Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ৯ – কোমল – অবিচল মহানবী (ﷺ)

 ride camel in night

১) ইহুদীদের একটি দল একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে এসে বলল: আস-সা-সামু আলাইকুম। অর্থাৎ, তোমার মরণ হোক। আল্লাহর রাসূল শান্তভাবে জবাব দিলেন – ওয়া আলাইকুম। অর্থাৎ, তোমাদেরও তাই হোক। অন্যদিকে আইশা(রা) ইহুদীদের মুখে বাজে কথা শুনে ভয়ানক ক্ষেপে গেলেন। পর্দার পেছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন – আস-সি-মু আলাইকুম (তোমাদেরও মরণ হোক)। উত্তেজিত হয়ে তাদের অভিশাপ দেয়া শুরু করলেন, বললেন – আল্লাহ তোমাদের ধ্বংস করুক। এর জবাবে – রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আইশার (রা) পক্ষ না নিয়ে বরং তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, বোঝালেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন – শান্ত হও আইশা। যা কিছু কোমল, তাই সুন্দর। কোন কিছুতে নম্রতা থাকলে সেটা সুন্দর হয়, আর কোন কিছুতে কর্কশতা থাকলে সেটা কুৎসিত হয়।

এখানে শেখার ব্যাপার অনেকগুলো –
এক) বাজে ব্যবহার/গ্রিটীং এর জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তেজিত হয়ে পড়েননি। যে ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা যেরকম, তার কথাবার্তাও সেরকম – এটাকে মেনে নেয়াই ভাল।

দুই) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চুপও থাকেননি। তিনি শান্তভাবে জবাব দিয়েছেন। কেউ আমাদের গ্রীট করলে – সেটা ভালই হোক, বা মন্দই হোক – আমরা চুপ থাকব না, জবাবে তাকে সমান কিছু বা তার থেকে ভালো কিছু বলব (আল কুরআন ৪:৮৬)।

তিন) কেউ যখন আমাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে, তখন সে ভুল বললেও আমরা সাধারণত চুপ থাকি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিন্তু তা করেননি। যখন তিনি (ﷺ) দেখলেন আইশা(রা) যেভাবে কথা বলছেন তা ঠিক নয়, সাথে সাথে তিনি (ﷺ) তাকে সংশোধন করে দিলেন।

২) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন একজন লিডার যিনি কোমল ছিলেন, আবার সাহসী এবং অবিচলও ছিলেন । তিনি সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। আলী(রা) বদরের যুদ্ধের কথা মনে করে বলেন – যখন যুদ্ধ খুব তীব্র হয়ে যেত, আমরা আল্লাহর রাসূলের আশে-পাশে আশ্রয় নিতাম।

আমরা যখন কোন সমস্যায় পড়ি, তখন যদি আমরা আমাদের আত্মীয়দের, বন্ধুদের, বিশেষ করে সিনিয়রদের নার্ভাস দেখি, তখন কিন্তু আমরাও নার্ভাস হয়ে পড়ি। অন্যদিকে, আমরা যদি তাদেরকে ধীর-স্থির, অবিচল দেখি, তখন আমরাও কিন্তু সাহস পাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিপদের মুখে অবিচল থাকতেন, নার্ভাস হয়ে যেতেন না – তাঁর (ﷺ) মুখের দিকে তাকালেও সাহাবারা সাহস পেত।
৩) একরাতে মদীনায় খুব জোরে কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছিল। গভীর রাতে এরকম শব্দ শুনে সবাই ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে পড়েছিল। সবাই যখন বাইরে বের হয়ে দেখতে যাচ্ছিল শব্দটা কোত্থেকে আসছে – তখন সবাই দেখল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেদিক থেকে শব্দ আসছিল সেখান থেকেই ফিরছেন – জিন (saddle) বিহীন এক ঘোড়ায় চড়ে, গলায় তরবারী ঝুলিয়ে। সবাইকে শান্ত করতে তিনি (ﷺ) বললেন – ভয়ের কিছু নেই, ভয়ের কিছু নেই, আমি দ্রুত এটা (ঘোড়া) পেয়ে গিয়েছিলাম।

কয়েকটা ব্যাপার এখানে লক্ষ্যনীয়:
এক) বাকী সাহাবারা যখন ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল, কি করতে হবে তা বুঝতে পারছিলেন না, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন কারো জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই বের হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ঘরেও কিন্তু অন্য অনেকের মত স্ত্রী / পরিবার ছিল।

দুই) বাকী সাহাবারা ঘোড়ায় জিন পড়িয়ে বের হওয়ার মাত্র প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিন ছাড়া শুধু তরবারী নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে একই সাথে সাহসীকতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার পরিচয় দিয়েছেন।

তিন) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথার শেষ অংশটা মনে দারুন দাগ কাটার মত। তিনি বললেন – তিনি দ্রুত ঘোড়া পেয়ে গিয়েছিলেন। লক্ষ্য করুন, এরকম পরিস্থিতিতে যদি আমরা সবার আগে যেয়ে পৌঁছতাম তাহলে হয়ত বলতাম – কি তোমরা তো কেউ আসলে না? বা, এত ধীরে ধীরে প্রস্তুত হলে চলবে? অথবা অন্তত – একটা ভাব দেখাতাম যে দেখ আমি সবার চাইতে সবচেয়ে সাহসী। কিন্তু,আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেরকম কিছুতো করেনইনি বরং এমন কিছু বলেছেন যাতে সাহাবাদের কেউ নিজের মন্থর গতির জন্য নিজেকে ছোট মনে না করে। সবচেয়ে আগে পৌঁছানোর জন্য তিনি নিজে কোন বাহবা নিলেন না – ক্রেডিট দিলেন দ্রুত গতির ঘোড়াকে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন এক মানুষ ছিলেন, এমন এক লিডার ছিলেন যিনি সবাইকে তাঁর কোমলতা আর অবিচলতা দিয়ে আগলে রাখতেন।

রেফারেন্স: 
১) শেইখ ইয়াসির কাযির সিরাহ লেকচার – পর্ব ২
২) ইহুদীদের হাদিসের রেফারেন্স – সাহিহ মুসলিম – http://www.sahihmuslim.com/sps/smm/sahihmuslim.cfm?scn=dspchaptersfull&BookID=26&ChapterID=911
৩) অন্য ধর্মের মানুষের গ্রিটিং এর জবাবে কি বলব – https://youtu.be/-HfNZOeyoUw?t=178
৪) আলী(রা) এর বদরের যুদ্ধের হাদিস – https://islam.stackexchange.com/questions/18582/reference-for-a-hadith-about-the-courage-and-bravery-of-the-prophet-muhammad-pb
৫) আনাস ইবনে মালিক(রা) এর ঘোড়ার হাদিস – সাহিহ বুখারী – http://islam.ru/en/content/story/courage-prophet-muhammad-peace-be-upon-him

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ১৪ নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ৯ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ]

No comments:

Post a Comment

Translate