প্রশ্ন: অসুস্থ ব্যক্তি (নারী-পুরুষ) কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর রোগীর জন্য শরীআতে কিছু বিশেষ বিধান রয়েছে,রোগীর কতক বিধান রয়েছে যা তার সাথেই খাস। কারণ সে যে অবস্থা অতিক্রম করে শরী‘আত সে মোতাবেক তাকে বিধান দিয়েছে। বস্তুত মহান আল্লাহ তার রাসূল (ﷺ)-কে সহজ, সরল ও একনিষ্ঠ দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন: “তিনি তোমাদের ওপর দ্বীনের ব্যাপারে কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি।”(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৭৮) আরেক স্থানে বলেন:“আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠিনতা চান না।”(সূরা আল বাক্বারাহ: ১৮৫) আরও বলেন:“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যতটুকু সম্ভব হয়, শ্রবণ কর এবং আনুগত্য কর।”(সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬) ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“নিশ্চয় দ্বীন সহজ।”(সহীহ বুখারী হা/৩৯) ইমাম ইবনু হিব্বান (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“যখন আমি তোমাদের কোনো আদেশ প্রদান করি, তখন তোমরা তা পালন কর যতটুকু তোমাদের সামর্থ্য হয়।”(ইবনু হিব্বান হা/৩৭০৪) এই মৌলিক নীতিমালাগুলোর ভিত্তিতে আল্লাহ তা‘আলা রোগীর জন্য তার ইবাদতের ক্ষেত্রে সহজতা প্রদান করেছেন, যাতে সে কষ্ট বা অসুবিধা ছাড়া ইবাদত সম্পাদন করতে পারে অতএব সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক রাব্বুল আলামীনের জন্য।
.
এক নজরে অসুস্থ ব্যক্তির পবিত্রতা অর্জনের মৌলিক নীতিমালা:
(১)- অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সুস্থ ব্যক্তির মতো করেই বড় অপবিত্রতা ও ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করা আবশ্যক। সে ছোট অপবিত্রতা থেকে অযু করবেন এবং বড় অপবিত্রতা থেকে গোসল করবেন।
.
(২)- অসুস্থ ব্যক্তি যদি পেশাব বা পায়খানা করে থাকেন তাহলে অযু করার আগে অবশ্যই পানি ব্যবহার করে কিংবা পাথর বা পাথরের স্থলাভিষিক্ত কিছু দিয়ে ঢিলা-কুলুখ করবেন। পাথর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই তিনটি পবিত্র পাথর দিয়ে ঢিলা করবেন। গোবর, হাড়, খাবার বা সম্মানিত কোনো বস্তু ঢিলা হিসেবে ব্যবহার করা জায়েয নেই। পাথর বা অনুরূপ বস্তু দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম; যেমন: টিস্যু পেপার ও এ জাতীয় অন্য কিছু। এরপর পানি ব্যবহার করবে। কারণ পাথর নাপাকির কাঠামোকে দূর করে। আর পানি স্থানকে পরিষ্কার করে। এতে করে ভালোভাবে পাক হবে। ব্যক্তির জন্য পানি, পাথর বা অনুরূপ যে কোনো বস্তু দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের স্বাধীনতা রয়েছে। যদি কেউ পানি বা পাথরের মধ্যে কোন একটায় সীমিত থাকতে চায়, তাহলে পানিই উত্তম। কারণ পানি স্থানকে পবিত্র করে, নাপাকির কাঠামো ও চিহ্নকে দূর করে দেয়। তাই এটি পরিষ্কারকরণে অধিক কার্যকরী। আর যদি পাথর ব্যবহারে সীমিত থাকে, তাহলে তিনটি পাথরের ব্যবহারে স্থানটি নির্মল হলে তিনটিই যথেষ্ট হবে। আর যদি নির্মল না হয়, তাহলে চতুর্থ ও পঞ্চমটি বৃদ্ধি করবে, যতক্ষণ না স্থানটি নির্মল হয়। উত্তম হলো বেজোড় সংখ্যায় শেষ করা। ডানহাতে পাথর ব্যবহার করে ঢিলা করা জায়েয নেই। যদি বামহাত কাটা থাকে অথবা ভেঙে যায় অথবা রোগ বা অনুরূপ কিছু থাকে, তাহলে প্রয়োজনের খাতিরে ডান হাত দিয়ে ঢিলা করবে; এতে গুনাহ হবে না।
.
(৩)- অসুস্থ ব্যক্তি অক্ষমতা বা রোগ বৃদ্ধির ভয় বা সুস্থ হতে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কায় পানি দিয়ে অযু করতে না পারেন তাহলে তায়াম্মুম করবেন। তায়াম্মুমের বিশুদ্ধ পদ্ধতি হলো: প্রথমে তায়াম্মুমের নিয়ত করে বিসমিল্লাহ্ পড়া। এরপর ভূপৃষ্ঠের উপর দুই হাতের তালু একবার নিক্ষেপ করা। এরপর বাম হাতের তালু দিয়ে ডানহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করা এবং ডান হাতের তালু দিয়ে বামহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করা। এরপর দুই হাত দিয়ে চেহারা মাসেহ করা। ওজুর পর যে যে যিকিরগুলো পড়া হয় তায়াম্মুমের শেষেও সে দোয়াগুলো পড়া।”(সহীহ বুখারী খণ্ড-১,পৃষ্ঠা: ৪৫৫ হা/৩৪৭; ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ৪২৫; ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৫৭) জেনে রাখুন এমন প্রত্যেক বস্তু দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েয যাতে ধুলা রয়েছে, এমনকি যদি সেটা ভূপৃষ্ঠ নয় এমন কিছুর উপরেও থাকে। যেমন যদি দেয়াল বা অনুরূপ কিছু থেকে ধুলা উড়ে তাহলে এটি দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েয হবে। আর যদি প্রথম তায়াম্মুমের পবিত্রতা বজায় থাকে তাহলে এই পবিত্রতা দিয়ে ওযুর মত সে কয়েক ওয়াক্তের নামায পড়তে পারবে। তাকে তায়াম্মুম নবায়ন করতে হবে না। যেহেতু এটি পানির বদলি। বিকল্প বস্তুর হুকুম মূল বস্তুর অনুরূপ। অযু বিনষ্ট করে এমন সকল কিছু তায়াম্মুম বিনষ্ট করে। আর পানি না থাকার পর উপস্থিত হলে কিংবা পানি ব্যবহারে অক্ষমতা থাকার পরে সক্ষমতা অর্জিত হলে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে।
.
(৪)- অসুস্থতা যদি কম হয় যার কারণে পানি ব্যবহার করলে শারীরিক ক্ষতি, ভয়াবহ রোগ, সুস্থতায় বিলম্ব, ব্যথা বৃদ্ধি বা বড় কিছু ঘটার আশঙ্কা না থাকে, যেমন: মাথাব্যথা, দাঁত ব্যথা প্রভৃতি অথবা যদি গরম পানি ব্যবহার করলে কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয হবে না। কারণ তায়াম্মুমের বৈধতা ক্ষতি দূর করার জন্য। এ অবস্থায় তার কোনো ক্ষতি নেই এবং তার কাছে পানি আছে। তাই তার উপর পানি ব্যবহার করা ওয়াজিব।
.
(৫)- অসুস্থ ব্যক্তির জন্য যদি অযু করতে অথবা নিজে নিজে তায়াম্মুম করতে কষ্ট হয়, তাহলে অন্য কেউ তাকে অযু অথবা তায়াম্মুম করাবেন এবং সেটি তার জন্য যথেষ্ট।
.
(৬)- যার কোনো ধরনের ক্ষত, আঘাত, ভাঙন বা এমন কোন রোগ আছে যে পানি ব্যবহার করলে তার ক্ষতি হয়, সে যদি জুনুবী হয় (বড় অপবিত্র হয়), তখন তার জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয। যদি তার জন্য শরীরের সুস্থ কোনো অংশ ধৌত করা সম্ভবপর হয়, তাহলে সে অংশ ধৌত করবে, আর বাকি অংশের জন্য তায়াম্মুম করবে।
.
(৭)- যার পবিত্রতা অর্জনের কোনো অঙ্গে জখম আছে সে পানি দিয়ে সেটি ধৌত করবে। যদি ধোয়া তার জন্য কষ্টকর হয় কিংবা ক্ষতিকর হয় তাহলে জখমযুক্ত অঙ্গটি ধোয়ার পালা যখন আসবে তখন পানি দিয়ে সেটি মাসেহ করবে। যদি পানি দিয়ে মাসেহ করা কষ্টকর হয় অথবা করলে ক্ষতি হয় তাহলে তায়াম্মুম করবে এবং তার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে।
.
(৮)- প্লাস্টার করা ব্যক্তি: তিনি এমন ব্যক্তি যার কোন অঙ্গে ভাঙ্গনের কারণে অঙ্গটি কাপড় বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে মোড়ানো, এমন ব্যক্তি পানি দিয়ে মাসেহ করবেন। এটাই তার জন্য যথেষ্ট। এমনকি যদি পবিত্র অবস্থায় প্লাস্টার করা না হয় তদুপরি।
.
(৯)- অসুস্থ ব্যক্তি নামায পড়তে চাইলে তার উচিত শরীর, জামা-কাপড় ও নামাযের স্থানকে নাপাকি থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হওয়া। সে যদি না পারে তাহলে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই নামায পড়বে। এতে কোনো গুনাহ হবে না।
.
(১০)- অসুস্থ ব্যক্তি যদি অনবরত পেশাবের রোগী হয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এর থেকে সুস্থ না হয় তাহলে তার উপর ওয়াজিব প্রত্যেক নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর শৌচ করা এবং প্রত্যেক নামাযের জন্য অযু করা। তার শরীর ও কাপড়ে যা লেগেছে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। অথবা কষ্ট না হলে নামাযের জন্য একটা পবিত্র কাপড় রেখে দিবে। আর কষ্ট হয়ে গেলে সেটা ক্ষমার্হ। নিজের জন্য সে সতর্কতা অবলম্বন করবে যাতে কাপড়ে, শরীরে অথবা নামাযের স্থানে পেশাব ছড়িয়ে না যায়। সে জন্য সে গোপনাঙ্গের অগ্রভাগে কোন নিরোধক ব্যবহার করবে। আল্লাহই তৌফিকদাতা। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবীদের উপর।(পুরো ১০ টি পয়েন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন; ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ লিল-বুহূসিল ইলমিয়্যা ওয়াল-ইফতা; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৪০৫; শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, শাইখ আব্দুল আযীয আলুশ শাইখ, শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে গুদাইয়্যান, শাইখ সালেহ আল-ফাউযান এবং শাইখ বকর আবু যাইদ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৫৩৫৬)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment