Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ৬ – মহানবীর ﷺ খাবার

 dates

১) অল্প কিছুদিন মাত্র হয়েছে মহানবী (সা) ও সাহাবীরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে এসেছেন। মদীনার সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিমরা এমনিতেই খুব বেশী ধনী ছিল না, তার উপর রিফিউজি হিসাবে তারা আশ্রয় দিয়েছে মক্কার মুসলিমদের। ফলে, সামগ্রিকভাবে মদীনার অর্থনীতি তখন কঠিন সময় পার করছে। মহান আল্লাহ্‌ কিছুদিন পরেই তাদের দু’হাত ভরে দিবেন, কিন্তু তার আগে তাদের ঈমানকে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন।

এরকম সময়ের এক ভর দুপুরে মদীনার রাস্তায় পায়চারী করতে দেখা গেল উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) কে। আরবের ট্র্যাডিশন অনুসারে এ সময় মানুষ খাওয়া-দাওয়া করে, ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করে। কিন্তু, উমার(রা) এর ঘরে নেই খাবার , তাই কি আর করা – হাঁটাহাঁটি করলে ক্ষুধার জ্বালা যদি কিছুটা কমে এই আশায় তিনি হাঁটাহাঁটি করছেন! হেঁটে যেতে যেতে উমার (রা) দেখলেন রাস্তার ধারে মহানবী (সা) বসে আছেন। মদীনার রোদকে ‘কাঠ-ফাটানো রোদ’ বললেও কম বলা হবে – এই অসহ্য গরমে আল্লাহর রাসূল রাস্তায় বসে কেন? উমার (রা) জিজ্ঞেস করলেন – “হে রাসূলুল্লাহ, আপনি এখানে কি করছেন?” মহানবী (সা) উমার (রা) এর চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন,  “তুমি যে কারণে বের হয়েছ সেই একই কারণ।”

মহানবীর (সা) পাশে এসে বসলেন উমার (রা)। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতেই দেখলেন রাস্তা ধরে আরেকজন আসছেন,  উমারের (রা) চেয়েও উত্তম কেউ – আবু বকর (রা)।

দৃশ্যটা ভেবে দেখুন – পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিন মানুষ – পাশাপাশি বসা – ভর দুপুরে – খালি পেটে – শান্ত, সৌম্য, কোন অভিযোগ নেই, কবে খাবার মিলবে, আদৌ মিলবে কিনা কিছু জানা নেই।

এসময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আবুল হাইসাম(রা) নামক এক আনসারী সাহাবী। মহানবী (সা) আর দুই সাহাবীকে রাস্তার ধারে বসে থাকতে দেখে বিষয়টা কি জিজ্ঞেস করলেন। উমার (রা) বললেন – তাঁরা ক্ষুধার জ্বালায় বাইরে বসে আছেন। আবুল হাইসাম (রা) সহ্য করতে পারলেন না। বললেন – “আমার বাড়ি আসুন, আমার কাছে খাবার আছে”। আবুল হাইসামের একটা মাত্র ছাগল ছিল। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন – “আল্লাহর কসম, আমাদের ছাগলটা কুরবানী করতে হবে, করে মাংস আর রুটি রেডি করতে হবে।”

ছাগল কুরবানী হলো, মাংস-রুটি রান্না হলো। মহানবী (সা), আবু বকর (রা) ও উমার (রা) খাবার খেলেন। মহানবী(সা) তাঁদের দু’জনকে মনে করি দিলেন – তাঁরা সবাই খালি পেটে তাদের বাড়ী থেকে বের হয়েছিলেন, আর তাঁদের পেটকে পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ্‌। তিনি (সা) পাঠ করলেন সূরা তাকাসুর এর শেষ আয়াতটি –

সুম্মা লাতুস আলুন্না ইয়াঊমা ইযিন ‘আনিন না’ঈম  (সূরা তাকাসুর ১০২:৮)

অর্থ: এরপর সেদিন তোমাদেরকে তোমাদের দুনিয়ার আরাম-আয়েশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।

এতক্ষণ ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট করার পর, দেরী করে দুপুরের খাবার খাওয়া সত্ত্বেও মহানবী (সা) আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করার কথা আবু বকর আর উমারকে মনে করিয়ে দিলেন। অথচ এই আমরা এত কিছু পাওয়ার পরেও আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে যেন ভুলেই গেছি।

২) মহানবীর (সা) প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশা (রা) এর বোনের ছেলে ছিলেন উরওয়া। আয়েশা (রা) হতে আমরা যে হাদিসগুলো পাই তার বেশীরভাগই বর্ণিত হয়েছে উরওয়ার মাধ্যমে। মহানবী (সা) এর চাল-চলন, কাজ-কর্ম সবকিছু সম্পর্কে উরওয়ার (রা) ছিল অপরিসীম আগ্রহ। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন খালা আয়েশা(রা) কে মহানবীর (সা) খাবার সম্পর্কে। উত্তরে আয়েশা (রা) বললেন, “অনেক সময় এমনকি ছয় সপ্তাহ কেটে যেত যখন আল্লাহর রাসূল (সা) এর ঘরে চুলা জ্বালানো হত না”।

বিস্মিত হলেন উরওয়া – “খালা, আপনারা কি খেয়ে বেঁচে থাকতেন?”

আয়েশার (রা) উত্তর, “আল-আসওয়াদাইন (দু’টো কালো খাবার) – খেজুর আর পানি”।

সেই আমলে ট্যাপ ছিল না, যে খুললেই পরিষ্কার পানি আসবে। পানি ফিল্টার করারও উন্নত কোন ব্যবস্থা ছিল না, কূয়ো থেকে সংগ্রহ করা পানির রঙ কালো হত।

৩) মহানবীর (সা) মৃত্যুর পর অনেক বছর কেটে গেছে। সাহাবী আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) তখন আরবের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। তিনি বেহেশতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ ব্যক্তিরও একজন। সেই আব্দুর রহমান বিন আউফের (রা)  সামনে একবার রাখা হল সুস্বাদু মাংস-রুটি।  হঠাৎ কি একটা মনে পড়ে যাওয়ায় হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন তিনি। আশে-পাশের লোকজন অবাক হয়ে গেল – দুনিয়ায় যে কোটিপতি, আখিরাতে যার জান্নাতের গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে, তার আবার দু:খ কি?

আব্দুর রহমান বললেন, “মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটি দিনের জন্য আল্লাহর রাসূল পেট ভরে গমের রুটি পর্যন্ত খাননি, এমনকি তার পরিবারও না।  আর আমার ভয় হচ্ছে, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের এত লম্বা হায়াত দিয়েছেন, যে আমরা এত সব নিয়ামত দেখতে পাচ্ছি! অথচ আল্লাহর রাসূল যেখানে চলে গেছেন সেটাই বরং ভালো”।

অর্থাৎ, আব্দুর রহমান (রা) বলছেন যে – আল্লাহ্‌ তাঁকে এই দুনিয়ায় এত লম্বা হায়াত আর এত রিযিক দিয়েছেন যে তাঁর ভয় হচ্ছে তিনি পরকালে কিভাবে এর জবাব দেবেন। আল্লাহর রাসূল (সা) অপেক্ষাকৃত কম বয়সে চলে গেছেন আর তিনি এত ভালো মানের খাবার-দাবারও খেতেন না – কাজেই তারঁ (সা) তুলনায় আমাদের হিসাব কতই না কঠিন হবে। তার চাইতে, আল্লাহর রাসূল (সা) যে কম হায়াতে এবং বিলাসিতাশূণ্য জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন সেটাই তো বরং ভালো।

রেফারেন্স ও টীকা:

১) মহানবীর (সা) জীবনকে গল্পের আকারে তুলে ধরার প্রয়াস “মহানবীর ﷺ মহাজীবন”। এটি মূলত: শেইখ ইয়াসির কাযীর সিরাত লেকচার ও ড. সাল্লাবীর সিরাতের বইকে অনুসরণ করে লেখা হয়েছে।

২)  সব হাদিসগুলো শামায়েলে তিরমিযীতে পাবেন।

৩) ১নং হাদিসের অনলাইন লিংক https://sunnah.com/urn/1803530 । ২ ও ৩ নং হাদিস পাবেন অনলাইন বুখারী ৮/৭৬ তে (http://i-cias.com/textarchive/bukhari/076.htm)।

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ১০ নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ৬ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ]

No comments:

Post a Comment

Translate