরাং গৃহ পালিত পশু হিসেবে মহিষ কুরবানী দিতে আপত্তি নেই তবে সর্বোত্তম পশু উট গরু, ছাগল ভেড়া পাওয়া গেলে সেগুলো দিয়েই কুরবানী করা উত্তম। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সুস্পষ্ট দলিল প্রমান ছাড়া যারা বলেন মহিষের কুরবানী হবেনা একথা সঠিক নয়। বড়জোড় এটা বলা যেতে পারে মহিষের চেয়ে উট, গরু, ছাগল কুরবানী করা উত্তম। কিন্তু সেটা না বলে সরাসরি মহিষ কুরবানী করা জায়েজ নয় বলা শরীয়তের বিধি বিধান সম্পর্কে এক প্রকার বাড়াবাড়ি। পাশাপাশি কুরবানির ক্ষেত্রে উত্তম সুন্নত হলো একটি পরিবার থেকে একটি পশু কুরবানি করা, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম করে দেখিয়েছেন। যদিও একাধিক ব্যক্তি শরিক হয়ে কুরবানি করাও বৈধ, কেননা প্রাথমিক যুগের অনেক আলেম এ মত সমর্থন করেছেন।” সুতরাং মাসালাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি পরিত্যাজ্য। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:

জুয়েল মাহমুদ সালাফি। 

No comments:

Post a Comment

Translate