ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর কুরবানী আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এতে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাত আদায়ের সাথে সাথে প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাতও পালন করা হয়। কেননা তিনি নিজে কুরবানী করেছেন এবং তাঁর উম্মতের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে অবশিষ্ট রেখে গেছেন। ফলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কুরবানীর বিধান বলবৎ থাকবে ইনশাআল্লাহ। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যাধিক। তাই এর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একান্ত দায়িত্ব। আজ আমরা কুরবানির পশুর সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়গুলো সংক্ষেপে বাংলায় উল্লেখ করার চেষ্টা করব।
Friday, June 20, 2025
কুরবানির পশু সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আমাদের জানা উচিত
❑ [১] কুরবানির সংজ্ঞা:
.
কুরবানী: ঈদুল আযহার দিনগুলোতে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আনআম শ্রেণীর (উট, গরু, ভেড়া বা ছাগল) প্রাণী জবাই করাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে। কুরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও তাকওয়ার প্রতীক, যা আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও মানবিকতার অনন্য শিক্ষা বহন করে। কুরবানীর বিধান আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ ও মুসলিমদের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত।(বিস্তারিত দেখুন; সূরা কাউছার, আয়াত: ২; সূরা আনআম, আয়াত: ১৬২; সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৩৪; সহিহ বুখারী হা/৫৫৫৮; ও সহিহ মুসলিমে হা/১৯৬৬; মুসনাদে আহমাদ হা/৪৯৩৫; সুনানে তিরমিযি হা/১৫০৭; সহিহ বুখারী হা/৫৫৪৫)
.
❑ [১] কুরবনীর হুকুম:
.
আলেমগণ কুরবানীর হুকুম নিয়ে মতভেদ করেছেন: কুরবানী করা কি ওয়াজিব যা পালন না করলে গুনাহ হবে; নাকি সুন্নতে মুয়াক্কাদা যা বর্জন করাটা নিন্দনীয়? বিশুদ্ধ মতানুযায়ী কুরবানী করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।তবে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের তাদের উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিয়মিত কোরবানি করা। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اَلْأُضْحِيَّةُ سُنَّةٌ وَلَيْسَتْ بِوَاجِبَةٍ ‘কুরবানী করা সুন্নাত, ওয়াজিব নয়’।ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الضَّحَايَا سُنَّةٌ لَا أُحِبُّ تَرْكَهَا ‘কুরবানী সুন্নাত’ এই সুন্নাত ত্যাগ করা আমি পসন্দ করি না”। হানাফী মাযহারেব ইমাম আবু ইউসুফ, মালিকী মাযহাবের ইমাম আশহাব এবং অধিকাংশ আলিমের মতে, তা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা।ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আহলে ইলম বা কুরআন-হাদীসের জ্ঞানীদের আমল ছিল এই যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়, বরং নবী করীম (ﷺ)-এর সুন্নাতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। কারো জন্য কুরবানী ওয়াজিব হওয়া কিংবা সুন্নত হওয়ার জন্য কুরবানীকারীকে ধনী হওয়া শর্ত। অর্থাৎ তার নিজের খরচপাতি ও সে যাদের খরচ চালায় তাদের খরচপাতির অতিরিক্ত তার কাছে কুরবানী করার অর্থ থাকা। অতএব, কোন মুসলমানের যদি মাসিক বেতন বা আয় থাকে এবং এ বেতন দিয়ে তার খরচ চলে যায়, এর অতিরিক্ত তার কাছে কুরবানীর পশু কেনার অর্থ থাকে তাহলে সে ব্যক্তি কর্তৃক কুরবানী দেয়ার শরয়ি বিধান রয়েছে। কুরবানী করার জন্য ধনী হওয়া শর্ত মর্মে দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ সে কুরবানী করেনি সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়”(সুনানে ইবনে মাজাহ হা/৩১২৩; এখানে সামর্থ্য দ্বারা উদ্দেশ্য ধনী হওয়া। এ বিধানের ক্ষেত্রে পুরুষ বা নারীর কোন ভেদ নেই।(বিস্তারিত দেখুন; ফাৎহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী, ১০ম খণ্ড,পৃষ্ঠা: ৩; মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালিক, পৃষ্ঠা: ১৮৯; শাফেঈ, আল-উম্ম; ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৪৩; আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা; খণ্ড:৫; পৃষ্ঠা: ৭৯-৮১; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭০২৯১)
.
❑ [২] কুরবানীর পশুর শর্তাবলি:
.
কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে ৬ টি শর্ত রয়েছে:
.
এক: পশুটি ‘আনআম’ শ্রেণীর চতুষ্পদ জন্তু হওয়া। আনআম হচ্ছে উট, গরু, ভেড়া ও ছাগল। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “আর আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য ‘মানসাক’ এর নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ ‘আনআম’ শ্রেণীর যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সে সবের উপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৩৪] আয়াতে بهيمة الأنعام (বাহিমাতুল আনআম) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে উট, গরু, ভেড়া ও ছাগল। আরবদের কাছে بهيمة الأنعام এর এ অর্থই পরিচিত। এটি হাসান, কাতাদা ও আরও অনেকের অভিমত।এগুলোর বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না। তবে অনেক বিদ্বান মহিষকে গরুর অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয বলেছেন।(মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৮১)
.
দুই: পশুটি শরিয়ত নির্ধারিত বয়সে পৌঁছা। ভেড়া হলে ‘জাযআ’ হওয়া (অর্থাৎ ছয়মাস পূর্ণ হওয়া)। আর অন্য শ্রেণীর হলে ‘সানিয়্যা’ হওয়া (অর্থাৎ এক বছর পূর্ণ হওয়া)। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমরা মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হওয়া ছাড়া কোন প্রাণী জবাই করবে না। তবে তোমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেলে ছয় মাস বয়সী ভেড়া জবাই করতে পারো”।[সহিহ মুসলিম] মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হচ্ছে- ‘সানিয়্যা’ ও ‘সানিয়্যা’ এর চেয়ে বেশি বয়স্ক পশু। আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- ‘সানিয়্যা’ চেয়ে কম বয়স্ক পশু। উটের ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ হচ্ছে- যে উটের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। গরুর ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ হচ্ছে- যে গরুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ হচ্ছে- যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে।আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- যে পশুর ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং উট, গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘সানিয়্যা’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কুরবানী শুদ্ধ হবে না। আর ভেড়ার ক্ষেত্রে ‘জাযআ’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কুরবানী হবে না।শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন: “কুরবানির নির্ধারিত বয়স অনুসরণ করা শরিয়তের দাবি। ইমামগণের সর্বসম্মত অভিমত হলো, শরিয়ত কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট বয়স নির্ধারণ করেছে, যার কম বয়সী পশু জবেহ করা বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এর চেয়ে কম বয়সী পশু কুরবানি করবে, তার কুরবানি সহীহ হবে না।”(নববী আল-মাজমু‘ খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৭৬) ইমাম কাসানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আমরা যে নির্দিষ্ট বয়সের কথা উল্লেখ করেছি,তা মূলত কম বয়সী পশুকে কুরবানির অনুপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য।কিন্তু বেশি হলে বাধা নেই।অর্থাৎ কেউ যদি নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সী পশু কুরবানি করে, তাহলে তা বৈধ নয়। কিন্তু যদি বেশি বয়সের পশু কুরবানি করে, তাহলে তা বৈধ এবং উত্তম হবে।এ কারণে কুরবানিতে ভেড়ার বাচ্চা (حمل), ছাগলের বাচ্চা (جدي), বাছুর (عجل) বা উটছানা (فصيل) কোরবানি করা বৈধ নয়;কারণ শরিয়তের নির্দেশনা যে নির্দিষ্ট বয়সের কথা বলেছে, এসব প্রাণী সেই বয়সে পড়ে না। দুই বছরের কম বয়সী গরু কুরবানি করা ইমামদের মধ্যে কারো নিকটেও বৈধ নয়।” (বদায়েউস সানায়ি; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৭০) আরো বিস্তারিত দেখুন; আল-বাহরুর রায়েক; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠ: ২০২; আত-তাজ ওয়াল ইকীল; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬৩; শরহে মুখতাসার খলিল; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৪ নববী আল-মাজমু‘ খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৬৫ ইবনু কুদামাহ; আল মুগনী; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৬৮; ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৩৭৭)
.
তিন: কুরবানীর পশু ঐ সব দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়া যেগুলোর কারণে কুরবানী আদায় হয় না; এমন ত্রুটি ৪টি: (১)। চোখে স্পষ্ট ত্রুটি থাকা: যেমন চোখ একেবারে কোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া কিংবা বোতামের মত বের হয়ে থাকা কিংবা এমন সাদা হয়ে যাওয়া যে, সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, চোখে সমস্যা আছে। (২)। সুস্পষ্ট রুগ্নতা: যে রোগের প্রতিক্রিয়া পশুর উপরে ফুটে উঠে। যেমন, এমন জ্বর হওয়া যার ফলে পশু চরতে বের হয় না ও খাবারে তৃপ্তি পায় না। এমন চর্মরোগ যা পশুর গোশত নষ্ট করে দেয় কিংবা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। (৩)। স্পষ্ট খোঁড়া হওয়া: যার ফলে পশুর স্বাভাবিক হাঁটা-চলা ব্যাহত হয়। (৪)। এমন জীর্ণ-শীর্ণতা; যা অস্থির মজ্জা নিঃশেষ করে দেয়। এ চারটি ত্রুটি থাকলে সে পশু দিয়ে কুরবানী দেয়া জায়েয হবে না। এ ত্রুটিগুলোর সমপর্যায়ের কিংবা এগুলোর চেয়ে মারাত্মক অন্য ত্রুটিসমূহকেও এ ত্রুটিগুলোর অধিভুক্ত করা হবে।সে রকম কিছু ত্রুটি নিম্নরূপ: (১)। অন্ধ পশু; যে তার দুই চোখে কিছুই দেখে না।(২)। যে পশু তার সাধ্যের অতিরিক্ত খাবার খেয়েছে; যতক্ষণ না তার তরল পায়খানা হয়ে সে আশংকামুক্ত হয়।(৩)। যে পশু গর্ভবতী; কিন্তু পশুটি শংকার মধ্যে রয়েছে; যতক্ষণ না তার শংকা দূরীভূত হয়।(৪)। গলায় ফাঁস লেগে কিংবা উপর থেকে পড়ে যে পশু আহত হয়ে মৃত্যুপথ-যাত্রী যতক্ষণ না সে পশু শংকামুক্ত হয়।(৫)। যে পশু কোন রোগজনিত কারণে হাঁটতে অক্ষম।(৬)। সামনের এক পা কিংবা পিছনের এক পা কর্তিত পশু।এ ত্রুটিগুলো যদি পূর্বে হাদিসে উল্লেখিত ত্রুটিগুলোর সাথে একত্রিত করা হয় তাহলে সর্বমোট ১০ টি ত্রুটি হবে; যেগুলোর কারণে কোন পশুকে কুরবানী করা জায়েয হবে না। উল্লেখিত ৬ টি এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত ৪ টি। এ সংক্রান্ত দলিল দেখুন;মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/১৭৫৭; মিশকাত, হা/১৪৬৫; ইমাম আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ হা/১১৪৮)
.
চার: পশুটি কুরবানীকারীর মালিকানাধীন হতে হবে। কিংবা শরিয়তের পক্ষ থেকে সে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে কিংবা মালিকের পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে। অতএব, যে ব্যক্তি যে পশুর মালিক নয় তার জন্য সে পশু দিয়ে কুরবানী দেয়া জায়েয হবে না। যেমন ছিনতাইকৃত পশু, চুরিকৃত পশু কিংবা অন্যায় মামলা দিয়ে প্রাপ্ত পশু ইত্যাদি। কেননা কোনো পাপ দিয়ে আল্লাহ্র নৈকট্য হাসিল করা শুদ্ধ নয়।ইয়াতিমের অভিভাবক যদি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ইয়াতিমের সম্পদ থেকে কুরবানী করে তাহলে সে কুরবানী সহিহ হবে; যদিও কুরবানী করতে না পারার কারণে ইতিপূর্বে সে ছিল ভগ্নহৃদয়। কোন প্রতিনিধি তার নিয়োগকারীর পক্ষ থেকে কুরবানী করলে সেটা সহিহ হবে।(ইবনু উসাইমীন; আহকামুল উদহিয়্যাহ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৬৫১)।
.
পাঁচ: কুরবানীর পশুর সাথে অন্য কারো অধিকার যেন সম্পৃক্ত না থাকে; এ কারণে বন্ধককৃত পশু দিয়ে কুরবানী করা জায়েয হবে না।
.
ছয়: শরিয়ত নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পশুটিকে কুরবানী দিতে হবে। এ সময়সীমা হচ্ছে ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর থেকে তাশরিকের দিনগুলোর সর্বশেষ দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তাশরিকের সর্বশেষ দিন হচ্ছে ১৩ ই যিলহজ্জ। সুতরাং কোরবানী দেয়ার সর্বমোট দিন সংখ্যা হচ্ছে ৪ দিন। ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর থেকে পরবর্তী ৩ দিন। তাই কেউ যদি ঈদের নামাযের আগে কিংবা ১৩ ই যিলহজ্জের সূর্যাস্তের পরে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী শুদ্ধ হবে না। কিন্তু, কোন ওজরের কারণে কারো যদি তাশরিকের দিনগুলোর চেয়ে বেশি বিলম্ব হয়ে যায় এতে কোনো অসুবিধা হবে না; যেমন- অবহেলা না করা সত্ত্বেও কারো কুরবানীর পশুটি পালিয়ে গেল এবং কুরবানীর সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে পশুটি পাওয়া গেল। কিংবা যাকে কুরবানী করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তিনি ভুলে গেলেন এবং এর মধ্যে কুরবানী করার সময় পার হয়ে গেল সেক্ষেত্রে সময়ের পরে জবাই করতে কোন অসুবিধা নেই। এ মাসয়ালাটিকে কিয়াস করা হয়েছে ঐ মাসয়ালার উপর: যে ব্যক্তি সলাত না আদায় করেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিংবা সলাতের কথা ভুলে গিয়েছে সে ব্যক্তি যখন জেগে উঠে কিংবা তার স্মরণে পড়ে তখনি সে সলাত আদায় করে। নির্ধারিত দিনগুলোতে রাতে কিংবা দিনে কুরবানীর পশু জবাই করা জায়েয হবে। তবে, দিনে জবাই করা শ্রেয়। আর ঈদের দিন খুঁতবার পর পর জবাই করা উত্তম। আগের দিনে জবাই করা পরের দিনে জবাই করার চেয়ে উত্তম। যেহেতু এতে নেকীর কাজে দ্রুত সাড়া দেওয়া হয়।” কুরবানীর পশু যবহ করার জন্য নারী-পুরুষের মাঝে কোন পার্থক্য বা শর্তারোপ করা হয়নি। যবহ করা কাজটি সাহসের ব্যাপার। কোনো নারী যদি কুরবানীর পশু যবহ করার সাহস রাখে, তাহলে সে করতে পারবে। ইমাম বুখারী ইবনু রাফি‘ থেকে বর্ণনা করেছেন যে,সাহাবী আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর মেয়েদেরকে নিজ হাতে তাদের কুরবানীর পশু যব্হ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।উক্ত হাদীস প্রমাণ করে মেয়েরাও নিজ হাতে কুরবানী করতে পারে।(সহীহ বুখারী, পৃ. ৮৩৩; ফাৎহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯; বিস্তারিত দেখুন; ইবনু উসাইমীন; আহকামুল উদহিয়্যাহ; ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ‘যাদুল মাআদ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩১৯; ফাতাওয়াল লাজনা দায়িমা’ খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৪০৬; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৬৫১)
.
❑ [৩] কোরবানির সর্বোত্তম পশু:
.
কুরবানী করার সর্বোত্তম পশু হচ্ছে: উট। এরপর গরু। এরপর ভেড়া ও ছাগল। এরপর গরুতে ভাগ দিয়ে কুরবানী করা। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ি এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াওমুল জুমু’আর ক্ষেত্রে বলেছেন: “যে ব্যক্তি প্রথম ঘণ্টায় (মসজিদে) গেল সে যেন একটি উট কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় ঘণ্টায় গেল সে যেন একটি গরু কুরবানী করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় ঘণ্টায় গেল সে যেন একটি শিং ওয়ালা প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়া (কাবশ) দিয়ে কুরবানী করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ ঘণ্টায় গেল সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করল। আর যে ব্যক্তি পঞ্চম ঘণ্টায় গেল সে যেন একটি ডিম কুরবানী করল।”(সহিহ বুখারী হা/৮৮১; ও সহিহ মুসলিম হা/৮৫০) এবং যেহেতু এটি আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জনমূলক জবাই। তাই এক্ষেত্রে হাদির ন্যায় উটই উত্তম। আর উটের মধ্যে ভাগ দেয়ার চেয়ে ভেড়া বা ছাগল দিয়ে কুরবানী করা উত্তম। কেননা কুরবানীতে রক্তপাতটাই উদ্দিষ্ট। আর একাকী কুরবানীকারী (একটি পশুর) সম্পূর্ণ রক্তপাত করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করেন। গানাম (ভেড়া-ছাগল) শ্রেণীর প্রাণীর মধ্যে কাবশ (প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়া) সর্বোত্তম। যেহেতু ‘কাবশ’ ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরবানীর পশু। এবং কাবশ এর গোশতও ভাল।”(আল-মুগনী খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৬৬; আরো দেখুন; ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমাহ; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৩৯৮; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৫৭৬৭)
.
❑ [৪] কোরবানির একটি পশু কয়জনের পক্ষ থেকে বৈধ হবে?
.
সামর্থ্যবান প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়ার বিধান রয়েছে। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “প্রতিটি (সামর্থ্যবান) পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একটি কুরবানী দেয়া ওয়াজিব”(মুসনাদে আহমাদ হা/২০২০৭) ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন: হাদিসটির সনদ মজবুত। আলবানী ‘সহিহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে হা/২৭৮৮) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন) কুরবানীর পশু হিসেবে একটি মেষ ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে, তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এবং যত মুসলিমের পক্ষ থেকে নিয়ত করে সবার পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। এটি সর্বজনবিদিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ছাগলে কুরবানিতে শরিক হওয়া বৈধ নয়। তবে উট ও গরুর কুরবানিতে একাধিক ব্যক্তি শরিক হওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য। এর পক্ষে নবী করিম ﷺ -এর একাধিক সহিহ হাদীস রয়েছে, এবং বিশুদ্ধ আকীদাভিত্তিক সালাফে সালেহীনদের মূল্যবান বাণী ও নির্ভরযোগ্য ফতোয়াসমূহ দ্বারা তা সুপ্রমাণিত। অতএব, কোনো লোক যদি একটি ছাগল কিংবা একটি ভেড়া দিয়ে কোরবানী দেয় তাহলে সেটা তার নিজের পক্ষ থেকে, তার পরিবারের মৃত বা জীবিত যত সদস্যদের পক্ষ থেকে নিয়ত করে সকলের পক্ষ থেকে জায়েয হবে। যদি আমভাবে বা খাসভাবে কোনো নিয়ত না করে তাহলে ‘আহলে বাইত’ বা পরিবার বলতে মানুষের ব্যবহারে যাদেরকে বুঝায় কিংবা ভাষাগতভাবে যাদেরকে বুঝায় তারা সকলে এর অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রথাগতভাবে ব্যক্তি যাদের ভরণপোষণ করে স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন তাদেরকে পরিবার বলে। আভিধানিক অর্থে পরিবার বলতে ব্যক্তির সেসব আত্মীয়দেরকে বুঝায় যারা তার নিজের বংশধর, তার পিতার বংশধর, তার দাদার বংশধর কিংবা তার প্রপিতামহের বংশধর। একটি মেষ দিয়ে যাদের যাদের পক্ষ থেকে কোরবানী করা জায়েয একটি উটের সপ্তমাংশ কিংবা একটি গরুর এক সপ্তমাংশ দিয়ে তাদের সবার পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। তাই, কেউ যদি এক সপ্তমাংশ উট দিয়ে কিংবা এক সপ্তমাংশ গরু দিয়ে তার পক্ষ থেকে, তার পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয় সেটা জায়েয হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম হাদির পশুর ক্ষেত্রে এক সপ্তমাংশ উট ও এক সপ্তমাংশ গরুকে একটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। অনুরূপ বিধান কুরবানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। যেহেতু এক্ষেত্রে কুরবানী ও হাদির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।সুতরাং যারা বলেন যে, কুরবানিতে শরিক হওয়া সফর ও হজের সাথে খাস (নির্দিষ্ট) তাদের এই খাসকরণের পিছনে কোনো দলিল নেই। এই খাসকরণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, উদ্ভট এবং দলিলবিহীন।(বিস্তারিত দেখুন; তিরমিযি হা/১২১৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৩১৮; ইমাম ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৬৩-৩৬৪; ইমাম নববী; কিতাবুল মাজমূ‘ শারহুল মুহাযযাব লিশ শীরাযী; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৭১; ইবনু উসাইমীন;আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৪২৮; ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৪০১-৪০২; ফাতওয়া নং: ২৪১৬;এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৩৮৭)
.
জেনে রাখা ভালো যে, দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একটি মেষ ক্রয়ে অংশীদার হয়ে সবার পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া জায়েয নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাতে এই মর্মে কিছু উদ্ধৃত হয়নি। অনুরূপভাবে আট বা ততোধিক ব্যক্তি একটি উট কিংবা একটি গরুতে অংশীদার হওয়া জায়েয নেই (তবে সাতজনের একটি উটে কিংবা গরুতে অংশীদার হওয়া জায়েয আছে)। কেননা ইবাদতগুলো তাওকিফিয়্যা (দলিলের সীমায় বিধান সীমাবদ্ধ এমন)। এগুলোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না; সেটা সংখ্যাগত সীমা হোক কিংবা পদ্ধতিগত সীমা হোক। তবে, সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার করা যেতে পারে। যেমন সওয়াবের ক্ষেত্রে অগণিত মানুষকে অংশীদার করার কথা উল্লেখ আছে।(বিস্তারিত দেখুন: ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৩৮৭)।
.
❑ [৫] কুরবানির পশু জবাই করার পদ্ধতি:
.
নিজের কুরবানীর পশুকে ব্যক্তির নিজেই জবাই করাটা উত্তম। যদি কোরবানিদাতা তা করতে না পারে কিংবা করতে না চায় তাহলে অন্যকে দায়িত্ব দিয়ে নিজে জবাই-এ উপস্থিত থাকায় কোনো অসুবিধা নাই। যদি সেটা করতে না পারে কিংবা করতে না চায় তাহলে জবাই অনুষ্ঠানে না থাকলেও কোনো অসুবিধা নাই। কেননা কুরবানীর পশু অন্যকে জবাই করার দায়িত্ব দেয়া জায়েয এতে আলেমদের কোন মতভেদ নেই। আর জবাই এর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়। কুরবানীর পশু কুরবানীর নিয়তে জবাই করা শর্ত। গোশতের জন্য জবাই করলে জায়েয হবে না। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত শর্ত।”(আল-মাজমু; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৮০) যে ব্যক্তি কুরবানীর পশু জবাই করতে চান তার জন্য পশু জবাইয়ের নিয়ম হচ্ছে, উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার’ বলে তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে গলা এবং ঠোঁটের মাঝে ধারালো ছুরি দিয়ে প্রাণীটিকে জবাই করা। আর গর্দান বা পূর্ণ মাথা বিচ্ছিন্ন না করা। হারাম মস্তিষ্ক পর্যন্ত কাটাও উচিত নয়। শ্বাসনালি ,খাদ্যনালি ও দুইি শাহরগের অন্তত একটি কেটে রক্ত প্রবাহিত করে জবাই সম্পন্ন করা। তবে বাম কাতে ফেলতে ভুলে গেলে দোষের কিছু হবে না। কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। কুরবানির পশু অন্যের দ্বারাও যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম যেমনটি প্রথমে উল্লেখ করেছি।পশু জবাই এর সময় নিম্নোক্ত দোয়া পড়া সুন্নত:بسم الله ، والله أكبر اللهم هذا منك ولك ، هذا عني اللهم تقبل من فلان وآل فلان”(বিসমিল্লাহ্ ওয়াল্লাহু আকবার। আল্লাহুম্মা হাযা মিনকা, ওয়া লাকা। হাযা আন্নি। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন …ওয়া আলি…)[ডট দেয়া স্থানদ্বয়ে কোরবানীকারীর নাম উল্লেখ করবে](অর্থ- আল্লাহ্র নামে শুরু করছি। আল্লাহ্ই মহান। হে আল্লাহ্, এটি আপনার পক্ষ থেকে; আপনারই জন্য। এটি আমার পক্ষ থেকে উৎসর্গিত (আর অপরের পক্ষ থেকে হলে বলবে: অমুকের পক্ষ থেকে)। হে আল্লাহ্, অমুকের ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে কবুল করুন।) এই দোয়ার মধ্যে শুধু ‘বিসমিল্লাহ্’ বলা ওয়াজিব। বিসমিল্লাহ্ এর অতিরিক্ত যে কথাগুলো আছে সেগুলো বলা মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটো ভেড়া দিয়ে কুরবানী করেছেন। দুটোকে তিনি নিজ হাতে জবাই করেছেন; বিসমিল্লাহ্ বলেছেন এবং তাকবীর বলেছেন।”(সহিহ বুখারী হা/৫৫৫৪ ও সহিহ মুসলিম হা/১৯৬৬) তবে “হে আল্লাহ্! এটি আমার বাবার কুরবানী” এই কথা বলতে কোন বাধা নেই। এটি নিয়ত উচ্চারণ করা নয়।(বিস্তারিত দেখুন: মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ, ৫ম খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৭৪-৭৫)
.
❑ [৬] কুরবানির গোশত খাওয়া এবং বন্টন করা:
.
কুরবানিকারী কুরবানির গোশত নিজে খেতে পারেন, হাদিয়া দিতে পারেন এবং সদকা করতে পারেন এটি উত্তম তবে ওয়াজিব নয়। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুঃস্থ অভাবীকে আহার করাও”।(সূরা হাজ্জ, আয়াত: ২৮) আল্লাহ্ আরও বলেন:“তখন তোমরা তা থেকে খাও এবং আহার করাও এমন দরিদ্রকে যে ভিক্ষা করে এবং এমন দরিদ্রকে যে ভিক্ষা করে না। এভাবে আমরা সেগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”।(সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৩৬) সালামা বিন আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমরা খাও, খাওয়াও এবং সংরক্ষণ করে রাখ”।(সহিহ বুখারী) হাদিসে ‘খাওয়াও’ কথাটি ধনীদেরকে হাদিয়া দেয়া এবং দরিদ্রদেরকে দান করাকে অন্তর্ভুক্ত করবে। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমরা খাও, সংরক্ষণ করে রাখ এবং দান করো”।(সহিহ মুসলিম হা/২৮০৪) কুরবানির গোশত কতটুকু খাওয়া যাবে, কতটুকু হাদিয়া দেওয়া হবে এবং কতটুকু সদকা করা হবে এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে। অগ্রগণ্য অভিমত হচ্ছে এক তৃতীয়াংশ খাওয়া, এক তৃতীয়াংশ হাদিয়া দেওয়া এবং এক তৃতীয়াংশ সদকা করা। যে অংশটুকু খাওয়া জায়েয সে অংশটুকু সংরক্ষণ করে রাখাও জায়েয; এমন কি সেটা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত হলেও যতদিন পর্যন্ত রাখলে এটি খাওয়া ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছবে না। কিন্তু যদি দুর্ভিক্ষের বছর হয় তাহলে তিনদিনের বেশি সংরক্ষণ করা জায়েয নয়।ওয়াজিব কুরবানি হোক কিংবা নফল কুরবানি হোক; গোশত খাওয়া কিংবা হাদিয়া দেয়ার হুকুমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অনুরূপভাবে কোন জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা হোক কিংবা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা হোক কিংবা কোন ওসিয়তের প্রেক্ষিতে কুরবানি করা হোক এ বিধানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা ওসিয়ত পূর্ণকারী ব্যক্তি ওসিয়তকারীর স্থলাভিষিক্ত হন। ওসিয়তকারী খেতে পারেন, হাদিয়া দিতে পারেন এবং সদকা করতে পারেন। কেননা এটাই তো মানুষের মাঝে প্রথাগতভাবে প্রচলিত। আর যেটা প্রথাগতভাবে প্রচলিত সেটা শব্দ দিয়ে উচ্চারণ করার সমতুল্য। প্রতিনিধিকে যদি তার নিয়োগকর্তা খাওয়া, হাদিয়া দেওয়া ও সদকা করার অনুমতি দেন কিংবা বিশেষ কারণ বা প্রথা অনুমতি দেয়াকে নির্দেশ করে তাহলে তিনি সেটা করতে পারেন। নচেৎ তিনি নিয়োগকর্তাকে হস্তান্তর করবেন। নিয়োগকর্তা নিজে বণ্টনের দায়িত্ব পালন করবেন। কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া ইত্যাদি কোন কিছুই বিক্রি করা হারাম। কসাইকে তার পারিশ্রমিক কিংবা পারিশ্রমিকের অংশ বিশেষ কুরবানির পশুর গোশত থেকে দেওয়া যাবে না। কেননা এটা বেচা-বিক্রির অধিভুক্ত। আর যাকে কুরবানির পশুর হাদিয়া দেওয়া হলো কিংবা সদকা দেওয়া হলো তিনি এ গোশত বিক্রি করা কিংবা অন্য যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন। তবে, তাকে যিনি হাদিয়া দিয়েছেন কিংবা সদকা দিয়েছেন তার কাছে বিক্রি করতে পারবেন না।(বিস্তারিত দেখুন ইমাম আলবানী, ইরওয়াউল গালীল, হা/১১৬০; মির‘আত, হা/১৪৯৩, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১২০ ও ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৪৪; ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১০৮-০৯; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৫৩২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment