প্রশ্ন: একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কখনো যিলহজ্জের দশ দিনে সিয়াম রাখেননি” আবার আরেকটি হাদিসে এসেছে, তিনি (ﷺ) যিলহজ্জের দশ দিনের সিয়াম কখনো ছাড়েননি এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ দুটো হাদীসের মধ্যে সমন্বয় কিভাবে হবে? একটা দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা।
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য।শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কিছু দিন, মাস এবং সময় রয়েছে, সেইদিন বা সেই সময়ের আমল বা কাজের মধ্যে রয়েছে অনেক ফযীলত। এরূপ একটি মাস হলো মুসলিম ঐতিহ্য কুরবানীর স্মৃতি বিজড়িত যিলহজ্জ মাস। এ মাসের মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো হজ্জ, কুরবানী এবং আরাফার দিনের মর্যাদা। সব মিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস হল যিলহজ্জ মাস। যিলহজ্জ মাসের আগমনের সাথে সাথে মুসলিমগণ তাওহীদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়। বনু আদমের সন্তানগণ স্মরণ করে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর চেতনাকে। যে চেতনার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সংস্কার ও সংশোধন করার শিক্ষা গ্রহণ করে। পাশাপাশি এই মাসের ফযীলত ও তাৎপর্য উপলব্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যিলহজ্জ মাসে অনেক আমল রয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তার ফযীলতও অত্যধিক।যিলহজ্জের প্রথম দশদিন ইবাদতের মহান মৌসুম। আল্লাহ তাআলা বছরের অন্যসব দিনের উপর এ দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়েছেন। প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “অন্য যে কোন সময়ের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর তথা দশদিনের নেক আমল অধিক প্রিয়। তারা (সাহাবীরা) বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়!! তিনি বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়; তবে কোনো লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোন কিছু নিয়ে ফেরত না আসে সেটা ভিন্ন কথা।”(সহিহ বুখারী; ২/৪৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/১৭২৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৬৮; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১২৪৮; ইরওয়াউল গালীল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৯৭) তাঁর থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “আল্লাহর কাছে ঈদুল আযহার দশদিনে পালনকৃত নেক আমলের চেয়ে অধিক পবিত্র ও অধিক সওয়াবের অন্য কোন আমল নেই। জিজ্ঞেস করা হল- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়? তিনি বললেন: না; আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে কোনো লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোনো কিছু ছাড়া ফেরত আসে”।(সুনানে দারেমী হা/১৭৭৪; বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৪৭৬; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১২৪৮; ইরওয়াউল গালীল,৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৯৮, সনদ হাসান) এ সকল দলিল ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ করে যে, এ দশটি দিন বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়ে উত্তম; এমনকি রমযানের শেষ দশ দিবসের চেয়েও উত্তম। তবে, রমযানের শেষ দশরাত্রি যিলহজ্জের দশরাত্রির চেয়ে উত্তম; যেহেতু ঐ রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর আছে, যে রাতটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম।”(দেখুন: তাফসীরে ইবনু কাসীর; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪১২) প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে- খাঁটি তওবা করার মাধ্যমে এ দিনগুলো শুরু করা। এ মাসের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো সিয়াম রাখা। যিলহজ্জ মাসের (প্রথম) ৯ দিন সিয়াম রাখা মুসলিমের জন্য সুন্নত।কেননা রাসূল (ﷺ) এ দশদিনে নেক কাজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। সিয়াম রাখা নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত। সিয়ামকে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য নির্বাচন করেছেন। হাদিসে কুদসীতে এসেছে- “বনী আদমের সকল আমল তার নিজের জন্য শুধু সিয়াম ছাড়া। সিয়াম আমারই জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেবো।”(সহিহ বুখারী হা/১৮০৫)
.
❑এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাসূল (ﷺ) নিজে কি জিলহজ্জ মাসের সিয়াম রেখেছেন? যদি রেখে থাকেন তাহলে যে হাদিসে রাখেননি বলা হয়েছে সেই হাদিস সম্পর্কে ব্যাখ্যা কি হবে?
.
প্রিয় পাঠক! প্রথমেই আমরা দুটি হাদিস দেখব তারপরে হাদিস সম্পর্কে সালাফদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখব:
.
ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহু তা’আলা উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ (রায্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন: مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَائِمًا فِي الْعَشْرِ قَطُّ “আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে কখনো যিলহজ্জের দশ দিনে সিয়াম রাখতে দেখিনি।”(সহীহ মুসলিম, হা/ ১১৭৬; আবূ দাঊদ, হা/২৪৩৭: তিরমিযী হা/৭৫৩, ইবনু মাজাহ হা/৫৫২, মুসনাদে আহমাদ হা/২৫০৯৭) ।
.
পক্ষান্তরে উম্মুল মু’মিনীন হাফসাহ্ (রায্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: أربع لم يكن يدعهن رسول الله صلى الله عليه وسلم صيام يوم عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر والركعتين قبل الغداة “চারটি জিনিস রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কখনো ছাড়তেন না: আশুরার সিয়াম, যিলহজ্জের দশ দিনের সিয়াম, প্রতি মাসের তিন দিন সিয়াম এবং ফজরের পূর্বে দুই রাক‘আত সালাত।”(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৮৭; হা/২৬৭৫২; নাসায়ী; আস-সুনান খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২০৫ হা/ ২৪১৬; ইবনু হিব্বান; আস-সহীহ খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৯৫ হা/৩৬৩৫; ইমাম বাইহাক্বী; আস-সুনানুল কুবরা খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৮৬ হা/৮১২৬; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর খণ্ড: ২৩; পৃষ্ঠা: ৩১৩, হা/৭৪১; ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন আবু দাউদ; খণ্ড:২; পৃষ্ঠা: ৪৬২)।
.

❑ প্রথমত: এ বিষয়ে ইমামগনের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে,যার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: তবে বলা হয়, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) যা জানতেন,সেটাই বর্ণনা করেছেন;”যিনি তার বিপরীত বর্ণনা করেছেন, সম্ভবত তিনি সেই বিষয়ে অবগত ছিলেন না।আর মূলনীতি হলো—জ্ঞাত ব্যক্তি অজ্ঞাত ব্যক্তির উপর প্রাধান্য লাভ করে, এবং প্রমাণ পেশকারী ব্যক্তির বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য হয় অপ্রমাণকারীর তুলনায়।”
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:قال الإمام أحمد رحمه الله في التعارض بين هذين الحديثين: إن المثبت مقدم على النافي.”ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) যখন দুটি হাদীসের মধ্যে বিরোধ দেখতে পেতেন, তখন বলতেন:”প্রমাণকারী (হাদিস) অপ্রমাণকারী (হাদিসের) উপর অগ্রাধিকার পায়।”(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৫৪)।
.
❑ দ্বিতীয়ত: কথাকে (বক্তব্যকে) কাজের (কর্মের) উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীস বক্তব্যভিত্তিক, আর আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাদীস কর্মভিত্তিক। সুতরাং বক্তব্যকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, কারণ সম্ভবত সে কর্মটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য বিশেষভাবে নিদিষ্ট ছিল,অথবা কোনো নির্দিষ্ট ওজরের কারণে তিনি তা করেছেন।”
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:”القول الصادر من الرسول عليه السلام الموجه إلى الأمة هو شريعة عامة، أما الفعل الذي يفعله هو، فيمكن أن يكون شريعة عامة حينما لا يوجد معارض له، ويمكن أن يكون أمراً خاصاً به عليه الصلاة والسلام”নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বানীসমূহ উম্মতের উদ্দেশ্যে পেশ করেছেন, তা একটি সার্বজনীন শরিয়ত। আর তিনি যে কাজ নিজে করেছেন,তা তখনই সার্বজনীন শরিয়ত হয় যখন তার কোনো বিরোধী কিছু না থাকে; অন্যথায় তা শুধু তাঁর জন্য নির্দিষ্ট (খাস) একটি বিষয় হতে পারে।”(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৯১৪১৮)
.
❑ তৃতীয়ত: এটা হতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো ওজর, যেমন সফর, অসুস্থতা, ব্যস্ততা ইত্যাদির কারণে এই দিনগুলোতে সিয়াম রাখেননি। তাই আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তিনি যা দেখেছেন তাই বর্ণনা করেছেন। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,وَأَمَّا حَدِيثُ عَائِشَةَ قَالَتْ: “مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَائِمًا فِي الْعَشْرِ قَطُّ”، وَفِي رِوَايَةٍ “لَمْ يَصُمْ الْعَشْرَ ” رَوَاهُمَا مُسْلِمٌ فِي صَحِيحِهِ، فَقَالَ الْعُلَمَاءُ: وَهُوَ مُتَأَوِّلٌ عَلَى أَنَّهَا لَمْ تَرَهُ، وَلَمْ يَلْزَمْ مِنْهُ تَرْكُهُ فِي نَفْسِ الْأَمْرِ؛ لِأَنَّهُ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَكُونُ عِنْدَهَا فِي يَوْمٍ مِنْ تِسْعَةِ أَيَّامٍ؛ وَالْبَاقِي عِنْدَ بَاقِي أُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِينَ رضي الله عنهن، أَوْ لَعَلَّهُ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَصُومُ بَعْضَهُ فِي بَعْضِ الْأَوْقَاتِ، وَكُلَّهُ فِي بَعْضِهَا , وَيَتْرُكُهُ فِي بَعْضِهَا لِعَارِضِ سَفَرٍ أَوْ مَرَضٍ أَوْ غَيْرِهِمَا، وَبِهَذَا يُجْمَعُ بَيْنَ الْأَحَادِيثِ”আয়িশাহ (রায্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্নিত হয়েছে,তিনি বলেছেন:”আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে কখনো যিলহজ্জের দশ দিনে সিয়াম রাখতে দেখিনি।”(সহীহ মুসলিম,হা/ ১১৭৬) অপর একটি বর্ণনায় আছে,”তিনি এই দশকে সিয়াম রাখতেন না।”এই দুটি হাদীস সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে আলেমগণ বলেন: এ হাদীসের ব্যাখ্যা হলো, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) যা দেখেছেন তা-ই বলছেন; এর মানে এই নয় যে, বাস্তবে তিনি সিয়াম রাখেননি। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই নয় দিনের মধ্যে কেবল একদিন তার (আয়শা রায্বিয়াল্লাহু ‘আনহার) কাছে থাকতেন, বাকি দিনগুলো অন্যান্য উম্মাহাতুল মু’মিনীনের নিকট থাকতেন। এছাড়াও হতে পারে, তিনি কখনো কখনো এই দিনগুলোতে সিয়াম রাখতেন,আবার কখনো পূর্ণ দশ দিনই রাখতেন, আবার কোনো বছর কোনো ওজরের কারণে যেমন সফর, অসুস্থতা ইত্যাদি — সিয়াম রাখতেন না। এইভাবে সব হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব। “(ইমাম নববী আল-মাজমু‘ খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৪১)
.
ইমাম শাওকানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:تَقَدَّمَت أَحَادِيثُ تَدُلُّ عَلَى فَضِيلَةِ الْعَمَلِ فِي عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ عَلَى الْعُمُومِ , وَالصَّوْمُ مُنْدَرِجٌ تَحْتِهَا. وَأَمَّا مَا أَخْرَجَهُ مُسْلِمٌ عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ: “مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَائِمًا فِي الْعَشْرِ قَطُّ” فَقَالَ الْعُلَمَاءُ: الْمُرَادُ أَنَّهُ لَمْ يَصُمْهَا لِعَارِضِ مَرَضٍ أَوْ سَفَرٍ أَوْ غَيْرِهِمَا، أَوْ أَنَّ عَدَمَ رُؤْيَتِهَا لَهُ صَائِمًا لَا يَسْتَلْزِمُ الْعَدَمَ، عَلَى أَنَّهُ قَدْ ثَبَتَ مِنْ قَوْلِهِ مَا يَدُلُّ عَلَى مَشْرُوعِيَّةِ صَوْمِهَا كَمَا فِي حَدِيثِ الْبَابِ فَلَا يَقْدَحُ فِي ذَلِكَ عَدَمُ الْفِعْلُ.” ا “আগে উল্লেখিত হাদীসসমূহ প্রমাণ করে যে, জিলহজের প্রথম দশ দিনে আমল করাকে সাধারণভাবে ফজিলতপূর্ণ বলা হয়েছে, আর সিয়াম তার অন্তর্ভুক্ত।আর সহীহ মুসলিমে আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত হাদীস ,যেখানে তিনি বলেন,”আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কখনোই এই দশকে সিয়াম রাখতে দেখিনি, এর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেন: এর অর্থ হলো, হয়তো কোনো অসুস্থতা, সফর বা অন্য কোনো ওজরের কারণে তিনি সিয়াম রাখেননি। অথবা, আয়েশা (রাযি.) তাঁর সিয়াম রাখা দেখেননি, তাই বলে এটি প্রমাণ করে না যে তিনি সিয়াম রাখেননি।এ ছাড়াও, তাঁর বক্তব্য থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, এই দিনগুলোতে সিয়াম রাখা শরীয়তে প্রমাণিত এবং তা সুন্নাত। যেমন হাদীসের মর্মবাণী থেকে বোঝা যায়। সুতরাং কেবল কর্ম (সিয়াম রাখতে না দেখা) দিয়ে এই বিধান বাতিল হয়ে যায় না।”(ইমাম শাওকানী; নাইলুল আওতার; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৮৩)
.
❑ চতুর্থত: এটাও হতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কখনো এই দিনগুলোতে সিয়াম রাখতেন না; কারণ তিনি এমন অনেক আমল পছন্দ করতেন, যা তিনি নিজে করতেন আবার ছেড়েও দিতেন, এই আশঙ্কায় যে তা উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যেতে পারে, যেমন তিনি রমজানে তারাবীহর সলাত জামাআতে পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন।তিনি কখনো কখনো কোনো আমল ছেড়ে দিতেন কেবল উম্মতের প্রতি মমতার কারণে সহজতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে এ বর্ণিত হয়েছে: আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা.) বলেন, আমি কখনোই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দোহা সলাত (সূবহাতুদ দোহা) আদায় করতে দেখিনি, যদিও আমি তা পড়ি। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন অনেক কাজ ছেড়ে দিতেন, যা তিনি করতে পছন্দ করতেন, এই আশঙ্কায় যে লোকেরা তা অনুসরণ করে বসবে এবং পরে তা তাদের উপর ফরজ হয়ে যাবে।”(সহীহ বুখারি হা/১১২৮; সহীহ মুসলিম হা/৭১৮)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৮৫২ হি:] বলেন:وَاسْتُدِلَّ بِهِ – أي بحديث ابن عباس – عَلَى فَضْلِ صِيَامِ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ لِانْدِرَاجِ الصَّوْمِ فِي الْعَمَلِ، وَلَا يَرد عَلَى ذَلِكَ مَا رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَغَيْرُهُ عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَائِمًا الْعَشْرَ قَطُّ؛ لِاحْتِمَالِ أَنْ يَكُونَ ذَلِكَ لِكَوْنِهِ كَانَ يَتْرُكُ الْعَمَلَ وَهُوَ يُحِبُّ أَنْ يَعْمَلَهُ خَشْيَةَ أَنْ يُفْرَضَ عَلَى أُمَّتِهِ “ইবন আব্বাস (রাদি.)-এর হাদীস থেকে জিলহজের প্রথম দশ দিন সিয়াম রাখার ফজিলতের প্রমাণ গ্রহণ করা হয়েছে, কারণ সিয়াম ‘সৎকর্মের’ অন্তর্ভুক্ত। আর আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা.)-এর হাদীস। যাতে তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কখনোই এই দশকে সিয়াম রাখতে দেখিনি’— তা এর বিরোধিতা করে না।কারণ হতে পারে, তিনি এমন কিছু আমল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেড়ে দিতেন, যাতে তা উম্মতের উপর ফরজ হয়ে না যায়।”(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৬০)
.
❑ পঞ্চমত: এটাও বলা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিলহজের প্রথম নয় দিন সিয়াম রাখতেন’ এই হাদীসটি দুর্বল, এবং তা দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।এই হাদীসটি হুনাইদা থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।কারো মতে, তিনি তার স্ত্রীর মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোনো স্ত্রী হতে বর্ণনা করেছেন,আবার কারো মতে, তিনি হাফসা (রাদিয়াল্লাহু আনহা.) থেকে বর্ণনা করেছেন,আরেক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি তার মায়ের মাধ্যমে উম্মু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা.) থেকে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন।(দেখুন: “নুসবুর রায়াহ” খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫৭) সুতরাং,হাদীসটি যদি দুর্বলও ধরা হয়, তবুও ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু.)-এর হাদীসের সাধারণ বক্তব্য, যাতে এই দশ দিনে সৎকর্ম করার ফজিলত এসেছে, সেটাই এই দিনগুলোতে সিয়াম রাখার শরঈ প্রমাণ হিসেবে রয়ে যায়।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি জিলহজের পূর্ণ দশ দিন সিয়াম রাখার বিষয়ে কিছু বলেছেন বা করেছেন?
উত্তরে তিনি বলেন:
” ورد عن النبي صلى الله عليه وسلم ما هو أبلغ من أن يصومها، فقد حث على صيامها بقوله عليه الصلاة والسلام: (ما من أيام العمل الصالح فيهن أحب إلى الله من هذه الأيام العشر، قالوا: ولا الجهاد في سبيل الله؟ قال: ولا الجهاد في سبيل الله؛ إلا رجل خرج بنفسه وماله فلم يرجع من ذلك بشيء)، ومن المعلوم أن الصيام من أفضل الأعمال الصالحة.أما فعله هو بنفسه فقد جاء فيه حديثان: حديث عائشة، وحديث حفصة، أما حديث عائشة فقالت: “ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم صام العشر قط”، وأما حديث حفصة فإنها تقول: “إن النبي صلى الله عليه وسلم لم يكن يدع صيامها”، وإذا تعارض حديثان أحدهما يثبِت والثاني ينفي، فالمثبت مقدم على النافي، ولهذا قال الإمام أحمد: حديث حفصة مثبت، وحديث عائشة نافي، والمثبت مقدم على النافي.وأنا أريد أن أعطيك قاعدة:إذا جاءت السنة في اللفظ فخذ بما دل عليه اللفظ، أما العمل فليس في الشرط أن نعلم أن الرسول فعله أو فعله الصحابة، ولو أننا قلنا: لا نعمل بالدليل إلا إذا علمنا أن الصحابة عملوا به، لفات علينا كثير من العبادات، ولكن أمامنا لفظ وهو حجة بالغة واصل إلينا، يجب علينا أن نعمل بمدلوله، سواء علمنا أن الناس عملوا به فيما سبق، أم لم يعملوا به.”
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন কিছু বর্নিত হয়েছে, যা সরাসরি তাঁর সিয়াম রাখার চেয়েও অধিক শক্তিশালী প্রমাণ বহন করে। তিনি এই দিনগুলোতে সিয়াম রাখার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “এই দশ দিনের মতো আর কোনো দিন নেই, যাতে নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হয়।” সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন: “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না?” তিনি বললেন: “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না, তবে সেই ব্যক্তি ছাড়া যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বের হয়ে যায় এবং কিছুই ফিরিয়ে আনে না।” এটা জানা কথা যে, সিয়াম হলো সর্বোত্তম সৎকর্মগুলোর একটি।আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সিয়াম রেখেছেন কি না—এ বিষয়ে দু’টি হাদীস এসেছে: একটি হাদীস আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা.) থেকে, তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কখনোই এই দশ দিনে সিয়াম রাখতে দেখিনি।”অপরটি হাফসা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনোই এই দশ দিনের সিয়াম ছাড়তেন না।” যখন দুটি হাদীসের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়—একটি কিছু ‘থাকার’ পক্ষে এবং অপরটি ‘না থাকার’ পক্ষে, তখন ‘থাকার’ পক্ষে যে হাদীস সেটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এ কারণেই ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:“হাফসার হাদীসটি প্রমাণমূলক, আর আয়েশার হাদীসটি অস্বীকৃতিমূলক। তাই প্রমাণকারী হাদীসই অগ্রাধিকারযোগ্য।” আমি তোমাকে একটি মূলনীতি দিতে চাই: যখন কোনো সুন্নাহ বর্ণনামূলক (لفظي) অর্থাৎ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়, তখন তা অনুযায়ী আমল করো। আমলের ক্ষেত্রে এটি শর্ত নয় যে, আমরা অবশ্যই জানব নবী ﷺ কিংবা সাহাবায়ে কেরাম তা আদায় করেছেন কি না। যদি আমরা বলি, আমরা শুধু তখনই কোনো হাদীস অনুযায়ী আমল করব, যখন নিশ্চিত হবো সাহাবায়ে কেরাম তা করেছেন—তাহলে বহু ইবাদত আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব, যখন কোনো সহীহ, নির্ভরযোগ্য ও সুস্পষ্ট দলিল আমাদের কাছে পৌঁছে যায়, তখন তা অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক—সে ব্যাপারে পূর্ববর্তীরা আমল করেছেন কি না, তা আমাদের জানা থাক বা না থাক।”(ইবনু উসামীন;লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ৯২তম পর্ব, প্রশ্ন: ১২) ।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, যিলহজ্জ মাসের প্রথম থেকে নবম তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখা সুন্নাত। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও এই বরকতময় দিনগুলোতে সিয়াম পালন করেছেন। সুতরাং যারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উপস্থাপন করে দাবি করেন নবীজি (ﷺ) এই দিনগুলোতে রোজা রাখতেন না। এই ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ এবং মুজতাহিদ ইমামদের ফাতওয়া থেকেও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি রোজা রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করে যিলহজ্জের এ পুণ্যময় দিনগুলোতে রোজা রাখার তাওফিক দান করুন!! (আল্লাহই ভালো জানেন)।
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সোমবার, ২৮ই জিলক্বদ, ১৪৪৬ হিজরি।
২৬ই মে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment