Friday, June 20, 2025

ইসলামি ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে লভ্যাংশ ভোগ করা যাবে কি

 প্রশ্ন: সুদী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য কি? ইসলামি ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে লভ্যাংশ ভোগ করা যাবে কি?

▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদভিত্তিক লেনদেন এবং ইসলামী ব্যাংকের বৈধ লেনদেনের পার্থক্য হচ্ছে;
.
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মূলত যে সুদভিত্তিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল,যা নিঃসন্দেহে হারাম। এই ব্যবস্থার ভিত্তি হলো ঋণ প্রদান ও গ্রহণের মাধ্যমে সুদ অর্জন। একদিকে, ব্যাংক গ্রাহকদেরকে সুদের বিনিময়ে ঋণ প্রদান করে। অপরদিকে, গ্রাহকগণ যখন ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে, তখন তারা ব্যাংককে সুদের বিনিময়ে ঋণ প্রদান করে।সুদের বিনিময়ে ঋণ প্রদান,যা কুরআন সুন্নাহ এবং এই উম্মতের ইজমা তথা সর্বসম্মত মতে স্পষ্ট হারাম।হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:وَكُلُّ قَرْضٍ شَرَطَ فِيهِ أَنْ يَزِيدَهُ ، فَهُوَ حَرَامٌ بِغَيْرِ خِلَافٍ ، قَالَ ابْنُ الْمُنْذِرِ : أَجْمَعُوا عَلَى أَنَّ الْمُسَلِّفَ إذَا شَرَطَ عَلَى الْمُسْتَسْلِفِ زِيَادَةً أَوْ هَدِيَّةً ، فَأَسْلَفَ عَلَى ذَلِكَ : أَنَّ أَخْذَ الزِّيَادَةِ عَلَى ذَلِكَ رَبًّا .وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ، وَابْنِ عَبَّاسٍ ، وَابْنِ مَسْعُودٍ ، أَنَّهُمْ نَهَوْا عَنْ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةً “যে ঋণের মধ্যে ঋণের চেয়ে বেশি পরিশোধ করার শর্তারোপ করা হয় কোন মতভেদ ছাড়া সেটা সুদ। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: তারা (আলেমগণ) এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, ধারদাতা যদি ধারগ্রহীতার কাছে অতিরিক্ত বা উপহারের শর্ত করে এবং সেটার উপর ভিত্তি করে ধার দেয়; তাহলে অতিরিক্ত অংশ গ্রহণ করা সুদ বলে গণ্য হবে। উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা এমন ঋণ থেকে নিষেধ করেছেন যেটা কোন প্রকার উপকার দেয়।”(ইবনু কুদামাহ আল-মুগনী’ খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪০)। সুদী লেনদেনের নানান রূপ রয়েছে। যথা: (১).সুদী ঋণ প্রদান ও গ্রহণ।(২).এক মুদ্রার সাথে অন্য মুদ্রা বিনিময়ের (মুদ্রার বদলে মুদ্রা বিক্রি) ক্ষেত্রে একটি বা উভয়টি প্রদানে বিলম্ব করা। (৩).অতিরিক্ত পরিমাণে কিংবা বিলম্ব করে স্বর্ণের সাথে স্বর্ণ বিনিময় করা। (৪).কিছু বিষয় যা মূলত সুদী ঋণ। যেমন: বিল ডিসকাউন্টিং, সঞ্চয়ী হিসাব, সুদ অথবা উপহার হিসেবে বিনিময় পাওয়া যায় এমন বিনিয়োগ সনদ, কিস্তিতে বিক্রির ক্ষেত্রে বিলম্বের জরিমানা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অর্থ উত্তোলন।
.
অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলো শরিয়তসম্মত ও বৈধ লেনদেনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যেমন: ক্রয়-বিক্রয় (বাই), মুদারাবা (অংশীদারভিত্তিক মুনাফাভাগ), এবং মুশারাকা (অংশীদারিত্ব)। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে তারা বিনিয়োগ করে এবং মুনাফা অর্জন করে। এছাড়াও, ইসলামী ব্যাংক মানি ট্রান্সফার ফি, মুদ্রা বিনিময় হারে পার্থক্য এবং মানি এক্সচেঞ্জ কার্যক্রম থেকে বৈধভাবে উপকৃত হয়। সুদভিত্তিক এবং শরিয়তসম্মত লেনদেনের মাঝে পার্থক্য করা এবং এ ধরনের লেনদেন করার ক্ষেত্রে ব্যাংক কীভাবে উপকৃত হয়, তার একটি সরল উদাহরণ হলো: কাস্টমার (গ্রাহক) যদি তার অর্থ থেকে উপকৃত হতে চায়, অর্থ বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে সে বাণিজ্যিক সুদী ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে অর্থ জমা করে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ দেয়। সাথে মূলধনের নিশ্চয়তাও প্রদান করে। এটি আসলে ব্যাংকের কাছে গ্রাহকের দেওয়া একটি সুদী ঋণ। এর বিপরীতে ব্যাংক সেই জমাকৃত অর্থ আরেকজন গ্রাহককে সুদের ভিত্তিতে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। ফলে ব্যাংক একটি দিক থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করে, অন্যদিকে সুদে ঋণ প্রদান করে এবং এই দুইয়ের মধ্যকার সুদের ব্যবধান থেকেই সে মুনাফা অর্জন করে।
.
অপরদিকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ পদ্ধতি হলো ইসলামী ব্যাংকগুলো গ্রাহকের নিকট থেকে অর্থ গ্রহণ করে শরিয়ত অনুমোদিত কোনো ব্যবসা, নির্মাণ প্রকল্প অথবা অনুরূপ কার্যক্রমে মুদারাবা ভিত্তিতে তা বিনিয়োগ করা। এই প্রক্রিয়ায় একটি শর্ত থাকে যে, প্রকল্পটি লাভজনক হলে ব্যাংক গ্রাহককে লাভের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রদান করবে। একইভাবে, শ্রমদাতা বা ব্যবস্থাপনার পক্ষ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকও লাভের একটি অংশ গ্রহন করবে। প্রকল্প থেকে অর্জিত লাভই ইসলামী ব্যাংকের প্রকৃত আয়। বাস্তবে, কখনো কখনো এই হালাল লাভ সুদভিত্তিক ব্যাংকের হারাম আয়ের চেয়েও বহুগুণে বেশি হয়ে থাকে। তবে মুদারাবায় একটি স্বাভাবিক ঝুঁকি থাকে। উপযুক্ত ও লাভজনক প্রকল্প নির্বাচন করা, সেটির কার্যকারিতা নিরীক্ষণ করা, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যবেক্ষণে শ্রম ব্যয় করতে হয়। ইসলামী ব্যাংক ও সুদভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো একদিকে হারাম সুদ, অন্যদিকে বৈধ মুদারাবা; যেখানে একজন গ্রাহক অর্থ হারাতেও পারেন, কারণ এতে মূলধনের নিশ্চয়তা থাকে না। তবে, প্রকল্পটি লাভজনক হলে তিনি হালাল আয় লাভ করেন।
সারসংক্ষেপে ইসলামী ব্যাংকের সামনে লাভ অর্জনের বহু বৈধ ও ন্যায্য পথ খোলা রয়েছে। এ কারণেই এসব ব্যাংকের প্রসার ঘটছে এবং দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। এমনকি কিছু অমুসলিম দেশও ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা গ্রহণ বা প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, কারণ এই ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায় এবং সুদভিত্তিক পদ্ধতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হয় যা অর্থনৈতিক ধ্বংস ও ব্যক্তিগত ক্ষতির অন্যতম কারণ।
.
▪️ইসলামি ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে লভ্যাংশ ভোগ করার বিধান কি?
.
❑ প্রথমত: প্রথমেই মনে রাখা জরুরি, শুধুমাত্র কোনো ব্যাংকের নামের সঙ্গে ‘ইসলামী’ শব্দ সংযুক্ত করলেই সেটি ইসলামী ব্যাংক হয়ে যায় না। ইসলামী ব্যাংক বলতে মূলত সেইসব ব্যাংককেই বোঝায়, যারা পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামি শরীয়তের বিধি-বিধান ও নীতিমালা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ব্যাংকের নাম ইসলামি না হলেও, যদি তা শরীয়ত সম্মতভাবে পরিচালিত হয়, তবে তাকেও ইসলামী ব্যাংক হিসেবে গণ্য করা যাবে। সুতরাং শুধু নাম নয় মূল পরিচয় লুকিয়ে থাকে কার্যপদ্ধতি ও নীতিমালায়। অতএব যদি কোনো ব্যাংক “ইসলামী ব্যাংক” হিসেবে পরিচিত হলেও বাস্তবে সুদভিত্তিক লেনদেন বা শরিয়ত পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, তবে তা প্রকৃত অর্থে ইসলামী ব্যাংক নয়। এমন প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করা, সেখানে অর্থ জমা রাখা জায়েজ নয়। কারণ এতে হারাম কার্যক্রমে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন:”তোমরা ন্যায় ও তাকওয়ার পথে একে অপরকে সাহায্য করো, আর পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সাহায্য কোরো না।”(সূরা মায়িদা, আয়াত: ২)। অন্যদিকে যদি কোনো ব্যাংক সত্যিকারের ইসলামী আদর্শ মেনে চলে অর্থাৎ কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয় এবং সুদ ও হারাম লেনদেন থেকে পুরোপুরি দূরে থাকে তাহলে সে ব্যাংকের সাথে লেনদেন করা, অর্থ জমা রাখা এবং ব্যবসা করা জায়েয। বরং তা প্রশংসনীয়ও। কারণ এমন উদ্যোগ হালাল ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায় এবং সুদনির্ভর সমাজব্যবস্থার বিকল্প গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।
.
❑ দ্বিতীয়ত: বর্তমানে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহ ঠিক কোন শরঈ নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এ বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। ফলে এসব ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে সেখান থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ সম্পূর্ণরূপে হালাল না হারাম এই ব্যাপারে নির্দিষ্টভাবে মত প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে দেশের সুপরিচিত একদল আলেমের মতে, বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহ মূলত মুদারাবা ভিত্তিক লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের নীতিতে পরিচালিত হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা এসব ব্যাংকে অর্থ আমানত রেখে প্রাপ্ত লভ্যাংশকে শরিয়তসম্মত মনে করেন। তবে একথাও সঠিক যে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকই সম্পূর্ণভাবে সুদমুক্ত নয়। যদিও কিছু ব্যাংক নিজেদেরকে ‘ইসলামী ব্যাংক’ বলে দাবি করে, বাস্তবে তারা শতভাগ শরীয়াহ্‌নির্ভর নয়। কারণ প্রতিটি ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নীতিমালার অধীন, যা সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে গভীরভাবে জড়িত। ইসলামী ব্যাংকগুলো যে খাতে বিনিয়োগ করে, সে সম্পর্কেও গ্রাহকদেরকে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তথ্য সরবরাহ করা হয় না। অনেক সময় বিনিয়োগের প্রকৃত খাত গোপন রাখা হয় অথবা সে বিনিয়োগ সুদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যাংক তৃতীয় পক্ষ হিসেবে একটি পণ্য নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয় করে, অতঃপর তা কিস্তিতে অধিক মূল্যে গ্রাহকের নিকট বিক্রি করে এটি প্রকৃত অর্থে সুদেরই একটি কৌশলগত রূপ। শরীয়াহ মতে এই ধরনের লেনদেন সন্দেহজনক। আর ইসলামী শরী‘আতের স্থিরীকৃত নীতিমালাসমূহের মধ্যে রয়েছে,إذا اجتَمَع الحلالُ والحرامُ غُلِّبَ الحرامُ “যখন কোন বিষয়ে হালাল ও হারামের মাসআলা একত্রিত হয়, তখন হারামের মাসআলা প্রাধান্য পায়’। অর্থাৎ সেটাকে হারাম বলে গণ্য করতে হবে।” নবী (ﷺ) বলেন إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيْرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِيْنِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ “নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর উভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়। অনেক মানুষই সেগুলোর বাস্তবতা জানে না। যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে, আর যে লোক সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে, সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে’ (বুখারী, হা/৫২, ২০৫১; সহীহ মুসলিম হা/১৫৯৯)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, دَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيْبُكَ فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأْنِيْنَةٌ وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيْبَةٌ “যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে দিয়ে যাতে সন্দেহের সম্ভাবনা নেই তা গ্রহণ কর। যেহেতু সত্য হল স্বস্তি এবং মিথ্যা হল সন্দেহপূর্ণ” (তিরমিযী হা/২৫১৮; নাসাঈ হা/৫৭১১)। এই কারণে শরীয়াহ্‌সম্মত লভ্যাংশের আশায় এ ধরনের ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ করাও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ও শঙ্কাস্পদ। একজন ধর্মভীরু মুসলমানের উচিত এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং পরিপূর্ণ হালাল উৎস নিশ্চিত করে তবেই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তাই আমি আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক মুদারাবা ভিত্তিক বিনিয়োগ কখন শরীয়তসম্মত হয় তা বোঝার জন্য নিচে কয়েকটি মৌলিক শর্ত উপস্থাপন করছি। আপনারা যারা ইসলামি ব্যাংকে মুদারাবা পদ্ধতিতে অর্থ জমা রাখতে চান, তারা অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
.
❑ তৃতীয়ত: আমানতের পরিচয় ও তার প্রকারভেদ:
.
অমানত বলতে এমন বস্তু বা সম্পদকে বোঝানো হয়, যা কারো কাছে কেবল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জমা রাখা হয় কোনো প্রকার লেনদেন বা ব্যবহার করার অধিকার না দিয়ে। হোটেল কিংবা অনুরূপ স্থানে ‘লকার’ নামে যেসব নিরাপদ সংরক্ষণব্যবস্থা থাকে, সেগুলো এই সংজ্ঞার আওতাভুক্ত। কোনো কোনো ব্যাংকেও এ ধরনের লকার-সেবা থাকতে পারে। অপরদিকে, প্রচলিত অর্থে যেটিকে ‘ব্যাংকিং আমানত’ বলা হয়, তা আসলে এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, ব্যাংক কেবল জমাকৃত অর্থ সংরক্ষণ করে না; বরং সেই অর্থকে বিভিন্ন লেনদেন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে। এই হলো আমানতের মৌলিক ধারণা। আর হুকুমের দিক থেকে ব্যাংকে (ডিপোজিট) আমানত দুই প্রকার: (১).লাভবিহীন আমানত ও (২).সঞ্চয়ী আমানত।
.
(১).লাভবিহীন আমানত বা (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট): এটাকে চাহিবামাত্র প্রদেয় আমানত কিংবা চলতি হিসাব বলা হয়। এর বৈশিষ্ট্য হল গ্রাহক ব্যাংকে তার অর্থ জমা রাখবেন এবং যখন ইচ্ছা তখন উত্তোলন করতে পারবেন। তবে কোন লাভ পাবেন না। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরণের লেনদেনে কোন আপত্তি নেই। যেহেতু এটি প্রকৃতপক্ষে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ। কিন্তু যদি ব্যাংকটি সুদি ব্যাংক হয় তাহলে এমন ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা জায়েয নয়। যেহেতু সুদি ব্যাংক এ অর্থ থেকে উপকৃত হবে এবং এ অর্থের মাধ্যমে তার হারাম কর্মকাণ্ডগুলোকে মজবুত করবে। তবে কোন গ্রাহকের যদি তার অর্থ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয় এবং অন্য কোন ইসলামী ব্যাংক না পান সেক্ষেত্রে তার সম্পদ সুদি ব্যাংকে সংরক্ষণ করলে গুনাহ হবে না।
.
(২).সঞ্চয়ী আমানত বা (ইনভেস্টমেন্ট ডিপোজিট): এই প্রকার আমানতের বৈশিষ্ট্য হল গ্রাহক নির্দিষ্ট মুনাফার প্রত্যাশায় একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে তিনি চুক্তি অনুযায়ী মুনাফা গ্রহণ করেন। এই ধরণের আমানতের কিছু বৈধ (জায়েয) পদ্ধতি রয়েছে, আবার কিছু পদ্ধতি শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ (হারাম)। জায়েয পদ্ধতির মধ্যে হল গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যকার চুক্তিটি মুদারাবা চুক্তি হওয়া। অর্থাৎ ব্যাংক নির্দিষ্ট আনুপাতিক লাভ দেয়ার বিপরীতে মুবাহ (শরিয়ত অনুমোদিত) প্রজেক্টসমূহে আমানতের অর্থ বিনিয়োগ করা। লাভ হলে নির্দিষ্ট অনুপাতে উভয় পক্ষ তা ভাগ করে নেয়। আবার লস হলেও উভয় পক্ষ তা বহন করা। এই চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণের উপর শর্তগুলো হল:
.
(১)। ব্যাংক কর্তৃক মুবাহ খাতগুলোতে অর্থ বিনিয়োগ করা। যেমন উপকারী প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়ন, আবাসন তৈরী, ইত্যাদি। সুদি ব্যাংক বা সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করা কিংবা অস্বচ্ছল লোকদেরকে সুদভিত্তিক ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করা জায়েয হবে না। তাই ব্যাংক কি কি খাতে বিনিয়োগ করে সেটা জানা আবশ্যক।
.
(২)। মূলধন ফেরত দেয়ার গ্যারান্টি না দেয়া। অর্থাৎ লোকসান হলে ব্যাংক গ্রাহকের মূলধন ফেরত দেয়ার দায় গ্রহণ না করা; যতক্ষণ না ব্যাংকের পক্ষ থেকে কসুরের কারণে লোকসান না হয় এবং ব্যাংকই এ লোকসানের প্রধান কারণ না হয়। কেননা যদি মূলধন ফেরত দেয়ার গ্যারান্টি দেয়া হয় এমন চুক্তি প্রকৃতপক্ষে ঋণের চুক্তি। অতিরিক্ত যে মুনাফা আসে সেটি সুদ হিসেবে গণ্য হবে।
.
(৩)। শুরু থেকে লাভ নির্দিষ্ট থাকা ও চুক্তিতে উল্লেখিত থাকা। তবে লাভ নির্দিষ্ট করতে হবে লভ্যাংশের সাধারণ অনুপাতের ভিত্তিতে; মূলধন থেকে নয়। উদাহরণত: এক পক্ষ পাবে লাভের এক তৃতীয়াংশ কিংবা অর্ধেক কিংবা ২০%। অবশিষ্টাংশ পাবে অপর পক্ষ। যদি লাভ অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট থাকে তাহলে এমন চুক্তি সঠিক হবে না। ফিকাহবিদ আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, লাভের অনুপাত অজ্ঞাত থাকলে মুদারাবা চুক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
.
কাতার ভিত্তিক ফাতওয়া বোর্ড ইসলাম ওয়েব’ এর আলিমগণ বলেন,”সূদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকে অর্থ বিনিয়োগ করা শরী‘আতের দৃষ্টিতে আপত্তিকর নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংক ইসলামী শরী‘আতের মূলনীতি অনুযায়ী উক্ত বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর কাজ করবে বা তাকে বৈধ ও হালাল ব্যবসায় লাগাবে এবং বিনিয়োগকারীকে মূলধনের গ্যারান্টি দিবে না (অর্থাৎ লাভ-লোকসান ও ক্ষতির)। অতঃপর লাভ হলে তা চুক্তি অনুপাতে উভয়ের মধ্যে বণ্টন করে নিবে। চুক্তিপত্রে লাভের শতাংশ উল্লেখ থাকা অপরিহার্য। উপরিউক্ত শর্তানুযায়ী বিনিয়োগ করা এবং লভ্যাংশ গ্রহণ করা বৈধ।(ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-২৭৮৬৪৭)।
.
❑ চতুর্থত: মুদারাবার হারাম পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
(১)। মূলধন ফেরত দেয়ার গ্যারান্টি দেয়া। উদাহরণত: গ্রাহক ১০০ মুদ্রা আমানত রাখল; যাতে করে তার মূলধন ফেরত দেয়ার গ্যারান্টিসহ সে ১০ মুদ্রা মুনাফা পায়। এটি সুদভিত্তিক ঋণ। অধিকাংশ ব্যাংকে এ লেনদেন চলে। এ ধরণের লেনদেনকে আমানত কিংবা ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট কিংবা সঞ্চয়ী বই নামে অভিহিত করা হয়। এ মুনাফা বিভিন্ন মেয়াদে বিতরণ করা হয় কিংবা লটারীর মাধ্যমে বিতরণ করা হয়; যেমনটি করা হয় ‘সি’ ক্যাটাগরীর ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে। উল্লেখিত সব লেনদেন হারাম।
.
(২)। ব্যাংক কর্তৃক হারাম প্রজেক্টগুলোতে অর্থ বিনিয়োগ করা। যেমন- সিনেমা হল বানানো, পর্যটন ভিলেজ তৈরী করা; যেসব ভিলেজে শরিয়ত গর্হিত কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, পাপের সয়লাব ঘটে। এমন ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হারাম। যেহেতু এর মাধ্যমে পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হয়।ব্যাংকগুলো যে ধরণের আমানতগুলোর লেনদেন করে সেগুলোর ব্যাপারে এটাই সার কথা।
.
ওআইসি-এর অধিভুক্ত ‘ইসলামী ফিকাহ একাডেমী’ এর সিদ্ধান্তে এসেছে যে:
” أولاً : الودائع تحت الطلب (الحسابات الجارية) سواء أكانت لدى البنوك الإسلامية أو البنوك الربوية هي قروض بالمنظور الفقهي ، حيث إن المصرف المتسلم لهذه الودائع يده يد ضمان لها ، هو ملزم شرعا بالرد عند الطلب .
ولا يؤثر على حكم القرض كون البنك (المقترض) ، مليئاً .
ثانياً : إن الودائع المصرفية تنقسم إلى نوعين بحسب واقع التعامل المصرفي :
أ‌- الودائع التي تدفع لها فوائد ، كما هو الحال في البنوك الربوية ، هي قروض ربوية محرمة ، سواء أكانت من نوع الودائع تحت الطلب (الحسابات الجارية) ، أم الودائع لأجل ، أم الودائع بإشعار ، أم حسابات التوفير .
ب‌- الودائع التي تسلم للبنوك الملتزمة فعليا بأحكام الشريعة الإسلامية بعقد استثمار على حصة من الربح هي رأس مال مضاربة ، وتنطبق عليها أحكام المضاربة (القراض) في الفقه الإسلامي التي منها عدم جواز ضمان المضارب ( البنك ) لرأس مال المضاربة “
এক: চাহিবামাত্র প্রদেয় (চলতি হিসাব) আমানতগুলো ইসলামী ব্যাংকসমূহে হোক কিংবা সুদি ব্যাংকসমূহে হোক ইসলামী ফিকাহর দৃষ্টিতে এগুলো ঋণ। এই আমানতগুলোর উপর গ্রহণকারী ব্যাংকের কর্তৃত্ব হচ্ছে ফেরত দেয়ার গ্যারান্টিযুক্ত কর্তৃত্ব। গ্রাহক চাহিবামাত্র ব্যাংক আমানতের এ অর্থ ফেরত দিতে আইনত বাধ্য। ব্যাংক (ঋণগ্রহীতা) সামর্থ্যবান হওয়ায় এ ঋণের হুকুমের উপর কোন প্রকার প্রভাব পড়বে না।
দুই: ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান লেনদেনের ভিত্তিতে ব্যাংকিং আমানত দুই ধরণের:
ক. যে আমানতগুলোর বিপরীতে মুনাফা দেয়া হয়। সুদি ব্যাংকগুলোতে যা বিদ্যমান। এ ঋণগুলো সুদভিত্তিক ও হারাম; চাই সেগুলো চাহিবামাত্র প্রদেয় (চলতি হিসাব) শ্রেণীর আমানত হোক কিংবা মেয়াদী আমানত হোক কিংবা নোটিশসহ আমানত হোক কিংবা সঞ্চয়ী হিসাব হোক।
খ. যে ব্যাংকগুলো বাস্তবে ইসলামী শরিয়ার বিধিবিধান মেনে চলে সে সব ব্যাংকে বিনিয়োগের চুক্তিতে মুদারাবার মূলধন হিসেবে যে আমানতগুলো জমা করা হয়; এই শর্তে যে লভ্যাংশের একটি ভাগ গ্রাহক পাবে। এমন আমানতগুলোর ক্ষেত্রে ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে উল্লেখিত মুদারাবার বিধিবিধানগুলো প্রযোজ্য। যে বিধানগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, মুদারিব (ব্যাংক) এর জন্য মুদারাবার মূলধনের গ্যারান্টি দেয়া নাজায়েয।”(মাজাল্লাতুল মাজমায়িল ফিকহ; সংখ্যা: ৯; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৯৩১; আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১৩৮৫১; ১৫১৩৬৬)।
.
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বৈধ পথে উপার্জন করা এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate