প্রশ্ন: তায়াম্মুম কাকে বলে? শরীয়তের দৃষ্টিতে তায়াম্মুমের হুকুম কি? তায়াম্মুম সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত কি কি? তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণ সমূহ কি কি? শুদ্ধতম হাদীস অনুসারে তায়াম্মুম করার পদ্ধতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর তায়াম্মুমের সংজ্ঞা: তায়াম্মুম (التيمم) অর্থ ‘সংকল্প করা’। পারিভাষিক অর্থে:আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে পানি না পাওয়া গেলে ওযু বা গোসলের পরিবর্তে নির্দিষ্ট নিয়মে পবিত্র মাটি দ্বারা মুখমন্ডল ও উভয় হাত মাসাহ করাকে তায়াম্মুম বলে।(ফিকহুল মুয়াস্সার,পৃষ্ঠা; ৩২)।এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর অন্যতম বিশেষ অনুগ্রহ। যা ইতিপূর্বে কোন উম্মতকে দেওয়া হয়নি।[ফিক্বহুস সুন্নাহ: খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৯]। এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য আবুবকর-পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কেননা সম্ভবত:৫ম হিজরী সনে বনুল মুছত্বালিক্ব যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে মদীনার উপকণ্ঠে ‘বায়দা’ (البَيْدَاء) নামক স্থানে পৌঁছে আয়েশা (রাঃ)-এর গলার হার হারিয়ে যায়।তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেটি খোঁজার জন্য কাফেলা থামিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে কোন পানি ছিল না। ফলে এভাবেই পানি ছাড়া সকাল হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন।(সূরা মায়েদাহ: ৬; সহীহ বুখারী, ফৎহুল বারী হা/৩৩৪ ‘তায়াম্মুম’ অধ্যায়-৭ হা/৪৬০৮ মুসলিম হা/৮৪২ ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ-২৮)
.
❑ শরীয়তের দৃষ্টিতে তায়াম্মুমের হুকুম:
____________________________________
তায়াম্মুম ইসলামী শরী‘আতে জায়েয,যা আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য বিশেষ ছাড়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,আর যদি তোমরা পীড়িত হও কিংবা সফরে থাক অথবা পায়খানা থেকে আস কিংবা স্ত্রী স্পর্শ করে থাক, অতঃপর পানি না পাও,তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা ‘তায়াম্মুম’ কর ও তা দ্বারা তোমাদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় মাসাহ কর’..।(সূরা মায়েদাহ ৫/৬, নিসা ৪/৪৩)আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ পাক-পবিত্র মাটি মুসলমানকে পবিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে,যদি দশ বছরও সে পানি না পায়। পানি যখন পাবে তখন সে যেন তাঁর গায়ে পানি লাগায়। এটাই তার জন্য উত্তম। নাসায়ীতে ”যদি দশ বছরও যদি পানি না পায়” পর্যন্ত অনুরুপ বর্ণনা করেছেন।(সহীহ আবূ দাঊদ হা/৩৩২, তিরমিযী হা/১২৪,নাসাঈ হা/৩২৪ মিশকাত হা/৫৩০) অপর বর্ননায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সকল মানুষের উপর তিনটি বিষয়ে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। (১) আমাদের (সলাতের) কাতারকে মালায়িকার সারির মত মর্যাদা দেয়া হয়েছে। (২) সমস্ত পৃথিবীকে বানানো হয়েছে আমাদের সলাতের স্থান এবং (৩) মাটিকে করা হয়েছে আমাদের জন্য পবিত্রকারী,যখন আমরা পানি পাবো না।(সহীহ মুসলিম ৫২২, সহীহ আল জামি‘ ৪২২৩, ইরওয়া ২৮৫, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ্ ২৬৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৬৯৭, মিশকাতুল মাসাবিহ, ৫২৬)
.
❑ তায়াম্মুম সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত সমূহ:
_____________________________________

.

.

.

.
(১) যদি পাক পানি না পাওয়া যায়।
(২) পানি পেতে গেলে যদি সালাত ক্বাযা হওয়ার ভয় থাকে।
(৩) পানি ব্যবহারে যদি রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকে।
(৪) যদি কোন বিপদ বা জীবনের ঝুঁকি থাকে ইত্যাদি। উপরোক্ত কারণ সমূহের প্রেক্ষিতে ওযু বা ফরয গোসলের পরিবর্তে প্রয়োজনে দীর্ঘদিন যাবৎ একটানা ‘তায়াম্মুম’ করা যাবে।(সূরা মায়েদাহ ৫/৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৭ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ-১০; বুখারী হা/৩৪৪; তিরমিযী হা/১২৪, ইরওয়া ১৫৩ মিশকাত হা/৫৩০)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “আমি বিছানায় শয্যাশায়ী। নড়াচড়া করার মত শক্তি রাখি না। এমতাবস্থায় আমি নামাযের জন্য কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে পারি ও নামায পড়তে পারি?
জবাবে তাঁরা বলেন:أولا : بالنسبة للطهارة يجب على المسلم أن يتطهر بالماء ، فإن عجز عن استعماله لمرض أو غيره تيمم بتراب طاهر ، فإن عجز عن ذلك سقطت الطهارة وصلى حسب حاله ، قال تعالى: ( فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ) ، وقال جل ذكره : ( وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ ) ، أما ما يتعلق بالخارج من البول والغائط فيكفي فيه الاستجمار بحجر أو مناديل طاهرة ، يمسح بها محل الخارج ثلاث مرات أو أكثر حتى ينقي المحل ” এক: মুসলিমের উপর পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা ওয়াজিব। যদি কোন রোগের কারণে কিংবা অন্য কোন কারণে পানি ব্যবহার করতে অক্ষম হয় তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে। যদি তায়াম্মুমও করতে না পারে তাহালে তার উপর থেকে পবিত্রতার বিধান মওকুফ হয়ে যাবে এবং সে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় নামায পড়বে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তোমরা সাধ্যমত আল্লাহ্কে ভয় কর”। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “তবে দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোন কষ্ট চাপিয়ে দেননি।”(সূরা আল-হাজ্জ আয়াত:৭৮) পক্ষান্তরে, পেশাব ও পায়খানার যা কিছু বের হয় সেটা পাথর দিয়ে কিংবা পবিত্র টিস্যুপেপার দিয়ে পরিষ্কার করাই যথেষ্ট। এগুলো দিয়ে ময়লা বের হওয়ার স্থানটি তিন বা ততোধিকবার পরিষ্কার করবে; যাতে করে স্থানটি নির্মল হয়ে যায়।”(ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৪৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন; “তার বক্তব্য: “কিংবা এটি (পানি) ব্যবহার করলে বা অন্বেষণ করতে গেলে শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা করে” অর্থাৎ যদি পানি ব্যবহার করলে তার শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সে অসুস্থ বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে সে আল্লাহর এই বাণীর সার্বিকতার অন্তর্ভুক্ত হবে: “যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাকো”(সূরা মায়েদা: ৬) অনুরূপভাবে কারো ওযুর অঙ্গসমূহে যদি ক্ষত থাকে কিংবা গোসলের ক্ষেত্রে পুরো শরীরে ক্ষত থাকে এবং (পানির স্পর্শে) শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তাহলে সে তায়াম্মুম করতে পারবে।”(ইবনু উসাইমীন আশ-শারহুল মুমতি: খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৭৮, ৩৭৯; ইবনুল জাওযী প্রকাশনীর ছাপা)
.
(ঙ) পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা। অর্থাৎ যে মাটির সাথে পেশাব-পায়খানা মিশ্রিত হয়েছে,সেই মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েয নয়।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসাহ কর।’(মায়েদাহ: ৬)।ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, صَعِيْدًا বলতে সেই মাটিকে বুঝানো হয়েছে যেই মাটিতে শষ্য উৎপাদন করা হয়। আর طَيِّبًا বলতে পবিত্র মাটিকে বুঝানো হয়েছে।(ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃঃ ৩৩)।তবে ধুলা-মাটিহীন স্বচ্ছ পাথর, কাঠ, কয়লা, লোহা, মোজাইক, প্লাষ্টার, টাইলস, চুন ইত্যাদি দ্বারা ‘তায়াম্মুম’ জায়েয নয়।(আলোচনা দ্রষ্টব্য: সাদেক শিয়ালকোটি,সালাতুর রসূল; টীকা, পৃঃ ১৪৮-৪৯) অতএব পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করতে হবে। কিন্তু যদি মাটি পাওয়া না যায়। তাহলে বালি অথবা পাথর দ্বারাও তায়াম্মুম করা বৈধ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاتَّقُوْا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর।”(সূরা তাগাবুন: ১৬)। আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বালি মাটির অন্তর্ভুক্ত।(ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃষ্ঠা: ৩৪)
.
❑ প্রচণ্ড শীতের দিনে ফরজ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করা জায়েজ?
_____________________________________
যে ব্যক্তির উপর গোসল ফরয হয়েছে সে ব্যক্তি নামায পড়তে চাইলে তার উপর ফরয হচ্ছে– পানি দিয়ে গোসল করে নেয়া। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বানী: “আর তোমরা জুনুবী (অপবিত্র) হলে প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬) তাই কেউ যদি পানি ব্যবহারে অক্ষম হয়– পানি না থাকার কারণে কিংবা পানি থাকলেও এর ব্যবহারে রোগের ক্ষতি হতে পারে কিংবা তীব্র ঠাণ্ডার কারণে (তার কাছে পানি গরম করার মত কিছু না থাকলে); তাহলে সে ব্যক্তি পানি দিয়ে গোসল করার পরিবর্তে মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করতে পারেন। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ মলত্যাগ করে আসে বা তোমরা স্ত্রী সহবাস কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬) এ আয়াতে দলিল রয়েছে যে, অসুস্থ ব্যক্তি পানি ব্যবহার করার ফলে যদি তার মৃত্যু ঘটা, কিংবা রোগ বেড়ে যাওয়া কিংবা আরোগ্য লাভ বিলম্ব হওয়ার আশংকা থাকে সেক্ষেত্রে তিনি তায়াম্মুম করবেন। আল্লাহ্ তাআলা তায়াম্মুমের পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: “তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬) আল্লাহ্ তাআলা এ বিধান প্রদান করার গূঢ় রহস্যও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন কাঠিন্য রাখতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬)
.
আমর বিন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘যাতুস সালাসিল’ এর অভিযানে এক ঠাণ্ডার রাতে আমার স্বপ্নদোষ হয়ে গেল। আমি আশংকা করলাম, আমি যদি গোসল করি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করলাম। এরপর আমার সাথীদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করলাম। আমার সাথীরা বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেন: হে আমর! তুমি কি জুনুবী (গোসল ফরজ হওয়া) অবস্থায় তোমার সাথীদের নিয়ে নামায পড়েছ? তখন আমি তাঁকে জানালাম কি কারণে আমি গোসল করিনি এবং আমি আরও বললাম: আমি শুনেছি আল্লাহ্ বলেন: ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি দয়ালু”(সূরা নিসা, আয়াত: ২৯) তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে দিলেন, কোন কিছু বললেন না।”(সুনানে আবু দাউদ হা/৩৩৪), আলবানী ‘সহিহ সুনানে আবু দাউদ’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)
.
হাফেয ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেন: وفي هذا الحديث جواز التيمم لمن يتوقع من استعمال الماء الهلاك سواء كان لأجل برد أو غيره ، وجواز صلاة المتيمم بالمتوضئين “এ হাদিসে দলিল রয়েছে যে, পানি ব্যবহার করলে যে ব্যক্তি মারা যাওয়ার আশংকা রয়েছে; সেটা ঠাণ্ডার কারণে হোক কিংবা অন্য কোন কারণে হোক তার জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয। তায়াম্মুমকারীর জন্য ওজুকারীদের ইমাম হওয়াও জায়েয।”(ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৫৪)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:إن كنت تستطيع أن تجد ماء دافئا أو تستطيع تسخين البارد ، أو الشراء من جيرانك أو غير جيرانك : فالواجب عليك أن تعمل ذلك ؛ لأن الله يقول : ( فاتَّقوا الله ما استَطَعْتُم ) ، فعليك أن تعمل ما تستطيع من الشراء أو التسخين أو غيرهما من الطرق التي تمكنك من الوضوء الشرعي بالماء ، فإن عجزت وكان البرد شديداً ، وفيه خطر عليك ، ولا حيلة لك بتسخينه ولا شراء شيء من الماء الساخن ممن حولك : فأنت معذور ، ويكفيك التيمم ؛ لقول الله تعالى : ( فاتَّقوا الله ما استَطَعْتُم ) وقوله سبحانه : ( فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ مِنْهُ ) .والعاجز عن استعمال الماء حكمه حكم من لم يجد الماء “যদি আপনার পক্ষে গরম পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় কিংবা আপনি গরম করতে পারেন কিংবা প্রতিবেশি বা অন্য কারো থেকে কিনে নিতে পারেন তাহলে সেটা করা আপনার উপর আবশ্যকীয়। কেননা আল্লাহ্ বলেন: “তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ্কে ভয় কর।”[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬] তাই আপনার কর্তব্য হচ্ছে পানি কেনা বা গরম করা কিংবা অন্য যেভাবে শরিয়তের বিধান মোতাবেক ওজু করা যায় সেটা করা। যদি আপনি অপারগ হন এবং ঠাণ্ডা অতি তীব্র হয়, পানি ব্যবহারে বিপদ ঘটার আশংকা থাকে, পানি গরম করা বা আশপাশে কারো থেকে গরম পানি কেনার কোন উপায় না থাকে সেক্ষেত্রে আপনার ওজর গ্রহণযোগ্য এবং তায়াম্মুম করাই আপনার জন্য যথেষ্ট। যেহেতু আল্লাহ্ বলেছেন: “তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ্কে ভয় কর” এবং তিনি আরও বলেছেন: “পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে: তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬] যে ব্যক্তি পানি ব্যবহারে অক্ষম সে ব্যক্তির হুকুম যে ব্যক্তি পানি পায়নি তার হুকুমের অনুরূপ।”(বিন বায; মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ১৯৯-২০০)আপনি আপনার শরীরের যতটুকু ধৌত করতে পারেন ততটুকু ধৌত করা আপনার উপর আবশ্যকীয়। যেমন- হাতদ্বয়, পাদ্বয় ইত্যাদি ধৌত করা; যদি এতে আপনার কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে। এরপর আপনি তায়াম্মুম করবেন।
.
❑ তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণ সমূহ:
_______________________________
(ক).ওযূ ভঙ্গের কারণ সংঘটিত হওয়া। অর্থাৎ তায়াম্মুম করার পরে পেশাব, পায়খানা ও বায়ু নিঃসরণ হ’লে, স্ত্রী সহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হ’লে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে।
.
(খ).পানি উপস্থিত হওয়া। অর্থাৎ তায়াম্মুম করার পরে পানি পাওয়া গেলে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার উপর উক্ত পানি দ্বারা ওযূ করা ওয়াজিব হবে। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ পাক-পবিত্র মাটি মুসলমানকে পবিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে, যদি দশ বছরও সে পানি না পায়। পানি যখন পাবে তখন সে যেন তাঁর গায়ে পানি লাগায়। এটাই তার জন্য উত্তম।নাসায়ীতে ” যদি দশ বছরও যদি পানি না পায় ” পর্যন্ত উনুরুপ বর্ণনা করেছেন।(আবূ দাঊদ ৩৩২, তিরমিযী ১২৪, ইরওয়া ১৫৩, মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৫৩০)
.
❑.সালাত আরম্ভ হওয়ার পরে পানি পাওয়া গেলে করণীয় :পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করে সালাত আরম্ভ করলে এবং সালাত রত অবস্থায় পানি উপস্থিত হ’লে উক্ত সালাত ছেড়ে পুনরায় ওযূ করে সালাত আদায় করতে হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে এক্ষেত্রে ছহীহ মত হ’ল, তাকে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর (মায়েদাহ ৬)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,”যখন পানি পাবে তখন তোমার চর্মে পানি লাগাবে, এটাই উত্তম’।(আবু দাউদ: ৩৩২ মিশকাত: ৫৩০) অতএব পানি পাওয়ার সাথে সাথে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে। পানি দ্বারা ওযূ করে সালাত আদায় করতে হবে।
.
❑ তায়াম্মুমের বিশুদ্ধ পদ্ধতি:
_______________________________
মুসল্লী পবিত্র হওয়ার নিয়ত করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মাটিতে দুই হাত একবার মারবে।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ; সহীহ বুখারী হা/১; মিশকাত হা/১; সহীহ তিরমিযী হা/২৫ সহীহ ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭, পৃঃ ৩২ সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪০২)।অতঃপর ফুঁক দিয়ে ঝেড়ে ফেলে প্রথমে বাম হাতের তালু দিয়ে ডানহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করা এবং ডান হাতের তালু দিয়ে বামহাতের কব্জির পিঠ মাসেহ করবে এরপর দুই হাত দিয়ে চেহারা মাসেহ করবে।যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন,তোমার জন্য এইরূপ করাই যথেষ্ট ছিল।এই বলে তিনি তাঁর দুই হাত মাটির উপর মারলেন এবং ফুঁক দিলেন। অতঃপর দুই হাত দ্বারা মুখমন্ডল ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন।(সহীহ বুখারী হা/৩৩৮, তায়াম্মুম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪; মুসলিম হা/৮৪৬ মিশকাত হা/৫২৮) ওজুর পর যে যে যিকিরগুলো পড়া হয় তায়াম্মুমের শেষেও সে দোয়াগুলো পড়া।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২১০৭৪)উল্লেখ যে, দুইবার হাত মারা ও কনুই পর্যন্ত মাসাহ করার হাদীস যঈফ।(আবু দাঊদ হা/৩৩০মিশকাত হা/৪৬৬ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-৬) শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আল-ফাতাওয়া’ গ্রন্থে বলেন: “সহিহ বুখারীর বর্ণনাটি সুস্পষ্ট যে, চেহারার পূর্বে হাতের তালুর পিঠ মাসেহ করেছেন”। অপর বর্ণনায় উদ্ধৃত: “তালুদ্বয়ের পিঠদ্বয়” প্রমাণ করে যে, তিনি প্রত্যেক হাতের কব্জির পিঠ অপর হাতের তালু দিয়ে মাসেহ করেছেন।” তিনি আরও বলেন: “কিন্তু বুখারীর একক বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, তিনি কব্জিদ্বয়ের পিঠ চেহারার পূর্বে মাসেহ করেছেন।(ইবনু তাইমিয়া মাজমুউ ফাতাওয়া,খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ৪২২-৪২৭)
.
পাশাপাশি জেনে রাখা ভাল যে,আবু দাঊদে দুইবার হাত মারা ও পুরো হাত বগল পর্যন্ত মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তার সনদ বিশুদ্ধ হলেও সেগুলো মূলতঃ কতিপয় সাহাবীর ঘটনা মাত্র, যা রাসূল (ﷺ) তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার আগে ঘটেছিল।(আবু দাঊদ হা/৩১৮; মিশকাত হা/৫৩৬) অতঃপর রাসূল (ﷺ) তায়াম্মুমের উক্ত পদ্ধতি অর্থাৎ দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ পদ্ধতি শিক্ষা দেন। যেমন ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বলেন,এটা সাহাবীদের কাজের ঘটনা,যা আমরা রাসূল (ﷺ) থেকে নকল করতে পারিনি। যেমনটি আম্মার (রাঃ) জুনবী অবস্থায় মাটিতে গড়াগড়ি করার ঘটনা নিজের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর যখন তিনি রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,তখন তিনি শুধু মুখমন্ডল ও দুই কব্জি মাসাহর নির্দেশ দান করেন। এ পর্যন্তই শেষ করেছেন। আর আম্মার (রাঃ) তার কাজ থেকে ফিরে আসেন।(তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫৩৬-এর টীকা দ্রঃ)।ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,কিন্তু আমল এর উপর (দুই হাত মারা) ছিল না। কারণ তখন সাহাবীগণ রাসূল (ﷺ)-এর শিক্ষা অনুযায়ী করেননি। বরং আমল ছিল শেষ হাদীসের প্রতি, যা পরেই আসছে।(সহীহ আবু দাঊদ হা/৩৪৩) অতএব রাসূল (ﷺ)-এরনআমল ও বক্তব্যই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়
.
❑ তায়াম্মুমের আনুষঙ্গিক মাসায়েলগুলো জেনে রাখা ভাল। যেমন:
____________________________________
অযু করার জন্য পানি খোঁজার পর না পাওয়া গেলে আওয়াল ওয়াক্তেই তায়াম্মুম করে নামায পড়া উচিৎ। শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পানির অপেক্ষা করা বা পানি খোঁজা জরুরী নয়। আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়ে শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পানির অপেক্ষা করা বা পানি খোঁজা জরুরী নয়। আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়ে শেষ ওয়াক্তে পানি পাওয়া গেলেও নামায পুনরায় পড়তে হবে না।(সিলসিলা সহীহ; ৬/২৬৫-২৬৮)
.
(১).তায়াম্মুম’ করে সালাত আদায়ের পরে ওয়াক্তের মধ্যে পানি পাওয়া গেলে পুনরায় ঐ সালাত আদায় করতে হবে না।(মিশকাত হা/৫৩৩; আবু দাঊদ হা/৩৩৮)
.
(২).পানি খোঁজাখুঁজি না করেই তায়াম্মুম করে নামায পড়লে এবং পানি তার আশে-পাশে মজুদ থাকলে নামায বাতিল গণ্য হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২২০)। এবং যে ব্যক্তি নামায পড়া অবস্থায় পানি পেয়ে যায়,তাকে নামায ছেড়ে দিয়ে ওযু করে পুনরায় নামায পড়তে হবে।(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৩)
.
(৩).ওযুর মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায়,তায়াম্মুমের দ্বারা সেসব কাজ করা যায়। অমনিভাবে যেসব কারণে ওযূ ভঙ্গ হয়, সেসব কারণে ‘তায়াম্মুম’ ভঙ্গ হয়।
.
(৪).ওযর দূরীভূত হওয়া। অর্থাৎ যে ওযরের কারণে তায়াম্মুম করা হয়েছে সে ওযর দূরীভূত হ’লে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে। যেমন অসুস্থতা বৃদ্ধির আশংকায় তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করা বৈধ। কিন্তু তায়াম্মুম অবস্থায় সুস্থতা ফিরে পেলে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে এবং তার উপর ওযু করে সালাত আদায় করা ওয়াজিব হবে।(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৩)
.
(৫).একই তায়াম্মুমে কয়েক ওয়াক্তের নামায পড়া সিদ্ধ।(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪০) সিদ্ধ না হওয়ার ব্যাপারে আসার গুলো শুদ্ধ নয়।
.
(৬).যদি মাটি বা পানি কিছুই না পাওয়া যায়,তাহলে বিনা ওযুতেই সালাত আদায় করবে।(সহীহ বুখারী হা/৩৩৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ও অন্যান্য; নায়লুল আওত্বার ১/৪০০, পানি ও মাটি ব্যতীত সালাত’ অনুচ্ছেদ)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment