Friday, June 20, 2025

দুই তিনটার বেশি পোশাক থাকা কি অপচয়

 প্রশ্ন: দুই-তিনটার বেশি পোশাক থাকা কি অপচয়? অতিরিক্ত দামি পোশাক, গয়না ইত্যাদি ব্যবহার করা কি অপচয়? অপচয়ের মূলনীতি কী?

উত্তর: জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু মূলনীতি দিয়েছে সেগুলো আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। যেমন:
১ অপচয় না করা:
ইসলামে অপচয় অত্যন্ত নিন্দনীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
(يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ)
❝হে আদমসন্তান! প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা তোমাদের শোভা-পোশাক পরিধান করো। খাও ও পান করো। তবে অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।❞
— [সূরা আ’রাফ: ৩১]
> এখানে “শোভা-পোশাক” বলতে পরিচ্ছন্ন, সুন্দর এবং পর্দানুযায়ী উপযুক্ত পোশাক বোঝানো হয়েছে যা নামাজের মর্যাদার উপযোগী।
আর খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন বা অতিরিক্ত ব্যয়বহুলতা ও অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অপচয় আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা, বরকত হীনতা এবং সর্বোপরি ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
তবে ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয়ের বিষয়টি আপেক্ষিক। তা মানুষের অবস্থার উপর নির্ভরশীল। একজন দরিদ্র মানুষের জন্য যে জিনিসটি ‘অপচয়’ হিসেবে গণ্য হতে পারে তা ধনীর জন্য খুবই সাধারণ বলে গণ্য হবে।
২. অহংকার না করা। ইসলামে অহংকার করা মারাত্মক অপরাধ।
৩. দরিদ্রদেরকে ভুলে না যাওয়া। আমাদের জন্য আবশ্যক হলো, ফরজ জাকাত আদায়ের পাশাপাশি গরিব-অসহায় মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করা।
৪. পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজগোজ ও অলংকার ইত্যাদির পিছনে অতিরিক্ত ব্যতিব্যস্ত না থাকা বা এসবের জন্য সীমাতিরিক্ত অর্থ খরচ না করা।
৫. বিলাসবহুল জীবন যাপন না করা:
দুনিয়ার চাকচিক্য ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে না দিতে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে। অতিরিক্ত বিলাসিতাকে ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ বিলাসিতা মানুষকে পাপাচারের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيْهَا فَفَسَقُوْا فِيْهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيْرًا
“যখন আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন আমরা সেখানকার বিলাসিতায় ডুবে থাকা ব্যক্তিদের নির্দেশ দেই। তখন তারা সেখানে পাপাচারে মেতে ওঠে। ফলে তার উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা ওটাকে বিধ্বস্ত করে দেই।” [বনী ইসরাঈল: ১৬]
৬. যুহদ বা দুনিয়া বিমুখতা:
ইসলাম মানুষকে দুনিয়ার অতিরিক্ত চাকচিক্যে না ডুবে বরং আখেরাতমুখী হতে উৎসাহিত করে। তাই আমাদের উচিত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়া।
৭. হালাল উপার্জন করা:
আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন মানুষের আয়-ব্যয় সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। তাই আমাদের জন্য আবশ্যক হলো, আয়ের ক্ষেত্রে যেমন হালাল পদ্ধতি অবলম্বন করা তেমনি হালাল খাতে অর্থ খরচ করা।
আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে হারাম উপায় অবলম্বন করা থেকে সর্বান্তঃকরণে দূরে থাকা আবশ্যক।
আমাদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদর্শিত এসব মূলনীতি ঠিক রাখা আবশ্যক।
▪️ কতগুলো পোশাক ব্যবহার করা উচিত?
একজন মুসলিম ব্যক্তির কতগুলো পোশাক থাকা উচিত এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে কোন বক্তব্য আসেনি। তার অর্থ হলো, এ বিষয়টি উন্মুক্ত। সুতরাং সামর্থ্যবান ব্যক্তি প্রয়োজন বোধে দুই তিন বা ততোধিক পোশাক ব্যবহার করতে পারে যদি তা সীমালংঘন পর্যায়ে না যায়।
– কোন সম্পদশালী ব্যক্তি যদি একাধিক পোশাক রাখে এবং একেক সময় একেকটা পরিধান করে এটাকে ‘অপচয়’ বলা যাবে না।
পক্ষান্তরে একজন গরিব মানুষ যদি আর্থিক সংকট থাকার পরেও ধনী মানুষের মত অনেকগুলো পোশাক ক্রয় করে তাহলে এটা তার জন্য অপচয় ও বিলাসিতা হিসেবে গণ্য হবে ।
❇️ অপচয়-এর মূলনীতি:
▪️শাইখ ইবনে উসাইমিন (রহ.)–কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:
আমরা শুনি, অপচয় ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হয়—যেমন: তার কাছে কতটুকু সম্পদ আছে তা অনুযায়ী, সে ব্যবসায়ী হোক বা ধনী?
উত্তরে তিনি বললেন:
“হ্যাঁ, এটি সত্য। অপচয় একটি আপেক্ষিক বিষয়। এটি কাজের নিজের সাথে নয় বরং করণকারীর সাথে সম্পৃক্ত।
যেমন ধরো: একজন গরিব নারী এমন গহনা পরল যা একজন ধনী নারীর গহনার সমান দামের—তাহলে সে কি অপচয়কারী হবে? যদি এই গহনা একটি ধনী নারী নেয়, আমরা বলব, এতে কোনো অপচয় নেই। কিন্তু যদি একটি গরিব নারী নেয়, তবে বলব—এতে অপচয় আছে।
এমনকি খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও অপচয় ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হয়। হতে পারে একজন দরিদ্র মানুষ সামান্য খাবারেই তৃপ্ত হয়ে যায়, অন্যদিকে আরেকজনের জন্য তা যথেষ্ট নয়।
তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, কারো ঘরে মেহমান আসে—সে তখন এমন খাবার পরিবেশন করে যা সে নিজে সাধারণত খায় না। তবে এটিও অপচয় গণ্য হবে না।
সারসংক্ষেপে—অপচয় কাজের নিজস্বতায় নয় বরং কার দ্বারা তা হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে। কারণ মানুষ একরকম নয়।”
[লিকাউল বাবিল মাহতুহ, ৮৮তম পর্ব / ৩৪ নম্বর প্রশ্ন]
▪️তিনি আরও বলেছেন,
“অপচয় হলো—সীমা অতিক্রম করা। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন, তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।
আমরা যদি বলি—অপচয় মানে সীমালঙ্ঘন, তাহলে এটি বিভিন্নরকম হতে পারে।
হতে পারে, কোনো কাজ একজনের জন্য অপচয়, কিন্তু আরেকজনের জন্য নয়।
যেমন, কেউ যদি ২০ লক্ষ রিয়াল দিয়ে একটি বাড়ি কেনে, তারপর ৬ লক্ষ রিয়ালে তা সাজায়, আবার দামি একটি গাড়িও কিনে—
যদি সে ধনী হয়, তাহলে এটি তার জন্য অপচয় নয়, কারণ ধনীদের জন্য এটি সহজ ব্যাপার।
কিন্তু সে যদি ধনী না হয়, তাহলে এটি অপচয় হিসেবে গণ্য হবে—সে মধ্যবিত্ত হোক বা গরিব।
অনেক গরিব মানুষ দেখা যায়, যারা নিজেদের ‘সম্পূর্ণ’ করে তোলার আকাঙ্ক্ষায় বিশাল অট্টালিকা কেনে, ব্যয়বহুল আসবাবে সাজায়—even কিছু টাকা ধার করেও। এটা ভুল।
সারসংক্ষেপে তিন শ্রেণি রয়েছে:
➤ প্রথম: ধনী ব্যক্তি—বর্তমান সময়ে সে যদি ২০ লক্ষ রিয়ালে বাড়ি, ৬ লক্ষ রিয়ালে আসবাব কিনে, গাড়িও নেয়—তবে তাকে অপচয়কারী বলা হবে না।
➤ দ্বিতীয়: মধ্যবিত্ত—এই ধরনের খরচ তার জন্য অপচয়।
➤ তৃতীয়: গরিব—তার জন্য এটি শুধুই অপচয় নয়, বরং বোকামি (সফাহাহ)।
কারণ, কীভাবে সে ঋণ করে এমন কিছু কিনতে পারে, যা তার একান্ত প্রয়োজন নয়?!”
[লিকাউল বাবিল মাহতুহ, ১০৭তম পর্ব / ২৩ নম্বর প্রশ্ন, উৎস: islamqa]
সর্বোপরি বলব, আমাদের উচিত, জীবন যাপনের সবকিছুতে (খাওয়া, পরা, ঘরবাড়ি, সাজসজ্জা, গ্যাস ও পানির ব্যবহার, যানবাহন ইত্যাদি) মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। খুব বেশি মিতব্যয়ী হওয়া কিম্বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘন থেকে দূরে থাকা।
✅ উপদেশ: যদি আলমারিতে অনেক সংখ্যক পোশাক অব্যবহৃত অবস্থায় বছরকে বছর পড়ে থাকে তাহলে সেগুলো গরিবদেরকে দিয়ে দেওয়া উচিত। এতে বিশাল সওয়াব অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু অপ্রয়োজনে সেগুলো জমিয়ে রাখা এক ধরনের মানসিক সংকীর্ণতা বা কৃপণতা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার। সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate