Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ৮ – মহানবী ﷺ আর বাচ্চা আনাস (রা)

 kids playing in desert2.jpg

সব সাহাবীর সাথেই আল্লাহর রাসূলের (সা) দারুন সম্পর্ক ছিল। কিন্তু, কোন কোন সাহাবীর সাথে এই সম্পর্ক ছিল বিশেষ কিছু, আবার কোন সাহাবীর ভূমিকাও রাসূলুল্লাহ(সা) এর জীবনে ছিল খুব বিশেষ কিছু। বড় বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সান্নিধ্যে আসা এক ব্যাপার, আর রাসূলুল্লাহ(সা) এর হাতের ছায়ায় বেড়ে ওঠা ভিন্ন আরেক ব্যাপার। এরকমভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ যে সাহাবীরা পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো আনাস(রা)।

আনাস(রা) এর বয়স যখন ৭-৮ এর মতো, তখন তার মা তাকে গিফট করেছিলেন রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে – যাতে সে রাসূলুল্লাহ(সা) এর ছোট-খাট বিভিন্ন কাজ করে দেয়, এটা ওটা এনে দেয়। রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছাকাছি থাকতে পারা তো বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার – সব মানুষের সেরা মানুষ তিনি, সব শিক্ষকের তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। এই আনাস(রা) বেঁচে ছিল অনেক বছর – মৃত্যুর সময় তার বয়স ১০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর সময় তার যে কত সন্তান আর নাতি-পুতি ছিল তার হিসেব করা মুশকিল, আর সম্পদও তার ছিল অঢেল। আনাস(সা) এর প্রতি আল্লাহর যে এত বারাকাহ – এটা কিন্তু কাকতালীয় নয়; এটা দু’আর ফল – আন্তরিক দু’আর ফল – রাসূলুল্লাহ(সা) এর দু’আর ফল।
একবার আনাস(রা) এর মা উম্মে সুলাইম রাসূল্ললাহ(সা) এর কাছে এসে বলল: “হে আল্লাহর রাসূল, আনাসকে দু’আ করে দিন।”
রাসূলুল্লাহ(সা) দু’আ করলেন – “হে আল্লাহ, আপনি তার সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বৃদ্ধি করে দিন, আর আপনি ওর জন্য যা রেখেছেন তাতে বারাকাহ দিয়ে দিন।”
(কাতাদা থেকে বর্ণিত – বুখারী ও তিরমিযি)
হাদিস থেকে শিক্ষা:
১) আমরা অন্য মুসলিমদেরকে, বিশেষ করে আমলদার ও ভালো মুসলিমদেরকে দু’আ করতে বলব। দু’আ সামান্য কিছু নয়, অনেক ভারী কিছু।
২) কেউ আমাদেরকে দু’আ করতে বললে, তার জন্য দু’আ করব, আন্তরিকতার জন্য করব, পরিপূর্ণভাবে দু’আ করব। লক্ষ্য করুন, রাসূলুল্লাহ(সা) এর দু’আ কতটা পরিপূর্ন ছিল। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় চাহিদা সম্পদ ও সন্তান – তাই তিনি এই দু’টির জন্য দু’আ করলেন, আর তিনি দু’আটি শেষ করলেন এমনভাবে যা ইহকালের ও পরকালের সব ভালো কিছুকেই ধারণ করে।
৩) আমরা আল্লাহর কাছে অধিক সম্পদ ও অধিক সন্তান চাইব। কিন্তু, এই আধিক্যতার উদ্দেশ্য হবে এগুলো ইসলামের জন্য ব্যয় করব, ভাল কাজের জন্য ব্যয় করব । বড়লোক হতে ইসলামে কোন নিষেধ নেই, বদলোক হতে নিষেধ আছে।

এই আনাস(রা) রাসূলুল্লাহ(সা) কে যতটা কাছের থেকে দেখেছেন, যতটা দীর্ঘ সময় ধরে কাছে থেকেছেন, খুব কম সাহাবীই সেরকম সুযোগ পেয়েছেন। আসুন সেই আনাস(রা) এর কাছ থেকে জানি দৈনন্দিন জীবনে কেমন ছিলেন আল্লাহর রাসূল(সা)।

১) আনাস(রা) বলেন: আমি ১০ বছর আল্লাহর রাসূলের সেবায় কাজ করেছি। আল্লাহর কসম, একবারের জন্য তিনি আমাকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলেন নাই, কখনও কঠোর কন্ঠে বলেন নাই – “তুমি কেন এটা করেছ?” অথবা “তুমি কেন ওটা করনি?” (বুখারী ৫৬৯১, মুসলিম ২৩০৯)

ব্যাপারটা বুঝুন: আনাস(রা) বলেননি – আমি ১০ বছর ধরে রাসূলুল্লাহ(সা) কে চিনতাম, বা বলেননি ১০ বছর তাঁর বাসায় গিয়েছি – তিনি বলেছেন আমি ১০ বছর তাঁর সেবা করেছি, অর্থাৎ কিনা ১০ বছর প্রতিনিয়ত তাঁর সাথে ছিলাম। আনাস(রা) কি এই ১০ বছরে কোন কাজে কোন ভুল করেন নাই? এটা হতে পারে না, অবশ্যই কিছু ভুল-ভাল করেছিলেন, ঠিকমত কোন-কোন কাজ করতে পারেন নাই। কিন্তু তারপরেও, রাসূলুল্লাহ(সা) একটিবারের জন্য উফ বলেন নাই, বিরক্ত প্রকাশ করেন নাই, রাগ দেখান তো দূরে থাক।

একজন মানুষ তার পরিবারের মানুষদের সাথে, কাছের মানুষদের সাথে কিভাবে আচরণ করে – তার মাধ্যমেই তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ পায়। কারণ বাইরের মানুষের সাথে সবাই ভদ্রভাবেই কথা বলে। সারাক্ষণ যাদের সাথে থাকা হয় তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাটা বেশী কঠিন। এই হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি – সর্বক্ষণ সেবক হিসেবে কাজ করা আনাস এর সাথে আল্লাহর রাসূলের (রা) ব্যবহার কেমন কোমল, ধৈর্য্যশীল ছিল। আমরা যদি আল্লাহর রাসূলের(সা) এই একটা মাত্র গুণকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারি, নিজের করে নিতে পারি, তাহলে মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক চিরদিনের জন্য বদলে যাবে।

২) আনাস(রা) যখন ছোট বালক ছিলেন তখনকার ঘটনা। একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ আনাসকে (রা) একটা কাজে বাইরে পাঠালেন। যাওয়ার পথে রাস্তার মধ্যে আনাস(রা) কিছু ছেলেকে দেখলেন তারা খেলা করছে। তাদেরকে দেখে কাজের কথা ভুলে ছোট্ট আনাসও (রা) খেলায় মজে গেলেন। খেলার ঘোরে কতক্ষণ কেটে গেছে আনাসেরও আর খেয়াল নাই, এমনি এক সময় আনাস(রা) হঠাৎ ফিল করলেন বিশাল সাইজের কোন এক খেলোয়াড় তাকে পেছন থেকে ঘাড় চেপে ধরেছে! আনাস(রা) মাথা ঘুরিয়ে দেখেন – একি! এ যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ এক মুখ হাসি নিয়ে উপস্থিত! হাসিমুখ নিয়েই রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন – “আনাস, আমি যা বলেছিলাম তা করেছ?” আনাস জবাব দিলেন – “আমি যাচ্ছি রাসূলুল্লাহ ﷺ  ।” (মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ ﷺ আনাস(রা)কে জরুরী কোন কাজেই কিন্তু পাঠিয়েছিলেন। অনেক সময় পার হওয়ার পরেও আনাস(রা) যখন ফিরলেন না, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্য রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি আনাস(রা) এর উপর তো রাগলেনই না, বরং প্র্যাক্টিকাল জোক করলেন! আবার অন্যদিকে, আনাসকে তার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতেও তিনি(সা) ভুললেন না। এভাবে, আমরা বাচ্চাদেরকে আদর করব, কিন্তু তাদের কে responsibility নিতেও শিখাব। শুধু আদর করে তাদেরকে ননীর পুতুল বানাব না। আমাদেরকে হতে হবে কোমলতা ও সঠিকতার ব্যালেন্স – ঠিক যেমন ছিলেন আমাদের রাসূল(সা)।

সূত্র:
১) শেইখ ইয়াসির কাযির সিরাহ লেকচার – পর্ব ২
[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ১২, ১৩ নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ৮ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ]

No comments:

Post a Comment

Translate