Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ১২ – তিনি ﷺ আমাদের কতটুকু ভালবাসতেন?

 

 আমরা অনেক সময় অনেক লেকচারে শুনেছি, অনেকে হয়ত পড়েছি যে – আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাদেরকে ভালবাসতেন। কিন্তু, এই ভালবাসাটা কতটুকু সেটা আমরা অনেকেই অনুধাবন করতে পারি না। আমাদের বুঝটা অনেকটা এরকম – রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর উম্মতকে ভালবাসতেন, আর আমি তাঁর উম্মত, কাজেই তিনি আমাকেও ভালবাসতেন – হুম ঠিক আছে বুঝলাম, তো এখন আমি কি করব?

অর্থাৎ রাসূল্ললাহ ﷺ এর ভালবাসাটা আমাদেরকে ছুঁয়ে যায় না। আমরা সেই ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি না। এই উপলব্ধিকে নাড়া দেয়ার প্রচেষ্টায় একটা হাদিস শেয়ার করব, কিন্তু তার আগে একটা বিষয় নিয়ে একটু ভাবতে বলব।

আপনার কি কখনো এমন হয়েছে – আপনি ইবাদতের কোন এক পর্যায়ে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। হয়ত কোন লাইলাতুল কদর এর রাতে, অথবা সদ্য পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া কোন প্রিয় মানুষের জন্য দু’আ করতে যেয়ে – আপনি আপনার দু’আর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। আপনার যদি হজ্ব / উমরা করার সৌভাগ্য হয়ে থাকে, তাহলে কা’বা শরীফের সামনে দাড়িয়ে দু’হাত তুলে দু’আ করার সময় কোন একবার এমন হওয়ার কথা যখন আপনার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরুচ্ছে না, আপনার দু’চোখ দিয়ে শুধু দর দর করে অশ্রু ঝরছে, আর আপনি শুধু বলছেন ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ এরও একদিন এরকম হয়েছিল। কিন্তু সেটা নিজের জন্য দু’আ করতে যেয়ে নয় – উম্মতের জন্য দু’আ করতে যেয়ে, যেই উম্মতের মধ্যে আমি একজন (ইনশাআল্লাহ), আপনি একজন, মসজিদে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যে লোকটা অন্য মাজহাবে নামাজ পড়ে সে-ও একজন। আমার জন্য দু’আ করতে চেয়ে, যে আপনি এই লেখাটি পড়ছেন – আপনার জন্য দু’আ করতে যেয়ে, আপনার পাশের ঐ অন্য রকম লোকটার জন্য দু’আ করতে যেয়ে – আল্লাহর রাসূল ﷺ কেঁদেছিলেন।

আসুন এবার হাদিসটা জানি।

একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তেলাওয়াতের মাঝে আসল নিচের আয়াতটি – যেখানে ইব্রাহিম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ দুআ করেছিলেন।

“যে আমার অনুসরণ করে, সে তো আমার এবং কেউ আমার অবাধ্যতা করলে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা ইব্রাহিম ১৪:৩৬)

এভাবে ইব্রাহিম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُতাঁর উম্মতের জন্য দু’আ করছিলেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তেলাওয়াত করলেন নিচের আয়াতটি – যেখানে মুসা عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ তাঁর উম্মতের জন্য দুআ করেছিলেন।

যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ। (সূরা মাইদাহ ৫:১১৮)”

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের উম্মতের জন্য কি দু’আ করবেন তা চিন্তা করলেন। আর দুই হাত শূন্যে তুলে কেবল বলতে লাগলেন –

আল্লাহুম্মা উম্মাতি, আল্লাহুম্মা উম্মাতি – ও আল্লাহ আমার উম্মত! ও আল্লাহ আমার উম্মত!

এভাবে বলতে বলতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর গলা ধরে আসল, তিনি কান্না শুরু করে দিলেন, আর কিছু বলতে পারলেন না। এই সময় আল্লাহ ﷻ জিব্রিল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ কে বললেন রাসূলুল্লাহ ﷺ কে যেয়ে জিজ্ঞেস করতে – কেন তিনি ﷺ কাদঁছেন (আল্লাহ ﷻ যদিও জানেন বান্দার অন্তরে কি আছে, কিন্তু তাও তিনি বান্দার মুখে তা শুনতে ভালবাসেন)। জিব্রিল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ কে কান্নার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি ﷺ জবাব দিলেন – “আমি কাঁদছি আমার উম্মতের কথা ভেবে, তাদের পরিণতি কি হবে তা ভেবে!”

জিব্রিল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ আল্লাহর ﷻ কাছে ফিরে যখন একথা জানালেন, তখন আল্লাহ ﷻ বললেন – “জিব্রিল, তুমি মুহাম্মাদের কাছে যাও এবং বলো – আমি আপনাকে আপনার উম্মতের বিষয়ে খুশী রাখব, আপনাকে কষ্টে ফেলব না।”

অন্যভাবে বলতে গেলে – আল্লাহ ﷻ যেন বলছেন, হে মুহাম্মাদ ﷺ । আপনি আপনার উম্মতকে এত বেশী ভালবাসেন, তাদের কষ্টে আপনি এত বেশী কষ্ট পান, কিন্তু আমি তো চাই না আপনি কষ্টে থাকুন, তাই আমি এমন কিছু করব যাতে আপনি আপনার উম্মতের পরিনতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন।

এখন থেকে আমরা যখনই এমন কিছু করতে যাব, যা আল্লাহর রাসূলের ﷺ শিক্ষার বিরোধী, আমরা যেন মনে রাখি আমরা কার অনুসরন করতে ব্যর্থ হচ্ছি, কাকে তাঁর ভালবাসার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। আল্লাহর রাসূল ﷺ তো আমাদের পাপ-মুক্তির জন্য চোখের পানি ফেলেছেন, হাহাকার করে দু’আ করেছেন – আর আমরা তাঁর উম্মত হিসাবে কি করছি? আমরা কি কোন কাজ করার আগে চিন্তা করি – আচ্ছা এই কাজটা যদি আমি আজ তাঁর ﷺ সামনে করতাম, তাহলে কি তিনি খুশী হতেন? গর্বিত হতেন?

আর সমস্ত উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহর ﷺ যে ভালবাসা ছিল, আমরা সেই একই ভালবাসা সব মুসলিমের প্রতি দিতে পারছি কি? আমরা কি সব মুসলিম ভাই/বোনকে আল্লাহর রাসূলের ﷺ উম্মত হিসাবে চিন্তা করতে পারছি? নাকি তাবলিগি / জামাতি / সালাফি / মডারেট তকমা লাগিয়ে অচ্ছুৎ করে ফেলছি? আজ যদি আল্লাহর রাসূল ﷺ আমার পাশে থাকতেন – তাহলে আমি যা করছি তা করতে করতে তাঁর চোখে চোখ রেখে কি বলতে পারতাম – “হে রাসূলুল্লাহ ﷺ, আপনি যে কাজ অপছন্দ করেন আমিও সে কাজ অপছন্দ করি, আপনি যাদেরকে ভালবেসে দু’আ করে গেছেন, আমিও আপনার মতই তাদেরকে ভালবেসে দু’আ করি!”

“বলুন (হে মুহাম্মাদ), যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মাফ করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান ৩:৩১)

সূত্র: শেইখ ইয়াসির কাযির সিরাহ লেকচার – পর্ব ২

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ১৭ নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ১২ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু ছোট লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ]

No comments:

Post a Comment

Translate