Wednesday, March 27, 2024

আয়েশার (রা) গুজব – যেভাবে অপবাদকে মোকাবিলা করতে হয়

 caravan (5)

দীর্ঘ ১ মাস ধরে জ্বরে ভুগেছেন আয়েশা(রা)। মুরাইসি থেকে ফেরার পর থেকেই গা গরম, সেই গা গরম ভয়াবহ জ্বরে রূপ নিল। এমন জ্বর যে বিছানা ছেড়ে উঠার জো নেই। ১ মাস পর একটু সুস্থ বোধ করছেন, তাই বাইরে বেরিয়েছেন তার ফুপু মিসতার মা’র সাথে। আয়েশার এদিকে জানাই নেই যে তাকে আর তরুণ সাহাবী সাফওয়ানকে ঘিরে এর মধ্যেই পুরো মদীনায় গুজব ছড়িয়েছে মুনাফিকেরা, গুজবের প্রধান ভূমিকায় ছিল প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। মুনাফিকদের গুজব-প্রচারণা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য ছিলো যে ৩ জন সাহাবা পর্যন্ত পরোক্ষভাবে এই গুজবে অংশ নিয়েছিলো, আর মিসতাহ ছিলো তাদের একজন।

১.

চলার পথে মিসতার মাকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। আয়েশা(রা)ও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। এ সময় অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে পথের মধ্যে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলেন মিসতার মা। আর তার মনের কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে আসলো। বলে উঠলেন – “চুলোয় যাক মিসতাহ!”। সাথে সাথে আয়েশা প্রতিবাদ জানালেন – “একি বলছেন ফুপু! যে ছেলে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে আপনি তাকে অভিশাপ দিচ্ছেন?”

“ভাগ্নী, তুমি কি জানো না মিসতা কি বলেছে?”

আয়েশা গুজবের কথা বিন্দুমাত্র জানতেন না। মিসতার মা’র মুখে ঘটনার বিস্তারিত শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল – ছি! মানুষের চিন্তা-ভাবনা এত খারাপ হতে পারে!

>> লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো – মিসতার মা যেই মাত্র মিসতাহ সম্বন্ধে খারাপ কিছু বলেছেন সেই মাত্র আয়েশা(রা) তার প্রতিবাদ জানিয়ে উলটো মিসতা’র প্রশংসা করেছেন। আমাদের সামনে কেউ যখন অন্য কারো গীবত করে তখন আমরা খুশীতে গদগদ হয়ে আরো দ্বিগুণ গীবত করি। আর এই হলেন আয়েশা(রা), এমন কি মায়ের মুখে পুত্রের গীবতকেও বরদাস্ত করলেন না, সাথে সাথে সেই পুত্রের গুণ মায়ের সামনে তুলে ধরলেন।

২.

কথার বিষ মারাত্মক জিনিস। এই বিষ রাসূলুল্লাহ(সা) কে পর্যন্ত বিমর্ষ করে দিল। আমরা যখন মানসিকভাবে দুর্বল বোধ করি, তখন কাছের মানুষের সাথে পরামর্শ করি, তাদের মুখে পজিটিভ কথা শুনলে আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। রাসূলুল্লাহ(সা) আলী(রা) কে ডাকলেন আয়েশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন বলে। আলী(রা) বললেন – আয়েশার কাজের মেয়ে বারিরা আয়েশা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে, কাজেই বারিরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন।

বারিরাকে ডাকা হলো। রাসূলুল্লাহ(সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন – “বারিরা, তুমি কি আয়েশার মধ্যে খারাপ কিছু কখনো দেখেছ?”

স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সা) জিজ্ঞেস করছেন তার মনীব সম্পর্কে! এক বিন্দু তো মিথ্যা বলা যাবে না – সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে শাস্তি চলে আসবে। আয়েশার মধ্যে কি খারাপ দেখেছে বারিরা? অনেক বড় কিছু? বারিরা বললো –“আটা মথতে যেয়ে আয়েশা অনেক সময় দুর্বল হয়ে ঘুমিয়েই পড়ে, আর ছাগল এসে তখন আটা খেয়ে ফেলে। এটাই আয়েশার সবচেয়ে খারাপ দিক”!

>> কি? এটা সবচেয়ে খারাপ দিক? আমাদের কাজের লোক তো দূরে থাক – স্বামী / স্ত্রী, বস, কলিগ, বন্ধুদের কে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে – বলো তো ওর মধ্যে কখনো খারাপ কিছু দেখেছ কিনা – আমাদের খারাপ কাজের লিস্ট মনে হয় সারাদিন বললেও শেষ করা যাবে না। আর এই হলেন আয়েশা(রা) – যার সম্পর্কে তার কাজের মেয়ে পর্যন্ত একটা খারাপ কিছু বলতে পারলো না, খারাপ বলতে যেয়ে বরং বুঝিয়ে দিল আয়েশা(রা) কতটা পরিশ্রমী ছিলেন!

৩.

এত অভিযোগের মুখে আয়েশা(রা) কি করেছিলেন? প্রতিবাদে মুখর হয়ে গিয়েছিলেন? চীৎকার-চেঁচামেচি করেছিলেন? মুনাফিকদের বদনাম শুরু করেছিলেন? মুনাফিকদের ঘাড় ধরে মদীনা থেকে বের করে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ(সা) এর উপর চাপ দিয়েছিলেন? না, এগুলোর কিছুই তিনি করেননি, কিছুই না, শুধুই ধৈর্য্য ধরে ছিলেন। মানুষের কাছে তিনি কোন বিচার চাননি, তিনি পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন আর সূরা ইউসুফের নিচের আয়াতটি উচ্চারণ করেছিলেন:

আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে এনেছিল ইয়াকুব বললেন, “নাবরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে কাজেই আমি ‘সাবরুন জামিল’ গ্রহণ করবো আর তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল””(সূরা ইউসুফ ১২:১৮)

>>‘সাবরুন জামিল’ বা ‘অপরূপ ধৈর্য্য’ এর অর্থ হলো যে ধৈর্য্যে মানুষের কাছে অভিযোগ না করে শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া হয়। আমাদের জীবনে আমাদের উপর অনেক অন্যায় হয়, অত্যাচার হয়, অনেকে আমাদের বদনাম করে – তখন সবসময় তার প্রতিবাদ জানাতে নেই, অনেক সময় প্রতিবাদ জানিয়ে লাভও হয় না। তার চাইতে ‘অপরূপ ধৈর্য্য’ ধারণ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করলে, একটা সময় আসে যখন সেই ক্ষত ঠিকই সেরে যায় – আমাদের সবার জীবনেই এরকম অভিজ্ঞতা আছে।

‘‘অপরূপ ধৈর্য্য’ এর কারণে আয়েশা (রা) আল্লাহর তরফ থেকে কি পুরষ্কার পেয়েছিলেন? আয়েশার সম্মানে আল্লাহ্‌ সূরা নূর নাজিল করেছিলেন যা আমরা আজ পর্যন্ত তেলাওয়াত করি। এই সূরার ১১ থেকে ২০ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ সরাসরি জানিয়ে দেন যে আয়েশা(রা) নিষ্পাপ। এর চাইতে বড় পুরষ্কার আর কি হতে পারে?

যারা মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছে তারা তো তোমাদেরই একটা দল এই অপবাদকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে কোরো নাবরং এতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর ওদের প্রত্যেকের জন্য নিজ নিজ পাপকাজের প্রতিফল আছে আর ওদের মধ্যে যে  ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেতার জন্য আছে মহাশাস্তি (সূরা নূর ২৪:১১)

 

(আয়েশা(রা) এর অপবাদের ঘটনাটি বুখারী ও মুসলিম দুই গ্রন্থেই আছে। একে ইফকের ঘটনা বলে।)

No comments:

Post a Comment

Translate