Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ২৫ – সালমান আল ফারসির (রা) রোমাঞ্চকর যাত্রা

 

ছবি: নিসিবিসের সেইন্ট জেকব চার্চ। কারো কারো মতে এই চার্চে বহু বছর সালমান আল ফারসি অবস্থান করেছিলেন। চার্চটি এখনও পর্যটকেরা দেখতে যায়। এটা দক্ষিণ-পূর্ব তুরষ্কে অবস্থিত। উইকিপিডিয়া থেকে ছবিটি নেয়া হয়েছে।

কেউ যদি দ্বীনের সন্ধানে আন্তরিকতার সাথে লেগে থাকে, এক সময় না এক সময় মহান আল্লাহ তাকে পথ দেখান। এই বিষয়টার উদাহরণ আমরা পাই বিখ্যাত সাহাবী সালমান আল ফারসির ঘটনায়।

কে ছিল এই সালমান আল ফারসি? মুসনাদ ইমাম আহমদ গ্রন্থে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিস থেকে আমরা জানি – সালমান আল ফারসি থাকত ইরানে, তার জন্ম হয়েছিল এক অগ্নি-পূজারী (জোরাস্ট্রিয়ান / মাজুস) ধর্মের অনুসারী বাবার ঘরে, জায়ান নামক এক গ্রামে । তার বাবা ছিল একজন জমিদার (ফার্সী: দিহকান), যে ছিল যেমন ধনী, তেমনই ক্ষমতাবান। এলাকার সবাই সালমানের বাবাকে মেনে চলত, সমীহ করে কথা বলত।

সালমানের বাবা মাজুস (অগ্নি-পূজারী) ধর্মের গভীর অনুরাগী ছিল। আর সে সালমানকে পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে সবচেয়ে বেশী ভালবাসত। কিশোর সালমানকে সে সব সময় আগলে রাখত। একমাত্র মন্দির ছাড়া আর কোথাও যেতে দিত না। সালমানও তার সারাটা দিন মন্দিরেই কাটাত।

সালমানের ছিল জ্ঞান-পিপাসু মন। সে তাদের মাজুস ধর্ম সম্পর্কে যা পেত তাই শিখে নিত। এই ধর্ম অনুসারে – মন্দিরে যে আগুন জ্বলে তা ভগবানের প্রতীক, তাই কোনভাবেই এই আগুনকে কখনো নিভতে দেয়া যাবে না।  গ্রামের সবাই এসে সেই আগুনের পূজা করত। কিশোর বয়সী সালমান মন্দিরে সবসময় অবস্থান করার কারণে আগুন তদারকী করার জ্ঞান পুরোটাই আয়ত্ত করে নিয়েছিল । কখন কাঠ দিতে হবে, কখন তেল ঢালতে হবে, বাতাসের বেগকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে – সব শিখে নিয়েছিল সে। এর ফলে, বয়স কম হলেও তাকে মন্দিরের আগুন-রক্ষাকারীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।  

আগেই বলেছি সালমানের বাবা তাকে বড় করেছিল ঘোর রক্ষণশীলতার মধ্যে। তাকে কারো সাথে মিশতে দেয়া হত না, মন্দিরের বাইরে অন্য কোথাও যেতে দেয়া হত না, মাজুস ধর্মের বাইরে অন্য কিছু শিখতে দেয়া হত না। কিন্তু আল্লাহ যদি কাউকে ইসলামের জন্য পছন্দ করে নেন – তাহলে তা ঠেকায় কে?

যেহেতু সালমানের বাবা জমিদার ছিল, তার ছিল অনেক জমি-জমা আর খেত-খামারী। একদিন একটা কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে সালমানকে বলল – “বাবা সালমান, আজ আমি একটা কাজে আটকা পড়ে গেছি। তুমি আমার অমুক জায়গার জমিটা একটু দেখে আস তো, সবাই ঠিক মত কাজ করছে কিনা।”

সালমান যেহেতু মন্দিরের বাইরে অন্য কিছু ভালমত চিনত না, সে জমি খুঁজতে যেয়ে পথ হারিয়ে ফেলল। হারাল তো হারালই, পথ হারিয়ে পৌঁছে গেল ছোট্ট এক চার্চে। চার্চটা কেমন যেন পুরনো, জীর্ণ-শীর্ণ, দেখলে গা শিউরে উঠে। তার মধ্যে সালমান এক পাদ্রীকে দেখল। লোকটা কি সুন্দর সুর করে কি জানি এক স্তুতি পাঠ করছে! কিশোর সালমান তাজ্জব বনে গেল – আচ্ছা অগ্নিপূজা ছাড়াও তাহলে অন্য ধর্ম আছে এই দুনিয়াতে? কি সুন্দর সুর করে লোকটা পড়ছে। কিন্তু, কি পড়ছে ও? ওর কথাগুলো যদি বুঝতে পারতাম!

সাহস করে কিশোর সালমান জিজ্ঞেস করে ফেলল – এই যে ভাই! তুমি কোন ধর্মের অনুসারী? তুমি এগুলো কি পড়ছ? আমাকে একটু বলবে?

লোকটা বলল – “দেখ আমি একজন পাদ্রী। আমি ঈসা(আ) এর প্রচারিত ধর্মের অনুসারী।“ এই পাদ্রী প্রকৃত খ্রিষ্টান ধর্মের উপর ছিল, সেইন্ট পল প্রচারিত পরিবর্তীত খ্রীষ্টান ধর্মের উপর নয়। পাদ্রীটি ধীরে ধীরে সালমানকে আল্লাহ, নবুওয়াত, কিতাব – এগুলোর ধারণা দিল। কথাগুলো শুনেই সালমানের অন্তর ধক করে বেজে উঠল। এত্ত সুন্দর ধর্ম পৃথিবীতে আছে আর আমি কিনা জানতামই না। এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে আগুনের পূজা করার কোন মানে হয়?

কিশোর সালমানের মধ্যে জানার আগ্রহের কোন শেষ নেই। সে পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করল – কোত্থেকে তুমি এই ধর্ম পেয়েছ? আমি এই ধর্ম সম্পর্কে আরো অনেক জানতে চাই।

পাদ্রী বলল – তুমি যদি সিরিয়ায় (শাম) যাও তাহলে এই ধর্মের বড় পাদ্রীর সন্ধান পাবে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত সালমান ঐ পাদ্রীর সাথে থাকল। এরপর বাড়ি ফিরে গেল। সালমানের বাবা তো এদিকে চিন্তায় অস্থির!

“কোথায় গিয়েছিলি বাবা? তোকে আমরা হন্যে হয়ে সব জায়গায় খুজেছি!”

সালমান তার বাবাকে সব খুলে বলল। বলল – “বাবা, অগ্নি-পূজা কখনো সত্য ধর্ম হতে পারে না। আমি সত্য ধর্মের সন্ধান পেয়েছি। চল আমরা আল্লাহর দেয়া এই ধর্মটাকে গ্রহন করি।”

কে শোনে কার কথা! সালমানের কথা শুনে তার বাবা রাগে অগ্নি-মূর্তি ধারণ করল। কি? অগ্নি-পূজা মিথ্যা? ভগবানকে নিয়ে এত বড় কথা? সালমানকে তার বাবা গৃহবন্দি করে ফেলল।

“আর কোথায় যাওয়া লাগবে না তোমার! যতদিন তোমার মাথার থেকে আল্লাহ, নবী, কিতাব – এগুলো বের না হচ্ছে, এই ঘরেই আটকা থাকবে তুমি!”

কিশোর সালমান খুব বুদ্ধিমান ছিল, সে হাল ছাড়ল না। আগুনের পূজা সে এই জীবনে আর কোনদিন করতে পারবে না। বুদ্ধি খাটিয়ে সে তার বাবার “জেলখানা” থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হল। পালিয়ে গিয়ে জুড়ে গেল এক সিরিয়াগামী কাফেলার সাথে। সিরিয়ায় যেয়ে সে মানুষকে জিজ্ঞেস করল – এই দেশের সবচেয়ে বড় চার্চ কোনটা? তারপর সবচেয়ে বড় চার্চের সবচেয়ে বড় পাদ্রীর কাছে যেয়ে বলল – আমি তোমার ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে চাই। বড় পাদ্রী তাকে গ্রহন করল। সালমান খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করল আর নিজের জীবন চার্চের কাজে নিবেদন করল।

কিন্তু কিছুদিন যেতেই সালমান লক্ষ্য করল – এই বড় পাদ্রী তো ভয়ানক ভন্ড। মানুষকে সোনা-রুপা দান করতে বলে, তারপর সেই দানের সোনা-রুপা সব নিজের প্রাইভেট রুমে নিয়ে রেখে দেয়। বড় পাদ্রীর দুই নম্বরী সালমান সব বুঝে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না, চুপ করে থাকে, বড় পাদ্রী বিরাট প্রভাবশালী লোক। দেখতে দেখতে অনেক বছর কেটে গেল, বড় পাদ্রীর বয়স আরো বাড়ল, সে মরেও গেল। বড় পাদ্রীর মৃত্যুর পর যখন সবাই তাকে নিয়ে খুব ভাল ভাল কথা বলছিল, সালমান তখন আর চুপ করে থাকতে পারল না। সবার সামনে বড় পাদ্রীর প্রাইভেট রুমের লুকানো সোনা-রুপা দেখিয়ে তার মুখোশ উন্মোচন করে দিল। সবাই সালমানকে খুব বাহবা দিল। তারপর চার্চ কমিটি এবার খুব দেখে শুনে অনেক আমলদার আর ভাল একজন পাদ্রী নিয়োগ করল।

এই পাদ্রী খুব ভাল লোক ছিল। সালমান তার থেকে ধর্ম, আদব-আখলাক অনেক কিছু শিখল। কিন্তু একদিন এরও মৃত্যুর সময় চলে আসল। সালমান তাকে জিজ্ঞেস করল – আপনি চলে গেলে আমি কার শিষ্যত্ব গ্রহণ করব? আপনার মত আরেকজন জ্ঞানী-গুনী পাদ্রীর সন্ধান আমাকে দিন।

পাদ্রী বলল – তুমি মসুল শহরের অমুক চার্চে যাও, ওখানে একজন পাদ্রী পাবে যার বিশ্বাস আমার বিশ্বাসের মত।

সালমান তা-ই করল। মসুলের এই পাদ্রীও খুব ভাল। তারও খুব আপন মানুষ হয়ে গেল সালমান। কিন্তু একদিন এই পাদ্রীরও মৃত্যুর দিন আসল। একেও সালমান জিজ্ঞেস করল – এখন আমি কার শিষ্য হব? পাদ্রী উত্তর দিল – তুমি নিসিবিস শহরে যাও। ওখানে আমার মত একজন পাদ্রী পাবে।

সালমান নিসিবিসেও গেল। (অনেকের মতে সে নিসিবিসের “সেইন্ট জেকব চার্চে” গিয়েছিল, এই চার্চটি এখনো আছে)। এই পাদ্রীও খুব ভাল মানুষ। এর সাথেও সালমান অনেক বছর কাটাল। কিন্তু, এই পাদ্রীরও একদিন মৃত্যুর সময় চলে আসল। একেও সালমান জিজ্ঞেস করল – এখন আমি কার শিষ্য হব? সে তাকে আম্মুরিয়ার এক পাদ্রীর কাছে যেতে বলল।

একইভাবে আম্মুরিয়ার পাদ্রীর সাথেও সালমানের অনেক বছর কাটল। তারপর এই পাদ্রীরও একদিন মৃত্যুর সময় চলে আসল। একেও সালমান জিজ্ঞেস করল – এখন আমি কার শিষ্য হব? কিন্তু শেষের এই পাদ্রী আর কোন পাদ্রীর সন্ধান দিতে পারল না। সে বলল  – দেখ, প্রকৃত খ্রিষ্টান ধর্ম বিকৃত হয়ে গেছে। আমি-তুমি যে খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করি, আমার জানামতে সেটা পালনকারী আর কোন পাদ্রী নেই। তবে শুন – তোমার আর কোন পাদ্রীর অনুসন্ধান করার দরকার নাই। ঈসা(আ) যে শেষ নবীর কথা বলে গিয়েছিলেন, তার আবির্ভাব হওয়ার সময় এসে গেছে! তার আসার প্রায় সব লক্ষনই প্রকাশ পেয়ে গেছে। তুমি বরং এখন সেই নবীর অনুসন্ধান কর।

আনন্দে চক চক করে উঠল সালমানের চোখ! “কোথায় পাব শেষ নবীকে আমি? কিভাবে পাব?”

পাদ্রী সালমানকে তিনটি লক্ষণের কথা বলল – “শেষ নবী হিজরত করে যাবেন খেজুর গাছের শহরে, সেখানকার মাটি কাদাযুক্ত হবে। দুই – তিনি দান গ্রহণ করবেন না, কিন্তু উপহার গ্রহণ করবেন। তিন – তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের চিহ্ন থাকবে (রাসূলুল্লাহ(সা) এর দুই কাঁধের মাঝখানে  ছোট্ট একটা উঁচু জায়গা ছিল যেখানে কিছু রঙ্গীন চুল ছিল, একে নবুয়তের সীল বা খাতম বলা হয়)।“

পরের লেখায় আমরা জানব এই দীর্ঘ অভিযাত্রা শেষে সালমান কি শেষ পর্যন্ত মহানবীর(সা) সন্ধান পেয়েছিল? পেলে কি খুব সহজেই পেয়েছিল, নাকি মহান আল্লাহ তাকে আরো কিছু পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছিলেন?

রেফারেন্স:

১) শেইখ ইয়াসির কাদি’র সীরাহ লেকচার – পর্ব ৪

২) শেইখ ইয়াসির কাদি’র সালমান আল ফারসির উপর লেকচার

৩) Men and Women around the Messenger, Sa’d Yusuf Abu ‘Aziz, Darussalam Publications

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ৩০ নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ২৫ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু ছোট লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।]

No comments:

Post a Comment

Translate