Friday, June 20, 2025

নাপাকি লেগে থাকা কাপড় পড়ে সালাত আদায় করার শারঈ হুকুম

 প্রশ্ন: যদি কারো কাপড়ে নাপাকি (নাজাসাত) লেগে থাকে, তাহলে সে অবস্থায় সালাত আদায় করার শারঈ হুকুম কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জেনে রাখা জরুরি তা হচ্ছে নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন করা সালাত শুদ্ধতার একটি শর্ত। যদি কারো পোশাকে নাপাকী লেগে থাকে এবং সে তা পরিষ্কার না করেই সালাত আদায় করে, তবে তার সালাত শুদ্ধ হবে না; বরং তা বাতিল গণ্য হবে। কেননা সে এমন এক অবস্থায় সালাত আদায় করেছে যা শরীয়তের বিধানবিরুদ্ধ এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা আদেশ করেছেন, তা থেকে বিচ্যুত। এই প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার এই দ্বীনে কোনো নতুন কিছু উদ্ভাবন করল যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।’’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করল, যাতে আমাদের নির্দেশ নেই, তা বর্জনীয়।’’(সহীহ বুখারী: ২৬৯৭; মুসলিম: ১৭১৮; আবূ দাউদ: ৪৬০৬; ইবনু মাজাহ: ১৪) “অতএব কেউ যদি নাপাক পোশাকে সালাত আদায় করে, তবে সে এমন একটি পদ্ধতিতে ইবাদত করেছে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে অগ্রাহ্যযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এই বিধান নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। এই বিষয়টি পরিস্কার ভাবে বুঝার জন্য বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। আমরা এই বিষয়টি তিনটি পয়েন্টে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
.
❑ প্রথমত: পবিত্রতা দুই প্রকার: (১). হাদাস (নাপাক অবস্থা) থেকে পবিত্রতা এবং (২).নাজাস (নাপাক বস্তু) থেকে পবিত্রতা।
(১)। হাদাস (নাপাক অবস্থা) থেকে পবিত্রতা: এটি আবার দুই ধরনের যথা: গুরু হাদাস ও লঘু হাদাস থেকে পবিত্রতা। যে ব্যক্তি হাদাসগ্রস্ত (যে ব্যক্তির ওযু নেই) অবস্থায় নামায পড়ে আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে তার নামায সঠিক নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “তোমাদের কারো ওযু ভঙ্গ হলে; ওযু না-করা অবধি আল্লাহ্‌ তার নামায কবুল করেন না।”(সহীহ বুখারী হা/৬৯৫৪)
.
(২)। নাজাস থেকে পবিত্রতা। যে ব্যক্তি জেনেশুনে স্মরণ থাকা অবস্থায় কোন নাপাকি নিয়ে সালাত পড়ে তার সালাত সহিহ নয়। জেনে রাখা ভাল যে সালাত আদায়কারীর জন্য তিনটি স্থানের নাপাকি দূর করা আবশ্যক:
.
প্রথম স্থান: নিজ দেহ। সালাত আদায়ের পূর্বে সালাত আদায়কারীর দেহ সম্পূর্ণরূপে পবিত্র থাকা আবশ্যক। শরীরের কোনো অংশে নাপাকি থাকলে তা সালাতের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত একটি সহিহ হাদীসে। তিনি বলেন:”নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন তিনি বললেন: “নিশ্চয় এ দুজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তবে কোন কবিরা গুনাহর কারণে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন চোখলখুরী করে বেড়াত। অপরজন পেশাব থেকে নিজেকে পবিত্র রাখত না…।”(সহিহ মুসলিম, হা/২৯২) এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, শরীর পবিত্র রাখা শুধু সালাতের জন্যই নয়, বরং দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
.
দ্বিতীয় স্থান: পোশাক। সালাত আদায়ের পূর্বে নামাযীর পোশাক সম্পূর্ণরূপে পবিত্র থাকা আবশ্যক। এর সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) এর হাদিসে তিনি বলেন: “একবার এক নারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল: আমাদের কেউ যখন তার পোশাকে হায়েযগ্রস্ত হয় তখন সে কি করবে; সে ব্যাপারে অবহিত করুন। তিনি বললেন: খসে ফেলে দিবে। এরপর পানি দিয়ে ঘষে ধুয়ে ফেলবে এবং তাতে নামায পড়বে।”(সহিহ বুখারী হা/২২৭)
.
তৃতীয় স্থান: সালাত পড়ার স্থান। সালাত আদায়ের পূর্বে সালাত আদায়ের স্থানও পবিত্র থাকা আবশ্যক। এর সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে আনাস বিন মালিক (রাঃ) এর হাদিসে তিনি বলেন: “একবার এক বেদুঈন এসে মসজিদের এক প্রান্তে পেশাব করে দিল। লোকেরা তাকে ধমকালো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে নিষেধ করলেন। যখন সে পেশাব শেষ করল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড় এক বালতি পানি আনার ও পেশাবের উপর ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।”(সহিহ বুখারী হা/২২১)
.
❑ দ্বিতীয়ত: যখন কাপড়ে নাপাকী লেগে যায় তখন তার তিনটি অবস্থা হতে পারে:
.
(১).যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে কাপড়ের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নাজাসাত (অপবিত্রতা) লেগেছে, তাহলে অবশ্যই ওই নির্দিষ্ট স্থানটুকু ধুয়ে ফেলতে হবে।
.
(২).যদি প্রবল ধারণা হয় যে, নাজাসাত (অপবিত্রতা) পোশাকের নির্দিষ্ট কোনো একটি স্থানে লেগেছে, তবে ওই স্থানটুকুও ধুয়ে ফেলতে হবে।
.
(৩).যদি সন্দেহ থাকে যে কোথায় নাপাকী লেগেছে, একাধিক স্থানের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ওই ক্ষেত্রে প্রথমে অনুসন্ধান করতে হবে এরপর নিজের প্রবল ধারণা অনুযায়ী যে স্থানে নাপাকি লেগেছে বলে মনে হয়, শুধু সেই স্থানটি ধুয়ে ফেলাই যথেষ্ট হবে।”(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইবনু উসাইমীন; আশ-শারহুল মুমতি, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২২১)
.
❑ তৃতীয়ত: কাপড়ে নাজাসাত (অপবিত্রতা) থাকা অবস্থায় সালাত আদায়কারীর দুটি অবস্থা হতে পারে।
.
(১).যদি কোনো ব্যক্তি নিশ্চিত জানার পরও নাজাসাত (অপবিত্র) কাপড়ে সালাত আদায় করে তাহলে তার ঐ সালাত শুদ্ধ হবে না। তাকে পুনরায় পবিত্র কাপড়ে সালাত আদায় করতে হবে। এর কারণ সালাতের শর্তসমূহের মধ্যে একটি হলো পোশাক পবিত্র থাকা। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আসমা বিনতে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত একটি সহিহ হাদীসে এসেছে:”একবার এক নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল: আমাদের কেউ যদি হায়েয (মাসিক রক্ত) দ্বারা তার কাপড় অপবিত্র করে ফেলে, সে অবস্থায় সে কী করবে? তিনি উত্তরে বললেন: সে যেন তা খুঁটে ফেলে, এরপর পানি দিয়ে ঘষে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলে, তারপর ঐ কাপড়ে সালাত আদায় করে।”(সহিহ বুখারী, হা/২২৭) এই হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কাপড় পবিত্র না থাকলে সালাত আদায় করা জায়েয নয়, বিশেষত যদি তা জানা থাকে। তাই অপবিত্রতা সম্পর্কে জেনে বুঝে সালাত আদায় করলে, তা বৈধ হবে না এবং তা পুনরায় আদায় করা আবশ্যক।
.
(২).যদি কেউ অজান্তে বা ভুলক্রমে এমন পোশাক পরিধান করে সালাত আদায় করে যাতে নাপাকি (নাজাসাত) লেগে ছিল কিংবা জানার পর ভুলে গেছে অতঃপর সালাত সম্পন্ন করার পর জানা গেল যে, কাপড়ে নাপাকি ছিল। অথবা কাপড়ে নাপাকি থাকার কথা আগে থেকেই জানতো কিন্তু ভুলে গিয়েছে। সালাত শেষ হওয়ার পর সেকথা স্মরণ হল। তবে অধিকাংশ আলেমের বিশুদ্ধ মতে তার সালাত সহিহ হয়েছে; তা পুনরায় আদায় করার প্রয়োজন নেই। কেননা সে তো এই নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়েছে না জেনে অথবা ভুলক্রমে। আর আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا“হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোন কিছু করে ফেলি তবে আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না।” (সূরা বাক্বারা: ২৮৬) “আল্লাহ্ বলেন, আমি তাই করলাম।” অর্থাৎ পাকড়াও করলাম না। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) এই অভিমতকে অধিকাংশ আলেমের অভিমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং নিজে এই অভিমতকে নির্বাচন করেছেন।(নববী আল-মাজমু; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৬৩) আর এই মাসয়ালায় খাস একটি দলিলও রয়েছে। সেটি হলো একদা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুতা নিয়ে সালাত আদায় করছিলেন, কিন্তু তাতে ছিল নাপাকি। তিনি তা জানতেন না। জিবরীল (আঃ) সে ব্যাপারে তাঁকে অবহিত করলে নামায চলাবস্থায় তিনি তা খুলে ফেললেন। এক্ষেত্রে তিনি নতুন করে সালাত আদায় করেননি।(হাদিসটি দেখুন আবু দাউদ হা/৬৫০; মুসনাদ আহমাদ হা/৪৬, ৪০০; মিশকাত হা/৭৬৬) সুতরাং যদি এটি সালাতের প্রথম অংশকে বাতিল না করে থাকে তাহলে অবশিষ্ট সালাতও  বাতিল করবে না। আর এ থেকে প্রমাণিত হয় সালাত অবস্থায় যদি নাপাকির ব্যাপারে জানতে পারে, তবে সালাত অবস্থাতেই উহা বিদূরীত করার চেষ্টা করবে যদি উহা বিদূরীত করতে গিয়ে সতর ঢেকে রাখার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা না হয়। অনুরূপভাবে যদি ভুলে যায় আর সালাতরত অবস্থায় তা স্মরণ হয়, তবে সতরের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা না হলে সালাত না ভেঙ্গেই উক্ত কাপড় খুলে ফেলবে। কিন্তু যদি সালাত শেষ হওয়ার পর স্মরণ হয় বা নাপাকি সম্পর্কে জানতে পারে, তবে সালাত বিশুদ্ধ হবে ফিরিয়ে পড়ার দরকার হবে না।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] হাম্বলি মাযহাব এর বিখ্যাত গ্রন্থ জাদিল মুস্তাকনির ব্যাখায় বলেন:
وقوله: (أو نَسيَها) أي: نَسيَ أنَّ النَّجاسة أصابته ، ولم يذكر إلا بعد سلامه فعليه الإعادة على كلام المؤلِّف ؛ لإخلاله بشرط الصَّلاة ؛ وهو اجتناب النجاسة ، فهو كما لو صَلَّى محدثاً ناسياً حدثه.
ومثل ذلك لو نسيَ أن يغسلها .
والرَّاجح في هذه المسائل كلِّها : أنه لا إعادة عليه سواء نسيها ، أم نسي أن يغسلها ، أم جهل أنها أصابته ، أم جهل أنها من النَّجاسات ، أم جهل حكمها ، أم جهل أنها قبل الصَّلاة ، أم بعد الصلاة .
والدَّليل على ذلك : القاعدة العظيمة العامة التي وضعها الله لعباده وهي قوله: ( لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ رَبَّنَا لا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا ) وهذا الرَّجُل الفاعل لهذا المحرَّم كان جاهلاً أو ناسياً ، وقد رفع الله المؤاخذة به ، ولم يبقَ شيء يُطالب به .
وهناك دليل خاصٌّ في المسألة ، وهو أنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم حين صَلَّى في نعلين وفيهما قَذَرٌ ؛ وأعلمه بذلك جبريل لم يستأنف الصَّلاة ، وإذا لم يُبْطِل هذا أولَ الصَّلاة ، فإنه لا يُبْطِلُ بقيَّة الصَّلاة “
গ্রন্থকারের বক্তব্য: “ভুলে গেছে”: অর্থাৎ নাপাকি যে লেগেছে সেটি ভুলে গেছে এবং সালাম ফেরানোর পূর্বে তার মনে পড়েনি; তাহলে গ্রন্থকারের মতানুযায়ী তাকে পুনরায় সালাত পড়তে হবে। যেহেতু ‘নাপাকি দূর করা’ শীর্ষক সালাতের শর্তটি এতে লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই এ ব্যক্তির অবস্থা এমন যে ব্যক্তি ওযু ভাঙ্গার কথা ভুলে গিয়ে ওযু ছাড়া সালাত পড়ে ফেলেছে এবং ঐ ব্যক্তির মত যে ব্যক্তি নাপাকি ধোয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল। এ সবকটি মাসয়ালায় অগ্রগণ্য অভিমত হলো: পুনরায় সালাত পড়া তার উপর আবশ্যক নয়; হোক সে ব্যক্তি নাপাকি লাগার কথা ভুলে গেছেন কিংবা নাপাকি ধোয়ার কথা ভুলে গেছেন কিংবা নাপাকি যে লেগেছে সেটাই জানত না; কিংবা সেগুলো যে, নাপাকি সেটাই জানত না; কিংবা নাপাকির হুকুম জানত না; কিংবা নাপাকিটা কি সালাতের আগের, না পরের সেটা জানত না। এর সপক্ষে দলিল হলো সেই মহান সাধারণ মূলনীতি যা আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের জন্য প্রণয়ন করেছেন: “আল্লাহ্‌ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কাজ চাপিয়ে দেন না। সে যা (ভাল) উপার্জন করে তার সুফল সে পায়, আবার যা (মন্দ) উপার্জন করে তার কুফলও সে ভোগ করে। হে আমাদের প্রভু! আমরা যদি ভুলে যাই কিংবা ভুল করি তাহলে আমাদেরকে শাস্তি দিবেন না।”[সূরা বাক্বারা, ২: ২৮৬] এই হারাম কাজ যে লোক করেছে সে অজ্ঞ ছিল কিংবা বিস্মৃতিগ্রস্ত ছিল। এমন লোককে পাকড়াও করা থেকে আল্লাহ্‌ নিস্তার দিয়েছেন। সুতরাং তার উপর কোন কিছু আরোপ করার বাকী নেই। এই মাসয়ালায় খাস একটি দলিলও রয়েছে। সেটি হলো যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন দুইটি জুতা পরে সালাত আদায় করলেন যে জুতাতে ময়লা ছিল এবং জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁকে বিষয়টি অবহিত করলেন তখন তিনি নতুনভাবে সালাত শুরু করলেন না। যদি এটি সালাতের প্রথম অংশকে বাতিল না করে থাকে তাহলে অবশিষ্ট সালাতকেও বাতিল করবে না।”(ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৩২) থেকে সমাপ্ত]
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:”যদি কোনো ব্যক্তি জানে যে তার শরীর বা পোশাকে নাপাকী (নাজাসাত) লেগেছে, কিন্তু তা সালাতের সময় ভুলে যায় এবং সালাত শেষ হওয়ার পর স্মরণ করে তাহলে তার ঐ সালাতের হুকুম কী?
জবাবে শাইখ বলেন:
:إذا كان على بدن الإنسان أو ثوبه نجاسة فنسي ذلك ولم يذكر إلا بعد الصلاة فصلاته صحيحة؛ لعموم قوله سبحانه: رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا [البقرة:286]، وصح عن رسول الله ﷺ أن الله سبحانه قال: قد فعلت.ولما ثبت عنه ﷺ أنه في بعض صلواته صلى في نعليه فأتاه جبرائيل فأخبره أن بهما خبثا فخلعهما، ولم يعد أول صلاته، وقال عليه الصلاة والسلام لأصحابه: إذا أتى أحدكم الصلاة فليقلب نعليه، فإن وجد بهما أذى فليزله ثم ليصل فيهما، فدل ذلك على أن المصلي إذا لم يعلم بالنجاسة في ثوبه أو نعله أو في مصلاه إلا بعد الصلاة، أو لم يذكر ذلك إلا بعد الصلاة، فإن صلاته صحيحة، بخلاف الحدث فإنه إذا صلى وهو محدث ناسيًا فإن صلاته غير صحيحة، وعليه أن يعيدها لقول النبي ﷺ: لا تقبل صلاة أحدكم إذا أحدث حتى يتوضأ, متفق على صحته، وقول النبي ﷺ: لا تقبل صلاة بغير طهور ولا صدقة من غلول أخرجه مسلم في صحيحه، والله ولي التوفيق.
“যদি কোনো ব্যক্তির দেহে বা পোশাকে নাপাকী (নাজাসাত) লেগে থাকে এবং সে তা ভুলে যায় এবং সালাত শেষে তা স্মরণ হয়, তাহলে তার সালাত শুদ্ধ। কারণ আল্লাহর এ সাধারণ বাণীর অন্তর্ভুক্ত:﴿رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا﴾(অর্থাৎ) ‘হে আমাদের রব! আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুল করি, তাহলে আমাদেরকে পাকড়াও করো না।’ (সূরা আল-বাকারা: ২৮৬) এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “(আমি তা করেছি।)” [অর্থাৎ আমি এই দোআ কবুল করেছি।] আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত আছে যে, তিনি একদা জুতা পায়ে দিয়ে সালাত আদায় করেছিলেন, অতঃপর জিবরাঈল (আ.) এসে তাঁকে জানালেন যে, জুতাদ্বয়ে অপবিত্র কিছু লেগে আছে। তখন তিনি তা খুলে ফেলেন এবং প্রথম দিকের (আদায় করা) সালাত পুনরায় পড়েননি। তিনি সাহাবীদের বললেন:“তোমাদের কেউ যখন সালাতে আসে, সে যেন তার জুতাদ্বয় উল্টে দেখে; যদি তাতে কোনো ময়লা দেখে, তাহলে তা দূর করুক, তারপর সে তা পরেই সালাত আদায় করুক।”(আবু দাউদ হা/৬৫০) এ থেকে প্রমাণিত হয়, যদি কোনো সালাত আদায়কারী তার পোশাক, জুতা বা সালাতের স্থান নাপাক হওয়ার বিষয়টি সালাতের পূর্বে না জানে, বা সালাতের পরে স্মরণ হয়, তাহলে তার সালাত শুদ্ধ। তবে হাদাস (অজু ভঙ্গ) ভিন্ন বিষয়।যদি কেউ অজু ছাড়াই ভুলবশত সালাত আদায় করে, তাহলে তার সালাত সহীহ হবে না এবং তাকে তা পুনরায় আদায় করতে হবে। কেননা, নবী ﷺ বলেছেন:“তোমাদের কেউ যখন অজু ভঙ্গ করে, তার সালাত কবুল হবে না যতক্ষণ না সে ওযু করে।”(এ হাদীস দু’জন ইমাম বুখারী ও মুসলিম একমত হয়ে বর্ণনা করেছেন) আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত গ্রহণযোগ্য নয়, এবং গনীমতের খিয়ানতের ধন-সম্পদ থেকে কোনো সদকা (যাকাত) কবুল হয় না।”(এটি ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন হা/২২৪) আল্লাহই তাওফীক দানকারী।”(বিন বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ২৯; পৃষ্ঠা: ১০৯)
.
আর যদি কেউ নাপাকী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে (অর্থাৎ জানত না),তাহলে করনীয় কি এ বিষয়ে শাইখ ইবনু বায (রহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে জবাবে তিনি বলেন:إذا كان لم يعلم نجاستها إلا بعد الفراغ من الصلاة فصلاته صحيحة، لأن النبي صلى الله عليه وسلم لمَّا أخبره جبريل وهو في الصلاة أن في نعليه قذَراً خلعهما ولم يُعد أول الصلاة. وهكذا لو علمها (أي النجاسة) قبل الصلاة ثم نسي فصلى فيها ولم يذكر إلا بعد الصلاة، لقول الله عز وجل: (ربنا لا تؤاخذنا إن نسينا أو أخطأنا)…أما إذا شك في وجود النجاسة في ثوبه وهو في الصلاة لم يجز له الانصراف منها سواء كان إماماً أو منفرداً وعليه أن يتم صلاته.”)ব্যক্তি যদি সালাত শেষ হওয়ার পর নাপাকীর বিষয়টি জানতে পারে, তাহলে তার সালাত সহীহ (সঠিক)। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে ছিলেন, তখন জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁকে জানালেন যে, তাঁর জুতার মধ্যে নাপাকী রয়েছে। তখন তিনি জুতা খুলে ফেলেন, কিন্তু সালাতের শুরু থেকে তা পুনরায় পড়েননি।”
একইভাবে যদি কেউ সালাত আদায়ের আগে জানতো যে তার কাপড়ে নাপাকী আছে, কিন্তু পরে ভুলে যায় এবং সে পোশাকেই সালাত  আদায় করে ফেলে, তারপর সালাত শেষে মনে পড়ে তাহলেও তার সালাত শুদ্ধ। এর দলীল হলো আল্লাহ তাআলার বাণী:“হে আমাদের রব! যদি আমরা ভুল করি কিংবা ভুলে যাই, তবে আমাদেরকে পাকড়াও করো না।”(সূরা আল-বাকারা: ২৮৬) আর যদি কেউ সালাতের মধ্যে সন্দেহ করে যে তার কাপড়ে (বা শরীরে) নাপাকী আছে কি না, তাহলে তার জন্য সালাত ভেঙে ফেলা বৈধ নয়; সে ইমাম হোক বা একাকী সালাত আদায়কারী। বরং তার উপর কর্তব্য হচ্ছে সালাত সম্পন্ন করা।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৩৯৬-৩৯৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate