Wednesday, March 27, 2024

সূরা ইউসুফ থেকে পাওয়া ১২টি লাইফ লেসন – পর্ব ৩ – সম্পর্ক উন্নয়ন

 [ সূরা ইউসুফ শুধু নবী ইউসুফ(আ) এর এক্সাইটিং লাইফ স্টোরিই নয়, অসংখ্য শিক্ষনীয় বিষয় আছে এই সূরাতে। চার পর্বের এই লেখায় আমি সূরা ইউসুফ থেকে পাওয়া অসংখ্য লাইফ লেসনের মধ্য থেকে ১২টা লাইফ লেসন শেয়ার করবো। আপনি ইসলাম প্র্যাকটিস করুন আর না-ই করুন, আশা করি লেখাটি আপনার কাজে আসবে।

পর্ব-১  আর পর্ব-২ এ আমি ৮টি লাইফ লেসন শেয়ার করেছিলাম। পর্ব-২ এর শেষে আমরা দেখেছিলাম যে মিশর থেকে ফিরে এসে ইউসুফ(আ) এর বড় ১০ ভাই তাদের বাবা ইয়াকুব(আ) কে অনুরোধ করে যাচ্ছিলো তিনি যেন পরের যাত্রায় বিনি ইয়ামিনকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে দেন। ইয়াকুব আপত্তি জানাতে থাকলেও তারাও ক্রমাগত অনুরোধ করে যাচ্ছিল।]

৯) চুপ হয়ে থাকা শিখুন (Learn to be quiet)

9. Silence

ভেবে দেখুন তো এরকম কিছু আপনার জীবনে ঘটেছে কিনা – আপনি ফেইসবুকে আপনার মতামত জানিয়ে নিজের টাইমলাইনে কিছু লিখেছেন। সাথে সাথেই আপনার সাথে অমত পোষণ করে একজন ঝাঁপিয়ে পড়লো আপনার উপর। আপনি উত্তর দিলেন, তো সে আপনাকে আরো খেপিয়ে দিয়ে কিছু লিখলো, আপনি আবার উত্তর দিলেন, সে আরো বেশী খেপিয়ে দিয়ে মন্তব্য করলো। ফেইসবুকের এক সামান্য স্ট্যাটাস মেসেজ নিয়ে মহাবিরক্তিতে দিন কাটা শুরু হলো আপনার। কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারছেন না, ঘুরে ফিরে তীর্যক কথাগুলো আপনার মনের দেয়ালে শুধু ধাক্কা দিতে থাকলো। কি করবেন এই রকম পরিস্থিতিতে? এর ইসলামিক উত্তর খুব সহজ – মানুষটির মঙ্গল কামনা করে কেটে পড়ুন (http://quran.com/25/63http://quran.com/28/55)  । উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) বলেছেন, ‘চুপ থাকার জন্য আমি কখনোই অনুতপ্ত হইনি, কিন্তু আমি বহুবার অনুতপ্ত হয়েছি আমার বক্তব্যের জন্য’।

আমরা যদি একটু ভালো করে চিন্তা করি তাহলে দেখব, খুব সম্ভবত আমরা নিজেরাও অতীতে কখনো না কখনো কোনো বন্ধুর উপর একই ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম – হয় অফলাইনে, নতুবা অনলাইনে। অন্যের ভুল ধরার ক্ষেত্রে আমরা একেকজন শার্লক হোমস হয়ে যাই, আর নিজের ভুল স্বীকার করার ক্ষেত্রে হয়ে যাই ইবলিশ [উল্লেখ্য, ইবলিশের বিশ্বাস হলো সে আদমকে সম্মান না করে কোনো ভুল করেনি, বরং মহান আল্লাহ আদমকে তার উপর স্থান দিয়ে ভুল করেছেন ]।

অন্যের কোনো আচরণ পছন্দ না হলে আমরা চুপ করে যাব, আর আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা রাখব। কেউ আমাদের সাথে যতই বিরক্তিকর কথা বলুক না কেন,  খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে না উঠে আমরা তাদের ছোট খাটো ভুলকে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাব। যদি তার ভুলটি এমন কিছু হয় যার ফলে বৃহত্তর ক্ষতির আশংকা থাকে তখন তাকে সুন্দর ব্যবহারের সাথে সম্ভব হলে ব্যক্তিগতভাবে (প্রাইভেটলি) শুধরে দিব [৯][১০]। ভেবে দেখুন কতবার এমন হয়েছে যে কাউকে সবার সামনে শুধরে দিতে যেয়ে আমরা অন্য মানুষের মন ভেঙ্গেছি? ফলে সে শুধরে না যেয়ে বরং আরো বেঁকে বসেছে!

আমাদের আরেক প্রবণতা হলো পর্যাপ্ত পড়াশুনা না করেই ইসলাম নিয়ে মন্তব্য করা। আমাদের কেউ জিজ্ঞেস করার আগেই আমরা ফতোয়া দেয়া শুরু করি – এটা হালাল, ওটা হারাম, এই ব্যাটা নাস্তিক, ঐ ব্যাটা মুনাফিক, আরে এতো বেহেশতে যাবে, ঐ লোক নির্ঘাত দোজখে যাবে ইত্যাদি। ইসলামের সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলোর একটি হলো ফতোয়া দেয়া, কারণ একজন মুফতিকে কোরআন, হাদিস, উসুল, ফিকহ সহ ইসলামের প্রত্যেকটা বিষয় সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতে হয়। এমন কি আবু বকর(রা) কে কোরআনের আয়াতের ব্যাখা জিজ্ঞেস করা হলে উনি বলেছিলেন, ‘কোন্‌ জমিন আমাকে জায়গা দিবে আর কোন্‌ আসমান আমাকে রক্ষা করবে, যদি আমি আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে না জেনে কোনও কথা বলি?’

এবার আসুন ফিরে যাই ইউসুফ(আ) এর ঘটনায়। ছেলেদের ক্রমাগত অনুরোধে বিনি ইয়ামিনকে মিশরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন বাবা ইয়াকুব। ইউসুফ যখন তার ১০ সৎ ভাইয়ের সাথে বিনি ইয়ামিনকে দেখলেন তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন যেভাবেই হোক ছোট ভাইকে আমার সাথে রেখে দিতে হবে। এ সময় আল্লাহ ইউসুফকে খুব অদ্ভূত একটা কাজ করতে হুকুম করলেন, যার মাধ্যমে বাবা ইয়াকুব এর ধৈর্যও চরমভাবে পরীক্ষিত হবে – ইউসুফ এক ফাঁকে বিনি ইয়ামিনের ব্যাগে রাজার কাপ (যেটা খুব দামী এবং তাদের ন্যাশনাল সিম্বল ছিলো) রেখে দিলেন। হৈ হৈ রৈ রৈ করতে করতে খবর রটে গেলো রাজার কাপ হারানো গেছে। তল্লাশী করতে করতে সেই কাপ পাওয়া গেলো বিনি ইয়ামিনের ব্যাগে (উল্লেখ্য, ইসলাম মিথ্যা বলা ও ওয়াদা ভংগের অনুমতি দেয় না, কিন্তু বড় কোনও ক্ষতি এড়ানোর জন্য ট্রিক করা ইসলাম সমর্থন করে)[১]। চুরির আইন অনুসারে ইউসুফ বিনি ইয়ামিনকে তার কাছে রেখে দিলেন । বিনি ইয়ামিনের বিরুদ্ধে যখন চুরির বিচার চলছে তখন তাকে রক্ষা না করে ১০ সৎ ভাই বরং এটা প্রমাণ করতে লেগে গেলো যে তারা বিনি ইয়ামিন এর মতো চোর নয়। তারা ১০ ভাই যে মায়ের সন্তান তারা সবাই খুব ভালো। অন্যদিকে, বিনি ইয়ামিন ও তার হারিয়ে যাওয়া ভাই ইউসুফ অন্য মায়ের সন্তান। তারা ইউসুফের ছোট বেলার একটা ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে বলল যে বিনি ইয়ামিনের ভাই ইউসুফও চুরি করেছিলো, কাজেই বিনি ইয়ামিনও যে চুরি করবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চোখের সামনে নিজের ব্যাপারে এরকম ডাহা মিথ্যা শুনেও ইউসুফ কোনো জবাব দিলেন না, শুধু মনে মনে তাদের এই কথাকে ঘৃণা করলেন।

ওরা বলল, ‘সে যদি চুরি করে থাকে, তার আপন ভাই (ইউসুফ) ও তো পূর্বে চুরি করেছিলো’। কিন্তু ইউসুফ প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনে গোপন রাখল ও ওদের কাছে প্রকাশ করলো না। সে মনে মনে বলল, ‘তোমাদের অবস্থা তো এর চেয়েও খারাপ, আর তোমরা যা বলছ সে-সম্বন্ধে আল্লাহ ভালো করেই জানেন’। (১২:৭৭)

রাগ-নিয়ন্ত্রণ:  

আমরা যে সব মুভি-নাটক দেখি, বই পড়ি – এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের শিখায় রাগ করতে পারাটা হলো ‘গাটস’ এর ব্যাপার, যে রাগ করতে না পারে তার কোনো পার্সোনালিটি নাই। আর ইসলাম বলে ঠিক উলটো কথা – যে রেগে যায় তার কোনো পার্সোনালিটি নাই। কারণ, রেগে যাওয়া মানুষ তার নিজের নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে সমর্পণ করে। আপনি যা করেননি তার জন্য কেউ হয়তো আপনাকে দোষ দিচ্ছে, বা আপনি যে কাজ অপছন্দ করেন ইচ্ছে করে সেই কাজই সে বার বার করে যাচ্ছে, অথবা অন্যদের কাছে আপনার বদনাম করে বেড়াচ্ছে – এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে আমাদের করণীয় কি? কোরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা জানতে পারি:

  • নিজের কন্ঠকে গাধার মধ্যে উচ্চ না করে বরং নামিয়ে ফেলুন (http://quran.com/31/19)
  • যে আপনাকে রাগিয়েছে তাকে ক্ষমা করে দিন (http://quran.com/42/37)
  • ধৈর্য ধরুন এবং সৌজন্য সহকারে এড়িয়ে চলুন (http://quran.com/73/10)
  • তার দোষের কথা ভুলে গিয়ে গুণের কথা মনে করুন (মুসলিম)
  • রাগ আসে শয়তানের তরফ থেকে। সুতরাং, ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ বলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। [৫]
  • আমরা রেগে গেলে শয়তান দ্রুত বেগে আমাদের রক্তে ছুটাছুটি করে আমাদের আরো রাগিয়ে দেয়। আগুনের তৈরী শয়তানকে জব্দ করার জন্য তাই অজু করুন। [৫]
  • দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়ুন, বসে থাকলে শুয়ে পড়ুন। সোজা কথা, এক্কেবারে ইন্যাক্টিভ হয়ে যান। নচেৎ রাগের মাথায় আপনি হয়তো এমন কিছু বলে ফেলবেন বা করে ফেলবেন যার জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে। [৫]
  • আপনার ধৈর্য্যের জন্য আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা রাখুন।

মনে রাখবেন, আপনার সাথে যে ভালো ব্যবহার করে তার সাথে ভালো ব্যবহার করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব হলো যে খারাপ ব্যবহার করে তার সাথে ভালো ব্যবহারে।

১০) সম্পর্ক তৈরী করুন (Connect!)

10.Connect

কাজ-শেষে বাসায় ফিরে কম্পিউটার, মোবাইল আর টিভিতে বুঁদ হয়ে না থেকে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করুন। আল্লাহর পরেই আমাদের উপর সবচাইতে বেশী অধিকার আমাদের বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান-সন্তুতির – বাসায় ফিরে তাদেরকে সময় দিন। ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের – বাসায় গিয়ে, ফোন করে, ইমেইল করে, যেভাবেই পারুন যোগাযোগ রক্ষা করুন, যে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখে না তার সাথে আরো বেশী করে যোগাযোগ করুন। কোথাও গেলে মটকা মেরে বসে না থাকে আমাদের অন্য মানুষদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। মহান আল্লাহ একেক মানুষকে একেক রকম শারিরীক গঠন, চিন্তা-ভাবনা, দক্ষতা দিয়ে তৈরী করেছেন যাতে আমরা একে অন্যকে জানার জন্য প্রয়োজনীয়তা বোধ করি (http://quran.com/49/13)।

সব সময় মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে হবে। ইউসুফ(আ) এর জীবনের পিছনের একটা ঘটনা থেকে আমরা মানুষকে সাহায্য করার আদব শিখতে পারি। ইউসুফ (আ) যখন জেলে ছিলেন তখন ইউসুফের কাছে রাজার দূত রাজার দেখা স্বপ্নের অর্থ জানতে চেয়েছিলো। উত্তরে ইউসুফ শুধু স্বপ্নের অর্থ বলেই ক্ষান্ত হননি, বরং নিজ উদ্যোগে বলে দিয়েছিলেন আসন্ন দুর্ভিক্ষ থেকে মিশর রাজ্যকে বাঁচাতে চাইলে রাজার করণীয় কি। অথচ, এই সেই দূত যে অনেক বছর আগে ইউসুফ(আ) কে কথা দিয়েছিলো, সে রাজার কাছে গিয়ে এটা বলবে যে ইউসুফ বিনা দোষে জেলে বন্দী আছে। এরকম অকৃতজ্ঞ বন্ধু যদি আমাদের কাছে সাহায্য চাইতো তাহলে আমরা কি তাকে সাহায্য করতাম? ইউসুফ(আ) কিন্তু একবারও সেই অকৃতজ্ঞতার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন না, বরং সে যা সাহায্য চেয়েছিলো তার চেয়ে বেশী সাহায্য করলেন।

সে বলল, ‘হে ইউসুফ, হে মহাসত্যবাদী! সাতটি শুঁটকো গাই সাতটি মোটাসোটা গাইকে খেয়ে ফেলছে, আর সাতটি সবুজ শিষ ও অপর সাতটি শুকনো শিষ সম্বন্ধে তুমি আমাদেরকে ব্যাখা করো, যাতে আমি লোকদের কাছে ফিরে যেতে পারি এবং ওরা জানতে পারে’। ইউসুফ বলল, ‘তোমরা সাত বছর একটানা চাষ করবে, এ সময় যে শস্য সংগ্রহ করবে ওর মধ্যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে, আর বাকী সব শিষ সহ রেখে দিবে। তারপর আসবে সাতটি কঠিন বছর যখন তোমরা পূর্বে সঞ্চিত খাবার খাবে, আর অল্প কিছু সংরক্ষণ করবে (পুনরায় চাষ করার জন্য)। এবং এরপর আসবে এক বছর সে-বছর মানুষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, এবং সে-বছর মানুষ ফলের রস নিঙরাবে (অনেক আনন্দ করবে)।  (১২:৪৬-৪৯)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ ইউসুফ(আ) এর মাধ্যমে আমাদের শেখালেন –

কিভাবে মানুষকে সাহায্য করতে হয়:

  • আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সাহায্য করা
  • কেউ কৃতজ্ঞতা জানাক আর না-ই জানাক তবু তাকে সাহায্য করা
  • নিজ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া
  • সাহায্যপ্রার্থী যতটুকু চাচ্ছে তার চেয়ে বেশী দিয়ে সাহায্য করা
  • নিজেকে সুপিরিয়র মনে না করে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া
  • ‘আমি সাহায্য না করলে তুমি এটা পারতে না’ – এই জাতীয় ভাব না নেয়া

একইভাবে, কোনো সমস্যায় পড়লে সুন্দর কথার মাধ্যমে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। অনেক সময় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা একটা কিছু বুঝার চেষ্টা করে হয়তো পারি না, কিন্তু আমার পাশের চেয়ারে বসা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেই সে এক মিনিটেই আমাকে এটা বুঝিয়ে দিতে পারতো। আমি পারি না বলার মধ্যে লজ্জার কিছু নাই, সাহায্য চাওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নাই – যদি এই সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্য হয় নিজেকে ইম্প্রুভ করা।

ইউসুফ(আ) এর ঘটনায় ফিরে যাওয়া যাক। ইউসুফের সৎ ভাইয়েরা কানআন ফিরে গেলে বাবা ইয়াকুব আরো ভেঙ্গে পড়লেন যখন শুনলেন বিনি ইয়ামিন মিশরেই রয়ে গেছে। তিনি ছেলেদেরকে বললেন, ‘তোমরা ইউসুফ আর বিনি ইয়ামিনকে খুঁজে এনে দাও’। সৎ ভাইয়েরা বুঝলো তাদেরকে আবার মিশরে যেতে হবে, মিশরে যেয়ে মিশরের মন্ত্রীর কাছে অনুনয়-বিনয় করে বিনি ইয়ামিনকে ফেরত চাইতে হবে। এই সময় এই সৎ ভাইদের মধ্যে অনুশোচনা বোধও শুরু হয়। তারা বুঝতে পারে ছোট ভাই ইউসুফ আর বিনি ইয়ামিনের সাথে তারা যে আচরণ করেছিলো তা ঠিক ছিলো না। তারা মিশরে ফিরে যেয়ে কোষাধ্যক্ষ ইউসুফের কাছে তাঁর সাহায্য চাইলো।

যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হল তখন বলল, ‘হে আযীয (বাদশাহ)! আমরা ও আমাদের পরিবার-পরিজন বিপদে পড়েছি, আর আমরা অল্প মাল এনেছি। আপনি তো আমাদের রসদ দেন পুরো মাত্রায়, আর আমাদের কিছু দানও করেন। আল্লাহ তো দাতাদের পুরষ্কার দিয়ে থাকেন’। (১২:৮৮)

এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের শেখালেন –

কিভাবে কারো সাহায্য চাইতে হয়:

  • যার সাহায্য চাইছেন তাকে সম্মানের সাথে সম্বোধন করা
  • নিজের করুন অবস্থা স্বীকার করে নেয়া
  • সাহায্যকারীর প্রশংসা করা
  • সাহায্যকারীর মঙ্গল কামনা করা

এই চারটি কন্ডিশন মেনে আমরা যদি কারো সাহায্য চাই, আল্লাহ চাইলে আমরা সাহায্য পাবোই।

১১) ক্ষমা একটি শিল্প, একে শিখুন (Learn the art of forgiveness)

11. forgive

ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করা – এই দুইটি কাজই মানুষ হিসাবে আমাদেরকে মর্যাদাকে উন্নত করে। আমরা যদি ক্ষমার শিল্পকে আয়ত্ত না করতে পারি, আমরা মনের মধ্যে বাসা বাঁধবে ঘৃনা আর অহংকার। ক্ষমা শিল্প শিখতে না পারলে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, ভয়াবহ কঠিন হবে পরকালের হিসাব।

ইউসুফ যখন তার সৎ ভাইদের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে দিলো, তারা সাথে সাথে তাদের ভুল স্বীকার করে নিলো এবং ক্ষমা চাইলো।

ওরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাকে আমাদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন আর আমরা নিশ্চয়ই অপরাধী ছিলাম’। (১২:৯১)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ আমাদের শেখালেন-

কিভাবে ক্ষমা চাইতে হয়:

  • ‘আমি অমুক কারণে ঐ কাজটা করেছিলাম’ জাতীয় একটা শব্দও না বলা
  • ক্ষমাকারীর প্রশংসা করা
  • অনুশোচনা সহ নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়া

পরবর্তীতে আপনার বাবা-মা, স্বামী/স্ত্রী বা বসের কাছে যখনই কোনো ব্যাপারে ক্ষমা চাইতে যাবেন, নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে কোনো যুক্তি দিবেন না, নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে মন থেকে ক্ষমা চান। আজ হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না, কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝতে পারবেন যে এই ভুল বুঝাবুঝির পিছনে আপনার দোষই বেশী ছিলো।

এবার ইউসুফের পালা ভাইদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার। নিজেকে ইউসুফের জায়গায় কল্পনা করে দেখুন – কেউ যদি আপনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিত্যক্ত কোনো কূয়ায় ফেলে দিত আপনি কি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন? কেউ যদি প্রায় ৪০ বছর আপনার বাবা-মাকে আপনার থেকে আলাদা করে রাখতো আপনি কি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন? শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো সেইবারও যে আপনাকে ‘চোর’ বলে অপবাদ দিয়েছে আপনি কি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন? ইউসুফ তার ভাইদের শুধু ক্ষমাই করলেন না, তিনি ৪০ বছরের সব কষ্টের স্মৃতি এক নিমিষেই ভুলে গেলেন। এটা সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে ইউসুফের জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করা। আর তাই ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে তিনি তার ভাইদেরকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিলেন, কারণ আল্লাহ ক্ষমাকারীকে ভালবাসেন।

সে বলল, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’। (১২:৯২)

ইউসুফ তার ভাইদেরকে বললেন তাদের বাবা-মাকে মিশরে নিয়ে আসতে। মিশরে প্রবেশের সময় ইউসুফ তার বাবা-মাকে বিরাট সংবর্ধনা দিলেন। সিংহাসনে বসতে দিয়ে বাবা-মাকে উপযুক্ত সম্মান দিলেন। বলা হয়ে থাকে, ইউসুফের অসামান্য কর্মদক্ষতা ও সততার কারণে এই সময় মিশরে ইউসুফের ক্ষমতা ও মর্যাদা রাজার সমান বা বেশী ছিলো।

আর ইউসুফ তার পিতামাতাকে উচ্চাসনে বসালো আর সে বলল, ‘হে আমার পিতা! এই আমার আগের স্বপ্নের ব্যাখা। আমার প্রতিপালক তা সত্যে পরিণত করেছেন। আর তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন ও শয়তান আমার আর আমার ভাইদের সম্পর্ক নষ্ট করার পরও আপনাদের মরুভূমি থেকে এখানে এনে দিয়ে আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন তা সূক্ষ্মভাবে করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ বিচারক। (১২:১০০)

ইউসুফের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের শেখালেন-

কিভাবে ক্ষমা করতে হয়:

  • ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথে ক্ষমা করে দেয়া
  • অপরাধটি মনে করিয়ে দিয়ে আর কখনোই কোনো কথা না বলা
  • ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করছি’ বললে ক্ষমাপ্রার্থিকে ছোট করা হয়, সেটা না বলে তাকে সম্মান করে এভাবে বলা – ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন’
  • ক্ষমাপ্রার্থীর দোষকে গোপন করে শয়তানের উপর বা অন্তরের কুমন্ত্রণার উপর দোষ চাপানো
  • তার এই ভুলের মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে কি শিখাতে চেয়েছেন তা নিয়ে চিন্তা করা।

ইসলামের শিক্ষা কতই না সুন্দর, তাই না!

[পর্ব-৩ এখানেই শেষ। ইনশা আল্লাহ শেষ লেসনটি পর্ব-৪ এ প্রকাশ করা হবে]

রেফারেন্স:

1. Pearls from Surat Yusuf – Dr. Yasir Qadhi

2. Leadership Lessons from the Life of Rasoolullah (SAW) – Mirza Yawar Baig

3. তাফসীর ইবনে কাথির

4. আহসানুল বায়ান

5. Anger Management – Dr. Yasir Qadhi

6. Notes from a Friend  – Anthony Robbins

7. The Strangest Secret – Earl Nightingale

8. Focal Point – Brian Tracy

9. Description of Prophet Muhammad (Peace Be Upon Him) – Shaykh Hamza Yusuf

http://sheikhhamza.com/transcript/Description-of-the-Prophet(SAW)

10. 10 Rules of  #TwitterFiqh – Shaykh Yahya Ibrahim

http://muslimmatters.org/2014/01/06/10-rules-twitterfiqh/

11. Ties of Kinship, Al-Adab Al-Mufrad – Imam Bukhari

http://www.sunnipath.com/library/Hadith/H0003P0002.aspx

No comments:

Post a Comment

Translate